২৫শে মার্চ – ৩০

৩০

বর্তমান সময়, রাত প্রায় ২টা

আতিকুর রহমানের জিপটা ঘ্যাঁচ করে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। “এই বাড়িটাই তুমি নিশ্চিত?” সে পাশে বসে থাকা ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইল। “জি, স্যার। এই বাড়িটাই আমি জানি। আমি এই এলাকাতেই বড় হয়েছি। এই বাড়ি আমি খুব ভালো চিনি। এইটা এই এলাকার সবচেয়ে বড় আর পুরানো বাড়ি।”

“শাবাশ,” বলে সে প্রথমেই পেছনের জিপ দুটোকে বাড়িটার দুপাশে মানে পেছন দিকে একটা আর ডান দিকে অন্যটাকে রাখতে বলল। যাতে বাড়ি থেকে ওদিক দিয়ে কেউ বের হলে ওরা দেখতে পায়। নির্দেশনা শেষ করার সময় সে আরেকটা ব্যাপার যোগ করে দিল, “বাড়িটা থেকে কেউ যদি বের হয় বা পালানোর চেষ্টা করে প্রয়োজনে যেকোনো ব্যবস্থা নেবে,” বলে সে নেমে এলো জিপ থেকে। কাছে এসে টংটং করে আওয়াজ করল গেটে। কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। ড্রাইভারকে বলল জোরে জোরে হর্ন বাজাতে। ড্রাইভার দুবার জোরে জোরে হর্ন বাজানোর সাথে সাথে গেটের কাছ থেকে কেউ একজন বলে উঠল, “কী ব্যাপার?”

এসপি আতিকুর রহমান চমকে উঠল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু কথা বলছে। “কে?”

“জি, বলুন। এত রাতে কী প্রয়োজন?”

“পুলিশ, আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে,” সে বুঝতে পেরেছে কেউ একজন ইন্টারকম থেকে কথা বলছে।

“কোন ব্যাপারে?”

“গেট খোল ব্যাটা, না হলে ভেঙে ভেতরে ঢুকব,” আতিক সাহেব রীতিমতো দাবড়ে উঠল।

ধীরে ধীরে খুলে গেল গেটটা। আতিকুর রহমান আবার জিপে উঠে বসতে জিপ দুটো রওনা দিল ভেতরের দিকে।

.

পুলিশের গাড়িটার উপস্থিতি তাকে ব্যাপক চমকে দিয়েছে। সে ভেবেছিল আজ রাতের মতো আর তেমন কিছু হবে না। গাড়িতে শুয়ে শুয়েই সে আজ রাত পাড়ি দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছিল। ভেবেছিল এবার একটা ঘুম দেবে। কারণ তার প্রচণ্ড টায়ার্ড লাগছে। কিন্তু হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের দুটো জিপ আসাতে বুঝল পরিস্থিতি আবারও খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে। আবার তার অ্যাকশন দেখানোর সময় চলে এসেছে।

গাড়ি থেকে বের হয়ে সে একলাফে দেয়ালের ওপর উঠে বসল। সাবধানে এক হাতে কাঁটাতার উঁচু করে ধরে শরীরটাকে গলিয়ে দিল ভেতরে। ধীরে ধীরে পুরো শরীরটাকে বাঁকিয়ে নিয়ে চলে এলো তারের এপাশে হঠাৎ এক হাত থেকে শক্ত তার ছুটে গেল। তারটা পায়ে আঘাত করতে যাবে থাবা দিয়ে ধরে ফেলল সে অন্য হাতে। সাথে সাথে লোহার কাঁটা ঢুকে গেল হাতের তালুতে। নিজের অজান্তেই মৃদু চিৎকার করে উঠল তীব্র ব্যথায়।

.

“সর্বনাশ পুলিশ কীভাবে জানতে পারল আমরা এখানে?” হাসান রীতিমতো চমকে গেছে। অরণি আর বশির সাহেবও এসে দাঁড়িয়েছে জানালার কাছে। আহমদ বশির দৌড়ে গেলেন টেবিলের কাছে। ওয়াকিটকিটা তুলে নিতে যাবেন তার আগেই ওটা বেজে উঠল। “হ্যাঁ হায়দার বলো,” তিনি চুপ করে আছেন সম্ভবত ওপাশে হায়দার কথা বলছে।

“হ্যাঁ শোনো, তুমি উলটা-পালটা কিছু করো না। প্রথমে শোনো কী বলে। যদি সার্চ ওয়ারেন্ট থাকে তবে ঢুকতে চাইলে ঢুকতে দিও, আর যদি না থাকে তবে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। বাকিটা আমি দেখব। আর হোসনাকে এখানে পাঠিয়ে দাও, এক্ষুনি,” ওয়াকিটকি নামিয়ে রেখে অরণি আর হাসানকে বলল, ‘পুলিশ সম্ভবত কোনো না কোনোভাবে জেনে গেছে তোমরা এখানে আছ। কাজেই তোমাদের পালাতে হবে। হোসনা মানে আমার আয়ার সাথে যাবে তোমরা। ও তোমাদেরকে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বের করে দেবে। তোমরা বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকবে। তারপর পুলিশ চলে গেলে আমি কল করে জানাব। হাসান তোমার নম্বরটা দাও।”

হাসান নম্বর বলতে বলতেই হোসনা চলে এলো। ইতোমধ্যে অরণি ডায়েরি, কয়েন, ছবি আর খামটা ব্যাগে ভরে ফেলেছে। হঠাৎ অরণি থেমে গিয়ে বলল, “চাচা, তার কী হবে? নিরীহ মানুষটা শুধুমাত্র আমাদের জন্য খামাখা বিপদে পড়বে। তাকে নিয়ে যেতে হবে।”

“অরণি তাকে কেউ চিনতে পারবে বলে মনে হয় না। আর চিনলেও সেটা আমি সামলাতে পারব। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমরা যদি এখানে ধরা পড়ো তবে বিপদ হয়ে যাবে। প্লিজ আর কথা বলো না যাও।”

হোসনা আসতেই ওরা রওনা দিল। মহিলা ওদরেকে নিয়ে চলে এলো বাড়ির একদম পেছনে এখানে ছোট্ট একটা গেট আছে। গেটটা খুলে হাসান উঁকি দিয়ে চট করে আবার মাথাটা ভেতরে টেনে আনল।

“কী হলো জলদি চলো। আবার ভেতরে চলে এলে কেন?” অরণি দাবড়ে উঠল।

হাসান ভেতরে এসে ওর মুখ চেপে ধরল। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “বাইরে পুলিশের একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে। চারজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে বাড়ির পেছনটা।”

.

আতিকুর রহমানের জিপ বাড়ির সদর দরজার কাছে এসে থামতেই আতিক সাহেব জিপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে এলো। সার্চ ওয়ারেন্টের কাগজটা তার হাতে ধরা। বাড়ির দরজার পাশেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ভীষণ লম্বা আর শুকনো এক লোক। চেহারা দেখেই সে চিনল এটা হায়দার আলি, “আমরা বাড়িটা সার্চ করব। এই যে সার্চ ওয়ারেন্ট।

হায়দার আলি একবার কাগজটার দিকে দেখল। আরেকবার আতিকুর রহমানের দিকে দেখল। “অফিসার, আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন কী করছেন।” আতিকুর রহমার তার দিকে আগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “আপনার মালিক বশির সাহেব কোথায়?”

“তিনি ওপরে স্টাডিতে আছেন,” হায়দার আলি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

আতিকুর রহমান তার ফোর্সকে পুরো বাড়িটা তন্নতন্ন করে খোঁজার নির্দেশ দিয়ে ভেতরে রওনা দিল। হায়দার আলির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনার মালিক বশির সাহেবের সাথে কথা বলব। চলুন।”

হাসান আর অরণিকে স্টাডিতে ফেরত আসতে দেখে আহমদ বশির রীতিমতো চিৎকার করে উঠল। সে ফোনে কথা বলছিল ফোনটা রেখে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, “তোমরা আবার ফেরত এসেছ কেন? পুলিশ প্রায় চলে এসেছে।”

“পেছনের গেটে পুলিশ পাহারায় আছে। আমরা বেরোলে ধরা পড়ে যেতাম।”

বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। আহমদ বশির ইশারায় ওদেরকে বুক শেলফের পেছনটা দেখাল। দুজনেই দৌড়ে গিয়ে ওটার পেছনে লুকাতেই দরজাটা ধাম করে খুলে গেল। আতিকুর রহমান দুজন পুলিশকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল, তাদের পেছন পেছন ঢুকল হায়দার আলি। “হ্যালো মি. আহমদ বশির, আমি আতিকুর রহমান। সুপারিনটেনডেন্ট অভ পুলিশ। সরি এত রাতে আপনার মতো মান্যগণ্য একজন মানুষকে ডিসটার্ব করতে হলো বলে দুঃখিত কিন্তু আমাদের কাজই হলো কিছু মানুষকে ডিসটার্ব করা যাতে অন্যেরা তাদের দ্বারা ডিসটার্ব না হয়।”

“হ্যালো মি. রহমান, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। কিন্তু আমার বাড়ি সার্চ করার হেতুটা জানতে পারলে খুশি হতাম,” আহমদ বশির ও আতিকুর রহমানের মতোই জবাব দিল।

“তার আগে আপনি আমাকে বলুন তো রাত বাজে প্রায় তিনটা আপনারা সবাই এই সময়ে জেগে কী করছেন?”

“আমি রাত জেগে কাজ করতে পছন্দ করি। অফিসার রাত জাগাটা কি অপরাধ?”

“রাত জাগাটা অপরাধ না কিন্তু চাকরবাকর সহ সবাই মিলে রাত জাগাটা অস্বাভাবিক,” আতিকুর রহমান স্টাডির চারপাশে বুক শেলফের বইগুলো দেখতে দেখতে কথা বলছে। অরণিরা যে বুক শেলফ্‌টার পেছনে লুকিয়ে আছে ঠিক ওটার পাশেরটার সামনে এসে থেমে গেল সে।

হাসান আর অরণি দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ বশির আতিক সাহেবকে বলল, “আপনি কিন্তু এখনও বাড়ি সার্চ করার কারণটা বলেননি।”

পুলিশ বিভাগের ধারণা আপনি বাড়িতে দুজন অপরাধীকে লুকিয়ে রেখেছেন,” বলে সে একেবারে আহমদ বশিরের সামনে এসে থামল। “যাদেরকে পুলিশ খুঁজছে।”

“তাই নাকি? তা কাদেরকে আমি লুকিয়ে রেখেছি যদি একটু জানাতেন তাহলে ভালো হতো,” আহমদ বশির মজা করার সুরে বলল।

“ওহহ কাম অন, স্যার। ইউ নো হোয়াট আই মিন। আপনার শিওরিটির জন্য বলছি যদি আমি ওদেরকে এখানে পাই…গড ক্যান সেইভ ইউ,” আতিকুর রহমান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

“অফিসার ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হু আই অ্যাম,” আহমদ বশিরও একইভাবে জবাব দিল।

“আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি কে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এক বিন্দু কেয়ার করি না।”

 “হয়তোবা আপনি করেন না। কিন্তু আপনার ওপরওয়ালাদের ভেতর কেউ না কেউ করবেই, কাজেই …”

আহমদ বশির কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই এক পুলিশ রুমে ঢুকল, “স্যার পুরো বাড়ি সার্চ করেছি,” বলে একটু বিরতি দিল। “স্যার, কাউকেই পাওয়া যায়নি।”

“কী বলছ? পুরো বাড়ি ভালোভাবে সার্চ করেছ তো?”

“জি স্যার, একদম তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কেউ নেই।”

“বাইরে ওদরে সাথে যোগাযোগ করেছ? কেউ বাইরে বেরিয়ে যায়নি তো?” আতিকুর রহমান প্রায় নিঃসন্দেহ ছিল ওরা এখানেই আছে। সঠিক কোনো এভিডেন্সের ভিত্তিতে না হলেও এই ব্যাপারে সে বিরাট একটা বাজি ধরে ফেলেছিল।

“না স্যার, কেউ বের হয়নি।”

আতিকুর রহমান আহমদ বশিরের দিকে তাকাল সে মুখে হালকা একটা টিটকারির হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “আমি বলেছিলাম। বাই দা ওয়ে নেভার মাইন্ড।”

আতিকুর রহমান চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েই থেমে গেল। “দাঁড়াও, এক মিনিট।”

সবাই থেমে গেল। অরণি আর হাসান প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।  

“পুরো বাড়ি সার্চ করা হয়েছে,” বলে সে একবার চারপাশ দেখল। “এই স্টাডি রুমটা বাদে। এখানে…” সে কথা শেষ করার আগেই কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল একসাথে। হঠাৎ রুমের টিঅ্যান্ডটি ফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন করে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ দুজন পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল রুমের একপাশে।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ। একজনের হাতে সাইলেন্সার লাগানো একটা কালো রঙের পিস্তল। আর সেটা অন্যজনের মাথার পাশে ঠেকানো। “খবরদার অফিসার, বাড়াবাড়ি করলে এই বুড়ো মানুষটা মারা যাবে।”

পিস্তল ধরা মানুষটার হাতে বন্দি আমির চাচা ছটফট করে উঠল। রুমের সবাই থমকে গেছে। বুক শেলফের আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো অরণি আর হাসান।

“দারুণ, এই তো নায়ক আর নায়িকাকে পাওয়া গেছে,” ওদেরকে দেখে আতিকুর রহমান বলে উঠল। তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে পিস্তল ধরে থাকা লোকটাকে বলল, “জাকির মাহমুদ, আন্তর্জাতিক ভাড়াটে গুন্ডা, তুমি আমাকে একটা জিনিস বলো দেখি এই মানুষটা, চাচাকে দেখিয়ে বলল। “তাকে আমি চিনি না জানি না। তাকে জিম্মি করলে আমি থেমে যাব তুমি ভাবলে কীভাবে? এবং কেন?”

“তুমি এই কারণে থামবে না অফিসার, তুমি থামবে এই কারণে,” বলে সে অন্য হাতটা দেখাল। চাচার গলা জড়িয়ে রাখা ওই হাতটাতে একটা ছোট্ট সিলিন্ডারের মতো জিনিস। “কারণ তুমি, এই ছেলে আর মেয়েটাকে ছেড়ে না দিলে এই বোমাটা আমি ফাটিয়ে দেব এবং আমরা সবাই মারা যাব। তুমি কি সেটাই চাও?”

পুলিশ অফিসার আর ওই লোকটা কথা বলছে হাসান সুযোগ বুঝে আলগোছে টেবিলের ওপর থেকে একটা ফুলদানি তুলে নিল। সে তাকিয়ে দেখল তার ফুলদানি তুলে নেওয়াটা খেয়াল করেছে একমাত্র হায়দার আলি। সে হায়দার আলিকে নীরবে ইশারা করল।

তখনও আতিকুর রহমান কথা বলছে, হাসান ফুলদানিটা বসিয়ে দিল ওর পাশের এক পুলিশের মাথায়। সাথে সাথে তুলকালাম বেধে গেল। হায়দার আলি তার পাশে দাঁড়ানো এক পুলিশের শটগানটা টেনে নিয়ে ওটার বাঁট বসিয়ে দিল ওরই মাথায়। আতিকুর রহমান খাপ থেকে পিস্তল বের করে আনতেই ফয়সল মাহমুদ বোমটা ছুড়ে দিল রুমের মাঝখানে। ওটা থেকে হুস হুস করে বেরিয়ে এলো ধোঁয়া। ওটা আসলে তার সর্বশেষ স্মোক বম্বটা।

মুহূর্তের ভেতরে স্টাডিটা পরিণত হলো নরকে। কোনো এক পুলিশের হাত থেকে শটগানটা পড়ে গেল মাটিতে। সম্ভবত তার সেফটি লক অফ করা ছিল। ধাম করে গুলি ছুটে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল কেউ একজন।

হাসান পড়ে গিয়েছিল মাটিতে, এক লাফে উঠে দাঁড়াল। তীব্র ধোঁয়ার কারণে কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আবছাভাবে অরণিকে দেখতে পেয়ে ওর একটা হাত ধরে দরজার দিকে রওনা দিল। দরজার কাছেই আমির চাচা পড়ে ছিলেন। তাকেও তুলে নিল দুজন মিলে। তিনজনে নিজেদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো দরজার বাইরে। এখানে একটু গোলমতো জায়গা এরপরেই প্যাচানো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। তিনজনেই খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসে হাপুসহুপস করে দম নিতে লাগল। “বশির, বশির সাহেবকে বের করে অনতে হবে,” অরণি কাশতে কাশতে বলল।

“আমি এখানে,” হায়দার আলি আহমদ বশিরকে ধরে আছে। দুজনের চোখ থেকে দরদর করে ঝরছে পানি। সবাই বেদম কাশছে।

“হায়দার দরজাটা,” আহমদ বশির দরজাটা দেখিয়ে বলল। হায়দার আলি ছুটে গেল দরজার দিকে। সে দরজার হাতলটা ধরে টান দেবে লাগানোর জন্য হঠাৎ কেউ একজন দরজাটা ধরে ফেলল।

এসপি আতিকুর রহমান। এক হাতে রুমালে মুখ চেপে আছে। অন্য হাতে দরজাটা ধরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। হায়দার আলি দরজাটা লাগাতে গেল আর চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনে। আতিকুর রহমান দরজাটা ছেড়ে দিয়ে হাত দিতে গেল কোমরের দিকে সম্ভবত পিস্তলের দিকে। আর হায়দার আলি এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিয়ে ধাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। সে দরজাটা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ধাম ধাম দুটো গুলি দরজা ভেদ করে বেরিয়ে এলো। একটা তার একবারে নাকের সামনে দিয়ে চলে গেল।

একদৌড়ে ওদের কাছে এসে হায়দার আলি বলল, “স্যার, জলদি চলুন। তোমরাও।”

সবাই মিলে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে নেমে এলো নিচে। হাসান আর অরণি মূল দরজার দিকে এগোচ্ছিল আহমদ বশির ওদেরকে মানা করল। ওরা সবাই মিলে চলে এলো বাড়ির পাশের দিকে। এখানে একটা ছোট দরজা দিয়ে প্রবেশ করল গ্যারাজে। সেখানে একটা বড় ল্যান্ড রোভার জিপ দাঁড় করানো। হায়দার আলি ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল গ্যারাজের লাগোয়া একটা রুমে। একটু পরেই ফিরে এলো চাবি সহ। ওপরে প্রচণ্ড শব্দে কিছু একটা ভেঙে পড়ল।

“পুলিশ মনে হয় দরজা ভেঙে ফেলেছে। জলদি সবাই গাড়িতে ওঠো,” বশির সাহেব চিৎকার করে উঠল

সবাই মিলে গাড়িতে উঠতেই হায়দার ছেড়ে দিল গাড়ি। গ্যারাজ থেকে গাড়িটা রীতিমতো ছিটকে বেরিয়ে এলো ড্রাইভওয়েতে। গাড়িটা ড্রাইভওয়ে দিয়ে ছুটছে হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। এটা সম্ভবত পেছনে পাঠানো গাড়িগুলোর একটা, হাসান ভাবল। ওদের জিপটা গেটের কাছে যেতেই ওটা খুলে যেতে লাগল। সয়ংক্রিয় সিস্টেম। ওদের গাড়িটা বেরিয়ে আসছে পুলিশের গাড়িটা একেবারে প্রায় সামনে চলে এলো।

গাড়ির আরোহীরা চিৎকার করে উঠল। “সবাই শক্ত হয়ে…” হায়দার আলি তার সবধার বাণী শেষ করতে পারল না তার আগেই পুলিশের জিপ চলে এলো প্রায় সামনে। হায়দার আলি সর্বোচ্চ চেষ্টা করল। বনবন করে হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে প্রায় এড়িয়ে গিয়েও এড়াতে পারল না। পুলিশের গাড়ির এক কোণা ওদের জিপের একপাশে লেগে গেল।

পুলিশের গাড়িটা প্রায় দুশো ডিগ্রি ঘুরে গেল সাথে সাথেই। তীব্র ঘূর্ণির চোটে পুলিশের গাড়ির পেছন থেকে একজন ছিটকে পড়ল রাস্তায়। আর ওদের জিপটা অনেকখানি কাত হয়ে উলটাতে উলটাতে আবার সোজা হয়ে উঠে গেল একপাশের ফুটপাথের ওপর। স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল সাথে সাথে।

বেদম ঝাঁকুনির চোটে এ-ওর গায়ের ওপর উঠে পড়েছিল। সবাই একটু ঠিকঠাক হতেই হায়দার আলি গাড়ি স্টার্ট করার চেষ্টা করল। তার হাতের একপাশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে।

“কাম অন, কাম অন, স্টার্ট হো শুয়োরের বাচ্চা,” হায়দার বিড়বিড় করে বাজে গাল বকল গাড়িকে। ওদিকে পুলিশের জিপ থেকে একজন বেরিয়ে এসেছে। সে শটগান তুলে এদিকে ফায়ার করল। বুম করে শব্দ হলো কিন্তু কিছুই হলো না। হয় শটগানের জন্য রেঞ্জটা অনেক বেশি অথবা সে ভুল দিকে নিশানা করেছে।

বুম করে আবার শব্দ হলো। ওদিকে গেট দিয়ে আরেকটা পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে আসছে। হায়দার আলি এখনও চেষ্টা করছে স্টার্ট করার। পুলিশের গাড়িটা এগিয়ে আসছে। ওদের গাড়ি এখনও স্টার্ট হচ্ছে না। পুলিশের গাড়িটা তীব্র বেগে এসে ওদের গাড়িটার একপাশে বাড়ি মারল। আরোহীরা সবাই চিৎকার করে উঠল আতঙ্কে।

ওদের গাড়িটা বাড়ি খেয়ে একপাশে ঘুরে সোজা হয়ে গেল। কিন্তু ওটা এখনও স্টার্ট হয়নি। পুলিশের গাড়িটা আবারও এগিয়ে আসছে ভীষণ বেগে ওদের জিপটা হঠাৎ স্টার্ট নিয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো লাফ দিল সামনের দিকে। একলাফে নেমে এলো ফুটপাথ থেকে

পুলিশের গাড়িটা ওদের জিপের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছিল ওদের জিপটা স্টার্ট নিয়ে সরে পড়াতে ওটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা ছুটে গেল দেয়ালের দিকে। দেয়ালের সাথে রোহমোর্ষক একটা শব্দ করে থেমে গেল গাড়িটা। হুস হুস করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে ওটার সামনে থেকে।

হায়দার আলি জিপের হুইল ঘোরাল বনবন করে। গাড়িটাকে খোলা রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে পা পুরো চেপে ধরল এক্সেলেটরে। খেপা ষাঁড়ের মতো জিপটা আগে বাড়ল। একটানে চলে এলো খোলা রাস্তায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *