২৫শে মার্চ – ১৬

১৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কার্জন হল এলাকা
২৬শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত প্রায় ১টা

আলমারির ভেতর থেকে লোকটা প্রায় গায়ের ওপরে পড়তে যাচ্ছে মনিরুজ্জামান চট করে সরে গেল একপাশে। আর মানুষটা মাটিতে লাফিয়ে পড়ে দুই হাতে মাথা-মুখ ঢেকে চিৎকার করতে লাগল, “আমারে মাইরেন না। আমি কিছু করি নাই। আমার বউ-বাচ্চা আছে। আমারে মাইরেন না।”

আবু আর কবির তাদের হাত থেকে জিনিসগুলো নামিয়ে রাখল। মনিরুজ্জামান মাটি থেকে লোকটাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিল। এটা খুন হওয়া দারোয়ানের ভাতিজা সোহেল। বয়স ত্রিশ-বত্রিশের বেশি হবে না। কিন্তু লম্বা দাড়ি থাকার কারণে বেশি বয়স্ক মনে হয়।

মনিরুজ্জামান তুলে ধরে বসানোর সাথে সাথে আবার লোকটা মাটিতে শুয়ে পড়ল। মনিরুজ্জামানের একটা পা ধরে চেঁচাতে লাগল, “ মাইরেন না, আমারে মাইরেন না।”

লোকটাকে সে জোর করে টেনে তুলল মাটি থেকে। আবু আর কবিরও সাহায্য করল। লোকটা এখনও সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। “সোহেল এই সোহেল, চুপ করো।” লোকটা চেঁচিয়েই যাচ্ছে। মনিরুজ্জামান লোকটার গালে ঠাসঠাস করে দুটো চড় মারল। চড় খেয়ে হঠাৎ থেমে গেল সে। এক মুহূর্ত মনিরুজ্জামান আর সাথের দুজনকে দেখল। “স্যার, আপনে। স্যার স্যার…” বলে সে মাটিতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

“স্যার, হেরা চাচারে মাইরা ফালাইছে। মাইরা ফালাইছে। আমার চোক্ষের সামনে মাইরা ফালাইছে।”

“চুপ করো, চুপ করে সোহেল,” মনিরুজ্জামান শক্ত করে লোকটাকে ধরে আছে। চোখের সামনে বীভৎসভাবে চাচাকে খুন হতে দেখে আর নিজের মৃত্যু ভয়ে লোকটা এক্সট্রিম ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। “সোহেল, চুপ করো।” বলে মনিরুজ্জামান দুই হাতে লোকটাকে ধরে আরেকবার ঝাঁকি দিল। “আবু দেখ তো, পানি আছে কি না।“

“আবু দৌড়ে চলে গেল পানি আনতে। একটু পরে ফিরে এলো একটা সিলভারের মগে পানি নিয়ে। মনিরুজ্জামান তাকে ধরে পানিটা খাইয়ে দিল পানি খেয়ে লোকটা একটু ধাতস্থ হতেই সে জানতে চাইল, “কী হয়েছিল?”

“স্যার, আমি আর চাচা ডিউটি দিতে আছিলাম। আমার ডিউটি শ্যাষ কইরা আমি এইহানে আইছিলাম কাফর বদলাইয়া বাড়ি যাইতাম। আচানক বাইরে অনেক চেঁচামেচি শুইনা দরজা খুইলা উহি মাইরা দেহি আমার চাচারে ধইরা মারতাছে,” বলে লোকটা একটু বিরতি দিল। সে থামতে মনিরুজ্জামান তাকে আরেক দফা পানি খাইয়ে দিল না হলে লোকটা আবারও ট্রমায় আক্রান্ত হতে পারে। পানি খেয়ে লোকটা আবারও শুরু করল। “এরফরে মারতে মারতে হের মাতায় গুল্লি কইরা দিল,” বলে সে থেমে থেমে ফোঁপাতে লাগল। “চাচা মইরা গেল।”

“এরপরে তুমি কী করলে?”

“চাচারে মাইরা হেরা পরথমে আপনের রুমে গিয়া সব ভাঙচুর করল। এরফরে এইহানে আইসা সব বাঙাবাঙি করল। আমি বাইর হইতে না ফাইরা ওই দরজার ভিতরে জিনেসপত্রের নিচে পলায়া আছিলাম। ভাবছিলাম আমি আইজকার মতন শ্যাষ। একবার বাইরে শব্দ হইতে আছিল আর আমার মনে হইতেছিল আমি শ্যাষ।”

মনিরুজ্জামান ভাবছে। “আচ্ছা ওদেরকে তো তুমি দেখেছ। ওরা কি কিছু খুঁজছিল?” লোকটা তার প্রশ্ন শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারেনি। “ঠিক আছে। ওদেরকে কি তুমি কোনো বাক্স খুঁজে পেতে দেখেছ?”

“বাক্স, স্যার?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বাক্স।”

“যেইডা আফনের নামে আইছিল আইজ বিকালে?”

“তুমি কীভাবে জানলে আমার নামে কোনো বাক্স এসেছিল কি না?”

“স্যার হেইডা তো হেরা পাইবো না।”

“মানে?” মনিরুজ্জামান আবু আর কবিরের দিকে তাকাল। বুঝতে পারছে না লোকটা কি ঠিক বলছে না ভুল বলছে।

“স্যার, হেইডা তো এহানে নাই।”

“তুমি কীভাবে জানলে ওটা এখানে নেই?”

“স্যার, হেইডা তো আমি নিজে আফনের বাসায় দিয়া আসছি বিকালে।”

“সোহেল, ঠিক করে বলো। আমি তোমার কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছি না। তুমি ওই বাক্স কোথায় পেলে?”

“স্যার আইজকা বিকালবেলা আফনের নামে একটা বাক্স আইছিল। হলুদ রঙের কাফর প্যাচান। আমার চাচা হেইডা পরথমে আফনের টেবিলের উপরে রাখছিল। তারফর আফনে আর আসেন নাই দেইখা চাচায় কইলো আফনের বাসায় দিয়া আসতে। কারণ যেই পোলাডা দিয়া গেছিল হেয় কইছিল এইডা নাকি অনেক জরুলি।”

“তারপর?”

“তারফরে কী স্যার। আমি তো হেইডা ম্যাডামের কাছে দিয়া আসছিলাম।”

“তুমি নিশ্চিত?”

“জি, স্যার।”

কবির মনিরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে বলল, “তার মানে বাক্সটা স্যার আপনার—”

“বাসায় আছে,” কবিরের কথাটা সে শেষ করে দিল। “চল আমরা এখন কোয়ার্টারে ফিরে যাব।“

“স্যার এইরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ওখানে যাবেন কীভাবে?” আবু জানতে চাইল।

“আমি জানি না। কিন্তু আমাদেরকে যেতেই হবে। জিনিসটা উদ্ধার করতেই হবে,” বলে সে দুজনের দিকে দেখল। “কবির, আবু তোদেরকে একটা কথা বলি। আমার মনে হয় কথাটা বলা দরকার। আমি কোয়ার্টারে ফিরে যাবই। আমাকে যেতেই হবে। আমি কিছুতেই জিনিসটা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে পড়তে দেব না। প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও। কিন্তু তোরা চাইলে এই ঝুঁকি এড়াতে পারিস। মানে আমি বলতে চাইছি…”

“স্যার, অমরা বুঝতে পেরেছি আপিনি কী বলতে চাচ্ছেন কিন্তু আমরা আপনাকে ছেড়ে যাব না। আমরা আপনার সাথেই থাকব। কি বলিস আবু?”

“অবশ্যই আমরা আপনার সাথেই আছি স্যার। আপনি যেখানেই যান না কেন।”

মনিরুজ্জামান চুপচাপ ওদেরকে দেখল। “ঠিক আছে তাহলে আমরা একসাথেই যাব। কিন্তু একে কী করা যায়?”

“স্যার আমার মনে হয় এখানে থাকাটাই ওর জন্য ভালো হবে। কারণ এখানে মিলিটারি একবার অভিযান চালিয়ে গেছে। তো আজ রাতে অন্তত এখানে আবার ফিরে আসার সম্ভবনা কম। ও এখানেই থাক সকাল হলে পালিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারবে।”

“হুমম আমারও তাই মনে হয়,” সে লোকটাকে ডেকে এক কোণে নিয়ে গেল। তাকে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি বোঝাল। সেইসাথে বুঝিয়ে দিল কীভাবে কী করবে সকাল বেলা। কতটুকু বুঝল কে জানে। মাখা নেড়ে সায় দিল।

ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনজনে বেরিয়ে এলো বাইরে। “স্যার আমরা কীভাবে যাব এখান থেকে?”

“বুঝতে পারছি না পুরোপুরি কিন্তু যেতে হবে। চিন্তা করে বের করতে হবে,” বলে সে একটু থামল। প্রথমত, যেহেতু বাইরে আর্মি টহল দিচ্ছে এবং বাকি সব পরিস্থিতির ব্যাপারে এখনও জানি না কাজেই ধরে নিতে হবে বাইরে কার্ফিউ চলছে। কাজেই আমরা রাস্তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করব। দ্বিতীয়ত, আমাদেরকে এখান থেকে যেতে হবে ফুলার রোড, টিচার্স কোয়ার্টারে। তার মানে, এখান থেকে বেরিয়ে আমাদেরকে রাস্তা পার হয়ে যেতে হবে গণিত ভবন, সেখান থেকে শহিদ মিনারের সামনে দিয়ে জগন্নাথ হলের ওপর দিয়ে ফুলার রোডের টিচার্স কোয়ার্টার।

“কিন্তু স্যার আমরা তো রাস্তা ধরে যেতে পারব না।“

“আমাকে কথা শেষ করতে দে,” মনিরুজ্জামান আবুকে থামিয়ে দিল। “আমরা এখান থেকে সামনের পাশ দিয়ে বের হবো না। অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে অনেকখানি জায়গা ঘুরে আমরা চলে যাব পেছন দিকে। সেখান থেকে চানখারপুল হয়ে আমরা ওইদিকে যাওয়ার চেষ্টা করব। কি বলিস?”

“জি, স্যার সেটা করা যেতে পারে। এইটাই আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে,” আবু বলল। তার কথার সাথে সায় দিয়ে কবিরও মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না।

“কবির, তোর কী মনে হয়, পরিকল্পনা ঠিক আছে?” মনিরুজ্জামান জানতে চাইল। “আমি চাচ্ছি সহজ রুট না ধরে ঘুরে অন্যদিক দিয়ে যেতে।”

“জি স্যার, এটাই ভালো হবে। আর এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই,“ কবির মাথা নেড়ে বলল।

“চল তাহলে বের হই এখান থেকে।” তিনজনই বের হয়ে এলো পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। আসার সময় মনিরুজ্জামান ল্যাবের মেঝে থেকে একটা চাদর তুলে নিল। ওটা তার আলমারিতে রাখা ছিল। গায়ের শার্টটা অনেক বেশি উজ্জ্বল। এই আঁধার রাতে এটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই গায়ের ওপরে জড়িয়ে নিল চাদরটা। আরেকবার চেক করে নিল কোমরে রাখা প্যাকেটটা। ওটাই আজ রাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বাইরে বেরিয়ে এসে তিনজনে চলে এলো কার্জন হলের ভেতরে পুকুর পাড়ে। এখান থেকে পার হয়ে চলে যাবে একেবারে পুরান ঢাকার কাছাকাছি এলাকায়। ওখান থেকে ঘুরে চানখারপুল হয়ে চলে আসবে গণিত বিভাগের ওখানে শহিদ মিনারের সামনে। সেখান থেকে জগন্নাথ হলের ভেতর দিয়ে চলে যাবে ফুলার রোডের টিচার্স কোয়ার্টারে। হলের পুকুর পাড়ের পাড় ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো হলের দিকে। হল পার হয়ে একেবারে দেয়ালের কাছে। এখান থেকে দেয়াল টপকে বাইরে গেলেই পুরান ঢাকার চানখারপুল। দেয়ালের ওপাশে অনেক শোরগোল শোনা যাচ্ছে।

“শশশশ,” মনিরুজ্জামান দুজনকে সাবধান করে দিল। “আমি আগে দেয়ালের ওপর উঠে দেখি ওপাশে কী অবস্থা।” আমি সিগন্যাল দিলে তোরা উঠে আসবি। মনিরুজ্জামান একলাফে দেয়ালের ওপর দুই হাত দিয়ে একটানে শরীরটাকে তুলে নিয়ে এলো দেয়ালের ওপরে

স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে তার চোখ চলে গেল মোড়ের কাছে যেখানে অনেকগুলো মিলিটারি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকগুলোকে ঘিরে আছে অনেক মিলিটারি। সবাই অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত। এদিক দিয়ে পার হওয়ার কথা স্বপ্নে ও ভাবা যাবে না, সে মনে মনে ভাবল। এদিক দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ।

আওয়াজটা প্রথম থেকেই আসছিল কিন্তু প্রাথমিক উত্তেজনার কারণে সে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। সে যেখানে দেয়ালের ওপর উঠে বসে আছে সেটার অপর পাশে দেয়ালের গোড়া থেকে ভেসে আসছে পানির মৃদু কলকল শব্দ। সে চট করে নিচে তাকাল।

একজন মিলিটারি দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করছে। মনিরুজ্জামান বরফের মতো জমে গেল সাথে সাথে, একটা আঙুল নাড়লেও বিপদ এখন। লোকটা মনের সুখে মুতেই চলেছে। মনিরুজ্জামান ধীরে ধীরে নিজের একটা পা দেয়াল থেকে নামিয়ে দিল। অন্য পা-টাকে আরেকটু নামাতে পারলেই যে পাশ থেকে উঠেছে সেদিকে লাফিয়ে পড়তে পারবে। পা-টাকে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ দেয়ালের ওপাশ থেকে আবু ডেকে উঠল, “স্যার, ওখানে কী অবস্থা?”

সাথে সাথে ঝট করে মিলিটারি লোকটা মুখ তুলল ওপরে। লোকটা চোখ ওপরে তুলতেই চোখাচোখি হয়ে গেল মনিরুজ্জামানের সাথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *