হত্যারহস্য (খুনীকে গুম করিবার চেষ্টা)

হত্যারহস্য (খুনীকে গুম করিবার চেষ্টা) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

A MYSTERIOUS MURDER. 

Police received an anonymous letter. Friday evening, stating that a murder has been com—mitted in the Balliaghatta Section of the town, and that the victim, who was the wife of the murderer, had been buried in the grounds attached to the house, in which the pair resided. On receipt of the letter, police immediately proceeded to the premises indicated, and was directed to the spot, where the murdered woman had been interred, by the stench which issued from the ground. On digging the suspected locality, the corpse of a woman in an advanced stage of decomposition was discovered.** 

STATESMAN. 

অর্থাৎ

অত্যদ্ভুত হত্যা। 

শুক্রবার সন্ধ্যার সময় পুলিস একখানি বিনামা পত্র প্রাপ্ত হয়েন; তাহাতে লেখা ছিল—সহরের ভিতর বেলিয়াঘাটায় একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে। এক ব্যক্তি তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিয়া যে গৃহে তাহারা দুইজনে বাস করিত সেই গৃহ সংলগ্ন জমিতে তাহার লাস পুঁতিয়া রাখিয়াছিলেন। পত্র প্রাপ্ত মাত্র পুলিস সেই বাড়ীতে গিয়াছিলেন, এবং যে স্থানে মৃত্তিকা হইতে গন্ধ আসিতেছিল তাহা অনুসরণ করিয়া যে স্থানে সেই দেহ প্রোথিত ছিল সেথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিলে তাহা হইতে এক স্ত্রীলোকের দুর্গন্ধময় এবং গলিত দেহ পাওয়া গিয়াছে। 

স্টেটসম্যান সংবাদ-পত্রে উপরিলিখিত সংবাদটি বাহির হইবার দুই দিবস পূর্ব্বে ডাকযোগে একটি পত্র আসিয়া আমার হস্তে পতিত হইল। পত্রখানির শীল দেখিয়া জানিতে পারিলাম, কলিকাতার ভিতর হইতে পত্র আসিতেছে, উহাতে ভবানীপুর ডাকঘরের ছাপ আছে। পত্রখানি খুলিলাম, দেখিলাম, উহা বাঙ্গালা অক্ষরে লেখা, কিন্তু কাহারও স্বাক্ষর নাই। উহাতে লেখা আছে;– 

“জমির মণ্ডল তাহার স্ত্রীকে খুন করিয়া পলাইয়া গিয়াছে। জমির মণ্ডলের বাড়ী বেলেঘাটা মোল্লা-পাড়ায়। সে তাহার স্ত্রীকে মারিয়া রসুই ঘরের পশ্চিমে গাড়িয়া রাখিয়াছে। ভাল করিয়া সেইস্থান খুঁড়িয়া দেখিলে উক্ত লাস পাওয়া যাইবে। আজ বার তের দিন হইল, সে খুন করিয়াছে। পাড়ার সকলেই একথা শুনিয়াছে। একটু পীড়াপীড়ি করিলে খোদার ফজলে সকল কথা বাহির হইয়া পড়িবে।” 

পত্র পাঠ করিয়া একবার ভাবিলাম, কোন দুষ্টলোক আমাদিগকে কষ্ট দিবার অভিপ্রায়ে এইরূপ পত্র লিখিয়াছে। কারণ, এই পত্রলেখক প্রকৃতই যদি আমাদিগকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত ইচ্ছা করিত, তাহা হইলে এই পত্রে সে আপনার নাম ও ঠিকানা নিশ্চয়ই লিখিয়া দিত। পুনরায় ভাবিলাম যে, এ পত্র একবারে অগ্রাহ্য করাও যুক্তি-সঙ্গত নহে; আমাদিগের কর্তব্য—এই বিষয়ে একটু অনুসন্ধান করা। জমির মণ্ডলের স্ত্রী আছে কি না, যদি থাকে—-তাহা হইলেই সে এখন কোথায়, জানিতে পারিলেই সকল গোল মিটিয়া বাইবে। আর জমির মণ্ডল বাস্তবিকই যদি পলায়ন করিয়া থাকে, অনুসন্ধানে তাহার কারণ প্রকাশ হইতেও বাকি থাকিবে না। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া পরিশেষে একটু অনুসন্ধান করাই স্থির করিলাম। 

অপরাহ্ণ পাঁচটার সময় একটিমাত্র মুসলমান—কর্মচারী সমভিব্যাহারে বেলিয়াঘাটা থানার এলাকাস্থিত মোল্লা—পাড়ায় উপনীত হইলাম। অনুসন্ধান করিয়া জমির মণ্ডলের বাড়ীও পাইলাম। জমির মণ্ডল ‘রাজের’ সর্দ্দার। খুব বড় মানুষ না হউক, কিন্তু নিতান্ত দরিদ্র নহে। তাহার কিছু নগদ টাকা আছে, একথা পাড়ার সকল লোকেই অবগত আছে। কারণ, গহনাপত্র বন্ধক রাখিয়া সে টাকাকড়ি ধার দিয়া থাকে। ইহা ব্যতীত বাড়ীখানিও নিজের। 

খোলার বাড়ী, দরজা রাস্তার উপর। নিকটে যাইয়া দেখিলাম, দ্বারের তালাবন্ধ। এই দ্বার দিয়া পশ্চিম মুখে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে হয়। দ্বারের দক্ষিণ পথের উপর দুইখানি গৃহ আছে, সেই গৃহের সহিত ভিতরের কোন সংস্রব নাই। সেই গৃহ চারিজন ভাড়াটিয়া দ্বারা অধিকৃত। অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইলাম যে, উক্ত চারিজন ব্যক্তির নাম সেখ ইব্রাহিম, সেখ আবদুল গফুর, সেখ ভিকু এবং সেখ ছমিরুদ্দি। ইহাদিগের চারিজনেরই বাসস্থান—ফরিদপুর জেলায়। ইহারা সকলেই প্রায় বৎসরাবধি এইস্থানে আছে এবং স্বামীর ঘরামীর কার্য্য করিয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করে। 

প্রথমে যখন আমি সেইস্থানে গমন করিলাম, তখন উহারা কেহই উপস্থিত ছিল না; কিন্তু ক্রমে এক এক করিয়া সকলেই আসিয়া উপস্থিত হইল। জমির মণ্ডলের কথা জিজ্ঞাসা করায় উহারা এইমাত্র বলিল, “বৃদ্ধ জমির তাহার স্ত্রী সেই বাড়ীর ভিতর বাস করিয়া থাকে। অপর কোন ব্যক্তি বা অপর ভাড়াটিয়া কেহই সেই বাড়ীর ভিতর থাকে না। দশ বার দিবস হইতে জমির মণ্ডলের স্ত্রীকে বাড়ীতে দেখিতে পাইতেছি না। একদিবস বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করায় অবগত হইলাম যে, তাহার স্ত্রী তাহার পিত্রালয়ে গমন করিয়াছে। আবার তিন চারি দিবস অতীত হইল, একদিবস দেখিলাম, জমিরও বাড়ীর দ্বার বন্ধ করিয়া কোথায় গমন করিতেছে। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে কহিল যে, সে তাহার স্ত্রীকে আনিবার নিমিত্ত যাইতেছে। সেই পর্য্যন্ত জমির বা তাহার স্ত্রীকে আমরা আর দেখি নাই।” 

উহারা যেরূপ কহিল, পাড়ার আরও দুই চারি ব্যক্তি সেইরূপ শুনিয়াছে বলিল। জমিরের শ্বশুরালয় যে কোন স্থানে, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। উহার আত্মীয়দিগের সম্বন্ধে অনুসন্ধান করায় জানিতে পারা গেল যে, তাহার তিনটি কন্যা, সকলেরই বিবাহ হইয়াছে, তাহার মধ্যে একটি কন্যার শ্বশুরালয় টালিগঞ্জে। ঘরামীগণের মধ্যে একজন তাহার বাড়ী জানিত, তাহাকে সঙ্গে লইয়া টালিগঞ্জে গমন করিলাম, অনুসন্ধানে বাড়ীও পাইলাম। যাহার সহিত এই কন্যাটির বিবাহ হইয়াছিল, তাহার নাম আবদুল হাকিম। আবদুল হাকিমকে জিজ্ঞাসা করায় সে তাহার শ্বশুরের শ্বশুরবাড়ীর কথা কিছুই বলিতে পারিল না। জমিরের কন্যাটিও কখন শ্রবণ করে নাই যে, তাহার মামার বাড়ী কোথাও আছে। সে তাহার মাতার নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছে যে, তাহার মাতার পিতৃকুলে কেহই নাই। এ পর্যন্ত কখন তাহার মাতা কোনস্থানে গমন করে নাই, চিরদিবসই সেই বাড়ীতে বাস করিয়া আসিতেছে। সে তাহার মামার সংসৃষ্ট কোন ব্যক্তিকে এ পর্যন্ত সেখানে আসিতে দেখে নাই। 

জমিরের কন্যার নিকট এইসকল বিষয় অবগত হইয়া, আবদুল হাকিমকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় মোল্লা পাড়ায় গমন করিলাম। এরূপ অবস্থায় বাড়ীর ভিতর অনুসন্ধান করিয়া দেখাই কর্তব্য বিবেচনা করিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

আমি পাড়ার দুই চারি জন লোক সংগ্রহপূর্বক সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। সদর দ্বারের যে তালাবন্ধ ছিল, তাহা সামান্য তালামাত্র। পাড়ার ভিতর হইতে কতকগুলি চাবি আনাইয়া উক্ত তালা খুলিতে চেষ্টা করিলাম, একটি চাবিতে উহা খুলিয়া গেল। আমরা সকলে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, বাড়ীর পূর্ব্বাংশে দুইখানিমাত্ৰ গৃহ আছে। উক্ত গৃহদ্বয়ের কথা আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, উহার দ্বার বাহিরের দিকে, ভিতরের সহিত কোন সংস্রব নাই। বাড়ীর উত্তরাংশে সারি সারি চারিখানি গৃহ। দেখিলাম উহার দুইখানি তালাবদ্ধ। এই গৃহদ্বয় জমির ও তাহার স্ত্রীর দ্বারা ব্যবহৃত হইত। অপর দুইখানি ঘর খোলা, উহাতে দ্রব্যাদি কিছুই নাই। এই গৃহশ্রেণীর সম্মুখে অর্থাৎ বাড়ীর দক্ষিণ অংশে দুইটি ছোট ছোট গৃহ আছে, ইহার একখানিতে কাষ্ঠ প্রভৃতি রহিয়াছে, অপরখানিতে জমিরের রন্ধনাদি হইত। পশ্চিমদিকে গৃহ নাই, উক্ত অংশ মৃত্তিকা প্রাচীরদ্বারা বেষ্টিত। সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার জন্য পূর্ব্বকথিত দ্বার ভিন্ন অপর আর দ্বার নাই। 

আমি যে পত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহাতে লেখা ছিল, “রসুই গৃহের পশ্চিমে গাড়িয়া রাখিয়াছে।” ভিতরে দেখিলাম, রসুই গৃহের পশ্চিমে অনেকটা খালি জমি পড়িয়া আছে। প্রথমে সেইস্থানেই অনুসন্ধান করা উচিত বিবেচনা করিলাম। পাড়া হইতে চারিখানি কোদালি সংগ্রহ করিয়া সেই বাড়ীর পূর্ব্বকথিত ভাড়াটিয়া-চতুষ্টয়ের হস্তে উহা প্রদান করিয়া তাহাদিগকে সেইস্থানে উত্তমরূপে খুঁড়িতে কহিলাম; কিন্তু তাহারা প্রথমে দুই তিন স্থান খুঁড়িয়া কোনস্থানে কিছুই প্রাপ্ত হইল না। তাহার পর সেই গৃহের পশ্চিম গায়ে যখন খুঁড়িতে আরম্ভ করিল, তখন এক প্রকার দুর্গন্ধ সেইস্থান হইতে বাহির হইতে লাগিল। সেই স্থান হইতে যতই মৃত্তিকা উঠিতে লাগিল, ততই উৎকট দুর্গন্ধ তীব্রতরভাব ধারণ করিল। উহারা কোদালি পরিত্যাগপূর্ব্বক দূরে গিয়া দণ্ডায়মান হইল ও কহিল, “মহাশয়! আমরা কোনক্রমেই আর খুঁড়িতে পারিব না। এইস্থান খুঁড়িতে খুঁড়িতে দুর্গন্ধ যেরূপ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহাতে আমরা আর অধিক খুঁড়িতে কোনক্রমেই পারিব না।” এইরূপ অবস্থায় আমার মনেও দৃঢ়বিশ্বাস হইল যে, এই স্থানে নিশ্চয়ই মৃতদেহ নিহিত আছে, তখন পাড়ার অনেককে সেইস্থান কহিলাম; কিন্তু আমার কথা কেহই শ্রবণ করিল না, কেহই সেই দুর্গন্ধময় স্থান খুঁড়িতে সম্মত হইল না। পরিশেষে অনন্যোপায় হইয়া আমি চারিজন ডোম ডাকাইলাম, উহারাই সেইস্থান খুঁড়িতে লাগিল। প্রায় দুই ফুট মাটি উঠাইয়া ফেলিলেই, তাহার ভিতর হইতে একটি লাস বাহির হইয়া পড়িল। সেই লাসের মস্তক উত্তরে, পদযুগল দক্ষিণদিকে। উহার মুখ পূর্ব্বদিকে, উহাকে বামপার্শ্বে ফিরাইয়া শায়িতভাবে রাখা আছে, ডোমদিগকে কহিলে উহারা সেই লাস আস্তে আস্তে উঠাইয়া প্রাঙ্গণের মধ্যে রাখিয়া দিল। লাসটি স্ত্রীলোকের। পাড়ার সকল লোক দেখিবামাত্র কহিল যে, “ইহা জমিরের স্ত্রীর লাস।” উহার অঙ্গে একখানিও অলঙ্কার নাই, পরিধানে বস্ত্র নাই। লাসটি একবারে পচিয়া গিয়াছে, মাংস সকল খসিয়া পড়িতেছে। মুখ একরূপ ভয়ানক আকার ধারণ করিয়াছে, চক্ষু খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। লাসটি মৃত্তিকার ভিতর হইতে উঠাইবার সময় উহার মস্তক হইতে অলকগুচ্ছ খসিয়া পড়িল, কোন কোন স্থানের মাংস মৃত্তিকার ভিতরেই রহিয়া গেল। উহা হইতে এরূপ প্রবলবেগে দুর্গন্ধ বাহির হইতে লাগিল যে, কে আর সেইস্থানে দাঁড়াইতে পারে? দেখিতে দেখিতে সমস্ত পাড়া দুর্গন্ধে মাতিয়া উঠিল। সেই পল্লীর আবাল-বৃদ্ধবনিতা সকলেই আপন আপন স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক যে দিক্ হইতে বায়ু প্রবাহিত হইতেছিল সেই দিকে আশ্রয় লইল। আমাদিগের আর কিছু উপায় নাই, জগতে আমরাই নরকভোগ করিতে জন্মিয়াছি; সুতরাং এ নরক পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গমন করিব? পলাশ, রসুন এবং কপূরের অনুগ্রহে কোনরূপে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। প্রথমতঃ লাসটি উত্তমরূপে দেখিলাম। উহা যে প্রকার বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে তাহার উপর কোন প্রকার আঘাতের চিহ্ন নয়নগোচর হইল না। কিরূপে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, লাস দেখিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। পরিশেষে লাস পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করা হইল।

কিরূপ অবস্থায় এবং কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, তখন তাহারই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। সেই বাড়ীর বাহিরের গৃহে যে চারিজন ভাড়াটিয়া আছে, প্রথমে তাহাদিগকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করিলাম। উহাদিগের নিকট হইতে যে সকল বিষয় অবগত হইলাম, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ;—

১ম। জমির মণ্ডলের পুত্র নাই; তিনটিমাত্র কন্যা, তিনজনেই বিবাহিতা। এক বৎসরের মধ্যে তাহার জামাতা বা কন্যাগণের মধ্যে কেহই সে বাড়ীতে গমন করে নাই। 

২য়। জমির ও তাহার স্ত্রী ভিন্ন অপর কেহ সেই বাড়ীর ভিতর দুই তিন মাসের মধ্যে বাস করে নাই। 

৩য়। দুই তিন মাসের পূর্ব্বে সেই বাড়ীর ভিতরের দুইখানি ঘর, যে ঘর এখন অনধিকৃত অবস্থায় রহিয়াছে, তাহা নাসিরুদ্দিন নামক এক ব্যক্তি দ্বারা অধিকৃত ছিল। সমির অবিবাহিত। সে তাহার বৃদ্ধা নানির সহিত সেই বাড়ীতে বাস করিত; কিন্তু দুই তিন মাস অতীত হইল, তাহার সহিত বাক্-বিতণ্ডা হওয়ায় জমির তাহাকে আপনার বাড়ী হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে। সেই অবধি সমির এই পাড়ার ভিতর অন্য বাড়ীতে বাস করিতেছে। 

৪র্থ। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, জমিরের স্ত্রী সমিরকে একটু ভালবাসিত; কিন্তু জমির তাহা দেখিতে পারিত না, সে তাহার স্ত্রীর চরিত্রের উপর সন্দেহ করিত। এইজন্যই জমির, সমিরকে আপনার বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিয়াছিল।

৫ম। জমিরের স্ত্রী পাড়ার সকলের সম্মুখেই বাহির হইত, পাড়ার ভিতর সকল স্থানেই প্রকাশ্যে গমনাগমন করিত।

৬ষ্ঠ। প্রায় বারদিবস পূর্ব্বে সন্ধ্যার সময় সকলেই জমিরের স্ত্রীকে দেখিয়াছে; কিন্তু তাহার পরদিবস হইতে কেহই আর তাহাকে দেখিতে পায় নাই। জিজ্ঞাসা করিলে জমির বলিত, তাহার স্ত্রী তাহার পিত্রালয়ে গমন করিয়াছে। 

৭ম। জমিরের বাড়ীর দ্বার কখন বন্ধ থাকিত না; কিন্তু যে দিবস হইতে তাহার স্ত্রীকে দেখিতে পাওয়া যায় নাই, সেইদিবস হইতে জমির যখন বাড়ীর ভিতরে থাকিত, তখন বাড়ীর দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ থাকিত, আর জমির বাহিরে থাকিত, তখন দ্বার বাহির হইতে তালাবন্ধ করিয়া রাখিত। 

৮ম। চারি পাঁচ দিবসমাত্র অতীত হইল, জমির তাহার সদর দ্বার তালাবদ্ধ করিয়া তাহার স্ত্রীকে আনিবার ভান করিয়া এইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে। সেই পর্যন্ত আর প্রত্যাগমন করে নাই। 

৯ম। জমিরের শ্বশুরবাড়ী যে কোন স্থানে, তাহা কেহই অবগত নহে। এ পর্যন্ত জমিরের স্ত্রীকে কেহই পিত্রালয়ে গমন করিতে দেখে নাই। 

১০ম। আমির নামক জমির মণ্ডলের একটি ভাই সেই পাড়ায় অবস্থান করে। সে কখন এখানে আগমন করে না। কারণ, উভয়ের মধ্যে পরস্পর মনোমালিন্য আছে। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

সেই সময়ে সেইস্থানে উক্ত সকল বিষয় অবগত হইয়া প্ৰথমে সমিরকে ডাকাইলাম। সে সমস্তই স্বীকার করিল। সে যে জমিরের বাড়ীতে ভাড়াটিয়া ছিল, জমিরের স্ত্রী যে তাহাকে ভালবাসিত, জমিরের সহিত কলহ করিয়া সে যে তাহার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াছে, ইহার সমস্ত কথাই সে একে একে বর্ণন করিল। কিন্তু জমিরের স্ত্রীর সহিত তাহার অবৈধ প্রণয়ের কথা কোনক্রমেই সে স্বীকার করিল না। 

সমিরের জবানবন্দী লেখা শেষ করিয়া, জমিরের ভাই আমিরকে ডাকাইলাম। তাহার নিকট হইতে জমিরের কন্যা এবং জামাতাগণের নাম পাইলাম। তাহাদিগের বাসস্থানের ঠিকানাও সে বলিয়া দিল। অধিকন্তু সে কহিল, “জমির প্রথমে যে বিবাহ করে, সেই স্ত্রী নাই; বহুদিবস হইল, তাহার মৃত্যু হইয়াছে। যে সময় তাহার স্ত্রীর মৃত্যু হয়, সেই সময়ে জমির বারাকপুরে থাকিত। সেইস্থানেই একটি স্ত্রীলোকের সহিত তাহার অবৈধ প্রণয় হয়। এ সেইস্থানের একটি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক, বাজারে ঘর ভাড়া করিয়া পাপের স্রোতবৃদ্ধি করিয়া আসিতেছিল। জমিরের সহিত সেইস্থানে ইহার প্রণয় হইলে, জমির তাহাকে নিজ গ্রামে লইয়া যায়, এবং পরিশেষে তাহাকে কলিকাতায় আনিয়া, ঘর বাঁধিয়া স্ত্রীপুরুষের মত বসবাস করিতে আরম্ভ করে। তাহার গর্ভে যে তিনটি কন্যা জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহার কিন্তু বিবাহের পর এ বাড়ীতে আর পদার্পণ করে নাই, তাহাদিগের গর্ভধারিণীর চরিত্রে তাহারা নিতান্ত অসন্তুষ্টা ছিল বলিয়াই বোধ হয়, তাহারা এ বাটীতে আসে না। উক্ত স্ত্রীলোকের পিত্রালয় নাই, এবং অপর কোন স্থানে যে তাহার গমন করিবার আছে, তাহাও আমি জানি না।” 

আমিরের জবানবন্দী শেষ হইয়া গেলে, পাড়ার অনেক লোককে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু সম্পূর্ণ সন্তোষজনক উত্তর আর কাহারও নিকট প্রাপ্ত হইলাম না। কেহ কহিলেন, তাঁহারা শ্রবণ করিয়াছেন যে, জমির তাহার শ্বশুরালয়ে গমন করিবার নাম করিয়া এইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে। কেহ কহিলেন, “জমির তাহার স্ত্রীর চরিত্র সম্বন্ধে সন্দেহ করিয়া, এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন পূর্ব্বক ভয়ে প্রস্থান করিয়াছে বলিয়া বোধ হয়।” এইরূপ যাঁহার মনে যেরূপ আসিতে লাগিল, তিনি সেইরূপই কহিতে লাগিলেন। জমির নিতান্ত গরিব ছিল না; তাহার টাকা, গহনা এবং তৈজসপত্র প্রভৃতি অধিক না থাকুক, কিন্তু নিতান্ত সামান্য ছিল না, একথা পাড়ার সকলেই কহিল। 

ইহার পর সেই বেনামী পত্র সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিলাম। কারণ, পত্রে যেরূপ লেখা ছিল, কাৰ্য্যেও দেখিলাম সেইরূপ ঘটিতে লাগিল। সুতরাং ভাবিলাম, পত্রলেখক সমস্ত অবস্থা, হয় স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছেন, না হয়—উত্তমরূপে অবগত আছেন। তাঁহাকে পাইলে, আরও অনেক কথা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এ অনুসন্ধানের কিন্তু কোন ফল প্রাপ্ত হইলাম না। এক এক করিয়া পাড়ার সকলকেই সেই পত্র দেখাইলাম, সকলকেই জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু কেহই কহিলেন না যে, এই পত্র তাঁহার লেখা। পত্রের লেখা সবিশেষ করিয়া দেখিয়াও কেহ বলিতে পারিলেন না যে, এ লেখা কাহার লেখার মত। 

এইরূপ যতদূর বুঝিলাম, সে দিবসের মত অনুসন্ধান শেষ করিলাম। বাড়ীর দ্বার পুনরায় বন্ধ করিয়া, এবং সেইস্থানে নিয়ম-মত পুলিস প্রহরীর বন্দোবস্ত করিয়া, আপনার স্থানে প্রত্যাগমন করিতে রাত্রি অনেক হইয়া গেল। আহারাদি করিয়া শয়ন করিলাম, কিন্তু নিদ্রা আসিল না। শুইয়া শুইয়া এই হত্যা-সম্বন্ধে অনেক কথা ভাবিতে লাগিলাম। অনেক বিবেচনা করিয়া, অনেক ভাবিয়া, পরিশেষে ইহাই স্থির করিলাম যে, এই হত্যা জমির ভিন্ন আর কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। একে জমিরের স্ত্রী বিবাহিতা নহে, তাহতে সে পূর্ব্বে চরিত্রহীনা সামান্য একটি স্ত্রীলোকমাত্র ছিল; এরূপ অবস্থায় জমিরের সহিত তাহার স্ত্রীর মত বাস করিলেও, তাহার প্রকৃত চরিত্র কোথায় যাইবে? সমিরের সহিত সে অবৈধ-প্রণয়ে আবদ্ধ হইয়া তাহাকে যে আন্তরিক ভালবাসিত, তাহার আর কোন ভুল নাই। সেই নিমিত্তই জমির সমিরকে আপনার বাড়ী হইতে দূর করিয়া দেয়। জমিরের স্ত্রী ‘পর্দা-নসিন” ছিল না, যেখানে ইচ্ছা, সেই স্থানে অনায়াসেই গমনাগমন করিত। এরূপ অবস্থায় কে জানে যে, সে সমিরের বাড়ীতে গমন করিত না? কে বলিবে যে, সে আপন হৃদয় হইতে সমিরকে দূরে রাখিয়াছিল? আর ইহাই বা কে বলিবে যে, বৃদ্ধ এই সকল বিষয় স্বচক্ষে দর্শন করিয়া বা অপর কাহারও মুখে শ্রবণ করিয়া, এই লোমহর্ষণকর কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে নাই? যেরূপ জানিতে পারা গেল, তাহাতে নিজের বাড়ীর দ্বার বৃদ্ধের এরূপভাবে বন্ধ করিয়া রাখিবার আর কোন কারণ ত ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছি না। আর হঠাৎই বা সে বাড়ী পরিত্যাগপূর্ব্বক স্থানান্তরে গমন করিবে কেন? এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া, পরিশেষে আমি ইহা স্থির করিয়া লইলাম যে, এই হত্যা জমির ভিন্ন আর কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। তবে অপর কেহ জমিরের সহায়তা করিলেও করিতে পারে। আর ইহাও স্থির করিলাম যে, জমির এই হত্যা করিয়া প্রাণের ভয়ে পলায়ন করিয়াছে। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

পরদিবস দিবা এগারটার সময় এই মোকদ্দমা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করা হইল। মোকদ্দমায় আসামীর নাম আছে মাত্র, কিন্তু আসামী উপস্থিত নাই, পলায়ন করিয়াছে। মাজিস্ট্রেট সাহেব আমাদিগের কর্তৃক নীত সেই ভাড়াটিয়া-চতুষ্টয়ের মাত্র জবানবন্দী গ্রহণ করিয়া দণ্ডবিধি ৩০২ ধারানুসারে হত্যা-অপরাধে জমিরের নামে এক ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দিলেন। 

জমিরকে ধরিবার জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা হইতে লাগিল। কলিকাতার ভিতর এমন কোন স্থানই বাকি রহিল না যে, যেখানে তাহার অনুসন্ধান হইল না। কি সহর, কি সহরতলী, কি পাকা বাড়ী, কি খোলার ঘর, সকল স্থানের সংবাদ, কতক বা প্রকাশ্য, কতক বা অপ্রকাশ্য ভাবে সংগৃহীত হইতে লাগিল। কিন্তু জমির যে কোথায় গমন করিল, সে সংবাদ কেহই প্রদান করিতে সমর্থ হইল না। কেহই বলিল না যে, জমিরকে সপ্তাহের মধ্যে কেহ দেখিয়াছে। 

জমিরের অনুসন্ধানের নিমিত্ত গলি গলি ঘুরিয়া দুই দিবস অতিবাহিত করিলাম; কিন্তু কি আশ্চর্য্য! তাহার কোনরূপ সংবাদ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলাম না। জমিরের নামে যে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছিল, তাহা তাহার দেশে প্রেরিত হইল। আমিও অন্যান্য স্থানে তাহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত সহর পরিত্যাগ করিলাম। প্রথমে যে কোনস্থানে যাইব, এবং কোথায় যাইলেই বা তাহার সন্ধান পাইতে পারিব, তাহার কিছুই ঠিক্ করিতে না পারিলেও আদেশের বশবৰ্ত্তী হইয়া আমাকে সহর পরিত্যাগ করিতেই হইল। 

জমিরের একটি কন্যার বিবাহ হইয়াছিল হুগলীতে। ইমাম-বাড়ীর নিকটেই রহমতের বাড়ী। তাহার পুত্র করিম, জমিরের জামাতা। প্রথমেই আমি সেইস্থানে গমন করিলাম। করিম ও রহমতের সহিত সাক্ষাৎ হইল। জমিরের কথা জিজ্ঞাসা করায় তাহাদিগের নিকট হইতে অবগত হইলাম যে প্রায় এক সপ্তাহ পূর্ব্বে জমির তাহার জামাতা ও কন্যাকে দর্শন করিবার জন্য সেইস্থানে গমন করিয়াছিল। কেবল একদিবসমাত্র সেইস্থানে অবস্থিতিপূর্ব্বক কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিবার নাম করিয়া সে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে। এই কয়েকটি কথামাত্র অবগত হইয়া আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। ভাবিলাম, পুনরায় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করি। কারণ, বিনা-সংবাদে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইয়া কোন লাভ নাই। আসিবার সময় ফরাশডাঙ্গার ভিতর গুপ্তভাবে সেইস্থানে একটি অনুসন্ধানও করিলাম। 

এই স্থান ইংরাজের অধিকৃত নহে, ইহা ফরাশিদিগের অধিকার-ভুক্ত। কোন ব্যক্তি ইংরাজ অধিকৃত স্থানে কোনরূপ অপরাধ করিয়া যদি সেইস্থানে অবস্থান করে, তাহা ইহলে সহজে তাহাকে ধরিয়া আনিবার অধিকার আমাদিগের নাই; এমন কি, সেইস্থানে গমন করিয়া আমরা কোন প্রকার সন্ধান পর্যন্তও ফরাশিদের বিনা অনুমতিতে করিতে অসমর্থ। এইরূপ নানা কারণে অন্যান্য স্থান হইতে অপরাধ করিয়া অনেক বক্তি অনেক ব্যক্তি প্রথমে আশ্রয় গ্রহণ করে, এবং সময় মত সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়া থাকে। মনে ভাবিলাম জমির ফরাশিদিগের অধিকারে আসিলেও আসিতে পারে। এই ভাবিয়া সেইস্থানে একটু সন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম সত্য, কিন্তু অনুসন্ধান শেষ করা দূরে থাকুক, আপনার প্রাণ লইয়া সেইস্থান হইতে পলাইতে হইল। আমি সেইস্থানে অনুসন্ধান করিতেছি, এই কথা জানিতে পারিয়া সেইস্থানের পুলিস আমাকে ধরিবার জন্য আমার পশ্চাৎ লোক প্রেরণ করিল। আমিও ইহা জানিতে পারিয়া দ্রুতপদে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম, তাহারাও দ্রুতপদে আমাকে ধরিবার জন্য ছুটিল। আমিও ‘তুড়ঙ্গের’ ভয়ে প্রাণপণে দৌড়িতে আরম্ভ করিয়া, অনেক কষ্টে উহাদিগের সীমা অতিক্রমপূর্ব্বক তবে পরিত্রাণ পাইলাম। ইহার পূর্ব্বে আমি জানিতাম না যে, তাহাদিগের সর্বপ্রধান কর্মচারীর অনুমতি না লইয়া, সেইস্থানে কোনরূপ অনুসন্ধান করিলে, তাহাকে ধৃত করিয়া কয়েদীর ন্যায় তুডুঙ্গে বন্ধ করিয়া রাখে, ও পরিশেষে যে পর্য্যন্ত বড় লাটসাহেবের নিকট হইতে আদেশ প্রাপ্ত না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত ছাড়িয়া দেয় না। আমাকেও সেই প্রকার আবদ্ধ করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করিয়াছিল, আমি পলাইয়া পরিত্রাণ পাইলাম; সুতরাং জমিরের সন্ধান আর করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

ফরাশডাঙ্গা হইতে কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হইলাম; অন্য কোনস্থানে গমন করিতে আমার মন সরিল না। কেন সরিল না, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, ফরাশডাঙ্গায় অনুসন্ধান করিতে গিয়া প্রথমেই ব্যাঘাত জন্মিয়াছে বলিয়াই বুঝি, অন্য স্থানে গমন করিতে আমার মন সরিল না। 

কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম সত্য, কিন্তু অনুসন্ধানের অপর কোন নূতন পথ বাহির করিতে সমর্থ হইলাম না। যে সকল অনুসন্ধান একবার হইয়া গিয়াছে, পুনরায় সেই সকল অনুসন্ধানই করিতে লাগিলাম। যে সকল স্থানে জমিরের বার বার অনুসন্ধান করিয়াছি, সেই সকল স্থানে পুনরায় ইহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। কিন্তু আমার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হইল, সমস্ত অনুসন্ধান বৃথা হইয়া গেল। জমিরের কোন প্রকার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। জমিরের দেশে যে ওয়ারেন্ট প্রেরণ করা হইয়াছিল, তাহাও ক্রমে ফেরত আসিল। সেইস্থানে জমির গমন করে নাই। যদিও তাহার জন্মস্থান সেইস্থানে, কিন্তু অনেক দিবস হইতে সে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে, সেইস্থানে তাহার ঘর বাড়ী প্রভৃতি কিছুই নাই। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

জমিরের বাড়ী আমি যেরূপভাবে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম, এখনও সেইরূপ ভাবেই বন্ধ আছে। সেইস্থানে যে পুলিস প্রহরীর বন্দোবস্ত ছিল, এখনও সে সেইরূপ ভাবে পাহারায় নিযুক্ত আছে। 

উত্তমরূপ অনুসন্ধান করিয়া যখন জমিরকে পাইলাম না তখন তাহার যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা সেই বাড়ী হইতে উঠাইয়া আনিবার সঙ্কল্প করিলাম। কারণ, নিয়মিত সময়ের মধ্যে সে যদি হাজির না হয়, তাহা হইলে তাহার সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া সরকার জব্দ করিয়া লইবেন। 

একদিন দিবা দশটার সময় পুনরায় আমরা জমিরের সেই বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। পূর্ব্বের মত পাড়ার কয়েকজন লোককে ডাকাইয়া, তাহাদিগের সম্মুখে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, জমিরের দুইখানি গৃহে তালা যেরূপে বন্ধ ছিল, তাহার কিছুমাত্র রূপান্তর হয় নাই। সর্ব্বসমক্ষে একটি গৃহের তালা ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, বিছানা, বাক্স, সিন্ধুক প্রভৃতি সমস্তই আপন আপন স্থানে রক্ষিত আছে, গৃহের কোন দ্রব্য যে স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহা বোধ হইল না। গৃহের ভিতর সিন্ধুক প্রভৃতির চাবির অনুসন্ধান করিলাম কিন্তু কোন স্থানেই উহা প্রাপ্ত হইলাম না। ভাবিলাম জমির পলায়ন করিবার সময় তাহার সমস্ত চাবি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছে। তখন অনন্যোপায় হইয়া কাজেই চাবি ভাঙ্গিতে হইল। এক এক করিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে বাক্স, পেট্রা, সিন্ধুক প্রভৃতি সমস্তই ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম; কিন্তু উহার ভিতরের অবস্থা দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন। সেই সকল দ্রব্য সমস্তই অন্তঃশূন্য, উহার ভিতর না আছে অলঙ্কার, না আছে টাকা, না আছে তৈজসপত্র, এবং না আছে পরিধেয় বস্ত্র প্রভৃতি। জমির নিতান্ত দরিদ্র লোক ছিল না, তাহার তৈজসপত্র প্রভৃতি অনেক ছিল, অলঙ্কারাদি সকলেই সৰ্ব্বদা দেখিয়াছে, নগদ টাকা সৰ্ব্বদা কিছু কিছু মজুতই থাকিত, অলঙ্কার প্রভৃতি বন্ধক রাখিয়া টাকা কর্জ্জ করিতে আসিলে, কেহ কখনই ফিরিয়া যাইত না। এরূপ অবস্থায় উহার গৃহ এরূপ শূন্য অবস্থায় কেন? প্রথমে সকলেই অনুমান করিলেন, তাহার সমস্ত দ্রব্যাদি অপর গৃহে আছে। সে গৃহের চাবিও ভাঙ্গা হইল, সে গৃহ একবারে পরিষ্কার; তাহাতে টাকাকড়ি, অলঙ্কার—পত্ৰ তৈজসাদি কিছুই নাই। গৃহের মেজেতে কেবল একটি মাদুর বিছান আছে, আর এই মাদুরের উপর একটি উপাধান আছে মাত্র। এ গৃহের অবস্থা দেখিয়া সকলে আরও বিস্মিত হইলাম। তখন সকলেই ভাবিলাম যে, জমির তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিয়া যে কয়েক দিবস এইস্থানে ছিল, তাহার মধ্যে তাহার সমস্ত দ্রব্যই ক্রমে বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছে, অথবা তাহার বিশ্বাসী কোন বন্ধুর নিকট সমস্ত দ্রব্য রাখিয়া প্রাণভয়ে পলায়ন করিয়াছে। 

উক্ত সকল দ্রব্যাদি জমির যে কোথায় লইয়া গেল, বা কাহার নিকটেই বা বিক্রয় করিল, তাহা একবার স্থিরভাবে ভাবিলাম; কিন্তু কোন বিষয়ে স্থির-সিদ্ধান্ত করিয়া উঠিতে পারিলাম না। টাকাকড়ি বা অলঙ্কারাদি সকলের অসাক্ষাতে লইয়া যাওয়া সম্ভব বটে, কিন্তু তৈজসপত্র প্রভৃতি অপর লোকের সাহায্য ব্যতীত অথচ প্রচ্ছন্নভাবে কোনস্থানে লইয়া যাইতে কেহই সমর্থ নহে। তবে জমির কি প্রকারে সেই সকল দ্রব্যাদি স্থানান্তরিত করিতে সমর্থ হইল? দিনমানে লইয়া গেলে কাহার না কাহারও সম্মুখে পড়িতেই হইবে আর রাত্রিতেও এই ভাড়াটিয়া চতুষ্টয়ের অজ্ঞাতসারে গমন করিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিলাম, সকলকে নানারূপ জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু কোন বিষয়েই স্থির-মীমাংসা করিয়া উঠিতে সমর্থ হইলাম না। সেইস্থানেই সে দিবসের অনুসন্ধান বন্ধ করিলাম। গৃহের দ্বার এবং বাড়ীর দ্বার পূর্ব্বরূপ বন্ধ করিয়া, নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে আপনার স্থানে চলিয়া আসিলাম। পাহারার বন্দোবস্ত যেরূপ ছিল, সেইরূপই রহিল। 

পরদিবস প্রাতঃকালে একটি লোক একখানি পত্র আনিয়া আমাকে অর্পণ করিল। পত্রখানি খুলিলাম ও পড়িলাম, উহা বাঙ্গালায় লেখা। পূর্ব্বে যে বেনামী পত্র পাইয়া এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইয়াছিলাম তাহা, এবং এই পত্র একই হস্তের লেখা বলিয়া বোধ হইল। তথাপি সন্দেহ মিটাইবার নিমিত্ত পূর্ব্ব পত্রখানি আনিয়া এই পত্রের সহিত ভালরূপে মিলাইয়া দেখিলাম। দেখিলাম, উভয় পত্রই এক হস্তে লিখিত। বর্তমান পত্রে লেখা ছিল; 

“মহাশয়! 

গতকল্য জমিরের গৃহ সন্ধান করিয়া আপনি কিছুই প্রাপ্ত হন নাই। অলঙ্কার বা নগদ টাকা প্রভৃতি মূল্যবান দ্রব্য, যাহা অনায়াসে এবং গুপ্তভাবে লইয়া যাইতে পারে, তাহার সমস্তই জমির লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। অবশিষ্ট তৈজসপত্র বা বস্ত্রাদি যাহা ছিল, তাহা যাহার দ্বারা পরে অপহৃত হইয়াছে, তাহা বলিতে লজ্জা হয়। পূর্ব্বে যদি আপনি জমিরের বাড়ীতে কোন বিশ্বাসী লোককে পাহারায় নিযুক্ত করিয়া স্থানান্তরে গমন করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, সেই সকল দ্রব্যাদি কিছুই স্থানান্তরিত হইত না। আপনি সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলেই ইহার সত্যাসত্য অবগত হইতে পারিবেন। ইতি।” 

এই পত্র পাঠ করিয়া মনে অন্য ভাবনার উদয় হইল। ভাবিলাম, সেই লেখক যদিও আপনার নাম প্রকাশ করিতে সম্মত নহেন, তথাপি তিনি যিনিই হউন না কেন, তাঁহার সংবাদ কিন্তু কখন মিথ্যা হইবে না। প্রথম পত্রে তিনি যাহা যাহা লিখিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই ছত্রে ছত্রে মিলিয়া গিয়াছে। তবে দ্বিতীয় পত্রের কথা আমি অবিশ্বাস করিব কি প্রকারে? এ পত্র পাঠ করিয়া সকলেই উত্তমরূপে বুঝিতে পারিবেন যে, জমিরের পরিত্যক্ত তৈজসপত্রাদি, যাহাকে সেইস্থানে পাহারায় নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই পুলিস-প্রহরী অপহরণ করিয়াছে, অথবা তাহারই সহায়তায় তাপর কেহ চুরি করিতে সাহসী হইয়াছে। কি লজ্জাকর কথা! যাহাকে বিশ্বাস করিয়া সেইস্থানে রাখিলাম, সেই এইরূপ অবিশ্বাসীর ন্যায় কার্য্য করিল? সে চুরি করিয়ছে বলিয়াই যে কেবল তাহারই অপযশ, তাহা নহে, আমিই বা এই কলঙ্ক হইতে কিরূপে উদ্ধার পাইব? যখন আমার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী শ্রবণ করিবেন যে, আমারই নিয়োজিত পুলিস—প্রহরী এইরূপ ঘৃণাকর চৌর্য্যবৃত্তিতে নিযুক্ত, তখন আমি কি বলিব? আর তাঁহারাই বা কি ভাবিবেন? যাহা হউক, সে যদিও আমার অধীন কর্ম্মচারী সত্য; তথাপি এ বিষয় আমি কোনরূপে উপেক্ষা করিয়া, এরূপ পাপাচরণের প্রশ্রয় দিতে কখনই সমর্থ হইব না। আমি ইহার উপযুক্ত অনুসন্ধান করিব, এবং প্রমাণ পাইলে উহাকে কারাগারে প্রেরণ করিতে কোনরূপেই বিরত হইব না। এইরূপ মনে মনে স্থির করিয়া সেই পত্রবাহককে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এ পত্র কোথা হইতে আনয়ন করিলে। চল, আমি তোমার সহিত এখনই তাহার নিকট গমন করিব।” 

পত্রবাহক বলিল, “মহাশয়! আমি আপনাকে কোথায় লইয়া যাইব? কে পত্র লিখিয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। আমি একজন সামান্য কুলি। কিছু পূর্ব্বে কোনরূপ মোট পাইবার প্রত্যাশায় আমি বহুবাজারের চৌরাস্তায় দাঁড়াইয়াছিলাম, সেই সময় একটি মুসলমান যুবক প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এই পত্র লইয়া তুমি কোন স্থানে গমন করিতে পার, কি না?’ উত্তরে আমি কহিলাম, ‘পয়সা পাইলে, না পারিব কেন?” আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনি এই পত্র ও দুই আনা পয়সা আমার হস্তে প্রদান করিলেন, এবং দূর হইতে এই বাড়ী আমাকে দেখাইয়া দিয়ে কহিলেন, ‘ঐ স্থানে গিয়া এই পত্র দেখাইলে, যাঁহার নামের পত্র, তাহা তুমি জানিতে পারিবে। তখন তাঁহার হস্তে এই পত্র প্রদান করিয়া, তুমি আপন ইচ্ছানুযায়ী স্থানে চলিয়া যাইও।’ দুই আনা পয়সার লোভে আমি এই পত্ৰ এইস্থানে আনিয়াছি। যিনি আমাকে পত্র দিয়াছিলেন, তিনিও আমার সহিত বরাবর আসিয়াছিলেন, কিন্তু আমি যেমন একই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, অমনি তিনি একখানি ট্রামগাড়িতে আরোহণ করিয়া বহুবাজারাভিমুখে গমন করিলেন। আমি তাঁহাকে পূর্ব্বে কখন দেখি নাই, এবং কোথায় থাকেন, তাহাও আমি অবগত নহি।” 

পত্রবাহকের কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাহার কথায় বিশ্বাস করিলাম; কিন্তু ভবিষ্যতে তাহাকে যদি প্রয়োজন হয়, এই বিবেচনায় তাহার থাকিবার ঠিকানা লিখিয়া লইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

মুসলমান রাজত্বের সময় ইহতে আমাদিগের দেশে একটি কথা বিদ্রুপচ্ছলে চলিয়া আসিতেছে যে, “প্রথমে উহাকে ফাঁসী দেও, তাহার পর খুনি মোকদ্দমার বিচার কর।” আজ আমরা তাহাই করিলাম। সেই বেনামী পত্র বিশ্বাস করিয়া প্রথমেই সেই প্রহরীকে সপেণ্ড করা হইল। তাহার পর তাহার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। প্রথমেই তাহার থাকিবার স্থান উত্তমরূপে খানা-তল্লাসি করা গেল, তাহার পর ক্রমে তাহার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব প্রভৃতির নিকটও অনুসন্ধান চলিতে লাগিল; কিন্তু কোনস্থানে সেই অপহৃত দ্রব্যের কোনরূপ অনুসন্ধান পাইলাম না। কেহই বলিতে পারিল না যে, কনষ্টেবল কোন সময়ে, কাহার সাহায্যে, এবং কি প্রকারে জমির মণ্ডলের দ্রব্যাদি স্থানান্তরিত করিয়াছে। কনষ্টেবলকে জিজ্ঞাসা করায় সে আমাদিগের সমস্ত কথাই উড়াইয়া দিল এবং কহিল, “কি? আমি চোর? আমার কার্য্য চোর ধরা, চোরকে শাস্তি প্রদান করান, তাহা না করিয়া আমি নিজেই চুরি করিব, এবং চোরের সহায়তা করিব, ইহা কি কখন সম্ভব হইতে পারে? আমি কি জানি না যে, চুরি করিলে তাহার কি প্রকার শাস্তি গ্রহণ করিতে হয়? আমি এ বিষয়ের কিছুই অবগত নহি, বা আমি কোন দোষেই দোষী নহি। আপনারা মিথ্যা ষড়যন্ত্র করিয়া,অথবা প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে অক্ষম হইয়া, আমার উপর মিথ্যা কলঙ্ক আরোপণ করিলেন। নিতান্ত অন্যায়পূর্ব্বক আমাকে সপেণ্ড করিয়া আমার চরিত্রের উপর মসীবিন্দু নিক্ষেপ করিলেন। আপনাদিগের ক্ষমতা আছে করুন; আমি নিতান্ত দরিদ্র, কাজেই উহা আমাকে সহ্য করিতে হইবে। বস্তুতঃ আমি নিৰ্দ্দোষ, সুতরাং আমি আর কিছুই বলিতে চাহি না, ভগবান ইহার বিচার করিবেন! 

কনষ্টেবলের সতেজ উত্তর শ্রবণে আমারও মনে যেন কেমন একরূপ সন্দেহ ইহল। একবার ভাবিলাম, কনষ্টেবল নির্দোষ, তাহার দ্বারা এ চুরি হয় নাই। আবার ভাবিলাম যাহার পত্রের সমস্ত কথা সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইয়া আসিতেছে, তাহার পত্র কিরূপে মিথ্যা বলিয়া উপেক্ষা করিব? পরক্ষণেই আবার মনে আসিল, জমির যখন পলায়ন করিয়াছে, তখন সে যে ইহার বন্দোবস্ত করিয়া যায় নাই, তাহাই বা কি প্রকারে বলিতে সমর্থ হইব? এইরূপ নানা প্রকার ভাবিতে ভাবিতে পুনরায় জমিরের বাড়ীতে গমন করিলাম। মনে করিলাম, এবার জমিরের গৃহের ভিতর এবং প্রাঙ্গণ প্রভৃতি অপরাপর স্থান সকল উত্তমরূপে খনন করিয়া দেখিব যে, কোনস্থানে কোন দ্রব্যের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইতে পারি কি না। এদেশে অশিক্ষিত লোকের মধ্যে এখনও একরূপ প্রথা প্রচলিত আছে যে, টাকাকড়ি প্রভৃতি মূল্যবান্-দ্রব্যাদি সমস্তই তাহারা মৃত্তিকার ভিতর পুঁতিয়া রাখিয়া দস্যুগণের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া থাকে, এবং সময়ে সময়ে বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক স্থানান্তরে গমন করিবার সময়, এমনকি, তৈজসপত্রাদিও মৃত্তিকার নিম্নে প্রোথিত করিয়া রাখে। জমির পলাইবার সময় যদি সেই উপায়ই অবলম্বন করিয়া থাকে, তাহা হইলে পূৰ্ব্বকথিত উপায়ে সমস্ত দ্রব্য বাহির হইয়া পড়িলেও পড়িতে পারে। এইরূপ ভাবিয়া জমিরের বাড়ীতে পুনরায় অনুসন্ধান করাই স্থির করিলাম। লোকজন সংগ্রহপূর্ব্বক পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীর ভিতর যে দুইখানি খালি গৃহের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, এক এক খানি করিয়া প্রথমে সেই গৃহ দুইখানি খুঁড়িয়া ফেলিলাম, এমনকি গৃহের ভিতর হইতে এক কোমর মাটী কাটিয়া প্রাঙ্গণের উপর স্তূপাকার করা হইল; কিন্তু কোনরূপ দ্রব্যের কোন প্রকার সন্ধান পাইলাম না। সেই গৃহ দুইখানি উত্তমরূপে দেখা হইলে এবার জমিরের শয়নগৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই গৃহের ভিতর সিন্ধুক, বাক্স প্রভৃতি যাহা ছিল, তাহার সমস্তই বাহিরে আনা হইল, এবং পরিশেষে আমার আদেশ-মত সেই গৃহের মৃত্তিকাও স্থানান্তরিত হইতে লাগিল। আমার সহিত কোদালি এবং লোকজন কম ছিল না, তাহাতে আবার পাড়ায় অনেকেই আসিয়া আমাদের সহিত যোগ দিয়াছিল; সুতরাং সেই গৃহ খুঁড়িয়া ফেলিতেও কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না। দেখিতে দেখিতে গৃহের প্রায় তিন ফুট মাটী স্থানান্তরিত হইয়া গেল। কিন্তু সেখান হইতে কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইলাম না। 

জমিরের শয়ন গৃহ হইতে কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না। পরিশেষে তাহার পার্শ্বের গৃহের উপর আমাদিগের লক্ষ্য পড়িল। আমরা সেই গৃহের ভিতর সদলে প্রবেশ করিলাম। গৃহের মেজের উপর একখানি মাদুর বিছান ছিল, একথা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। গৃহের ভিতর প্রবেশপূর্ব্বক পূর্ব্বোক্ত মাদুরখানি আমি স্বহস্তে উঠাইয়া বাহিরে ফেলিয়া দিলাম; কিন্তু যে স্থানে উহা বিস্তারিত ছিল, সেইস্থান যেন কেমন একরূপ বোধ হইল। বোধ হইল সেই স্থানটি যেন প্রকৃত অবস্থায় নাই, সেইস্থানের মৃত্তিকা যেন স্থানান্তরিত বা বিলোড়িত হইয়াছিল। পুনরায় যেন সে স্থানের মৃত্তিকা সেইস্থানে স্থাপিত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে; কিন্তু উহা পূর্ব্বের অবস্থা ঠিক প্রাপ্ত হয় নাই, চতুষ্পার্শ্বের স্থানের সহিত সেই স্থানটি যেন এক প্রকার বোধ হইতেছে না, কেমন যেন একটু ভিন্ন ভিন্ন বলিয়া বোধ হইতেছে। সেই গৃহের এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে যেন একটু আশার উদয় হইল। ভাবিলাম, জমির তাহার তৈজসপত্র বা অন্য দ্রব্যাদি সেইস্থানেই প্রোথিত করিয়া রাখিয়াছে। যে সকল দ্রব্যাদির জন্য কনষ্টেবলকে চৌর্য্যাপরাধে অপরাধী ভাবিতেছি, সেই সকল দ্রব্যাদি হয়ত এখনই এইস্থান হইতে বাহির হইয়া পড়িবে। এখনই হয়ত সকলেই জানিতে পারিবেন যে, আমরা কিরূপ মিথ্যা সন্দেহ করিয়া, এই কনষ্টেবলের সর্বনাশ সাধনের চেষ্টা করিয়াছিলাম। সকলেই হয় ত এখনই বুঝিবেন যে, সময় সময় আমরা কিরূপ মহাভ্রমে পতিত হইয়া সত্য মিথ্যা বুঝিয়া উঠিতে পারি না। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা আসিয়া আমার হৃদয় অধিকার করিল, আমি ক্ষণকালের নিমিত্ত স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া এই সকল ভাবনা ভাবিতে লাগিলাম। 

যে কনষ্টেবলের উপর সন্দেহ করিয়া আমরা তাহার বিপক্ষে অনুসন্ধান করিতেছিলাম, সেও সেইস্থানে আমাদিগের সহিত উপস্থিত ছিল। গৃহের এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া, তাহারও দেখিলাম, যেন ভাবান্তর উপস্থিত হইল। বুঝিলাম, আমার হৃদয়ের ভাব যেন তাহারও হৃদয়ে প্রবেশ করিয়াছে। সে কিন্তু আমাকে কিছুই বলিল না, তথাপি তাহার মনের ভাব আমি বুঝিলাম। যে চক্ষুদ্বয় সেই গৃহের মৃত্তিকা লক্ষ্য করিতেছিল, সেই চক্ষুদ্বয় একবার আমার চক্ষুর উপর পতিত হইল। তাহার সেই চক্ষুর প্রতিঘাতে আমার হৃদয় আলোড়িত হইয়া উঠিল, আমি তাহার হৃদয়ের ভাব বুঝিলাম। মনে করিলাম, সে যেন বলিতেছে, ‘এখন দেখুন—আমি দোষী কি না, আমি চোর কি সাধু?’ পাঠকগণ আমাকে ক্ষমা করিবেন। কারণ যে চক্ষু একবার দেখিয়া আমি তাহার হৃদয়ের ভাব অবগত হইতে পারিলাম, আমার এই সামান্য বুদ্ধিতে সেই চক্ষুর প্রকৃত চিত্র আপনাদিগের সম্মুখে উপস্থাপিত করিতে পারিলাম না। কারণ, বিধাতা সে ক্ষমতা আমাকে দেন নাই। 

যে সকল ব্যক্তির হস্তে কোদালি ছিল, তাহাদিগের একজনের হস্ত হইতে একখানি কোদালি লইয়া, বিনা বাক্যব্যয়ে সেই কনষ্টেবল সেইস্থান খনন করিতে প্রবৃত্ত হইল। আমরা সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া অতীব কৌতূহলের সহিত দেখিতে লাগিলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

সেইস্থান হইতে অল্প পরিমাণ মৃত্তিকা স্থানান্তরিত করিতে না করিতেই কেমন এক প্রকার দুর্গন্ধ বাহির হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে উক্ত দুর্গন্ধ ক্রমে প্রবলবেগ ধারণ করিতে লাগিল। সেই গৃহের ভিতর সেই সময় যে সকল ব্যক্তি উপস্থিত ছিল দেখিলাম, তাহারা একে একে সকলেই সেই গৃহের বাহিরে গমন করিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পৰ্য্যন্ত আমি সেইস্থানে নিতান্ত কষ্টের সহিত দণ্ডায়মান ছিলাম, কিন্তু পরিশেষে আমাকেও গৃহের বাহিরে যাইতে হইল। এইরূপ ভয়ানক দুর্গন্ধ হইলেও কনষ্টেবল সবিশেষ আগ্রহের সহিত সেইস্থান খনন করিতেছিল, কিন্তু আর অধিকক্ষণ সেইস্থানে থাকিতে সমর্থ হইল না। সেইস্থানে কোদালি ফেলিয়া, সেও আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। 

যে স্থান হইতে দুর্গন্ধ বাহির হইতেছিল, সেইস্থানে জমিরের দ্রব্যাদি পোঁতা আছে, ইহাই আমাদিগের সকলের বিশ্বাস। কিন্তু সেইস্থান হইতে ভয়ানক দুর্গন্ধ বাহির হইবার কারণ কি? যে সময় জমিরের স্ত্রীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই সময়ও এইরূপ দুর্গন্ধ প্রথমে বাহির হয়, ও পরিশেষে সেই লাস দেখিতে পাওয়া যায়। এবারও কি সেইরূপ আর একটি মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়িবে? এইরূপ নানাপ্রকার কথা ক্রমে আমাদের মনে উদয় হইতে লাগিল। আরও ভাবিলাম, জমির কেবল তাহার স্ত্রীকে হত্যা করার অপরাধে এখন অভিযুক্ত; কিন্তু এখন ভাবগতিকে বোধ হইতেছে যে, সে আরও একটি হত্যাকাণ্ড সংসাধিত করিয়াছে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, জমিরের স্ত্রী একটি চরিত্রহীন স্ত্রীলোক; একথা যে কেহ কেহ বলিয়াছে, কেবল তাহা নহে। কিন্তু এখন স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে, সে কথা সমস্তই প্রমাণ-সিদ্ধ। বৃদ্ধ জমির বোধ হয়, তাহার স্ত্রীকে উপপতির সহিত একত্র দেখিয়া থাকিবে। এই অবস্থা দেখিয়া মানবমাত্রেরই অন্তঃকরণে যেরূপ স্বাভাবিক ক্রোধের উদয় হইয়া থাকে, ইহারও বোধ হয়, সেইরূপ প্রচণ্ড ক্রোধের উদয় হইয়াছিল। আর সেই ক্রোধের বশবর্তী হইয়াই জমির উপপতির সহিত তাহার স্ত্রীকে শমন-সদনে প্রেরণ করিয়াছে। অতএব এই গৃহের ভিতর হইতে এখনই সেই উপপতির লাস নিশ্চয়ই বাহির হইয়া পড়িবে। তখন সকলেই জানিতে পারিবেন যে, কোন ব্যক্তি এইরূপ রিপুপরতন্ত্র হইয়া ইহজগৎ হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়াছে। 

মনে এইরূপ নানাপ্রকার পর্যালোচনা করিয়া, পুনরায় তিন চারি জন ডোম আনাইবার নিমিত্ত লোক পাঠাইলাম। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে চারিজন ডোম আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগকে সেই গৃহ দেখাইয়া দিলাম, ও পূর্ব্বোক্ত কোদালি দিয়া সেইস্থান খনন করিতে কহিলাম। আদেশপ্রাপ্ত হইয়া দুইজন সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে প্রবৃত্ত হইল। সেই প্রচণ্ড দুর্গন্ধের নিমিত্ত যদিও আমি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে সমর্থ হইলাম না, তথাপি কর্তব্য কর্ম্মের অনুরোধে আমাকে সেই গৃহের দ্বারে দণ্ডায়মান থাকিতে হইল। দেখিলাম, উহারা সেইস্থানের মৃত্তিকা ক্রমে উঠাইতে লাগিল। সেইস্থানের মৃত্তিকা যত উঠাইতে লাগিল, পূর্ব্বোক্ত উৎকৃষ্ট দুর্গন্ধ আরও প্রবল বোধ হইতে লাগিল। সেইস্থানে অপেক্ষা করা আমার পক্ষে এখন আরও কষ্টকর হইতে লাগিল। 

এইরূপে মৃত্তিকা খনন করিতে করিতে প্রায় তিন ফুট নিম্নে একটি গলিত শব বাহির হইয়া পড়িল। উহাকে দেখিবার নিমিত্ত পাড়ার যে সকল ব্যক্তি সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, তাহারা দ্রুতবেগে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল এরূপ কু-প্রবৃত্তির বশবর্তী হইয়া যে হতভাগ্য জমিরের দ্বারা কালসদনে প্রেরিত হইয়াছে, প্রত্যেকের ইচ্ছা—সে অগ্রে যাইয়া সেই পাপাচারীর দেহ দর্শন করে। সকলেই দ্রুতপদে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল সত্য; কিন্তু কাহারই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল না। কারণ, এরূপ অবস্থায় এ যে কাহার দেহ, কেহই চিনিতে পারিল না। 

ডোম-চতুষ্টয় একত্র হইয়া সেই কবর হইতে সেই দেহ অতীব সাবধানতার সহিত উঠাইল, ও গৃহের ভিতর হইতে বাহিরে আনিয়া সেই প্রাঙ্গণে রাখিয়া দিল। জমিরের স্ত্রীর দেহ যেরূপভাবে পচিয়া গিয়াছিল, ইহা কিন্তু ততদূর গলিয়া যায় নাই; চুল সকল মস্তক হইতে একবারে খসিয়া পড়ে নাই, মাংসও শরীরে সংলগ্ন আছে। তবে ভয়ানক দুর্গন্ধের সহিত বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে। চক্ষুদ্বয় একবারে গলিয়া গিয়াছে, মুখ নিতান্ত বিকৃত অবস্থা ধারণ করিয়াছে; সহজে যে কেহ সেই দেহ চিনিতে পারে, সে ক্ষমতা কাহারও নাই। উহার অবয়ব দেখিয়া কিন্তু বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, সেই দেহ স্ত্রীলোকের নহে—পুরুষের। পূর্ব্বে আমরা যেরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, পুরুষের দেহ দেখিয়া সেই অনুমান আরও দৃঢ়ীভূত হইল। ভাবিলাম, জমির উভয়কেই হত্যা করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছে। এখন যে কোন প্রকারেই হউক, তাহাকে ধৃত করিতে না পারিলে, ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীদিগের নিকট আমাদিগকে সবিশেষ লাঞ্ছিত হইতে হইবে। কারণ, যে ব্যক্তি দুই দুইটা হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে, তাহার উপযুক্ত দণ্ড হওয়া নিতান্ত আবশ্যক, তাহার প্রমাণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। 

সেই দেহ কাহার, তখন তাহাই জানিবার আমাদিগের একান্ত প্রয়োজন হইল। সেইস্থানে যে সকল ব্যক্তি উপস্থিত ছিল, প্রত্যেককেই সেই দেহ উত্তমরূপে দেখিতে কহিলাম, তাহারা সবিশেষ যত্নের সহিত সেই দেহ দেখিতে লাগিল। পাড়ার যে সকল ব্যক্তি সেইস্থানে উপস্থিত ছিল না, তাহাদিগকেও ডাকিতে কহিলাম। কারণ, যে কোন ব্যক্তি কর্তৃকই হউক, সেই দেহ সনাক্ত হওয়ার নিতান্ত আবশ্যক। 

যে সকল ব্যক্তি সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, তাহারা সেই লাস দেখিয়া আপনা-আপনিই কি যেন ইঙ্গিতে বলাবলি করিতে লাগিল, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করিলে কেহই কোন কথা স্পষ্ট করিয়া বলিল না। আমিও তাহাদিগের মনোভাব প্রথমে বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। এইরূপে প্রায় দশ পনর মিনিট গত হইয়া গেল, সেই সময় পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তিদিগের মধ্যে একজনের কথা আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। তাহার কথা আমি কতক বুঝিতে পারিলাম। সেই কথা শুনিয়া আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, আমরা কি ভ্রান্ত! সামান্য সামান্য কারণে হঠাৎ আমরা একটি বিষয়ে স্থির-সিদ্ধান্ত করিয়া লইব; কিন্তু পরিশেষে অনায়াসেই আমরা বুঝিতে পারি যে, সামান্য কারণে সময় সময় আমরা কি মহাভ্রমে পতিত হইয়া থাকি। মধ্যে মধ্যে আমি যেমন মহাভ্রমে পতিত হই, জানি না অন্যান্য সকলেও সেইরূপ মহাভ্রমে কখন পতিত হন, কি না? সময়ে সময়ে যদি তাঁহারাও আমার মত ভ্রমের ছায়া অবলম্বন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাঁহারা আমার মত প্রতিজ্ঞাপালনে সমর্থ হন কি না, তাহাও বুঝিতে পারিতেছি না। এ বিষয়ে আমি অনেক সময়ে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, অনেক সময়ে মনে করিয়াছি, কোন বিষয়ের সত্যাসত্য সবিশেষরূপে জানিতে না পারলে, সে বিষয় সম্বন্ধে কোনরূপ ধারণাকে মনের ভিতর স্থান প্রদান করিব না। কিন্তু কৈ, সে প্রতিজ্ঞাপালন সমর্থ হই কৈ? আবার অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অনেক বিবেচনা করিয়া, প্রচুর প্রমাণ পাইয়া প্ৰকৃত বলিয়া যাহা হৃদয়ে স্থান দিয়া থাকি, পরিশেষে তাহাই অপ্রকৃত বলিয়া হৃদয় হইতে দূরে নিক্ষেপ করিতে হয় কেন? যে মন, যে কথা প্রথমে বিশ্বাস করিল, সেই মন, সেই কথা পরিশেষে অবিশ্বাস করে কেন? ইহার উত্তর কি কেহ দিতে পারেন? 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

যে কথা শ্রবণ করিয়া আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইল, তাহা বোধ হয়, পাঠকগণ অনায়াসেই বুঝিতে পারিয়াছেন। যদি না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে কথোপকথনকারী দুই ব্যক্তির দুই একটি কথা শ্রবণ করুন। এক ব্যক্তি অপরকে কহিতেছে—

“কি হে, লাস দেখিলে? কাহার লাস চিনিতে পার?” 

“যেন একটু পারি পারি বলিয়া বোধ হইতেছে। তুমি কি চিনিতে পার নাই?” 

“আমি ত চিনিয়াছি, যাহাকে লইয়া এত গোল, এ সেই ভিন্ন অপর কেহ নহে।” 

“আমিও তাই ভাবিতেছি, জমির যেন তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিল, জমিরকে হত্যা করিল কে?” 

এই কয়েকটি কথা শুনিয়াই আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইয়াছিল। আমি ত মহাভ্রমে পতিত, আমার ঊর্দ্ধতন পর কর্ম্মচারীমাত্র সকলেই আমার দশা প্রাপ্ত হইয়াছেন। তাহার উপর আবার ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবও মহাভ্রমে পড়িয়া জমিরের নামে গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দিয়াছেন। 

আজ জমিরের অনুসন্ধান শেষ হইল। আমরা জমিরের অন্বেষণে বিরত হইলাম। জমির যে তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে, সে ভ্রম আমাদিগকে পরিত্যাগ করিল। আমরা সকলেই সবিশেষ লজ্জিত হইলাম। মাজিস্ট্রেট সাহেব পরিশেষে আপনার আদেশ প্রত্যাহার করিলেন, জমিরের নামের ওয়ারেন্ট বাতিল হইল। 

এই দুইটি হত্যা কাহার দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে, তখন তাহারই অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। এই ভীষণকাণ্ডের নায়ক কে, কাহা দ্বারা এবং কি নিমিত্তই বা এই লোমহর্ষণকর কার্য সম্পাদিত হইল, তখন তাহাই ভাবিতে আরম্ভ করিলাম। এ ভাবনা যে কেবল আমি একাকীই ভাবিতে লাগিলাম, তাহা নহে; অনেক কৰ্ম্মচারীই এই ভাবনা ভাবিতে নিযুক্ত হইলেন। যেমন লাস পাওয়া গেল, যেমন উহা জমিরের লাস বলিয়া স্থির হইল, অমনি আমি এই সংবাদ উর্দ্ধতন কর্ম্মচারীর নিকটে প্রেরণ করিলাম। সংবাদ পাইবামাত্র একে একে সকলেই সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে সেইস্থান পুলিস-কৰ্ম্মচারী দ্বারা পূৰ্ণ হইয়া গেল। 

পূর্ব্বে জমির সম্বন্ধে যে হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, সেই অনুসন্ধান-সম্বন্ধীয় বিষয়গুলি এখন একবার আদ্যোপান্ত পৰ্যালোচনা করা আবশ্যক হইল। কাহার কথার উপর বিশ্বাস করিয়া আমরা এইরূপ মহাভ্রমে পতিত হইয়াছিলাম, তাহাও একবার এখন ভাবিতে হইল। যাহাদিগের কথার উপর নির্ভর করিয়া এই ভ্রম ঘটিয়াছিল, তাহারা এই হত্যাকাণ্ডে কোনরূপ মিশ্রিত আছে কি না, তাহাও একবার সবিশেষরূপে আলোচনা করার প্রয়োজন হইল। 

এ সম্বন্ধে যতদূর মনে করিতে পারিলাম, এবং অনুসন্ধানের কাগজ প্রভৃতি দেখিয়া যতদূর বুঝিতে পারিলাম, তাহাতে দেখিলাম, জমিরের বাড়ীর ভাড়াটিয়া-চতুষ্টয়ের অর্থাৎ সেখ ইব্রাহিম, সেখ আবদুল গফুর, সেখ ভিকু, এবং সেখ ছমিরুদ্দির কথা আমরা বিশ্বাস করিয়াছিলাম বলিয়াই এত বিভ্ৰাট ঘটিয়াছে। কাজেই ভাবিলাম, এ সম্বন্ধে তাহারা কোনরূপ দোষী হউক বা না হউক, আর আইনানুযায়িনী তাহাদিগের উপর আমাদিগের কোন প্রকার ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক, তাহাদিগকে লইয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখিতে হইবে যে, তাহারা এরূপ মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগের অনুসন্ধানের স্রোত অন্যদিকে ফিরাইয়া দিয়াছিল কেন? 

উক্ত চারি ব্যক্তিই সেইস্থানে উপস্থিত ছিল। তাহাদিগকে কিছু না বলিয়া, আমরা তাহাদিগের গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই গৃহের ভিতর যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা সমস্তই গৃহ হইতে বাহির করিলাম। বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি, সমস্তই খুলিয়া দেখিলাম; কিন্তু সন্দেহ সূচক কেন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইলাম না। কেবল ভিকু সেখের বাক্সের ভিতর হইতে একখানি তসরের বস্ত্র বাহির হইল। সেই বস্ত্র দেখিয়া পাড়ার সকলেই কহিল, উহা জমিরকে পরিধান করিতে মধ্যে মধ্যে অনেকেই দেখিয়াছে। ভিকুকে জিজ্ঞাসা করায়, সেও তাহাই কহিল ও বলিল যে, কিছুদিবস পূর্ব্বে কোনস্থানে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থ গমন করিবার উপলক্ষে সেই বস্ত্রখানি সে জমিরের নিকট হইতে চাহিয়া লইয়াছিল, সেই পর্যন্ত উহা তাহার নিকটেই আছে। বস্ত্র-সম্বন্ধে আমাদিগের প্রথমে যে একটু সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল, ভিকুর কথায় সে সন্দেহ কতক পরিমাণে হ্রাস হইল, কিন্তু একেবারে মিটিল না। 

উক্ত চারি ব্যক্তি পূর্ব্বে যে সকল কথা বলিয়াছিল, এখনও তাহাই বলিতে লাগিল; কিন্তু জমিরের লাস যে কি প্রকারে সেই গৃহের ভিতর গেল, সে সম্বন্ধে কোন কথাই বলিতে পারিল না বা বলিল না। উহাদিগের উপর নানাপ্রকার সামান্য সামান্য কারণে আমাদিগের সন্দেহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। 

সেই বাড়ীর ভিতর দুই স্থান হইতে দুইটি লাস বাহির হইয়াছিল, না হয়, আরও একটি লাস বাহির হইবে, এই ভাবিয়া এবার ঘরামী-চতুষ্টয়ের গৃহ খনন করিয়া দেখাই সাব্যস্ত করিলাম। এ বিষয়ে যেমন আমাদিগের সকলের মত এক হইল, অমনি কোদালিহস্তে চারি পাঁচ ব্যক্তি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশপূর্ব্বক সেই গৃহ উত্তমরূপে খনন করিতে প্রবৃত্ত হইল। মেজের সকল স্থানেই প্রায় এক কোমর গর্ভ হইয়া পড়িল; কিন্তু প্রথমে কোন দ্রব্যই পাওয়া গেল না। উক্ত গৃহের মৃত্তিকা খনন করিয়া সেই গৃহের ভিতর যে স্থানে রাখা হইতেছিল, পরিশেষে সেইস্থান খনন করিতে করিতে প্রথমে দুইটি পিত্তলের কলসী বাহির হইয়া পড়িল। উক্ত কলসীদ্বয় মৃত্তিকার ভিতর হইতে বাহিরে আনা হইল; দেখা গেল যে, তাহার একটি নোট, এবং টাকায় প্রায় অর্দ্ধপূর্ণ, অপরটির ভিতর সোনা ও রূপার বিস্তর অলঙ্কার। অপর একস্থান হইতে তৈজসপত্র, এবং বাক্সে-বন্ধ বিস্তর বস্ত্রাদি বাহির হইয়া পড়িল। উহার ভিতর অনেক দ্রব্য দেখিয়া পাড়ার সকলেই বলিল, এই সকল দ্রব্য সেই বৃদ্ধ জমির ও তাহার স্ত্রীর। উহারা চারিজন কিছু বলুক আর নাই বলুক, অতঃপর কিন্তু দুই দুইটি হত্যা করা অপরাধে সকলেই বন্দী হইয়া, অশ্রুজল মোচন করিতে লাগিল। আর আমাদিগের সকলের মন আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল। কনষ্টেবল তখন উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিল, “এখন দেখুন মহাশয়! আমি বিশ্বাসী কি অবিশ্বাসী? চোর কি সাধু?” 

দুই দুইটি খুনি মোকদ্দমার আসামী ধৃত হইল, সমস্ত মাল বাহির হইয়া পড়িল। মোকদ্দমার উপায় হইয়া গেল, আমরাও বিলক্ষণ সন্তুষ্ট হইলাম। কিন্তু আমার মন হইতে একটি বিষয়ের সন্দেহ সহজে মিটিল না। পাঠকগণ কি জানিতে চাহেন, আমার সেই সন্দেহ কি? 

আমার মনে হইল উহারা আমাদিগের নিকট রাশি রাশি মিথ্যা কথা বলিয়াছে, উহাদিগের গৃহ হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি বাহির হইয়া পড়িয়াছে; ইহা সমস্তই সত্য, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড কাহা দ্বারা সম্পাদিত হইল? ইহারা চোর, চোরা—দ্রব্যমাত্রই ইহাদিগের নিকট হইতে বাহির হইল বলিয়াই কি ইহাদিগকে হত্যাকারী বলিতে হইবে? 

হয় ত হইতে পারে, কোন ব্যক্তি কোন কারণে উহাদিগের উপর অসন্তুষ্ট ছিল, সেই উহাদিগকে হত্যা করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। আর তাহার পরে এই ব্যাপার দেখিয়া লোভ সম্বরণ করিতে না পারিয়া, ঘরামীরা দ্রব্যাদি আপনাদিগের গৃহে রাখিয়া দিয়াছে, এবং বিপদের আশঙ্কা করিয়া লাস দুইটি পুঁতিয়া রাখিয়াছে। 

হয় ত হইতে পারে, কোন চোরের চুরি করিবার প্রত্যাশায় ইহাদিগকে হত্যা করিয়াছে। কিন্তু চুরি করিবার পূর্ব্বেই ইহাদিগের গৃহেই হউক বা অপর কাহার দ্বারাই হউক, কোনরূপ প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হইয়া সমস্ত দ্রব্যাদি ফেলিয়া প্রস্থান করিয়াছে। পরিশেষে লোভের বশবর্তী হইয়াই সেই সকল দ্রব্যাদি সেই ভাড়াটিয়াগণ নিজের গৃহে রাখিয়া দিয়াছে। 

হয় ত হইতে পারে, আমাদিগের প্রথম অনুমান সত্য। জমির তাহার ভ্রষ্টা স্ত্রীকে হত্যা করিয়া, পরিশেষে পলায়ন করিবে বিবেচনাপূর্ব্বক তাহার সমস্ত দ্রব্যাদি ইহাদিগের নিকট লুক্কায়িত অবস্থায় রাখিয়া দিয়াছিল। কিন্তু পলাইবার পূর্ব্বেই যাহার নিমিত্ত সে তাহার স্ত্রীকে হত্যা করে, সেই ব্যক্তি তাহার প্রতিহিংসা সাধন করিয়া ধরা পড়িবার ভয়ে সেই শব মৃত্তিকার ভিতর প্রোথিত করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। এই হতভাগ্যগণ হয় ত তাহার কিছুই অবগত নহে, পূর্ব্বের পরামর্শানুযায়ীই ভাবিয়াছে যে, জমির পলাইয়াছে। সুতরাং জমিরের দ্রব্যাদি যেখানে জমির রাখিয়া গিয়াছিল, সেইস্থানে রহিয়াছে। হত্যা বা চুরি কিছুই ইহাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। 

এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া চিন্তিয়া পরিশেষে সেইস্থানের আবশ্যকোপযোগী সমস্ত অনুসন্ধান সমাপনপূর্ব্বক রাত্রি প্রায় দুইটার সময় সকলে সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। আসামী চতুষ্টয়ের মধ্য হইতে যদি কোনরূপে কোন কথা বাহির করিতে পারা যায়, সেই বিবেচনায় আসামী চতুষ্টয় সেই রাত্রির নিমিত্ত চারিজন কর্মচারীর নিকটে থাকিবে, এইরূপ আদেশ হইল। সেই চারিজন কর্মচারীর মধ্যে আমিও একজন ছিলাম; আমি আবদুল গফুরকে লইয়া আমার বাসায় গমন করিলাম। রাত্রির অবশিষ্টাংশ আবদুল গফুরের সহিত বকিতে বকিতে শেষ হইয়া গেল। প্রথমে সে কোন কথাই বলিল না, সহজে তাহার নিকট হইতে কোন কথাই প্রথমে বাহির করিতে পারিলাম না। তাহার সহিত অনেক বকিয়া, তাহাকে নানাপ্রকার ভয় দেখাইয়া, এবং মধ্যে মধ্যে অনেক মিষ্টকথা বলিয়া ও নানাপ্রকার আশা ভরসা দিয়া, পরিশেষে তাহার মনের কপাট ফাঁক করিতে সমর্থ হইলাম। তাহার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া পরিশেষে আপনার মন স্থির করিতে পারিলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ 

আবদুল গফুর আমাকে যেরূপ বলিয়াছিল, তাহার প্রথম হইতেই পাঠকগণকে সংক্ষেপেই বলিতে হইল। আবদুল গফুর বলিয়াছিল, “মহাশয় আমাদিগের সকলের বাসস্থানই এক গ্রামে। আমাদিগের পরস্পরের মধ্যে কোনও নিকট সম্বন্ধ না থাকিলেও আমরা একবারে পর নহি। বহুদিবস হইল, আমরা সকলেই আপন গ্রাম পরিত্যাগপূর্ব্বক কলিকাতায় আগমন করিয়াছি। এইস্থানে ঘরামির কার্য করিয়া আপন আপন জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ ও পরিবারবর্গকে প্রতিপালন করিয়া থাকি, এবং মধ্যে মধ্যে এইস্থান হইতে আপন গ্রামে গমন করিয়া আপন স্ত্রী-পুত্র প্রভৃতিকে দর্শন করি ও তাহাদিগের খরচের সংস্থানাদি করিয়া গিয়া প্রত্যাগমন করিয়া থাকি। এবার দেশ হইতে আসিবার পর জমিরের বাড়ীতে ঘর লইয়া, সেইস্থানে সকলে একত্র বসবাস করিয়া আসিতেছি, এবং এখনও ঘরামীর কার্য্য করিয়া দিনপাত করিতেছি। জমির ও তাহার স্ত্রী বাড়ীর ভিতর থাকিত, সমির ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি সেই বাড়ীর ভিতর কখন স্থান পায় নাই। জমির যে কারণে সমিরকে তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত করিয়া দেয়, তাহা আপনারা অবগত আছেন। 

“জমির নিতান্ত দরিদ্র ছিল না, যে প্রকার সংস্থান ছিল, তাহা এখন আপনারা দেখিতে পাইতেছেন। তাহার অর্থই তাহার কালস্বরূপ হইল! তাহার অর্থই আমাদিগকে প্রলোভিত করিল, এবং এখন দেখিতেছি যে, সেই অর্থই আমাদিগের সর্ব্বনাশ-সাধন করিবে!” 

এই পৰ্য্যন্ত বলিতে বলিতে আবদুল গফুরের চক্ষু দিয়া জলধারা বহিল, কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল। প্রায় দশ মিনিটকাল আর কিছুই বলিতে সমর্থ না হইয়া চুপ করিয়া সেইস্থানে বসিল, এবং অশ্রুজল বিসর্জ্জন করিতে লাগিল, পরিশেষে কথঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিল। 

“মহাশয়! জমিরের অর্থের উপর প্রথমে ইব্রাহিমের দৃষ্টি পড়িল। একদিবস কথায় কথায় সেই আমাদিগকে প্রথমে বলিল, ‘মজুরি করিয়া আর কিছুই হয় না। জমিরের টাকাগুলি যদি কোনরূপে হস্তগত করিতে পারা যায়, তাহা হইলে আমাদিগের কাহারও আর কোন প্রকার কষ্ট থাকে না। এই কথায় কেহ বা সম্মত হইল, কেহ বা কহিল, এরূপ কার্য্য করা দূরে থাকুক, মনে ভাবিলেও পাপ আছে। পরিশেষে কিন্তু দেখিলাম, সময়ের পরিবর্তনে ক্রমে সকলের মনেরও পরিবর্তন আরম্ভ হইল। কেহ বা দুইদিনে, কেহ বা দশদিনে, কেহ বা পনেরদিনে আপন আপন মনের গতি ফিরাইল। ক্রমে সকলেই ইব্রাহিমের মতে মত দিলাম। যখন আমরা সকলে একমত হইলাম, তখন কোন উপায়ে জমিরের অর্থরাশি অপহরণ করিতে সমর্থ হইব, তাহারই উপায় উদ্ভাবন করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। কেহ বলিল, ‘রাত্রিকালে সিঁদ কাটিয়া উহার গৃহের ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক সমস্ত দ্রব্যাদি চুরি করা হউক।’ কেহ বা তাহাতে অমত করিয়া কহিল, “না, সেরূপ উপায়ে চুরি করা হইবে না, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে।’ কেহ বলিল, দিনমানে যখন কেহই বাড়ীতে থাকিবে না, সেই সময়ে চুরি করাই সঙ্গত।’ কেহ বা তাহাতে অমত করিয়া কহিল, ‘যে কোন প্রকারেই হউক, চুরি করিতে হইবে। কিন্তু চোরা-দ্রব্য আমাদিগের গৃহে রাখিবে না, অন্য লোকের সাহায্যে উহা স্থানান্তর প্রেরণ করিব। এইরূপ এক এক জন এক এক প্রকার কহিল; কিন্তু কোন্ উপায়ে যে দ্রব্যাদি অপহৃত হইবে, তাহা স্থির হইল না। পরন্তু চুরি যে করিতে হইবে, তাহা স্থির হইয়া গেল। 

“সেই সময়ে একদিবস বৃদ্ধ জমির কোন কার্য্যে স্থানান্তর গমন করিয়াছিল। বাড়ীতে বৃদ্ধ না থাকায় সেইদিন আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার বড়ই সুযোগ উপস্থিত হইল। সেই রাত্রিতেই আমরা জমিরের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি। ভিকু বাড়ীর পশ্চিম অংশের প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া প্রথমে ভিতরে প্রবেশ করে, ও সদর দ্বার—যাহা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, তাহা খুলিয়া দেয়, আমরাও পরিশেষে সেই উন্মুক্ত পথে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি। জমিরের স্ত্রী বোধ হয়, সেই সময় জাগরিতা ছিল। বাড়ীর ভিতরে মনুষ্য গমনের শব্দ শুনিয়া প্রদীপহস্তে সে গৃহের বাহিরে আগমন করে। সম্মুখে আমরা দণ্ডায়মান ছিলাম, সে আমাদিগকে চিনিতে পারিয়া চোর চোর বলিয়া যেমন চীৎকার করিবার উপক্রম করিল, অমনি ছমিরুদ্দি তাহার গলা টিপিয়া ধরিল। সে সেইস্থানে পড়িয়া গেল। আমরাও পরিশেষে সকলে একত্র হইয়া ছমিরের সাহায্য করিলাম। দেখিতে দেখিতে জমিরের স্ত্রীর জ্ঞানলোপ হইল, আর তাহার চৈতন্য হইল না। এইরূপে সেইস্থানে একটি হত্যাকাণ্ড আমাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হইয়া গেলে, প্রথমে আমরা নিতান্ত ভীত হইয়া পড়িলাম। তখন যে কি করিব, কি উপায় অবলম্বনে এই হত্যা হইতে নিষ্কৃতি পাইব, সেই ভাবনা আসিয়াই আমাদিগের হৃদয় অধিকার করিল। সুতরাং সেই রাত্রিতে আমরা চুরি করিতে আর সমর্থ হইলাম না। 

“আমাদিগের সকলের মধ্যে ইব্রাহিম অতিশয় সাহসী। তার এই অবস্থা দেখিয়া কোন প্রকারে ভীত বা চিন্তিত হয় নাই। তাহারই পরামর্শ-মত পরিশেষে আমরা সেই প্রাঙ্গণে একটি কবর খনন করিয়া তাহারই ভিতর উহাকে প্রোথিত করিয়া রাখিলাম। সেইস্থান হইতেই পরিশেষে আপনারা সেই লাস পাইয়াছেন। 

“এই অসম-সাহসিক কার্য্য সমাপ্ত করিতে রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া গেল। যেরূপ উপায়ে আমরা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, সেইরূপ উপায়েই আমরা বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। সদর দ্বার পূর্ব্বের ন্যায় ভিতর হইতেই বন্ধ থাকিল। পরদিবস আর আমরা আমাদিগের কার্য্যে গমন করি নাই, বাসায় বসিয়াই সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিলাম। সেই দিবস আমাদিগের মনে অতিশয় ভয় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। কারণ, হঠাৎ যদি বৃদ্ধ বাড়ীতে প্রত্যাগমন করে, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই তাহার স্ত্রীর অন্বেষণ করিবে। হয় ত তাহাতে একটা গোলযোগ হইয়া সকল কথা বাহির হইয়া পড়িবে। এই ভয়েই আমরা বাসায় উপস্থিত ছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, যদি বৃদ্ধ আগমন করে, তাহা হইলে কোন প্রকার মিথ্যা কথা কহিয়া যাহাতে সে গোলযোগ করিতে না পারে, তাহার উপায় করিব। বিশেষতঃ মনেরও স্থিরতা ছিল না; সর্ব্বদা মনে হইতেছিল, সেই হত্যাকাণ্ড যেন সম্মুখেই হইতেছে। মুহূর্তে মুহূর্ত্তে যেন দেখিতেছি, সেই আলুলায়িত-কেশা অবলা যেন আমাদিগের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিকট হাসি হাসিতেছে, মধ্যে মধ্যে ভ্রুকুটী কটাক্ষে যেন ভয় প্রদর্শন করিতেছে। কখন যেন দেখিতেছি, আমার সম্মুখেই নিদয়রূপে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইতেছে। কখন মনে হইল, আমি যেন স্বহস্তে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিতেছি। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে মধ্যে মধ্যে জ্ঞানশূন্য হইতেছিলাম। এইরূপ ভাবেই সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইল, কাজেই আপনার নিয়মিত কর্ম্মে গমন করিতে সমর্থ হইলাম না। অন্নব্যঞ্জন প্রস্তুত হইলে, আহার করিতে বসিলাম, কিন্তু বিলক্ষণ ক্ষুধা থাকিলেও আহারে সমর্থ হইলাম না। কিছুই যেন ভাল লাগিল না। কোন বিষয়েই আপনার মনকে স্থির করিতে পারিলাম না। এইরূপে দিনমান অতিবাহিত হইয়া গেল। 

“পুনরায় রাত্রি হইল, পুনরায় আমাদিগের পরামর্শ হইতে লাগিল। যে কার্য্যের নিমিত্ত একটি হত্যা পর্য্যন্ত হইয়া গেল, সেই কাৰ্য সম্পন্ন করা এক্ষণে আমাদিগের কর্তব্য বোধ হইল। সেই গভীর নিশীথে পুনরায় আমরা সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই নির্জ্জন গৃহের ভিতর বিনা প্রতিবন্ধকে আমরা আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলাম। জমিরের স্ত্রীর নিকট যে চাবিগুচ্ছ ছিল, তাহা পূর্ব্ব রাত্রিতেই আমরা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। সেই চাবির সাহায্যে সিন্ধুক, বাক্স প্রভৃতি খুলিয়া সমস্ত দ্রব্যাদি বাহির করিলাম, ও ক্রমে অপহৃত সমস্ত দ্রব্যাদি আমাদিগের গৃহে আনিয়া মৃত্তিকার ভিতর পুঁতিয়া রাখিলাম। যে সকল দ্রব্যাদি আমাদিগের গৃহ হইতে বাহির হইয়াছে, উহা সমস্তই জমিরের। আমাদিগের ইচ্ছা ছিল, গোলযোগ মিটিয়া গেলে সমস্তই যথানিয়মে বণ্টন করিয়া লইব; কিন্তু অদৃষ্টে তাহা ঘটিল না। এখন বুঝিতেছি, এইরূপ হত্যাকাণ্ড-সংমিশ্রিত অসৎ উপায়ে উপার্জিত অর্থ দ্বারা যদি আমরা সুখলাভ করিতে পারি, তাহা হইলে জগতে দুঃখভোগ করিবে কে? তাহা হইলে পাপের উপযুক্ত দণ্ড ঈশ্বর কাহাকে প্রদান করিবেন? একথা প্রথমে বুঝি নাই, কিন্তু এখন বুঝিতে পারিতেছি। এখন দেখিতেছি, পাপ করিলে তাহার পরিত্রাণ নাই। এখন বুঝিতেছি, যতই সতর্ক হই, যতই সাবধান হই, ততই গুপ্তভাবে এবং একান্ত সাবধানতার সহিত পাপকার্য সম্পন্ন করি না কেন, সেই সর্ব্বশক্তিমানের সর্ব্বদর্শী চক্ষু হইতে নিস্তার পাইবার উপায় নাই! তাঁহার অভীপ্সিত দণ্ড হইতে পরিত্রাণ পাইতে পারে, এরূপ কেহই সৃষ্ট জগতের মধ্যে বর্তমান থাকিতে পারে না। এখন বুঝিতে পারিতেছি, লোভে পড়িলে তাহার পরিণাম কি হয়, পাপ করিলে তাহার কি দণ্ড আছে!” ইহা বলিতে বলিতে পুনরায় আবদুল গফুরের বাকরোধ হইয়া গেল, চক্ষু দিয়া জলধারা বহিতে লাগিল। 

দশম পরিচ্ছেদ 

কিয়ৎক্ষণ পরে আবদুল গফুর আপনার মনের বেগ সম্বরণ করিয়া, পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিল। 

“মহাশয় এইরূপে আরও দুই তিন দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। প্রথমে মনের ভিতর যেরূপ ভাবের উদয় হইয়াছিল, তাহা ক্ৰমে হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইতে লাগিল ক্রমে আমরা প্রকৃতিস্থ হইতে লাগিলাম। পঞ্চম দিবসে ঠিক সন্ধ্যার পর বৃদ্ধ জমির প্রত্যাগমন করিল। সেই সময় আমরা সকলেই সেইস্থানে উপস্থিত ছিলাম। সে আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে গিয়া দেখে যে, সদর দ্বার বাহির হইতে তালাবন্ধ। এই তালা আমরাই বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম। কিন্তু আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলে তাহাদের কহিলাম যে, তাহার স্ত্রী একখানি পত্র পাইয়া সেইদিন প্রাতঃকালে তাহার পিত্রালয়ে গমন করিয়াছে; বলিয়া গিয়াছে যে, যত শীঘ্র পারে সে প্রত্যাগমন করিবে। বৃদ্ধ জমির আমাদিগের কথা বিশ্বাস করিল বুঝিলাম। সে তখন আমাদিগের নিকট উপবেশন করিল। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে সমর্থ না হইয়া, রাত্রি প্রায় এগারটা পর্য্যন্ত সে আমাদিগের নিকট বসিয়া বসিয়া নানাপ্রকার গল্প করিতে লাগিল। দ্বারের চাবি তাহার স্ত্রী আমাদিগের কাহারও নিকট রাখিয়া গিয়াছে কি না, সে বিষয়েও বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিল; কিন্তু উত্তরে জানিতে পারিল যে, চাবি রাখিয়া যায় নাই। তখন অনন্যোপায় হইয়া সেই তালা ভাঙ্গিয়া বৃদ্ধ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। যে গৃহে বৃদ্ধ শয়ন করিবে, সেই গৃহও দেখিল তালাবদ্ধ। সে তালাও ভাঙ্গিয়া ফেলিল। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখ যে, তাহার দ্রব্যাদি কিছুই নাই। তখন দেখিলাম, সে গোলযোগ করিবার উপক্রম করিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমরা সকলে পুনরায় তাহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। আমাদিগের নিতান্ত ভয়ের উদয় হইল। এখন কোন প্রকার সুযোগ হইলে, আমাদিগের উপরেই সন্দেহ পড়িবে। কারণ, আমরা ব্যতীত সেই সময়ে অপর কেহই সেই বাড়ীতে উপস্থিত ছিল না। 

“বৃদ্ধ আগমন করিলে কোন উপায় অবলম্বন করিতে যাবে, হইবে ইতিপূর্ব্বে পরামর্শ করিয়া আমরা এক প্রকার করিয়াই রাখিয়াছিলাম। আমরা বৃদ্ধের গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াই পরামর্শানুযায়ী কার্য্যেই একবারে হস্তার্পণ করিলাম। যে কার্য্য আমরা সেই সময়ে সহজেই করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, এখন কিন্তু তাহা বলিতেও আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইতেছে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে! আমরা তখন অবলীলাক্রমে সেই নিরপরাধ বৃদ্ধের সর্ব্বনাশ করিলাম! সেইস্থানে তাহাকে হত্যা করিয়া, পাপের স্রোত আরও প্রবলবেগে বর্দ্ধিত করিলাম! 

“এখন বুঝিতে পারিতেছি, যে পাপ আমাদিগের দ্বারা সংঘটিত হইয়াছে, সে পাপের শেষ নাই, সে পাপের দণ্ড হইতে নিষ্কৃতি পাইবার উপায় নাই। তখন কিন্তু উহা বুঝিতে পারি নাই। ধরা পড়িয়া পাপের যে উপযুক্ত ফল প্রাপ্ত হইব, তাহা একবারের নিমিত্তও ভাবি নাই। তখন অর্থলোভে মত্ত হইয়া, হিতাহিত জ্ঞান-বর্জ্জিত হইয়াছিলাম বলিয়াই, আজ এরূপ বিপদাপন্ন হইয়াছি। 

“যাহা হউক, পূর্ব্ব-পরামর্শানুযায়ী আমাদিগের সমস্তই ঠিক ছিল। দেখিতে দেখিতে অন্য গৃহের ভিতর একটি কবর প্রস্তুত হইয়া গেল। বৃদ্ধ জমির উহার ভিতর চির-শয্যায় শায়িত হইল। আমরা তখন সমস্ত গৃহ তালাবদ্ধ করিয়া দিলাম, সদর দ্বারও তালাবন্ধ হইল। পরদিবস হইতে আমরা মিথ্যা কথা প্রচার করিয়া পাড়ার সকল লোককেই প্রতারিত করিলাম। সকলেই জানিতে পারিল যে, জমিরের স্ত্রী তাহার পিত্রালয়ে গমন করায়, বৃদ্ধ তাহাকে আনিতে গমন করিতেছে বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে। 

“আমরা মনে করিয়াছিলাম, যেরূপ উপায়ে এই কীর্তি সম্পন্ন করিয়াছি, তাহাতে কাহারও মনে কোন প্রকার সন্দেহ উপস্থিত হইবে না। কিন্তু ঈশ্বরের কি অদ্ভুত কৌশল। দেখিলাম, পাড়ার দুই এক ব্যক্তির মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহ হইতে লাগিল। সকলেই যেন কেমন একটি বিপদের আশঙ্কা করিতে লাগিল। আমরা ভাবিলাম, এই কথা ক্ৰমে প্রকাশ হইয়া পড়িলে, আমাদিগের আর নিস্তার নাই। পুলিস যদি কোন প্রকারে সন্ধান পায়, ও প্রথমেই যদি জমিরের লাস বাহির হইয়া পড়ে, তাহা হইলে আমাদিগের আর বাঁচিবার উপায় থাকিবে না। এই বলিয়া আমাদের সকলের পরামর্শ-মত জমিরের উপর পুলিসের সন্দেহ জন্মাইবার চেষ্টা করিলাম। সেই সময়ে পুলিসে একখানি বেনামী পত্র পাঠান হইল। সেই পত্রে বেশ স্পষ্ট করিয়া লেখা হইল যে, কোন স্থানে জমিরের স্ত্রীর লাস পাওয়া যাইবে। ভাবিয়াছিলাম, পুলিস জমিরের স্ত্রীর লাস প্রাপ্ত হইলে, নিশ্চয়ই জমিরের উপর সন্দেহ করিবে। এদিকে এ কথাও সকলে শুনিয়াছিল যে, কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া জমির বাড়ী হইতে পলায়ন করিয়াছে। বিশেষতঃ তাহার স্ত্রীর চরিত্র নিতান্ত মন্দ ছিল। আরও ভাবিয়াছিলাম, পুলিস জমিরকে চতুর্দিকে অনুসন্ধান করিয়া ফিরিবে, আর এদিকে জমিরের লাস পচিয়া মৃত্তিকায় পরিণত হইবে; সুতরাং আমাদিগের উপর কোন প্রকারে সন্দেহ হইবার আর কোনরূপ কারণ থাকিবে না। যাহা ভাবিয়াছিলাম, প্রথমে কাৰ্য্যেও হইয়াছিল তাহাই; কিন্তু ঈশ্বর ঘুরাইয়া ফিরাইয়া যে স্থানের ঘটনা, সেইস্থানেই সকলকে লইয়া গিয়া পরিশেষে উপস্থিত করিলেন। উহার দ্রব্যাদির অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। তখন পাছে আমাদিগের উপর পুলিসের কোনরূপ সন্দেহ জন্মে, এই ভয়ে অনুসন্ধানের স্রোত ফিরাইয়া, পুলিস-কৰ্ম্মচারীর উপর দোষ ফেলিবার চেষ্টা করিলাম। ভাবিলাম, তাহাকেই লইয়া অনুসন্ধান চলিবে, এদিকে আর কেহই দেখিবে না। কিন্তু ঈশ্বরের চক্ষু হইতে কে পরিত্রাণ পাইবে? সকলেই দেখিলেন, তাঁহার চক্রে কি প্রকারে কোথা হইতে সমস্ত দ্রব্য বাহির হইয়া পড়িল, আর আমরাই বা কিরূপে ধৃত হইলাম!” এই বলিয়া আবদুল গফুর নিরস্ত হইল। 

অপর তিন ব্যক্তি কোন কথাই স্বীকার করিল না। তাহারা বিনা অপরাধে ধৃত হইয়াছে, এই কথাই কেবল বার বার বলিতে লাগিল। কিন্তু পরিশেষে উহারা সকলেই হত্যা অপরাধে বিচারার্থ প্রেরিত হইল। আবদুল গফুর প্রকৃত কথা বলিয়াছিল বলিয়া, মাজিষ্ট্রেট সাহেব তাহার উপর বিশিষ্ট অনুগ্রহ করিলেন। আসামী শ্রেণী হইতে তাহার নাম উঠাইয়া তাহাকে সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত করিলেন। সেও সর্ব্বসমক্ষে স্পষ্টরূপে প্রকৃত কথা বলিয়া ফেলিল। 

যে মুটিয়া একখানি পত্র আমার হস্তে প্রদান করিয়াছিল, তাহার কথা বোধ হয়, পাঠকগণ এখনও বিস্মৃত হয়েন নাই। আর ইহাও বোধ হয়, আপনাদিগের মনে আছে যে, সেই সময়ে ঠিকানা লিখিয়া লইয়া উহাকে যাইতে দেওয়া হইয়াছিল; সুতরাং তাহাকে পাইতে সবিশেষ কষ্ট পাইবার কোনরূপ সম্ভাবনাই ছিল না। তাহাকে যে দিবস আনয়ন করিলাম, সেইদিবস আসামীগণ আমাদিগের নিকট ছিল না, মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সমীপে প্রেরিত হইয়াছিল। সুতরাং সেই কুলিকে লইয়া একবারে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের এজলাসে উপনীত হইলাম। আমাদিগের ইচ্ছা সেই আসামীগণকে দেখিয়া যদি সে কাহাকেও চিনিতে পারে। কার্য্যেও দেখিলাম আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল, এবং সাক্ষ্য প্রদানকালে ইব্রাহিমকে দেখাইয়া দিয়া সে কহিল যে, সেই ব্যক্তিই বহুবাজারের চৌরাস্তায় তাহার হস্তে পত্র প্রদান করিয়াছিল। 

দুই মাস পরে বিচার শেষ হইয়া গেল। ইব্রাহিম, ভিকু, ছমিরুদ্দি তিনজনেই নিৰ্ব্বাসিত হইল। আবদুল গফুর কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশে প্রস্থান করিল। কনষ্টেবল আপনার চাকরি পাইল, কিন্তু আর অধিক দিবস কৰ্ম্ম না করিয়া, পেন্সন গ্রহণপূর্ব্বক আপন দেশে গমন করিল। 

[আশ্বিন, ১৩০০ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *