অদ্ভুত-হত্যা

অদ্ভুত-হত্যা

প্রথম পরিচ্ছেদ 

শারদীয়া পূজার সময় প্রায় আশ্বিন মাস। সেই সময় গৃহস্থমাত্রেরই অর্থের প্রয়োজন হইয়া থাকে। ছোট, বড়, ধনী, দরিদ্র প্রভৃতি যিনি সংসারে যেরূপ স্থান অধিকার করিয়া আছেন, তাঁহার অর্থেরও সেই পরিমাণে প্রয়োজন হইয়া থাকে। এই সময় জুয়াচোরের জুয়াচুরি বাড়িয়া যায়। সংসারী লোকের অপেক্ষা চোর জুয়াচোরগণের খরচ, তাহাদিগের অবস্থা অনুযায়ী না হইয়া প্রায় অধিক হইয়া পড়ে; সুতরাং, ঐ সকল খরচের সংস্থান করিবার নিমিত্ত তাহারা যে কোন উপায় অবলম্বন করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হয় না। চুরি বলুন, ডাকাইতি বলুন, হত্যা বলুন, যাহা করিতে হয়, তাহা করিতেই তাহারা প্রস্তুত; কোন গতিকে অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারিলেই হইল। এই নিমিত্তই পূজার পূর্ব্বে হত্যা প্রভৃতি অপরাধের সংখ্যা এত অধিক দেখিতে পাওয়া যায়। 

এই সময় প্রায়ই একটি না একটি অদ্ভুত রকমের হত্যার সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। উহার ঘটনাবলী এরূপ অদ্ভুত ও বিস্ময়জনক যে, বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়াও সেই সকল হত্যার রহস্য সম্পূর্ণ রূপে সমুৎঘাটন করিতে সমর্থ হওয়া যায় না। সময় সময় দুই একটি হত্যার রহস্য সকল উদ্ঘাটিত হয় বটে, কিন্তু তাহার সংখ্যা নিতান্তই সামান্য। আজ কয়েক বৎসর অতীত হইল, এই আশ্বিন মাসে পূজার কিছুদিবস পূর্ব্বে একটি রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানের ভার আমার উপর পতিত হয়, ও ঈশ্বরের নিতান্ত অনুগ্রহে সেই মোকদ্দমার কিনারা হইয়াছিল। আজ সেই মোকদ্দমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে বিবৃত হইতেছে। 

এক দিবস অতিশয় প্রত্যূষে এক ব্যক্তি আসিয়া থানায় উপস্থিত হইল। যে থানায় আসিয়া সে উপস্থিত হইয়াছিল, সেই থানা সহরের অন্তর্গত নহে, সহরতলীর মধ্যে সংস্থাপিত। ভারতীয় পুলিস বিভাগের মধ্যে প্রায় সকল স্থানেই “প্রথম এতলা” চলিত আছে, তাহা পুলিস কর্ম্মচারীমাত্রেই অবগত আছেন। কিন্তু কলিকাতা প্রভৃতি বড় বড় রাজধানীতে ঐ “প্রথম এতলার” প্রয়োজন নাই। “প্রথম এতলা কি?” একথা পুলিস কর্মচারী ব্যতীত অপর পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন; সুতরাং, তাঁহাদিগের নিমিত্ত উহার একটু সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে দেওয়া আমার কর্তব্য। “প্রথম এতলা” বা “First Information” আর কিছুই নহে। পুলিসের অনুসন্ধান উপযোগী ভারতীয় দন্ডবিধি আইন অনুযায়ী কোনরূপ ঘটনা ঘটিলে, সেই ঘটনার সংবাদ সর্ব্বপ্রথম যে থানায় আনিয়া থাকে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী কর্তৃক তাহার একটি এজাহার লওয়া হয়। ঐ এজাহার বা জবানবন্দী যে পুস্তকে লিখিত হয়, সেই পুস্তকের নাম প্রথম এতলা বা First Information Report. যে পুস্তক -খানিতে ঐ এজাহার লিখিত হয়, তাহা ৩ ভাগে বিভক্ত; সুতরাং প্রথম সংবাদদাতার সংবাদ ঐ পুস্তকের এক অংশে লিখিত হয়; অপর দুই অংশে তাহারই ঠিক নকল হয়। নকলের একখানি থানায় থাকে, একখানি পুলিস বিভাগের প্রধান কৰ্ম্মচারীর নিকট প্রেরিত হয়; অবশিষ্ট একখানি বিচারকের নিকট প্রেরণ করা হয়। সহরতলীর মধ্যেও ঐরূপ প্রথম এতলার নিয়ম প্রচলিত আছে। যে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমাকে লিপ্ত হইতে হয়, তাহা সহরতলির একটি থানার এলাকায় ঘটিয়াছিল। ঐ থানায় গমন করিয়া প্রথমেই আমি প্রথম এতলাখানি পাঠ করিলাম। উহার সারমর্ম্ম এইরূপ :—

“আমার নাম শম্ভু; জাতিতে আমি উড়িয়া। আমি বিজয় বাবুর বাগানের মালী। প্রত্যহ রাত্রিতেই আমি বাগানে থাকি। কিন্তু কলা রাত্রিতে আমি বাগানে ছিলাম না। আমার দেশের একটি লোকের সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলাম। সেই স্থানে উপস্থিত হইবার পর অতিশয় বৃষ্টি হয় বলিয়া রাত্রিতে আমি বাগানে আর প্রত্যাগমন করিতে পারি না। যাইবার সময় আমি বাগানের সদর দরজায় তালা বন্ধ করিয়া গিয়াছিলাম। অদ্য প্রাতঃকালে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, সদর দরজার সেই তালা খোলা রহিয়াছে। বাগানের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহার মধ্যে যে দোতালা পাকা বাড়ী আছে, তাহার নিকট আমি গমন করিলাম। দেখিলাম তাহার দরজার চাবিও খোলা। আমি যে সময় বাগান হইতে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় আমি নিজ হস্তে ঐ তালা বন্ধ করিয়া গিয়াছিলাম ও উভয় চাবিই আমি আমার সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। তালা খোলা দেখিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমতঃ নিম্ন তলার ঘরগুলি দেখিলাম; কিন্তু, কোন দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে বলিয়া অনুমান হইল না। তাহার পর উপরে উঠিলাম। বিজয় বাবু বাগানে আসিয়া যেখানে উপবেশন করিতেন বা যে ঘরে বসিয়া আমোদ আহ্লাদ ও গীতবাদ্য করিতেন, প্রথমেই আমি সেই ঘরে গমন করিলাম। সেই ঘরের অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইল, ঐ ঘরে কেহ আসিয়াছিলেন, নৃত্যগীত প্রভৃতি হইয়াছিল, মদ্যপানও চলিয়াছিল; কারণ, দেখিতে পাইলাম, দুই তিনটি মদের বোতল ও গ্লাস সেইস্থানে পড়িয়া রহিয়াছে; বাদ্যযন্ত্র সকল যে স্থানে রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে নাই; বসিবার বিছানার উপর রহিয়াছে। স্ত্রীলোকগণ নৃত্য করিবার কালীন যে ঘুঙ্গুর ব্যবহার করিয়া থাকেন, তাহাও সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল যে, আমার অনুপস্থিতিতে আমার মনিব বাগানে আগমন করিয়াছিলেন। নৃত্যগীত ও আমোদআহ্লাদ করিবার পর পুনরায় প্রস্থান করিয়াছেন। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই ঘরের পার্শ্ববর্তী ঘরে গমন করিলাম। সেই ঘরে গিয়া যাহা দেখিলাম, তাহা বলিতেও আমার ভয় হয়। সেই ঘরের অবস্থা দেখিয়া আমি আরো ভীত হইয়া পড়িলাম। দেখিলাম, একটি স্ত্রীলোক উলঙ্গ অবস্থায় সেই ঘরের মধ্যে চিৎ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। অনুমান হইল, সে মরিয়া গিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমি ঘর হইতে বহির্গত হইলাম ও একেবারে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই সময় আমি যে কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। বাগানের মধ্যে অপর কেহই ছিল না যে কোনরূপ পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি। আমি কিছুই বিবেচনা করিতে না পারিয়া, দ্রুতগতিতে আমার মনিবের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি কলিকাতা সহরের মধ্যে বাস করেন। তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, ও যাহা যাহা আমি দেখিয়া আসিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত কথা আমি তাঁহাকে কহিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন, ও কহিলেন “আমি তো কাল বাগানে যাই নাই।” তাহার পরই তাঁহার গাড়ী প্রস্তুত হইল। তিনি ঐ গাড়িতে বাগানে আগমন করিলেন। আমিও গাড়ীর উপর বসিয়া আসিলাম। বাড়ী হইতে আরও দুই তিন জন তাঁহার সহিত আগমন করিল। তাঁহারা সকলে বাগানে আসিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও তাঁহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিলাম। ঘরের ও মৃতদেহের অবস্থা দেখিয়া তাঁহারা সকলেই বাহিরে আসিলেন। আমি রাত্রিতে বাগানে উপস্থিত ছিলাম না বলিয়া আমার উপর নিতান্তই অসন্তুষ্ট হইলেন, ও আমাকে সহস্র গালি দিয়া, পরিশেষে কহিলেন, “যাও, তুমি গিয়া থানায় এই সংবাদ প্রদান কর। যে পর্য্যন্ত পুলিস আসিয়া এই স্থানে উপস্থিত না হইবে, সেই পর্য্যন্ত আমরা এই স্থান হইতে গমন করিতেছি না।” মনিবের এই আদেশ শুনিয়া আমি থানায় আসিয়াছি ও এই সংবাদ প্রদান করিতেছি। আমি কাহার উপর নালিস করিতেছি না, বা কাহার উপর আমার সন্দেহ হয় না; কারণ, রাত্রিকালে আমি নিজেই সেইস্থানে উপস্থিত ছিলাম না। এই আমার এজাহার।” 

প্রথম এতলা পাঠ করিয়াই বুঝিতে পারিলাম, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান বা ইহার রহস্য উদ্ঘাটন নিতান্ত সহজ নহে। এই অনুসন্ধানের নিমিত্ত বিশেষ কষ্টভোগ করিতে হইবে, ও কষ্ট ভোগ করিয়াও যে কতদূর কৃতকার্য্য হইতে পারা যাইবে, তাহা বলা যায় না। যাহা হউক, যখন অনুসন্ধানের ভার আমার উপর পতিত হইয়াছে, তখন সাধ্যমত চেষ্টা করিতেই হইবে। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া থানায় সেই সময় যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমাদিগের থানার ইনস্পেক্টার কোথায়?” উত্তরে একজন কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “তিনি এখনই ঐ খুনি মোকদ্দমার সংবাদদাতার সহিত যে বাগানে সেই মৃতদেহ পড়িয়া আছে, সেই বাগানে গমন করিয়াছেন; বোধ হয় এখনও সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইতে পারেন নাই।” 

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আমি সেই স্থানে আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিলাম না। সেই থানা হইতে একটি লোক সঙ্গে লইয়া, আমিও সেই বাগান অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

আমি সেই বাগানে উপস্থিত হইবার অতি অল্পক্ষণ পূর্ব্বেই সেই থানার ইনস্পেক্টার সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিলেন। তিনি বাগানের মধ্যবর্তী সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ঐ মৃতদেহ দর্শন করিতেছেন, এরূপ সময় আমিও গিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। 

আমাকে দেখিবামাত্রই তিনি কহিলেন, “আপনি এখানে কোথা হইতে?” 

আমি। আপনি যেখান হইতে। 

ইনস্পেক্টার। আমিতো আমার থানা হইতে আগমন করিতেছি। 

আমি। আমিও আপনার থানা হইতে আসিয়াছি। 

ইনস্পেক্টার। আপনি কি আমার থানায় আসিয়াছিলেন? 

আমি। হাঁ। 

ইনস্পেক্টার। কেন? 

আমি। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত। 

ইনস্পেক্টার। আপনি কিরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন? 

আমি। আপনি টেলিফোন করিয়া যে সংবাদ পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, সেই সংবাদ পাইয়া আগমন করিয়াছি। আমি প্রথমতঃ আপনার থানায় গমন করিয়াছিলাম। সেই স্থানে প্রথম এতলা পড়িয়া দেখিলাম ও শুনিলাম আপনি অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া গিয়াছেন; তাই আমি আপনার থানা হইতে এখানে আসিয়াছি। 

ইনস্পেক্টার। আপনি যত শীঘ্র এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, এত শীঘ্র আর কেহই উপস্থিত হইতে পারে না। সে যাহা হউক, আপনি যখন প্রথম হইতেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, তখন আসুন প্রথম হইতেই উভয়ে মিলিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করি। 

বলা বাহুল্য, আমিও সেই ইনস্পেক্টারের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া যে ঘরে মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেই ঘরের মধ্যেই অগ্রে প্রবেশ করিলাম; কারণ, সেই সময় ঐ ঘরের মধ্যে সেই ইনস্পেক্টার উপস্থিত থাকিয়া মৃতদেহ দর্শন করিতেছিলেন। 

ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, মৃত্তিকার উপর একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ চিৎ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার সমস্ত শরীর একেবারে উলঙ্গ। কোন স্থানে বস্ত্রের চিহ্নমাত্রও নাই। স্ত্রীলোকটিকে দেখিয়া অনুমান হয়, তাহার বয়ঃক্রম ২৫ বৎসরের অধিক হইবে না। গৌরাঙ্গ ও দেখিতে অতিশয় সুশ্রী পরিধানে যেমন বস্ত্র নাই, তেমনি অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কারও নাই। পায়ে “মেদির” চিহ্ন আছে। ঐ চিহ্ন নিতান্ত পুরাতন বলিয়া অনুমান হয় না; বোধ হয় মৃত্যুর দিবসেই সে পায়ে “মেদি” মাখিয়াছিল। সমস্ত শরীরের কোন স্থানে কোনরূপ অলঙ্কার না থাকিলেও তাহার শরীরের অবস্থা দেখিয়া অনুমান হয়, তাহার অলঙ্কার পরিধান করা অভ্যাস ছিল। নাসিকা ও কান দেখিয়া তাহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে। মৃত দেহটি উত্তমরূপে দেখিলাম। তাহার কোন স্থানে কোনরূপ অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না; কিন্তু, তাহার চক্ষুদ্বয় দেখিয়া বোধ হইতে লাগিল, উহা যেন দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দূরে গিয়া পতিত হইবার উপক্রম করিতেছে; সুতরাং, সেই মূর্তি দেখিতে অতিশয় ভয়াবহ হইয়া রহিয়াছে। শরীরের কোন স্থানে কোনরূপ অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না সত্য, কিন্তু তাহার গলার চতুষ্পার্শ্বে বেষ্টিত একটি কাল দাগ দেখিতে পাওয়া গেল। উহা দেখিয়া আমাদিগের স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে, বস্ত্র বা রজ্জু অথবা সেই প্রকারের অপর কোনরূপ দ্রব্য দ্বারা উহার গলা বেষ্টনপূর্ব্বক, উহার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করিয়া, তাহাকে হত্যা করা হইয়াছে। আরও অনুমান হইল, উহাকে হত্যা করিয়া উহার পরিহিত অলঙ্কার, এমন কি বস্ত্রখানি পর্য্যন্ত অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। তাহার পরিধানে যে বস্ত্রখানি ছিল, তাহাও বোধ হয় বহুমূল্যের হইবে; নতুবা, উহাকে বিবস্ত্রাবস্থায় রাখিয়া যাওয়ার আর কোনরূপ কারণই দেখিতে পাওয়া যায় না। 

ঐ ঘরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমরা অপর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বলা বাহুল্য, যে সময় আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, সেই সময় সেই বাড়ীর অধিকারী বিজয়বাবুও আমাদিগের সঙ্গে সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। 

দ্বিতীয় ঘরের মধ্যে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, ঐ ঘরটি অতিশয় বিস্তৃত ও উহার মধ্যস্থল একটি প্রকাণ্ড গালিচার দ্বারা আচ্ছন্ন। ঐ গালিচাখানি একখানি পরিষ্কার বড় চাদরের দ্বারা আবৃত। ঐ গালিচার তিন পার্শ্বে মধ্যে মধ্যে বসিবার উপযোগী কয়েকখানি মখমলে মোড়া চেয়ার আছে। গালিচা বিছানার উপরও কয়েকটি মোটা মোটা তাকিয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ঐ সকল দ্রব্য যেন শৃঙ্খলার সহিত রক্ষিত নাই; সেই দিবস বোধ হয় কোন ব্যক্তি ঐ সকল দ্রব্য যেন ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করিয়াছে; কিন্তু, তাহাদিগের স্থানে আর তাহাদিগকে স্থাপিত করা হয় নাই। ঐ বিছানার উপর ৩/৪টি বোতল গড়াগড়ি যাইতেছে। উহা হইতে এখন পর্যন্ত মদিরার গন্ধ নির্গত হইতেছে। তিনটি কাঁচের গ্লাসও সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে ও সেই স্থানে বসিয়া মাংসাদি আহার করা হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়; কারণ, ২/১ খানি হাড় এদিক ওদিক পড়িয়া রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া সহজেই অনুমান হয়, কয়েকজন লোক সেই স্থানে বসিয়া মদিরাদি পান করিয়াছে। তদ্ব্যতীত, ঐ ঘরের যে স্থানে বাদ্যযন্ত্র সকল রক্ষিত থাকিত, তাহাও সেই স্থানে নাই। ঐ সকল যন্ত্র সেই বিছানার উপর পড়িয়া রহিয়াছে; তদ্ব্যতীত, নৃত্য করিবার কালীন স্ত্রীলোকগণ তাঁহাদিগের পায়ে যে ঘুঙ্গুর গুচ্ছ বাঁধিয়া থাকেন, তাহারও একটি সেই স্থানে পড়িয়া আছে। এই সকল অবস্থা দেখিয়া সহজেই আমাদের মনে হইল যে, ঐ স্থানে বসিয়া নৃত্য-গীত হইয়াছে গানবাদ্য, হইয়াছে ও সুরাপানও চলিয়াছে; পরিশেষে এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে। 

ঐ ঘরের মধ্যে বিজয়বাবুর একটি আলমারি ছিল; তাহা চাবিবন্ধ অবস্থায় দেখিতে পাইলাম। বিজয়বাবুর নিকট হইতে চাবি লইয়া ঐ আলমারি খুলিলাম। দেখিলাম, উহার ভিতর মূল্যবান বস্ত্রাদি অনেক আছে, কিন্তু উহার একখানিও স্থানান্তরিত হয় নাই। অপরাপর, স্থানে অপরাপর অনেক দ্রব্যাদিও রহিয়াছে; তাহাও কেহ স্পর্শ করে নাই। 

এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমরা বাহিরে আসিলাম। শম্ভু মালির নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, ঐ ঘরের সমস্ত দরজা ভিতর হইতে বন্ধ হয় ও পরিশেষে একটি দরজায় বাহির হইতে তালা বন্ধ করা হয়। ঐ তালা শম্ভুর নিকটেই থাকে। গত কল্য যখন শম্ভু বাহিরে গিয়াছিল, সেই সময় ঐ তালা সে নিজহস্তে বন্ধ করিয়া, ঐ তালার ও সদর দরজার চাবি সে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল। 

ঐ তালা ও সদর দরজার তালা দেখিয়া যেন অনুমান হইল যে, ঐ তালাদ্বয়ের একটি তালাও কোনরূপে ভাঙ্গা হয় নাই, চাবি দ্বারা খোলা হইয়াছে। কারণ তালাদ্বয়ের কলের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য ঘটে নাই, ঠিক আছে; অথবা উহার উপরেও কোনপ্রকার চিহ্ন প্রভৃতি দেখিতে পাওয়া যায় না। 

বাগানের এই সকল অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া আমরা সকলে বাহিরে আসিয়া উপবেশন করিলাম ও সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে হইলে কোন্ পন্থা প্রথম হইতে অবলম্বন করা কর্তব্য, তাহার পরামর্শ করিতে লাগিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে দুইটি বিষয় সম্বন্ধে আমাদিগের বিশেষরূপ বিবেচনা করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। ১ম, ঐ মৃত দেহটি কাহার। ২য়, কাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা। এই দুইটি বিষয় লইয়া একটু ভাবিবার সময় নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় আসিয়া মনে উদিত হইল। 

১। ঐ স্ত্রীলোকটি যেরূপ সুশ্রী ছিল বলিয়া অনুমান হইতেছে, তাহাতে কোন বড় ঘরের গৃহস্থ রমণী যে এ না হইতে পারে তাহাই বা কি করিয়া বলা যায়? 

২। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে এই রমণী বিজয়বাবুর পরিবারের মধ্যে বা তাঁহার আত্মীয়স্বজনের পরিবারের মধ্যস্থিত কেহ হইবার খুব সম্ভাবনা নয় কি? বিজয়বাবুর দ্বারা বা তাঁহার জ্ঞানমত যদি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে এই হত্যার উদ্দেশ্য চুরি নহে, ঐ স্ত্রীলোকটির চরিত্র বা সেই প্রকার অপর কোন বিষয়ই এই হত্যার কারণ। 

৩। বিজয়বাবুর দ্বারা বা তাঁহার জ্ঞানমত যদি এই কাৰ্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে হত্যার পর উহাকে উলঙ্গ অবস্থায় রাখিয়া যাইবার কারণ কি? সময় সময় ভদ্রলোকের দ্বারা তাঁহাদিগের ঘরের মহিলা হত্যা হইয়া থাকে বটে, কিন্তু আজ পৰ্য্যন্ত মৃত দেহ একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় পরিত্যাগ করিতে কোন ভদ্রলোককে দেখি নাই বা শুনি নাই। এরূপ অবস্থায় এই কার্য্য বিজয়বাবুর দ্বারা বা তাঁহার জ্ঞানমতে যে সম্পন্ন হইয়াছে, তাহাই বা অনুমান করি কি প্রকারে? 

৪। বিজয়বাবুর দ্বারা বা যদি তাঁহার জ্ঞানমতে এই কাৰ্য্য না হইয়া থাকে, তাহা হইলে অপর কাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা? তাঁহার বিনা অনুমতিতে কে তাঁহার বাগানের মধ্যে গমন করিয়া এইরূপ ভয়ানক কার্য্য করিতে সাহসী হইতে পারে? আর তাঁহার দ্বারা বা তাঁহার জ্ঞানমতেই যদি এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলেই কি তিনি নিজের বাগানের মধ্যে এইরূপ কার্য্য সম্পন্ন করিবেন ও তাঁহার নিজের বাড়ীর মধ্যে ঐ ‘মৃতদেহ এরূপভাবে রাখিয়া দিতে সাহসী হইবেন? ইহাই বা কিরূপে অনুমান করা যাইতে পারে? 

৫। স্ত্রীলোকটি অতিশয় সুশ্রী বলিয়াই আমরা গৃহস্থ রমণী বলিয়া অনুমান করিতেছি; কিন্তু, এ যে বারবনিতা নহে, তাহাই বা অনুমান না করি কেন? গৃহস্থ রমণীগণ প্রায় অলক্তক রাগে তাঁহাদিগের পদযুগল রঞ্জিত করিয়া থাকেন, ইহাই প্রায় দেখিতে পাওয়া যায়। মেদি পাতার রং ব্যবহার করিতে কোন গৃহস্থ হিন্দুরমণীকে ইতিপূর্ব্বে আমি কখন দেখিয়াছি বলিয়া অনুমান হয় না। ঐ রং প্রায় বেশ্যাগণই অধিক পরিমাণে ব্যবহার করিয়া থাকে। আরও ব্যবহার করেন—মুসলমান গৃহস্থ রমণীগণ। ভদ্রবংশীয় মুসলমানদিগের স্ত্রীলোকগণ মেদি পাতার রং যেরূপ পরিমাণে ব্যবহার করিয়া থাকেন, ততদূর আর কেহ ব্যবহার করেন কিনা সন্দেহ। এরূপ অবস্থায় ঐ স্ত্রীলোকটি বারবণিতা হইলেও হইতে পারে বা কোন ভদ্রবংশসম্ভূতা মুসলমান-রমণী হইলেও হইতে পারেন। 

৬। ইনি যদি ভদ্রবংশীয় কোন মুসলমান রমণীই হন, তাহা হইলে ইহার অলঙ্কার প্রভৃতি চুরি করিবার নিমিত্ত এ কার্য্য কাহার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই; ইহার চরিত্রের নিমিত্তই এই কাৰ্য্য হইয়া থাকিবে। তাহা হইলেই বা ইহাকে একেবারে বিবস্ত্রা করিয়া রাখিয়া যাইবে কেন? 

৭। যদি এই মৃতদেহ কোন বারবনিতার হয়, তাহা হইলে এই হত্যার উদ্দেশ্য চুরি হইবারই খুব সম্ভাবনা ও তাহা হইলে উহাকে একেবারে উলঙ্গ করিয়া রাখিয়া যাওয়া যে একেবারে অসম্ভব, তাহা নহে। কারণ, বোধহয় উহার পরিধানে কোন বহুমূল্য শাড়ি ছিল। চোরগণ সেই শাড়ির লোভ কোনরূপে সম্বরণ করিতে না পারিয়া, উহার অঙ্গ হইতে উহা উন্মোচিত করিয়া লইয়া গিয়াছে; সুতরাং উহাকে বিবস্ত্রা অবস্থায় থাকিতে হইয়াছে। 

৮। চোরের দ্বারাই যদি এই কাৰ্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহারা কোন সাহসে স্ত্রীলোকটিকে এই অপরিচিত বাগানের মধ্যে আনিতে সাহসী হইবে ও কোন সাহসের উপর নির্ভর করিয়া তাহারা উহার মৃতদেহ এইরূপ অবস্থায় পরিত্যাগ পূর্ব্বক প্রস্থান করিতে সাহসী হইবে? বিশেষতঃ, যেরূপ আমোদ আহ্লাদ, নৃত্য-গীত ও সুরাপানাদি হইয়াছে বলিয়া অনুমান হইতেছে, তাহা চোরের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া একেবারেই অসম্ভব। তবে বলিতে পারিনা সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চোরগণও যদি এইরূপ ভাবে কার্য্য করিতে সাহসী হয়, তাহা হইলে, এরূপ কার্য্য অনায়াসেই হইতে পারে। কিন্তু বাগানের দরয়ানের সহিত যোগ না করিয়া কোন চোর যে এইরূপ কার্য্য করিতে সাহসী হইবে, তাহা আমার বোধ হয় না। 

৯। যদি চোরের দ্বারাই এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে ও দরয়ানের সহিত যদি তাহাদিগের কোনরূপ ষড়যন্ত্র থাকে, তাহা হইলে শম্ভুর কথাই বা আমরা বিশ্বাস করি কি প্রকারে? যে ব্যক্তি ভয়ানক দুষ্কর্ম করিবার নিমিত্ত এই বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, সে পূর্ব্ব হইতে এই বাগানের অবস্থা না জানিলে, কখনই ইহার মধ্যে প্রবেশ করিতে সাহসী হয় নাই; কারণ, সে পূর্ব্ব হইতে এই বাগানের অবস্থা জানিয়াছে; এই বাগানের ভিতর যে একজন দরয়ান বা মালি থাকে, তাহাও তাহার জানিতে বাকী নাই; এরূপ অবস্থায় তাহাকে হাত না করিয়া কোন সাহসে সে ইহার মধ্যে প্রবেশ করিতে সাহসী হইবে? ওদিকে আবার দেখিতে পাওয়া যাইতেছে যে, দুইটি তালাদ্বারা বাগানের বাড়ী ও বাগানের দরজা আবদ্ধ ছিল, তাহা খোলা হইয়াছে অথচ উহার কোনরূপ ব্যতিক্রম ঘটে নাই; এরূপ অবস্থায় একেবারেই অনুমান করা যাইতে পারে যে, শম্ভুর যোগে তাহারা এই বাগানের মধ্যে প্রবেশ করে নাই, তাহা নহে। শম্ভু ইহার সমস্ত বিষয় অবগত আছে, ভয়বশতঃ কোন কথা বলিতেছে না। 

১০। শম্ভু যদি ইহার অবস্থা অবগত থাকে, বা তাহার চাবি দিয়া সে যদি বাগান ও বাড়ীর দরজা খুলিয়া দিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার কতদূর অবগত থাকিবার সম্ভাবনা? এই বাগানের ভিতর যে খুন হইবে বা চুরি হইবে, ইহা পূৰ্ব্ব হইতে অবগত হইতে পারিলে, সে বোধ হয় কখনই এরূপ কার্য্যে সম্মতি প্রদান করিত না। চোরগণ বোধ হয় ভদ্রবেশে ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত এখানে আগমন করিয়াছিল, “বাগানের মধ্যে কিয়ৎক্ষণ আমোদ আহ্লাদ করিয়া আমরা প্রস্থান করিব,” এইরূপ বলিয়া শম্ভুকে কিছু প্রদান পূর্ব্বক, তাহার মতানুযায়ী তাহারা ঐ বাগানের ভিতর প্রবেশ করে ও পরিশেষে আপন কার্য্য উদ্ধার করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। পরিশেষে শম্ভু ভিতরে গমন করিয়া যখন এই ভয়ানক অবস্থা দেখিতে পায়, তখন অতিশয় ভীত হইয়া পড়েও মনিবের বাড়ীতে গমন করিয়া এই সংবাদ প্রদান করে; কিন্তু নিজে বাগানে উপস্থিত ছিল ও তাহারই নিকট হইতে বাগানে আমোদ আহ্লাদ করিবার নিমিত্ত কেহ যে উহা গ্রহণ করিয়াছিল, তাহা গোপন করিয়া রাখে। আমাদিগের এই অনুমান যদি সত্যি হয়, তাহা হইলে যে পৰ্য্যন্ত শম্ভু প্রকৃত কথা না কহিবে সেই পৰ্য্যন্ত এই মোকদ্দমার কোনরূপেই কিনারা হইতে পারে না। এরূপ অবস্থায় শম্ভুকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা আমাদিগের কর্তব্য; কারণ, তাহার মনিবকে দিয়া এই কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে কখনই তাহার নিজের দোষ স্বীকার করিয়া মনিবের অপ্রীতিভাজন হইবে না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্ব কথিতরূপ অনেক প্রকার ভাবনা চিন্তার পর পরিশেষে শম্ভু মালিকে ডাকিয়া, তাহাকে উত্তমরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেই মনস্থ করিলাম। আমরা যে স্থানে বসিয়াছিলাম, বিজয়বাবুও তাহার নিকটবর্ত্তী স্থানে বসিয়াছিলেন। সেই স্থান হইতে তাঁহাকে স্থানান্তরে যাইতে কহিলাম। তিনি স্থানান্তরে গমন করিলে আমরা শম্ভুমালিকে সেই স্থানে ডাকাইলাম। সে আমাদিগের সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?” 

শম্ভু। আমার নাম শম্ভু। 

আমি। শম্ভু কি? তুমি কোন জাতি? 

শম্ভু। শম্ভু পয়ড়া, আমি উডিয়া। 

আমি। তাহা তো দেখিতে পাইতেছি, কোন জেলায় তোমার বাসস্থান?

শম্ভু। বালেশ্বর জেলায়। 

আমি। তুমি বিজয়বাবুর মালি না দরয়ান? 

শম্ভু। আমি দুই কাৰ্য্যই করিয়া থাকি? 

আমি। দুই কাৰ্য্য তুমি কিরূপে করিয়া থাক? 

শম্ভু। দিবাভাগে মালির কার্য্য করি। আমার থাকিবার ঘর বাগানের দরজায়। আমি সেই স্থানে থাকি। বাগানের দরজার চাবিও আমার নিকট থাকে। 

আমি। বাড়ীর চাবি? 

শম্ভু। তাহাও আমার নিকট থাকে। 

আমি। তুমি ব্যতীত, এই বাগানে আর কয়জন মালি আছে? 

শম্ভু। আমি ব্যতীত আর কেহই নাই। 

আমি। এত বড় বাগান তুমি একলা পরিষ্কার রাখ কি প্রকারে? 

শম্ভু। অপর লোকের আবশ্যক হইলে, ঠিকা লোক নিযুক্ত করিয়া বাগানের কার্য্য করান হয়। তাহারা দিবাভাগে কার্য্য করিয়া সন্ধার পূৰ্ব্বেই চলিয়া যায়। 

আমি। কাল কয়জন ঠিকা লোক এই বাগানে কার্য্য করিয়াছিল? 

শম্ভু। কাল কেহ কাজ করে নাই। গত এক মাসের মধ্যে অপর কোন লোক কোনরূপ কার্য্য করে নাই। আমি। তুমি তো মালির ও দরয়ানের উভয় কার্য্যই করিয়া থাক; কিন্তু, বেতন পাও কয় টাকা? শম্ভু। পাঁচ টাকা। 

আমি। আর খোরাক পোষাক কিছু পাইয়া থাক? 

শম্ভু। না। কেবলমাত্র পাঁচ টাকাই পাইয়া থাকি। 

আমি। কেবলমাত্র পাঁচ টাকার নিমিত্ত এই জঙ্গলের মধ্যে পড়িয়া থাক কেন? শহরের মধ্যে কাহার বাড়ীতে থাকিলে অভাবপক্ষে ৭/৮ টাকা অনায়াসেই পাইতে পার। 

শম্ভু। বাগানে থাকিলে খোরাকীখরচ অনেকটা কম হয় বলিয়াই আমরা বাগানে থাকিতে ভালবাসি। আমি। কেবল খোরাকী কেন, আরও কিছু কিছুতো তোমরা অনায়াসেই উপার্জ্জন করিয়া থাক। 

শম্ভু। আপনারা তো তা সবই জানেন। 

আমি। জানি বলিয়া বলিতেছি। অপরাপর বাবুরা বাগানে আসিলে সময় সময় তাঁহাদিগের নিকট হইতে তোমরা প্রায়ই তো বক্‌সিস্ পাইয়া থাক। 

শম্ভু। কেহ কেহ কখন কখন কিছু দিয়া থাকেন। তাহা আমার মনিবও অবগত আছেন। যাহা আমরা পাইয়া থাকি তাহা তাঁহার সম্মুখেই পাইয়া থাকি। 

আমি। তাঁহার অসাক্ষাতে? 

শম্ভু। তাঁহার অসাক্ষাতে আর কোথা হইতে পাইব? 

আমি। তাঁহার অসাক্ষাতে যাঁহারা বাগানে আসিয়া আমোদ আহ্লাদ করিয়া চলিয়া যান, তাঁহারা বস্সি বলিয়াতো প্রায়ই কিছু না কিছু প্রদান করিয়া থাকেন। 

শম্ভু। বাবুর সঙ্গে না আসিলে, আমি কাহাকেও বাগানের ভিতর প্রবেশ করিতে দিই না। 

আমি। মিথ্যা কথা। 

শম্ভু। কিসে মিথ্যা হইল? 

আমি। তোমার বাবু যদি নিজে বাগানে আসিতে না পারেন ও তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণকে পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে তুমি তাঁহাদিগকে বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিতে দেও না? 

শম্ভু। না। 

আমি। মিথ্যা কথা। তোমার মনিবতো এইখানেই উপস্থিত আছেন। তাঁহাকে ডাকিয়া ইহা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিব? শম্ভু। তিনি যদি চিঠি দেন বা তাঁহার কোন লোককে সঙ্গে পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে তাঁহাদিগকে বাগানে প্রবেশ করিতে দি। 

আমি। আর তাঁহারা প্রত্যাগমন করিবার সময় বক্‌সিস দিয়া যান না? 

শম্ভু। কখন কখন কেহ কিছু দিয়া থাকেন। কিন্তু সেরূপ অবস্থা প্রায়ই ঘটেনা। 

আমি। তোমার মনিব প্রত্যহ বাগানে আসিয়া থাকেন কি? 

শম্ভু। না। 

আমি। কোন দিন আসেন। 

শম্ভু। শনিবার ও রবিবারে প্রায়ই আসিয়া থাকেন। 

আমি। তিনি একাকী আসেন, না তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণের মধ্যে কেহ তাঁহার সহিত আসিয়া থাকেন? 

শম্ভু। কখন চাকর ব্রাহ্মণ লইয়া নিজেই আসেন, কখন বা বন্ধুবান্ধবগণও তাঁহার সহিত আসিয়া থাকেন। কখন বা একাকী আসিয়া কিয়ৎক্ষণ পরে পুনরায় চলিয়া যান। 

আমি। স্ত্রীলোকগণ কখন তাঁহার সহিত এখানে আসিয়া থাকেন? 

শম্ভু। কখন কখন আসেন। 

আমি। কোন স্ত্রীলোক আসিয়া থাকেন? 

শম্ভু। তাঁহার বাড়ীর স্ত্রীলোক। তাঁহার স্ত্রী। তাঁহার কন্যা ও বাড়ীর অপরাপর স্ত্রীলোক। 

আমি। তুমি তোমার মনিবের বাড়ীর সমস্ত স্ত্রীলোকদিগকে চেন? 

শম্ভু। চিনি। 

আমি। কিরূপে তুমি তাহাদিগকে চিনিলে? 

শম্ভু। আমি তরিতরকারি লইয়া প্রত্যহই বাবুর বাড়ীতে গিয়া থাকি। অন্দরমহলে গমন করিতে আমার কোনরূপ নিষেধ নাই; সুতরাং, সকলকেই আমি বাড়ীতে দেখিয়াছি ও সকলকে চিনি।  

আমি। যে স্ত্রীলোকটি ঐ ঘরের মধ্যে মরিয়া পড়িয়া আছে, সে তোমার বাবুর কে হয়? 

শম্ভু। সে আমার বাবুর বাড়ীর কোন স্ত্রীলোক নহে। 

আমি। তুমি মিথ্যা কথা কহিতেছে। তোমার বাবু যে একথা আমাদিগের নিকট স্বীকার করিয়াছেন? 

শম্ভু। তাঁহার বাড়ীর কেহ নহে, তিনি স্বীকার করিবেন কোথা হইতে? 

আমি। আর যদি স্বীকার করিয়া থাকেন? 

শম্ভু। তাহা হইলে হয় মিথ্যা কহিয়াছেন, না হয় অপর কোন স্ত্রীলোক সম্প্রতি তাঁহার বাড়ীতে আসিয়াছে, যাহাকে আমি দেখি নাই। 

আমি। তোমার মনিবের বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ তো সময় সময় এই বাগানে আসিয়া থাকেন; তদ্বব্যতীত আর কোন স্ত্রীলোক এখানে আসিয়া থাকে কি? 

শম্ভু। না, আর কোন স্ত্রীলোক এখানে আসেন না। 

আমি। কোন বেশ্যা? 

শম্ভু। কোন বেশ্যাকে আমি কখন এখানে আসিতে দেখি নাই। 

আমি। কোন নর্তকী? 

শম্ভু। তাহাতো আমি দেখি নাই। 

আমি। তাহা হইলে যে ঘরে বাদ্যযন্ত্র সকল পড়িয়া রহিয়াছে ঐ ঘরে বসিয়া গানবাদ্য কে করিয়া থাকে? শম্ভু। তাঁহারা আপনারাই করিয়া থাকেন। 

আমি। আর ঘুঙ্গুরগুচ্ছ পায় দিয়া কে নৃত্য করিয়া থাকে? 

শম্ভু। বাবুরা আপনারাই নৃত্য করিয়া থাকেন। 

আমি। মিথ্যা কথা, ইহা একেবারেই হইতে পারে না। তুমি অনুমান করিয়া দেখ দেখি, ইহার পূর্ব্বে তুমি আমাকে আর কখন দেখিয়াছ? 

শম্ভু। ঠিক মনে হয় না; যেন দেখিয়াছি বলিয়া অনুমান হয়; কিন্তু, কোথায় দেখিয়াছি তাহা ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

আমি। দেখ দেখি, এই বাগানে তোমার মনিবের সহিত আমাকে কখন দেখিয়াছ কি না? 

শম্ভু। মনে হয় না। 

আমি। যে দিন একটি বাইজি আসিয়া এখানে গীতবাদ্য করিয়াছিল, সেইদিন আমিও যে সেই মজলিসে উপস্থিত ছিলাম, তাহা বোধ হয় এখন তুমি মনে করিতে পারিতেছ না? 

এই স্থানে পাঠকগণকে বলিয়া দেওয়া কৰ্ত্তব্য যে, ইতিপূর্ব্বে আমি কখন সেই বাগানে ভিতর প্রবেশ করি নাই। শম্ভু। বোধ হয় আপনি ছিলেন, কিন্তু আমার ঠিক মনে হইতেছে না। 

আমি। বাইজির নাচ হইয়াছিল তাহা তোমার মনে হইতেছে? 

শম্ভু। তাহা মনে পড়িতেছে। 

আমি। তাহা হইলে ইতিপূর্ব্বে তুমি কিরূপে বলিতেছিলে যে তোমার বাবুর পরিবার ব্যতীত আর কোন স্ত্রীলোক কখন এই বাগানের ভিতর প্রবেশ করেন নাই। 

শম্ভু। কোন বেশ্যা কখন এই বাগানের ভিতর আইসে নাই, তাহাই আমি বলিয়াছিলাম। 

আমি। তবে বাইজি আসিল কি প্রকারে? 

শম্ভু। সে তো আর বেশ্যা নয়, সে বাইজি। 

আমি। ঠিক কথা, যে বাইজি সে বেশ্যা হইবে কিরূপে! আচ্ছা শম্ভু! আমি তোমাকে এখন গুটিকতক কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি তাহার যথার্থ উত্তর দিবে কি না? 

শম্ভু। আমি মিথ্যা কহিব কেন? যথার্থ যাহা জানি তাহাই কহিব। 

আমি। আমি তোমাকে পূর্ব্বেই সতর্ক করিয়া দিতেছি যে তুমি এখন বিশেষ বিবেচনা করিয়া আমার কথার উত্তর প্রদান করিও। আরও তোমাকে বলিয়া দিতেছি যে তোমার মনিব রাত্রিকালে এই বাগানে ছিলেন না। তুমি ব্যতীত বাগানে আর কোন লোকজন বা চাকর-চাকরাণী কেহই থাকে না। বাড়ীর চাবি তোমার নিকট থাকে; বাগানের দরজার চাবিও তুমি তোমার নিকট রাখিয়া থাক। তুমি বাগানে সমস্ত রাত্রি উপস্থিত ছিলে; তোমার নিকট যে চাবি থাকে তাহা দিয়াই বাগানের দরজা ও ঘরের তালা খোলা হইয়াছে এবং সেই ঘরের মধ্যে মৃতদেহ পাওয়া যাইতেছে। এরূপ অবস্থায় এই হত্যার নিমিত্ত তুমি সম্পূর্ণরূপে দায়ী। যদি এখনও সমস্ত কথা বলিয়া প্রকৃত হত্যাকারীকে ধরিবার নিমিত্ত আমাদিগের সহায়তা না কর, তাহা হইলে জানিও, এই হত্যাপরাধে তুমি সর্ব্বতোভাবে দোষী হও বা না হও, এই হত্যার প্রতিশোধের নিমিত্ত তোমাকেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। আমি জানি এই হত্যা তোমার জ্ঞানতঃ হয় নাই; কিন্তু, তুমি যতদূর অবগত আছ, তাহার আর এখন কিছুমাত্র গোপন করিও না। তোমার দ্বারা যাহা কিছু অপরাধ ঘটিয়াছে, তাহা প্রত্যেক বাগানের প্রত্যেক মালী বা দরোয়ানের দ্বারা হইয়া থাকে, তাহা আমি বিশেষরূপ অবগত আছি; নতুবা, কেবলমাত্র পাঁচ টাকায় তোমাদিগের কোনরূপেই ভরণপোষণ নির্ব্বাহ হইতে পারে না। তুমি চাকরি যাইবার ভয়ে তোমার যে সামান্য অপরাধ এখন স্বীকার করিতে সম্মত হও নাই, আমি বলিতেছি সেই অপরাধ এখন স্বীকার করিলেও তোমার মনিব কোনরূপে তোমাকে কর্ম্মচ্যুত করিতে পারিবেন না। তোমার চাকরি যাহাতে থাকে তাহা আমি করিব। কিন্তু এখনও যদি তুমি আমার কথা না শুন, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিও, ঐ স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করার অপরাধে তোমাকেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। 

আমার কথা শুনিয়া শম্ভু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার অবস্থা দেখিয়া আমার প্রতীতি জন্মিল যে এ যাহা বলিয়াছে, তদ্ব্যতীত অনেক কথা সে অবগত আছে। এখন সেই সকল কথা সে বলিবে কিনা তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। কিয়ৎক্ষণ স্থিরভাবে থাকিবার পর সে কহিল “আমি তো গত রাত্রিতে বাগানে উপস্থিত ছিলাম না। এখানে কি হইয়াছে না হইয়াছে, তাহা আমি কিরূপে বলিব?” 

তাহার কথা শুনিয়া আমি পুনরায় তাহাকে কহিলাম, “এখনও দেখিতেছি তুমি মিথ্যা কথা পরিত্যাগ করিতেছ না। রাত্রিকালে তুমি যে স্থানে গমন করিয়াছিলে বলিয়াছ ও যে স্থানে ও যাহাদিগের নিকট রাত্রি অতি বাহিত করিয়াছ বলিয়া আমাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলে, অনুসন্ধানে তাহার সমস্তই মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে; তুমি যাহাদিগের নাম করিয়াছিলে তাহাদিগকে থানাতে আনাও হইয়াছে; যদি ইচ্ছা কর তাহা হইলে তাহাদিগকে এখনই আমি এখানে আনাইয়া লইতেছি। তাহা হইলেই শুনিতে পাইবে তোমার সাক্ষাতে তাহারা কি বলে।” 

আমার কথা শুনিয়া শম্ভু পুনরায় চুপ করিয়া রহিল। পুনরায় আমি তাহাকে কহিলাম, “আমি তোমাকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছি, এখনও তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান কর; নতুবা, জানিও নিশ্চয়ই তোমার অমঙ্গল উপস্থিত হইবে। ইহার পর সমস্ত কথা বলিলেও তোমার পরিত্রাণের আর কোনরূপ উপায় থাকিবে না। এখনও আমার পরামর্শ শুনিয়া কার্য্য কর। 

শম্ভু। আমার মনিব শুনিলে আমার চাকরি যাইবে। 

আমি। আমরা তোমার মনিবকে কোন কথা বলিব না; তথাপিও যদি তিনি কিছু জানিতে পারেন, তাহা হইলেও যাহাতে তোমার চাকরি না যায়, আমরা তাহার বন্দোবস্ত করিব। 

শম্ভু। আমি আপনাদিগের কথায় বিশ্বাস করিলাম; যাহা ভাল বিবেচনা হয় তাহা করিবেন। কিন্তু আমি তো তাহাদিগকে চিনি না। 

আমি। কাহাদিগকে? 

শম্ভু। কাল রাত্রিতে যাহারা বাগানে আসিয়াছিল। 

আমি। কাহারা কাল রাত্রিতে বাগানে আসিয়াছিল? 

শম্ভু। আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে আমি তাহাদিগকে চিনি না। ইতিপূর্ব্বে আর কখন তাহাদিগকে দেখি নাই বা তাহাদিগের কোনরূপ পরিচয়ও আমি গ্রহণ করি নাই। 

আমি। তাহা হইলে তাহাদিগকে বাগানের মধ্যে আসিতে দিলে কেন? 

শম্ভু। আমার কুবুদ্ধি, তাহার উপর লোভ। 

আমি। কয়টি টাকা তুমি পাইয়াছিলে? 

শম্ভু। পাঁচটি। 

আমি। এত অল্প টাকায় তুমি এরূপ কার্য্য করিতে মত দিলে কি প্রকারে? শম্ভু। কি কাৰ্য্য? 

আমি। খুন। 

শম্ভু। দোহাই ধর্ম্মাবতার! আমি খুনের কিছুই অবগত নহি। আমি যাহা কিছু জানি তাহার সমস্তই এখনই আমি আপনার নিকট বলিতেছি; ইহার মধ্যে একটিও মিথ্যা কথা আপনি পাইবেন না। 

আমি। আচ্ছা যাহা জান আনুপূর্ব্বিক বল দেখি। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

শম্ভু কহিল, “কল্য সন্ধ্যার পর আমি এই বাগানের দরজায় বসিয়া আছি, এরূপ সময় একখানি গাড়ি আসিয়া হঠাৎ এই বাগানের দরজায় উপস্থিত হইল। ঐ গাড়ীর মধ্যে একটি স্ত্রীলোক ও তিনটি পুরুষ ছিল। একটি পুরুষ সেই গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া আমার নিকট আগমন করিল ও আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “দরোয়ান, আজ তোমার মনিব এই বাগানে আসিবেন কি?” 

আমি। “না, তিনি শনিবার ও রবিবার ভিন্ন আর কোন দিবস বাগানে আসেন না।” 

পুরুষ। তাহা হইলে তুমি আমাদিগের একটি অনুরোধ রক্ষা করিবে কি? সেই অনুরোধ রক্ষার নিমিত্ত আমরা তোমাকে দুইটি টাকা প্রদান করিতেছি। 

আমি। কি করিতে হইবে? 

পুরুষ। আমরা একটু আমোদ আহ্লাদ করিবার নিমিত্ত একটি বাগান স্থির করিয়াছিলাম; কিন্তু, সেই বাগানে হঠাৎ বাবুর পরিবারবর্গ আসিয়া উপস্থিত হওয়ায় আমরা সেই বাগানে প্রবেশ করিতে সমর্থ হই নাই; সুতরাং, আমাদিগকে অন্য স্থানের অনুসন্ধান করিতে হইতেছে। 

আমি। আপনারা কতক্ষণ পর্য্যন্ত বাগানের মধ্যে আমোদ-আহ্লাদ করিবেন? 

পুরুষ। ২/৩ ঘণ্টার অধিক নহে। তাহার পর আমরা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব। 

আমি। দুই টাকায় ঐ কার্য্য কখন হইতে পারে না। 

পুরুষ। কয় টাকায় হইতে পারে? 

আমি। যদি দশ টাকা পাই, তাহা হইলে ২/৩ ঘণ্টার নিমিত্ত আমি এই বাগান ছাড়িয়া দিতে পারি।

পুরুষ। দশ টাকা কোনরূপেই আমরা দিতে পারি না নিতান্তপক্ষে পাঁচ টাকা পৰ্য্যন্ত প্রদান করিতে পারি। 

তাহার সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, আমি পরিশেষে পাঁচ টাকাতেই স্বীকৃত হইলাম; কারণ, ভাবিলাম “মনিব কিন্তু আজ আসিবেন না; তবে কেন আমি পাঁচ টাকা পরিত্যাগ করি? ইহাতে আমার মনিবের কোনরূপ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই। দুই তিন ঘণ্টা পরেই যখন উহারা আমোদ আহ্লাদ করিয়া চলিয়া যাইবে, তখন একথা কোনরূপে প্রকাশিত হইতে পারিবে না। এরূপ অবস্থায় কেন পাঁচ পাঁচটি টাকা পরিত্যাগ করি।” মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, আমি তাহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। তাহারা গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিল। আমিও বাগানবাড়ীর দরজা খুলিয়া দিয়া তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে যাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম ও আলো জ্বালিয়া দিয়া আমি আমার ঘরে আসিয়া উপবেশন করিলাম। উহারা ঘরের মধ্যে বসিয়া আমোদ আহ্লাদে প্রবৃত্ত হইল। এইরূপে দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর আমি নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম। আমার ইচ্ছা ছিল যে পর্য্যন্ত উহারা বাগান পরিত্যাগ না করিবে, সেই পর্যন্ত আমি শয়ন করিব না; কিন্তু, তাহা পারিলাম না। কোথা হইতে কাল নিদ্রা আসিয়া আমাকে আক্রমণ করিল। বাগানের দরজা খোলা ছিল; সুতরাং, সেইরূপ অবস্থাতেই রহিয়া গেল। যখন আমার নিদ্রা ভাঙ্গিল তখন দেখিলাম রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছে। গান বাজনা প্রভৃতি কিছুই হইতেছে না। তাহারা চলিয়া গিয়াছে কি না তাহা দেখিবার নিমিত্ত আমি সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম বাদ্যযন্ত্রাদি এদিক ওদিক পড়িয়া রহিয়াছে, লোকজন কেহই নাই, সকলেই চলিয়া গিয়াছে। পার্শ্বের ঘরে গিয়া দেখিলাম, সেই স্ত্রীলোকটির মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমার অতিশয় ভয় হইল। কি করিব তাহা কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, দ্রুত গতি আমার মনিবের নিকট গমন করিলাম, ও “আমি রাত্রিতে বাগানে উপস্থিত ছিলাম না।” এইরূপ মিথ্যাকথা বলিয়া আমার দোষ গোপন করিতে চেষ্টা করিলাম। তিনি আমার সহিত এই স্থানে আগমন করিয়া স্বচক্ষে সমস্ত অবস্থা দর্শন করিলেন, ও পরিশেষে এই সংবাদ প্রদান করিবার নিমিত্ত আমাকে থানায় পাঠাইয়া দিলেন। সেই স্থানে আমি ভয়ক্রমে যাহা যাহা বলিয়াছি তাহা আপনি অবগত আছেন, ইহাই প্ৰকৃত কথা। ইহা ব্যতীত, আর কোন কথা আমি অবগত নহি।” এই বলিয়া শম্ভু নিরস্ত হইল। 

আমি। তোমার কথা আমি অনেকটা বিশ্বাস করিতেছি ও আরও দুই চারিটি কথা আমি তোমাকে জিজ্ঞাসাও করিতেছি। ইহারও তুমি যথাযথ উত্তর প্রদান করিবে। 

শম্ভু। জিজ্ঞাসা করুন, আমি কোন মিথ্যা বলিব না। প্রকৃত যাহা অবগত আছি, তাহাই আমি বলিব।

আমি। উহারা কয়জন আসিয়াছিল? 

শম্ভু। চারিজন। 

আমি। তাহার ভিতর পুরুষ কয়জন ও স্ত্রীলোকই বা কয়জন? 

শম্ভু। তিনজন পুরুষ, একটিমাত্র স্ত্রীলোক। 

আমি। পুরুষ কয়টি কোন দেশীয় লোক বলিয়া অনুমান হয়? 

শম্ভু। তিনজনই বাঙ্গালি। 

আমি। বাঙ্গালি সত্য; কিন্তু কি প্রকারের বাঙ্গালি? ছোটলোক না ভদ্রলোক? 

শম্ভু। তাহাদিগের পরিধানে বেশ পরিষ্কার কাপড় ছিল। দেখিয়া ভদ্রলোক বলিয়াই অনুমান হয়। 

আমি। তাহাদিগকে তুমি চিন? 

শম্ভু। না, তাহাদিগকে আমি চিনি না ইতিপূর্ব্বে তাহাদিগকে যে কখন দেখিয়াছি তাহাও আমার বোধ হয় না। একথা আমি পূৰ্ব্বেই তো আপনাকে বলিয়াছি। 

আমি। যদি এখন তাহাদিগকে দেখিতে পাও তাহা হইলে চিনিতে পারিবে কি? 

শম্ভু। বোধ হয় দেখিলে চিনিতে পারিব। 

আমি। তিন জনকেই চিনিতে পারিবে? 

শম্ভু। তিন জনকেই চিনিতে পারিব; কিন্তু, যে ব্যক্তি আমার সহিত কথা কহিয়াছিল ও যাহার নিকট হইতে আমি পাঁচ টাকা প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাকে কখনই ভুলিব না; যখন দেখিব তখনই তাহাকে চিনিতে পারিব। 

আমি। যে স্ত্রীলোকটি উহাদিগের সঙ্গে আসিয়াছিল, সে ইতিপূর্ব্বে কখন এই বাগানে আসিয়াছিল? 

শম্ভু। না, তাহাকে আর কখনও এখানে আসিতে দেখি নাই। 

আমি। যাহার মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে, ঐ স্ত্রীলোকটিই কি তাহাদিগের সঙ্গে আসিয়াছিল? 

শম্ভু। হাঁ, ঐ স্ত্রীলোকটিই আসিয়াছিল।. 

আমি। যখন সে বাগানের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, তখন তাহার অঙ্গে কোন অলঙ্কার দেখিয়াছিলে? 

শম্ভু। অনেক সোনার গহনা ছিল। 

আমি। তাহার পরিধানে কিরূপ বস্ত্র ছিল? 

শম্ভু। খুব একখানি ভাল কাপড় ছিল। বোধ হয় মূল্যবান বেনারসী শাড়ি। 

আমি। যখন তাহারা বাগানের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, সেই সময় তাহাদিগের সহিত অপর কোন দ্রব্যাদি ছিল? 

শম্ভু। কয়েক বোতল মদ ছিল। কিছু খাবারও সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। 

আমি। তাহারা যে গাড়ীতে আসিয়াছিল তাহা ঘরের গাড়ী না ভাড়াটিয়া গাড়ী? 

শম্ভু। ভাড়াটিয়া গাড়ি; কারণ, আমার সম্মুখে তাহারা ঐ গাড়ীর ভাড়া দিয়া উহা বিদায় করিয়া দিয়াছিল। আমি। কত ভাড়া দিয়াছিল, দেখিয়াছ? 

শম্ভু। দুই টাকা আমার সম্মুখে দিয়াছিল; ইহার পূর্ব্বে যদি কিছু দিয়া থাকে বলিতে পারিনা। 

আমি। গাড়োয়ান ভাড়া লইবার সময় কোন কথা বলিয়াছিল? 

শম্ভু। অপর কোন কথা কহিতে শুনি নাই। যেমন তাহাকে ভাড়া দেওয়া হইল অমনি সে তাহার গাড়ী ঘুরাইয়া লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

আমি। ঐ গাড়োয়ান কোথা হইতে উহাদিগকে আনিয়াছিল, সেই সময় তাহা কিছু বুঝিতে পারিয়াছিলে? শম্ভু। না। 

আমি। এ গাড়ীতে ঘোড়া ছিল কয়টি, একটি না দুইটি? 

শম্ভু। দুইটি। 

আমি। কি রঙের ঘোড়া ছিল? 

শম্ভু। দুইটি ঘোড়াই লাল রঙের। 

আমি। ইহা ব্যতীত আর কোন কথা তুমি অবগত আছ? 

শম্ভু। আর যাহা জিজ্ঞাসা করিতে হয় করুন, আমি যাহা অবগত আছি তাহা বলিব। কারণ আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, আমি আর কোনরূপ মিথ্যা কথা কহিব না, বা কোন কথা গোপনও করিব না। 

শম্ভুর নিকট এইসকল বিষয় অবগত হইয়া আমাদিগের মনে অনেক সাহসের উদয় হইল। কি কারণে ও কাহাদিগের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছে, তখন তাহার কতকটা অনুমান 

আমরা সমর্থ হইলাম। বিজয় বাবুর উপর আমরা যে একটু সন্দেহ করিতেছিলাম, সেই সন্দেহ এখন সম্পূর্ণরূপে অন্তর্হিত হইল। এখন মনে হইল, শম্ভুর কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে বিশেষ চেষ্টা করিতে পারিলে যে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান হইবে না, বা হত্যাকারীগণ যে ধৃতও হইবে না তাহা নহে। মৃতদেহ যে কাহার তাহাও জানিতে পারা যাইবে। হত্যাকারীগণ যে কে তাহাও প্রকাশিত হইয়া পড়িবে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই স্থানে আর অধিকক্ষণ অপেক্ষা করিলাম না। একখানি গাড়ী আনাইয়া যতশীঘ্র পারি সেই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। কোথায় যে গমন করিলাম তাহা পাঠকগণ ক্রমে অবগত হইতে পারিবেন। থানার যে কৰ্ম্মচারী পূর্ব্ব হইতেই এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তিনি সেই বাগানের ভিতর অবস্থিতি করিয়া ঐ মৃতদেহ সম্বন্ধে “সুরতহাল” ও অপরাপর আবশ্যকীয় অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

বাগান হইতে বহির্গত হইয়া আমি আমার প্রধান কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাহাকে এই মোকদ্দমার সমস্ত অবস্থা বলিয়া তাঁহার দ্বারা সহর ও সহরতলীর সমস্ত থানায় একটি আদেশ প্রচারিত করাইলাম। টেলিফোন যোগে ঐ আদেশ দেখিতে দেখিতে সমস্ত থানায় গিয়া উপস্থিত হইল। যে আদেশ আমার প্রধান কর্মচারী প্রচারিত করিয়া ছিলেন তাহার সারমর্ম্ম এই রূপ—

বাগানের মধ্যে একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া ও অনুসন্ধান করিয়া যতদূর অবগত হইতে পারা গিয়াছে, তাহাতে এই অনুমান করা হইতেছে যে ঐ স্ত্রীলোকটি কোন সম্ভ্রান্ত বারবনিতা। তাহার পরিধানে একখানি ভাল বস্ত্র ও অনেকগুলি অলঙ্কার ছিল। অনুমান হয় নৃত্যগীত প্রভৃতি করিবার নিমিত্ত কোন বাবু তাহাকে বাগানে আনিয়াছিলেন। এই নিমিত্ত প্রত্যেক থানার ইনস্পেক্টারগণ তাঁহাদিগের এলাকার সমস্ত স্থানে ঢোল সোরেত দ্বারা এই অবস্থা এরূপ ভাবে প্রকাশ করেন যে এলাকার সমস্ত লোক বিশেষ বারবনিতাগণ এই অবস্থা যেন অবগত হইতে পারেন। যদি কাহার নিকট হইতে জানিতে পারা যায় যে কোন স্ত্রীলোক গতকল্য কাহার সহিত বাগানে গিয়াছিল ও এখন পর্যন্ত প্রত্যাগমন করে নাই, তাহা হইলে সেই সংবাদ যত শীঘ্র হয় নিম্ন স্বাক্ষরকারীর নিকট প্রেরিত হইবে। এই সংবাদ প্রকাশিত হইবার দুই ঘণ্টা পরেই সংবাদ আসিল সিমলার তিনটি স্ত্রীলোক কল্য সন্ধ্যার সময় বাগানে গমন করিয়াছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রত্যাগমন করে নাই। তাঁহাদিগের পরিধানে ভাল ভাল কাপড় ও অনেকগুলি সোনা রূপার অলঙ্কার আছে। 

এই সংবাদ পাইবা মাত্রই আমি সিমলায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে বাড়ী হইতে স্ত্রীলোক কয়েকটি গমন করিয়াছে সেই বাড়ীতে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, সেই বাড়ীতে নৃত্য নাম্নী একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক বাস করে। গতকল্য সন্ধ্যার পূর্ব্বে দুইটি বাবুর সহিত সে তাহার দুইটি কন্যাকে লইয়া বাগানে গমন করিয়াছে; কিন্তু, এখন পর্য্যন্ত প্রত্যাগমন করে নাই। 

এই কথা শুনিয়া আমার মনে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে যদি শম্ভুর কথা প্রকৃত হয় তাহা হইলে যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সে নৃত্য বা তাহার কন্যা হইতে পারে না; কারণ, তাহারা যখন তিন-জন একত্র গমন করিয়াছে তখন একজনের মৃতদেহ পাওয়া যাইবে ও অপর দুই জনের কোন রূপ সন্ধান পাওয়া যাইবে না, ইহা কখনই হইতে পারে না। তথাপি মনের সন্দেহ একবার মিটাইয়া লওয়াই কৰ্ত্তব্য। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ঐ বাড়ীতে অপর যে সকল স্ত্রীলোক বাস করিত তাহাদিগের দুই একজনকে সঙ্গে লইয়া আমি পুনরায় সেই বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম ও ঐ মৃতদেহটি তাহাদিগকে দেখাইলাম। ঐ মৃতদেহ দেখিবা মাত্রই তাহারা বলিয়া উঠিল, “ইহা গৌরবের মৃতদেহ।” 

আমি। গৌরব কে? 

স্ত্রীলোক। নৃত্যর বড় কন্যা। 

আমি। তাহার ছোট কন্যার নাম কি? 

স্ত্রীলোক। তাহার নাম শৈরব। 

আমি। কাল যখন উহারা বাগানে যাইবার নিমিত্ত বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়াছিল, তখন তোমরা বাড়ীতেই ছিলে?

স্ত্রীলোক। আমরা বাড়ীতেই ছিলাম, আমাদিগের সম্মুখে উহারা বাহির হইয়া আইসে। 

আমি। কাহার সঙ্গে উহারা গমন করিয়াছিল? 

স্ত্রীলোক। চারিটি বাবুর সহিত। 

আমি। তাহাদিগকে তোমরা চিন? 

স্ত্রীলোক। উহাদিগকে ইতিপূৰ্ব্বে কখন দেখি নাই। 

স্ত্রীলোকগণের কথা শুনিয়া আমার মনে হইল শম্ভু বোধ হয় এখনও সমস্ত কথা সত্য কহে নাই। যাহা হউক তাহাকে আর একবার ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া দেখা আবশ্যক। 

এই ভাবিয়া শম্ভুকে পুনরায় ডাকাইলাম ও তাহাকে অনেকরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া দেখিলাম; কিন্তু, সে তিনটি স্ত্রীলোকের কথা কোনরূপেই স্বীকার করিল না। 

শম্ভুর কথা শুনিয়া, সে যে সত্য বলিতেছে কি মিথ্যা বলিতেছে, তাহা আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। যদি তাহার কথা প্রকৃত হয়, যদি কেবলমাত্র একটি স্ত্রীলোকই ঐ বাগানে আসিয়া থাকে, তাহা হইলে অপর স্ত্রীলোক দুইটি কোথায় গেল? প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে যে দুইটি স্ত্রীলোক অলঙ্কারে শোভিত হইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়াছিল। তাহার মধ্যে একটিকে হতা অবস্থায় এই স্থানে পাওয়া যাইতেছে। তাহার পরিধানে একখানি অলঙ্কার, এমন কি একখানি বস্ত্ৰ পৰ্য্যন্ত নাই, সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় অপর স্ত্রীলোকদ্বয়ের অবস্থাও যে এইরূপ ঘটে নাই, তাহাই বা অনুমান করা যাইতে পারে কিরূপে? 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, যে স্ত্রীলোক কয়েকটি আমার সহিত ঐ বাগানে মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত আসিয়াছিল তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া, পুনরায় আমি তাহাদিগের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই বাড়ীতে আরও অনেকগুলি স্ত্রীলোক বাস করিত। মনে করিলাম উহাদিগের প্রত্যেককেই উত্তম রূপে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখা কর্তব্য যে তাহারা কোন কথা বলিতে পারে কি না। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, এক এক করিয়া আমি সেই বাড়ীর প্রত্যেককেই অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু যাহাদিগের সহিত স্ত্রীলোকত্ৰয় বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের সম্বন্ধে কেহই কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে পারিল না। এইসকল অনুসন্ধান করিতে দিবা ৩টা বাজিয়া গেল। তিনটার পর আমি সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার উপক্রম করিতেছি, এরূপ সময় একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী আসিয়া সেই বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইল। দেখিলাম ঐ গাড়ী হইতে দুইটি স্ত্রীলোক বহির্গত হইয়া সেই বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিল। উহাদিগের মধ্যে একজন প্রাচীনা ও একজন নবীনা। অনুমানে অবগত হইতে পারিলাম, প্রাচীনার নাম নৃত্য ও নবীনার নাম শৈরব। পাঠকগণ বোধ হয় চিনিতে পারিয়াছেন, ইহারা দুইজন ও যাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে যে একত্র বাগানে যাইবার নাম করিয়া গতকল্য সন্ধ্যার সময় বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিল। 

ইহাদিগকে দেখিয়া আমার মনের একটি আশঙ্কা অন্তর্হিত হইল। পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম ইহারাও হয়তো কোন স্থানে হতা হইয়া পড়িয়া আছে; কিন্তু, ইহাদিগকে প্রত্যাবর্তন করিতে দেখিয়া সে চিন্তা দূর হইল। তখন আমি শৈরবকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি যখন বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলে, সেই সময় তোমার সমস্ত অলঙ্কার পরিধান করিয়া গিয়াছিলে; কিন্তু, এখন তোমার অঙ্গে সেই সকল অলঙ্কার দেখিতে পাইতেছি না; তাহা আছে তো?” শৈরব কহিল, “আমার সমস্ত অলঙ্কার আমার মাতার নিকট আছে।” 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

শৈরবকে আমি যে সময় অলঙ্কারের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, সেই সময় নৃত্য বাড়ীর স্ত্রীলোকগণকে জিজ্ঞাসা করিতেছিল, “গৌরব প্রত্যাগমন করিয়াছে কি?” কিন্তু তাহার কথায় কেহ কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, সকলেই আমাকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, “তোমার গৌরবের কথা ঐ বাবুটি বলিতে পারেন, উহাকে গিয়া জিজ্ঞাসা কর?” উহাদিগের কথা শুনিয়া নৃত্য আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “বাবা আমার গৌরব এখন কোথায়?” 

নৃত্য বেশ্যা ও গৌরব বেশ্যার কন্যা হইলেও, মাতা ও সন্তানের মধ্যে যেরূপ সম্পর্ক তাহার কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় না, ইহা সকলেই অবগত আছেন। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ মাতার কর্ণগোচর করা যে কিরূপ লোমহর্ষণ ব্যাপার, তাহা কাহারও অবিদিত নাই। এই নিমিত্তই সেই বাড়ীর সকলেই ঐ সংবাদ মাতার কর্ণগোচর না করিয়া, সেই দুরূহ কার্য্যের বিষম ভার আমার স্কন্ধে অর্পণ করিল। যে অনুসন্ধান করিতে আমি প্রবৃত্ত হইয়াছি, যাহার নিমিত্ত আমি এত কষ্ট সহ্য করিয়া এই বারবনিতাগণের দ্বারে দ্বারে ফিরিতেছি, সেই কাৰ্য্য যদি আমাকে উদ্ধার করিতে হয়, তাহা হইলে সন্তানের মৃত্যু সংবাদ মাতার কর্ণগোচর করাও আমার একরূপ কর্তব্য কর্ম্মের মধ্যে পরিগণিত হইয়া পড়িল। যে কার্যক্ষেত্রে বিচরণ করিয়া আমাকে দিনযাপন করিতে হয়, তাহাতে হৃদয় একরূপ কঠিন হইয়াই পড়িয়াছে। তাহার উপর এই কঠিন হৃদয়কে আরও কঠিন করিয়া এই মৰ্ম্মভেদী সংবাদ মাতার কর্ণগোচর করিতে বাধ্য হইলাম। 

এই নিদারুণ সংবাদ পাইবামাত্র নৃত্য একবার উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিল ও দেখিতে দেখিতে সেই স্থানে পতিত হইল। বাড়ীর সকলেই তাহাকে সান্ত্বনা করিতে লাগিল। কিন্তু প্রবল শোক যাহার হৃদয়ে একবার বিদ্ধ হইয়াছে, সান্ত্বনাবাক্যে তাহাকে প্রবোধ দেওয়া কাহার সাধ্য! নৃত্য কাহার কথা শুনিল না, পুনরায় উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে আরম্ভ করিল। এইরূপে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হইয়া গেল পুনরায় আমাকেই কথা কহিতে হইল। আমিই তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, “দেখ নৃত্য, তোমার হৃদয়ে মর্মান্তিক যাতনা উপস্থিত হইয়াছে বলিয়াই তুমি রোদন করিতেছ কিন্তু এখন রোদন করিয়া কোনও ফল নাই ঈশ্বর তোমার ও তাহার অদৃষ্টে যাহা লিখিয়াছিলেন, তাহা হইয়াছে। রোদন করিলে সেই ফলের আর কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হইবে না। আমার বিবেচনায় এখন তোমার নিরস্ত হইয়া, যাহাতে তাহার সৎকার হয় এখন তাহারই উপায় বার করা উচিত, ও আমাদিগকে সাহায্য করিয়া যে ব্যক্তি তোমার হৃদয়ে এই প্রবল যন্ত্রণা প্রদান করিয়াছে, যাহাতে সে ধৃত হইয়া উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হয়, তাহার চেষ্টা করাই এখন তোমার কৰ্ত্তব্য। গৌরব ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার আর প্রত্যাগমন করিবার কোনরূপ উপায় নাই; কিন্তু তোমার অসময়ের সম্বল যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে, তাহার পুনঃ প্রাপ্তির উপায় এখনও আছে। আমাদিগকে বিশেষরূপ সাহায্য করিলে যদি আমরা সেই হত্যাকারীদিগকে ধরিতে সমর্থ হই, তাহা হইলে গৌরবের পরিহিত অলঙ্কারগুলি যে আমরা তাহাদের নিকট হইতে পুনরায় গ্রহণ করিতে পারিব না, এ কথা বলিতে পারি না।” 

আমার কথা শুনিয়া নৃত্য চুপ করিল ও কহিল, “আমাকে কি করিতে হইবে বলুন।” 

আমি বিশেষ কিছুই করিতে হইবে না। কেবল গৌরব কাহার সহিত কোথায় গমন করিয়াছিল? তাহারই যথাযথ বর্ণন করিতে হইবে। 

নৃত্য। মহাশয়, সে অনেক কথা। আমি আমার দুইটি কন্যাকে লইয়া এই স্থানে বাস করিয়া থাকি। ইহারা ব্যতীত আমার আর কেহই নাই। আমি ইহাদিগকে সামান্য বেশ্যাবৃত্তি করিতে দেই নাই। শৈশব কাল হইতেই আমি ইহাদিগকে নৃত্যগীত শিখাইয়াছি। কোন ভদ্রলোক কোন স্থানে আমোদ আহ্লাদ করিবার ইচ্ছা করিলে, প্রায়ই ইহাদিগকে লইয়া গিয়া থাকেন; সুতরাং, বাগানে যাওয়া ইহাদিগের একরূপ প্রধান কার্য্যের মধ্যেই দাঁড়াইয়াছে। কোন ভদ্র লোক ইহাদিগকে কোন বাগানে লইয়া যাইতে চাহিলে, আমি সাহস করিয়া ইহাদিগকে কখনই ছাড়িয়া দিতে পারি না; কারণ, সামান্য পরিমাণে সুরাপান করিলেই ইহারা জ্ঞানশূন্য হইয়া যায়। এই নিমিত্ত যখন ইহারা কোন স্থানে গমন করে তখন আমিও উহাদিগের সঙ্গে গমন করিয়া থাকি। আমরা কেবল একজন কোন স্থানে গমন করি না। যদি কোন বাবু কেবল আমার একটিমাত্র কন্যাকে বাগানে লইয়া যাইতে চাহেন ও একজনের উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করেন, তাহা হইলেও আমি আমার অপর কন্যাকে লইয়া তাহার সহিত গমন করিয়া থাকি। এমন কি নিতান্ত পরিচিত লোক হইলেও আমার কোন কন্যা কখন তাঁহার সহিত একাকী গমন করে না। 

পরশ্ব সন্ধ্যার পর আমি আমার ঘরে বসিয়া আছি, কন্যাদ্বয় তাহাদিগের ওস্তাদের নিকট বসিয়া একটি নূতন গানের রাগ গতের সহিত মিলাইয়া শিক্ষা করিতেছে, এরূপ সময় একটি বাবু আসিয়া আমার ঘরে উপস্থিত হন। তাঁহার সহিত সোনাগাছির রামাদালালও আগমন করিয়াছিল। ঐ বাবুটি আমাদিগের ঘরে আসিয়া উপবেশন করিলেন ও কিয়ৎক্ষণ পরে আমাকে কহিলেন, “বঙ্গদেশীয় একজন সম্ভ্রান্ত জমিদার কলিকাতায় আগমন করিয়াছেন। তাঁহার ইচ্ছা তোমার একটি কন্যাকে তিনি একদিন বাগানে লইয়া যান। গীতবাদ্য প্রভৃতির দ্বারা যদি তোমার কন্যা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিতে পারে, তাহা হইলে আমি তাহাকে তাঁহার নিকট হইতে মাসিক ৩০টি টাকা বেতন স্থির করিয়া দিব। ঘরে বসিয়া সে মাসে মাসে বেতন গ্রহণ করিবে। কেবলমাত্র সপ্তাহে এক দিবস তাহাকে বাগানে গমন করিতে হইবে।” ঐ বাবুটির কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “বাগানে যাওয়াই আমার কার্য্য। তিনি একটিকে বাগানে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আপনাকে বলিয়া দিয়াছেন; আমি দুইটিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। ইহাদিগের মধ্যে যেটিকে তাঁহার পছন্দ হয়, সেইটিকেই তিনি চাকর রাখিতে পারেন। কবে যাইতে হইবে ও প্রথম দিবসের নিমিত্ত কি পাওয়া যাইবে, তাহা আমাকে বলিয়া যান; কারণ, সেই দিবস উহাদিগকে আমি আর অন্য কোন স্থানে পাঠাইয়া দিব না।” আমার কথার উত্তরে তিনি কহিলেন, “আগামী কল্য সন্ধ্যার পর আমি পুনরায় আসিব। সেই সময় সেই জমিদার মহাশয়ের আরও দুই একজন প্রিয় সহচর আগমন করিবেন; কারণ, তাঁহাদিগের পছন্দ না হইলে তোমাদিগকে আমি লইয়া যাইতে পারিব না। যদি তোমার কন্যাদ্বয়কে দেখিয়া তাঁহাদিগের পছন্দ হয়, তাহা হইলে অদ্যই তোমরা আমাদিগের সহিত গমন করিতে পারিবে, ও যদি যাওয়া হয় তাহা হইলে এক রাত্রির নিমিত্ত তোমাদিগকে ২৫ টাকা প্রদান করিব।” আমি কহিলাম, “২৫ টাকা তো যে সে ব্যক্তি আমাদিগকে প্রদান করিয়া থাকে। অত বড় জমিদার হইয়া যদি কেবলমাত্র ২৫ টাকা আমাদিগকে প্রদান করেন তাহা হইলে উহা আমাদিগের উপযুক্ত হইবে তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু, তাঁহার মানা কোথায় থাকিবে?” আমার কথাগুলি শুনিয়া সেই ব্যক্তি কহিলেন, “জমিদার মহাশয়ের সহচরগণ যদি তোমার কন্যাদ্বয়ের মধ্যে কাহাকেও পছন্দ করেন, তাহা হইলে টাকার জন্য আটকাইবে না। এক রাত্রির নিমিত্ত ৫০ টাকা পৰ্য্যন্ত আমি তোমাদিগকে দেওয়াইয়া দিতে পারিব। এই বলিয়া সেই ব্যক্তি সে দিবস চলিয়া গেলেন। কল্য সন্ধ্যার সময় পুনরায় তিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন তাঁহার সহিত রাম দালালকে দেখিতে পাইলাম না। কিন্তু, তাঁহার সহিত অপর তিনটি বাবু আগমন করিয়াছিলেন। প্রথম ব্যক্তি অপর তিন জনকে সঙ্গে লইয়া আমার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া উপবেশন করিলেন, ও আমার কন্যাদ্বয়কে তাঁহাদিগকে দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “আমি যে দুইটি স্ত্রীলোকের কথা বলিয়াছিলাম তাহারা ইহারাই। ইহারা দুই সহোদরা। যদি জমিদার মহাশয় ইহাদিগের মধ্যে কাহাকেও পছন্দ করেন, তাহা হইলে বলুন আমি ইহাদিগকে প্রস্তুত হইতে বলি। তাঁহার কথার উত্তরে ঐ তিনজনের মধ্যে একজন অপর দুই জনের সহিত পরামর্শ করিয়া কহিলেন, “ইহারা দুই জনই দেখিতেছি সমান রূপবতী; গুণবতী বোধ হয় এক রূপই হইবে; সুতরাং ইহাদিগের মধ্যে যে কোনরূপ পার্থক্য আছে তাহা আমার বোধ হইতেছে না। যাহার ইচ্ছা হয় তিনিই গমন করিতে পারেন। তাঁহাকেই জমিদার মহাশয় পছন্দ করিবেন।” এই কথার উত্তরে প্রথম ব্যক্তি কহিলেন, “আমি ইহাদিগের দুই জনকেই যাইতে ইচ্ছা করি। জমিদার মহাশয় নিজে দেখিয়া শুনিয়া পছন্দ করিয়া লউন।” উত্তরে তিনি কহিলেন, “এ উত্তম কথা”। 

এইরূপ কথাবার্তার পর প্রথম ব্যক্তি আমার কন্যাদ্বয়কে প্রস্তুত হইতে কহিলেন। দেখিতে দেখিতে তাহারা প্রস্তুত হইল। একটি বড় জমিদারের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছে; বিশেষ তাঁহার পছন্দ হইলে মাসিক বেতন হইবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা আছে ভাবিয়া দুই ভগ্নীই দুইখানি অতি উৎকৃষ্ট বেনারসী শাড়ী পরিধান করিল ও উভয়ের যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহা দ্বারা উভয়েই আপনাপন অঙ্গ শোভিত করিল। আমি একখানি সাদা কাপড় পরিয়া তাহাদিগের সহিত গমন করিতে প্রস্তুত হইলাম। রাত্রিযাপন করিবার কালীন কন্যাদ্বয়ের যদি বস্ত্র পরিধান করিবার প্রয়োজন হয়, এই ভাবিয়া দুইখানি বেশী বস্ত্র আমার সহিত গ্রহণ করিলাম। দুইখানি গাড়িতে করিয়া তাঁহারা চারিজন আগমন করিয়াছিলেন, ঐ গাড়ি দুইখানিই আমাদিগের দরজায় দাঁড়াইয়া ছিল। গৌরব প্রথমেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া ঐ গাড়ির একখানিতে গিয়া উপবেশন করিল। সে গাড়িতে বসিবামাত্রই যে তিন ব্যক্তি কেবলমাত্র সেই দিন আগমন করিয়াছিল, তাহারাও গিয়া সেই গাড়িতে উঠিল। প্রথম ব্যক্তি শৈরব ও আমাকে লইয়া অপর গাড়িতে উঠিলেন, ও আমাদিগকে কহিলেন, “উহারা যখন তোমার অপর কন্যার গাড়িতে উঠিয়াছেন, তখন আর তাহাকে এই গাড়িতে আনা ভাল দেখায় না।” আমাদিগকে এই বলিয়া তিনি দুই গাড়ির গাড়োয়ানকেই ডাকিয়া কহিয়া দিলেন, “তোমরা কেহ অগ্র পশ্চাৎ গমন করিও না, দুইখানি গাড়িই একত্রে লইয়া যাইও।” তাঁহার কথা শুনিয়া আমি আর কোনরূপ প্রতিবাদ করিলাম না। গাড়ি দুইখানি চলিতে লাগিল। দেখিলাম দুইখানি গাড়িই অনেক দূর পর্য্যন্ত একত্র গমন করিল। তাহার পর আমাদিগের গাড়ির ঘোড়ার রাস ছিঁড়িয়া গেল। ঐ রাস বাঁধিয়া লইতে অনেকক্ষণ বিলম্ব হইল। সেই সময় অপর গাড়িখানি যে কোন দিকে চলিয়া গেল তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমাদিগের সহিত যে ব্যক্তি গমন করিতেছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কহিলেন, “উহারা যে বাগানে গমন করিলেন সেই বাগান আমি চিনি। সেইস্থানে তোমাদিগকে লইয়া আমি অনায়াসেই গমন করিতে পারিব। তাহার নিমিত্ত তোমাদিগের চিন্তা নাই।” তাঁহার কথা শুনিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম ও সেই গাড়ির ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। সহর পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্ধকারের মধ্য দিয়া সেই গাড়ি নিতান্ত আস্তে আস্তে চলিতে লাগিল। ক্রমে রাত্রি ১১টা বাজিয়া গেল তথাপি আমরা সেই বাগানে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিলাম না। এইরূপে আরও দুই ঘণ্টা গমন করিবার পর, একস্থানে গিয়া আমাদিগের গাড়ী থামিল। সেইস্থানে তিনি অবতরণ করিলেন ও আমাদিগকেও নামিতে কহিলেন। আমরা গাড়ী হইতে অবতরণ করিবার পর গাড়োয়ান তাহার গাড়ী লইয়া চলিয়া গেল। তিনি আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া একটি অন্ধকার গলির মধ্যে প্রবেশ করিলেন ও কহিলেন, “একটু গমন করিলেই আমরা বাগানে গিয়া উপস্থিত হইব।” এই বলিয়া তিনি দ্রুতপদে অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। এইরূপে অন্ধকারের মধ্যে আর কিছুদূর গমন করিবার পর আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে কত ডাকিলাম; কিন্তু, আমাদিগের কথার কেহই উত্তর দিলেন না। আমরা অনন্যোপায় হইয়া যে স্থানে গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়াছিলাম সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। সেই স্থানের অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইল উহার চতুর্দিকে বাগান ও জল। নিকটবর্তী কোন স্থানে কোনরূপ লোকজনের বসতি নাই। এই অবস্থায় ফিরিতে হইয়া আমাদিগের মনের গতিক সেই সময় যে কি হইয়াছিল তাহা আপনারাই অনুমান করিয়া দেখুন। আমার নিকট যে আর দুইখানি বস্ত্র ছিল, তাহার একখানি আমার কন্যাকে পরিধান করিতে দিলাম; কারণ, সেই সময় পরিধানে ভাল কাপড় ও অলঙ্কার দেখিতে পাইলে দুষ্ট লোকে নানা রূপ বিপদ ঘটাইতে পারে। আমার কন্যা বস্ত্র পরিবর্তন করিলে তাহার অঙ্গ হইতে সমস্ত অলঙ্কারগুলি খুলিয়া পরে কাপড়খানিতে বাঁধিয়া লইলাম। সেই স্থানের রাস্তাঘাট চিনি না, কোন দিকে যাইব জানিনা, কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার লোক নাই, গাড়ী প্রভৃতি ভাড়া পাইবারও উপায় নাই; সুতরাং, অনন্যোপায় হইয়া একদিকে চলিতে লাগিলাম। এইরূপে চলিতে চলিতে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। সেই সময় দেখিতে পাইলাম আমরা একটি পাড়াগাঁয়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। সেই গ্রামের একটি ভদ্রলোকের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার নিকট আমাদিগের দুঃখের কথা কহি। তিনি আমাদিগকে এক স্থানে বসাইয়া অনেকরূপ চেষ্টা করিয়া একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া দেন। ঐ গাড়িতেই আমরা এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। আমাদিগের অবস্থাতো এইরূপ হইয়াছে; কিন্তু, ইহার পূর্ব্বে আমার বড় কন্যার কি অবস্থা ঘটিয়াছিল তাহা জানিতে না পারিয়া আরও উদ্বিগ্ন হইয়াছিলাম, এরূপ সর্ব্বনাশ ঘটিবে তাহা কিন্তু একবারের নিমিত্তও ভাবিয়াছিলাম না।” 

নৃত্যের কথা শুনিয়া সমস্ত অবস্থা বুঝিতে পারিলাম। চারিজন একত্রে মিলিত হইয়া এই কার্য্য করিয়াছে। তিনজন এই হত্যাকার্যে লিপ্ত ছিল, অপর একজন, যাহাতে ইহাদিগের দুইজনকে শৈরবের নিকট হইতে পৃথক রাখিতে পারা যায় সেই কার্য্য করিয়াছিল। কারণ তিনটি স্ত্রীলোকে একত্র থাকিলে এ কাৰ্য্য সহজে সম্পন্ন হইতে পারিত না। 

অনুসন্ধানের রাস্তা বাহির হইল। ক্রমে রামা দালালের অনুসন্ধান করিলাম, ও সোনাগাছিতেই তাহাকে পাইলাম। যাহার সহিত সে প্রথমে নৃত্যর বাড়ীতে আসিয়াছিল, তাহাকে সে চিনিত; সুতরাং, তাহার সাহায্যে সেই আসামী ধৃত হইল, এই ব্যক্তি নৃত্য ও শৈরবকে জঙ্গলের ভিতর ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছিল। অনেক পীড়াপীড়ির পর সে সমস্ত কথা স্বীকার করিল, ও তাহার সঙ্গী অপর তিনজনেরও ঠিকানা বলিয়া দিল। বলা বাহুল্য, তাহারাও ধৃত হইল। অপহৃত অলঙ্কারের মধ্য হইতে অনেক অলঙ্কার তাহাদিগের নিকট হইতে বাহির হইয়া পড়িল। 

গাড়োয়ান দুইজনকেও পাওয়া যায়। তাহারা ও শম্ভু এই মোকদ্দমার সাক্ষি হইয়াছিল। বিচারে চারিজন আসামীর বিপক্ষে এই মোকদ্দমা প্রমাণিত হওয়ায় প্রধান বিচারালয় হইতে সকলেই আজীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত হয়। 

[আশ্বিন, ১২৯৯] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *