২৯
বর্তমান সময়, রাত প্ৰায় ১২টা
এসপি আতিকুর রহমান তার কাজে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। দুটো সোর্স থেকে সে এই হায়দার আলির ব্যাপারে জানতে পেরেছে। দুটো সোর্সই তার কাছে এসেছে বেশ আকস্মিকভাবে। হায়দার আলির ছবিটা নিয়ে সে এর ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলার পর আরেকজন কনস্টেবল এসে জানায় এই লোকটাকে সে দেখেছে। মৃত মহিলার ডেড বডি যখন উদ্ধার করা হয় সেখানেই একটা বেশ দামি গাড়ির সামনে এই লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল। কালো সানগ্লাস চোখে ছিল এই ব্যাপারটাও নাকি পরিষ্কার মনে আছে তার। এই কনস্টেবল সাতক্ষীরা এলাকার লোক, ওদের নিজেদের এলাকায় একটা গাড়ির ওয়ার্কশপ আছে। আর গাড়ির ব্যাপারে নাকি তার ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে। এই কারণেই দামি গাড়িটার সামনে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খেয়াল করেছিল।
আতিকুর রহমান দুই দুইটা সোর্স থেকে খবর পেয়ে এই লোকটার ব্যাপারে শিওর হয়। এরপর এর ব্যাকগ্রাউন্ড বের করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এক্স আর্মি সোলজার, এখন বেশ নামকরা একজন মানুষের ব্যক্তিগত বডিগার্ড হিসেবে কাজ করে। সিনিয়র অফিসারের সাথে মারামারি করার অপরাধে আর্মি থেকে এই লোককে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে জেল খেটেছে কিছুদিন, সেখান থেকে খন্দকার আহমদ বশির তাকে ছাড়িয়ে আনে। এই আহমদ বশির তার দূর সম্পর্কের চাচা হয়। জেল থেকে উদ্ধার করে কিছুদিন পড়ালেখা করিয়ে তার সাথে কাজে রেখে দেয়। এখন সে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি কাম ব্যক্তিগত বডিগার্ড হিসেবে কাজ করে।
তার কাজের এর পরের ধাপ ছিল এই খন্দকার বশিরের খোঁজ বের করা। এর ব্যাপারেও বিস্তারিত জানতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি। এই লোকের ব্যাকগ্রাউন্ড এবং বর্তমান চিত্র পড়তে গিয়ে আরও বেশ মজার কিছু তথ্য আবিষ্কার করে সে।
এই লোক দেখি আরেক কাঠি ওপরে, সে মনে মনে বলেছিল। তার মন বলছে কোনো না কোনোভাবে এই লোক কেসটার সাথে মারাত্মকভাবে জড়িত।
তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্যটা সে খুঁজে পায় এরপরেই। এই খন্দকার আহমদ বশিরের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার পরে সে মোহাম্মদপুর থানার এন্ট্রি পথের সিসি ক্যামের ফুটেজ থেকে সাদেকুর রহমান নামের ভুয়া উকিলের একটা ছবি উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে চারপাশ থেকে খবর নিতে থাকে। যে তথ্য বেরিয়েছে সেটা খুবই চমকপ্রদ। এই লোক নাকি প্রফেশনাল গুন্ডা। বেশ শিক্ষিত কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে থাকতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে ক্যাডারবাজি আর চাঁদাবাজি করত। এরপর ড্রাগ ব্যবসায় জড়িয়ে কিছুদিন জেলও খেটেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একটা প্রফেশনাল গ্যাঙের সাথে কাজ করে বলে গুজব আছে। এই গ্যাঙটা নাকি পয়সার বিনিময়ে খুন করে। গত সপ্তাহে মিন্টু রোডে মন্ত্রী খুনের ঘটনাও নাকি এদেরই কাজ। আর এদের দলের নেতা এক কুখ্যাত আন্তর্জাতিক অপরাধী।
এই জায়গাটাতে এসে আটকে যায় সে। তার মানে কি ওই মন্ত্রী খুনের ঘটনা আর এই কেস কোনোভাবে সংযুক্ত? সে সাথে সাথে ওই কেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে খবর দেয়। তবে তার নাকি এখন অফ ডিউটি, তাকে সকালের আগে পাওয়া যাবে না। তাই সে খন্দকার আহমদ বশিরের বাড়িতে অভিযান চালানোর জন্য সার্চ ওয়ারেন্টের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই লোকটা তাকে অনেককিছুই জানাতে পারবে। সার্চ ওয়ারেন্টটা চলে এলেই সে অভিযান চালাবে ওখানে।
.
“কী?” হাসান রীতিমতো দাঁড়িয়ে পড়ল। “অরণি তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? এসব কী উলটা-পালটা বলছ!”
“আমি ঠিকই বলছি হাসান,” অরণি সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। ওর চোখে পানি। “মা ছোটবেলা থেকে এতিম ছিল এটা আমরা জানতাম। তাকে লালন-পালন করেছিল মা’র দূর সম্পর্কের কোন খালা আর খালু। এটাও আমরা জানতাম। মা ছোটবেলা থেকেই বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকত। স্কুল জীবনে বোর্ডিং স্কুলে, তারপর ওখানেই কলেজ এবং সবশেষে ভার্সিটি লাইফে হলে। মা নাকি বাড়িতে যেত খুবই কম। এটা আমার বাবার কাছ থেকে শোনা। ভার্সিটি লাইফে বাবার সাথে মা’র পরিচয় এবং বিয়ে। আমার বাবা আর মা একই সাথে পড়ত। মাকে বিয়ে করার ব্যাপারটা আমার বাবার পরিবার কখনোই মেনে নিতে পারেনি। আমার বাবা আর মা তারা ইউনিভার্সিটিতে থাকতেই সেকেন্ড ইয়ারে বিয়ে করে ফেলেছিল এবং বিয়ে করে তারা তখনই একসাথে থাকত। বিয়ে মেনে না নেওয়ায় বাবা তার পরিবারকে ছেড়ে চলে এসেছিল।”
“হ্যাঁ, তখনই আমরা পাশাপাশি বাসায় থাকতাম আজিমপুরে। আঙ্কেল আর ম্যাডাম যখন আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে এসে উঠল তখন আমি একদম ছোট। ম্যাডাম তখন থেকেই আমাকে খুব আদর করত আমার মনে আছে, হাসান বলল।
“হ্যাঁ, তখন মা-বাবা দুজনেই টিউশনি আর টুকটাক কাজ করত পড়াশুনার পাশাপাশি। আর বাবাকে সাহায্য করতেন আমার চাচা। মা মাঝে মাঝেই বলত এই চাচা যদি সাহায্য না করতেন তবে মা-বাবা চলতে পারতেন না। এই চাচার কাছেই আমি এখন থাকি। আমার বাবারা বেশ ধনী পরিবার ছিল। যাহোক, আমার মা-বাবা যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে তখন আমার জন্ম হয়। আমার মা’র তখন এক বছর গ্যাপ পড়ে পড়াশুনায়। এরপর বাবা পাশ করে চাকরিতে ঢোকার পর মা পড়াশুনা শেষ করে। ততদিনে আমার দাদা মারা যাওয়ার পর চাচা বাবাকে তাদের পরিবারের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমেরিকা চলে যান। আমার বাবা তার পৈত্রিক সম্পত্তির খুব সামান্য অংশই নিজের জন্য রাখেন। বেশিরভাগই বিক্রি করে চাচার কাছে পাঠিয়ে দেন। শুধুমাত্র ঢাকার ফ্ল্যাটা বাদে। কারণ বাবা চাচাকে বলেছিলেন দেশের বাইরে তার টাকার দরকার হবে। আর ততদিনে মা চাকরি করছে, আমি বড় হয়েছি বাবাও খুব ভালো চাকরি করত। সব মিলিয়ে আমরা খুবই সুখী ছিলাম। যতদিন না …
“যতদিন না কী?” আহমদ বশির সাহেব জানতে চাইল।
“২০০৯ সালের একটা দিন। আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে অন্ধকার দিন। আমি তখন এইচএসসি পাশ করেছি। ইউনিভার্সিটি ভর্তি কোচিং করছি। হঠাৎ মা’র নামে বাসায় একটা চিঠি আসে। আমার মাকে যে খালা বড় করেছেন তিনি লিখেছেন। মা বাসায় ছিলেন না। বাবা কী মনে করে চিঠিটা পড়ে ফেলে। আমি ওইদিন কোচিং থেকে বাসায় ফিরে শুনি মা-বাবা প্ৰচণ্ড ঝগড়া করছে। আমি খুব ভড়কে যাই। কারণ এর আগে কোনোদিনই বাবা আর মাকে ঝগড়া করতে দেখিনি। আমি আড়াল থেকে শুনতে থাকি। বাবা বারবার চিৎকার করে বলছিল ‘আফরোজা তুমি এত বড় মিথ্যে কথা কীভাবে বলতে পারলে।” বাবা বারবার একটা কথাই বলছিল।”
“মিথ্যেটা কী ছিল?” হাসান জানতে চাইল।
“আর চিঠিটাতেই বা কী লেখা ছিল?” আহমদ বশির প্রশ্ন করল।
“মিথ্যেটা ছিল মা’র জন্ম পরিচয়। যে খালা চিঠি লিখেছিলেন তিনি মারা যাওয়ার আগে ওটা ছিল মায়ের কাছে তার শেষ চিঠি। ওখানে লেখা ছিল, মা’কে তারা স্রেফ বড় করেছেন, তাদের সাথে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, মুক্তিযুদ্ধের একদম পরপরই মাকে কে যেন তাদের কাছে দিয়েছিল অনাথ সন্তান হিসেবে। বাবার দুঃখ ছিল মা এটা জানত, কিন্তু এতগুলো বছর বাবার কাছে সেটা লুকিয়েছিল। মা যুদ্ধশিশু ছিল এটা বাবার দুঃখ ছিল না, দুঃখটা ছিল মা কেন বাবার কাছে ব্যাপারটা এতগুলো বছর বলেনি। মা কোনো জবাব দেয়নি। বাবা রাগে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ওইদিন রাতেই আমরা বাবার মৃত্যুর খবর পাই। বাবা অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছিল। মৃতদেহ পরীক্ষ করে নাকি জানা যায় বাবা প্রচণ্ড মাদকাসক্ত ছিলেন। বাবা কি সত্যি সত্যিই মাদকাসক্ত অবস্থায় অ্যাকসিডেন্ট করেছিল নাকি আত্মহত্যা করেছিল সেটা আমরা কোনোদিনই জানতে পারিনি। তখন আমিও প্রচণ্ড অভিমানে মা’র সাথে কথা বলতাম না। মা কেমন জানি মনমরা হয়ে থাকত। বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে সাথে সাথে চাচা দেশে আসতে পারেননি। বাবা মারা যাওয়ার কয়েকদিন পর চাচা দেশে আসার পর তার সাথে আমি আমেরিকা চলে যাই। তারপর আজ সকালে ফিরি। এই আমার কাহিনি।”
সবাই চুপ করে আছে। অরণি টিসু দিয়ে চোখ মুছছে।
“অরণি তুমি জানো না ম্যাডম কতটা কষ্ট পেয়েছিল তুমি চলে যাওয়াতে। তোমার বাবার মৃত্যুর চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি তুমি চলে যাওয়াতে। তিনি প্রায়ই বলতেন, একদিন তুমি ঠিক ফিরবে এবং সেদিন তোমার সব ভুল ভাঙবে,” হাসানের চোখেও পানি।
আহমদ বশির খুকখুক করে মৃদু কাশলেন। “আমি বুঝতে পারছি তোমরা দুজনেই অনেক কষ্ট পাচ্ছ কিন্তু এই মুহূর্তে আসলে আমার কাছে মনে হয় তোমার মায়ের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হবে যদি আমরা তার কথাগুলো পালন করি। কি বলো?”
“জি অবশ্যই,” অরণি চোখ মুছতে মুছতে বলল। “এই আমার ঘটনা। আপনি এটাই জানতে চাচ্ছিলেন। এখন আপনি খামটা খুলতে পারেন।”
“অবশ্যই,” বলে বশির সাহেব টেবিল থেকে খামটা আর একটা লেটার ওপেনার তুলে নিল। সিলটা ভেঙে খামটা খুলে ফেলল। তারপর দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে খামটা থেকে বের করে আনল একটা কাগজ।
কাগজটা খুলতে খুলতে সে বলল, “একটা ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। অরণি তোমার ডায়েরিটা খোল তো।”
অরণি ডায়েরিটা খুলল। ছেঁড়া পাতাটা খাপে খাপে বসে গেল ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠার সাথে, যেখানে ডায়েরির মালিকের ব্যক্তিগত সব তথ্য থাকে।
“দারুণ, ডায়েরির মালিকের পরিচয়টা জানা যাবে,” হাসান পাতাটা দেখতে দেখতে বলল। “মনিরুজ্জামান খান, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই লোক কে?”
“এই লোক যে-ই হোক। এর সাথেই তোমার মায়ের কোনো না কোনো সম্পর্ক ছিল,” আহমদ বশির বলল। “অরণি আমার ধারণা তোমরা মা মানে আফরোজা আক্তার শায়লার যে জন্ম পরিচয় তোমরা জানতে সেটা ভুল ছিল। আমি যদিও এখনও জানি না তবে অনুমান করতে পারি। এই মনিরুজ্জামান ছিলেন সম্ভবত আফরোজার বাবা,” তিনি একটু থামলেন। “এবং এই মনিরুজ্জামানের পরিচয় উদ্ধার করতে পারলেই আমরা আমাদের রহস্যের সমাধান পাব।”