১
কুর্মিটোলা বিমানবন্দর, ঢাকা
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : বিকেল প্রায় ৫টা
দূর থেকে দেখে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরটাকে লাগছে একটা সুরক্ষিত আমি ক্যাম্পের মতো। অন্তত রিটায়ার্ড কর্নেল হাবিবের চোখে তাই মনে হলো। এয়ারপোর্ট রোডের দুই পাশে বিকেলের পড়ন্ত রোদে গাছের ছায়াগুলো দীর্ঘ হতে শুরু করেছে মাত্র। এর মাঝ দিয়ে কর্নেল হাবিবের আর্মি জিপটা এসে থেমে গেল এয়ারপোর্টের মেইন গেটের ঠিক সামনেই। থামার সাথে সাথে দুজন সেন্ট্রি তার আইডি দেখতে চাইল। যদিও খানিকটা রাগ লাগল তার, এই জিপ দেখার পরও আইডি দেখতে চাওয়ার কোনো মানে হয় না। তবে এখন কোনো ধরনের ঝামেলা করার কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনোটাই তার নেই। আসলে নিজের কাজ ফেলে এখানে আসারই কোনো ইচ্ছে তার ছিল না কিন্তু খোদ প্রেসিডেন্টের আদেশ বলে কথা। না এসে উপায় নেই।
গাড়ি থেকে নেমে একটা উইনস্টোন সিগারেট ধরিয়ে চারপাশে তাকাল সে। বিমানবন্দরে তুমুল সিকিউরিটির বহর দেখে তার মতো মানুষেরও মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড়। আর্মি, পুলিশ, স্পেশাল ফোর্স কারও অভাব নেই। চারপাশের বাতাসে টানটান একটা উত্তেজনা। নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হয়। উত্তেজনা আর ভয়ের মাত্রাটা এতই বেশি যে তার কাছে মনে হলো বাতাসে ছুরি চালিয়ে সেটাকে কাটা যাবে। সিকিউরিটির দিকে একবার নজর বুলিয়ে এয়ারপোর্টের কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল সে।
ভেতরে একপাশে সবকিছু আর্মির নিয়ন্ত্রণে। লবি থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্টের আগমনের প্রস্তুতি। বয়-বেয়ারারা ছুটাছুটি করছে। বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন যার যার কাজ দেখে নিচ্ছে শেষবারের মতো। মিলিটারি, আমলা আর বিশেষ ব্যক্তিবর্গের একটা দল ইতোমধ্যেই প্রেসিডেন্টকে বিদায় জানানোর লাইনে দাঁড়াতে ব্যস্ত। কর্নেল হাবিবের মুখে একটা টিটকারির হাসি ফুটে উঠল যখন দেখল সবসময়ের মতোই এখনও কে কার আগে দাঁড়াবে তা নিয়ে মৃদু ঠেলাঠেলি চলছে। মানুষ আসলে কখনো বদলায় না, এমনকি এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও তেলবাজি কমতে চায় না লোকজনের।
সে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে পাশের লবিতে চলে এলো। এখানে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বহু লোকজন হাউকাউ করছে। বাচ্চাদের চেঁচামেচি, মহিলাদের চিৎকার আর মৃদু ফিসফিসানিতে চারপাশ অস্থির। সবাই চেষ্টায় আছে কীভাবে একটা পশ্চিম পাকিস্তানের টিকিট জোগাড় করে এখান থেকে পালানো যায়। এরা প্রায় সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিক, বেশিরভাগই আলাদা সম্প্রদায়ের লোক, কিছু পাঞ্জাবি, পাঠান আর সিন্ধিও আছে। বিভিন্ন পেশার সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে পাকিস্তানের এই অংশে তাদের বসবাস ছিল। এদের প্রায় সবাইকেই গোপনে এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ জানানো হয়েছে।
এরা সবাই জানে, সে নিজেও জানে কী ঘটতে চলেছে আজ রাতে। জানে না শুধু এই ভূমির মানুষেরা। আজ রাতে তাদের ওপর কত বড় বিপদ নেমে আসতে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে আরও অবাক হলো সে। আজ এই এয়ারপোর্টে একটা বাঙালির চেহারাও সে দেখতে পায়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ভূমিতে, তাদের নিজেদের এয়ারপোর্টে একটা বাঙালি নেই। ব্যাপারটা তার কাছে খুবই দুঃসহ মনে হলো।
ভাবতে ভাবতে সে লোকজনের ভিড় ঠেলে সামনে এগোল। বিশেষ একজন লোককে তার দরকার। কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে কি? ভাবতে ভাবতেই সে সামনে দেখতে পেল মানুষটাকে। লোকটা তার পরিবারের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত এখনও টিকিট ম্যানেজ করতে পারেনি। তাকে দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে লোকটার চেহারায় বহু রং খেলে গেল। প্রথমে অস্বস্তির, তারপর ভয়ের এরপর সম্ভাব্য বিপদের। কর্নেল হাবিব তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “হ্যালো প্রফেসর।” সাথে সাথে প্রফেসরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
.
প্রেসিডেন্ট এলো আরও আধা ঘণ্টা পর, ঠিক পাঁচটা বাজে। মিটিং বাতিল করে সে সরাসরি চলে এসেছে। চোখে-মুখে একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ তার। কর্নেল হাবিব বিদায়ী অতিথিদের লাইনে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই বুঝতে পারল প্রেসিডেন্ট আলোচনা বাতিল করে দিয়ে এসেছেন। তার মানে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে চাতুর্যপূর্ণ খেলা সে চালিয়ে এসেছে আজ তার ইতি টানতে যাচ্ছে।
কর্নেলের মনে পড়ে গেল দুবছর আগে ১৯৬৯ সালে ঠিক এই দিনেই ২৫শে মার্চ সে বৃদ্ধ আইয়ুব খানকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। ব্যক্তিগতভাবে সেদিন হাবিব নিজে তার সেই পার্টিতে উপস্থিত ছিল। সেই দিনটা থেকে আজকের দিনটা কত ভিন্ন। অন্যদের মতো সে নিজেও ভেবেছিল বৃদ্ধ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে হটিয়ে ইয়াহিয়া খানের মতো একজন প্রতাপশালী মানুষ ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি পালটে যাবে কিন্তু সেটা হয়নি। বরং পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও খারাপই হয়েছে। তবে এইসব রাজনীতি তার ভাবার বিষয় নয়। সে শুধুমাত্র তার নিজের কাজ নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে। সেটাও এই রাজনীতির খেলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং সেটা বুদ্ধির খেলা, আর সেটা এই খেলার মতো নোংরা খেলা নয়। বরং অনেক ভয়ংকর খেলা।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অতিথিদের সাথে বিদায় পর্ব সম্পন্ন করল খুব দ্রুত। প্রায় কারও সাথেই হাত মেলাল না। কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে প্লেনের দিকে এগোল। যাওয়ার আগে একবার সামান্য তাকিয়ে হাতের ইশারায় তাকে ফলো করতে বলল।
প্রেসিডেন্টের জন্য বিমান একদম প্রস্তুত করাই ছিল। সাদা এবং সবুজ রঙের বোয়িংটাতে পূর্ণ জ্বালানি নেওয়া হয়েছে ছয় হাজার মাইল পাড়ি দেওয়ার জন্য। এটার যাত্রাপথ শ্রীলঙ্কা হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি। প্লেনে উঠে প্রেসিডেন্ট হাবিবকে ঠিক তার সামনের সিটটাতে বসতে বলল। বিমানবালাকে নির্দেশ দিল পাইলটকে একটু বিলম্ব করতে এবং সেই সাথে হুইস্কি পরিবেশন করতে। হাবিব প্রেসিডেন্টের সামনে বসে আছে। প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থার নির্দেশ জারি করতে ব্যস্ত। বিমানবালা হুইস্কি পরিবেশন করার সাথে সাথে সে একটা গ্লাস তুলে নিয়ে এক চুমুকে খালি করার সাথে সাথে আরেকবার ভরে নিল। ইশারায় কর্নেলকেও নিতে বলল। কর্নেল গ্লাসটা তুলে নিয়ে চুমুক না দিয়ে বসে রইল চুপচাপ। প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন নির্দেশ শেষ হতে হাবিব বুঝে গেল খেলা শুরু হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। হয়তো সে করাচি নেমেই যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে দেবে।
কাজ শেষ করে প্রেসিডেন্ট হুইস্কির আরেকটা গ্লাস তুলে নিয়ে হাবিবের দিকে তাকাল। হাবিব কথা বলতে শুরু করল, “স্যার…”
“আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লিসেন এনিথিং। আই জাস্ট ওয়ান্ট দ্যাট। আই ওয়ান্ট দ্যাট ‘ব্রোকেন হর্স ‘। ইফ ইউ কান্ট গেট দ্যাট, ডোন্ট কাম ব্যাক টু ওয়েস্ট পাকিস্তান। আই ওয়ান্ট দ্যাট ব্রোকেন হর্স,” প্রেসিডেন্ট কোনো বিরতি না দিয়েই একটানা বলে গেল।
সাথে সাথে হাবিবের চোখের সামনে ভেসে উঠল তার ছেলে-মেয়ের চেহারা। “ইয়েস স্যার, আই উইল গেট দ্যাট। আই প্রমিজ।”
“ইউ বেটার,” বলে প্রেসিডেন্ট আরেকবার গ্লাস তুলে নিয়ে তাকে বিদায় জানাল। কর্নেল প্লেন থেকে নেমে এসে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, ইটস টাইম ফর অ্যাকশন।