২৫শে মার্চ – ১০

১০

কালী মন্দির, রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত প্রায় ১০টা

মনিরুজ্জামান তার ওপেল রেকর্ডটা নিয়ে সন্তর্পণে কার্জন হল পার হয়ে এলো। চারপাশ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কার্জন হল পার হয়ে সে ধীরে ধীরে বাঁক নিল ডান দিকে। কিছুদূর এগিয়ে অন্ধকার রাস্তায় বর্ধমান হাউজের একটু সামনে পার্ক করল গাড়িটাকে। এখান থেকে একটু সামনে হাতের ডান দিকে কালী মন্দিরের গেট। এই মন্দিরটা বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো কালী মন্দিরগুলোর একটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরে এটার অবস্থান ধরে নেওয়া হলেও মূলত এটা অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানের একটি অংশের ওপর। তবে এই এলাকাটাকে মূলত বলা হয় কালী মন্দির এলাকা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুরানো এই মন্দিরটা অত্যন্ত সম্মানের। তবে রাতের আঁধারে মনিরুজ্জামানের এখানে কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে আসার পেছনে মূল কারণ হলো হাফিজের রেখে যাওয়া সিম্বলিক বার্তা। সে এটা বুঝতে পারার একমাত্র কারণ হাফিজের সবসময়ের হেয়ালি। মাসখানেক আগে তারা যখন এইসব বিষয় নিয়ে একটা পরিকল্পনার দিকে যাচ্ছিল তখন হাফিজ আর সে একদিন ক্যাম্পাস থেকে হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে আসে। এখানে পুকুরপাড়ে বসে তারা আলাপ করেছিল এবং হাফিজ তাকে বলেছিল এই মন্দিরটার সাথে নাকি ইতিহাসের অনেক ঘটনার সংযোগ আছে এবং তার নিজের অনেক গোপন রহস্যও নাকি এর সাথে সংযুক্ত। এরপর মার্চের এক তারিখে ও আবারও এই মন্দিরের কথা বলেছে, সেইসাথে এই মন্দিরের সাথে সংযুক্ত একজন বিশেষ ব্যক্তির নাম। আয়নাতে মা-কালীর মূর্তি দেখে হাফিজের ওই কথটা মনে পড়াতেই তার দুই আর দুই চার যোগ করে নিতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি।

মনিরুজ্জামান গাড়িটা বাংলা একাডেমির সামনে পার্ক করে আবু আর কবিরকে নিয়ে নেমে এলো। বের হওয়ার আগে সে পকেটে রাখা পিস্তলটা আরেকবার চেক করে নিয়েছে, আর গাড়ি থেকে নেমে হাফিজের দেওয়া প্যাকেটটা একটা ভাঁজ দিয়ে শার্টের নিচে ঢুকিয়ে রাখল। বাসা থেকে বেরোনোর আগে ওটাকে একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ফাইলে ভরে নিয়েছে সে। গাড়ি থেকে নেমে এসে সে একবার চারপাশে তাকাল। এই রাস্তাটা এমনিতেই বেশ অন্ধকার থাকে সন্ধ্যার পর, আজ মনে হয় পুরো কালিগোলা অন্ধকার। ব্যাপার কী? রাস্তার লাইটগুলো সব বন্ধ কেন, মনে মনে ভাবল সে। অন্ধকার থাকা সত্ত্বেও ডান দিকে পাঁচশ গজেরও বেশি দূরত্বে অন্ধকারে মনে হলো যেন একটা মিলিটারি জিপ এসে থামল। তবে সে নিশ্চিত হতে পারল না। আবু আর কবিরকে নিয়ে কালী মন্দির এলাকায় ঢুকে গেল।

.

খানিকটা দূরে অন্ধকার রাস্তার ধারে একটা মিলিটারি জিপের ভেতরে একজন মানুষ রাস্তার দিকে নজর রাখছে, অন্যজন ওয়ারলেসে কথা বলছে।

“স্যার, টার্গেট জাস্ট স্টপড ইন ফ্রন্ট অভ একাডেমি গেট অ্যান্ড এন্টারড দা টেম্পল এরিয়া।”

অপর প্রান্ত থেকে জবাব এলো, “ডু নট প্রসিড, কিপ অ্যান আই অন দেম। আই অ্যাম কামিং।” কর্নেল হাবিব ওয়ারলেসের মাউথপিসটা রেখে তার সামনে বসা পাকিস্তান আর্মি কমান্ডের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার ব্যক্তিদের একজনের দিকে তাকাল। তার চোখে প্রশ্ন।

তার দিকে তাকিয়ে তিনি জবাব দিলেন, “উই আর গোয়িং টু ম্যাসাকার ঢাকা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি এরিয়া উইল বি ফার্স্ট। লেটস স্টার্ট উইথ ইয়োর্স।” কর্নেল হাবিবের মুখে ক্রূর হাসি ফুটে উঠল।

.

“স্যার, আমরা যাচ্ছি কোথায়?” কবির প্রশ্ন করল। মনিরুজ্জামান কোনো জবাব দিল না। সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। আবু আর কবির চোখাচোখি করল। তারা কালী মন্দিরের অন্ধকার রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। চারপাশে বেশ ভূতুড়ে অন্ধকার।

মনিরুজ্জামান ওদরেকে নিয়ে কালী মন্দিরের পুকুর পাড়ে এসে থেমে গেল। পুকুরের ওপারেই মন্দির। শত বছরের পুরানো মন্দিরের অবয়ব অন্ধকারের ভেতরে কেমন অদ্ভুত এক আবহ সৃষ্টি করেছে। মনিরুজ্জামান চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে আছে।

“স্যার কী হলো কিছু বলছেন না যে?”

“আমার ধারণা হাফিজকে খুন করা হয়নি। সে সত্যিই সুইসাইড করেছে,” মনিরুজ্জামান মৃদু স্বরে বলল।

আবু আর কবির দুজনেই আবছা অন্ধকারে চাঁদের আলোয় তার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। “স্যার, কেন আপনার এরকম মনে হচ্ছে?” কবির জানতে চাইল।

“কারণ তার পেছনে লোক লেগেছিল। সে অনেকদিন ধরে, বলতে গেলে বহু বছর ধরে পুরানো একটা রহস্যের পেছনে লেগেছিল। মাস ছয়েক আগে আমি আমার একটা প্রজেক্টের জন্য হন্যে হয়ে ফান্ড খুঁজছিলাম, এটা তো তোরা জানিসই। তখন প্রথমবারের মতো হাফিজ আমাকে ওর এই রহস্যের ব্যাপারে খানিকটা ইঙ্গিত দেয়। এরপর দুই মাস আগে আমাকে মোটামুটি বিস্তারিত বলে। যার খানিকটা আমি তোদের সাথে শেয়ার করেছি আজ রাতে বাসা থেকে বেরোনোর আগে। এরপর অনেকদিন ওর সাথে আর তেমনভাবে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমি আমার প্রজেক্টের জন্য ফান্ড খোঁজা বাদ দিয়ে কাজে নেমে যাই কারণ হাফিজ আমাকে এই ব্যাপারে বেশ শক্তিশালী একটা আশ্বাস দিয়েছিল। এই মার্চের এক তারিখে ও আমাকে জরুরি তলব করে পল্টনে দেখা করতে বলে কিন্তু ওইদিন ওখানে গন্ডগোল শুরু হয়ে যাওয়াতে আমরা বিস্তারিত আলাপ করতে পারিনি। তবে ওইদিন দুইটা ঘটনা ঘটেছিল। কথা প্রসঙ্গে হাফিজ আমাকে কয়েকটা কথা বলেছিল। ও বলেছিল ওর যদি কিছু হয়ে যায় আমি যেন ওই শব্দগুলো মনে রাখি। আমি তখন জানতে চাই ওর এরকম কেন মনে হচ্ছে যে, কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। এর জবাবে ও আমাকে বলেছিল, ওর পেছনে নাকি লোক লেগেছে এবং ওর ধারণা ওরা পাকিস্তান সরকারের লোক। ও নাকি নিশ্চিত ছিল। ও এমনকি আমাকেও সাবধান করে দিয়েছিল। ওইদিন ঠিক বিদায় নেওয়ার আগ মুহূর্তে ও আমাকে বলেছিল, প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে দেবে তাও মুখ খুলবে না,” এই পর্যন্ত বলে আবছায়া অন্ধকারে মনিরুজ্জামান আবু আর কবিরের দিকে ফিরে তাকাল।

“আমার ধারণা ও ঠিক তাই করেছে। ও যখন বুঝতে পেরেছে নিৰ্দিষ্ট কারও কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই সে নিজে আত্মহত্যা করেছে এবং ওর ওই রহস্যের সমাধানের জন্য এমন কিছু ক্লু রেখে গেছে যেটা একমাত্র আমিই বুঝতে পারব। যেমন, ওর রহস্যের একটা হলো এই কালী মন্দির, বলে সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটা দেখাল।

“কেন স্যার? এই মন্দিরের এমন কী বিশেষত্ব আছে?” কবির বেশ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল।

“মন্দিরের তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। বিশেষত্ব এই মন্দিরের একজন ব্যক্তির। হাফিজ মার্চের এক তারিখে ওর বলা বিশেষ কথাগুলোর ভেতরে একটা ছিল, এই মন্দিরের একজন পুরোহিতের নাম এবং ও বলেছিল ওর কিছু হলে ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে। হিসাবটা আসলেও খুব সোজা ছিল। আমি বলেছিলাম না, হাফিজ এমনকিছু ক্লু রেখে যাবে যেটা একমাত্র আমি বুঝতে পারব। ঘটেছেও ঠিক তাই।”

“ওর বাড়িতে অ্যান্টিক আয়নাটায় মৃত্যুর ঠিক আগে ও একটা কথা লিখে রেখে গেছে।”

“সত্য সর্বদা তোমার সামনেই থাকে,” কবির বিড়বিড় করে বলল। “ঠিক এই কথাটাই লেখা ছিল, আপনার জন্য রেখে যাওয়া ছবিটার পেছনে।”

 “ঠিক। আর তোরা যেটা বুঝতে পারিসনি, তোরা কেন অন্য কারও যেটা বুঝতে পারার কথা নয় সেটা হলো, ওই আয়নাটাতেই ঠিক পেছনের দেয়ালে একটা কালী মূর্তির প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল। তার মানে হিসাবটা খুব সোজা। ওই ছবির বস্তুটিকে খুঁজে বার করতে হলে আমাকে কালী মন্দিরের ওই বিশেষ ব্যক্তিটিকে খুঁজে বার করতে হবে, যার নাম হাফিজ আমাকে বলেছিল, “ এই পর্যন্ত বলে মনিরুজ্জামান আবারও দুজনের দিকে তাকাল।

“দারুণ,” আবু প্রায় চিৎকার করে উঠল। “অসাধারণ, বুদ্ধিমান লোকজনের কাজকারবারই আলাদা,” বলে সে কবিরের পিঠে একটা চাপড় মারল। “কবির, তুইও একদিন এরকম বুদ্ধিমান হয়ে যাবি। আর আমি এরকম গাধাই থেকে যাব।”

“কথা কম বল আবু, চল আমাদেরকে পুরোহিত মশাইকে খুঁজে বার করতে হবে,” বলে মনিরুজ্জামান হাঁটা দিল মন্দিরের দিকে। আবু আর কবিরও হাঁটা দিল তার পেছন পেছন।

পুকুরের পাড় ধরে তারা মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল। মন্দিরের প্রাঙ্গণটা বেশ বড়। একপাশে পূজা দেওয়ার মণ্ডপ। অন্যপাশে মা আন্দময়ীর আশ্রম। আর পেছন দিকে সম্ভবত মন্দিরের লোকজনের থাকার এবং প্রাত্যহিক কাজকর্ম করার স্থান। শত শত বছরের পুরানো মন্দিরটার মূল আকৃতিটা দেখার মতোই বটে। বেশ আগে মনিরুজ্জামান একবার তার স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসেছিল। সেদিন ওরা এই মন্দিরের পুকুর পাড়ে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছিল। তখনও তারা বিয়ে করেনি। কত আগের কথা কিন্তু ভাবলে সেদিন মনে হয়। নিজের স্ত্রীর কথা মনে হতে তার বুকের ভেতরে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। যে সময়টাতে তার স্ত্রীর পাশে থাকা সবচেয়ে জরুরি ছিল ঠিক সে সময়টাতেই সে ওকে দূরে পাঠিয়ে দিল। আর কি কখনো দেখা হবে ওর সাথে?

মন্দিরের প্রাঙ্গণে একটা বাতি জ্বলছে। মনিরুজ্জামান ভাবছিল কী করবে। ডাক দেবে নাকি। কিন্তু কী বলে ডাক দেবে বুঝে ওঠার আগেই আবু চিৎকার করে উঠল, “কেউ আছেন?” “কেউ আছেন?”

প্রথমে কোনো নড়াচড়া নেই। একটু পর অন্ধকার কোণ থেকে কেউ একজন কথা বলে উঠল, “কাকে চাইছেন?”

“কে বলছেন? একটু সামনে আসবেন দয়া করে?” মনিরুজ্জামান বলে উঠল।

“আপনি কে? কাকে চাইছেন, না বললে সামনে আসার দরকার বোধ করছি না,” অন্ধকারের কণ্ঠস্বরটাও নাছোড়বান্দা।

“ঠিক আছে আমি মনিরুজ্জামান, আমি একজনকে খুঁজতে এসেছি। নারায়ণ ব্যানার্জি। আমার মনে হয় তিনি আপনাদের প্রধান পুরোহিত। তার সাথে আমার জরুরি একটা দরকার আছে। আপনি দয়া করে যদি তাকে একটু খবর দেন তাহলে খুব ভালো হয়।”

“মা-কালীর দরবারে যেকোনো আগন্তুক তার মেহমান কিন্তু আপনি সকালে এলে ভালো হয়। তিনি এখন নেই,” অন্ধকারের কণ্ঠস্বর এখনও বেশ কঠোর। “এই রাতে তার সাথে দেখা করা সম্ভব না।”

“নগেন, তুমি মা-কালীর নাম বলছ আর মায়ের সেবাদাস হয়ে এটা জানো না যে তার দরবারে মিথ্যে কথা বলতে নেই.” আরেকটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল। মন্দিরের অন্ধকার অবয়বের ভেতর থেকে ধুতি পরিহিত একজন মানুষ বেরিয়ে এলেন। “নগেন, আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তবে তুমি এখন যেতে পারো।” এতক্ষণ ওদের সাথে কথা বলতে থাকা মানুষটা আলোতে এসে একবার মাথা নুইয়ে আবার অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

“আপনিই নারায়ণ ব্যানার্জি?” মনিরুজ্জামান জানতে চাইল। “আমি হাফিজের বন্ধু। আমার ধারণা ভুল না হলে আপনার কাছে আমার জন্য কিছু একটা আছে?”

মানুষটা একবার মনিরুজ্জামানকে ভালো করে দেখল তারপর তার সঙ্গী দুজনকে। “আমি আপনাকে অবিশ্বাস করছি না কিন্তু আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো আপনিই হাফিজ সাহেবের বন্ধু?”

“কারণ অন্য কেউ হলে এ পর্যন্ত আসতে পারত না। আপনাকে খুঁজে বার করতে পারত না। আমি পেরেছি, এটাই কি যথেষ্ট নয়?” মনিরুজ্জামান তার চোখের গভীরে তাকিয়ে বলল।

“আমার মনে হয় যদি সত্যিই আপনি মনিরুজ্জামানের বন্ধু হয়ে থাকেন তবে আপনি একটা বিশেষ কথা জানেন,” মানুষটার চোখে একদিকে বিপদের গন্ধ অন্যদিকে মৃদু একটা হাস্যরস, সেইসাথে চ্যালেঞ্জের আহ্বান, যেটা শুধুমাত্র একজন বুদ্ধিমান মানুষ অন্যজনকে ছুড়ে দিতে পারে।

মনিরুজ্জামান একমুহূর্ত ভাবল কিন্তু সময় নেই। খেলাটা তাকে খেলতেই হবে, ঝুঁকিটা নিতেই হবে।

সে বড় করে দম নিয়ে বলল, “সত্য সর্বদা তোমার সামনেই থাকে।”

“আপনি পরীক্ষায় পাশ করেছেন বন্ধু। দুঃখিত কিছু মনে করবেন না। যেহেতু আমি হাফিজকে বন্ধুর মতো মনে করতাম। আপনাকেও করতে পারি। আপনি আমার সাথে আসুন,” বলে তিনি পেছন ফিরে মন্দিরের ভেতরের দিকে রওনা দিল।

মনিরুজ্জাম ফোঁস করে আটকে রাখা দম ছাড়ল। একবার পেছন ফিরে আবু আর কবিরকে আসতে বলে পুরোহিতের পেছনে হাঁটা দিল।

“এদিক দিয়ে আসুন প্লিজ,” পুরোহিত তাদেরকে পথ দেখিয়ে মন্দিরের একদম ভেতরে নিয়ে এলেন।

ভেতরের একটা কক্ষে এসে তিনটা চেয়ার টেনে বসালেন সবাইকে, নিজেও একটা চেয়ার টেনে নিলেন।

“গোটা ব্যাপারটা কী? আসলে আমাকে খুলে বলুন তো, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। হাফিজ কি আসলেই সুইসাইড করেছে? ও এমন কাজ কেন করতে গেল,” মনিরুজ্জামান বসতে বসতে একটানা গড়গড় করে কথাগুলো বলে উঠল।

“ধীরে বন্ধু,” ভদ্রলোকের মুখে কৌতুকের হাসি। “আপনাদের ধর্মগ্রন্থেই তো আছে ‘স্রষ্টা ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।” আমি জানি আপনার মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ। আমার সে যোগ্যতাও নেই এবং আমি আসলে সব উত্তর জানিও না। আপনার বন্ধুর মৃত্যুর ব্যাপারে যদি জানতে চান তবে বলব স্বেচ্ছামৃত্যু অনেকসময় অবধারিত যন্ত্রণাময় মৃত্যুর চেয়ে মঙ্গলকর।”

“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন হাফিজ সুইসাইডই করেছে।”

“আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আপনিই সব উত্তর জানতে পারবেন। আমার ধারণা আপনার সে যোগ্যতা আছে। তা না হলে আপনার বন্ধু হাফিজ আপনাকে এই ব্যাপারটার উত্তরসূরি করতেন না।”

“আমার জিজ্ঞাসা অন্য জায়গায়। আমি হয়তো বের করতে পারব কি পারব না। কিন্তু সেটা কি আমাকে আদৌ করতে দেওয়া হবে। মানে হাফিজের ব্যাপারে সবকিছু ফাঁস হলো কীভাবে? নিশ্চয়ই কেউ একজন মুখ খুলেছে। তা না হলে হাফিজকে মরতে হতো না। আমার ধারণা অবধারিত মৃত্যু সামনে দেখতে পেয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে সে প্রচণ্ড ঘৃণা করত। ওদের হাতে মরার চেয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু তার কাছে অনেক মহান ছিল। প্রশ্ন হলো ওরা জানল কীভাবে এবং সেটা আজকের দিনেই কেন?”

নারায়ণ বাবু ওপরের দিকে তাকালেন, “ভগবান আমাদের সহায় হোন। আপনি আসলেই বুদ্ধিমান। আপনি খেলোয়াড়। আর আমি একজন ক্রীড়ানক মাত্র। আমি আপনাকে কিছুই বলব না। আমি শুধুমাত্র আমার ভূমিকা পালন করব। আর আপনাকে বলব, জলদি করুন। বিপদ আসন্ন।”

“আপনার ভূমিকাটা কী?”

“আমার ভূমিকা আমি ইতোমধ্যেই পালন করে ফেলেছি। আপনি আসতে একটু দেরি করে ফেলেছেন বন্ধু। আমার ওপর নির্দেশ ছিল হাফিজ সাহেবের কিছু হয়ে গেলে তার গচ্ছিত জিনিসটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়া। আমি আজ সন্ধ্যায়ই সেটা আপনার অফিসে পৌঁছে দিয়েছি।”

“ওফফফ হো। কিন্তু আমি তো সেখানে ছিলাম না।”

“তাহলেও সেটা ওখানেই আছে।”

“কিন্তু জিনিসটা কী?”

“প্রাচীন সেই ঘোড়া।”

“এই ঘোড়ার ব্যাপারটা…” মনিরুজ্জামান কথা শেষ করতে পারল না হঠাৎ চারপাশের মাটি কাঁপতে লাগল। একজন সেবাদাস দৌড়ে ওদের কক্ষে প্রবেশ করল। “প্রভু সৈন্য, অনেক অনেক সৈন্য ট্রাক ভরতি আর তাদের সাথে বড় বড় কামান। আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে।” সে কথা শেষ করতে না করতেই প্রচণ্ড শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। আর তীব্র ঝাঁকুনির সাথে ভেঙে পড়ল মন্দিরের একটা অংশ।

শক্তিশালী ঝাঁকুনিতে ওরা সবাই মাটিতে ছিটকে পড়েছে। “ট্যাংক, পশ্চিম পাকিস্তানিরা ট্যাংক দিয়ে ফায়ার করেছে। তার মানে কি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল নাকি?”

সে জবাব পেয়ে গেল বাইরে থেকে। চারপাশের শব্দ অনেকটাই থেমে এসেছে। “মি. মনিরুজ্জামান এবং নারায়ণ ব্যানার্জি,” বেশ পরিশীলিত গলায় কেউ একজন ইংরেজিতে বলে উঠল। “আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি আজ রাতে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি আর্মি একটা অপারেশন চালাতে যাচ্ছে, যেটাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘অপারেশন সার্চলাইট’। আজ রাতে ঢাকা শহর ধ্বংস হবে এবং আমরা প্রথমে এখান থেকেই মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে শুরু করব। মি. মনিরুজ্জামান আমি জানি আপনি ভেতরেই আছেন। আমি পাঁচ গুনব এর ভেতরে আপনারা বেরিয়ে না এলে আমি ট্যাংকের গোলা দিয়ে মন্দিরটা উড়িয়ে দেব।”

“সময় উপস্থিত বন্ধুরা। আপনাদেরকে পালাতে হবে,” নারায়ণ ব্যানার্জি মনিরুজ্জামানের কানে কানে বলে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *