৩৮
দশ দিন পর
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা
বিদায় বেলা
“তুমি শিওর চলেই যাবে?” হাসান অরণির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল। দুজনের চোখই ছলছল করছে বিদায় বেলায়।
“হাসান, এভাবে বললে আমি যেতে পারব? আমি তো কথা দিয়েছি কিছুদিনের ভেতরেই আবার ফিরে আসব,” অরণি বলল।
ওরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। অরণির আমেরিকা ফিরে যাওয়ার ফ্লাইটের আর এক ঘণ্টা বাকি। ইতোমধ্যেই সব ব্যাপার সামাধান হয়েছে। অরণি আর হাসান পুরো কেসটার সমাধান করে পুলিশ ফাইল ক্লিয়ার করেছে। সম্পন্ন হয়েছে ওর মায়ের দাফন। ওর মাকে কবর দেওয়া হয়েছে তার বাবা মনিরুজ্জামান আর মায়ের কবরের ঠিক পাশে। আফতাব আহমদ ওদের সাথে কয়েকদিন কাটিয়ে ফিরে গেছেন মালয়েশিয়ায়। তিনি হাসানকে কথা দিয়েছেন খুব শিগগিরই ফিরে আসবেন আবার দেশে। এখনও সব কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি।
ম্যাপটা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অরণির মায়ের বাসা থেকে শুরু করে সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ধরে নেওয়া হয়েছে ওটা চিরকালেল মতোই হারিয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই হাসানকে তার কেস থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বসুন্ধরা সিটিতে ঝামেলা সহ কিছু ব্যাপার সমাধান করা হয়েছে আর কিছু ব্যাপার চেপে যাওয়া হয়েছে। এসব ব্যাপারে ওদেরকে অনেক সাহায্য করেছে এসপি আতিকুর রহমান। পুরো ব্যাপারটার সমাধান করতে পারায় নিজের ডিপার্টমেন্টে তার অবস্থার আরও শক্ত হয়েছে।
অরণি মায়ের দাফন সম্পন্ন করে ফিরে যাচ্ছে আমেরিকায়। হাসান ওকে সি-অফ করতে এসেছে।
“কোনোভাবেই কি থাকা যায় না?” হাসান আবারও বলল।
“না হাসান। আমি একটা প্রজেক্টের একদম মাঝামাঝি চলে এসেছিলাম। ওটা শেষ করেই আবার ফিরে আসব। আর সত্যি কথা বলতে আমার পড়াশুনা শেষ করে আমি দেশেই ফিরে আসব। যদিও কথাটা খুবই অদ্ভুত শোনায়। কারণ সবাই এই দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে চায় আর আমি ফিরে আসতে চাইছি। তবুও আমি ফিরে আসব।”
বিদায় নিয়ে অরণি লাইনে দাঁড়াল। হাসান দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ মাইকে ঘোষণা এলো খারাপ আবহাওয়ার কারণে সব ফ্লাইট ছাড়তে লেট হবে। অরণি আবার ফিরে এলো।
হাসান হাসতে হাসতে বলল, “দেখেছ এই দেশের আবহাওয়াও তোমাকে যেতে দিতে চাইছে না।”
“অন্তত দুঘণ্টা লেট হবে। আচ্ছা তোমার মোবাইলটা দাও তো আমি যাচ্ছি এটা চাচাকে জানানো হয়নি। তাকে জানিয়ে দেই,” অরণি বলল। হাসান মোবাইলটা দিতে অরণি চাচাকে ফোন করল। কথা শেষ করে সে হাসানকে বলল, “আমার আরেকটা ফোন দিতে হবে।”
“দাও, সমস্যা কী? কাকে?”
“আমার থিসিস সুপারভাইজারকে। চাচা বলল, আমার ই-মেইলের উত্তর না পেয়ে সে নাকি অনেকবার কল করেছিল। দেখি একটা ফোন করে জানিয়ে দেই আমি ফিরে যাচ্ছি।”
অরণি ফোনে কথা বলা শেষ করে হাসানকে ফোনটা ফেরত দিতে দিতে বলল, “হাসান আমার তো ফ্লাইটের দেরি আছে। আমাকে একটা জরুরি ই—মেইলের উত্তর দিতে হবে।”
“হঠাৎ ই-মেইল?”
“না আমার সুপারভাইজারের সাথে কথা হলো তো। আমরা যে গ্রুপের সাথে কাজ করছিলাম ওদের সাথে একটা কন্ট্রাক্ট হওয়ার কথা ছিল। ওটা নাকি আজ-কালের ভেতরে জমা দিতেই হবে। ওই জন্যই ও বারবার আমার বাসায় ফোন করছিল। আমি ই-মেইলটা পাঠিয়ে দেই। কারণ আমার যেতে তো অনেক সময় লাগবে। এখানে কি সাইবার ক্যাফে আছে?”
“না সাইবার ক্যাফে নেই, কিন্তু এখানে জায়গায় জায়গায় ফ্রি ইন্টারনেট বুথ থাকে। দাঁড়াও দেখি।”
দুজনে মিলে একটা ফ্রি বুথ খুঁজে বার করল। কিন্তু ওটাতে একজন দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করতে করতে অরণি জানাল, “আমি ই-মেলইটা পাঠিয়ে আমরা ক্যাফেতে বসে কফি খাবো? কি বলো?”
“কফি কেন? চলো ডিনার করে নেই। কারণ তুমি আবার কখন খাও না খাও ঠিক তো নেই।”
“হ্যাঁ, তাই চলো।”
“ওই যে বুথ খালি হয়েছে। যাও।”
অরণি আর হাসান মনিটরের সামনে এসে জিমেইল ওপেন করে নিজের অ্যাকাউন্টে ঢুকল। “কতদিন মেইল খুলি না দুনিয়ার মেইল এসে বসে আছে,’ অরণি ইনবক্স দেখতে দেখতে বলল। “কী ব্যাপার আমার নামে আমাকে ই—মেইল করল কে? ও মাই গড,” অরণির হাত থেকে ব্যাগটা ঠাস করে মাটিতে পড়ে সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ল।
“কী ব্যাপার? কী হলো? শরীর খারাপ করল নাকি?” হাসান পাশ থেকে জানতে চাইল হঠাৎ সবকিছু এভাবে পড়ে যাওয়াতে সে চমকে গেছে।
অরণি ওর কথার উত্তর না দিয়ে ভূতের মতো হাত তুলে মনিটরের দিকে দেখাল। “মায়ের ই-মেলই।”
“কী?” হাসান মনিটরের দিকে দেখল। “হায় খোদা ম্যাডামের ই-মেইল। কবে ডেটটা দেখা তো।“
এটা তার মৃত্যুর আগের দিন।”
“ই-মেলইটা পড়ো।”
“ডিয়ার অরো,
তোমার মামণি বলছি। আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি। আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটা তোমাকে দিয়ে গেলাম। যত্ন করে রেখো। পারলে মামণিকে ক্ষমা করে দিও।
“সর্বনাশ, আমার মনে হয় এই চিঠিতে কোনো ব্যাপার আছে। এটা ম্যাডাম নিশ্চয়ই এমনি এমনি পাঠাননি।”
“আমাদেরকে এই ই-মেইল অ্যাড্রেসের ভেতরে ঢুকতে হবে।”
“কেন?”
“কারণ যখন চিঠির যুগ ছিল তখন মা একটা কাজ করতেন। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পুরানো চিঠির খামের ভেতরে বাবার জন্য নোট রেখে যেতেন।”
“নোট মানে?”
“নোট মানে কী করতে হবে, কখন আসবে এসব আর কি?”
এই জন্য তোমার মনে হচ্ছে, এই অ্যাকাউন্টে ঢুকতে হবে?”
“আরও একটা ব্যাপার আছে হাসান। ওই ছবিটার কথা মনে আছে? পা ভাঙা ঘোড়ার ছবিটা। ওখানে মায়ের হাতে একটা লেখা ছিল না?”
“হ্যাঁ।”
“ওখানে এই ই-মেইল অ্যাড্রেসটাই লেখা ছিল।”
“তুমি শিওর?”
“হ্যাঁ অবশ্যই, আমি শিওর।”
“তাহলে লগ আউট করে এটা থেকে বের হও, তারপর চেষ্টা করো।”
“হুমমম,” অরণি নিজের ই-মেইল থেকে লগ আউট করে জিমেইলের অ্যাকাউন্টা বারে অ্যাড্রেসটা লিখল। “পাসওয়ার্ড কী হতে পারে?”
“তুমিই ভালো বলতে পারবে। তবে তোমার নাম ট্রাই করে দেখো।”
“ওকে…নাহ কাজ হয়নি। দাঁড়াও আমার বার্থ-ডে। নাহ… আচ্ছা ওই ছবিটাতে একটা কথা লেখা ছিল না, ট্রুথ ইজ অলওয়েজ…
ওটা দিয়ে ট্রাই করে দেখবে? দেখো।”
অরণি কথাটা পাসওয়ার্ডের জায়গায় টাইপ করে লগ ইন দিল। লগ ইন হচ্ছে দুজনেই অপেক্ষা করছে। খুব সুন্দরভাবেই লগ ইন হয়ে গেল। “শাবাশ। এ তো দেখি সত্যি সত্যিই…’
হাসান কথা বলতে বলতে অরণি ইনবক্স দেখল নাহ কিছু নেই। ড্রাফটে ঢুকতেই দেখল একটা মেইল সেভ করা। সেটা ওপেন দিতেই দুজনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
“ও মাই গড। এ তো দেখি সেই ম্যাপ।”
“হ্যাঁ, মা শুরুতেই পুরো ব্যাপারটা জানার পর এটাকে স্ক্যান করে এখানে রেখে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি ইঙ্গিতে সব সাজিয়ে রেখেছিলেন যাতে আমি এগুলো খুঁজে বার করতে পারি। আর বাকি সব ছিল সাজানো নাটক। যাতে … ‘
“ও গড়… এই কারণেই ম্যাডাম লিখে রেখে গিয়েছিলেন, ‘সত্য সর্বদা সম্মুখেই বিদ্যমান’ ঠিক যেভাবে হাফিজ স্যার লিখেছিলেন এবং এটাই ছিল পাসওয়ার্ড। এখন এটাকে…”
“আমরা উদ্ধার করব,” অরণি দৃঢ়স্বরে বলল।