২৫শে মার্চ – ২৪

২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় এলাকা
২৬শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত ২টা ৩০ মিনিট

মনিরুজ্জামান প্রায় নিশ্চিত ছিল গাড়িটা থেকে ওদেরকে লক্ষ করে গুলি করা হবে। আর গাড়িটার সাথে তাদের দূরত্বও এতই কম ছিল যে দৌড়ে সেটাকে কভার করা সম্ভব ছিল না। তারপরও তিনজনে দৌড়াচ্ছিল প্রাণপণে। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে গাড়িটা তীব্র বেগে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ঠাসঠাস একটানা কয়েকটা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। গাড়িটা প্রায় সাথে সাথেই টালমাটাল হয়ে রাস্তার পাশের আইল্যান্ডে উঠে কাত হয়ে থেমে গেল।

ওরা ততক্ষণে দেয়ালের কাছে অন্ধকার কোণে পৌঁছে গেছে। অন্ধকারে থেমে গিয়ে তিনজেনই হাঁপাতে লাগল। মনিরুজ্জামান এই প্রথম খেয়াল করল যে গাড়িটা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে গেছে ওটা মিলিটারি জিপ না। একটা সাদা গাড়ি। ওটার পেছনে একটা ধাওয়া করে একটা মিলিটারি জিপ ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল। ওটা থেকেই সামনের গাড়িটাকে গুলি করা হয়েছে। মিলিটারি জিপটা গিয়ে ওই গাড়িটার পেছনে থেমে গেল। ততক্ষণে টহলরত একটা জিপও ওখানে চলে এসেছে। দুটো জিপ থেকেই অস্ত্র হাতে কয়েকজন মিলিটারি নেমে এসে গাড়িটাকে ঘিরে দাঁড়াল।

মনিরুজ্জামান মনে মনে ভাবল তাদের উচিত এখন দেয়াল পার হয়ে হলের এলাকাতে ঢুকে যাওয়া কিন্তু সামনের দৃশ্যটা থেকে সে চোখ ফেরাতে পারল না। তিনজনই সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে।

গাড়িটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারিদের একজন সাদা গাড়িটার দরজা খুলে ফেলল। অপর একজন গাড়ির ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করল মোটাসোটা একজন মানুষকে। মনিরুজ্জামান অনুমান করল সম্ভবত কোনো শিক্ষক তার গাড়িটা নিয়ে পালাতে চাচ্ছিল, মিলিটারিরা তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলেছে। আর গাড়িটার দিকে লক্ষ ছিল বলেই তাদেরকে খেয়াল করেনি পেছনের মিলিটারি জিপটা। মিলিটারিরা লোকটাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে ইচ্ছেমতো লাথি আর বন্দুকের নল দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে মাটিতে শুইয়ে দিল। লোকটার এই অবস্থা দেখে গাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার করতে করতে নেমে এলো বয়স্ক এক মহিলা। মহিলা লোকটার কাছ পর্যন্ত আসার আগেই তাকে গুলি করে ফেলে দিল একজন। অপর একজন মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকা লোকটার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করল। গাড়ির ভেতরে সম্ভবত আরও কেউ ছিল দুই পাশ থেকে গাড়িটার ওপরে কয়েকরাউন্ড ব্রাশ ফায়ার করে গেল তারা। গাড়ির ভেতর থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে আসার মাঝপথেই থেমে গেল তীব্র গুলির শব্দে।

মনিরুজ্জামান আবু আর কবিরকে দেখল। বীভৎস দৃশ্যটা সবাইকেই নাড়া দিয়ে গেছে। আবুর চোখে পানি, কবির জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে সামনে। সে ওদের দুজনের কাঁধে হাত রাখল। “চল, আমাদের এখন যেতে হবে।”

তিনজনে মিলে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকল। দেয়াল পার হয়ে ওরা জগন্নাথ হলের দিকে কোনাকুনি এগোল। হলের এলাকার এই অংশটাতে একটা ছোট ক্যান্টিন, তার ঠিক পেছনে বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখার একটা স্টোররুম। এখান থেকে হলের সামনে মাঠের একটা অংশ চোখে পড়ে। মাঠের পরেই হলের মূল ভবন।

ক্যান্টিনটা পার হয়ে ওরা চলে এলো স্টোররুমের পেছনে। ওরা যতই এগোচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ ততই বাড়ছে। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দের সাথে মর্টারের গোলাবর্ষণ হতে হলের উত্তর দিকের একটা অংশ ধসে পড়ল। মনিরুজ্জামান স্টোররুমের কোণা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল। এতক্ষণ যে আলো চোখে পড়ছিল সেটা কোনো লাইটের না। দারোয়ানদের কোয়র্টারের একটা অংশ দাউদাউ করে জ্বলছে। সেটার আলোয় চারপাশ আলোকিত। সেই আলোয় সে দেখতে পেল জ্বলন্ত কোয়ার্টারের সামনে কয়েকটা মৃতদেহ পড়ে আছে।

“বানচোত, শালাদের এতটুক মুনষ্যত্ব নেই। মৃতদেহগুলো এমনভাবে ফেলে রেখেছে যেন কুকুর-বিড়াল মরে পরে আছে,” মনিরুজ্জামান দেখল আবু তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

“থাকলে কি আর ওরা এসব করে,” মনিরুজ্জামান জবাবে বলল। “চল এদিকে সুবিধা হবে না। স্টোররুমের অন্য পাশে গিয়ে দেখি ওদিকের কী অবস্থা।” তারা সবাই মিলে স্টোরের অন্য পাশে চলে এলো। এখান থেকে হলের একটা অংশ এবং সামেনের মাঠের প্রায় পুরোটাই চোখে পড়ে। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, ‘সারেন্ডার সারেন্ডার, অর শ্যাল বি কিলড’ ‘সারেন্ডার সারেন্ডার, অর শ্যাল বি কিলড’ সেই সাথে বিভিন্ন দিক থেকে ভেসে আসছে ব্রাশ ফায়ার আর সিঙ্গেল শটের শব্দ।

মনিরুজ্জামান স্টোরের এক কোণে বসে সামনে দেখার চেষ্টা করল। এখান থেকে পুরো মাঠ আর হলের সামনের পুরোটা পরিষ্কার চোখে পড়ে। প্রথমেই চোখে পড়ল ট্যাংকটা। মাঠের কোণে একটা নির্দিষ্টি জায়গায় বারবার ওটা সামনে যাচ্ছে আবার পেছনে আসছে। প্রথম দেখায় সে বুঝতে পারল না ট্যাংকটা আসলে করছে কী। মনিরুজ্জামানের কাছে মনে হলো কিছু একটা সমান করছে। ট্যাংকটা থেকে কিছুটা দূরে স্তূপাকৃতির কিছু একটা তেরপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। জিনিসটা কী বোঝা গেল না। ওটার ঠিক পাশেই চার-পাঁচ জন মিলে একটা গর্ত খুঁড়ছে। মিলিটারিরা পাহারা দিচ্ছে খুঁড়তে থাকা লোকগুলোকে। গর্তটা খোঁড়া শেষ হতে লোকগুলো উঠে এলো ওপরে। লোক না বলে ছেলে বলাই ভালো। নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছেলেগুলো উঠে আসতেই ওদেরকে গর্তটার পাড়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। দুজন মিলিটারি একে একে গুলি করে অবলীলায় সবাইকে গর্তে ফেলে দিল। একটা ছেলে বসে এক মিলিটারির পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগল। মিলিটারিটা কোমর থেকে পিস্তল বের করে তার মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে লাশটা ঠেলে ফেলে দিল গর্তে।

“উফফফফ,” মনিরুজ্জামান চোখ ফিরিয়ে নিল, এত বীভৎসতা আর সহ্য হচ্ছে না। মনিরুজ্জামান সরে এসে বসে পড়ল। সে আর সহ্য করতে পারছে না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পশু হয়ে গেছে। ওদেরকে আর মানুষের পর্যায়ে ফেলা যায় না। আজ রাতেই এরা বাঙালিদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। আর সেটার মূল হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে নিষ্ঠুরতা। সে আবারও উঠে দাঁড়িয়ে আবু আর কবিরের পাশ থেকে উঁকি দিল। তেরপলে ঢাকা জিনিটার ওপর থেকে এখন তেরপল সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ওটা আসলে কোনো জিনিস না। ওখানে লাশ স্তূপ করে রাখা। কমপক্ষে পঁচিশ থেকে ত্রিশটা লাশের কম হবে না। ট্যাংক দিয়ে ঠেলে লাশগুলো গর্তটাতে ফেলে দেওয়া হলো। এরপর গর্তের আলগা মাটিগুলো ফেলে ট্যাংকটা উঠে এলো গণকবরটার ওপরে। আবারও আগে-পিছে করে মাটি সমান করতে লাগল। মনিরুজ্জামান বুঝতে পারল এর আগেও ট্যাংকটা আসলে আরেকটা গর্তের মাটি সমান করছিল।

এই বীভৎস দৃশ্য আবু আর সহ্য করতে পারল না। সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বমি করে দিল হড়হড় করে। কবির ওকে সাহায্য করতে করতে জানতে চাইল, “স্যার, এখন কী করবেন? এদিকে তো নারকীয় অবস্থা। পুরো হলেই মনে হয় রেইড চলছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই মেরে ফেলছে। আর ওদিকে রাস্তায় জিপের টহল, বেরোলেই গুলি করবে। এখন আমরা কী করব?”

মনিরুজ্জামান চুপচাপ ভাবতে লাগল। আজ রাত তার কাছে মনে হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার রাত। “কিছুই করার নেই। আমরা আগের পরিকল্পনাতেই ঠিক থাকব। কারণ যেহেতু পেছনে গেলেও বিপদ, আর সামনে গেলেও বিপদ কাজেই আমরা সামনেই এগোব। চল।”

তারা উঠে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে খানিকটা খোলা জায়গা পার হয়ে এলো। অন্ধকার থাকাতে তেমন একটা অসুবিধা হলো না। এখান থেকে পাঁচশ গজের মতো দূরত্বে একটা লাকড়ির গুদাম। ওটার ওপরে টিনের ছাদ কিন্তু চারপাশ খোলা। লাকড়ির গুদামটার ঠিক পরেই হলের মূল ভবন শুরু। কিছুটা দূর যেতে পারলে হলের একটা অংশে উঠে যেতে পারবে। কিন্তু লাকড়ির গুদামের আগে এই পাঁচশ গজ দূরত্ব পেরোনোটাই ঝামেলা। কারণ আগুনের আলোয় এই অংশটা একদম আলোকিত হয়ে আছে।

অন্ধকারের এক কোণায় দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল মনিরুজ্জামান। “শোন, এখান থেকে আমরা যতটা সম্ভব আস্তে আস্তে মাটিতে শুয়ে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে এগোব। খুব সাবধানে আর খুব আস্তে। ভুলেও কোনো শব্দ করবি না, আর যদি কেউ কাছাকাছি চলে আসে তবে থেমে যাবি, মাটিতে শুয়ে থাকবি লাশের মতো, যাতে ওরা আমাদেরকে মরা মনে করে। বুঝেছিস? খুব সাবধানে।”

ধীরে ধীরে মাটিতে শুয়ে ওরা অনেকটা হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে এগোতে এগোতে আলোকিত জায়গাটায় প্রবেশ করল। মাটিতে ঘাস আছে, তাই তেমন একটা কষ্ট হচ্ছে না কিন্তু ঘাস সামান্য ভেজা ভেজা তাই কাপড়চোপড় আঠা আঠা হয়ে গেল। তিনজনই খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। মনিরুজ্জামান ভালোভাবে বাম দিকে খেয়াল রাখছে। কারণ কেউ দেখতে পেলে বা এদিকে আসলে ওদিক থেকেই আসবে। যতই এগোচ্ছে ততই বাড়ছে আগুনের চড়চড় শব্দ আর হলের ভেতর থেকে ভেসে আসা গুলি আর আর্তনাদের শব্দ। যদিও এগোচ্ছে তবুও সে বুঝতে পারছে না আসলে ওদিকে গিয়ে কী হবে। যে অবস্থা তাতে সামনে এগোলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তবুও এগোতে হবে। লাকড়ির গুদাম এখনও প্রায় একশ গজ দূরে। ধীরে ধীরে এগোলেও এখনও তেমন কোনো ঝামেলা হয়নি। নিজের ভয়কে ভেতরে চেপে রেখে এগোতে লাগল সে।

হঠাৎ দুজন সৈন্য কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো হলের ভেতর থেকে সৈন্য দুজন কথা বলতে বলতে ওদের একদম কাছে এসে দাঁড়াল। তিনজনই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। চেষ্টা করছে নিজেদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলতে। একটু এদিক-ওদিক হলেই এখন ধরা পড়ে যাবে। এমনকি সৈন্যরা যদি একটু এদিকে ফিরে ভালোভাবে তাকায়ও তাহলেও ধরা পড়ে যাবে ওরা। ভয়ংকর পরিস্থিতি।

সৈন্য দুজন কথা বলতে বলতে সিগারেট ধরাল। লাইটার জ্বলে ওঠার খস্ শব্দটাও পরিষ্কার শুনতে পেল ওরা। দুজনে বিড়ি টানছে আর কথা বলছে। ওরা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। দুজনে আলাপ করছে হল রেইড দেওয়ার কথা। ওদের পুরো একটা দল এখনও হলের ভেতরে প্রতিটা রুম সার্চ করছে। পুরো হলটাকে আরও কয়েকদফা সার্চ করতে হবে দেখে দুজনেই বিরক্তি প্ৰকাশ করল। সিগারেট টানা শেষ হতে দুজনে আবার রওনা দিল হলের দিকে মনিরুজ্জামান দুজনের দিকে ইশারা করে দ্রুত এগোল লাকড়ির গুদামের দিকে।

গুদামের কাছাকাছি অন্ধকারে আসতেই দ্রুত গুদামে স্তূপ করে রাখা লাকড়ির আড়ালে চলে গেল হামাগুড়ি দিয়ে। লাকড়ির স্তূপের আড়ালে এসে বড় বড় করে দম নিতে লাগল সবাই।

“উফফফ আজ রাতে ভাগ্য আর কয়বার আমাদেরকে সাহায্য করবে!” কবির হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

“আর বেশি করবে না, কিন্তু তারপরও আমি এগিয়েই যাব,” মনিরুজ্জামান বলল। নিজের ভেতরে সে আশ্চর্য এক শক্তির আভাস টের পাচ্ছে। নিজেকে এরকম ভয়ংকর তার এর আগে কখনো মনে হয়নি। হয়তো বা চোখের সামনে এই বীভৎস নিষ্ঠুরতার কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক। “আমি কিছুতেই জিনিসটা হাতছাড়া করতে পারব না। আর এই বদমাইশ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে তো কিছুতেই পড়তে দেব না।”

“এখন আমরা কী করব, স্যার? হলের ভেতরে তো ঢোকা যাবে না। ভেতরে পাকিস্তানিরা রেইড দিচ্ছে। আরও নাকি কয়েক রাউন্ড রেইড দেবে,” আবু বলল।

“আস্তে, গাধা কোথাকার,” কবির মৃদু স্বরে আবুকে ধমকে উঠে মনিরুজ্জামানের দিকে ফিরে বলল, “স্যার, ভেতর দিয়ে না গেলে তো এদিক দিয়ে আর বেরোনোর রাস্তা নেই।”

মনিরুজ্জামান একবার সামান্য মাথা উঁচু করে লাকড়ির ফাঁক দিয়ে হলের দিকে দেখল। মাঠে এখনও ট্যাংকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। হলের দিকের আরেকটা অংশে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। হলের ভেতর থেকে প্রায়ই ভেসে আসছে গুলির সিঙ্গেল শট।

“আমাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই, ভেতরেই ঢুকতে হবে। আমরা এক সাইড দিয়ে ঢুকে অন্যপাশে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। পেছন দিকে যেতে পারলে হলের পুকুর পাড় ধরে অন্যপাশের দেয়ালের কাছাকাছি চরে যাওয়া যাবে। তারপর দেয়াল টপকে কোয়ার্টার এলাকা,” এই পর্যন্ত বলে সে একটু থামল। “যতটুকু বললাম ওই পর্যন্ত যাওয়া প্রায় অসম্ভব কিন্তু…শশশশ,” মনিরুজ্জামান ভয়ে জমে গেল। খুব কাছেই কোথাও থেকে একটা শব্দ শুনেছে। শব্দটা এতই কাছে, সে জমে গেছে একদম।

“স্যার?”

“শশশশ, কেউ একজন আছে এখানেই কোথাও,” বলে সে হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একপাশে জমা করা কিছু লাকড়ির দিকে তাকাল। শব্দটা ওই দিক থেকেই এসেছে। হালকা পায়ে সে ওদিকে এগিয়ে গেল। লাকড়ির স্তূপটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ স্তূপটা ভাগ হয়ে এদিকে-ওদিকে ছিটকে পড়ল কিছু লাকড়ি। ভেতর থেকে কেউ একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল মনিরুজ্জামানের ওপরে। মনিরুজ্জামান কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে পড়ে গেল দুজনেই।

লোকটা মনিরুজ্জামানকে দুই হাতে ধরার চেষ্টা করছে আর সে চেষ্টা করছে ছাড়ানোর। আবু আর কবির হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। লোকটা মনিরুজ্জামানের পায়ে ধরে আছে শক্ত করে, আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে।

আতঙ্কের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার সাথে সাথে মনিরুজ্জামান শুনতে পেল লোকটা আবোল-তাবোল বকছে আর তাকে ছেড়ে দিতে বলছে। “এই এই থামো থামো,” মনিরুজ্জামান তাকে তুলে ধরে শক্ত করে ঝাঁকি দিল। “থামো।”

“স্যার আস্তে, মিলিটারিরা শুনে ফেলবে,” কবির মনিরুজ্জামানকে সাবধান করল।

“এই এই শান্ত হও,” লোকটাকে ধমকে ওঠার সাথে সাথেই সে চিনতে পারল তাকে। এই লোকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সম্ভবত কোনো অনুষ্ঠানে বা মিটিঙে পরিচয় হয়েছিল। “ইনি, ইনি জগন্নাথ হলের শিক্ষক। এখানে কী যেন একটা দায়িত্বে আছেন,” ওদের উদ্দেশে কথাটা বলে মনিরুজ্জামান লোকটাকে শক্ত করে ধরে বলল, “স্যার আপনি এখানে কী করছেন? স্যার? আমাকে চিনতে পেরেছেন, আপনার সাথে একটা মিটিঙে পরিচয় হয়েছিল।”

“কে কে? ও আমি আমি বুঝতে পারছি না,” লোকটা এখনও পুরোপুরি শকে আছে।

“স্যার আপনি এখানে এই লাকড়ির স্তূপের নিচে কী করছেন?” আবু আর কবির তাকে ধরে আছে দুপাশ থেকে।

“একটু পানি খাওয়া যাবে?” অসহায়ের মতো সে দুপাশে দেখল।

“না স্যার, আমরা এখানে লুকিয়ে আছি। পানি তো নেই। কী হয়েছিল এখানে?”

“ও পানি নেই। ওরা,” বলে সে ডুকরে কেঁদে উঠল। “আমি ইউনিভার্সিটি ক্লাব থেকে এসে বাথরুমে গোসল করছিলাম। হঠাৎ শুনি বাইরে তুমুল শব্দ আর কোলাহল। আমি গোসলখানা থেকে বেরোনোর আগেই ওই সৈন্যগুলো আমার বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। প্রথমেই আমার স্ত্রীকে গুলি করে তারপর আমার বাচ্চা ছেলেটাকে গুলি করে মারে। আর আমি,” বলে সে আবারও কেঁদে উঠল। কাপুরুষের মতো পেছনের দরজা দিয়ে পালাই। ওখান থেকে পেছনের বাগানে বসে দেখি ওরা প্রতিটা কোয়ার্টারে ঢুকে ঢুকে সবাইকে গুলি করে মারছে। শুধুমাত্র একজন শিক্ষক তার গাড়ি নিয়ে পালাতে পেরেছিল।”

মনিরুজ্জামান মনে মনে ভাবল সে-ও পারেনি, সম্ভবত ওই শিক্ষককেই ওরা শহিদ মিনারের সামনে গুলি করে মারতে দেখেছে। সেটা এই ভদ্রলোককে বলল না। “তারপর স্যার?”

“এখানে তো আমরা বেশি শিক্ষক থাকতাম না, শুধুমাত্র হলের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন। সবাইকে মেরে ওরা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢোকে। ওখান থেকে সবাইকে বের করে মাঠে নিয়ে এসে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। সব্বাইকে, একজনকেও ছাড়েনি। আর অন্যদিকে হলের ভেতরে ঢুকে যাকে পায় তাকেই গুলি করে মারতে থাকে। আর কয়েকজনকে বাঁচিয়ে রাখে কবর খোঁড়ার জন্য। কবর খোঁড়া শেষ হলেই ওদেরকেও মেরে ওখানেই কবর দিয়ে দেয়। ইশশশ কী ভয়ংকর। সবাই মারা গেল। আমি বেঁচে আছি। ইশশ ইশশশশ,” লোকটা অঝর ধারায় কাঁদছে। “জানো অনেক ছেলেরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাথরুমে, পুকুরে কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে ছিল। তাও ওরা বাঁচতে পারেনি। সব্বাইকে গুলি করে মেরেছে। এখনও মারছে। আর আমি কাপুরষের মতো বেঁচে রইলাম,” লোকটা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

মনিরুজ্জামান প্রতি পদে পদে অনুভব করছে এখানে থাকাটা চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে সৈন্যরা এখানে চলে আসতে পারে, শব্দ শুনে ফেলতে পারে। শুনে ফেলতে পারে কি? ইতোমধ্যেই শুনে ফেলেছে। তারপরও মানুষটাকে থামাতে পারল না। “আপনি কীভাবে বাঁচলেন?”

“আমি বাগানের ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে ছিলাম। এরপর যখন সৈন্যরা মাঠের ওপরে অন্যদেরকে মারতে যখন ব্যস্ত তখন মাটিতে শুয়ে শুয়ে চলে আসি এখানে। এরপর থেকে লাকড়ির নিচে লুকিয়ে ছিলাম।”

“স্যার, এখান থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তা আছে? হলের ভেতরে না ঢুকে কোনোভাবে বেরোনো যাবে?”

“বেরোনোর রাস্তা…” মানুষটা চুপচাপ ভাবতে লাগল। মনিরুজ্জামান মনে মনে ভাবল এইরকম আতঙ্কের পর এখনও তার চিন্তা করার শক্তি আছে সেটাই অবাক করার বিষয়। “না এখান থেকে হলে না ঢুকে কোনোভাবেই বেরোনো যাবে না। তবে, হলের এইদিক দিয়ে যদি ভেতরে ঢোকো তবে ওখান থেকে কয়েকটা রুম পার হলেই পেছন দিকে পুকুর পাড়ে যাওয়ার একটা রাস্তা আছে।”

হঠাৎ একদম কাছেই কেউ কথা বলে উঠল উর্দু ভাষায়। তিনজনই সাথে সাথে মাটিতে শুয়ে পড়ল লাকড়ির আড়ালে। উর্দু ভাষায় কেউ একজন বলে উঠল সে এখানে নাকি কথা বলার শব্দ শুনেছে, তাই অপরজনকে সার্চ করে দেখতে বলছে কোনো ছাত্র এখানে লুকিয়ে আছে কি না। অপরজন কিছু শোনেনি তাই সে লাকড়ির গুদামের ভেতরে ঢুকতে চাইছে না। দুজনে ঢুকবে কি ঢুকবে না এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে, আর ওরা শক্ত হয়ে পড়ে আছে। হঠাৎ একজন সুন্দর সমাধান দিল। এখানে খুঁজে দেখার দরকার কি? লাকড়ির স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিলেই চলে। পটপট করে কয়েকটা শব্দ হলো আর শুকনো লাকড়ির গাদায় আগুন ধরে গেল প্রায় সাথে সাথেই।

এখন আর লুকিয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। হয় চোখে পড়তে হবে অথবা কিছুক্ষণের ভেতরে আগুনে পুড়ে অথবা ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে। মনিরুজ্জামান ধোঁয়ার হাত থেকে বাঁচতে মুখ চেপে ধরে আবু আর কবিরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল অন্য লোকটাকে তুলে নেওয়ার। আর সে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে হলের পেছন দিকে দেখাল যেদিক দিয়ে পুকুর পাড়ে যাওয়া যাবে। “আমাদেরকে পালাতে হবে, আমি চিনি না কাজেই আপনি আগে থাকবেন। দৌড়ান।”

লোকটা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল। সেও মুখ চেপে ধরে হলের দিকে দৌড় দিল। আর তার পেছনে প্রাণপণে দৌড় দিল বাকি সবাই। সাথে সাথে সৈন্যরা দেখে ফেলল তাদেরকে। উর্দুতে চিৎকার করে উঠল ওদেরকে দেখতে পেয়ে।

“জোরে, জোরে,” মনিরুজ্জামান কোনো রাখঢাক না করে চিৎকার করে বলল। দূরত্বটা ত্রিশ গজেরও কম, সৈন্য দুজন কিছু করার আগেই ওরা পার হয়ে গেল দূরত্বটুকু। ওই শিক্ষক হলের কাছে পৌঁছে জানালা গলে ঢুকে পড়ল, তার পেছনে মনিরুজ্জামান, আবু আর কবির। ওরাও ঢুকল আর জানালার একটা পাল্লা ভেঙে পড়ল গুলির শব্দের সাথে।

ওরা সবাই হলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। যে রুমটায় ঢুকেছে ওটাতে লাইট জ্বলছে। পুরো রুম লন্ডভন্ড

শিক্ষক ভদ্রলোক থেমে গিয়েছিল মনিরুজ্জামান তাকে ঠেলে দিল সামনের দিকে। “থামবেন না। আপনি পথ দেখান।

ওরা মানুষটাকে অনুসরণ করে অন্য একটা রুমে ঢুকে পড়ল। এটার এক কোণে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে।

“এটা, এটা না, দাঁড়ান,” ভয়ে আতঙ্কে লোকটা গুলিয়ে ফেলেছে।

“জলদি করুন,” মনিরুজ্জামানের মনে হলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভেতরে তো মিলিটারি আছেই, যেকোনো সময় বাইরের সৈন্যরাও ভেতরে ঢুকে পড়বে। দ্রুত এখান থেকে বের হতে না পারলে আর রক্ষা নেই। “জলদি।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ,” লোকটা উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলো করিডরে। “পেয়েছি, এদিকে।”

ওরা সবাই করিডর ধরে ছুটল। পুরো করিডর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এখানে-ওখানে পড়ে আছে মৃতদেহ। সমস্ত হলঘরটাকে দেখাচ্ছে কসাইখানার মতো। “ডানে ডানে।”

ওরা সবাই ডান দিকে ঘুরে গেল। লোকটার পেছনে পেছনে কবির আর আবু, সবার শেষে মনিরুজ্জামান ডানে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেল করিডরের অপর প্রান্ত ধরে ছুটে আসছে কয়েকজন। সময় নেই সময় নেই।

লোকটা ডানে ঘুরে চলে এলো রান্নাঘরের পেছনে। একটা টিনের দরজা হাঁট করে খোলা, সেটা দিয়ে বেরিয়ে এলো সবাই পুকুর পাড়ে। সামনেই পুকুর। পেছনে রান্নাঘর থেকে উর্দুতে চিৎকার ভেসে আসছে। কোনোরকম চিন্তা না করেই মনিরুজ্জামান ঝাঁপ দিল পুকুরে। অন্ধকার কালো পানি তাকে গিলে নিল সাথে সাথেই। একবার ডুবে ভেসে ওঠার সাথে সাথে আবার ডুব দিল নিচের দিকে।

কচুরিপানা ভরতি পুকুরটার একদম নিচের দিকে নেমে এসে ডুবসাঁতার দিয়ে সামনের দিকে এগোল। কতক্ষণ পানির নিচে ডুবে ছিল বলতে পারবে না। দম ফুরিয়ে যেতে আবার ভেসে উঠল। কচুরিপানার ফাঁক দিয়ে শ্বাস নিতে নিতে দেখল পুকুর পাড়ে সৈন্যরা লাইট মেরে মেরে দেখছে পানিতে। টানা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ কানে আসতেই আবারও নিচের দিকে ডুব দিল সে। এবার ডুবসাঁতার কেটে চলে এলো পুকরের একেবারে অপর প্রান্তে। আবারও দম ফুরিয়ে যেতে উঠে এলো ওপরের দিকে। পুকরের পাড় থেকে পানির ওপর ঝুলে থাকা একটা ঘন ঝোপের ভেতরে নিজেকে আড়াল করে বসে রইল চুপচাপ।

এই প্রথম খেয়াল করল পুকুরে জায়গায় জায়গায় অনেকগুলো মৃতদেহ ভাসছে। আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সৈন্যরা সবাই যখন পুকুর পাড় থেকে চলে গেল, তার আরও আধা ঘণ্টা পর উঠে এলো পুকরের পাড়ে। উপরে উঠে ঝোপের ভেতরে ঘাসের ওপর শুয়ে হাঁপাতে লাগল।

শুয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছে হঠাৎ একটা হাত পড়ল তার কাঁধে। সে চমকে উঠে বসার আগেই মানুষটা বলে উঠল, “স্যার আমরা।” আবু আর কবির চপচপে ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“শশশশ আস্তে,” মনিরুজ্জামান বলল। “সৈন্যরা কেউ আছে?”

“না, পুকুর পাড়ে এখন কেউই নেই। সবাই চলে গেছে।”

“ওহহহ আল্লাহ মেহেরবান তোরা বেঁচে আছিস। হয়েছিল কী?” সে জানতে চাইল।

“স্যার আপনি পানিতে লাফিয়ে পড়ার সাথে সাথেই আমরা লাফ দেই। কিন্তু ওই লোকটা, মানে স্যার। তিনি আর লাফিয়ে পড়তে পারেননি। ভয়ে হোক আর যেকোনো কারণেই হোক তিনি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সাথে সাথে পেছন থেকে মিলিটারিরা তাকে গুলি করে। তিনি গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যান। এরপর সৈন্যরা পানিতে লাইট মেরে আমাদেরকে খুঁজতে থাকে আর এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে। আমরা দুজনেই ডুবসাঁতার দিয়ে কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে ছিলাম। আর পানিতে এমনিতেই অনেক লাশ পড়ে ছিল তাই ওরা আর বুঝতে পারেনি আমরা মরেছি না মরিনি। এর কিছুক্ষণ পর আর কিছু নড়তে-চড়তে না দেখে ওরা চলে যায়। তখন স্যার আমরা আপনাকে পাড়ে উঠতে দেখে এদিকে চলে আসি।”

“আহারে লোকটা লাকড়ির গুদামে লুকিয়ে ছিল। আমাদের সাথে দেখা না হলে বোধ হয় বেঁচেই থাকত। মানুষটা পানি খেতে চেয়েছিলেন। পারেননি, শেষ পর্যন্ত পানিতেই তার সমাধি হলো। আল্লাহ তাকে বেহশত নসিব করুক,” বলে সে একটু থামল। “চল, আমরা এগোই।”

তিনজনেই গায়ের কাপড় খুলে চিপে নিল। মনিরুজ্জামান আরেকবার কোমরে বেঁধে রাখা প্যাকেটটা চেক করে নিল। এত ঝামেলার মাঝেও জিনিসটা এখনও ঠিকভাবে আছে দেখে সে অবাকই হলো।

তিনজনে মিলে পুকুর পাড়ের সাথেই দেয়াল টপকে টিচার্স কোয়ার্টার এলাকায় প্রবেশ করল। এটা টিচার্স কোয়ার্টার এলাকার পেছন দিকটা। কোয়ার্টারের এই অংশটাতে বাগান। এদিক দিয়ে সিকি মাইলের মতো এলাকা এগিয়ে গেলে মসজিদ। আর মসজিদের ঠিক পরের বাসাটাই মনিরুজ্জামানের বিল্ডিং। ওই বিল্ডিঙের দোতলায় থাকে সে।

মনিরুজ্জামান ইশারায় ওদেরেকে দাঁড়াতে বলল। সে ওদেরকে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে একটা বিল্ডিঙের এক পাশ থেকে উঁকি দিল। এখানেও মিলিটারিরা আছে। কোয়ার্টারগুলোর সামনের রাস্তায় জিপে করে টহল দিচ্ছে। কোয়ার্টার এলাকার সামনের দিকের মাঠে বেশ কয়েকটা মিলিটারি ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সে চোখ সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল হঠাৎ দেখল কোয়ার্টার বিল্ডিঙের ভেতর থেকে দুজন মিলিটারি টানতে টানতে একটা মেয়েকে টেনে বের করে ট্রাকে নিয়ে ওঠাল।

আবু আর কবিরের কাছে ফিরে এসে বলল, “খুব সাবধানে। এখানেও মিলিটারি পাহারা আছে। সামনের দিকে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা এখানে পেছনের বাগান দিয়ে এগোব। মসজিদ পার হয়ে আমার বাসার পেছন দিকে গিয়ে দোতলা পর্যন্ত বেয়ে উঠে যাব। ওখান থেকে জিনিসটা নিতে হবে?”

“স্যার এখান থেকে বেরোবেন কীভাবে?” কবির প্রশ্ন করল।

“এখনও জানি না। তবে কিছু একটা বের করে ফেলব। প্রয়োজনে সকাল পর্যন্ত এখানেই লুকিয়ে থাকব। দেখা যাক আগে জিনিসটা হাতে আসুক। পরেরটা পরে দেখা যাবে। এখন এগোই।”

 অন্ধকারে সবাই সাবধানে সামনে এগোল। মসজিদ পার হয়ে কোয়ার্টারের পেছনে চলে এলো সহজেই। নিজের কোয়ার্টারের পেছেনে এসে মনিরুজ্জামান থেমে গেল। “তোরা এখানেই দাঁড়া। আমি নিয়ে আসছি।”

মনিরুজ্জামান বাড়ির পেছনের পাইপ বেয়ে উঠতে লাগল। দোতলা পর্যন্ত উঠে এলো সহজেই। পাইপ বেয়ে বাথরুমের জানালার কাছে এসে থেমে গেল। এক হাতে পাইপ ধরে অন্য হাতে জানালার ভেতরে হাত গলিয়ে ভেতর থেকে সিটকিনিটা খুলে ফেলল। এরপর মৃদু ঠেলা দিতেই জানালার গ্রিলটা খুলে উন্মুক্ত হয়ে গেল জানালাটা। শরীরটাকে একটা দোল দিয়ে জানালার ওপরের কার্নিস ধরে পা রাখল জানালার তাকে। এরপর ধীরে ধীরে সহজেই নেমে এলো বাসার বাথরুমে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোল বেডরুমের দিকে। বাতি জ্বালানো যাবে না। বেডরুমে বিছানার পাশে টর্চ লাইট আছে, ওটা দিয়ে খুঁজে বের করতে হবে প্যাকেটটা। বেডরুমের সামনে এসে সে দরজাটা হালকা ঠেলা দিল। ভেতরে একদম অন্ধকার। কীসের যেন পোড়া পোড়া গন্ধ। সে বিছানার দিকে এগোতে যাবে খট করে লাইট জ্বলে উঠল।

“হ্যালো মি. মনিরুজ্জামান, আমি কর্নেল হাবিব,” মনিরুজ্জামান দেখল তার বিছানায় বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে সিভিলিয়ান পোশাক পরা একজন মানুষ। তার পাশেই মিলিটারি পোশাকে দুজন দাঁড়ানো।

মনিরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে লোকটা আবারও পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে উঠল, “আমরা অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার ধারণা আপনার সাথে আমার দীর্ঘ আলাপচারিতা আছে।”

মনিরুজ্জামান কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানের ওপরে বন্দুকের বাঁটের আঘাতে জ্ঞান হারাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *