২৫শে মার্চ – ২২

২২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
২৬শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত ২টা ১৫ মিনিট

“স্যার ওখানে কী হলো? বিস্ফোরণের শব্দ বলে মনে হলো,” মনিরুজ্জামান ফিরে আসার পর কবির জানতে চাইল।

মনিরুজ্জামান ওদের পাশে বসে পড়ল। “ওদিকের অবস্থা খুবই খারাপ।”

“শব্দ হলো কীসের স্যার?” এবার আবু প্রশ্ন করল।

“শহিদ মিনার, শহিদ মিনারটা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ওরা আমাদেরকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে চাইছে জাতিগতভাবে। আমাদের নিজস্বতা বলে কিছু রাখবে না। আমার মনে হয় এই কারণেই আজ রাতের অভিযান।”

“স্যার এখন কী করবেন? কোয়ার্টারে ফিরে যাবেন কীভাবে?” কবিরকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।

“বুঝতে পারছি না। যেভাবে ওরা আজ রাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তছনছ করে দিচ্ছে তাতে তো মনে হচ্ছে না…” হঠাৎ শহিদ মিনারের ওদিক থেকে গরগর শব্দ ভেসে এলো। সেই সাথে লোকজনের চেঁচামেচি আর গাড়ির শব্দ।

“কবির একটু দেখে আসবি ওপাশে কী হচ্ছে?”

“জি স্যার,” বলে কবির চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে জানাল, “স্যার মনে হয় ওরা এখন এখান থেকে সরে পড়ছে। ট্যাংক দুটোকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে আর মিলিটারি ট্রাক আর জিপগুলোও সরিয়ে ফেলছে।”

“তাই নাকি তা হলে তো মনে হয় আমরা এখানে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখতে পারি। যদি এখান থেকে সৈন্যরা সরে পড়ে তাহলে কোয়ার্টার পর্যন্ত পৌছতে পারার একটা সুযোগ আছে। একটু অপেক্ষা করে দেখি,” বলে সে একটু চুপচাপ ভাবল। “শোন আমরা যেটা করতে পারি। যদি কিছুক্ষণের ভেতরে সৈন্যরা এখান থেকে সরে পড়ে তাহলে আমরা হয়তো এদিক দিয়েই যাওয়ার সুযোগ পাব। তাহলে এখান থেকে, মানে গণিত ভবনের সামনে দিয়ে আমরা শহিদ মিনারের সামনের রাস্তাটা পার হবো। রাস্তাটা পার হয়ে আমরা ঢুকে যাব জগন্নাথ হলে। ওখানে জগন্নাথ হলের ভেতর দিয়ে ফুলার রোডের টিচার্স কোয়ার্টারের পেছন দিকে ঢুকব। বুঝেছিস?”

দুজনেই মাথা নাড়ল।

“ভেরি গুড, এখন একটু অপেক্ষা করব আমরা।”

.

কর্নেল হাবিব তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেজরকে ভালোভাবে দেখছে। একটু আগেই তাকে রেগুলার ডিউটি থেকে সরিয়ে কর্নেলের অধীনে কাজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে।

সিন্ধি ছেলে হলেও দেখতে একদম পাঞ্জাবিদের মতো। ছয় ফিটের ওপর লম্বা, সাদা ফরসা গায়ের রং, খাড়া নাক, ছোট ছোট চুল আর ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফে অত্যন্ত সুদর্শন যুবক। কুচকুচে কালো মেজর ফয়সলের পাশে তাকে দেখতে লাগছে টিউবলাইটের মতো। “নাম?” কর্নেল প্রশ্ন করল।

“মির্জা বেগ, স্যার।”

“কোন রেজিমেন্ট?”

“ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট।”

“তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছ, তাই না?”

“জি স্যার।”

“কোন বিভাগে?”

“পদার্থবিজ্ঞান, স্যার।”

“দেখো তো এই লোকটাকে চিনতে পারো কি না?” বলে কর্নেল একটা ছবি এগিয়ে দিল মেজরের দিকে।

মেজর মেরুদণ্ড সোজা রেখেই টেবিলের ওপর রাখা ছবিটা একপলক দেখে নিল। “জি স্যার। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি তাকে ভালোভাবেই চিনি। তার নাম মনিরুজ্জামান খান।”

“বসো মেজর তোমাকেই আমার দরকার। আমার ধারণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা তুমি খুব ভালো করে চেনো। আজ রাতে তুমি আমাকে বিশেষ একটা ব্যাপারে সহায়তা করবে,” কর্নেল থেমে গিয়ে ফয়সলের দিকে হাত বাড়াল। ফয়সল তার হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিল।

“এই ম্যাপটা ভালোভাবে দেখে প্রথমে আমাকে কিছু জিনিস বোঝাবে তুমি। তারপর আমরা কাজে নামব।”

.

মনিরুজ্জামান একবার ঘড়ি দেখল। “আমার মনে হয় এবার আমরা একটা ট্রাই দিয়ে দেখতে পারি। কি বলিস?” সে কবিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

“জি স্যার। এখন মনে হয় ওরা অন্তত এদিক থেকে সরে গেছে,” বলে আবুর দিকে তাকিয়ে বলল, চল আমরা দেখে আসি।”

“না, দাঁড়া একসাথেই যাই। ফাঁকা পেলে আর ফিরে আসব না, চেষ্টা করব কোনো না কোনোভাবে রাস্তা পার হওয়ার,” বলে মনিরুজ্জামান বসা অবস্থাতেই একটা হাত বাড়িয়ে দিল আবুর দিকে। আবু হাতটা ধরে টেনে তুলল তাকে। তিনজনই একসাথে রওনা দিল ভবনটার কোণার দিকে। কাছে এসে প্রথমে কবির উঁকি দিয়ে দেখল।

“না, স্যার,” ফিসফিস করে বলল। “কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমার মনে হয় কাজ হতে পারে।”

“চল,” বলে মনিরুজ্জামান চাদরটাকে গায়ের সাথে জড়িয়ে নিল। তিনজনই মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো ভবনটার কোণা থেকে। এখান থেকে বাগানের একটা অংশ পার হলে নিচু দেয়াল। এখানকার দেয়ালটাও কার্জনের দেয়ালটার মতোই হাঁটু পর্যন্ত উঁচু। দেয়ালের অপর পাশে মূল রাস্তা। রাস্তাটা শহিদ মিনারের সামনে দিয়ে কতদূর গিয়ে দুভাগ হয়ে গেছে। বামেরটা চলে গেছে জগন্নাথ হল, ফুলার রোড টিচার্স কোয়ার্টারের দিকে। আর অন্যটা চলে গেছে রোকেয়া হল পার হয়ে হাতের বামে কলা ভবনের দিকে

ওরা দেয়ালটার কাছে এসে একবার চারপাশটা দেখে নিল। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু আগেও এই এলাকা সরগরম ছিল মিলিটারি, ট্রাক আর ট্যাংকের আওয়াজে। এখন দেখাচ্ছে একদম মৃত্যুপুরীর মতো।

মনিরুজ্জামান একবার শহিদ মিনার যেখানে ছিল সেদিকে দেখল। সেখানে এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃদু ধোঁয়া উড়ছে। বাতাসে হালকা পোড়া পোড়া গন্ধ। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও রসায়নেও মনিরুজ্জামানের ভালো দখল আছে। গন্ধটা শুঁকে সে অনুমান করল সম্ভবত শহিদ মিনারটাকে ওড়ানোর জন্য মিলিটারিরা ডিনামাইট ব্যবহার করেছে। মনিরুজ্জামান আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল সামনের দিকে। কবির আর আবু দেয়াল ঘেঁষে তার থেকে খানিকটা এগিয়ে গেছে। কবির অন্যপাশে যাওয়ার জন্য দেয়ালের ওপরে পা তুলছে হঠাৎ মনিরুজ্জামানের চোখের কোণে কিছু একটা ধরা পড়ল। পা নামিয়ে সে একলাফে অনেকটা এগিয়ে পেছন থেকে কবিরের শার্ট টেনে ধরে বসিয়ে দিল দেয়ালের নিচে। হঠাৎ হতচকিত হয়ে গেলেও আবুও বসে পড়ল ওদের সাথে সাথেই।

একটা মিলিটারি জিপ ওদের সামনের রাস্তা দিয়ে দুপাশে লাইট মারতে মারতে এগিয়ে গেল সামনের রাস্তা ধরে। তিনজনই নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে আছে। জিপটা পার হয়ে যেতেই উঠে বসল সবাই।

“কী ব্যাপার…?” কথাটা শেষ করার আগেই আবারও আরেকটা আলো দেখা গেল রাস্তায়। আবারও তিনজন শুয়ে পড়ল। এবার আরেকটা জিপ পার হয়ে গেল।

শুয়ে শুয়েই মনিরুজ্জামান ফিসফিস করে বলল, “শালারা পুরোপুরি চলে যায়নি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তাই এই দুটো জিপ টহল দিচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই আমাদেরকে দেখতে পেলে সাথে সাথে গুলি করে ফেলে দেবে,” থেমে গিয়ে সে সামান্য মাথাটা তুলে দুদিকে দেখল। দুটো জিপ এখন রাস্তার দুদিকে। জিপ দুটোর গতিবিধি দেখে সে বুঝতে পারল, এরা ঢাকা মেডিকেলের এলাকা থেকে শুরু করে একেবারে টিএসসি হয়ে রোকেয়া হলের এলাকা পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে পাহারা দিচ্ছে। একটা একদিকে গেলে অন্যটা আরেক দিকের এলাকা কভার করছে। যাতে এইদিক দিয়ে একটা মাছিও পার হতে না পারে।

মনিরুজ্জামান মনে মনে ভাবল, ঘটনা কী, শালারা এই এলাকা এমনভাবে পাহারা দিচ্ছে কেন। দুই পাশ দেখতে দেখতে সে আবারও চট করে মাথা নিচু করে ফেলল। একটা জিপ ফিরে আসছে। জিপের আলোটা ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে সে আবারও মাথা তুলে দুই পাশ দেখতে দেখতে পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলল।

“কবির, আবু, দুজনেই শোন,” মাটিতে শুয়ে দুজনের দিকে ফিরে ফিসফিস করে সে বলল। “আমি মনে হয় পাহারাদার জিপ দুটোর গতিবিধি বুঝতে পেরেছি। দুটো জিপ পালাক্রমে দুই দিক পাহারা দিচ্ছে। তার মানে একটা জিপ যখন রাস্তার এক মাথায় থাকবে অপর জিপটা থাকবে রাস্তার মাঝামাঝি। মাঝামাঝি জিপটা আমাদেরকে ক্রশ করে যাওয়ার পর অপর জিপটা ফিরে আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে। এক মিনিটের মতো। আমরা এই সময়টাই ধরব।”

“স্যার, এত অল্প সময়ে আমরা রাস্তা পার হয়ে অপর পাশে যেত পারব?” কবির বলল। “যদি দেখে ফেলে তাহলে তো গুলি করে দেবে।”

“কিছু করার নেই। এই ঝুঁকিটুকু নিতেই হবে। কারণ এখানে তো আর সারারাত বসে থাকা সম্ভব না। আমাদেরকে কোয়ার্টারে পৌঁছতেই হবে। কাজেই এইভাবেই যেতে হবে,” বলে সে একটু বিরতি দিল। কারণ তাদের পাশ দিয়ে আবারও টহল জিপ ফিরে যাচ্ছে। জিপটা চলে যাওয়ার পর আবার সে ফিসফিসানির সুরে বলতে লাগল, “আমি বলার সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিবি। দৌড়ানোর সময় আমাকে ফলো করবি। আর সাবধানে দৌড়াবি। একবার পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই।”

মনিরুজ্জামান মাথাটা সামান্য তুলে দেখল। একটা জিপ ঢাকা মেডিকেলের দিকে চলে যাচ্ছে, অপর জিপটার আলো এখনও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ সে শোয়া থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়াল, “এক্ষুনি।”

মনিরুজ্জামান এক লাফে দেয়াল পার হয়ে নেমে এলো রাস্তায়। দুটো জিপের একটাও কাছাকাছি নেই। সে মাথা নিচু করে চাদর সামলে দৌড় দিল রাস্তা বরাবর। আবু আর কবির পেছনে আছে কি না দেখার সময় নেই। শুধু অনুভব করল ওরা তার পেছনেই আছে। তিনজনেই প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। খুব দ্রুতই তারা গণিত ভবন থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত রাস্তাটা পার হয়ে এলো। এখান থেকে কোনাকুনি দৌড়ে পার হতে হবে জগন্নাথ হলের দেয়াল পর্যন্ত। এইটুকুই সবচেয়ে কঠিন কাজ। মনিরুজ্জামান শহিদ মিনারের কোণায় এসে এক মুহূর্তের জন্য থামল। এই সময়টুকুর ভেতরে দুটো জিনিস তার চোখে পড়ল। প্রথমত, বাকি দুজন তার সাথেই আছে। দ্বিতীয়ত, একটা জিপ ফিরে আসছে।

সে আবারও বড় করে দম নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে রাস্তার মোড় বরাবর কোনাকুনি দৌড় দিল। প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান, প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। তিন রাস্তার কোণাটা পার হয়ে আরেকটু রাস্তাটা ধরে এগোলেই দেয়ালটার কাছে পৌঁছে যাবে। ওরা মোড়া পার হয়ে এলো প্রায় বিদ্যুতের গতিতে। আর একটু এগোলেই জগন্নাথ হলের এক পাশের দেয়ালের কাছে পৌঁছে যাবে। মোড় পার হয়ে রাস্তাটা ধরে দৌড়াচ্ছে এখন তারা। আর একটু এগোলেই দেয়ালটা… এমন সময় সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে একটা গাড়ির আলো এসে পড়ল ওদের গায়ে।

ওরা ঠিক যেদিকে ছুটে যাচ্ছে সেদিক থেকে সরাসরি আসতে থাকা গাড়িটার একদম মুখোমুখি হয়ে গেল তিনজন।

“উফফফ,” মানুষ হঠাৎ ব্যথা পেলে যেরকম শব্দ করে মনিরুজ্জামানের মুখ থেকে অনেকটা সেরকম একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। মুহূর্তের আতঙ্কে ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল তিনজনই। যেভাবে মুখোমুখি পড়ে গেছে নিশ্চয়ই গাড়িটা থেকে ওদের দেখে ফেলেছে। যেকোনো মুহূর্তে গুলি ছুটে এসে ছিন্নভিন্ন করে দেবে…মনিরুজ্জামান ওদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল, “থামিস না, দৌড়া।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *