২৫শে মার্চ – ৩৭

৩৭

রাজবাড়ি, গাজীপুর
বর্তমান সময়, বেলা ১টা ৩০ মিনিট

“এরপর, এরপর কী হলো?” অরণি জানতে চাইল। তার চোখে পানি। উপস্থিত প্রায় সবার চোখেই পানি।

“এরপর দেশে যুদ্ধ লেগে যায়। হাফিজ স্যারের বাসা থেকে জিনিসটা উদ্ধার করে আমি আর আজমত চাচার ভাতিজা দুজনে মিলে তোমার মা’কে নিয়ে যশোর চলে যাই। সেখান থেকে বর্ডার পার হয়ে ভারত। যুদ্ধের সময়টা আমরা ওখানেই ছিলাম শরণার্থী শিবিরে। তারপর দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসি। আমার তখন অনেক কাজ। প্রথমেই আজমত চাচার ভাতিজাকে তোমার মায়ের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি জিসিনটাকে সিকিউর করার চেষ্টা করি। মনিরুজ্জামান স্যারের আরও দুজন ছাত্র, ওরা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। ওদেরকে সহ আবারও কাল্টটাকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। সেটা করতে করতে আবারও দেশে দুর্ভিক্ষ লাগে, পঁচাত্তরে দেশ আবারও উত্তাল হয়ে ওঠে। এরপর আমি দেশের বাইরে চলে যাই। মালয়েশিয়া যাওয়ার একটা সুযোগ আসে। সেখানে গিয়ে পড়াশুনা শুরু করি আবারও। এরপর আর দেশে ওভাবে ফিরে আসা হয়নি। দেশের সবকিছু সামলে রাখা থেকে শুরু করে আড়াল থেকে আফরোজার দেখভাল পর্যন্ত সবকিছুই করত ওরা। অবশ্য সবই করা হতো আড়াল থেকে। কিছুদিন আগে আমার দুই বন্ধুকে খুন করা হয়। একই সময়ের একটু পরে আমার প্রাণের ওপরও হামলা হয়। আহত অবস্থায় ভয় পেয়ে আফরোজাকে ফোন করে সব বলে দেই। ওর জন্ম পরিচয় থেকে শুরু করে সবকিছু। এমনকি এই জিনিসগুলোও যে ব্যাংকের লকারে রাখা ছিল সেটার সন্ধানও দিয়ে দেই ওকে। কিন্তু ওটাই আমার ভুল ছিল এখন মনে হচ্ছে। এই জিনিসগুলোই আফরোজার প্রাণ কেড়ে নিল। আমি আসলে – “

“কিন্তু কারা করছে এসব? কারা আপনার শত্রু? ওই কবির লোকটা? সে—ই কি এসব করছে? ওই দিনের ঘটনার পর তার কী হলো? আপনার সাথে এরপর আর তার দেখা হয়নি?”

“অরণি,” হাসান ডাক দিল। “অরণি।”

“অরণি একটু বিরক্ত হয়েই ওর দিকে ফিরে তাকাল,

“হাত?”

“কী?”

“কী?”

“হাত। মনিরুজ্জামান, মানে তোমার নানা ওই কবির লোকটার একটা হাত কেটে ফেলেছিল। আর…”

“সর্বনাশ, আমির চাচারও একটা হাত…”

.

“একদম ঠিক ধরেছ অরণি, কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেছে,” কণ্ঠস্বরটা শুনে সবাই ফিরে তাকাল। আমির চাচা, তার সাথে আরও কয়েকজন। প্রত্যকের হাতেই অস্ত্র। সবার সামনে চাচার ঠিক সাথেই ওই লোকটা যে ওদের পিছু লেগে ছিল।

“কবির…” আফতাব সাহেব মৃদু স্বরে বলল।

“হ্যাঁ বন্ধু, কতদিন পর দেখা তাই না!” চাচা মৃদু হাসিমুখে বলল। তার এক হাতে হাসানের দেওয়া অস্ত্রটা। সেটা সে সোজা তুলে ধরল আফতাব মাহমুদের দিকে। “আবু তোমার কাছে যদি কোনো অস্ত্র থাকে তবে সেটা নামিয়ে রাখো…” বলে সে পিস্তলের নলটা ঘুরিয় দিল এসপি আতিকুর রাহমানের দিকে। “…এবং মি. এসপি প্লিজ আপনার অস্ত্রটা। আর তোমারও,” শেষ কথাটা সে হায়দারকে বলল।

এসপি আতিকুর রহমান তার নাইনএমএমটা মাটিতে নামিয়ে রাখতেই একজন এসে তুলে নিল সেটা। একই কাজ করা হলো হায়দার আলির ক্ষেত্রেও। “আপনারা,” আতিকুর রহমান কিছু বলতে চাচ্ছিল কবির তাকে থামিয়ে দিল। “একদম চুপ। কেউ কোনো কথা বলবে না।”

এবার সে অরণির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয় গল্পের বাকি অংশটা এখন শেষ করা উচিত। ২৫শে মার্চ রাতে আমার হাত কাটার পর আহত অবস্থায় আমি আর মেজর ফয়সল পালিয়ে আসি। মেজর ফয়সল খুব বেশি আহত হয়নি। সে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আর্মি ক্যাম্পে। যুদ্ধ যখন শেষ হওয়ার পথে পরিস্থিতি বুঝে আমি চলে যাই পাকিস্তানে। পরবর্তীতে সেখান থেকে দেশের বাইরে। এর কয়েকবছর পর দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে ফিরে আসি দেশে। আমার বন্ধু আফতাব মাহমুদ আবুকে অনেক খুঁজেছি। পাইনি। কিন্তু কখনোই খোঁজা বাদ দিইনি। সম্প্রতি আমার ছেলে রীতিমতো তদন্ত করে তাকে এবং তার দুই বন্ধুকে খুঁজে বার করে। ওদেরকে খুঁজে বের করার ইতিহাস বিস্তারিত বলব না। শুধু এটুকু বলব, আমার ছেলে অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ। সে খুব সুন্দর করে ব্যাপারটা খুঁজে বার করে। এরপর তার পরিকল্পনা অনুযায়ীই একটা ফাঁদ পাতি আমি। দেশে তার দুই বন্ধুকে খুন করা হয় প্ল্যান করে। এরপর মালয়েশিয়াতে নাটক সাজানো হয় আবুকে খুন করার। আসল পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। আমি জানতাম তোমাকে আঘাত করা হলে তুমি মনিরুজ্জামান স্যারের মেয়ের সাথে যোগাযোগ করবে। এবং তুমি তাই করো। এরপর তাকে খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। তোমাদের ফোন কলের সূত্র ধরে তাকে বের করে ফেলি আমরা।”

“তার মানে আপনিই আমার মা’কে খুন করেছেন?”

“মামণি এত অস্থির হলে হয়। না আমি তোমার মাকে খুন করিনি। আফরোজাকে খুঁজে বের করে তার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েই বুঝে যাই ও-ই মনিরুজ্জামান স্যারের মেয়ে। ওর পেছনে লেগে থাকতে বলি আমার লোকদের কিন্তু কীভাবে যেন বুঝতে পেরে স্রেফ গায়েব হয়ে যায় ও। দুদিন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েও হদিস করতে পারেনি আমার লোকজন। এই দুদিনেই সে এসব নাটক সাজায়। এরপর ও বাড়ি ফিরে আসার সাথে সাথে আমরা আর ঝুঁকি নিতে চাইনি। ওখানেই ওকে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু ওর বাড়িতে ঢুকে ওকে ধরার চেষ্টা করার সময়ে আমাদের একজনের হাত থেকে পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে ও নিজেই নিজের বুকে গুলি করে। আমরা পুরো বিপদের মধ্যে পড়ে যাই। কারণ সমস্ত রহস্যটার চাবিকাঠি ছিল ওর কাছে। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় এই ছেলেটা আসে। কারণ আমাদের গাড়ি ওখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে পার্ক করা ছিল। আফরোজা মারা যাওয়ার পর ও যখন বাসার ভেতরে এসে ঢোকে আমরা তখন পেছন দিয়ে আফরোজার ডেড বডি বাইরে নিয়ে আসি। ওর গাড়িতে করেই আফরোজার ডেড বডিটা সরানোর পরিকল্পনা ছিল। ডেড বডি ওর গাড়ির বুটে রাখার পর খেয়াল হয় গাড়ি তো আছে কিন্তু চাবি তো এই ব্যাটার কাছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই গ্যারাজে আসতেই ওর কাছ থেকে চাবিটা ছিনিয়ে নেওয়া হবে। এই ব্যাটাও বাইরে আসে আর হঠাৎ করেই ঘটনাস্থলে চলে আসে পুলিশ। এই ব্যাটা ফেঁসে যায়। পুরো পরিস্থিতিটা হয়ে পড়ে লেজেগোবরে। আমি পড়ি মহা বিপদে। এই জিনিসগুলো উদ্ধারের আশা যখন ছেড়ে দেব ভাবছিলাম তখনই জানতে পারি আমেরিকা থেকে আফরোজার মেয়ে আসছে। আমি পরিকল্পনা করি আফরোজার মেয়েটার হাতে সবকিছু তুলে দিতে হবে। কারণ আফরোজা এইসব জিনিসের ভেতরে যদি কিছু লুকিয়ে রেখে গিয়ে থাকে তবে একমাত্র তুমিই পারবে এর সমাধান করতে। এবং আমার ধারণা ভুল ছিল না।

“তার মানে ওই উকিল সাদেকুর রহমান আপনারই লোক?”

“না সে আমার লোক। সাধারণ গুন্ডা আমার সাথে মাঝে মাঝে কাজ করে। এই কাজের জন্য তাকে স্রেফ ভাড়া করো হয়েছিল,” কবির সাহেবের পাশ থেকে পিস্তল হাতের লোকটা বলে উঠল। এই লোকই বসুন্ধরা সিটি থেকে সব জায়গায় ওদেরকে ফলো করছিল। আতিকুর রাহমান যাকে স্টাডিতে জাকির বলে ডেকেছিল।

“আর তাই আপনি আমাদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন যাতে আমরা জিনিসটা উদ্ধার করতে পারি এবং আপনারা সেটা ছিনিয়ে নিতে পারেন,” অরণি রীতিমতো হিসিয়ে উঠল। “আমরা জীবনেও সেটা করব না।”

“অবশ্যই করবে তোমরা। ইতোমধ্যেই অনেকখানি করে ফেলেছ। আফরোজা সবকিছু জানার পর হাতে পাওয়ার পর কী কী করেছিল এটা একমাত্র তোমরাই বুঝতে পেরেছ এবং এই পর্যন্ত চলে এসেছ। বাকিটাও পারবে,” কবির বলে উঠল। “অরণি আমি সব জানি। অস্বীকার করো না। আমি হয়তো সবসময় তোমাদের সাথে ছিলাম না কিন্তু আমার ছোট্ট একটা জিনিস ছিল। একটা ছোট্ট ছারপোকা। ওটা একদিকে লোকেশন নিশ্চিত করে পাশাপাশি ওটা একটা লিসেনিং ডিভাইসও। তোমার মনে আছে আমি সারাক্ষণ কানে হেডফোন লাগিয়ে রাখতাম?” আসলে-”

“আপনি আমাদের কথা শুনতেন,” হাসান হতবাক।

“একদম ঠিক বলেছ খোকা। আমি সবই শুনেছি।”

“কিন্তু আপনার ডিভাইসটা আমরা সরিয়ে ফেলেছি।”

“একটা, কিন্তু অন্যটা?”

“মানে আরও ছিল?”

“তুমি কি কখনো তোমার মানিব্যাগ চেক করেছ? কিংবা তোমার ওই ব্যাকপ্যাকটা? দুটো নয় তিনটা ছিল ছারপোকা। হা হা। অরণি তুমি এয়ারপোর্টে নামার পর কাস্টমসে দেরি, বাইরে ছিনতাইকারির হামলা, আমার সাথে তোমার পরিচয় সবই ছিল সাজানো। আমিই বারবার জাকিরকে মেজেস দিয়ে দিয়ে তার পরবর্তী পদক্ষেপের নির্দেশ দিচ্ছিলাম। এমনকি বশিরের স্টাডিতে আমাকে জিম্মি করাটাও ছিল আমারই সিদ্ধান্ত। এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে প্রায় সবই আমার বুদ্ধিতে। এখন তুমি আমাকে জিনিসটা বের করে দেবে।”

“জীবনেও না, কখনোই না,” অরণি আবার ঝামটে উঠল।

“অবশ্যই মামণি। তা না হলে,” হঠাৎ করেই তার একজন লোক হাসানকে একপাশে টেনে নিয়ে ওর কপালের পাশে পিস্তল ঠেকাল। “এই ছেলেটা মারা যাবে।”

“অরণি প্লিজ, সত্যি তুমি যদি পারো তবে করো। এর জন্য অনেক প্ৰাণ গেছে আর না। আমিও এর সমাধান দেখতে চাই,” হঠাৎ আফতাব মাহমুদ বলে উঠল।

অরণি একবার হাসানের দিকে তাকাল। ওর কপালের পাশে পিস্তলের নল ঠেকানো। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। আরেকবার কবিরের দিকে দেখল। “ঠিক আছে।”

“দাঁড়াও,” সবাই থেমে গেল। “এই তুমি,” সে হাসানকে ধরে থাকা লোকটাকে বলল। “ওকে ছেড়ে আমার বন্ধু আর ওই লোকটা আহমদ বশিরকে সার্চ করো। ওদের ওপর আমার ভরসা খুব কম।”

 বলার সাথে সাথে লোকটা হাসানকে ধাক্কা মেরে আফতাব সাহেবের ওপরে ফেলে দিল। হাসান তাকে নিয়ে পড়তে পড়তে কোনোমতে রক্ষা করল ভারসাম্য। তবে সে অনুভব করল আফতাব সাহেব ধাক্কা লাগার সময়ে তার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিল। “আমি যখন বলব তখন এটা চাপবে,” হাসানের কানে কানে ফিসফিস করে বলল সে।

হাসান জিনিসটা নিয়ে আলগোছে পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মৃদু মাথা নেড়ে বোঝাল সে শুনতে পেয়েছে। কবিরের সাথের লোকটা সার্চ করল আফতাব মাহমুদ আর আহমদ বশিরকে। ওদের মোবাইল থেকে শুরু করে নিয়ে গেল সবকিছু।

অরণি কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। “জিনিসটা বের করতে আমার হাসানের সাহায্য লাগবে।”

“ঠিক আছে বালক, যাও মামণিকে হেল্প করো,” কবির আদেশ দিল I

“হাসান এখানে এসো,” অরণি তার নানা মনিরুজ্জামানের কবরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাসানকে এগোতে বলল। হাসানও তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। “মা যদি এখানে সত্যিই কিছু লুকিয়ে রেখে থাকেন তবে সেটার কু এখানেই আছে।”

“কিন্তু সমস্যা হলো আমরা শেষ পর্যন্ত যেটা দেখেছিলাম তাতে…” হাসান কথা বলতে বলতে কবরের ওপরে নামের ফলকটা হাত দিয়ে পরিষ্কার করছিল। হঠাৎ মনিরুজ্জামান খান লেখা নামটা এবং সালটার ঠিক নিচেই একটা তির চিহ্ন দেওয়া। “অরণি এটা দেখো।” সাদা পাথরের ওপরে হালকা সবুজ শ্যাওলার স্তর। স্তরটার ওপরে নামটার ঠিক নিচে হালকা কালো রঙের একটা তির চিহ্ন দেওয়া।

“এটা অবশ্যই মায়ের দেওয়া। কারণ, ‘

“চিহ্নটা অনেক নতুন,” অরণির কথাটা হাসান শেষ করে দিল।

“ঠিক। কিন্তু ওদিকে কী আছে?” দুজনেই তির চিহ্ন দেওয়া জায়গাটার দিকে ফিরে তাকাল। ওদিকে স্রেফ পুরানো ভাঙা জিপটা আছে আর আছে বটগাছ।

“অবশ্যই কিছু একটা আছে ওদিকে। চলো, ওখানে গিয়ে দেখতে হবে। “ দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে ওদিকে এগোল। সাথে কবিরের দুজন গুন্ডাও এগোল। অরণি আর হাসান গাড়িটার কাছে এসে থেমে গেল। ওদের সাথে আহমদ বশিরও এসে দাঁড়িয়েছে।“

“এখানে কী থাকতে পারে,” সে জানতে চাইল।

“এখনও বুঝতে পারছি না। তবে কবরের ফলকের কাছে দেওয়া চিহ্নটা এদিকেই নির্দেশ করছে,” বলে হাসান আস্তে আস্তে গাড়িটার দরজার কাছে এসে থেমে গেল। গাড়িটার বলতে গেলে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আগেই পুড়ে গিয়েছিল সব। এখন মূল স্ট্রাকচারটা বাদে আর কিছুই প্রায় নেই। তবে পোড়া সিটগুলো আর ড্যাশবোর্ডটা এখনও আছে। “অরণি এদিকে এসো,” হাসান ডাক দিতে অরণি আর মি. বশির ওর কাছে এসে থেমে গেল। হাসান শরীর গলিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। “দেখো।” অরণি বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখল। গাড়ির পোড়া ভিউ মিররের নিচে যেখানে পুতুল বা খেলনা ঝোলানো থাকে হাসান ওখান থেকে কিছু একটা খুলে আনছে। অরণির বুকটা ধক করে উঠল। একবার ভাবল হাসান জিনিসটা পেয়ে গেছে। কিন্তু হাসান যেটা খুলে আনল সেটা একতাড়া কাগজ। আর সাথে কিছু একটা আছে। কাগজগুলো সুতো দিয়ে বাঁধা। সুতোর বাঁধনটা খুলে দিতেই কাগজগুলো বেরিয়ে পড়ল।

“দেখি কী এগুলো?” কবির কাগজগুলো হাসানের হাত থেকে টান নিয়ে নিল। “এগুলো তো ম্যাপ বা ওরকম কিছু না। এগুলো তো ডায়েরির পাতা। আসল জিনিস কোথায়?”

“এগুলো নিশ্চয়ই সেই ডায়েরির মিসিং পাতা,” অরণি বলল।

“হ্যাঁ ডায়েরির পাতা দিয়ে আমি কী করব? আসল জিনিস কোথায়?” হাসান গাড়ির মেঝে থেকে কিছু একটা তুলে নিল। জিনিসটা অনেকটা গোল চাকতির মতো। “এটা একটা কম্পাস।”

“দাঁড়াও, এটা কি এখানে ঝোলানো ছিল?” অরণি জানতে চাইল।

“মনে হয়,” হাসান জবাব দিল।

“যদি এটা এখানও থেকে থাকে তবে এটাকে আবার জায়গামতো ঝোলাতে হবে। তাহলে হয়তো দিক-নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে। কারণ…”

“ঝোলাও জলদি ঝোলাও,” অরণির কথার মাঝখানে বাজেভাবে থামিয়ে দিল কবির সাহেব। তাকে দেখতেও ভীষণ অস্থির লাগছে। “জলদি করো।”

হাসান আর অরণি কাজ শুরু করে দিল। অবশিষ্ট সুতো দিয়ে কম্পাসটাকে আবারও ভিউ মিররের সাথে ঠিক যেভাবে ছিল সেভাবে ঝুলিয়ে দিল। “ খেয়াল রোখো কম্পাসের কাঁটার লাল অংশটা কোন দিকে নির্দেশ করে।”

হাসান মনোযোগ দিয়ে কম্পাসের কাঁটাটাকে ফলো করছে। কাঁটাটা ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে থেমে গেল। “দারুণ, কিন্তু ওটা কোনদিকে নির্দেশ করছে?”

“এটা তো ওই দিকে দেখাচ্ছে। ওখানে তো খোলা মাঠ ছাড়া আর কিছু নেই,” কাঁটটার লাল প্রান্তটা গাড়ির পেছনে খোলা জায়গাটাকে দেখাচ্ছে। “চলো বাইরে গিয়ে দেখি।”

দুজনেই বেরিয়ে চলে এলো গাড়িটার পেছন দিকে। “এখানে তো সামনে ছোট্ট মাঠের মতো একটা জায়গা, এরপর ফসলের জমি।”

“দাঁড়াও ওদিকে না। জিনিসটা থাকলে এখানেই কোথাও আছে,” অরণি গাড়িটার পেছন দিকে এগিয়ে গেল। ওটার পেছনের দরজা নেই। একটা সিট ভেঙে মেঝেতে পড়ে আছে। “এগুলোকে নাড়ানো হয়েছে সম্প্রতি। দেখো মেঝেতে দাগ।”

“হ্যাঁ, আমি সরাচ্ছি,” বলে হাসান এক ঝটকা দিয়ে সিটটাকে সরিয়ে দিল। সিটটার ঠিক নিচেই জিপের মেঝেতে একটা ঢাকনামতো লাগানো। এটাতে সম্ভবত ইমার্জেন্সি কিট রাখা হতো। হাসান হাত বাড়িয়ে ওটা তুলে নিল। সবাই ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কবিরের চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে হাত বাড়িয়ে হাসানের হাত থেকে ঝটকা মেরে বাক্সটা নিয়ে নিল। বাক্সটার সাইজ মোটামুটি একটা বড় মগের মতো হবে।

টেপ দিয়ে মোড়ানো বাক্সটা থেকে সে টেপ সরিয়ে ঢাকনা খুলে ফেলল। ভেতরে কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা। কাপড়টা সরিয়ে দিতেই কালো রঙের পাথরের ঘোড়াটা বেরিয়ে এলো। কবির সাহেব সেটা চোখের সামনে তুলে ধরল। “অবশেষে… কীভাবে খুলতে হবে এটা?” আহমদ বশিরের দিকে ফিরে বলল সে।

“আমি যতদূর জানি এটার মাথাটা আলগা হওয়ার কথা। কোনো একদিকে মোচড় দিলে সেটা খুলে যাবে,” সে এক হাতে ওটা খুলতে পারবে না তাই হাসানের হাতে ধরিয়ে দিল। “খোল।” ওকে নির্দেশ করেই এক হাতে পিস্তল তুলে ধরল। বশির সাহেবের কথামতোই হাসান ঘোড়াটার মাথাটা ধরে ডানে মোচড় দিল। মৃদু খরখর শব্দের সাথে খুলে গেল মাথাটা। সবাই উৎকণ্ঠার সাথে অপেক্ষা করছে ভেতরে কী আছে দেখার জন্য। হাসান উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখল। দেখেও সে চুপ করেই রইল।

“কী হলো, কিছু বলছ না কেন? বের করো ভেতরে কী আছে,” কবির সাহেব ধমকে উঠল। হাসান তবুও কোনো উত্তর দিল না। বরং জিনিসটা বাড়িয়ে দিল কবিরের দিকে। কবির রীতিমতো খাবলা দিয়ে সেটা নিয়ে নিল। ভেতরে তাকিয়ে সে চিৎকার করে উঠল।

“কী ব্যাপার ভেতরে কী?” অরণি জানতে চাইল উৎকণ্ঠার সাথে।

“কিছুই নেই,” কবিরের কণ্ঠে হাহাকার। “এর ভেতরে কিছুই নেই,” বলে সে রীতিমতো চেঁচাতে লাগল। “হায়, কিছুই নেই। এতগুলো বছর, এত অপেক্ষা সব শেষ,” সে রীতিমতো বিলাপ করছে। “তার মানে এসব ফাঁকিবাজি। সব তোমাদের দোষ। কবির হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। “নিশ্চয়ই তোমরা জানো ম্যাপটা কোথায় আছে। নিশ্চয়ই এই ছুড়িটার কাজ এসব। বল, কোথায় রেখেছিস ম্যাপটা?” বলে সে সোজা অরণির কপালে পিস্তল ঠেকাল।

“থামুন, আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন নাকি,” হাসান পেছন থেকে এগিয়ে এলো। আফতাব সাহেব তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। “জিনিসটা আমার কাছে আছে। আমি সরিয়েছি।”

“কোথায়?” এবার সে অরণিকে ছেড়ে দিয়ে হাসানের দিকে পিস্তল তুলল। “এই যে,” বলে হাসান ওর হাত বাড়িয়ে দিল। হাতের মুঠিটা বন্ধ। কবির লাফ দিয়ে এগিয়ে এলো। হাসানের হাতের দিকে এগিয়ে এসে হাতটা ধরতে যাবে হাসান মুঠোর ভেতরে বাটনটা চেপে দিল।

জিনিসটা আসলে কী, বাটনটা চাপলে কী হবে কিছুই তার জানা নেই। প্রথমে বুঝতেও পারল না আসলে কী ঘটল। হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আর সামনে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জাকিরের মাথাটা ফাটা তরমুজের মতো বিস্ফোরিত হলো। শুধু দেখল আশেপাশের সবাই এদিক-সেদিক লাফিয়ে পড়ছে, অরণি মাটিতে বসে গেল দুই কান চেপে ধরে। দুই-একজন মাটিতেও শুয়েও পড়ল। সবার থেকে এক মুহূর্ত দেরিতে হলেও সে বুঝতে পারল ব্যাপারটা কী ঘটছে। তীব্র একটা শব্দের সাথে সে অনুভব করল চারপাশে বুলেট ছুটছে ক্ষিপ্ত ভোমরার মতো। এরপর একের পর এক গুলি। সাথে সাথে সে-ও বাটনটা ছেড়ে দিয়ে দুই কান চেপে ধরে শুয়ে পড়ল মাটিতে

সবার আগে সামলে উঠলেন আফতাব সাহেব। কারণ একমাত্র তিনিই জানতেন আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে। তিনি নিজেকে সামলে উঠে বসার সাথে সাথেই দেখলেন কবিরের হাতের পিস্তলটা মাটিতে পড়ে আছে। ওটার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালেন। কিন্তু অসুস্থ হওয়ায় তার নড়াচড়া অনেক ধীর। তিনি পিস্তলটা ধরার আগেই কবিরের এক লোক তার অস্ত্র তুলে নিয়ে তাক করল আফতাব সাহেবের দিকে। কিন্তু কিছু করার আগেই গুলি এসে তার কণ্ঠনালি ভেদ করে গেল। হাসান অরণিকে ধরে উঠে বসে দেখল পরিস্থিতি পালটে গেছে। দুই দিক থেকে সমানে গুলি এসে কবিরের গুন্ডা দলকে ঘায়েল করে ফেলছে একের পর এক।

হাসান প্রথমে বুঝতে পারল না গুলিগুলো আসছে কোথা থেকে কিন্তু সাথে সাথে দেখল সুট পরা তিনজন লোক। দুদিক থেকে সবাইকে কভার করে সমানে গুলি করছে।

কবির এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে মাটিতে পড়ে থাকা তার পিস্তলের দিকে হাত বাড়ানোর আগেই আফতাব সাহেব সেটা তুলে নিলেন। সোজা কবিরের বুকের দিকে তাক করে বললেন, “তুই সবসময়ই নিজেকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান মনে করেছিস তুই আসলে একটা গাধা। তুই কীভাবে ধরে নিলি আমি ব্যাকআপ ছাড়া বোকার মতো এখানে চলে আসব। আমার বডিগার্ডদের কথা তোর মনে রাখা উচিত ছিল। হাসানের হাতের ওই বাটনটা ছিল ওদেরকে সিগন্যাল দেওয়ার একটা বায়ার। আর এটা মনিরুজ্জামান স্যারের সম্মানে আমার তরফ থেকে তোকে গিফট্,” বলে সে পরপর তিনটা গুলি করল কবিরের বুকে। গুলি খেয়ে কবির লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। রাজ্যের বিস্ময় আর হতাশা নিয়ে মারা গেল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *