৩
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা
বর্তমান সময়, ৯ই জুলাই, ২০১৪
সময় : সকাল প্রায় ৮টা
“এটা কী?”
“আপনি চোখে দেখতে পাচ্ছেন না, এটা কী?” অরণি ভীষণ বিরক্তি নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাস্টমস অফিসারের দিকে তাকাল। এমনিতেই বিনা প্রস্তুতিতে লম্বা জার্নি, তার ওপর মনের অবস্থা যা-তা। এমন সময় যদি কাস্টমসের লোকজন অকারণে আজেবাজে প্রশ্ন করে বিরক্ত করে তবে মেজাজ খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ইউএস-এ থেকে বাংলাদেশ দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ ঘণ্টার জার্নি। তাও কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই।
খবরটা শোনা মাত্রই অরণি এমনকি কাপড়ও চেঞ্জ করেনি। সোজা এয়ারপোর্টে এসে প্লেনে উঠেছে। প্লেন শাহজালাল এয়াপোর্টে ল্যান্ড করার পর দীর্ঘ ইমিগ্রেশন লাইন পার হওয়া পর্যন্ত কোনো ঝামেলা হয়নি। এরপরই চেকিঙের জন্য দাঁড়াতেই শুরু হলো যত সমস্যা। অরণির সাথে ছোট একটা হাতব্যাগ ছাড়া আর কোনো লাগেজ নেই। এই ব্যাগটা আসলে তার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার ব্যাগ। সে যখন তার মায়ের খবরটা শুনতে পায় তখন সে লাইব্রেরিতে ছিল। তার চাচা ফোন করে খবরটা জানায়। খবটা শুনে বাসায় গিয়ে ও কাপড়ও চেঞ্জ করেনি। শুধু ব্যাগটা নিয়ে ওতে টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস ভরেছে, আর জুতোজোড়া চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসেছে।
কে জানত অকারণে এই কাস্টমসে এত ঝামেলা পোহাতে হবে। প্রথমে ওর ব্যাগটা চেক করতে গিয়ে দেরি করছিল। যদিও এখনও ও বুঝতে পারেনি ঝামেলাটা কোথায়। প্রথমে ওকে দেরি করাল কাউন্টারে আটকে রেখে। তারপর লাইন থেকে বের করে নিয়ে এলো একটা আলাদা রুমে। তখন থেকে এই লোক এটা-ওটা ঘাঁটছে আর আজেবাজে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। এবার অরণির উঠল রাগ। সে রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠল, “আপনি আসলে চাচ্ছেনটা কী, আমাকে বলেন তো?”
“আপনি রাগ হবেন না প্লিজ। একটু অপেক্ষা করুন। আমি দেখছি।”
বলে সে বেরিয়ে গেল। অরণি মহা বিরক্তির সাথে অপেক্ষা করতে লাগল।
তাকে আরও দশ মিনিট বসিয়ে রেখে লোকটা ফেরত এলো। তার মুখে একটা তেলতেলে হাসি। “সরি ম্যাডাম, দেরি হয়ে গেল। এই নিন আপনার পাসপোর্ট, এভরিথিং ইজ ফাইন।”
অরণির ইচ্ছে হলো লোকটাকে একটা চড় মারে। কিন্তু এমনিতেই সে মহা ঝামেলার ভেতরে আছে। সেটাকে আর বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। পাসপোর্টটা ব্যাগে ভরে সে বাইরের দিকে হাঁটা দিল। কিন্তু সে জানে না ঝামেলার শুরু হলো মাত্র।
মেয়েটা হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার একটু পর কাস্টমস অফিসার মুখে বত্রিশ ভোল্টের একটা হাসি নিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দিল। দিনটা তার খুব ভালো যাচ্ছে, সকালবেলা উঠেই একটা মেয়েকে পনেরো মিনিট দেরি করিয়ে দিয়ে যদি নগদ দশ হাজার টাকা পাওয়া যায় খারাপ কী!
এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই সকাল বেলার রোদটা অরণির চোখে ধাক্কার মতো লাগল। কতদিন পর পরিচিত সেই ঢাকা। পাঁচ বছর আগে এই ঢাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল মনের ভেতর অনেক কষ্ট নিয়ে। কে জানত তাকে এভাবে ফিরে আসতে হবে দ্বিগুণ কষ্ট নিয়ে। যে মানুষটার ওপর রাগ করে চলে গিয়েছিল সে মানুষটা…
ভাবতে ভাবতে আপন মনেই সে হাঁটছিল কার পার্কের দিকে, হঠাৎ করেই কিছু একটা ওর গায়ের ওপর এসে পড়ল। অরণি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতের ব্যাগটা ধরে কেউ টান দিল। ব্যাগটা তো ছুটে গেলই প্ৰচণ্ড হ্যাঁচকা টানে ও মাটিতে পড়ে গেল।
ও মাটিতে পড়েছে বেশ জোরে, মুহূর্তের জন্য মনে হলো জ্ঞান হারাবে কিন্তু টিকে রইল প্রচণ্ড ইচ্ছের জোরে। আবছাভাবে বুঝতে পারল ওর পাশ দিয়ে হুশশশ করে চলে গেল কিছু একটা। অরণি এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে যে উঠে বসার কথাও ভুলে গেছে। এখনও ও পরিষ্কারভাবে ভাবতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারল ওর আশেপাশে লোকজন জমে গেছে। চারপাশে লোকজনের মৃদু কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কেউ ওকে সাহায্য করছে না। অরণি নিজেই উঠে বসল। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে দেখল ঠিকই আছে, ভাঙেনি। পরনের জিন্স আর শার্ট টেনেটুনে ঠিক করল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ব্যাগটা ওরা নিতে পারেনি। ওটা হাত থেকে ছুটে গেলেও ওর বেল্টের একপাশে ওটার ফ্ল্যাপ আটকানো ছিল। এই কারণেই বাইকের ছিনতাইকারীরা টান দিতেই ও মাটিতে পড়ে গেছে।
অরণি উঠে বসার চেষ্টা করতে কোমরে বেশ ব্যথা টের পেল। চারপাশের লোকজনের ভিড়ে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ কেউ একজন ধমকে উঠল, “সরেন সরেন, এইহানে কী? সরেন।”
একজন বয়স্ক লোক। বেশ মোটাসোটা, মুখে লম্বা দাড়ি। মনে হয় সিএনজি বা টেক্সি ড্রাইভার হবে। লোকটার একটা হাত নেই কিন্তু বেশ জাদরেল চেহারা।
“সবাই এইহান থেইক্কা সরেন। একটা মানুষ পইরা গেছে আর আপনেরা তামশা দেখতাছেন। কেউ সাহায্য করা তো দূরে থাক সবাই মিল্লা তামশা দেহা। এই নুর, হাফিজ সরা তো সবাইরে,” সে তার মতো একই পোশাক পরা আরও দুজনের উদ্দেশে বলল।
“আম্মাজান আপনে আমার লগে আহেন,” বলে সে অরণির দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। অরণি লোকটার হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে ধন্যবাদ জানাল।
“ব্যথা পাইছেন নি কোথাও, আম্মাজান?” অরণির হাত ডলতে দেখে জানতে চাইল।
“না না, আমি ঠিক আছি,” যদিও ওর গলা কাঁপছে। “আমাকে একটা টেক্সি বা ক্যাব ডেকে দিতে পারবেন, প্লিজ।”
“আপনে আমার গাড়িতে আসেন আম্মাজান। ওইহানে আমার গাড়ি। আসেন।”
অরণি লোকটার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। লোকটার আন্তরিকতা ওর মন ছুঁয়ে গেছে। একটা কালো রঙের ক্যাবের সামনে এসে থেমে গেল ওরা। লোকটা ক্যাবের দরজা খুলে দিতে ও উঠে বসল।
“কই যাইবেন আম্মাজান?”
“আমি আমি, ঢাকা মেডিকেল।”
“কেউ অসুস্থ নি, আম্মাজান?”
অরণি উত্তর দিল না। কেউ অসুস্থ নয়, ওকে মর্গে যেতে হবে, ঢাকা মেডিকেল মর্গে। ওর মায়ের লাশ পড়ে আছে ওখানে। অরণির প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। ও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়ল।