২৫শে মার্চ – ৩৪

৩৪

রাজবাড়ি, গাজীপুর
২৬শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : সকাল প্রায় ৬টা

মনিরুজ্জামান শেষবারের মতো সবকিছু দেখে নিচ্ছে। সে একবার তার ঘড়ি দেখল। তারা এখানে আসার পর পঞ্চাশ মিনিট পার হয়েছে। তার মানে কর্নেল যদি রওনা দিয়ে থাকে তাহলে কিছুক্ষণের ভেতরেই পৌঁছে যেতে পারে এখানে। তার পরিকল্পনাটা খুবই সংক্ষিপ্ত এবং পরিচ্ছন্ন। তবে কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে। সে হিসাব করে দেখেছে তাদের আছে দুইটা বন্দুক। একটা তার কাছে থাকবে আরেকটা কবিরকে দিয়ে সে তাদের বাড়ির ছাদে তুলে দেবে। আজমত চাচা আর তার এক ভাতিজা রামদা হাতে ভেতরে মেয়েদের রুমের পাহারায় থাকবে। আর আবুর ওপর বর্তিত হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য একটা দায়িত্ব। মনিরুজ্জামান তার অবস্থানটা আরেকবার দেখে নিল। কোমরের পেছন থেকে বের করে আনল বিরাট ছুরিটা। তার বাবার ছুরি এটা, প্ৰায় এক ফুট লম্বা। সামান্য ধার করে নেওয়াতে একদম চকচক করছে কিনারগুলো। সে ছুরিটাকে কোমরের পেছনে রেখে দিল।

ইতোমধ্যেই বাইরের বাড়ির লোকজন সবাইকে ভেতরে সরিয়ে আনা হয়েছে। মেয়েদেরকে নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে ভেতরের রুমে। শেষবাবের মতো সবকিছু ঠিকঠাক করে মনিরুজ্জামান পুরো ব্যাপারটা আরেকবার খতিয়ে দেখল। নাহ এখনও তেমন বড় ধরনের কোনো দুর্বলতা চোখে পড়ছে না। নিজের জায়গা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির ভেতরে এসে নার্গিসকে রাখা রুমে নক করতে আজমত চাচার বউ দরজা খুলে দিল। মনিরুজ্জামান ভেতরে ঢুকে দেখল নার্গিস দুর্বল হয়ে শুয়ে আছে। তার মাথায় ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে পানি দিচ্ছে একটা মেয়ে। একটু আগেও নার্গিস প্রসব ব্যথায় চেঁচামেচি করছিল, এখন আবার কী হলো। সে উদ্‌বিগ্ন স্বরে দাইমার কাছে জানতে চাইল, “কী ব্যাপার? ওর কী হয়েছে?”

“বুঝতাছি না বাজান। মনে অয় খুব দুর্বল অয়া গেছে। কিন্তুক এইরকম সময়ে দুর্বল অওন তো খুব খারাপ। বাচ্চা-মা দুইজনেরই ক্ষতি অইবার পারে।”

“তাহলে এখন কী করবেন?”

“দেহি বাবা…” কারও দৌড়ে আসার শব্দে মহিলা থেমে গেল।

আজমত চাচার ভাতিজা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ভাইজান গাড়ি আইতাছে। ছাদ থাইক্কা আমি পরপর তিনডা আলো দেখছি।”

“তার মানে তিনটা গাড়ি হতে পারে। মনে আছে তো তোমাদেরকে কী করতে হবে?”

“জি ভাইজান। আমার শরীরে এট্টু রক্ত থাকতে কেউ এই দরজা পার অইতে পারব না,” শক্ত করে রামদা দুই হাতে চেপে ধরে সে বলল! মনিরুজ্জামান তার কাঁধে একবার চাপড় দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে নার্গিসকে দেখল। তারপর বেরিয়ে এলো বসার ঘরে।

“কবির গাড়ি আসছে। মনে হয় যা আশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশিই হবে। সম্ভবত তিনটা গাড়ি। তবে প্ল্যানে পরিবর্তন হবে না। যা বলেছি তাই। কবির তুই ছাদে। আবু তুইও তোর পজিশনে চলে যা। সবাই এক্ষুনি। আবু তোর ব্যাগটা খুব সাবধানে।”

“জি স্যার,” আবু টেবিলের ওপর থেকে ব্যাগটা তুলে নিল।

সবাই যার যার পজিশনে রওনা দেওয়ার পর মনিরুজ্জামান তার বন্দুক আর গুলি চেক করল। তারপর বসার ঘরের টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটা চেক করে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। বাইরে বেরিয়ে সে বড় করে নিঃশ্বাস নিল। ভোর হয়ে গেছে। সকালের আর বেশি দেরি নেই। এর আগেই অনেককিছু ঘটে যাবে।

সে বাইরে এসে তার নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান নিয়ে নিল।

.

কর্নেল হাবিবের মেজাজ একটু খিঁচড়ে আছে। একে তো সে তার প্রয়োজন মতো সাপোর্ট পায়নি, তার ওপর রিপোর্ট করতে গিয়ে গালি শুনতে হয়েছে। তবে এখানকার নাটকটা বেশ উপাদেয় হবে বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। কয়েকবার পথ হারিয়ে ফেললেও এবার তারা সঠিক পথেই এগোচ্ছে।

“স্যার, সামনেই মনে হয় বড় কোনো বাড়ি,” মেজর ফয়সল জানাল।

মেজর আমি অন্ধ না। আমিও দেখতে পাচ্ছি। এই ব্যাটাকে জিজ্ঞেস করো,” বলে সে সামনে বসে থাকা ছোটখাটো মানুষটাকে একটা লাথি দিল। খান লজটা খুঁজে বের করার জন্য মূল রাস্তার পাশেই একটা চায়ের বন্ধ দোকানের ভেতর থেকে এই লোকটাকে ধরে আনা হয়েছে।

লোকটা লাথি খাবার সাথে সাথে হাউমাউ করে উঠল, “স্যার এইডাই হেগো বাড়ি। আমারে ছাইড়া দেন স্যার।”

“ঠিক করে বল, হারামজাদা,” মেজর ফয়সল চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিল।

“স্যার, এইডাই।”

কর্নেল ইশরা করল একে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ফয়সল কোনো ঝামেলাতে গেল না। চুলের মুঠি ধরে লোকটাকে স্রেফ ঠেলে ফেলে দিল চলন্ত জিপ থেকে। লোকটা অন্ধকারের ভেতরে একটা চিৎকার দিয়ে মিলিয়ে গেল।

কর্নেল সামনের দিকে তাকাল। বাড়িটার অবয়ব এখন অন্ধকারেও বেশ চোখে পড়ছে। সামান্য আলোও দেখা যাচ্ছে। বিরাট বাড়ি। এধরনের বাড়িতে আগের দিনের জমিদাররা থাকত। কাঁচা কিন্তু বেশ চওড়া রাস্তাটা পার হয়ে তারা বাড়িটার মূল ভবনের সামনের ছোট্ট মাঠের মতো জায়গাটায় এসে থেমে গেল। তিনটা জিপ দাঁড়িয়ে গেল পরপর। কর্নেল গাড়ি থেকে নেমে এলো। তার সাথে সাথে মেজর ফয়সল।

কর্নেল নেমে আসার সাথে সাথে তিনটা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তিনটা ব্যাপার উপলব্ধি করল। প্রথমেই বাড়িটার সামনের ছোট্ট মাঠের একপাশে একটা বটগাছ, ওটার ঠিক পাশেই আর্মি একটা জিপ। তার মানে মনিরুজ্জামান এখানেই এসেছে এবং এখনও আছে। দ্বিতীয়ত, বাড়ির ভেতর থেকে একজন মহিলার মৃদু চিৎকার ভেসে আসছে এবং তৃতীয়ত, কীসের যেন একটা গন্ধ এসে লাগল নাকে…

তৃতীয়টা অনুভব করার আগেই কোথা থেকে যেন তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ ভেসে এলো। কর্নেলের মনে হলো শব্দটা যেন একেবারে কাছেই কোথাও থেকে এলো। শব্দটা হওয়ার সাথে সাথে কাচ ভাঙার শব্দ হতেই কর্নেল মেজর ফয়সলকে চেপে ধরে লাফিয়ে পড়ল একপাশে। উড়ন্ত জিনিসটা এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেয়েছে বলেই সে এবং মেজর দুজনেই প্রাণে বেঁচে গেল। ধাম করে একটা শব্দ আর সাথে সাথে প্রথম জিপটা জ্বলন্ত অঙ্গারে পরিণত হলো। ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন সৈনিক। সবাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে আর তাদের সমস্ত শরীর পরিণত হয়েছে জ্বলন্ত মশালে।

.

মনিরুজ্জামান দেখল তার পরিকল্পনা শতভাগ কাজে দিয়েছে। এটাই ছিল তার বিশেষ পরিকল্পনা। তাদের বাড়ির গুদামে জমা করা ছিল বেশ কয়েক ড্রাম পেট্রোল। ওগুলোকে আনা হয়েছিল ভিন্ন একটা দরকারে কিন্ত কাজে না লাগায় বেশ কয়েক বছর ধরে পড়ে ছিল। মনিরুজ্জামান ওগুলো বোতলে ভরে ভরে মোলোটোভ ককটেল তৈরি করেছে, যেটাকে দেশি ভাষায় বলা হয় পেট্রোল বোমা। এবং এগুলো ছুড়ে মারার দায়িত্ব ছিল আবুর ওপরে।

প্রথম জিপটা জ্বলে উঠতেই বাকি দুটো জিপ থেকে পিঁপড়ের মতোই বেরিয়ে এলো সবাই। সাথে সাথে মনিরুজ্জামান সক্রিয় হলো। বট গাছের পাশে পার্ক করে রাখা জিপটার পেছনের দরজা খুলে গেল। সেখান থেকে মনিরুজ্জামান আগুন ধরিয়ে ছুড়ে মারল আরেকটা বোতল। এটা সে কোনো গাড়িকে উদ্দেশ্য করে মারেনি। এটা সে মেরেছে মাটিতে পড়ে থাকা একটা পাথরে। ওই পাথরটা আসলে নিশানা, ওখান থেকে অনেকটা জায়গার মাটি পেট্রোল দিয়ে ভেজানো ছিল। বোতলটা পড়ার সাথে সাথে আগুন ধরে গেল অনেকখানি জায়গার মাটিতে। সেই সাথে জিপ থেকে বেরিয়ে আসা কয়েকজনের গায়ে। বাকি আরও দুজনকে মনিরুজ্জামান ফেলে দিল দোনলা বন্দুকের দুই গুলিতে।

গুলি করেই সে জিপের নিচে শুয়ে পড়ে গুলি ভরতে লাগল। এবার সে কবিরের গুলির শব্দ আশা করছে।

.

প্রথম বোতলটা ফাটার সাথে সাথে কর্নেল ঠিক যতটা চমকে উঠেছিল দ্বিতীয়টা ফাটার সাথে সাথে তার চমক ভেঙে গেল। সে চিৎকার করে সবাইকে সরে পড়তে বলল পেছন দিকে। আর খুঁজে বের করল দ্বিতীয় বোতলটা কোন দিক থেকে আসছে। অবাক হয়ে দেখল পার্ক করা জিপের ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তার মানে ওখানে কেউ আছে। প্রথমেই সে অবশিষ্টদের নিয়ে সরে এলো খানিকটা দূরে। এরপর তাদেরকে দুদিকে ঘুরিয়ে গুলি করতে বলল। এক গ্রুপ বাড়ির দিকে অপর গ্রুপ গাড়ির দিকে পজিশন নিয়ে ব্রাশ ফায়ার ওপেন করে দিল।

.

মনিরুজ্জামান গুলি ভরতে ভরতেই ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়ে গেল। সে জিপের নিচে গুটিশুটি মেরে পড়ে রইল। ওপরে গুলির বন্যা বয়ে যাচ্ছে, সে পড়ে রইল ফ্লোরে। হঠাৎ ঠকঠক করে কিছু একটা ভেতরে এসে পড়ল। গ্রেনেড। সাথে সাথে সে জিপের সামনের দরজা দিয়ে বাইরে লাফ দিল। ঝেড়ে দৌড় দিল গোরস্থানের পেছন দিকে। পেছনে গাড়িটা আগুনে বোমার মতো বার্স্ট করল।

.

ওদিকে আবু তীব্র গুলি বৃষ্টিতে বারান্দার একপাশে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। গুলি বৃষ্টি থামতেই সে আরেকটা বোতল ছুড়ে মারল। কিন্তু এটা বেশি দূরে গেল না। বারান্দার একপাশেই পড়ে ফেটে গেল। ঠিক তখনই বটগাছের পাশে গাড়িটা বার্স্ট করল। সে কী করবে বুঝতে পারছে না হঠাৎ দেখল মনিরুজ্জামান ভীষণ বেগে দৌড়ে আসছে। সে একটা হাত বাড়িয়ে তাকে বারান্দায় টেনে তুলল। উলটোদিকে ঘুরে দুজনেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। দরজার বাইরে আরেক রাউন্ড গুলি বৃষ্টি হয়ে গেল।

“তুই ঠিক আছিস?” গুলির শব্দ থামার সাথে সাথে মনিরুজ্জামান জানতে চাইল।

“হ্যাঁ স্যার। কিন্তু কবিরের কী হলো ও এখন পর্যন্ত একটা গুলিও করেনি।”

“আল্লাহ জানে। গুলি-টুলি খেলো কি না কে জানে। চল ভেতরে চল। যেভাবেই হোক বাইরের সৈন্যদেরকে আটকাতে হবে,” দুজনেই দৌড়ে চলে এলো ভেতরে। বসার ঘরের সোফাটা তুলে প্রথমেই আটকে দিল দরজার পেছনে। তারপর অন্যান্য জিনিসপত্র জমা করতে লাগল ওটার পেছনে।

.

কর্নেল একটা হাত তুলে গুলি থামানোর নির্দেশ দিল। সে বলার সাথে সাথেই সবাই গুলি থামিয়ে দিল। তারা প্রায় সবাই মাটির একটা ঢিবির পেছনে আশ্রয় নিয়েছে। রাগে-দুঃখে কর্নেলের পিত্তি জ্বলে গেল। একটা সিভিলিয়ান ব্লাডি সিভিলিয়ান এভাবে তাকে ঘোল খাইয়ে দিল। এই বোকামির দায় একমাত্র তার। রাগে তার নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। একবার তার চারপাশে তাকিয়ে সে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করল। সে, মেজর ফয়সল আর তিনজন সৈন্য অক্ষত আছে। বাকিরা সবাই হয় আগুনে পুড়ে, না হয় গাড়ির বিস্ফোরণে, আর না হয় গুলিতে মারা গেছে। কর্নেল দ্রুত একবার হিসাব করে নিল। এখনও সুযোগ আছে। এখানও তার শেষ ট্রাম্প কার্ড বাকি। এবার খুব সাবধানে খেলবে সে।

“সবাই সাবধানে, এখন আমরা সামনে এগোব। আমার কথা ছাড়া কেউই একটা পা-ও নাড়বে না। বুঝেছ?”

“ইয়েস স্যার।”

“লেটস গো।”

.

আবু আর মনিরুজ্জামান মিলে সদর দরজাটা বন্ধ করে ভেতরের দিকে ছুটে এলো। ভেতরে কেউই নেই। ব্যাপার কী? সবাই গেল কোথায়। ভেতরের ঘরের ঠিক বাইরেই আজমত চাচা মরে পড়ে আছে। তার ভাতিজা কোথাও নেই। মনিরুজ্জামান এক ধাক্কায় খুলে ফেলল দরজাটা। মহিলারা সবাই ঘরের এক কোণে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে কাঁদছে। দাইমা বসে আছে নার্গিসের খাটের ঠিক পাশেই। নার্গিস বন্ধ চোখে শুয়ে আছে বিছানায়। আর বিছানার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কবির। তার এক হাতে একটা সদ্যজাত সন্তান অপর হাতে বন্দুকটা। মনিরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে সে একটা হাসি দিল।

“কবি…?”

“শশশশ স্যার আপনার মেয়ে সন্তান হয়েছে। এটাকে জন্ম দিতে গিয়ে আপনার বউটা গেছে। এখন এটাকে যদি বাঁচাতে চান,” বলে সে ক্রন্দনরত বাচ্চাটাকে দেখাল। “তাহলে আমি যা বলি তাই শুনুন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *