২৫শে মার্চ – পূর্বকথা

পূর্বকথা

আন্টাঘর ময়দান (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক), ঢাকা
২২শে নভেম্বর, রবিবার, ১৮৫৭
সময় : ভোর প্রায় ৫টা

নিজের বারোটা বাজানোর বহু পন্থা আছে। কিন্তু সেই বারোটা যে এভাবে বাজবে কখনোই ভাবতে পারেনি সে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সবকিছু গুছিয়ে আনার পর যদি পুরো ব্যাপারটা এভাবে কেঁচে যায় তবে এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না।

আন্টাঘর ময়দানের সামনে দাঁড়িয়ে সুবাদারের বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সে। রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। বাস্তবিক পক্ষে সেটাও সম্ভব না। কারণ শুধুমাত্র চোখ দুটো বাদে তার মাথা-মুখসহ সবই পাগড়ির কাপড় দিয়ে ঢাকা। আলগোছে হাতটা চলে গেল কোমরে বাঁধা চামড়ার থলিটার দিকে। হাত বুলিয়ে সে নিশ্চিত হলো, না ওটা ঠিকই আছে।

এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। অত্যন্ত কঠিন হলেও সে এবং সুবাদার সাহেব মিলে সবকিছু গুছিয়ে এনেছিল। তারা দুজনেই প্রায় নিশ্চিত ছিল কোম্পানির হাতে পড়ার আগেই তারা পলাতে পারবে। কিন্তু এখন সুবাদারের বাড়ির সামনে কোম্পানির প্রহরারত সৈনিক প্রমাণ করে সে ধরা পড়ে গেছে এবং হয়তো এতক্ষণে মারাও গেছে। ভাগ্যিস সে নিজে বাড়িতে ঢোকার আগে একবার চারপাশটা জরিপ করে নিতে চেয়েছিল। তা না হলে সেও বেঘোরে ধরা পড়ত। প্রশ্ন হলো, সুবাদার সাহেব কি মৃত্যুর আগে তার মুখ খুলেছেন? আর তার স্ত্রী?

ভাবতে ভাবতে সে হাঁটতে লাগল, মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। হঠাৎ কুয়াশাচ্ছন্ন গলির ভেতর থেকে একটা ছায়া উড়ে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষটা তার মুখ চেপে ধরল। ধস্তাধস্তি করতে যাবে, সহসা মানুষটার কণ্ঠস্বর শুনে থমকে গেল সে।

“থামো, আমি।”

“হায় খোদা, আপনি?” বলে মানুষটিকে টেনে গলির ভেতরে অন্ধকার কোণে নিয়ে গেল। “ব্যাপার কী? কী হয়েছে? সুবাদার সাহেব কোথায়?“

“তুমি বাড়ির সামনে কোম্পানির সৈন্যদের দেখতে পাওনি? সুবাদার সাহেব ধরা পড়ে গেছেন,” সুবাদারের স্ত্রী, বেগম সাহেবা মুখ থেকে কাপড় সরাতে সরাতে বললেন। আপরিসীম সাহসী নারী হিসেবে এই অঞ্চলে তার খ্যাতি আছে। এমনকি ইংরেজ কমান্ডাররাও এই অঞ্চলে তার এবং তার স্ত্রীর প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে সুবাদারকে সমঝে চলে।

“আমি জানি তুমি কী ভাবছ। “

“সুবাদার সাহেব কি মুখ খুলেছেন?” সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল। প্রশ্নটা তার করতে খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু এর উত্তর জানতে হবে তাকে।

“সুবাদার সাহেব মারা গেছেন,” বেগম সাহেবার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। “ঘণ্টাখানেক আগে তুমি বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই ইংরেজ সৈন্যরা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে। তিনি আমাকে চিলেকোঠায় তুলে দিয়ে একাই সৈন্যদের মুখোমুখি হন। কয়েকজনকে ঘায়েল করার পর ওরা যখন তাকে ঘিরে ফেলে তখন তিনি নিজেই নিজের বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দেন,” বেগম সাহেবার গলা কাঁপছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

…কারণ তিনি জানতেন একবার ধরা পড়লে তাকে কথা বলতে হবে,” তার নিজেরও অশ্রু বাঁধ মানছে না। “আপনি পালালেন কীভাবে?”

“তিনি মারা যাওয়ার একটু পরেই লে. ডডওয়েল আর আর্থার মেয়ো এসে ঢোকে। আমি তখন ওপর থেকে সব দেখছি। ডডওয়েল সুবাদার মারা গেছে দেখে রাগে চিৎকার করতে থাকে। দুয়েকজন সৈন্যকে চড়—থাপ্পড়ও মারে। কিন্তু মেয়ো একদম শান্ত ছিল, সে পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দেয়। আমি চিলেকোঠা দিয়ে ছাদে উঠে পড়ি। সৈন্যরা যখন বাড়ির ভেতরটা তল্লাশি করছে আমি তখন চাকরদের ঘরে ঢুকে কাপড় পালটে চলে আসি এখানে। আমি জানতাম তুমি ফিরে আসছ।”

“এখন আমরা…”

“কোনো উপায় নেই, ওরা আজ পুরো ঢাকা আক্রমণ করবে। যেকোনো সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে পুরোদমে। সমস্ত ঢাকা শহর ঘিরে ফেলা হয়েছে এবং কোম্পানির সৈন্যদের একটা বড় অংশকে লেলিয়ে দেওয়া হবে তোমার পেছনে। আমি নিজে আর্থার মেয়োকে এই নির্দেশ দিতে শুনেছি।”

নিজের অজান্তেই তার আরেকবার হাত চলে গেল কোমরে। কোনোভাবেই সে এটা ইংরেজদের হাতে পড়তে দেবে না। প্রয়োজনে নষ্ট করে ফেলবে।

“আমি কিছুতেই এটা—”

“আমি জানি। আমিও সেটা হতে দেব না। তাহলে এতদিনে এত মানুষের কষ্ট, জীবন দান এবং সুবাদার সাহেবের মৃত্যু সব বৃথা হয়ে যাবে।”

“এখন করণীয় কী?” হঠাৎ একদল সৈন্য গলির সামনে দিয়ে মার্চ করে চলে গেল।

“হায় খোদা-আক্রমণ শুরু হতে যাচ্ছে।”

“এখন উপায়, এদিকে পালানোর পথ বন্ধ অন্যদিকে—“

“লালবাগ।”

“লালবাগ! আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে, ওটাই ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য হবে। ওটা দখল করতে পারলেই ঢাকা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর আপনি ওখানে আশ্রয় নিতে চান?”

“আমার একটা পরিকল্পনা আছে,” আজ সকালে এই প্রথম মহিলার মুখে মৃদু হাসি দেখতে পেল সে।

.

একই সময়ে একটু দূরে…

সকাল সবেমাত্র হতে শুরু করেছে। শীতের সকালে এখনও সমস্ত ঢাকা শহর কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে নিমজ্জিত। পাঁচটা বাজতে কিছুটা সময় বাকি। কিন্তু ঢাকাবাসীরা এখনও শীতের সকালের আরামদায়ক ঘুমে নিমজ্জিত। তারা জানেও না কত বড় বিপর্যয় তাদের ওপর নেমে আসতে যাচ্ছে।

দিনটা আশুরার দিন, মহররমের ১০ তারিখ। তাই আগের দিন রাতে সবাই একটু দেরিতে ঘুমাতে গেছে। যদিও পুরো ভারতবর্ষ সিপাহি বিদ্রেহের জ্বলন্ত আগুনে উত্তপ্ত কিন্তু সেই উত্তাপের ছোঁয়া ঢাকাবাসীর গায়ে খুব একটা লাগেনি। বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট কিছু উত্তেজনা দেখা দিলেও ইংরেজ কমান্ডার আর কোম্পানির সৈন্যরা সেটা ভালোভাবেই দমন করতে পেরেছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভেতরে অনেকেই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে থাকার কারণে ব্যাপারটা সামলানো তাদের জন্য হয়েছে আরও সহজ। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আরেকটি ছোট্ট ঘটনার রেশ ধরে এবং বৃহত্তর পর্যায়ের নির্দেশে কোম্পানি আজ দেশি সৈন্যদের নির্মূল অভিযানে নেমে পড়ল।

প্রায় দুই শতাধিক সৈন্য অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসে জড়ো হলো আন্টাঘর ময়দানের সামনে। তাদের পুরোধার নেতৃত্বে রয়েছে লে. ডডওয়েল, লে. লুইস এবং লে. ইটিবিয়াস। আরও দুজন কমান্ডার লে. উইলিয়াম ম্যাকফারসন এবং আর্থার মেয়ো রয়েছে অন্যদিকে। পুরো পরিকল্পনা করাই আছে। এখন শুধু আক্রমণের অপেক্ষা।

খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আজানের ধ্বনি শোনামাত্রই পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেল। ময়দানে অপেক্ষারত বাহিনীর কাছ থেকে খানিকটা দূরে ট্রেজারির কাছে পুরো দুই দল সৈন্য নিয়ে প্রস্তুত ছিল লে. ম্যাকফারসন এবং আর্থার মেয়ো। আজানের ধ্বনি শোনা মাত্রই তারা আক্রমণ করল ট্রেজারি। প্রথমেই পাহারায় অবস্থানরত প্রায় ঘুমন্ত অপ্রস্তুত সৈন্যদেরকে নিরস্ত্র করা হলো এবং তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হলো। ট্রেজারির গেট পার হয়েই তারা ঘিরে ফেলল পুরো ট্রেজারি। ট্রেজারির প্রধানকে তার বিছানা থেকে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হলো। তারপর লে. ম্যাকফারসনের নির্দেশে শুরু হলো ট্রেজারির ওপর কামান দাগা। ঘুমন্ত, জাগ্রত, সাধারণ মানুষ এবং স্থানীয় সৈন্যসহ পুরো ট্রেজারি একরকম ধসিয়ে দেওয়া হলো কামান দেগে। ভেতরের বেশিরভাগ মানুষই কামানের গোলায় মারা গেল যারা কোনোমতে বাইরে বেরোতে সক্ষম হলো তাদেরকে বিনা বিচারে গুলি করে ফেলে দেওয়া হলো।

আর্থার মেয়ো পুরো ঘটনা দেখল চুপচাপ। এবার সে ফিরে তাকাল বন্দি ট্রেজারি প্রধানের দিকে। ইতোমধ্যেই ইংরেজ সৈন্যরা তার ওপর বেশ একচোট প্রহার কার্য শেষ করে ফেলেছে।

মেয়ো কাছে এগিয়ে জানতে চাইল, “ইউ হেল্পড হিম, হোয়ার ইজ হি?” ট্রেজারি প্রধান রক্তমাখা মুখ নিয়ে তার দিকে ফিরে তাকাল, “ইউ গট মি, বাট ইউ উইল নেভার গেট হিম। অর দা থিং ইউ আর লুকিং ফর।”

মেয়োর মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ হয়ে গেল। সে তার হাতের ছড়িটা তুলল আঘাত করতে, এমন সময় একজন ইনফর্মার এগিয়ে এসে কিছু একটা বলল তার কানে কানে। সাথে সাথে তার মুখে ফুটে উঠল ক্রূর হাসি।

মৃদু হাসি নিয়ে ট্রেজারির প্রধানের দিকে এগিয়ে গেল সে, “ইউ আর ব্লাডি রং। মাই পিপল হ্যাজ সিন দেম টু এন্টার দা ফোর্ট, সো আই উইল গেট হিম অ্যান্ড দা থিং আই অ্যাম লুকিং ফর,” বলে সে সৈন্যদের দিকে ফিরে ঘোষণা করল, “কিল হিম।”

***

অন্যদিকে আন্টাঘর ময়দানে অপেক্ষারত সৈন্যদের ওপর নির্দেশ ছিল ট্রেজারিতে কামান দাগা মাত্রই তারা লালবাগ দুর্গের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুর্গ আক্রমণ করবে। লে. লুইস এবং লে. ডডওয়েলের নেতৃত্বে তারা কেল্লার দিকে রওনা দিল। অন্যদিকে লে. ইটিবিয়াসের নেতৃত্বে সৈন্যরা ঘিরে ফেলল দুর্গটাকে পেছন থেকে। তাদের সাথে এসে যোগ দিল মেয়ো আর ম্যাকফারসন।

লালবাগ দুর্গে ইংরেজ বাহিনীর আক্রমণটা হলো খুবই সুসংহত এবং নিষ্ঠুর। ইংরেজরা যখন আক্রমণ করল তখন দুর্গের ভেতরে বেশিরভাগ সৈন্যই ঘুমাচ্ছিল। অনেকেই আবার আশুরার রোজা রাখার জন্য সবেমাত্র সেহরি খেয়ে ঘুমিয়েছে। গুটিকয়েক দেশি সৈন্য ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে দুর্গে পাহারারত ছিল। তাই তাদেরকে নিরস্ত্র করতে ইংরেজদের কোনো বেগই পেতে হলো না। পাহারাদারদের নিরস্ত্র করেই তারা কামান দাগল দুর্গের প্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের ভাঙা অংশের দিকে। দুটো গোলার আঘাতেই ধসে পড়ল প্রাচীরের নির্দিষ্ট অংশটা। প্রাচীর ধসা মাত্রই পিলপিল করে সৈন্যরা ঢুকে যেতে লাগল ভেতরে।

ভেতরে ঢুকে তারা প্রথমেই দখল নিয়ে নিল দুর্গের মূল কামানটার। দখল নিয়ে ওটাকে উলটো করে দুর্গের দিকেই ঘুরিয়ে দিল। ওখানে তখন কাঁচা ঘুম থেকে উঠে আসা হতচকিত সৈন্যরা সবেমাত্র একত্রিত হতে শুরু করেছে। কামানের গোলার আঘাতে বেশিরভাগ সৈন্যই মারা পড়ল। কিন্তু কিছু সৈন্য বুরুজে উঠে এবং পরি বিবির মাজারের ভেতরে ঢুকে লড়তে লাগল অত্যন্ত বীরত্বের সাথে। বুরুজের সৈন্যদেরকে সামলাতে লে. ডডওয়েলের খুব একটা বেগ পেতে হলো না। কিন্তু পরিবিবির মাজারের ভেতর থেকে একটানা গুলি এসে ঘায়েল করে ফেলল বেশ কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যকে। ওখান থেকে একের পর এক মুহুর্মুহু বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ হতে লাগল তাদের ওপর।

পালটা আক্রমণের পরেও ওই নির্দিষ্ট অংশটা থেকে তুমুল আক্রমণের মুখে ইংরেজ সৈন্যরা বাধ্য হলো কিছুটা পিছু হটতে। লে. ডডওয়েল দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল পরিবিবির মাজার গোলার আঘাতে উড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মেয়ো বাধা দিল।

“আই নো হি ইজ দেয়ার। ইউ ক্যান্ট ইউজ ক্যানন।”

“হাউ ক্যান ইউ বি সো শিশুর?”

“আই হ্যাভ বিন ফলোইয়িং হিম ফর মান্থ, আই নো হিজ এভরি মুভ। নো ক্যানন, কিপ ফায়ারিং অ্যান্ড রাউন্ড হিম। হি উইল কাম আউট।”

ইংরেজরা এবার পরিবিবির মাজারটাকে ঘিরে ফেলে কামানের পরিবর্তে একটানা গুলি চালিয়ে যেতে লাগল। ওটার ভেতর থেকে এখনও গুলি আসছে তবে থেমে থেমে। আরও কয়েক রাউন্ড গুলি চালানোর পর ওটার ভেতর থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে গেল। ইংরেজরা ভেতরে প্রবেশ করল মাজারের গেট টপকে। গেটের ভেতরেই দুজন দেশি সৈন্য মরে পড়ে আছে। এরাই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আর্থার মেয়ো নিজে চেক করল দুজনকেই। না এদের কেউই না।

এবার সে তার সৈন্যদের নিয়ে সাবধানে প্রবেশ করল মাজারের ভেতরে। সেখানেও একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। তার সাথে তিনটা বন্দুক এতক্ষণ এগুলো দিয়েই সে প্রতিরোধ করছিল। মেয়ো একটা বন্দুক লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল। অবশেষে তাকে কবজা করতে পেরেছে সে। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে একজন সৈন্যকে বলল দেহটা সোজা করতে।

“স্যার দিস ইজ আ লেডি,” সৈন্যটা মৃতদেহটার মুখের কাপড় সরিয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে।

সাথে সাথে মেয়োর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। “হোয়াট!” সে লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল দেহটার দিকে এবং অত্যন্ত অবাক হয়ে সে আবিষ্কার করল এটা সুবাদারের ওয়াইফ। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে ফিরে তাকাল তার ইনফর্মারের দিকে। লোকটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে।

“স্যার আই স হিম অ্যান্ড অ্যানাদার পার্সন এন্টারিং দা ফোর্ট দিস মর্নিং,” ভয়ে কাঁপতে কাঁপতেই সে অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করল। মেয়ো রাগে চিৎকার করে উঠে গুলি করল লোকটাকে। আবারও সে তার হাত ফসকে পালিয়েছে। এবার সম্ভবত চিরকালের মতো এবং সেই সাথে নিয়ে গেছে মহামূল্যবান জিনিসটা।

পরবর্তী জীবনে ঢাকা শহরে সিপাহি বিদ্রোহ দমনে তার বিশেষ অবদানের কারণে ইংরেজ সরকার তাকে ভিক্টোরিয়া ক্রুশ দিয়ে সম্মানিত করে কিন্তু ওই মানুষটা এবং তার সাথের জিনিসটা সে আর কোনোদিনই খুঁজে পায়নি।

.

আর্থার মেয়ো যখন লালবাগ দুর্গে পরিবিবির মাজারে দাঁড়িয়ে অসহায় রাগে চিৎকার করছে অন্যদিকে সে তখন একটানা ছুটে চলেছে। অনেক আগেই ঢাকা থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। প্রথমে সুবাদারের স্ত্রীর পরিকল্পনা শুনে সে চমকে উঠেছিল। তার মোটেও সায় ছিল না ওতে কিন্তু এটাই ছিল একমাত্র উপায়। এছাড়া কিছু করারও ছিল না। দুর্গে প্রবেশ করার সময়ে তারা জানত ইংরেজদের চর চারপাশ থেকে অবশ্যই দেখছে তাদেরকে। আসলে ওদের চেহারা দেখিয়ে দুর্গে প্রবেশ ছিল একটা ধোঁকা মাত্র।

আগেই অনুমান করতে পেরেছিল ওদেরকে দুর্গে প্রবেশ করতে দেখলে অন্য কোথাও খোঁজা হবে না। তাই সুবাদারের স্ত্রী দুর্গে প্রবেশ করেই কয়েকজন সৈন্যকে নিয়ে পরিবিবির মাজারে অবস্থান নেয়। যাতে ইংরেজদের দেরি, করিয়ে দিতে পারে। অন্যদিকে সে সৈন্যরা আসার আগেই দুর্গের পেছনের দেয়াল টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে। দুর্গ দখল করেই ইংরেজরা ঢাকা শহর ঘিরে ফেলে। ইংরেজ সৈন্যরা শহরটাকে ঘিরে ফেলার একটু আগেই সে নগরীর বাইরে চলে আসতে সক্ষম হয়।

এবার তাকে বুড়িগঙ্গা নদীতে নেমে সাঁতরে পার হতে হবে অনেকদূর। এখান থেকে পালানোর একটাই একমাত্র রাস্তা। হালকা করে একবার কোমরের চামড়ার থলেটাতে হাত বুলাল সে। এটাকে এভাবে নিয়ে পানিতে নামা ঠিক হবে না, এত মূল্যবান জিনিসটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি নেওয়া কিছুতেই ঠিক হবে না। নদীর তীরে সে একটা মাজার দেখতে পেয়ে সেদিকে এগোল। মাজারের মানত প্রাঙ্গন থেকে তুলে নিল একটা পাথরের ভাঙা ঘোড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *