বেকুব বৈজ্ঞানিক (অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকের চক্ষুতে অজ্ঞলোকের ধূলিনিক্ষেপের অদ্ভুত রহস্য! )

বেকুব বৈজ্ঞানিক (অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকের চক্ষুতে অজ্ঞলোকের ধূলিনিক্ষেপের অদ্ভুত রহস্য!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, একদিবস নিতাইচাদ বৈরাগীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তাহাকে দেখিবামাত্রই আমি চিনিতে পারিলাম, সেও আমাকে চিনিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “নিতাই! তুমি জেল হইতে কোন্ তারিখে খালাস হইয়াছ?” 

নিতাই। আজই জেল হইতে অব্যাহতি পাইয়াছি। কিন্তু আপনাদিগের হস্ত হইতে এখনও অব্যাহতি পাই নাই। পুলিস প্রহরীরা জেল হইতে আমাকে এইস্থানে আনয়ন করিয়াছে; কিন্তু কি নিমিত্ত যে আনয়ন করিয়াছে, এবং আরও কতক্ষণ পর্যন্ত যে আমাকে এইস্থানে থাকিতে হইবে, তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। 

আমি। তুমি যাহা বুঝিতে পারিতেছ না, তাহা আমি তোমাকে বুঝাইয়া দিতেছি। এইস্থানের নিয়ম আছে যে, কোন ব্যক্তির কোন গুরুতর অপরাধে কারাদণ্ড হইলে তাহাকে সেই সময় একবারে জেলে পাঠান হইয়া থাকে। পরিশেষে তাহার মেয়াদের তারিখ পূর্ণ হইলে, তাহাকে পুনরায় এইস্থানে আনয়ন করা হয়, এবং তাহার চেহারা উঠাইয়া লইয়া যে থানা হইতে তাহার মেয়াদ হইয়াছিল, সেই থানায় তাহাকে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। তোমাকেও এই নিমিত্ত এখানে আনা হইয়াছে। এইস্থানে তোমারও চেহারা উঠাইয়া লওয়া হইবে। পরিশেষে যে থানা হইতে তোমার কারাদণ্ড হইয়াছিল, সেই থানায় পাঠাইয়া দেওয়া হইবে। সেইস্থান হইতে তুমি আপন গৃহে গমন করিতে পারিবে। 

নিতাই। আপনাদের এ সকল কার্য্য সম্পন্ন করিতে কত বিলম্ব হইবে? 

আমি। বিলম্ব অধিক হইবারই সম্ভাবনা। কিন্তু মনে করিলে যাহাতে তুমি শীঘ্র নিষ্কৃতিলাভ করিতে পার, আমি তাহার উপায় করিতে পারি। 

নিতাই। তাহা হইলে অনুগ্রহ পূর্ব্বক যাহাতে আমি শীঘ্র নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারি, তাহার উপায় করুন। 

আমি। যদি তুমি তোমার পূর্ব্ব প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন কর, তাহা হইলে যাহাতে তুমি শীঘ্র নিষ্কৃতিলাভ করিতে সমর্থ হও, আমিও তাহার উপায় করিতে পারি। 

নিতাই। আমি কি প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ আছি, তাহা ত আমার কিছুমাত্র মনে নাই। আমি কোন সময়ে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম? 

আমি। যে সময়ে তুমি ধৃত হইয়াছিলে। 

নিতাই। আমি কি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম? 

আমি। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, কি উপায়ে তুমি হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন কর। উত্তরে তুমি কহিয়াছিলে, “যে উপায়ে আমি এই হত্যা করিয়াছি, তাহা এখন আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিলে আমাকে নিশ্চয়ই ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। নতুবা কিছু দিবসের নিমিত্ত আমাকে মেয়াদ খাটিতে হইবে মাত্র। মেয়াদ গত হইলে যখন আমি প্রত্যাগমন করিব, সেই সময় আমি আপনাকে বলিয়া যাইব যে, কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া আমি এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিয়াছি।” এখন তুমি জেল হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছ, সুতরাং এখন তোমার পূর্ব প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করা কর্তব্য। 

নিতাই। যদি আমি আপনার নিকট এরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ থাকি, তাহা হইলে সেই প্রতিজ্ঞা আমি প্রতিপালন করিব। এখন যাহাতে আমার শীঘ্র মুক্তিলাভ হয়, তাহার উপায় করুন। 

নিতাইয়ের এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া কৌতূহলপরবশ হইয়া, সেই সময়ের প্রয়োজনীয় কাৰ্য্য সকল যত শীঘ্র হইবার সম্ভাবনা, সম্পন্ন করিয়া লইয়া, তাহাকে ভবানীপুর থানায় পাঠাইয়া দিলাম। 

এই ঘটনার কিছুদিবস পরে নিতাইয়ের সহিত আমার পুনরায় সাক্ষাৎ হয়। সেই সময়ে সে তাহার প্রতিজ্ঞা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ না করিলেও কতক পরিমাণে রক্ষা করিয়াছিল। সে আমাকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহা পাঠকগণের নিকট বর্ণন করিবার পূর্ব্বে, কি অপরাধে ও কিরূপ উপায়ে নিতাই ধৃত হইয়া কারারুদ্ধ হয়, তাহাই বর্ণন করা আমার বোধ হয় সম্যরূপে বিধেয়। 

নিতাইচাদের কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে, আজ পর্য্যন্ত বিজ্ঞানশাস্ত্র সম্পূর্ণরূপে উন্নতি লাভ করিতে পারে নাই। বিশেষতঃ ইংরাজী বিজ্ঞান এখনও অনেক বিষয়ে পশ্চাতে পড়িয়া আছে। কেন যে আমি বৈজ্ঞানিকদিগের উপর এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিলাম, এই আখ্যায়িকা অধ্যয়ন করিলেই পাঠকগণ তাহা বুঝিতে পারিবেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

রাত্রি নয়টার সময় ভবানীপুর থানা হইতে টেলিফোন সংবাদ আসিল যে, ভবানীপুরের থানার অধীনস্থ চাউলপট্টি রোডে একটি বারবনিতাকে হত্যা করিয়া কে তাহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। 

এই সংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্র কালবিলম্ব না করিয়া, চাউলপট্টি রোডের যে বাড়ীতে এই হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হইয়াছিল, সেই বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। উহা একখানি খোলার বাড়ী এবং পুলিস থানার সন্নিকটবর্তী। সেই বাড়ীতে কেবল দুইটিমাত্র স্ত্রীলোক ভিন্ন অপর আর কেহই থাকে না। তাহাদিগের মধ্যে একজনের নাম বিন্দু, তাহাকে বাড়ীতেই পাইলাম। অপর স্ত্রীলোকটির নাম মল্লিকা। জানিলাম, সেই মল্লিকাই হত হইয়াছে, এবং তাহার যথাসর্বস্ব অপহৃত হইয়াছে। 

মল্লিকা যে গৃহে থাকিত, প্রথমেই সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, দ্বার খোলা রহিয়াছে, সেই দ্বারের পার্শ্বে অর্থাৎ গৃহের পূর্ব্বদিকে একখানি পালঙ্কের উপর মল্লিকা চিৎ হইয়া শয়ন করিয়া রহিয়াছে। হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় না যে, তাহার জীবন বহির্গত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমরা যখন তাহাকে দেখিলাম, তখন তাহার হাত পা শক্ত, এবং শরীর শীতল হইয়া গিয়াছে। সেই গৃহের ভিতর প্রবিষ্ট হইবার পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম যে, মল্লিকা হয় ত কোনরূপ অস্ত্রের দ্বারা আহত হইয়া মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইয়াছে। কিন্তু তাহার সেই পালঙ্কের নিকট গমন করিয়া তাহার সেইরূপ মৃত্যুর কোন প্রকার চিহ্নও দেখিতে পাইলাম না; না আছে—সেইস্থানে কোনরূপ অস্ত্র, না আছে—রক্তের চিহ্ন। 

কিরূপ আঘাত পাইয়া মল্লিকা হত হইয়াছে, তাহা জানিবার মানসে মল্লিকার গাত্রের বসন খুলিয়া ফেলিলাম, এবং পা হইতে আরম্ভ করিয়া মস্তক পর্য্যন্ত বিশিষ্টরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কিন্তু শরীরের কোনস্থানে কোন প্রকার চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। কেবল দেখিলাম, অর্দ্ধ চব্বিত পানের কিয়দংশ তাহার মুখের ভিতর রহিয়াছে। উহার শরীরের কোনস্থানে অলঙ্কারের লেশমাত্র নাই। 

মল্লিকার শরীরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কিরূপে সে হত হইয়াছে, তাহার বিষয় কিছুমাত্র অনুমান করিতে না পারিয়া পরিশেষে সেই গৃহের অবস্থার উপর লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহের ভিতর আমারি, সিন্ধুক, বাক্স, প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহার সমস্তই ভগ্নাবস্থায় রহিয়াছে, এবং তাহার অভ্যন্তরস্থ দ্রব্য সকল স্থানচ্যুত হইয়া কতক পালঙ্কের নিম্নে, কতক আলমারির পার্শ্বে পতিত রহিয়াছে। এই সকল অবস্থা দেখিয়া অনুমান হয় যে, এই সকল আমারি প্রভৃতির ভিতর যে সকল বহুমূল্য দ্রব্যাদি ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। 

গৃহের এই সকল অবস্থা এবং হত স্ত্রীলোকের অবস্থা দেখিয়া যখন আমরা কিরূপে তাহার মৃত্যু হইয়াছে, তাহার কিছুই অনুমান করিতে পারিলাম না, তখন প্রধান প্রধান কর্ম্মচারীবর্গের মধ্যে পরামর্শ করিয়া স্থির হইল যে, এই মৃতদেহ যে ডাক্তার সাহেব কর্তৃক পরদিবস ছেদিত ও পরীক্ষিত হইবে, সেই ডাক্তার সাহেবকে এইস্থানে আনয়ন করিয়া যে অবস্থায় এই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই অবস্থাতেই তাহাকে দেখান হউক। এই লাস আর ডেড্‌হাউসে পাঠাইবার আবশ্যক নাই। শবচ্ছেদ করিতে করিতে যিনি এখন বৃদ্ধ হইয়া আসিতেছেন, সেই বহুদর্শী ডাক্তার সাহেব মল্লিকার অবস্থা দেখিলে বোধ হয় বলিতে পারিবেন, কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া ইহাকে হত্যা করা হইয়াছে। 

পরামর্শে যাহা স্থির হইল, কার্য্যে তাহা পরিণত হইল। দ্রুতপদে একখানি গাড়ি পাঠাইয়া দিয়া রাত্রি প্রায় এগারটার সময় বাড়ি হইতে ডাক্তারবাবুকে সেইস্থানে লইয়া যাওয়া হইল। তিনি উপস্থিত হইয়া মল্লিকার মৃতদেহ আপাদমস্তক উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলেন। বহুক্ষণ পরীক্ষা করিয়াও বোধ হইল, তিনিও কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। কিন্তু তিনি আমাদিগকে কহিলেন, “বোধ হয়, ‘হায়ড্রোসেনিক এসিড নামক বিষ-প্রয়োগ করিয়া ইহাকে হত্যা করা হইয়াছে। কারণ, এক হায়ড্রোসেনিক এসিড ভিন্ন অপর কোন তেজস্কর বিষ এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই, যাহার দ্বারা মুহূর্তের মধ্যে মনুষ্যের জীবন নষ্ট হইতে পারে। এই স্ত্রীলোকটির জীবনও শুনিতেছি, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হইয়াছে।” 

ডাক্তারবাবু আমাদিগকে এইরূপ ভাবে বুঝাইলেন সত্য; কিন্তু বোধ হইল, তাঁহার মনেও সম্পূর্ণরূপে সন্দেহের উদয় হইয়াছে। যে পর্য্যন্ত তিনি প্রত্যাগমন না করেন, সেই পর্যন্ত মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা না হয়, আমাদিগকে এই উপদেশ দিয়া তিনি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন, এবং কিয়ৎক্ষণ পরেই তাঁহার ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারি অর্থাৎ সর্ব্বপ্রধান ইংরাজ ডাক্তারকে সঙ্গে করিয়া পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন সেই প্রধান ডাক্তার সাহেব প্রথমে স্থানীয় অবস্থা উত্তমরূপে শ্রবণ ও দর্শন করিয়া, পরিশেষে একান্ত মনোযোগের সহিত সেই মৃতদেহের আপান-মস্তক উত্তমরূপে দর্শন করিলেন। কিন্তু তাঁহার মতামত সম্বন্ধে আমাদিগকে কিছু না বলিয়া, তাঁহার সমভিব্যাহারীকে কি বলিতে বলিতে সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। আমরাও তখন আর, অপেক্ষা না করিয়া, সেই মৃতদেহ গৃহ হইতে বাহির করিয়া পরীক্ষার্থ প্রেরণ করিলাম। 

মৃতদেহ গৃহ হইতে বাহির করিলে পর, আমরা পুনরায় সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া উত্তমরূপে অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। গৃহের প্রত্যেক দ্রব্য এক এক করিয়া বাহিরে আনিয়া সেই গৃহের অভ্যন্তরে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু এরূপ কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইলাম না যে, যাহার দ্বারা—কি উপায়ে হত্যা হইয়াছে,—তাহার কারণ নির্ণয় করিতে সমর্থ হই। আমাদিগের সকলেরই পরিশেষে অনুমান হইল যে, কোন না কোনরূপ বিষ-প্রয়োগ করিয়া ইহাকে হত্যা করা হইয়াছে। 

আমাদিগের সকলের মনে এইরূপ সন্দেহ হইল সত্য; কিন্তু অপর কর্তৃক প্রযুক্ত বিষ প্রভাবে হত হইলে, অথবা নিজেই বিষপান করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইলে, সেই মৃতব্যক্তির দেহে সচরাচর আমরা সে সকল লক্ষণ বা চিহ্ন দেখিয়া থাকি, ইহাতে সেই প্রকারের একটিমাত্রও চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। তথাপি এই মৃত্যুর কারণ, বিষপ্রয়োগ ভিন্ন অন্য কোনো কিছুই মনে হইল না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

যে বাড়ীতে এই হত্যাকাণ্ড সংসাধিত হইয়াছে, সেই বাড়ীতে বিন্দু ব্যতীত এখন আর কেহই নাই। এ সম্বন্ধে বিন্দু যাহা অবগত আছে, তাহা তাহাকে আমরা সকলেই এক এক করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, এবং সে যাহা বলিয়াছিল, তাহাও উত্তমরূপে শ্রবণ করিয়াছিলাম। তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ :—

“প্রায় পাঁচ বৎসর হইতে আমি এই বাড়ীতে বসবাস করিতেছি। মল্লিকাও বোধ হয়, তিন বৎসরের অধিক এই স্থানে ছিল। কেবলমাত্র আমরা দুইজন এই বাড়ীতে বাস করিতাম বলিয়া, আমাদিগের মধ্যে বিলক্ষণ প্রণয় ছিল। রাত্রিকাল ব্যতীত প্রায় সমস্ত সময়ই আমরা একত্র যাপন করিতাম। আমাদিগের মধ্যে কোনরূপ কলহ বিবাদ কি আত্মবিচ্ছেদ কখন ঘটে নাই, এক-কথায় সহোদরা ভগিনীর ন্যায় আমরা উভয়ে এইস্থানে বাস করিয়া আসিতেছিলাম। আমাদিগের মধ্যে কেহই কোন ব্যক্তির রক্ষিতা ছিল না, সুতরাং উদরান্নের সংস্থান করিবার নিমিত্ত সন্ধ্যার পরই আমাদিগের উভয়কেই সদর দ্বারে গিয়া বসিতে হইত। ঈশ্বর আমাদিগের অদৃষ্টে যে দিবস যাহা লিখিতেন, সেইদিবস তাহাই উপার্জ্জন করিয়া আমরা আপন আপন গৃহে আসিয়া শয়ন করিতাম। আমার শরীর সম্পূর্ণরূপ সুস্থ নহে বলিয়া, আমি রাত্রি দশটার পর আর দ্বারে থাকিতাম না; দশটাও বাজিত, আমিও গিয়া আপন গৃহে শয়ন করিতাম। কিন্তু মল্লিকা অল্প উপার্জ্জনে সন্তুষ্ট হইত না, তাহার আশাও সহজে নিবৃত্ত হইত না। সুতরাং সে অধিক উপার্জ্জনের প্রত্যাশায় অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত সদর দ্বারে বসিয়া থাকিত। এমন দিনও ঘটিয়াছে দেখিয়াছি যে, সমস্ত রজনী উক্তরূপে বসিয়া বসিয়া রাত্রি প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকা সর্বশেষে আপন গৃহে গিয়া শয়ন করিয়াছে। 

“অদ্য সন্ধ্যার সময় নিয়মিতরূপ বেশভূষা করিয়া আমরা উভয়েই সদর দ্বারে গিয়া উপবেশন করিয়াছিলাম। আমার অতি সামান্য যে দুই তিনখানি অলঙ্কার আছে আমার গাত্রে তাহাই ছিল; কিন্তু মল্লিকার গাত্রে অনেকগুলি অলঙ্কার ছিল। সে এই সামান্য উপার্জ্জনের মধ্য হইতে কিছু কিছু সঞ্চিত করিয়া অনেক দিবসে অনেকগুলি অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়াছিল, এবং প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় সেই সমস্ত অলঙ্কার পরিধান করিয়া আমার সহিত সদর দ্বারে গিয়া উপবেশন করিত। 

“আমরা উভয়ে সদর দ্বারে গিয়া উপবেশন করিবার অতি অল্প সময় পরে একজন যুবক আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইল, এবং মল্লিকাকে ইঙ্গিত করিয়া আমাদিগের বাড়ীতে ভিতর প্রবেশ করিল। তাহারই প্রত্যাশায় সেই যুবক বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, এই ভাবিয়া মল্লিকাও সেইস্থান হইতে উঠিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। সেই যুবকের আপাদ-মস্তক একখানি লালরঙ্গের র‍্যাপার দিয়া আবৃত ছিল, সুতরাং তাহার অবয়ব বা মুখের আকৃতি আমি উত্তমরূপে দেখিতে পাই নাই; অথচ উহাকে ইতিপূর্বে আমি যে কখন দেখিয়াছি, তাহাও আমার বোধ হয় না। 

“যে সময় আমরা উভয়েই সদর দ্বারে বসিয়াছিলাম, সে সময় মল্লিকার গৃহের দ্বার খোলা ছিল, এবং সেই গৃহের ভিতর একটি আলো জ্বলিতেছিল। যে সময় সেই অপরিচিত যুবক বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, এবং মল্লিকা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল, সেই সময় আমি দেখিলাম যে, সেই যুবক মল্লিকাকে কোন কথা না বলিয়া একেবারে মল্লিকার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। মল্লিকাও উহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আপন গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং গৃহের দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিল। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে হইল যে, সেই ব্যক্তি মল্লিকার নিকট নিশ্চয়ই উত্তমরূপে পরিচিত। কারণ, পূর্ব্ব হইতে সবিশেষরূপে পরিচিত না হইলে বিনা বাক্যব্যয়ে কেহই কাহারও গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে সাহসী হয় না। এই ভাবিয়া আমি সে দিকে আর কোনরূপ লক্ষ্য না করিয়া, নিজের অন্ন-চেষ্টা নিমিত্ত কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে বসিয়া থাকিলাম। পরিশেষে আমার ধূমপানের ইচ্ছা বলবতী হওয়ায় আমি সদর দ্বার হইতে উঠিয়া আপনার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

“আমি আমার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিবার অতি অল্প সময় পরেই মল্লিকার গৃহের দ্বার খোলার শব্দে আমার নয়ন পুনরায় সেইদিকে আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম যে, সেই আগন্তুক মল্লিকার গৃহের দ্বার খুলিয়া দ্রুতপদে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল। লালরঙ্গের র‍্যাপারের দ্বারা যেরূপভাবে তাহার সমস্ত শরীর আবৃত করিয়া সে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, গৃহ হইতে বহির্গত হইবার সময় ঠিক সেইরূপ ভাবেই আপন শরীর আচ্ছাদন করিয়া বহির্গত হইয়া গেল। আগন্তুক বহির্গত হইয়া গেল, কিন্তু মল্লিকা তাহার গৃহ হইতে বহির্গত হইল না, ইহাতে আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহের উদয় হইল। কারণ, কোন আগন্তুক আমাদিগের গৃহে আসিলে, সে যাহাতে পুনরায় আমাদিগের গৃহে আসে, তাহার নিমিত্ত আমরা তাহাকে বিশিষ্টরূপে যত্ন করিয়া থাকি, এবং পরিশেষে যখন সে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া যায়, তখন তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রায়ই সদর দ্বার পর্য্যন্ত গমন করিয়া থাকি। সুতরাং মল্লিকাকে যখন তাহার গৃহ হইতেই বহির্গত হইতে দেখিলাম না, তখন আমি আমার গৃহ হইতেই মল্লিকাকে ডাকিলাম। দুই তিন বার ডাকিবার পরও যখন তাহার কোন প্রকার উত্তর পাইলাম না, তখন আমার হস্তস্থিত হুক্কা আমার গৃহে রাখিয়া, দুই এক পদ করিয়া ক্রমে মল্লিকার গৃহের নিকট গমন করিলাম। পুনরায় তাহাকে ডাকিলাম, কিন্তু তাহাতেও কোন উত্তর না পাইয়া আমি তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। আপনারা প্রথমে আসিয়া উহাকে যেরূপ অবস্থায় দেখিয়াছেন, আমিও গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহাকে ঠিক সেইরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইলাম উহাকে বার বার ডাকিতে লাগিলাম। কিন্তু যখন কোনরূপেই উত্তরপ্রাপ্ত হইলাম না, তখন উহার গাত্রে হস্তার্পণ করিয়া ডাকিলাম, তাহাতেও কোনো উত্তর পাইলাম না। প্রথমে ভাবিয়াছিলাম, মল্লিকা নিদ্রিতা হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু পরক্ষণেই বুঝিলাম যে, সামান্য নিদ্রায় সে অভিভূতা হয় নাই, মহানিদ্রা আসিয়া তাহাকে আশ্রয় করিয়াছে! আরও দেখিলাম যে তাহার শরীরে যে সকল অলঙ্কারাদি ছিল তাঁহার চিহ্নমাত্রও নাই। 

“এই ব্যাপার দেখিয়া,—কি কর্তব্য, হঠাৎ তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, মল্লিকার গৃহ হইতে দ্রুতপদে বহির্গত হইয়া সদর দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলাম, দেখিলাম যে, নিকটে একজন পুলিস প্রহরী দাঁড়াইয়া আছে, তাহাকে সমস্ত অবস্থা বলিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া সে কহিল, ‘অতি অল্পক্ষণ হইল, একজন লোক তোমাদিগের বাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া পশ্চিমদিকে গমন করিয়াছে, উহার গাত্রে একখানি লালরঙ্গের র‍্যাপার আছে বলিয়া বোধ হয়।’ এই বলিয়া প্রহরী সেই ব্যক্তির উদ্দেশে পশ্চিমদিকে দ্রুতপদে গমন করিল, আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। অনেক দূর পর্যন্ত গমন করিয়া নানাস্থানে তাহার অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম, কিন্তু কোন স্থানে তাহার কিছুমাত্র সন্ধান না পাইয়া, আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম। পাহারাওয়ালাও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আমাদিগের বাড়ীতে প্রবেশ করিল, এবং মল্লিকার অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়া থানায় সংবাদ দিবে বলিয়া, বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। ইহার কিয়ৎক্ষণ পরেই এক এক করিয়া আপনারা ক্রমে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিলেন। উহার যে অলঙ্কারাদি ছিল, তাহা আমি উত্তমরূপে অবগত আছি, এবং সেই সকল অলঙ্কার পুনরায় দেখিলে আমি চিনিতে পারিব।” 

আমি। যাহাকে তুমি মল্লিকার গৃহে প্রবেশ করিতে এবং গৃহ হইতে বহির্গত হইতে দেখিয়াছ, সে কতক্ষণ পৰ্য্যন্ত মল্লিকার গৃহের ভিতর ছিল? 

বিন্দু। অতি অল্প সময় সে মল্লিকার গৃহের ভিতর ছিল; আমার বোধ হয় কুড়ি পঁচিশ মিনিটের অধিক হইবে না।

আমি। যখন সেই ব্যক্তি মল্লিকার গৃহের দ্বার খুলিয়া বহির্গত হইয়া যায়, সেই সময় মল্লিকার গৃহ অন্ধকারময় ছিল, কিনা? 

বিন্দু। গৃহ অন্ধকারময় ছিল না, একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। সেই ব্যক্তি বহির্গত হইয়া যাইবার পর আমি যখন মল্লিকাকে ডাকিতে যাই, সেই সময় সেই প্রদীপের সাহায্যেই আমি জানিতে পারি যে, মল্লিকা মরিয়া গিয়াছে, এবং তাহার অঙ্গের অলঙ্কার সকল অপহৃত হইয়াছে। 

আমি। তুমি এখনই বলিলে যে, প্রায় তিন বৎসর পর্য্যন্ত মল্লিকা তোমার সহিত একত্র বাস করিতেছে। এই তিন বৎসরের মধ্যে উহাকে তুমি কখন পীড়িত দেখিয়াছ? যদি দেখিয়া থাক, তাহা হইলে কি প্রকারের পীড়ার সে আক্রান্ত হইত? 

বিন্দু। আমার বোধ হয় মল্লিকার শরীরে কোনরূপ পীড়া ছিল না। কারণ গত তিন বৎসরের মধ্যে এক দিবসের নিমিত্তও আমি তাহাকে কোন প্রকার পীড়ায় পীড়িত হইতে দেখি নাই। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

বিন্দু যে সকল কথা বলিল, তাহা কৰ্ম্মচারীমাত্রই সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলেন। তখন কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, সকলে তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। যে বাড়ির ভিতর এই ঘটনা ঘটিয়াছে, একা বিন্দু ব্যতীত অপর কেহই এখন আর সেই বাড়ীতে বাস করে না। সুতরাং জিজ্ঞাসাবাদ করা যাইতে পারে, এরূপ অপর কোন লোককেও পাওয়া গেল না। তথাপি বাড়ির নিকটবর্ত্তী অপরাপর স্ত্রীলোক ও পুরুষদিগকে জিজ্ঞাসা করা হইল; কিন্তু কেহই কোন কথা বলিতে পারিল না। এইরূপেই সমস্ত রাত্রি সেইস্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। 

পরদিবস অতি প্রত্যূষেই পুনরায় সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলাম। নিকটবর্ত্তী স্থান সকল উত্তমরূপে দেখিলাম, নিকটবর্তী লোকদিগকে উত্তমরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করিলাম। নিকটবর্তী পরিচিত লোকদিগকে এই বিষয়ে আমাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত একান্ত অনুরোধ করিলাম, তাহারাও প্রাণপণে আমার সাহায্য করিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন। এইরূপে সে দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু কাহা-কর্তৃক এই হত্যা সংসাধিত হইয়াছে, তাহার কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না। তাহার পরদিবসও সেই রূপে কাটিয়া গেল; কিন্তু কেহই কোন সংবাদ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইল না। 

চতুর্থ দিবস প্রাতঃকালে পুনরায় আমি সেই স্থানের সন্নিকটবর্তী পরিচিত লোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে বহির্গত হইলাম। ইচ্ছা—যাঁহারা ইতিপূর্বে আমাকে সাধ্যমত সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন, তাঁহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিব ও দেখিব যে, এই বিষয়ের কোনরূপ সংবাদ তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কোনরূপ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছে, কি না। 

মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে গমন করিতেই, এরূপ সময়ে অপর আর একজন পরিচিত ব্যক্তির সহিত পথে সাক্ষাৎ হইল। ইঁহার বাসস্থান ঘটনা স্থান হইতে বহুদূরবর্তী হইলেও, নিকটবর্ত্তী এক স্থানে তাঁহার সৰ্ব্বদা যাতায়াত আছে। আমাকে দেখিবামাত্রই তিনি কহিলেন, “কোন সবিশেষ কার্য্যোপলক্ষে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মনস্থ করিয়াছিলাম। কিন্তু ভালোই হইল যে, হঠাৎ সাক্ষাৎ হইয়া গেল। এক্ষণে জিজ্ঞাসা করিতেছি, চাউল পট্টীতে যে খুন হইয়াছে, তাহার অনুসন্ধানে আপনি নিযুক্ত আছেন কি?” 

আমি। যে রাত্রিতে মল্লিকা হত্যা হইয়াছে, এবং তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহৃত হইয়াছে, সেই রাত্রি হইতেই আমি অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছি। 

পরিচিত ব্যক্তি। ইহার কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ হইয়াছেন কি? 

আমি। সন্ধান করিতে সমর্থ হওয়া ত পরের কথা, এরূপ কোন কথা এ পর্য্যন্ত জানিতে পারি নাই, যাহার উপর নির্ভর করিয়া সন্ধানে নিযুক্ত হইতে পারি। 

পরিচিত। আমি বোধ হয়, এ বিষয়ে আপনাকে কিছু সাহায্য করিতে সমর্থ হইব। কোন প্রয়োজনীয় কাৰ্য্যোপলক্ষে আমি এখন গমন করিতেছি। আপনি সময় মত আমার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিবেন, যাহা কিছু আমি অবগত হইতে পারিয়াছি, এবং এই বিষয়ে যাহার উপর আমার সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে, তাহার সমস্ত অবস্থা আপনাকে আমি বলিয়া দিব। যে সময় আপনি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, সেই সময় অপহৃত দ্রব্যের একটি তালিকা সঙ্গে করিয়া আনিবেন। 

এই বলিয়া সেই পরিচিত ব্যক্তি তাঁহার কার্য্যোপলক্ষে গমন করিলেন। আমি সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া ভাবিতে লাগিলাম,—এখন কি করা যাইতে পারে? কোন্ সময়ে গমন করিলে উহার সহিত সাক্ষাৎ হইবার সম্ভাবনা, তাহা উঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম না। উনিই বা কোন সময়ে তাঁহার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিবেন, আর আমিই বা কোন সময়ে তাঁহার বাড়িতে গমন করিলে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব, একথা আমার জানিয়া লওয়া উচিত ছিল। যাহা হউক, যখন উঁহার কথার ভাবে অনুমান হইতেছে যে, এ সম্বন্ধে ইনি কোন না কোন সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছে, তখন যেরূপেই হউক বা যে সময়েই হউক, উঁহার সহিত আমাকে সাক্ষাৎ করিতেই হইবে। আমিও যখন এই কার্য্যের নিমিত্ত নিযুক্ত আছি, তখন আর কোনস্থানে গমন না করিয়া উঁহারই বাড়িতে গিয়া বসিয়া থাকি, তাহা হইলে যখনই কেন উনি প্রত্যাগমন করুন না, তখনই আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। 

মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্তই স্থির করিয়া আমি সেইস্থান হইতে সেই পরিচিত ব্যক্তির বাড়ীতেই গমন করিলাম, এবং যে পর্য্যন্ত তিনি প্রত্যাগমন না করিলেন, সেই পৰ্য্যন্ত সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। 

দিবা প্রায় বারটার সময় তিনি আপন বাড়িতে প্রত্যাগমন করিলেন, এবং সম্মুখেই আমাকে দেখিতে পাইয়া কহিলেন, “আপনি কতক্ষণ হইতে আমার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছেন?” 

আমি। আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পর হইতেই আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি, এবং আপনার প্রত্যাশায় বসিয়া আছি। 

পরিচিত। মৃতা স্ত্রীলোকের যে সকল দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে, তাহার মধ্যে সোণার বালা আছে কি? 

আমি। আছে বৈ কি। একজোড়া সোণার বালা, যাহা মল্লিকা হস্তে পরিয়াছিল, তাহা পাওয়া যাইতেছে না।

পরিচিত। সেই বালা কি প্রকারের? 

আমি। ডায়মণ্ডকাটা বাঘমুখো বালা। 

পরিচিত। ভালো, আপনি চৈতন্যকে চিনেন কি? 

আমি। কোন্ চৈতন্য, চৈতন্য দাস। সে চাউল পট্টীর নিকটেই থাকে, এবং যে চুরি মোকদ্দমায় চারি পাঁচ বার মেয়াদ খাটিয়াছে, সেই চৈতন্য? 

পরিচিত। হাঁ, সেই চৈতন্য। 

আমি। তাহাকে আমি উত্তমরূপে জানি। 

পরিচিত। এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে আপনারা তাহাকে উত্তমরূপে দেখিয়াছেন কি? 

আমি। কেন, তাহার উপর এ বিষয়ের সন্দেহ হয় কি? 

পরিচিত। সে বিষয়ে সন্দেহ না হইলে আর আপনাকে বলিতেছি কেন? 

আমি। কি কারণে তাহার উপর আপনার সন্দেহ হইয়াছে? 

পরিচিত। মূল কারণ পরে বলিতেছি। কিন্তু যে ব্যক্তি ঘটনার এত নিকটবর্ত্তী স্থানে বাস করে, এবং চুরি করা অপরাধে যে ব্যক্তি একাদিক্রমে কয়েকবার কারাগারে বাস করিয়া আসিয়াছে, সে যে এ বিষয়ের কিছুমাত্র অবগত নহে, তাহা ত প্রথমতঃই অসম্ভব বোধ হয়। 

আমি। যদি তাহার উপর আপনার নিতান্তই সন্দেহ হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে সন্দেহের সহজেই ভঞ্জন করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। চৈতন্য দাস একে নিতান্ত সামান্য লোক, তাহার উপর পুরাতন চোর; এরূপ লোক সম্বন্ধে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা নিতান্ত কঠিন কৰ্ম্ম নহে। 

পরিচিত। আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, এই কাণ্ড চৈতন্যের দ্বারাই সম্পাদিত হইয়াছে। একথা কি নিমিত্ত বলিতেছি, তাহারও বিশিষ্ট কারণ আছে। শ্রবণ করিলে আপনাকেও আমার মতের পোষকতা করিতে হইবে। আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধু কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে জনৈক পোদ্দারের দোকানে বসিয়াছিলেন। সেই সময় চৈতন্য দাস একগাছি ডায়মণ্ডকাটা বাঘমুখো বালা লইয়া সেই পোদ্দারের দোকানে গমন করে, এবং তাহার নিকট সেই বালা বিক্রয় করিয়া আইসে। এই অবস্থা আমার বন্ধু স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছেন। আবশ্যক হইলে তাঁহার নামও আমি আপনার নিকট প্রকাশ করিতে প্রস্তুত আছি। 

আমি। চৈতন্যের আজকাল যেরূপ অবস্থা, তাহাতে সে সোণার বালা কোথা পাইবে? আপনি যাহা কহিলেন, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে এক কাৰ্য্য চৈতন্য ব্যতীত অপর কাহারও দ্বারা সম্পাদিত হয় নাই। কোন পোদ্দারের নিকট চৈতন্য বালা বিক্রয় করিয়াছে, তাহার নাম ও ঠিকানা যদি আপনি আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে এখনই গমন করিয়া আমি সে সম্বন্ধে যাহা কিছু অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, তাহা শেষ করিয়া ফেলিতে পারি। এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে বিলম্ব করা আর কোনরূপেই কর্তব্য নহে। বিশেষতঃ চৈতন্য যে প্রকারের বালা বিক্রয় করিয়াছে বলিতেছেন, মল্লিকার অপহৃত বালাও ঠিক সেই প্রকারের। 

আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া পরিচিত ব্যক্তি সেই পোদ্দারের নাম ও ঠিকানা আমাকে গোপনে বলিয়া দিলেন। সুতরাং তাঁহার নাম গোপনে রাখিলাম। 

ইঁহার নিকট হইতে এই সকল ব্যাপার অবগত হইয়া আমার মনে দৃঢ়বিশ্বাস হইল যে, চৈতন্য দাস নিজেই এই অভিনয়ের নেতা, সে স্বহস্তে এই কাৰ্য সম্পাদন না করিলে তাহারই সহায়তায় এই কাৰ্য সম্পাদিত হইয়াছে; নতুবা একগাছি বালা সে কোথায় পাইবে? আরও ভাবিলাম যে, এরূপ অবস্থায় আমার প্রথমে কোন্ দিকে গমন করা উচিত? পোদ্দারের নিকট গিয়া এই বিষয়ের অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, কি অগ্রে চৈতন্যের নিকট গমন করিয়া প্রথমে তাহাকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত? এ সম্বন্ধে কিয়ৎক্ষণ চিন্তার পর, ন্যায় হউক বা অন্যায় হউক, মনে মনে স্থির করিলাম, অগ্রে পোদ্দারের নিকট গমন করাই কর্তব্য। কারণ, সে যদি প্রকৃতকথা কহে, এবং তাহার নিকট হইতে যদি সেই সোণার বালা পাওয়া যায়, তাহা হইলে সেই বালা বিক্রয় সম্বন্ধে পরিশেষে চৈতন্য আর কোনরূপেই অস্বীকার করিতে পারিবে না। তখন অনায়াসেই আমরা আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব। এই ভাবিয়া প্রথমে সেই পোদ্দারের দোকান অভিমুখেই গমন করিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

আমার পরিচিত ব্যক্তি যে পোদ্দারের কথা বলিয়া দিয়াছিলেন, তাহার দোকানে গমন করিয়া দেখিলাম যে, সেই পোদ্দারও আমার নিকট একবারে অপরিচিত নহে। এই ঘটনার কিছুদিবস পূর্ব্বে কোন এক কাৰ্য্যোপলক্ষে সেই পোদ্দারকে আমার নিকট আসিতে হয়। সুতরাং সেই সময় হইতেই আমরা উভয়ে উভয়ের নিকট পরিচিত। যাহা হউক, আমাকে দেখিবামাত্র পোদ্দার কহিল, “কি মহাশয়! কোথায় গমন করিতেছেন?” 

আমি। অন্য কোনস্থানে গমন করিতেছি না, তোমারই নিকট আগমন করিয়াছি। 

পোদ্দার। আমার নিকট, কেন মহাশয়? 

আমি। প্রয়োজন না থাকিলে আর কে কাহার নিকট আগমন করিয়া থাকে? যে সময় তোমার প্রয়োজন হইয়াছিল, সেই সময় তুমি আমার নিকট গমন করিয়াছিলে; এখন আমার প্রয়োজন হইয়াছে, সুতরাং আমাকে তোমার নিকট আসিতে হইয়াছে। 

পোদ্দার। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি আপনার নিকট গমন করিয়াছিলাম, সেই কার্য্য আপনার অনুগ্রহেই সম্পন্ন হয়। সুতরাং যে কার্য্যের নিমিত্ত আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, আমার সাধ্যানুসারী হইলে তাহাও এখনই সম্পাদিত হইবে। এখন আমাকে কি করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন। 

আমি। যাহা হউক, এখন আমার জিজ্ঞাস্য এই, তুমি দুই এক দিবসের মধ্যে কোন ব্যক্তির নিকট হইতে কোন অলঙ্কার খরিদ করিয়াছ কি? 

পোদ্দার। অনেকের নিকট হইতে অনেক অলঙ্কার খরিদ করিয়াছি। যদি কোন অলঙ্কার সম্বন্ধে আপনার জানিবার প্রয়োজন থাকে, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন। আমি যাহা অবগত আছি, তাহা এখনই আমি আপনাকে বলিয়া দিতেছি। 

আমি। স্মরণ করিয়াই হউক বা খাতাপত্র দেখিয়াই হউক, বল দেখি, একগাছি ডায়মণ্ডকাটা বাঘমুখো সোণার বালা তুমি ইহার মধ্যে খরিদ করিয়াছ কি না? যদি খরিদ করিয়া থাক, তাহা হইলেই বা উহা তুমি কাহার নিকট হইতে, এবং কত মূল্যে খরিদ করিয়াছ? 

পোদ্দার। কেন মহাশয়! উহা কি অপহৃত দ্রব্য? 

আমি। সে কথা পরে বলিব। এখন আমার কথার উত্তর অগ্রে প্রদান কর। 

পোদ্দার। আপনি যেরূপ কহিলেন, সেই প্রকারের একগাছি বালা আমি খরিদ করিয়াছি। 

আমি। কাহার নিকট হইতে খরিদ করিয়াছ? 

পোদ্দার। চৈতন্য দাস নামক এক ব্যক্তির নিকট হইতে। 

আমি। সে বালা এখন কোথায়? 

পোদ্দার। দোকানেই আছে। 

আমি। উহা বাহির করিয়া আমাকে দেখাও। দেখিলে আমি বোধ হয়, চিনিতে পারিব। যে বালার নিমিত্ত আমি অনুসন্ধান করিতেছি, ইহা সেই বালা কি না, বুঝিতে পারিব। 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া পোদ্দার তাহার বাক্স হইতে একগাছি সোণার বালা বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, “এই বালা আমি খরিদ করিয়াছি।” 

পোদ্দারের হস্ত হইতে বালাগাছাটি গ্রহণ করিয়া আমি উত্তমরূপে দেখিলাম। মল্লিকার হস্তে যে প্রকারের বালা পরিহিত ছিল বলিয়া বিন্দু আমাদিগকে বলিয়াছিল, ইহাও সেই প্রকারের বালা বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। 

“কি নিমিত্ত আমি এই বালার অনুসন্ধান করিতেছি, তাহা একটু পরে আসিয়া আমি তোমাকে বলিয়া যাইব, এবং সেই বালা যদি না হয়, তাহা হইলে ইহাও তোমাকে প্রত্যার্পণ করিয়া যাইব। যে পৰ্য্যস্ত আমি প্রত্যাগমন না করিব, তাহার মধ্যে যাহার নিকট হইতে তুমি এই বালা খরিদ করিয়াছ, তাহাকে যদি দেখিতে পাও, তাহা হইলে তাহাকে এইস্থানে বসিয়া রাখিবে।” এই বলিয়া বালাসহ আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

চাউল পট্টীর যে বাড়ীতে মল্লিকা হত ও তাহার দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছিল, দ্রুতপদে আমি সেই বাড়ীতে গমন করিলাম। বিন্দু তখন বাড়ীতেই ছিল, সেই বালা তাহাকে দেখাইবামাত্র সে বলিয়া উঠিল, “ইহা মল্লিকার বালা। যে দিবস মল্লিকা হত হয়, সেইদিবস সন্ধ্যার সময় এই বালা তাহার হস্তে ছিল।” 

বিন্দুর এই কথা শুনিয়া সেইস্থানে আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব করিলাম না। আমি চৈতন্যের বাড়ী চিনিতাম, অপর দুই তিন জন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া একবারে তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। চৈতন্য বাড়ীতেই ছিল, সুতরাং তাহাকে পাইতে আর কোনরূপ কষ্টই হইল না। আমি তাহাকে লইয়া সেই পোদ্দারের দোকানে পুনরায় গমন করিলাম, অপরাপর কর্মচারীগণ চৈতন্যের বাড়িতেই বসিয়া রহিলেন। 

পোদ্দারের দোকানে উপস্থিত হইবামাত্র ইহাকে দেখিয়া পোদ্দার একবারে বলিয়া উঠিল, ‘মহাশয়! আমি ইহারই নিকট হইতে এই বালা খরিদ করিয়াছি। ইহারই নাম চৈতন্য দাস।’ 

তখন আমি চৈতন্যকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন হে! তুমি এই বালা বিক্রয় করিয়াছ?” 

চৈতন্য। হাঁ মহাশয়! আমি এই বালা বিক্রয় করিয়াছি। 

আমি। একগাছি বিক্রয় করিয়াছ, কি দুই গাছিই বিক্রয় করিয়াছ? 

চৈতন্য। একগাছি বিক্রয় করিয়াছি। 

আমি। অপর আর একগাছি কোথায়? 

চৈতন্য। আমার একগাছি বই ছিল না। 

আমি। এই একগাছি বালা তুমি কোথায় পাইলে? 

চৈতন্য। আমার ভগিনীর নিকট হইতে পাইয়াছি। এই বালা তিনি আমাকে বেঁচিতে দিয়াছিলেন; সুতরাং আমি উহা বিক্রয় করিয়াছি, এবং উহার মূল্য আমি তাঁহাকেই প্রদান করিয়াছি। 

আমি। তোমার ভগিনী কেথায় থাকেন? 

চৈতন্য। তিনি তাঁহার শ্বশুর বাড়ীতে থাকেন।

আমি। তাহার শ্বশুর বাড়ী কোথায়? 

চৈতন্য। কলিকাতার বহুবাজারে। 

আমি। মিথ্যা কথা। এ বালা কিছুতেই তোমার ভগিনীর হইতে পারে না। 

এই সময় সেই পোদ্দার পুনরায় আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়! এ ব্যক্তি এই বালা কি চুরি করিয়া আনিয়া বিক্রয় করিয়াছে।’ 

আমি। এক হিসাবে চুরি বটে। এ চুরি সামান্য নহে। 

পোদ্দার। কি প্রকারের চুরি? 

আমি। চাউলপট্টীতে খুন হইয়াছে শুনিয়াছ? 

পোদ্দার। শুনিয়াছি। 

আমি। হত্যাকারী মল্লিকানাম্নী একজন বারবনিতাকে হত্যা করিয়া তাহার যে সকল দ্রব্য অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, সেই সকল অপহৃত দ্রব্যের মধ্যস্থিত ইহা একটি দ্রব্য। 

পোদ্দার। কি সর্বনাশ! 

এই বলিয়া পোদ্দার আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না, এবং এই বালা যে পুনরায় ফিরিয়া পাইবে, সে আশাও না করিয়া, চৈতন্য দাসকে সহস্র গালি দিতে দিতে আপন দোকানে গিয়া উপবেশন করিল। 

আমি চৈতন্যকে সেইস্থান হইতে পুনরায় তাহার বাড়ীতে লইয়া গেলাম, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ আমার প্রত্যাশায় সেইস্থানেই অপেক্ষা করিতেছিলেন। আমার নিকট হইতে আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া তাঁহারও মনে মনে স্থিরসিদ্ধান্ত করিলেন যে, চৈতন্যের দ্বারাই এই হত্যাকাণ্ড সংসাধিত হইয়াছে। চৈতন্যের গৃহ তখন উত্তমরূপে সন্ধান করা হইল; কিন্তু অপর কোন অলঙ্কার তাহার গৃহ হইতে পাওয়া গেল না। এখন সকলের মনে সন্দেহ হইল যে, সমস্ত অলঙ্কারই এ বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছে। এখন যে পোদ্দারের নিকট হইতে বালা পাওয়া গেল, তাহার নিকট আরও কোন দ্রব্য আছে, কি না? আর যদি থাকে, তাহা হইলে সে এখন আর স্বীকার করিবে, কি না? তাহাই ঠিক করিতে হইবে। 

চৈতন্যের বাড়িতে যখন অপর আর কোন অলঙ্কার পাওয়া গেল না, তখন চৈতন্য যাহা বলিয়াছিল, সে সম্বন্ধে একটু সন্ধান করা নিতান্ত আবশ্যক মনে হইল। চৈতন্যকে সঙ্গে লইয়া বহুবাজারে গমন করিলাম। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, তাহার ভগিনী বাস্তবিকই বহুবাজারে তাহার স্বামীর গৃহে বাস করিয়া থাকে। তাহার স্বামী বড় মানুষ না হইলেও, নিতান্ত সামান্য লোক নহে। যে বাড়ীতে তাহারা বাস করে, সে বাড়ী তাহাদিগের নিজের এবং বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া তাহাদিগকে নিতান্ত দরিদ্র বলিয়া বোধ হয় না। যাহা হউক, সেই বালা গাছাটি চৈতন্যের ভগিনীর হস্তে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এই বালা কাহার, তাহা তিনি বলিতে পারেন, কি না? উত্তরে তিনি কহিলেন, এই বালা কাহার, তাহা তিনি অবগত নহেন; ইহার পূর্ব্বে এই বালা তিনি কখন দর্শন করেন নাই। তাহার নিকট হইতে এই অবস্থা অবগত হইয়া বুঝিতে পারিলাম যে, চৈতন্য দাস মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। চৈতন্য যখন তাহার ভগিনীর কথা শুনিল, এবং যখন জানিতে পারিল, মল্লিকাকে হত্যা করা অপরাধে সে ধৃত হইয়াছে, তখন তাহার মুখ শুখাইয়া গেল। সে অতিশয় ভীত হইয়া বার বার বলিতে লাগিল, “আমি চোর সত্য; কিন্তু হত্যাকারী নহি। পূর্ব্বে কয়েকবার চুরি করা অপরাধে দণ্ড পাইয়াছি সত্য; কিন্তু হত্যাকার্য্যে কখন হস্তার্পণ করি নাই। আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, অতঃপর এই বালা সম্বন্ধে আমি প্রকৃতকথা বলিব। অনুসন্ধান করিলেই আপনারা জানিতে পারিবেন যে, আমি প্রকৃতকথা বলিতেছি, কি না, এবং এই হত্যাকাণ্ডের আমি সংসৃষ্ট ছিলাম, কি না।” 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

চৈতন্যের শেষ কথার উত্তরে তাহাকে কহিলাম, “এই বালা সম্বন্ধে তুমি এখন প্রকৃতকথা বলিতে চাহিতেছ, বল। তোমার কথা শুনিলেই বুঝিতে পারিব, তুমি মিথ্যা কথা কহিতেছ, কি না?” 

চৈতন্য। যেরূপ উপায়ে আমি এই বালা প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহার প্রকৃত অবস্থা বলিলে আমাকে পুনরায় জেলে গমন করিতে হইবে, এই নিমিত্ত আমি প্রকৃত কথা গোপন করিয়া এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত মিথ্যা কথা কহিতেছিলাম। কিন্তু এখন আমি যে বিষয় জানিতে পারিলাম, তাহাতে আর প্রকৃতকথা গোপন করা কর্ত্তব্য নহে। কারণ, প্রকৃতকথা বলিলে বড়জোর জেলে যাইব, নতুবা হত্যাপরাধে আমাকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। 

আমি। তুমি এখন কিরূপ অবস্থায় পতিত, তাহা যদি আপনা-আপনিই বুঝিতে পারিয়া থাক, তাহা হইলে তুমি প্রকৃতকথা বলিলেও বলিতে পার। ইহা আমরা এখন অনুমান করিতে পারিতেছি। 

চৈতন্য। বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমি কিন্তু আর মিথ্যা কথা কহিব না। যে দিবস আমি এই বালা বিক্রয় করিয়াছি, সেইদিবস প্রাতঃকালে আমাদিগের পাড়ার একটি বালকের নিকট এই বালা দেখিতে পাই। সে এই বালা যে কোথা পাইল, তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু একটি ছল অবলম্বন করিয়া আমি এই বালা তাহার নিকট হইতে গ্রহণ করি, এবং পরিশেষে পোদ্দারের দোকানে গমন করিয়া উহা বিক্রয় করিয়া ফেলি। সেই বালকের মাতা পরিশেষে এই অবস্থা জানিতে পারিয়া আমার নিকট আগমন করে, এবং পুলিসে গিয়া আমার নামে নালিস করিবে বলিয়া ভয় প্রদর্শন করে। যাহাতে সে কোনরূপ গোলযোগ না করে, এই নিমিত্ত দশটি টাকা আমি তাহাকে প্রদান কর, সে তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া চলিয়া যায়। 

আমি। এ অসম্ভব কথা। এই প্রকারে তুমি বালকের হস্ত হইতে কোনরূপেই পাইতে পার না। ইহা বালকের বালা নহে, এ বালা বড় হাতের; সুতরাং বালক এ বালা কিরূপে প্রাপ্ত হইবে? আর, একগাছি সোণার বালার পরিবর্তে তাহার মাতা কেবলমাত্র দশটি টাকা লইয়া যে সন্তুষ্ট হইবে, তাহাও ঠিক মনে ধরে না। 

চৈতন্য। আমি প্রকৃতকথা বলিতেছি। আপনি আমার সঙ্গে চলুন, আমি সেই বালক ও তাহার মাতাকে দেখাইয়া দিব। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন, আমি এখনও মিথ্যা কথা কহিতেছি, কি না। 

আমি। সেই বালকের বাসস্থান কোথায়? 

চৈতন্য। তাহারা আমাদিগের পাড়াতেই বাস করিয়া থাকে। 

আমি। সেই বালকের বয়ঃক্রম কত হইবে? 

চৈতন্য। বোধ হয়, দশ এগার বৎসর হইবার সম্ভাবনা। 

সত্য হউক আর মিথ্যা হউক, চৈতন্য যাহা কহিল, তাহা একবার দেখা আবশ্যক। এই বিবেচনায় চৈতন্যকে সঙ্গে লইয়া সেই বালকের উদ্দেশে গমন করিলাম, যে পাড়ায় চৈতন্যের বাস, সেই পাড়ার ভিতর প্রবেশ করিবার কালীন একটি বালককে দেখাইয়া দিয়া চৈতন্য কহিল, “এই সেই বালক।” অপরাপর বালকগণের সহিত সেই বালক সেইস্থানে খেলা করিতেছিল। ডাকিবামাত্র সেই আমার নিকট আগমন করিল। তখন চৈতন্যকে দেখাইয়া দিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বল দেখি, তুমি এই লোকটিকে চেন?” 

বালক। চিনি, এ চোর আমাদিগের পাড়ায় থাকে। 

আমি। এ চোর, তুমি কি প্রকারে জানিলে? 

বালক। সকলেই বলে চৈতন্য চোর। সে দিবস আমি একগাছি বালা পাইয়াছিলাম, তাহাও সে আমার নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়াছে। 

আমি। এই বালা তুমি কাহার নিকট পাইয়াছিলে? 

বালক। কাহারও নিকট হইতে পাই নাই, কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম। 

আমি। যে স্থানে কুড়াইয়া পাইয়াছিলে, সেই স্থানটি আমাকে দেখাইয়া দিতে পার? 

বালক। পারি বৈ কি! আমার সঙ্গে আসুন, আমি এখনই সেইস্থান আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি। 

এই বলিয়া উক্ত বালক আমাকে সঙ্গে লইয়া একটি বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। কালীঘাটের পার্শ্ব দিয়া যে গঙ্গা প্রবাহিত হইয়াছে, এবং যাহা আদিগঙ্গা বলিয়া সকলের পরিচিত, সেই আদিগঙ্গার পূর্ব পার্শ্বস্থ একটি বাগানের ভিতর উক্ত বালক আমাকে সঙ্গে লইয়া প্রবেশ করিল, এবং এক স্থানের একটি পুরাতন ও ভগ্ন সোপানাবলী দেখাইয়া দিয়া কহিল, “সেইদিবস প্রাতঃকালে আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছিলাম। সেই সময় এই সোপানের নিম্নদেশে একগাছি বালা দেখিতে পাইয়া উহা উঠাইয়া লই। কিন্তু বাড়ী যাইবার সময় রাস্তায় চৈতন্যের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। সে আমার হস্তে বালা দেখিতে পাইয়া আমার নিকট হইতে উহা কাড়িয়া লয়, এবং সেই স্থান হইতে দ্রুতবেগে প্রস্থান করে।” 

বালকের কথা শুনিয়া তখন বিশ্বাস হইল যে, চৈতন্য এ পর্য্যন্ত যে কথা বলিয়াছে, তাহা প্রকৃত। কিন্তু এইস্থানে সেই বালা আসিল কি প্রকারে? 

যে স্থানে সেই বালক বালা পাইয়াছিল, সেইস্থান ও তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান সকল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু সেইস্থানে কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না। সেই সোপানাবলীর কিছুদূর অন্তরে কলাগাছের একটি ঝাড় ছিল; তাহার নিকটে যখন গমন করিলাম, তখন একখানি কাপড় সেইস্থানে পড়িয়া আছে দেখিতে পাইলাম। সেই কাপড়খানি উঠাইলাম, এবং উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। উহার ভিতর একটি সোণার মাড়ি প্রাপ্ত হওয়া গেল। এখন চৈতন্যের ও বালকের কথা আরও বিশ্বাস হইল। সেই মাড়ি এবং কাপড় বিন্দুকে দেখাইলে সে কহিল, ‘এ উভয় দ্রব্যই মল্লিকার।’ 

কি প্রকারে সেই সকল দ্রব্য সেইস্থানে গমন করিল, তাহার কোন প্রমাণ প্রাপ্ত হইলাম না; সুতরাং সে বিষয়ের কোনরূপ স্থির-সিদ্ধান্তও করিয়া উঠিতে পারিলাম না। তখন মনকে এই বলিয়া বুঝাইলাম যে, হত্যাকারী অপহৃত দ্রব্যাদি উক্ত কাপড়ে করিয়া সেই নির্জ্জন স্থানে প্রথমে লইয়া যায়, এবং সেইস্থানে বসিয়া অপহৃত দ্রব্য সকল হয় নিজেই গ্রহণ করে, বা তাহার সহিত যদি অপর কোন ব্যক্তি থাকে, তাহা হইলে এইস্থানে বসিয়া অপহৃত দ্রব্য বিভাগ করিয়া লয়। বিভাগের সময় হয় ত এই বালা স্থানচ্যুত হইয়া পড়ে; সুতরাং অন্ধকারে উহারা তাহা দেখিতে পায় নাই। আর যে কাপড় পাওয়া গেল, বোধ হয় সেই কাপড়ে করিয়া উহারা দ্রব্যাদি প্রথমে লইয়া খায়, এবং উক্ত স্থানে গিয়া সেই সকল দ্রব্যাদি গ্রহণ করিয়া কাপড়খানি দূরে নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া যায়। মাড়িটা উহারা দেখিতে পায় নাই; সুতরাং উহা কাপড়ের ভিতরই রহিয়া গিয়াছে। 

অনুসন্ধান করিয়া যে পথ পাইয়াছিলাম, তাহা পুনরায় এইস্থানে শেষ হইয়া গেল। চোর হইলেও চৈতন্যকে আর রাখিতে পারিলাম না। বুঝিলাম যে, এ হত্যা তাহাদ্বারা হয় নাই; সুতরাং তাহাকে ছাড়িয়া দিতে হইল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

উপস্থিত মোকদ্দমা সম্বন্ধে আমাদিগের মনে মনে যে একটু আশার সঞ্চার হইয়াছিল, চৈতন্যকে ছাড়িয়া দেওয়ার পর হইতেই সে আশা দূরে পলায়ন করিল। এখন কোন্ পন্থা অবলম্বন করিয়া পুনরায় অনুসন্ধানে লিপ্ত হওয়া যায়, মনে মনে তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলাম। 

মল্লিকার শব ছেদ করিয়া যে ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন, সেই সময়ে সেই ডাক্তার সাহেবের পরীক্ষার ফল আমরা জানিতে পারিলাম। তখন বুঝিলাম, মল্লিকার মৃত্যুর কারণ শবচ্ছেদকারী ডাক্তার সাহেব কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাহার উদরের অভ্যন্তরে আহারীয় প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহার সমস্তই পরীক্ষার নিমিত্ত রাসায়নিক পরীক্ষকের (Chemical Examiner) নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন। কারণ, যদি কোনরূপ বিষপ্রয়োগে মল্লিকার মৃত্যু হইয়া থাকে, তাহা হইলে রাসায়নিক পরীক্ষক তাহা স্থির করিতে পারিবেন। এই কথা ইংরাজী বিজ্ঞান বলিয়া থাকেন। 

চৈতন্যকে ছাড়িয়া দেওয়ার পর আরও দুই তিন দিবস অতীত হইয়া গেল। কিন্তু কোনস্থান হইতে কোনরূপ বিশিষ্ট সন্ধান পাওয়া গেল না। যখন আর কোন পথ পাইলাম না, তখন মনে মনে কেবলমাত্র দুর্ভাবনা হইতে লাগিল। ভাবিলাম, আমাদিগের কর্তৃক এই মোকদ্দমা ধরা পড়িবার আর কোন আশা নাই। 

মনে মনে নিরাশ হইয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া, অন্য কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিব, এইরূপ স্থির করিতেছি, এরূপ সময়ে হঠাৎ চৈতন্য আসিয়া একদিবস আমার নিকট উপস্থিত হইল। চৈতন্যকে দেখিয়া আমি কহিলাম, “কিহে চৈতন্য! কোথা হইতে অসময়ে আসিয়া হঠাৎ উপস্থিত হইলে?” 

চৈতন্য। আমাদিগের আর সময় অসময় কি? মনে করিলাম, আপনার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিব। তাই আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

আমি। কি নিমিত্ত আসিয়াছ? আমার দ্বারা তোমার কোন উপকার হইতে পারে, এমন কোন কার্য্যের নিমিত্ত যদি আসিয়া থাক বল; সাধ্যমত তোমার উপকার করিতে আমি প্রস্তুত আছি। 

চৈতন্য। আমার নিজের কোন কার্য্যের নিমিত্ত আপনার নিকট আগমন করি নাই। আপনি আমাকে ফাঁসী হইতে বাঁচাইয়াছেন; সুতরাং আমি যদি আপনার কোনরূপ উপকার করিতে পারি, এই ভাবিয়া এই কয়েক দিবস অনেক পরিশ্রম করিয়াছি, এবং একটু সামান্য সন্ধানও প্ৰাপ্ত হইয়াছি। কিন্তু তাহার দ্বারা আপনার কোন ফল হইবে কি না, তাহা কিন্তু আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

আমি। তোমার কথা শুনিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। কারণ, প্রথমতঃ আমার দ্বারা তোমার কোনরূপ উপকারই হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ কোন চোর কাহারও কর্তৃক কোনরূপ উপকার প্রাপ্ত হইলে প্রত্যুপকার করা দূরে থাকুক, কিসে তাহার অনিষ্ট করিতে পারিবে, তাহারই চেষ্টা দেখিয়া থাকে। 

চৈতন্য। আমি আপনার কর্তৃক কোনরূপ উপকার প্রাপ্ত হই নাই, একথা বলিবেন না। কারণ, যখন কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারি কোন খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত থাকেন, তখন যদি কাহারও উপর সেই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে সন্দেহ হয়, এবং তাহার বিপক্ষে অতি সামান্য পরিমাণ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা হইলে অধুনাতন পুলিস কর্মচারীর হস্ত হইতে তাহার আর রক্ষা থাকে না। সেই তিল পরিমাণ প্রমাণকে তাল করিয়া তাহারই উপর সমস্ত ভার চাপাইয়া দিয়া, সামান্য যশোলাভের প্রত্যাশায় পুলিস তাহার সর্ব্বনাশ করিয়া থাকেন। কিন্তু আপনার হস্তে আমি যেরূপে পতিত হইয়াছিলাম, যেরূপ অবস্থায় আমার নিকট হইতে অলঙ্কার বাহির হইয়াছিল, তাহাতে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইয়াছিল যে, কেহই আমার নির্দোষিতার প্রমাণ স্বরূপ আমার কোন কথাই শুনিবেন না; অধিকন্তু আমার বিপক্ষে আরও একটু আধটু প্রমাণের সংগ্রহ করিয়া লইয়া আমাকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিবেন। কারণ, আজকাল পুলিস-কর্ম্মচারীগণের এইরূপই ধৰ্ম্ম দেখিতে পাই। একজনের দোষ অপরের স্কন্ধে চাপাইয়া দিয়া প্রায়ই তাঁহারা মোকদ্দমার সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন। আপনার ব্যবহার কিন্তু তাহার বিপরীত দেখিয়া, আমি যে কতদূর সন্তুষ্ট হইয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। এই নিমিত্তই আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া এই কয়েক দিবস আপনার কার্য্যের নিমিত্তই ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। নতুবা আপনার অনিষ্ট করিবার যে চেষ্টা করিতাম, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। 

আমি। বাজে কথা ছাড়িয়া দেও। কি সন্ধান পাইয়াছ, বল দেখি। 

চৈতন্য। আপনি চেতলার কাহাকেও চিনেন কি? 

আমি। চেতলার অনেক লোকের সহিত আমার পরিচয় আছে। সুতরাং অনেককেই আমি চিনি, এবং অনেকে আমাকেও চিনে। 

চৈতন্য। চেতলার হর-বাড়ী ওয়ালীর বাড়ী আপনি কি চিনেন? 

আমি। চিনি বলিয়া আমার বোধ হইতেছে না। 

চৈতন্য। না চিনেন, সেই বাড়ী আমি এখনই আপনাকে দেখাইয়া দিব। 

আমি। কেন, সেই বাড়ীতে কি হইয়াছে? 

চৈতন্য। সেই বাড়ীতে গোলাপনাম্নী একজন বারবনিতা বাস করিয়া থাকে। কালীঘাটের নিতাই বৈরাগী আজকাল তাহাকে রাখিয়াছে। নিতাইয়ের অবস্থা ভাল নহে, সামান্য কার্য্য করিয়া সে জীবন যাপন করে। কিন্তু আজকাল দেখিতেছি, গোলাপের গৃহে সে প্রতিদিনই বিস্তর অর্থ ব্যয় করিতেছে। এমন রাত্রিই নাই, যে রাত্রিতে অভাব পক্ষে তাহার দুই এক বোতল সরাপও ব্যয় না হয়। যে হত্যার অনুসন্ধানে আপনি নিযুক্ত আছেন, নিতাই কর্তৃক সেই হত্যাকাণ্ডসম্পাদিত না হউক, কিন্তু সে যে কোনস্থানে না কোনস্থানে কোনরূপ অকার্য্য করিয়া কিছু অর্থের সংস্থান করিতে পারিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। 

আমি। যে কার্য্যের দ্বারা নিতাই তাহার জীবিকা নির্বাহ করে, সেই কার্য্য করিয়া এরূপ ব্যয় করা নিতাইয়ের পক্ষে কি একবারেই অসম্ভব? 

চৈতন্য। সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। একদিবসে তিন চারি আনার অধিক সে উপার্জ্জন করিতে পারে না। 

আমি। তাহা হইলে সন্দেহের কারণ বটে। সে যে এইরূপ ভাবে খরচ-পত্র করিতেছে, তাহা তুমি জানিলে কি প্রকারে? 

চৈতন্য। প্রথমতঃ এই অবস্থা আমি তাপরের মুখে শুনিতে পাই, তাহার পর স্বচক্ষে দেখিয়াছি। 

আমি। গোলাপনান্নী যে স্ত্রীলোকটির গৃহে নিতাই গমন করে, তাহার অবস্থা কি প্রকার? এই সকল খরচ-পত্রের সাহায্য গোলাপের নিকট ত সে প্রাপ্ত হয় না? 

চৈতন্য। গোলাপকে আমি অনেক দিবস হইতে জানি। কিছুদিবস পূর্ব্বে তাহার অবস্থা অতিশয় শোচনীয় ছিল; নিয়মিতরূপে দুইবেলা আহার জুটিত কি না সন্দেহ। ইতিপূর্ব্বে একখানি ভাল কাপড় পরিতে তাহাকে কখনও দেখি নাই। সম্প্রতি নিতাই তাহাকে অনেকগুলি কাপড় খরিদ করিয়া দিয়াছে, এবং চারিগাছি পুরাতন মলও কোথা হইতে আনিয়া দিয়াছে; আর বলিয়াছে যে, শীঘ্র তাহাকে আরও দুই একখানি সোণার অলঙ্কার প্রস্তুত করাইয়া দিবে। 

আমি। নিতাই যে পুরাতন মল গোলাপকে কোথা হইতে আনিয়া দিয়াছে, সেই চারিগাছি মল তুমি আপনার চক্ষে দেখিয়াছ কি? 

চৈতন্য। না দেখিলে বলিব কেন? আপনি আমার সহিত তাহার বাড়ীতে চলুন, তাহা হইলে আপনিও উহা গোলাপের পায়ে দেখিতে পাইবেন। 

আমি। সেই মল কি প্রকারের? 

চৈতন্য। রূপার পাক দেওয়া মল। 

আমি। কোন সময়ে গোলাপের বাড়ীতে গমন করিলে নিতাই ও গোলাপ উভয়কেই একস্থানে দেখিতে পাইব?

চৈতন্য। আমি যতদূর অবগত আছি, তাহাতে আজকাল প্রায় সর্ব্বদাই উহারা একত্র থাকিয়া আমোদ-আহ্লাদ করে। আমার বোধ হয়, যখন গমন করিবেন, তখনই তাহাদিগের উভয়কেই একস্থানে দেখিতে পাইবেন। এখনও সেইস্থানে গমন করিলে বোধ হয়, উভয়কেই একত্র দেখিতে পাওয়া যাইবে। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

চৈতন্যের এই কথা শুনিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। অপহৃত দ্রব্যের তালিকা দেখিয়া জানিতে পারিলাম, নিতাই যেরূপ চারিগাছি মল তাহার উপপত্নী গোলাপকে প্রদান করিয়াছে, সেই প্রকারের চারিগাছি মলও মল্লিকার গৃহ হইতে অপহৃত হইয়াছে। সুতরাং আর কালবিলম্ব না করিয়া চৈতন্যকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ চেতলায় গমন করিলাম। এখন আর আমি একাকী নহি; চেতলায় গমন করিবার সময় আরও দুই তিন জন কর্মচারীকে সঙ্গে লইয়া গমন করিলাম। সেখানে গিয়া একবারে হর-বাড়ীওয়ালীর বাড়ীতে প্রবেশ না করিয়া প্রথমে চৈতন্যকে পাঠাইয়া দিলাম। আমরা পথে দাঁড়াইয়া রহিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে চৈতন্য প্রত্যাগমন করিল ও কহিল, “নিতাই ও গোলাপ উভয়েই শয়ন করিয়া আছে।” 

এই সংবাদ পাইবামাত্র আমরা হর-বাড়ীওয়ালীর বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম, এবং চৈতন্যের নির্দেশ-মতো গোলাপের গৃহের সম্মুখে গিয়া উপনীত হইলাম। সেইস্থান হইতে নিতাইকে ডাকিবামাত্র নিতাই ও গোলাপ উভয়ে বাহিরে আসিল। আমার সঙ্কেত অনুযায়ী একজন কর্মচারী নিতাইকে সঙ্গে লইয়া বাড়ীর বাহিরে গমন করিলেন। আর একজন কর্ম্মচারি বিন্দুকে আনিবার নিমিত্ত দ্রুতপদে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। কারণ, পূর্বে যে চারিগাছি মনের কথা চৈতন্য বলিয়াছিল, গোলাপের পায়ে সেই মল এখন পর্যন্ত বর্তমান ছিল। 

গোলাপকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, তাহার পরিহিত চারিগাছি মল বাস্তবিকই নিতাই প্রদান করিয়াছে, এবং আরও দুই এক খানি অলঙ্কার প্রদান করিবে বলিয়া প্রতিজ্ঞাও করিয়াছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রদান করে নাই। আমরা সেইস্থানে বসিয়া গোলাপকে এবং তাহার বাড়ীওয়ালীকে আবশ্যক-অনুযায়ী বিষয় সকল জিজ্ঞাসা করিতেছি, এমন সময় যে কর্ম্মচারী বিন্দুকে আনিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছিলেন, তিনি বিন্দুর সহিত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গোলাপের পায়ে যে চারিগাছি মল পরিহিত ছিল, তাহা উত্তমরূপে দেখিবার নিমিত্ত বিন্দুকে চুপি চুপি বলিয়া দিলাম। বিন্দু সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া গোলাপের পরিহিত মল চারিগাছি অনেকক্ষণ পর্যন্ত দর্শন করিল, এবং পরিশেষে চুপি চুপি আমাকে কহিল, “আমার বোধ হইতেছে. এই মলই মল্লিকার সেই অপহৃত মল। তথাপি আমি উহা একবার আমার হস্তে লইয়া দেখিতে ইচ্ছা করি।” 

বিন্দুর কথা যুক্তি-সঙ্গত বিবেচনা করিয়া সেই চারিগাছি মল খুলিয়া দিবার নিমিত্ত গোলাপকে কহিলাম। আদেশমাত্র গোলাপ পা হইতে মল খুলিয়া আমার সম্মুখে রাখিয়া দিল। আমি উহা বিন্দুর হস্তে অর্পণ করিলাম। মল হাতে করিবামাত্র বিন্দু বলিয়া উঠিল, “আমি এই মল ঠিক চিনিতে পারিয়াছি। ইহা মল্লিকার মল ব্যতীত অপর কাহারও নহে।” 

বিন্দুর কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে পুনরায় আশার সঞ্চার হইল। ভাবিলাম যে, এইবার মোকদ্দমার উদ্ধার হইলেও হইতে পারে। সেই সময় নিতাইকে বাহির হইতে ডাকাইলাম, এবং মনের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। বলিলাম, “তুমি এই মল মল্লিকাকে দিয়াছ?” কিন্তু সেই মল তাহা-কর্তৃক গোলাপকে প্রদত্ত হইয়াছে, একথা প্রথমে সে অস্বীকার করিল। তখন হর ও গোলাপকে ডাকাইয়া তাহার সম্মুখে উক্ত মলের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। উভয়েই তখন নিতাইয়ের কথার প্রতিবাদ করিয়া তাহার সম্মুখে প্রকৃতকথা কহিল। তখন নিতাই উহা স্বীকার করিল ও কহিল, “এই মল চারিগাছি আমি গোলাপকে দিয়াছি সত্য; কিন্তু কোনস্থান হইতে অপহরণ করিয়া আনি নাই। জনৈক পোদ্দারের দোকান হইতে ক্রয় করিয়া আনিয়াছি।” 

নিতাইয়ের এই কথা যদিচ আমরা বিশ্বাস করিলাম না, তথাপি তাহাকে কহিলাম, “কোন্ দোকান হইতে উহা খরিদ করিয়া আনিয়াছ, তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দেও।” নিতাই সেই পোদ্দারের দোকান আমাদিগকে দেখাইয়া দিবে বলিয়া, আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইল সেইস্থান হইতে বহির্গত হইবার পূর্ব্বে গোলাপের গৃহ আমরা উত্তমরূপে সন্ধান করিয়া দেখিলাম, কিন্তু সন্দেহজনক আর কোন দ্রব্যই পাওয়া গেল না। 

নিতাই আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া একে একে কয়েকখানি পোদ্দারের দোকানে গমন করিল। এক পোদ্দারের নিকট গমন করিলে, সে অস্বীকার করাতে নিতাই বলিল, “তবে বুঝি এ দোকান নয়, অন্য দোকান হইবে।” অন্য দোকানে গেলে সেইরূপে সে পোদ্দারও অস্বীকার করিল, নিতাইও পূর্ব্বের ন্যায় বলিল। এইরূপে কোন পোদ্দারই তাহার নিকট যে মল বিক্রয় করিয়াছে, একথা স্বীকার করিল না। তখন নিতাই বলিল, “আমি দোকান ঠিক করিতে পারিতেছি না। বোধ হয়, যে ব্যক্তি দোকানে থাকিয়া আমার নিকট মল বিক্রয় করিয়াছে, সে ব্যক্তি এখন কোন দোকানে উপস্থিত নাই; অথবা কোনরূপ ভয়ে কেহ প্রকাশ করিতেছে না।” আমরা বলিলাম, “এই দুই দিনে তুমি সেই লোককে বা দোকানকে ভুলিয়া গেলে, এ কি কাজের কথা? তুমি এখানকার সকল পোদ্দারেরই নিকটেই ত জিজ্ঞাসা করিলে। বিক্রয় করিয়া থাকিলে, তাহা তাহাদের বলিতে আপত্তির কারণ কি?” যাহা হউক, আমরা তখন বুঝিলাম, নিতাই কোনস্থান হইতে এই মল ক্রয় করে নাই, মিথ্যা কথায় আমাদিগকে ভুলাইবার চেষ্টা করিতেছে। 

নিতাইয়ের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া মনে করিলাম যে, ইহার গৃহে অনুসন্ধান করিতে আর বিলম্ব করা উচিত নহে। এই ভাবিয়া তখনই তাহার বাড়ীতে গমন করিলাম, এবং উত্তমরূপে তাহার গৃহে অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু অলঙ্কারাদি আর কিছুই পাইলাম না, কেবল দুইশত টাকার অধিক নগদ টাকা প্রাপ্ত হওয়া গেল। এত টাকা সে কোথা হইতে প্রাপ্ত হইল, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। সে কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। তখন নিশ্চয়ই বুঝিলাম যে, সে অপহৃত অলঙ্কারগুলি হয় বিক্রয় করিয়াছে, না হয় বন্ধক দিয়া এই সকল অর্থের সংস্থান করিয়া রাখিয়াছে। 

সেই সময় নিতাইকে ভয়-মিত্রতা দেখাইয়া নানারূপ বুঝাইতে লাগিলাম, প্রথমে সে কিছুতেই স্বীকার করিল না যে, মল্লিকা তাহা-কর্তৃক হত, বা অলঙ্কার সকল তাহা-কর্তৃক অপহৃত হইয়াছে। কিন্তু পরিশেষে তাহাকে স্বীকার করিতে হইল। তখন সে কহিল, “আমি মল্লিকাকে হত্যা করি নাই, কিন্তু তাহার অলঙ্কার সকল অপহরণ করিয়াছি মাত্র। আমি যখন তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, সেই সময় মল্লিকা হত অবস্থায় পড়িয়াছিল, এবং তাহার অঙ্গে অলঙ্কার সকল পরিহিত ছিল। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে হঠাৎ কেমন লোভের উদয় হইল; আমি সেই অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। যে সকল অলঙ্কারাদি আমি অপহরণ করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহার একখানিও আমি বিক্রয় করি নাই, সমস্ত অপরের নিকট বন্ধক রাখিয়া এই সকল অর্থের সংস্থান করিয়াছি, এবং আজ কয়েক দিবস হইতে উহা অজস্ররূপে ব্যয়ও করিয়া আসিতেছি। যে চারিগাছি মল গোলাপের নিকট পাওয়া গিয়াছে, তাহাও অপহৃত দ্রব্য সকলের মধ্যেরই এক দ্রব্য।” 

নিতাইয়ের নিকট হইতে এই সকল কথা অবগত হইয়াই যে আমরা সন্তুষ্ট হইলাম, তাহা নহে; যে যে ব্যক্তির নিকট সেই সকল অলঙ্কার নিতাই বন্ধক দিয়াছিল, তাহাদের নাম ধাম নিতাইকে জিজ্ঞাসা করিলাম। নিতাই তখন আর কিছু গুপ্ত রাখিল না। সুতরাং নিতাইয়ের নির্দেশমত তাহাদিগের নিকট হইতে সেই সকল অলঙ্কারের উদ্ধার করিলাম। পূর্ব্বে যে একগাছি বালা ও একটি মাকড়ি পাওয়া গিয়াছিল, এইরূপ অনুসন্ধানে এখন তাহার জোড়া বালা ও মাকড়িও পাওয়া গেল। 

এইদিনে আমাদের অনুসন্ধান কাৰ্য্য শেষ হইল। যাহা হউক, এইবারে হত্যা ও চুরি এই উভয় অপরাধে নিতাই আলিপুরের কোর্টে প্রেরিত হইল। তাহার বিপক্ষে যে সকল প্রামাণ্য সাক্ষী সংগ্রহ হইয়াছিল, তাহারা সকলেই সাক্ষ্য প্রদান করিল। যাহারা মল্লিকার অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিল, তাহাদিগের দ্বারা সেই সকল অলঙ্কার সনাক্ত হইল। বিন্দু যে সকল অবস্থা দেখিয়াছিল, তাহা সে বর্ণন করিল। এতদ্ব্যতীত চৈতন্য, হর, গোলাপ এবং যে সকল ব্যক্তির নিকট নিতাই অলঙ্কার বন্ধক দিয়াছিল, তাহারা সকলেই এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে যে যেরূপ জানিত, তৎসমস্ত প্রকাশ করিয়া নিতাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিল। উক্ত সকল প্রমাণ দ্বারা নিতাইয়ের চুরি অপরাধ অবিসম্বাদিতরূপে সাব্যস্ত হইল, কেবল প্রমাণের মধ্যে অবশিষ্ট রহিল—রাসায়নিক পরীক্ষক। ইহার পরীক্ষা হইলেই, কি বিষ প্রয়োগ করা হইয়াছিল, তাহা অবধারিত হইবে, এবং হত্যাপরাধে নিতাই দায়রায় প্রেরিত হইবে। 

সময়-মত রাসায়নিক পরীক্ষকও আসিয়া সাক্ষ্য প্রদান করিলেন; কিন্তু তাঁহার কথা শ্রবণ করিয়া আমরাও একবার অবাক হইয়া গেলাম। তিনি কহিলেন যে, তাহার পরীক্ষায় তিনি কোনরূপ বিষের চিহ্ন প্রাপ্ত হন নাই ইঁহার এই এক-কথাতেই হত্যা-অপরাধ উড়িয়া গেল, কোন সাক্ষীর সাক্ষ্যই টিকিল না। সুতরাং কেবলমাত্র চুরি করা অপরাধে নিতাই দায়রায় প্রেরিত হইল। সেইস্থানে নিতাই কেবলমাত্র চুরি অপরাধ স্বীকার করিয়া লইয়া কয়েক বৎসরের নিমিত্ত জেলে গমন করিল। উপস্থিত দর্শকমাত্রই বেকুব বৈজ্ঞানিকদিগকে সহস্র গালি দিতে দিতে আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিল। 

এক্ষণে পাঠকগণ! এই ঘটনার আমূল বৃত্তান্ত অবগত হইলেন; কিন্তু আমাদের ন্যায় আপনারাও বোধ হয়, হত্যার কারণ প্রকৃতরূপে জানিবার নিমিত্ত উৎসুক হইয়াছেন। আমিও পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, সেই ঔৎসুক্যবশতঃ নিতাই চোর জেল হইতে মুক্তি পাইলেই তাহার নিকট উক্ত কারণ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। নিতাই পরে বলিবে বলিয়া আমার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল। এখন পুনরায় আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, তখন সে আমাকে এই বলিয়া তাহার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিয়াছিল, “আমাদিগের দেশীয় গাছ-গাছড়ার ভিতরে এখন বিষাক্ত গাছ আছে যে, তাহার কণিকামাত্র শিকড় পানের সহিত কাহাকেও খাইতে দিলে, সেই পান খাওয়া শেষ হইবার পূর্বেই তাহার মৃত্যু হয়। কিন্তু বর্তমান বৈজ্ঞানিকদিগের মধ্যে আজ পর্যন্ত এমন কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না যে, উক্ত শিকড় খাইয়া মৃত্যু হইলে যিনি বলিয়া দিতে পারেন, কোন বিষ প্রয়োগ করা হইয়াছে। যে গাছের শিকড় এতদূর বিষাক্ত, সেই গাছ এ দেশে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়! এমন কি প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়ীতেই প্রায় সেই গাছ বিদ্যমান আছে, কিন্তু ইহার গুণ অধিকাংশ লোকেই অবগত নহে। সেই গাছের শিকড় পানের সহিত মল্লিকাকে খাওয়াইয়া আমি উহাকে হত্যা করিয়াছিলাম; কিন্তু বেকুব বৈজ্ঞানিকদিগের মূর্খতার নিমিত্তই আমি কয়েক বৎসরমাত্র জেল খাটিয়াই অব্যাহতি পাইয়াছি।” 

যে গাছের শিকড় খাইয়া মল্লিকা উক্তরূপে আশ্চৰ্য্য মৃত্যু হইয়াছিল, নানাকারণে সেই গাছের নামোল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই, এবং বিহিতও নহে। কিন্তু উপস্থিত ঘটনা যে আমাদিগের পরীক্ষায় চাক্ষুষ জ্বলন্ত সত্য, সে বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। অবশ্য চোর বিজ্ঞান শিখিয়া যে সেই গাছের শিকড় আবিষ্কার করিয়াছে, তাহা নহে। লোক—পরম্পরা-গত ব্যবহার ক্রমে সেই অশিক্ষিত চোর সেই শিকড়ের গুণাগুণ অবগত হইয়া থাকিবে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের এখনও ততদূর ক্ষমতা জন্মে নাই যে, সেই মূর্খ লোকেরও কার্য্যের কারণ অনুসন্ধানে কৃতকাৰ্য্য হয়! 

[ফাল্গুন, ১৩০২] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *