২৫শে মার্চ – ৭

মোহাম্মদপুর থানা, ঢাকা
বর্তমান সময়, সকাল প্রায় ১০টা

অরণি থানার ডিউটি অফিসারের দিকে তাকিয়ে আছে চোখ গরম করে। লোকটা প্রথমে খুব ভাব নেওয়ার চেষ্টা করলেও অরণির অগ্নিমূর্তি দেখে এখন একটু থতমত খেয়ে গেছে। “দেখুন ম্যাডাম, ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হবে এটা…“

“কত টাকা দিতে হবে? বলেন। আপনারা তো টাকা ছাড়া একটা আঙুলও নাড়ান না। বলেন,” অরণি রীতিমতো চিৎকার করছে। ডিউটি অফিসারের মুখ লাল হয়ে গেছে। চারপাশ থেকে সবাই তাকিয়ে আছে।

“ম্যাডাম দেখেন আপনি ভুল বকছেন। এখানে টাকার কোনো ব্যাপার নেই। আসলে এটা আমার এখতিয়ারের ভেতরেই পড়ে না। সন্দেহভাজন গ্রেপ্তারকৃতদের আমরা এভাবে ভিজিটরের সাথে দেখা করতে দিতে পারি না। তবুও আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি থানার ইনচার্জ এখনও আসেননি। তিনি আসলে আমি কথা বলে দেখতে পারি।”

“কয়টা বাজে? তিনি এখনও আসেননি কেন?”

“আমার মনে হয়,” পেছন থেকে সাদেকুর রহমান মৃদুস্বরে বলল। “তিনি ঠিকই বলছেন। আমাদের আসলে অপেক্ষা করা উচিত। ইনচার্জ আসলে কথা বললে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

অরণি চুপ করে ভাবছে। এরা কথা ভুল বলেনি। এভাবে বারবার চিল্লাচিল্লি করে আসলে খুব একটা লাভ হবে না। “ঠিক আছে আমরা অপেক্ষা করছি। তিনি আসলে জানাবেন প্লিজ,” সে ডিউটি অফিসারকে বলল। লোকটার সাথে চিল্লাচিল্লি করাতে এখন নিজের ওপরই রাগ লাগছে ওর।

অরণি সাদেকুর রহমানকে নিয়ে বেঞ্চে বসে পড়ল। বেঞ্চে ওদের সাথে দুজন মহিলা বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে। এরা আসলে ঘুমাচ্ছে। সম্ভবত এরাও কারও সাথে দেখা করতে এসেছে। সকাল মাত্র হতে শুরু করেছে। থানার দৈনন্দিন ব্যস্ততা এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। অরণি চুপচাপ বসে পুরো পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছে। ওর মাথায় আসলে কিছুই ঠিকমতো ঢুকছে না। একবার ভাবল ব্যাগের ভেতর থেকে ওর মায়ের রেখে যাওয়া খামটা বের করে দেখে কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবল ব্যাপারটা কি আসলে ঠিক হবে? সাদেকুর রহমান ওর হাতে খামটা দেওয়ার পর সেটা খুলে এই অদ্ভুত জিনিসগুলো দেখে ও যারপরনাই অবাক হয়ে যায়। সাদেক সাহেবের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করে, “এগুলো কী?” সাদেক সাহেব হতাশার সাথে মাথা নাড়ে। কয়েনটা মাটি থেকে তুলে আনার পর দেখে ওতে একটা বিশেষ নকশা কাটা। আর দুমড়ানো মোচড়ানো ছবিটা দেখেই বোঝা যায় এটা অনেক পুরানো। ছবিটাতে রক্তের দাগগুলোও অনেক পুরানো। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপরটা অপেক্ষা করছিল ওর জন্য ছবির পেছনে। ওখানে হালকা কালি দিয়ে ওর জন্য একটা নোট লেখা ছিল।

ওর মায়ের হাতের লেখা। ও দেখেই চিনেছে। নোটটা ওকে অ্যাড্রেস করেই লেখা হয়েছে। কারণ শুরুতেই ওর নাম লেখা। নোটটা লেখাও হয়েছে খুব অদ্ভুতভাবে। কথাগুলো ইংরেজি কিন্তু লেখা হয়েছে বাংলায়। নোটটা অনেকটা এরকম—

“অরণি— ইফ সামথিং হ্যাপেনস টু মি ফলো দিস। হোয়াটএভার হ্যাপেনস ট্রাস্ট নো ওয়ান বাট হাসান। অ্যান্ড রিমেমবার ‘ট্রুথ ইজ অলওয়েজ ইন ফ্রন্ট অভ ইউ।”

নিচে ওর মায়ের সই, ঠিকানা আর ই-মেইল অ্যাড্রেস লেখা। ব্যাপারটার আগা-মাথা ও কিছুই বুঝতে পারেনি।

ও যখন নোটটা পড়ছে পেছন থেকে সাদেকুর রহমান উঁকি দিয়ে সেটা দেখে। নোটটা পড়ে সে জানতে চায়, “হাসান কে?”

“হাসান, হাসান শাহরিয়ার রিওন। আমার মায়ের ছাত্র ছিল। আমরা একই স্কুলে পড়তাম, ও আমার চেয়ে দুই ক্লাস ওপর পড়ত। খুবই উচ্ছৃঙ্খল একটা ছেলে। কেউই ওকে খুব একটা পছন্দ করত না কিন্তু আম্মু খুবই ভালোবাসত ওকে, আদর করত। আর একারণেই ওকে আরও বেশি অপছন্দ করতাম আমি।”

“ম্যাডাম, নামটা কী বললেন?”

“হাসান শাহরিয়ার রিওন।”

“আপনি শিওর, আপনার আম্মা এই নামের মানুষটির কথাই বলেছে এখানে?”

“অবশ্যই, কারণ হাসান বলতে আম্মু অবশ্যই ওকেই বোঝাবে।”

“সর্বনাশ।”

“কী ব্যাপার? কী হলো?”

“আপনার মায়ের খুনের সন্দেহে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মানে যার গাড়িতে আপনার মায়ের ডেড বডি পাওয়া গেছে তার নামও হাসান শাহরিয়ার রিওন। ছেলেটা সাংবাদিক।”

“কী? আপনি শিওর?”

“অবশ্যই ম্যাডাম। আমার কাছে ওই খবরের পত্রিকার কাটিংও আছে,” বলে সে তার ফাইলের ভেতর থেকে একটা পত্রিকার কাটিং বের করে দেখাল। “দেখেন।”

অরণির রিপোর্টটা পড়ার দরকার নেই। কারণ রিপোর্টের ওপরেই গ্রেপ্তারকৃত সন্দেহভাজনের ছবি দেওয়া এবং সেটা শতভাগ হাসানেরই ছবি। “ও মাই গড। ওকে কোথায় রাখা হয়েছে?”

“মোহাম্মদপুর থানায়।”

“আমাকে ওখানে যেতে হবে,” বলার পরইে ওরা বাইরে এসে ওই চাচার ক্যাবে করেই রওনা দেয় মোহাম্মদপুর থানার উদ্দেশ্যে। আর এখন বসে আছে থানার ইনচার্জ এলে তার অনুমতি নিয়ে ওকে হাসানের সাথে দেখা করতে হবে। গোটা ব্যাপারটা ওর কাছে এতটাই গোলমেলে আর ঘোলাটে লাগছে ও আসলে কিছুই বুঝতে পারছে না। গাড়িতে সাদেকুর রহমান একবার জানতে চেয়েছিল, “ম্যাডাম আপনার কি মনে হয়, আপনার মা এই হাসান রিওনের নাম এই ছবিতে লিখে রেখে গেলেন কেন? আর এই ছবি, কয়েন এগুলো কী?”

অরণি কোনো উত্তর দেয়নি। উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থাও ওর নেই। কী উত্তর দেবে। ওর বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সাথে রাগ করে চলে গিয়েছিল আমেরিকা। এরপর ওর মায়ের সাথে গত পাঁচ বছরে কোনো যোগাযোগই হয়নি। প্রচণ্ড অভিমানে ও যোগাযোগ করেনি। ওর মা-ও করেনি। তবে ওর পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছিল একদিন ওর মা ঠিকই ওর সাথে যোগাযোগ করবে। এজন্যই ওইদিন চাচার কাছে মা কল করেছিল শুনে ওর মনটা আনচান করে উঠেছিল। কিন্তু এখন অবশেষে মায়ের সাথে ওর দেখা হলো মর্গে। আর এরপর একের পর এক আজব আজব ঘটনা, ও কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। এখন কাঠের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে ওর হালকা ঝিমুনি আসছে। রাতে প্লেনে বসে সে বেশ ভালোই ঘুমিয়ে নিয়েছিল, তাই অতটা খারাপ লাগছে না। তবে একটা ফ্রেশ ঘুম হলে ভালো হতো। তার কোনো ধারণাই নেই আরও বহুক্ষণ তাকে বিনা ঘুম বা বিশ্রামেই কাটাতে হবে।

হঠাৎ ওর পাশে বসে থাকা সাদেক সাহবে ফিসফিস করে বলে উঠল, “ওসি সাহেব আসছেন।”

অরণি মুখ তুলে তাকাল। বাংলাদেশ পুলিশে একটা সময় ছিল যখন ওসি, এসপি বলতে বোঝাত বয়স্ক লোকজনকে। কিন্তু সে চিত্র পরিবর্তন হয়েছে। বেশ ইয়াং বয়সের ছেলেমেয়েরা সরকারি বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়ে ওসি, এএসপি, এসপি হতে পারে। এই ওসি ভদ্রলোক বেশ ইয়ং। অরণির কাছে মনে হলো এই লোক সদ্য ত্রিশের কোঠা পার করেছে। ওসি গাড়ি থকে নেমে একজন কনস্টেবলের সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে গেল। ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে এসআই চলে গেল ভেতরে। ভেতর থেকে ওদের ডাক এলো আরও প্রায় আধা ঘণ্টা পর।

ওরা যে এসআইয়ের সাথে কথা বলেছিল সে ওদেরকে এসে বলল, “আমি ওসি সাহেবের সাথে কথা বলেছি, তিনি রাজি হতে চাচ্ছেন না। আপনারা কথা বলে দেখুন হয়তো রাজি হতে পারেন।”

অরণি আর সাদেকুর রহমান ঢুকল ভেতরে। ওসি সাহেব ওদেরকে বেশ ভদ্রভাবেই বসতে বললেন।

“আমি আপনাদের ব্যাপারটা শুনেছি কিন্তু দেখুন এভাবে আমরা সন্দেহভাজনদেরকে ভিজিটরদের সাথে দেখা করতে দিতে পারি না।”

“ব্যাপারটা বুঝতে পারছি কিন্তু আজ সকালেই আমি আমেরিকা থেকে এসেছি, যাকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হয়েছে সে আমার মায়ের খুবই প্রিয় একজন ছাত্র ছিল এবং একটা সময় সে আমাদের পরিবারের খুব কাছেরও একজন ছিল। আমি জানি না কীভাবে কী হয়েছে কিন্তু আমাকে তার সাথে কথা বলতেই হবে। আমার জানতে হবে আসলে কী ঘটেছে,” অরণি বেশ মরিয়া হয়েই দ্রুত কথাগুলো বলে উঠল।

“তাসমিন অরণি, রিসার্চ স্টুডেন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি। যিনি খুন হয়েছেন তিনি আপনার মা, তাই না?” ওসি সাহেব একটা ফাইলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

যদিও অরণির মনে হলো লোকটা মোটেও ফাইলটা পড়ছেন না। “আপনি কীভাবে জানলেন আমি কোথায় পড়ি? কী করি?” অরণির চোখ সরু হয়ে গেছে।

ওসি মৃদু হাসল, “প্রশ্নটা বাচ্চাদের মতো হয়ে গেল না? জানাই আমাদের কাজ। আমরা অনেক কিছুই জানি এবং আরও জানতে চাই। যেমন আমি এই মুহূর্তে দুটো জিনিস জানতে চাই। এক. কে আপনার মা মিসেস অফরোজা আক্তারকে খুন করেছে? দুই. আপনি আপনার মায়ের খুনির সাথে কেন এতটা মরিয়া হয়ে দেখা করতে চাইছেন? তার সাথে কি আপনার কোনো সম্পর্ক ছিল?”

“দেখুন, আপনি কী জানেন না জানেন তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমি শুধু জানতে চাই আপনি আমাকে তার সাথে দেখা করতে দেবেন কি দেবেন না?”

“দেখা করে আপনি কী করবেন? সে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি। ওই সাংবাদিক, যদিও সে আদৌ কোনো পত্রিকায় কাজ করে না। নিজের পরিচয় দেয় একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে। আমরা তার গাড়ির বুটে আপনার মায়ের লাশ পেয়েছি এবং আমরা সেটা পেয়েছি আপনার মায়ের বাড়ির সামনেই। আমরা যখন তাকে অ্যারেস্ট করি তখন সে আপনার মায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল। তার ভাষ্য মতে, সে নাকি আপনার মায়ের সাথে দেখা করতেই তার বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও দেখা হয়নি। সে বেরিয়ে আসছিল এমন সময় আমরা তাকে অ্যারেস্ট করি এবং তার গাড়ির বুটে আপনার মায়ের লাশ কীভাবে এলো সে ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। যদিও তার এই বক্তব্য আমরা একদম বিশ্বাস করিনি।”

“কারণ কী?”

“কারণটা খুব সহজ। প্রথমত, সে বলেছে আপনার মা তাকে নাকি বাড়িতে ডেকেছিল দেখা করার জন্য। কিন্তু এর কোনো এভিডেন্স সে দেখাতে পারেনি। না মোবাইলে না অন্য কোনো ভাবে।

দ্বিতীয়ত, সে আপনার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল বাড়ির ভেতরে। আপনার মা যদি ওখানে না-ই থেকে থাকেন তবে সে বাড়ির ভেতরে ঢুকল কীভাবে?

তৃতীয়ত, এটাই প্রথমবার না যে সে অ্যারেস্ট হয়েছে। এর আগেও সে বহুবার বহু কৃর্তী করে পুলিশের সাথে গোলমালে জড়িয়েছে এবং ধরা খেয়েছে। সে সাংবাদিক হিসেবে যতটা না বিখ্যাত, তার চেয়ে বেশি কুখ্যাত। সাংবাদিকতার জগতে সে বেশ কুখ্যাত একজন মানুষই বলা চলে এবং আপনি জানেন কি না জানি না, তার পরিবারের লোকজনও তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমরা খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, একমাত্র আপনার মা-ই তাকে বেশ স্নেহ করতেন এবং তার পরিণতি তো দেখতেই পাচ্ছেন। এখন আপনি আমাকে বলুন, এমন একজন লোকের কথা আমরা কেন বিশ্বাস করব?”

অরণি চুপচাপ ভাবছে। ওসি সাহেব কথাগুলো ভুল বলেননি।

“তার চেয়ে বড় কথা, ওসি আবার শুরু করলেন, “সে আমাদের কাছেই মুখ খোলেনি, আপনার সাথে কথা বলবে সেটা আপনি কীভাবে ভাবছেন?”

“ঠিক বলেছেন এবং এই কারণেই আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। কারণ সে আপনাদের সাথে সহযোগিতা করেনি, তার মানে সে আমার সাথে কথা বললে হয়তো কাজ হতেও পারে। হয়তো আপনাদের জন্য সেটা সহায়তার ব্যাপার হতে পারে।”

ওসি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “ঠিক আছে, তবে একটা শর্ত।”

“কী?”

“তার সাথে আপনার কী কথা হয় আপনি আমাকে বিস্তারিত বলবেন এবং মিস অরণি আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমার কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছেন। আমাকে সেটাও বলতে হবে।”

অরণি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “ঠিক আছে আমি বলব।”

ওসি একটা বেল বাজাতে একজন কনস্টেবল এলো। “তাকে,” অরণিকে দেখিয়ে বলল। “সাত নম্বর সেলে নিয়ে যাবে। তুমি কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবে এবং খেয়াল রাখবে।”

অরণি উঠে দাঁড়াতে ওর সাথে সাথে সাদেকুর রহমানও ওর সাথে উঠে দাঁড়াল। অরণি তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি এখানেই বসুন কিংবা বাইরে অপেক্ষা করুন। আমি একাই দেখা করব।”

“কিন্তু,” সাদেকুর রহমান কিছু বলতে চাচ্ছিল, ওসি তাকে থামিয়ে দিল। “তিনি ঠিকই বলেছেন, আপনি এখানেই বসুন। আপনার সাথে আমার কথা আছে।”

অরণি একটু অস্বস্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, সাদেক সাহেবকে ওসির সাথে রেখে যাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না বুঝতে পারছে না। কনস্টেবল যেদিকে সেলগুলো সেদিককার মেইন দরজাদা খুলল। ওটার সামনে পাহারায় ছিল একজন কনস্টেবল। সে সরে গিয়ে ওদেরকে জায়গা করে দিল। কনস্টেবল সামনে হাঁটছে অরণি তার সাথে সাথেই। ওকে ওর ব্যাগটা রেখে আসতে হয়েছে। ঢোকার আগে একজন মহিলা পুলিশ এসে ওকে চেক করে দেখেছে ওর সাথে কিছু আছে কি না। পকেটে একটা চাবির রিং ছিল। ওর বাসার চাবির রিং, সেটাও রেখে আসতে হয়েছে।

এই সেলগুলোকে বলা হয় টেম্পোরারি সেল। এই সেলগুলোতে সাময়িকভাবে অপরাধীদের রাখা হয়। এখান থেকে চালান করে দেওয়া হয় কোর্টে, অন্যান্য থানায় কিংবা স্থায়ী জেলখানায়। অরণি কনস্টেবলের পাশ দিয়ে হাঁটছে। আড়চোখে একবার প্রথম সেলটার দিকে তাকাল। সেলের সাইজ বেশ বড়ই। কিন্তু লোকসংখ্যাও অনেক। ওকে দেখে শিস বাজাল কেউ একজন। অরণি সাথে সাথে বাড়িয়ে দিল হাঁটার গতি। ওরা একটার পর একটা সেল পার হয়ে আসছে। নিজেকে ওর সাইলেন্স অভ দা ল্যাম্বসের ক্লারিস স্টার্লিঙের মতো মনে হচ্ছে। যদিও সে যার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে ডক্টর লেকটারের মতো কেউ নয়। ওর অনেক পরিচিত একজন মানুষ, ওর মায়ের অত্যন্ত স্নেহের বখে যাওয়া মেধাবী একজন ছাত্র এবং অরণির জীবনের প্রথম ক্রাশ। যদিও কথাটা সে কোনোদিন কাউকে বলেনি, এমনকি নিজেকেও না, তবে সে জানে এবং ওই মানুষটাও জানত অন্তত অনুমান করতে পারত।

অরণি কনস্টেবলের সাথে সাত নম্বর সেলের সামনে এসে দাঁড়াল। এই সেলটাও অন্য সেলগুলোর মতোই বড়, তবে একটু বেশি পরিষ্কার এবং এতে লোকসংখ্যা অনেক কম। পাঁচ-ছয়জনের বেশি হবে না। অরণি অনুমান করল এখানে সম্ভবত কোনো বিশেষ ক্যাটাগরির বন্দিদেরকে রাখা হয়। সেলের সামনে দাঁড়িয়ে কনস্টেবল হাতের চিরকুটে লেখা নামটা জোরে পড়ল, “হাসান শাহরিয়ার।”

অরণি চোখ বুলাল, মানুষটা এক কোণে বসে ছিল। একটু ভুল হলো, এলো ওরা চারজন এক কোণে বসে ছিল, মনে হয় ওরা কিছু একটা করছিল। আসলে ওই চারজন কার্ড খেলছিল বসে। কারণ হাসান উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ও দেখতে পেল ওর হাতে কার্ড। কত বছর পর দেখা, পাঁচ বছরের বেশি। মানুষটা তেমন একটা বদলায়নি, একই রকম পাতলা গড়ন, লম্বা। শুধুমাত্র মাথার চুলগুলো একটু এলোমেলো আর মুখে কয়েকদিনের বড় হওয়া দাড়ি। মানুষটা হেঁটে চলে এলো সেলের গ্রিলের একদম কাছে।

“হ্যালো, অরো,” অরণি আশ্চর্য হয়ে দেখল হাসানের মুখে সবসময়ের মতো এক চিলতে বাঁকা হাসি। এই হাসিটা দেখেই একসময় ও লোকটার প্রেমে পড়েছিল। এখন ভাবতেও অস্বস্তি লাগে।

“হাই হাসান, ভালোই আছ মনে হচ্ছে,” অরণি ওর হাতের কার্ডগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল। “তুমি তো সবসময়ই এরকম ছিলে।” অরণির চেয়ে বড় হলেও ও সবসময় তাকে নাম ধরে ডাকত। বলে অরণি কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা একটু একা কথা বলব।” কনস্টেবল একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

অরণি চোখ তুলে হাসানের দিকে তাকাল। যতই স্বভাবসুলভ ড্যামকেয়ার ভাব দেখাক, তার চোখের গভীরে বেশ একটা দিশেহারা ভাব নজর এড়ায় না।

“অরো, আমি জানতাম তুমি আসবে। কারণ একমাত্র তুমি এই গল্প বিশ্বাস করবে না,” হাসান গ্রিল ধরে অরণির দিকে তাকিয়ে বলল।

“আর যদি আমি করি?”

“তুমি করবে না, কারণ আমার ধারণা তুমি এমন কিছু জানো যেটা অন্য কেউ জানে না।”

অরণি একটু চমকে গেল, হাসান কি ওর মায়ের রেখে যাওয়া নোটের ব্যাপারে কিছু জানে। “তুমি এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?”

“কারণ আমি জানি আফরোজা ম্যাম এমন কিছু একটা তোমাকে বলে গেছেন যেটা অবশ্যই ইঙ্গিত করে আমি নির্দোষ।”

“হাসান, মা এমন কিছু বলে যাননি, ইনফ্যাক্ট মা আমার সাথে যোগাযোগই করতে পারেননি,” হাসানের চোখে অরণি পরিষ্কার হতাশা দেখতে পেল। “মা কিছুই বলে যাননি, মা শুধু বলে গেছেন তোমাকে বিশ্বাস করতে যেটা আমার সম্ভবত করা উচিত না।”

“যদি তিনি তোমার সাথে যোগাযোগই না করে থাকেন তবে সেটা কীভাবে বলে গেলেন?”

“মা ছোট্ট একটা নোট রেখে গেছেন।”

“ও মাই গড। আমার দেরি করা একদম উচিত হয়নি। ও খোদা,” হাসান রীতিমতো আঁতকে উঠল। “অরণি পুরো ব্যাপারটাই একটা সেট-আপ। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। বিশ্বাস করো আমি কিছুই জানি না।”

“দেরি করা মানে। কীসের দেরি করা? দেখো হাসান, আমার মা মারা যাওয়ার আগে একমাত্র শেষ কথা যেটা বলে গেছেন সেটা হলো তোমাকে বিশ্বাস করতে। তাই আমি তোমাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করব। বাট ইউ হ্যাভ টু গিভ মি আ রিজন টু বিলিভ ইউ। আমাকে সব খুলে বলো তুমি কী জানো আর না জানো। যদি সেটা না বলো তবে আমি কিছুই করতে পারব না।”

 “ঠিক আছে, শোনো। তুমি আমেরিকা চলে যাওয়ার পর তোমার মা একদিন আমার বাসায় এসেছিলেন। তখনও আমি বড় আপার সাথে থাকতাম। তিনি অনেক কান্নকাটি করেন এবং অনেক দুঃখ প্রকাশ করেন। তুমি ধারণাও করতে পারবে না তুমি ইউএস চলে যাওয়াতে তিনি কতটা দুঃখ পেয়েছিলেন। তবে কেন তুমি চলে গেল আর কেন তুমি তার ওপর রাগ করেছিলে, সে ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। আমি বারবার জিজ্ঞেস করার পরও না।”

“অরণি একটু অস্বস্তির সাথে নড়ে উঠল। “তারপর।”

তারপর দীর্ঘদিন আমার সাথে ম্যাডামের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এর মধ্যে আমিও পড়া শেষ করে একটা পত্রিকাতে ঢুকি এবং নানা ধরনের ঝামেলাতে জড়াতে থাকি। ইউ নো মি। দীর্ঘদিন তার সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি। এরপর গত কয়েকদিন আগে, সম্ভবত ম্যাডাম মারা যাওয়ার একদিন কি দুদিন আগে আমি রাতের বেলা বাসায় ফিরছিলাম। গ্যারাজে গাড়ি থেকে নামার পর দেখি ম্যাডাম গ্যারাজের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বেশ অবাক হয়ে যাই। তাকে দেখেই মনে হচ্ছিল প্রচণ্ড ভয়ে আছেন। আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন, ওটা যেন আমি তোমার হাতে পৌঁছে দেই। আমাকে বারবার রিকোয়েস্ট করে বলেন, আমি যেন ওটা না খুলি এবং যেকোনোভাবে ওটা তোমার কাছে পৌঁছে দেই। কী হয়েছে? কী হচ্ছে? কী ব্যাপার? এসব জিজ্ঞেস করেও আমি কোনো উত্তর পাইনি। তারপর তিনি বললেন, তাকে যেতে হবে। আমি বললাম, বসায় যেতে। তিনি বললেন, দরকার নেই। এতে আমার বিপদ হতে পারে। তারপর আমি তাকে একটা সিএনজি ডেকে দিলে তিনি চলে যান।”

“তারপর,” অরণি অনুমান করল সম্ভবত ওর ব্যাগের প্যাকেটটা। কারণ ওতে ওই দিনের তারিখ লেখা।

“তারপর পরদিন সকালে আমার মোবাইলে একটা কল আসে, ম্যাডাম ফোন করে বলেন সব ঝামেলা নাকি মিটে গেছে প্যাকেটা আর তোমাকে দেওয়ার দরকার নেই। আমাকে তার বাসায় যেতে বলেন। আমি একটা কাজে আটকে যাওয়াতে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। আমি বাসায় পৌঁছে দেখি বাসায় কেউ নেই। আমি সেদিন প্যাকেটটা দরজার সামনে রেখে চলে আসি। পরের দিন ম্যাডাম আবার আমাকে ফোন করে বলেন তার সাথে দেখা করতে। ওইদিনও আমার পৌছতে দেরি হয়ে যায়। বাসায় পৌঁছে দেখি কেউ নেই। আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ মনে পড়ে তোমাদের বসার চাবিটা কোথায় থাকত। আমি চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বসে থাকি আরও আধা ঘণ্টা। এরপর বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, বাইরে আসতেই দেখি পুলিশ চারপাশ থেকে আমার গাড়ি ঘিরে ফেলেছে এবং এরপর ম্যাডামের লাশ বের হয় আমার গাড়ির বুট থেকে। অরণি আমি এই জানি এর থেকে বেশি কিছু না। বিলিভ মি।”

“আমার প্রশ্ন হলো তোমার সাথে যদি এসবের কোনো সংশ্লিষ্টাতাই না থাকে তবে তোমাকে কেন ফাঁসানো হলো?”

“আমিও জানি না। তবে আমি জানতে পারব যদি আমি এখান থেকে বেরোতে পারি। বিলিভ মি। আমি পারবই। কিন্তু আমাকে আগে এখান থেকে বেরোতে হবে। তা না হলে আমাকে এখানেই মরতে হবে। ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে। আমি মরব এবং আসল খুনি চিরকালই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাবে এবং তুমিও কোনোদিন সত্যিটা জানতে পারবে না।”

অরণি চুপচাপ ভাবছে। হাসান যা বলছে তা এক হিসেবে ভুল না, ঠিকই আছে। কারণ ও জানে হাসান যত খারাপ ছেলেই হোক বা যেমনই হোক ওর মাকে সে মারতে পারবে না। কারণ নিজের মায়ের চেয়ে বেশি স্নেহ সে পেয়েছে ওর মায়ের কাছ থেকে। আর হাসান যদি সত্যি বলে থাকে তবে আসল খুনিকে খুঁজে বের করা ওর একার পক্ষে সম্ভব হবে না। হাসানকে ওর দরকার। আর সবচেয়ে বড় কথা ওর মা হাসানকেই একমাত্র বিশ্বাস করতে বলে গেছে। ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। “আমি কীভাবে তোমাকে এখান থেকে বের করব। আইনসিদ্ধভাবে জামিনের জন্য – “

“অরণি, ওভাবে হবে না। আমি যা বলি তা শোনো। ওরা আর এক ঘণ্টার ভেতরে আমাকে হাজিরা দিতে কোর্টে নিয়ে যাবে। আমি ঠিক যেভাবে বলি সেভাবে কাজ করো।”

.

অরণি আরও পনেরো মিনিট পর বাইরে বেরিয়ে এলো। ওর সাথের সাদেকুর রহমানকে বলল, “আমি খুব টায়ার্ড। এখন এক খালার বাসায় যাব। ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিয়ে আমি আপনাকে কল করব।”

“শিওর ম্যাম, আপনি? যদি কোনো হেল্প লাগে অবশ্যই আমাকে কল করবেন। এই যে এখানে আমার মোবাইল নম্বর আছে।” সাদেকুর রহমান বিদায় নেওয়ার সাথে সাথে অরণি দৌড়ে চলে এলো ওর রেখে যাওয়া ক্যাবটার কাছে। সেই এক হাতওয়ালা চাচা সিটে বসে বসে পেপার পড়ছে।

“চাচা আমার একটা উপকার করতে হবে। আমি জানি আপনাকে বলাটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু আমার এছাড়া আর উপায় নেই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *