২৫শে মার্চ – ৫

ঢাকা মেডিকেল মর্গ, ঢাকা
বর্তমান সময়, সকাল প্রায় ৯টা

সময়, শরীর, পরিস্থিতি কোনোটাই অরণির নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। এয়ারপোর্টে দেরি হওয়াতে ওর বিরক্ত লাগছিল। আর এখানে মর্গের সামনে অপেক্ষা করতে করতে অনেকদিন পর মনে হচ্ছে আবার সে সত্যিকারের বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। পৃথিবীর সবখানেই হাসপাতাল জায়গাটা মোটামুটি চব্বিশ ঘণ্টাই জমজমাট থাকে। ঢাকা মেডিকেলও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এখানেও দিনের শুরুটা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই দেরি করে শুরু হয়। তাই অরণিকে এখন মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দেওয়ার পথে অরণি কান্নায় ভেঙে পড়লে বুড়ো চাচা দ্রুত গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে থামিয়ে ওর কাছে জানতে চায় সব ঠিকঠাক আছে কি না। অরণি দ্রুতই নিজেকে সামলে নেয়। তারপর আবার গাড়ি ছাড়তে বলে। চাচা মিয়া আর বেশি কিছু জানতে চায়নি। পথে টুকটাক দুয়েকটা কথা হয়েছে।

ওর কাছে জানতে চেয়েছে ও কোথা থেকে এসেছে। কেউ মারা গেছে কি না। অরণির জবাব শুনে চাচা সান্ত্বনা দিয়েছে। লোকটাকে ভালো লেগে গেছে ওর। এইরকম একটা মুহূর্তে এইটুকু সান্ত্বনাও ওর জন্য অনেক। তাই ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে ও ভাড়া দেওয়ার পর চাচা যখন বলল, অপেক্ষা করবে কি না ও আর মানা করেনি।

এরপর ভেতরে এসে অপেক্ষা করছে। অরণির ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও ওদের দারুণ সুখী পরিবার ছিল। সবই ঠিকঠাক ছিল। তারপর সেই ঘটনা এবং বাবার মৃত্যু। মায়ের ওপর প্রচণ্ড অভিমান করে ও চলে যায় ইউএস-এ, ওর চাচার কাছে। এই পাঁচ বছরে ও কখনোই মা’র সাথে যোগাযোগ করেনি, ওর মা-ও কখনো ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। ও জানে মা কেন করেনি। কারণ ও আর ওর মা একই রকম জেদি। তবে ও জানত একদিন মায়ের সব রাগ ভাঙবে এবং সেদিন ওরা ঠিকই আবার কথা বলবে। তাই সেদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে চাচার কাছে যখন শুনল ওর মা ফোন করেছিল, প্রচণ্ড সুখী বোধ করেছিল ও। প্রায় সাথে সাথেই সে মায়ের নম্বরে কল ব্যাক করে কিন্তু মায়েল মোবাইল বন্ধ পায়। এরপর অফিসের নম্বরে কল করে জানতে পারে মা ছুটিতে আছে। ও অপেক্ষা করছিল কখন আবার মা কল করবে। অবশেষে কল এলো এবং সেটা মায়ের না তার মৃত্যুর সংবাদের।

অরণির সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে, মায়ের কাছে ওর অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার ছিল। অনেক রাগ-অভিমান ব্যক্ত করার ছিল, যেগুলো হয়তো আর কোনোদিনই করা হবে না। অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে যেগুলোর উত্তর হয়তো আর কোনোদিনই জানা হবে না। কোনোদিনই আর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা হবে না। কোনোদিনই না। ও আর ওর মা ছিল বান্ধবী থেকেও বেশি। অরণির এখন মনে হচ্ছে ওভাবে কিছু না বুঝে না শুনে হঠাৎ রাগ করে ইউএস চলে যাওয়াটা ওর আসলে একদমই উচিত হয়নি। হয়তো ওর মায়েরও কিছু বলার ছিল।

অরণি ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ সুট পরা একজন লোককে হন্তদন্ত হয়ে ওর দিকে এগোতে দেখল। এই গরমের ভেতরেও লোকটার পরনে কালো কোট। লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশের মতো হবে, দোহারা গড়ন, মাথার চুল তেল বা জেল জাতীয় কিছু একটা দিয়ে পাট করে আঁচড়ানো। অরণির কাছাকাছি এসে সে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “আপনি অরণি? তাসমিন অরণি? আফরোজা আক্তার শায়লা ম্যাডামের মেয়ে?”

“জি, আপনি?”

“আমি সাদেকুর রহমান। শায়লা ম্যাডামের পারসোনাল অ্যাটর্নি।”

অরণি নামটা চিনতে পারল এই লোকটাই ক্যালিফোর্নিয়ায় ওদের বাসায় ফোন করে ওর মায়ের মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিল। “আপনি জানলেন কীভাবে আমি এখানে আছি?” অরণি বুঝতে পারছে না লোকটাকে আসলে ওর কী বলা উচিত।

“আপনি রওনা দেওয়ার পরপরই আপনার চাচা আমাকে ফোন করে জানায়। ভেবেছিলাম এয়ারপোর্টে আপনাকে রিসিভ করব কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়াতে সেখানে আর যাওয়া হয়নি। অনুমান করে সরাসরি এখানে চলে এসেছি।”

“জি, বুঝতে পেরেছি। সম্ভবত আপনিই আমাকে এখন সবচেয়ে বেশি হেল্প করতে পারবেন। বলুন তো আসলে আম্মুর হয়েছিল কী?”

“ম্যাডাম আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। পুলিশ আসার আগে সেগুলো ক্লিয়ার করে নেওয়াই ভালো। শায়লা ম্যাডামের সাথে আমার আগে থেকেই পরিচয় থাকলেও আমাদের ভেতরে প্রফেশনাল কোনো সম্পর্ক ছিল না। ম্যাডাম মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে হঠাৎ আমার অফিসে এসে হাজির। ওই দিনই তিনি আমাকে নিজের ব্যক্তিগত উকিল হিসেবে নিয়োগ দেন এবং আপনাকে দেওয়ার জন্য আমার কাছে…”

একজন সাদা অ্যাপ্রন পরা ডাক্তার আর তার সাথে দুজন পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখল ওরা। ওদেরকে দেখে সাদেকুর রহমান থেমে গেল। অরণির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আপনার তেমন কিছু বলার দরকার নেই, যা বলার আমিই বলছি।” সে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কি এখানে ডিউটি ডাক্তার?”

“না আমি ডিউটি ডাক্তার না, ডিউটি ডাক্তার বাইরে আছেন। আপনাদের কোনো কথা থাকলে আমাকে বলতে পারেন। আপাতত আমিই এখানে দায়িত্ব পালন করছি।”

“আমরা মিসেস আফরোজা আক্তারের ডেড বডি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। তিনি মিসেস শায়লা আক্তারের মেয়ে অরণি, তাসমিন অরণি। তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। মাত্রই এসে পৌঁছেছেন।”

“আপনারা কি লাশ ডিসচার্জ করতে চান তাহলে কিছু প্রসিডিউর আছে, আপনারা…”

“না, আমি শুধু ডেড বডিটা একবার দেখতে চাই,“ অরণি কথা বলে উঠল “সেটা এখনি করা যেতে পারে, তবে যদি ডেড বডি নিয়ে যেতে চান..”

“বললাম না, আমি শুধু একবার দেখতে চাই,” সাদেকুর রহমান কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল অরণি তাকে থামিয়ে দিল।

“ঠিক আছে যেমন আপনাদের ইচ্ছে,” বলে সে একজন পুলিশের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল, “আপনি আসুন আর মিস. অরণি আপনি আসুন, আপনি,” সাদেকুর রহমানকে বলল, “এখানেই থাকুন।“

“কেন আমি এখানে কেন থাকব? তিনি আমার ক্লায়েন্ট আমিও আসব,” সাদেকুর রহমান তড়বড় করে উঠল। তার ভাবখানা এমন ডাক্তার তাকে এখানে থাকতে বলে ভীষণ অন্যায় করেছে।

“ঠিক আছে সাদেক সাহেব,” অরণী তাকে থামিয়ে দিল। “আপনি বাইরেই বসুন আমি আসছি।” ওর এসব বিষয় নিয়ে তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। ওর শুধু মাকে একবার দেখা দরকার। তারপর সব হবে।

মর্গের লাশ কক্ষের ব্যাপারে নাটক-সিনেমা আর উপন্যাসে যেরকম বীভৎস বর্ণনা থাকে জায়গাটা মোটেও সেরকম কিছু না। এটা আসলে হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডের মতোই। তবে তাপমাত্রা প্রায় ফ্রিজিং পয়েন্টে থাকে বলে খুব ঠান্ডা আর স্যাঁতসেঁতে।

সারি সারি টেবিলের ওপরে লাশগুলো প্লাস্টিক জাতীয় এক ধরনের শিট দিয়ে ঢাকা। প্রতিটা লাশের সাথে লাগানো থাকে একটা করে ট্যাগ। ওটাই লাশের পরিচয় বহন করে। ডাক্তার অরণিকে নিয়ে এরকম অনেকগুলো টেবিল পার হয়ে এলো। হাতের ক্লিপবোর্ডে আটকানো কাগজের সাথে মিলিয়ে একটা টেবিলের সামনে এসে থেমে গেল। ট্যাগের সাথে কাগজটা আরেকবার মিলিয়ে নিয়ে লাশের মুখের ওপর থেকে শিট সরাল।

অরণি একটু সামনে এগোল। এর আগেও একবার অরণিকে এই অভিজ্ঞতার সন্মুখীন হতে হয়েছে। তার বাবার মৃত্যুর সময়। সেদিনও ঠিক এভাবেই সে এরকম একটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক এভাবেই একটা প্লাস্টিকের শিট দিয়ে ঢাকা ছিল অ্যাকসিডেন্টে ছিন্নভিন্ন ওর বাবার লাশ। তবে পার্থক্য একটাই, সেদিন ওর পাশে ছিল মা। আর আজ সে তার মায়ের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কেউই নেই। বাবার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ওর কষ্ট হয়েছিল। প্রচণ্ড কষ্ট। মনে হয়েছিল, ওর পুরো পৃথিবী দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আর মায়ের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ওর অনুভূতি হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।

লাশ ঘরে কয়েকদিন ধরে পড়ে থাকার কারণে ওর মায়ের মৃতদেহের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এছাড়া চেহারা একদম ফ্রেশ। মনে হচ্ছে যেন ঘুমাচ্ছে। অরণি মুখটার দিকে তাকিয়ে কান্না করল না। ওর চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ওর কষ্ট হলো না, খারাপ লাগল না। ও শুধু অনুভব করল প্রচণ্ড রাগে ওর হাত-পা কাঁপছে। এই তীব্র রাগের একটি অংশ নিজের ওপর, কারণ ও মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর বাকিটা তাদের ওপর যারা এর জন্য দায়ী।

“কীভাবে মারা গেছেন তিনি?” অরণির মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল। ও চাচার কাছে জানতে চেয়েও উত্তর পায়নি।

“গুলি করা হয়েছিল। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে,” ডাক্তার উত্তর দিল।

“কে করেছে, এই ব্যাপারে…?” অরণিকে থামিয়ে দিয়ে পুলিশ উত্তর দিল, “ম্যাডম আপনে জানেন না, খুনি তো ধরা পড়েছে। সে মোহাম্মদপুর থানায় আছে। আপনের মায়েরে মাইরা গাড়িতে কইরা লইয়া যাইতেছিল, পুলিশ ধইরা ফালাইছে।”

অরণি কোনো কথা না বলে আরেকবার মায়ের মুখটা দেখল তারপর সোজা পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল। বাইরে বেরিয়ে ডাক্তারের কাছে একটা কাগজে ভিজিটরের সই করে সোজা এসে সাদেকুর রহমানের সামনে দাঁড়াল, “আপনি আমাকে জানাননি কেন আম্মুর খুনি ধরা পড়েছে?’

“আমি বলেছিলাম তো, আপনার চাচাকে, তিনি আপনাকে বলেননি?”

অরণি চুপ হয়ে গেল, বুঝল চাচাই ওকে জানায়নি। হয়তো আগে থেকে শোক দিতে চাননি। হয়তো ভেবেছেন ও নিজে এসে সব দেখুক, বুঝুক। ও বড় করে একবার নিঃশ্বাস নিল। “আপনি আমাকে মোহাম্মদপুর থানায় নিয়ে চলুন। আমি খুনিকে দেখতে চাই এবং জানতে চাই সে কেন আমার মাকে খুন করেছে।”

“ম্যাডাম আপনি শান্ত হোন। আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে।”

“দেখুন আমি আগে আম্মুর খুনিকে দেখতে চাই তারপর সব শুনব, “ অরণি রীতিমতো চিৎকার করছে। ওর গলা শুনে আশেপাশের কয়েকজন ফিরে তাকাল।

সাদেকুর রহমান ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো পাশের একটা নির্জন করিডরে। “কী পাগলামি করছেন আপনি? আমি আপনাকে হেল্প করার জন্যই আছি। আগে আমার কথা শুনুন। আপনি অবশ্যই ওখানে যাবেন, তার আগে এটা দেখুন।” বলে সে অরণির হাতে একটা মুখ বন্ধ খাকি রঙের খাম ধরিয়ে দিল। “ম্যাডাম মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে এটা আমার কাছে জমা রেখেছিলেন এবং বলেছিলেন, তার যদি কিছু হয় তবে এটা আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। আগে এটা খুলুন তারপর বাকি সব দেখা যাবে।”

অরণি খামটা হাতে নিল। লার্জ সাইজের একটা খাম। একবার নাড়া দিল। ভেতরে কাগজ মনে হচ্ছে তবে নাড়া দিলেই কী যেন একটা নড়ছে। ও খামের মুখটা ছিঁড়ে ফেলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা কুরিয়ারের প্যাকেট। বেশ নামকরা একটা আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সংস্থার প্যাকেট। মুখটা বন্ধ। ওপরে ওর নাম আর ঠিকানার জায়গায় ওদের ক্যালিফোর্নিয়ার ঠিকানা লেখা। আর প্রেরকের জায়গায় ওর মায়ের নাম, ঠিকানা আর ই-মেইল অ্যাড্রেস। ও খামের মুখটা খুলে ভেতরে হাত দিল। একটা ডায়েরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরি, সাল লেখা ১৯৭১। সাথে একটা সাদা-কালো পাথরের ঘোড়ার ছবি। ছবিটা দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরানো, দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল। চাপ দিয়ে সোজা করা হয়েছে। ছবির ওপরে কিছু একটা লেখা ছিল পড়া যায় না, ঝাপসা হয়ে গেছে। ছবিটাতে কয়েক ফোঁটা শুকনো রক্তের দাগও দেখতে পেল। ছবিটা উলটাতে দেখল পেছনে পেনসিল দিয়ে কী যেন লেখা। লেখাটা পড়তে যাবে খামের ভেতর থেকে টুং করে একটা কয়েন মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *