কুলসম
প্রথম পরিচ্ছেদ
ইংরাজী ১৮৮১ সালের ২রা মার্চ তারিখে একখানি গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট আসিয়া আমার হস্তে পড়িল। উহা এলাহাবাদের ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হইতে ফজলে রহমান নামক এক ব্যক্তির নামে বাহির হইয়াছে। দেখিলাম, ফজলে রহমান খুনি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত। প্রায় এক বৎসর যাবৎ এই ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে; কিন্তু এ পর্যন্ত সে ধৃত হয় নাই, কিম্বা তাহার কোন প্রকার সন্ধানও কেহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তবে সম্প্রতি এলাহাবাদে পুলিস লোকপরম্পরায় অবগত হইয়াছেন যে, ফজলে রহমান এখন কলিকাতায় আছে; কিন্তু কলিকাতার কোন স্থানে এবং কি প্রকারে অবস্থান করিতেছে, তাহার সঠিক সংবাদ এ পর্যন্ত পান নাই। আমাদিগের দ্বারা কোন প্রকারে যদি উহার সন্ধান হয়, এই অভিপ্রায়ে ঐ ওয়ারেন্ট আমাদিগের নিকট প্রেরিত হইয়াছে। ঐ আসামীর অনুসন্ধানের ভার আমার উপর অর্পিত হইল। কিন্তু এ বিষয়ের সন্ধান লইবার পূর্ব্বে অন্য কার্যোদ্দেশে ইমামুদ্দিন ডাক্তারের নিকট আমাকে গমন করিতে হইল।
ইমামুদ্দিন মেডিকেল কালেজে ডাক্তারি বিদ্যা শিক্ষা করেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া মেডিকেল কলেজের নিয়মানুযায়ী তিনি সরকারী কর্ম্ম গ্রহণ করেন। দুই বৎসর অতীত হইল, তিনি ডাক্তার হইয়াছেন। এই দুই বৎসরে তিনি সাহাবাদ জেলার ভিতর কোন সরকারি হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার ছিলেন; দুই মাস মাত্র অতীত হইল, তিনি চাকরি পরিত্যাগ করিয়া সেই স্থান হইতে কলিকাতায় আগমন করিয়াছেন। সিকদার বাগানের ভিতর একটি বাড়ীভাড়া লইয়া এখন সেইস্থানেই আছেন। তাঁহার ইচ্ছা, এই স্থানেই অবস্থিতি পূর্বক চিকিৎসা আরম্ভ করেন।
২রা মার্চ রাত্রি ৮টার পর আমি সিকদারবাগানে ইমামুদ্দিন সাহেবের বাসায় গমন করিলাম। ইমামুদ্দিন সাহেব বাড়ীতেই ছিলেন। তাঁহার বেহারা মিয়া সংবাদ দিবামাত্র তিনি বাহিরে আসিলেন, দরজায় আমাকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়ের নাম কি? আপনি কাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহেন?”
আমি আমার নাম বলিলাম। আরও বলিলাম, আমি ডাক্তার ইমামুদ্দিন সাহেবের সহিত সাক্ষাতের প্রত্যাশা করি। “আপনি ইমামুদ্দিনকে চিনেন কি?”
“না মহাশয়! আমি তাঁহাকে কখন দেখি নাই, বা তাঁহার সহিত আমার আলাপ পরিচয় নাই।”
“আমার নামই ইমামুদ্দিন। আমার নিকট আপনার কি প্রয়োজন, তাহা আমাকে বলিতে পারেন।” ডাক্তার সাহেবের কথা শুনিয়া আমি আমার পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম। ডাক্তার সাহেবের বাসার সম্মুখেই রাস্তার উপর একটি গ্যাস জ্বলিতেছিল; সেই গ্যাসালোকে তিনি পত্রখানি পাঠ করিলেন। উহাতে লেখা ছিল;—
“প্রিয় ইমামুদ্দিন!
আমি তোমাকে আমার বন্ধু ডিটেকটিভ পুলিসের যে বাবুর কথা বলিয়াছিলাম, অদ্য তিনি তোমার নিকট এই পত্রসহ গমন করিতেছেন। তাঁহাকে সমস্ত অবস্থা বিশেষ করিয়া বলিলে, আমার বিশ্বাস যে, তিনি ইহার ভিতরের অবস্থা অনায়াসে অবগত হইতে পারিবেন। তাহা হইলে আমাদিগের মনের সমস্ত ধাঁধা মিটিয়া যাইবে।
ইতি
২রা মার্চ।
তোমার যোগেন্দ্র।”
পত্র পাঠ করিয়া ইমামুদ্দিন সাহেব আমাকে তাঁহার বৈঠকখানায় লইয়া গেলেন। সেইস্থানে আমরা উভয়ে উপবেশন করিলাম। বেহারা তামাক আনিয়া দিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিল। ইমামুদ্দিন সাহেব ধূমপান করিতে করিতে বলিলেন, “প্রিয়বাবু! এ বড় অদ্ভুত কথা, বড় অদ্ভুত ঘটনা। এ ঘটনার কিছুই আমি স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। ভাবিয়াও ইহার আদি অন্ত কিছুই বুঝিতে সমর্থ হইতেছি না।”
উত্তরে আমি কহিলাম, “সমস্ত অবস্থা ও সকল কথা, যতদূর আপনি স্মরণ করিতে পারেন, তাহা পরিষ্কাররূপে একে একে আমাকে বলুন; দেখি, আমিও উহার কিছু স্থির করিয়া উঠিতে পারি কিনা।”
ডাক্তার সাহেব আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। বেহারাকে বলিলেন, “আমরা যে পর্য্যন্ত এই ঘরে থাকিব, সে পর্যন্ত আর কেহ যেন এই ঘরের ভিতর প্রবেশ, বা আমাদিগের কথাবার্তা শ্রবণ করিতে না পারে, সে বিষয়ে বিশেষরূপে সতর্ক থাকিস।”
এই বলিয়া তিনি আমার আরও নিকট উপবেশন করিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ইমামুদ্দিন সাহেব বলিতে আরম্ভ করিলেন :—
“প্রায় এক মাস অতীত হইল,—একদিবস সন্ধ্যার পর আমি আমার এই গৃহে একাকী বসিয়া একখানি সংবাদপত্র পাঠ করিতেছি, এমন সময় দেখিলাম, একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর শকট আসিয়া আমার দ্বারের সম্মুখে উপস্থিত হইল। সেই শকটের আরোহী একজন মুসলমান যুবক। আমি উহাকে চিনিতাম না; কিন্তু পরে অবগত হইয়াছিলাম, উহার নাম হোসেন খাঁ। গাড়ি হইতে হোসেন খাঁ বাহির হইয়াই সম্মুখে আমার সেই বেহারাকে দেখিতে পাইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ডাক্তার সাহেব বাড়ীতে আছেন?” সে বৈঠকখানা দেখাইয়া দিয়া কহিল, “যান, ঐ স্থানে তিনি একাকী বসিয়া আছেন।” বেহারার কথা শুনিয়া সে আমার এই বৈঠকখানার ভিতর দ্রুতপদে প্রবেশ করিল। আমি সম্মুখেই বসিয়াছিলাম; আমাকে দেখিয়া কহিল, ‘ডাক্তার সাহেব! আমার ভগিনীপতি গওহর আলি বড়ই পীড়িত, আমার ভগিনী তাঁহার অবস্থা দেখিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া নিতান্ত অস্থির হইয়াছে। আপনাকে এখনই আমার সহিত গমন করিতে হইবে। আমি একেবারে গাড়ি-সহিতই আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আপনি কালবিলম্ব না করিয়া, অনুগ্রহ পূর্ব্বক আমার সহিত আগমন করুন। এখান হইতে আপনাকে বহুদূর গমন করিতে হইবে না; মাণিকতলা এইস্থান হইতে অতি নিকট।’
“হোসেন খাঁ যেরূপ ব্যগ্রতার সহিত আমার সহিত কথা কহিতে লাগিল, তাহার সহিত শীঘ্র গমন করিবার নিমিত্ত যেরূপ পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল, তাহাতে আমি তাহাকে কোন কথাই বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে সমর্থ হইলাম না। তৎক্ষণাৎ তাহার গাড়িতে উঠিয়া আমি তাহার সহিত মাণিকতলার গওহর আলির বাড়ীতে গমন করিলাম।
“গওহর আলি মাণিকতলার ভিতর একজন সবিশেষ পরিচিত লোক। তাঁহার বিষয় সম্পত্তির অবস্থা আমি অবগত নহি; কিন্তু তাঁহার বাড়িটি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। সদর বাড়ীতে একতালা একটি পাকা দলিজ। অন্দরের ভিতরে কোন অংশ দ্বিতল, কোন অংশ ত্রিতল; সমস্তই কিন্তু জীর্ণ, বহু পুরাতন বলিয়া বোধ হয়। একটি বিস্তৃত পুরাতন বাগান এই বাড়ীর সংলগ্ন। উহাতে আম, লিচু, নারিকেল প্রভৃতি পুরাতন বৃক্ষ সকল নানাপ্রকার বন্য লতাপাতায় ক্রমে আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে। সেই বাগানের ভিতর একটি পুষ্করিণী আছে, তাহার প্রায় সমস্ত দিকই জঙ্গলে আবৃত; মধ্যে একটিমাত্র অতি সঙ্কীর্ণ পথ আছে, তাহা দিয়া সেই পুষ্করিণীতে যাওয়া যায়।
“হোসেন খাঁর সহিত আমি সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। একটা পুরাতন সোপানাবলীর সাহায্যে একটি দ্বিতল গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একখানি খাটের উপর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক একটি মনুষ্য শয়ন করিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার পার্শ্বে একটি অবগুণ্ঠনবতী স্ত্রীলোক বসিয়া রোদন করিতেছেন। হোসেন খাঁ পূৰ্ব্বোক্ত ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, ‘মহাশয়! ইনিই আমার ভগিনীপতি গওহর আলি। ইনিই এই বাড়ীর একমাত্র অধিকারী! দেখুন, কোন প্রকারে কোন ঔষধ দ্বারা ইঁহার জীবনদান করিতে পারেন কিনা।’
“আমি সেই রোগীর নিকট উপবেশন করিলাম। তাহার মুখের বস্তু উঠাইয়া দেখিলাম যে, বহুদিবসের ক্ষয়রোগে ইঁহার শরীর ক্ষয় হইয়া গিয়াছে, বাঁচিবার কোন আশা নাই—অন্তিমকাল আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ইহার কথা কহিবার ক্ষমতা নাই। বোধ হয়, দুই তিন দিবসের মধ্যেই ইনি ইহলোক হইতে অন্তর্হিত হইবেন। এই প্রকার অবস্থা দেখিয়াও চিকিৎসকের প্রথানুযায়িনী আমি একটি ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া দিলাম। আমি আমার ভিজিটের টাকা গ্রহণ করিয়া সেইদিবস রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। আসিবার সময় হোসেন খাঁ আমাকে বিশিষ্টরূপ অনুরোধ করিল—যেন আমি পরদিবস পুনরায় তাহাদের বাড়ীতে যাই। অনিচ্ছা থাকিলেও আমি তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম।
“পরদিবস প্রাতঃকালে পুনরায় সেই বাড়ীতে গমন করিলাম। সেইদিবস রোগীর অবস্থা আরও মন্দ বোধ হইল। তথাপি ‘পুনরায় বৈকালে আসিতে হইবে’ এবার গওহর আলির স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে আমাকে এই অনুরোধ করিলেন। কাজেই “বৈকালে পুনরায় আগমন করিব’ এই বলিয়া ভিজিটের টাকা লইয়া চলিয়া আসিলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
“সন্ধ্যার পর আমি রোগী দেখিবার নিমিত্ত পুনরায় সেইস্থানে গমন করিলাম। হোসেন খাঁ সেই বাড়ীর সম্মুখে পথের উপর দণ্ডায়মান ছিল, আমাকে দেখিবামাত্র সে আমার আগে আগে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, আমি তাহার অনুগমন করিতে লাগিলাম।
“উপরে উঠিয়া দেখি, রোগী শয্যার উপর শয়ন করিয়া আছেন; একখানি বস্ত্রদ্বারা তাহার শরীর আবৃত রহিয়াছে।
তাহার স্ত্রী তাহার পার্শ্বেই উপবিষ্টা। শুনিলাম, অতি অল্পক্ষণ হইল, রোগী নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছেন। আমি রোগীর পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহার মস্তকের আবরণ অল্পে অল্পে উঠাইলাম, কিন্তু উঠাইয়া কি দেখিলাম? দেখিলাম, তাঁহার নয়ন উন্মীলিত, কিন্তু স্পন্দন-রহিত; শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ। বুঝিলাম, আমার রোগী সামান্য নিদ্রায় নিদ্রিত নহেন, মহানিদ্রা আশ্রয় করিয়া রোগের দারুণ যন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছেন।
“এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি অতিশয় দুঃখিত হইলাম। মুখ দিয়া ভাল মন্দ কোন কথা বাহির করিতে সমর্থ হইলাম না। হোসেন খাঁ আমার নিকটেই দণ্ডায়মান ছিল, সে আমার মুখ ও রোগীর অবস্থা দেখিয়া সমস্ত অবস্থা বুঝিতে পারিল; “ভাই ভাই” বলিয়া অতি উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিল। তাহার ক্রন্দনে সেই অবগুণ্ঠনবতী রমণীও ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন। কেবল ক্রন্দন নহে, তিনি সেইস্থানে পতিতা হইয়া কপালে করাঘাত করিতে করিতে একবারে অধীরা হইয়া উঠিলেন। হোসেন খাঁর অবস্থাও ক্রমে সেইরূপ হইয়া আসিতে লাগিল। আমি রোগী দেখিতে যাইয়া যে কিরূপ বিপদগ্রস্ত হইলাম, তাহা আপনি বুঝিয়া দেখুন। সেই বাড়ীতে অন্য আর কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না; কেবল এই স্ত্রীলোকটি; এবং পুরুষের মধ্যে হোসেন খাঁ। ইহারা উভয়েই গওহরের শোকে অভিভূত, হিতাহিত জ্ঞান-বিবর্জ্জিত। ইহাদিগকে সান্ত্বনা দান করে, এমন একটি লোক নাই। প্রথম দিবস আমি যখন তথা গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় নীচের গৃহে একটি পরিচারিকাকে দেখিয়াছিলাম; কিন্তু আজ আর তাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। কোন বাড়ীতে কাহারও মৃত্যু হইলে, পাড়ার প্রায় সকল স্ত্রীপুরুষই আগমন করিয়া সেইস্থানে সমাগত হয়, ইহাই আমাদিগের দেশের নিয়ম। কিন্তু আজ সেই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখিলাম; সেইস্থানে কেহই আগমন করিল না। কেন আসিল না, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম, কাহারও সহিত ইহাদিগের সদ্ভাব নাই, সুতরাং কেহই আগমন করিতেছেন না। আবার ভাবিলাম, হয়ত এইস্থানে যে এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা বোধ হয়, কেহুই অবগত হইতে পারেন নাই। যাহা হউক, অনন্যোপায় হইয়া সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম, এবং উহাদিগকে শান্ত করিবার অভিপ্রায়ে আমি অনেক বুঝাইতে লাগিলাম। এইরূপে ক্রমে রাত্রি আটটা বাজিয়া গেল। সেই সময় যাহাতে তাহারা লোকজন সংগ্রহ করিয়া মৃতদেহের সৎকার করে, বুঝাইয়া তাহার পরামর্শ প্রদান করিতে লাগিলাম। ইহারা ক্রমে আমার কথাগুলি বুঝিল বলিয়া বোধ হইল; যে গৃহে মৃতদেহ ছিল, সেই গৃহের দ্বার সকল উত্তমরূপে বন্ধ করিয়া আমার সহিত নীচে আসিল। শবের নিকট কেহই থাকিল না, কেবলমাত্র একটি প্রদীপ সেইস্থানে জ্বলতে লাগিল।
“আমরা যখন নীচে আসিলাম, সেই সময় দেখিলাম, একখানি পাল্কী আসিয়া অন্দরে প্রবেশ করিল। পাল্কী হইতে একটি চতুর্দ্দশ বৎসর বয়স্কা বালিকা বহির্গতা হইয়া বেহারাদিগকে একটি টাকা প্রদান করিল; বেহারারা পাল্কী লইয়া প্রস্থান করিল। যে স্থানে আমরা দণ্ডায়মান ছিলাম, বালিকা আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। বালিকাকে দেখিবামাত্র হোসেন ও তাহার ভগিনী পুনরায় কাঁদিয়া উঠিল। কি অবস্থা হইয়াছে জানিতে না পারিয়া বালিকাও রোদন করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে, আমার পিতা কোথায়?”—উত্তরে হোসেন খাঁ কাঁদিয়া কহিল, “অভাগি! তোর পিতা কি আর এখন বর্তমান আছেন যে, বলিয়া দিব, তিনি কোথায়? তিনি আমাদিগকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক চলিয়া গিয়াছেন! তাঁহার দেহ ঐ গৃহে পড়িয়া আছে মাত্র।” এই কথায় বালিকা আরও অধীরা হইয়া উঠিল, পিতার মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেইদিকে ছুটিল। হোসেন খাঁ তাহার গতিরোধ করিল, বলিল, “না কুসম! তুমি এখন তোমার পিতার মৃতদেহ দেখিতে পাইবে না। এখন সেই দৃশ্য দেখিলে তুমি জ্ঞানশূন্যা হইয়া পড়িবে, তাহা হইলে হয় ত তুমিও তোমার পিতার অনুগমন করিবে। প্রথমে তুমি একটু সুস্থা হও, তাহার পরে তুমি তোমার পিতার মৃতদেহ দেখিও।” হোসেন খাঁর যুক্তি সঙ্গত বিবেচনা করিয়া, আমিও তাহার প্রস্তাবে মত দিলাম। বালিকা ক্ষুণ্নমনে সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া রোদন করিতে লাগিল। আমি আরও এক ঘণ্টাকাল সেইস্থানে অবস্থিতি পূৰ্ব্বক ইহাদিগকে কতক পরিমাণে শান্ত করিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
“সেই রাত্রিতে আমি আমার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। আমার হৃদয়ে যে স্বাভাবিক স্ফূর্ত্তিটুকু ছিল, আজ তাহা গওহরের বাড়ীতে রাখিয়া আসিতে হইল। কষ্টে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইল। সেই মৃতদেহের মুখমণ্ডল আমার অন্তরে সতত জাগিতে লাগিল; তাহার সেই উন্মীলিত পলকহীন চক্ষু যেন আমার চক্ষের সম্মুখেই রহিল। আবার মধ্যে মধ্যে সেই প্রস্ফুটিত কুলসম-কমলের নয়নযুগল যেন আমার নয়ন-যুগলে মিলিত হইতে লাগিল। দেখিতে লাগিলাম, যেন সেই সুচারু সুন্দর সুকুমার বালিকার মুখখানি বিষাদে ভরিয়া গিয়াছে। সেই আকর্ণ-বিস্ফারিত লোচনযুগল হইতে দুইটি ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী অবিরাম বাহিয়া, তাহার ঈষদুন্নত উরোদেশ অতিক্রম করিয়া চলিয়াছে। তাহার সেই সুকুঞ্চিত অলকদাম বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়িয়া, সেই ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী-নীরে স্নাত হইতেছে। তখন সেই আলুলায়িত-কেশা, ভ্রমর-কৃষ্ণ-ভ্রূযুগ-সমন্বিতা আয়তলোচনা করুণ-কটাক্ষ করিয়া আশ্রয়-ভিক্ষা করিতেছে। তাহার সরল নাসিকার প্রান্তবর্তী সুগোল গণ্ডদ্বয় আরক্তিম আভা ধারণ করিয়াছে। বালিকার কর্ণে কয়েকটি আভরণ ও বামহস্তের অঙ্গুলিতে একটিমাত্র অঙ্গুরীয়ক ভিন্ন অঙ্গে অন্য কোন প্রকার অলঙ্কার নাই; পরিহিত পরিচ্ছদও তত পরিপাটী নহে; তথাপি তাহার স্বাভাবিক অঙ্গসৌষ্ঠবে তাহাকে বড়ই সুন্দরী বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল, যেন নিতম্বিনী মন্থর গতিতে আমার নিকট আগমন করিতেছে। আসিয়া সে যেন অশ্রুনীরে অভিষিক্ত হইয়া আমার চরণ ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল। দেখিলাম, তাহার বালিকা-সুলভ লজ্জা তাহাকে যেন আজ পরিত্যাগ করিয়াছে; তাই সে নিতান্ত আত্মীয়ার ন্যায় আমার নিকট বসিয়া অশ্রুজলে আপন নয়নযুগল ভাসাইতে লাগিল। কখন বা মনের কপাট খুলিয়া আমার নিকট অকপটে মনের কথা প্রকাশ করিতে লাগিল। এইরূপ নানাপ্রকার স্বপ্নকল্পিত চিন্তার প্রবল অত্যাচারে সে রাত্রি আর নিদ্রার মুখ দেখিতে পাইলাম না; ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। শয্যা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক বাহিরের গৃহে আসিয়া উপবেশন করিলাম। বেহারা তামাক দিয়া গেল। আমি সেই প্রকার জাগ্রৎ অবস্থায়ও স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে অন্যমনা হইয়া ধূমপান করিতে লাগিলাম।
“প্রাতঃকালে ছয়টার সময় দেখিলাম, একখানি শিবিকা আসিয়া আমার দ্বারদেশে উপনীত হইল। উহার পশ্চাতে একটি প্রবীণা স্ত্রীলোক, সেই স্ত্রীলোকটি আমার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। সে আমাকে দেখিবামাত্র কহিল, “মহাশয়! আমি পরের কোন প্রয়োজন বশতঃ এইস্থানে আগমন করিয়াছি, যদি অনুগ্রহ পূর্ব্বক আপনি আমার কয়েকটা কথা শ্রবণ করেন, তাহা হইলে আমার এইস্থানে আগমনের কারণ আপনাকে বলিতে পারি।’
“স্ত্রীলোকটির কথা শুনিয়া আমি কহিলাম,—‘তুমি যে প্রয়োজনের নিমিত্ত আমার নিকট আগমন করিয়াছ, তাহা অক্লেশেই বলিতে পার। তোমার কি অসুখ হইয়াছে, তাহা আমাকে বল।’
“উত্তরে সেই স্ত্রীলোকটি আমাকে কহিল, ‘মহাশয়! আমি পীড়াগ্রস্তা নহি, বা আমার কোন প্রকার অসুখও হয় নাই। ঐ শিবিকার ভিতর কোন ভদ্রবংশীয় একটি স্ত্রীলোক আসিয়াছেন, তিনি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা করেন। যদি অনুমতি হয়, তাহা হইলে আদেশ করুন, আমি উঁহাকে আপনার নিকট আনয়ন করি।’ প্রবীণার কথায় আমি সম্মত হইলাম; সেই স্ত্রীলোকটিকে আমার নিকট আনিতে কহিলাম। সে শিবিকার ভিতর হইতে একটি স্ত্রীলোককে আমার নিকটে আনয়ন করিল।
“একখানি মোটা কাপড়ে আপাদ-মস্তক আচ্ছাদিত করিয়া, সেই স্ত্রীলোকটি আমার সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। এই স্ত্রীলোকটি যে কে, তাহা আমি ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তিনিও প্রথমে কোন কথা বলিতে পারিলেন না; আমার সম্মুখে চিত্র-পুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন। বোধ হইল, যেন তিনি নীরবে রোদন করিবার চেষ্টা করিতেছেন; কিন্তু বিশেষ চেষ্টা করিয়াও দুর্দমনীয় রোদনধ্বনিকে সম্বরণ করিতে সমর্থ হইতেছেন না।
“স্ত্রীলোকটির এই অবস্থা দেখিয়া আমি কহিলাম, ‘আপনার কোন প্রকার ভয় বা আশঙ্কা নাই; আপনি অকপটচিত্তে আপনার মনের কথা আমার নিকট প্রকাশ করিতে পারেন। আপনার দুঃখপ্রতীকারের চেষ্টা, আমাদ্বারা যতদূর সম্ভব, করিতে প্রস্তুত আছি।’
“আমার কথা শুনিয়া সেই স্ত্রীলোকটি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া ফেলিলেন। সেই সময় তাঁহার মুখের বস্ত্র সরিয়া পড়িল। তিনি আমার পদযুগল ধারণ করিয়া কহিলেন, ‘এ জগতে আমার আপন বলিবার কেহই নাই। আপনি আমাকে রক্ষা করুন, এই বিপদ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন।
“স্ত্রীলোকটিকে এবার আমি চিনিলাম। ইনি যুবতী নহেন, বালিকা। ইনিই আমাদিগের সেই পূর্ব্বপরিচিতা গওহরের কন্যা—কুসম। যে সুকোমল মূর্ত্তির ছায়া সমস্ত রজনী আমার হৃদয়-দর্পণে প্রতিফলিত হইয়া আমাকে শ্রমনাশিনী নিদ্রাদেবীর সুকোমল অঙ্কে শায়িত হইতে দেয় নাই, সেই অপরূপ-রূপশালিনী বালিকা কুসম, আমার পদযুগল ধরিয়া নিতান্ত কাতরভাবে রোদন করিতেছেন। তখন ভাবিলাম, আমার হস্তদ্বারা আমার পদযুগল হইতে উহার করপল্লবদ্বয় বিচ্ছিন্ন করিয়া আমার হস্তদ্বয়কে পবিত্র করি। অন্ধ যেমন করস্পর্শ দ্বারা অর্দ্ধ-প্রস্ফুটিত কমল-কোরকের অতুলনীয়া শোভা অনুভব করিয়া লয়, মনে করিলাম, বালিকা-রূপান্ধ আমিও সেইরূপ আমার হস্তদ্বারা সেই অর্দ্ধ—প্রস্ফুটিত করকমল স্পর্শ করিয়া আমার ইহজন্ম সার্থক করিয়া লই। এইরূপ ভাবিয়া যেমন আমি আমার করদ্বয় বাহির করিলাম, অমনই কে যেন আমার হস্ত বদ্ধ করিয়া আমাকে বলিয়া দিল, ‘মূর্খ। কি কর, কাহার হস্ত স্পর্শ করিতে চাহ? বিপদগ্রস্তা কুলকামিনীর হস্ত স্পর্শ করিয়া কুলধর্ম্মের অবমাননা করিও না। রূপ-মুগ্ধ হইয়া হঠাৎ প্রজ্বলিত—পাবকে পদার্পণ করিও না। সাবধান! পুড়িয়া ভস্ম হইয়া যাইবে।’
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
“সেই বালিকাকে আমি তখন মিষ্টকথায় তুষ্ট করিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাঁহাকে যতই বুঝাইতে লাগিলাম, তাঁহাকে যতই মিষ্টকথা বলিতে লাগিলাম, দেখিলাম, তাঁহার শোকাবেগ ততই উথলিয়া উঠিতে লাগিল; তিনি ততই যেন অধীরা হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। কি নিমিত্ত তিনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, জানিবার অভিপ্রায়ে তাঁহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। প্রায় একঘণ্টা পরে দেখিলাম, কুসম ক্ৰমে সুস্থা হইয়া আসিতেছেন। পরে অনেক কষ্টে কুলসম অশ্রুবেগ সম্বরণ করিয়া, যাহা বলিবার নিমিত্ত আমার নিকট আগমন করিয়াছিলেন, তাহা বলিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার কথা আমি যতই শ্রবণ করিতে লাগিলাম, ততই আমি বিস্ময়-সাগরে ডুবিতে লাগিলাম বটে, কিন্তু তাঁহার সকল কথা আমি বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। কুলসম, কাহিনী বর্ণন করিবার পূর্ব্বেই আপন সমভিব্যাহারিণীকে অন্তরে গমন করিতে কহিলেন। সে বাহিরে গমন করিলে কুসম বলিলেন;—
‘মহাশয়! আমি আপনার পরিচিতা বা আত্মীয়া নহি; কিন্তু আপনাকে দয়াবান ভদ্রলোক বলিয়া আমার বিশ্বাস হওয়ায়, এই সহায়-হীন অবস্থায় আজ আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আমি অন্তঃপুর-বাসিনী কুলকামিনী, বিশেষ বিপদগ্রস্তা হইয়াই এইরূপ সহায়-হীন অবস্থায় আপনার নিকট আসিয়াছি। আজ আমি রমণীভূষণ লজ্জার মস্তকে পদাঘাত করিয়া অপরিচিত ব্যক্তির নিকট যে কেন আগমন করিয়াছি, তাহা শ্রবণ করিয়া ইহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করুন, ইহাই আমার একমাত্র ভিক্ষা।
‘আপনি যতদূর শুনিয়াছেন, তাহাতে বোধ হয় আপনি জানেন যে, এই অভাগী গওহর আলির একমাত্র কন্যা। যে অবগুণ্ঠনবতী স্ত্রীলোকটিকে আপনি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছেন, হোসেন খাঁ পরিচয়-মত যাঁহাকে আপনি গওহরের স্ত্রী বলিয়া অবগত হইয়াছেন, তিনি বাস্তবিকই তাঁহার পরিণীতা পত্নী কি না, তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু তিনি আমার জননী নহেন। প্রায় দশ বৎসর অতীত হইল, আমার মাতা আমাকে পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন। আমার বৃদ্ধ পিতা সেই সময় হইতে আমাকে লালন-পালন করিয়া আসিতেছিলেন। কিন্তু কেবল একমাস গত হইল, একদিবস দেখিলাম, আমার বৃদ্ধ পিতা কোথা হইতে হোসেন খাঁ ও সেই স্ত্রীলোকটিকে আনয়ন করিয়া আমাদিগের গৃহে স্থান প্রদান করিলেন। ক্রমে আমি জানিতে পারিলাম যে, পিতা বৃদ্ধবয়সে অধঃপতনের সোপানে পদক্ষেপ করিতেছেন। সেই সুন্দরীকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়া তাঁহার পাণিগ্রহণের সঙ্কল্প করিয়াছেন। একদিবস কথায় কথায় পিতা তাঁহার নিজের মনের ভাব আমার নিকটে প্রকাশ করিলেন; শুনিয়া আমার আপাদ-মস্তক জ্বলিয়া গেল। পিতার প্রস্তাবে আমি নিতান্ত দুঃখিত হইলাম। তখন এই মুখরা বালিকার মুখ হইতে দুই একটি তিরস্কার বাক্যও বাহির হইল। আমার কথায় পিতা অতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন। আমার কথা অসহ্য হওয়াতে, তিনি আমাকে যৎপরোনাস্তি অবমাননা করিলেন, এবং নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া পরিশেষে আমাকে আজ্ঞা দিলেন, ‘বাড়ী হইতে এখনই দূর হইয়া যা।’
‘এতদিবস পর্য্যন্ত যে পিতা আমাকে প্রতিপালন করিয়া আসিতেছিলেন, যাঁহার স্নেহ এবং যত্নে আমি লালিত—পালিত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়া বালিকা বয়স প্রায় অতিক্রম করিতে বসিয়াছি, তাঁহার কথা আমার অন্তরের ভিতর শেল-সম বিদ্ধ হইল। বালিকা-সুলভ ক্রোধের বশবর্তিনী হইয়া ভাল মন্দ কিছুই বিবেচনা করিতে পারিলাম না; অভিমানভরে পিতৃভবন পরিত্যাগ করিলাম। বাড়ীতে চারি পাঁচজন চাকরাণী ছিল, তাহাদিগের একজন দ্বারা একখানি পাল্কী আনাইয়া, তাহারই সমভিব্যাহারে তখনই বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। খিদিরপুরে আমার পিতার এক ভগিনী ছিলেন, আমি তাঁহারই নিকট গমন করিলাম।
‘জানি না, বিধাতা আমার অদৃষ্টে কি লিখিয়াছেন আমাকে আরও কত কষ্ট সহ্য করিতে হইবে! আমি আমার ফুফুর নিকট গমন করিবার কয়েক দিবস পরেই, বৃদ্ধা ফুফু আমার অদৃষ্ট দোষে ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। সেই বৃদ্ধা বিধবার আর কেহই ছিল না, পাড়ার প্রতিবেশীরা সমবেত হইয়া তাঁহার সৎকার কার্য্য সমাধা করিলেন। পত্র দ্বারা পিতাকে এই সংবাদ প্রদান করা হইল; কিন্তু তিনি সেইস্থানে গমন করা দূরে থাকুক, পত্রের উত্তর পর্য্যন্তও লিখিলেন না।
‘স্নেহময় পিতার কোন সংবাদ প্রাপ্ত না হইয়া, আমার মন নিতান্ত অস্থির হইল। বিশেষতঃ সেইস্থানেই বা আর কাহার নিকট থাকিব? কাজেই একখানি পাল্কী লইয়া গত সন্ধ্যার সময় আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া উপনীত হইলাম। বাড়ীতে আসিয়াই পিতার অবস্থা শুনিলাম। পিতৃশোকে আমার হৃদয় যেরূপ অভিভূত হইল, তাহা আপনি স্বচক্ষেই সন্দর্শন করিয়াছেন। আমি আমার পিতাকে দেখিতে চাহিলাম,—জন্মের মত নয়ন ভরিয়া সেই মূর্তি একবার দেখিতে চাহিলাম, তাঁহার বক্ষের উপর মস্তক রাখিয়া হৃদয় ভরিয়া একবার কাঁদিতে চাহিলাম; কিন্তু আমার কথা কেহই শুনিল না, আমার দুঃখে কেহই কর্ণপাত করিল না; মিথ্যা ছল করিয়া উহারা আমাকে বঞ্চিতা করিল। আপনিও তাহাদিগের কৌশল-জাল ছিন্ন করিতে না পারিয়া, তাহাদের মতে মত দিলেন। এই হতভাগী সেই নীচের গৃহে পড়িয়া রোদন করিতে লাগিল।’
“এই কথা বলিতে বলিতে কুসমের কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল। আর কথা কহিতে পারিলেন না। তাঁহার সেই নবনীত-সুকোমল গণ্ডস্থল অশ্রুজলে প্লাবিত হইতে লাগিল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
“প্রায় পনর মিনিট পরে মনের বেগ সংযত করিয়া কুলসম পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিলেন;—
‘সেই নীচের গৃহে শুইয়া রোদন করিতে করিতে ক্রমে আমার তন্দ্রা আসিল। সেই সময় আমার কর্ণে মনুষ্যের কাতর কণ্ঠস্বর প্রবেশ করিল। বোধ হইল, সেই অস্ফুটস্বর আমার পিতার কণ্ঠ হইতে নির্গত হইতেছে। আমি চকিতের ন্যায় উঠিলাম, উঠিয়া সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। ভাবিলাম, স্বপ্নে এইরূপ স্বর শ্রবণ করিয়াছি। চক্ষু মুছিলাম, মনোযোগ পূৰ্ব্বক ভাবিলাম, তখনও যেন সেই স্বর আমার কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। পিতার কাতর-কণ্ঠ-নিঃসৃত অর্দ্ধস্ফুট চীৎকার শব্দ তখনও আমার কর্ণকে পরিত্যাগ করিল না। এখন আর আমি তন্দ্রায় অভিভূত নহি। তবে কি জাগিয়া স্বপ্ন দেখিতেছি—তাহা কিরূপে হইবে? তখন আমার হৃদয়ে বলের সঞ্চার হইল; ভাবিলাম, আমার যাহা হইবার হইবে, আমি আর কাহারও কথা শুনিব না, তৎক্ষণাৎ গমন করিয়া আমার সেই মৃত পিতাকে অবলোকন করিব। এই ভাবিয়া দাঁড়াইলাম, গৃহের বাহিরে আসিলাম; কিন্তু আর কাহাকেও সেইস্থানে দেখিতে পাইলাম না। তখন সাহসের উপর ভর করিয়া আস্তে আস্তে উপরে উঠিলাম। যে গৃহে আমার পিতা শয়ন করিতেন, সেই গৃহে প্রবেশ করিতে গিয়া দেখি, দ্বার তালাবদ্ধ। সেই গৃহের অপর পার্শ্বে বারান্দার সন্নিকটে অপর আর একটি দ্বার ছিল। সেই দ্বারের নিকট গমন করিয়া দেখিলাম, উহাও বন্ধ, কিন্তু ভিতরদিক্ দিয়া। সেই দ্বার জীর্ণ অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছিল, উভয় কপাটের মধ্যভাগ সংস্কারাভাবে ক্রমে ফাঁক হইয়া পড়িয়াছিল। উহার ভিতর আমার অঙ্গুলি প্রবেশ করাইয়া দিয়া, কৌশলে ভিতরের খিল খুলিয়া সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, আমার পিতা যে খাটে শয়ন করিতেন, তাহার উপর আপাদ-মস্তক বস্ত্রে আবৃত করিয়া কে যেন শয়ন করিয়া রহিয়াছেন। আমি ভাবিলাম, এই আমার পিতার মৃতদেহ। সেই সময় বাস্তবিক নিতান্ত অধীর না হইয়া শান্তভাবে জন্মের মত একবার পিতৃমুখ দেখিয়া লইতে বাসনা করিলাম। সেই গৃহে একটি প্রদীপ অল্প অল্প জ্বলিতেছিল; বামহস্তে সেই প্রদীপ গ্রহণ করিয়া ক্রমে পিতার নিকট গমন করিলাম। তাঁহার মস্তকের নিকট দণ্ডায়মান হইয়া, সেই শবাচ্ছাদক বস্তু আস্তে আস্তে দক্ষিণ হস্তদ্বারা উঠাইলাম। উঠাইয়া কি দেখিলাম! দেখিলাম, উহা একটি বৃদ্ধের শব। ইনিই কি আমার পিতা? মনে যেন কেমন একরূপ সন্দেহ হইল, উহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। আমার ভ্রম হইয়াছে ভাবিয়া পুনরায় দেখিলাম, চক্ষুদ্বয় উত্তমরূপে মুছিয়া আবার দেখিলাম। এইরূপ যতবার দেখিলাম, ততবারই আমার মনে হইল, যেন ইহা আমার পিতার দেহ নহে, অপরের দেহ। তখন শোকে সন্দেহে নিতান্ত অধীর হইয়া পড়িলাম; তাই বলিয়াই বুঝি চিনিতে পারিলাম না। এই ভাবিয়া পুনরায় মন স্থির করিয়া দেখিলাম,—প্রদীপের আলো উজ্জ্বল করিয়া আবার দেখিলাম, কিন্তু তাহা যে আমার পিতারই দেহ, তাহা মনকে বুঝাইতে পারিলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া কোন প্রকার গোলযোগ না করাই স্থির করিলাম। মনে নিতান্ত ভয় হইল। কারণ, বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া যাইবার কালে আমি যে সকল দাস—দাসী দেখিয়া গিয়াছিলাম, এখন তাহাদিগের মধ্যে একজনমাত্রও নাই। একটি অপরিচিত পুরুষ ও একটি অপরিচিত স্ত্রীলোক, এখন এই বাড়ীর সর্ব্বে-সৰ্ব্বা। উহারা যে কে, কোথা হইতে আগমন করিয়াছে, এবং উহারা বা কি চরিত্রের লোক, তাহার বিন্দুবিসর্গও যখন আমি অবগত নহি, তখন এইস্থানে গোলযোগ করিলে, ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্টের সম্ভাবনা অধিক। ইহা জানিয়া, যাহাতে উহারা আমার এই অবস্থার কণামাত্রও অবগত হইতে না পারে, তাহা করাই যুক্তি-যুক্ত মনে করিলাম। তখন সেই মৃতদেহ পূৰ্ব্বমত আবৃত করিয়া, সেই প্রদীপ যথাস্থানে রাখিয়া, সেই দ্বার সেইরূপে বন্ধ করিয়া, আমি আস্তে আস্তে নীচের তলায় আসিলাম। যে গৃহে শয়ন করিয়াছিলাম, সেই গৃহে গিয়া পুনরায় শয়ন করিলাম। সেই অপরিচিত স্ত্রীপুরুষ তখন যে কোথায়, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। পিতার কণ্ঠনিঃসৃত শব্দের মত শব্দ যদি পুনরায় শুনিতে পাই, এই ভাবিয়া চুপ করিয়া রহিলাম; কিন্তু সেই প্রকার শব্দ আর শুনিতে পাইলাম না।
‘প্রায় এক ঘণ্টা পরে সেই স্ত্রীলোকটি আমার গৃহে প্রবেশ করিল। দেখিল, আমি যে স্থানে শুইয়াছিলাম, সেইস্থানেই শুইয়া আছি। আমি যে সকল অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছি, তাহার কোন কথা উহাকে বলিলাম না; বরং পূর্ব্বের ন্যায় আমার পিতার মৃতদেহ দেখিবার জন্য, ব্যাকুলতা প্রকাশ করিতে লাগিলাম। ‘কল্য প্রাতঃকালে দেখাইব’ বলিয়া আমার নিকটে বসিয়া সে আমাকে কত প্রকার বুঝাইতে লাগিল। আমি সেইস্থানেই শুইয়া শুইয়া কাঁদিতে লাগিলাম। ক্রমে পুনরায় আমার তন্দ্রা আসিল। যখন আমি গাত্রোত্থান করিলাম, দেখিলাম, রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছে, সেই স্ত্রীলোকটি সেইস্থানে নাই। আমি সেই গৃহ হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বাহির বাড়ীতে যাইলাম। দেখিলাম, আমাদিগের পুরাতন একজন পরিচারিকা সেইস্থান দিয়া গমন করিতেছে। তাহাকে আমি আমার পিতার মৃত্যুসংবাদ প্রদান করিলাম; সে কাঁদিয়া ফেলিল ও কহিল, ‘সেই নিমিত্তই কল্য ইমামুদ্দিন ডাক্তার এইস্থানে আগমন করিয়াছিলেন। সে আপনাকে চিনিত। এ সময়ে আমার পরামর্শদাতা আর কেহই নাই, এই ভাবিয়া আমি সেই পুরাতন পরিচারিকাকে সঙ্গে লইলাম। লইয়া আপনার নিকট এই বিপদের সময় আগমন করিয়াছি। এখন আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করেন, তাহাই করুন। এই বিপদে আপনি ভিন্ন আমার অন্য আর উপায় নাই। উহারা এখন পর্যন্তও আমাকে আমার পিতার মৃতদেহ দর্শন করিতে দেয় নাই। এই বলিয়া কুলসম একেবারে কাঁদিয়া ফেলিল। তাহা দেখিয়া আমি যে সবিশেষ বিচলিত হই নাই—তাহা কে বলিবে?
সপ্তম পরিচ্ছেদ
“কুলসনের কথা শুনিয়া আমার হৃদয়ে বাস্তবিকই দয়ার উদয় হইল। তাহার প্রায় সমস্ত কথাই আমি বিশ্বাস করিলাম; কিন্তু সেই মৃতদেহ যে তাহার পিতা গওহরের দেহ নহে, এই কথা আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে সমর্থ হইলাম না। কুসমকে সেই সময় সম্বোধন করিয়া কহিলাম, ‘কুসম! তুমি পিতৃশোকে নিতান্ত অধীরা হইয়া যে সবিশেষ কষ্টভোগ করিতেছ, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, ও ইহাও দেখিতে পাইতেছি যে, তুমি সম্পূর্ণ বিপদ্গ্রস্ত। কিন্তু সেই মৃতদেহ যে তোমার পিতার দেহ নহে, ইহাও আমি কোনক্রমে বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। কুসম! তুমি বালিকা। অতি অল্প বয়সে তুমি মাতৃহীনা হইয়াছ বলিয়াই, মাতৃশোকে যে কিরূপ অধীর হইতে হয় তাহা তুমি তখন বুঝিতে সমর্থ হও নাই। এখন তুমি বড় হইয়াছ, শোক দুঃখ কাহাকে বলে, তাহা বুঝিতে সমর্থ হইয়াছ বলিয়াই, পিতৃশোকে তুমি এত অধীরা হইয়া পড়িয়াছ। হোসেন খাঁ ও তাঁহার ভগিনী তোমার উচ্ছলিত শোকাবেগ বুঝিতে পারিয়াই, হঠাৎ তোমাকে তোমার পিতার মৃতদেহ দেখিতে দেয় নাই। আমার বিশ্বাস যে, তোমার অবস্থা দেখিয়া উহারা অতিশয় ভীত হইয়াছে। ভাবিয়াছে, তুমি তোমার পিতার মৃতদেহ হঠাৎ দেখিলে, পিতৃশোকের দুর্দমনীয় বেগ কোন প্রকারেই সম্বরণ করিতে পারিবে না, নিতান্ত অধীরা হইয়া মূৰ্চ্ছিতা হইয়া পড়িবে, হয়ত সে মূৰ্চ্ছার আর অপনোদন হইবে না। এই দুৰ্ব্বির্ষহ শোক ক্ৰমে তোমার হৃদয়ে স্থান পাইলে, পরিশেষে তুমি তোমার পিতার মৃতদেহ দেখিলেও, একেবারে হতজ্ঞান হইবে না, এই ভাবিয়াই উহারা সে দৃশ্য তোমায় এখন পর্যন্ত দেখিতে দেয় নাই। কুসম! বর্ষাকালের ভরা নদীর বাঁধ হঠাৎ ভাঙ্গিয়া সেই পথে যখন সমস্ত জলরাশি প্রবল বেগে বহির্গত হইয়া থাকে, তখন কি সেই বাঁধ আর কেহ রক্ষা করিতে পারে? কাহারও ক্ষমতা নাই, সেই বাঁধ বাঁধিয়া পুনরায় সেই প্রচণ্ড স্রোত রক্ষা করে। কিন্তু সেই বাঁধ যদি খোলা থাকে, নদীতে জল-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি সেই খোলা পথে জল বহির্গত হইতে থাকে, তাহা হইলে সেইস্থানের স্রোত কখনই প্রবল হয় না; ইচ্ছা করিলে সহজেই সেই জলস্রোত বন্ধ করা যাইতে পারে। এইরূপ ভাবিয়াই উহারা তোমাকে তোমার পিতার মৃতদেহ এখন পর্যন্ত দর্শন করিতে দেয় নাই। তুমি গুপ্তভাবে তোমার পিতার গৃহে প্রবেশ করিয়া যে দেহ দর্শন করিয়াছ, ও যাহাকে তোমার পিতার দেহ নহে বলিয়া স্থির করিয়াছ, সে অপর কাহারও দেহ নহে, নিশ্চয় জানিও যে, সে তোমার পিতার মৃতদেহ। এখন তুমি পিতৃশোকে নিতান্ত আকুলা, সুতরাং ভাল-মন্দ বিবেচনা-শক্তি হইতে এখন তুমি বঞ্চিতা। তোমার হৃদয় এখন পিতৃচিন্তায় জজ্জরীভূত, অন্য চিন্তা এখন তোমার মনে স্থান পাইতেছে না। তাই এখন তুমি পাগলের ন্যায় মনে মনে কত প্রকার ভাবিতেছ, জাগ্রৎ অবস্থাতেও কত প্রকার স্বপ্ন আসিয়া তোমার মনকে আলোড়িত করিতেছে। এই অবস্থা যে কেবল তোমারই হইয়াছে, তাহা নহে; মানবমাত্রই এই শোকের বশীভূত। একদিবস না একদিবস সকলকেই এইরূপ সহ্য করিতে হয়; তবে কাহাকেও অধিক, কাহাকেও বা অল্প। তুমি যখন আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ, তখন যতদূর সাধ্য, তোমার সাহায্য করাই আমার কর্তব্য। চল, আমিও তোমাদের সহিত গমন করিতেছি। এখনও যদি উহারা তোমাকে তোমার পিতার শব দর্শন করিতে না দেয়, তাহা হইলে আমি যেরূপে পারি, তোমাকে লইয়া তোমার পিতার গৃহে প্রবেশ করিব। সেই সময় তুমি আমার সম্মুখে সেই সব উত্তমরূপে দেখিতে পারিবে। দিনমানে উত্তমরূপে দর্শন করিয়াও যখন তোমার বোধ হইবে যে, উহা তোমার পিতার দেহ নহে, তখন যাহা করিতে হয়, তাহা আমিই করিব, তোমাকে কষ্ট পাইতে হইবে না।’
“আমার প্রস্তাবে কুসম সম্মত হইল। আমার কোচমানকে গাড়ি আনিতে আদেশ করিলাম। সে আজ্ঞা পাইবামাত্র গাড়ি আনিয়া উপস্থিত করিল। কুসম যে পাল্কীতে আগমন করিয়াছিল, সেই পাল্কীতেই উঠিল। তাহার পরিচারিকাকে আমার গাড়িতে উঠাইয়া লইলাম। বেহারাগণ পাল্কী লইয়া মাণিকতলাভিমুখে গমন করিল, আমার গাড়িও আস্তে আস্তে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল।
“কুলসমের পরিচারিকা—গওহর আলির পুরাতন চাকরাণী; সুতরাং কুসম যদি হতজ্ঞান হইয়া তাহার পিতাকে চিনিতে না পারে, তথাপি সেই স্ত্রীলোকটি যে তাহাকে চিনিতে পারিবেই, তাহার আর কোন ভ্রম নাই। এইরূপ বিবেচনা করিয়া, আমি উহাকে আমার গাড়িতেই উঠাইয়া লইলাম। ইহা ব্যতীত আমার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, তাহা আপনি আপনা হইতেই ক্রমে বুঝিতে পারিবেন।
গাড়ি ও পাল্কী ক্রমে গমন করিতে লাগিল। ক্রমে আমরা গওহর আলির বাড়ীর সম্মুখে উপনীত হইলাম।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
“কুসমের পাল্কী বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। সেই সময় আমি কুসমকে বলিয়া দিলাম, ‘যদি উহারা এখনও তোমার পিতার মৃতদেহ তোমাকে দেখিতে না দেয়, তাহা হইলে আমাকে সংবাদ দিও, আমি ভিতরে গিয়া যাহা কর্তব্য বিবেচনা হয়, তাহা করিব। আমাকে এইস্থানেই পাইবে।’ কুসম বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই স্ত্রীলোকটিকেও পাঠাইয়া দিলাম; কুলসমের সহিত গমন করিয়া তাহাকেও সেই মৃতদেহ দেখিতে কহিলাম। আমি সেই বাড়ীর সম্মুখেই গাড়ির ভিতর বসিয়া রহিলাম।
“প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে সেই স্ত্রীলোকটি প্রত্যাগমন করিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় বলিল, ‘প্রাতঃকালে যখন হোসেন খাঁ ও তাঁহার ভগিনী কুলসমের গৃহে প্রবেশ করে, সেই সময় কুলসমকে সেইস্থানে দেখিতে না পাইয়া তাহারা অতিশয় চিন্তিত হয়। কুলসম যে কোথায় গমন করিল, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, অতিশয় ব্যাকুল হয়, এবং পাড়ার ভিতর ও সেই বাড়ীর ভিতরস্থিত নানাস্থানে তাহার অন্বেষণ করে। কোনস্থানে কিন্তু ইহার কোন সংবাদ না পাইয়া অতঃপর কি উপায় অবলম্বন করিবে, বিষণ্নমনে বসিয়া তাহাই ভাবিতেছে, এমন সময় আমরা সেইস্থানে উপনীত হইলাম। আমাদিগকে দেখিয়া তাহারা যেন হস্তে স্বর্গ পাইল, বিশেষ স্নেহের সহিত কুসমকে বসাইল ও আদর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘মা! তুমি আমাদিগকে না বলিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছিলে? তোমার নিমিত্ত যে আমরা ক্রমে আরও অস্থির হইয়া পড়িতেছিলাম।’ উত্তরে কুসম কহিল, ‘যখন আপনারা আমাকে আমার পিতার মৃতদেহ দেখাইলেন না, তখন আমি অনন্যোপায় হইয়া সেই চিকিৎসাকারী ডাক্তারের নিকট গমন করিয়াছিলাম। কারণ, আমি বুঝিয়াছিলাম, তিনি আপনাদিগের মতের পোষকতা করিয়াছিলেন বলিয়াই আপনারা আমার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে দেন নাই। সুতরাং তাঁহার সম্মতি হইলেই আপনারা আমাকে আমার পিতৃদেহ দেখাইতে
‘কুসমের কথাই শেষ হইতে না হইতেই উহারা কহিল, ‘কুসম! তোমারই ইষ্ট কামনা করিয়া আমরা তোমার ইচ্ছার প্রতিকূলতাচরণ করিয়াছিলাম। ইহার নিমিত্ত ডাক্তারের নিকট গমন করার কোন প্রয়োজনই ছিল না। যদি তুমি তোমার পিতার মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত অধীরা হইয়াই থাক, তবে চল,—তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করি।” এই বলিয়া উহারা কুলসমকে লইয়া উপরে গমন করিল।
আমিও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। যে গৃহে আমার মনিব শয়ন করিতেন, দেখিলাম, উহার দ্বার তালাবদ্ধ। হোসেন খাঁ চাবি খুলিয়া দিল; আমরা সকলে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। খাটের উপর দেখিলাম, কে যেন শয়ন করিয়া আছে। তাহার সর্ব্বশরীর কাপড়ে ঢাকা। কুসম বিশেষ ব্যগ্রতার সহিত কাপড় উঠাইয়া ফেলিল, আমরা সকলেই সেই মৃতদেহ উত্তমরূপে দর্শন করিলাম। সেই মৃতদেহ অবলোকন করিয়া কুসম যেন হতজ্ঞান হইল, মৃতের কাপড় ছাড়িয়া দিল, গৃহের চতুর্দ্দিকে যেন একবার চাহিল, পুনরায় কাপড় উঠাইয়া আবার সেই মৃতের মুখ দেখিল। আবার সেই কাপড় ছাড়িয়া দিল, দুই হস্তদ্বারা দুই তিন বার চক্ষু মুছিল আবার কাপড় উঠাইল, আবার সেই মৃতদেহ দর্শন করিল। এবার আর কোনক্রমেই স্থির থাকিতে না পারিয়া কুসম ‘পিতা পিতা’ বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। আমিও কোন প্রকারে তখন রোদন সম্বরণ করিতে না পারিয়া, চীৎকার করিয়া উঠিলাম।’
“সেই স্ত্রীলোকটির সমস্ত কথা আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিয়া তাহাকে কহিলাম, ‘তুমি যে মৃতদেহ দর্শন করিলে উহা কাহার মৃতদেহ?”
“উত্তরে সে কহিল, ‘সেই মৃতদেহ আমার পুরাতন মনিব সেই গওহর আলি সাহেবের।’
‘কুলসম সেই মৃতদেহ দেখিয়া কি বলিল?”
‘কি আর বলিবে মহাশয়! উহা দেখিবামাত্র তাহার পিতৃশোক উথলিয়া উঠিল। সে পিতা পিতা’ বলিয়া এখনও ধরায় লুণ্ঠিতা হইয়া রোদন করিতেছে।’
“সেই স্ত্রীলোকটির কথা শুনিয়া তখন বুঝিলাম, কুসম শোকাবেগের বশবর্তিনী হইয়াই সেইরূপ মহাভ্রমে পতিত হইয়াছিল। ইহাও ভাবিলাম, যখন কুলসমের সন্দেহ মিটিয়া গেল, তখনই শীঘ্রই ইহার সৎকার হওয়া আবশ্যক। এই বলিয়া সেই স্ত্রীলোকটি দ্বারা হোসেন খাঁকে ডাকাইলাম। সে আমার নিকট আগমন করিলে কহিলাম, ‘লাস সৎকারের নিমিত্ত তোমরা এত বিলম্ব করিতেছ কেন?”
“উত্তরে সে কহিল, ‘মহাশয়! দেখিয়াছেনই ত, আমাদিগের বাড়ীতে অপর লোক আর কেহই নাই; সুতরাং রাত্রিতে উহাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত কোন প্রকার বন্দোবস্ত করিয়া উঠিতে পারি নাই। আজ সকালে সমস্ত ঠিক হইয়াছে; এই পাড়ার মুসলমানদিগকে আমি সংবাদ প্রদান করিয়াছি, তাঁহারা এখনই আসিবেন। বস্ত্র প্রভৃতি যাহা কিছু প্রয়োজন হইবে, তাহারও সমস্ত যোগাড় করিয়া আনিয়াছি। উঁহারা আসিলে—তৎক্ষণাৎ আমরা ইঁহাকে লইয়া গিয়া মাটি দিয়া আসিব।’
“হোসেন খাঁর কথা শুনিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। ক্রমে দেখিতে দেখিতে এক এক করিয়া পাড়ার অনেকেই আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইতে লাগিল। আরও দেখিলাম, প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা মধ্যে উহারা আমাদিগের প্রথামত সেই মৃতদেহ একখানি চারিপায়ার উপর উত্তম বস্ত্রদ্বারা আবৃত করিয়া, মাণিকতলায় গোর-স্থানাভিমুখে লইয়া গেল। এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমি সেইস্থান হইতে আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। আসিবার সময় সেই স্ত্রীলোকটিকে কহিলাম, ‘তুমি দেখিও, যেন কুলসমের কোন প্রকারে অযত্ন না হয়। যদি বুঝিতে পার, ইহার কোনরূপ কষ্ট হইতেছে, তাহা হইলে তখনই আমার নিকট গমন করিয়া সেই সংবাদ আমাকে প্রদান করিও।’ এই বলিয়া আমার পকেট হইতে দুইটি মুদ্রা বাহির করিয়া তাহাকে প্রদান করিলাম। আরও কহিলাম, ‘তুমি কুসমকে বিশেষ যত্ন করিও, আমি তোমাকে উপযুক্তরূপ পারিতোষিক প্রদান করিব। মধ্যে মধ্যে তুমি আমার নিকট গমন করিয়া কুলসমের সংবাদ আমাকে বলিয়া আসিও, আমিও অবকাশ মত তোমার বাড়ীতে আগমন করিয়া তাহার সংবাদ গ্রহণ করিব।’ এই বলিয়া তাহার বাড়ীর ঠিকানা আমার পকেট বহিতে লিখিয়া লইয়া, আমার বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। সেই শোক-শুষ্কা স্বর্ণলতার সহিত সে দিবস আর আমার সাক্ষাৎ হইল না।”
নবম পরিচ্ছেদ
ঘটনা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিতে করিতে আমি মনে করিলাম, মাতা-পিতৃহীনা, অপরিচিতা বালিকা কুলসম—ডাক্তারের কেহই নহে, ইতিপূর্ব্বে তিনি কুলসমকে যে আর কখন দেখিয়াছিলেন, তাহাও বোধ হয় না; তবে কেন আজ তিনি কুলসমের নিমিত্ত এত কষ্ট সহ্য করিতে প্রস্তুত? যাহাতে কুসমের কোন প্রকারে কষ্ট না হয়, সেইদিকে আজ তাঁহার এত প্রখরদৃষ্টি কেন? কে বলিবে কেন?—দূর হউক, আমার তাহাতে আসে যায় কি? যে কার্য্যে আসিয়াছি, তাহাই করিয়া যাই।
ডাক্তার বলিতে লাগিলেন, “সেই পরিচারিকাকে পূৰ্ব্বকথিত উপদেশ প্রদান পূর্ব্বক বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। নিয়মিত কার্যে মনকে ব্যাপৃত করিতে চেষ্টা করিলাম; কিন্তু দেখিলাম, আজ আমার মন আমার বশীভূত নহে। কেন যে সে আজ আমার বিদ্রোহী হইল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। দিবা দ্বিপ্রহরের সময় মন আমার উপর প্রাধান্য বিস্তার করিয়া, আমাকে লইয়া সেই পরিচারিকার বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইল। সেইস্থানে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহাকে কুলসমের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম এবং ইহাও তাহাকে বলিয়া দিলাম যে, ‘যদি এইস্থানে কুলসমের কোনরূপ কষ্ট হইতেছে, এরূপ বুঝিতে পার, তাহা হইলে তাহাকে আমার বাড়ীতে থাকিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিও।’ আরও বলিয়া দিলাম, ‘আমার বাড়ীতে আমার একমাত্র বৃদ্ধমাতা ভিন্ন অপর স্ত্রীলোক কেহই নাই, কুলসম কুসুমকে পাইলে, তিনি বিশেষ যত্নের সহিত রাখিবেন।’
“পরিচারিকা সময় মত কুলসমকে আমার অভিপ্রায় জানাইতে সম্মত হইল। সন্ধ্যার পর আমি পুনরায় আগমন করিব বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। আমার প্রস্তাবে কুলসম সম্মত হইবে কি না, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। কখন সন্ধ্যা হইবে, কখন গিয়া কুলসমের মনোভাব অবগত হইতে পারিব, এইরূপ যতই ভাবিতে লাগিলাম, দিনমান যেন ততই দীর্ঘ বোধ হইতে লাগিল, সন্ধ্যা-সতী ততই যেন বিলম্ব করিয়া আগমন করিতে লাগিলেন।
“সন্ধ্যার পর পুনরায় সেই পরিচারিকার গৃহে উপনীত হইলাম। তাহার নিকট অবগত হইলাম,—সে আমার মনের ভাব কুলসমের নিকট প্রকাশ করিয়াছিল, কিন্তু কুলসম তাহাতে সম্মত হয় নাই। বরং বলিয়াছে, তাহার বিমাতা তাহাকে বিশেষ যত্ন করিতেছেন, ও যাহাতে কোন বিষয়ে তাহার কোন প্রকার কষ্ট না হয়, তজ্জন্য সতত যত্নবতী আছেন। উহার কথা শুনিয়া প্রথমে মনে একটু কষ্ট হইল; কিন্তু তাহার কোন প্রকার কষ্ট নাই শুনিয়া, পরিশেষে আনন্দিত হইলাম।
“এইরূপে প্রায় এক সপ্তাহ অতীত হইয়া গেল। এই সময়ের মধ্যে যখনই আমি কুসমের সংবাদ লইতাম, তখনই জানিতে পারিতাম, সে বিশেষ সুখের সহিত দিনযাপন করিতেছে। পিতার মৃত্যুতে প্রথমে যথেষ্ট কষ্ট হইলেও, স্নেহময়ী বিমাতার গুণে সে পিতৃশোক ভুলিয়া গিয়াছে।
“কুলসমের যে সমাচারমাত্র শুনিয়া আমার মন সর্ব্বদা আনন্দিত থাকিত, অতঃপর অদৃষ্ট-দোষে সেই সমাচার হইতেও আমি বঞ্চিত হইলাম। কুলসমের পিতার মৃত্যুর আট দশ দিবস পর হইতেই, সেই বাড়ীতে পূর্ব্বোক্ত পরিচারিকার যাওয়া বন্ধ হইল। একটি সামান্য ছল অবলম্বন করিয়া হোসেন খাঁ তাহাদিগের বাড়ীতে উহার যাওয়া বন্ধ করিয়া দিল। সুতরাং সেই অবধি কুলসমের সংবাদ জানিবার আমার আর কোন উপায় রহিল না। সেই বাড়ীতে গতিবিধি আছে, এমন আর কোন লোকের সন্ধান করিয়াও উঠিতে পারিলাম না।
“একদিবস রাত্রিতে আমি নিদ্রিতাবস্থায় একটি দুঃস্বপ্ন দেখিয়া হঠাৎ জাগিয়া গাত্রোত্থান করিলাম। সে রাত্রিতে কোন প্রকারেই আর নিদ্রা আসিল না। নানারূপ ভাবনা আসিয়া আমার চিত্ত অধিকার করিল। সেই ভাবনা-স্রোতের মধ্যে দেখিলাম, ক্রমে কুলসমের ভাবনাও আসিয়া উপস্থিত হইল। সে এখন কিরূপ অবস্থায় আছে? কোথায় আছে? তাহার বিমাতা কি এখনও সেই প্রকার যত্ন করিয়া, তাহাকে প্রতিপালন করিতেছে? হোসেন খাঁ বাস্তবিকই তাহাকে কি প্রাণের সহিত ভালবাসিয়া থাকে? কিরূপে তাহাকে একবার দেখিতে পাইব? কিরূপেই বা তাহার সমাচার প্রাপ্ত হইব? এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। আমি শয্যা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক বাহিরের গৃহে আগমন করিলাম। সে দিবা কোন কৰ্ম্মই আমার ভাল লাগিল না, কিছুতেই আমার মনকে স্থির করিতে পারিলাম না।
“কলিকাতায় আসিয়া অল্পদিনমাত্র ব্যবসায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। যে সকল রোগী আমার চিকিৎসাধীনে আছে, তাহাদিগকে না দেখিলেও নয়; কাজেই ইচ্ছার বিপরীতেও আমাকে রোগী দেখিতে গমন করিতে হইল। যে দুই তিনটি রোগী ছিল, তাহা দেখিয়া দিবা দশটার সময় সারকিউলার রোড দিয়া প্রত্যাগমন করিতেছি, এমন সময় দেখিলাম, ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ নিজের গাড়িতে গমন করিতেছেন; আর সেই গাড়ির ভিতর দ্বিজেন্দ্রনাথ বাবুর সম্মুখে হোসেন খাঁ বসিয়া রহিয়াছে। দ্বিজেন্দ্রনাথবাবুর সহিত হোসেন খাঁকে দেখিয়া আমার মন যেন কেমন হইল। ভাবিলাম, হোসেন খাঁর বাড়ীতে কি পুনরায় আর কাহারও পীড়া হইয়াছে? যদি তাহাই হইবে, তবে আমাকে না ডাকিয়া দ্বিজেন্দ্রনাথ বাবুকেই বা ডাকিল কেন? আমি গওহরকে বাঁচাইতে পারি নাই বলিয়াই, কি উহারা আমাকে আর ডাকিল না? এই প্রকার নানারূপ ভাবিতে ভাবিতে আমার বাসায় ফিরিলাম।
দশম পরিচ্ছেদ
“এই বিষয় সম্বন্ধে অনেক প্রকার ভাবিয়া, অনেকরূপ আলোচনা করিয়া, পরিশেষে দ্বিজেন্দ্রনাথ বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করাই সাব্যস্ত করিলাম। আমি দ্বিজেন্দ্রনাথবাবুর বাসা জানিতাম। সেইদিবস বেলা চারিটার সময় তাঁহার বাসায় গিয়া উপনীত হইলাম।
“দ্বিজেন্দ্রনাথবাবু ও আমি একই বৎসর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া সরকারী কার্য্য গ্রহণ করি। আমি ছিলাম—সাহাবাদ জেলায়, আর দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন—অযোধ্যায়। প্রায় এক সময়ে আমরা উভয়ে কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, স্বাধীনভাবে চিকিৎসা করিবার অভিপ্রায়ে কলিকাতায় আগমন করি। আমি সিকদার বাগানে একটি বাড়ী ভাড়া করি; দ্বিজেন্দ্রনাথবাবু বাড়ী লয়েন—চোরবাগানে।
“বৈকালে যখন দ্বিজেন্দ্রনাথবাবুর বাসায় যাই, তিনি তখন বাসায় ছিলেন না। আমার সেইস্থানে উপস্থিত হইবার প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে তিনি আগমন করিলেন। আমাকে বিশেষ সম্মানের সহিত আপনার নিকট বসাইলেন, ও অন্যান্য অনেক কথার পর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার এখন কি মনে করিয়া আগমন?’
আমি। অনেক দিবস আপনার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই; বিশেষ একটু প্রয়োজনও আছে।
দ্বিজেন্দ্র। এমন কি প্রয়োজন আছে যে, আপনাকে নিজে আমার নিকট আগমন করিতে হইল?
আমি। আপনি আজ একজন মুসলমানের সহিত সারকিউলার রোড দিয়া গমন করিতেছিলেন নয়?
দ্বিজেন্দ্র। হোসেন খাঁ নামে একজন মুসলমানের সহিত তাহার বাড়ীতে একটী রোগী দেখিতে গমন করিয়াছিলাম?
আমি। হোসেন খাঁর বাড়ীতে রোগী? তথায় কাহার ব্যারাম হইয়াছে?
দ্বিজেন্দ্র। রোগের কথা শ্রবণ করিয়া আপনি এত ব্যস্ত হইতেছেন কেন?
আমি। না তা’ নয়—কাহার ব্যারাম, এ কথা জিজ্ঞাসা করিবার কারণ,—সেই বাড়ীর অনেককেই আমি জানি।
দ্বিজেন্দ্র। হোসেন খাঁর ভাগ্নী কুসম নাম্নী একটি বালিকাকে দেখাইবার নিমিত্ত সে আমাকে লইয়া গিয়াছিল।
“দ্বিজেন্দ্রনাথের এই কথা শুনিয়া ক্ষণকালের নিমিত্ত যেন আমি চৈতন্যহারা হইলাম। পরিশেষে অনেক কষ্টে মনের আবেগ সম্বরণ করিয়া কহিলাম, ‘কুলসম?—কুলসমের ব্যারাম হইয়াছে? তাহার কি রোগ দেখিলেন?”
দ্বিজেন্দ্র। জ্বরাতিসারে সে শয্যাগত, তাহার বাঁচিবার আশা নাই। বোধ হয়, দুই এক দিবসের মধ্যেই তাহার জীবনলীলা শেষ হইবে।
আমি। এ রোগ তাহার কতদিবস হইয়াছে বোধ হয়?
দ্বিজেন্দ্র। এ অতি পুরাতন রোগ; শুনিলাম, দুই তিন বৎসর হইতে সে এই রোগে ভুগিতেছে।
আমি। কুলসমকে আমি বিশ দিবস পূর্ব্বে দেখিয়াছি, সেই সময় তাহার কোন প্রকার রোগ ছিল না, সবল ও সুস্থ ছিল। আমার বোধ হয়, তবে এ কুলসম নহে; অন্য কোন স্ত্রীলোক হইবে।
দ্বিজেন্দ্র। না, এ কুলসমই, গওহরের একমাত্র কন্যা—কুলসম। এই কথা আমাকে হোসেন খাঁ স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছে।
“দ্বিজেন্দ্রনাথের এই কথা শুনিয়া উহাদিগের যে সকল বিষয় আমি অবগত ছিলাম, তাহা তাঁহাকে স্পষ্ট করিয়া কহিলাম। গওহরের মৃত্যুশয্যায় চিকিৎসা, তাহার মৃত্যু, তাহার স্ত্রী এবং হোসেন খাঁর অবস্থা, রোগী দেখিতে গিয়া আমার বিপদ, কুলসমের শিবিকায় পিতৃগৃহে আগমন, মৃত পিতাকে দেখিবার নিমিত্ত তাহার ইচ্ছা ও আমাদিগের নিষেধ, তৎপরদিবস আমার বাসায় কুলসমের আগমন, তাহার বিবৃত কাহিনী, পরিশেষে তাহার সহিত আমার গমন, তাহার পিতৃদেহ সন্দর্শন ও সৎকার প্রভৃতি সমস্ত কথা আমি দ্বিজেন্দ্রনাথকে আনুপূর্ব্বিক কহিলাম। তিনি সমস্ত কথা শুনিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন ও পরিশেষে কহিলেন, ‘আগামী কল্য প্রাতঃকালে যখন পুনরায় আমি সেইস্থানে গমন করিব; সেই সময় আমি বিশেষ করিয়া ইহা অবগত হইব যে, বর্তমান রোগী সেই কুসম কি না।’
“দ্বিজেন্দ্রনাথের কথায় আমি আনন্দিত হইলাম, এবং তাঁহাকে কহিলাম, ‘আমাকে যদি কোন প্রকারে সেইস্থানে লইয়া যাইতে পারেন, কোন প্রকারে আমাকে সেই রোগী দেখাইবার যদি বন্দোবস্ত করিতে পারেন, তাহা হইলে আমি অনায়াসেই বুঝিতে পারিব যে, এই রোগী সেই কুসম কিনা?’ তিনি তাহারও চেষ্টা করিবেন প্রতিজ্ঞা করিলেন; আমিও সে দিবস সে স্থান পরিত্যাগ করিলাম।
“পরদিবস অর্থাৎ অদ্য দিবা দুইটার সময় আমি পুনরায় দ্বিজেন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম। তিনি কহিলেন, ‘আমি অনুসন্ধান করিয়া হোসেন ও তাহার ভগিনীর নিকট হইতে অবগত হইলাম, বর্তমান রোগী গওহরের কন্যা—সেই কুলসম। রোগ অতিশয় কঠিন, সুতরাং অপর আর একজন চিকিৎসকের সহিত পরামর্শ করিয়া ঔষধাদির ব্যবস্থা করিলে ভাল হয়, এই প্রস্তাব করিলে হোসেন খাঁ আমার প্রস্তাবে প্রথমে সম্মত হইয়াছিল। কিন্তু যখন আপনাকে ডাকিয়া আনিবার পরামর্শ দিলাম, তখন হোসেন খাঁ সে মত উল্টাইয়া দিল। বোধ হইল, আপনার উপর তাহারা সন্তুষ্ট নহে।
“এই কথা শুনিয়া আমি বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। মনে নানাপ্রকার ভাবনার আবির্ভাব হইতে লাগিল। সেই সময় যোগেন বাবু এইস্থানে আগমন করিয়াছিলেন। তিনি আমার একজন বিশেষ বন্ধু, সুতরাং সমস্ত কথা তাঁহার নিকট কহিলাম। তিনি আপনাকে আমার নিকট পাঠাইয়া দিবেন বলিয়া গেলেন, আপনিও আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। এক্ষণে আমার নিকট সমস্ত ব্যাপার শ্রবণ করিলেন। অতএব অনুগ্রহ পূর্ব্বক বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখুন দেখি, ইহার ভিতর কোন প্রকারের রহস্য আছে কি না?”
একাদশ পরিচ্ছেদ
ডাক্তার ইমামুদ্দিনের নিকট সমস্ত ব্যাপার শ্রবণ করিয়া, আমি সে বিষয় আদ্যোপান্ত উত্তমরূপে আলোচনা করিতে . লাগিলাম। ইহার ভিতরের অনেক বিষয় অবলম্বন করিয়া উভয়ে বাদ-প্রতিবাদ করিতে আরম্ভ করিলাম। উভয়ের কথাবার্তা হইতেছে, এরূপ সময়ে বেহারা একখানি পত্র লইয়া ডাক্তার সাহেবের হস্তে প্রদান করিল; বলিল, ‘একজন দ্বারবান্ আসিয়া ইহা দিয়া গেল।’ ডাক্তার সাহেব সেই পত্র পাঠ করিতে করিতে যেন হতজ্ঞান হইয়া পড়িলেন, তাঁহার বাক্শক্তি ক্ষণকালের নিমিত্ত বন্ধ হইয়া গেল। পত্রখানি হস্তচ্যুত হইয়া সেইস্থানে পতিত হইল।
পত্রপাঠে ডাক্তার সাহেবের এইরূপ অবস্থা হইল দেখিয়া, উহাতে যে কি লেখা আছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার একান্ত কৌতূহল জন্মিল। পত্রখানি সেইস্থান হইতে উঠাইয়া আমি পাঠ করিলাম। উহাতে লেখা ছিল;—
“প্রিয় ইমামুদ্দিন!
কুসমের অবস্থা জানিবার নিমিত্ত তুমি একান্ত ব্যস্ত ছিলে বলিয়া, এই নিদারুণ সংবাদ তোমাকে প্রদান করিতে বাধ্য হইলাম। এক ঘণ্টামাত্র অতীত হইল, আমি আমার চিকিৎসাধীনা কুসমকে দেখিতে গিয়াছিলাম; কিন্তু সেইস্থানে গমন করিয়া দেখি, কুলসম আর জীবিতা নাই। আমি তাহার মৃতদেহ দর্শন করিয়াছি। আমার বোধ হয় আমার সেইস্থানের গমনের অতি অল্পক্ষণ পূর্ব্বেই সে ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে।
তোমার
শ্রীদ্বিজেন্দ্রনাথ।”
এই পত্র পাঠ করিয়া ইমামুদ্দিনের হতজ্ঞান হইবারই কথা। যিনি যাহাকে ভালবাসেন, যাহার নিমিত্ত হৃদয় সৰ্ব্বদা অস্থির থাকে, যাহার বিপদজনক ভাবী অমঙ্গল ঘটনা কল্পনা করিলেও যাহার অন্তরে অনিবাৰ্য্য শোক আসিয়া উপস্থিত হয়, একেবারে তাহার মৃত্যুসংবাদ প্রাপ্ত হইলে, হতজ্ঞান না হইয়া তিনি কতক্ষণ স্থির থাকিতে পারেন?
ইতিপূর্ব্বে আমি ইমামুদ্দিনের নিকট যে সকল ব্যাপার শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহাতেই আমি এক প্রকার বিস্মিত হইয়াছিলাম। কিন্তু তাহার উপর এই পত্র পাঠ করিয়া তিনিও স্তম্ভিত হইলেন, সেই সঙ্গে আমার মনেও এক প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি আপন মনের ভাব গোপন করিয়া ইমামুদ্দিনকে সান্ত্বনা করিবার অভিপ্রায়ে কহিলাম, “এই পত্র পাঠ করিয়া আপনি অস্থির হইতেছেন কেন? যাহাকে আপনি কয়েক দিবস পূর্ব্বে সম্পূর্ণ সুস্থ কলেবরে দেখিয়াছেন, সে বহুদিবসের জ্বরাতিসারে হঠাৎ মরিবে কি প্রকারে? দ্বিজেন্দ্রনাথ ভ্রমে পতিত হইয়াছেন, অপর কাহারও চিকিৎসা করিয়া তাহাকেই কুসম স্থির করিয়া লইয়াছেন। বিশেষতঃ পূর্ব্বে কখনই তিনি কুলসমকে দেখেন নাই। এরূপ অবস্থায় আপনি অধীর হইবেন না। আমি পুলিস-কর্মচারী, যে বিষয়ে আমার সন্দেহ হইবে, তাহা দেখিবার আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। এরূপ অবস্থায় আপনি আমার সহিত আগমন করুন, আমরা উভয়েই এখন সেইস্থানে গমন করিব। আপনি যাহাতে স্বচক্ষে সেই মৃতদেহ দর্শন করিতে পারেন, আমি তাহার উপায় করিব। তাহা হইলেই আমাদিগের চক্ষু-কর্ণের বিবাদ মিটিয়া যাইবে। সত্বর হউন, এখন আর কালবিলম্ব করা কোনরূপেই উচিত নহে।”
যাহার হৃদয় শোকের প্রবল স্রোতে ভাসিয়া যাইতেছিল, আজ সেই ডাক্তার, আমার কথায় সম্মত হইয়া, শীঘ্র তাঁহার গাড়ি প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত কোচমানকে আদেশ প্রদান করিলেন। দেখিতে দেখিতে গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহার সেই বেহারাকে সঙ্গে লইয়া সেই গাড়িতে উভয়েই কুলসমের বাটী-অভিমুখে গমন করিলাম। বাড়ীর একটু দূরে গাড়ি ও বেহারাকে রাখিয়া, আমরা উভয়েই সেই বাড়ীর ভিতর নিঃশব্দে প্রবেশ করিলাম। সেইস্থানে অন্ধকারময়ী রজনীর অন্ধকারে আমরা আপন আপন দেহ লুকাইয়া সেই বৃক্ষরাজি-সমাকীর্ণ পুরাতন, অথচ ভগ্ন বাড়ীর ভিতর ধীরে ধীরে উপনীত হইলাম। প্রবেশকালে আমরা কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না, বা কেহই আমাদিগের গতি রোধ করিতে অগ্রসর হইল না। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ক্রমে আমরা সেই অন্দর মহলের ভিতর প্রবেশ করিলাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরাতন ও ভগ্ন সিঁড়ি দিয়া ক্রমে আমরা উভরে উঠিলাম, তখন পর্যন্তও কোন প্রাণীর সাড়াশব্দ পাইলাম না।
ডাক্তার সাহেব, যে গৃহে গওহর আলির মৃতদেহ পূৰ্ব্বে দেখিয়া আসিয়াছিলেন, ক্রমে আমরা সেই গৃহের নিকট গিয়া উপনীত হইলাম। দেখিলাম, বাহির হইতে সেই গৃহের জীর্ণ দ্বার তালাবদ্ধ। সেই পুরাতন দ্বারের ফাঁক দিয়া দেখিলাম, উহার ভিতর একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে। সেই গৃহের একপার্শ্বে একখানি খাটের উপর কে যেন বস্ত্রাচ্ছাদিত হইয়া শয়ন করিয়া আছে; কিন্তু সেই গৃহে অপর লোকজন আর কেহই নাই।
এই অবস্থা দেখিয়া আমি আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না, সবলে অথচ নিঃশব্দে সেই তালা ভাঙ্গিয়া সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ইমামুদ্দিন দ্রুতপদে সেই বস্ত্রাচ্ছাদিত মনুষ্যের নিকটবর্তী হইয়া তাহার আচ্ছাদক বস্তু উন্মোচন করিলেন। তখন দেখিতে পাইলেন, উহা একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ।
যে সময়ে সেই মৃতদেহের উপর ইমামুদ্দিনের নয়ন আকৃষ্ট হইল। সেই সময়ে তাঁহার হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার ছিল কি না, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ নহে। তিনি প্রথমে সেই মৃতদেহ দর্শন করিলেন; কিন্তু আপন চক্ষুকে বিশ্বাস না করিয়া নিকটবর্তী সেই প্রজ্বলিত প্রদীপ আনিয়া পুনরায় উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, “এতক্ষণ পরে আমার হৃদয় একটু শান্ত হইল, ইহা কুসমের মৃতদেহ নহে। এ মুখ কখনই কুলসমের হইতে পারে না। কিন্তু আমার কুসম কোথায়?” ইমামুদ্দিনের এই কথা শুনিয়া আমিও সন্তুষ্ট হইলাম; কিন্তু সেই সময়ে তাঁহাকে স্থির হইতে কহিলাম। আরও কহিলাম, “এখন গোলযোগ করিলে কুলসম, হোসেন খাঁ প্রভৃতি কাহারই সন্ধান পাইব না। যদি ইহারা কোন পাপে লিপ্ত থাকে, তাহা হইলে এইস্থানে আমাদিগের আগমনবার্তা জানিতে পাইবামাত্র উহারা পলায়ন করিবে। সুতরাং আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না, অথচ এই অদ্ভুত রহস্য চিরদিবসের নিমিত্ত অপ্রকাশিত থাকিবে।”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
এখন ইমামুদ্দিনকে কিয়ৎ পরিমাণে প্রকৃতিস্থ বোধ হইতে লাগিল। কিন্তু যে পৰ্য্যন্ত কুলসমকে দেখিতে পাইতেছেন না, সেই পর্যন্ত তিনি একেবারে স্থির হইতে পারিবেন কিরূপে? এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমিও অতিশয় বিস্মিত হইলাম। তখন কুলসমের অনুসন্ধানই আমাদিগের সর্ব্বপ্রথমে করণীয় হইল, তৎপরে কর্তব্য—হোসেন খাঁ ও সেই স্ত্রীলোকটিকে খুঁজিয়া বাহির করা।
যে গৃহে শব রাখা হইয়াছিল, তাহার ভিতরস্থিত প্রজ্বলিত মৃৎপ্রদীপ নিৰ্ব্বাপিত করিয়া কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে স্থিরভাবে দাঁড়াইলাম। ইচ্ছা—সেই ঘোর রজনীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া যদি কোনরূপ শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। কিন্তু তাহা ঘটিল না, কোন গৃহের ভিতর হইতে কোনরূপ শব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল না। তখন উভয়েই আস্তে আস্তে সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া, সেই গৃহের সম্মুখবর্তী অথচ একটু দূরের বারান্দার উপর গিয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইলাম। সেই সময়ে বোধ হইল, সেই বাড়ীর অনতিদূরে বাগানের মধ্যস্থিত পূর্ব্বকথিত সেই পুষ্করিণীর নিকট হইতে যেন এক প্রকার অস্পষ্ট শব্দ উত্থিত হইতেছে।
এই শব্দ শ্রবণ করিয়া আমরা উভয়েই ধীরে ধীরে সেই ভগ্ন অট্টালিকার সোপানাবলী বাহিয়া নিম্নে আগমন করিলাম। কিন্তু অপর আর কাহারও সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইল না। নীচে নামিয়া পরিশেষে উভয়েই সেই পুষ্করিণী-অভিমুখে আস্তে আস্তে চলিলাম। যতই সেই পুষ্করিণীর নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিলাম, পূৰ্ব্বশ্ৰুত শব্দ ততই যেন নিকটবর্তী বোধ হইতে লাগিল। সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া নিস্তব্ধ ভাবে ক্রমশই অগ্রবর্ত্তী হইতে লাগিলাম। ইতিপূৰ্ব্বে এরূপ কার্য্যে ইমামুদ্দিন যদিও কখন অগ্রসর হন নাই, কিন্তু প্রবল প্রণয়ের অনিবার্য্য স্রোতের বশবর্তী হইয়া, ভাবী বিপদের আশঙ্কা হৃদয় হইতে দূর করিয়া, তিনি আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। যে কাৰ্য্যে আজ আমি অগ্রবর্তী, সেই কার্য্য আমার পক্ষে নূতন নহে। বিপদ্-সমাকীর্ণ স্থানে এইরূপ ভাবে আমি যে কতবার গমন করিয়াছি, তাহার সংখ্যা নাই। এইরূপ অসীম সাহসের উপর নির্ভর করিয়া এইরূপ ভাবে কত পাপীকে যে কত সময়ে ধৃত করিয়াছি, তাহার সম্পূর্ণ তালিকা আমার নিকট আছে কি না সন্দেহ।
ক্রমে আমরা সেই শব্দের নিকটবর্তী হইয়া একটি আম্রবৃক্ষের অন্তরালে দণ্ডায়মান হইলাম। রজনী যদিও গাঢ় অন্ধকারময়ী, তথাপি আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, সেই আম্রবৃক্ষের অল্পদূরে এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান হইয়া এক মনে এক স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে নিযুক্ত রহিয়াছে। তাহার কোন দিকে লক্ষ্য নাই, কোন দিকে দৃষ্টি নাই, একাগ্রচিত্তে কোদালিহস্তে সে একটি খাদ খনন করিতেছে।
এই অবস্থা দেখিয়া উভয়েই বিস্মিত হইলাম, একটু ভীতও হইলাম। আমাদিগের নিশ্বাস ঘন ঘন বহিতে আরম্ভ করিল। তখন আর কোন কথা না বলিয়া, হিতাহিত কোন বিষয় না ভাবিয়া, উভয়েই সেই আম্রবৃক্ষের অন্তরাল হইতে বহির্গত হইলাম, ও দ্রুতপদে গমন করিয়া সেই মৃত্তিকা-খননকারীর উপর সবেগে পতিত হইলাম। সে ব্যক্তি নিজ হস্তস্থিত কোদালি দিয়া আমাদিগকে প্রহার করিবার নিমিত্ত সবিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু যখন কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিল না, তখন বলপ্রয়োগে আমাদিগের হস্ত ছাড়াইয়া পলায়ন করিবার চেষ্টা করিল। সে একাকী, আমরা দুইজন; বিশেষতঃ সে মৃত্তিকা খনন করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, এদিকে আমরা সতেজ; সুতরাং তাহার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হইল। উপায়াভাবে সে আমাদিগের হস্তে বন্দী হইল।
আমরা উভয়ে মিলিয়া তাহাকে উত্তমরূপে বাঁধিলাম। সে কে? সে এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছে যে, আমরা চোরের ন্যায় ইহাকে উত্তমরূপে বাঁধিলাম? নিশীথ সময়ে একাকী মৃত্তিকা খনন করিলে যদি কাহারও কোন অপরাধ হয়, তাহা হইলে তজ্জন্য তাহাকে বন্ধন করিতে পারি। নতুবা আইন-সঙ্গত কোন অপরাধই ইহার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথের পত্রে পূর্ব্বে অবগত হইয়াছিলাম বটে যে, কুলসমের মৃত্যু হইয়াছে। কিন্তু গুপ্ত ভাবে আমরা যে মৃতদেহ দর্শন করিয়াছি, সেই মৃতদেহ কুলসমের নহে। তবে কেন আমরা উহাকে ধৃত করিলাম? এ ভাবনা এখন আমাদিগের মনে হইল না। কিন্তু তাহাকে ধৃত করিয়া তাহাকে আবদ্ধ করিলাম।
এ ব্যক্তিকে উত্তমরূপে বাঁধিয়া, আমি আমার পকেট হইতে একটি দিয়াশলাই বাহির করিয়া জ্বালিলাম। এই আলোর সাহায্যে ইমামুদ্দিন ইহাকে দেখিলেন, দেখিয়া চিনিলেন। পাঠক! ইনি আপনাদিগের পূর্ব্বপরিচিত সেই হোসেন খাঁ। এ যে স্থান খনন করিতেছিল, তাহা দেখিয়া বোধ হইল, কোন ব্যক্তিকে সেইস্থানে প্রোথিত করিবার নিমিত্ত এই কবর প্রস্তুত হইতেছিল।
আমি উহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “হোসেন খাঁ! কুলসমকে এখন কোথায় রাখিয়াছ?”
উত্তরে হোসেন খাঁ কহিল, “সে মরিয়া গিয়াছে।”
“না, সে মরে নাই। উপরের গৃহে বস্ত্রাচ্ছাদিত যে মৃতদেহ আছে, তাহা কুলসমের মৃতদেহ নহে।”
আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া হোসেন খাঁ নিরুত্তর। ইহার পর উভয়ে তাহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু হোসেন খাঁর নিকট হইতে কোন কথার উত্তর আর পাওয়া গেল না, সে নিতান্ত গম্ভীরভাবে আপনার মুখ বন্ধ করিয়া রাখিল।
আমি যখন দেখিলাম, তাহার নিকট হইতে আর কোন কথা পাইবার সম্ভাবনা নাই, অথচ চীৎকার করিয়া পাছে আমাদিগের সকল কার্য্য নষ্ট করিয়া দেয়, এইজন্য উত্তমরূপে কাপড় জড়াইয়া হোসেন খাঁর মুখ বন্ধ করিয়া দিলাম; কথা কহিবার বা চীৎকার করিবার ক্ষমতা আর তাহার রহিল না। এখন আমরা উভয়ে তাহাকে লইয়া সেই উদ্যান হইতে বাড়ীর ভিতর গমন করিলাম, এবং পরিশেষে সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যে স্থানে আমাদিগের গাড়ী ছিল, সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম, ও সেইরূপ বন্ধনাবস্থায় হোসেন খাঁকে সেই গাড়ির ভিতর রাখিয়া দিলাম। যাহাতে এই ব্যক্তি কোনরূপে গাড়ির ভিতর হইতে পলায়ন করিতে না পারে, সহিস, কোচমান ও বেহারাকে এইরূপ উপদেশ দিয়া, আমরা পুনরায় সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
আমরা উভয়ে পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। ইমামুদ্দিনের গাড়িতে যে দুইটি লন্ঠন জ্বলিতেছিল, তাহার একটি খুলিয়া সেই আলোর সাহায্যে আমরা এবার সেই বাড়ীর ভিতর দ্রুতপদে প্রবেশ করিলাম। এবার আমাদিগের পরিহিত পাদুকার ‘খট্ মট্’ শব্দে সেই শব্দ মাত্র শূন্যা রজনীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হইল। সেই নির্জ্জন পুরাতন বাড়ীর প্রত্যেক কক্ষে, প্রত্যেক প্রাচীরে, এবং প্রত্যেক বৃক্ষে সেই ধ্বনি সবলে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। সেই সময় একটি যুবতী অন্দরের একটি প্রকোষ্ঠ হইতে প্রদীপহস্তে নিতান্ত ত্রাসিত অন্তঃকরণে বহির্গত হইল। বোধ হইল, অসময়ে আমাদিগের সেই নির্জ্জন পুরীতে প্রবেশ করিবার শব্দ পাইয়াই, ইনি এরূপভাবে বহির্গত হইলেন। ইহাকে দেখিবামাত্রই ইমামুদ্দিন চিনিলেন ও কহিলেন, “ইনি হোসেন খাঁর ভগিনী, ইনিই গওহর আলির বনিতা বলিয়া আমার নিকট পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন।”
ইমামুদ্দিনের এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র আমি আরও দ্রুতপদে তাঁহার নিকটবর্তী হইলাম, ইমামুদ্দিনও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেন। উক্ত রমণীর নিকটে উপস্থিত হইবামাত্র একটি উৎকট গন্ধ আসিয়া আমাদিগের নাসিকায় প্রবেশ করিল। এ গন্ধ ইমামুদ্দিন যদিও সহ্য করিতে পারিলেন; কিন্তু আমার পক্ষে নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল, আমার মস্তক ঘুরিয়া উঠিল, আমি সেইস্থানে বসিবার উপক্রম করিতে লাগিলাম। ইমামুদ্দিন দেখিলেন, সেই রমণীর হস্তে একখানি রুমাল রহিয়াছে, ও বুঝিলেন, এই উৎকট গন্ধ সেই রুমাল হইতে বহির্গত হইতেছে। তিনি রমণীকে কোন কথা না বলিয়া তাহার হস্ত হইতে উহা কাড়িয়া লইলেন ও আমাকে কহিলেন, “এই রুমালে “ক্লোরোফরম” নামক অজ্ঞানকারী প্রচণ্ড বিষ আছে। যে উৎকট এবং বিষাক্ত গন্ধ আসিয়া আমাদের নাসিকায় প্রবেশ করিতেছে, তাহা ইহারই গন্ধ। “
ইমামুদ্দিনের কথা শুনিবামাত্রই সেই স্ত্রীলোকটি সেইস্থান হইতে পলায়ন করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহার সকল চেষ্টা বিফল হইল। আমরা উহাকে ধরিয়া উহারই অঞ্চল দিয়া উহাকে উত্তমরূপে বন্ধন করিলাম।
যে গৃহ হইতে উক্ত স্ত্রীলোকটি প্রদীপহস্তে বহির্গত হইয়াছিল, আমি পরিশেষে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। আমার হস্তস্থিত সেই প্রজ্বলিত আলোকের সাহায্যে দেখিতে পাইলাম, সেই গৃহের ভিতর মৃত্তিকার উপর একটি স্ত্রীলোক অচেতন অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। আরও দেখিলাম, সেইস্থানে একটি ছোট শিশিও রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়াই আমি বুঝিতে পারিলাম, এ স্ত্রীলোকটি কে। তখন আমি ইমামুদ্দিনকে সেইস্থানে ডাকিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিবামাত্রই ইমামুদ্দিন সেই স্ত্রীলোকটির সহিত সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
ইমামুদ্দিন সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই সেই ভূতলশায়িনী জ্ঞান-শূন্যা স্ত্রীলোকটিকে দেখিতে পাইলেন। তাহাকে দেখিবামাত্র ইমামুদ্দিন বাতান্দোলিত কদলীবৃক্ষের ন্যায় কাঁপিতে কাঁপিতে সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন, তাঁহার মুখমণ্ডল শুষ্ক হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে চক্ষুদ্বয় নীলিমাবর্ণ ধারণ করিল, বাক্শক্তি-বিরহিত হইয়া ক্ষণকালের নিমিত্ত তিনি আপন চৈতন্য হারাইলেন। প্রায় দশ মিনিট পরে ইমামুদ্দিনের চৈতন্য উদয় হইল। তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে “কুলসম”
“কুলসম” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিলেন। তাঁহার হৃদয়-কন্দরোধিত সেই সকরুণ “কুসম” ধ্বনি সেই প্রাচীন কক্ষমধ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। সেই ভীষণ শব্দ আরও ভীষণরূপ ধারণ করিয়া আমার কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। সেই ভীষণ ধ্বনিতে কঠিন হৃদয় আমার প্রাণেও আঘাত লাগিল। তখন আমি ইমামুদ্দিনকে কহিলাম, “ডাক্তার! তুমি এখন এরূপ অধীর হইলে কিরূপে চলিবে? তোমার কুসম যদিও এখন অচেতন অবস্থায় পতিতা, তথাপি কে বলিতে পারে, সে জীবিতা নহে? বুঝিতেছি, এই তীব্র ক্লোরোফরমে সে অজ্ঞান হইয়াছে; কিন্তু তাহার যে আর জ্ঞানের উদয় হইবে না, তাহা কে বলিতে পারে? তুমি ডাক্তার, সুতরাং এ বিষয় বিবেচনা করিবার ক্ষমতা আমা অপেক্ষা তোমার অনেক অধিক। তুমি এখন এইরূপে অধীর হইয়া পড়িলে, কি হইবে? একবার ভাব দেখি, যদি ইঁহার বাঁচিবার আশা থাকে, তাহা হইলেও এরূপভাবে তুমি কখনই ইঁহার সংজ্ঞা লাভের উপায় করিতে সমর্থ হইবে না। এখন স্ত্রীলোকের স্বভাব পরিত্যাগ করিয়া প্রকৃত পুরুষের ন্যায় কার্য্য কর। আমার বোধ হইতেছে, যদিও প্রায় পূর্ণমাত্রায় ইনি জ্ঞান শূন্যা হইয়াছেন, কিন্তু এখনও ইঁহার মৃত্যু হয় নাই। চেষ্টা করিলে এখনও তুমি ইহার প্রাণরক্ষা করিতে পারিবে।”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া ইমামুদ্দিন যেন একটু সুস্থ হইলেন। তিনি আপনার দুর্দমনীয় শোক কথঞ্চিৎ নিবৃত্ত করিয়া, সেই আয়-লোচনার গাত্রে হস্ত-প্রদান করিলেন, পরিশেষে তাহার নাড়ি উপলব্ধি করিয়া বুঝিলেন যে, আমি যাহা কহিতেছিলাম, তাহা প্রকৃত। কুসম যদিও একেবারে অচেতন, কিন্তু তাহার প্রাণবায়ু এখনও বহির্গত হয় নাই। সবিশেষ চেষ্টা করিলে, এখনও তাহার জীবনে প্রাণসঞ্চার হইলেও হইতে পারে।
আর কালবিলম্ব করা উচিত নহে বিবেচনা করিয়া, উভয়ে মিলিয়া কুলসমকে বহনপূর্ব্বক বাড়ীর বাহিরে লইয়া গেলাম। গওহরের বনিতা বন্ধনাবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া রহিল। ডাক্তারের গাড়ির ভিতর হইতে হোসেন খাঁকে বাহির করিয়া, কুলসমকে সেই গাড়িতে স্থাপনপূর্ব্বক ইমামুদ্দিন সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
আমি ইমামুদ্দিনের সেই বেহারার সাহায্যে দুইজন পুলিস প্রহরীকে ডাকাইয়া আনিলাম। তাহাদিগের একজনের দ্বারা নিকটবর্তী থানায় সংবাদ পাঠাইয়া দিলাম। এই সংবাদ পাইবামাত্র থানায় ইনস্পেক্টর সাহেব আমার সাহায্যার্থ আগমন করিলেন। ইনস্পেক্টর সাহেব আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা শুনিয়া হোসেন খাঁ ও তাঁহার ভগিনীকে চিনিয়া লইলেন। তিনি উভয়কেই সেই রাত্রির নিমিত্ত সেইস্থানে কয়েদী অবস্থায় রাখিলেন। গৃহের ভিতর যে মৃতদেহ ছিল, তাহার উপরও পাহারা রহিল। আমিও সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম, ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল।
সূর্য্যোদয় হইলে, সকলে মিলিয়া সেই বাড়ীর খানাতল্লাসি আরম্ভ করিলাম। আমাদিগের আবশ্যকোপযোগী বিশেষ কোন দ্রব্যই পাওয়া গেল না। হোসেন খাঁ যে স্থানে খাত প্রস্তুত করিবার কালীন ধৃত হয়, তাহার নিকটবর্ত্তী একস্থানের মৃত্তিকা নূতন খনিত বলিয়া বোধ হইল। সেইস্থানে খনন করিয়া দেখায় চুন ঢাকা একটি মৃতদেহ পাওয়া গেল। চুনের সহিত সংযোগ হওয়ায় সেই মৃতদেহ এত শীঘ্র পচিয়া গিয়াছিল যে, উহা কাহার মৃতদেহ, তাহার কিছুই স্থির হইল না।
যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ উপরের গৃহে রক্ষিত ছিল, পরীক্ষায় জানা গেল, স্বাভাবিক রোগে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। কিন্তু উহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহার কিছুই তখন স্থির হইল না। জিজ্ঞাসা করায় হোসেন খাঁ ও তাহার ভগিনী কোন কথারই উত্তর প্রদান করিল না।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
অচেতন কুসমকে ইমামুদ্দিন আপন বাড়ীতে লইয়া গেলেন, এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ও অপরাপর তিন চারিজন ডাক্তারকে আনাইয়া তাঁহাদিগের হস্তে চিকিৎসার ভার অর্পণ করিলেন। নিজেও প্রাণপণে তাহার শুশ্রুষা করিতে লাগিলেন। এইরূপে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল, রোগীকে ক্রমে সুস্থ বোধ হইতে লাগিল। তখন তাহার সেই বিষম নেসা ক্রমে দূর হইতে লাগিল, ক্রমে তাহার জ্ঞানের সঞ্চার হইতে আরম্ভ হইল। ক্রমে কুসম চক্ষু উন্মীলন করিলেন। এতক্ষণ পরে সকলের মুখেই হাসির রেখা দেখা দিল। আর কোন ভয় নাই দেখিয়া, সকলে একটু বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত বৈঠকখানায় গমন করিলেন। কিন্তু ইমামুদ্দিন তাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না, এক মনে তিনি সেই রোগীর পার্শ্বেই বসিয়া রহিলেন
এইরূপে আরও কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে, অতি ক্ষীণস্বরে রোগী বলিয়া উঠিলেন, “হা ঈশ্বর! আমাকে আর কেন যন্ত্রণা দেও? যাঁহাকে আমি কখন পাইব না, পাওয়া দূরের কথা, একবারের নিমিত্ত যাঁহাকে দেখিতে পাইয়াও হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করিতে পারিব না, তাঁহার সেই মনোহর প্রেমমূর্তি আমার সম্মুখে রাখিয়া আরও কষ্ট দেও কেন? এই অন্ধকারময় নিৰ্জ্জন স্থানে আমাকে অনশনে মরিতে হইতেছে, একথা তিনি জানিতে পারিতেছেন কি? যিনি আমার সংবাদ পাইবার নিমিত্ত বিশেষ ব্যস্ত থাকিতেন; যিনি সেই সময় জানিতে পারিয়াছিলেন, বিমাতা মাতার ন্যায় আমাকে স্নেহ করিতেছেন, তিনি কিরূপে এখনই আমার এই শোচনীয় অবস্থা জানিতে পারিবেন? হে স্বপ্ন! তুমি আমাকে পরিত্যাগ কর, সেই দেবমূর্তিকে আমার সম্মুখ হইতে অন্তর্হিত কর, আর সহ্য হয় না।”
কুলসমের এই কথা শ্রবণ করিয়া ইমামুদ্দিন আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “কুলসম! তুমি আর এখন তোমার পিশাচী বিমাতার নিকটে নাই, এখন তুমি আমার অন্তঃপুরের ভিতরই অবস্থান করিতেছ। তুমি যাহা দেখিতেছ, তাহা স্বপ্ন নহে—স্বপ্ন কল্পিত প্রতিমূৰ্ত্তি নহে—প্রকৃতই তুমি আমার সম্মুখে শয়ন করিয়া আছে। তোমার বিপদের সমস্ত আশঙ্কা এখন দূর হইয়াছে, তুমি এখন ক্রমেই সুস্থ হইতেছ, তোমার আর ভয় নাই।”
“এ কি স্বপ্ন নহে? যাঁহাকে আমি দেবতা বলিয়া জানিয়াছি, প্রকৃতই তিনি কি তবে আমার সম্মুখে উপবিষ্ট!” এই বলিয়া তিনি তাঁহার মস্তচ্যুত বস্তু উঠাইয়া মস্তক আবৃত করিলেন; কিন্তু তাঁহার চক্ষুজলে বস্ত্ৰ ভিজিয়া গেল। ইমামুদ্দিনের চক্ষুও জলে পূর্ণ হইল। দুই এক দিবস পরেই কুসম উত্তমরূপে আরোগ্যলাভ করিয়া উঠিলেন।
এদিকে হোসেন খাঁ ও তাহার ভগিনী খুনি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত হইল না; কিন্তু বিষ প্রয়োগে কুলসমের প্রাণবধের উদযোগ করিতেছিল বলিয়া, তাহারা উভয়েই আসামী হইল। অনুসন্ধানে আমি কোনরূপেই বিরত হইলাম না। ক্রমে জানিতে পারিলাম, এই হোসেন খাঁই পূৰ্ব্বকথিত এলাহাবাদের খুনি মোকদ্দমার পলাতক আসামী ফজলে রহমান। যে উপায়ে গওহর আলিকে হত্যা করিয়াছে, সেই রূপেই এলাহাবাদে এক হত্যাকাণ্ড সাধন করিয়া ইহারা পলায়ন করে। সেই স্ত্রীলোক তাহার ভগিনী নহে, উহারই রক্ষিত, নাম—হামিদনেসা। হামিদ নেসার মোকদ্দমা এইস্থানেই মিটিয়া গেল। বিষ-প্রয়োগ অপরাধে দায়রা হইতে তাহার সাত বৎসরের নিমিত্ত কঠিন পরিশ্রমের সহিত কারাবাসের আজ্ঞা হইল। আর এলাহাবাদের এলাসে হোসেন খার বিচার হইল। সে, তথাকার বিচারে চরমদণ্ড প্রাপ্ত হইয়া ইহলোক পরিত্যাগ করিল।
হোসেন খাঁর ফাঁসী হইবার পূর্ব্বদিবসে এলাহাবাদের হাজত গৃহে গিয়া আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। গওহর আলির মৃত্যুর রহস্যকথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, প্রথমে ইতস্ততঃ করিয়া পরিশেষে হোসেন খাঁ সংক্ষেপে কহিল, “এলাহাবাদে হত্যা করার পর, আমি ধরা পড়িবার উপক্রম দেখিয়া আমার উপপত্নীর সহিত কলিকাতায় পলায়ন করিলাম। হঠাৎ গওহর আলির সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায়, মিথ্যা ছল করিয়া তাহার সহিত তাহারই বাড়ীতে গমন করিলাম। তাহার সমস্ত বিষয় হস্তগত করিবার অভিপ্রায়ে প্রথমে হামিদনের সহিত বিবাহ দিলাম। যখন হামিদ তাহার উত্তরাধিকারিণী হইল, তখন গওহরকে হত্যা করাই স্থির করিলাম। পথে একদিবস একজন নিতান্ত দীন ও মৃতপ্রায় রোগীকে দেখিতে পাইলাম। জানিলাম, ইহার কেহই নাই, এবং থাকিবারও কোন স্থান নাই; যত্ন করিয়া উহাকে গওহরের বাড়ীতে লইয়া গেলাম। সেই দিবসেই গওহরকে একটি গৃহের ভিতর বন্ধ করিয়া, সেই রোগীকে গওহর আলি বলিয়া পরিচয় দিয়া চিকিৎসা করাইলাম। সে মরিয়া গেলে, গওহরকে হত্যাপূর্ব্বক তাহার সৎকার কার্য্য প্রকাশ্যরূপে সম্পন্ন করিলাম। পীড়িত ব্যক্তির মৃতদেহ বাড়ীর ভিতরই পুঁতিয়া রাখিলাম। সকলেই জানিলেন, সুচিকিৎসা হইলেও গওহর আলির মৃত্যু হইয়াছে। গওহর আলির মৃত্যুতেও হামিদন তাহার বিষয় সম্পত্তি পাইল না, কোথা হইতে তাহার কন্যা কুসম আসিয়া উপস্থিত হইল। কাজেই তখন তাহাকেও হত্যা করা স্থির হইল। পূর্ব্বরূপ উপায়ে একটি রুগ্ন স্ত্রীলোকেরও সংগ্রহ হইল, কিন্তু কুলসমকে হত্যা করিবার পূর্ব্বেই আপনাদিগের হস্তেই আমরা ধৃত হইলাম। তাহার পর যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহার সমস্ত ব্যাপারই আপনি অবগত আছেন।”
কুলসম আরোগ্যলাভ করিয়া ইমামুদ্দিনের গৃহেই অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া যাইবার পরে সকলেই জানিতে পারিলেন, ডাক্তার ইমামুদ্দিন পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হইতেছেন। কিন্তু এই বিবাহের পাত্রী যে কে, তাহা প্রথমে অনেকেই জানিতে পারিলেন না। এই ঘটনার পর হইতে আমার সহিত ইমামুদ্দিনের বিশেষ বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়াছিল। আমি হিন্দু হইলেও মুসলমানের এই বিবাহে যোগ দিয়াছিলাম। বিবাহের সময় সকলেই দেখিলেন, এই বিবাহের পাত্রী আমাদিগের বিশেষ পরিচিতা মাতা-পিতৃহীনা সেই কুলসম।
[বৈশাখ, ১৩০০]