২৫শে মার্চ – ১৫

১৫

বসুন্ধরা সিটি, লেভেল ফোর
বর্তমান সময়, বেলা প্রায় ২টা

হাসান আর অরণি হাঁ করে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেই হতবাক। ওদের ধারণা তাহলে ঠিকই ছিল।

“একটু পেছাও পেছাও,” অরণি হাসানকে তাড়া দিল। “এই যে এখানে, “ দুজনেই মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।

মনিটরে দেখা যাচ্ছে ম্যানেজার ছেলে দুটোর সাথে কথা বলতে যাওয়ার সাথে সাথে অরণির মা ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করল। সামনে কাউন্টারের ওপর একটা বক্সে অনেকগুলো মার্কার রাখা। মার্কারগুলোর ভেতর থেকে একটা মার্কার তুলে নিয়ে কাগজটার ওপর কিছু একটা লিখে সেটা তুলে ধরল সিসি ক্যামের দিকে। এক সেকেন্ডের মতো ধরে রেখেই সেটা হাতের তালুতে মুড়িয়ে ফেলে দিল পাশের ওয়েস্টবিনে। একটু পরেই ম্যানেজার আসার পর তার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল। ম্যানেজার তাকে একটা কুরিয়ারের ব্যাগ বের করে দিতেই সেটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে বিদায় নিল।

“কী বুঝলে?” হাসান অরণির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

“বুঝলাম ওই লেখাটাই আমাদের ব্লু। ওটাকে উদ্ধার করতে হবে। মা যখন লেখাটা তুলে ধরেছে ঠিক ওই জায়গাটা স্টিল করে জুম করো। তাহলেই লেখাটা পড়া যেতে পারে।”

“ওকে,” বলে হাসান আবার ফুটেজটা পিছিয়ে দিল। ঠিক নির্দিষ্ট জায়গাটায় এসে স্টিল করে দিল।

“ব্যাস ব্যাস, এবার জুম করে দেখো হয় কি না?”

“হাসান সেটাকে ধীরে ধীরে জুম করতে লাগল। লেখাটা আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল। সর্বোচ্চ জুম করার পর থেমে গেল সে। হয়তো পুরোপুরি পরিষ্কার নয় তবে লেখাটা বেশ ভালোই পড়া যাচ্ছে। কাগজটার ওপরে মার্কার দিয়ে গোটা গোটা হাতে লেখা, ‘অ্যান্টিক শপ ডাউনস্টেয়ারস’।

“অ্যান্টিক শপ, অ্যান্টিক শপ, নিচের তলায় মানে লেভেল থ্রি-তে মনে হয় একটা অ্যান্টিক শপ আছে। আমি যখন এই কুরিয়ারের দোকানটা বের করার জন্য ম্যাপটা খুঁজছিলাম তখন চোখে পড়েছিল,” হাসান জানাল।

“তার মানে আমাদেরকে ওখানে যেতে হবে। আমার মনে হয় ওখানে গেলে আমরা এই ছবিটা নিয়ে কোনো না কোনো সূত্র পাব। দারুণ, চলো,” অরণি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

“শাবাশ এখানকার কাজ শেষ। এবার আসলেই আমাদের বিদায় নেওয়া উচত। আরে এ ব্যাটা গেল কই?” এতক্ষণ উত্তেজনার কারণে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি দোকানের ছেলেটা নেই। ওদের ব্যস্ততার সুযোগে সে সটকে পড়েছে। “সর্বনাশ জলদি বেরোও এখান থেকে। এই ব্যাটা নিশ্চিত সিকিউরিটি ডাকতে গেছে।”

দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো দোকানটা থেকে। বেরিয়ে এসে একটা মোড় নিতেই দেখে, সত্যি সত্যিই ওই ব্যাটা সাথে দুজন মার্কেট সিকিউরিটিকে নিয়ে এদিকেই আসছে।

“মরার ওপর খাঁড়ার ঘা, জলদি এদিকে, বলে হাসান অরণির একটা হাত ধরে টান দিয়ে অন্য একটা গলির ভেতরে ঢুকে এক সাইড হয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল। ওই ছেলেটা সিকিউরিটি দুজনকে নিয়ে চলে গেল ওদের গলির মুখের সামনে দিয়ে।

“জলদি করো, এভাবে বেশিক্ষণ টিকে থাকা যাবে না। সিকিউরিটির লোকজন ওখানে আমাদেরকে না পেয়ে কী করবে কে জানে। আর যদি

ভুলেও পুলিশকে জানায় তহালেই হয়েছে। চলো নিচের অ্যান্টিক শপে। যত দ্রুত সম্ভব ওখানকার কাজ সেরে এখান থেকে ভাগতে হবে। যত বেশি সময় এখানে থাকব, এই শপিং মল আমাদের জন্য মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠবে।”

দুজনেই দ্রুতপদে রওনা দিল এসকেলেটরের দিকে।

.

দোকানের সারিগুলোর ফাঁকে দাঁড়িয়ে সে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ রাখছে কুরিয়ারের দোকানটার দিকে। মনে মনে ভাবছে, ঘটনা কী? এই দুজন সেই যে দোকোনে ঢুকল আর খবর নেই কোনো। এতক্ষণ করছেটা কী? বিরক্ত হয়ে অপেক্ষা করতে করতে মোবাইল বের করে দেখল একবার। নাহ, আর কোনো এসএমএস নেই। তার মানে নতুন কোনো নির্দেশনাও নেই। তাকে ওদের পেছনেই লেগে থাকতে হবে এবং ওরা কোনো ঝামেলায় পড়লে সাহায্য করতে হবে প্রয়োজনে।

কুরিয়ারের দোকানটা থেকে হঠাৎ করে ইউনিফর্ম পরা একটা ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। ছেলেটা প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। ব্যাপার কী? এই পোলা এভাবে দৌড়ে বেরিয়ে এলো কেন? কোনো ঝামেলা হয়নি তো। এই দুই মাল আবার কোনো বিপদে পড়ল না তো! একবার ভাবল ভেতরে ঢুকে দেখে। আবার ভাবল …

সে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে দুজন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো দোকানটা থেকে। সে চট করে সরে গেল একপাশে। দুজনেই বেরিয়ে গেল দোকানের সারিগুলোর ভেতর দিয়ে। সেও পিছু পিছু রেলিঙের সামনে এসে দাঁড়াল। দুজনেই নেমে যাচ্ছে এসকেলেটর দিয়ে। ডান দিকে তাকিয়ে সে দেখল কুরয়িারের ইউনিফর্ম পরা ছেলেটা দুজন সিকিউরিটি গার্ডকে নিয়ে এদিকেই আসছে। বুঝে গেল পরিস্থিতি ভালো না। নিশ্চয়ই এই দুজন ওখানে কোনো কাণ্ড ঘটিয়েছে। আলগোছে চলে এলো সে সিঁড়ির কাছে। তাকে এখন দেখতে হবে এই দুজন যাচ্ছেটা কোথায়?

.

এসকেলেটর দিয়ে দুজনেই নেমে এলো নিচের ফ্লোরে, মানে লেভেল থ্রি-তে। অরণি হাসানের কাছে জানতে চাইল, “তোমার মনে আছে কত নম্বর দোকান?”

“না, দোকানের নম্বর মনে নেই, কারণ অত ভালোভাবে খেয়াল করিনি তখন। তবে খুঁজে বের করা যাবে,” হাসান চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল। “দাঁড়াও, কাউকে জিজ্ঞেস করি।”

অরণি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আর হাসান একটা দোকানে ঢুকে দোকানদারের সাথে কথা বলতে লাগল। দোকানদার ইশারায় তাকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। অরণির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। একদিকে পুলিশের তাড়া অন্যদিকে আবার সিকিউরিটি।

হাসান দোকানটা থেকে বেরিয়ে এলে অরণি জানতে চাইল, “পেয়েছ?”

“হ্যাঁ, পেয়েছি। ওই পাশের সারি দিয়ে ঢুকলে তিন নম্বর দোকান। দোকানের নাম ‘অ্যান্টিকস ওয়ার্ল্ড”,” হাসান হাঁটতে হাঁটতে জানল।

“তুমি শিওর এই দোকানটার কথাই বলেছে মা?”

“শিওর তো না কিন্তু এই ফ্লোরে একটাই অ্যান্টিকের দোকান আছে। ইনফ্যাক্ট এই পুরো শপিং মলেই একটা অ্যান্টিকের দোকান। কাজেই এছাড়া অন্যকিছু হওয়ার সম্ভবনা কম।

দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে নির্দেশনা অনুযায়ী দোকানটা খুঁজে বার করল। বাইরে থেকে দেখে বেশি বড় দোকান বলে মনে হলো না। ওরা ঢুকতে যাবে অরণি হাসানের একটা হাত চেপে ধরে বলল, “হাসান প্লিজ উলটা-পালটা কিছু করো না।”

হাসান হেসে ফেলল, “ঠিক আছে করব না। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যাপারটাও তো বের করতে হবে তাই না?”

অরণি মাথা নাড়ল, “তবুও। আমরা ইতোমধ্যেই অনেক উলটা-পালটা করে ফেলেছি। এর শেষ কোথায় কে জানে!”

“এত চিন্তা করো না। আমরা তো সত্যিকার অর্থে কোনো অপরাধ করিনি। বরং একটা সত্যকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি,” বলে হাসান অরণির হাতে মৃদু চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করল। “বাই দা ওয়ে, ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিলে তো ভালোই দেখায় তোমাকে।”

অরণি হেসে ফেলল, “এত পাগল টাইপের হওয়ার পরও মেয়েরা তোমাকে কেন পছন্দ করে এখন বুঝতে পারছি। কথা না বলে চলো।”

দুজনেই কাচের স্লাইডিং ডোর ঠেলে প্রবেশ করল ভেতরে।

দোকানের নাম অ্যান্টিক ওয়ার্ল্ড এবং সত্যিকার অর্থেই দোকানটা অ্যান্টিক ওয়ার্ল্ড। চারপাশে নানা ধরনের পুরানো জিনিসের ছড়াছড়ি। প্রতিটা জিনিসই খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো এবং দোকানটাও সাজানো হয়েছে পুরানো ধাঁচের অ্যান্টিকের মতো করেই। এমনকি দোকানের প্রতিটা আসবাব থেকে শুরু করে সবকিছুই সাজানো হয়েছে অ্যান্টিক জিনিসপত্র দিয়ে। দোকানটা ছোট হলেও সত্যিকার অর্থে পুরো দোকানটাকেই একটা অ্যান্টিক পিস বলে মনে হয়।

“শিসসস, কারবার দেখছ! পুরো দোকানটাই দেখি একটা অ্যান্টিক পিস। এধরনের দোকান আমাদের দেশে আছে বললে আমি বিশ্বাস করতাম না, “ হাসান চারপাশ দেখতে দেখতে বলল।

অরণির কাছে অবশ্য অতটা আহামরি মনে হচ্ছে না। কারণ এধরনের দোকান বাইরের দেশে সে এর আগেও দেখেছে কিন্তু দেশে মনে হয় না এধরনের দোকান আগে চোখে পড়েছে।

“দেখো কাউন্টারটা কী সুন্দর, মনে হচ্ছে পুরানো দিনের কোনো জাহাজের অংশের মতো,” অরণি মন্তব্য করল।

“এটা আসলেই একটা পুরানো পর্তুগিজ জাহাজের অংশ বিশেষ। সত্যি বলতে গেলে একটা পর্তুগিজ জলদস্যু জাহাজের অংশ,” কাউন্টারের পেছন থেকে একজন মানুষ বলে উঠল। তার চেহারাতে মোটেও কোনো পুরানো দিনের ছাপ নেই। অত্যন্ত আধুনিক জিন্স আর টি-শার্ট তার পরনে, মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। স্পাইক করা চুল, চোখে গোল্ড রিমের চশমা। “আপনাদের জন্য কী করতে পারি?” বেশ হাসিমুখে সে জানতে চাইল।

“আ-আপনি দোকানের মালিক?” অরণি জানতে চাইল। “নাকি কর্মচারী?”

“আপনার কী মনে হয়?” লোকটা হাসিমুখেই পালটা প্রশ্ন করল।

অরণি হেসে ফেলল। “সরি, বোকার মতো প্রশ্ন করলাম? আসলে আমরা একটা বিশেষ জিনিসের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলাম।”

“এখানে সবাই বিশেষ কোনো জিনিসের ব্যাপারে খোঁজ নিতেই আসে। সরি আমার কথাটাও মনে হয় একটু উদ্ধত হয়ে গেল। আসলে আমরা শুধুমাত্র বিশেষ ধরনের অ্যান্টিকই রাখি এবং এখানে মূলত সবাই অ্যান্টিক খুঁজতেই আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের কাস্টমারের সংখ্যা লিমিটিড এবং সিলেক্টেড।”

“কারণ কী?” এবার হাসান জানতে চাইল। অরণি তার মুখের ভাব দেখেই বুঝে গেছে লোকটার কথা বলার উদ্ধত ভাব তার ভালো লাগেনি।

“এর কারণ, এটা বাংলাদেশ। এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ অ্যান্টিক বোঝে না। মূলত এই দেশের মানুষ খোঁজে শো-পিস। একটা পুরানো টেবিল বা ফুলদানির দাম কীভাবে এত হয় এটা তাদেরকে বোঝানো যায় না। আর আমরা বোঝানোর চেষ্টাও করি না। তাই আমরা লিমিডেট এবং সিলেক্টেড কাস্টমার নিয়েই ডিল করি।”

“আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, আমরা আসলে…” অরণি কথা বলার মাঝখানে লোকটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনারা আসলে একটা পুরানো ছবির ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছেন তাই না?”

দুজনেই চট করে তার দিকে ফিরে তাকাল। “আপনি জানলেন কীভাবে?” প্রশ্নটা হাসানের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

“আমি বুঝতে পেরেছি তার কারণ ঠিক গত সপ্তাহে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন ওটার ব্যাপারে জানতে,” লোকটা ওদের সারপ্রাইজটা বেশ এনজয় করছে। “এবং সেই ভদ্রমহিলার চেহারার সাথে আপনার চেহারার ব্যাপক মিল আছে। কাজেই দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নেওয়াটা খুব কষ্টকর হয়নি। তার চেয়ে বড় কথা আমি টিভি দেখি।”

হাসান আর অরণি চোখাচোখি করল। লোকটা কী বোঝাতে চেয়েছে দুজনের একজনেরও না বোঝার কথা নয়। দুজনের চেহারাতেই ভয় খেলে গেল।

“গত সপ্তাহে একজন ভদ্রমহিলা আমার কাছে একটা বিশেষ জিনিসের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। এরপরই তার মৃত্যুর খবর পড়লাম পত্রিকাতে, ছবি সহ। আর আজ সকালে সেই মহিলার সম্ভাব্য খুনি পালাল এবং আজই সেই মহিলার চেহারার সাথে অদ্ভুত মিল আছে এমন একজন মানুষ আমার দোকানে আবার ফিরে এলো কোনো একটা ব্যাপারে জানতে। এতগুলো দুই আর দুই চার মেলানো মনে হয় খুব কঠিন নয়।”

“আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমরা এই বিশেষ জিনিসটার ব্যাপারে জানতে এসেছি,” বলে অরণি প্যাকেট থেকে ছবিটা বের করে দেখাল।

“লোকটা ছবিটা হাতে নিয়ে চোখের চশমাটা একটু নামিয়ে নিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। “কোনো সন্দেহ নেই এই ছবিটাই। তবে ব্যাপারটা কি জানেন?” লোকটা ছবিটা অরণির হাতে ফেরত দিতে দিতে বলল। “এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।”

দুজনেই লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের চোখে-মুখে হতাশা।

“তবে আমি আপনাদেরকে ঠিক ওই উপদেশটাই দেব যেটা আমি ওই ভদ্রমহিলাকে দিয়েছিলাম,” বলে লোকটা একবার অরণিকে আরেকবার হাসানকে দেখল। “আপনারা আরেকজন মানুষের সাথে দেখা করুন। তিনি সম্ভবত এই ব্যাপারে আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন। আমি ওই মহিলাকে …তিনি আপনার কী হন? বড় বোন?”

“না তিনি আমার মা ছিলেন,” অরণি জবাব দিল।

“আমি আপনার মাকেও একই কথা বলেছিলাম। আপনারা পুরান ঢাকায় চলে যান। ওখানে একটা বহু পুরানো অ্যান্টিক শপ আছে। ওটার যে বৃদ্ধ মালিক তিনি আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন। আমি আপনাদেরকে ঠিকানাটা লিখে দিচ্ছি।”

হাসান আর অরণি চোখাচোখি করল। মনে হয় ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন।

“ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ আমরা ওভাবেই চেষ্টা করব,” অরণি লোকটার হাত থেকে ঠিকানাটা নিতে নিতে বলল। “আপনাকে আবারও অনেক ধন্যবাদ,” অরণি বলল।

“জানেন কেন আপনাদেরকে আমি পুলিশে ধরিয়ে দিইনি?”

“কেন?” দুজনেই পেছন ফিরে রওনা দিয়েছিল। লোকটার কথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসান জানতে চাইল।

“কারণ আমার ধারণা এই ছবিটা যে জিনিসেরই হয়ে থাকুক সেটার পেছনে মস্ত বড় কোনো রহস্য আছে এবং আপনার মা সম্ভবত,” অরণিকে দেখিয়ে বলল। “সেটার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি চাই এই রহস্যটার সমাধান হোক। যদি সেটার সমাধান হয়। হয়তো আমিও জানতে পারব।”

দুজনেই বিদায় নিয়ে দোকানটা থেকে বেরিয়ে এলো। “তোমার কি মনে হয়, লোকটা সত্যি কথা বলল?” অরণি জানতে চাইল হাসানের কাছে।

“আমি কীভাবে বলব? তবে মনে হলো সত্যি কথাই বলেছে। কারণ আমরা দোকানটাতে ঢোকার আগেই লোকটা আমাদের ব্যাপারে জানতে পেরেছে টিভি থেকে। আর তোমাকে দেখেই, তোমার চেহারার সাথে তোমার মায়ের চেহারার মিল দেখে অনুমান করে নিয়েছে বাকিটা। বুদ্ধিমান মানুষ। তবে আমার কি ধারণা জানো?”

“কী?”

“লোকটা টিভির নিউজটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। করলে আমাদেরকে ধরিয়ে না দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না।”

“হুমম আমরা এখন কী করব?” অরণি প্রশ্ন করল হাসানের কাছে।

“কী আর করব এখন আবার পুরান ঢাকায় যেতে হবে। ঠিকানাটা দেখি, “ বলে হাসান অরণির হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিয়ে দেখল। ““মর্মর’, এটা সম্ভবত দোকানের নাম। গানের ভুবন মার্কেট, টিকাটুলি। হুমমম বুঝলাম এখন আমাদেরকে টিকাটুলি যেতে হবে এবং যদি ওই লোকের নির্দেশনা ঠিক থাকে তবে আমরা ওখানে এমন একজনকে পাব যে কি না আমাদেরকে এই ছবি এবং এর মূর্তির ব্যাপারে খোঁজ দিতে পারবে।”

“আচ্ছা, এই নামে আজিজ মার্কেটে একটা দোকান আছে না?”

“তা আছে কিন্তু আমি যতদূর জানি ওরা শুধুমাত্র পাথরের কাজ করে। আর এটা তো টিকাটুলিতে। মনে হয় এটা ভিন্ন কোনো দোকান। আবার ওদের আউটলেটও হতে পারে। কে জানে।”

 “ঠিক আছে আমরা তাহলে ওখানেই যাব। ভেরি গুড়, কাজ অনেকদূর এগিয়েছে,” অরণি মন্তব্য করল।

“ভুল বললে। কাজ খুব বেশি না এগোলেও এটুক অন্তত বুঝতে পেরেছি, আমরা ঠিক ট্রাকেই আছি। তোমার মায়ের মানে ম্যাডামের ট্রাক আমরা ঠিকভাবেই ফলো করেত পারছি।”

“এটাও বা কম কি? এবার তাহলে আমরা …ও মাই গড,” বলে অরণি শক্ত করে হাসানের হাত চেপে ধরল।

দুজনেই এসকেলেটর দিয়ে নামছিল। হাসান তখনও ঠিকানাটা দেখছে, হঠাৎ অরণির হাতের টান খেয়ে চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে?” বলেই তার চোখ পড়ল সামনের দিকে। বসুন্ধরা সিটির নিচের ফ্লোরে পুলিশ গিজগিজ করছে এবং তাদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আছে কুরিয়ারের ছেলেটা এবং শপিং মলের সিকিউরিটি গার্ডরা। পুলিশের একজন অফিসারও আছে তাদের সাথে। ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নেড়ে নেড়ে অফিসারের সাথে কথা বলছে।

“শিট, ব্লাডি হেল,” হাসানের মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে গেল, নাকি সে ইচ্ছেকৃতভাবে বলল বুঝতে পারল না।

.

বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে একই ফ্লোরে ওদের ঠিক অপজিটে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন মানুষ। মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে নিচের ফ্লোরটা। মনে মনে দুইটা বাজে গালি দিয়ে উঠল। পুলিশ ভরতি ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কী করে ওঠা উচিত। এবার তার কাছে মনে হচ্ছে ছেলেমেয়ে দুজন কঠিন বিপদে পড়েছে। দেখা যাক ওরা কী করে। ওদের কর্মপন্থা অনুযায়ী সে নিজের কাজ ঠিক করবে। আলগোছে নিজের কোমরে রাখা পিস্তলটাতে একবার হাত বুলাল। পায়ের কাছে খোপের ভেতরে আরেকটা ছুরি আর স্মোক গ্রেনেড আছে। যেভাবেই হোক সে ওদেরকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করবে। এখন দেখা যাক ওরা কী করে।

.

হাসান আর অরণি রেলিং ধরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কী করে উঠবে বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ পুলিশ অফিসার লোকটা ওপরে তাকাল। একেবারে সোজা ওরা ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই। হাসান চট করে টান দিয়ে অরণিকে সরিয়ে আনল রেলিং থেকে। টেনে নিয়ে গেল গলির ভেতরে।

“এখন কী করবে?” অরণি অসহায়ের মতো জানতে চাইল।

“জানি না, বুঝতে পারছি না। ইসসস আরেকটু সময় পেলেই হতো, এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারতাম,” হাসানের গলায় আক্ষেপের সুর। “সেটা বেভে তো এখন আর লাভ নেই। কী করা যায় সেটা

“ অরণির কথা শেষ হওয়ার আগেই শপিং মলের সেন্ট্রাল থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল, “সম্মানিত গ্রাহকবৃন্দ পুলিশের উপস্থিতিতে আপনারা ভয় পাবেন না। শপিং মলের সিকিউরিটিতে হঠাৎ একটু ঝামেলা হওয়াতে সেটা ঠিক করার জন্যই এখানে তাদের উপস্থিতি।“

হঠাৎ স্পিকার খরখর করে উঠল। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল এবার, “আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, আপনাদের মাঝে দুজন অপরাধী ঢুকে পড়েছে। সাতাশ-আটাশ বছরের একটা ছেলে, লম্বা দেখতে এবং সম্ভবত সাদা শার্ট পরনে। মেয়েটার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। সেন্ট্রাল ডিসপ্লেতে তাদের ছবি দেখানো হচ্ছে। কেউ যদি তাদের দুজনের কাউকে দেখতে পান তবে সাথে সাথে পুলিশ অথবা সিকিউরিটির কাউকে অবগত করুন। আপনাদেরকে আবারও বলছি ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি মেট্রপলিট্যান পুলিশের এসপি আতিকুর রহমান বলছি। ধন্যবাদ।”

“সর্বনাশ,” অস্ফুটে বলে উঠল হাসান। “চলো চলো। নিচ দিকে নেমে লাভ নেই। চলো ওপরের দিকে চলো। নিচের সব বেরোবার রাস্তা সম্ভবত বন্ধ হয়ে গেছে। দেখা যাক ওপরে উঠে কিছু করা যায় কি না।“

“ওপরে উঠে কী করবে? ওরা পুরো শপিং মল থরোলি সার্চ করবে। আমাদেরকে খুঁজে বের না করে ছাড়বে না,” অরণির গলায় চরম আতঙ্ক।

“কথা বলে লাভ নেই। ওদিকে চলো। আমরা আগে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাই। পরে দেখা যাবে।

.

“আপনি কী করতে চাচ্ছেন আমাকে বলুন তো। এখানে কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটুক আমি সেটা চাই না,” শপিং মলের সিকিউরিটি চিফ তার পাশে দাঁড়ানো এসপি আতিকুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল।

“আমি গেরান্টি দিচ্ছি এখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না। আমি চাইছি ওরা যেন ধরা পড়ে। পরেরটা পরে দেখা যাবে,” অতিকুর রাহমান তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে বলল।

সে নিজের ওপর একটু বিরক্ত। পুরো পরিস্থিতিটা সে ধরতে পারছে না। আজ সকালে জজ কোর্টের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পর সে ভেবেছিল এই ছেলেমেয়ে দুটো সাধারণ ক্রিমিনাল। টিভিতে ওদের ব্যাপারে খবর প্রচার করার আইডিয়াটা মূলত তারই ছিল। তারপরই ওদরেকে স্পট করা হয় বসুন্ধরা সিটিতে। একটা কুরিয়ারের দোকানে তারা প্রবেশ করে একজন কুরিয়ার বয়কে জিম্মি করে।

আতিকুর রহমানের কাছে কিছুই পরিষ্কার হচ্ছে না। এই ছেলেমেয়ে দুজন আসলে কারা এবং এদের ভূমিকা কী। তবে এই মুহূর্তে সব বাদ দিয়ে ওদরেকে ধরার ব্যাপারে সে মনোনিবেশ করল। একবার এরা ধরা পড়লে সবই বের হয়ে আসবে। ইতোমধ্যেই পুলিশ চারপাশে সার্চ করা শুরু করে দিয়েছে। অতিকুর রহমান ভাবল এরা যাবে কোথায়। সে দুদিক থেকে সার্চ শুরু করতে বলেছে। একটা গ্রুপ ওপর থেকে নিচে, আরেকটা গ্রুপ নিচ থেকে ওপরে। ধরা ওদের পড়তেই হবে।

.

হাসান আর অরণি ছুটতে ছুটতে থার্ড ফ্লোরের পেছন দিকে চলে এলো। এখানে পেছন দিয়ে ওঠার জন্য সিঁড়ি আছে। এই সিঁড়িটা সাধারণত সাধারণ গ্রাহকেরা ব্যবহার করে না। এটা মূলত শপিং মলের লোকজনের ব্যবহারের সিঁড়ি। ওরা দুজনেই পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতে লাগল। হঠাৎ অরণি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে এই পেছনের সিঁড়ি দিয়েও নিচ থেকে পুলিশ উঠছে।

“হাসান, এই সিঁড়ি দিয়েও পুলিশ উঠছে,” অরণি হাসানের শার্টে ধরে টানতে টানতে বলল। অরণি বুঝতে পারছে না হাসান ওপর দিকে তাকিয়ে আছে কেন?

“অরণি,” হাসান থমথমে কণ্ঠে বলে উঠল।

“কী হয়েছে?” অরণি হাসানের কন্ঠ শুনে ভয় পেয়ে গেছে।

“আমরা ফাঁদে পড়ে গেছি।”

“মানে?”

“ওপরেও পুলিশ পাহারা আছে, সিঁড়ির মাথায় এবং ওরা ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে।

“সর্বনাশ! এখন কী করবা?” অরণির কণ্ঠে চরম ভীতি। ঠিক তখনই ওপর থেকে একজন পুলিশ ওদরেকে দেখতে পেয়ে সাথে সাথে বাঁশি ফুঁ দিল।

.

দূর থেকে বাঁশির শব্দ শুনে আতিকুর রহমানের মুখে হাসি ফুটে উঠল। যাক এবার ওরা ধরা পড়তে যাচ্ছে। সাথে কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে যেদিক থেকে বাঁশির শব্দ এসেছে সেদিকে রওনা দিল সে।

.

পুলিশের বাঁশির শব্দ শুনে আরেকজন মারাত্মক চমকে উঠল। সে শপিং গ্রাহকদের সাথে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিল এবং সেইসাথে ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সম্ভাব্য কর্মপন্থা। হঠাৎ পুলিশের বাঁশির শব্দ শুনে চমকে উঠল সে। বাঁশির শব্দের অর্থ, হয় পুলিশ ওদেরকে দেখে ফেলেছে না হয় ধরে ফেলেছে। মনে মনে সে প্রার্থনা করল যেন ধরে ফেলে না থাকে। ধরে ফেললে ওদেরকে উদ্ধার করা খুব মুশকিল হবে। সে ভিড়ের ভেতরে আলগোছে রওনা দিল যেদিক থেকে বাঁশির শব্দটা এসেছে সেদিকে।

.

“সর্বনাশ ওরা আমাদেরকে দেখে ফেলেছে,” অরণি হাসানের হাত ধরে টানতে টানতে বলল।

হাসান ঝটকা দিয়ে অরণির হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে খপ করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল অরণি হাতটা। “কথা বলবে না। আমি যা যা করি তাই তাই করো। আমার সাথে এসো।”

হাসান অরণির হাত ধরে জোরে টান দিয়ে সিঁড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ঢুকে পড়ল মার্কেটের ভেতরে। আলো ঝলমলে দোকানগুলো দুজনেই দৌড়ে পার হয়ে চলে এলো ফ্লোরের পেছন দিকে।

“কী করবে এখন? কোনদিকে যাবে?” অরণি হাঁপাতে হাঁপাতে জানতে চাইল।

“দাঁড়াও,” হাসান এদিক-ওদিক তাকিয়ে নির্দিষ্ট কিছু একটা খুঁজছে।

“কী খুঁজছ?”

“এই তো পেয়ে গেছি,” বলে সে একটা বন্ধ দরজার সামনে চলে এলো। শাটার নামানো বন্ধ একটা দরজা।

“এটার ভেতরে কী?”

“একটু, একটু অপেক্ষা করো,” তালাটা পরীক্ষা করে সে পাশের দেয়ালে দেখল। ওখানে একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার ঝোলানো। ওটা দেয়াল থেকে টেনে নামিয়ে তালাটার ওপর জোরে আঘাত করল সিলিন্ডারটা দিয়ে।

আরেকবার, আরেকবার।

“হাসান জলদি করো,” অরণি হাসানের প্ল্যানটা বুঝতে পেরেছে। সম্ভবত পেছনের এই ছোট্ট দোকানগুলো অনেক ব্র্যান্ড শপ তাদের গুদাম ঘরের মতো ব্যবহার করে। হাসান মনে হয় এটাতে ঢুকে অপেক্ষা করতে চাইছে। ওদের ফ্লোরের অন্যদিক থেকে শোনা যাচ্ছে চিৎকার-চেঁচামেচি। পুলিশ বুঝে গেছে ওরা এই ফ্লোরেই আছে।

পায়ের আওয়াজ এদিকে এগিয়ে আসছে, যেকোনো সময় পুলিশ ওদেরকে দেখে ফেলবে। “হাসান জলদি।”

খটাস করে শাটারে লাগানো তালাটা ভেঙে গেল। হাসান এক হাতে শাটার টেনে তুলে অন্য হাতে অরণিকে টেনে ধরে ভেতরে ঢুকে গেল। খটাখট শব্দে নামিয়ে দিল শাটারটা।

ভেতরে দুজনই চুপচাপ বসে রইল অন্ধকারে। বাইরে পায়ের আওয়াজ আর চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পুলিশ সম্ভবত থরো সার্চ করছে পুরো ফ্লোর। ওরা দুজনেই অপেক্ষা করতে লাগল চুপচাপ।

ধীরে ধীরে বাইরের আওয়াজ কমে আসতে লাগল। একদম কমে এলে হাসান উঠে দাঁড়িয়ে সুইচ খুঁজে বের করে লাইট জ্বেলে দিল। ভেতরে সারি সারি কাপড়ের স্তূপ। মনে হয় এটা কোনো কাপড়ের ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র রাখার জায়গা।

“উফফফ বাঁচা গেছে,” অরণি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল।

হাসান হেসে উঠল। “মোটেই না। কিছুক্ষণের ভেতরেই ওরা বুঝতে পারবে ওদেরকে বোকা বানানো হয়েছে। আরেক রাউন্ড সার্চ দিলেই বাইরের ভাঙা তালা দেখে ওরা বুঝে ফেলবে। আর তাছাড়া যাদের স্টোর এটা ওদের কেউ চলে আসতে পারে যেকোনো সময়। ওরা প্রায়ই এখান থেকে কাপড় নিতে আসে।”

“তুমি জানলে কীভাবে এখানে এরকম ছোট ছোট স্টোর আছে?”

“এখানে একবার একটা ব্র্যান্ড শপের মেলায় আমি ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়। তখন দেখেছি। অরণি আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। প্রথমেই যেটা করতে হবে। এখানে প্রচুর কাপড় আছে, আমাদেরকে পরনের কাপড় বদলে ফেলতে হবে। তুমি কাপড় বেছে নাও আমি পেছন ফিরে দাঁড়াচ্ছি।”

.

চারপাশে পুলিশ আর মানুষের হুড়াহুড়ির ভেতরে সে হন্যে হয়ে ওদরেকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে। নিজেকে টেনেহিঁচড়ে ভিড়ের ভেতর থেকে বের করে আনল। ওরা এই ফ্লোরেই আছে। নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে পুলিশকে বোকা বানিয়েছে। কিন্তু তাই বলে তাকেও। সে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো দোকানের সারির পেছন দিকে। ওরা এখানেই কোথাও আছে।

.

হাসান আর অরণি সাবধানে দোকানের শাটার সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। দুজনেই তাদের পোশাক পালটে নিয়েছে। অরণি আবার জিন্স আর শার্ট জাতীয় একটা পোশাক পরেছে, আর মাথা ঢেকে নিয়েছে একটা কালো স্কার্ফ দিয়ে। হাসানও মাথায় একটা ক্যাপ পরে নিয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার খুব সহজ একটা পরিকল্পনা করেছে হাসান। ওরা বের হয়ে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যাবে। এরপর ভিড়ের স্রোতে মিশে দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে বাইরে বেরিয়ে আসবে।

হঠাৎ শক্তিশালী একজোড়া হাত দুজনের দুটো হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বসিয়ে দিল। টানটা যে-ই দিয়ে থাকুক সে এত দ্রুত আর শক্ত টান দিয়েছে দুজেনই গলির মুখে একটা দোকানের আড়ালে বসে পড়তে বাধ্য হলো। সাথে সাথে একজন মানুষ ওদের মুখ চেপে ধরে মৃদু স্বরে বলল, “শশশশশ।”

দুজন পুলিশ ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। পুলিশ দুজন চলে যাওয়ার সাথে সাথে লোকটা ওদেরকে ওঠার ইশারা করল। “কে আপনি, এভাবে…?” হাসান বলার আগেই লোকটা বলে উঠল, “কোনো কথা না, আমার সাথে এসো।” সে ওদেরকে নিয়ে রেলিঙের কাছে চলে এলো। “নিচে দেখো।” দুজনেই নিচে তাকাল। নিচে অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করছে। দরজার কাছে প্রত্যেককেই চেক করা হচ্ছে। “ওরা চেক না করে কাউকেই বেরোতে দিচ্ছে না। তোমরাও পারবে না। আমি যা বলি শোনো। আমি যখন বলব তখন দৌড়ে নিচে নামবে এরপর বেরিয়ে যাবে।”

“কিন্তু…”

“আবার কথা বলে!” লোকটা দাবড়ে উঠল। “কোনো কথা নেই, দেখো।” বলে সে নিজের মোজার ভেতর থেকে চকচকে সিলিন্ডারের মতো কিছু বের করে আনল। দুটো সিলিন্ডার। জিনিস দুটোর মুখ খুলে নিচের দিকে ছুড়ে মারল। দুটা সিলিন্ডার থেকেই ঘন ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। সেইসাথে নিজের কোমর থেকে পিস্তল বের করে ওপরের দিকে তাক করে দুটো গুলি করল। ধোঁয়া আর গুলির শব্দে চারপাশে শোরগোল বেড়ে গেল সাথে সাথে।

“আমার সাথে এসো।”

“আপনি করছেনটা কী?”

“আগুন লাগাচ্ছি।”

“মানে?”

“২০০৯ সালে এখানে একবার তীব্র আগুন লেগেছিল। সেই আতঙ্ক মানুষের মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। আমি আবারও লাগাচ্ছি।” ওরা কিছু বলার আগেই লোকটা ওদরেকে নিয়ে লিফটের কাছে এসে একটা ফায়ার অ্যালার্মের সুইচ চেপে ধরল। সাথে সাথেই চারপাশে তীব্র শব্দে বাজতে লাগল অ্যালার্ম।

.

প্রথমে চারপাশে ধোঁয়া আর ঠাসঠাস গুলির শব্দ। তারপারেই বাজতে থাকা অ্যালার্মের শব্দে লোকজনের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশের লোকেরা অরণি আর হাসানকে না পেয়ে মেইন গেট বন্ধ করে দিয়েছিল। ভেবেছিল থরো সার্চ না করে কাউকে বেরোতে দেবে না। সেই আশা গুড়ে বালি। আতঙ্কিত লোকজন স্রোতের মতো এসে পড়ল গেটের ওপরে। প্রথম ধাক্কায়ই সিকিউরিটি গেট, পাহারা আর মেশিনপত্র সব উড়ে গেল। সামনের অংশের অনেক জায়গার কাচ ভেঙে বেরিয়ে এলো লোকজন। পুরো শপিং মলে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা। সব দোকানদাররা শপাশপ নামাতে লাগল দোকানের শাটার। অনেক দোকোনে ছোটখাটো চুরি আর লুটতরাজও হয়ে গেল।

“এবার দৌড়াও, ভিড়ের ভেতর মিশে গিয়ে বেরিয়ে যাও।”

লোকটা ভুল বলেনি। এখান থেকে নির্বিঘ্নে বের হওয়ার এরচেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। দুজনেই ছুটল ভিড় আর ধোঁয়া উপেক্ষা করে। তীব্র ঠেলাঠেলির ভেতরে বেরিয়ে এলো বাইরে। ওদরেকে সাহায্য করা লোকটা অনেক আগেই গায়েব হয়ে গেছে। দুজনেই দৌড়াতে দৌড়াতে বাইরে রওনা দিল আমির চাচার গাড়ির দিকে।

আছে মানুষটা, অন্যান্য সবার মতো গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে বসুন্ধরা সিটির দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে, কী হচ্ছে ওখানে ওদরেকে দেখে সে দেরি না করে গাড়ি ছেড়ে দিল।

হাসান আর অরণির দিকে তাকিয়ে বুড়ো মানুষটা জানতে চাইল, “ওইহানে কিছু হইছ নি? আগুন-টাগুন লাগছে?”

হাসান আর অরণি কেউই জবাব দিল না। দুজনেই বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে।

.

আরও আধা ঘণ্টা পর বসুন্ধরা সিটিতে পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এলো। ইতোমধ্যেই চেক করে ধরা পড়েছে আগুনের ব্যাপারটা ফলস অ্যালার্ম ছিল। সেইসাথে ধোঁয়ার রহস্যটাও ভেদ করার চেষ্টা চলছে।

এসপি আতিকুর রহমান পুরো সিটির বাজে অবস্থার দিকে তাকিয়ে আছে। তার একটা হাত মুখের একপাশে, ওখানে খানিকটা কেটে গেছে ভাঙা কাচ লেগে। সামনের দিকে তাকিয়ে সে কল্পনাও করতে পারছে না একজোড়া অ্যামেচার ছেলেমেয়ে এই কাণ্ড ঘটাতে পারে। এখানে-ওদের উপস্থিতি টের পাওয়ার পর সে যখন ফোর্স নিয়ে এখানে এলো, ভেবেছিল বেড় দিয়ে মাছ ধরার মতো ওদরেকে ধরে ফেলবে। এখন দেখা যাচ্ছে তার জাল ছিঁড়ে ওরা বেরিয়ে তো গেছেই সেইসাথে তার জালের অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। এখন ওপর মহলে জবাব দিতে দিতে তার জান খারাপ হয়ে যাবে। তবে তার আগে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষকে আর এই সিকিউরিটি ভদ্রলোককে সামলাতে হবে। ভদ্রলোক এখনও পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। তার মানে এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। আতিকুর রহমান তার দিকে এগিয়ে গেল। তার হাতে একটা প্রাথমিক লিস্ট।

“সতোরো জন আহত, এর মধ্যে পাঁচজন পুলিশ। দুজনের অবস্থা গুরুতর। দোকানপাট আর লোকসানের কথা নাই বললাম। আর সেই সাথে ওই দুজন মানুষ গায়েব,” বলে সে আতিকুর রহমানের দিকে ফিরে তাকাল। “আমি ভেবেছিলাম পুলিশ ফোর্সের সবচেয়ে দক্ষ একজন মানুষের সাথে কাজ করছি। এই যদি হয় অবস্থা,” বলে সে চুপ হয়ে গেল।

কথাগুলো আতিকুর রহমানের মাথায় বোমার মতো ফাটল সে সব সহ্য করতে পারে কিন্তু… ফরেনসিকের একজন এসে তার সাথে দেখা করতে চাইলে সে অনুমতি দিল।

“স্যার আমরা স্পটে এগুলো পেয়েছি। আগুন ছাড়াই ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য মূলত এগুলোই দায়ী।”

“স্মোক গ্রেনেড,” মনে মনে সে খুবই আশ্চর্য হলো। একই জিনিস কোর্টের প্রাঙ্গণেও পাওয়া গিয়েছিল। এরা এগুলো পেল কই! ব্যাপারটা এখন আর খেলা খেলা নেই। এবার তার ইগোতে লেগেছে। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। তবে তার মনের ভেতরে কী যেন একটা তাকে খোঁচাচ্ছে কিন্তু সে ধরতে পারছে না কোনোভাবেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *