২৫শে মার্চ – ২০

২০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
২৬শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত প্রায় ২টা

“স্যার এখন আমরা কোনদিকে যাব?” কবির জানতে চাইল। “আমাদের পরিকল্পনার তো বারোটা বেজে গেছে।”

“হ্যাঁ, তাই তো…,” হঠাৎ টাশশশশ, টাশ টাশ টাশ গুলির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। “…মনে হচ্ছে,” মনিরুজ্জামান তার মুখের কথা শেষ করল। তিনজনই ফ্যাকাল্টির লাইব্রেরির বারান্দা দিয়ে হাঁটছিল হঠাৎ খুব কাছেই গুলির তীব্র শব্দে বসে পড়ল রেলিঙের নিচে।

“স্যার এদিকেও আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে নাকি? এরা তো দেখি সমানে মানুষ মারতেছে,” আবু আতঙ্কিত গলায় বলল।

“হ্যাঁ, এখন তো তাই মনে হচ্ছে,” মনিরুজ্জামান রেলিঙের ওপরে মাথা তুলে বোঝার চেষ্টা করছে গুলির শব্দ কোনদিক থেকে এলো। “এটা মনে হয় রাস্তায় কাউকে গুলি করে মারল। মনে হলো বড় মাঠের সামনে। আবার টিচার্স কোয়ার্টারেও হতে পারে।”

“স্যার, আমরা তো সোহেলকে কার্জনে লুকিয়ে থাকতে বললাম, ওকে আবার খুঁজে পেয়ে মেরে ফেলবে না তো?”

কবির ধমকে উঠল আবুকে, “তোর যত সব উদ্ভট কথা। এখন সোহেলের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা কর,” বলে সে মনিরুজ্জামানের দিকে ফিরে বলল, “স্যার এখন কী করবেন? এখান থেকে তো মনে হচ্ছে না আমরা কোয়ার্টারে যেতে পারব।”

“আমিও বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটা জানি আজ রাতে কোয়ার্টার থেকে ওটা না নিয়ে আমি অন্য কোথাও যাচ্ছি না,” মনিরুজ্জামান দৃঢ় স্বরে বলল। “আমি তো আগেও তোদেরকে বলেছি চাইলে তোরা চলে যেতে পারিস।”

“স্যার, আমি সেজন্য বলিনি, আমি বলেছি ম্যাডামের কথাটা একবার চিন্তা করবেন না?”

মনিরুজ্জামান একবার অসহায়ভাবে কবিরের দিকে তাকাতে আবু বলে উঠল, “স্যার, আমি আপনার সাথে আছি, যেখানেই যান আপনি।”

মনিরুজ্জামান এক মুহূর্ত চিন্তা করল, “যেহেতু আমরা আগের পরিকল্পনায় থাকতে পারছি না তাহলে নতুন পথ ধরব। এখান থেকে আমরা দেয়াল টপকে গণিত ভবনের ওদিকে ঢুকে যাব। ওখান থেকে শহিদ মিনার এলাকা ক্রশ করে টিচার্স কোয়ার্টার পার হয়ে জগন্নাথ হল। ওটা পার হতে পারলেই আমরা ফুলার রোডে টিচার্স কোয়ার্টারের পেছন দিকে চলে যেতে পারব। ওখান পর্যন্ত একবার চলে যেতে পারলে টিচার্স কোয়ার্টারে ফিরে যাওয়াটা তেমন কঠিন কিছু হবে না।”

“স্যার ওখানে পৌঁছে আমরা যদি জিনিসটা নিতেও পারি তারপর বেরোব কী করে?”

“সেটা এখনও বলতে পারছি না। আগে তো পৌঁছাই, তারপর দেখা যাবে। আর আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা আছে। আগে থেকে বলে লাভ নেই। ওখানে পৌঁছতে পারলে বুঝতে পারব সেটা কাজে লাগানো যাবে কি না? চল রওনা দেই।”

আবারও তিনজনে মিলে রওনা দিল। মনিরুজ্জামান দুজনকে সাবধান করে দিয়ে বলল, “দুজনেই শুনে রাখ, সাবধান খুব সাবধান। কোনো শব্দ না। কোনো চিৎকার না। আর ভুলেও জান চলে যাওয়ার মতো বিপদে না পড়লে রাস্তায় পা দিবি না। বুঝেছিস?”

মাথা নাড়ল দুজনেই। “এবার চল,” বলে মনিরুজ্জামান চাদরটা ভালো করে গায়ে প্যাচিয়ে নিয়ে বারান্দা থেকে নিচের বাগানের মতো জায়গাটায় নেমে গেল। মুখে আঙুল দিয়ে ইশারায় দুজনকে নিঃশব্দে নেমে আসতে বলল। একে একে দুজনেই নেমে এলো লাফিয়ে। তিনজনে মিলে সন্তর্পণে এগোল সামনের দিকে।

যদিও এই এলাকায় আলো প্রায় নেই বললেই চলে তারপরও এদিকে—সেদিকে টুকরো টুকরো আলো যা আছে ওরা সেটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। আর দুটো ভবন পেরোতে পারলেই গণিত ভবনের দেয়াল। ওই দেয়াল টপকে গণিত ভবনের এলাকায় ঢুকে শহিদ মিনার এলাকা পার হতে পারলে ওখান থেকে ফুলার রোড যাওয়াটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

তারা সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে গণিত ভবনের দেয়ালের দিকে এগোল। যত এগোচ্ছে টাশশ টাশশ আওয়াজ ততই বাড়ছে।

“স্যার, এত শব্দ কীসের? গুলির আওয়াজের মতো মনে হচ্ছে,” আবু বলল।

“তাই তো মনে হচ্ছে,” মনিরুজ্জামান কান পেতে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছে। হাঁটতে হাঁটতে দেয়ালের কাছে চলে এসেছে তিনজনই। দেয়ালের কাছে এসে প্রথমে মনিরুজ্জামান তারপর আবু আর কবির একে একে দেয়াল টপকে পার হয়ে এলো।

দেয়ালের এপাশে নামতেই প্রথমে চোখে পড়ল আগুনের লেলিহান শিখা। রাস্তার ওপাশে কিছু একটা আগুনে পুড়ছে। মাঠের দিকেও মনে হলো যেন আগুনের অংশ বিশেষ চোখে পড়ল। গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তনাদে চারপাশ প্রকম্পিত। মাঠের কাছ থেকে একটা কামানের গোলাবর্ষণের আওয়াজ ভেসে এলো।

“স্যার এখানে তো মনে হচ্ছে নরক নেমে এসেছে। এখান দিয়ে যাবেন কীভাবে?” কবির উৎকণ্ঠার সাথে বোঝার চেষ্টা করছে আসলে এখানে হচ্ছেটা কী!

তারা তিনজনই মাথা নিচু করে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বসে আছে। “আমিও বুঝতে পারছি না। এখানকার পরিস্থিতি আসলেই খারাপ। কিন্তু এদিক দিয়ে যদি যেতে না পারি তাহলে তো আর উপায় নেই। তোরা এখানেই অপেক্ষা কর, আমি একটু পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করে আসি।”

মনিরুজ্জামান একটা ভবনের কোণা থেকে উঁকি দিল। এখান থেকে শহিদ মিনারের একটা অংশ চোখে পড়ে। শহিদ মিনারের সামনের অংশে মিলিটারি আর মিলিটারি ট্রাক গিজগিজ করছে। ভিড়ের ভেতরে সে দুটো ট্যাংকও দেখতে পেল। এখান দিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনাতেও আনা সম্ভব না।

ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই তীব্র শব্দে চারপাশ প্রকম্পিত হলো। মাটিতে মৃদু কাঁপনের সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেল সে।

মনিরুজ্জামান নিজেকে একটু সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার উঁকি দিল শহিদ মিনারের দিকে।

একবার ভাবল আধো অন্ধকারে ভুল দেখছে, যদিও ওদিকটা যথেষ্ট আলোকিত। কিন্তু ভুল দেখাটাও অস্বাভাবিক না। কারণ চোখের সামনে থেকে শহিদ মিনারটা পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেছে। যেখানে শহিদ মিনার ছিল সেখানে এখন কিছুই নেই।

পুরো শহিদ মিনারটাকেই ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *