ইংরেজ ডাকাত (২)

ইংরেজ ডাকাত (শেষ অংশ) 

(হিলি ও ওয়ার্নার নামক দুইজন দস্যুর অদ্ভুত বৃত্তান্ত) 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

রাত্রি যখন এগারটা, তখন দেখিলাম, আমার প্রেরিত চৌকীদার প্রত্যাগমন করিল। তাহার সহিত জামালপুর থানার দুইজন কনষ্টেবল, এবং ইনিশ সাহেব ছিলেন। ইনিশও কলিকাতা পুলিসের একজন ইনস্পেক্টার। পলাতক ইংরাজ কয়েদীদিগের অনুসন্ধানে আমরা যেরূপে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, ইনিও সেইরূপে নিযুক্ত হন। আমাদিগের মত তিনিও নানাস্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করেন; কিন্তু কোন স্থানেই উহাদিগের কিছুমাত্র সন্ধান করিতে না পারিয়া, পরিশেষে বর্দ্ধমানাভিমুখে গমন করিতেছিলেন। যখন তিনি মেমারি ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হন, তাহার অনেক পূর্ব্বে আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছিলাম। সেইস্থানে থাকিয়া তিনি আমাদের অনুসন্ধান পান এবং ইহাও জানিতে পারেন যে, আমরা পলায়িত কয়েদীদ্বয়ের অনুসন্ধান প্রাপ্ত হইয়া জামালপুর অভিমুখে গমন করিয়াছি। এই সংবাদ পাইয়া তিনি আমাদিগের অনুসরণ করেন, ও ক্রমে রাত্রি নয়টার সময় জামালপুরে গিয়া উপস্থিত হন। জামালপুর হইতে আমরা যে কোনদিকে গমন করিয়াছি, তাহার অনুসন্ধান করিতে না পারিয়া, সেই রাত্রি সেইস্থানে যাপন করিবার মানসে তিনি জামালপুরের থানায় গিয়া উপস্থিত হন। একে সমস্ত দিবস অনাহার, তাহাতে নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া তিনি নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়েন; সুতরাং, সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াই জনৈক কনষ্টেবলের একখানি চারিপায়া অধিকার করিয়া লন। যে কর্ম্মচারী সেই সময় থানায় উপস্থিত ছিলেন, তিনি সাহেবের নিমিত্ত কিরূপ আহারাদির যোগাড় করিবেন, তাহার চেষ্টায় নিযুক্ত হন। সেই সময় চৌকিদার আমার পত্র লইয়া সেইস্থানে উপস্থিত হয়। সাহেব প পড়িয়া সমস্ত অবগত হন, এবং আহারাদি না করিয়াই, দুইজন কনষ্টেবল সমভিব্যাহারে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হন। 

পূর্ব্বে ইনিশ সাহেবের সহিত একত্র আমি কর্ম্ম কাজ করিয়াছিলাম; তিনি আমাকে বিশেষরূপ জানিতেন, আমিও তাঁহাকে জানিতাম। জানিতাম, কোন কথা তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলে, তিনি তাহা বুঝেন। কোন কার্য্য করিবার নিমিত্ত মনে মনে সঙ্কল্প করিলেও, যদি সেই কার্য্য অন্যায় বলিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে সময়ে সময়ে তিনি সেই সঙ্কল্পিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান হইতে নিবৃত্ত হন। যাহা হউক, তাঁহাকে দেখিয়া আমার মনে বিশেষ আনন্দ হইল। ভাবিলাম যে, আমার সঙ্গী হাবাতে লোকটা আর আমাকে বড় অধিক জ্বালাতন করিতে পারিবে না; কারণ, কোন্ কৰ্ম্ম ভাল, কোন্ কৰ্ম্ম মন্দ, তাহা ইনিশ সাহেব উহাকে ভালরূপে বুঝাইয়া দিতে অনায়াসেই সমর্থ হইবেন। 

ইনিশ সাহেবেরও সমস্ত দিবস আহার হয় নাই। এই সময়ের মধ্যে হরনাথবাবু সকলের আহারের উদ্যোগ করিয়াছিলেন। এই অসময়ে পাড়াগাঁয়ে যেরূপ উদ্যোগ হইতে পারে, হরনাথবাবু তাহার অপেক্ষা উৎকৃষ্টরূপেই উদযোগ করিয়াছিলেন উত্তম লুচি তরকারি এবং দুগ্ধ ও মিষ্টান্নের আয়োজন হইয়াছিল। সাহেবত্রয় হরনাথবাবুর মিষ্টকথায়, এবং মিষ্টব্যবহারে সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন। পরে তাঁহার আয়োজিত সেই সকল আহারীয় দ্রব্যাদি অমৃতবোধে ভক্ষণ করিয়া আপন আপন কঠোর জঠরজ্বালার নিবৃত্তি করিলেন, এবং আহার শেষ হইয়া গেলে, উষ্ণ দুগ্ধ পান করিয়া ‘চা’র কার্য সারিয়া লইলেন। 

সাহেবত্রয় এইরূপে পরিতুষ্টির সহিত আহারাদি করিলেন বলিয়াই, যে আমার নিজের আহারের কোনরূপ কষ্ট হইল, তাহা নহে, আমারও আহারের উত্তম আয়োজন হইয়াছিল। হরনাথবাবুর বাড়ীতে যে ব্রাহ্মণ, গৃহ দেবতা নারায়ণের পূজা করিয়া থাকেন, তাঁহারই সাহায্যে আমার নিমিত্তও লুচি প্রভৃতি প্রস্তুত হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, সেই রাত্রিতে আমার আহারের কার্য্যটা উত্তমরূপে শেষ হইতে বাকী থাকিল না। রাত্রি বারটার সময় হরনাথ বাবুকে আশীর্ব্বাদ করিয়া ও বার বার ধন্যবাদ দিয়া, সেই কনষ্টেবলদ্বয় সমভিব্যাহারে আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। 

রাত্রি বারটার সময় কালওয়ারা গ্রামে উপনীত হইলাম। সেইস্থানে পলায়িত সাহেবদিগের কোন সংবাদ না পাইয়া, আরও অর্দ্ধঘণ্টা কাল চলিয়া বলরামপুরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানেও কোন সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। রাত্রি যখন একটা, তখন চণ্ডীপুর গ্রামে গিয়া জনৈক কৃষকের নিকট হইতে সংবাদ পাইলাম, যে, অদ্য প্রাতঃকালে সাতটার সময় দুইজন সাহেব সেইস্থানে দামোদর নদীর বাঁধে বাঁধে বেড়াইতেছিল। কিন্তু তাহার পর কোথায় বা কোনদিকে যে উহারা গমন করিয়াছে, তাহা কিন্তু সে বলিতে পারিল না। যদি অপর কোন ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হয়, যদি কেহ আমাদিগকে কোনরূপ সংবাদ দিতে সমর্থ হয়, এই ভাবিয়া সেই গ্রামের নানাস্থানে অনেক অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু, সেই নিশীথ রাত্রিতে কেবলমাত্র দুই একটি শৃগাল ভিন্ন অপর আর কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইল না। সেই সময় গ্রামস্থ সমস্ত লোক আপন আপন বাড়ীতে নিদ্রিত; সুতরাং, কাহার সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইবে? কে-ই বা আমাদিগকে সংবাদ দিবে যে, সাহেবদ্বয় কোনদিকে গমন করিয়াছে? আর কাহাকেই বা আমরা দেখিতে পাইব যে, কিছু বলিতে পারুক, বা না পারুক, তাহাকে দুইটি কথা জিজ্ঞাসা করি? 

যাহা হউক, আর এক ঘণ্টাকালমাত্র দামোদর-চরে হাটু-পরিমিত বালুকা ভাঙ্গিয়া গমন পূৰ্ব্বক সাহেবত্রয় ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। সেই চণ্ডীপুর গ্রামের দামোদরের বাঁধের উপর তাঁহারা বসিলেন; বসিয়া সেইস্থানে শয়ন করিলেন, ও ক্রমে সেই বালু-শয্যার উপর নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। কনষ্টেবল দুইজনের সহিত আমিও সেইস্থানে বসিলাম ও বসিয়া বসিয়া ঢুলিতে লাগিলাম। 

রাত্রি আড়াইটার সময়, নদীর অপরপার্শ্বে একখানি মেঘ দেখিতে পাইলাম। দেখিতে দেখিতে সেই মেঘে সমস্ত আকাশ ঢাকিয়া ফেলিল, ক্রমে অল্পে অল্পে ও পরে সজোরে বৃষ্টি আসিল। সেই বৃষ্টিজল-পতনে সাহেবগণের নিদ্রা ভাঙ্গিল, আমরাও দাঁড়াইলাম। বৃষ্টি পতিত হইতে না হইতেই আমি আমার পিরানটি খুলিয়া চাদরে জড়াইয়াছিলাম। যে কনষ্টেবলদ্বয় আমাদিগের সহিত ছিল, তাহাদের নিকট দুইটি ছাতি ছিল। ইনিশ সাহেব একটি কাড়িয়া লইলেন, আমি ও কনষ্টেবলদ্বয় অপরটির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া, আমার চাদরখানি (যাহা একবার শুখাইয়া লইয়াছি) ও পিরানটি যাহাতে না ভিজে, তখন তাহারই চেষ্টা পাইলাম। 

সেই বৃষ্টির প্রবল ধারায় আমাদিগের সমস্ত শরীর ভিজিয়া গেল, সাহেবত্রয়ের কোট, পেনটুলান বাহিয়া জলধারা বালির উপর পড়িতে লাগিল। 

এইরূপ ভিজিতে ভিজিতে সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক আমরা চণ্ডীপুর গ্রামের ভিতর গমন করিলাম। সম্মুখে একজনের একখানি চণ্ডীমণ্ডপ দেখিতে পাইয়া, তাহার ভিতর প্রবেশপূর্ব্বক সেই অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হইতে রক্ষা পাইলাম। চণ্ডীমণ্ডপের অধিকারী অতিশয় ভদ্রলোক, ও আমাদিগের সমভিব্যাহারী একজন কনষ্টেবলের পরিচিত। তাঁহাকে ডাকিবামাত্রই তিনি শয্যা পরিত্যাগপূর্ব্বক ভিজিতে ভিজিতে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমাদিগের এবং সাহেবদিগের অবস্থা দেখিয়া তাঁহার মনে দয়ার উদয় হইল। আমাদিগকে তাঁহার সেই চণ্ডীমণ্ডপে বসিবার স্থান দিয়া বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন, এবং তাঁহার যেরূপ সংস্থান ছিল, তিনি সেইরূপ বিছানা আনিয়া আমাদিগকে প্রদান করিলেন। সাহেবত্রয় তাঁহাদের সেই ভিজা কোট-পেন্টুলান প্রভৃতি ছাড়িয়া, সেই বিছানা দ্বারা উলঙ্গ শরীর আবৃত করিয়া, সেইস্থানে নিদ্রা যাইতে লাগিলেন। 

আমি চাদর পরিয়া আমার কাপড় ছাড়িলাম। উহা একস্থানে শুখাইতে দিয়া, আমিও একস্থানে শয়ন করিলাম। একটু নিদ্রাও হইল। পরদিবস প্রাতঃকালে পাঁচটার সময় আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। প্রাতঃক্রিয়া সেইস্থানে সমাপন পূৰ্ব্বক সাহেবদিগকে উঠাইলাম। তাঁহারা উঠিয়া আপন আপন আর্দ্রবস্ত্র পরিধান করিলেন। আমার কাপড় প্রায় শুখাইয়া গিয়াছিল; আমিও তাহা পরিধান-পূর্ব্বক সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম! 

৯ই মার্চ তারিখের প্রাতঃকালে ছয়টার সময়, আমরা শ্রীকৃষ্ণপুরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে একজনের নিকট অবগত হইলাম, দুইজন সাহেব ৮ই মার্চ বেলা বারটার সময় সেই গ্রামের ভিতর দিয়া বালাগড় গ্রামাভিমুখে গমন করিয়াছেন। 

চলিলাম—সেই বালাগড় গ্রামে। যখন আমরা সেই গ্রামে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা সাড়ে সাতটা। গ্রামের ভিতর গমন করিতেই প্রথমে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, তিনি কহিলেন, “সাহেবদ্বয় গোলাম রহমান কাজির বাড়ীতে আছেন।” ইহা শুনিয়া সাহেবত্রয় তখন দৌড়িতে আরম্ভ করিলেন, কি করি, আমরা তিনজনও তখন তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। সকলের মনেই আশা, এখনই উহাদিগকে পাইবে! কিন্তু কাজী সাহেবের বাড়ীতে পৌঁছিয়াই আমরা সমস্ত আশা হইতে বঞ্চিত হইলাম। কাজী গোলাম রহমান কহিলেন, “দুইজন সাহেব গত কল্য প্রায় বেলা বারটার সময় আমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, এবং আহারাদি করিয়া দিবসের অবশিষ্টাংশ ও সমস্ত রাত্রি আমার বাড়ীতেই ছিলেন; কিন্তু, অদ্য প্রাতঃকালে পাঁচটার সময় প্রস্থান করিয়াছেন। কোথায় গিয়াছেন, জানি না। ঐ ময়দানের ভিতর দিয়া মোহনপুর-অভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন।” আরও কহিলেন, “সাহেবদ্বয়কে গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই দেখিয়াছেন। উহারা সকলের নিকটেই পরিচয় দিয়াছে যে, তাহারা সরকারী কর্ম্মচারী। এই প্রদেশের ভিতর দিয়া একটি রেলের রাস্তা প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত গবর্ণমেণ্ট ইচ্ছুক হইয়াছেন। কোন্ কোন্ স্থান, এবং কোন্ কোন্ গ্রামের ভিতর দিয়া সেই রেলপথ প্রস্তুত হওয়া উচিত, তাহাই স্থির করিবার নিমিত্ত তাহাদিগের এই প্রদেশে আগমন। এই নিমিত্তই তাহারা গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।” 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

একটি প্রকাণ্ড জনশূন্য ময়দানের একপার্শ্বে বালাগড় গ্রাম, অপরপার্শ্বে মোহনপুর। সেইদিন প্রাতঃকালে সাড়ে সাতটার সময় মোহনপুরে গমন করিবার প্রত্যাশায় সেই প্রকাণ্ড ময়দানে পদার্পণ করিলাম। তিনজন সাহেব অগ্রে অগ্রে, তাহার পশ্চাৎ আমি; তৎপশ্চাৎ পুলিসের পোষাক পরিয়া দুইজন কনষ্টেবল। সাহেবেরা কখনও চলিতেছেন, কখন বা দৌড়িতেছেন; আমরা অতিকষ্টে তাঁহাদের সঙ্গে চলিতেছি, পথে একটি লোক নাই যে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করি যে কোন ব্যক্তি আমাদিগকে দূর হইতে দেখিতেছে, সেই ব্যক্তিই ভয়ে পলায়ন করিতেছে। সেই পল্লীগ্রামের ভিতর সাহেবদিগের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কে তাঁহাদের নিকট আসিবে? যে রাখালগণ সেই মাঠে গরু চরাইতেছিল, সাহেব দেখিয়া তাহারা গরু ফেলিয়া ভয়ে পলাইতে লাগিল। যে স্ত্রীলোক বা পুরুষগণ কাষ্ঠ সংগ্রহ করিতেছিল, তাহারা তাহাদিগের ঝুড়ি ও কাষ্ঠ ফেলিয়া দৌড়াইল। যে কৃষকগণ লাঙ্গল বহিতেছিল, তাহারা লাঙ্গল গরু ফেলিয়া জঙ্গলের অন্তরালে গিয়া লুকাইল। এইরূপে আমাদিগকে যে দেখিল সে-ই পলাইতে লাগিল। এমন একটি লোকও পাইলাম না যে, তাঁহাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি। এইরূপে বেলা এগারটার সময়, মোহনপুরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে গ্রামের অধিবাসীগণের নিকট হইতে সাহেবদ্বয়ের কোন সন্ধান না পাইয়া, সাহেবত্রয় একেবারে বসিয়া পড়িলেন। গ্রামের প্রান্তভাগে একটি মুদির দোকান ছিল। তাহার দোকানের সম্মুখে বাঁশবাগানে সাহেবত্রয় অতিশয় ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হইয়া বাঁশতলায় গিয়া শয়ন করিলেন। ইনিশ সাহেব আমাকে ডাকিয়া কহিলেন, “বাবু তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া যাইতেছে, ক্ষুধায় জঠরানল জ্বলিতেছে, এই সময় যদি আমাদিগের নিমিত্ত কোনরূপ উপায় করিতে পার, তাহা হইলে চিরকাল কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকিব।” সাহেবের কথা শুনিয়া, আমার মনে অতিশয় দয়া হইল। আমি ক্লান্ত হইলেও একেবারে অকর্ম্মন্য হই নাই। ইংরাজ জাতি আমাদিগকে অকৰ্ম্মন্য বলিয়া ঘৃণা করিয়া থাকেন একটু পরিশ্রম করিলেই আমরা নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়ি বলিয়া উপহাস করেন। আলস্যপ্রিয়তা এবং দীর্ঘসূত্রতা আমাদিগের অঙ্গের ভূষণ বলিয়া জনসমাজে আমাদের নিন্দা সর্বদা প্রচারিত করেন, তাহা বলিয়াই যে আমাকে একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িতে হইবে, তাহা নহে। আজ তাঁহারা দেখিলেন যে, তাঁহাদিগের চির প্রচলিত বিশ্বাস প্রকৃত নহে, জঠরানল জ্বলিলে বিনা আহারে তাঁহারা যেরূপ ক্লান্ত হয়েন আমরা সেইরূপ হই না। পদব্রজে দ্রুতগমন করিয়া তাঁহারা যেরূপ শ্রান্ত হইয়া পড়েন, আমরা ধীরে ধীরে গমন করিয়া তাঁহাদের অপেক্ষা অনেকদূর চলিতে সক্ষম। আজ তাঁহারা বুঝিলেন যে, অল্পেতে বাঙ্গালী একেবারে ক্লান্ত হইয়া পড়ে না, বিনা আহারে, বিনা নিদ্রায়, বিনা সম্বলে, তাহারা যেরূপ পরিশ্রম করিতে পারে, সে অবস্থায় সাহেবগণ তাঁহাদিগের শতাংশের একাংশও করিতে সমর্থ হয়েন না। 

যাহা হউক, উত্তরে সাহেবকে কহিলাম, “সাহেব! আমি যখন তোমাদিগের সঙ্গে আছি, তখন আর তোমাদিগের ভাবনা কি? আমি এখনই কোন না কোন উপায় করিতেছি।” এই বলিয়া কনষ্টেবলদ্বয়ের পোষাক ছাড়াইয়া একজনকে সঙ্গে লইয়া গ্রামের ভিতর গমন করিলাম; সন্ধান করিয়া গোয়ালাদিগের আবাস-স্থল বাহির করিলাম। সেইস্থানে কিছু দুগ্ধ ক্রয় করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় জানিতে পারিলাম, তাহাদের সমস্ত দুগ্ধই প্রায় বিক্রীত হইয়া গিয়াছে। তখন দুগ্ধের দ্বিগুণ মূল্য প্রদান করিতে আমি সম্মত হইলে উহারা নানাস্থান হইতে সংগ্রহ করিয়া, প্রায় দশ সের দুগ্ধের যোগাড় করিল। তাহাদেরই একটি পাত্রে সেই দুগ্ধ লইয়া এবং দুগ্ধ পান করিবার নিমিত্ত একটি মৃৎপাত্র খরিদ করিয়া, যে স্থানে সাহেবগণ শুইয়াছিলেন, আমরা সেই গোপগণের সহিত সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দুইসের দুগ্ধ আমাদিগের তিনজনের নিমিত্ত স্বতন্ত্র আনিয়াছিলাম। আট সের দুগ্ধ সাহেব-তিনজনকে প্রদান করিলে, তাঁহারা অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। দুগ্ধের কতক অংশ পান করাতে তাঁহাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা দূরীভূত হইল; সুতরাং তাঁহারা একটু বিগত-ক্লম ও সুস্থ হইলেন। পরিশেষে দেখিলাম, তিনজনেই সেইস্থানে নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। আমরা তিনজনেও আমাদের জন্য আনীত সেই দুগ্ধ পান করিয়া, কতক পরিমাণে পিপাসা ও ক্ষুধা নিবৃত্ত করিলাম। 

দিবা একটার সময় তাঁহাদের নিদ্রাভঙ্গ হইল। অবশিষ্ট যে দুগ্ধ ছিল, তাহা সেই সময়ে পান করিলেন। এখন তাঁহাদের ধূমপানের ইচ্ছা হইল; কিন্তু কাহারও নিকট না আছে পাইপের তামাক, না আছে—চুরুট। সমস্তই পূৰ্ব্ব দিনে নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া এবার হাবিৎ সাহেব কহিলেন, “বাবু! যদি কোনরূপে চুরুটের সংগ্রহ করিতে পার, তাহা হইলে বিশেষ উপকৃত হই।” আমি কহিলাম, “এরূপ পল্লীগ্রামে চুরুটের সংগ্রহ হইতেই পারে না।” এই বলিয়া সেই মুদীর দোকানে গমন করিলাম। তাহার দোকানে তামাকের পাতা ছিল; তাহাই লইয়া জড়াইয়া জড়াইয়া, একপ্রকার চুরুট প্রস্তুত করিলাম। এইরূপ চুরুট মধ্যে মধ্যে উড়িয়াদের নিকট অনেকেই দেখিয়াছেন। সাহেবগণ উক্ত চুরুটকেই তখন ‘বর্ম্মা সিগার’ জ্ঞান করিয়া ধূমপান-লালসার নিবৃত্তি করিলেন। কিন্তু খলের স্বভাব কতক্ষণ স্থির থাকিতে পারে? এখন হাবিৎ সাহেব আমার সহিত অসৎ ব্যবহার আরম্ভ করিলেন। তিনি কহিলেন, “বাবু! তুমিই আমাদিগকে এইরূপ কষ্ট দিলে। তোমার কথা মতই আমরা মোহনপুরে আসিয়া সকল দিব্‌ নষ্ট করিলাম।” এবার আমার অতিশয় রাগ হইল। আমি কহিলাম, “তুমি ইংরাজ, কিন্তু তোমার মত মিথ্যাবাদী লোক আমি কখনও দেখি নাই। আমি কোন কথা না বলিয়াই দোষী! আমি তোমাদের সহিত একত্র আর কিছুতেই থাকিব না। যে স্থানে তোমাদের ইচ্ছা, সেইস্থানে তোমরা গমন কর, আমিও আমার ইচ্ছানুযায়ী স্থানে প্রস্থান করি। যদি ইনিশ সাহেব এই সঙ্গে না থাকিতেন, তাহা হইলে এই কয়েকদিবস আমি তোমাদিগের সঙ্গে কিছুতেই থাকিতাম না।” এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে ক্রোধভরে প্রস্থান করিলাম। অতি অল্প পথ গমন করিতে না করিতেই ইনিশ সাহেব আসিয়া আমাকে ধরিলেন, ও আমাকে মিষ্ট কথা বলিয়া আমাকে পুনরায় সেইস্থানে লইয়া গেলেন, এবং হাবিৎকে মিষ্ট মিষ্ট ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। আমি পুনরায় গিয়া তাঁহাদিগের সহিত একত্র হইবার প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে, সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্যস্থানে গমন করাই বিবেচনা করিলাম। কিন্তু এখন কোনদিকে গমন করা উচিত বা কোনদিকে গমন করিলে পলায়িত সাহেবদিগের অনুসন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা, তাহা কিছুমাত্র স্থির না করিয়া সাহেবক্রয় সেইস্থান হইতে উঠিলেন, ও সম্মুখে যে পথ দেখিতে পাইলেন, সেই পথ অবলম্বন করিয়া চলিতে লাগিলেন। আমরাও ছায়ার ন্যায় তাঁহাদিগের অনুগমন করিতে লাগিলাম। 

আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া গমন করিতে করিতে করিতে হরপুর ও নতু নামক দুইখানি গ্রামে পলাতকদের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন প্রকার সন্ধান পাইলাম না। কারণ, সাহেব দেখিয়া কেহই আমাদিগের নিকট আসিল না। এরূপ অবস্থায় অনন্যোপায় হইয়া আমরা গ্রামের বাহিরে একটি আম্র কাননের ভিতর গিয়া উপবেশন করিলাম এই সময়ে আমি মনে মনে ভাবিলাম, “এই সকল পাপ কোনরূপে বিদায় করিতে না পারিলে আর উপায় নাই। “ দেখিলাম, উঁহারাও ক্রমে ক্লান্ত হইয়া আসিতেছেন, এবং দুইদিবস সাহেবী খানা খাইতে পান নাই। সেই সময় ইনি আমাকে কহিলেন, “এখন যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে সহজে যে উহাদিগের সন্ধান পাইব, এরূপ বোধ হইতেছে না। এরূপ স্থলে আমাদিগের এখন কি করা কর্তব্য?” সাহেবের কথা শুনিয়া আমিও সুযোগ পাইলাম ও কহিলাম, “আমাদিগের কার্য্য আমরা অনেকদূর করিয়াছি, এবং ইহাও অবগত হইতে পারিয়াছি যে, সাহেবদ্বয় এখন বৰ্দ্ধমান জেলার ভিতরই আছে। এ ক্ষেত্রে বর্দ্ধমান পুলিসের কর্তব্য তাহাদের অনুসন্ধান করা। বর্দ্ধমান এখান হইতে বহুদূর নহে, সেইস্থানে কেনার কোম্পানির হোটেল আছে। আমার বিবেচনায় বৰ্দ্ধমান গমনপূর্ব্বক প্রথমে আহারাদি করিয়া, দুইদিবসের ক্ষুধা নিবৃত্ত করুন। পরিশেষে সেইস্থানের ডিষ্ট্রাক্ট সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাদের সাহায্য গ্রহণ করুন।” উঁহারা আমার কথা শুনিয়া সন্তুষ্টান্তঃকরণে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; কিন্তু আমাকেও তাঁহাদের সঙ্গে গমন করিতে অনুরোধ করিলেন। আমার আন্তরিক ইচ্ছা কোন গতিতে উহাদিগকে বিদায় করি। আমি কহিলাম, “আমার আর এক পদও চলিবার ক্ষমতা নাই; অভাবপক্ষে এইদিবস এইস্থানে বিশ্রাম না করিলে, আমার পায়ের বেদনা কমিবে না; সুতরাং চলিতেও সমর্থ হইব না। আপনারা গমন করুন, আমি এই আম্র-বাগানের ভিতর শুইয়া থাকি। আর দুইদিবসের মধ্যে যদি আপনারা এইস্থানে প্রত্যাগমন করেন, তাহা হইলে আমাকে হয় এই আম্র—বাগানের মধ্যে না হয়, এই গ্রামের মধ্যে কাহারও বাড়ীতে পাইবেন।” আমার কথা শুনিয়া কনষ্টেবলদ্বয়ও তাহাই বলিল। তখন তাঁহারা আমাদিগের তিনজনকে সেই আম্র কাননে পরিত্যাগ পূর্ব্বক, পুনরায় দামোদর পার হইয়া বৰ্দ্ধমান অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। বলা বাহুল্য, ইঁহারা পূর্ব্বে যেরূপ উপায়ে দামোদর পার হইয়াছিলেন, এবারও সেই উপায় অবলম্বন করিলেন। আমরাও সেইস্থান হইতে উঠিয়া, দূরবর্তী অন্য আর একস্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম। মনে ভয়, যদি উঁহারা আবার ফিরিয়া আইসেন। 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ 

১৮৮৯ খৃষ্টাব্দের ৯ই মার্চ তারিখের দিবা তিনটার সময় সাহেবগণকে বিদায় করিয়া দিয়া, কনষ্টেবলদ্বয়কে পোষাক ছাড়িতে কহিলাম। তাহারা তাহাদের চাপরাস, পাগড়ি প্রভৃতি পুলিসের সমস্ত পোষাক খুলিয়া বাঁধিয়া লইল। সেই সময় আমি মনে মনে স্থির করিলাম, “সাহেবদ্বয় যখন মোহনপুরের নিকট ময়দানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, তখন যে দিকেই গমন করুক না কেন, এই প্রকাণ্ড ময়দানের চতুঃপার্শ্বের কোন না কোন গ্রাম তাহাদিগকে অতিক্রম করিতেই হইয়াছে। সেই গ্রামে এখন আমরা গমন করিতে পারিলে যে তাহাদের কোন সন্ধান পাইব না, তাহা নহে; দিনমানে নিশ্চয়ই কেহ না কেহ তাহাদিগকে দেখিয়াছে।” মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া একজন কনষ্টেবলকে কহিলাম, “তুমি এই গ্রামের ভিতর গমন করিয়া এমন একটি লোককে সন্ধান করিয়া লইয়া আইস, যে এই প্রকাণ্ড ময়দানের চতুঃপার্শ্বস্থিত গ্রামগুলির নাম অবগত আছে।” কনষ্টেবল আমার কথা শুনিয়া, সেই গ্রামাভিমুখে গমন করিল। কিন্তু গ্রামের ভিতর তাহাকে আর গমন করিতে হইল না, গ্রামের বাহিরেই সেইরূপ একটি লোককে পাইয়া, তাহাকে আমার নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সেই প্রকাণ্ড ময়দানের চতুঃপার্শ্বস্থিত সমস্ত গ্রামগুলির নাম আমার পকেট বহিতে পর পর লিখিয়া লইলাম। সে ব্যক্তি আমাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, আপন স্থানে প্রস্থান করিল। আমি কনষ্টেবলদ্বয়কে তখন কহিলাম, “ দেখ সিপাহীদ্বয়ঃ, পলায়িত কয়েদীদ্বয়ের সন্ধান পাইয়া, যখন আমরা এতদূর আসিয়া পড়িয়াছি, তখন এরূপ অবস্থায় সাহেবক্রয়ের মত তাহাদিগের আশা একেবারে পরিত্যাগ করা আমাদিগের পক্ষে কোনক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নহে। আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, যদি আমরা আন্তরিক ইচ্ছার সহিত একটু ক্লেশ সহ্য করিতে সমর্থ হই, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাহাদিগকে ধরিতে পারিব। আমাদিগের যে প্রধান অসুবিধা ছিল, তাহা আর এখন নাই। সাহেবদিগকে দেখিয়া কোন ব্যক্তি আমাদিগের নিকটে আসিতে সাহসী হইতেছিল না; কিন্তু এখন আমাদিগকে দেখিয়া আর কেহই পলাইবে না। যাহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিব, অকুতোভয়ে তাহারা তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে। সুতরাং সাহসের সহিত একটু পরিশ্রম করিলে, এখন সেই পলায়িত সাহেবদ্বয়ের সন্ধান আমরা নিশ্চয়ই পাইব। সাহসের উপর নির্ভর করিয়া, চল, এই ময়দানের চতুঃপার্শ্বের গ্রামগুলি একবার আমরা পরিভ্রমণ করি। তাহা হইলে যে গ্রামের ভিতর দিয়া উহারা গমন করিয়াছে, সেই গ্রামে উপস্থিত হইতে পারিলে, নিশ্চয়ই আমরা জানিতে পারিব যে, উহারা কোনদিকে প্রস্থান করিয়াছে। তখন সেইদিক্ অবলম্বন করিয়া উহাদিগের অনুসরণ করিলে নিশ্চয়ই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। তবে কিছু অধিক সময় লাগিবার সম্ভাবনা।” দেখিলাম, আমার কথা শুনিয়া উহারা আমার অভিপ্রায় বুঝিল; এবং আমার অনুবর্ত্তী হইয়া চলিতে স্বীকৃত হইল। 

আমরা সেইস্থান হইতে দ্রুতপদে বহির্গত হইলাম। এখন আর আমরা ক্লান্ত নহি, এখন আর আমাদিগের পায়ের বেদনা জানিতে পারিলাম না, কেবল আশার আশায় আশ্বাসিত হইয়া চলিতে লাগিলাম। প্রথমে হিজলনা গ্রামে উপনীত হইলাম। সেইস্থানে কোন সংবাদ না পাইয়া, ক্রমে বনগাঁ, গোপালনগর, মধুবানি, ধামু, বড়ো, সাদিপুর, কনকপুর, চলবলপুর, হইবৎপুর, জামদাহ, চক্ষুনজাদি, শম্ভুপুর, বিরূপুর, গোপালপুর, খরপুর, ও রাইপুর গ্রাম সকল অতিক্রম করিলাম; কিন্তু, কোনস্থানে কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত না হওয়ায়, যেন মনের আশা ক্রমে ভঙ্গ হইতে লাগিল। সেই সময় আমরা সকলেই ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় অতিশয় কাতর হইয়া পড়িলাম। ভাবিলাম, এইবার সম্মুখে যে গ্রাম পাইব, সেই গ্রামে বিশ্রাম করিয়া পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিব। 

আর এক ক্রোশ পথ অতিবাহিত করিলে, সম্মুখে একখানি গ্রাম দেখিতে পাইলাম। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, সেই গ্রামের নাম তেয়াণ্ডুল। এই গ্রামের আরও কিছু নিকটবর্তী হইলে শুনিতে পাইলাম, সেই গ্রামের ভিতর বিবাহের বাদ্য বাজিতেছে। উক্ত বাদ্য লক্ষ্য করিয়া চলিলাম। সম্মুখে একটি ক্ষুদ্র নদী ছিল, হাঁটিয়া ঐ নদী পার হইলাম, ও ক্রমে বিবাহ-বাড়ী গিয়া উপস্থিত হইলাম। এখন সন্ধ্যা সাতটা। পাঠকগণ! একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন, চারি ঘণ্টার মধ্যে এতগুলি গ্রাম অতিক্রম করিতে আমাদিগকে কত দ্রুতপদে চলিতে হইয়াছে। 

যে বাড়ীতে বিবাহ হইতেছিল, সেই বাড়ীর অধিকারী উগ্রক্ষত্রিয় বংশ-সম্ভুত ও সেই গ্রামের একজন বর্দ্ধিষ্ণু লোক; নাম –কৈলাসচন্দ্র সাঁই। তিনি আমাদিগকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! কোথা হইতে আগমন করিতেছেন, এবং কোনস্থানে গমনের ইচ্ছা?” তাঁহার এই প্রশ্নে আমি উত্তর করিলাম, “মহাশয়! আমি ব্রাহ্মণ, এবং অতিথি। এই দুইটি লোক আমার সমভিব্যাহারী।” আমার কথা শুনিয়া তিনি আমাদিগকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না। বিশেষ সমাদরের সহিত আমাদিগকে বসাইলেন। পদ প্রক্ষালনের নিমিত্ত জল আনাইয়া দিলেন, হস্তপদ ধৌত করিলাম। পরিশেষে সরবৎ ও সন্দেশ আনিয়া জলযোগ করিতে অনুরোধ করিলেন। সেই সময় আমি তৃষ্ণায় অস্থির হইয়াছিলাম, কোন কথা না কহিয়াই জলযোগ করিলাম। তিনি যখন দেখিলেন, আমি সুস্থ হইয়াছি, তখন তিনি আমার নিকট আসিয়া উপবেশন করিলেন এবং কহিলেন, “মহাশয়! আপনি অতিথি নহেন। আপনি কে, এবং কোথায় বা গমন করিবেন, যদি বিশেষ কোন প্রতিবন্ধক না থাকে, তাহা হইলে আমাকে বলিয়া অনুগৃহীত করুন।” 

তাঁহার কথা শুনিয়া আমরা কে, কি নিমিত্ত এই প্রদেশে আগমন করিয়াছি, এবং পলায়িতদ্বয়ের গমনের পথ হারাইয়া যেরূপ ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, তাহা তাঁহাকে কহিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া কহিলেন, “বোধ হয়, আমি আপনাকে দুইজন সাহেব সম্বন্ধে একটু সংবাদ প্রদান করিতে পারিব; কিন্তু এখন আমি বলিতেছি না। বাড়ীতে ব্ৰাহ্মণ লুচি ভাজিতেছে, আপনারা একটু সুস্থ হইয়া আমার এই স্থানে অগ্রে আহার করুন, পশ্চাতে আমি সকল কথা বলিব। কারণ, আপনাদিগকে যেরূপ ব্যস্ত দেখিতেছি, তাহাতে এখন আপনাদিগকে সেই সংবাদ প্রদান করিলে আপনারা আহার না করিয়াই, অনাহারে আমার বাড়ী হইতে চলিয়া যাইবেন। 

আমরা একে অতিশয় ক্ষুধার্ত হইয়াছিলাম, তদুপরি তাঁহার এই অনুরোধ! তাহার উপর তাঁহার নিকট হইতে কিছু সন্ধান পাই বারআশা! কাজেই দায়ে পড়িয়া তাঁহার বাড়ীতে উত্তমরূপে আহারাদি করিলাম। আমরা সকলে যখন আহার করিয়া বসিলাম, সেই সময় কৈলাসবাবু সেই গ্রামের চৌকীদার গয়ারাম সাঁতরাকে ডাকিলেন। গয়ারাম বিবাহের বাড়ীতেই উপস্থিত থাকিয়া কৰ্ম্ম-কাজ করিতেছিল। গয়ারাম আমাদের নিকটে আসিলে, তিনি কহিলেন, “গয়ারাম! আজ প্রাতঃকালে যে দুইজন সাহেবের কথা বলিতেছিলে, তাহাদের অবস্থা যতদূর তুমি অবগত আছ, ইঁহাদিগকে শুনাইয়া দাও।” 

গয়ারাম কহিল, “আমার একটু আকের খেত আছে। আজ সকালে আমি গ্রামের বাহিরে ময়দানে বসিয়া আক মাড়াইতেছিলাম, এমন সময় দেখিলাম, দুইজন সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহারা কিছু আকের রস খাইতে চাহিলে, আমি উহা প্রদান করিলাম। পরিশেষে আরও দুইগাছি ইক্ষু লইয়া, তাহারা শুকুর গ্রামাভিমুখে প্রস্থান করিল। যখন তাহারা প্রস্থান করে, তখন বেলা অনুমান সাড়ে সাতটা। ইহাই আমি অবগত আছি, আর কিছুই জানি না।” 

গয়ারামের কথা শুনিয়া শরীরে পুনরায় বলের সঞ্চার হইল। তখন গয়ারামকে কিছু পারিতোষিকের প্রলোভন দেখাইলে, যে পৰ্য্যন্ত উহাদিগকে গমন করিতে দেখিয়াছিল, সে তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিবে বলিল। সেই রাত্রি আটটার সময় আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

রাত্রি যখন নয়টা, সেই সময় শুকুর গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম। অনুসন্ধানে ব্রজবাগ্দীর নিকট অবগত হইলাম যে, দুইজন সাহেব প্রাতঃকালে আটটার সময় শুকুর গ্রাম অতিক্রম-পূৰ্ব্বক গ্রামাভিমুখে গমন করিয়াছে। চলিলাম—সেই বলাগ্রামে। রাত্রি যখন দশটা, সেই সময় বলাগ্রামে গিয়া অবগত হইলাম যে, প্রায় সাড়ে আটটার সময় তাহারা জামাইপোতা-গ্রামাভিমুখে প্রস্থান করিয়াছে। যখন জামাইপোতা গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি দুইটা। সেইস্থানে যুগল চং নামক এক ব্যক্তির নিকট অবগত হইলাম যে, সেইদিবস প্রাতঃকালে নয়টার সময় দুইজন সাহেব সেই গ্রাম অতিক্রম-পূর্ব্বক রাজার মায়ের দীঘির অভিমুখে গমন করিয়াছে। সেইস্থানে গমন করিতে করিতে রাত্রি শেষ হইয়া আসিল। ৯ই মার্চ তারিখ এইরূপেই পথে পথে অতিবাহিত করিলাম। 

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ 

আমাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাহেবক্রয় কোথায় গমন করিয়াছিলেন বা কি করিয়াছিলেন, তাহা বোধ হয়, পাঠকগণ জানিতে ইচ্ছা করেন। এ সম্বন্ধে আমার চাক্ষুযজ্ঞান নাই; তবে পরে আমি যেরূপ শুনিয়াছিলাম, তাহাই নিম্নে লিখিত হইল। 

তাঁহারা বর্দ্ধমান গমনপূর্ব্বক প্রথমে ষ্টেশনে গমন করেন। সেইস্থানে কেনার কোম্পানির হোটেলে চব্য-চোষ্য ভোজন পান করিয়া লয়েন। পরিশেষে পলাতকদ্বয়ের যতদূর সন্ধান পাওয়া গিয়াছে, এবং তাঁহারা যতদূর যাহা করিয়াছেন, তাহা তাঁহাদের ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীকে তারযোগে এবং পত্রযোগে জ্ঞাপন করেন। তাহার পর, সেইস্থানের ডিস্ট্রাক্ট সুপারিন্টেণ্ডেন্টের সহিত সাক্ষাৎ-পূর্ব্বক সমস্ত অবস্থা তাঁহাকে জ্ঞাপন করিয়া, তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনিও উপস্থিতরূপে সাহায্য প্রদানে সম্মত হয়েন। 

সাহেবত্রয়ের প্রেরিত টেলিগ্রাফ প্রাপ্ত হইয়া কলিকাতার সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী যখন জানিতে পারিলেন যে, পলাইতদিগের অনুসন্ধান প্রাপ্ত হইয়াও তাঁহারা সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক বর্দ্ধমান গমন করিয়াছেন, তখন তিনি তাঁহাদিগের উপর নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং সবিশেষ অনুযোগ-পূর্ণ এক পত্র লোকদ্বারা তাঁহাদিগের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। সেই পত্রে এইরূপ আদেশ প্রদত্ত হইল যে, যে স্থানে আমাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক উহারা চলিয়া গিয়াছেন, পত্রপাঠ মাত্র সেইস্থানে গমন করেন, এবং আমার সহিত মিলিত হইয়া পলায়িতদ্বয়ের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হয়েন; যে পর্যন্ত উহারা ধৃত না হয়, সেই পর্য্যন্ত তাহাদিগের অনুসন্ধান হইতে নিবৃত্ত না হইয়া, তাহারা যেন প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে গমন করেন। কেবল এই আদেশ দিয়াই যে তিনি ক্ষান্ত হইয়াছিলেন, তাহা নহে; কলিকাতায় আরও যে সকল প্রধান প্রধান ইংরাজ-কর্মচারী ছিলেন, তাঁহাদিগকেও সেইস্থানে প্রেরণ করিয়াছিলেন। 

বর্দ্ধমান পুলিসের বড় সাহেবও প্রায় আড়াই শত সুশিক্ষিত ও খাস পুলিসকে তোজদান-বন্দুক বাঁধাইয়া, সেইস্থানে প্রেরণ করেন। ইংরাজ-কর্ম্মচারীগণও প্রত্যেক একটি একটি রিভল্ভার সঙ্গে করিয়া লয়েন। সকলেরই এইরূপ অস্ত্র লইবার তাৎপর্য এই যে, সকলেরই মনে বিশ্বাস পলায়িত সাহেবদ্বয়ের নিকটেও আগ্নেয় অস্ত্র আছে। 

যে আম্রকাননে আমাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাহেবত্রয় বর্ধমান গমন করিয়াছিলেন, চলৎশক্তি-বিরহিত হইয়া যে আম্রকাননে আমি পড়িয়া থাকিব,—এই বিশ্বাসে তাঁহারা আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সকলেই সেই আম্রকাননে গিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রথমে আমার অনুসন্ধান করিলেন; কিন্তু আমি যে কোথায় গমন করিয়াছি, তাহা কাহারও নিকট অবগত হইতে পারিলেন না। অস্ত্র-শস্ত্র লইয়া অনেক লোক সেই পল্লীগ্রামে উপস্থিত হওয়ায়, গ্রামস্থ প্রজাগণ অতিশয় ভীত হইয়া পড়িল। এমন কি, তাঁহারা যে সকল গ্রামের মধ্য দিয়া গমন করিতে লাগিলেন, সেই সকল গ্রামের লোকজন অতিশয় ভীত হইয়া গ্রাম পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল। তাহারাও এইরূপে সেই স্থানীয় গ্রাম-সমূহ প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু, না পাইলেন—আমার ঠিকানা, না পাইলেন—পলান্তি কয়েদীদ্বয়ের কোনরূপ সন্ধান! 

আমার সন্ধান তাঁহারা কোথা হইতে পাইবেন? উহারা যে সময়ে, যে স্থানে অনুসন্ধান করিতেছিলেন, আমি সেই সময়ে তাঁহাদিগের নিকট হইতে বোধ হয়, ৭০/৮০ মাইল দূরে। 

এইরূপে তাঁহারা কিছুই করিতে না পারিয়া, গ্রামে গ্রামে জঙ্গলে জঙ্গলে, শৃগাল তাড়াইয়া বেড়াইতে লাগিলেন; যে পৰ্য্যন্ত কলিকাতায় আমার প্রত্যাগমনের সংবাদ না পাইলেন, সেই পর্য্যন্ত আর প্রত্যাগমন করিলেন না। 

“সাহেবগণ জঙ্গলে জঙ্গলে শৃগাল তাড়াইয়া বেড়াইলেন” এই কথার অর্থ বোধ হয়, পাঠকগণ বিশেষরূপে অবগত হইতে পারিয়াছেন। যদি কেহ আমার মত অল্পবুদ্ধি পাঠক থাকেন, তবে তাঁহাকে এইমাত্র বলিলেই তিনি বুঝিতে পারিবেন যে, যখন সাহেবগণ আসল কার্য্যের কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না, অথচ কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিবার আদেশও পাইলেন না, তখন আপন আপন পিস্তল লইয়া জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিয়া ফিরিয়া মৃগয়ার সখ মিটাইয়া লইলেন। 

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ 

১০ই মার্চ তারিখের প্রাতঃকাল পাঁচটার সময় রাজার মায়ের-দীঘিতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে সৰ্ব্বানন্দ বসাক নামক এক ব্যক্তির নিকট জানিতে পারিলাম যে, তিনি তাহার পূর্ব্বদিবস দিবা দশটার সময় দুইজন সাহেবকে দীঘির ধারে বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছেন; কিন্তু তাহারা যে কোনদিকে গমন করিয়াছে, তাহা বলিতে পারিলেন না। পূর্ব্বে একবার বৃহৎ ময়দানের ভিতর পড়িয়া পলায়িত সাহেবদিগের গতি স্থির করিতে না পারিয়া যেরূপ কষ্ট পাইয়াছিলাম, অদ্য আবার সেইরূপ কষ্টে পতিত হইলাম। অদ্য যে স্থানে আসিয়া আমরা উপস্থিত হইলাম, সেই স্থানটি পূর্ব্বের ন্যায় বৃহৎ ময়দান না হইলেও নিতান্ত ক্ষুদ্র ময়দান নহে। এইস্থানে পুনরায় সাহেবদিগের গতি স্থির করিতে অসমর্থ হইলাম, পুনরায় আমাকে পূৰ্ব্বমত উপায় অবলম্বন করিতে হইল। 

যাহা হউক, সেইস্থানের নিকটবর্ত্তী গ্রাম-সমূহে পুনরায় অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। দিবা এগারটা পর্যন্ত কুলে, নূরপুর, শিবরামপুর, খাননে, আহারবেলোন, জোতবমি ও পলাশন প্রভৃতি গ্রাম-সমূহ দর্শন করিলাম। কিন্তু কোনস্থানে কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া, পরিশেষে দিবা সাড়ে এগারটার সময় গোপীনাথপুরে প্রবেশ করিলাম। সেইস্থানে সেখ রমজান নামক একজন মুসলমানের নিকট অবগত হইলাম যে, ৯ই মার্চ তারিখের দিবা এগারটার সময় দুইজন ইংরাজ আসিয়া তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হন, এবং সেইস্থানে ডাল ও ভাত খাইয়া তাহার দলিজে শয়ন করিয়া থাকেন। দিবা তিনটার সময় উভয়ে গাত্রোত্থান করিয়া, তাহার বাঁশঝাড় হইতে দুইখানা মুটারি গোছের বাঁশ কাটিয়া লইয়া, সেইস্থান হইতে ফকিরপুর অভিমুখে গমন করিয়াছেন। 

চলিলাম—সেই ফকিরপুর। সেইস্থানে দিবা বারটার সময় উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে জানিতে পারিলাম যে, সাহেবদ্বয় বৈকাল চারিটার সময় সেই গ্রাম পরিত্যাগ পূর্ব্বক আরিনা-গ্রামাভিমুখে গমন করিয়াছে। আমরা সাড়ে বারটার সময় আরিনাগ্রামে উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে বাবু প্রসন্নচন্দ্র রায়ের নিকট অবগত হইলাম যে, তাহারা অপরাহ্ন সাড়ে চারিটার সময় সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে। দিবা একটার সময় যখন সোনাই গ্রামে পৌঁছিলাম, তখন জানিলাম, সাহেবদ্বয় সেই গ্রামে আসিয়াছিল—বৈকাল পাঁচটার সময়; সেইস্থান হইতে উহারা কামদেবপুর—অভিমুখে গমন করিয়াছে। দিবা দুইটার সময় কামদেবপুরে উপনীত হইয়া জানিলাম, সাহেবদ্বয় সেখ এমদাদ আলির বাড়ীতে পূৰ্ব্বদিবস সন্ধ্যা ছয়টার সময় গিয়া উপস্থিত হয়; এবং রাত্রিতে ডাল ও রুটি আহার করিয়া সেইস্থানেই রাত্রিযাপন করে। পরদিন প্রাতঃকালে পাঁচটার সময় তাহারা সেই গ্রাম পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্যস্থানে গমন করিয়াছে। কোনদিকে গমন করিয়াছে, অনুসন্ধানে তাহা আর কেহই বলিতে পারিল না। সেই সময় ময়দানে লোকজন না থাকায়, কেহ জানিতে পারে নাই যে, তাহারা কোন গ্রামাভিমুখে গমন করিয়াছে। 

এই সময় ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও নিদ্রায় আমার শরীর অবসন্ন হইয়াছে, চলিবার আর ক্ষমতা নাই; পায়ের নীচে ফোস্কা পড়িয়াছে; জুতা জোড়াটি এরূপভাবে ছিঁড়িয়া গিয়াছে যে, তাহা আর পায়ে দিবার উপায় নাই। সেইস্থানে কিছু আহারীয় দ্রব্যের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু একস্থানে অর্দ্ধসের কাঁচা দুগ্ধ ভিন্ন আর কিছুই পাইলাম না। সেই গ্রামে একজন চামার বাস করিত, তাহাকে ডাকাইয়া আনিয়া জুতা জোড়াটি সেলাই করাইয়া লইলাম। এমদাদের বাড়ী হইতে একটু সরিষার তৈল চাহিয়া লইয়া, অল্প জল ও সেই তৈল একত্র করিয়া, পায়ের নীচে অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল মালিশ করিলাম। তখন পায়ের বেদনা কিছু কম বোধ হইল। 

দিবা তিনটার সময় পুনরায় সেইস্থান হইতে চলিলাম। পথিমধ্যে একটি গ্রাম (বোধ হয় ঝেঁয়ে গ্রাম) হইতে কিছু মুড়ি সংগ্রহ-পূর্ব্বক চাদরে রাখিয়া, তাহাই খাইতে খাইতে চলিলাম। ঝেয়ে, চিন্তামণিপুর, সরঙ্গা, বিলাসপুর, নারায়ণপুর, বোঁয়াই, সিবরামবাটী, পুনসুড়, ওই প্রভৃতি গ্রাম সন্ধ্যা ছয়টা পৰ্য্যন্ত অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া, পরিশেষে রাত্রি সাতটার সময় সুলতানপুর গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। সেইস্থানে ব্রজনাথ মণ্ডলের নিকট জানিতে পারিলাম যে, সেইদিবস প্রাতঃকাল আটটার সময় সাহেবদ্বয় তাহার নিকট হইতে দুইগাছি ইক্ষু চাহিয়া লইয়া কালনা গ্রাম-অভিমুখে গমন করিয়াছে। 

আমরা যদিচ অতিশয় ক্লান্ত হইয়াছিলাম, তথাপি বিশ্রাম না করিয়া সেই কানা গ্রামে চলিলাম। কিন্তু সেইস্থানে কোনরূপ অনুসন্ধান প্রাপ্ত না হইয়া ক্রমে ক্রমে বরদা, বেড়গ্রাম, দেবরাজহাট, বহুড়াগড়ে, দইওড় প্রভৃতি ভ্রমণ করিয়া, রাত্রি তিনটার সময় আমরাইল গ্রামে উপনীত হইলাম। সেইস্থানে সাহেবদ্বয়ের পুনরায় সন্ধান পাইলাম। উহারা সেইদিবস দিবা দুইটার সময় সেই গ্রাম অতিক্রম পূর্ব্বক শ্যামপুর-অভিমুখে গমন করিয়াছে। রাত্রি চারিটার সময় শ্যামপুরে গমন পূর্ব্বক অবগত হইলাম, দিবা আড়াইটার সময় উহারা সেই গ্রাম অতিক্রম পূর্ব্বক ডংলা গ্রামের পথ ধরিয়াছে। আমরা যখন ডংলা গ্রামে উপস্থিত হইলাম, তখন ভোর পাঁচটা। জানিতে পারিলাম, তাহারা দিবা তিনটার সময় সেই গ্রাম অতিক্রম-পূৰ্ব্বক কুমুড়ি গ্রামে গমন করিয়াছে। এইরূপভাবে পথে, পথে, গ্রামে, গ্রামে, ঘুরিয়া ঘুরিয়া, সেই ১০ই মার্চ তারিখের রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। আহার হইল—পূর্ব্বোক্ত অর্দ্ধসের দুগ্ধ ও এক পয়সার মুড়ি। বিশ্রাম ত একেবারেই পরিত্যাগ করিলাম। কুসমুড়ি গ্রাম বাঁকুড়া জেলার ভিতর। ১০ই তারিখের রাত্রি যেমন প্রভাত হইল, সেই সঙ্গে বৰ্দ্ধমান জেলাও ফুরাইল। এখন বাঁকুড়া জেলায় গমন করাই মনস্থ করিলাম। 

ষোড়শ পরিচ্ছেদ 

৯ই মার্চ তারিখে যখন ইংরাজ কর্মচারী-ত্রয় আমাকে পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক চলিয়া যান, সেই সময় আমার নিকট সম্বলের মধ্যে ছিল, কেবল তিনটি টাকা ও কয়েকটি পয়সা। ১০ই তারিখের প্রাতঃকালে দেখিলাম, কয়েকটি মাত্র পয়সা ভিন্ন আর কিছুই নাই—সমস্তই ব্যয় করিয়াছি। যে ব্যক্তি কিছু সন্ধান দিয়াছে, যাহার দ্বারা কোন রূপ সন্ধান পাইবার আশা পাইয়াছি, তাহাদিগকে দুই চারি আনা করিয়া প্রদান করিতে করিতে, সমস্তই শেষ হইয়া গিয়াছে। ১০ই তারিখে যখন আমার খরচের অনাটন হইল, তখন এক স্থানে অঙ্গুলি হইতে আমার সোণার আংটা খুলিয়া প্রথমে বন্ধক দিতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কেহই অপরিচিত লোকের দ্রব্য বন্ধক রাখিতে স্বীকৃত হইল না। পরিশেষে উহা একজন অপরিচিত লোকের নিকট বিক্রয় করিলাম। অতি অল্প দিবস পূৰ্ব্বেই ২৫ টাকা দিয়া এই আংটী আমি খরিদ করিয়াছিলাম; কিন্তু অদ্য বিপাকে পড়িয়া, কেবল ১০ টাকায় উহা বিক্রয় করিয়া ফেলিলাম। সেই টাকাতেই আমরা আবশ্যকীয় খরচ করিতে করিতে চলিলাম। 

১১ই মার্চ তারিখের প্রাতঃকাল ছয়টার সময় কুসমুড়ি গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে জানিতে পারিলাম যে, সাহেবদ্বয় পূৰ্ব্বদিন সন্ধ্যা ছয়টার সময় সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হয়। সেইস্থানে কখানি বারওয়ারি ঘর আছে, সেই ঘরেই তাহারা রাত্রিযাপন করে। পরিশেষে অদ্য প্রাতঃকাল পাঁচটার সময় সেই গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে; কিন্তু কোন গ্রামাভিমুখে গমন করিয়াছে তাহা কেহই অবগত নহেন, কারণ মার্চ মাসের প্রাতঃকাল পাঁচটার সময় সেই প্রদেশের কেহই শয্যাত্যাগ করেন না। 

যে কয় দিবস হইতে আমি উহাদিগের অনুসরণ করিতেছি, সেই কয় দিবসেই দেখিতেছি, উহারা এরূপ প্রত্যূষে গ্রাম পরিত্যাগ করে যে, সেই সময়ে কেহই দেখিতে পায় না—উহারা কোন দিকে প্রস্থান করিতেছে। কাজেই আমাকে নানা গ্রাম ভ্রমণ করিয়া উহাদিগের অনুসন্ধান করিতে হইতেছে। উহাদিগের প্রাতঃকালের গতি নির্ণয় করিতে অনেক সময় নষ্ট হয় বলিয়াই, এ পর্যন্ত উহাদিগের নিকটবর্তী হইতে পারিতেছি না। 

মার্চ মাস উক্ত প্রদেশে ইক্ষু মাড়িবার সময়। এতঞ্চলে যেরূপ কলে ইক্ষু মাড়া হইয়া থাকে, তাহাতে একপ্রকার “কেঁচ কোঁচ” শব্দ অনেক দূর হইতে শ্রবণগোচর হয়। ১০ই মার্চ তারিখের সাহেবদিগের বক্রগতিতে আমার মনে বিশ্বাস হইয়াছিল যে, যে স্থানে ইক্ষু মাড়া হয়, সেই স্থান দিয়াই উহারা গমনাগমন করিয়া থাকে। কারণ, সেই সকল স্থানে গমন করিলেই, ইক্ষু-রস ও ইক্ষু অনায়াসেই পাওয়া যায়। গত দুই দিবসের মধ্যে যখন আমি উহাদিগের গতি—নির্ণয়ে অপারক হইয়াছি, তাহার পর প্রায়ই ইক্ষু মাড়িবার স্থানে উহাদিগের পুনরায় সন্ধান প্রাপ্ত হইয়াছি। 

অদ্য প্রাতঃকালে উহাদিগের গতি স্থির করিতে না পারিয়া, পুনরায় নিকটবর্ত্তী গ্রাম সকলে অনুসন্ধান না করিয়া, ইক্ষু মাড়িবার স্থানেই অনুসন্ধান করিবার ইচ্ছা করিলাম। কমুড়ি হইতে বহির্গত হইয়া, ইক্ষুমাড়া কলের শব্দ অনুসরণ করিয়া, প্রথমে দশাইবাটী গ্রামে গমন করিলাম। সেই স্থানে কোন সন্ধান না পাইয়া, সিংলে গ্রামের কলে গমন করিলাম। সেই স্থানে জানিতে পারিলাম যে, সাহেবদ্বয় সেই স্থানে গমন করিয়াছিল, তাহার পর সেই স্থান হইতে গোবিন্দপুর গ্রামাভিমুখে প্রস্থান করিয়াছে। গোবিন্দপুরে কোন সন্ধান পাইলাম না, কিন্তু করসুন গ্রামের কলে পুনরায় উহাদিগের সন্ধান পাইলাম—সেই স্থান হইতে উহারা আবদুলপুরের দিকে গমন করিয়াছে। কিন্তু আবদুলপুরে কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। পরিশেষে সন্ধান পাইলাম, আমরুল গ্রামের ইক্ষুর কলে। 

ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, অনিদ্রায় ও পথশ্রমে আমরা যেরূপে ক্লান্ত হইয়াছিলাম, আজ প্রথম হইতেই উহাদিগের সন্ধান পাওয়ায়, সে কষ্ট ভুলিলাম, ও যত দ্রুত চলিতে পারি, তত দ্রুত চলিতে লাগিলাম। আমরুল গ্রামে অবগত হইলাম যে, উহারা ধরাবাড়ি গ্রামের দিকে গিয়াছে। ধরাবাড়ি গ্রামে জানিতে পারিলাম, প্রায় এক ঘণ্টা হইল, উহারা বাল্‌ স গ্রামাভিমুখে প্রস্থান করিয়াছে। দ্রুতপাদে সেই বাসি গ্রামে গমন করিলাম; এবং সেই স্থানে অবগত হইলাম যে, উহারা ঈশ্বরগোড় গ্রামে গিয়া পৌছিয়াছে। সেই গ্রামে গমন করিলে, এক ব্যক্তি কহিল “এই মাত্র উহাদিগকে হাঁসিপুকুর গ্রামে দেখিয়া আসিতেছি।” আরও দ্রুত গতিতে চলিলাম—সাহেবদ্বয় হাঁসিপুকুর পরিত্যাগ পূর্ব্বক তেলিসায়ের গ্রামের দিকে গমন করিয়াছে। সেই স্থানে যাইবামাত্র অবগত হইলাম,—প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা হইল, উহারা জামকুড়ি গ্রামাভিমুখে প্রস্থান করিয়াছে। 

এখন বেলা আড়াইটা হইয়াছে। কোন রূপ স্নান, কি আহারের বন্দোবস্তের আবশ্যক; কিন্তু, আজ তাহা একেবারেই ভুলিয়া গেলাম। যেরূপ উহাদিগের সন্ধান পাইতে লাগিলাম, অমনি সেই দিকে ছুটিতে লাগিলাম। এইরূপ অবস্থায় দিবা তিনটার সময় জামকুড়ি গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। 

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ * 

বাঁকুড়া জেলার ভিতর শুসুনিয়া পাহাড়ের জঙ্গলের কথা পাঠকগণের মধ্যে বোধ হয়, অনেকেই অবগত আছে। এই জঙ্গল জামকুড়ি গ্রাম হইতেই আরম্ভ। এই জঙ্গলের ভিতর না আছে, এমন হিংস্র জন্তুই নাই। যে স্থান হইতে সেই সুবিস্তীর্ণ জঙ্গল আরম্ভ, সেই স্থানে দুই তিনি খানি দোকান আছে। এই স্থানকে জামকুড়ির বাজার কহে। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া, তথাকার দোকানদারদিগকে জিজ্ঞাসা করায়, জানিতে পারিলাম যে, দুই জন সাহেব এই স্থানে একটু পূর্ব্বে দাঁড়াইয়াছিল। তাহারা দুই জনে কি বলাবলি করিয়া এই জঙ্গলের পথ আশ্রয় করিয়াছে। এই কথা শ্রবণ—পূর্ব্বক, আমরাও সেই নিবিড় জঙ্গলের পথ অবলম্বন করিলাম। প্রায় এক মাইল মাত্র পথ অতিবাহিত করিলে, দেখিলাম, যাহাদের নিমিত্ত এত ক্লেশ সহ্য করিয়া এত দূরে আগমন করিয়াছি, সেই পলায়িত কয়েদী-দ্বয়-ওয়ার্নার ও হিলি সাহেব,—-আমাদিগের দিকেই আগমন করিতেছে। যখন আমি প্রথমে উহাদিগকে দেখিতে পাইলাম, তখন উহারা আমার নিকট হইতে প্রায় সহস্র ফিট ব্যবধানে ছিল। আমি দূর হইতে দেখিয়াই উহাদিগকে চিনিতে পারিলাম। যে পথ দিয়া আমরা গমন করিতেছিলাম, বা যে পথ দিয়া উহারা আগমন করিতে ছিল, তাহা জঙ্গলের ভিতর-স্থিত সঙ্কীর্ণ পথ। এমন কি, সেখানে দুই জন মনুষ্য পার্শ্বে পার্শ্বে হইয়া চলা যায় না। আমি আগে অগ্রে চলিতেছিলাম; আমার পশ্চাদভাগে পর পর কনষ্টেবল-দ্বয় আসিতেছিল। সাহেব-দ্বয়ের মধ্যে প্রথমে ছিলেন, ওয়ার্নার, তাহার পশ্চাদ্ভাগে হিলি। উভয়ের হস্তেই মুটরে গোছের খুব মজবুত এবং প্রায় পাঁচ হস্ত লম্বা এক একখানি বাঁশ। 

সাহেবদিগকে দেখিবামাত্র, আমি আমার অনুচর সেই কনষ্টেবলদ্বয়কে কহিলাম,—“যাঁহাদিগের নিমিত্ত আমাদিগের এত ক্লেশ, ঐ দেখ, তাহারা আসিতেছে। এখন একটু বিবেচনার সহিত কার্য্য করার প্রয়োজন। ইহারা দুই জনেই অতিশয় বলবান্। বিশেষ হিলি একজন ক্ষমতাশালী লড়ায়ে গোরা। সম্মুখ হইতে উহাদিগকে আক্রমণ করিলে, কোন ক্রমেই উহাদিগকে পরাজিত করিতে পারিব না, ঐ বাঁশের এক এক আঘাতেই আমাদিগকে শমন সদনে প্রেরণ করিবে। আমার বিবেচনায় এক কাজ কর, তোমরা উভয়েই এই আম্র-বৃক্ষের অন্তরালে লুক্কায়িত হও, আমি উহাদিগের নিকট দিয়া উহাদিগের পশ্চাদ্ভাগে গমন করি। পশ্চাৎ হইতে আমি একেবারে হিলিকে ধরিব। যদি হিলিকে গ্রেপ্তার করিতে সমর্থ হই, তাহা হইলেই মনে করিব, আমাদিগের সমস্ত কষ্ট ও পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। আমি যেমন হিলিকে ধরিব, ঠিক সেই সময় তোমরাও ওয়ার্নারকে ধরিবে। কিন্তু যদি দেখ যে, আমি একাকী হিলিকে পরাজয় করিতে পারিতেছি না, তখন তোমরা ওয়ার্নারকে ছাড়িয়া দিয়া আমার সাহায্য করিবে। এই সুযোগে যদি ওয়ার্নার পলায়, অথচ আমরা হিলিকে গ্রেপ্তার করিতে সমর্থ হই, তাহা হইলেও ক্ষতি নাই।” 

বোধ করি, ১০/১৫ সেকেণ্ডের মধ্যে এই পরামর্শ স্থির করিয়া, উহাদিগের নিকট একটি ছাতা লইয়া, আমি সাহেব—দ্বয়ের দিকে গমন করিলাম। কনষ্টেবল-দ্বয় সেই আম্রবৃক্ষের অন্তরালে গমন করিল। সেই সময়ে সাহেব-দ্বয় আমাদিগের অনেক নিকটবর্ত্তী হইয়াছিল। সাহেব-দ্বয়ের দিক্ আমার হস্তস্থিত সেই ছাতাটায় আবৃত করিয়া, উহাদিগের পার্শ্ব দিয়া পশ্চাদ্ভাগে গমন করিলাম। 

পশ্চাদ্ভাগে গমন করিয়াই, হস্তস্থিত ছাতা সেই স্থানে ফেলিয়া দিলাম, এবং চকিতের ন্যায় পশ্চাৎ হইতে আমার দুই বাহু দ্বারা বেষ্টন করিয়া, হিলির হস্তস্থিত বাঁশের সহিত তাহার দুই হস্ত ও কোমর একেবারে জড়াইয়া ধরিলাম। সেই সময় কনষ্টেবল-দ্বয় পূর্ব্বোক্ত লুকাইবার স্থান হইতে বহির্গত হইয়া, ওয়ার্নারকে ধরিয়া ফেলিল। সেই সময় আমি উচ্চৈঃস্বরে কনষ্টেবল-দ্বয়কে কহিতে লাগিলাম,—“শীঘ্র আমার ভিল্ভার দেও; সাহেবদ্বয়ের মধ্যে যে আমাদিগের হস্ত ছাড়াইয়া পলায়নের চেষ্টা করিবে, তাহাকে আমি এই স্থানে হত্যা করিয়া এই জঙ্গলের ভিতর রাখিয়া প্রস্থান করিব।” পাঠকগণকে বোধ হয় আর বলিয়া দিতে হইবে না যে, আমাদিগের নিকট রিভলবার বা অন্য কোন অস্ত্র ছিল না, কেবল উহাদিগকে ভয়-প্রদর্শন করাই আমার ইচ্ছা। আমার কথা শুনিয়া, ওয়ার্ণার কহিল,—“না বাবু, যখন ধরা পড়িয়াছি তখন আর পলাইতেছি না।” 

হিলি একজন বীরপুরুষ। আমি যেমন তাহাকে ধরিলাম, অমনি সে গ্রীবা ফিরাইয়া, রোষ-কষায়িত নেত্রে একবার আমাকে দেখিয়া লইল। দেখিয়াই, আমার হস্ত-বন্ধনের ভিতর হইতে প্রথমেই সে তাহার হস্তদ্বয় বাহির করিয়া লইবার বিশেষ চেষ্টা করিল, কিন্তু কোন ক্রমে সে তাহা পারিল না। তাহার হস্তের বাঁশ, তাহার পেট ও বুকের উপর পড়ায়, আমার পক্ষে অনেক সুবিধা হইয়াছিল বলিয়াই বোধ করি, সে হস্ত বাহির করিয়া লইতে কোন ক্রমেই সমর্থ হইল না। যখন দেখিল, আমার হস্ত হইতে তাহার হস্ত ছাড়াইবার আর উপায় নাই, তখন সে ঊর্দ্ধদেশে এক লম্ফ প্রদান করিল, ও আমাকে লইয়াই যেন দুই হস্ত ঊর্দ্ধে উঠিল। ইহাতেও আমার হস্তচ্যুতি হইল না। তখন সে সেই স্থানে মৃত্তিকার উপর আমার সহিত পড়িয়া গেল। সে নিম্নে পড়িল, আমি তাহার উপরে। সেই সময় প্রায় পাঁচ মিনিট কাল আমাদের উভয়ের এক প্রকার মল্লযুদ্ধ হইল; কখন সে আমার উপরে, কখন আমি তাহার উপরে। তাহার চেষ্টা,—আমার হস্ত কোনরূপে ছাড়াইয়া লয়; আর আমার ইচ্ছা যে, উহাকে বিশেষ কায়দার সহিত ধরিয়া রাখি—যেন আমার হস্ত কোন প্রকারে শিথিল না হয়। সেই সময়ে কি জানি, কিরূপে আমার নাসিকায়, ভয়ানক আঘাত লাগিল। ঝর্ ঝর্ করিয়া নাসিকা দিয়া রক্তধারা বহির্গত হইয়া, আমার কামিজের সম্মুখভাগ রঞ্জিত হইল, হিলির কাল কোটের কোন কোন স্থানে ভিজিয়া গেল; তথাপি আমি তাহাকে পরিত্যাগ করিলাম না, প্রাণপণে তাহাকে আমার আয়ত্বাধীন করিবার চেষ্টাই করিতে লাগিলাম। এইরূপে প্রায় পাঁচ মিনিটকাল অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু কোন প্রকারেই আমি উহাকে কায়দা করিতে পারিলাম না, বা হিলিও আমার হাত ছাড়াইতে পারিল না। 

যে দুইজন কনষ্টেবল ওয়ার্নারের হাত ধরিয়া সেইস্থানে দাঁড়াইয়াছিল, তখন তাহাদিগের মধ্যে একজন আমার সাহায্য করিবার নিমিত্ত আগমন করিল। সে আসিয়াই হিলির চুল চাপিয়া ধরিল। হিলি আর মস্তক উত্তোলন করিতে পারিল না, বা আর বল-পূর্ব্বক আমার নিম্নে ফেলিতেও সমর্থ হইল না। এই সময় আমি জুতা-সহিত আমার পা কৌশলপূর্বক উহার মস্তকের নিকট লইয়া, ক্রমে উক্ত পা উহার গলদেশে স্থাপন-পূর্ব্বক সবিশেষরূপে চাপিয়া ধরিলাম। এবার হিলি বিলক্ষণ কায়দায় পড়িল। তাহার জিহ্বা বাহির হইল, আর ভালরূপে কথা কহিতে সে সমর্থ হইল না। বলিতে কি, এদেশীয় কোন লোকের গলা যদি কেহ সেইরূপ জুতা-সহিত পায়ের দ্বারা জোর করিয়া চাপিয়া ধরে, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, তাহার জীবন কোন প্রকারেই রক্ষিত হয় না। হিলি বিলাতি গোরা, কাজে 

কাজেই সে মরিল না। সেই সময় গোঙাইতে গোঙাইতে সে আমাকে কহিল, “আমি পরাজয় মানিলাম, আমি আপনার নিকট বশ্যতা স্বীকার করিলাম, এখন আপনি ত আমাকে ছাড়িয়া দিন।” হিলির কথা শুনিয়া আমি তাহাকে সগৰ্ব্বে কহিলাম, “কি! আমি তোমাকে ছাড়িয়া দিব, আর তুমি পলায়ন করিবে? আমি এখন তোমাকে এইস্থানে হত্যা করিয়া, আমার পরিশ্রমের সার্থকতালাভ করিব।” আমার কথা শুনিয়া, হিলি পুনরায় অতি মৃদুস্বরে গোঙাইতে গোঙাইতে কহিল, “আমি ইংলণ্ডবাসী, তুমি আমার কথা অনায়াসে বিশ্বাস করিতে পার। আমরা মুখে যে প্রতিজ্ঞা করিব, কার্য্যে তাহার অন্যথা করিব না। আমি তোমাকে ঈশ্বরের দিব্য দিয়া কহিতেছি যে, তুমি আমাকে মারিও না, আমি তোমার শরণাপন্ন হইলাম। আমাকে ছাড়িয়া দেও, আমি খৃষ্টান হইয়া আমার ধর্ম্মের দিব্য করিয়া কহিতেছি, যে, আমি যে পর্য্যন্ত তোমার কর্তৃত্বাধীনে থাকিব, সেই পর্য্যন্ত আমি পলায়নের চেষ্টা করিব না, বা পলাইব না।” 

হিলির কথা শুনিয়া একবার ভাবিলাম, উহার কথায় বিশ্বাস করিয়া একেবারে ছাড়িয়া দেওয়া উচিত নহে। কিন্তু পরক্ষণেই আমার মনে হইল, উহার কথায় বিশ্বাস না করিয়াই বা কি করি। এখন উহাকে একেবারে ছাড়িয়া না দিলে; কি প্রকারেই বাবু উহাকে আয়ত্বাধীন করিব এবং কি প্রকারেই বা উহাকে সেই নিবিড় জঙ্গলের ভিতর হইতে বাহির করিয়া লইয়া যাইব। সুতরাং এইরূপ অবস্থাতে আমি হিলির কথায় বিশ্বাস করিলাম; তাহাকে মুহূর্তের নিমিত্ত ছাড়িয়া দিয়া, আমার চাদরখানি, যাহা সেইস্থানে পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা কুড়াইয়া লইয়া তাহারই দ্বারা তাহার দুই বাহুর উপর পশ্চাৎ হইতে এরূপভাবে বাঁধিয়া দিলাম যে, আর তাহার হস্ত উত্তোলন করিবার উপায় রহিল না। সে সেইস্থানেই মৃতের ন্যায় পড়িয়া হাঁপাইতে লাগিল। ওয়ার্নারের ভাগ্যও হিলির ভাগ্যের সমতুল হইল। কনষ্টেবলদিগের একখানি চাদির দিয়া, তাহাকেও সেইরূপে বন্ধন করিলাম। হিলিকে পরিশেষে উঠাইয়া দিলাম; কিন্তু হিলি উত্তমরূপে দাঁড়াইতে পারিল না। আমাদিগের পরস্পরের জড়াজড়ির সময় আমার নাকে যেমন আঘাত পাইয়াছিলাম, হিলিও তাহার গায়ে সেইরূপ আঘাত প্রাপ্ত হয়। যাহা হউক, তাহাকে উঠাইয়া আমরা উভয়কেই জামকুড়ির সেই বাজারে লইয়া গেলাম। 

একখানি দোকানের সম্মুখে উহাদিগকে বসাইলাম। ওয়ার্নার বসিয়া রহিল, হিলি শুইয়া পড়িল। দেখিলাম, হিলির সেই মোটা কোর্ট ঘর্ম্মে ভিজিয়া গিয়াছে, তাহার লাল মুখ একেবারে সাদা হইয়া পড়িয়াছে। বুঝিলাম, এরূপ অবস্থা হওয়ার কারণ—কতক পরিশ্রম, কতক কালা লোকের নিকট বিশেষ অপমানের সহিত পরাজয় স্বীকার। 

হিলির কোট খুলিয়া ফেলিলাম। একটা লোককে কিছু প্রদান করায়, সে একখানি পাখা আনিয়া উহাদিগকে বাতাস করিতে লাগিল। আমিও আমার পিরান খুলিয়া সেইস্থানে বসিলাম। ঘর্ম্মে আমারও সমস্ত শরীর একবারে ভিজিয়া গিয়াছিল। দোকান হইতে একটু জল লইয়া আমার রক্ত সকল ধুইয়া ফেলিলাম, ও হস্তপদ প্রক্ষালন করিলাম। প্রায় অর্দ্ধ-ঘণ্টাকাল এইরূপে সেইস্থানে অতিবাহিত করায়, সকলেই একটু সুস্থির হইলাম। 

সেইস্থান হইতে পুলিসের ফাড়ী অধিকদূর নহে,—প্রায় দুই মাইল হইবে। সেই বাজার হইতে ফাঁড়ীতে সংবাদ পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত একটি লোকের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু প্রথমে কেহই গমন করিতে সম্মত হইল না। পরিশেষে এই সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত একটি টাকা প্রদান করিলে, একজন দোকানদার গমন করিতে স্বীকৃত হইল। তাহাকে সমস্ত অবস্থা বলিয়া পরিশেষে সেই ফাড়ীর কর্ম্মচারীকে হাতকড়ি ও লোকজনের সহিত আগমন করিতে বলিয়া দিলাম; দোকানদার গমন করিল। দিবা সাড়ে চারিটার সময় ফাঁড়ীদার হাত-কড়ি ও আট দশজন ঘাটোয়ালকে লইয়া আগমন করিল। সেই সময় হিলি ও ওয়ার্নারের হাতের বন্ধন খুলিয়া দিয়া, সেই একজোড়া হাত-কড়িতেই উভয়কেই আবদ্ধ করিলাম। ফাড়ীদার ও ঘাটোয়ালগণ তাহাদিগকে ফাঁড়ীতে লইয়া চলিল; আমরাও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। পাঁচটার কিছু পরেই আমরা সকলে সেইস্থানে উপনীত হইলাম। 

ফাঁড়িদারটি বেশ ভদ্রলোক। কয়েকদিবস আমাদিগের আহার হয় নাই জানিয়া, তিনি আহারের উদ্যোগ করিলেন। একজন মুসলমানকে ডাকাইয়া, তাহা দ্বারা সাহেবদিগের নিমিত্ত মুরগি, এবং রুটি প্রস্তুত করান হইল। সাহেবদ্বয় পরিতৃপ্তির সহিত আহার করিল, তাহার উপর দুগ্ধ পান করিয়া আমাদিগকে ধন্যবাদ দিতে লাগিল সেই সময় হিলি আমাকে কহিল, “বাবু! যখুন আপনি আমাকে ধৃত করেন, সেই সময় আমার হাত বন্ধ করিয়া আপনি অতিশয় বুদ্ধির কার্য্য করিয়াছিলেন। কারণ, যদি আমি আমার হস্ত খোলা পাইতাম, তাহা হইলে আপনার অদৃষ্টে যে কি হইত, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি আমার এই হস্তদ্বারা প্রস্তর ভাঙ্গিতে পারি। তাহার উপর আমার হাতে এই বাঁশ ছিল! একটু সুযোগ পাইলেই এই হস্ত দ্বারা আপনার মস্তক চূর্ণ করিতাম।” 

এ পর্যন্ত আমার স্নান হয় নাই, ফাঁড়ীর নিকটে একটি পুষ্করিণী ছিল। স্নান করিবার নিমিত্ত আমি তাহাতে নামিলাম। কয়েকদিবস পরে উত্তমরূপে স্নান করিয়া, শরীরের ক্লান্তি দূর করিলাম। কিন্তু জল হইতে উঠিয়াই দেখিলাম, আমার আর চলৎশক্তি নাই, পায়ের নীচে ফোস্কায় পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। কি করি—অনেক কষ্টে ফাড়ীতে আসিলাম। আর এক পদও অগ্রসর হইবার উপায় নাই! আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত হইলে, যে স্থানে বসিয়াছিলাম, সেইস্থানে বসিয়াই আহার করিলাম। 

সন্ধ্যার পরেই দুইখানি গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া আনান হইল ও প্রায় ত্রিশজন ঘাটোয়াল আসিয়া একত্র হইল। একখানি গাড়ির উপর সাহেবদ্বয়কে লম্বা করিয়া শোয়াইলাম, এবং গাড়ির দড়া দিয়া জড়াইয়া উভয়কেই সেই গাড়ির সহিত বাঁধিলাম, অর্থাৎ গরুর গাড়িতে দুইখানি লম্বা কাষ্ঠ বোঝাই করিতে হইলে, যেরূপে বাঁধিয়া থাকে, সেইরূপ ভাবেই বাঁধা হইল। সেই গাড়ির সম্মুখে এবং পশ্চাতে সেই কনষ্টেবলদ্বয় বসিল। তাহার পশ্চাৎ অপর গাড়িতে আমি আরোহণ করিলাম; আর সেই ত্রিশজন ঘাটোয়াল উভয় গাড়ি বেষ্টন করিয়া চলিল। সেই দু’খানা গাড়ি ঘোড়ার গাড়ি অপেক্ষাও দ্রুতগতিতে চলিতে লাগিল। কারণ, ঘাটোয়ালগণ সেই গাড়ি দু’খানাকে একরূপ ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। সমস্ত রাত্রি চলিয়া, তাহার পরদিবস আমরা বর্দ্ধমান-ষ্টেশনে আসিয়া উপনীত হইলাম। গাড়ির উপর বন্ধনাবস্থায় সাহেব রহিয়াছেন দেখিয়া, পথে লোকে লোকারণ্য হইতে লাগিল। বোধ হইল, যেন তাহারা কি নূতন কাণ্ড দেখিতেছে। অনেকে সাহেবদ্বয়কে দেখিতে দেখিতে আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে ষ্টেশন পর্যন্ত গমন করিল। সকলের নিকট ইহাদিগের পরিচয় দিতে দিতে, আমার মুখ বেদনা করিতে লাগিল। 

[* “ওয়ার্নার ও হিলি দুই জনেই বৃটিশ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ওয়ার্নার বুদ্ধিমান্ ও চতুর। পূর্ব্বে সেলাই কলের সিঙ্গার কোম্পানীর বড় কর্ম্মচারী ছিল। তহবিল ভাঙ্গিয়া ব্রহ্মে পলায়ন করে। গ্রেপ্তার হইয়া জেলে যায়। কলিকাতার বড় জেলে বন্দী হইয়া থাকে। হিলি ওরফে মার্টন যেমন বলবান্, সেইরূপ সাহসী, আবার সেইরূপ চতুর। কোথা হইতে কলিকাতায় আসিয়া রাণীমুদীর গলি তোলপাড় করিয়া দিয়াছিল। এমন বাড়ী নাই, যে বাড়ীতে ইহাঁর নৈশ শুভাগমন হয় নাই। বাড়ী বাড়ী বেড়াইয়া, ছাদে ছাদে দৌড়িয়া, টাকা কড়ি, চেন ঘড়ী, যে কত চুরী করিয়াছিল, তাহার ঠিকানা নাই। যাহাই হউক, শেষে হইাকেও গিয়া কলিকাতার বড় জেলে বন্দী হইয়া থাকিতে হয়। 

বন্দি-জীবন কিন্তু দুই জনেরই অসহ্য হইল। হিলিই প্রধান অভিনেতা। কারাপক্ষী শিকল কাটিল। খাঁচা ভাঙ্গিয়া বাহির হইল। টেবিলচেয়ার টুল প্রভৃতির সাহায্য সোপান করিয়া কারাগারের উত্তুঙ্গ প্রাচীর উত্তীর্ণ হইল। পলাইবার সময় ওয়ার্নারকে সঙ্গে লইল। তাহার পর কোথায় গেল, কেহ জানিতে পারিল না। চারিদিকে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। কারাগারের রক্ষিপুরুষেরা যখন দেখিয়াও কিছু করিতে পারেন নাই, তখন আর সহজে তাহাদিগকে ধরে কাহার সাধ্য! 

রেলে খবর হইল, বন্দরে খবর হইল, চারি দিকে ‘তার’ চলিল, কলিকাতায় তোলপাড় লাগিল। এখানে ওখানে ভূতের ভয়ের মত ভয় হইল। তালতলায় অপদেবতার আবির্ভাব হইল। “এই হিলি! ঐ ওয়ার্নার!” চারি দিকেই ধর্ ধর্ শব্দ। কিন্তু ধরিবার লোক নাই। 

পুলিসের সাহেবেরা কেবল সহরেই সাজেগোজেন। পক্ষী ধরিবার ভার পড়িল, গোয়েন্দা পুলিসের সেই সামান্য সর্ ইনস্পেক্টার প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের উপর। কিন্তু শুদ্ধ বাঙ্গালীর উপর নির্ভর করিয়া থাকা ত আর উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজপুরুষদিগের অভ্যস্ত নহে। তাই একদিকে প্রিয়নাথকে পাঠাইয়া, অন্যদিকে দুই জন সাহেব ইনস্পেক্টারের উপরও আসামি অনুসন্ধানের আদেশ হইল। ইনস্পেক্টার ফোর্সাইথ এবং ডেভিসও আসরে অবতীর্ণ হইলেন। 

ফোর্সাইথ ও ডেভিস আসরে অবতীর্ণ হইলেন বটে, কিন্তু একবার দেখা দিয়া গা ঢাকা হইলেন। প্রিয়নাথ হুগলী ও চন্দননগরে আসামীদের সন্ধান না পাইয়া, বৰ্দ্ধমান যাত্রা করিলেন। ওদিকে ফোর্সাইথ এবং ডেভিসও বৰ্দ্ধমানে উপস্থিত। প্রিয়নাথ সন্ধান পাইলেন, হিলি এবং ওয়ার্নার মেমারিতে আছে। প্রিয়নাথ ফোর্সাইথের সঙ্গে মেমারি যাত্রা করিলেন। ডেভিস সেখানে তাহার পরে হাজির হইয়াছিলেন। কিন্তু কারা পক্ষীদিগের সেখানে কোন সন্ধান হইল না। সাহেব ইনস্পেক্টারযুগল কি আর বৃথা কষ্ট সহ্য করিতে পারেন? তাঁহারা বর্দ্ধমানে গিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। প্রিয়নাথ পাখী ধরিবার জন্য ব্যস্ত হইল। 

হিলি এবং ওয়ার্নারও পাকা পাখী। এই এক গ্রামে, পরক্ষণেই অন্য গ্রামে; এই ওদিকে, পরক্ষণেই অন্য দিকে। কখন যে কোনদিকে গতি, তাহা স্থির করা অসম্ভব। প্রিয়নাথ কিন্তু কিছুতেই ছাড়িবার পাত্র নহেন। পক্ষিদ্বয় যত উড়িতে থাকিল, তিনিও ততই দৌড়িতে লাগিলেন। এইরূপ ধাবন ও অনুধাবনে তাঁহাকে শেষে বাঁকুড়া পৰ্য্যন্ত যাইতে হইল। বাঁকুড়া জেলার সুশুনী পাহাড়ের কাছে জামকুড়ী নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে গিয়া প্রিয়নাথ ও ওয়ার্নার দুই জনকেই এক সঙ্গে দেখিতে পাইলেন। প্রিয়নাথের  সঙ্গে কেবল দুইজন গ্রাম্য চৌকিদার। ফোর্সাইথ ও ডেভিসের সঙ্গে থাকা উচিত ছিল কি না, তাহা কলিকাতার ডেপুটি কমিশনের ল্যাম্বার্ট সাহেব স্থির করিবেন। আর আমাদের সূক্ষ্মদর্শী ছোট লাটভ তাহার বিচার করিবেন। 

হিলি ভীমের মত বলবান, অপিচ বৃটিশ। ওয়ার্নার ও হিলি দুই জনের হাতেই বৃহৎ বংশনিৰ্ম্মিত যষ্ঠি। কিন্তু প্রিয়নাথ নেটীব হইলেও কর্তব্যনিষ্ঠ। প্রাণ যায় সেও স্বীকার তথাপি আসামী গ্রেপ্তার করিতে হইবে। একাকী অসম সাহসে ভর করিয়া, তিনি একলম্ফে গিয়া হস্তিরূপী হিলিকে আক্রমণ করিলেন। হিলিও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। দুইজনে ঘোর দ্বন্দ্বযুদ্ধ হইতে লাগিল। বীর বৃটিশে আর ভীরু নেটিরে যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখিতে পাইলে আমাদের নয়ন সার্থক হইত। যে গ্রাম্য চৌকিদারদিগকে অকৰ্ম্মণ্য বলিয়া এংলো-ইণ্ডিয়ান রাজপুরুষদিগের স্থির বিশ্বাস, যাহাদিগের নিন্দা না করিয়া সরকারী রিপোর্ট লেখকেরা জলগ্রহণ করেন না; ওদিকে সেই গ্রাম্য চৌকীদারসম্প্রদায়ের দুইটি হতভাগা গিয়া ওয়ার্নারকে কায়দা করিল। বৃটিশ বীর হিলি প্রিয়নাথ কর্তৃক পরাজিত হইল, শোণিতাক্ত প্রিয়নাথের বাহু-পিঞ্জরে কারাব্যাঘ্র আবদ্ধ হইল। বড়ই সুখের বিষয় বড় আহ্লাদের কথা। 

ওয়ার্নার ও হিলি কলিকাতায় আনীত হইয়াছে। হিলি আসিয়াই ডেপুটি কমিশনরের কাছে বাঙ্গালী পুলিস কর্মচারী প্রিয়নাথের শত মুখে সুখ্যাতি করিয়াছে। বলিয়াছেন যে ব্যক্তি আমার মত লোককে একাকী গ্রেপ্তার করিয়াছে সে বড় সাধারণ লোক নহে। তাহার পৌরুষ ও বুদ্ধি অসাধারণ।” বস্তুতও সকলেই দেখিতেছেন সামান্য সাব ইনস্পেক্টার প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় যে অসাধারণ কার্য্য করিয়াছেন, তাহা বড় বড় বীর বৃটিশদিগেরও অসাধ্য। ফোর্সাইথ ও ডেভিস যে কাৰ্য্য অসাধ্য বলিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, প্রিয়নাথ সেই কার্য্য সিদ্ধ করিয়াছেন। ইহার বাড়া আহ্লাদের বিষয় আর কি হইতে পারে? সার স্টুয়ার্টের শাসনে গুণের পুরস্কার অবশ্যই হইবে।” 

দৈনিক ও সমাচার চন্দ্রিকা। ৫ই চৈত্র, সন ১২৯৫ সাল।]

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ 

১২ই মার্চ তারিখের দিবা দশটার সময় বৰ্দ্ধমান-ষ্টেশনে আসিয়া উপনীত হইলাম। প্রথমেই কলিকাতায় এই মৰ্ম্মে এক টেলিগ্রাম করিলাম,—“ পলাতক সাহেবদ্বয়কে আমি বাঁকুড়া জেলার ভিতর গ্রেপ্তার করিয়া, বৰ্দ্ধমান—ষ্টেশনে আসিয়া উপনীত হইয়াছি।” কলিকাতায় সংবাদ প্রেরণের পর ভাবিলাম যে, যখন আমি বৰ্দ্ধমান-ষ্টেশনে আসিয়া উপনীত হইয়াছি, তখন এইস্থানের প্রধান পুলিস কর্ম্মচারীকে সংবাদ দেওয়া উচিত। এই ভাবিয়া একখানি পত্র লিখিয়া সেইস্থানের পুলিসের বড় সাহেব কর্ণেল হিউমের নিকট পাঠাইয়া দিলাম। আমার পত্র পাইবামাত্র অশ্বপৃষ্ঠে কর্ণেল সাহেব ষ্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং প্রথমেই হিলি ও ওয়ার্নার সাহেবকে দেখিলেন। সেই সময় তাহারা কেনার কোম্পানির হোটেলে বসিয়া আহার করিতেছিল, আর আমি সেইস্থানে বসিয়া তাহাদিগের উপর পাহারা দিতেছিলাম। কর্ণেল সাহেব পরিশেষে আমাকেই জিজ্ঞাসা করিলেন, যে, “ইহাদিগের ধৃতকারী প্রিয়নাথবাবু কোথায়?” উত্তরে আমি কহিলাম, “আমারই নাম প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়।” তখন তিনি আমার পৃষ্ঠে দুই চারিবার করাঘাত করিয়া, বারবার আমাকে প্রশংসা ও ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। পরিশেষে আদ্যোপাত্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন, এবং কহিলেন “বঙ্গদেশীয় লোক যে বিনা আহার নিদ্রার এতদূর কষ্ট-স্বীকার করিতে পারে তাহা আমি এই প্রথম অবগত হইলাম।” 

কর্ণেল সাহেব পরিশেষে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইঁহাদিগের গ্রেপ্তার সম্বন্ধে কলিকাতায় কোন সংবাদ প্রদান করিয়াছ কি?” 

আমি। হাঁ মহাশয়, আমি সংবাদ প্রেরণ করিয়াছি। 

কর্ণেল। কিরূপ সংবাদ প্রদান করিয়াছ? 

আমি। আমি এই টেলিগ্রাফ করিয়াছি যে, পলাতক সাহেবদ্বয়কে আমি বাঁকুড়া জেলার ভিতর গ্রেপ্তার করিয়া বৰ্দ্ধমান-ষ্টেশনে আসিয়া উপনীত হইয়াছি। 

কর্ণেল। এ ঠিক সংবাদ হয় নাই আমি সংবাদ প্রেরণ করিতেছি। 

এই বলিয়া তিনি নিম্নলিখিত-রূপ টেলিগ্রাফ করিলেন; “আপনার পুলিসের কর্ম্মচারী প্রিয়নাথবাবু, ওয়ার্নার ও হিলিকে বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত জামকুড়ি গ্রামের নিকটবর্তী স্থানে গ্রেপ্তার করিয়া, এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। আমি নিজে উপস্থিত থাকিয়া তাঁহাদিগকে পাঠাইয়া দিবার বন্দোবস্ত করিতেছি। দিবা চারি ঘটিকার সময় উপযুক্ত পরিমাণ লোকজনের সহিত হাবড়া-ষ্টেশনে উপস্থিত থাকিবেন।” 

কর্ণেল। তোমার নিকট খরচের উপযুক্ত পরিমাণ টাকা আছে কি না? যদি না থাকে, আমি এখন প্রদান করি; পরে কলিকাতা হইতে আনাইয়া লইব। 

আমি। খরচের টাকার অনাটন হইবে না, আমার নিকট টাকা আছে। 

পাঠকগণকে পূর্ব্বে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, আমার নিকট যে টাকা ছিল, তাহার সমস্তই শেষ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আসামীদ্বয়কে ধৃত করিয়া তাহাদের পকেট অনুসন্ধান করিয়া প্রায় ২৫/৩০ টাকা পাইয়াছিলাম; এবং সেই টাকা খরচ করিয়া আসিতেছি। 

কর্ণেল। টাকার সাহায্য তুমি প্রার্থনা কর না। উহাদিগকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে যদি কতকগুলি লোকের সাহায্য প্রার্থনা কর; তাহা বল। 

আমি। লোকের আর আবশ্যকতা কি? আমি নিজেই আছি, ও আপনার অধীনের জামালপুর থানার দুইজন কনষ্টেবল আছে। বিশেষত রেলের গাড়িতে গমন করিব, অত লোক আর কি হইবে? 

কর্ণেল। তুমি ইহাদিগকে সবিশেষ জান না দেখিতেছি। এরূপ ভয়ানক লোক আর নাই। এরূপ কয়েদীকে বিশেষ সতর্কতার সহিত লইয়া যাওয়া উচিত। কারণ, উহারা পুনরায় পলায়ন করিতে পারে। 

আমি। যখন জঙ্গলের ভিতর হইতে উহাদিগকে এখান পৰ্য্যন্ত আনিতে সমর্থ হইয়াছি, তখন বোধ হয়, পলাইবার ভয় আর নাই। 

কর্ণেল। তুমি ছেলেমানুষ; এই বৃদ্ধের কথায়, অবহেলা করিও না। আমি কিরূপ বন্দোবস্ত করিয়া দিই, দেখ।

এই বলিয়া ট্রেন আগমন করিলে। তৃতীয় শ্রেণী গাড়ির একখানি কম্পার্টমেন্ট একেবারে ভাড়া করিয়া লৌহ রেল দ্বারা উহা এরূপভাবে ঘিরিয়া দিলেন যে, তাহার ভিতর হইতে আর কাহারও বাহির হইবার উপায় রহিল না। তিন-চারিটি ভয়ানক সিংহ একত্ৰ লইয়া যাইবার নিমিত্ত সেইরূপ ঘেরা হয় কিনা সন্দেহ! কর্ণেল সাহেব প্রথমে আমাকে গাড়ির ভিতর উঠাইয়া দিলেন। তাহার পর সাহেবদ্বয়, তৎ পশ্চাৎ সাতজন পুলিস কর্ম্মচারী অর্থাৎ জাল ফিরিক বাঁধিয়া একজন সাব ইনস্পেক্টার, উন্মুক্ত তরবারি হস্তে দুইজন হেড কনষ্টেবল এবং সঙ্গীন বন্দুক লইয়া চারিজন কনষ্টেবল। সকলে গাড়ির ভিতর উঠিলে, দুইটি উৎকৃষ্ট তালা দ্বারা সেই লৌহদ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া তাহার একটি চাবি আমার হস্তে দিলেন, আর অপরটি গার্ড সাহেবের হস্তে দিলেন। এরূপ বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া, কর্নেল সাহেব যে পৰ্য্যন্ত আমাদিগের গাড়ি বর্ধমান-স্টেশন হইতে না ছাড়িল, সে পৰ্য্যন্ত সেইস্থানেই দাঁড়াইয়া রইলেন। 

ক্রমে গাড়ি হাবড়া স্টেশনে উপস্থিত হইল। দেখিলাম, একজন প্রধান ইংরাজ কৰ্ম্মচারী আটজন অধীনস্থ ইংরাজ কর্ম্মচারীর সহিত সেইস্থানে আমাদিগের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান। সকলেই উত্তম সজ্জায় ও অস্ত্র শস্ত্রে শোভিত। গাড়ি যেমন থামিল, অমনি সর্বাগ্রে আমাদিগের গাড়ির দরজা খুলিয়া সেই ইংরাজ কর্মচারীগণ আমাদিগকে নামাইয়া লইলেন। পূৰ্ব্ব হইতেই সেইস্থানে কয়েকখানি ঘোড়ার গাড়ি রাখা হইয়াছিল; সকলেই সেই সকল গাড়িতে আরোহণ পূর্ব্বক লালবাজার অভিমুখে চলিলাম। দেখিতে দেখিতে গাড়ি আসিয়া লালবাজারে উপনীত হইল। 

সেই প্রধান কৰ্ম্মচারী সকলকে লইয়া সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট গমন করিলেন। সেই সময় সৰ্ব্বপ্রধান কর্মচারীর সহিত হিলির দুই একটী কথা হইয়াছিল; তাহা বোধ হয় সকলেই জানিতে ইচ্ছুক। 

সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী। তুমি কেমন বোধ করিতেছ, হিলি? 

হিলি। বোধ আর কি করিব? কিন্তু আমি তোমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি। 

সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী। তুমি ধরা পড়িয়াছ বলিয়া আমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতেছ? 

হিলি। আমি ধরা পড়িয়াছি বলিয়া তোমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি না। (আমাকে দেখাইয়া দিয়া) তোমার পুলিসের ভিতর যে এই একজন কর্ম্মচারী আছেন, এই নিমিত্ত আমি তোমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি। 

সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী। কেন এই কর্ম্মচারী ভিন্ন কি আর কেহ তোমাকে ধরিতে পারিত না? 

হিলি। না, নিশ্চয়ই না। বিলাতে আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অনেক ভাল ভাল ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী ঘুরিয়াছেন; কিন্তু, আমাকে কেহই কখনও ধরিতে সমর্থ হন নাই। বলিতে কি, আপনার এই কর্ম্মচারীর মত একজন ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী আমাদিগের ইংলণ্ডের কোনস্থানের পুলিসেও নাই। বাঙ্গালীর যে এত সাহস ও ধৈর্য্য আছে, তাহা আমি পূৰ্ব্বে কখনও জানিতাম না। 

সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী। আমার অনেক ভাল ভাল ইংরাজ কৰ্ম্মচারী আছে; তাহাদিগকেও আমি তোমাদিগের অনুসন্ধানে পাঠাইয়াছি। তাহারা নিশ্চয়ই তোমাকে ধরিয়া আনিতে সমর্থ। 

হিলি। না, কখনই না। এ প্রদেশে এমন কোন ইংরাজ কৰ্ম্মচারী নাই যে, সে আমাকে ধরিতে পারে। কারণ, যেস্থানে আমি ধৃত হইয়াছি, তাহার নিকটবর্তী কোনস্থানে কোন শ্বেতমনুষ্য দেখিলে আমি কি পলাইতাম? আমি প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইতাম। আমার নিকট যে বাঁশ ছিল, তাহারই এক এক আঘাতে তাহাদের মস্তক চূর্ণ করিতাম। 

সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী। তুমি জান যে, আমার ইংরাজ কর্মচারীমাত্রই পিস্তল সহ তোমাদিগের অন্বেষণে বহির্গত হইয়াছিল; দূর হইতে তোমাকে জখম করিয়া, পরিশেষে ধৃত করিত। 

হিলি। ওঃ! তা’ আমি জানি। রিভল্ভারের সামান্য গুলিতে কি আপনি মনে করেন, আমাকে জখম করিতে পারে? দেখুন দেখি, আমার শরীরের কতস্থানে কত বড় বড় গুলি প্রবেশের চিহ্ন এখনও পর্য্যন্ত বিদ্যমান আছে। 

এই বলিয়া হিলি, আপনার অঙ্গস্থিত কোট খুলিয়া তাঁহাকে গা’ দেখাইল। তিনি আর কিছু না বলিয়া, সেই প্রধান কৰ্ম্মচারীকে কহিলেন, “ইহাদিগকে এ স্থান হইতে লইয়া গিয়া উত্তমরূপে বন্দোবস্তের সহিত রাখিয়া দেওয়া হউক।” কর্মচারী তাহাই করিলেন। তাহারা রীতিমত কয়েদগৃহে আবদ্ধ হইল; ভিতরে বাহিরে ইংরাজ প্রহরীর পাহারা পড়িল। 

সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী পুনরায় আমাকে একাকী ডাকাইলেন। আমি কিরূপে উহাদের সন্ধান পাইলাম, এবং কিরূপেই বা উহাদিগকে ধৃত করিলাম, তাহা আনুপূর্ব্বিক আমার নিকট শ্রবণ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। বাঁকুড়া ও বর্দ্ধমান জেলার ‘ম্যাপ’ বাহির করিয়া, কোন্ কোন্ গ্রাম দিয়া আমি গমন করিয়াছি, তাহা অবগত হইয়া মাপিয়া দেখিলেন যে, আমি ৮০০ ঘণ্টাকাল ক্ৰমাগত চলিয়া প্রায় ১৮০ মাইল পথ গমন করিয়া সাহেবদিগকে ধরিতে সমর্থ হইয়াছি। এত পথ হাঁটিয়া গমন করিয়াছিলাম শুনিয়া, তিনি সবিশেষ আশ্চর্যান্বিত ও সন্তুষ্ট হইলেন, এবং পরিশেষে আমাকে নগদ ২০০ শত টাকা পারিতোষিক প্রদান করিলেন। অধিকন্তু, তিনি এই সকল বিবরণ গবর্ণমেণ্টে লিখিয়া পাঠাইলেন, তাহাতে লেফটেনান্ট গবর্ণর সাহেব ৩০০ তিনশত টাকা ম্যুলার চেন, ঘড়ী ও একখানি প্রশংসাপত্র আমাকে প্রদান করিলেন। 

আমি যে সময় সাহেবদ্বয়কে ধৃত করিয়া কলিকাতায় আগমন করি, সেই সময় আমার বড় সাহেব কলিকাতায় ছিলেন না; তিনিও উহাদিগের অনুসন্ধানে বর্দ্ধমান-জেলার ভিতর ছিলেন। তিনি প্রত্যাগমন পূর্ব্বক আমার উপর বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন, এবং তাঁহার অঙ্গুলি হইতে অঙ্গুরীয় মোচন করিয়া আমার অঙ্গুলিতে পরাইয়া দিলেন। 

আমি পারিতোষিক পাইলাম বলিয়া, যে অপরাপর আর কেহ কোনরূপ পারিতোষিক পাইল না, তাহা নহে। শ্রীরামপুরের ষ্টেশনমাষ্টার প্রথমেই আমাকে যে সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার নিমিত্ত তিনি পারিতোষিক পাইলেন। মেমারি ষ্টেশনের সিগনলার, যিনি আমাকে মেমারি ষ্টেশনে প্রথম সংবাদ প্রদান করেন, তাহাকেও গবর্ণমেণ্ট কিছু অর্থ প্রদান করিলেন, এবং যে কনষ্টেবলদ্বয় আদ্যোপান্ত আমার সহিত থাকিয়া আমাকে সবিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছিল, তাহাদিগকে উপযুক্ত পারিতোষিক প্রদান করিতে আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী বিস্মৃত হইলেন না। বলা বাহুল্য এই বিষয় লইয়া সেই সময় প্রায় সকল সংবাদপত্রেই তুমুল আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছিল। কোন কোন সংবাদপত্র হইতে তাহার কথঞ্চিৎ উদ্ধৃত হইল। সমুদায় উদ্ধৃত করিলে স্বতন্ত্র একখানি পুস্তক হয়। 

[THE B. STYLE OF JACK SHEPHARD, two prisoners, named Healey and warner, broke out of the Presidencey Jail on the 5th instant, and althouth datected in the act of escaping, and pursued with hue and cry, got clear away.** 

*Great, therefore, was the surprise when day after day passed, and nothing was heard of the missing men, even although a reward of Rs. 400 had been offered for information that would lead to their apprehension. The belief was beginning to gain ground that the police had been outwitted, and that the wild daring which had set at naught the bolts and bars and shackles of the Presidency Jail was seconded by qualities of craft and resource worthy of a better cause. But the runaways were by no means so completely masters of the game as was supposed and on Monday they were fairly captured by Sub-inspector Preonath Mukerji, at—tached to the Calcutta Detective police. A violent scrimmage took place, in the course of which the Sub-Inspector was rather badly hurt. They were still in their Jail dress, Healey being without his helmet, which he had dropped when escaping from prison. They reached Calcutta yesterday, and were placed before the Deputy Commisioner of police, where Healey lavished gratuitous compliments on the Sub-Inspector. He was the most Plucky Native whom Healey had ever know, and his conduct could not have been better if he had been a Euro—pean; while after the capture he had acted with great kindness. The Doputy Commissioner was no doudt deeply affected by the chivalry of the convict in thus bearing testimony to the delicacy and humanity of his captor. Still, without Healey’s testimonial, the Sub-Inspector deserves some reward for his highly successful achievement. 

THE ENGLISHMAN. 13-3-1889]

উপসংহার 

সময়মত ইংরাজ আসামীদ্বয় জেল হইতে পলায়ন অপরাধে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। কিন্তু মাজিষ্ট্রেট সাহেব কয়েদীদিগের উপর দোষারোপ না করিয়া, জেলের বন্দোবস্তের উপর দোষারোপ করিয়া, যে কয়েক দিবস তাহারা বাহিরে ছিল, অর্থাৎ কেবল ছয়দিনমাত্র উহাদিগের মেয়াদের পরিমাণ বাড়াইয়া দিলেন। 

যে জল হইতে ওয়ার্নার ও হিলি পলায়ন করিয়াছিল, পুনরায় তাহাদিগকে সেই জেলেই গমন করিতে হইল। পূর্ব্বে তাহারা যেরূপভাবে জেলের ভিতর আবদ্ধ ছিল, এবার কিন্তু সেইরূপভাবে তাহাদিগকে রাখা হইল না। এবার তাহাদের নিমিত্ত বিশেষ বন্দোবস্ত হইল। তাহাদের নিমিত্ত নূতন বেড়ী প্রস্তুত হইল, নতুন শেল নির্ম্মিত হইল, এবং তাহাদের উপর বিশেষ পাহারার বন্দোবস্ত হইল। 

বাস্তবিক এবার সবিশেষ সতর্কতার সহিত উহাদিগকে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইল। ক্রমে হিলি সাহেবের মেয়াদ পূর্ণ হইয়া আসিতে লাগিল। জেল হইতে উহার মুক্তি পাইবার যখন দুই তিন মাসমাত্র বাকি আছে, সেই সময় হইতে সকলেই নিতাও ভীত হইতে লাগিলেন। এইস্থানের ইংরাজ অধিবাসীবর্গ সকলেই ভাবিলেন যে, হিলি যদি এইস্থানেই অবস্থিতি করে, তাহা হইলে তাহার অত্যাচারে কাহাকেই সুখে বাস করিতে হইবে না। এখন নির্বিবাদে তাঁহারা যেরূপভাবে রাত্রিযাপন করেন, হিলি কারামুক্ত হইলে সেইরূপে রাত্রিযাপন করিতে পারিবেন না; হিলি সকলেরই সৰ্ব্বস্বান্ত করিবে; এক এক করিয়া সকলের গৃহ হইতে মূল্যবান দ্রব্য সকল অপহরণ করিয়া, আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবে। 

পুলিসের সর্ব্বপ্রধান-কর্ম্মচারীও ভাবিলেন, কলিকাতার ইংরাজ অধিবাসীবর্গ হিলির নিমিত্ত যেরূপ ভীত হইয়াছে, তাহা নিতান্ত অমূলক নহে। এরূপ দস্যু এইস্থানে থাকিলে, কাহারও মান, সম্ভ্রম এবং অর্থ বজায় রাখা নিতান্ত সহজ হইবে না; একেবারে এদেশের সর্ব্বনাশ সাধিত হইবে! এইস্থানে পদার্পণ করিবামাত্রেই যে সকল ভয়ানক ভয়ানক কার্য্য ইহার দ্বারা সংসাধিত হইয়াছে, তাহার নিমিত্তই সকলে একেবারে অস্থির। তাহার উপর জেল হইতে মুক্ত হইবার পর পুনরায় যদি সে এখানে থাকে, তাহা হইলে দেশের যে কিরূপ সৰ্ব্বনাশ সাধিত হইবে, তাহার স্থিরতা নাই। কোন প্রকারেই উহাকে এ প্রদেশে থাকিতে দেওয়া হইবে না। এই ভাবিয়া গবর্ণমেন্টের সহিত তিনি এ বিষয়ে পরামর্শ করিলেন। উহাকে এ প্রদেশে রাখা কোনপ্রকারেই সিদ্ধান্ত হইল না। মেয়াদের কিছুদিবস বাকি থাকিতেই সরকারী খরচে উহাকে বিলাতে প্রেরণ করা হইবে। আরও সাব্যস্ত হইল যে, কলিকাতা-পুলিসের কোন উপযুক্ত ইংরাজ কর্মচারী উহাকে সঙ্গে লইয়া বোম্বাই পৰ্য্যন্ত পৌঁছিয়া দিবেন। সেইস্থান হইতে কোন উপযুক্ত কর্ম্মচারী উহাকে লইয়া বিলাতে গমন করিবেন। 

যেরূপ বন্দোবস্ত হইল, কাৰ্য্যেও তাহাই হইল। জেল হইতে মুক্ত হইবার কিছুদিবস পূর্ব্বে এইস্থানের একজন ইংরাজ-কর্মচারীর সমভিব্যাহারে উহাকে বোম্বাই প্রেরণ করা হইল। উভয়েই রেলে উঠিয়া গমন করিতে লাগিলেন। 

রেলগাড়িতে অধিকদূর গমন করিতে হইলে সকলেই যেরূপ করিয়া থাকে, ইংরাজ-কর্মচারীও তাহাই করিলেন; অর্থাৎ আপনার হ্যাট-কোট প্রভৃতি সমস্ত খুলিয়া সেই গাড়ির ভিতর রাখিয়া দিলেন, এবং কখন বা শয়ন করিয়া, কখনও বা উপবেশন করিয়া সেই সুদূর পথ অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। হিলি সম্বন্ধে যে সকল কাগজ-পত্র ইংরাজ কর্মচারীর নিকট ছিল, তাহা তিনি তাঁহার কোটের পকেটে রাখিয়াছিলেন। 

রাত্রিদিবস চলিয়া গাড়ি ক্রমে বোম্বাই সহরের নিকটবর্তী হইল। এতক্ষণ পর্য্যন্ত হিলি কেবল সুযোগ অনুসন্ধান করিতেছিল। এই সময়ে ইংরাজ-কর্মচারী একটু অসাবধান অবস্থায় ছিলেন। এই সুযোগে হিলি সমস্ত কাগজ পত্রের সহিত সেই ইংরাজ-কৰ্ম্মচারীর কোট, টুপি প্রভৃতি গ্রহণ করিয়া, সেই দ্রুতগামি রেলগাড়ি হইতে লম্ফপ্রদান করিল। যাহার জীবনের উপর মায়া নাই, যে মুহূর্তের নিমিত্তও কোন বিপদকে বিপদ্ বলিয়া গ্রাহ্য করে না, তাহার এইরূপ দুঃসাহসিক কার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়া অসম্ভব নহে। সেইরূপে দ্রুতগামী রেলগাড়ি হইতে লম্ফপ্রদান করিলে, হস্তপদ ভাঙ্গি য়া যাইবারই সম্ভাবনা; কিন্তু, হিলির তাহাতে কিছুই হইল না। সে লম্ফপ্রদান করিবার পর সেইস্থানের ময়দান দিয়া দ্রুতপদে দৌড়িতে আরম্ভ করিল। 

হিলির পতন শব্দে ইংরাজ কৰ্ম্মচারীর চমক ভাঙ্গিল; চক্ষু ফিরিয়া দেখিলেন, না আছে হিলি, না আছে তাহার পুলিসের সেই পোষাক-পরিচ্ছদাদি। তখন অনন্যোপায় হইয়া কৰ্ম্মচারীও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গাড়ি হইতে লম্ফপ্রদান করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু সাহসে কুলাইল না। তৎপরে পরবর্ত্তী ষ্টেশনে নামিয়া পূর্বোক্ত ময়দানের দিকে ধাবমান হইল। * 

সেই সময়ে সেই প্রদেশীয় অনেক লোক সেই ময়দানে কৃষিকাৰ্য্য প্রভৃতিতে নিযুক্ত ছিল। কর্ম্মচারীর অবস্থা দেখিয়া ময়দানস্থিত সেই সকল লোক তাহাকে সাহায্য করিল, এবং সকলে মিলিয়া সেইস্থানে হিলিকে ধরিয়া ফেলিল। 

পুলিসের নিকট হইতে পলায়ন করা অপরাধে সেই প্রদেশে হিলির নামে আর একটি মোকদ্দমা উপস্থিত হইল। বিচারে এবার আর সে নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারিল না; পুনরায় সে ছয় মাসের নিমিত্ত জেলে গমন করিল। এবার তাহার স্থান হইল, বোম্বাই জেলের ভিতর। 

মেয়াদের সময় অতীত হইয়া গেলে, পূর্ব্বের বন্দোবস্ত অনুযায়ী তাহাকে বিলাতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে। সেইস্থানে গমন করিয়া হিলি কিরূপে দিনপাত করিতেছে, সে সংবাদ আমরা পাই নাই। 

ওয়ার্নার জেল হইতে মুক্তিলাভ করিয়া কিছুদিবস কলিকাতায় থাকিয়া, সম্প্রতি বোম্বাই সহরে অবস্থিতি করিতেছেন। 

***

আমরা এই গল্পে সমস্ত নাম ঠিক রাখিলাম, কেবল কোন বিশিষ্ট কারণে আমার সহিত যে তিনজন ইংরাজ পুলিস কর্ম্মচারী ছিলেন, তাহাদিগের নাম ছদ্মভাবে রহিল। 

[মাঘ, ১৩০১ ] 

* The convict Healey, who had, in company with Warner, escaped form the Presidency Jail and had been captured by Sub Inspector Preonath Mukherjee of the Calcutta Detective Po—lice after great difficulty, when being conveyed from Calcutta to Bombay under the escort of Constable Large and two sepoys after the completion of his term of imprisonment, leapt form the train. He took with him the constable’s great coat, cap and Rupees 37 and the paper relating to his deportation. When the train stopped at the next station, the escort alighted and commenced a search which led to the recapture of convict. The papers had in the meantime been made away with. Healey was therefore, on his arrival at Bombay, placed before the magistrate who remanded him to jail. 

AMRITA BAZAR PATRIKA, 2-10-91 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *