২৫শে মার্চ – ২৫

২৫

ওয়ারি, ঢাকা
বর্তমান সময়, সন্ধে প্ৰায় ৬টা

“তুমি নিশ্চিত এই বাড়িটাই?” অরণি হাসানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দুজনেই দেয়ালের ওপাশে অন্ধকারের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট বাড়িটার দিকে তাকাল। ঢাকা শহরে এখনও এরকম বাড়ি আছে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।

“চিয়ার আপ, হাসান,” হাসানকে একদম মনমরা লাগছে দেখে অরণি বলল। “দেখাই যাক না কী হয়। এমনিতেই তো আমরা কম বিপদের মধ্যে নেই। নতুন করে আর কী বিপদ হবে বলো।”

“অরণি, তুমি আহমদ বশিরকে চেনো না। এই লোক একটা সাপের চেয়েও ভয়ংকর। অন্তত আমার তাই মনে হয়। যদিও অনেকেই আমার সাথে একমত পোষণ করবে না। কারণ সে নাকি অনেকের জন্য জানও দিয়ে দেয়। তবে আমার মোটেও পছন্দ না একে। আল্লা জানে আবার কোন ঝামেলায় ফেলবে!”

“কিন্তু কী আর করার আছে বলো। আমরা এখন ফাটা বাঁশে আটকা। সামনে-পেছনে যেদিকেই যাই দুদিকেই বিপদ। তার মানে সামনে এগোনোই ভালো। হয়তোবা মুক্তির একটা পথ আমরা পেয়ে যেতেও পারি। আর যেহেতু মা’র রেখে যাওয়া নির্দেশনা আমাদেরকে এখানেই নির্দেশ করে তার মানে এখানে আমাদের আসতেই হবে। আমার ধারণা এখন পর্যন্ত আমরা সঠিকভাবেই এগিয়েছি। যদিও মা’র খুনের রহস্য এবং সেটার সাথে তোমার সংযুক্তির সাথে এই অদ্ভুত ধাঁধার তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি। বরং আমরা আরও গভীরে জড়িয়ে যাচ্ছি। তারপরও আমার কেন জানি মনে হয় এর শেষ প্রান্তে একটা সমাধান আছে। মা নিশ্চয়ই এমনি এমনি এতসবকিছু রেখে যাননি।”

 “হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। চলো যেতে যখন হবে তাহলে দ্রুত যাওয়াই ভালো। তবে মনে রেখো আমি যেসব বিষয় বলেছি সেগুলো ভালোমতো খেয়াল রেখো।”

“হ্যাঁ ঠিক আছে থাকবে,” অরণির মনে পড়ে গেল একটু আগে বুড়িগঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন।

.

তাঁতি বাজার মোড় থেকে রওনা দিয়ে ওরা চলে যায় বুড়িগঙ্গার পাড়ে। একটু দূর এগিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে হাসান একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে দুই বোতল পানি, সামান্য কিছু খাবার আর জরুরি জিনিস কিনে নিয়ে আসে। চাচা বুড়িগঙ্গার পাড়ে মোটামুটি নির্জন একটা জায়গায় গাড়িটা দাঁড় করানোর পর ওরা গাড়ি থেকে নেমে পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।

সূর্য পশ্চিশ আকাশে হেলে পড়েছে। দিগন্তে চমৎকার লাল আভা ছড়াচ্ছে অস্তমান সূর্য। বুড়িগঙ্গার এদিকটা বেশ নির্জন। এদিকে-ওদিকে দুচারটা জুটি ছাড়া আর তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ওরা নাশতা করে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। হাসান একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল।

অরণি ওর পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, “এখন বলো, কে এই লোক খন্দকার আহমদ বশির। আর তোমার পেছনেই বা সে লেগেছিল কেন?”

“খন্দকার আহমেদ বশির আমাদের দেশের বেশ স্বনামধন্য একজন ব্যক্তিত্বই বলা চলে। অন্তত একটা মহল বেশ ভালোভাবেই তার নাম জানে। অত্যন্ত ধনী মানুষ। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোর একটির ছেলে সে। জীবনের প্রথম ধাপে ছিল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। পড়াশুনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করে। ওখান থেকেই স্কলারশিপ নিয়ে ডক্টরেট করার জন্য চলে যায় বিদেশ। দেশের বাইরে থেকে ফিরে এসে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর সে এই চাকরি ছেড়ে দেয়। সেটা আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে। এরপর থেকে পড়াশুনা আর নানা ধরনের সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজকর্ম নিয়েই আছে সে। আর সেইসাথে বছরের বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায় এবং ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব এসব নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। সেই সাথে অনেক এতিমখানা, অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রমের ধারক এবং বাহক। এছাড়াও প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে। এককথায় সে একজন স্কলার এবং সোশাল হিরো। এটা হলো তার বাইরের ইমেজ।”

“আর বাকিটা?”

“এই লোকের আরেকটা দিক আছে। আরেকটা পরিচয় আছে। সে অনেকটা দ্বৈত সত্তার মতো। ড. জেকির অ্যান্ড মি. হাইডের পুরানো কাহিনি। তার বাইরের সামাজিক দিকটা যতটা উজ্জ্বল এবং অন্য দিকটা ঠিক ততটাই অন্ধকার। ড. খন্দকার আহমদ বশির একজন অ্যান্টিক চোরাচালানি এবং বলা হয়ে থাকে এশিয়ার সেরা অ্যান্টিক চোরাচালানিদের একজন। এই অ্যান্টিকের জগতে সে দারুণ শিক্ষিত এবং পণ্ডিত লোক। তার এই মেধা এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে সে কখনো চোরাচালান করে এবং কখনো কখনো মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এসব দেশের চোরাচালানিদের ফ্রি-রুট ব্যবহারের ব্যবস্থাপক হিসেব কাজ করে দেয়। তবে তার এই পরিচয়টা খুব সীমিত লোকজন ছাড়া তেমন কেউ জানে না।”

“ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। তার সাথে তোমার সমস্যাটা কোথায়?”

“আমি তখন দৈনিক সময়ের আলোতে কাজ করতাম। জার্নালিজম থেকে পাশ করেই আগের কাজের অভিজ্ঞতার কারণে দেশের প্রথম সারির পত্রিকাতে কাজ পেয়ে যাই। তখন আমি এই লোকের ব্যাপারে জানতে পারি। আমার এক সোর্স তার ব্যাপারে বিশদ জানায় আমাকে। আমি আরও খেটে ভেতরের অনেক খবর বের করে আনি। এর ওপর একটা রিপোর্ট তৈরি করে অফিসে জমা দেওয়ার পরদিনই আমাকে এডিটর সাহেব ডেকে পাঠান। এখানে আমি একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলি। আমি জানতাম না যে, এডিটর সাহেব নিজে এই লোকের বন্ধু মানুষ, এটা আমি পরে জানতে পারি। তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে ইচ্ছেমতো ঝাড়েন। আমিও তার ঝাড়ি খেয়ে খেপে যাই। আমি নিয়ত করি এই রিপোর্ট আমি ছাপবোই। একটা অনলাইন পত্রিকাতে ছদ্মনামে রিপোর্টটা ছেপে দেই। ব্যাস আমার ওপর নরক নেমে আসে। কিছুক্ষণের ভেতরেই অনলাইনে এর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। এরপর প্রথমেই নিউজটাকে সরিয়ে ফেলা হয়। ওইদিনই আমাকে বের করে দেওয়া হয় ‘সময়ের আলো’ থেকে। পুলিশের তরফ থেকেও আমাকে হেনস্তা করা হয়। এরপর শেষ ধাপে আমি খবর পাই এই লোক নাকি আমার মাথার ওপর বাউন্টি ঘোষণা করেছে।”

“এরপর?”

“এরপর আর কি আমি পালাই। সোজা বাংলায় বলতে গেলে লেজ তুলে পালাই। কারণ ততদিনে আমি বুঝে গেছি আমার রক্ত যত গরম এই লোকের রক্ত তত ঠান্ডা। আর দুনিয়া এভাবেই চলে। ব্যাস দীর্ঘদিন এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করি। অনেকটা সময় বান্দরবন আর রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকায় কাটাই। ওখানে সময়টা অবশ্য ভালোই কেটেছে। একটা লোকাল ট্রাইবের সাথে ছিলাম। ওদের স্কুলে পড়িয়েছি। মজাই লেগেছে। এরপর ঢাকা ফিরে আসি পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর। কিন্তু ফিরে এসে আমি বুঝতে পারি বিপদ কেটে গেছে ঠিকই কিন্তু আমার ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে গেছে। কোনো পত্রিকা অফিস কিংবা চ্যানেল আমাকে সহজে কাজে নেবে না। সো আর কি এরপর থেকে ফ্রিল্যান্স কাজ করি। আমার পরিবারের লোকজন আমাকে পছন্দ না করলেও উত্তরসূরি হিসেবে ফ্যামিলি থেকে বেশ ভালো অ্যাসেট পেয়েছি আমি। একারণে টাকার চিন্তা নেই। ঘুরিফিরি খাইদাই আর ঘুমাই। কাজ করতে ইচ্ছে হলে করি, না হলে আড্ডা মারি, সিনেমা দেখি, বই পড়ি। এভাবেই চলছে।”

“তুমি কি শিওর এই লোকটার অন্ধকার দিকটা আসলেই এতটা অন্ধকার?”

“অবশ্যই অরণি। কিন্তু রিপোর্ট করার সময় আমি একটা ভুল করেছিলাম। আমার সোর্সগুলোকে যাচাই করিনি আমি। তাই নিজের ভেতরে একটা সন্দেহ আজও রয়ে গেছে। তবে এই লোক ভয়ংকর। আমার রিপোর্ট যাই হোক এরপর সে যা খেল দেখাল, ওটা দেখলেই বোঝা যায়।”

“তোমার কী ধারণা এই লোকের সন্ধান মা পেল কীভাবে?”

“আমি জানি না। হতে পারে এই লোক তো বেশ বিখ্যাত। বিশেষ করে আমাদের দেশের ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব এসব ব্যাপারে সে আসলেই একজন স্কলার লোক।”

“আচ্ছা তোমার কি মনে হয়, এরকমটা হতে পারে হয়তো এই লোকই আসলে এসব ঘটাচ্ছে। সে-ই আসলে মা-কে খুন করে তোমাকে ফাঁসিয়েছে? তারপর এসব নাটক করছে?” অরণি জানতে চাইল।

“হতে পারে কিন্তু সম্ভবনা কম। আমাকে ফাঁসানোর জন্য চাইলে সে আরও অনেক কিছুই করতে পারত কিন্তু তার জন্য একজন নির্দোষ মানুষকে খুন করে আমাকে ফাঁসাবে বলে মনে হয় না।”

“এখন কী করতে চাও?” অরণির প্রশ্নটা শুনে হাসান ওর দিকে ফিরে তাকাল। তারও চোখে-মুখে দ্বিধা। হাসান আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে উলটো ওকে প্রশ্ন করল, “তুমি কী করতে বলো? সে হলো এমন একজন মানুষ যার সাথে আমি জীবনেও দেখা করতে চাই না। তো তুমি যা বলো আমি সেটাই করব।”

“কঠিন সিদ্ধান্ত। তবু আমাদেরকে তার সাথে দেখা করতেই হবে। আর কোনো উপায় নেই,” বলে অরণি সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।

“ঠিক আছে,” বলে হাসান সিগারেটের গোড়াটা ফেলে দিল। “চলো। চাচা ওয়ারি, আমরা এখন ওয়ারি যাব।”

এরপর ওরা চলে আসে ওয়ারিতে। হাসান বাড়িটা চেনে। কারণ রিপোর্ট করার সময় সে এখানে এসেছিল।

.

“চলো,” বলে হাসান গাড়ি থেকে নেমে এলো। ওর পিছু পিছু অরণিও নামল। “চাচা আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন। যদি কোনো জরুরি কিছু হয় তাহলে আমি আপনাকে মোবাইলে কল দিয়ে জানাব,” হাসান গাড়ির জানালা দিয়ে চাচাকে বলল। চাচা সায় জানাল মাথা নেড়ে।

ওরা দুজনে বাড়ির বিশাল গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। কোনো গার্ড বা লোক নেই।

“কই কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না,” অরণি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল। হাসান গেটের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।

“কাকে চাচ্ছেন?” হঠাৎ পরিষ্কার একটা কণ্ঠ বলে উঠল। দুজনেই চমকে গেল গলাটা শুনে।

“কী ব্যাপার? কে কথা বলল?” হাসান বলে উঠল। অরণির মতো সেও চমকে গেছে। কারণ কথা শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

“কী জানি? কাউকে তো দেখছি না,” অরণিও বোঝার চেষ্টা করছে কে কথা বলল।

“কাকে চাচ্ছেন?” আবারও কণ্ঠটা বলে উঠল।

“ও বুঝেছি। স্পিকার। গেটের সাথেই কোথাও স্পিকার লাগানো আছে। অনেকটা ইন্টারকমের মতো,” অরণিকে বলে সে কণ্ঠটার উদ্দেশ্যে বলল, “আমরা ড. আহমদ বশিরের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম।”

“আপনাদের কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?” কণ্ঠটা জানতে চাইল। হাসান অরণির দিকে একবার তাকাল। “নাহ, আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই কিন্তু ব্যাপারটা খুবই জরুরি।”

“সরি স্যার, তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারও সাথে দেখা করেন না। “ “হ্যালো, শুনুন,” অরণি বলে উঠল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া নেই। “কী ব্যাপার? এই ব্যাটা তো কথাই শুনল না।”

“তাই তো দেখা যাচ্ছে। এই লোকের সাথে দেখা করতে গেলে ফ্যাসাদে পড়তে হবে এটা তো জানা কথা,” হাসান দুঃখের হাসি হাসল।

“আরে ধুৎ, বাদ দাও তো। এখন বলো দেখা কীভাবে করব?”

“আমি জানি না,” হাসান দুই হাত নাড়ল।

হঠাৎ স্পিকারের কণ্ঠটা আবারও শোনা গেল। এবার অন্য একটা কণ্ঠ। “স্যার, আপনার নামটা?”

“আমার নাম হাসান। হাসান শাহরিয়ার রিয়ন,” হাসান জবাব দিল। “তার সাথে দেখা করাটা….”

কণ্ঠটা ওকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল, “আর আপনার সাথে যে ম্যাডাম, তার নামটা?”

দুজনেই আবার চমকে গেল। হাসান গেটের চারপাশে তাকাল। শুধু স্পিকার নয়, নিশ্চয়ই ক্যামেরাও লাগানো আছে।

“তাসমিন অরণি।”

“ঠিক আছে স্যার, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমি গেটটা খুলে দিচ্ছি। বশির স্যার আপনাদের সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন। আপনারা ভেতরে ঢুকে ড্রাইভওয়ে ধরে হেঁটে চলে আসুন। আমি দরজার কাছে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করব।

একটু পরেই গেটটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। হাসান অরণির দিকে তাকিয়ে বলল, “আফটার ইউ।”

“আমি আছি টেনশনে আর তুমি আছ তোমার ফাইজলামি নিয়ে।”

ওরা দুজনেই গেট দিয়ে ঢুকে ড্রাইভওয়ে ধরে হেঁটে চলে এলো মূল দরজার কাছে। ওখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার দিক তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ে তার বসে যাওয়া নাক। নিশ্চয়ই একসময় মারামারি করতে গিয়ে নাকটা ভেঙে গেছে। অত্যন্ত চমৎকার এবং পরিপাটি পোশাক পরা তালগাছের মতো লম্বা আর শুকনো লোকটা। প্রথম দর্শনের সাথে সাথেই লোকটার ব্যাপারে হাসানের মনে হলো এই লোকটা একটা ভদ্রবেশী গুন্ডা। এই লোকটাকে সে এর আগে দেখেনি কিন্তু এর নাম শুনেছে। হায়দার আলি। এই ব্যাটাই ওর পেছনে গুন্ডা লাগিয়েছিল।

“ওয়েলকাম স্যার,” বলে লোকটা হাসানের সাথে হাত মেলাল। হাসান চমকে উঠল লোকটার সাথে হাত মেলাতে গিয়ে। অরেকটু হলে বদমাইশটা ওর হাত ভেঙে দিয়েছিল। এরকম শুকনো একটা লোকের হাতে এত অস্বাভাবিক শক্তি সে এর আগে কখনো দেখেনি। হাসানের হাত মুচড়ে দিয়ে সে অরণির দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা নাড়ল।

লোকটা ওদেরকে ভেতরের দিকে দেখিয়ে ইশারা করে বলল, “স্যার আপনারা এদিক দিয়ে সোজা চলে যাবেন। শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি আছে ওটা দিয়ে ওপরে উঠে গেলে ডান দিকে একটা ওপেন স্টাডি। বশির স্যার ওখানেই আছেন। তবে স্যার একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার। আপনাকে আমার সার্চ করে দেখতে হবে।”

“কেন? আমি কি ডাকাত নাকি?” হাসানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।

“ন্যা স্যার, ব্যাপারটা ওরকম না, আমার ওপর এই রকম নির্দেশই আছে। আমার কিছু করার নেই,” লোকটার বলার ভঙ্গিটা অত্যন্ত মার্জিত কিন্তু ভয়ংকর।

হাসান রেগে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অরণি ওর হাত ধরে মানা করল, “ঠিক আছে। করুন। আপনি কি আমাকেও সার্চ করবেন?”

“না ম্যাডাম, এরকম কোনো অর্ডার আমার ওপর নেই,” লোকটা হাসানকে সার্চ করতে করতে তার পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে নিল। “ধন্যবাদ স্যার। এটা আমার কাছেই থাক। আপনি যাওয়ার সময় আমি এটা ফেরত দিয়ে দেব,” বলে সে পিস্তলটা তার প্যান্টের পকেটে রেখে দিল।

হাসান অগ্নিদৃষ্টিতে লোকটাকে দেখছে। অরণি রওনা দিচ্ছে হাসান হঠাৎ মুখভঙ্গি একদম পরিবর্তন করে লোকটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “আরে তুমি হায়দার মামা না? ভালো আছ?”

লোকটা চরম অপ্রস্তুত হয়ে একবার অরণিকে দেখল আরেকবার হাসানকে। “সরি স্যার, আমাকে বলছেন?”

“আরে মিয়াঁ জিগাইলাম, বালা আছো নি?”

লোকটা আরেকবার ওদেরকে দেখল, “জি স্যার, ভালো।”

হাসান ওর দিকে তাকিয়ে আরেকবার দাঁত বের করে সামনের দিকে রওনা দিল। হাঁটতে হাঁটতে অরণি ওর দিকে তাকিয়ে একবার মাথা নেড়ে মনে মনে বলল, বয়েজ আর অলওয়েজ বয়েজ অ্যান্ড হাসান ইজ অলওয়েজ হাসান।

.

এসপি আতিকুর রহমান নিজের ডেস্কে বসে একের পর এক কেস ফাইল পড়ছে। আর ভীষণ উত্তেজিত বোধ করছে সে। বেয়ারাকে ডেকে চা আনতে বলল। একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে লাগল সে। সাধারণত সিগারেট সবসময় খুব বেশি না খেলেও এই মুহূর্তে প্রচণ্ড চা এবং সিগারেটের তৃষ্ণা বোধ করছে। এই কেসের ফাইলগুলো তাকে বেশ ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। ঘটনার শুরু একটা খুন দিয়ে। তারপর একের পর এক বহু কিছু ঘটে গেছে। প্ৰথমে যে মহিলা খুন হয়েছে তাকে খুনের সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় তারই এক প্ৰাক্তন স্টুডেন্টকে। ওই ছেলেকে জজ কোর্টের সামনে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় ওই মহিলারই মেয়ে। সেখান থেকেই তার এই কেসের সাথে ইনভলভমেন্ট। এরপর সে সবকিছু জানে। কিন্তু যেটা সে বুঝতে পারছে না সেটা হলো, এই ছেলেটা যদি এই মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড হয়ে থাকে এবং তারা যদি পরিকল্পনা করে মহিলাকে মেরে থাকে তাহলে এত কাণ্ড করছে কেন। আর এই ঘটনার সাথে সে পরের ঘটনাগুলো মেলাতে পারছে না।

চা আর সিগারেট শেষ করে সে আবার কেস ফাইল নিয়ে বসল। এবার সে শুরু করল খুন হওয়া মহিলার অটপসি রিপোর্ট এবং ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে। মহিলার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে গিয়ে একটা মারাত্মক ব্যাপার তার চোখে পড়ল। মহিলার এক কলিগ জানিয়েছে এই মহিলার মেয়ে পাঁচ বছর আগে মায়ের সাথে ঝগড়া করে আমেরিকা চলে গিয়েছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল মহিলার হাজব্যান্ড অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার ঠিক পরপরই। এখানে কি কোনো ব্যাপার আছে? সে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল।

সে আবারও ফোনটা তুলে নিয়ে একটা বিশেষ নম্বরে ডায়াল করল। এই নম্বরে ফোন করে সে এই কেসের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটা ব্যক্তির ফাইল থেকে শুরু করে যাদের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে, যারা যারা এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে সবার ব্যাপারে ডিটেইল খোঁজখবর নেওয়ার নির্দেশ দিল। বিশেষভাবে বলে দিল খুন হওয়া মহিলা মারা যাওয়ার ঠিক আগে কার কার সাথে দেখা করেছিল সে ব্যাপারে যতটুকু জানা সম্ভব তা খুঁজে বের করতে বলল।

কথা বলা শেষ করে সে আরেকটা সিগারেট ধরাল। এই কেসটা তাকে দারুণ ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। নিজের ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বের সে খুব আগ্রহ বোধ করছে এর ব্যাপারে। তাকে এই কেসের সমাধান খুঁজে বার করতে হবে।

.

তার করোলা গাড়িটা ওয়ারিতে প্রবেশ করল। তাকে একটা নির্দিষ্ট বাড়ি খুঁজে বার করতে হবে। মোবাইলের ডিসপ্লেতে সে ঠিকানাটা আরেকবার দেখে নিল কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে সে ঠিকানাটা খুঁজে না পেয়ে একটা দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো। তাকে ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করতে হবে। সে দোকানের দিকে এগিয়ে গেল।

.

হাসান আর অরণি প্যাচানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় স্টাডিতে চলে এলো। বাড়ির এই অংশটা অনেকটাই ডুপ্লেক্সের মতো বানানো। ইন্টেরিওরও অত্যন্ত চমৎকার। ওপেন একটা স্টাডি, একপাশে খোলা বারান্দা, আরেকপাশে দেয়ালজোড়া বইয়ের তাক। প্রতিটা তাক আবার বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটা ভাগে কাঠের প্যানেলিঙের ওপর একজন করে বিশেষ ব্যক্তির আবক্ষ মূর্তি রাখা। অরণি অনুমান করল, প্রতিটি ভাগে আলাদা আলাদা বিষয়ের বই এবং বইয়ের বিষয়বস্তু অনুযায়ী সেই ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশেষ ব্যক্তিটিরর মূর্তি সেই তাকের ওপর রাখা। যেমন একটা ভাগে শেকসপিয়রের মূর্তি দেখে ও অনুমান করল ওখানে ইংরেজি সাহিত্যের অথবা নাটকের বই রাখা। আবার আরেকপাশে প্লেটোর মূর্তি, হতে পারে ওখানে ফিলোসফির বই আছে। পুরো স্টাডি জুড়ে এরকম অনেকগুলো শেলফ্। তবে সব ছাড়িয়ে দৃষ্টি পড়ে ঘরের মাঝখানে বিশাল পড়ার ডেস্কটার ওপরে। ডেস্কটার ওপর অসংখ্য বইপত্র আর ফাইল রাখা। টেবিলটার অন্যপাশে একটা বিরাট মনিটরের ডেস্ক্রটপ কম্পিউটার, পেছন দিকে একটা টাইপরাইটার আর টেবিলের ওপর একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর অ্যাপলের আই-প্যাড রাখা।

ওদের দিকে পাশ ফিরে টি-শার্ট পরা একজন মানুষ টাইপরাইটারে টাইপ করছে। তার টাইপিঙের গতি দেখলে যেকোনো প্রফেশনাল টাইপিস্ট অথবা কম্পোজার লজ্জা পেয়ে যাবে। পেছন থেকে মানুষটার কাঁধ আর ঝুঁটি করে রাখা চুল দেখা যাচ্ছে এবং বোঝা যাচ্ছে হালকা-পাতলা একজন মানুষ।

ওরা ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা একমনে টাইপ করেই চলেছে। ওরা যে এসেছে সেদিকে কোনো নজর নেই।

হাসান ওদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য মৃদু কাশি দিল।

“আপনারা এসেছেন আমি জানি, সেটা জানানোর জন্য কাশাকাশির কোনো প্রয়োজন নেই। বি সিটেড প্লিজ,” অত্যন্ত পরিষ্কার ঝরঝরে গলায় মানুষটা বলল। সে এখনও ওদের দিকে পেছন ফিরে টাইপ করেই চলেছে।

আরও কয়েকমিনিট পর লোকটা টাইপ থামিয়ে একতাড়া কাগজ একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে খামের ভেতরে ঢুকিয়ে ওদের দিকে ফিরে বসল। অত্যন্ত বয়স্ক একজন মানুষ। সরু লম্বা একটা মুখ এবং চোখ দুটো অদ্ভুত নীল। বাঙালি বা ইন্ডিয়ানদের ভেতরে সাধারণত এত নীল চোখ দেখা যায় না। অরণি বেশ অবাক হয়ে লোকটার চোখজোড়া দেখছে।

“আমার মা ব্রিটিশ ছিলেন,” অরণি লোকটার কথা শুনে পুরোপুরি চমকে উঠল। এই ব্যাটা বুঝল কীভাবে ও কী ভাবছিল।

“আমাকে একটা কথা বলুন তো দেখি,” লোকটা হাসানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি টাইপরাইটারে কেন টাইপ করছিলাম? আই মিন এখানে একটা ডেক্সটপ আছে, আমার ড্রয়ারে একটা ল্যাপটপ আছে দেন হোয়াই টাইপরাইটার?”

“সরি স্যার, আমি জানি না,” হাসান জবাব দিল।

“বিকজ, কখনো কখনো রিলায়েবিলিটি ইস্যুতে পুরানো জিনিসের কাছে ফিরে যেত হয়। ইউ কান্ট হ্যাক আ টাইপরাইটার। এই কারণেই সিআইএ সহ বড় বড় ইন্টেলিজেন্স এখনও ক্ষেত্রবিশেষে টাইপরাইটার ব্যবহার করে। বাট ইভেন আফটার, দিস ইজ পাস্ট। এটা হলো সময়ের অতীত,” সে ট্যাবটা দেখিয়ে বলল, “এটা হলো আমাদের বর্তমান, আর ড্রয়ার খুলে একটা সিলভার কালারের অত্যাধুনিক চকচকে কোল্ট পিস্তল বের করে ট্যাবটার পাশে রেখে বলল, “এটা হলো আপনাদের ফিউচার।”

.

নির্দিষ্ট বাড়িটা খুঁজে বার করার পর সে পুরো বাড়িটা একবার গাড়িতে চক্কর দিল। বাড়িটার গেটের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করল কয়েকবার। গেটের ভেতরে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু এইটুকু বোঝা যাচ্ছে বিরাট একটা বাড়ি। দেখেই সে অনুমান করতে পেরেছে এর সিকিউরিটি বেশ কড়া। গেটের কাছেই অন্ধকারে একটা গাড়ি দাঁড় করানো। সাদা রঙের গাড়িটার ভেতরে কেউ একজন বসে আছে। চেহারা বোঝা গেল না। চারপাশে চক্কর দিয়ে এসে সে বাড়িটার দেয়ালের কাছেই গাড়িটা রেখে নেমে এলো। তার মোবাইলে বাড়িটার কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছে। সে দেয়ালের পাশে এসে বাড়িটার দিকে একবার উঁকি দিয়ে দেখল। দেয়ালটা খুব উঁচু নয়, বড়জোর পাঁচ ফিট হবে। কিন্তু ওপরে কাঁটাতার দেওয়া। কে জানে ওটাতে আবার কারেন্ট আছে কি না। সে দেয়ালের ওপর দিয়ে বাড়িটার আরও কয়েকটা ছবি তুলল। ছবি তোলা শেষ করে আবার গাড়িতে ফিরে এসে গবেষণায় বসে গেল ছবিগুলো নিয়ে। এমন সময় তার মোবাইলে একটা মেসেজ এলো, ‘নো ফারদার স্টেপস্ আনটিল নেক্সট্ অর্ডার অর অ্যানি ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন।”

.

আতিকুর রহমান তার ডেস্কে সব ফাইল ছড়িয়ে নিয়ে বসে আছে। তার চেহারা হয়েছে দেখার মতো। সে কেসটার যত গভীরে ঢুকছে ততই যেন তল খুঁজে পাচ্ছে না। তবে সে দুটো দুর্দান্ত লিঙ্ক বের করতে পেরেছে। প্রথমত, খুন হওয়া মহিলার মেয়েটা যখন সকালে মোহাম্মদপুর থানায় আসে তখন তার সাথে একজন উকিল এসেছিল এই উকিল বলেছিল সে খুন হওয়া মহিলার নিয়োগ দেওয়া উকিল। এটা সম্পূর্ণ ভুয়া তথ্য। এই উকিল ভদ্রলোকের সাথে মহিলার কোনো সংযোগ ছিল না। ইনফ্যাক্ট সে খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই নামে কোনো উকিলই নেই। দ্বিতীয়ত, এই মহিলা খুন হওয়ার পরপরই এক লোক বিভিন্ন সোর্স থেকেই খুনের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এমনকি ডিউটি অফিসারকে ঘুস দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কে এই লোক। এই উকিল আর এই লোকের পরিচয় বের করতে হবে তাকে।

.

পিস্তলটা দেখে দুজনেই অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল। হাসান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বশির সাহেব তাকে থামিয়ে দিল। “ইয়াং ম্যান, আমাকে তুমি যেকোনো একটা কারণ দেখাও, আমি এই মুহূর্তে তোমাকে গুলি করব না।”

হাসান আবারও অস্বস্তিতে নড়ে উঠল। “কারণ…কারণ আপনি আমার খুনের মামলায় ফেঁসে যাবেন।”

বশির সাহেব হেসে উঠল। সে তার সামনে থেকে অ্যাপলের আই-প্যাডটা তুলে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল। তারপর নির্দিষ্ট জিনিসটা খুঁজে পেতে পড়তে লাগলেন, ““তাসমিন অরণি’, বয়স চব্বিশ, আনুমানিক উচ্চতা পাঁচ ফিট চার, কালো চুল, দেখতে সুন্দরী,” বলে একবার অরণিকে দেখল। ““হাসান শাহরিয়ার রিওন’, বয়স সাতাশ, উচ্চতা পাঁচ ফিট দশ, হালকা—পাতলা গড়ন। দুজনেই পলাতক আসামি। সশস্ত্র এবং বিপজ্জনক। এদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের তরফ থেকে অনুরোধ করা যাচ্ছে,” বলে সে ট্যাবটা ঘুরিয়ে ওদেরকে দেখাল। একটা অনলাইন পত্রিকার খবর। সেটাতে দুজনের ছবি দেওয়া। “তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত আর নাই বা পড়লাম।”

এখন আপনারা দুজনেই আমাকে বলুন। আমি যদি এই হাসান শাহরিয়ার নামের ছেলেটাকে গুলি করে এবং তাসমিন অরণিকে বন্দি করে পুলিশকে খবর দেই এবং তাদেরকে বলি এই দুজন আমার বাড়িতে ডাকাতির জন্য হানা দিয়েছিল এবং হাসান শাহরিয়ার আমাদের পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে মেরে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছিল বিধায় আমার সিকিউরিটি গার্ড তাকে গুলি করতে বাধ্য হয়েছে, বলে সে একটু বিরতি দিল। “আমার যে চেহারা আপনি খবরে ছাপিয়েছিলেন। আমি যদি সত্যি এমন হই তাহলে কি আমার এমনটাই করা উচিত নয়?”

হাসান কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ বসে আছে। লোকটা একবারে ভুল বলেনি। চাইলে সে সত্যিই এটা করতে পারে।

“আমার ধারণা আপিন আমার সাথে একমত পোষণ করেছেন। মুখে না হলেও মনে মনে। এবার আমাকে বলুন তাহলে কেন আমি আপনাকে গুলি করব না?”

“কারণ আমরা সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে এখানে এসেছি এবং আমার ধারণা আপনি এই ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করবেন,” অরণি জবাব দিল। “এবং আপনি যা যা বললেন, আমাদের সাথে এই কাজগুলো করলে কয়েকটা ব্যাপার কোনোদিনই আর জানতে পারবেন না।”

“হুমমমম নাউ ইউ টক বিজনেস,” বলে সে একবার অরণিকে দেখল আরেকবার হাসানকে। মৃদু হেসে বলল, “আপনাকে মাফ করে দেওয়া হলো, আবারও অরণির দিকে ফিরল। “মিস অরণি আমার ধারণা যদি ভুল না হয় আপনি কেন এখানে এসেছেন তা আমি জানি।”

“তাহলে আপনিই বলুন আমি কেন এখানে এসেছি,” অরণি সরাসরি লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে।

“আপনি এখানে এসেছেন আপনার মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী। আমার ধারণা আপনার কাছে কিছু জিনিস আছে। আপনার মা মারা যাওয়ার আগে ওগুলো রেখে গেছেন এবং এই জিনিসগুলোর সাথে প্রাচীন কোনো একটা রহস্যের যোগাযোগ আছে। আমার ধারণা আপনার মা এই কারণেই খুন হয়েছেন,” আহমদ বশির একটানা বলে থেমে গেল। “এবং আমার মনে হয় আমার কাছে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলোর এসবের সাথে সংযোগ আছে।”

হাসান আর অরণি দুজনেই চমকে গেছে। লোকটা একদম ঠিক ঠিক বলে গেছে। তার মানে এই লোক অনেক কিছুই জানে। “আপনি এতসব কীভাবে জানলেন?” অরণি প্রশ্ন করল।

“আমার ধারণা,” লোকটা ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়েই বলল, “আপনার কাছে একটা ডায়েরি আছে। ঠিক মিস অরণি?”

অরণি চমকে গেল ডায়েরিটার কথা শুনে। “আমার কাছে কী আছে না আছে সেটা বড় কথা নয়। আমাকে আগে বলুন আপনি এতসব জানলেন কীভাবে?”

“ট্রাস্ট, মিস অরণি আমরা যদি একসাথে কাজ করতে চাই তবে আমাদের ভেতরে বিশ্বাস থাকতে হবে,” সে উঠে দাঁড়িয়ে কফি পট থেকে একটা চকলেট কালারের মগে কফি ঢেলে নিল। হাসান আর অরণি দুজনেই তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে মগটার দিকে তাকিয়ে আছে। আহমদ বশির বলে চলেছে, “আপনি হয়তো অনেক কিছুই ভাবছেন এবং এখানে বসে থাকা এই ছেলেটা আমার ব্যাপারে যে মতামতই পোষণ করে থাকুক না কেন, সত্যি কথা হলো আমি এসব জেনেছি আপনার মায়ের কাছ থেকে। আমার কিছু বিশেষ ব্যাপারে জ্ঞান আছে এবং আপনাদের কিছু জিনিস জানার আছে। তাই আপনার মা মিসেস আফরোজা আক্তার শায়লা চেয়েছিলেন আমরা একসাথে কাজ করি। আর এই কারণেই আমরা এখন এখানে। আমরা হলাম ধাঁধার একেকটা টুকরোর মতো। যেগুলোর আলাদা আলাদা কোনো অর্থ নেই কিন্তু একসাথে এর মূল্য অসীম, “ বলে সে অরণির একদম সামনে ঝুঁকে এলো। “আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না এই পুরো ধাঁধাটা আপনার মা-ই সৃষ্টি করেছিলেন যাতে আমরা একসাথে কাজ করে এর সমাধান বের করি। পুরো ব্যাপারটা কী নিয়ে, আমি এখনও সেটা জানি না কিন্তু আমার বিশ্বাস আমরা সেটা বের করতে পারব। যদি…যদি আমরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখি।”

“কিন্তু আমরা কীভাবে আপনার ওপর বিশ্বাস রাখব? বলেন, “ হাসান জানতে চাইল। “আমরা কীভাবে জানব যে এসব ঘটনা আপনি সৃষ্টি করেননি। আপনিই ম্যাডামকে খুন করে আমাকে ফাঁসাননি?”

“কারণ আমি যদি সেটাই করতাম তাহলে এতক্ষণে এখানে পুলিশ চলে আসত। আর ছেলে তোমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইলে আমি সেটা অনেকভাবেই নিতে পারতাম। চিনি না জানি না এমন একজন নির্দোষ মানুষকে খুন করার দরকার পড়ত না,” বলে সে একটু বিরতি দিল। “তারপরও আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করবে কি করবে না সেটা তোমাদের ব্যাপার,” বলে সে চুপচাপ কফি খেতে লাগল।

অরণি আর হাসান নিজেদের ভেতরে হালকা কথা বলে নিল। “ঠিক আছে মি. বশির আমরা আমাদের তথ্য আপনার সাথে শেয়ার করব। বিনিময়ে অবশ্যই আপনাকেও আপনারটা করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটার পরিষ্কার একটা সমাধান না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদেরকে আপনার নিরাপত্তা দিতে হবে।”

সে এক মুহূর্ত চিন্তা করল। “ঠিক আছে। তবে আমার ধারণা আপনারা খুবই ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। যেভাবে কফির মগের দিকে তাকাচ্ছিলেন তাতেই আমি বুঝেছি। আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন। ইচ্ছে করলে গোসল দিয়ে কাপড়চোপড়ও বদলাতে পারেন। আমার নাতনির কিছু কাপড় আছে, আমার মনে হয় তুমি ওগুলো পরতে পারবে। তুমি করেই বললাম কারণ তুমি ওর বয়সিই হবে,” অরণিকে বলে সে হাসানের দিকে ফিরে বলল, “এই ছেলে তুমি এদিকে এসো।”

“দুজনেই ভালোভাবে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। কারণ সামনে আমাদের অনেক কাজ। হয়তোবা সারারাতই আলোচনা করতে হতে পারে,” বশির সাহেব আবার তার টাইপরাইটারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন, অরণি বলে উঠল, “আমাদের একজন ড্রাইভার আছে। তিনি আমাদেরকে সকাল থেকে সাহায্য করেছেন। তাকে যদি একটু ভেতরে নিয়ে আসা যেত।”

আহমদ বশির কিছু না বলে একটা ওয়াকিটকির মতো জিনিস তুলে নিয়ে নির্দেশ দিল।

.

আতিকুর রহমান পাগলের মতো কাজ করছে। এই কেসের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটা ফাইল সে পড়েছে। প্রতিটা ঘটনা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই ভুয়া উকিলের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

“স্যার,” খটাস করে তার সামনে এসে এক কনস্টেবল স্যালুট ঠুকল। “হ্যাঁ বলো।”

“স্যার, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।”

“কে?”

“স্যার, এক বয়স্ক দারোগা।”

“কেন, সে আবার কী চায়?” আতিকুর রহমান ভাবল নিশ্চয়ই কোনো তদবিরের জন্য এসেছে।

“স্যার আপনি যে মহিলার মার্ডার কেসের ব্যাপারে খোঁজ করছেন ওই ব্যাপারে নাকি তার কাছে কিছু তথ্য আছে।”

“ঠিক আছে নিয়ে এসো,” আতিক সাহেব চমকে উঠল। কাজের কিছু হতে পারে।

একটু পরেই কনস্টেবল এক দারোগাকে নিয়ে প্রবেশ করল। বেশ বয়স্ক এক লোক। এখনও দারোগার র‍্যাঙ্কে পড়ে আছে। তার মানে হয় তার জ্যাক নেই আর না হয় অতিরিক্ত সৎ…”বসুন। আপনার কাছে নাকি কী তথ্য আছে?”

“জি স্যার, ওই ভদ্রমহিলা খুন হওয়ার পর যখন আমরা ছেলেটাকে অ্যারেস্ট করি ওই টিমে আমিও ছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী স্যার আমিই ওই ফোন কলটা রিভিস করেছিলাম যেটাতে আমাদেরকে জানানো হয়েছিল অমুক বাড়ির কার পার্কে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে।

“এখানে আমার একটা কথা বলার আছে,” আতিক সাহেব লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল। “আপনারা ওই ফোন নম্বরটা ট্রেস করার চেষ্টা করেননি?”

“স্যার করেছিলাম কিন্তু সেটা এত অল্প সময় লাইনে ছিল ধরা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনার পর খবরটা যখন মিডিয়াতে আসে একজন লোক আমার নম্বরে ফোন করে এই বিষয়টার বিস্তারিত জানতে চায়। আমাকে সে পরিচয় দিয়েছিল সাংবাদিক। আমি প্রথমে কিছু বলতে অস্বীকার করি। তারপর বেশি জোরাজুরি করার পর আমি কিছু কিছু ব্যাপার তাকে জানাই। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার সন্দেহ লাগে। এর আগে বিভিন্ন কেসে আমি অনেক সাংবাদিকের সাথে কথা বলেছি। লোকটাকে আমার মোটেও সাংবাদিক মনে হয়নি। তবুও আমি জানতে চাই সে কোন পত্রিকায় কাজ করে? জবাবে সে একটু চুপ থেকে একটা পত্রিকার নাম বলে। মজার ব্যাপার হলো আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই নামে কোনো পত্রিকাই নেই।”

“অদ্ভুত।”

“জি স্যার, খুবই আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু পরে আর এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এখন এতসবকিছু ঘটে যাওয়ার পর আমার কাছে মনে হলো ব্যাপারটা আপনার সাথে শেয়ার করা দরকার।”

“অনেক ধন্যবাদ। আপনার কাছে কি সেই নম্বরটা আছে?”

“জি স্যার, আমি বলছি আপনি লিখে নিন।”

আতিকুর রহমান নম্বরটা একটা ছোট কাগজে লিখে নিয়ে সেটা একজন এসআইকে ডেকে তার হাতে ধরিয়ে দিল। “এই নম্বরটাকে ট্রেস করুন। কার নম্বর? ঠিকানা কী? আমি জানতে চাই। সম্ভব হলে টেলিকমের এই নম্বরের ডাটাবেইজটার একটা প্রিন্ট কপি নিয়ে আসবেন।”

ঘণ্টাখানেকের ভেতরে তার হাতে প্রিন্ট কপিটা চলে এলো। প্রিন্ট কপিটা তুলে নিয়ে সে দেখল, এটা হায়দার আলি নামের একজনের নম্বর। এক্স আর্মির সোলজার। বর্তমানে পেশায় দেহরক্ষী। ভেরি গুড। আতিকুর রহমান মনে মনে ভাবল, এবার একটু এগোনো যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *