২৫শে মার্চ – ১১

১১

পুরান ঢাকা
বর্তমান সময়, বেলা প্রায় ১২টা

অরণি গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তাকে খুবই হতভম্ব মনে হচ্ছে। চড় খেয়ে তার মুখের একটা পাশ লাল হয়ে গেছে। চাচাও ওদের দিকে ফিরে তাকিয়েছে। তাকেও যথেষ্ট পরিমাণে হতভম্ব মনে হচ্ছে। হওয়ারই কথা, যে মানুষটাকে এত কষ্ট করে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা হলো সে যদি এরকম আচরণ করে তবে হতভম্ব হওয়ারই কথা।

“কী? খুব অবাক হয়ে গেলে মনে হচ্ছে?” হাসান হাত ডলতে ডলতে বলল। জোরে চড় মারার করণে সেও হাতে ব্যথা পেয়েছে। এটা তোমার মায়ের তরফ থেকে, তাকে একা ফেলে চলে যাওয়ার কারণে। “তোমার মায়ের মেয়ে হওয়ার কোনো যোগ্যতা তোমার ছিল না,” হাসান হাত ডলতে ডলতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। “তোমার মায়ের সন্তান হওয়া উচিত ছিল আমার। তুমি জানো মানুষটা কতটা কষ্ট পেয়েছিল যখন তুমি তাকে ছেড়ে চলে গেলে?” তার চোখে চকচকে অশ্রু।

অরণি মনে মনে বলল, তুমি তো আরও জানো আমিও কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম। কতটা কষ্ট পেয়ে আমি চলে গিয়েছিলাম মাকে ছেড়ে। মুখে বলল, “তুমি জানো না হাসান আমি কেন তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম,” অরণির চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইছে না। মনে মনে একবার ভাবল হাসান কি সত্যিটা জানে? ওর সাথে কি মা শেয়ার করেছে? হাসানের পরের কথাটা শুনে ও স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

“কেন অরণি? কী এমন হয়েছিল যে তুমি তাকে ছেড়ে চলে গেলে? তোমার সবচেয় প্রিয় মানুষটিকে ছেড়ে? কী এমন ঘটেছিল? এমনকি হাজারবার জিজ্ঞেস করার পরও ম্যাডাম আমাকে বলেনি। ব্যাপারটা কী অরণি?” হাসান ওর চোখের দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে বলল। অরণি চুপ করে আছে। যাক হাসান তাহলে জানে না।

ওদের কথার মাঝখানে চাচা মৃদু কাশি দিয়ে উঠল, “মামণি, আমাদের মনে হয় এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। এখান থেকে সরে পড়লে ভালো হতো।”

“হ্যাঁ চাচা, ঠিক বলেছেন,” অরণি চোখের পানি মুছে নাক টেনে বলল। “আপনি গাড়ি স্টার্ট দেন। হাসান, এ হচ্ছে আমির চাচা। তোমাকে উদ্ধার অভিযানে তিনি আমাকে অনেক হেল্প করেছেন। আসলে তিনি না থাকলে ব্যাপারটা সম্ভব হতো না।”

“থ্যাঙ্কস চাচা,” হাসান তার স্বভাবসুলভ ত্যাড়া ভঙ্গিতে বলল। “চাচার বাড়ি কই?” সে তার কপালের পাশে সামান্য ছড়ে যাওয়া একটা জায়গা ডলছে। গাড়ির পরিবেশ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। যদিও হাসান, অরণি কেউই কারও দিকে তাকাচ্ছে না।

“গাজীপুর বাবা,” চাচা মাথা নেড়ে বলল।

“চাচার হাত কাটা গেল কেমনে? একটা হাতের কবজি ছাড়া গাড়ি চালাতে সমস্যা হয় না?” অরণি ঝট করে হাসানের দিকে তাকাল তার চোখে আপত্তি। তার মতে এমন একটা প্রশ্ন করে হাসান মোটেই ঠিক করেনি।

“না বাবা, বহু বছর গাড়ি চালাই তো এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। আর হাত কাটা গেছিল সংগ্রামের সময়ে। পাকিস্তানিগো হাতে ধরা পড়ছিলাম। তার আগেই হাতে শেল লাগছিল। যখন উদ্ধার হইলাম তখন হাতে পচন ধরছিল। পরে কাইটাই ফালাইতে হইছে। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো, আর এহন মনে অয় এইটাই তো ভালা। হা হা হা,” চাচার কথা শুনে মনেই হলো না সে মাইন্ড করেছে। “তা বাবা আমরা এখন কোনদিকে যাব। তোমরা যে খেইল দেহাইলা এর পরে তো মনে হয় জরুর পুলিশ পিছে লাগবো।”

“লাগবো না চাচা, এরমধ্যেই লেগে গেছে,” হাসান গাড়িতে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে, সে মৃদু হাসছে।

“তোমার মনে হয় খুব মজা লাগতেছে,” অরণির মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে হাসানের হাসি দেখে।

“অবশ্যই মজা লাগতেছে। কতদিন এরকম অ্যাডভেঞ্চারাস কিছু করি না,” সে এখন বেশ জোরে জোরেই হাসছে। “অনেকদিন পর আবার মনে হচ্ছে দম পাচ্ছি,” বলে সে অরণির দিকে ফিরে তাকাল। “রিলাক্স অরো, এই ঘটনা আমার জন্য নতুন কিছু না। এরকম সিচুয়েশনে আমি এর আগেও পড়েছি এবং কী করতে হবে তা ভালো করেই জানি।”

“বাবাজি আমি উলটা-পালটা গাড়ি কতক্ষণ চালাব? কোথায় যাইতাম কইলে ভালা অইতো।”

“আমাদের প্রথম কাজ হলো গাড়ি বদলানো। এই গাড়িটা সবাই দেখেছে এবং কিছুক্ষণের ভেতরেই এটার জন্য নির্দেশনা চলে আসবে। সেইসাথে আমাদের সবার সম্ভাব্য বিবরণ। তার মানে আমাদের প্রথম কাজ হলো গাড়ি বদলানো। চাচাকে এবার আমরা বিদায় জানাব,” বলে হাসান অরণির দিকে ফিরল।

.

সিএমএম কোর্টের প্রাঙ্গণে হুলস্থুল কাণ্ডের ভেতরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছে এসপি আতিকুর রহমান। তার পাশে স্ট্রেচারে শুয়ে একটানা কথা বলেই যাচ্ছে মোহাম্মদপুর থানার ওসি বজলুর রশিদ। চারপাশে এখনও লোকজনের কোলাহল থামেনি। পুরান ঢাকার এই জায়গাটাতে জজ কোর্ট এবং সিএমএম কোর্ট পাশাপাশি অবস্থিত হওয়াতে একে বলা হয় আইন পাড়া। এই এলাকায় এর আগে কখনো এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। ইনফ্যাক্ট বাংলাদেশেই সাম্প্রতিক সময়ে এরকম ঘটনা নেই বললেই চলে। কিছুদিন আগে একটা জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা বাদ দিলে এভাবে অপরাধী ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা এক বিরল ব্যাপার। কথাটা মনে হতে আতিকুর রহমানের ব্যাপক হাসি পেল। কারণ এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর দরকারই পড়ে না, সবাই আজকালকার দিনে রাজনৈতিক কিংবা ওপর মহলের সাথে আঁতাত করেই ছাড়া পেয়ে যায়। তবে এই ঘটনা প্রমাণ করে এইরকম একটা আইন এলাকার মতো জায়গার নিরাপত্তা কতটা দুর্বল এবং অপরাধী বহন করার প্রক্রিয়াটাও কতটা নিরাপত্তাহীন।।

আতিক সাহেব আরেকবার চারপাশে তাকাল। অ্যাক্সিডেন্টে আর বিভিন্ন ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছে, তাদেরকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা বজলুর রশিদের কাছে শুনে তার কাছে দুটো ব্যাপার খটকা লাগছে। এক. মেয়েটা তার মায়ের খুনিকে কেন ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে? দুই. স্পটে দুটো স্মোক বম্বের কেসিং পাওয়া গেছে এগুলো এলো কোত্থেকে?

ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। এখানে গভীর কোনো ব্যাপার আছে। তার ইনস্টিঙ্ক তাকে সাবধান করে দিল। এই ইনস্টিঙ্কের ওপর তার অনেক ভরসা, কারণ এর ওপর ভরসা করেই সে টিকে আছে। চারপাশের এই পরিস্থিতিতে সৎ পুলিশ হওয়ার মতো বিলাসিতা করে সে টিকে আছে একমাত্র এর জোরেই।

আতিক সাহেব বজলুর রশিদের দিকে তাকাল। বজলু মিয়া বলেই যাচ্ছে। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে তারপরও কথার বিরাম নেই। আতিক সাহেব তাকে থামিয়ে দিল। “থামুন, আমি আপনার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি? তবে আপনার কথা থেকে বুঝতে পেরেছি এই ঘটনার পেছনে আপনার একটা মারাত্মক ভুল আছে। আপনি মেয়েটাকে ছেলেটার সাথে দেখা করতে না দিলে এটা ঘটত না। কাজেই চুপচাপ হাসপাতালে যান, শুয়ে থাকুন, সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুলবেন না। বুঝেছেন?”

বজলু মিয়া মাথা নাড়ল। তাকে নেওয়ার পর আতিকুর রহমান একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব-ইন্সপেক্টরকে ডেকে নির্দেশ দিল, “প্রথমে এই এলাকা ঠিক করুন। সবকিছু সরিয়ে এক ঘণ্টার ভেতরে এখানকার স্বাভাবিক পরিবেশ যেন ফিরে আসে। আর ওই ছেলে এবং মেয়টার ব্যাপারে চারপাশে রেড অ্যালার্ট জারি করে দিন। আর মিডিয়া যদি জানতে চায় প্রয়োজনে ওদেরকে ব্যবহার করুন। আমি ওদেরকে চাই। আর শুনুন আপনি এই কেস এবং এর যাবতীয় ডিটেইল আমার ডেস্কে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। ওদের ব্যাপারে আমাকে সব জানতে হবে,” বলে সে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার থেমে গেল।

“আপনি এক কাজ করুন সবগুলো মিডিয়াতে এই ছেলে আর মেয়টার ছবি দিয়ে দিন। বলুন ওদেরকে ধরিয়ে দিতে।”

“স্যার,” সাব-ইন্সপেক্টর বলল। “মেয়টার ছবি তো আমাদের কাছে নেই।”

“আরে কী যন্ত্রণা মেয়েটা কি সানি লিওন নাকি যে ওর ছবি আপনার কাছে থাকবে। সংগ্রহ করুন।“

“জি, স্যার।”

গাড়িতে উঠতে উঠতে আতিকুর রহমানের মনে হলো, এই ব্যাপারটা তাকে ডিটেইল জানতে হবে।

.

“কিছু মনে না করলে একটা কথা জিগাইতে পারি?” চাচা জানতে চাইল।

“হ্যাঁ, চাচা বলুন,” অরণি জবাব দিল।

“আপনাগো গাড়ি বদলানোর দরকার কেন?”

“কারণ ওই ঘটনার পর এই গাড়িটা মার্কামারা হয়ে গেছে। পুলিশের লোকজন প্রথমেই এই গাড়িটাই খুঁজবে। কাজেই আগে এটা বদলাতে হবে।”

“বাবা আমার মনে অয় এই ব্যাপারে আমি তোমাগো সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারব,” চাচা গাড়ি চালাতে চালাতে বলল।

“ও চাচা আপনি তো টেক্সিক্যাব সমিতির কী জানি একটা,” অরণির মনে পড়ে গেল চাচা প্রথমে একবার এটা তাকে বলেছিল।

“জি মামণি। সভাপতি। তুমরা চাইলে আমি যেকোনো গাড়ির ব্যবস্থা কইরা দিতে পারব,” চাচা বেশ জোর দিয়ে বলল।

অরণি হাসানের দিকে ফিরে তাকাল, “কী বলো?” হাসান কাঁধ ঝাঁকালো, “ঠিক আছে। এটা বরং ভালোই হয়।”

“ঠিক আছে এখন বলো আমরা প্রথম যাব কোথায়? কোথা থেকে শুরু করব?” অরণি জানতে চাইল।

“আমাদেরকে আগে ঠিকঠাক হতে হবে। আমার অবস্থা খুব খারাপ প্লাস আমি কতদিন ঠিকমতো গোসল করিনি কে জানে। আমি ঠিকঠাক না হয়ে কিছুই করতে পারব না। আমার ধারণা তোমারও একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার,” হাসান বলল।

“হ্যাঁ, আমারও গোসল করে চেঞ্জ করা দরকার। তবে… কী জানি? ঠিক আছে এটাই ভালো হবে কিন্তু আমরা যাবটা কোথায়?” অরণির কণ্ঠে অনিশ্চয়তা।

“আমার বাসায় কিংবা তোমার মায়ের বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমি তো বলেছিই না এক্সাক্টলি এরকম না হলেও এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমি এর আগেও পড়েছি। এই কারণেই আমার এরকম ছোটখাটো কিছু ব্যাপার রেডি করাই থাকে,” হাসানের মুখে মৃদু হাসি।

“মানে?” অরণি যথেষ্টই অবাক।

এর আগে একবার এক প্রভাবশালী লোকের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার পর সে আমাকে প্যাদানি দেওয়ার জন্য হুলিয়া জারি করে। ওরা আমাকে নীলক্ষেত মোড়ে প্রায় ধরেই ফেলেছিল, কোনোভাবে পালাই। কিন্তু এরপর যা ঝামেলায় পড়ি। সবচেয়ে বড় ঝামেলা ছিল ওখান থেকে পালানোর সময়ে মোবাইলটা হারিয়ে ফেলি। কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ওই ঘটনার পর যাবতীয় নম্বরসহ একটা মোবাইল, এক সেট কাপড় আর হাবিজাবি জরুরি সব জিনিস নিয়ে আমি কয়েকটা প্যাক রেডি করে কয়েক জায়গায় রেখে দেই। এরকম একটা প্যাক রাখা আছে আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায়। আর ওখানে গেলে তুমিও ফ্রেশ হতে পারবা। ভাবি খুব চমৎকার মানুষ।”

“কিন্তু ওখানে গেলে তাদের আবার কোনো বিপদে ফেলে দেওয়া হবে না তো?”

“মনে হয় না। আর এটুকু ঝুঁকি এখন নিতেই হবে,” বলে হাসান চাচার দিকে ফিরে বলল, “চাচা, আমি যেভাবে বলি, শুনুন। আপনি আমাদেরকে আরামবাগ মোড়ে এজিপি কলোনির সামনে নামিয়ে দেবেন। এরপর আপনি গিয়ে পালটে আসবেন গাড়িটা। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি টেক্সি ক্যাব না এনে একটা সাধারণ গাড়ি আনতে পারেন। আর আপনিও পোশাকটা পালটে আসবেন সম্ভব হলে। এক ঘণ্টা পর আপনি নটরডেম কলেজের সামনে দাঁড়াবেন। আমরা ওখানেই থাকব। আপনার সাথে কোনো মোবাইল আছে?… আচ্ছা থাক নম্বর নেব কীভাবে আমাদের কারও সাথে তো মোবাইল নেই। ঠিক আছে ওই কথাই রইল আপনি তাহলে রওনা দেন,” হাসান একটানা কথাগুলো বলে একটু বিরতি দিল। “আর চাচা, আপনাকে এভাবে বারবার জড়াতে হচ্ছে দেখে আমারও খারাপ লাগছে কিন্তু কী করব বলেন আমাদের আসলে আর রাস্তা নেই।”

“আরে বাপ কী যে কও। তোমরা আমারে বিদায় দিবা শুইন্নাই মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। এহন বরং মজা লাগতাছে। হাহা। তুমরা কুনো চিন্তা কইরো না। আমি ঠিক এক ঘণ্টা পরেই চইলা আসমু।”

চাচা ওদেরকে এজিপি কলোনির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। ওরা কলোনির ভেতরের দিকে হাঁটা দিল।

“কতদূর এখান থেকে?” অরণি জানতে চাইল।

ওই তো দুটো বিল্ডিং পরেই। আমার এই বড় ভাইটি ইউনিভার্সিটি লাইফে ছিল পাগল বিশেষ। এখন বিয়েটিয়ে করে গেছে,” হাসান হাসতে হাসতে বলল।

“গেছে মানে?”

“গেছে মানে বোঝো না? মুরগি হয়ে গেছে আর কি। বেচারা চাকরি আর সংসার নিয়ে শেষ, প্যাথেটিক লাইফ।”

অরণি ঝট করে হাসানের দিকে ফিরল, “হাসান, মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত। সবাই কি তোমার মতো বাউন্ডুলে হয়ে থাকবে নাকি, সবসময়। আশ্চর্য!”

“আরে কী যন্ত্রণা, এত সিরিয়াস হওয়ার মতো কী বললাম! আজব। তুমি ওকে জানো না। ইউনিভার্সিটি লাইফে ও যে কী ছিল। আমি বলতে চেয়েছি বিয়ে করে বেচারা এখন অনেক রেগুলার হয়ে গেছে। ওর জন্য ভালোই হয়েছে। তুমি এখন সিরিয়াসনেস কমাও তো। মেয়েদের নিয়ে এই এক ঝামেলা, হুদাই সিরিয়াস,” সে আফসোসের সাথে মাথা নাড়ল।

অরণি আবারও রাগের সাথে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল হাসান হাত উঁচু করে দেখাল, “ওই বিল্ডিং। চলো ভাবির সাথে পরিচিত হয়ে মজা পাবা, খুবই চমৎকার মানুষ। এক সময়ের বামপন্থি নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। এখন দুর্দান্ত গৃহিণী, হাহা।”

ওরা তিনতলায় উঠে কলিংবেশ বাজালে হাসিখুশি এক মহিলা দরজা খুলে দিল। হাসানকে দেখে রীতিমতো চিৎকার করে উঠল, “আরে হাসান, কতদিন পর,” এইটুকু বলেই তার মুখ কালো হয়ে গেল। “তোর ওই ঝামেলাটার কী হলো?”

“আরে ভাবি আগে ভেতরে তো ঢুকতে দাও। সব বলব,” বলে ও অরণিকে দেখাল। “ভাবি ও অরণি, আমার…’

“হাসান, ওকে তোর পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। ইউনিভার্সিটি লাইফে ওর কথা বলে বলে তুই আমাদের কান পচিয়ে দিতি। এসো অরণি ভেতরে এসো।”

ভাবির কথায় অরণি একটু অবাক হয়ে গেল। হাসান ওর কথা অন্যদের সাথে গল্প করত। আশ্চর্য! ও হাসানের দিকে তাকিয়ে দেখল হাসান মনে হয় একটু লজ্জা পেয়ে গেছে।

ওরা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে হাসান ভাবিকে টেনে পাশের রুমে নিয়ে গেল, “ভাবি, তুমি একটু আমার সাথে এসো। জরুরি কথা আছে।” ওরা ভেতরে চলে যেতে অরণি ড্রয়িংরুমে বসল। সাধারণ বাসা, পুরানো আমলের কোয়ার্টার যেমন হয়। মোটামুটি সুন্দর করে গোছানো। টিপিক্যাল মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুম। কিন্তু কোথায় যেন একটা মায়ার ছোঁয়া আছে। অরণি অনেকদিন পর এরকম কোনো বাড়িতে এসেছে। ওর মনে পড়ে যাচ্ছে একসময় ওদের বাড়িতে প্রায় এরকম একটা ড্রয়িংরুম ছিল। আর এখন ওর পরিবার! ভাবতে গিয়ে ওর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

হাসান ভাবিকে নিয়ে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ভাবির চেহারা গম্ভীর হয়ে গেছে। হাসান নিশ্চয় তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে। অরণির হঠাৎ মনে হলো এখানে এসে ওরা এই পরিবারের মানুষগুলোকে বিপদে ফেলে দিল না তো।

হাসান ওর সামনে এসে বলল, “অরণি তুমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাও। আমরা খুব জলদি বেরোব,” ভাবির দিকে ফিরে বলল, “ভাবি, তুমি অরণিকে তোমার এক সেট পোশাক দিতে পারবে। আমার ধারণা তোমার পোশাক ওর বেশ হয়ে যাবে। আর তুমি আমাকে আমার ব্যাগটা দাও। দিয়ে দ্রুত কিছু খেতে দাও।”

“ওমা আমি তো আরও রান্নাবান্না করতে…

“কোনো দরকার নেই। কিছু থাকলে সেটাই দাও আর না থাকলে নেই। আর তোমার পিচ্চিদের স্কুল ছুটি হবে কখন?”

“এই তো আর ঘণ্টাখানেক বাদে।”

“ওকে, আমরা আধা ঘণ্টার ভেতরে বেরোব। অরণি তুমি গোসল সেরে নাও।” অরণি গোসল সেরে ভাবির এক সেট সালোয়ার-কামিজ পরে নিল। মোটামুটি ভালোই ফিট করেছে। তবে অনেকদিন পর সালোয়ার-কামিজ পরাতে ওর অস্বস্তি হচ্ছে একট। তারপরও এখন অনেকটাই ফ্রেশ লাগছে ওর। হাসানও ওর ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিল। ওরা বেরোবে, হাসান ওর ব্যাগ গোছাচ্ছে, অরণি জানতে চাইল, “এর ভেতরে কী আছে?”

“এক সেট কাপড় ছিল তো দেখলেই। এই মোবাইলটা, সাথে আরেকটা মোবাইল, এটা তুমি রাখবে। এটাতে আমার এই সেটটার নম্বর সেভ করা আছে। আর এখানে টাকা আছে বেশ কিছু। নাও এগুলো তুমি রেখে দাও, কয়েকটা এক হাজার টাকার নোট ও বাড়িয়ে দিল।

“টাকা লাগবে না, আমার কাছে তো ডলার আছে। ভাঙাতে হবে আর কি,” টাকা নিতে অরণির অস্বস্তি লাগছে।

“আরে গাধা ডলার ভাঙাতে পারবে কি না কে জানে। এগুলো রাখো, প্রয়োজনে পরে ডলার ভাঙিয়ে ফেরত দিয়ো। আরে ফ্রেশ হওয়ার পর তোমাকে তো বেশ লাগছে, ভালোই দেখাচ্ছে সালোয়ার-কামিজে। ভাবি ভাবি,” হাসান ডাকতে ডাকতে চলে গেল।

“হ্যাঁ, ঠিক আছে,” অরণি টাকাগুলো নিয়ে ওর ব্যাগে গুঁজে রাখল। মনে মনে ভাবল, এই ছেলেটা আজও মানুষ হলো না, এভাবে কেউ কারও প্রশাংসা করতে পারে! এটা একমাত্র ওর দ্বারাই সম্ভব।

“আরে তোরা এভাবে কিছু না খেয়ে বেরিয়ে যাবি, আমি…” ভাবি রান্নঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল।

“ভাবি কোনো দরকার নেই। আমরা এখান থেকে যত দ্রুত বেরোব তত ভালো। আর তুমি তো বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে যাবে। ভাবি শোনো, ইকবাল ভাইকে সালাম দিয়ো। আর হ্যাঁ, কেউ যদি আমাদেরকে এখানে খুঁজতে আসে তুমি স্রেফ বলবে, তুমি কিছুই জানো না। ঠিক আছে?’

“ঠিক আছে। কিন্তু তোরা…” ভাবি কিছু একটা বলতে চাইলে হাসান থামিয়ে দিল।

“ভাবি, আমরা সাবধানে থাকব।”

“হাসান তুই চাইলে কিন্তু আমি তোদেরকে ইকবালের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারি। ওখানে তোদের কেউ খুঁজে পাবে না।”

“ভাবি সেটা সম্ভব না। কারণ আমাকে এটার সমাধান করতে হবে। আর সেটা আমাকে করতে হবে এখানে। ওখানে গিয়ে আমি কয়দিন লুকিয়ে থাকব, বলো।”

ভাবি এগিয়ে এসে একবার হাসানের মাথায় হাত বুলাল আর অরণিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সাবধানে থেকো। আর হাসান তুই ওকে দেখে রাখিস।”

ওরা হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে এলো। নটরডেম কলেজের সামনে এসে দেখে চাচা এখনও আসেনি।

“অরণি, তোমার কি মনে হয় চাচা আসবে।“

“কী জানি তবে আমার মনে হয় আসবে। কারণ তার যদি এই ব্যাপারটা থেকে পালানোর ইচ্ছেই থাকত তবে সে এর আগেই পালাতে পারত তোমার ওই ব্যাপারটা নিয়ে এত ঝামেলা করতে হতো না। দেখো মাত্র চল্লিশ মিনিট গেছে, আরও তো সময় আছে। অপেক্ষা করে দেখি।”

“ঠিক আছে। তবে এখানে না। আরেকটু এগিয়ে কোনো একটা রেস্তোরাঁয় বসে কিছু খেয়েই নেই। এরপর কী করব সেটা ভেবে বের করতে হবে।“

ওরা একটা রিকশা নিয়ে মতিঝিলের কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ল। রেস্তোরাঁটার ভেতরে একপাশে ছোট ছোট ঘেরা জায়গা আছে আলাদা আলাদা বসার জন্য। ওরা বসে পড়ল ওরকম একটা জায়গা দেখে।

খাবার অর্ডার করার পর অরণি জানতে চাইল, “এবার কী করা? আমরা কোথা থেকে শুরু করব?”

“প্রথমেই তুমি আমাকে ম্যাডামের রেখে যাওয়া প্যাকেটটা দেখাও।“

অরণি ব্যাগের ভেতর থেকে ওটা বের করে হাসানের হাতে দিল। হাসান প্যাকেটা থেকে সব বের করল একটা একটা করে। প্রথমে কুরিয়ারের প্যাকেটটা। ওটার ভেতরেই বাকি সব রাখা। এরপর ছবিটা বের করে উলটে—পালটে দেখতে লাগল।

“এটাও ছিল ওখানে,” বলে অরণি কয়েনটা ওর হাতব্যাগের একটা ছোট চেন খুলে বের করে দিল।

“আশ্চর্য! এরকম কয়েন তো কখনো দেখিনি। আর ছবিটাও খুব অদ্ভুত। ছবিটাতে কয়েক ফোঁটা শুকনো রক্তের দাগও দেখলাম। আজব! আর তার চেয়ে অবাক ব্যাপার ওই ডায়লগ আর আমার নাম,” বলে ও ডায়লগটা বিড়বিড় করে পড়তে লাগল, “ট্রুথ ইজ অলওয়েজ ইন ফ্রন্ট অভ ইউ”, ‘সত্য সর্বদা তোমার সামনেই থাকে।”

“এ থেকে আমরা কী বুঝব? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না? তুমি?” অরণি জানতে চাইল। এরপর ফিসফিস করে বলল, “ওগুলো আড়াল করো, ওয়েটার আসছে।“

হাসান অরণির ব্যাগটা দিয়ে সব ঢেকে দিল। ওয়েটার খবার দিয়ে যাওয়ার পর দুজনেই খেতে খেতে আলোচনা করে যেতে লাগল। “আচ্ছা ম্যাডাম যে তোমাদের বাসায় ফোন করেছিলেন তখন কি কিছু বলেছিলেন?”

“না, আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কী, আমি তখন বাসায় ছিলাম না। ফোন ধরেছিল আমার চাচার ছোট মেয়েটা। সে কিছুই বলেনি।”

“আমার সাথে যখন ম্যাডামের দেখা হয় আমাকেও তিনি কিছু বলেননি। আমার মনে হয় এই ছবি, এই ডায়লগ, কয়েন এগুলো এমনকিছু যেটা একমাত্র তুমি বুঝতে পারবে।”

“কেন এরকম মনে হচ্ছে তোমার। মনে রেখো ম্যাডামের পেছনে লোক লেগেছিল। সেটা যারাই হোক এবং তাদের হাত থেকে ম্যাডাম কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছিলেন এবং যতদূর মনে হয় কোনোভাবে তিনি সেটা তোমাকে দিয়ে দিতে চাইছিলেন। এর মানে এখানে এমন কিছু আছে যেটা একমাত্র তুমিই বুঝতে পারবে। আর একারণেই তিনি ওটাকে কুরিয়ার…” বলে হাসান থেমে গেল। “দাঁড়াও দাঁড়াও, এক মিনিট,” সে কুরিয়ারের প্যাকেটটা টেনে নিল।

কুরিয়ারের প্যাকেটটা একটা আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সংস্থার। এরা একমাত্র দেশের বাইরেই কুরিয়ার করে। এদের ইনবাউন্ড কোনো সার্ভিস নেই।

“সিএইচএল। এরা তো দেশের বাইরেই কুরিয়ার করে। তার মানে তিনি এটা তোমার কাছেই পাঠাতে চাইছিলেন।”

“হ্যাঁ, ওপরে আমার ক্যালিফোর্নিয়ার ঠিকানাও দেওয়া আছে।”

“অবশ্যই। কিন্তু আমার প্রশ্ন তিনি কুরিয়ার করার জন্য যদি ওখানে গিয়ে থাকেন এবং সবকিছু কুরিয়ারের প্যাকেটে ঢুকিয়েও থাকেন তাহলে কুরিয়ার করলেন না কেন?”

“মা হয়তো সময় পাননি। হয়তো পেছনে কেউ লেগে ছিল যে কারণে নিরাপদ মনে করেননি।”

“আমি ঠিক জানি না কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার কাছে একদম স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কারণ ধরো তুমি একটা কিছু তোমার কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছ না। দেশের বাইরে কাউকে পাঠাবে। সে ক্ষেত্রে তুমি কুরিয়ার করার জন্য নিশ্চয়ই এমন কোনো সংস্থা বেছে নেবে…“

“যার ওপর তুমি ভরসা করতে পারো,” হাসানের কথাটা অরণি শেষ করে দিল। হাসান আবার বলতে লাগল, “হ্যাঁ ঠিকই তো আছে, এটা তো বেশ ভালো সংস্থা। বিশ্বমানের। ম্যাডাম যদি কুরিয়ারটা করে দিতেন তবে তো সেটা তখন ওদের জিম্মায় চলে যেত। আর এরা নিশ্চয়ই আলতু-ফালতু না।”

“মা হয়তো ওদেরকে নিরাপদ মনে করেননি। তাই প্যাকেট করার পরও দেয়নি।”

“উঁহু, নিশ্চয়ই এখানে কোনো গড়বড় আছে। কারণ আমি জীবনেও শুনিনি কেউ কারও জন্য কুরিয়ারের প্যাকেটে কিছু রেখে যায়। তাও আবার এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস।”

“তার মানে কি তুমি বলতে চাইছ এটা কোনো ধরনের কু?”

“সেটা আমি এখনও নিশ্চিত বলতে পারছি না। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের প্যাকেটটা একবার হলেও চেক করা উচিত।”

“তাহলে কী করতে চাও?”

“আমরা এখান থেকে ওই কুরিয়ার শপে যাব।“

“তুমি কীভাবে বুঝবে মা ওদের কোন আউটলেটে গিয়েছিল?” অরণি প্যাকেটে ঠিকানা খুঁজছে।

“ভালো করে দেখো। আমার মনে হয় ওটা প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকার কথা।”

“অ্যাড্রেস অ্যাড্রেস…এই তো। ধুস এখানে তো লেখা সিএইচএল, ঢাকা, বাংলাদেশ। ঠিকানা তো নেই,” অরণির কণ্ঠে হতাশা। “গুগলে একটা সার্চ দিয়ে দেখা যায় না? তোমার মোবাইলে ইন্টারনেট নেই?”

“আরে নাহ এটা ব্যাকআপ মোবাইল। এটাকে নেট অ্যাকটিভ করা নেই। দাঁড়াও এটা যে মানের কুরিয়ার সংস্থা তাতে এর গন্ডাখানেক আউটলেট থাকবে না, একটা বড়জোর দুটো। একটু খোঁজ নিলেই পাওয়া যাবে।”

অরণি এখনও প্যাকেটটাই দেখছে। “মনে হয় লাগবে না। দেখো এখানে লাইনিঙের কাছে একটা— এই তো অ্যাড্রেস আছে। সিএইচএল, পান্থপথ, বসুন্ধনা সিটি, লেভেল ফোর।”

“সাবাস ওখানেই। আমরা ওখানেই যাব। তুমি বসো আমি বিল দিয়ে আসছি,” ওদের খাওয়া শেষ।

হাসান চলে যেতে অরণি হাত ধুয়ে বসে অপেক্ষা করছে। হাসান এলো রীতিমতো ঝড়ের বেগে।

“অরণি,” ওর কণ্ঠ শুনে অরণি চমকে গেল।

“তুমি ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেল, এখনই।”

“কেন? কী ব্যাপার? কী হয়েছে?” অরণি হতভম্ব।

“আমরা দ্রুত এখান থেকে বেরোব। হাসান ব্যাগ থেকে একটা সানগ্লাস বের করে পরে নিয়ে জিনিসপত্র সব তুলে ব্যাগে ভরে নিল। ওরা দ্রুত বেরিয়ে এলো রেস্তোরাঁ থেকে।

“দ্রুত চলো, চাচা যদি আসে— এতক্ষণে চলে আসার কথা। না এলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।”

“ব্যাপার কী, বলো তো? হয়েছে কী?”

“আমাদেরকে টিভিতে দেখাচ্ছে,” বলে ও অরণির মুখের দিকে তাকাল। ‘পলাতক আসামি হিসেবে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *