হিন্দু রমণী (অর্থাৎ আমাদের প্রত্যক্ষীভূত একটি সতীর আশ্চর্য্য স্বামীভক্তি!)

হিন্দু-রমণী (অর্থাৎ আমাদের প্রত্যক্ষীভূত একটি সতীর আশ্চর্য স্বামীভক্তি!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একটি খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে জনৈক হিন্দু রমণীর চরিত্র এবং তাহার পতি-ভক্তি সম্বন্ধে যেরূপ জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই আজ পাঠকগণকে এই স্থানে উপহার প্রদান করিব। 

নিয়মিতরূপে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া ঘটনাস্থলে গিয়া উপনীত হইলাম। ঘটনাস্থল কলিকাতা সহরের মধ্যবর্তী কোন এক দুর্নীতিপূর্ণ স্থান। যাহার নিমিত্ত এই ঘটনা ঘটিয়াছে, সে সেই স্থানে দুষ্কর্ম্ম-পরায়ণা, চরিত্রহীনা একটি স্ত্রীলোক। তাহার কলিকাতায় নাম বিধু, দেশে নাম রাধামণি। 

বিধু ওরফে রাধামণি আজ হত—মস্তক, কলেবর হইতে বিচ্যুত—রুধির স্রোতে তাহার গৃহখানি প্লাবিত এবং একখানি শাণিত অস্ত্র রক্তাক্ত হইয়া সেই স্থানে পতিত। 

যে গৃহের ভিতর বিধু আজ শেষ লীলা সম্বরণ করিয়াছে, সেই গৃহখানি তাহার নিজের। উহা ইষ্টক নিৰ্ম্মিত সুন্দর অট্টালিকা নহে, জীর্ণাবস্থা-প্রাপ্ত একখানি সামান্য খাপ্‌রেলের গৃহ। উহার কোন স্থানের খাপ্‌রেল সরিয়া গিয়াছে, কোন স্থানের খুঁটি হেলিয়া গিয়াছে, কোন স্থানের বেড়া ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, এবং কোন স্থানের দরমা সরিয়া পড়িয়াছে। সেই বাড়ীর ভিতর কেবলমাত্র একখানি গৃহ, উহাতেই বিধু বাস করিত। বিধু ব্যতীত অপর কোন ভাড়াটিয়া সেই বাড়ীতে থাকিত না। 

বাহির হইতে বিধুর গৃহের অবস্থা দেখিয়া যেরূপ বোধ হয়, ভিতর কিন্তু সেরূপ নহে। সমস্ত গৃহখানি একখানি সুরঞ্জিত চন্দ্রাতপে আবৃত। সেই গৃহের এক পার্শ্বে একখানি কারুকার্য খচিত পালঙ্ক, তাহার উপর দুগ্ধফেননিভ সুদৃশ্য শয্যা। অপর পার্শ্বে সারি সারি দুইটি আলমারি। সেই আলমারিদ্বয় এরূপ যত্নে রক্ষিত যে, দেখিলেই অনুমান হয়, অল্পদিবস হইল, উহা ক্রয় করিয়া আনা হইয়াছে। উহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলে, এখন পর্য্যন্ত উহার উপর প্রতিবিম্ব পতিত হয়। উহার একটি তৈজসপত্র, খেলনা এবং পুত্তলিকাদি দ্বারা পরিপূর্ণ। অপরটির ভিতর অলঙ্কার এবং বস্ত্রাদি সবিশেষ যত্নের সহিত রক্ষিত আছে। 

গৃহের মেজেটি অতি পরিপাটী, পরিষ্কৃত এবং পরিচ্ছন্ন। পালঙ্কের সম্মুখে একখানি তক্তপোষ এবং তাহার উপর একখানি চিক্কণ মছলন্দ বিন্যস্ত। সেই মছলন্দের উপর বিধুর মৃত দেহ বিশৃঙ্খল ভাবে পতিত; কিন্তু তাহার মস্তক মেজের উপর গড়াগড়ি দিতেছে। রক্তধারা গৃহ-তল আপ্লুত করিয়া পরিশেষে নরদামা বাহিয়াও কিয়দংশ বাহিরে গিয়া পড়িয়াছে। 

যে সময় বিধুর মৃতদেহ প্রথম আবিষ্কৃত হয়, সেই সময় উক্ত গৃহের একমাত্র দ্বার উন্মুক্ত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। অথচ তাহার গৃহের কোন দ্রব্য স্থানান্তরিত বা অপহৃত হয় নাই! 

বিধুর অবয়ব দেখিয়া অনুমান হয় যে, তাহার বয়ঃক্রম ত্রিংশ বৎসরের অধিক নহে। অঙ্গ-সৌষ্ঠব উত্তম না হইলেও বর্ণ গৌর, তাহাকে একবারে কুরূপা বলা যায় না। 

যে অস্ত্র দ্বারা বিধু হত হইয়াছে বলিয়া অনুমিত হয়, সে অস্ত্রও বিধুর নিজের। তাহার গৃহের ভিতর দ্বারের বাম পার্শ্বে একটি খুটাতে উহা লম্বিত থাকিত। যে সময় পুলিশ প্রথমে গৃহের ভিতর প্রবেশ করেন, সেই সময়ে উহা রক্তাক্ত অবস্থায় মেজের উপর পতিত ছিল। 

যে গৃহে বিধু বাস করিত, তাহার সম্মুখে সামান্য একটু প্রাঙ্গন আছে। উহা ইষ্টক নির্ম্মিত প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। সেই প্রাচীরের একস্থানে একটি পুরাতন দ্বার আছে, বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার উহাই একমাত্র পথ। সেই প্রাঙ্গনের এক পার্শ্বে একখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র রন্ধনশালা, এবং তাহার সন্নিকটে একটি কূপ। বাড়ীর ভিতর জলের কল নাই, সেই কূপের জলেই সাংসারিক সমস্ত কার্য্য নিৰ্ব্বাহ্ হইয়া থাকে। 

যে দিবস বিধুর মৃতদেহ প্রথমে দেখিতে পাওয়া যায়, সেই দিবস অতি প্রত্যূষে পাড়ার অপর আর একটি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক সৰ্ব্ব প্রথমে বিধুর বাড়ীর সদর দ্বার উন্মুক্ত অবস্থায় দেখিতে পায়। এরূপ প্রত্যূষে বিধু কখনই গাত্রোত্থান করে না, বা তাহার সদর দ্বার কখনই উন্মুক্ত হয় না। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই স্ত্রীলোকটির মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হয়; সে সেই উন্মুক্ত দ্বার দিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া বিধুর গৃহের দ্বারও সম্পূর্ণ উন্মোচিত অবস্থায় দেখিতে পায়। এই ব্যাপার দেখিয়া সে “বিধু বিধু” বলিয়া বার বার ডাকিতে থাকে, কিন্তু বিধুর কোনরূপ উত্তর না পাইয়া তাহার গৃহের দ্বারের নিকট গমন করিলে, সেই ভীষণ দৃশ্য তাহার নয়ন গোচর হয়। এই ব্যাপার দেখিয়া সে কোনরূপেই স্থির থাকিতে পারে না, তখনই উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া উঠে। তাহার চীৎকারে পাড়ার অনেকেই আসিয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে, এবং হত্যাকারীর পদচিহ্ণ প্রভৃতি নিদর্শন সকল একবারে বিনষ্ট করিয়া ফেলে। এই ভয়ানক সংবাদ ক্রমে পাড়ার ভিতর প্রচারিত হইয়া পড়ে, এবং পরিশেষে পাড়ার লোকজন কর্তৃক এই সংবাদ থানায় প্রেরিত হয়। 

অনুসন্ধান উপলক্ষে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপনীত হইয়া পূৰ্ব্ববর্ণিত ব্যাপার সকল দেখিতে এবং শুনিতে পাইলেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ উপনীত হইবার পূর্ব্বে প্রতিবেশীবর্গের পদক্ষেপে যদিচ প্রাঙ্গনের সমস্ত নিদর্শন বিলুপ্ত হইয়া যায়, তথাপি পূর্ব্ববর্ণিত কূপের সন্নিকটে জল-মিশ্রিত রক্তের কথঞ্চিৎ নিদর্শন দৃষ্টিগোচর হয়। উহা দেখিয়া সকলেই অনুমান করেন যে, হত্যা করিবার পর, হত্যাকারী রক্তাপ্লুত হস্তপদ প্রভৃতি সেই কৃপসন্নিকটে উত্তমরূপে প্রক্ষালন পূর্ব্বক পরিশেষে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছে। 

এই হত্যার ব্যাপার দেখিয়া কৰ্ম্মচারীগণ নানা প্রকারে আপনাপন যুক্তি সকল প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। 

কেহ কহিলেন, “বিধুর যথাসর্বস্ব অপহরণ করিবার মানসে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে, কিন্তু কোনরূপ 

প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হওয়ায় হত্যাকারী তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হয় নাই।” 

কেহ কহিলেন,—“এ হত্যার উদ্দেশ্য কোনরূপেই তাপহরণ হইতে পারে না। কারণ, হত্যা করিবার পরে যদি হত্যাকারী কোনরূপ প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হইয়া অপহরণ করিতে বিরত হইত, তাহা হইলে নিশ্চিন্ত ভাবে কূপ সন্নিকটে গমন করিয়া কখনই সে রক্তাপ্লুত হস্তপদ প্রক্ষালন করিতে সাহসী হইত না।” 

কেহ কহিলেন, “এ হত্যার প্রধান উদ্দেশ্য শত্রুতা হইবারই অতীব সম্ভাবনা। কোন সবিশেষ কারণ বশতঃ হত্যাকারী এই হতভাগিনীর প্রতি ক্রোধান্বিত হয়, এবং অপর কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া সেই ক্রোধ দমন করিতে না পারিয়া, তাহার প্রাণের উপর হস্তক্ষেপ করে। এই নিমিত্তই ইহার কোন দ্রব্যের উপর হত্যাকারী হস্তক্ষেপ করে নাই। যদি চুরি করিবার অভিপ্রায়ে এই হত্যার অবতারণা হইত, তাহা হইলে বিশেষরূপ প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হইলেও তাহার কিছু না কিছু নিদর্শন নিশ্চয়ই পরিলক্ষিত হইত।” 

কেহ কহিলেন, “এই বিষম অভিনয়ের উদ্দেশ্য অপহরণ বা মনোবিবাদ কিছুই নহে। ইহার অঙ্কুর প্রণয়, এবং পরিণাম ফল এই হত্যা। আমার অনুমান হয় যে, কোন অল্পবুদ্ধি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই হতভাগিনীর অপবিত্র প্রণয়কে পবিত্র বোধ করিয়া, আপন হৃদয়ে স্থান প্রদান করিয়াছিল। পরিশেষে যখন অবগত হইতে পারিয়াছে যে, সে বিষম ভ্ৰমে পতিত হইয়া দুৰ্ল্লভ সুধার পরিবর্তে অনায়াস-লভ্য বিষ পান করিয়াছে, তখন সে সেই বিষম বিষের জ্বালা সহ্য করিতে না পারিয়া, এই প্রলয়ঙ্কর কার্য্যে হস্তক্ষেপ পূর্ব্বক মনের বিষম জ্বালা নিবৃত্তি করিয়াছে। অথবা কোন অদূরদর্শী যুবক পবিত্র জ্ঞানে ইহার অপবিত্র প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া, হিতাহিত জ্ঞানের মস্তকে পদাঘাত করিয়া ইহার প্রণয় স্রোতে গা ঢালিয়া মনের সুখে সন্তরণ করিবার বাসনা করিয়াছিল; কিন্তু যখন দেখিল যে, তাহার সেই পবিত্র বাসনা পূর্ণ হইল না, যখন বুঝিতে পারিল যে, প্রণয়িনীর যে প্রণয়কে সে পবিত্র মনে করিয়াছিল, তাহাতে পবিত্রতার লেশমাত্র নাই, অথচ তাহার কলুষময়ী স্রোতোগতি অন্যদিকে, তখন সে কোনরূপে আপনার মনের বেগ সম্বরণ করিতে সমর্থ না হইয়া এই নৃশংস কার্য সম্পন্ন করিয়া আপনার মনকে কিয়ৎ পরিমাণে সন্তুষ্ট করিবার উপায় করিয়াছে।” 

যে কর্ম্মচারীর মনে এইরূপে যে প্রকার ভাবের উদয় হইতে লাগিল, তিনি আপনাপন যুক্তি প্রদর্শন করিয়া সেই সকল ভাবের অনুরূপ কথা কহিতে লাগিলেন। কিন্তু কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে এই লোমহর্ষণকারী অভিনয়ের নায়ক ধৃত হইয়া রাজ দণ্ডে সমুচিত দণ্ড লাভ করিতে সমর্থ হইবে, তাহার যুক্তি কেহই কোনরূপে স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। যাঁহার মনে যেরূপ ভাবের উদয় হইতে লাগিল, তিনি সেই ভাবের পন্থা অবলম্বন করিয়া ক্রমে অগ্রগামী হইতে লাগিলেন। কিন্তু কেহই কোনরূপে আপনাপন মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এইরূপে ক্রমে কিছু সময় অতিবাহিত হইয়া গেল, সংকল্পিত কার্য্যের কিন্তু কিছুই হইল না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

অনুসন্ধানে নিযুক্ত কর্মচারিবর্গ মিলিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে করিতে সকলেই অবগত হইতে পারিলেন যে, গোকুল নামক এক ব্যক্তি এই হতভাগিনীর প্রণয়ে মুগ্ধ ছিল। 

বিধু ওরফে রাধামণির প্রণয়ে গোকুল কিরূপে মুগ্ধ হইয়াছিল, তাহা বর্ণন করিবার পূর্ব্বে গোকুল কে, তাহার চরিত্রই বা কিরূপ, তাহাই পাঠকগণের অবগতির নিমিত্ত এই স্থানে প্রথমেই বর্ণিত হইল। 

গোকুলের বাসস্থান যশোহর জেলার অন্তর্গত কোন এক ক্ষুদ্র পল্লীতে। গোকুলের পিতা নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তিও নহেন, অথবা তাঁহাকে বড় লোকও বলা যায় না। পল্লীগ্রামে মধ্যমাবস্থা চাষী গৃহস্থের অবস্থা সর্ব্বদা যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, ইনিও সেই অবস্থার লোক ছিলেন। গোকুল তাহার পিতার একমাত্র সন্তান। যে গ্রামে গোকুলের বাস, সেই গ্রামের নিকটবর্ত্তী অপর একখানি গ্রামে একটি বিদ্যালয় ছিল, সেই বিদ্যালয়েই গোকুল প্রথমে লেখাপড়া শিক্ষা করে। তৎপরে কোন উচ্চ শ্রেণীর বিদ্যালয়ে আরও কিছু দিবস শিক্ষা করিয়া কোনরূপ চাকরীর প্রত্যাশায় কলিকাতায় আগমন করে। তাহার অনেক দিবস পূর্ব্বে সে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিল। গোকুলের পিতা গোকুলের নিতান্ত শৈশব কালেই একটি সুপাত্রীর সহিত তাহার পরিণয় কার্য্য সম্পন্ন করিয়া দিয়াছিলেন। 

গোকুলের সৌভাগ্যবশতঃ যে সময় গোকুল চাকরীর প্রত্যাশায় প্রথমে কলিকাতায় আগমন করে, সেই সময় কোন একজন সওদাগরের আফিসে কয়েকজন লোকের প্রয়োজন হয়। অন্যান্য লোকের সঙ্গে গোকুলও সেই চাকরীর প্রত্যাশা করিয়া একখানি আবেদন করে। গোকুলের আবেদন গ্রাহ্য হয়। কুড়ি টাকা বেতনে একটি কৰ্ম্ম সে প্রাপ্ত হয়। 

যে কার্য্যে তিনি প্রথমে নিযুক্ত হন, সেই কার্য্যের নিমিত্ত তাহাকে প্রায় সর্ব্বদাই মফস্বলের নানা স্থানে গমন করিতে হইত; এবং সময় বিশেষে এক এক স্থানে প্রায় দুই তিন মাস পর্যন্ত অতিবাহিত করিতে হইত। 

এইরূপ কার্য্যোপলক্ষে সে যখন মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিতি করে, সেই সময় রাধামণির কুহকে পতিত হইয়া তাহারই প্রণয়ে নিজ মন প্রাণ অর্পণ করে। পরিশেষে কলিকাতায় আসিবার সময় তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসে। গোকুল চাকরী উপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়া এক দিবসের নিমিত্তও দেশে গমন করে নাই, বা তাহার উপার্জিত অর্থের দ্বারা তাহার বৃদ্ধ পিতা মাতাকে কোনরূপ সাহায্যও করে নাই, অথবা তাহার যুবতী ভার্যারও কোনরূপ তত্ত্ব লয় নাই। চাকরী করিয়া গোকুল যাহা কিছু উপার্জ্জন করিতে লাগিল, তাহা হইতে নিজের অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়া তদবশিষ্ট সমস্তই রাধামণিকে প্রদান করিতে লাগিল। 

রাধামণি অতিশয় চতুর স্ত্রীলোকছিল। কলিকাতায় আসিবার পর সেই স্থানের অপরাপর চরিত্রহীনা স্ত্রীলোকদিগের সহিত মিলিত হইয়া ক্ৰমে তাহাদিগের ভাবভঙ্গি উত্তমরূপে শিক্ষা করিল; যেরূপ চাল চলন এবং কার্য-প্রণালী অবলম্বন করিয়া তাহারা অর্থ উপার্জ্জন এবং সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করে, রাধামণিও তাহাই অবলম্বন করিল। সেই সঙ্গে সঙ্গে আপনার নামও পরিবর্ত্তন করিয়া ফেলিল। পূর্ব্বে তাহার নাম ছিল রাধামণি, এখন সে বিধু নামে পরিচিত হইতে লাগিল। 

গোকুল ইহার উপর ক্রমে এরূপ মুগ্ধ হইয়া পড়িল যে, যে সময় তাহাকে কলিকাতায় থাকিতে হইত, সেই সময় পূর্ব্বের ন্যায় সে আর অপর কোন স্থানে বাস করিত না; যে গৃহে বিধু বাস করিত, সেই গৃহেই সে রাত্রিদিন অতিবাহিত করিতে লাগিল। ক্রমে জমিদারের নিকট হইতে কিয়ৎ পরিমাণ স্থান লইয়া তাহার উপর পূর্ব্ববর্ণিত একখানি খাপ্‌রেলের বাড়ীও প্রস্তুত করিয়াছিল। এক এক করিয়া তৈজস আদি এবং বিছানা-পত্র ক্রয় করিয়া ক্রমে তাহার গৃহ পূর্ণ করিয়া দিতে লাগিল। 

গোকুলের চরিত্রের বিষয় ক্রমে চতুৰ্দ্দিকে প্রচারিত হইয়া পড়িতে লাগিল, ক্রমে ক্রমে তাহার পিতা মাতা এবং বনিতা পৰ্য্যন্ত সকলেই তাহার চরিত্রের বিষয় অবগত হইলেন। যাহাতে গোকুলের চরিত্র সংশোধিত হয়, সেই অভিপ্রায়ে তাহার পিতা প্রথম প্রথম অনেক যত্ন করিলেন। কোনরূপে কৃতকার্য হইতে না পারিয়া কোনরূপ উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক গোকুলকে একবার দেশে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তাহাতেও সফল কাম হইতে পারিলেন না। 

বৃদ্ধ পিতা কোন প্রকারে আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে না পারিয়া আপনার বন্ধু বান্ধবের সহিত পরামর্শ করিয়া পরিশেষে গোকুলের যুবতী ভার্য্যাকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন, এবং তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহার পত্নীকে তাহার হস্তে অর্পণ করিয়া কহিলেন, “তুমি আমাদিগকে কোনরূপে সাহায্য কর আর না কর, তাহাতে আমাদিগের কোন ক্ষতি নাই; কিন্তু তোমার পত্নীকে তোমার নিকট রাখিয়া তাহাকে প্রতিপালন করা তোমার নিতান্ত কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। বিশেষতঃ এখন আর ইনি বালিকা নহেন, ইঁহারও এখন প্রধান কার্য্য স্বামীর সেবা শুশ্রূযা করা। এইরূপ অবস্থায় আমি ইঁহাকে তোমার নিকট রাখিয়া আপ। দেশে গমন করিতেছি, দেখিও, ইঁহার যেন কোনরূপ কষ্ট না হয়।” এই বলিয়া বৃদ্ধ পিতা গোকুলের নিকট তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া বৃদ্ধ যখন গোকুলকে সুপথে আনিতে সমর্থ হইলেন না, তখন মনে মনে এইরূপ উপায় স্থির করিয়া গোকুলের ভার্য্যাকে আনিয়া তাহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। ইচ্ছা যে, আপনার স্ত্রী নিকটে থাকিলে কোনরূপে যদি গোকুলের চরিত্র সংশোধিত হয়। 

বৃদ্ধ গোকুলের হস্তে তাহার স্ত্রীকে অর্পণ করিয়া, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন সত্য, কিন্তু কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া একবার স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন না; স্থানান্তরে অবস্থিতি করিয়া সন্ধান লইতে লাগিলেন যে, পুত্র তাহার বনিতার উপর কিরূপ ব্যবহার করে। ইচ্ছা,—যদি দেখিতে পান বা অবগত হইতে পারেন যে, পুত্র তাহার বনিতার উপর নিতান্ত অসৎ ব্যবহার করিতেছে, তাহা হইলে পুনরায় তিনি তাহাকে সঙ্গে করিয়া আপন দেশে লইয়া যাইবেন এবং তাঁহার সাধ্যমত তাহাকে প্রতিপালন করিবেন। 

বৃদ্ধ যতদূর ভাবিয়াছিলেন, দেখিলেন যে, তাঁহাকে আর ততদূর করিতে হইল না। জানি না, কিভাবিয়া গোকুল কোন গৃহস্থের বাড়ীতে একখানি ঘর ভাড়া করিয়া সেই স্থানে তাহার বনিতাকে রাখিয়া দিল। 

এত দিবস পর্য্যন্ত গোকুল বিধুর বাড়ীতেই আহারাদি করিত, এখন আপনার স্ত্রীর নিকট দিবাভাগে আহার করিতে লাগিল। কিন্তু রাত্রিকালের আহারের যেরূপ বন্দোবস্ত বিধুর বাড়ীতে ছিল, সেইরূপই রহিল। শয়ন, পূর্ব্বের ন্যায় বিধুর বাড়ীতেই হইতে লাগিল। তাহার বনিতা অপরিচিত স্থানে একাকীই রাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিল। 

গোকুল তাহার স্ত্রীকে কলিকাতায় আনয়ন করিয়াছে, গোকুল এ কথা বিধুকে প্রথমে না বলিলেও ক্রমে এই সংবাদ তাহার কর্ণে গিয়া উপনীত হইল। এই কথা শুনিবামাত্র বিধু ক্রোধে নিতান্ত অধীর হইয়া পড়িল, এবং পরিশেষে গোকুলকে নানাবিধ অকথ্য কথায় গালি দিতে লাগিল। গোকুল কিন্তু অম্লান বদনে তাহার সমস্তই সহ্য করিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। গোকুলের স্ত্রী মাতঙ্গিনী কলিকাতায় স্বামীর নিকট অবস্থিতি করিলেও গোকুলের চরিত্রের কিছুমাত্র পরিবর্তন হইল না। 

মাতঙ্গিনীর পিত্রালয় নদীয়া জেলার অন্তর্গত কোন একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে। মাতঙ্গিনী বর্তমান স্ত্রীলোকদিগের সদৃশ শিক্ষিতা নহে। তাহার পিতা মাতা লেখা পড়া শিখিবার নিমিত্ত কখনও তাহাকে কোন বিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন নাই; কেবল মাত্র গৃহ কাৰ্য ও গুরুজনের সেবা শুশ্রুষা করিতেই তাহাকে উত্তমরূপে শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন। 

মাতঙ্গিনী কলিকাতায় তাহার স্বামীর নিকট গমন করিয়াছে, এই কথা শ্রবণ করিয়া তাহার ভ্রাতা তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত কলিকাতায় আগমন করিলেন। কারণ, ইতিপূর্ব্বে তিনিও তাঁহার ভগিনীপতির চরিত্রের বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিয়াছিলেন। এরূপ অবস্থায় তাঁহার ভগিনী দুশ্চরিত্র স্বামীর হস্তে পতিত হইয়া সবিশেষরূপে কষ্টভোগ করিতেছে কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত কলিকাতায় আগমন করিলেন। ভগিনীর অবস্থা দেখিয়া তাঁহার বিলক্ষণ অনুমান হইল যে, তাঁহার ভগিনী মনের সুখে দিন যাপন করিতে পারিতেছেন না। কিন্তু ভগিনীকে জিজ্ঞাসা করিয়া তিনি তাহার কিছুই অবগত হইতে পারিলেন না। তিনি যতবার জিজ্ঞাসা করিলেন, মাতঙ্গিনী ততবার কহিল যে, তাহার কোনরূপ কষ্ট নাই, সে স্বামীর সহিত মনের সুখে কলিকাতায় বাস করিতেছে। 

এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়া মাতঙ্গিনীর ভ্রাতা তাঁহার দেশে গমন করিলেন। যাইবার সময় মাতঙ্গিনীকে সঙ্গে লইয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন; কিন্তু মাতঙ্গিনী তাঁহার প্রস্তাবে কোনরূপে সম্মত হইল না। সুতরাং তাঁহাকে একাকীই গমন করিতে হইল। 

মাতঙ্গিনীর ভ্রাতার সহিত মাতঙ্গিনীর যে সকল কথা হইয়াছিল, গোকুল তাহার সমস্তই জানিতে পারিল, এবং ভাবিল যে, এখানে মাতঙ্গিনীর কোনরূপ কষ্ট নাই, সে মনের সুখে কালযাপন করিতেছে। 

মাতঙ্গিনী যাহাই বলুক, এবং মাতঙ্গিনীর ভ্রাতা ও গোকুল যাহাই ভাবুক, প্রকৃত পক্ষে মাতঙ্গিনীর কিন্তু কষ্টের অবধি ছিল না। একখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র ও ভগ্নাবশিষ্ট খাপরেলের ঘরের মধ্যে মাতঙ্গিনীর থাকিবার স্থান নির্দিষ্ট ছিল, তাহার উপর গোকুল এরূপ অল্প পরিমাণে খরচ-পত্র প্রদান করিত যে, মাতঙ্গিনী তাহার দ্বারা নিতান্ত আবশ্যক ব্যয়ও কোনরূপেই কুলাইয়া উঠিতে পারিত না। দিবাভাগে গোকুলের আহারাবশিষ্ট যাহা কিছু থাকিত, তাহারই দ্বারা নিতান্ত কষ্টে মাতঙ্গিনী কোনরূপে জীবন ধারণ করিত মাত্র। রাত্রিকালে গোকুলের আহার করিবার স্থান বিধুর বাড়ীতে ছিল, সুতরাং মাতঙ্গিনীকে আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিতে হইত না, অথচ নিজের আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুতের খরচ-পত্র গোকুলের নিকট পাইত না। সুতরাং অনাহারে মাতঙ্গিনীকে রাত্রি যাপন করিতে হইত। 

কুড়ি টাকা হইতে গোকুলের বেতন এখন পঞ্চাশ টাকা হইয়াছিল; কিন্তু তাহা হইতে একটি পয়সাও কোনরূপে স্থানান্তরিত করিবার অধিকার গোকুলের ছিল না, তাহার সমস্তই বিধুকে অর্পণ করিতে হইত। দিবাভাগের আহারাদি ব্যয় নির্ব্বাহের নিমিত্ত বিধু অনুগ্রহ করিয়া যাহা কিছু গোকুলকে প্রদান করিত, গোকুল তাহাই আপনার পত্নীর হস্তে অর্পণ করিত। সেই অর্থ দ্বারা গোকুলের দিবাকালীন আহারীয় বাদে যদি কিছু বাঁচিত, তাহারই দ্বারা মাতঙ্গিনীর সমস্ত ব্যয় নিৰ্ব্বাহিত হইত। হিন্দু-রমণী ভিন্ন এরূপ কষ্ট আর কোন রমণী সহ্য করিতে পারে, কি না, তাহা জানি না।

মাতঙ্গিনীকে কলিকাতায় রাখিয়া যাইবার কিছু দিবস পরে গোকুলের বৃদ্ধ পিতা পুনরায় কলিকাতায় আগমন করিলেন। যে বাড়ীতে মাতঙ্গিনী বাস করিত, এবার তিনি সেই বাড়ীতেই আসিয়া পাঁচ সাত দিবস অবস্থিতি করিলেন।

মাতঙ্গিনী প্রকাশ্যরূপে কোন কথা না বলিলেও এই পাঁচ সাত দিবস সেই স্থানে অবস্থিতি করিয়া বৃদ্ধ সকল বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিলেন। 

গোকুল তাহার মাতা-পিতাকে কখন কোনরূপ সাহায্য না করিলেও, এবং তাহার স্ত্রীর কখন কোনরূপে সন্ধান না লইলেও, বৃদ্ধের নিকট মাতঙ্গিনী কখনও কোনরূপ কষ্ট পায় নাই। তদ্ব্যতীত সময় সময় দুই একখানি করিয়া অনেকগুলি অলঙ্কারও বৃদ্ধ মাতঙ্গিনীকে প্রদান করিয়াছিলেন। মাতঙ্গিনীকে লইয়া তিনি যে সময় কলিকাতায় আগমন করেন, সেই সময় অলঙ্কারগুলি আপন বাড়ীতেই রাখিয়া আসিয়াছিলেন। এবার বৃদ্ধের কলিকাতায় আগমন করিবার উদ্দেশ্য দুই প্রকার ছিল, প্রথমতঃ মাতঙ্গিনী গোকুলের নিকট কিরূপ আদর যত্ন প্রাপ্ত হইতেছে, কোনরূপে তাহাকে কষ্ট ভোগ করিতে হইতেছে কি না, তাহারই যথাযথ অনুসন্ধান লওয়া, এবং আবশ্যক হইলে মাতঙ্গিনীকে কলিকাতা হইতে সঙ্গে করিয়া বাড়ীতে লইয়া যাওয়া; দ্বিতীয়তঃ মাতঙ্গিনীর অলঙ্কারগুলি মাতঙ্গিনীর হস্তে প্রদান করা। 

যে কার্য্যের নিমিত্ত বৃদ্ধ কলিকাতায় আগমন করিয়াছিলেন, সে কাৰ্য্য অনায়াসেই শেষ করিলেন, অর্থাৎ মাতঙ্গিনীর গহনাগুলি গোকুলের অসাক্ষাতে মাতঙ্গিনীর হস্তে অর্পণ করিলেন, ও সেই সঙ্গে কিছু নগদ টাকা প্রদান করিয়া কহিলেন, “গোকুল যদি তোমার আবশ্যক সমস্ত খরচ প্রদান করিতে অপারক হয়, তাহা হইলে এই অর্থ হইতে তুমি তোমার সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করিও, এবং প্রয়োজন হইলে লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া কাহারও দ্বারা আমাকে পত্র লেখাইও। আমি জানিতে পারিলে তোমার যখন যাহা আবশ্যক হইবে, তখনই তাহা পাঠাইয়া দিব; অর্থাভাবে যেন কোনরূপ কষ্ট সহ্য করিও না। কিন্তু আমার প্রদত্ত অর্থ কোনরূপে তুমি গোকুলকে প্রদান করিও না।” 

বৃদ্ধ আরও কহিলেন, “যখন তুমি বুঝিতে পারিবে যে, গোকুলের হস্তে তোমার সুখ-ভোগের সম্ভাবনা নাই, বা গোকুলের নিমিত্ত তোমাকে আর্থিক বা মানসিক কষ্ট সহা করিতে হইতেছে, তখন পত্র দ্বারাই হউক, বা অপর যে কোন উপায়েই হউক, তুমি আমার নিকট সংবাদ প্রেরণ করিও। সংবাদ পাইবামাত্র আমি এই স্থানে আগমন করিয়া তোমাকে লইয়া যাইব। 

“গোকুলের চরিত্র যাহাতে সংশোধিত হয়, সাধ্যমত তাহারই চেষ্টা করিবে। আমার বিশ্বাস যে, পতিব্রতা স্ত্রী মনে করিলে তাঁহার দুশ্চরিত্র স্বামীর চরিত্র অনায়াসেই পরিবর্ত্তন করিতে সমর্থ হন। স্বামীর যে কার্য্য অপরের দ্বারা কোনরূপে সংশোধিত হইবার সম্ভাবনা নাই, সেই কাৰ্য্য যতই কেন দুরূহ হউক না, সাধ্বী স্ত্রীর দ্বারা তাহা অনায়াসেই সুসম্পন্ন হইয়া থাকে।” 

মাতঙ্গিনীকে এইরূপ উপদেশ দিয়া বৃদ্ধ পুনরায় কলিকাতা পরিত্যাগ করিলেন। 

স্বামীর চরিত্র সংশোধনের নিমিত্ত মাতঙ্গিনী অনেক চেষ্টা করিতে লাগিলেন সত্য, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে সমর্থ হইলেন না। অধিকন্তু গোকুল জানিতে পারিল যে, তাহার বৃদ্ধ পিতা মাতঙ্গিনীর অলঙ্কারগুলি আনিয়া মাতঙ্গিনীর হস্তে অর্পণ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু নগদ অর্থ কিছু দিয়া গিয়াছেন কি না, তাহা প্রথম প্রথম বুঝিতে পারিল না। 

বৃদ্ধ, মাতঙ্গিনীর হস্তে তাহার সমস্ত অলঙ্কার প্রদান করিয়া গিয়াছে, ক্রমে এই কথা বিধু ওরফে রাধামণির কর্ণগোচর হইল। মাতঙ্গিনীর যে কোনরূপ অলঙ্কার আছে, ইতিপূর্ব্বে বিধু তাহা জানিত না। সুতরাং সেই সকল অলঙ্কার দেখিবার নিমিত্ত বিধুর অতিশয় কৌতূহল জন্মিল, এবং সময়মত এক দিবস মাতঙ্গিনীর নিকট আগমন করিয়া তাহার কৌতূহল পরিতৃপ্ত করিয়া গেল। 

মাতঙ্গিনীর অলঙ্কারগুলি দেখিয়া বিধু মনে মনে যে সন্তুষ্ট হইল, তাহা নহে, অধিকন্তু ভয়ানক ঈর্ষা আসিয়া তাহার মন অধিকার করিল। মনে মনে ভাবিল, “যে গোকুলের নিমিত্ত আমি আমার মন প্রাণ সমস্তই অর্পণ করিয়াছি, সেই গোকুল আমাকে প্রতারণা করিয়া মাতঙ্গিনীকে এতগুলি উত্তম উত্তম অলঙ্কার প্রদান করিয়াছে! পুরুষের পক্ষে ইহা অপেক্ষা বিশ্বাস-ঘাতকের কার্য্য আর কি হইতে পারে?” 

বিধু অতিশয় চতুরা স্ত্রীলোক ছিল! মাতঙ্গিনীর গহনাগুলি দেখিয়া তাহার মনে যে ভয়ানক ঈর্ষার উদয় হইয়াছিল, তাহা কিন্তু গোকুলের নিকট কোনরূপে প্রকাশ করিল না। কিন্তু মনে মনে লক্ষ্য রহিল যে, সুযোগ মতে এক এক খানি করিয়াই হউক, বা একবারেই হউক, মাতঙ্গিনীর সমস্ত অলঙ্কার হস্তগত করিতে হইবে। 

এইরূপে আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। গোকুল, মাতঙ্গিনী ও বিধুর সহিত পূর্ব্বরূপ ব্যবহার করিয়াই দিন যাপন করিতে লাগিল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

এক দিবস বিধু গোকুলকে কহিল, “নাথের-বাগানে আমার বিশেষ পরিচিত একটি স্ত্রীলোক আছে। তাহার বাড়ীতে কোনরূপ কার্য্য উপস্থিত হওয়ায় সে আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইয়াছে; সুতরাং আমাকে সেই স্থানে গমন করিতেই হইবে। কিন্তু তোমার হস্তে পড়িয়া আজ পর্য্যন্ত আমি এমন একখানি ভাল অলঙ্কার প্রস্তুত করাইতে সমর্থ হইলাম না যে, তাহা পরিধান করিয়া এক দিবসের নিমিত্তও লোকালয়ে গমন করিতে পারি। সামান্য দুই একখানি যাহা আছে, তাহারই দ্বারা এ পর্যন্ত একরূপ কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছিলাম, কিন্তু বালা জোড়াটি এরূপ হইয়া গিয়াছে যে, তাহা পরিয়া কোন প্রকারেই কোন ভদ্র স্থানে গমন করিতে পারা যায় না। তুমি যে আফিসে কার্য্য কর, সেই আফিসের অনেক বাবু নিশ্চয়ই আপনাপন স্ত্রীকে বা ভালবাসার পাত্রীকে যে উত্তম উত্তম অলঙ্কার সকল প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাঁহাদিগের কাহারও নিকট হইতে অন্ততঃ এক দিবসের নিমিত্ত যদি এক জোড়া সোনার ভাল বালা আনিয়া আমাকে অর্পণ কর, তাহা হইলে আমি উহা পরিধান করিয়া অনায়াসেই নিমন্ত্রণে গমন করিতে পারি। নিমন্ত্রণ স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিবার পর, অনায়াসেই তুমি উহা প্রত্যর্পণ করিয়া আসিতে পারিবে। এইরূপ উপায় অবলম্বন করিলে, কাহারও কোনরূপ ক্ষতি হইবে না, অথচ অনায়াসেই আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া আসিতে পারিব। 

“তোমার স্ত্রী মাতঙ্গিনীর যে বালা আছে, তাহা আমি দেখিয়াছি। তোমার বন্ধু-বান্ধবগণের নিকট হইতে কোনরূপ উৎকৃষ্ট বালা সংগ্রহ করিতে যদি নিতান্তই অপারক হও, তাহা হইলে অভাব পক্ষে তোমার স্ত্রীর বালার সদৃশ এক জোড়া বালা কোনরূপে সংগ্রহ করিয়া আনিতে পারিলেও আমার কার্য্য একরূপ নির্ব্বাহ হইতে পারিবে।” 

বিধুর কথা শুনিয়া গোকুল মনে করিল যে, নিমন্ত্রণে যাইবার নিমিত্ত প্রকৃতই তাহার এক জোড়া বালার আবশ্যক হইয়াছে। আরও ভাবিল যে, অপরের নিকট যাচ্‌ঞা না করিয়া, মাতঙ্গিনীর বালা জোড়াটি আনিয়া দুই এক দিবসের নিমিত্ত বিধুকে অর্পণ করিলে ক্ষতি কি? 

বিধু যাহা বলিল, সরলান্তঃকরণে গোকুল তাহা বুঝিয়া গেল। বিধুর আন্তরিক ইচ্ছা যে, যাহাতে গোকুল মাতঙ্গিনীর বালা জোড়াটি আনিয়া তাহার হস্তে প্রদান করে। কিন্তু গোকুল তাহার দুরভিসন্ধির কথা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। 

গোকুল মনে যাহা ভাবিল, কার্য্যেও তাহাই করিল। আপনার বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতি কাহারও নিকট বালার নিমিত্ত গমন না করিয়া একবারে আপনার পত্নী মাতঙ্গিনীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। বিধুর নাম শ্রবণ করিলে পাছে মাতঙ্গিনী বালা দিতে অস্বীকার করে, এই ভয়ে প্রকৃত কথা গোপন করিয়া গোকুল তাহার পত্নীর নিকট মিথ্যা কথা কহিল। কহিল, “আমার আফিসের জনৈক বাবুর স্ত্রী নিমন্ত্রণ উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিবেন, কিন্তু তাঁহার পরিধানোপযোগী কোনরূপ ভাল অলঙ্কার না থাকায়, তিনি দুই এক দিবসের নিমিত্ত তোমার বালা জোড়াটি চাহিয়া পাঠাইয়াছেন। এই বন্ধুর নিকট হইতে অনেক সময় আমি অনেকরূপ উপকার প্রাপ্ত হইয়া থাকি, সুতরাং তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করা আমার একান্ত কৰ্ত্তব্য কাৰ্য্য।” 

হিন্দু-রমণী মাতঙ্গিনী স্বামীর এইরূপ প্রস্তাবিত বিষয়ের কোনরূপ বিপরীতাচরণ করিতে পারিল ন; তৎক্ষণাৎ বালা জোড়াটি বাহির করিয়া স্বামীর হস্তে অর্পণ করিল। গোকুল হৃষ্টান্তঃকরণে বালা জোড়াটি লইয়া বাড়ী হইতে প্রস্থান করিল এবং দ্রুতগতি বিধুর নিকট গমন করিয়া বালা জোড়াটি তাহার হস্তে অর্পণ করিল। 

কোন স্ত্রীলোকের বাড়ীতে বিধুকে নিমন্ত্রণে গমন করিতে হইবে, এইরূপ কথা বলিয়া বিধু গোকুলকে বালা আনিবার নিমিত্ত যে অনুরোধ করিয়াছিল পাঠকগণ শুনিয়া বিস্মিত হইবেন, সেইরূপ অনুরোধের কোন মূলই ছিল না। নিমন্ত্রণে যাওয়ার কথা সম্পূর্ণ রূপ মিথ্যা! 

গোকুলের নিকট হইতে বালা গ্রহণ করিয়া বিধু উহা আপনার হস্তে পরিধান করিল ও নিমন্ত্রণে যাইবার ভান করিয়া একখানি পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান পূর্ব্বক বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। কিন্তু নাথের বাগানে গমন করিবার পরিবর্তে কিয়ৎক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরিয়া তিন চারি ঘণ্টার মধ্যে আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিল। সে দিবস বালা জোড়াটি বিধুর নিকটেই রহিয়া গেল; কিন্তু পর দিবস প্রত্যূষে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই বিধু, মাতঙ্গিনীকে প্রত্যর্পণ করিবার নিমিত্ত সেই বালা জোড়াটি গোকুলের হস্তে অর্পণ করিল। উহা যে মাতঙ্গিনীর বালা, বিধু পূর্ব্বেই তাহা অবগত হইতে পারিয়াছিল। কিন্তু কোনরূপ দূরভিসন্ধি সাধনের বাসনায়, যত শীঘ্র পারিল, বিধু উহা প্ৰত্যপণ করিল। গোকুল সেই বালা জোড়াটি লইয়া আপনার স্ত্রীকে অর্পণ করিল। 

গোকুল মিথ্যা ছল অবলম্বন করিয়া মাতঙ্গিনীর বালা জোড়াটি চাহিয়া লইয়া গিয়া তাহার কোন বন্ধুর স্ত্রীর পরিবর্তে বিধুকে যে অর্পণ করিয়াছিল, ক্রমে মাতঙ্গিনী তাহা জানিতে পারিল। এই ঘটনার কয়েক দিবস পরে বিধু কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া মাতঙ্গিনীর নিকট আগমন করে ও কথায় কথায় সেই বালার কথা মাতঙ্গিনীকে বলিয়া যায়। স্বামীর চাতুরীর বিষয় প্রকাশ হইয়া পড়িলেও মাতঙ্গিনী গোকুলকে কোন কথা কহিল না। 

এই ঘটনার দশ-বার দিবস পরেই পুনরায় নিমন্ত্রণে যাইবার ভান করিয়া বিধু গোকুলের নিকট দুই তিন খানি অলঙ্কার যাচ্‌ঞা করিল, এবং কহিল, “এ সমস্ত গহনাই তোমার পত্নী মাতঙ্গিনীর আছে। সুতরাং তাহার নিকট হইতে দুই এক দিবসের নিমিত্ত অনায়াসেই তুমি আনয়ন করিতে পারিবে।” 

বিধুর কোন কথার প্রতিবাদ করিবার ক্ষমতা গোকুলের ছিল না, সুতরাং যেরূপে হউক, মাতঙ্গিনীর নিকট হইতে অলঙ্কার কয়েক খানি আনয়ন করিয়া বিধুর হস্তে অর্পণ করিবে, এই প্রতিজ্ঞা করিল। 

সময় মত গোকুল মাতঙ্গিনীর নিকট গমন করিয়া তাহার মনের ভাব মাতঙ্গিনীকে কহিল। গোকুলের কথা শুনিয়া মাতঙ্গিনী অন্তরে একান্ত কষ্ট অনুভব করিল, ও কহিল, “আপনার পিতাই আমাকে এই অলঙ্কারগুলি প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন, সুতরাং আপনার ইচ্ছা হইলে আপনি ইহার সমস্তই গ্রহণ করিতে পারেন। বিশেষতঃ হিন্দু-রমণীর পক্ষে স্বামীকে অদেয় কোন দ্রব্যই নাই। কিন্তু যে অলঙ্কারগুলি আবশ্যক হইলে সময় সময় আমাকে পরিধান করিতে হয়, সেই অলঙ্কারগুলি বেশ্যার অঙ্গে উঠিলে, ইহা অপেক্ষা দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছুই নাই। আপনি যখন আমার কয়েক খানি অলঙ্কার বিধুকে দুই এক দিবসের নিমিত্ত অর্পণ করিতে চাহিয়াছেন, তখন আমি কোনরূপেই আপনার মতের বিরুদ্ধাচরণ করিতে চাহি না। কিন্তু আপনার নিকট বিনীতভাবে আমার এই নিবেদন যে, ভবিষ্যতে এরূপ প্রতিজ্ঞায় আপনি যেন আর কখনও আবদ্ধ না হন। কারণ, এইরূপে আমার অলঙ্কারগুলি লইয়া গিয়া বিধু যে পরিধান করিবে, তাহা আমি কোনরূপে দেখিতে পারিব না।” এই বলিয়া যে কয়েকখানি অলঙ্কার গোকুল চাহিয়াছিলেন, মাতঙ্গিনী আপনার বাক্স হইতে তাহা বাহির করিয়া স্বামীর হস্তে অর্পণ করিলেন। গহনাগুলি প্রাপ্ত হইয়া গোকুল হাসিতে হাসিতে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল, ও যথা সময়ে বিধুর নিকট উপস্থিত হইয়া অলঙ্কারগুলি তাহার হস্তে প্রদান করিল। বলা বাহুল্য, পূর্ব্বের ন্যায় গহনাগুলি পরিধান করিয়া নিমন্ত্রণে যাইবার ভান করিয়া বিধু বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল, এবং সন্ধ্যার পর বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিয়া, অলঙ্কারগুলি মাতঙ্গিনীকে প্রত্যর্পণ করিবার নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ গোকুলের হস্তে অর্পণ করিল। বিধুর ব্যবহার দেখিয়া গোকুল মনে মনে বিশেষরূপ সন্তুষ্ট হইল। সেই রাত্রিকালে গহনাগুলি না লইয়া গিয়া পরিসি প্রাতঃকালে উহা বাড়ীতে লইয়া গেল, এবং আপনার স্ত্রীর হস্তে প্রদান করিল। গহনা কয়েকখানি লইয়া মাতঙ্গিনী আপনার বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

এই ঘটনার পর আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। প্রায় এক মাস পরে এক দিবস বিধু গোকুলকে কহিল, “কল্য আমাকে একবার সোনাগাছিতে গমন করিতে হইবে, এবার দুই একখানি অলঙ্কারের কার্য্য নহে; তোমার স্ত্রীর সমস্ত গহনা এবার আমাকে আনিয়া দিতে হইবে।” 

বিধুর কথা শুনিয়া গোকুল কহিল, “যদি আমার স্ত্রী তাহার সমস্ত অলঙ্কারগুলি আমাকে না দেয়, তাহা হইলে আমি কি প্রকারে আনয়ন করিব? সে ইচ্ছা করিয়া যদি আমার হাতে তাহার সমস্ত অলঙ্কারগুলি প্রদান না করে, তাহা হইলে আমি কি করিতে পারি? কারণ, তুমি বিশেষরূপ অবগত আছ যে, তাহার অলঙ্কারগুলির মধ্যে একখানিও আমার প্রদত্ত নহে।” 

গোকুলের কথার উত্তরে বিধু কহিল, “গহনাগুলি যদি তোমার প্রদত্ত নহে, তাহা হইলে তোমার স্ত্রী এতগুলি অলঙ্কার কোথায় পাইল? তোমার ওসকল কথা আমি শুনিতে চাহি না। যেরূপে পার, অভাবপক্ষে এক দিবসের নিমিত্তও অলঙ্কারগুলি আমাকে আনিয়া দিতেই হইবে। এক দিবসের নিমিত্ত উহা আমার হস্তে পড়িলে, আমি কি উহা খাইয়া ফেলিব? ইতিপূর্ব্বেও ত দুইবার আমাকে তোমার স্ত্রীর অলঙ্কার আনিয়া দিয়াছ, তাহাতে আমি তোমার কিছু লোকসান করিয়াছি, বলিতে পার? একশেট অলঙ্কার যে তুমি আমাকে প্রস্তুত করিয়া দিবে, সে ক্ষমতা তোমার নাই। থাকিলেও দিবে না, বা আমাকেও কোনরূপে তুমি পরিত্যাগ করিবে না। তাহা হইলে আমি অপর চেষ্টা-চরিত্র করিয়া দুই একখানি অলঙ্কারের যোগাড় করিতে পারি। অনেক কষ্টে যে গহনাগুলি প্রস্তুত করাইয়াছিলাম, তাহা এখন পুরাতন হইয়া গিয়াছে। উহা পরিধান করিয়া এখন আর কোনরূপে ভদ্রস্থানে গমন করিতে পারা যায় না বলিয়াই তোমায় তোষামোদ করিতেছি। আগে যদি জানিতে পারিতাম যে, তুমি সামান্য অলঙ্কারের নিমিত্ত আমার সহিত এইরূপ ব্যবহার করিবে, তাহা হইলে আমি কখনই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া সেই স্থানে যাইতে স্বীকৃত হইতাম না।” 

বিধুর কথা শুনিয়া গোকুল আর কোন কথা কহিতে পারিল না; কেবলমাত্র বলিল, “আচ্ছা আমি মাতঙ্গিনীর নিকট গমন করিতেছি। যদি কোনরূপে তাহার নিকট হইতে অলঙ্কারগুলি আনিতে পারি, তাহার চেষ্টা করিব।” এই বলিয়া গোকুল মাতঙ্গিনীর নিকট গমন করিল, এবং তাহার নিকট আপনার মনের ভাব প্রকাশ করিল। গোকুলের কথা শুনিয়া মাতঙ্গিনী কহিল, “তাহা কিরূপে হইতে পারিবে? একথা পূৰ্ব্বেই আমি আপনাকে বলিয়াছি, আমার অলঙ্কার আমি কোন বার-বনিতাকে পরিতে দিব না।” 

গোকুল। বিধু যদিও চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক, কিন্তু তাহাকে কোনরূপে বার-বনিতা বলা যাইতে পারে না। অতি অল্প বয়সে সে বিধবা হইয়াছে ও এত দিবস কেবলমাত্র আমার সহিতই সে কালযাপন করিয়া আসিতেছে। এরূপ অবস্থায় তাহাকে চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক বলিতে চাহ বল, কিন্তু কোন প্রকারেই তাহাকে বার-বনিতা বলিতে পার না। আমার বোধ হয় যে, তোমার অলঙ্কার সে অনায়াসেই পরিধান করিতে পারে। 

মাতঙ্গিনী। এতদিবস পর্য্যন্ত আপনি যাহা করিয়াছেন, আমি কোনরূপে তাহার প্রতিবন্ধকতাচরণ করি নাই, বা আমাকে যাহা বলিয়াছেন, অবনত মস্তকে তখনই আমি তাহা প্রতিপালন করিয়াছি। স্বামীর আদেশ লঙ্ঘন করা হিন্দু—রমণীর পক্ষে মহাপাপ, তাহা আমি অবগত আছি। কিন্তু আপনি একবার মনে ভাবুন দেখি যে, এক ব্যক্তির দুইটি স্ত্রী হইলে সেই স্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে কোন প্রকারে সদ্ভাব থাকিতে পারে, কি না, বা এক জনের অলঙ্কারাদি অপরে ব্যবহার করিলে, সে তাহা সহ্য করিতে পারে, কি না। যদি স্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে এইরূপ হইয়া থাকে, তাহা হইলে স্ত্রী ও উপপত্নীর মধ্যে আরও কিরূপ বিসদৃশ ভাব হইবার সম্ভাবনা, তাহা আপনি অনায়াসেই বিবেচনা করিতে পারেন। চিরদিবস অবনত মস্তকে আপনার আদেশ আমি প্রতিপালন করিয়া আসিতেছি, এবং যত দিবস বাঁচিব, তত দিবসই প্রতিপালন করিব। কিন্তু আপনার বর্তমান আদেশ প্রতিপালনে সম্মত হইয়া মহাপাপে নিমজ্জিত হইলেও, আমার অলঙ্কারগুলি যে আমার সম্মুখে এক জন বার-বনিতা পরিধান করিবে, তাহা আমি দেখিতে পারিব না। 

গোকুল তুমি যদি আমার আদেশ প্রতিপালন না কর, বা অলঙ্কারগুলি অভাবপক্ষে এক দিবসের নিমিত্তও আমার হস্তে অর্পণ না কর, তাহা হইলে তোমার সমস্ত অলঙ্কার কাড়িয়া লইয়া কলিকাতা হইতে তোমাকে দূর করিয়া দিব। 

মাতঙ্গিনী। আপনি স্বামী, আমি স্ত্রী; আপনি স্বাধীন, আমি পরাধীন। আমাকে দূর করিয়া দেওয়া আপনার পক্ষে নিতান্ত সামান্য কাৰ্য্য। আপনি আমাকে দূর করিয়া দিবেন, আমাকে পরিত্যাগ করিবেন, কিন্তু আমি আপনাকে পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমি যেস্থানে থাকিব, আমার হৃদয় হইতে আপনাকে দূর করিতে পারিব না। কোন হিন্দু-রমণী তাহার স্বামীকে তাহার হৃদয় হইতে দূর করিতে পারে, একথা আপনি কখনও শুনিয়াছেন কি? 

গোকুল। আমার কথা না শুনিলে, তোমার অদৃষ্টে বিস্তর দুঃখ আছে, ইহা তুমি জান কি? 

মাতঙ্গিনী। স্বামীর কথা না শুনিলে স্ত্রীলোক মাত্রকেই বিশেষরূপ দুঃখ ও কষ্ট ভোগ করিতে হয়, তাহা আমি বিশেষরূপে অবগত আছি। তথাপি আপনার বর্তমান প্রস্তাবে আমি কোনরূপেই সম্মত হইতে পারিব না। পূৰ্ব্বে না জানিয়া একবার আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছিলাম, তাহার পর জানিয়াও একবার আপনার কথার অন্যথাচরণ করি নাই। কিন্তু সেই সময়েই আমি আপনাকে বলিয়াছিলাম যে, এরূপ কার্য্য পুনরায় আমা হইতে আর হইবে না।

গোকুল। আমি তোমার ওসকল কথা শুনিতে চাহি না। এখন তুমি তোমার অলঙ্কারগুলি এক দিবসের নিমিত্ত আমার হস্তে প্রদান করিবে, কি না? 

মাতঙ্গিনী। আমি পূর্ব্বেই একথা আপনাকে বলিয়াছি। আপনার এ অনুরোধ আমি কোন প্রকারেই রক্ষা করিতে পারিব না। 

গোকুল। তুমি ভাল চাহ ত, এখনও আমার প্রস্তাবে সম্মত হও; নতুবা এই পদাঘাতে এখনই আমি তোমাকে উত্তমরূপ শিক্ষা প্রদান করিব, এবং তোমার সমস্ত অলঙ্কার লইয়া গিয়া সমস্তই বিধুকে একবারে অর্পণ করিব। 

মাতঙ্গিনী। অলঙ্কার আমার নহে। আপনার এই সামান্য অলঙ্কারের নিমিত্ত আমাকে পদাঘাত করিতে হইবে কেন? করিলেই বা তাহাতে আমার অপমান কি? স্বামীর পদাঘাতে কোন্ স্ত্রী অপমান বোধ করে? আমার অনিচ্ছা সত্বেও আমার অলঙ্কারগুলি লইবার নিমিত্ত যদি আপনার বাসনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে যে বাক্সের ভিতর উহা রক্ষিত আছে, আপনি অনায়াসেই উহা গ্রহণ করিয়া আপনার ইচ্ছামত কার্য্য করিতে পারেন। এই নিন্ চাবি। 

এই বলিয়া মাতঙ্গিনী তাঁহার বাক্সের চাবি গোকুলের সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন। গোকুল আর কোনরূপ বাক্যব্যয় না করিয়া সেই চাবি দ্বারা মাতঙ্গিনীর বাক্স খুলিয়া তাহার সমস্ত অলঙ্কার গ্রহণ পূর্ব্বক হাসিতে হাসিতে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। বলা বাহুল্য, গোকুল অলঙ্কারগুলি লইয়া বিধুর বাড়ীতে গমন করিল। 

গহনাগুলি প্রাপ্ত হইয়া বিধু বিশেষরূপ আনন্দিত হইল, এবং পূর্ব্বের অপেক্ষা গোকুল সেই দিবস বিধুর নিকট বিশেষরূপ আদর প্রাপ্ত হইল। গহনা প্রাপ্ত হইবামাত্র বিধু সেই গহনা পরিধান পূর্ব্বক যেমন নিমন্ত্রণের ভান করিয়া তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া যাইত, আজ কিন্তু আর সেরূপ গমন করিল না; গোকুলের হস্ত হইতে অলঙ্কারগুলি গ্রহণ করিয়াই আপনার বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া দিল। পর দিবসও বিধু নিমন্ত্রণে গমন করিল না, বা পূর্ব্বের ন্যায় গহনাগুলি প্রত্যর্পণ করিবার নিমিত্ত গোকুলের হস্তে প্রদানও করিল না। এইরূপে ক্রমে সময় অতিবাহিত হইতে লাগিল। এক দিবস দুই দিবস করিয়া ক্রমে ক্রমে সাত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু বিধু মাতঙ্গিনীর অলঙ্কারগুলি প্রত্যর্পণ করিবার কথা মুখেও আনিল না। গোকুলও বিধুকে কোন কথা বলিতে সাহসী হইল না। 

মধ্যাহ্নকালে আহারার্থে গোকুল গমন করিলে এক দিবস মাতঙ্গিনী কথায় কথায় আপনার অলঙ্কারের কথা তুলিল। কিন্তু গোকুলের সে কথা ভাল লাগিল না, অধিকন্তু মাতঙ্গিনীকে কতকগুলি দুৰ্ব্বাক্য বলিয়া গোকুল বাসা পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল, তোমার গহনা যত দিবস না আনিতে পারিব, তত দিবস আর এবাটীতে পদার্পণ করিব না। 

সন্ধ্যার সময় নিয়মিতরূপে গোকুল বিধুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইল, ও কথায় কথায় একবার গহনার প্রসঙ্গ ও পাড়িল, গোকুলের কথা শুনিয়া বিধু কহিল, “কিসের গহনা? যে গহনা তুমি আমাকে অর্পণ করিয়াছ, পুনরায় সেই গহনা চাহিতে তোমার লজ্জা করিতেছে না। চিরকাল ধরিয়া দাস্যবৃত্তি করিলাম, কিন্তু কখনও কিছু প্রদান করিলে না। এখন যদি দুইখানি অলঙ্কার কোন গতিতে আসিয়া আমার হস্তে পতিত হইয়াছে, তাহাও আবার ফেরত লইতে চাও! কি লজ্জার কথা!” 

বিধুর কথা শুনিয়া প্রথমে গোকুল মনে করিল যে, বিধু তাহার সহিত রহস্য করিতেছে; কিন্তু পরিশেষে যখন জানতে পারিল যে, বিধু প্রকৃতই অলঙ্কারগুলি প্রত্যর্পণ করিবে না, তখন তাহার মনে একটু আন্তরিক কষ্ট হইল। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ্যে তাহাকে কোন কথা বলিতে সাহসী হইল না, অথচ বিষম লজ্জার জন্য পুনরায় মাতঙ্গিনীর নিকটেও গমন করিতে পারিল না। এখন রাত্রিদিন বিধুর বাড়ীতেই তাহাকে অবস্থিতি করিতে হইল। 

রাত্রিদিন বিধুর বাড়ীতে অবস্থিতি করায়, নানাকারণে বিধুর অসুবিধা হইতে লাগিল। সুতরাং যাহাতে গোকুল রাত্রিদিন তাহার বাটীতে না থাকে, তাহার নিমিত্ত বিধুকে কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিতে হইল। কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া দুই একদিন বিধু গোকুলের নিকট আপনার মনের ভাব কহিল; কিন্তু বিধুর মনের ভাব ঠিক বুঝিতে না পারিয়াই হউক, অথবা ইচ্ছা করিয়াই হউক, গোকুল তাহাতে কর্ণপাতও করিল না। তখন অনন্যোপায় হইয়া বিধু সামান্য সামান্য কথা অবলম্বন করিয়া গোকুলের সহিত কলহ করিতে প্রবৃত্ত হইল, এবং সময় সময় অকথ্যরূপে গোকুলকে গালাগালি প্রদান করিতে লাগিল। কিন্তু তাহাতেও গোকুল কোনরূপ বিরক্তি-ভাব প্রকাশ করিল না, বা বিধুর বাড়ীও পরিত্যাগ করিল না। 

মাতঙ্গিনীর গহনাগুলির অবস্থা যাহা হইল, তাহা পাঠকগণ দেখিলেন। অধিকন্তু মাতঙ্গিনীর খোরাকীর টাকা বন্ধ হইল। দিবাভাগে আহার করিবার নিমিত্ত গোকুল আর বাসায় যায় না। সুতরাং মাতঙ্গিনীর খরচার টাকাও বিধু আর প্রদান করে না। মাতঙ্গিনীর বৃদ্ধ শ্বশুর তাহাকে যে সামান্য অর্থ প্রদান করিয়া গিয়াছিলেন, তাহার দ্বারাই মাতঙ্গিনী ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। স্বামীর জ্বালায় এইরূপ জ্বালাতন হইয়াও মাতঙ্গিনী তাঁহার শ্বশুরের নিকট বা তাঁহার ভ্রাতার নিকট কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিলেন না, মনের কষ্ট মনেই নিবারণ করিয়া কোনরূপে দিন যাপন করিতে লাগিলেন। কিন্তু এবার মনে করিল যে, তিনি কোনরূপেই আর কলিকাতায় থাকিবেন না; তাঁহার বৃদ্ধ শ্বশুর এইবার কলিকাতায় আগমন করিলে তাঁহার সহিত তিনি তাঁহার বাড়ীতে গমন করিবেন। কারণ, স্বামীর এইরূপ ব্যবহার চক্ষুর উপর দেখিয়া, কোন রমণী অনায়াসে তাহা সহ্য করিতে পারে? 

এইরূপ আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। গোকুল লজ্জার খাতিরে হউক, বা বিধুর নিমিত্তই হউক, অথবা ইচ্ছা করিয়াই হউক, মাতঙ্গিনীর সহিত দেখা করিল না, বা তাহার কোনরূপ সংবাদও গ্রহণ করিল না। এই সময় মনিবের কার্য্যের নিমিত্ত তাহাকে এক মাসের নিমিত্ত সহর পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিতে হইল। যাহাতে সহর পরিত্যাগ করিতে না হয়, তাহার নিমিত্ত গোকুল আফিসে গিয়া অনেক চেষ্টা করিল। কিন্তু কোনরূপেই কৃতকাৰ্য্য হইতে না পারিয়া সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্বেও বিধুর অনুমতি লইয়া এক মাসের নিমিত্ত তাহাকে সহর পরিত্যাগ করিতে হইল। সহর পরিত্যাগ করিবার ইচ্ছা গোকুলের না থাকিলেও, প্রথমতঃ আফিসের আদেশ কোন প্রকারেই বন্ধ হইল না, দ্বিতীয়তঃ, বাহিরে গমন করিবার নিমিত্ত বিধু বিশেষরূপ পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল, কাজেই অনন্যোপায় হইয়া ও মাতঙ্গিনীকে কিছু না বলিয়াই গোকুল সহর পরিত্যাগ করিল। 

কয়েক দিবস পর্য্যন্ত একবারও স্বামীর সংবাদ না পাইয়া মাতঙ্গিনী একবারে অস্থির হইয়া পড়িলেন, এবং যে স্বামীর মুখ দেখিলেও পাপ হয়, সেই স্বামীর সংবাদ পাইবার নিমিত্ত বাসার একটি স্ত্রীলোককে বিধুর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন। যখন জানিতে পারিলেন যে, মনিবের কার্য্যের নিমিত্ত কিছু দিবসের জন্য তিনি সহর পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন তিনি প্রকৃতিস্থ হইলেন। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যে দিবস বিধু ওরফে রাধামণির মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া যায়, যে দিবস হইতে পুলিশ-কৰ্ম্মচারীগণ এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে লিপ্ত হন, তাহার প্রায় এক সপ্তাহ পূর্ব্বে মনিবের কার্য্যোপলক্ষে গোকুল সহর পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিয়াছে। 

বিধুর প্রণয়ে গোকুল বিশেষরূপ মুগ্ধ। তাহার নিমিত্ত গোকুল আপনার উপার্জ্জন-লব্ধ সমস্ত অর্থই ব্যয় করিয়া থাকে, তাহার নিমিত্ত সে আপনার পরিণীতা ভার্য্যার অলঙ্কারগুলি পর্য্যন্ত অপহরণ করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই, এবং তাহার প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া সে আপন বনিতাকে পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছে। এমন গোকুলের দ্বারা বিধু যে হত হইবে, তাহাই বা সহজে কিরূপে অনুমান করা যাইতে পারে? বিশেষতঃ গোকুল কলিকাতায় নাই। হত্যার সময় সে যদি কলিকাতায় থাকিত, তাহা হইলেও তাহাকে লইয়া অনুসন্ধান চলিতে পারিত; কিন্তু এরূপ অবস্থায় গোকুলের উপর কিরূপে সন্দেহ করা যাইতে পারে? 

অনুসন্ধানে নিযুক্ত কর্মচারীগণের মনে এইরূপ নানা প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল; তথাপি গোকুলের সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করা একবারে অযুক্তিযুক্ত নহে, ইহাও কিন্তু সকলে বলিলেন। 

সকলের পরামর্শ-মত গোকুল সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা যখন স্থির হইয়া গেল, তখন আমি অপর আর একজন কর্মচারীকে সঙ্গে লইয়া, যে বাড়ীতে মাতঙ্গিনী বাস করিতেন, সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

মাতঙ্গিনী আমাদিগের সম্মুখে বাহির হইলেন না, কিন্তু সেই বাড়ীর ও তাহার নিকটবর্তী অপরাপর স্ত্রীলোক এবং পুরুষগণের নিকট হইতে যাহা কিছু অবগত হইতে পারিলাম, তাহা পূৰ্ব্বেই পাঠকগণকে নিবেদন করিয়াছি। কিরূপে মাতঙ্গিনী প্রথম কলিকাতায় আগমন করেন, কলিকাতায় আসিয়া আপন স্বামী গোকুলের নিকট তিনি কিরূপ ব্যবহার প্রাপ্ত হন, কিরূপে গোকুল তাঁহার অলঙ্কারগুলি তাঁহার অনিচ্ছা সত্বে লইয়া গিয়া বিধুর হস্তে অর্পণ করে, তাহাও পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইতে পারিয়াছেন, এবং সেই গহনা উপলক্ষে কিরূপে গোকুল মাতঙ্গিনীর সহিত দেখা—সাক্ষাৎ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া ও পরিশেষে মাতঙ্গিনীর নিমিত্ত কোনরূপ বন্দোবস্ত না করিয়া বা তাঁহাকে কিছুমাত্র না বলিয়া, কিরূপে সহর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহাও পাঠকগণের জানিতে বাকী নাই। 

আমরা এই সকল ঘটনা জানিতে পারিলাম বটে, কিন্তু তখন যে গোকুল কোথায়, তাহা সেই স্থানের কেহই আমাদিগকে বলিতে পারিল না। অথচ অনেকেই কহিল যে, মাতঙ্গিনীর অলঙ্কার লইয়া গোলযোগের কয়েক দিবস পর হইতে সেইস্থানের কেহই গোকুলকে আর দর্শন করে নাই। 

এই সকল ব্যাপার অবগত হইয়া আমরা মনে মনে স্থির করিলাম,—গোকুল যে আফিসে কার্য্য করে, সেই আফিসে গমন করাই কর্তব্য। কারণ, আফিসের কার্য্যোপলক্ষে গোকুল যে স্থানে গমন করিয়াছে, তাহা আফিসের লোক ভিন্ন আর যে কেহ বলিতে পারিবে, তাহা বোধ হয় না। আর যদি বিধু বাঁচিয়া থাকিত, তাহা হইলে সে বলিতে পারিত! মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিয়া গোকুলের আফিসে যাইবার মানসে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমরা গোকুলকে পূৰ্ব্বে কখনও দেখি নাই, সুতরাং কোন স্থানে তাহাকে দেখিলেও হঠাৎ চিনিতে পারিব না, এই বিবেচনায় গোকুলের পূর্ব্ব-পরিচিত জনৈক বিধুর প্রতিবাসীকে আমার সঙ্গে লইয়া মাতঙ্গিনীর বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম। 

মাতঙ্গিনীর বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া কিয়দ্দূর আসিবার পরই দেখিতে পাইলাম যে, একটি লোক দ্রুত পদবিক্ষেপে আমাদিগের দিকে আগমন করিতেছে। দূর হইতে তাহাকে দেখিতে পাইয়া, আমাদিগের সমভিব্যাহারী গোকুলের সেই পরিচিত লোকটি কহিল, “ঐ যে লোকটি আমাদিগের দিকে আগমন করিতেছে, উহার চলনের ভাব দেখিয়া উহাকে গোকুল বলিয়া অনুমান হইতেছে।” 

আমাদিগের সমভিব্যাহারীর এই কথা শুনিয়া আমরা আর অগ্রবর্তী হইলাম না, সেই স্থানেই সকলে স্থিরভাবে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইলাম। দেখিতে দেখিতে সেই লোকটি ক্রমে আমাদিগের নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল। সেই সময় আমাদিগের সমভিব্যাহারী ব্যক্তি কহিল, “মহাশয়! আমার অনুমান সত্য, ঐ ব্যক্তিই সেই গোকুল। 

ক্রমে গোকুল আসিয়া আমাদিগের সমীপবর্তী হইয়া পড়িল। সেই সময় আমি গোকুলকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, “গোকুল! এই দিকে আইস। তোমার নিকট আমাদিগের সবিশেষ কার্য্য আছে।” আমার কথা শুনিয়া গোকুল আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। 

গোকুল এক মাসের নিমিত্ত কার্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছে, অথচ সেই এক মাস এখন অতীত হইয়া যায় নাই, এরূপ অবস্থায় কিরূপে গোকুল আসিয়া হঠাৎ এইস্থানে উপস্থিত হইল? তবে কি এই হত্যাকাণ্ড গোকুলের দ্বারা সমাহিত হইল? 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া গোকুলকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “শুনিয়াছি যে, সহর পরিত্যাগ করিয়া তুমি কাৰ্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলে। সেই স্থান হইতে তুমি কোন্ তারিখে প্রত্যাগমন করিয়াছ? 

আমার এই প্রশ্নের উত্তর গোকুল হঠাৎ প্রদান করিতে পারিল না। অনেক ভাবিয়া সে আমার কথার উত্তর প্রদান করিল। কিন্তু তাহাকে দেখিয়া আমাদিগের মনে সহজেই অনুমান হইল যে, ইহার মন গাঢ় চিন্তায় আচ্ছন্ন, ইহার মস্তিষ্ক যেন কোনরূপ বিষম ভাবনার আন্দোলনে আলোড়িত। চক্ষু ঈযৎ রক্তবর্ণ—দৃষ্টি স্থির নহে। এইরূপ অবস্থায় গোকুল কহিল, “স্থানান্তর হইতে আমি অদ্যই প্রত্যাগমন করিয়াছি।” 

আমি। তুমি এক মাসের নিমিত্ত গমন করিয়াছিলে, কিন্তু এখনও এক মাস অতীত হয় নাই, ইহার মধ্যেই তুমি প্রত্যাগমন করিলে যে? 

গোকুল। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি গমন করিয়াছিলাম, এই কয় দিবসের মধ্যে সেই কাৰ্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে, সুতরাং আমি প্রত্যাগমন করিয়াছি। 

আমি। তুমি কলিকাতায় কখন আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ? 

গোকুল। এই আসিতেছি, এখনও বাড়ী যাই নাই। আপনারা ডাকিলেন বলিয়া, এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।

আমি। আমরা তোমাকে কেন ডাকিলাম বলিতে পার? 

গোকুল। না মহাশয়! তাহা আমি জানি না। আপনারা সরকারী কর্ম্মচারী, আমাকে কেন ডাকিলেন, তাহা আমি কি প্রকারে বলিব? 

আমি। আমরা সরকারী কর্মচারী, তাহা তোমাকে কে বলিল? সরকারী কর্মচারীর কোনরূপ চিহ্ন আমাদিগের নিকট দেখিতে পাইয়াছ কি? 

গোকুল। না। 

আমি। তবে তোমাকে কে কহিল যে, আমরা সরকারী কর্মচারী? 

গোকুল। কেহ বলে নাই, আমি আপনাদিগকে চিনি। 

আমি। সে কথা যাউক, তুমি কখন আসিলে ঠিক করিয়া বল দেখি? 

গোকুল। পূৰ্ব্বেই তাহা আমি আপনাকে বলিয়াছি। আমি এখনই আসিতেছি। 

আমি। তোমার পরিহিত এই বস্ত্র ভিন্ন অপর বস্ত্রাদি কিছুই তোমার নিকট নাই। এরূপ অবস্থায় তুমি কিরূপে এখনই আগমন করিতেছ? 

গোকুল। অপর কোন বস্ত্রাদি আমার সহিত ছিল না, আমি এক বস্ত্রেই গমন করিয়াছিলাম। 

আমি। তুমি একবারেই এই স্থানে আগমন করিতেছ, কি বস্ত্রাদি বিধুর বাড়ীতে রাখিয়া আসিয়াছ? 

গোকুল। বিধু? বিধু কে? 

আমি। তুমি বিধুকে চিনিতে পারিলে না? 

গোকুল। না মহাশয়! ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

আমি। দেশে যাহার নাম ছিল রাধামণি, এখন হইয়াছে বিধু; যাহার নিমিত্ত তুমি পাগল, যাহার প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া তুমি তোমার পরিণীতা ভার্য্যাকে পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছ, সেই বিধুকে তুমি এখন চিনিয়া উঠিতে পারিতেছ না? 

গোকুল। এখন বুঝিতে পারিতেছি। না মহাশয়! আমি তাহার বাড়ীতে গমন করি নাই। 

আমি। বিধুর সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া, তোমার স্ত্রী মাতঙ্গিনীর বাড়িতে যে তুমি একবারে আসিবে, একথা সহজে কে বিশ্বাস করিবে? স্থানান্তরে গমন করিবার সময় তুমি তোমার স্ত্রীকে বলিয়া গিয়াছিলে কি? 

গোকুল। বলিয়া গিয়াছিলাম বৈ কি। স্ত্রী নিকটে থাকিলে তাহাকে না বলিয়া কোন ব্যক্তি কোন স্থানে গমন করিয়া থাকে না কি? 

আমি। অপরের কথা তুমি ছাড়িয়া দাও! তুমি আপনার কথা বল। 

গোকুল। হাঁ মহাশয়! বলিয়া গিয়াছিলাম। 

আমি। মিথ্যা কথা। চল, আমিও তোমার সহিত গমন করিতেছি। তোমার বাসার নিকটবর্তী লোকজনের দ্বারা এবং বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটীয়াগণের দ্বারা, এমন কি তোমার পরিণীতা ভার্য্যা মাতঙ্গিনীর দ্বারা আমি এখনই প্রমাণ করাইয়া দিব যে, তুমি আমাকে যে সকল কথা কহিলে, তাহার বিন্দুমাত্রও সত্য নহে, সমস্তই মিথ্যা। 

আমার কথা শুনিয়া গোকুল আর কোন কথা কহিল না, আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাহার বাসা অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। 

যে বাড়ীতে মাতঙ্গিনী বাস করিত, আমরা পুনরায় সেই বাটীতে গমন করিলাম। এবার গোকুলকে আমাদিগের সমভিব্যাহারে আসিতে দেখিয়া সেই বাটীর সকলেই বিস্মিত হইল। যাহা হউক, মাতঙ্গিনীর বাড়ীতে গোকুল সম্বন্ধে আপাততঃ আর কোনরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন নাই, এইরূপ বিবেচনা করিয়া, আমরা ক্ষণবিলম্ব ব্যতিরেকে গোকুলকে লইয়া একবারে বিধুর বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। 

যে সময় গোকুলকে লইয়া আমরা বিধুর বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম, সেই সময় পর্য্যন্ত বিধুর লাস স্থানান্তরিত করা হয় নাই। যেরূপ অবস্থায় উহার মৃতদেহ আমরা প্রথমে দর্শন করিয়াছিলাম, এখন পর্যন্ত সেইরূপ ভাবেই সেই মৃতদেহ রক্ষিত ছিল। 

প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় যে, কোন ব্যক্তি তাহার স্ত্রী প্রভৃতি প্রণয়িনীকে, ভক্তি-ভাজন মাতাপিতাকে, বা স্নেহাষ্পদ পুত্র-কন্যাকে যদি কোনরূপে হত্যা করে, তাহা হইলে ধৃত হইয়া সে প্রথমে আপন দোষ অস্বীকার করে; কিন্তু পরিশেষে সেই হত্যাকারীকে হত ব্যক্তির সন্নিকটে যদি কিয়ৎক্ষণ একাকী রাখিয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে প্রায়ই সে আপনার মনের ভাব কোনরূপে গোপন করিতে সমর্থ হয় না, তৎক্ষণাৎ অকপট চিত্তে সৰ্ব্ব সমক্ষে আপনার দোষ স্বীকার করিয়া ফেলে। 

বিধুকে হত্যা করার নিমিত্ত গোকুলের উপর যদিও প্রথমে আমাদিগের কোনরূপ সন্দেহ ছিল না; কিন্তু হঠাৎ তাহাকে কলিকাতায় দেখিতে পাইয়া ও তাহার কথাবার্তা শ্রবণ করিয়া, পরিশেষে আমাদিগের মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। মনে করিলাম যে, যে গৃহে বিধুর মৃত দেহ এখনও পড়িয়া রহিয়াছে, এবং নররুধিরে যে গৃহ একবারে আপ্লুত হইয়া পড়িয়াছে, সেই গৃহের ভিতর গোকুলকে কিয়ৎক্ষণ একাকী রাখিয়া দিব। তাহা হইলেই বুঝিতে পারিব যে, এই হত্যা গোকুলের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, কি অপর কোন ব্যক্তি এই ভয়ানক হত্যা করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। 

মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিলাম সত্য, কিন্তু আমার মনের কথা গোকুলের নিকট প্রকাশ না করিয়া, তাহাকে সঙ্গে লইয়া বিধুর বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। 

এ দিকে গোকুলের স্ত্রী মাতঙ্গিনী বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার স্বামী কোনরূপ বিষম অপরাধে অভিযুক্ত হইয়াছে ও আমরা তাহাকে ধৃত করিয়া স্থানান্তরে লইয়া যাইতেছি। কিন্তু কি অপরাধে গোকুল ধৃত হইল, তাহার বিন্দুবিসর্গও অবগত হইতে না পারিলেও তিনি একবারে অস্থির হইয়া পড়িলেন। তখন আমাদিগের নিকট হইতে যদি কোনরূপ প্রকৃত তথ্য অবগত হইতে পারেন, বাড়ীর অপরাপর লোক জনের দ্বারা তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

আমরা তাহাদিগের কথায় কর্ণপাত না করিয়া, গোকুলকে সঙ্গে লইয়া বিধুর বাড়ীতে উপনীত হইলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

মনে মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, কার্যেও তাহা করিলাম। যে গৃহের ভিতর বিধুর মৃতদেহ পড়িয়াছিল, গোকুলকে সঙ্গে লইয়া একবারে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

যাহার প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া গোকুল আপনার দেশ পরিত্যাগ করিয়াছে, যাহার নিমিত্ত আপনার মাতাপিতার অপার স্নেহ একবারে ভুলিয়া গিয়াছে, যাহার নিমিত্ত আপন পতিব্রতা ভার্য্যাকে পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছে, সেই প্রণয়িনীর এইরূপ ভয়ানক অবস্থা হঠাৎ দর্শন করিলে মানবের হৃদয়ে যেরূপ ভাবে উদয় হওয়া স্বাভাবিক, গোকুলের কিন্তু তাহার কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তাহার চক্ষু দিয়া বিন্দু-পরিমিত অশ্রু বিসর্জ্জন হওয়া দূরে থাকুক, মুখ দিয়া একটিমাত্র কথাও নির্গত হইল না। বিধুর মৃতদেহ পূর্ব্বোক্ত তক্তাপোষের উপর বিশৃঙ্খল ভাবে পতিত ছিল, গোকুল একবার তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। পরক্ষণেই সেই দৃষ্টি মেজের উপরিস্থিত বিধুর মস্তকের উপর পতিত হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই দৃষ্টি রক্তাক্ত মেজের উপর পতিত হওয়ায় গোকুল কখন সেই রুধির-রঞ্জিত স্থান দেখিতে লাগিল, কখন বা সেই স্থানে পতিত সেই তীক্ষ্ণ অস্ত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া মনে মনে কি বলিতে লাগিল, কখন বা যে স্থানে সেই অস্ত্র রক্ষিত থাকিত, সেই স্থানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। 

গোকুলের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের স্পষ্টই অনুমান হইল যে, গোকুলের মনের গতি পূর্ব্বাপেক্ষা যেন কিয়ৎপরিমাণে পরিবর্তিত হইয়াছে। সুতরাং তাহাকে সেই ভীষণ দৃশ্যময় গৃহের ভিতর একাকী রাখিয়া আমরা সকলে গৃহের বাহিরে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলাম। দেখিতে দেখিতে গোকুলও গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া আমাদিগের সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং সৰ্ব্বসমক্ষে উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল “যেমন কর্ম্ম, তাহার উপযুক্ত ফলই ফলিয়াছে!” 

গোকুলের কথা শুনিয়া আমরা একটু বিস্মিত হইলাম। ভাবিলাম, “যেমন কর্ম্ম তাহার উপযুক্ত ফল ফলিয়াছে”—এ কথার অর্থ কি? বোধ হইতেছে যে, গোকুলের অসম্মতিতে বিধু কোন অসৎ কার্য্য করিয়াছিল বলিয়া, তাহার এই দশা ঘটিয়াছে, এবং সেই অসৎ কার্য্য কি, তাহা গোকুল নিশ্চয়ই অবগত আছে বলিয়া অনুমান হইতেছে। আর গোকুলের নিকট হইতেই সে তাহার কর্ম্মের উপযুক্ত প্রতিফল প্রাপ্ত হইয়াছে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া গোকুলকে কহিলাম, “বিধু এমন কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে যে, তুমি নিজেই তাহাকে এইরূপ প্রতিফল প্রদান করিয়াছ?” 

এই সময় গোকুলের মুখের দিকে আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম যে, যে সময় আমাদিগের সহিত তাহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, সেই সময় তাহার মুখশ্রী যেরূপ ছিল, এখন তাহার সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন হইয়া গিয়াছে। তাহাকে যেন অপর কোন ব্যক্তি বলিয়া অনুমান হইতেছে। 

আমার কথার উত্তরে গোকুল সদর্পে কহিল, “পাপীয়সী নিতান্ত অবিশ্বাসিনী। তাহার এইরূপ দণ্ড হওয়াই কৰ্ত্তব্য।”

আমি। অবিশ্বাসিনীর অদৃষ্টে এইরূপ দণ্ড হওয়াই বাঞ্ছনীয়; কিন্তু এ দণ্ড তুমি নিজে কেন প্রদান করিলে? 

গোকুল। আমি প্রদান না করিলে এইরূপ কার্য্যে হস্ত প্রদান করিতে আর কে সম্মত হইবে? এ যে এরূপ পিশাচিনী, তাহা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবি নাই। ভাবিয়াছিলাম, উভয়ের দণ্ডই হইয়াছে। কিন্তু এখন দেখিতেছি যে, তাহা হয় নাই। এখন দেখিতেছি যে, আমার কার্য্য সম্পূর্ণ হয় নাই; কেবল অর্দ্ধেক হইয়াছে মাত্র। 

গোকুলের কথা শুনিয়া এখন আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, গোকুল স্বহস্তেই বিধুকে হত্যা করিয়াছে। আরও কোন ব্যক্তিকে হত্যা করার ইচ্ছা ছিল, তাহা করিয়া উঠিতে পারে নাই। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, আমি গোকুলকে পুনরায় কহিলাম, “গোকুল! আমি এখন তোমাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে কি?” 

গোকুল। আমি কোনরূপ মিথ্যা কথা কহিব না। যাহা জানি, তাহার সমস্তই কহিব। 

আমি। তুমি এরূপ ভাবে বিধুকে হত্যা করিলে কেন? 

গোকুল। সে আমার সহিত এরূপ বিশ্বাস ঘাতকের কার্য্য করিল কেন? 

আমি। বিধু তোমার পরিণীতা ভার্য্যা নহে, সে চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক। তাহার দ্বারা বিশ্বাস ঘাতকের কার্য্য না হইবে, ত কাহার দ্বারা হইবে? 

গোকুল। এ কথা আমি এখন বুঝিতে পারিয়াছি। পূর্ব্বে বুঝিতে পারিয়াছিলাম না বলিয়াই, আমার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সাধিত হইয়াছে। 

আমি। কিরূপে এই ভয়ানক লোমহর্ষণকর কার্য্য সমাধান করিলে, এবং কেনই বা এইরূপ দুরূহ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে, তাহার আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত জানিতে ইচ্ছা করি। তুমি পূর্ব্বেই প্রতিজ্ঞা করিয়াছ যে মিথ্যা কথা কহিবে না। সুতরাং ভরসা করি, এখন তুমি প্রকৃত কথা কহিবে। 

গোকুল। মহাশয়! আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, আমার সময় নিকটবর্তী। বিধু যেরূপ কার্য্য করিয়াছে, তাহার প্রতিফল আমি স্বহস্তেই তাহাকে প্রদান করিয়াছি; কিন্তু আমি যে সকল মহাপাপ করিয়াছি, তাহাতে আমার অবস্থা বিধুর অবস্থার সদৃশ হওয়াই কৰ্ত্তব্য। আপনাদিগের হস্তে আমার সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইবে, তাহাও আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। সুতরাং এরূপ অবস্থায় আমি মিথ্যা কথা কহিব কেন? এই হত্যাঘটিত সমস্ত ব্যাপার আমি আদ্যোপান্ত বর্ণন করিতেছি, আপনারা শ্রবণ করুন। 

“আমি চাকরী উপলক্ষে দেশ পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিবার অতি অল্প দিবস পরেই ঈশ্বরানুগ্রহে একটি চাকরী প্রাপ্ত হই। সেই সময়ে মনিবের কাৰ্য্যোপলক্ষে আমাকে প্রায়ই সহর পরিত্যাগ করিয়া মফস্বলে থাকিতে হইত। যে সময় আমি মেদিনীপুরে ছিলাম, সেই সময় এই বিধুর প্রণয়ে আমি মুগ্ধ হইয়া পড়ি। যে স্থানে আমার বাস ছিল, তাহার অতি সন্নিকটে রাধামণি বাস করিত। রাধামণি বাল-বিধবা হইলেও তাহার মাতা-পিতা তাহাকে পাড়ার কোন স্থানে গমনাগমন করিতে নিষেধ করিত না, রাধামণি ইচ্ছামত পাড়ার ভিতর ভ্রমণ করিয়া বেড়াইত, এবং মধ্যে মধ্যে আমাদিগের বাসায়ও আসিত। সেই সময় আমার সহিত উহার প্রথম পরিচয় হয়; এবং ক্রমে আমি উহার প্রণয়ে মুগ্ধ হই, সেও আমার প্রতি আসক্ত হইয়া পড়ে 

“আমি যে সময় সেই স্থান হইতে কলিকাতায় আগমন করি, রাধামণিও আমার সহিত আগমন করে। এই স্থানে আমি উহার বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দি। আমি একাল পর্য্যন্ত যাহা কিছু উপার্জ্জন করিয়াছি, তাহার সমস্তই উহার হস্তে প্রদান করিয়াছি। এই পাপীয়সীর প্রণয়ে আমি এতদূর মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, আমার কিছুমাত্র হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। উহার নিমিত্ত আমি আমার জন্মস্থান পরিত্যাগ করিয়াছি, বৃদ্ধ মাতাপিতার মায়া একবারে ভুলিয়া গিয়াছি, পরিণীতা বনিতার কথা ভ্রমক্রমেও একবার মনে উদয় হইতে দেই নাই। ভাবিতাম, রাধামণি বিধবা হইলেও তাহার চরিত্র কলুষিত নহে। আমা ব্যতীত সে অপর কোন পুরুষকে আপন হৃদয়ে স্থান প্রদান করিতে পারিবে না! এক কথায় আমি রাধামণিকে আমার পরিণীতা ভাৰ্য্যা অপেক্ষাও ভাল বাসিতাম। ভাবিতাম, জগতে আমার আপনার বলিবার যদি কেহ থাকে, সে রাধামণি। যদি কেহ আমাকে অন্তরের সহিত ভালবাসে, সে রাধামণি। যদি আমার প্রাণের সহিত ভাল বাসিবার কোন লোক থাকে, তবে সে রাধামণি! 

“রাধামণিকে আমি অন্তরের সহিত ভালবাসিতাম ও প্রাণের সহিত বিশ্বাস করিতাম বলিয়া, আজ আমার এই দশা উপস্থিত হইয়াছে! আপনার সতী স্বাধ্বী বনিতা মাতঙ্গিনীর প্রতি ভ্রমক্রমেও আমি দৃষ্টিপাত করিতাম না বলিয়া, আজ আমার এই দশা উপস্থিত হইয়াছে! আমি অপবিত্র প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া পাপীয়সী রাধামণির প্রতি এরূপ আসক্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, পরিশেষে মাতঙ্গিনীর অলঙ্কারগুলি পর্য্যন্ত পিশাচিনীর হস্তে প্রদান করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হই নাই। যখন বুঝিলাম যে, সে ছল অবলম্বন করিয়া, আমারই সাহায্যে মাতঙ্গিনীর অলঙ্কারগুলি পর্য্যন্ত আত্মসাৎ করিল, তখন পর্যন্ত আমি তাহাকে কোনরূপে অবিশ্বাস করি নাই, বা এরূপ বিসদৃশ ব্যবহারের নিমিত্তও তাহাকে একটিমাত্র কটু কথাও কহি নাই, সমস্তই সহ্য করিয়া আসিয়াছি। সুতরাং তাহার উপযুক্ত প্রতিফল সে আজ আমাকে প্রদান করিল! 

“মাতঙ্গিনীর অলঙ্কারগুলি রাধামণির হস্তে প্রদান করিবার অতি অল্প দিবস পরেই মনিবের কার্য্যোপলক্ষে আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হয়। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি মফস্বলে গমন করি, সেই কার্য্য সম্পন্ন করিতে অন্ততঃ এক মাস অতিবাহিত হইবে, প্রথমে এইরূপ অনুমান করিয়াছিলাম। একমাস কাল রাধামণিকে না দেখিয়া কি প্রকারে সেই স্থানে অতিবাহিত করিব, মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া যাহাতে স্থানান্তরে গমন করিতে না হয়, তাহার নিমিত্ত আফিসে গিয়া অনেকরূপ চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কোন প্রকারেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিলাম না। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া পরিশেষে আমাকে গমন করিতেই হইল। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্থানান্তরে গমন করিবার নিমিত্ত রাধামণি সেই সময় আমাকে বারবার অনুরোধ করিয়াছিল। কিন্তু সেই অনুরোধের অর্থ সেই সময় কিছুমাত্র অনুভব করিতে পারি নাই। এখন বুঝিতে পারিতেছি যে, সেই অনুরোধের অর্থ কি? এখন জানিতে পারিতেছি যে, আমাকে স্থানান্তরে প্রেরণ করিবার নিমিত্ত রাধামণি আমাকে এত অনুরোধ করিয়াছিল কেন? 

“যাহা হউক, আমি স্থানান্তরে গমন করিলাম সত্য; কিন্তু রাধামণির নিমিত্ত আমার অন্তর সর্ব্বদা জ্বলিতে লাগিল। যে কাৰ্য্য এক মাসেও সম্পন্ন হওয়া সুকঠিন, রাত্রিদিন পরিশ্রম করিয়া অতি অল্প দিবসের মধ্যেই সেই কাৰ্য্য সমাপ্ত করিলাম। ইচ্ছা,—যতশীঘ্র পারি, কলিকাতায় আগমন করিয়া রাধামণির সহিত সাক্ষাৎ করিব। কার্য্য সমাপ্ত হইবামাত্র আমি সেই স্থান হইতে কলিকাতাভিমুখে প্রস্থান করিলাম ও রাত্রি আন্দোজ নয় ঘটিকার সময় রাধামণির বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বাড়ীর সদর দ্বার একবারে উন্মুক্ত না থাকিলেও উদ্ঘাটিত রহিয়াছে। আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেই দ্বার দিয়া আস্তে আস্তে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম; ইচ্ছা—রাধামণির অজ্ঞাত—সারে একবারে তাহার সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইব, হঠাৎ আমাকে সম্মুখে দেখিয়া সে একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িবে। 

“বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম যে, তাহার গৃহের দ্বারও খোলা, কিন্তু একবারে উন্মুক্ত নহে। সেই গৃহের ভিতর একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে। আমি বাহির হইতে রাধামণিকে না ডাকিয়া, বা কোনরূপ পদশব্দ না করিয়া দ্বার ঠেলিয়া একবারে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। মনে যাহা কখনও ভাবি নাই, স্বপ্নেও যাহা কখন অনুমান করি নাই, গৃহের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই সেই ভয়ানক পাপ দৃশ্য একবারে সম্মুখে পতিত হইল। ইহা দেখিবামাত্র আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান হারাইলাম। সেই গৃহের ভিতর দ্বারের পার্শ্বে একখানি ভাল অস্ত্র ছিল, উহাদ্বারা সেই গৃহের মধ্যস্থিত অপরিচিত পুরুষকে লক্ষ্য করিয়া আঘাত করিলাম। দেখিলাম, উহার মস্তক শরীর হইতে বিচ্যুত হইয়া নিম্নে পতিত হইল; সেই সময় প্রজ্বলিত প্রদীপটিও স্থানভ্রষ্ট হইয়া নিম্নে পতিত হইল ও নিৰ্ব্বাপিত হইয়া গেল। সেই অন্ধকার গৃহের ভিতর আমি রাধামণি ওরফে বিধুর অনেক অনুসন্ধান করিলাম। ইচ্ছা হইল, তাহাকেও সমন সদনে প্রেরণ করিব; কিন্তু কোনরূপে তাহাকে প্রাপ্ত না হইয়া অস্ত্র খানি গৃহের ভিতর নিক্ষেপ করিয়া নিতান্ত দুঃখিত অন্তঃকরণে গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম, এবং কূপ সন্নিকটে গমন করিয়া আপনার হস্তপদ উত্তমরূপে ধৌত করিয়া, বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। 

সেই সময় আমি মনে করিয়াছিলাম যে, কেবলমাত্র সেই অপরিচিত পুরুষটিকেই হত্যা করিতে সমর্থ হইয়াছি, কিন্তু পাপীয়সী প্রাণ-ভয়ে কোথায় পলায়ন করিয়াছে। সুতরাং পিশাচিনীর পাপের উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করিতে আমি সমর্থ হই নাই। কিন্তু মহাশয়! আমি এখন দেখিতেছি যে, আমার মনোবাঞ্ছা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হইয়াছে। পিশাচিনীর পাপের উপযুক্ত দণ্ড আমি স্বহস্তেই প্রদান করিতে সমর্থ হইয়াছি। এখন আমার পাপের উপযুক্ত দণ্ড আপনারা আমাকে প্রদান করুন। সতী সাধ্বীর উষ্ণ নিশ্বাস ও নয়নাশ্রুর ফল এইরূপেই ফলিয়া থাকে!” 

গোকুলের কথা শুনিয়া আমরা বিস্মিত হইলাম। আমাদিগের নিকট সে যাহা কহিল, বিচারকদিগের নিকটও সে একই কথা বলিয়া গেল, কোন কথা গোপন করিল না। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

হত্যাপরাধে গোকুল ধৃত হইল। অবস্থাঘটিত প্রমাণ যতদূর ছিল, তদ্ব্যতীত গোকুলের নিজ মুখে প্রকাশিত বিবরণের উপর নির্ভর করিয়া, বিচারার্থ গোকুলকে বিচারকের সন্নিকটে প্রেরণ করা হইল। 

বিধুকে হত্যাকরা অপরাধে গোকুল ধৃত হইয়াছে, এই কথা ক্রমে তাহার স্ত্রী মাতঙ্গিনীর কর্ণগোচর হইল। এই সংবাদ পাইবামাত্র মাতঙ্গিনী প্রথমতঃ শোকে একবারে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। কিন্তু পরিশেষে কোনরূপে ধৈর্য্য ধারণ করিয়া কিরূপে আপন স্বামীর প্রাণ রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, তাহার চিন্তায় নিযুক্ত হইলেন। যে বাড়ীতে মাতঙ্গিনী বাস করিতেন, সেই বাড়ীর অপরাপর কয়েকজন স্ত্রীলোকের দ্বারা অনুসন্ধান লইয়া, কিরূপ অপরাধে গোকুল ধৃত হইয়াছেন, ধৃত হইবার পর কিরূপেই বা তিনি নিজ দোষ স্বীকার করিয়া লইয়াছেন, তাহার সমস্তই অবগত হইতে পারিলেন। 

বিচারার্থ গোকুল বিচারকের নিকট প্রেরিত হইয়াছে, তথাপি আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকিয়া গোকুলের বিপক্ষে যদি আরও কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারি, তাহার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় দেখিলাম যে, দুইটি স্ত্রীলোক আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগের একজনকে দেখিবামাত্র আমি চিনিতে পারিলাম। মাতঙ্গিনী যে বাড়ীতে বাস করিতেন, সেই বাড়ীতে উক্ত স্ত্রীলোকটিকে আমি পূৰ্ব্বে দেখিয়াছিলাম। তাহাকে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এরূপ অসময়ে তুমি এখানে আসিয়াছ কেন, এবং তোমার সহিত যে স্ত্রীলোকটি আসিয়াছেন, তিনিই বা কে?” 

স্ত্রীলোক। ইনি কোন প্রয়োজনের জন্য আপনার নিকট আসিয়াছেন। ইঁহার নাম মাতঙ্গিনী। ইনি গোকুলবাবুর পত্নী। 

আমি। আপনি গৃহস্থ-কন্যা কি নিমিত্ত এরূপ অবস্থায় আমাদিগের নিকট আগমন করিয়াছেন? 

মাতঙ্গিনী। হত্যাপরাধে দোষী আমার স্বামী ধৃত হইবার পূর্ব্বে আপনারা আমাদিগের বাসায় গমন করিয়াছিলেন; কিন্তু সেই সময় আমার মনের কথা প্রকাশ করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছিল না। এখন শুনিলাম, আমার স্বামী বিধুকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হইয়াছেন। সুতরাং আজ আমাকে আপনাদিগের নিকট আসিতে হইল। 

আমি। আপনার এমন কি একান্ত আবশ্যক কথা আছে, যে আপনি আমার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আমাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন? 

মাতঙ্গিনী। আমার পতির উপপত্নী বিধুকে হত্যা করা অপরাধে আপনারা আমার পতিকে ধৃত করিয়াছেন। কিন্তু এ হত্যা তাঁহা দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। 

আমি। গোকুলের দ্বারা এই হত্যা হয় নাই, এ কথা এখন আর কে বিশ্বাস করিবে? সে নিজেই আপনার সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়া লইয়াছে। 

মাতঙ্গিনী। আপনারা বিশ্বাস করুন, বা না করুন, কিন্তু আমি বলিতেছি, আমার স্বামী এই বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে নিৰ্দ্দোয়। তিনি মিথ্যা কথা বলিয়া সমস্ত দোষ আপনার উপর গ্রহণ করিয়াছেন। 

আমি। তাহার মিথ্যা কথা বলিবার প্রয়োজন কি? 

মাতঙ্গিনী। প্রয়োজন আছে বলিয়াই, মিথ্যা কথা বলিয়াছেন, এবং বরাবরই বলিয়া যাইবেন। আপনার পরিবারের দোষ তিনি সৰ্ব্বসমক্ষে প্রকাশ করিতে চাহেন না বলিয়াই, তিনি বিনাদোষে ভয়ানক দণ্ড গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। 

আমি। আপনার কথার ভাব কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। ইহাতে গোকুলের পারিবারিক কোন কথাই নাই?

মাতঙ্গিনী। আছে। তাহাই বলিবার নিমিত্ত আজ আমি আপনাদিগের নিকট আগমন করিয়াছি। যে হত্যা অপরাধে আপনারা আমার স্বামীকে ধৃত করিয়াছেন, সে হত্যার বিষয় তিনি কিছুমাত্র অবগত নহেন। সে হত্যা তাঁহার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, আমা কর্তৃক সেই হত্যা সাধিত হইয়াছে। 

মাতঙ্গিনীর কথা শুনিয়া আমরা একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলাম। কিছুক্ষণ পরে তাঁহাকে কহিলাম, “তুমি এরূপ ভাবে মিথ্যা কথা বলিবার নিমিত্ত আমাদিগের নিকট আগমন করিয়াছ কেন? এরূপ কার্য্য রমণীর দ্বারা কখনই হইতে পারে না। বিশেষতঃ তুমি হিন্দু-রমণী।” 

মাতঙ্গিনী। এরূপ কার্য্য হিন্দু-রমণীর দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে কি না, তাহা আমি জানি না। তবে এইমাত্র জানি যে, এই কার্য্য আমার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। 

আমি। তোমার দ্বারা এ কার্য্য কিরূপে সাধিত হইবে? 

মাতঙ্গিনী। আমি কয়েক মাস পৰ্য্যন্ত কলিকাতায় বাস করিতেছি। কিন্তু যাঁহার আশায় এই স্থানে বাস করা, হতভাগিনী বিধুর জ্বালায় তাঁহার আশাতে আমি একবারে বঞ্চিত। আমার স্বামী রাত্রিদিন তাহার বাড়ীতেই পড়িয়া থাকেন, ভ্রমক্রমেও দিনান্তরে একবার বাসায় যান না। আমার এই যন্ত্রণা আমি এত দিবস সহ্য করিয়া আসিতেছিলাম। আবার তাহার উপরে সেই পাপীয়সী চতুরতা করিয়া আমার অলঙ্কার কয়েকখানি পর্যন্ত আত্মসাৎ করিল। এইরূপ নানা কারণে আমি আর সহ্য করিতে না পারিয়া, চিরদিবসের নিমিত্ত আমি আমার শত্রু নিপাত করিয়াছি। ভাবিয়াছিলাম যে, আমার স্বামী এখন স্থানান্তরে, এই সময় যদি আমি একাকী তাহার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া তাহাকে হত্যা করি, তাহা হইলে আমার স্বামীর উপর কোনরূপ সন্দেহ হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। আমার উপর কাহারও কোনরূপ সন্দেহ হইবার কারণও নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সন্ধ্যার পরই আমি বিধুর বাড়ীতে গমন করিলাম। ইহার পূর্ব্বেও আমি কয়েকবার তাহার বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম। সুতরাং একাকী আসিতে আমার কোন কষ্টই হইল না। আসিয়া দেখি যে, তাহার গৃহের দ্বার সকল উন্মুক্ত, আর বিধু তক্তাপোযের উপর শয়ন করিয়া গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত। আমি সুযোগ আর পরিত্যাগ না করিয়া, সেই গৃহের মধ্যস্থিত একখানি তীক্ষ্ণ অস্ত্র দ্বারা উহার শরীর হইতে মস্তক বিচ্যুত করিয়া ফেলিলাম, ও ধীরে ধীরে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া আপন বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই সময়েই আমার স্বামী বাড়ীতে আগমন করিলেন। আমি তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিলাম। ইত্যবসরে তিনি আপনাদিগের দ্বারা ধৃত হইলেন। কিন্তু কোনরূপ প্রকৃত কথা না বলিয়া, আমাকে রক্ষা করিবার জন্য নিজেই আত্মদোষ স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। মহাশয়! আমার স্বামী নির্দোষ। তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়া প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদান করুন। 

মাতঙ্গিনীর কথা শুনিয়া বুঝিলাম যে, আপনার স্বামীর প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত সে মিথ্যা কথা কহিতেছে। এরূপ হত্যা হিন্দু-রমণীর দ্বারা কোনরূপেই সম্পন্ন হইতে পারে না। 

যাহা হউক, মাতঙ্গিনী যাহা কহিল, অনন্যোপায় হইয়া তাহা আমাকে লিখিয়া লইতে হইল, এবং বিচারকদিগের নিকট আমাকে সে কথা বলিতে হইল। আমার ন্যায় বিচারকগণও মাতঙ্গিনীর কথা অবিশ্বাস করিলেন। বিচারে গোকুলের প্রাণদণ্ডের আদেশ হইল। 

বিচারে গোকুলের প্রাণদণ্ডের আদেশ হইবার পর কোন কোন ব্যক্তির পরামর্শ অনুযায়ী গোকুল জেল হইতে হাইকোর্টে আপিল করিল। হাইকোর্টের বিচারকগণ এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া গোকুলকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “এই হত্যা গোকুলের দ্বারা সম্পন্ন হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা হইলেও যখন তাহার স্ত্রী সমস্ত দোষ আপনার উপর গ্রহণ করিতেছে, তখন প্রকৃত তথ্য নির্ণয় করা বড়ই কঠিন। এরূপ অবস্থায় একজনের প্রাণদণ্ডে আদেশ প্রদান করা কোনরূপেই যুক্তিসঙ্গত নহে।” 

গোকুল অব্যাহতি পাইয়া সেই দিবসই আপনার পত্নী মাতঙ্গিনীকে সঙ্গে লইয়া আপন দেশে প্রস্থান করিল। ইহার পর আর কোনরূপ দুষ্কর্ম্মে গোকুল যে কখনও পদার্পণ করিয়াছে, তাহা এ পর্য্যন্ত আর কেহই শ্রবণ করেন নাই। আমার বোধ হয়, মাতঙ্গিনী স্বামীর সহিত একত্র হইয়া মনের সুখে এখনও যশোহর জেলায় বাস করিতেছেন। ইনিই প্রকৃত হিন্দু-রমণী! 

[আশ্বিন, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *