পথে খুন! (২) (শেষ অংশ)

পথে খুন! (২) (অর্থাৎ রাজবর্গে গাড়ির ভিতর হত্যা ও তহত্যাকারী ধৃত করিবার অদ্ভুত কৌশল!) 

শেষ অংশ 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

পাঠকগণ পূর্ব্বে একটু আভাষ পাইয়াছেন যে, করিমন-নেসা বৃদ্ধ আশানুল্লার কন্যা। কিন্তু কিরূপ কন্যা, ঔরসজাতা কন্যা, কি পালিতা কন্যা, তাহা আপনারা অবগত নহেন। এখন তাহা অবগত হইবার প্রয়োজন নাই; আবশ্যক হয়, সময়-মত অবগত হইতে পারিবেন। 

বৃদ্ধ আশানুল্লার অন্তঃপুরের ভিতর কেবলমাত্র তাঁহার এই কন্যা করিমন-নেসা ভিন্ন পরিবারের মধ্যে অপর স্ত্রীলোক আর কেহই ছিল না। মধ্যে মধ্যে অন্তঃপুরের ভিতর অপর যে দুই একজন স্ত্রীলোককে দেখিতে পাওয়া যাইত, তাহারা পরিচারিকা ভিন্ন অপর কেহই নহে। 

আবদুল হাই নিতান্ত সামান্য লোক না হইলেও তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল না। তিনি নিতান্ত দরিদ্র ভাবেই কালযাপন করিতেন। আবদুল হাই যখন বালক ছিলেন, সেই সময় হইতে তিনি সর্ব্বদা বৃদ্ধ আশানুল্লার বাড়ীতে গমন করিতেন, এবং প্রায় সর্ব্বদাই সেই স্থানেই সময় অতিবাহিত করিতেন। আশানুল্লার অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিবার পক্ষে বালক আবদুল হাইয়ের কোনরূপ প্রতিবন্ধক ছিল না। সেই সময় করিমন-নেসাও নিতান্ত বালিকা ছিল। অন্তঃপুরের ভিতর আবদুল হাই ও করিমন-নেসা সর্ব্বদা বাল্যক্রীড়ায় দিনযাপন করিতেন। উভয়ের মধ্যে ভালবাসাও যথেষ্ট হইয়াছিল, ক্রমে উভয়েই বড় হইয়া পড়িলেন। সেই সময় বৃদ্ধ আশানুল্লা একদিবস উভয়ের সম্মুখেই পরিহাসচ্ছলে বলিয়া বসিলেন, “ইহাদিগের মধ্যে এখন হইতে যেরূপ প্রণয় দেখিতে পাওয়া যায়, যদি ইহাদিগের পরস্পরের সহিত বিবাহ হয়, তাহা হইলে সেই প্রণয় আরও কিরূপ মধুর হইবে, তাহা বলা যায় না।” 

বৃদ্ধ আশানুল্লার এই কথা উভয়েরই কর্ণে প্রবেশ করিল; কিন্তু সেইদিবস হইতে উভয়ের মনে কেমন একরূপ লজ্জার উদয় হইল। সেইদিবস হইতে উভয়ের একত্র ক্রীড়া, নির্জ্জনে ভ্রমণ করা, একস্থানে বসিয়া গল্প করা দূর হইল। এখন হইতে আবদুল হাই আর অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলনা। প্রবেশ করিলেও করিমন-নেসা আর তাহার সম্মুখে আগমন করিল না। 

এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু বৃদ্ধ আশানুল্লা তাঁহার মনের আশা পূর্ণ করিতে পারিলেন না। কেন পারিলেন না, তাহা তখন আমরা অবগত ছিলাম না। বৃদ্ধের মনের ভাব বৃদ্ধই অতি উত্তমরূপে অবগত ছিলেন। এই সময় করিমন-নেসা তাহার পরিচারিকার মুখে অবগত হইলেন যে, আবদুল হাই, রেয়াজুদ্দিন নামক এক ব্যক্তিকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হইয়াছেন। কি কারণে তিনি যে রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়াছেন, তাহা কিন্তু, তিনি বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। অথচ প্রবল লজ্জা নিবন্ধন কোন কথা আশানুল্লাকে জিজ্ঞাসা করিতেও পারিলেন না; কিন্তু তাঁহার অন্তরের ভিতর বিষম শেল বিদ্ধ হইল। সেই যন্ত্রণায় তিনি নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িলেন। কোন উপায় অবলম্বন করিলে আবদুল হাইয়ের জীবন রক্ষা হইতে পারে, তাহা অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কোনমতে কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলেন, আর লজ্জা করা উচিত নহে; পিতাকে বলিয়া যে প্রকারে হউক, আবদুল হাইয়ের প্রাণরক্ষার চেষ্টা করা কর্তব্য। কারণ, বাল্যকাল হইতে আবদুল হাইয়ের চরিত্র তিনি যতদূর পর্য্যন্ত অবগত ছিলেন, তাহাতে কিছুতেই তিনি এইরূপ বিশ্বাস করিতে পারিবেন না যে, আবদুল হাই দ্বারা কোন প্রকারে কোন নরহত্যা সম্পন্ন হইতে পারে। 

করিমন মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া বৃদ্ধ আশানুল্লাকে কিরূপে আপন মনের ভাব জানাইবেন, তাহারই সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। কিন্তু বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়াও দুই এক দিবসের মধ্যে কোনরূপ সুযোগ পাইলেন না। 

করিমন-নেসার সহিত আশানুল্লার প্রায়ই নিৰ্জ্জনে সাক্ষাৎ হইত না। যে সময় বৃদ্ধ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেন, সেই সময় পরিচারিকা প্রভৃতি কেহ না কেহ তাঁহার সহিত থাকিত। সুতরাং তাহাদিগের সাক্ষাতে করিমন পিতাকে কোন কথাই বলিতে পারিতেন না। 

এইরূপ দুই তিন দিবস অতীত হইয়া গেল। অথচ বৃদ্ধের নিকট যখন আপন মনের কথা প্রকাশ করিবার উপযুক্ত সময় প্রাপ্ত হইলেন না, তখন করিমন মনে মনে স্থির করিলেন, “এইরূপে বিলম্ব করিয়া মিথ্যা সময় নষ্ট করা আর কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে। যেরূপে হউক, অদ্য পিতার নিকট আমার মনের কথা ব্যক্ত করিবই করিব। তাঁহাকে যদি নিৰ্জ্জনে পাই, ভালই; নতুবা পরিচারিকাবর্গের সম্মুখেও আজ আমার মনের কথা প্রকাশ করিতে সঙ্কুচিত হইব না।” 

মনে মনে এইরূপ পরামর্শ স্থির করিয়া যে সময় বৃদ্ধআশানুল্লা বাড়ীর ভিতর আহার করিতে আগমন করিবেন, সেই সময়ের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেইদিবস আহার করিবার নিমিত্তও আশানুল্লা বাড়ীর ভিতর আগমন করিলেন না। সুতরাং করিমন-নেসা সেইদিবস যে কিরূপ কষ্টে অতিবাহিত করিলেন, তাহা পাঠকগণ সহজেই অনুমান করিতে পারিবেন। 

দিবাভাগে বৃদ্ধের সাক্ষাৎ না পাইয়া করিমন-নেসা স্থির করিলেন যে, রাত্রিকালে যখন পিতা শয়ন করিবার নিমিত্ত বাড়ীর ভিতর আগমন করিবেন, সেই সময় তিনি আপন মনের কথা পিতাকে কহিবেন। 

শয়ন করিবার নিমিত্ত বৃদ্ধ আশানুল্লা প্রায়ই অধিক রাত্রিতে বাড়ীর ভিতর আগমন করিতেন। যে সময় তিনি বাড়ীর ভিতর আগমন করিতেন, তাহার অনেকক্ষণ পূর্ব্বে করিমন-নেসা নিদ্রিত হইয়া পড়িতেন। আজ কিন্তু করিমন নেসার চক্ষে নিদ্রা আসিল না। বসিয়া বসিয়া অনায়াসে তিনি রাত্রি জাগরণ করিলেন, এবং নানাপ্রকার চিন্তাকে আপন মনে স্থান দিয়া অশেষরূপ ক্লেশ ভোগও করিতে লাগিলেন। 

কোন বন্ধুর বাড়ীতে আশানুল্লার নিমন্ত্রণ হওয়ায় দিবা দশটার মধ্যেই তিনি আপন বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলেন; এই নিমিত্ত দিবাভাগে আহার করিবার নিমিত্ত তিনি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করেন নাই। কি নিমিত্ত যে বৃদ্ধ অদ্য বাড়ীর ভিতর আগমন করেন নাই, তাহা কিন্তু করিমন জানিতেন না; সুতরাং রাত্রিকালেও তাঁহার নিমিত্ত অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। 

নিমন্ত্রিত হইয়া বৃদ্ধ যে স্থানে গমন করিয়াছিলেন, রাত্রি কালেও সেইস্থান হইতে তিনি প্রত্যাগমন করিতে সমর্থ হইলেন না। সুতরাং পিতার অপেক্ষায় বসিয়া বসিয়া করিমন নেসাও সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিয়া ফেলিলেন। দিবারাত্রির মধ্যে আশানুল্লাকে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না দেখিয়া, করিমন আরও চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। আবদুল হাইয়ের নিমিত্ত গুপ্ত চিন্তা একে তাঁহার মনকে জর্জরিত করিয়া ফেলিয়াছিল, তাহার উপর আবার বৃদ্ধ পিতা আশানুল্লার চিত্তা হৃদয়ে প্রবেশ করায় তিনি একবারে অস্থির হইয়া পড়িলেন, এবং পরিশেষে জনৈক পরিচারিকা পাঠাইয়া যখন জানিতে পারিলেন যে, কোন নিমন্ত্রণ উপলক্ষে আশানুল্লাকে গমন করিতে হইয়াছিল, এবং সেইস্থানে দিবারাত্রি তিনি অতিবাহিত করিয়াছেন, তখন তিনি কথঞ্চিৎ সুস্থ হইলেন। যাহা হউক, পরদিবস আপনার মনের কথা পিতাকে জানাইবেন বলিয়া মনকে প্রবোধ দিয়া তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। 

পূর্ব্বরূপ নিয়মানুসারে দিবা দ্বিপ্রহরের সময় আশানুল্লা ভোজনার্থ অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, ও নিরূপিত স্থানে গমন করিয়া আহারার্থ উপবেশন করিলেন। যে সময় আশানুল্লা আহারার্থ উপবেশন করেন, সেই সময় সেইস্থানে দুই এক জন পরিচারিকা ভিন্ন অপর আর কেহ প্রায়ই থাকে না। করিমনও প্রায়ই সেই সময় সেইস্থানে আগমন করিতেন না। আজ কিন্তু বৃদ্ধ আশানুল্লা আহারার্থ আসিয়া উপবেশন করিবামাত্রই করিমন আসিয়া সেইস্থানে উপবেশন করিলেন। পরিচারিকাগণ যাহারা সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, তাহারা করিমন-নেসাকে সেইস্থানে উপবেশন করিতে দেখিয়া একটু দূরে গিয়া দণ্ডায়মান হইল। 

অসময়ে আশানুল্লা করিমনকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “করিমন! তুমি কেমন আছ, তোমার শরীর সুস্থ আছে ত?” 

করিমন। হাঁ পিতা; আমি ভাল আছি, আমার কোন অসুখ হয় নাই। 

আশানুল্লা। অসময়ে তোমাকে এখানে দেখিয়া আমার মনে অতিশয় ভয় হইয়াছিল। ভাবিয়াছিলাম, হয় ত তোমার কোন প্রকার অসুখ হইয়াছে, তাই তুমি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছ। 

করিমন। আমি হঠাৎ একটি কথা শুনিতে পাইলাম। কিন্তু উহা সত্য কি মিথ্যা, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। এই নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। 

আশানুল্লা। তুমি কি কথা জানিতে পারিয়াছ, তাহা আমাকে বল। উহা কতদূর সত্য কি মিথ্যা, তাহা আমি এখনই তোমাকে বলিয়া দিব। 

করিমন। আমি বাল্যকালে দেখিতাম যে, আবদুল হাই নামক একটি বালক সর্ব্বদাই আমাদের বাড়ীতে আসিত; তাহা কি আপনার মনে আছে? 

আশানুল্লা। বেশ মনে আছে। যখন তুমি বালিকা ছিলে, সেই সময় সে অন্তঃপুরের ভিতর আসিয়া সর্ব্বদা তোমার সহিত খেলা করিত। তুমি তাহাকে বিশেষরূপে ভালবাসিতে, সেও তোমাকে প্রাণের সমান দেখিত। এখন তুমিও বড় হইয়াছ, সেও বড় হইয়াছে; এই নিমিত্ত সে আর অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করে না, কিন্তু আমার নিকট প্রত্যহ সৰ্ব্বদাই আসিয়া থাকে। 

পিতার মুখে উভয়ের ভালবাসার কথা শ্রবণ করিয়া করিমন আপনার মস্তক অবনত করিলেন। লজ্জা আসিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইল। তাঁহার মুখ হইতে সহজে আর কোন কথা বাহির হইল না। 

কন্যার এই অবস্থা দেখিয়া পিতা পুনরায় কহিলেন, “তাহার কথা তোমার হঠাৎ মনে হইল কেন?”

করিমন। আমি শুনিলাম, তিনি না কি কাহাকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হইয়াছেন, একথা কি প্ৰকৃত?

আশানুল্লা। তোমাকে একথা কে বলিল? 

করিমন। জনৈক পরিচারিকার মুখে আমি একথা শ্রবণ করিয়াছি। 

আশানুল্লা। তুমি যাহা শ্রবণ করিয়াছ—তাহা প্রকৃত। আবদুল হাই হত্যাপরাধে পুলিস কর্তৃক ধৃত হইয়া কারাগারে প্রেরিত হইয়াছে। 

করিমন। তিনি কাহাকে হত্যা করিয়াছেন? 

আশানুল্লা। যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, তুমি তাহাকে কি প্রকারে চিনিবে বল? সে ব্যক্তি এদেশীয় লোক নহে, তাহার না রেয়াজুদ্দিন। 

করিমন। তিনি উহাকে হত্যা করিলেন কেন? 

আশানুল্লা। প্রকাশ—চুরি করিবার অভিপ্রায়ে আবদুল হাই এই হত্যা করিয়াছে। 

করিমন। আবদুল হাই চোর, একথা পিতা আপনি বিশ্বাস করিয়াছেন কি? বাল্যকালে আমি তাঁহার চরিত্র যেরূপ দেখিয়াছি, এখনও যদি তাঁহার চরিত্র সেইরূপ থাকে, তাহা হইলে আমি কিছুতেই অনুমান করিতে পারি না যে, তিনি চোর বা নরঘাতক। 

আশানুল্লা। তুমি তাহাকে বাল্যকালে দেখিয়াছ, কিন্তু আমি তাহাকে এখন পর্য্যন্ত দেখিতেছি। তাহার ন্যায় সচ্চরিত্র বালক আর কখনও দেখিয়াছি বলিয়া আমার বোধ হয় না। আমার বিশ্বাস,—বিশ্বাস কেন, আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, এ হত্যা এখনই তাহার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। 

করিমন। পূর্ব্বে তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল না, কিন্তু আজকাল তাঁহার অবস্থা কি প্রকার? 

আশানুল্লা। তাহার অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই। মধ্যে মধ্যে আমি তাহাকে সাহায্য করিতাম বলিয়া তাহার আহারাদির কষ্ট হয় নাই। নতুবা অর্থাভাবে এতদিবস তাহাদিগের কষ্টের পরিসীমা থাকিত না। 

করিমন। আপনার বিশ্বাস মত তিনি নিরপরাধ বটেন; কিন্তু দূরদৃষ্টবশতঃ অতীব গুরুতর অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত, অথচ সেই মোকদ্দমা হইতে পরিত্রাণ পাইবার আশায় খরচ পত্র করিবারও তাঁহার ক্ষমতা নাই। অতএব এরূপ স্থলে তাঁহার অদৃষ্টে কি ঘটিবে পিতা? 

আশানুল্লা। যেরূপ অবস্থায় সে পতিত হইয়াছে, যদি তাহাতে বিশেষরূপ খরচপত্র করিয়া এই মোকদ্দমার কোন উপায় করা না হয়, তাহা হইলে এ বিপদ হইতে উদ্ধার হইবার তাহার আর কোনরূপেই সম্ভাবনা নাই। 

করিমন। এ মোকদ্দমায় তাঁহার কিরূপ দণ্ড হইবার সম্ভাবনা? 

আশানুল্লা। যেরূপ ভয়ানক অভিযোগে সে অভিযুক্ত, পুলিস যদি তাহা প্রমাণিত করিতে পারে, এবং বিচারক যদি তাহা বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে উহার ফাঁসী হইবারই সম্ভাবনা। 

পিতার এই কথা শ্রবণ করিয়া করিমন একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন, এবং পরিশেষে পিতাকে কহিলেন, “আপনার বিবেচনায় যখন তিনি নিরপরাধ, তখন তাঁহাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত কোনরূপ উপায় হইতে পারে না কি?”

আশানুল্লা। কেন হইবে না, অর্থ হইলেই উপায় হইতে পারে। কিন্তু এ কাৰ্য্য অল্প অর্থে সম্পন্ন হইবার নহে, অধিক অর্থের প্রয়োজন। একজন ভাল কৌন্সলি নিযুক্ত করিতে হইলে অধিক অর্থের প্রয়োজন; কিন্তু উহার নিমিত্ত এত অর্থ কে প্রদান করিবে? 

করিমন। অর্থ নাই বলিয়া কি বিনাদোষে একজনের জীবন নষ্ট হইবে? এই বিপদের সময় কেহই তাঁহাকে অর্থ দিয়া সাহায্য করিবে না? 

করিমনের এই কথা শ্রবণ করিয়া বৃদ্ধ আশানুল্লা একটু হাসিলেন ও কহিলেন, “এই কলিকাতা সহরের মধ্যে আমি এমন লোক দেখিতে পাই না যে, কোনরূপ নিজের স্বার্থ দেখিতে না পাইলেও সে ব্যক্তি এত টাকা প্রদান করিতে পারেন। যদি তোমার বাল্য সহচরের উপর এতদূর দয়া হইয়া থাকে, তাহা হইলে যদি তুমি ইচ্ছা কর, তবে তাহার সাহায্যের নিমিত্ত তুমি অনায়াসেই অর্থ প্রদান করিতে পার।” 

পিতার এইরূপ ব্যঙ্গোক্তি শুনিয়া করিমন-নেসা নিতান্ত লজ্জিতা হইলেন। কিন্তু আপন মুখ অবনত করিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “আমার যদি অর্থ থাকিত, তাহা হইলে এরূপ কার্য্যে আমি অনায়াসেই তাহা প্রদান করিতাম। কিন্তু আপনি অবগত আছেন, আমার হস্তে কপদকমাত্রও নাই। তথাপি আমার অলঙ্কারগুলি প্রদান করিলে একজন নির্দোষ ব্যক্তির যদি প্রাণরক্ষা হয়, তাহা হইলে উহা প্রদান করিতে এখনই আমি প্রস্তুত আছি।” 

কন্যার এই কথা শুনিয়া বৃদ্ধ আশানুল্লা পুনরায় একটু হাসিলেন ও কহিলেন, “অলঙ্কার কি অর্থ নহে? উহা বিক্রয় করিলে এখনই নগদ মূল্য পাওয়া যাইবে; সুতরাং তাহার দ্বারা আবদুল হাইয়ের অনেক সাহায্য হইবার সম্ভাবনা। যদি তুমি আবদুল হাইয়ের প্রাণরক্ষা করিবার মানসে তোমার অলঙ্কারগুলি প্রদান করিতে সম্মত হও, তাহা হইলে উহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। তুমি এখন নিতান্ত বালিকা নহ, তোমার নিজের ভাল মন্দ এখন তুমি বুঝিতে সমর্থ হইয়াছ। এরূপ অবস্থায় যদি তুমি তোমার অলঙ্কারগুলি প্রদান করিতে চাহ, তাহা হইলে উহা আমাদের অর্পণ কর। সেই সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া যে অর্থ পাওয়া যাইবে, তাহার দ্বারা যতদূর সম্ভব, আমি আবদুল হাইকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিব। কিন্তু পূর্ব্বেই আমি তোমাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, তোমার অলঙ্কারগুলি এইরূপে একবার নষ্ট হইয়া গেলে আমার নিকট হইতে উহা তুমি আর কখনই প্রাপ্ত হইবে না।” 

করিমন। না পাই, তাহাতে আমার দুঃখ নাই। উহার দ্বারা যদি একজন নিরপরাধ লোকের জীবন রক্ষা হয়, তাহা হইলে বিনা অলঙ্কারেও আমি কতদূর সন্তুষ্ট থাকিব, তাহা আমি বলিতে পারি না। 

এই বলিয়া করিমন সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনার থাকিবার গৃহে প্রবেশ করিলেন। সেই অবকাশে আশানুল্লার আহারাদিও শেষ হইয়া গেল। 

কিয়ৎক্ষণ পরে একটি বাক্সহস্তে করিমন-নেসা পুনরায় আপনার পিতার নিকট গমন করিলেন, এবং সেই বাক্সটি পিতার সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়া কহিলেন, “পিতঃ! আমার যাহা কিছু অলঙ্কার আপনি প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই ইহার ভিতর আছে। আপনি এই অলঙ্কারগুলি বিক্রয় করিয়া যাহাতে নিরপরাধের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হয়েন, তাহার চেষ্টা করুন।” 

বৃদ্ধ আশানুল্লা কন্যার কথা শ্রবণ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং সেই স্থানেই বাক্সটি খুলিয়া দেখিলেন যে, এ পর্যন্ত তিনি কন্যাকে যে সকল অলঙ্কার প্রদান করিয়াছেন, তাহার সমস্তই উহার ভিতর আছে। আরও দেখিলেন যে, ইতিপূর্ব্বে তাহার সহিত কথা কহিবার সময় করিমন-নেসার শরীরে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহাও উন্মোচিত করিয়া করিমন সেই বাক্সের ভিতর রাখিয়া দিয়াছে। এখন তাহার শরীরের কোনস্থানে অলঙ্কারের চিহ্নমাত্র নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া বৃদ্ধ আপনার মনের ভাব আর কোনরূপে গোপন করিতে পারিলেন না; তাঁহার মুখ দিয়া তামনি নির্গত হইয়া পড়িল, “কন্যা! দেখিতেছি, এখনও তুমি তোমার বাল্যপ্রণয় ভুলিতে পার নাই। খোদা যদি কখন দিন দেন, আবদুল হাইকে আনিয়া যদি কখন আমি তোমাকে অর্পণ করিতে পারি, তবেই আমার মনের কষ্ট দূর হইবে; নতুবা মরিলেও আমার এ কষ্ট যাইবে না। যাও বেটী, তোমার অলঙ্কারের বাক্স তুমি লইয়া যাও। আবদুল হাইকে বাঁচাইবার নিমিত্ত যত টাকার প্রয়োজন হইবে, তাহার জন্য তোমাকে কিছু ভাবিতে হইবে না, সে সমস্ত অর্থই আমি প্রদান করিব। তোমার বলিবার পূর্ব্বেই আমি সমস্তই ঠিক করিয়া দিয়াছি, অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া কলিকাতা সহরের সৰ্ব্বপ্রধান উকীল কৌন্সলিগণকে নিযুক্ত করিয়াছি। তাঁহারা আবদুল হাইকে বাঁচাইবার নিমিত্ত সবিশেষরূপে চেষ্টাও করিতেছেন, এবং পূর্ব্বাপর সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া আমাকে ইহাও বলিয়াছেন যে, নিশ্চয়ই তাঁহারা এই মোকদ্দমা হইতে আবদুল হাইকে খালাস করিয়া আনিতে পারিবেন।” 

এই বলিয়া বুদ্ধ আশানুল্লা অলঙ্কারের বাক্স আপন কন্যার হস্তে প্রদান করিয়া অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। করিমনও সবিশেষ আনন্দের সহিত আপনার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

অন্তঃপুরের ভিতর কন্যা ও পিতার সহিত যে সকল কথাবার্তা হইল, তাহা আমরা কি প্রকারে জানিতে পারিলাম, ইহা কোন কোন পাঠক আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। তাঁহাদের প্রশ্নের উত্তরে এই স্থানে এইমাত্র আমি বলিয়া রাখি যে, কোন অনুসন্ধান উপলক্ষে পরিশেষে আমাকে উক্ত অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিতে হয়, এবং সেই সময় যে সকল পরিচারিকা সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের জবানবন্দী আমাকে লিখিতে হয়। সুতরাং সেই সময় এই সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়ে। কি অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে যে এই অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিতে হইয়াছিল, তাহার বিবরণ সময়-মত পাঠকগণ অবগত হইতে পারিবেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করা অপরাধে আবদুল হাই অভিযুক্ত হইলেন। যে পর্য্যন্ত পুলিসের অনুসন্ধান সম্যকরূপে শেষ না হইল, সেই পৰ্য্যন্ত তিনি হাজত গৃহে অবস্থান পূর্ব্বক অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করিতে লাগিলেন, এবং মনোকষ্টে ও নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িলেন। কিন্তু কি নিমিত্ত ও কিরূপ অবস্থায় যে তিনি রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়াছেন, তাহার কোন কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিলেন না। 

আবদুল হাই তাঁহার নিজের অবস্থা নিজে বিশেষরূপে অবগত ছিলেন, এবং ইহাও জানিতেন যে, যে গুরুতর অভিযোগ তাঁহার উপর আনীত হইয়াছে, তাহা হইতে নিষ্কৃতিলাভ করা তাঁহার পক্ষে কোনরূপেই সম্ভবপর নহে। তিনি নিজে একে কপদক-শূন্য; তাহার উপর তাঁহার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এরূপ লোকজন কেহই নাই, যিনি নিজের অর্থ ব্যয় করিয়া আবদুল হাইকে সাহায্য করিতে সমর্থ হন। সুতরাং তিনি মনে মনে একরূপ স্থিরই করিয়া রাখিলেন যে, এ বিপদ হইতে এবার আর কোন প্রকারেই তাঁহার নিষ্কৃতি নাই। 

পুলিস-কর্তৃক এই ঘটনার অনুসন্ধান শেষ হইলে, তিনি মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে আনীত হইলেন। প্রথম হইতে সরকারী উকীল তাঁহার মোকদ্দমা চালাইতে লাগিলেন। 

আদালতে উপনীত হইবার পর এই ভয়ানক বিপদের সময় আবদুল হাইয়ের মনে একটু আনন্দের উদয় হইল। ইতিপূর্ব্বে তিনি যাহা কখন স্বপ্নেও ভাবেন নাই, আদালতে আসিয়া তাহাই দেখিতে পাইলেন বলিয়া, তাঁহার মুখে সেইরূপ আনন্দের রেখা পতিত হইয়াছিল। 

আবদুল হাই দেখিলেন যে, মাজিষ্ট্রেট সাহেবের কোর্টে যে কয়েকজন সৰ্ব্বপ্রধান উকীল আছেন, তাঁহাদের মধ্যে একজন তাঁহার পক্ষ সমর্থন করিবার নিমিত্ত উপস্থিত আছেন। সেই উকীল তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “এই মোকদ্দমায় তুমি কোনরূপে ভীত হইও না। যে প্রকারে পারি, আমি তোমাকে খালাস করিবার চেষ্টা করিব।” 

উকীল মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া আবদুল হাই কহিলেন, “আপনি একান্ত অনুগ্রহ করিয়া এই মোকদ্দমা হইতে আমাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত উপস্থিত হইয়াছেন বলিয়া আপনাকে ধন্যবাদ না দিয়া আমি থাকিতে পারিতেছি না। কিন্তু মহাশয় কিরূপে আপনি এই মোকদ্দমায় আমার পক্ষ সমর্থন করিবেন, তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কারণ, আপনার পারিশ্রমিক সম্পূর্ণরূপে প্রদান করা পরের কথা; ফলতঃ আপনাকে গাড়ি ভাড়া বলিয়া প্রদান করিতে পারি, এরূপ একটি পয়সাও আমার নিকট নাই। এরূপ অবস্থায় আপনি আমার পক্ষ কিরূপে সমর্থন করিবেন? “ এই বলিতে বলিতে আবদুল হাইয়ের চক্ষু জলধারায় পূর্ণ হইয়া গেল, তাঁহার মুখ দিয়া আর কোন কথা নির্গত হইল না। তিনি বিস্ফারিতনেত্রে উকীলের দিকে চাহিয়া রহিলেন। 

আবদুল হাইয়ের কথার উত্তরে উকীল মহাশয় কহিলেন, আমার পারিশ্রমিকের ভাবনা তোমাকে ভাবিতে হইবে না। সে ভাবনা যিনি ভাবিতেছেন, তিনিই আমাকে আমার পারিশ্রমিকের টাকা প্রদান করিবেন। আর এই আদালত হইতে যদি তুমি উদ্ধার না পাও, তাহা হইলে উচ্চ আদালতের সমস্ত খরচা তিনি প্রদান করিবেন। সে নিমিত্ত তোমার ভাবিবার কোন প্রয়োজন নাই।” 

উকীল মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া আবদুল হাই আদালতের চতুষ্পার্শ্বে একবার লক্ষ্য করিয়া পুনরায় কহিলেন, “এ অবস্থায় অর্থ দিয়া আমাকে সাহায্য করিবে, এরূপ কোন লোক কোথাও নাই, এবং এইস্থানেও কাহাকে দেখিতে পাইতেছি না। এরূপ অবস্থায় বিস্তর অর্থ ব্যয় করিয়া আমাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত কে অগ্রসর হইয়াছেন, তাহা আমি জানিতে পারি না কি? এরূপ পরোপকারী লোকের নাম জানিতে কোনরূপ প্রতিবন্ধক আছে কি?” 

উত্তরে উকীল মহাশয় পুনরায় কহিলেন, “কোন্ ব্যক্তি তোমার নিমিত্ত অর্থ সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন, তাঁহার নাম জানিয়া তোমার লাভ কি? এখন কোন প্রকারে এই বিপদ হইতে উদ্ধার হওয়াই তোমার কার্য্য।” 

আবদুল হাই পুনরায় কহিলেন, “আমার নিমিত্ত অযাচিত ভাবে এত অর্থ ব্যয় করিয়া যিনি আমার উপকারের অভিপ্রায়ে প্রস্তুত হইয়াছেন, সেই পরোপকারী মহাত্মার নাম আমি জানিতে পারিব না, ইহা অপেক্ষা আমার পক্ষে কষ্টের কারণ আর কি হইতে পারে?” 

এই বলিয়া আবদুল হাই বিষণ্ণমনে সেইস্থানে দণ্ডায়মান রহিলেন। 

মোকদ্দমা আরম্ভ হইল। আমাদিগের সাহায্যে যাহাতে এই মোকদ্দমা প্রমাণিত হয়, সরকারী উকীল মহাশয় তাহার বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। প্রথম দিবস দুই এক জন সাক্ষীর জবানবন্দী হইয়া অন্য দিবসের নিমিত্ত মোকদ্দমা স্থগিত রহিল। যে সকল সাক্ষী দ্বারা এই মোকদ্দমা প্রমাণিত হইবে, এইরূপে ক্রমে ক্রমে তাহাদিগের সকলের জবানবন্দীই গ্রহণ করা হইল। 

এই মোকদ্দমায় যে সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হইয়াছিল, তাহাদের বিবরণ নিম্নে দেওয়া গেল :—প্রথম সাক্ষী—যে প্রথমে আপন গাড়িতে করিয়া রেয়াজুদ্দিনের মৃতদেহ থানায় আনিয়া উপস্থিত করে, দ্বিতীয় শ্রেণী ঠিকা গাড়ির সেই গাড়িবান। এই ব্যক্তি ইতিপূর্ব্বে আমাদিগের নিকট যাহা যাহা বলিয়াছিল, এখনও প্রায় সেই রূপই কহিল। অধিকন্তু কহিল যে, যে ব্যক্তি ধৰ্ম্মতলার মোড়ে তাহার গাড়ি ভাড়া করিয়াছিল, বর্ত্তমান আসামী আবদুল হাই সেই ব্যক্তি। কিন্তু তখন তাহার হস্তে একটি বড় হীরার আংটী ছিল, এখন তাহা নাই। এই ব্যক্তি আরও কহিল, “ইহার আকৃতি দেখিয়া ও ইহার স্বর শ্রবণ করিয়া আমার মনে নিশ্চয়ই প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, আমি যাহা কহিলাম, তাহা প্রকৃত ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না।” 

দ্বিতীয় সাক্ষী–যে থানায় রেয়াজুদ্দিনের মৃতদেহ প্রথম নীত হয়, সেই থানার পুলিস-কর্ম্মচারী। যেরূপ বন্ধনাবস্থায় সেই লাস তিনি প্রথম দেখিয়াছিলেন, এবং মৃতব্যক্তির নিকট যে সকল দ্রব্যাদি পাওয়া গিয়াছিল, তাহার যথাযথ বিবরণ এই কৰ্ম্মচারী বর্ণন করেন। 

তৃতীয় সাক্ষী—যিনি সেই লাস পরীক্ষা করিয়া মৃত্যুর কারণ নির্দ্দেশ করেন, সেই ডাক্তার সাহেব। তাঁহার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাইড্রোসেনিক এসিড নামক মহা তেজস্কর বিষ পান করাইয়া এই ব্যক্তিকে হত্যা করা হইয়াছে। যেরূপ অবস্থায় তিনি সেই মৃতদেহ দেখিয়াছেন, তাহাতে তিনি কোন প্রকারেই অনুমান করিতে পারেন না যে, ইহা হত্যা নহে—আত্মহত্যা। 

চতুর্থ সাক্ষী—এই প্রবন্ধের লেখক। কিরূপ অবস্থায় তিনি জানিতে পারিলেন যে, এই মৃতদেহ কাহার; কিরূপ অবস্থায় আবদুল হাইয়ের উপর তাঁহার সন্দেহ হইল; কিরূপে আবদুল হাই ধৃত হইলেন, এবং আবদুল হাইয়ের গৃহ—তল্লাসি করিয়াই বা কি কি দ্রব্য, এবং অতিশয় পুরাতন হাইড্রোসেনিক এসিডের শিশি কিরূপ অবস্থায়, এবং কোন্ স্থানে পাওয়া গিয়াছিল; তিনি তাহার যথাযথ বর্ণন করিলেন। করিমন-নেসার দুইখানি ছবি ফটোগ্রাফ যে যে স্থানে পাওয়া গিয়াছিল, তাহাও বর্ণন করিয়া ফটোগ্রাফ দুইখানি কোর্টে দাখিল করিয়া দিলেন। মৃতব্যক্তির পরিহিত বস্ত্রাদি সকল পরীক্ষা করিবার কালীন তাঁহার ফতুইয়ের পকেট যেরূপ ভাবে ছিন্ন দেখিয়াছিলেন, তাহাও প্রকাশ করিলেন। পঞ্চম সাক্ষী—মৃত রেয়াজুদ্দিনের বন্ধু আবদুল ছোভান। তিনি আমার নিকট যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, অকপটে সেই সকল কথা বিচারালয়ে প্রকাশ করিলেন এবং আসামী আবদুল হাইকে দেখাইয়া দিয়া কহিলেন, “করিমন—নেসাকে বিবাহ করা উপলক্ষে ইঁহার সহিত রেয়াজুদ্দিনের বচসা হয়। ইনিই রেয়াজুদ্দিনকে বিশেষরূপ ভয় প্রদর্শন করিয়া ক্রোধভরে নছিবনের বাড়ী হইতে চলিয়া যান।” 

ষষ্ঠ সাক্ষী—নছিবন বাড়ীওয়ালী। যেরূপ অবস্থায় রেয়াজুদ্দিন সর্ব্বপ্রথম তাহার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন, এবং পরিশেষে যেরূপ অবস্থায় সে উক্ত মৃতদেহ সনাক্ত করে, তাহার যথাযথ বিবরণ সে বর্ণন করিল। আসামী আবদুল হাইয়ের সহিত রেয়াজুদ্দিনের জীবিত অবস্থায় বিবাহ উপলক্ষে যেরূপ বাগবিতণ্ডা হইয়াছিল, তাহার যতদূর সে শুনিয়াছিল, তাহাও সে বর্ণন করিল। 

সপ্তম এবং অষ্টম সাক্ষী—নছিবন বাড়ীওয়ালীর দুইজন ভাড়াটিয়া। নছিবন যে সকল কথা বলে, ইহারও প্রায় সেই সকল কথা বলিয়া নছিবনকে সমর্থন করে। 

এইরূপে আরও দুই তিন জন সাক্ষীদ্বারা সামান্য সামান্য কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হইবার পর মাজিষ্ট্রেট সাহেবের মনে প্রকৃষ্টরূপে বিশ্বাস হইল যে, এই হত্যাকাণ্ড আবদুল হাইয়ের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, আবদুল হাই প্রণয়িনীর প্রণয় প্রার্থী বলিয়াই রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়াছে। তাঁহার মনে এইরূপ বিশ্বাস হইবার পরই তিনি বিচারার্থ এই মোকদ্দমা দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

নিয়মিত সময়ে কলিকাতার হাইকোর্টের দায়রায় আবদুল হাইয়ের মোকদ্দমা আরম্ভ হইল। নয়জন জুরির সাহায্যে জজসাহেব এই মোকদ্দমার বিচার করিতে আরম্ভ করিলেন। সরকারী কৌশলি আসামীর বিপক্ষে মোকদ্দমা চালাইতে লাগিলেন, এবং হাইকোর্টের প্রধান কৌন্সলিদিগের মধ্যে দুইজন কৌললি আবদুল হাইয়ের পক্ষ সমর্থন করিবার জন্য বদ্ধ পরিকর হইলেন। এখন পর্যন্তও আবদুল হাই অবগত নহেন যে, তাঁহার পক্ষ সমর্থনকারী প্রধান কৌন্সলিদিগকে কোন ব্যক্তি অর্থ প্রদান করিতেছেন। 

মোকদ্দমা আরম্ভ হইল। সরকারী কৌন্সলি মোকদ্দমার আনুপূর্বিক অবস্থা সর্ব্বপ্রথমে জুরিদিগকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলেন, এবং তাহার পর সেই সকল বিষয় প্রমাণ করিবার নিমিত্ত একে একে সাক্ষীগণকে ডাকিতে লাগিলেন। নিম্ন আদালতে যে সকল সাক্ষীর জবানবন্দী হইয়াছিল, তাহাদিগের সাক্ষ্যই পুনরায় গৃহীত হইল। তাহারা পূৰ্ব্বে যেরূপ বলিয়াছিল, এখনও সেইরূপ কহিল। 

আসামীর পক্ষীয় কৌন্সলি মহাশয় উপরি-উক্ত সাক্ষীগণকে ভয়ানকরূপে জেরা করিতে লাগিলেন। তিনি সাক্ষীগণের সেই সকল কথার ভিতর হইতে তাঁহার প্রয়োজনীয় কয়েকটি বিষয় সংগ্রহ করিয়া লইলেন। 

এইরূপ সাক্ষীগণের জবানবন্দী শেষ হইয়া গেলে সরকারী কৌন্সলি পুনরায় জজ ও জুরিগণকে সম্বোধন করিয়া তাঁহার সাধ্যমত আসামীর দোষ সকল কীৰ্ত্তন করিলেন। যাহাতে তাঁহারা হত্যাপরাধে আসামীকে দোষী বলিয়া আপনাদিগের মত প্রকাশ করেন, তাহার নিমিত্ত তিনি বিশেষরূপে চেষ্টা করিলেন। 

সরকারী কৌন্সলির যাহা কিছু বক্তব্য ছিল, তাহা সমস্ত বলিয়া উপবেশন করিলে পর, আসামীর পক্ষীয় কৌন্সলি দণ্ডায়মান হইয়া আসামীকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে এক সুদীর্ঘ বক্তৃতা করিলেন। তাঁহার যুক্তিপূর্ণ মনোহর বক্তৃতা শ্রবণ করিয়া জজ, জুরিগণ এবং দর্শকবৃন্দ সকলেই মোহিত হইয়া পড়িলেন। 

তাঁহার সেই সুদীর্ঘ বক্তৃতার অবিকল অনুবাদ এইস্থানে প্রদান করিলে এই প্রবন্ধের কলেবর অতিশয় দীর্ঘ হইয়া পড়িবে বলিয়া তাহা পরিত্যক্ত হইল। কিন্তু যে কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করিয়া তিনি আসামীকে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহারই শেষ অংশের সারাংশ এইস্থানে বিবৃত হইল মাত্র। তিনি কহিলেন, 

“বিজ্ঞ জজসাহেব ও শিক্ষিত জুরিগণ! সর্ব্বশেষে আপনাদিগের নিকট আমার করপুটে এই নিবেদন যে, আপনারা প্রকৃত বিচার করিবেন, এইরূপ শপথ করিয়া বিচারার্থ এই স্থানে উপবেশন করিয়াছেন। এই সকল কথা মনে রাখিয়া আপনারা এই মোকদ্দমায় আপন আপন অভিপ্রায় প্রকাশ করুন, এই আমার অভিলাষ। আর ইহাও আপনাদিগের স্মরণ থাকা আবশ্যক যে, আপনাদিগের মতামতের উপর একজনের জীবন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিতেছে। বর্তমান মোকদ্দমায় আপনাদিগের সম্মুখে দণ্ডায়মান এই হতভাগ্য ব্যক্তি যদি প্রকৃতই এই ভয়াবহ কার্য্য সম্পন্ন করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার জীবন রক্ষা করিবার নিমিত্ত আজ আমি আপনাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হই নাই; আপনাদিগের নিকটে ন্যায়সঙ্গত বিচারের প্রার্থী হইয়া আজ আমি আপনাদিগের সম্মুখে উপনীত। রেয়াজুদ্দিন যে নিতান্ত নির্দয়রূপে হত হইয়াছে, সে বিষয় কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু এখন আপনাদিগের কর্তব্য যে, সেই হত্যাকাণ্ড এই হতভাগ্যের দ্বারা সংসাধিত হইয়াছে কি না, তাহারই বিচার করা। এই সময়ে আরও একটি বিষয় আপনাদিগকে স্মরণ করিয়া দেওয়া আমার নিতান্ত কর্তব্য কৰ্ম্ম, যে ব্যক্তি কোন অপরাধে অভিযুক্ত, নানাকারণে তাহার উপর সন্দেহ উপস্থিত হইলে, তাহারই দ্বারা যে সেই অপরাধ সংসাধিত হইয়াছে, বৰ্ত্তমান আইন অনুসারে সে কথা আপনারা বলিতে পারেন না, বা সেই মোকদ্দমায় তাহাকে দণ্ডবিধান করিবার ক্ষমতাও আপনাদিগের নাই। এই হত্যাকাণ্ড লইয়া অনেক দিবস হইতে ভয়ানক গোলযোগ চলিতেছে। সংবাদপত্র সকল নানারূপে আপন আপন মত প্ৰকাশ করিয়া সর্ব্বসাধারণের মনকে একবারে কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে, এবং আপামর সাধারণ সকলেই এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে নানারূপ গল্প উঠাইয়া বৰ্ত্তমান আসামীই যে এই হত্যার নায়ক, তাহা অন্যায়রূপে একরূপ স্থির করিয়াই রাখিয়াছে। সুতরাং এই সকল বিষয়ে এই হতভাগ্যের অবস্থা যে কিরূপ ভয়ানক হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা আপনাদিগের ন্যায় বুদ্ধিমান্ জুরিগণকে আমার বলিয়া দিতে হইবে না। আমার ভাগ্যবশতঃ যদি আপনাদিগের ন্যায় শিক্ষিত জুরির হস্তে এই মোকদ্দমার বিচারের ভার অর্পিত না হইত, তাহা হইলে আমার দশা অতিশয় ভয়ানক হইয়া দাঁড়াইত!! 

“এইস্থানে আমার কর্তব্য কৰ্ম্ম যে, আপনাদিগকে একটি উপদেশ প্রদান করা, এবং প্রয়োজন হইলে আমার সেই কথা প্রকৃত কি না, তাহা বিজ্ঞ জজ মহোদয় আপনাদিগকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিবেন। আপনারা ইতিপূর্ব্বে এই খুনি মোকদ্দমা সম্বন্ধে লোক-পরম্পরায় যে সকল কথা শুনিয়াছেন, গল্পচ্ছলে যে সকল কথা লইয়া তর্ক-বিতর্ক করিয়াছেন, এবং কৌতূহল নিবারণের নিমিত্ত সবিশেষ আগ্রহও যত্নের সহিত যে সকল কথা শ্রবণ করিয়াছেন, তাহার সমস্তই এখন আপনাদিগের মন হইতে দূরীভূত করিয়া এই মোকদ্দমার বিচার করিতে হইবে। যে সকল ব্যক্তি আপনাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া এই মোকদ্দমায় সাক্ষ্য প্রদান করিল, কেবলমাত্র তাহাই উপলক্ষ করিয়া আপনাদিগকে এই মোকদ্দমার বিচার করিতে হইবে। যে সকল কথা সাক্ষীর মুখে প্রকাশ হয় নাই, অথচ আপনারা গল্পচ্ছলে হউক বা সংবাদ পত্র পাঠ করিয়া হউক, আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছেন, এই বর্ত্তমান বিচারের সময়ে সে সকল কথা আপনারা একবারের নিমিত্তও মনে স্থান দিতে পারিবেন না। যদি দেন, তাহা হইলে সম্পূর্ণরূপে অবিচার করা হইবে, এবং হয় ত একজন নির্দোষ ব্যক্তি বিনাদোষে চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইবে। কিরূপ অবস্থার উপর নির্ভর করিয়া আপনাদিগকে এই মোকদ্দমার বিচার করিতে হইবে, আমি কেবলমাত্র তাহারই আভাষ এইস্থানে প্রদান করিলাম। এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে আসামীর বিপক্ষে কিরূপ প্রমাণ উপস্থিত হইয়াছে, তাহা পূৰ্ব্বে তন্ন তন্ন করিয়া আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছি, এবং বোধ হয়, আপনারাও বিশেষরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছেন। তথাপি আমার বক্তব্য শেষ করিবার পূর্ব্বে সেই মোকদ্দমা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা আপনাদিগকে পুনরায় বলিতে ইচ্ছা করি। 

“এই মোকদ্দমায় যতগুলি সাক্ষীর এজাহার গৃহীত হইয়াছে, তাহার মধ্যে দুইজনের সাক্ষ্যই সৰ্ব্বপ্রধান। এই দুই ব্যক্তি যাহা বলিয়াছে, তাহা যদি সত্য বলিয়া আপনাদিগের প্রতীতি হয়, তাহা হইলে এই হতভাগ্য ব্যক্তিকে আপনারা চরমদণ্ডে দণ্ডিত করুন; তাহাতে আমাদিগের কোন কথাই বলিবার নাই। এই দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন সাক্ষী—দ্বিতীয় শ্রেণী গাড়ির সেই গাড়িবান। অপর ব্যক্তির নাম আবদুল ছোভান; ইনি মৃত রেয়াজুদ্দিনের একজন প্রাণের বন্ধু। এই দুই ব্যক্তির সাক্ষী কতদূর বিশ্বাসযোগ্য, তাহা বিবেচনা করিবার পূর্ব্বে একবার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উহাদিগের বিবৃত বিষয় আলোচনা করা কর্তব্য। প্রথম ব্যক্তি রাত্রিকালে কেবল একবারমাত্র যে ব্যক্তিকে দেখিয়াছে, বা যে ব্যক্তি পূর্ব্ব হইতে তাহার পরিচিত নহে, এবং পূর্ব্বেও তাহাকে আর কখনও দেখে নাই, তাহাকে নিশ্চয়রূপে সনাক্ত করা যে কতদূর গুরুতর বিষয়, তাহা আপনারাই বিবেচনা করিয়া দেখুন। আপনারা সকলেই শিক্ষিত হইয়া যখন এই জরির আসন অধিকার করিয়াছেন, তখন সৰ্ব্ববিষয়ে আপনাদিগের বিশেষরূপে চিন্তা করিবার ক্ষমতা আছে বলিয়াই আমি এই সকল কথা বলিতে সাহসী হইতেছি। আপনারাই বলুন দেখি, রাত্রিকালে পথিমধ্যে যে সকল অপরিচিত ব্যক্তিকে আপনারা দেখিতে পান, সেই সকল ব্যক্তিকে দুই এক দিবস পরে অপর কোনস্থানে দেখিলে চিনিতে পারেন কি? কখনই না। 

“বর্ত্তমান অবস্থায় আরও দেখুন, যে ব্যক্তি গাড়ি ভাড়া করিল, সে পথের উপর দণ্ডায়মান, গাড়িবান কোচবাক্সে বসিয়া আছে। তাহার গাড়ির ভিতর যে এইরূপ হত্যাকাণ্ড ঘটিবে, তাহা সে সেই সময়ে অবগত নহে। এরূপ অবস্থায় তাহাকে পুনরায় দেখিলে সে চিনিতে পারিবে, এইরূপ বিবেচনায় উত্তমরূপে দেখিবার কোন গাড়িবানের প্রয়োজন হয় না, এবং রাত্রিকালে যতই কেন আলো থাকুক না, তথাপি যে সে ভাল করিয়া উহাকে দেখিয়া লয়, তাহা আমার বোধ হয় না। 

আপনারা আরও বিবেচনা করিয়া দেখুন, যেরূপ অবস্থায় গাড়িবান পতিত, তাহাতে তাহার অবস্থা কি প্রকার ছিল, সেই হত্যাপরাধে কোন ব্যক্তি যদি ধৃত না হয়, তাহা হইলে যেরূপ অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে তাহার উপরই বিশেষরূপ সন্দেহ হইবার সম্ভাবনা। এরূপ অবস্থায় অশিক্ষিত ও হিতাহিত-জ্ঞান-বিবর্জ্জিত গাড়িবান না করিতে পারে, এরূপ কোন কাৰ্য্যই নাই। একজনকে সনাক্ত করিয়া দিতে পারিলে, যাহার উপর হইতে এই ভয়ানক দায়িত্ব দূর হয়, সেই ব্যক্তি পুলিসকর্তৃক ধৃত বৃত্তিকে যে অন্যায়রূপে সনাক্ত করিবে না, তাহা আপনারা ভাবিতে পারেন কি? আরও দেখুন, যদি গাড়িবানের প্রথম এজাহার প্রকৃতই হয়, তাহা হইলে যে ব্যক্তি তাহার গাড়ি ভাড়া করিয়াছিল, তাহার অঙ্গুলিতে একটি উৎকৃষ্ট ও বড় হীরার আংটা ছিল, একথা আমাদিগকে বিশ্বাস করিতেই হইবে। কিন্তু বর্ত্তমান আসামীর অবস্থা সরকারী পক্ষীয় সাক্ষীগণের মধ্যে হইতে যেরূপ অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহাতে সেইরূপ বহুমূল্য হীরার আংটী বর্ত্তমান আসামীর থাকা কোনরূপেই সম্ভবপর হইতে পারে না। ইহা ব্যতীত আবদুল ছোভান, নছিবন প্রভৃতি অপরাপর সাক্ষীগণও যাহা বলিয়াছেন, তাহাও আপনারা শ্রবণ করিয়াছেন। তাহারা সকলেই একবাক্যে বলিয়াছে, যে, আবদুল হাইয়ের অঙ্গুলিতে কোনরূপ আংটী তাহারা কখনও দেখে নাই। 

“যাহার আংটী নাই, বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়াও পুলিস যাহার নিকট হইতে আংটী প্রাপ্ত হন নাই, যে ব্যক্তিকে আংটা পরিধান করিতে কেহ কখন দেখেন নাই, সেই ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির নিকট হইতে আংটা চাহিয়া লইয়া সাজিয়া গুজিয়া যে নরহত্যা করিতে গমন করিবে, তাহাই বা কিরূপে অনুমান করিতে পারি? কারণ, যদি ইহার দ্বারা সেই হত্যা হইয়া থাকে, সেই হত্যা হঠাৎ ঘটে নাই। আপন প্রণয়ের পথ পরিষ্কার করিবার অভিপ্রায়ে সে সেই হত্যা হইয়াছে; সুতরাং এ বিষয়ে পূৰ্ব্ব হইতে ইহাকে অনেক ভাবিতে হইয়াছে। যে ব্যক্তি পূৰ্ব্ব হইতে ইচ্ছা করিয়া এক ব্যক্তিকে হত্যা করিবে, সে অপরের নিকট হইতে মূল্যবান হীরার আংটী চাহিয়া আনিয়া উত্তম সাজে সাজিয়া, কখন এরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে পারে না। 

“এই হত্যাসম্বন্ধে আরও দুই একটি কথা আপনাদিগকে বিশেষরূপে বিবেচনা করিতে হইবে। এই হত্যার উদ্দেশ্য কি? সরকারী কৌশলি মহাশয় বলিতেছেন, এই হত্যার উদ্দেশ্য প্রণয়, এবং সাক্ষীর দ্বারা তাহা প্রমাণ করিবার চেষ্টাও করিয়াছেন। কিন্তু আমি বলিতেছি যে, এই হত্যার উদ্দেশ্য প্রণয় নহে, এ হত্যার উদ্দেশ্য চুরি। তাহার প্রমাণ—পুলিসকর্ম্মচারী সাক্ষী, এবং ফতুইয়ের নূতন ছিন্ন পকেট। আরও আমি বলিতেছি যে, এই হত্যা যদি চুরির উদ্দেশ্যে হইয়া থাকে, তাহা হইলে বর্ত্তমান আসামীর দ্বারা তাহা কখনই হইতে পারে না। 

“এই অনুমান যদি আপনারা বিশ্বাস করিয়া লইতে পারেন, তাহা হইলে বন্ধু আবদুল ছোভানের সাক্ষ্যের মূল্য এক কপদকও নহে। ইহা ব্যতীত আবদুল ছোভানের সাক্ষ্য সম্বন্ধে আরও দুই একটি কথা আমার বলিবার আছে। যদি আবদুল ছোভানের সহিত রেয়াজুদ্দিনের প্রকৃত বন্ধুত্ব জন্মিয়া থাকে, তাহা হইলে একজনের নিমিত্ত অপর বন্ধু না বলিতে পারে, এমন কথাই নাই; না করিতে পারে, এমন কাৰ্য্যই নাই। ইহাই এই জগতের নিয়ম। এরূপ অবস্থায় আবদুল ছোভানের জবানবন্দী সম্বন্ধে বিবেচনা করিবার সময় আপনাদিগকে সবিশেষ সতর্কতার সহিত কার্য করিতে হইবে। 

“প্রধান দুইজন সাক্ষী সম্বন্ধে আমার যাহা কিছু বলিবার ছিল, তাহা আপনাদিগকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, এবং এখনও যাহা আপনাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া আবশ্যক, আমি সে বিষয়েও কোনরূপ কর্তব্য কর্ম্মের ত্রুটী করিব বলিয়া বোধ করি না। 

“এই দুইজন সাক্ষীর পরই বোধ হয়, বাড়ীওয়ালী নছিবনের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন। আপনারা তাহার কথা শ্রবণ করিয়াছেন, তাহার ভাবভঙ্গী স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছেন, এবং যৌবনকাল হইতে এই বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত যেরূপ ভাবে দিনপাত করিয়াছে, তাহাও সাক্ষীগণের জেরায় ও তাহার নিজের কথাতেই আপনারা উত্তমরূপে অবগত হইতে সমর্থ হইয়াছেন। এইরূপ হীনচরিত্রা ও অর্থ-পিশাচিনীর কথার উপর নির্ভর করিয়া যদি একজনকে চরমদণ্ডে দণ্ডিত করিতে আপনারা কৃতসঙ্কল্প হইয়া থাকেন, তাহা হইলে সে সম্বন্ধে আমার আর কিছুই বলিবার নাই। 

“রেয়াজুদ্দিন যে হত হয় নাই, এবং কোন ব্যক্তি যে তাহাকে হত্যা করে নাই, তাহা কিন্তু আমি বলিতেছি না। আমি বলিতেছি, চুরি করিবার অভিপ্রায়ে রেয়াজুদ্দিন অপর কর্তৃক হত হইয়াছে, এবং তাহার ফতুইয়ের পকেট হইতে বহুমূল্যের কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে। কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, আমরা এ পর্যন্ত তাহা অবগত হইতে পারি নাই সত্য; কিন্তু এ সম্বন্ধে আমি অনুসন্ধানকারী অনুচরবর্গের উপর কথঞ্চিৎ দোষারোপ না করিয়া থাকিতে পারি নাই। কারণ, বিশেষরূপ পরিশ্রম ও যত্ন করিয়া অপরিচিত হতব্যক্তি যে কে, তাহা যখন কৰ্ম্মচারীগণ বাহির করিতে সমর্থ হইলেন, বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া নছিবন ও আবদুল ছোভানকে প্রাপ্ত হইয়া আপনাদিগের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিলেন; তখন সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারী যদি মনে করিতেন, তাহা হইলে মৃতব্যক্তির বাসস্থান কোথায়, তাহার আত্মীয়স্বজন কে কে আছে, তাহা কি বাহির করিতে পারিতেন না? তাহা যদি বাহির করিতে পারিতেন, তাহা হইলে বহুমূল্যের কি দ্রব্য তাঁহার নিকট ছিল, তাহাও অনায়াসে জানিতে পারিতেন। এরূপ হইলে প্রণয়ের তুফান তুলিয়া এই হতভাগ্যের সর্ব্বনাশ সাধন করিতে কখনই অগ্রসর হইতে সাহসী হইতেন না। 

“আমার মনে যে বিশ্বাস, আপনাদিগের হৃদয়েও যদি সেই বিশ্বাস স্থান পায়, অর্থাৎ চুরির অভিপ্রায়েই এই হত্যাকাণ্ড সাধিত হইয়াছে, তাহা যদি আপনারা বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে আপনাদিগকে মুক্তকণ্ঠে বলিতে হইবে যে, আপনাদিগের সম্মুখবর্তী ঐ হতভাগ্য ব্যক্তি দ্বারা তাহা কখনই হয় নাই। 

“সর্ব্বশেষে আমার এই নিবেদন যে, আপনারা ভালরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া এই মোকদ্দমায় মতামত প্রকাশ করিবেন। কারণ, আপনাদিগের মতামতের উপরই একজনের মরণ বাঁচন নির্ভর করিতেছে।” 

এই বলিয়া আসামীর পক্ষ-সমর্থনকারী কৌন্সলি মহাশয় উপবেশন করিলে জুরিদিগকে যাহা কিছু জজসাহেবের বক্তব্য ছিল, তাহা তিনি সংক্ষেপে বর্ণন করিলেন। জজসাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া, সেই সময় যাঁহারা সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই কহিলেন, “প্রকারান্তরে জজসাহেব আসামী-পক্ষীয় কৌন্সলির পক্ষই বিলক্ষণ সমর্থন করিলেন।” যাহা হউক, জজসাহেবের যাহা কিছু বক্তব্য ছিল, তাহা শেষ হইয়া গেল। জুরিগণ সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া কহিলেন, “আমাদিগের বিবেচনায় বর্ত্তমান আসামী হত্যাপরাধে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ।” 

জুরিগণের এই কথা শ্রবণ করিয়া জজসাহেব আসামীকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি প্রদান করিলেন। আসামী আবদুল হাই জজসাহেবকে বার বার ধন্যবাদ দিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

তাঁহার নিমিত্ত এইরূপে অজস্র অর্থ ব্যয় করিয়া কে তাঁহাকে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার করিল, তাহা কিন্তু তিনি এখন পর্যন্তও অবগত হইতে পারিলেন না। 

বিনাদণ্ডে আবদুল হাই নিষ্কৃতি পাইল বলিয়া তাঁহার ও তাঁহার আত্মীয়স্বজনের মনে যে কতদূর আনন্দের উদয় হইল, তাহা পাঠকগণ সহজেই অনুমান করিতে পারিবেন। কিন্তু সেই সময় আমাদিগের মনের গতি যে কিরূপ হইল, তাহা আপনারা অনুমান করিতে পারেন কি? যদি না পারেন, তাহা হইলে আমাদিগের নিজের কথা আমরা নিজেই বলিয়া দি, আপনারা জানিয়া লউন। 

আমাদিগের এত যত্ন, এত কষ্ট ও এত পরিশ্রম সকলই বিফল হইয়া গেল। আমরা আবদুল হাইকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলাইতে পারিলাম না বলিয়া আমাদিগের মনে নিতান্তই ক্ষোভের উদয় হইল। অগত্যা আমরা বিষণ্নমনে বিচারালয় হইতে বহির্গত হইয়া, মনে মনে জুরি প্রথার উপর সহস্র গালি দিতে দিতে আপন আপন স্থানে চলিয়া আসিলাম। আমরা সম্মুখে যাঁহাকে দেখিলাম, তখনই তাঁহাকে কহিলাম, “বর্তমান জুরিপ্রথা যে পর্য্যন্ত উঠিয়া না যাইবে, সেই পর্য্যন্ত কোনরূপেই সুবিচার হইবে না, এবং দোষীগণ কোনরূপেই দণ্ডিত হইবে না।” 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

রেয়াজুদ্দিন আবদুল হাই কর্তৃক হত হউন বা না হউন, কিন্তু যিনি তাঁহার প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার মনস্কামনা পূর্ণ হইল। তাঁহার কণ্টকাকীর্ণ পথ একবারে নিষ্কণ্টক হইয়া গেল। 

এই গোলযোগ মিটিয়া যাইবার কিছুদিবস পরে বৃদ্ধ আশানুল্লা একদিবস অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া তাঁহার কন্যা করিমন-নেসাকে আপনার সম্মুখে ডাকাইয়া আনিলেন, এবং স্পষ্টই তাহাকে কহিলেন, “দেখ করিমন! তুমি এখন বড় হইয়াছ, আর অনেক দিবস হইতে তোমার বিবাহের বয়সও হইয়াছে; কিন্তু সাংসারিক ও মানসিক নানাকারণে আমি এ পর্যন্ত তোমার বিবাহ দিতে সমর্থ হই নাই। এখন সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া গিয়াছে। অথচ আমি নিজে আমার হৃৎপিণ্ডের পীড়ার নিমিত্ত এতদিবস পর্য্যন্ত যে কষ্টভোগ করিয়া আসিতেছি, তাহারও কিছুমাত্র উপশম হইতেছে না, এবং দিন দিন বৃদ্ধিই হইতেছে। সুতরাং কোন্ সময়ে যে আমার মৃত্যু হইবে, তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। এরূপ অবস্থায় এখন তোমার বিবাহ দেওয়া আমার নিতান্ত কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে। আমি মনে মনে স্থির করিয়াছি যে, দুই চারি দিবসের মধ্যেই তোমার বিবাহ কার্য্য শেষ করিয়া দিব; কিন্তু তোমার বিবাহ হইবার পূর্ব্বে তোমার একটি বিষয় অবগত হওয়া কৰ্ত্তব্য। কারণ, যখন তুমি বড় হইয়াছ, তখন সেই বিষয়ে তোমার মতামত জানিয়া আমারও সেই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা উচিত। এই বিবেচনা করিয়া অদ্য আমি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। তুমি কন্যা, আমি পিতা হইয়াও যখন তোমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তখন লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া তোমারও সেই বিষয়ের উত্তর প্রদান করা কর্ত্তব্য। আর নিতান্তই যদি আমার সম্মুখে আমার প্রস্তাবিত বিষয়ের উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ না হও; অথচ আমার প্রস্তাবিত বিষয় যদি তোমার অভিমত না হয়, তাহা হইলে পরিচারিকা দ্বারা এ সংবাদ আমাকে প্রেরণ করিও। কারণ, তোমার অনভিমতে আমি এ বিষয়ে হস্তার্পণ করিতে চাহি না। 

“আমার প্রস্তাবিত বিষয় আর কিছুই নহে। যে আবদুল হাই শৈশবকাল হইতে তোমার সহিত একত্র খেলা করিয়া আসিতেছে, এবং হত্যাপরাধে অভিযুক্ত হইলে যাহার উদ্ধারের নিমিত্ত তুমি আমাকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিয়াছিলে, আর সেই মোকদ্দমা হইতে যাহাকে উদ্ধার করিবার নিমিত্ত আমাকে অজস্রমুদ্রা ব্যয় করিতে হইয়াছে, সেই আবদুল হাইয়ের হস্তে আমি তোমাকে অর্পণ করিতে বাসনা করি। আবদুল হাই যদিও নিতান্ত দরিদ্র, তোমার ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্ব্বাহ করিবার ক্ষমতা তাহার নাই; তথাপিও আমি তাহার হস্তে তোমাকে অর্পণ করিতে মনস্থ করিয়াছি। কারণ, একমাত্র কন্যা তুমি ব্যতিরেকে আমার আর কেহই নাই। সুতরাং আমার এই অগাধ সম্পত্তি তোমাকে ও তোমার সহিত পরিণয় হইলে আবদুল হাইকে অর্পণ করিয়া যাইব—মনস্থ করিয়াছি। আবদুল হাই এখন কপৰ্দ্দক শূন্য হইলেও পরিশেষে যে তোমাকে অর্থ কষ্ট সহ্য করিতে হইবে, তাহা আমার বোধ হয় না।” 

যে সময় বৃদ্ধ আশানুল্লা করিমন-নেসাকে এই সকল কথা বলিতেছিলেন, সেই সময়ে করিমন নিতান্ত লজ্জিতা হইয়া অধোবদনে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া কোন গতিতে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার উপায় অনুসন্ধান করিতেছিলেন; কিন্তু কোনরূপেই পলায়নের সুযোগ পাইতেছিলেন না। বৃদ্ধের কথা যেমন শেষ হইল, অমনি সুযোগ পাইয়া করিমন—নেসা পিতাকে কহিলেন, “আমি আসিতেছি”। এই বলিয়া করিমন অধোবদনে সেইস্থান হইতে স্থানান্তরে প্রস্থান করিলেন। আর বৃদ্ধের সম্মুখে আগমন করিলেন না। কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত বৃদ্ধ কন্যার অপেক্ষা করিলেন, কিন্তু যখন দেখিলেন, তিনি আর তাহার সম্মুখে আগমন করিলেন না, তখন বুঝিতে পারিলেন যে, করিমন তাহার বিবাহের কথা শুনিয়া অতিশয় লজ্জিতা হইয়াছেন বলিয়া, তাঁহার সম্মুখে আর আগমন করিতে পারিলেন না। মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া বৃদ্ধ আশানুল্লা অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া বাহির বাটীতে গমন করিলেন। 

করিমনকে বৃদ্ধ আশানুল্লা আর কোন কথা বলিলেন না। পরিচারিকা দ্বারা কোনরূপ সংবাদ প্রদান করে কি না, দুই চারি দিবস তাহারই নিমিত্ত অপেক্ষা করিলেন। যখন দেখিলেন, করিমন নিজেও কোন কথা বলিলেন না, এবং পরিচারিকা দ্বারাও কোনরূপ সংবাদ প্রেরণ করিলেন না। তখন বুঝিলেন, এ বিবাহে করিমনের অমত নাই; বরং সম্পূর্ণরূপেই মত থাকিবার সম্ভাবনা। 

বৃদ্ধ যাহা ভাবিয়াছিলেন, করিমন-নেসার মনের ভাব বাস্তবিক তাহাই হইয়াছিল। পূৰ্ব্ব হইতেই তাহার হৃদয়ে প্রণয়ের বীজ অঙ্কুরিত হইয়াছিল, মনে মনে তিনি আবদুল হাইকে পতিত্বে বরণ করিয়াছিলেন; কিন্তু ভয়ানক লজ্জার অনুরোধে, একথা তিনি কাহারও নিকট প্রকাশ করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। এখন পিতার মনের ভাব জানিতে পারিয়া, তাঁহার আর আনন্দের সীমা রহিল না। কখন এই শুভকাৰ্য্য সম্পন্ন হইবে, দিবানিশি তাহাই ভাবিতে ভাবিতে করিমন দিনযাপন করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে ক্রমে আরও দুই চারি দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, একদিবস বৃদ্ধ আশানুল্লা তাঁ—মনের কথা আবদুল হাইকে কহিলেন। দরিদ্র আবদুল যে সেই প্রস্তাবে অসম্মত হইবেন না, তাহা বৃদ্ধ আশানুল্ল।।বলক্ষণ জানিতেন। আবদুল হাই সে বিষয়ে সম্মত হইলেন, এবং সেইদিবস হইতে দিবারাত্রি বৃদ্ধের বাড়ীতেই বাস করিতে লাগিল। 

হত্যাপরাধে যে অভিযুক্ত হইয়াছিল, সেই দরিদ্র আবদুল হাইয়ের সহিত ধনবান বৃদ্ধ আশানুল্লা আপনার একমাত্র কন্যা করিমন-নেসার বিবাহের সম্বন্ধে যে কেন করিলেন, তাহা আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। পাঠকগণের মধ্যে কাহারও ততদূর বিবেচনা করিবার ক্ষমতা আছে কি না, তাহাও জানি না। যে ব্যক্তি একবার হত্যাপরাধে অভিযুক্ত হইয়াছিল, এবং সেই অপরাধে দণ্ডিত না হইলেও তাহার দ্বারা যে সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছিল, সেই সম্বন্ধে আমাদিগের ও আপামর সাধারণের মনে কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না, সেই ব্যক্তির চরিত্র কি ভয়ানক! যে ব্যক্তি স্বহস্তে নরহত্যা করিতে পারে, তাহার দ্বারা না হইতে পারে—এরূপ কোন দুষ্কর্ম্ম এ জগতে নাই!! এরূপ অবস্থায় ধনবান্ বৃদ্ধ আশানুল্লা কেন যে সেই নরঘাতকের হস্তে আপন কন্যাকে অর্পণ করিতেছেন, তাহা তিনিই বলিতে পারেন। যদি বৃদ্ধের অবস্থা মন্দ হইত, বা করিমন-নেসাকে বিবাহ করিতে যদি কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান প্রস্তুত না থাকিতেন, তাহা হইলে আমরা কোন প্রকারে বৃদ্ধের উপর দোষারোপ করিতে সমর্থ হইতাম না। 

আমরা যে যাহাই মনে করি, বৃদ্ধ আশানুল্লা কিন্তু তাহা মনে করিলেন না; তিনি তাঁহার প্রস্তাবিত শুভকার্য সম্পন্ন করিলেন। দেখিলেন, এই বিবাহে তিনি যেমন সুখী হইয়াছেন, তাঁহার কন্যা তদপেক্ষা আরও সুখানুভব করিতেছেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

আবদুল হাই ও করিমন-নেসার বিবাহ হইবার পর প্রায় এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। তাঁহারা উভয়েই এখন বৃদ্ধ আশানুল্লার বাড়ীতে থাকিয়া মনের সুখে দিনযাপন করিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ আশানুল্লাও তাঁহাদিগের সুখে সুখী হইয়া দিনপাত করিতে লাগিলেন সত্য; কিন্তু তাঁহার হৃৎপিণ্ডের যে পীড়া ছিল, তাহা ক্রমেই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতে লাগিল। 

পূর্ব্ববর্ণিত ঘটনার প্রায় দেড় বৎসর পরে একদিবস সংবাদ আসিল যে, বিশিষ্ট সন্দেহজনক অবস্থায় জনৈক মুসলমানের মৃতদেহ তাহার গৃহের ভিতর পাওয়া গিয়াছে। সুতরাং এ বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত স্থানীয় পুলিসের সাহায্য করা আবশ্যক। 

সংবাদ পাইবামাত্র যে বাড়ীতে সেই মুসলমানের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। দেখিলাম সেই বাড়ী আমার পূর্ব্ব হইতেই পরিচিত। আর দেখিলাম, যাঁহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তিনিও পূৰ্ব্ব হইতে আমার নিকট পরিচিত, এবং পাঠকবর্গও তাঁহাকে উত্তমরূপে চিনেন। ইনি অপর আর কেহই নহেন, করিমন—নেসার পিতা সেই বৃদ্ধ আশানুল্লা। 

আমি যখন সেইস্থানে উপনীত হইলাম, তখন যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহের দরজা জানালাগুলি উন্মুক্ত অবস্থায় রহিয়াছে, এবং মৃতদেহ একখানি পালঙ্কের উপর স্থাপিত আছে। 

বস্ত্রাচ্ছাদিত মৃতদেহের বস্ত্র উন্মোচিত করিয়া দেখিবামাত্রই আমি সেই মৃতদেহ চিনিতে পারিলাম, উহা আমাদিগের পূর্ব্ব পরিচিত বৃদ্ধ আশানুল্লার মৃতদেহ। সেই মৃতদেহটি তখন উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কিন্তু কোন স্থানে এমন কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না, যাহা দেখিয়া বৃদ্ধের মৃত্যুর কারণ নির্ণয় হইতে পারে। 

যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, গত রজনীতে নিয়মিতরূপে আহারাদির পর বৃদ্ধ আসান শয়ন গৃহে আগমন করেন, এবং দরজা জানালা সকল ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া দিয়া নিয়মিতরূপ শয়ন করেন। যে গৃহে তিনি শয়ন করিতেন, রাত্রিকালে সেই ঘরে আর কেহই থাকিত না; বৃদ্ধ একাকীই সেই গৃহে রাত্রি যাপন করিতেন। প্রত্যহ প্রত্যূষে বৃদ্ধ শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিতেন, ও গৃহের দরজা খুলিয়া বাহিরে গমন করিতেন। 

অদ্য প্রত্যূষে সেই নিয়মের বিপর্য্যয় লক্ষিত হওয়ায়, জনৈক পরিচারিকা আসিয়া প্রথমে তাহাকে বাহির হইতে ডাকিল; কিন্তু বৃদ্ধের কোনরূপ উত্তর প্রাপ্ত না হইয়া তাহার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল; সুতরাং দ্বারে আঘাত করিয়া পুনরায় তাহাকে বার বার ডাকিতে লাগিল। কিন্তু তাহাতেও বৃদ্ধ কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলেন না। ক্রমে এই সংবাদ অন্তঃপুরের ভিতর প্রচার হইয়া পড়িল, এবং দেখিতে দেখিতে এই সংবাদ আবদুল হাই ও করিমন—নেসার কর্ণে গিয়া উপস্থিত হইল। 

এই সংবাদ পাইবামাত্র আবদুল হাই দ্রুতপদে আপন শ্বশুরের শয়ন-কক্ষের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও বৃদ্ধকে ডাকিতে ডাকিতে, বার বার গৃহদ্বারে আঘাত করিতে লাগিলেন। আবদুল হাইয়ের সেই চীৎকারেও বৃদ্ধ কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলেন না; কিন্তু তাঁহার পুরাতন দরজা আবদুল হাইয়ের সেই সবল আঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া উন্মোচিত হইয়া গেল। আবদুল হাই দেখিলেন যে, যে খিল দ্বারা সেই দরজা ভিতর হইতে বদ্ধ ছিল, সেই খিল ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় উক্ত দরজা খুলিয়া গিয়াছে। 

অপরাপর লোকজনের মধ্যে সেই সময়ে যাঁহারা সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগকে সঙ্গে লইয়া আবদুল হাই সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন, ও দ্রুতগতি বৃদ্ধের পালঙ্কের নিকট গমন করিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার বুদ্ধি লোপ পাইয়া গেল। দেখিলেন,—বৃদ্ধ মৃতাবস্থায় পালঙ্কের উপর পড়িয়া আছেন! 

এই ব্যাপার দেখিয়া কি করা কর্তব্য, এবং কি কারণেই বা বৃদ্ধ আশানুল্লার মৃত্যু হইল, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিলেন। 

সংবাদ পাইয়া পুলিসও আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং পালঙ্কের উপরেই মৃতদেহ দেখিতে পাইলেন; কিন্তু মৃত্যুর কারণ কিছুই অনুমান করিতে পারা যাইতেছে না। গৃহের অবস্থা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখা হইয়াছে, বাহির হইতে কোন লোক গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে বা গৃহ হইতে কোন লোক বাহিরে গমন করিয়াছে, এমন কোন নিদর্শন এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। বৃদ্ধ আশানুল্লা অপর কোন ব্যক্তি কর্তৃক হত হইলেন, কি আত্মহত্যা করিলেন, অথবা কোনরূপ পীড়া হইয়া তাঁহার মৃত্যু হইল, তাহার কিছুমাত্র এ পর্য্যন্ত স্থির করিয়া উঠিতে পারা যাইতেছে না। 

কর্মচারী মহাশয়ের নিকট হইতে এইরূপ ঘটনা জানিয়া আমি কহিলাম, “এই বৃদ্ধকে আমি অনেক দিন পূৰ্ব্ব হইতে জানি। কিন্তু সত্য মিথ্যা বলিতে পারি না, সেই সময়ে আমি শুনিয়াছিলাম, সেই বৃদ্ধ মধ্যে মধ্যে হৃৎপিণ্ড রোগে আক্রান্ত হইতেন। একথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে বৃদ্ধ স্বাভাবিক ভাবেই মরিয়াছেন। কিন্তু এই অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া অনুসন্ধান কার্য্যে একবারে বিরত হওয়া আমাদের এখন কর্তব্য নহে।” 

আমি আরও কহিলাম, “যে গৃহে বৃদ্ধ শয়ন করিতেন, এবং যে গৃহে তাঁহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহটি একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখা কর্তব্য। কারণ, যদি ইনি কোন অনিবাৰ্য্য কারণে আত্মহত্যা করিয়া থাকেন, তাহা হইলে কি কারণে আত্মহত্যা করিয়াছেন, তাহার কারণ দর্শাইয়া কোনরূপ পত্রাদি লিখিয়া রাখিলেও রাখিতে পারেন।” 

আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া কৰ্ম্মচারী আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। অপরাপর প্রয়োজনীয় কার্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া এবং বৃদ্ধের মৃতদেহ পরীক্ষার্থ ডেড্‌হাউসে পাঠাইয়া দিয়া, আবদুল হাইয়ের সম্মুখে বৃদ্ধের গৃহের ভিতর অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলেন। বলা বাহুল্য, সেই অনুসন্ধানে আমিও তাঁহার সাহায্য করিতে লাগিলাম। 

সেই গৃহের ভিতর একপার্শ্বে একটি টেবিল ছিল। আমরা প্রথমেই সেই টেবিলের উপর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু আমাদিগের প্রয়োজনীয় কোনরূপ কাগজ-পত্র দেখিতে পাইলাম না। 

সেই টেবিলের উপর একপার্শ্বে একটি কাষ্ঠের হাতবাক্স ছিল। দেখিলাম, উহা চাবি বদ্ধ। বৃদ্ধ আশানুল্লা যে শয্যায় শয়ন করিতেন, সেই শয্যার উপর একটি রিংয়ে কয়েকটি চাবি পাওয়া গিয়াছিল, উহার মধ্যস্থিত একটি চাবি দ্বারা সেই বাক্সটি খোলা গেল। 

সেই বাক্সের ভিতর অনেক কাগজপত্র ছিল, এক এক খানি করিয়া উহা আমরা বাক্স হইতে বাহির করিয়া পড়িয়া দেখিতে লাগিলাম। এইরূপ কতকগুলি কাগজ বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করিবার পর দেখিতে পাইলাম যে, সেই বাক্সের ভিতর দুইখানি বড় লেফাফা রহিয়াছে, দুই খানিই বাক্স হইতে বাহির করিলাম। দেখিলাম, উহা গালা দিয়া উত্তমরূপে আবদ্ধ, এবং তাহার উপর শীলমোহর করা আছে। উহার একখানির উপর লেখা আছে “উইল”। অপর খানির উপর লেখা আছে “গোপনীয়। আবদুল হাই বা করিমন-নেসার নিমিত্ত।” সেই দুইখানি লেফাফা দেখিয়াই ভাবিলাম যে, ইহার ভিতর যাহা কিছু আছে, তাহা দেখিলেই বৃদ্ধের মৃত্যুর কারণ নির্ণয় হইবার খুব সম্ভাবনা। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যে লেফাফার উপর “উইল” বলিয়া লেখা ছিল, আমি সৰ্ব্বসমক্ষে প্রথমে সেইখানিই খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, উহা বৃদ্ধ আশানুল্লার লিখিত প্রকৃতই একখানি উইল, এবং তাহার সহিত বৃদ্ধের স্থাবর ও অস্থাবর সমস্ত বিষয় সম্পত্তির একখানি তালিকা। 

এইস্থানে বৃদ্ধের যে সমস্ত বিষয় আছে, সকলেই এমন কি আবদুল হাই ও করিমন-নেসা পর্য্যন্ত কেবল তাহাই জানিতেন। এই সকল বিষয় সম্পত্তির নিমিত্তই বৃদ্ধ আশানুল্লা এইস্থানে একজন ধনবান ব্যক্তির মধ্যে পরিগণিত ছিলেন। উইলে লিখিত বিষয়ের তালিকা দেখিয়া এখন সকলেই বিস্ময়ান্বিত হইলেন; তাঁহার স্বোপার্জ্জিত এ প্রদেশীয় বিষয় অপেক্ষা তাঁহার পূর্ব্ববঙ্গস্থিত পৈত্রিক সম্পত্তির মূল্যই অধিক। 

পূর্ব্ববঙ্গে তাঁহার যে অগাধ সম্পত্তি আছে, একথা ইতিপূর্ব্বে কাহারও নিকট কেন যে তিনি প্রকাশ করেন নাই, তাহা বলা যায় না। যাহা হউক, অতঃপর সকলেই জানিতে পারিলেন, দেশে ও বিদেশে অগাধ সম্পত্তি রাখিয়া বৃদ্ধ আশানুল্লা ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন। সেই উইল দেখিয়া সকলে আরও অবগত হইলেন যে, তাঁহার সমস্ত বিষয়ের তিন-চতুর্থাংশ কন্যা করিমন-নেসা, এবং এক-চতুর্থাংশ আবদুল হাই প্রাপ্ত হইয়াছেন। 

উক্ত উইল পাঠ সমাপ্ত হইলে, করিমন-নেসার মতানুসারে কেবলমাত্র আবদুল হাইয়ের সম্মুখে অপর লেফাফার ভিতরস্থিত কাগজগুলি বাহির করিয়া পাঠ করিলাম। 

তাহাতে যে সকল বিষয় লিখিত ছিল, তাহা পাঠ করিতে করিতে আমার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। তখন আমার মনের ভিতর এক ভয়ানক ভাবের উদয় হওয়ায়, আমার সমস্ত শরীর কাঁপিতে লাগিল। ক্ষণকালের নিমিত্ত আমি যেন জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িলাম। আমার ন্যায় আবদুল হাইয়েরও ঠিক সেইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল। যাহা হউক, পরিশেষে অনেক কষ্টে উহার শেষ পর্যন্ত পাঠ করিয়াছিলাম। পাঠকগণ যদি জানিতে চাহেন, তাহা হইলে উহার সারাংশ নিম্নে প্রদত্ত হইল। পাঠ করিলেই বুঝিতে পারিবেন যে, আমরা বুঝিতে না পারিয়া সময় সময় কিরূপ ভয়ানক কার্য্য সকল করিয়া ফেলি। উহাতে লেখা ছিল :—

“প্রিয় কন্যা করিমন! অতি শৈশবকাল হইতে তুমি আমা কর্তৃক লালিত পালিত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়াছ, সুতরাং তোমার বংশ সম্বন্ধীয় কোন কথাই তুমি অবগত নহ। কারণ, এ পর্য্যন্ত কোন কথাই আমি তোমার নিকট প্রকাশ করি নাই, এবং আমি ভিন্ন আর কেহই তাহা অবগত নহে। এ সম্বন্ধে তোমাকে অন্ধকারে রাখা আমার কর্তব্য নহে বিবেচনা করিয়া, এখন আমি তাহা প্রকাশ করিয়া যাইতেছি। আমার মৃত্যুর পরে যখন তুমি এই সকল অবস্থা জানিতে পারিবে, তখন ইচ্ছা হয় তুমি ইহা গোপন রাখিও, ইচ্ছা না হয় প্রকাশ করিও, তাহাতে আমার কোনরূপ আপত্তি নাই। 

“পূর্ব্ববঙ্গের কোন এক প্রধান নগরীতে জনৈক বৰ্দ্ধিষ্ণু মুসলমানের গৃহে আমার জন্ম হয়। যে সময় আমার পিতা পরলোক গমন করেন, সেই সময় তাঁহার উত্তরাধিকারীর মধ্যে কেবলমাত্র আমাকেই রাখিয়া যান। পিতার মৃত্যুর বহু দিবস পূর্ব্বে আমার মাতা ইহজীবন ত্যাগ করিয়াছিলেন। পিতার মৃত্যুর সময় আমার বয়ঃক্রম বিংশতি বর্ষের অধিক ছিল না। সে সময় আমার বিবাহ হয় নাই, জানি না, মুসলমান পুত্রকে পিতা এত দিবস পর্য্যন্ত কেন অবিবাহিত রাখিয়াছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর আমি দেখিলাম যে, আমাকে তিনি অগাধ জমিদারীর অধীশ্বর করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। পিতার অবর্তমানে আমি জমিদার হইলাম সত্য, কিন্তু জমিদারীর কোন কার্য্য আমাকে দেখিতে হইল না; পুরাতন ও বিশ্বস্ত কর্ম্মচারীগণ তাহা সুচারুরূপে নির্ব্বাহ করিতে লাগিল। 

“আমি যৌবন-সুলভ আমোদে মত্ত হইয়া দিনযাপন করিতে লাগিলাম। এই সময় আমি একটি কুহকিনীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া তাহার প্রণয়ে আসক্ত হইয়া পড়িলাম। সেই পিশাচিনী সেই সময়ে বিধবা হইলেও তাহাকে ভদ্রবংশ-সম্ভূত বলিয়া আমার বিশ্বাস ছিল। তাহার রূপে আমি এতই মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, আমাদিগের ধর্ম্মানুযায়ী তাহাকে নিকা না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। সেই পিশাচিনীর নাম হালিমন-নেসা। তাহার উপর আমি এতই আসক্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, নিকার পূর্ব্বে সে আমাকে যাহা বলিল, তাহাই করিলাম; এমন কি “সেন-মোহরের” নিমিত্ত আমার পৈত্রিক সমস্ত জমিদারী তাহাকে লিখিয়া দিলাম। তদ্ব্যতীত আরও কয়েক সহস্র মুদ্রা প্রদান করিব বলিয়া তাহার নিকট প্রতিশ্রুত রহিলাম। 

“সেই পিশাচিনী হালিমন-নেসাই তোমার জননী। তোমার জন্মিবার কয়েক বৎসর পরেই, সে সতীত্বে জলাঞ্জলি দিয়া কোরবান আলী নামক একজন হাকিমের সহিত আমার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়। পিশাচিনী সেই সময় যদি কোন দূরবর্তী স্থানে চলিনা যাইত, তাহা হইলে তোমাকে লইয়া আমাকে দেশত্যাগী হইতে হইত না। দূরে যাওয়া পরের কথা, কিছুদিবস পর্য্যও সে কোরবান আলির গৃহে গুপ্তভাবে বাস করিল, ও পরিশেষে যে গ্রামে আমার বাসস্থান, সেই গ্রামে প্রকাশ্য বাজারে বাস করিতে লাগিল। এই নিদারুণ অপমান আমি কোনরূপেই সহ্য করিতে না পারিয়া, বিশ্বস্ত কর্মচারীর হস্তে জমিদারীর ভার অর্পণ করতঃ তোমাকে লইয়া এইস্থানে আগমন করিলাম, এবং সেই সময় হইতে আমি এইস্থানে বাস করিতে লাগিলাম! 

“আমার পূর্ব্ববঙ্গের জমিদারী হইতে টাকা আসিতে লাগিল। তাহা দ্বারা এইস্থানে আমি একটি ব্যবসা আরম্ভ করিলাম। উক্ত ব্যবসায়ে আমার দিন দিন উন্নতি হইতে লাগিল। এইস্থানে আমার যে সকল বিষয় দেখিতেছ, সকলই আমার সেই ব্যবসার ফল। 

“বলিতে লজ্জা হয়, সেই পিশাচিনীকে হত্যা করিয়া তাহার কলঙ্কের প্রতিশোধ লইব, প্রথমে মনে করিয়াছিলাম। কিন্তু একে স্ত্রীহত্যা মহাপাপ, তাহাতে যাহার সহিত বহুদিবস একত্র সহবাস করিয়াছি, তাহাকে হত্যা করিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না। সুতরাং আমাকেই দেশ পরিত্যাগ করিতে হইল। 

“যে সময় হালিমন আমাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়, সেই সময় সে অলঙ্কার-পত্রে ও নগদ মুদ্রায় বিস্তর অর্থ লইয়া গিয়াছিল। তদ্ব্যতীত যে কাগজে “সেনমোহর” লেখাপড়া হইয়াছিল, তাহাও তাহার সঙ্গে ছিল। 

“আমার এইস্থানে আসিবার কয়েক বৎসর পরই হাকিম কোরবান আলির মৃত্যু হয়। তাহার মৃত্যুর পর হালিমন কাহার নিকট এবং কোথায় ছিল, অনেক দিবস পর্য্যন্ত তাহার ঠিক সংবাদ প্রাপ্ত হই নাই। কেহ বলিল, সে মরিয়া গিয়াছে; কেহ বলিল, সে স্থানান্তরে গমন করিয়াছে। 

“যে সময় আবদুল হাই হত্যাপরাধে ধৃত হয়, তাহার কয়েক মাস পূর্ব্বে তোমার সহিত তাহার বিবাহ দিবার সঙ্কল্প করিয়া তাহারই উদ্যোগ করিতেছিলাম, এমন সময় একদিবস রেয়াজুদ্দিন নামক এক ব্যক্তি হঠাৎ আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হয়। যে রেয়াজুদ্দিনের কথা আমি বলিতেছি, তাহাকে বোধ হয় তুমি চিনিতে পারিয়াছ। যে রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করা অপরাধে আবদুল হাই অভিযুক্ত হইয়াছিল, ইনি সেই রেয়াজুদ্দিন। 

“রেয়াজুদ্দিন আমার সহিত নির্জ্জনে সাক্ষাৎ করিয়া আমাকে কহিল, ‘আমি শুনিয়াছি যে, করিমন-নেসা নাম্নী আপনার একটি সুন্দরী কন্যা আছে। আরও শুনিয়াছি যে, আবদুল হাই নামক এক ব্যক্তির সহিত আপনি তাহার বিবাহ দিতে মনস্থ করিয়াছেন, এই নিমিত্তই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আবদুল হাইয়ের সহিত করিমন—নেসার বিবাহ না দিয়া, আমার সহিত তাহার বিবাহ দিন।’ 

“রেয়াজুদ্দিনের কথার উত্তরে আমি তাহাকে কহিলাম, ‘তুমি আমার নিকট পরিচিত নহে। সুতরাং তোমার হস্তে আমি আমার কন্যাকে কখনই অর্পণ করিতে পারি না।’ 

“আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া রেয়াজুদ্দিন নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িল, এবং ক্রোধভরে আমাকে কহিল, ‘আমার প্রস্তাবে যদি তুমি সম্মত না হও, তাহা হইলে নিশ্চিত জানিও, আমা হইতেই তোমার সর্ব্বনাশ হইবে! তোমার পত্নী হালিমন-নেসা আমার অনুগতা হইয়া এখন আমারই অধীনে বাস করিতেছে। যে জমিদারীর নিমিত্ত তুমি বড় মানুষ হইয়াছ, সেই জমিদারী এখন আর তোমার নহে, ইহা তোমার স্মরণ হয় কি? বিবাহের সময় সেই সমস্ত জমিদারী তুমি তোমার স্ত্রী হালিমন-নেসার “সেনমোহরে” লিখিয়া দিয়াছ, তাহা তোমার এখন স্মরণ নাই কি? সেই সেনমোহরের সমস্ত কাগজ-পত্র এখন আমার হস্তগত হইয়াছে। এই নিমিত্ত বলিতেছি, এখনও তুমি আমার প্রস্তাবে সম্মত হও, নতুবা হালিমন-নেসাকে দিয়া নালিস করাইয়া তোমার সমস্ত সম্পত্তি দখল করিয়া লইব। তখন দেখিবে, তোমার জমিদারীর জমিদার কে হয়?” 

“রেয়াজুদ্দিনের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে হইল, “সেনমোহরের” কাগজ-পত্র প্রভৃতি কিছুই ইহার হস্তগত হয় নাই। আমাকে ভয় প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত সে এইরূপ বলিতেছে। এই ভাবিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, ‘সেনমোহরের” কাগজ-পত্রগুলি যদি তুমি আমাকে দেখাইতে পার, এবং হালিমন-নেসা যে এখনও জীবিতা আছে, তাহা যদি প্রমাণ করিতে সমর্থ হও, তাহা হইলে তোমার প্রস্তাবিত বিষয়ে বিবেচনা করিতে পারি। 

“আমার কথা শ্রবণ করিয়া রেয়াজুদ্দিন তাহার পরিহিত চাপকান ও কামিজের নিম্নস্থিত একটি ফতুইয়ের পকেট হইতে একতাড়া কাগজ বাহির করিয়া একটুদূর হইতে আমাকে দেখাইল। কিন্তু সেই কাগজগুলি আমার হস্তে প্রদান করিল না। সেই কাগজগুলি দেখিবামাত্রই আমি চিনিতে পারিলাম, উহা প্রকৃতই আমার লিখিত “সেনমোহরের” কাগজ। 

“সেই কাগজগুলি আমাকে দেখাইয়া পুনরায় রেয়াজুদ্দিন উহা তাহার ফতুইয়ের পকেটে রাখিয়া দিল, এবং পরিশেষে আমাকে কহিল, ‘হালিমন-নেসা এখনও জীবিতা আছে কি না, তাহার আর প্রমাণ কি করিব? তুমি আমার সহিত আগমন কর, তাহা হইলে স্বচক্ষে তুমি তোমার হালিমন-নেসাকে দেখিতে পাইবে।’ 

রেয়াজুদ্দিনের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না; দুইজন দ্বারবান সঙ্গে লইয়া তখনই আমি তাহার সহিত গমন করিলাম। সে আমাকে একটি গৃহের ভিতর লইয়া গেল। দেখিলাম,—সেই গৃহের ভিতর একটি শীর্ণকার স্ত্রীলোক শয়ন করিয়া রহিয়াছে। অনেক দিবস পরে যদি আমি তাহাকে দেখিলাম, তথাপি দেখিবামাত্রই তাহাকে চিনিতে পারিলাম, এবং হালিমন বলিয়া তাহাকে ডাকিলাম। আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া সে যেমন আমার দিকে তাকাইল, অমনি আমি সেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম 

“এইরূপ অবস্থায় পড়িয়া আমার মনে যে কিরূপ কষ্টের উদয় হইল, তাহা আর কি বলিব? তখন আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া, সৎ উপায়েই হউক বা অসৎ উপায়েই হউক, কোনরূপে সেই কাগজগুলি হস্তগত করিবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলাম। একদিবস রেয়াজুদ্দিন আসিয়া পুনরায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিল। সেইদিবস আমি মিষ্টকথায় তাহাকে তুষ্ট করিয়া, আপাততঃ খরচ পত্রের নিমিত্ত তাহাকে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলাম। যাইবার সময় বলিয়া দিলাম, ‘তোমার বিবাহের সম্বন্ধে আমি বিশেষরূপ বিবেচনা করিব।’ 

“পরিশেষে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া আমি জানিতে পারিলাম, যে কাগজ-পত্রের বলে রেয়াজুদ্দিন আমার সর্ব্বনাশ করিতে বসিয়াছে, সেই কাগজ-পত্র সর্ব্বদাই আপনার সঙ্গে রাখে। এরূপ অবস্থায় অন্য কোন উপায় অবলম্বন করিলে সেই কাগজগুলি সংজে হস্তগত করিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। সুতরাং নিজ মানসম্ভ্রম ও বংশ মর্যাদা প্রভৃতি রক্ষা করিবার নিমিত্ত আমাকে মহাপাপ সংগ্রহ করিতে হইবে। পরচুল প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়া সেই বৃদ্ধবয়সে যুবা সাজিয়া, রাত্রিকালে আমি রেয়াজুদ্দিনের অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। এইরূপ দুই চারি দিবস তাহার অনুসন্ধান করিতে করিতে একদিবস উপযুক্ত সুযোগ জুটিয়া গেল। দিবাভাগে সে কোন স্থানে সুরাপান করিয়াছিল, রাত্রি হইলেও সে নেশা দূর হইল না। নেশার ঝোঁকে রাত্রিকালে সে একটি হোটেলের ভিতর প্রবেশ করিল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই হোটেলের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহার নিকট উপবেশন করিলাম, এবং তাহাকে অধিক পরিমিত সুরা পান করাইয়া তাহাকে একরূপ অচেতন করাইলাম। নিয়মিত সময়ে হোটেল বন্ধ হইয়া গেল; সুতরাং আমাদিগকেও হোটেল পরিত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিতে হইল। পথে আসিয়া একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাকে সেই গাড়িতে উঠাইয়া দিলাম, আমিও তাঁহার সঙ্গে সেই গাড়িতে আরোহণ করিলাম। সুযোগ পাইলেই উহাকে হত্যা করিয়া আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিব, এই অভিপ্রায়ে পূৰ্ব্ব হইতেই একশিশি হাইড্রোসেনিক এসিড (তেজস্কর বিষ) সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলাম। আজ সুযোগ পাইয়া গাড়ির ভিতরে রুমাল দ্বারা উহার হস্তদ্বয় উত্তমরূপে বাঁধিলাম, এবং পকেট হইতে বিয়ের শিশি বাহির করিয়া সবলে উহাকে পান করাইলাম। রেয়াজুদ্দিন একে নেশায় অত্যন্ত বিভোর ছিল, তাহার উপর এই ভয়ানক বিষ উদরস্থ হইবামাত্র ইহজীবন পরিত্যাগ করিল। আমিও উহার ফতুইয়ের পকেট ছিঁড়িয়া কাগজগুলি আত্মসাৎ পূর্ব্বক নিঃশব্দে দ্রুত চলিত গাড়ি হইতে লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক প্রস্থান করিলাম। গাড়িবান যে হীরার আংটার কথা বলিয়াছিল, তাহা প্রকৃত। সর্ব্বদা যে হীরার আংটা আমি ব্যবহার করিতাম, সেই সময়েও উহা আমার অঙ্গুলিতে ছিল। 

“এইরূপে আমি একাকী এই ভয়ানক নরহত্যা সাধন করিয়া আপন বাটীতে প্রত্যাগমন করিলাম, এবং তৎক্ষণাৎ সেই কাগজগুলি ভস্মে পরিণত করিয়া ফেলিলাম।” 

“জানি না, এই ভয়ানক নরহত্যা-জনিত মহাপাপ করিয়া কেন আমি ধৃত হইলাম না; অথচ বিনাদোষে আবদুল হাই ধৃত হইয়া ভয়ানক অভিযোগে অভিযুক্ত হইল। আবদুল হাইকে বাঁচাইবার নিমিত্ত আমি যে কেন অজস্র অর্থ ব্যয় করিয়াছিলাম, তাহা তোমরা অনায়াসেই এখন বুঝিতে পারিবে। 

“যে সময় আবদুল হাই হত্যাপরাধে ধৃত হয়, সেই সময় তোমার পাপীয়সী জননী হালিমন-নেসা জীবিতা ছিল। কিন্তু তাহার কিছুদিবস পরে সেও ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। এ জগতে তোমাদিগের শত্রুর মধ্যে এখন কেহই বৰ্ত্তমান নাই। এখন আশীর্ব্বাদ করি, মনের সুখে তোমরা বিষয় সকল উপভোগ কর।” 

এই কাগজগুলি পাঠ শেষ হইলে বুঝিতে পারিলাম যে, আমরা বুঝিতে না পারিয়া সময় সময় কি ভয়ানক কাৰ্য্যই করিয়া থাকি। পূর্ব্ববর্ণিত হত্যাকাণ্ডে যদি আবদুল হাইয়ের দণ্ড হইত, তাহা হইলে কি সৰ্ব্বনাশ‍ই হইত!! 

[আষাঢ়, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *