অর্থই অনর্থ (অর্থাৎ অর্থলাভে বিশ্বস্ত বন্ধুর সর্ব্বনাশ!

অর্থই অনর্থ (অর্থাৎ অর্থলোভে বিশ্বস্ত বন্ধুর সর্ব্বনাশ!) 

অবতরণিকা 

দশ বৎসরেরও অধিক হইবে, আশ্বিন মাসের প্রথমেই গোপিনাথ দাস নামক এক ব্যক্তি কলিকাতা হইতে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়। অনুসন্ধান করিয়া উহাকে বাহির করিবার ভার পরিশেষে আমারই উপর ন্যস্ত হয়। 

এই কলিকাতা সহরের মধ্য হইতে নিত্য নিত্য কত লোক কতরূপে নিরুদ্দেশ হইয়া যাইতেছে, উহাদিগের আত্মীয়স্বজন কতস্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিয়া পরিশেষে বিফল মনোরথ হইয়া স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেছে, কিন্তু সেই সকল বয়ঃপ্রাপ্ত নিরুদ্দেশ ব্যক্তিগণের অনুসন্ধানের ভার কখন কোন ডিটেকটিভ পুলিস কর্মচারীর উপর অর্পিত হইতে দেখি নাই। তবে গোপিনাথ দাসকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে আমি নিযুক্ত হইলাম কেন? 

পাঠকগণ যখন জানিতে পারিবেন, কিরূপ ভয়ানক অবস্থায় পড়িয়া গোপিনাথ নিরুদ্দেশ হইয়াছে, তখন বুঝিতে পারিবেন, যে এরূপভাবে যে ব্যক্তি নিরুদ্দেশ হয়, তাহার অনুসন্ধান করা পুলিসের একটি প্রধান কর্তব্যকৰ্ম্ম। 

এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়া যেরূপ পরিশ্রম, ও যে সকল উপায় অবলম্বন করিয়া ইহার আনুষঙ্গিক বিষয় সকল অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ বর্ণন করিতে হইলে এই প্রবন্ধ নিতান্ত দীর্ঘ হইয়া পড়িবে, অথচ সেই সকল নীরস বিবরণ পাঠে পাঠকবর্গের ধৈর্য্য কোন প্রকারেই স্থির থাকিবে না, এই বিবেচনায় অনুসন্ধানের সেই জটিল অংশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক, অনুসন্ধানে যাহা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, কেবল তাহারই সারাংশ বর্ণিত হইলমাত্র। 

গোপিনাথের নিরুদ্দেশ হইবার ছত্রিশ বৎসর পূর্ব্ব হইতে যে সকল ঘটনা ঘটিয়া আসিয়াছে, তাহার স্থূল বিবরণ প্রথমেই পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করা আমার বিবেচনায় একান্ত কর্তব্য। কারণ প্রথম হইতে যে সকল ঘটনা ঘটিয়া আসিতেছে, ধারাবাহিকরূপে তাহার স্থুল বিবরণ পাঠকগণকে না জানাইয়া, মধ্য হইতে কতক অবস্থা যদি তাঁহাদিগকে বলিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে ঘটনাচক্রের আনুপূর্ব্বিক অবস্থা তাঁহারা কোন প্রকারেই উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইবে না। সুতরাং গল্পের প্রকৃত রসাস্বাদনও তাঁহাদিগের পক্ষে একরূপ অসম্ভব হইয়া উঠিবে। 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

গদাধর বসু ফুলবাগানের একজন সম্পত্তিশালী লোক ছিলেন। তাঁহার পূর্ব্ব বাসস্থান যে কোথায় ছিল, কোথা হইতে আগমন করিয়া তিনি যে কলিকাতায় বসবাস করেন, তাহা কিন্তু এখন কেহই বলিতে পারেন না। গদাধর ব্যবসায়ী লোক ছিলেন, ব্যবসাকাৰ্য্য অতি উত্তমরূপে বুঝিতেন, সুতরাং ব্যবসাতেই ক্রমে তাঁহার বিশেষ উন্নতি হইয়াছিল। ব্যবসার উপর নির্ভর করিয়া তিনি প্রায় দুই লক্ষ টাকার সংস্থান করিয়াছিলেন। 

গদাধর যেমন অগাধ সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন, সংসারে কিন্তু তাঁহার তেমন আত্মীয়স্বজন কেহই ছিল না। আপনার লোকের মধ্যে কেবলমাত্র স্ত্রী—চাঁপা ও একমাত্র পুত্র পরাণ। পরাণ ক্রমে বড় হইতে লাগিল, তাহার বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পিতামাতার স্নেহও ক্রমে বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। চাঁপা ক্ষণকালের নিমিত্ত তাহাকে নয়নের অন্তরাল করিতে পারিতেন না। বালকের রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবা শুশ্রূযার নিমিত্ত পর্য্যাপ্ত পরিমিত দাস-দাসী থাকিলেও চাঁপা স্বহস্তে তাহাকে বেশ-ভূষায় সজ্জিত করাইতেন, আহারীয় বা পানীয় দ্রব্য স্বহস্তে প্রদান করিতেন। শিশুও ক্রমে মাতৃস্নেহ বুঝিতে পারিল, সেও অঞ্চল ধরিয়া সর্ব্বদা মাতার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। 

পঞ্চম বৎসর বয়ঃক্রমের সময় পরাণের ‘হাতে খড়ি’ হইল। গদাধর উপযুক্ত শিক্ষকের হস্তে পরাণকে অর্পণ করিলেন। শিক্ষক গদাধরের বাড়ীতে থাকিয়াই পরাণকে যথাসাধ্য শিক্ষা প্রদান করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে এক এক বৎসর করিয়া ক্রমে কয়েক বৎসর অতীত হইয়া গেল, পরাণ ক্রমে দশ বৎসর বয়ঃক্রমে পদার্পণ করিল। 

এতদিবস পর্য্যন্ত পরাণ যেরূপ সুখ-সম্ভোগের সহিত কালাতিবাহিত করিয়া আসিতেছিল, দশমবর্ষে পদার্পণ করিবার কয়েকমাস পরেই তাহার সেই সকল সুখ বিদূরিত হইবার উপক্রম হইল। তাহার অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ—জীবনরূপী রাক্ষস বিকট আস্যে হাস্য করিতে লাগিল। 

সেই সময়ে পরাণের স্নেহময়ী জননী চাঁপা রুগ্ন-শয্যায় শয়ন করিলেন। গদাধর তাঁহার চিকিৎসার নিমিত্ত অনেক অর্থব্যয় করিলেন। সেই সময়ে সহরে যে সকল প্রধান প্রধান চিকিৎসক ছিলেন, একে একে প্রায় সকলেই চাঁপাকে দেখিলেন; কিন্তু কেহই সেই প্রবল রোগের হস্ত হইতে তাঁহাকে মুক্ত করিতে পারিলেন না। 

ক্রমাগত তিন চারি মাস শয্যাগত থাকিয়া পরাণের স্নেহময়ী জননী পরিশেষে পুত্রস্নেহ ভুলিলেন, স্বামীর ভালবাসা আর তাঁহার হৃদয়ে স্থান পাইল না, সংসারের নানারূপ সুখের প্রলোভন আর তাঁহার জীবনকে ফিরাইতে পারিল না। তিনি ইহজীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ পরিত্যাগ করিয়া, প্রণয় স্নেহ ভালবাসাতে জলাঞ্জলি দিয়া, সুখের সংসার অন্ধকার করিয়া, স্বামী ও পুত্রের সম্মুখে তাঁহার সেই সুদীর্ঘ সুনীল চক্ষুদ্বয় চিরদিনের নিমিত্ত মুদিত করিলেন। 

চাঁপার অকাল-মৃত্যুতে সেই দশম বৎসর বয়স্ক বালক পরাণ অধীর হইয়া পড়িল। শোকে নিতান্ত অধীর হইয়া মা-মা বলিয়া অনবরত রোদন করিতে লাগিল। দাসদাসীগণ পরাণকে কোন প্রকারেই সান্ত্বনা করিতে পারিল না, গদাধরের প্রবোধবাক্যও পরাণের হৃদয়ে স্থান পাইল না। 

যাহাতে পরাণ চাঁপাকে ভুলিতে পারে, গদাধর এখন তাহারই চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এখন হইতে তাহাকে সর্ব্বদা আপনার নিকটে রাখিতেন; এখন হইতে পরাণের সহিত একত্র শয়ন, একত্র ভোজন, একত্র ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন; এককথায় এখন হইতে তিনি পরাণের অনুগামী ছায়ার ন্যায় চলিতে লাগিলেন। পিতৃস্নেহ পাইয়া পরাণও ক্রমে মাতার শোক বিস্মৃত হইতে লাগিল। এইরূপে দুই বৎসর অতীত হইয়া গেল। 

মনুষ্যগণ যদি ভবিষ্যৎ বুঝিতে পারিতেন, পরিণামে কি কার্য্যের কিরূপ ফল ফলিবে, তাহা যদি সকলে অনুমান করিতে পারিতেন, তাহা হইলে এ জগতে কাহাকেই কষ্ট পাইতে হইত না; সকলেই মনের সুখে, সুখ-স্বচ্ছন্দে কালাতিবাহিত করিতে পারিতেন; এই ধরাধাম স্বর্গধামে পরিণত হইত! কিন্তু মানবের অদৃষ্ট ইহার বিপরীত! 

আজ গদাধরের অদৃষ্টেও তাহাই হইল। তিনি ভবিষ্যৎ বুঝিতে না পারিয়া, আপনার মনস্তাপের পথ পরিষ্কার করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

আজকাল সংসারের রীতি-নীতি অতি ভয়ানক! এ সংসারে রূপের প্রশংসা নাই, গুণের বিচার নাই; দয়াধর্ম্মের আদর নাই, প্রণয় ভালবাসার পুরস্কার নাই; আছে কেবল তার্থ। যাহার অর্থ আছে, সেই রূপবান্; যাহার অর্থ আছে সেই গুণবান্! অর্থ না থাকিলে কেহ তাহাকে বিদ্বান বলে না, যাহার অর্থ নাই, সে জ্ঞানহীন! অর্থবান্ নরঘাতী হইলেও লোকে তাহাকে দয়ালু কহে, তস্করও অর্থের বলে ধার্ম্মিক বলিয়া পরিগণিত হয়! পিশাচের হস্তে অর্থ পড়িলে সে প্রণয়ী হয়, তখন তাহারও হৃদয়ে ভালবাসার স্রোত বহিতে থাকে! ধনবান ব্যক্তি কখন বৃদ্ধ হন না, অশীতি বৎসর বয়ঃক্রমেও তিনি যুবক বলিয়া পরিগণিত! 

গদাধরের সহস্র দোষ থাকিলেও, তিনি দুই লক্ষ টাকার অধিকারী; সুতরাং গদাধর সর্ব্বগুণে বিভূষিত! তাঁহার বয়ঃক্রম যতই হউক না কেন, তাঁহাকে যুবক ভিন্ন আর কিছুই বলা যাইতে পারে না! 

গদাধরের স্ত্রী-বিয়োগ হইতে না হইতেই, তাঁহার সহিত নিজ কন্যার বিবাহ দিবার নিমিত্ত যে কত লোক আসিয়া তাহার তোষামোদ করিতে আরম্ভ করিল, তাহার হিসাব কে রাখে? পুনর্ব্বার বিবাহ করিবেন না বলিয়া গদাধর প্রথম প্রথম অনেককে বিদায় করিলেন। ক্রমে ‘না হুঁ’ আরম্ভ হইল, পরিশেষে দুই বৎসর গত হইতে না হইতেই বিবাহ করাই স্থির করিলেন। বড় একটি পাত্রীও জুটিয়া গেল। অশুভলগ্নেই শুভকাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গেল! পরাণের নূতন মা তারা আসিয়া গদাধরের অন্তঃপুর অধিকার করিয়া বসিলেন। 

যিনি আসিয়া চাঁপার আসন গ্রহণ করিলেন, তাঁহার প্রকৃতি, চাঁপার প্রকৃতির তুলনায় সম্পূর্ণরূপ ভিন্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। চাঁপা যাহার উপর সদয় ছিলেন, তারা তাহার উপর নির্দয়। চাঁপা যাহাকে ভালবাসিতেন, তারা তাহাকে দুই চক্ষে দেখিতে পারেন না। দাস-দাসীগণ যে কার্য্যের নিমিত্ত চাঁপার নিকট পুরস্কৃত হইত, তাহার নিকট তাহারা কার্য্যের নিমিত্ত অযথা কটু-কাটব্য শ্রবণ করিতে লাগিল। চাঁপা ছিলেন মিষ্টভাষিণী, তারা হইলেন মুখরা চাঁপার কথায় সকলেই সন্তুষ্ট হইতেন, তারার কথায় সকলেই মৰ্ম্মাহত! 

বাড়ীর লোকজন দাস-দাসী প্রভৃতি কেহই তারার ব্যবহারে সন্তুষ্ট নহে। পুরাতন ভৃত্যগণ তাহার ব্যবহারে একে একে কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিল। 

তারার হৃদয় শত সহস্র দোষে দূষিত হইলেও, গদাধর কিন্তু তাহার হৃদয় স্বচ্ছকাচের ন্যায় দেখিতে লাগিলেন। দাস-দাসী লোকজন প্রভৃতির উপর দুর্ব্যবহার, গদাধরের নিকট তারার একবিন্দু অশ্রুজলে বিধৌত হইতে লাগিল। ক্রমে গদাধর বুঝিতে লাগিলেন, সকলেই দোষী, নির্দোষ কেবল তারা! 

হায়! কালের কি বিচিত্র গতি! অপত্যস্নেহে যাঁহার হৃদয় এতদিবস পর্য্যন্ত দৃঢ়রূপে আবদ্ধ ছিল, তারার ভীষণ কুটিলচক্রে পড়িয়া তাঁহার সেই অপত্যস্নেহ ক্রমে দূরে পলায়ন করিতে লাগিল! যে পরাণ এতদিবস পর্য্যন্ত পিতার আনন্দ বর্দ্ধন করিয়া আসিতেছিল, আজ সেই পরাণকে দেখিয়াই গদাধরের হৃদয়ে নিরানন্দের বীজ অঙ্কুরিত হইতে লাগিল! 

এইরূপ আরও দুই বৎসর অতীত হইয়া গেল। ক্রমেই তারা স্বামীর যেরূপ সোহাগিনী হইতে লাগিলেন, তাঁহার প্রাধান্যও সেইরূপ বাড়িতে লাগিল। সেই সময়ে তারা একটি কন্যাসন্তান প্রসব করিলেন। গদাধর আদর করিয়া কন্যার নাম রাখিলেন রাণী। দাস-দাসীগণ রাণীকে বিশেষরূপে আদর ও যত্ন করিতে লাগিল। পরাণ অপেক্ষা রাণীর আদর, বোধ হয়, সহস্রগুণ বাড়িল। মনিব যাহাকে প্রাণের সহিত ভালবাসেন, ইচ্ছায় হউক বা অনিচ্ছায় হউক, অনুচরবর্গকে তাহার শতগুণ ভালবাসা দেখাইতে হয়; সুতরাং রাণী সকলের নিকটেই অধিক ভালবাসা পাইতে লাগিল। আর সেইসঙ্গে পরাণ সকলের চক্ষে বিষস্বরূপ হইয়া উঠিতে লাগিল। 

পরাণ আর এখন স্নেহময় পিতার পূর্ব্বের ন্যায় প্রিয়তম পুত্র নহে! জানি না, কি কারণে এখন গদাধর আর তাহাকে দেখিতে পারেন না, ইচ্ছায় হউক বা অনিচ্ছায় হউক তাহাকে আর মিষ্টকথা বলিতে পারেন না। ভ্রমক্রমে যদি কোনদিন তিনি পরাণের প্রতি কোনরূপ সদয় ব্যবহার করেন, তাহা হইলে সে দিন মহাপ্রলয় উপস্থিত হয়; তারার নয়নজলে রাশিরাশি বস্ত্র সিক্ত হইয়া যায়! সুতরাং পরাণের অনিচ্ছাসত্ত্বেও শত্রুবৎ ব্যবহার না করিলে গদাধরের আর উপায় থাকে না। 

এইরূপ অবস্থায় পড়িয়া পরাণ আরও দুই বৎসর অতিবাহিত করিল। কিন্তু এই দুই বৎসরকাল তাঁহাকে যে কত কষ্টভোগ করিতে হইল, তাহা বর্ণন করা এই ক্ষুদ্র লেখনীর কর্ম্ম নহে। দুই-লক্ষ ধন-পতির পুত্র হইয়া পরাণকে অনেক দিবস উপবাসে কালযাপন করিতে হইয়াছে, বিনাদোষে বিমাতার নিকট সহস্র কটূক্তিও শুনিতে হইয়াছে! পিতা এই সকল অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াও তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টাই করেন নাই। অধিকন্তু তারার মনস্তুষ্টির নিমিত্ত, বরং তাহারই পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন। 

পরাণের বয়ঃক্রম এখন ষোড়শ বৎসর। যেমন হউক, একটু লেখাপড়াও পরাণ শিখিয়াছিল। সে পিতামাতার এইরূপ নিদয় ব্যবহার আর কোনরূপেই সহ্য করিতে না পারিয়া, একদিন মনের কষ্টে বিনাসম্বলে একাকী পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করিল। কোথায় যাইবে, কি করিবে, কি খাইয়া জীবনধারণ করিবে, এ ভাবনা ক্ষণকালের নিমিত্তও না ভাবিয়া, ভক্তিভাবে আপনার স্বর্গীয় মাতার চরণে প্রণিপাতপূর্ব্বক অশ্রুপূর্ণ-লোচনে একাকী পিতৃভবন পরিত্যাগ করিল। ইচ্ছা—মুষ্টিভিক্ষা করিয়া জীবনধারণ করিতে হয়, তাহাও করিবে; তথাপি এই পাপপুরে আর পদার্পণ করিবে না। পিতা বা বিমাতার মুখ এ জন্মে আর দর্শন করিবে না। 

পিতৃভবন পরিত্যাগ করিয়া পরাণ চলিল। বাটী হইতে পরাণ ইতিপূর্ব্বে কখনও বহির্গত হয় নাই, দূরপথ অতিক্রমজনিত ক্লেশ ইতিপূর্ব্বে পরাণ সহ্য করে নাই; কিন্তু আজ পরাণকে তাহার সমস্তই অবলীলাক্রমে সহ্য করিতে হইল! কপদকমাত্র সম্বলশূন্য পরাণ কেবলমাত্র কতকগুলি কাগজপত্র ও কয়েকখানি পুস্তক সঙ্গে লইয়া চলিতে লাগল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

পরাণ কোন পথ অবলম্বনে কিরূপে কোন্ কোন্ স্থান দিয়া গমন করিল, তাহা আমরা জানিতে পারি নাই। কিন্তু বাটী হইতে বহির্গত হইবার প্রায় দুই মাস পরে, পরাণ বর্দ্ধমানে গিয়া উপস্থিত হয়। সেইস্থানে একজন বস্ত্রবিক্রেতার দোকানে মাসিক দুই টাকা বেতনে পরাণ কিছুদিবস কৰ্ম্ম করে। আহারাদির ব্যয় পরাণের বেতন হইতে লাগিত না, দোকানদারের বাসাতেই আহারাদি চলিয়া যাইত। এইরূপে প্রায় এক বৎসরকাল সেইস্থানে কর্ম্ম করিয়া পরাণ বর্দ্ধমান পরিত্যাগ করিল। 

বর্দ্ধমান পরিত্যাগের পর পরাণের সন্ধান পাইলাম, একেবারে আগ্রা সহরে। আরও অবগত হইলাম, বর্দ্ধমান হইতে আগ্রায় যাইবার কালে পথিমধ্যে কিরণ নামধেয় একটি যুবকের সহিত তাহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। বয়সে কিরণ প্রায় পরাণের সমতুল্য হইবে। পিতামাতার অকালমৃত্যুতে কিরণ বিশেষ কষ্টে পতিত হয়; তাহার উপর জ্ঞাতিগণ একত্র হইয়া, তাহার যে কিছু বিষয় সম্পত্তি ছিল, তাহার সমস্তই অপহরণ করিয়া লয়, এবং পরিশেষে তাহার প্রাণ নষ্ট করিবার অভিপ্রায়ে নানারূপ কৌশল অবলম্বন করে। এই সকল কারণে কিরণ আপনার বাসস্থান পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়া নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছে। কিরণ তাহার এইরূপ পরিচয় প্রথমেই পরাণের নিকট প্রদান করিয়াছিল। 

পরাণ যেরূপ অদৃষ্টচক্রে ঘুরিতেছে, কিরণের অদৃষ্টও প্রায় সেইরূপ। পরাণ পিতামাতার জ্বালায় দেশত্যাগী, কিরণ জ্ঞাতিবর্গের জ্বালায় পথের ভিখারী। সুতরাং উভয়ের অবস্থা একই। উভয়েরই থাকিবার ঠিকানা নাই, ভ্রমণের উদ্দেশ্য নাই; কাজেই উভয়ের মধ্যে ক্রমে ভালবাসার সঞ্চার হইতে লাগিল। উভয়েরই শয়নের স্থান বৃক্ষমূলে, বসিবার স্থান মৃত্তিকা, ভ্রমণের স্থান অনির্দিষ্ট বা অসীম রাজবর্ষ। কাজেই উভয়ের মধ্যে ক্রমে ভালবাসা বাড়িতে লাগিল। উহাদিগকে যিনি দেখিলেন, তিনিই কহিলেন, উভয়ের মধ্যে কোনরূপ ভিন্নভাব নাই; উভয়ের একই হৃদয় একই আত্মা। কিন্তু এইসকল দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে, যিনি মানব-চরিত্র উত্তমরূপ অধ্যয়ন করিয়াছেন, সেইরূপ কোন মহাত্মা যদি সেই সময়ে উপস্থিত থাকিয়া উভয়ের হৃদয় পরীক্ষা করিয়া দেখিতেন, বিশেষ মনোযোগের সহিত উভয়ের ভাবভঙ্গি এবং গতিবিধি লক্ষ্য করিতেন, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, তিনি কহিতেন যে, পরাণের হৃদয় নিৰ্ম্মল ও সরলতায় পরিপূর্ণ, কিন্তু কিরণের হৃদয়ে সেই সরলতার লেশমাত্রও নাই; তাহা পরাণের হৃদয় হইতে সম্পূর্ণরূপ বিপরীত। পরের দুঃখ ও কষ্ট দেখিলে, পরাণের হৃদয় সতত কাঁদিয়া থাকে, সেই কষ্টের অপনোদনের নিমিত্ত পরাণ সর্ব্বদা যত্নবান হয়ে, কিন্তু কিরণের হৃদয় কাঁদে নিজের দুঃখে, কিরূপে আপনার সুখ—সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হয়, কিরণের লক্ষ্য কেবল সেইদিকে। পরাণ পরের নিমিত্ত সৰ্ব্বত্যাগী হইতে পারেন, কিন্তু কিরণের লক্ষ্য নিজের স্বার্থব্যতীত অপরদিকে পতিত হয় না। 

আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময়ে আগ্রায় বাঙ্গালীর সংখ্যা এখন অপেক্ষা অনেক অল্প ছিল। কার্য্যোপলক্ষে যাঁহারা সেই সময়ে সেইস্থানে অবস্থিতি করিতেন, তাঁহারা এখনকার মত অপরিচিত অথচ বিপদগ্রস্ত অবস্থায় পরিচিত প্রতারক বাঙ্গালীদিগের দ্বারা প্রতারিত হইতেন না। সেই সময়ে দূরদেশস্থিত বাঙ্গালীমাত্রই অপরিচিত বাঙ্গালীর কথায় বিশ্বাস করিতেন, কষ্টের কথা শুনিয়া বিশেষ সহানুভূতি দেখাইতেন ও প্রাণপণে তাহার কষ্ট—অপনোদনের চেষ্টা করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইতেন না। 

পরাণ ও কিরণ উভয়ে আগ্রায় উপনীত হইয়া জয়চন্দ্ৰ নামক জনৈক বাঙ্গালী দোকানদারের আশ্রয় গ্রহণ করিল। উভয়েই জয়চন্দ্রের নিকট অপরিচিত হইলেও তিনি তাহাদিগের উপর বিশেষ সহানুভূতি দেখাইয়া উভয়কেই সাদরে আশ্রয় প্রদান করিলেন। পরাণ ও কিরণ কিন্তু আপনাদিগের প্রকৃত পরিচয় গোপনে রাখিয়া তাঁহার নিকট ছদ্ম পরিচয়ে পরিচিত হইল। তবে যেরূপ কষ্টে পড়িয়া উভয়েই আপনাপন বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহার সমস্তই জয়চন্দ্রের নিকট আনুপূর্বিক কহিল। উহাদিগের অবস্থা শুনিয়া জয়চন্দ্র অশ্রুবিসর্জ্জন না করিয়া থাকিতে পারিলেন না। পরাণ জয়চন্দ্রের দোকানের কর্ম্ম-কার্য্য সকল দেখিতে লাগিল। তাহার কার্য-পটুতায় এবং সরল ব্যবহারে দোকানদার জয়চন্দ্র তাহার উপর দিন দিন সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। সেই সময়ে দোকানের জনৈক কৰ্ম্মচারী কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া জয়চন্দ্র পরাণকেই সেই কর্ম্মে নিযুক্ত করিলেন। পরাণের উৎসাহে এবং যত্নে ক্রমেই দোকানের বিশেষ শ্রীবৃদ্ধি হইতে লাগিল। এই দোকানে পূর্ব্বে যেরূপ লাভ হইত, সেই লাভের পরিমাণ ক্রমে দ্বিগুণে পরিণত হইল। দোকানের শ্রীবৃদ্ধি এবং পরাণের কাৰ্য্য-পটুতা দেখিয়া জয়চন্দ্ৰ বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া পরাণের বেতন পঁচিশ টাকা হইতে ক্রমে পঞ্চাশ টাকা করিয়া দিলেন। বেতনের টাকা হইতে অতি অল্পই পরাণকে ব্যয় করিতে হইত। অবশিষ্ট যাহা থাকিত, তাহা পরাণ গ্রহণ করিতেন না, উহা জয়চন্দ্রের নিকটই জমা থাকিত। 

জয়চন্দ্রের দোকানে পরাণ কৰ্ম্ম করিতে নিযুক্ত হইবার কিছুদিবস পরেই গোপিনাথ দাস নামক এক ব্যক্তি কোথা হইতে আগ্রায় গমন করে। সে প্রথমে জয়চন্দ্রের দোকানে যায়, সেইস্থানেই পরাণের সহিত তাহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। জানি না, কি কারণে পরাণ গোপিনাথের উপর সদয় হন, ও আপনার বাসস্থানেই তাহাকে আশ্রয় প্রদান করেন। পরাণের আশ্রয় পাইয়া এবং পরাণের ব্যবহারে নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া গোপিনাথ আর পরাণকে পরিত্যাগ করে না, ক্রমে তাহার দাসত্ব করিতে প্রবৃত্ত হয়। প্রথম প্রথম গোপিনাথ পরাণের নিকট হইতে মাসিক দুই টাকা বেতন প্রাপ্ত হইত, কিন্তু তাহার প্রভুভক্তি দেখিয়া পরাণ তাহার বেতন দুই টাকা হইতে ক্রমে পাঁচ টাকা করিয়া দেন। পরাণ ও তাঁহার ভৃত্য গোপিনাথ কাহাকেও বেতন হইতে আহারাদির ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে হইত না; সে সমস্ত ব্যয় জয়চন্দ্র বহন করিতেন। জয়চন্দ্রের অন্নব্যয় যথেষ্ট ছিল, এই দুই ব্যক্তি ব্যতিরেকে অপরাপর অনেকেই তাহার অন্নে প্রতিপালিত হইত। 

কিরণ যে আগ্রায় একেবারে বেকার অবস্থায় বসিয়াছিল, তাহা নহে। জয়চন্দ্রের যত্নে একজন মাড়ওয়ারির দোকানে তাহারও একটি কৰ্ম্ম হয়; সেই কর্ম্মের উপর নির্ভর করিয়া কিরণও দিনযাপন করিতে লাগিল। তাহারও আহারাদির ব্যয় জয়চন্দ্রই বহন করিতে লাগিলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

এইরূপে মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর অতিবাহিত হইল। কিরণ, পরাণ এবং গোপিনাথ আগ্রাতেই দিনযাপন করিতে লাগিলেন। গোপিনাথ এবং পরাণের মধ্যে চাকর মনিব সম্বন্ধ থাকিলেও ইহারা যেরূপভাবে একত্র কালাতিপাত করিত, তাহা দেখিয়া অন্য কেহই বলিতে পারিত না যে, ইহারা চাকর ও মনিব। এককথায় গোপিনাথ চাকর হইলেও পরাণ তাহাকে বন্ধুর ন্যায় দেখিতেন। কিরণের নিকট যেমন তাহার কোন বিষয় গুপ্ত ছিল না, গোপিনাথও সেইরূপ পরাণের সকল বিষয় অবগত ছিল। এমনকি বহুদিবস একত্র থাকায় গোপিনাথ, পরাণ ও কিরণের প্রকৃত পরিচয় পর্য্যন্তও অবগত হইতে পারিয়াছিল। যাহার অন্নে পরাণ প্রতিপালিত হইতেন, সেই জয়চন্দ্র যে সকল বিষয় অবগত ছিলেন না, গোপিনাথ তাহা জানিত। 

ধনবানের পুত্র হইয়া পরাণ অনেক কষ্টভোগ করিয়াছেন সত্য, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা যে কাহাকে বলে, তাহা তিনি এ পর্যন্ত অনুভব করিতে পারেন নাই। ঈশ্বর তাঁহাকে যতই কেন মানসিক কষ্ট দিউন না, তাঁহার শরীর কিন্তু নীরোগ রাখিয়াছিলেন। আজ সেই নীরোগ শরীরে হঠাৎ রোগের সূত্রপাত হইল, বিনাকারণে হঠাৎ শিরঃপীড়া হইয়া তাঁহাকে নানাপ্রকারে কষ্ট দিতে আরম্ভ করিল। পরিশেষে এই রোগ দিন দিন এত বৰ্দ্ধিত হইতে আরম্ভ হইল যে, সেই কষ্ট সহ্য করিতে ক্রমেই তিনি অশক্ত হইতে লাগিলেন। যাহাতে পীড়ার উপশম হয়, তাহার নিমিত্ত তিনি অনেক চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু উপশমের পরিবর্তে ক্রমেই উহার বৃদ্ধি হইতে লাগিল। 

গোপিনাথ এইরূপ অবস্থা দৃষ্টি করিয়া নানারূপ সেবা শুশ্রূষা করিতে লাগিল, নিজের কর্ম্ম-কার্য্য বন্ধ করিয়া সর্ব্বদা পরাণের নিকটে রহিল, ও স্বহস্তেই পরাণকে ঔষধাদি সেবন করাইতে লাগিল। কিন্তু তাহাতেও পীড়ার উপশম হওয়া দূরে থাকুক, ক্রমেই আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। সেই প্রদেশীয় চিকিৎসকগণ একে একে প্ৰায় সকলেই পরাণকে উত্তমরূপে দেখিলেন, কিন্তু রোগের প্রকৃত কারণ যে কি, তাহা নির্দ্দেশ করিতে কেহই সমর্থ হইলেন না। 

পরাণের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কিরণ অতিশয় দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আগ্রা সহরের কোন চিকিৎসক কর্তৃক পরাণের রোগের কিছুমাত্র উপশম না হওয়ায়, পরিশেষে তিনি এই স্থির করিলেন,—প্রথমতঃ বোম্বাই সহরে পরাণকে লইয়া গিয়া সেইস্থানের প্রসিদ্ধ চিকিৎসকগণের দ্বারা তাঁহার চিকিৎসা করাইবেন। ঈশ্বরের অনুকম্পায় সেইস্থানে যদি পরাণ আরোগ্যলাভ করিতে পারেন, ত ভালই, নতুবা অগত্যা তাঁহাকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে হবে। কলিকাতায় অনেক উৎকৃষ্ট চিকিৎসক আছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে সুযোগ্য এবং সর্ব্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের হস্তে পরাণের চিকিৎসা-ভার অর্পণ করিলে নিশ্চয় সুফল ফলিবার সম্ভাবনা। 

পরাণের চিকিৎসার নিমিত্ত কিরণ যে উপায় স্থির করিলেন, সময়মত একদিবস উহা জয়চন্দ্রের নিকট বলিলেন। সমস্ত অবস্থা শুনিয়া, কিরণের প্রস্তাব অযুক্তি-পূর্ণ নহে বিবেচনা করিয়া, জয়চন্দ্র তাহার অনুমোদন করিলেন, ও এতদিবস পর্য্যন্ত বেতনের যত টাকা পরাণ তাঁহার নিকট জমা রাখিয়াছিলেন, চিকিৎসার ব্যয় প্রভৃতি নির্ব্বাহের নিমিত্ত সেই সমস্ত অর্থই তিনি পরাণের অনুমতি-অনুসারে কিরণের হস্তে অর্পণ করিতে সম্মত হইলেন। 

বোম্বাই গমনের দিন স্থির হইল। কিরণ মনিবের নিকট বিদায় এবং জয়চন্দ্রের নিকট হইতে সঞ্চিত সমস্ত অর্থ গ্রহণ করিয়া পরাণের সমভিব্যাহারে বোম্বাই গমনের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। মনিবকে বোম্বাই সহরে গমন করিতে হইবে, ইহা অবগত হইয়া, সেই বিশ্বস্ত ভৃত্য গোপিনাথও তাঁহার সহিত গমন করিতে উদ্যত হইল। গোপিনাথকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে কিরণ প্রথমে অসম্মত হইলেন, নানারূপ অসুবিধা ও নিরর্থক অর্থব্যয় হইবে প্রভৃতি বলিয়া, অনেক প্রকার ওজর আপত্তি করিতে লাগিলেন। কিন্তু কিরণের সে আপত্তি পরিশেষে রহিল না, আপনার মনিবকে ছাড়িয়া গোপিনাথ কোন প্রকারেই আগ্রায় থাকিতে সম্মত হইল না। বোম্বাই গমনের উপযোগী সমস্ত বিষয় স্থির হইলে, পরাণ কিরণ এবং গোপিনাথ জয়চন্দ্রের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া সময়মত রেলে উঠিলেন। জয়চন্দ্র তাহাদিগের সহিত ষ্টেশন পর্যন্ত গমন করিলেন, নিয়মিত সময়ে গাড়ি ষ্টেশন ছাড়িয়া ছুটিল। জয়চন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বিষণ্নমনে আপনার স্থানে প্রত্যাগমন করিলেন। 

গোপিনাথকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইবার বিষয়ে কিরণ পূর্ব্বে যে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, সেই অনিচ্ছার প্রকৃত কারণ যে কি ছিল, তাহা পরাণ বা গোপিনাথ কেহই বুঝিতে পারিয়াছিলেন না। কিরণ যেরূপভাবে উহাদিগকে বুঝাইয়াছিলেন, উহারা সেইরূপ ভাবেই বুঝিয়াছিল। কিরণও তাহার প্রকৃত কারণ কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া কিরূপে গোপিনাথকে তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিদায় দিবেন, মনে মনে কেবল তাহারই উপায় উদ্ভাবন করিতেছিলেন। ক্রমে গাড়ি তিন চারি ষ্টেশন অতিক্রম করিয়া একটি ছোট ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই সময়ে পরাণ পিপাসায় নিতান্ত অস্থির হইয়াছেন বলিয়া কিরণ জল সংগ্রহের নিমিত্ত জিদ করিয়া গোপিনাথকে নামাইয়া দিলেন। নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া গোপিনাথকে জলের নিমিত্ত নামিতে হইল। ষ্টেশনের বাহিরে একটি ইঁদারা ছিল, জল সংগ্ৰহ করিবার নিমিত্ত যেমন গোপিনাথ তাহার নিকটবর্তী হইল, অমনি গাড়ি ছাড়িয়া দিল। গোপিনাথ দ্রুতপদে আসিয়াও গাড়িতে আর আরোহণ করিতে পারিল না, সেই স্থানেই তাহাকে থাকিতে হইল। গোপিনাথের পরিধেয় বা সম্বলাদি যাহা কিছু ছিল, তাহা সমস্তই গাড়ির ভিতর রহিয়া গেল। সম্বলের মধ্যে তাহার নিকট রহিল, কেবল সেই জলের ঘটী। 

সেইস্থান হইতে বোম্বাই গমন করিবার কোনরূপ সুযোগ করিতে না পারিয়া গোপিনাথ পরিশেষে পদব্রজেই আগ্রা গমন করিতে মনস্থ করিল। সেইস্থান হইতে আগ্রায় পৌঁছিতে তিনদিবস লাগে। অনাহারে অনবরত চলিয়া গোপিনাথ চতুর্থ দিবসে জয়চন্দ্রের বাসায় উপস্থিত হইল গোপিনাথের নিকট সমস্ত অবস্থা শ্রবণ করিয়া জয়চন্দ্র দুঃখিত হইলেন, ও কহিলেন, “তুমি পরাণের নিকট না থাকিলে উত্তমরূপে তাহার সেবা শুশ্রূষা কে করিবে? আমি তোমার যাইবার সংস্থান করিয়া দিতেছি; তুমি বোম্বাই গমন করিয়া তোমার মনিবের সেবায় রত হও।” 

জয়চন্দ্রের প্রস্তাবে গোপিনাথ সম্মত হইল। তাঁহার নিকট হইতে পর্যাপ্ত পরিমিত অর্থ গ্রহণ করিয়া পরদিবস গোপিনাথ পুনরায় বোম্বাই যাইবার মানসে আগ্রা সহর পরিত্যাগ করিল। 

নিয়মিত সময়ে গোপিনাথ বোম্বাই সহরে গিয়া উপস্থিত হইল। ইহার পূর্ব্বে সে কখনও বোম্বাই গমন করে নাই। সুতরাং সেইস্থানে পরাণ ও কিরণের সন্ধান করা তাহার পক্ষে নিতান্ত সহজ হইল না। গোপিনাথ একমাসকাল সেইস্থানে অতিবাহিত করিল, কিন্তু কোনরূপেই পরাণ বা কিরণের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিল না। বোম্বাই সহরে যে সকল বাঙ্গালীর সহিত গোপিনাথের সাক্ষাৎ হইল, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহই পরাণ বা কিরণের কোনরূপ সন্ধান প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইলেন না। 

এইরূপ অবস্থায় মাসাধিক সেইস্থানে অবস্থিতিপূর্ব্বক কোনরূপেই আপন মনিবের সমাধান করিতে না পারিয়া, পরিশেষে গোপিনাথ কলিকাতা গমন করাই স্থির করিল। 

পরাণ ও কিরণের মধ্যে পূর্ব্বে যাহা স্থির হইয়াছিল, তাহা গোপিনাথ জানিত। জানিত বোম্বাই সহরে পরাণের রোগ আরোগ্য না হইলে তাঁহারা কলিকাতায় গমন করিবেন। পরাণ ভাবিল, তাহার মনিবের রোগ বোম্বাই সহরের কেহ আরোগ্য করিতে পারিবে, এরূপ আশা কাহারও নিকট না পাইয়া, হয়ত তাঁহারা কলিকাতায় গমন করিয়াছেন। এইরূপ ভাবিয়া গোপিনাথ বোম্বাই সহর পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইল। 

আগ্রায় গমন করিবার বহুপূর্ব্বে গোপিনাথ একবার কলিকাতায় আসিয়া, প্রায় মাসাবধি অবস্থিতি করিয়াছিল। কলাবাগানে তিলক দাস নামধেয় এক ব্যক্তি বহুদিবস হইতে বসবাস করিতেছে। যে খাপ্‌রেলের বাড়ীতে তিলক দাস থাকে, তাহা তিলকের নিজের বাড়ী। তিলক গোপিনাথের দূর-কুটুম্ব, পূর্ব্বে গোপিনাথ কলিকাতায় আসিয়া এই তিলকের বাড়ীতেই অবস্থিতি করিয়াছিল। এবারও সে তিলকের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। যে কয়েকদিবস ছিল, সে এইস্থানেই ছিল। এইস্থান হইতেই গোপিনাথ নিরুদ্দেশ হয়, ও এই তিলক দাসের যত্নে ও চেষ্টায় আমাকে এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইতে হয়। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

গোপিনাথকে অনুসন্ধান করিবার ভার আমার উপর ন্যস্ত হইলে, আমি প্রথমে গিয়া তিলক দাসের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। এ সম্বন্ধে তিলক দাস কি কি বিষয় নিজে অবগত আছে, এবং কি কি বিষয় অপরের নিকট শ্রবণ করিয়াছে, তাহা তাহাকে আনুপূর্ব্বিক বলিতে কহিলাম। আমার কথার উত্তরে তিলক দাস বলিল :—

“মহাশয়! গোপিনাথের বাসস্থান এবং আমার জন্মস্থান একই গ্রামে। সম্পর্কে গোপিনাথ আমার দূর-কুটুম্ব। আমি যখন সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসি, তখন গোপিনাথের অবস্থা মন্দ ছিল না; মধ্যবিত্ত গৃহস্থের যাহা কিছু থাকা সম্ভব; গোপিনাথের তাহার সমস্তই ছিল। কলত্র, এবং পুত্রকন্যায় গৃহ পূর্ণ, গোয়ালে গরু বাছুরের জায়গা হইত না, ছয়খানি লাঙ্গলে আবাদ হইত, গোলা ধান্যে পূর্ণ ছিল। এইরূপ সুখের অবস্থা গোপিনাথকে অধিক দিবস ভোগ করিতে হয় নাই, দুই চারি বৎসরের মধ্যেই গোপিনাথের ভাগ্যলক্ষ্মী দূরে পলায়ন করিলেন। গৃহলক্ষ্মীও সেই সঙ্গে চলিয়া গেল, পুত্রকন্যাগুলিও একে একে তিরোহিত হইল। গরু, বাছুর, ধন, ধান্য প্রভৃতির চিহ্নমাত্রও রহিল না। কি পাপে যে ঈশ্বর তাহার এইরূপ অবস্থা করিলেন, তাহা তিনিই জানেন। 

“এইরূপে সমস্ত হারাইয়া মনের কষ্টে গোপিনাথ বাসস্থান পরিত্যাগ করিল। আজ এইস্থানে, কাল অন্য একস্থানে, এইরূপ নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া গোপিনাথ দিন অতিবাহিত করিতে লাগিল। সেই সময়ে তাহার মনের স্থিরতা ছিল না, কোনস্থানে স্থিরভাবে থাকিতে পারিত না। কেহ যত্ন করিয়া রাখিলে, সেইস্থানে দুই একদিবস থাকিয়া পরিশেষে অন্যস্থানে গমন করিত। সেই সময়ে একদিবস গোপিনাথ হঠাৎ আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। তাহার অবস্থা আমি পূৰ্ব্বেই শুনিয়াছিলাম, সুতরাং বিশেষ যত্নের সহিত আমার বাড়ীতে তাহাকে থাকিবার স্থান দিয়াছিলাম। সেই সময়ে প্রায় মাসাবধি আমার বাড়ীতে থাকিয়া, পরিশেষে সে আমার বাড়ী হইতে চলিয়া যায়। 

“ইহার পর বহুদিবস আর গোপিনাথকে দেখিতে পাই নাই। কিন্তু লোক পরম্পরায় শুনিয়াছিলাম যে, ভারতবর্ষের নানাস্থানে, তীর্থে তীর্থে সে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছে। ইহাও বহুদিবসের কথা। তাহার পর আর কোন সংবাদ পাই নাই।” 

“অদ্য চারিদিবস হইল, গোপিনাথ পুনরায় আমার নিকট আগমন করে। পূর্ব্বে তাহাকে যেরূপ অবস্থায় দেখিয়াছিলাম, এবার আর তাহার সেরূপ অবস্থা ছিল না। পূর্ব্বে সৰ্ব্ব-সময়েই তাহাকে চঞ্চল বলিয়া বোধ হইত, এখন সে স্থির ও গম্ভীর। এবার তাহাকে দেখিয়া আমার বেশ বিশ্বাস হইল, পূর্ব্বে যে সকল কষ্ট তাহাকে আশ্রয় করিয়াছিল, সেই সকল কষ্ট যেন এখন তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছে। সে যেন এখন পুনরায় সংসারের মায়ায় আবদ্ধ হইয়াছে। 

“যে দিবস গোপিনাথ আমার বাড়ীতে আগমন করে, সেইদিবস রাত্রিতে তাহার সহিত আমার অনেক কথাবার্তা হয়। অনেক কথার মধ্যে সে এতদিবস কোথায় ও কি প্রকারে ছিল, তাহা আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করি। উত্তরে সে কহে যে, আমার বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া অনেক দিবস সে নানাস্থান ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে আগ্রায় গিয়া উপস্থিত হয়। সেইস্থানে পরাণচন্দ্র বসু নামে এক ব্যক্তির সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়, পরাণচন্দ্রের ব্যবহারে সে অতিশয় সন্তুষ্ট হয়, ও পরিশেষে তাহারই দাসত্ব স্বীকার করিয়া এতদিবস পর্য্যন্ত তাহার সেবা শুশ্রূষা করিয়া আসিতেছিল। পরাণের সহিত সেইস্থানে আর এক ব্যক্তি থাকিত, তাহার নাম কিরণ। কিরণের সহিত পরাণের বড় ভাব ছিল। কিছু দিবস হইল, তাহার মনিবের শিরঃপীড়া হয়। সেই পীড়া সেই স্থানে আরোগ্য না হওয়ায়, বোম্বাই সহরের ভাল চিকিৎসকের দ্বারা চিকিৎসা করান সাব্যস্ত হয়। গোপিনাথ, পরাণ এবং কিরণ পরিশেষে আগ্রা সহর পরিত্যাগ করিয়া বোম্বাই যাইবার নিমিত্ত রেলপথে গমন করে। পথিমধ্যে গোপিনাথ ষ্টেশন হইতে জল লইবার জন্য গাড়ি হইতে অবতরণ করে, কিন্তু সেই গাড়িতে আর উঠিতে না পারায় কিরণ ও পরাণের সঙ্গ হারায়, এবং বহুকষ্টে হাঁটিয়া ফিরিয়া আগ্রায় যায়। পরিশেষে সেখানে পরাণের মনিব জয়চন্দ্রের সাহায্যে সে বোম্বাই সহরে গমন করে। কিন্তু সেইস্থানে মনিবের কোনরূপ সন্ধান করিতে না পারিয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হয়। কারণ সে জানিত যে, উহাদিগের সঙ্কল্প ছিল, বোম্বাই সহরে চিকিৎসার সুবিধা না হইলে তাঁহারা কলিকাতায় আগমন করিবেন। 

“গোপিনাথ শুনিয়াছিল যে, পরাণের বাসস্থান কলিকাতায়। তাঁহার পিতার নাম গদাধর বসু। ইনি ফুলবাগানের একজন বড় মানুষ। পিতার সহিত মনের মিল না হওয়ায় এতদিবস তিনি বিরাগী অবস্থায় ছিলেন। কলিকাতায় আসিয়া পরাণ সম্ভবতঃ আপনার বাড়ীতেই গমন করিয়াছেন, এই ভাবিয়া আহারাদির পর গোপিনাথ আপন মনিবের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ফুলবাগানে গমন করে। সেইস্থানে গিয়া গোপিনাথ জানিতে পারে যে, কয়েকমাস হইল, গদাধর বসু ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু মৃত্যু সময়ে আপনার বহুল সম্পত্তি কেবল তাঁহার একমাত্র কন্যা রাণীকে প্রদান না করিয়া উইল করিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার পুত্র পরাণ যদি কখনও ফিরিয়া আইসেন, তাহা হইলেও তিনি সমস্ত সম্পত্তির তিন অংশ প্রাপ্ত হইবেন; অবশিষ্ট এক অংশমাত্র কন্যা রাণীর হইবে। পিতা যেরূপভাবে উইল করিয়া গিয়াছেন, তাহা জানিতে পারিয়া কয়েকদিবসমাত্র হইল, পরাণচন্দ্র আপনার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন, এবং তিনিই যে পরাণ, সে সম্বন্ধে প্রমাণ প্রয়োগপূর্ব্বক পিতার পরিত্যক্ত বিষয়ের অধিকারী হইয়াছেন। 

“এই অবস্থা জানিতে পারিয়া গোপিনাথ নিতান্ত হৃষ্টান্তঃকরণে মনিবের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হয়। মনিবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার কথা দ্বারবানদিগের নিকট বলায় কেহই তাহার কথা গ্রাহ্য করে না, বা তাহাকে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেও দেয় না। এইরূপ অবস্থায় গোপিনাথ সন্ধ্যা পর্য্যন্ত সেইস্থানে থাকিয়া কোন প্রকারে মনিবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হয় নাই। কাজেই বিফলমনোরথ হইয়া সে সেদিন প্রত্যাগমন করিয়াছিল। 

“গোপিনাথ যখন মনিবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রত্যাশায় বাহিরে বসিয়াছিল, সেই সময়ে সে বাটীর দ্বিতল বারান্দার উপর একবারমাত্র সে কিরণকে দেখিতে পায়। কিরণও গোপিনাথকে দেখেন। কিন্তু পরস্পর কোন কথা হয় না, গোপিনাথকে দেখিবামাত্র কিরণ গৃহের ভিতর প্রবেশ করেন, আর বাহির হন নাই। এইরূপ অবস্থায় সন্ধ্যা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিয়া, ও পরিশেষে দ্বারবানদিগের নিকট হইতে দুই একটি মিষ্টকথা শুনিয়া গোপিনাথ চলিয়া আইসে। 

“পরদিবস প্রত্যূষে গোপিনাথ পুনরায় গমন করে। মনিবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া শীঘ্র প্রত্যাগমন করিবে, ও এইস্থানে আসিয়া আহারাদি করিবে, এইরূপ বলিয়া যায়, কিন্তু সে এপর্যন্ত আর প্রত্যাগমন করে না। আমরাও পরিশেষে পরাণ বাবুর বাড়ীতে গিয়া তাহার অনুসন্ধান করি। দ্বারে খোদ পরাণ বাবুর সহিত সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, গোপিনাথ তাঁহার নিকট গমন করে নাই, বা গোপিনাথ বলিয়া তাঁহার কখন কোন চাকর ছিল না, বা গোপিনাথ দাস নামে কোন ব্যক্তিকে তিনি চিনেন না। এইরূপ অবস্থায় কাজেই আপনাদিগের সাহায্য আমাকে গ্রহণ করিতে হইয়াছে। এখন যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই করুন। গোপিনাথের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যদি কোন ব্যয়ভারও আমাকে গ্রহণ করিতে হয়, হৃষ্টচিত্তে আমি সে ভার বহন করিতে প্ৰস্তুত আছি। আর লোকজনের বা অপর যে কোন বিষয়ের আপনার যখন আবশ্যক হইবে, তখনই সে সাহায্য আমার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইবেন। আমার বাড়ী ভিন্ন এই কলিকাতা সহরে গোপিনাথের আর থাকিবার স্থান নাই, বা অপর কাহারও সহিত তাহার আলাপ আছে বলিয়া বোধ হয় না, এবং তাহার নিকট একটিমাত্র পয়সাও নাই।” 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

তিলক দাসের কথা শুনিয়া আমারও মনে কেমন একটা সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। আরও দুই একটি কথা তিলক দাসকে জিজ্ঞাসা করা উচিত বিবেচনায় তাহাকে কহিলাম, “তোমরা পরাণ বাবুর বাড়ীতে গমন করিয়া স্বয়ং পরাণ বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলে কহিলে; কিন্তু সেই সময়ে পরাণ বাবু একাকী ছিলেন? কি কিরণও তাঁহার সহিত ছিল? এবং পরাণকে তোমরা পূর্ব্ব হইতে চিনিতে কি না?”

তিলক। মহাশয়! আমি পরাণ বাবুকেও চিনি না, কিরণ বাবুকেও জানি না। কেবলমাত্র একটি বাবুর সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হয়। দ্বারবানগণ সেই বাবুকে পরাণ বাবু বলিয়া আমাদিগের নিকট পরিচয় প্রদান করে, তাহাতেই জানি যে, পরাণ বাবুর সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইয়াছিল। 

আমি। যে দিবস গোপিনাথ তোমার বাটীতে আগমন করে, সেইদিবস রাত্রিতে গল্পচ্ছলে তোমার নিকট পরাণের পরিচয়, অর্থাৎ তাহার পিতার নাম কি, এবং বাসস্থান কোথায়, তাহা বলিয়াছিল। কিন্তু কিরণ সম্বন্ধে সে সেইরূপ কোন কথা বলিয়াছিল কি? 

তিলক। হাঁ মহাশয়! বলিয়াছিল। তাহার নিকট হইতে অবগত হইয়াছিলাম যে, কিরণের পিতার নাম কেদারনাথ দাস, বাসস্থান টালিগঞ্জে। 

তিলকের নিকট হইতে এই কয়েকটিমাত্র বিষয় অবগত হইয়া আমি সেদিবস সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। একবার মনে ভাবিলাম, নিতান্ত সামান্য বিষয়ের নিমিত্ত তিলক দাস আমাকে কষ্ট দিতেছে। গোপিনাথের হয় ত মনের স্থিরতা নাই, কোথায় চলিয়া গিয়াছে; কিছুদিবস পরে হয় ত হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইবে। আবার ভাবিলাম, যখন এ কর্ম্মে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তখন প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য যে, হঠাৎ গোপিনাথ কোথায় গমন করিল, এবং পরাণই বা গোপিনাথ সম্বন্ধে সকল কথা তিলকের নিকট অস্বীকার করিল কেন? 

যাহা হউক, তিলকের বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া ফুলবাগানে পরাণ বাবুর বাড়ীর উদ্দেশে চলিলাম। ফুলবাগানের ভিতর পরাণের বাড়ীই সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ, এবং তাঁহার পিতা সকলের নিকটেই সুপরিচিত ছিলেন; সুতরাং সেই বাড়ী খুঁজিয়া লইতে কোন কষ্টই হইল না। বাড়ীর সম্মুখে উপনীত হইয়া দেখিলাম, বাড়িটি বৃহৎ এবং বহুদূর-ব্যাপী; কিন্তু পুরাতন এত বড় বাড়ীতে যেরূপ লোকজন থাকা উচিত, তাহার কিছুই নাই। উহার সকল অংশই প্রায় নির্জ্জন, এবং কোলাহল-বিবর্জ্জিত। কেবলমাত্র সদরদ্বারে চারিজনমাত্র দ্বারবান্ বসিয়া আছে। এই বাড়ীর সম্মুখ দিয়া ইতিপূৰ্ব্বে আমি অনেকবার গমনাগমন করিয়াছি, কিন্তু চারিজন দ্বারবান কখন দেখি নাই, নিত্যই একজন থাকিত; কেবল আজ দেখিলাম, চারিজন। 

দ্বারের সম্মুখে উপনীত হইয়া সেই পুরাতন দ্বারবানকে একটু দূরে ডাকাইলাম। আমি উক্তস্থানে গমন করিবার সময় জনৈক প্রহরীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। সেই প্রহরী উক্ত দ্বারবানকে ডাকিবামাত্র সে আমার নিকট আগমন করিল। 

আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি আমায় চেন কি?” 

দ্বারবান্। না চিনিলেও এখন চিনিতে পারিতেছি, আপনি পুলিস-কৰ্ম্মচারী হইবেন। 

আমি। হাঁ, তোমার অনুমান সত্য, আমি পুলিস-কর্ম্মচারীই বটে। তোমার নিকট আমার দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন আছে বলিয়াই, আমি তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। 

দ্বারবান্। যাহা আপনার জিজ্ঞাস্য আছে, তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। আমি যতদূর জানি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। 

আমি। তোমার নাম কি? 

দ্বারবান্। আমার নাম ভৈরব সিং। 

আমি। তুমি কতদিবস এই বাড়ীতে দরয়ানি করিতেছ? 

ভৈরব। প্রায় আট দশ বৎসর হইতে আমি এই বাড়ীতে প্রতিপালিত হইতেছি। 

আমি। তাহা হইলে তুমি গদাধর বাবুর সময়েও এই স্থানে ছিলে? 

ভৈরব। তাঁহার নিকটেই বরাবর ছিলাম। তাঁহার মৃত্যুর পর এখন তাঁহার পুত্রের দ্বারা প্রতিপালিত হইতেছি। 

আমি। গদাধর বাবুর পুত্রের নাম কি? 

ভৈরব। তাঁহার পুত্রের নাম পরাণবাবু। 

আমি। পরাণবাবু এখন কোথায়? 

ভৈরব। বাড়ীতেই আছেন। 

আমি। পরাণবাবু কি বরাবরই বাড়ীতে আছেন? 

ভৈরব। না, তিনি বহুদিবস হইতে এই বাড়ীতে ছিলেন না। অল্পদিবসই হইল, তিনি বাড়ীতে আগমন করিয়াছেন।

আমি। ইতিপূর্ব্বে তিনি কোথায় ছিলেন? 

ভৈরব। কোথায় ছিলেন, তাহা আমি জানি না। যখন ষোল বৎসর পরাণবাবুর বয়ঃক্রম, সেই সময় বিমাতার সহিত মনান্তর হওয়ায় তিনি এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। এতদিবস যে তিনি কোথায় ছিলেন, তাহা আমি অবগত নহি। প্রায় এক বৎসর হইল, বাবুর বিমাতা মরিয়া গিয়াছেন, এবং কয়েকমাস হইল, কর্তাও স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। কর্তার মৃত্যুকালে কেবলমাত্র তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের কন্যা এই বাড়ীতে ছিলেন। এখন পরাণবাবুও বহু বৎসর পরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন ও পিতার বিষয়াদি উপভোগ করিতেছেন। 

আমি। পরাণবাবু এই বাড়ীতে এখন একাকী আছেন, কি তাঁহার একজন বন্ধুও তাঁহার সহিত এখন এই বাড়ীতে বাস করিতেছেন? 

ভৈরব। পরাণবাবুর কোন বন্ধুকে এই বাড়ীতে বাস করিতে আমি দেখি নাই। তবে অনেকে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন বটে; কিন্তু এইস্থানে থাকিতে অপর আর কাহাকেও দেখি নাই। 

আমি। পরাণবাবু ভিন্ন এই বাড়ীতে অপর পুরুষমানুষ আর কেহই এখন থাকেন না? 

ভৈরব। থাকেন বৈকি, জামাইবাবু এইস্থানেই থাকেন। 

আমি। পরাণবাবু প্রথম যে দিবস আগমন করেন, সে দিবস তুমি কোথায় ছিলে? 

ভৈরব। দরজাতেই ছিলাম, পরাণবাবু আমার সম্মুখেই আগমন করেন। 

আমি। পরাণবাবু যে সময় প্রথম এই বাড়ীতে আগমন করেন, সেই সময়ে তিনি একাকী আসেন, কি অপর আর কেহ তাঁহার সহিত আগমন করেন? 

ভৈরব। অপর আর কেহই তাঁহার সহিত আগমন করেন নাই। জামাইবাবু তাঁহাকে আনিবার নিমিত্ত স্টেশনে গমন করিয়াছিলেন, কেবলমাত্র তিনিই তাঁহার সহিত আগমন করেন। 

আমি। বাবুর সহিত কোন চাকর-চাকরাণী আইসে নাই? 

ভৈরব। না। 

আমি। তোমার মনে হয়, সম্প্রতি কোন ব্যক্তি বাবুর পুরাতন চাকর পরিচয় দিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিল? 

ভৈরব। হাঁ মনে হয়, একটি লোক আসিয়াছিল। 

আমি। বাবুর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল? 

ভৈরব। না, প্রথমদিন বাবুর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় নাই। সে দিবস বাবুর শরীর কিছু অসুস্থ ছিল বলিয়া আমাদিগের উপর আদেশ ছিল, যেন কোন অপরিচিত ব্যক্তি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত উপরে যাইতে না পারে। সেই ব্যক্তি আসিয়া বাবুকে সংবাদ দিবার নিমিত্ত আমাদিগকে বার বার অনুরোধ করিয়াছিল, আমরা কিন্তু তাহার অনুরোধ রাখিতে পারি নাই। বাবুর আদেশ অনুযায়ী তাঁহার নিকট উহার আগমন সংবাদও প্রদান করি নাই।

আমি। বাবুর সহিত সেদিবস উহার সাক্ষাৎ হয় নাই, কিন্তু তাহার পর সে পুনরায় আসিয়াছিল কি? ও যদি আসিয়াছিল, তাহা হইলে বাবুর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল কি? 

ভৈরব। হাঁ, মহাশয়! তাহার পরদিবস অতি প্রত্যূষেই সে পুনরায় আগমন করিয়া বাড়ীর সম্মুখে বসিয়াছিল। বেলা অনুমান নয়টার সময় বাবুর গাড়ি প্রস্তুত করিতে বলিবার জন্য হঠাৎ আদেশ পাই। আদেশানুযায়ী গাড়ি প্রস্তুত হয়, বাবু আসিয়া গাড়িতে আরোহণ করেন। গাড়িতে আরোহণ করিবার সময় সেই ব্যক্তি গাড়ির নিকট গিয়া বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করে। বাবু উহাকে আপনার সেই গাড়ির ভিতর উঠাইয়া লইয়া কোথায় গমন করেন। তাহার পর আর সে ব্যক্তি এইস্থানে আগমন করে নাই। 

আমি। দিবা নয়টার সময় বাবু গাড়িতে উঠিয়া বাহির হইয়া যান, কিন্তু সেই গাড়ি পুনরায় কোন্ সময়ে ফিরিয়া আইসে? 

ভৈরব। দিবা দশটা কি এগারটার সময় কোচমান গাড়ি ফিরাইয়া আনে। বাবু কিন্তু সে গাড়িতে ফিরিয়া আসেন নাই। 

আমি। বাবু তবে কিসে করিয়া ফিরিয়া আসেন? 

ভৈরব। তিনি একখানি ঠিকাগাড়িতে ফিরিয়া আসেন। 

আমি। বাবু যখন ফিরিয়া আইসেন, তখন সেই ব্যক্তি তাঁহার সহিত আগমন করে কি না? 

ভৈরব। না, বাবু একাকীই আগমন করেন। 

আমি। বাবু কোন সময়ে প্রত্যাগমন করেন? 

ভৈরব। বাবুর ফিরিয়া আসিতে বেলা অধিক হইয়াছিল, আমার বোধ হয়, বেলা দুইটার কম হইবে না। কেন মহাশয়! আপনি এতকথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? কি হইয়াছে? 

আমি। এমন কিছুই হয় নাই, যে ব্যক্তি বাবুর সহিত গমন করিয়াছিল, তাহারই সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না বলিয়া এতকথা জিজ্ঞাসা করিতে হইতেছে। 

ভৈরব। বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকেই কেন জিজ্ঞাসা করুন না। তাহা হইলে জানিতে পারিবেন, তাঁহার নিকট হইতে সেই লোকটি কোথায় গমন করিয়াছে। 

আমি। তুমি যাহা কহিলে, তাহা প্রকৃত। আমি এখনই গিয়া বাবুকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি; কিন্তু তোমাদিগের দ্বারা যদি আমার কার্য্য সফল হয়, তাহা হইলে এই সামান্য কর্ম্মের নিমিত্ত একজন বড় লোককেবিরক্ত করা কর্তব্য নহে। ভাল, আর একটি কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি। সেইদিবস সেই লোকটিকে সঙ্গে লইয়া বাবু যে গাড়ি করিয়া বহির্গত হইয়া গিয়াছিলেন, সে গাড়ীর কোচমান এখন কোথায়? 

ভৈরব। সে আস্তাবলেই আছে। তাহাকেও কি কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করেন? 

আমি। তাহাকে একবার জিজ্ঞাসা করিলে ক্ষতি কি? সে লোকটি বাবুকে পরিত্যাগ করিয়া কোন্ সময়ে কোনদিকে গমন করিয়াছে, জানিতে পারিলে, বাবুকে কষ্ট দেওয়ার আর কোন প্রয়োজন হইবে না। 

আমার কথা শুনিয়া ভৈরব কোচমানকে ডাকিবার নিমিত্ত আস্তাবল-অভিমুখে প্রস্থান করিল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। কোচমান আস্তাবলেই ছিল। আমি যে নিমিত্ত তাহার নিকট গমন করিয়াছি, তাহার বিষয় ভৈরব কোচমানকে বুঝাইয়া দিল। ভৈরবের কথা শুনিয়া কোচমান কহিল, “যে লোকটিকে সঙ্গে লইয়া বাবু গাড়িতে উঠিয়াছিলেন, সেই ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিয়া কোনস্থানে বাবুকে গমন করিতে আমি দেখি নাই। বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গাড়ি লইয়া সোজা বাগানে গমন করি। বাবু এবং সেই অপরিচিত ব্যক্তি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া বাগানের ভিতর প্রবেশ করেন। আমি গাড়ি লইয়া সেইস্থানেই অপেক্ষা করিতেছিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে বাগানের উড়িয়া মালি কতকগুলি ফুলসহ গাড়ির নিকট আগমন করে। পুষ্পগুলি সে গাড়ির ভিতর রাখিয়া দেয় ও কোচবাক্সের উপর উপবেশন করিয়া আমাকে কহে, ‘এই স্থানে বাবুর অধিক বিলম্ব হইবে বলিয়া, তিনি গাড়ি ফিরাইয়া লইয়া যাইতে আদেশ দিয়াছেন।’ মালির কথা শুনিয়া আমি গাড়ি ফিরাইয়া লইয়া আসি। পথিমধ্যে পুষ্পগুলিসহ মালি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া কোথায় গমন করে। ইহার পর বাবু যে কখন প্রত্যাগমন করেন, তাহা আমি অবগত নহি।” 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

ভৈরব সিংহ ও কোচমানের কথা শুনিয়া ভাবিলাম, পরাণবাবুর সহিত সাক্ষাৎ না করিলে, এ গোলযোগ মিটিবে না। এই ভাবিয়া আমি পুনরায় পরাণবাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম; ভৈরব সিংও আমার সহিত সেইস্থানে গমন করিল। আমার আদেশমত ভৈরব সিং পরাণবাবুর নিকট গমন করিয়া আমার আগমনবার্তা কহিল, এবং বলিল, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার বাসনা করি। 

আদেশমত আমি পরাণবাবুর বৈঠকখানায় গমন করিলাম। দেখিলাম, দুইজন তোষামোদকারীর সহিত পরাণবাবু একখানি বিস্তৃত গালিচার উপর আয়নার সম্মুখে বসিয়া আপনার প্রতিবিম্ব দর্শন করিতেছেন। আমি সেইস্থানে গমন করিবামাত্র পরাণবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দ্বারবান্ প্রমুখাৎ অবগত হইলাম যে, জনৈক পুলিশ কৰ্ম্মচারী আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে অভিলাষ করেন, আপনি কি সেই পুলিস কর্মচারী?” 

আমি। আমি আপনার দর্শন-অভিলাষী সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারী। 

পরাণ। আমার সহিত সাক্ষাতের আপনার কি প্রয়োজন?

আমি। বিশেষ কিছু প্রয়োজন আছে, মহাশয়ের নাম কি? 

পরাণ। আমার নাম শ্রীপরাণচন্দ্র বসু। 

আমি শুনিলাম, বহুবৎসর পরে আপনি আগমন করিয়া পিতার পরিত্যক্ত সম্পত্তির অধিকারী হইয়াছেন। কিন্তু এত দিবস আপনি কোথায় ছিলেন? 

পরাণ। আমি যে স্থানেই ছিলাম না কেন, সে বিষয় আপনার জানিবার কোন প্রয়োজন দেখি না। 

আমি। প্রয়োজন না থাকিলে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি কেন? আপনি বলুন বা না বলুন, আমি জানি, বহুদিবস আপনি আগ্রায় ছিলেন। 

পরাণ। আগ্রায় থাকি, বা যেখানেই থাকি, তাহাতে আপনার কোনরূপ লাভ-লোকসান দেখি না। 

আমি। এবিষয়ে আমার কোনরূপ লাভ বা লোকসান আছে কি না, তাহা আমি জানি। আপনিও বোধ হয়, পরে, জানিতে পারিবেন। আপনার সহিত আপনার বন্ধু কিরণবাবু যে আগমন করিয়াছিলেন, তিনি কি এই ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যে কেহ? 

পরাণ। কিরণ? কিরণ নামক কোন ব্যক্তিকে আমি জানি না। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কিরণ নামে কোন ব্যক্তি নাই। 

আমি। যে ব্যক্তি কিরণকে চিনে, আজ কয়েকদিবস-মাত্র অতীত হইল, সে কিরণকে এই বাড়ীতে দেখিয়াছে, অথচ আপনি বলিতেছেন, আপনি কিরণকে চিনেন না! সে যাহা হউক, আপনার আগ্রায় যে চাকর ছিল, সেই চাকর আপনার সঙ্গে এখানে আসিয়াছে কি? 

পরাণ। কে বলিল—আমি আগ্রায় ছিলাম? কোন চাকর আমার সহিত আগমন করে নাই। 

আমি। আপনি এখানে আগমন করিবার কতদিবস পরে আপনার বিশ্বস্ত চাকর গোপিনাথ দাস এখানে আগমন করিয়াছিল? 

পরাণ। গোপিনাথ নামে আমার কোন চাকর কখন ছিল না, বা গোপিনাথ নামক কোন ব্যক্তি এখানে আমার নিকট আগমন করে নাই। 

পরাণের কথা শুনিয়া ভাবিলাম, এখন দেখিতেছি, পরাণকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা যুক্তি-যুক্ত নহে। যেকথা ইঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহার কিছুই অবগত নহে বলিয়া ইনি উত্তর প্রদান করিতেছেন। অপরাপর লোকের নিকট হইতে যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছি, পরাণ সে সকল কথাও অস্বীকার করিতেছে। এরূপ অবস্থায় পরিষ্কার করিয়া উহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা কর্ত্তব্য নহে। এখন বিলক্ষণ অনুমান হইতেছে, ইঁহার হৃদয়ে পাপ আছে; নতুবা সকল কথা অস্বীকার করিবেন কেন? এইরূপ অনুমান করিয়া আমি পরাণকে পুনরায় কহিলাম, “আমি এখন প্রস্থান করিতেছি, আবশ্যক হইলে সময়মত আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।” এই বলিয়া আমি বৈঠকখানা হইতে নীচে আসিলাম, এবং বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া প্রস্থান করিলাম। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলাম যে, উপরের যে বৈঠকখানায় আমি বসিয়াছিলাম, তাহার বারান্দায় দাঁড়াইয়া পরাণ দেখিতেছে, আমি কোথায় বা কোনদিকে গমন করি। আমি কোনদিক লক্ষ্য না করিয়া সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিলাম। 

সেইদিবস অপর কয়েকজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী সঙ্গে লইয়া আমি পরাণবাবুর তিলজলার বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই বাগানে কেবলমাত্র একজন উড়িয়া মালি ছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, কোচমান যে কথা বলিয়াছিল, তাহা প্রকৃত। মালি আরও কহিল, পরাণবাবু তাহার সমভিব্যাহারীকে সঙ্গে লইয়া বাগানে আগমন করেন, এবং কোন কার্য্যোপলক্ষে মালিকে স্থানান্তরে প্রেরণ করেন। মালি প্রত্যাগমন করিয়া সেই বাগানের ভিতর পরাণবাবুকে একাকী দেখিতে পায়। পরিশেষে মালি একখানি ঠিকাগাড়ি আনাইয়া দিলে, সেই গাড়িতে পরাণবাবু প্রস্থান করেন। পরাণবাবুর সহিত যে ব্যক্তি আগমন করিয়াছিল, মালি তাহাকে আর দেখিতে পায় নাই, বা কোথায় প্রস্থান করিয়াছে, তাহারও কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে পারিল না। 

মালির কথা শুনিয়া সেই বাগানের ভিতর একবার উত্তমরূপে দেখিবার ইচ্ছা করিলাম। প্রথমে বাগানের মধ্যস্থিত বাড়িটি উপর নীচে বেশ করিয়া দেখিলাম। পরিশেষে বাগানের ভিতর সকল স্থান উত্তমরূপে দেখিলাম। কেন যে বাগানের ভিতর অনুসন্ধান করিলাম, কিসের অনুসন্ধান করিলাম, তাহা জানি না। কিন্তু দেখিলাম, অভ্যাসের দোষেই বোধ হয় দেখিলাম। এখন অনুসন্ধান করিতে কেবলমাত্র বাকী থাকিল, বাগানের ভিতরের পুষ্করিণী। এই পুষ্করিণীটা বাগানের একপার্শ্বে, ইহার জলও ভাল নহে। সেদিকে প্রায় কেহ গমন করে না, সে পুষ্করিণীর জলও কেহ ব্যবহার করে না। উক্ত বাগানের নিকটবর্তী অপর আর একটি বাগানের পুষ্করিণীতে মালি স্থান করে, ও সেই পুষ্করিণীর জলই সে পান করে। 

পূর্ব্বোক্ত পুষ্করিণীর নিকট গমন করিলে অপর আর একজন কর্ম্মচারী পুষ্করিণীর ভিতরস্থিত একটি স্থান দেখাইয়া কহিল, “দেখুন দেখি, ঐ স্থানে কি দেখা যাইতেছে।” সেইদিকে লক্ষ্য করিয়া স্পষ্ট কিছুই দেখিতে পাইলাম না; কিন্তু বোধ হইল, জলের মধ্যে শৈবালের নিম্নে কি যেন ভাসিতেছে। একজনকে সেই পুষ্করিণীর ভিতর নামাইয়া দিলাম। পুষ্করিণীর জল অধিক ছিল না, সে ব্যক্তি আস্তে আস্তে সেইস্থানে গমন করিল। এইস্থানের জল প্রায় একগলা হইবে। সেই স্থানে গমন করিয়াই সে চীৎকার করিয়া উঠিল ও কহিল, “মহাশয়! এ যে একটি মৃতদেহ বলিয়া বোধ হইতেছে। উহার কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আস্তে আস্তে উহাকে কিনারার দিকে লইয়া আইস।” সে তাহাই করিল। পরিশেষে উক্ত মৃতদেহটি জল হইতে উঠাইয়া মৃত্তিকার উপর রাখা হইল। দেখিলাম, উহা পুরুষের মৃতদেহ, বক্ষস্থলে আঘাতের ভীষণচিহ্ন, কোমরে দুই তিনখানি বড় ইট বাঁধা আছে। 

এই মৃতদেহ দেখিয়া আমার মনে স্থিরবিশ্বাস হইল, এই মৃতদেহ গোপিনাথের। তথাপি নিশ্চয় জানিবার নিমিত্ত তিলক দাসকে আনাইতে পাঠাইলাম। সংবাদ পাইবামাত্র তিলক দাস সেইস্থানে আসিয়া উক্ত মৃতদেহ দর্শন করিল। দেখিয়াই কহিল, “এ-ই গোপিনাথ। কে ইহাকে হত্যা করিল? কাহার সহিত ইহার এরূপ শত্রুতা ছিল যে, সে তাহার প্রতিশোধ গ্রহণ করিল?” 

গোপিনাথের লাস বাগানের ভিতরেই রহিল। তিলক দাস এবং আরও কয়েকজন কর্মচারী সেইস্থানে রহিলেন। আমি অপর কয়েকজন কর্মচারীর সহিত পরাণের বাড়ীতে গমন করিলাম। দ্বারবান ভৈরব সিংহের নিকট জানিতে পারিলাম, বাবু এখনও বৈঠকখানায় আছেন। এবার বিনা সংবাদ দানেই আমরা একেবারে উপরের বৈঠকখানায় গমন করিলাম। আমাদিগকে দেখিবামাত্র পরাণকে যেন অতিশয় ভীত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কিন্তু সে তখন স্বীয় ভাব গোপন করিয়া কহিল, “বিনাসংবাদে আপনারা একেবারে এখানে আগমন করিলেন কেন?” 

আমি। সংবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নাই বলিয়াই, সংবাদ দেওয়া হয় নাই। 

পরাণ। ভদ্রলোকের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে হইলে সংবাদ দিবার প্রয়োজন নাই, এ কিরূপ কথা হইল?

আমি। যখন সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন বিবেচনা করিয়াছিলাম, তখন সংবাদ দিয়াছিলাম। হত্যাকারীর নিকট গমন করিতে হইলে পুলিস তাহাকে পূর্ব্বে সংবাদ প্রদান করে না। 

পরাণ। আমি কি তবে হত্যাকারী যে, আপনার বিনা-সংবাদে আমার নিকট আগমন করিলেন? 

আমি। এইরূপ ত অনুমান হয়, আপনি গোপিনাথকে হত্যা করিয়াছেন। আর আমরা আপনাকে ধৃত করিতে এইস্থানে আগমন করিয়াছি। 

পরাণ। ভদ্রলোকের উপর এরূপ অন্যায় দোষারোপ করিবেন না। এরূপভাবে আমার সহিত কথা কহিলে আপনাদিগের ভয়ানক বিপদ হইবে জানিবেন। আপনারা জানেন, যে, বিনা অনুমতিতে অপরের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে তাহার কি অপরাধ হয়? 

আমি। খুব জানি। জানিয়া শুনিয়াই আমরা তোমার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছি, এবং হত্যাপরাধে তোমাকে ধৃত করিতেছি। 

এই বলিয়া পরাণের হস্ত ধারণ করিলাম, এবং বলপূর্ব্বক তাহাকে নীচে আনিলাম। সদরদ্বারের সম্মুখে আমাদের গাড়ি ছিল, সেই গাড়ির ভিতর তাহাকে উঠাইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে যে বাগানে লাস পাওয়া গিয়াছিল, সেই বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

যেস্থানে গোপিনাথের মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, সেইস্থানেই পরাণচন্দ্র বন্ধনাবস্থায় বসিয়া রহিল। সেই সময়ে পরাণচন্দ্রের আকৃতি যেন পরিবর্তিত হইল, তাহার মুখ দিয়া এ পর্য্যন্ত যে সকল নির্ভয়-ব্যঞ্জক বাক্যসকল নির্গত হইতেছিল তাহা বন্ধ হইল। সে যেন সেইস্থানে মৃতপ্রায় বসিয়া রহিল; কিন্তু মধ্যে মধ্যে এক একবার গোপিনাথের মৃতদেহের উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে লাগিল। 

লাস পাইবার পরেই আমার মনে একটি সন্দেহের উদয় হইয়াছিল। উহা যে কি, তাহা আমি এখন পাঠকদিগকে বলিব না: সময়মত সকলেই অবগত হইতে পারিবেন। আমি কিন্তু সেই সন্দেহ মিটাইবার নিমিত্ত কেদারনাথ দাসের অনুসন্ধানের নিমিত্ত টালিগঞ্জে একজন কর্মচারীকে প্রেরণ করিয়াছিলাম। যে সময় আমরা পরাণকে লইয়া সেই বাগানের ভিতর উপবিষ্ট, সেই সময় সেই কৰ্ম্মচারী দুইজন লোক সমভিব্যাহারে টালিগঞ্জ হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহার নিকট হইতে জানিতে পারিলাম, বহুদিবস হইল, কেদারনাথ দাস ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার আত্মীয়স্বজন প্রভৃতি কেহই নাই, কেবল কিরণ-নামধেয় একটিমাত্র পুত্র ছিল, সেও বহুদিবস হইতে দেশত্যাগী। কেদারনাথ যেস্থানে বাস করিতেন, সেইস্থান হইতে একজন লোককে আনিয়াছি। ইনি কিরণকে পূৰ্ব্বে দেখিয়াছেন, এখন চিনিলেও বোধ হয় চিনিতে পারেন। আরও একটি বৃদ্ধ লোককে পাইয়াছি, সে কেদারনাথের নিকট বহুদিবস চাকরী করিয়াছিল, এ ব্যক্তিও কিরণকে চিনিত। এই বলিয়া কর্মচারী তাঁহার আনীত লোকদ্বয়কে আমার সম্মুখে আনিয়া উপস্থাপিত করিলেন। 

পরাণকে দেখাইয়া দিয়া আমি প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে কহিলাম, “দেখুন দেখি মহাশয়! আপনি ইহাকে চিনিতে পারেন কি না?” পরাণকে উত্তমরূপে দেখিয়া তিনি কহিলেন, “ইঁহার মুখাকৃতি অনেকটা কিরণের মুখাকৃতির সহিত মিলে। কিন্তু আমি ঠিক চিনিতে পারিতেছি না যে, ইনি কিরণ, কি না; কারণ বহুবৎসর হইতে আমি কিরণকে দেখি নাই। আমি যে সময়ে দেখিয়াছি, সেই সময় কিরণ বালক ছিল।” 

যে ব্যক্তি কেদারনাথের নিকট চাকরী করিত, সেই বৃদ্ধকে পরিশেষে পরাণকে দেখিবার নিমিত্ত কহিলাম। অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত দেখিয়া বৃদ্ধ কহিল, “আমি কিরণকে বহুবৎসর পূর্ব্বে দেখিয়াছি, তখন সে বালক ছিল। আর আমি এখন বৃদ্ধ হইয়াছি; সুতরাং আমি ঠিক বলিতে পারি না, ইনি সেই কিরণ কি না? কিন্তু ইঁহার মুখের ভাব অনেকটা সেই কিরণের মুখের মত। আরও একটি কথা, বাল্যকালে কিরণ অতিশয় দুষ্ট বালক ছিল। সেই সময়ে একদিবস দৌড়াদৌড়ি করিতে করিতে পড়িয়া যাওয়ায় উহার বামহস্তের একখানি হাড় ভাঙ্গিয়া যায়। ডাক্তারের চিকিৎসায় সেই হস্ত যদিও পরিশেষে যোড়া লাগে, কিন্তু উহা বাঁকাই থাকিয়া যায়। দেখুন দেখি, উহার বামহস্তের কোন হাড় বাঁকা আছে কি না।” এই বলিয়া বৃদ্ধ দূরে গিয়া উপবেশন করিল। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

বৃদ্ধের কথা শুনিয়া পরাণের নিকট গমন করিলাম, তাহার গাত্রের কাপড় খুলিবামাত্র সকলেই দেখিতে পাইলাম, ইহার বামহস্তের হাড় যেন বাঁকা আছে। এইরূপ অবস্থা দৃষ্টি করিয়া আমাদিগের মনে আর কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। পূর্ব্বে আমার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, এখন দেখিলাম, তাহা কার্য্যে পরিণত হইল। 

পূর্ব্বে পরাণের বিপক্ষে যে সকল প্রমাণ পাইয়াছিলাম তাহা তাহাকে সমস্ত বলিলাম। তিলক দাস যে সকল কথা গোপিনাথের নিকট শ্রবণ করিয়াছিল, আমি যে সকল বিষয় ভৈরব সিং দ্বারবান, কোচমান, মালি প্রভৃতির নিকট হইতে অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই পরাণকে একে একে বলিয়া পরিশেষে তাহাকে কহিলাম, তোমার উপর আমরা যেরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহাতে তোমার কোনরূপেই নিস্তার পাইবার আশা নাই। তুমি ক্ষণকালের নিমিত্ত মনে স্থান দিও না যে, গদাধর বাবুর পরিত্যক্ত সম্পত্তি তুমি আর ভোগ করিতে পারিবে। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, যাহা করিবার তাহা করিয়াছ, এখন তুমি তোমার কৃত পাপরাশি সর্ব্বসমক্ষে প্রকাশপূর্ব্বক সেই পাপের কতক প্রায়শ্চিত্ত করিয়া, ঈশ্বরের নিকট ক্ষমা-প্রার্থনা কর।” 

দেখিলাম, আমার কথা শুনিয়া পরাণ যেন আপনার পাপ সর্ব্বসমক্ষে প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইল। কেবলমাত্র আমার কথাতেই যে তাহার মনের ভাব পরিবর্তিত হইল, তাহা নহে; আমার বোধ হয়, উহার অপর কারণ ছিল। পুলিস বিভাগে আমার প্রায় ষোলবৎসর কাটিয়া গিয়াছে। এই ষোলবৎসরে আমার যতদূর জ্ঞান জন্মিয়াছে, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে, হত্যাকারীকে যদি হতব্যক্তির নিকট কিয়ৎক্ষণ স্থিরভাবে রাখিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে অন্ততঃ শতকরা পঁচানব্বইজন নরঘাতক সেই সময়ে আপন দোষ স্বীকার করে। পরাণকেও তাহাই করা হইয়াছিল। সুতরাং সেও যে এখন আপন দোষ স্বীকার না করিবে, এমন নহে। 

সেই সময়ে পরাণ আমাকে কহিল, “মহাশয়! মহাপাতকী আমার দ্বারা যে গোপিনাথ হত হইয়াছে, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি আর এই ভয়ানক দৃশ্য দেখিতে পারি না। এইস্থান হইতে আমাকে স্থানান্তরে লইয়া চলুন, সেইস্থানে বসিয়া আমার দ্বারা যে সকল মমতাহীন ভয়ানক দস্যুর কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার সমস্তই আপনাদিগের নিকট মুক্তকণ্ঠে প্রকাশ করিতে সম্মত আছি।” 

পরাণের কথা শুনিয়া এবং তাহার ভাবভঙ্গি দেখিয়া ভাবিলাম, এখন পরাণ প্রকৃতকথা বলিতে প্রস্তুত। এই ভাবিয়া পরাণকে সেই বাগানের মধ্যস্থিত বাড়ীর ভিতর লইয়া গেলাম, আমাদিগের সহিত আরও অনেকে সেইস্থানে গমন করিল। পরাণ সেইস্থানে উপবেশন করিয়া আপনার কৃত ভয়ানক পাপকাহিনী সকল বিবৃত করিতে আরম্ভ করিল। 

পরাণ কহিল, “মহাশয়! আমার মত বিশ্বাস-ঘাতকী ও মহাপাতকী এ জগতে আর আছে কি? আমার দ্বারা যে সকল ভয়ানক ভয়ানক কার্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা যে এজগতে রক্তমাংস-গঠিত অপর কোন মনুষ্যের দ্বারা নিষ্পন্ন হইতে পারে, তাহা আমার বোধ হয় না! 

“আপনি যে অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া অদ্য এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহা অমূলক নহে, ইহা নিশ্চিত। আপনি যে অনুমান করিয়াছেন, আমার নাম পরাণচন্দ্র নহে, আমি টালিগঞ্জের কেদারনাথ দাসের পুত্র কিরণ, তাহা প্রকৃত। আপনি যে অনুমান করিতেছেন, গোপিনাথ আমার দ্বারা হত হইয়াছে, তাহাও প্রকৃত। ইহা ব্যতীত অপরাপর বিষয় যাহা আপনাদিগের অনুমান শক্তিতে কুলায় নাই, তাহাও এই হতভাগার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। যখন আমি সমস্ত বলিতে বসিয়াছি, তখন আর কিছুমাত্র গোপন করিব না, সমস্তই বলিতেছি, আপনারা শ্রবণ করুন। 

“আমার প্রকৃত নাম কিরণচন্দ্র দাস, আমার পিতার নাম কেদারনাথ দাস, বাসস্থান ছিল—টালিগঞ্জে। আমার পিতার অবস্থা প্রথমে নিতান্ত মন্দ ছিল না; কিন্তু পরিশেষে তাঁহার অবস্থার পরিবর্তন হয়, তিনি নিতান্ত দরিদ্র হইয়া পড়েন। সংসারের মধ্যে ছিলেন—কেবল তিনি ও আমি। ক্রমে তিনিও ইহজীবন পরিত্যাগ করেন। আমি তখন অন্য কোন উপায় না দেখিয়া টালিগঞ্জ পরিত্যাগ করি। বাল্যকালে লেখাপড়া শিক্ষা করি নাই, কেবল আমোদ—প্রমোদ ও অপরাপর বয়াটে ছেলেদের সঙ্গে মিশিয়া কাল কাটাইতাম। পিতার মৃত্যুর পর আমি আমার বন্ধুবান্ধব—গণের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহারা অনেকেই আমার কষ্টে দুঃখপ্রকাশ করিলেন সত্য, কিন্তু আমাকে একমুষ্টি অন্ন প্রদানে কেহই সম্মত হইলেন না। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনপূর্ব্বক দেশ-পৰ্যটনেই কৃতসঙ্কল্প হইলাম। এইরূপে নানাস্থানে পরিভ্রমণ করিতে করিতে পথিমধ্যে একদিবস পরাণচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি দেশত্যাগী। সুতরাং আমাদিগের উভয়ের উদ্দেশ্যই এক হইল। দুইজন একত্র মিলিত হইয়া নানাস্থান ভ্রমণ করিতে করিতে ক্রমে আগ্রায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে জয়চন্দ্র নামক একজন সদাশয় মহাত্মার সাহায্য পাইলাম। পরাণ তাঁহার নিকট কৰ্ম্ম করিতে লাগিল, আমিও তাঁহারই যত্নে অপর একস্থানে কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যে হতভাগ্য গোপিনাথ এখন আমার হস্তে হত হইয়াছে, সেও কোথা হইতে আসিয়া আমাদিগের সহিত মিলিত হইল, ও পরিশেষে পরাণের দাস্যবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হইল। ইহার মত প্রভুভক্ত ভৃত্য এজগতে সহজে পাওয়া নিতান্ত দুষ্কর! 

“পরাণচন্দ্র আমার কেহই ছিলেন না, কিন্তু তিনি আমাকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতেন। তাঁহার মনের সমস্ত কথা আমার নিকট অকপটে প্রকাশ করিতেন। এইরূপে বহু বৎসর আমরা সেইস্থানেই অবস্থান করিতে লাগিলাম। “আমি যে দোকানে কর্ম্ম করিতাম, সেই দোকানে কোন দ্রব্য ক্রয় করিবার নিমিত্ত একদিবস একজন বাঙ্গালী আগমন করেন। তাঁহার সহিত একখানি বাঙ্গালা সংবাদপত্র ছিল। আমাদিগের দোকান হইতে প্রস্থান করিবার সময় তিনি সেই সংবাদ-পত্রখানি ভ্রমক্রমে ফেলিয়া যান। সেই সংবাদ-পত্রখানি আমি উঠাইয়া লই, এবং অবকাশমত দোকানে বসিয়াই পাঠ করিতে থাকি। উক্ত সংবাদ পত্র পাঠ করিতে করিতে একটি বিজ্ঞাপনের উপর আমাকে নয়ন আকৃষ্ট হয়। আমি উহা বিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করি। মহাশয়! সেই বিজ্ঞাপনই আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছে, সেই বিজ্ঞাপন হইতেই বন্ধুহত্যা প্রভৃতি যে সকল মহাপাতক হইতে পারে, তাহা আমার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। 

“উক্ত বিজ্ঞাপন এইরূপভাবে লেখা ছিল। 

“আমার মাতা তারা বহুদিবস হইল, ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন, সম্প্রতি আমার পিতা গদাধর বসুও স্বর্গে গমন করিয়াছেন। পরাণচন্দ্র বসু নামধেয় আমার এক বৈমাত্র ভ্রাতা ছিলেন; বহুবৎসর অতীত হইল, তাঁহার পিতা এবং তাঁহার বিমাতার বর্তমানেই তিনি গৃহ পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছেন। সম্প্রতি পিতা তাঁহার মৃত্যুকালে তাঁহার পরিত্যক্ত অসীম বিষয়ের একখানি উইল করিয়া গিয়াছেন। এই উইলে লেখা আছে, ‘যদি আমার প্রথমা স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র শ্রীমান পরাণচন্দ্র বসু এখনও জীবিত থাকে ও তিন বৎসরের মধ্যে যদি সেই পুত্র আমার বাটীতে প্রত্যাগমন করে, তাহা হইলে সেই সমস্ত বিষয়ের তিন অংশ প্রাপ্ত হইবে। অবশিষ্ট এক অংশ আমার দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভজাতা কন্যা শ্রীমতী রাণী দাসী পাইবে। আর যদি পরাণের কোনরূপ সন্ধান না হয়, তাহা হইলে সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী অধিকারিণী, আমার উক্ত একমাত্র কন্যা শ্রীমতী রাণী দাসীই হইবে।’ পিতা এই মৰ্ম্মে উইল করিয়া গিয়াছেন। পরাণ দাদা! তুমি যদি জীবিত থাক, তাহা হইলে এই বিজ্ঞাপন দেখিবামাত্র তুমি বাটীতে প্রত্যাগমন করিবে। উইল উকীলের নিকট আছে। এখানে আগমন করিয়া, আপনিই যে পরাণ, তাহা সেই উকীল মহাশয়ের নিকট প্রমাণ করাইতে পারিলেই আপনার সমস্ত বিষয় প্রাপ্ত হইবেন। অদ্য হইতে আমি তিন বৎসরকাল আপনার অপেক্ষা করিব। ইহার মধ্যে যদি আপনি আগমন না করেন, তাহা হইলে সমস্ত বিষয়ই আমার হইবে, জানিবেন। 

শ্রীপরাণচন্দ্র বসুর ভগিনী ও গদাধর বসুর একমাত্র কন্যা 

শ্রীমতী রাণী দাসী
ফুলবাগান,—কলিকাতা।” 

“এই বিজ্ঞাপন দেখিয়া আমার মনে এক ভয়ানক ভাবের উদয় হইল। যাহার সহিত আমি একত্র এত বৎসর অতিবাহিত করিতেছি, সেই একান্ত বিশ্বাসী বন্ধুর সর্ব্বনাশ করিতে আমি কৃতনিশ্চয় হইলাম! সেই বিজ্ঞাপন পাঠ করিয়াই আমি আমার বিশ্বস্ত বন্ধুর ভালবাসা ভুলিলাম! অর্থের লোভ-প্রদর্শক আশ্বাস আমার হৃদয়ে প্রবেশ করিল! “বিজ্ঞাপনের কোন কথা আমি পরাণের নিকট প্রকাশ করিলাম না। অধিকন্তু কোন সংবাদ পত্র তাহার হস্তে প্রথমে যাহাতে পতিত না হয়, সেইদিকে সর্ব্বদা লক্ষ্য রাখিলাম। 

“পাপমুখে যখন পাপকথা ব্যক্ত করিতে বসিয়াছি, তখন আর মনের ভাব গোপন করিয়া লাভ কি? সেই সময়ে আমি মনে মনে স্থির করিলাম—এ জগৎ হইতে পরাণের অস্তিত্ব কোনরূপে লোপ করিয়া পরাণ পরিচয়ে তাহার সমস্ত বিষয় নিজে অধিকার করিব। কিন্তু আগ্রায় কোনরূপে সে সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একে জয়চন্দ্ৰ বর্তমান, তাহার উপর পরাণের ভৃত্য গোপিনাথ। মনে ভয় হইল, যদি পরিশেষে উহাদিগের দ্বারা মূলকথা প্রকাশ হইয়া পড়ে! যদি সকলে জানিতে পারে যে, পরাণের মৃত্যু হইয়াছে, কিরণ, পরাণ-পরিচয়ে তাহার সমস্ত বিষয় অধিকার করিয়াছে, তাহা হইলে আমার উপায় কি হইবে? আমার জীবনের অবশিষ্টাংশ সুখের পরিবর্তে কারাগারের কঠিন যন্ত্রণায় লয়-প্ৰাপ্ত হইবে! 

“এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তার পর, এক উপায় স্থির করিলাম; সুযোগমতে নিত্য নিত্য পরাণের দেহে বিষ প্রয়োগ করিতে লাগিলাম। সে বিষে মৃত্যু হয় না, কিন্তু ভয়ানক শিরঃপীড়া জন্মায়। আমার মনস্কামনা ক্রমে পূর্ণ হইল। পরাণ ক্রমেই শিরঃপীড়ায় অস্থির হইতে লাগিল। আগ্রার চিকিৎসকগণ কোনরূপেই শিরঃপীড়ার শান্তি করিতে পারিল না! শান্তি হইবে কিসে? ঔষধ সেবনের ভার আমার হস্তে! চিকিৎসকগণ-প্রদত্ত ঔষধের সঙ্গেও আমি সেই বিষ প্রয়োগ করিতে ভলিলাম না। কাজেই উপশমের পরিবর্ত্তে পীড়া ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। পরিশেষে স্থানান্তরে গমন করিয়া পরাণের চিকিৎসা করাইবার ব্যপদেশে, মনিব জয়চন্দ্রের সম্মতিক্রমে আমরা বোম্বাই যাত্রা করিলাম। গোপিনাথকে সঙ্গে লইতে আমি অসম্মত ছিলাম; কিন্তু গোপীনাথের ঐকান্তিকতায় ও পরাণচন্দ্রের নিতান্ত ইচ্ছায়, অগত্যা তাহাকে সঙ্গে লইতে হইল। কিন্তু পথিমধ্যে কৌশলক্রমে তাহাকে রেলগাড়ি হইতে নামাইয়া দিলাম। সে ষ্টেশনে পড়িয়া রহিল, আমরা প্রস্থান করিলাম। 

“আমরা বোম্বাই সহরে গমন করিতেছি, একথা গোপিনাথ জানিত। পরিশেষে বোম্বাই গমন করিয়া কোনরূপে সে আমাদিগের সন্ধান পায়, এই ভয়ে বোম্বাই গমন না করিয়া আমরা পুনায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। পথে আমি এরূপ ভাবে ঔষধ প্রয়োগ করিলাম যে, যখন আমরা পুনায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন পরাণ সংজ্ঞাহীন। সেইস্থানে একটি বাসা লইলাম, আমাকে পরাণ বলিয়া পরিচয় দিলাম; সংজ্ঞাহীন পরাণের নাম হইল কিরণ। সেইস্থানে দুই একজন চিকিৎসকের দ্বারা রোগীর চিকিৎসা করাইলাম; কিন্তু তাঁহাদিগের প্রদত্ত ঔষধের পরিবর্তে এমন একরূপ বিষ প্রয়োগ করিলাম যে, সেইদিবসেই রোগীর মৃত্যু হইল। উহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সেইস্থানেই সমাধা করিলাম।” 

“এখন আমি আর কিরণ নহি, আমি পরাণচন্দ্র বসু। এই ভয়ানক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়া আমি পুনা পরিত্যাগ করিলাম। পরাণের পরিত্যক্ত বাক্স প্রভৃতি যাহা ছিল, তখন উত্তমরূপে দেখিলাম; উহার ভিতর তাঁহার বাল্যকালের দুই একখানি পত্র পাইলাম। তাঁহার একখানি কোষ্ঠী পাইলাম এবং আরও কতকগুলি কাগজপত্র পাইলাম। এই সকল কাগজপত্র দেখিয়া আমার মনে বিশেষ আনন্দ হইল। ইহাদের দ্বারা, আমিই যে পরাণ, তাহা উকীলকে বেশ বুঝাইতে পারিব, তাহার কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না। ইহা ব্যতীত পরাণের এতদিবসের সঞ্চিত সমস্ত অর্থই আমার হস্তগত হইল। পরাণের সমস্ত পরিচয়ই আমি জানিতাম। এখন তারযোগে রাণীকে সংবাদ দিলাম, ‘আমি তোমার ভ্রাতা পরাণচন্দ্র, তোমার বিজ্ঞাপন দেখিয়াছি, এবং বাড়ী যাইবার নিমিত্ত আমি মেলট্রেণে রওনা হইলাম।’ 

“যেরূপ টেলিগ্রাম করিলাম, কার্য্যেও সেইরূপ হইল। মেলগাড়িতে হাবড়ায় আসিয়া উপনীত হইলে ষ্টেশনে একটি বাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তিনি রাণীর স্বামী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়া আমাকে কহিলেন, ‘টেলিগ্রাম পাইয়া আপনাকে সঙ্গে করিয়া বাড়ীতে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আমি এখানে আগমন করিয়াছি। যাহা হউক তিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া ফুলবাগানের বাড়ীতে আনয়ন করিলেন। সেইস্থানে রাণীর সহিতও আমার সাক্ষাৎ হইল। ভগিনীর যেরূপ কর্তব্য, রাণী আমার সহিত সেইরূপ ব্যবহারই করিল। আমি কৃত্রিম দুঃখ প্রকাশ করিয়া পিতা ও বিমাতার জন্য রোদন করিলাম। সেইদিবস সেইরূপেই অতিবাহিত করিলাম। যে উকীলের নিকট গদাধর বসুর প্রদত্ত উইল ছিল, পরদিবস তাঁহার নিকট গমন করিলাম। তিনি বাল্যকালের পত্র কয়খানি এবং কোষ্ঠী দেখিয়াই আমাকে পরাণ বলিয়া স্থির করিলেন। সেইদিবস হইতেই আমি এই অগাধ সম্পত্তির অধিকারী হইলাম। 

সেইদিবস হইতেই আমি এই বাড়ীতেই বাস করিয়া আসিতেছি। পরাণের বিমাতা তারা তাহার উপর যেরূপ ব্যবহার করিতেন শুনিয়াছি, রাণীর ব্যবহার কিন্তু তাহা হইতে বিপরীত দেখিলাম। রাণী আমার উপর যেরূপ ব্যবহার করিতে লাগিল, সহোদরের প্রতি সহোদরার সেইরূপ ব্যবহার অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপে মনের সুখে কিছু দিবস অতিবাহিত করিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, মূলকথা আর কোনরূপেই প্রকাশ হইবে না। 

“যাহা আমি কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই, সম্প্রতি একদিবস আমি তাহা দর্শন করিলাম! দেখিলাম, আমাদিগের বাড়ীর সম্মুখে পরাণের সেই বিশ্বস্ত ভৃত্য হতভাগ্য গোপিনাথ বসিয়া আছে। উহাকে দেখিবামাত্র আমার অন্তরে যে কিরূপ ভয়ানক ভাবের স্রোত বাহিরে লাগিল, তাহা অপর কেহ অনুমান করিতে পারিবে না। ভাবিলাম, এতদিবস পরে আমার সর্ব্বনাশ উপস্থিত! গোপিনাথ, দেখিতেছি, সকল কথা প্রকাশ করিয়া দিবে! এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বোধ হয় গোপিনাথও সেই সময় আমাকে দেখিতে পাইয়াছিল। সে রাত্রিতে আমি কোনরূপেই নিদ্রা যাইতে পারিলাম না। কি প্রকার উপায় অবলম্বন করিলে আমি এই বিপদ হইতে উদ্ধার হইতে পারিব, কেবল তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। পরিশেষে উহাকে হত্যা করাই স্থির হইল। কারণ, গোপিনাথের অস্তিত্ব যদি লোপ হয়, তাহা হইলে আমার গুপ্তকথা প্রকাশের আর কোন ভাবনাই নাই। গোপিনাথ ব্যতীত এ সকল কথা আর কেহই অবগত নহে। যাহা হউক, পরদিবস প্রত্যূষে আমি দেখিতে পাইলাম, গোপিনাথ পুনরায় আসিয়া আমার বাড়ীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে। উহাকে দেখিবামাত্র আমি গাড়ি সাজাইতে আদেশ দিলাম। গাড়ি প্রস্তুত হইলে বস্ত্রের ভিতর একখানি সাংঘাতিক ছুরিকা লুকাইয়া লইয়া গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিলাম। আমাকে দেখিবামাত্র গোপিনাথ আমার গাড়ির নিকট আগমন করিল। পরে আমাকে দেখিয়া কহিল, “বাবু! আপনি এখানে আছেন? আমার বাবু কোথায়? তাঁহার রোগ আরোগ্য হইয়াছে কি?’ 

“গোপিনাথের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, ‘হাঁ! তোমার বাবু ভাল হইয়াছেন। তুমি এখানে কবে আসিলে? তুমি কি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহ? আমি তাঁহারই নিকট গমন করিতেছি। যদি তুমি যাইতে চাহ, আমার সহিত আইস।’ এই বলিয়া আমি গোপিনাথকে আমার গাড়িতে উঠাইয়া লইলাম, তাহাকে লইয়া এই বাগানে আসিলাম। গাড়িবান ও মালিকে বাগান হইতে বিদায় করিয়া দিয়া, তীক্ষ্ণ ছুরির আঘাতে গোপিনাথের ইহজীবন শেষ করিলাম পরিশেষে তাহার দেহ দৃঢ়রূপে বন্ধন করিয়া ঐ পুষ্করিণীর ভিতর নিক্ষেপ করিলাম। পরে যাহা হইয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। আপনারাই ভালরূপ জানেন। 

“মহাশয়! এই জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ নিজ বাগানের ভিতর গোপিনাথকে হত্যা করিয়া ভাবিলাম, প্রকৃত কথা প্রকাশকারী যে এক ব্যক্তি ছিল, নিভৃতে তাহাকে হত্যা করিলাম! এ হত্যা করিতে কেহ আমাকে দেখে নাই। বিশেষতঃ গোপিনাথ এইস্থানের ভেতরে থাকিবে। তাহার নিরুদ্দেশের সংবাদ এ জগতে কেহ কখনো জানিতে পারিবে না। সুতরাং আমি নিরাপদে দিনযাপন করিতে পারিব। কোনরূপে যদি উক্ত লাস বাহির হইয়াই পড়ে তাহা হইলে কিছুতেই এই অপরিচিত ব্যক্তিকে সনাক্ত করিতে পারিবে না। সুতরাং মূলকথা কিরূপে প্রকাশ পাইবে? কিন্তু মহাশয়! যাহা ভাবিলাম, এখন দেখিতেছি, তাহার বিপরীত হইল! কোন মনুষ্য আমার এই ভয়ানক পাপের কথা জানিতে না পারিলেও ঈশ্বরের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইলাম না! দুষ্কর্ম করিতে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে মানুষের মনে যদি ঈশ্বরের কথা একবার মনে হইত, তাহা হইলে জগতে বোধ হয়, এত পাপের প্রশ্রয় হইত না; মনুষ্যগণ পাপস্রোতে বোধ হয়, নরকের দিকে এতদূর অগ্রগামী হইতে পারিত না! যাহা হউক মহাশয়! আমার অদৃষ্টে যাহা ঘটিবার, তাহা ঘটুক! অর্থের নিমিত্ত যে কিরূপ অনর্থ ঘটিতে পারে, আমার দৃষ্টান্তই তাহার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত! এই দৃষ্টান্ত দেখিয়া মনুষ্যগণ এখন হইতে তাহা শিক্ষা করুন, ঈশ্বরের নিকট এখন এই আমার প্রার্থনা।” এই বলিয়া কিরণ নিরস্ত হইল। 

সেইস্থানে যে সকল ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, কিরণের সমস্ত কথা শুনিয়া তাঁহারা একেবারে স্তম্ভিত হইলেন! এই কথা ক্রমে রাণীর কর্ণে গিয়া উপস্থিত হইল। রাণী যুগপৎ ক্রোধ, ভয় ও ঘৃণায় অভিভূতা হইলেন। 

যাহা হউক, সময়ে আদালতে এই মোকদ্দমার বিচার হইল। বিচারস্থলে তিলকদাস, টালিগঞ্জনিবাসী কিরণের প্রতিবেশী সেই ভদ্রলোক, বেতনভোগী কর্ম্মচারী সেই বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং আরও অনেক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। আগ্রা হইতে ব্যবসায়ী এবং পুনার চিকিৎসকদ্বয়কেও আনা হইয়াছিল। সকলের সাক্ষ্যে কিরণ জুরীদিগের বিচারে পরিশেষে চরম দণ্ডে দণ্ডিত হইলেন। 

[কাৰ্ত্তিক ১৩০১] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *