মার ধন চুরি (ধনী-পুত্রের প্রেমের দায়!)

মার ধন চুরি (ধনী-পুত্রের প্রেমের দায়!) Done page।05

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একটি চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে একদিবস আমাকে সিমলার হরিহর দাসের বাড়ীতে গমন করিতে হইয়াছিল। আমি যে দিবস তাহার বাড়ীতে গমন করিলাম, তাহার প্রায় এক সপ্তাহ পূর্ব্বে সেই বাড়ীতে চুরি হইয়াছিল। 

হরিহরের বাড়ীতে গমন করিয়া দেখিলাম, যে বাড়ীতে হরিহর বাস করে, সেই বাড়ীতে কেবল দুইটিমাত্র কামরা আছে। তাহার একটি হরিহর দ্বারা অধিকৃত, অপরটিতে থাকে—দামুর মাতা। অনুসন্ধানে অবগত হইলাম, দামোদর তাহার মাতার সহিত প্রায় তিন বৎসর হইতে এই বাড়ীতে বাস করিতেছে। দামুর মাতা বিধবা। দামুর পিতার মৃত্যুর সময় দামু নিতান্ত বালক ছিল। বিধবা তাহার পুত্রকে এতদিবস পর্য্যন্ত প্রতিপালন করিয়া এখন তাহাকে কার্য্যের উপযুক্ত করিয়াছে। সে তাহার পুত্রটিকে প্রতিপালন করিয়াছে সত্য; কিন্তু দামু তাহার চরিত্র কোনরূপে নির্দোষ রাখিতে সমর্থ হয় নাই। কু-সঙ্গে মিশিয়া তাহাকে নানা প্রকার অসৎ উপায় অবলম্বন করিতে হইয়াছে, এবং একবার দুই বার করিয়া ক্রমে তাহাকে তিন তিন বার জেল পৰ্য্যন্ত দেখিতে হইয়াছে। কেবল দুই মাসমাত্র অতীত হইল, শেষবার দামু জেল হইতে বহির্গত হইয়াছে। তৃতীয় বার যখন দামু ধরা পড়ে, সেই সময় দিনমানে একটা বাড়ীর ভিতর সে প্রবেশ করিয়াছিল। বাড়ীতে সেই সময় কেহ উপস্থিত না থাকায় গৃহের তালা ভাঙ্গিয়া সে ভিতরে প্রবেশ করে, এবং বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি সেই গৃহের ভিতর ছিল, তাহা ভাঙ্গিয়া তাহার ভিতর হইতে মূল্যবান্ সমস্ত দ্রব্য অপহরণ করে। কিন্তু দামুর দূরদৃষ্ট বশতঃ বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার সময়, হঠাৎ একটা পাহারাওয়ালার সম্মুখে পড়িয়া ধৃত হয়। এই মোকদ্দমায় দামু এক বৎসরের নিমিত্ত শ্রীমন্দিরে গমন করিয়াছিল। 

দামুর মাতা বিধবা সত্য, কিন্তু নিতান্ত দরিদ্রা ছিল না, গহনা-পত্র এবং নোট প্রভৃতিতে তাহার সহস্র মুদ্রার অধিক ছিল। যে গৃহে সে শয়ন করিত, সেই গৃহের ভিতর একটি বড় কাষ্ঠের সিন্ধুকে সেই সকল দ্রব্যাদি থাকিত। দামু ইহা জানিত কি না, জানি না। কিন্তু শ্রবণ করিলাম, তাহার মাতার অসাক্ষাতে সে নীচ-প্রবৃত্তির তৃপ্তি-সাধন আশায় সেই সকল বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি ভাঙ্গিয়া তাহার ভিতরস্থিত দ্রব্যাদি অপহরণ করিতে পূর্ব্বে কয়েকবার চেষ্টাও করিয়াছিল, কিন্তু কোনরূপে সফল মনোরথ হইতে পারে নাই। 

দামুর মা’র পুত্র একমাত্র হইলেও আপনার পুত্রের জন্য যে সর্ব্বদা শঙ্কিত থাকিত, সর্ব্বদাই তাহার মনে ভয়—যদি কোন সুযোগে দামু তাহার সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া অযথা ব্যয় করিয়া ফেলে। দামু যতদিবস জেলের ভিতর থাকিত, ততদিবস বৃদ্ধা পুত্র-বিরহে আন্তরিক কষ্ট পাইলেও নিঃশঙ্কচিত্তে দিনপাত করিত। দামু যখন জেলের বাহিরে, তখন বৃদ্ধা কোনরূপেই আপনার গৃহ পরিত্যাগ করিত না; রাত্রিকালে নিদ্রায় সুষুপ্তিসুখও অনুভব করিতে আদৌ সমর্থ হইত না। 

দামুর জ্বালায় যে কেবলমাত্র বৃদ্ধাই নিতান্ত অসন্তুষ্টা ছিল তাহা নহে, পাড়ার সকলেই তাহার জালায় বিশেষ জ্বালাতন হইত। সুযোগ পাইলে আপন হউক বা পর হউক, কাহারও অর্থাদি অপহরণ করিতে সে পরাম্মুখ হইত না। 

পাড়ায় কোনরূপ চুরি হইলে পুলিস আসিয়া প্রথমেই দামুর অনুসন্ধান করিতেন। সময়ে সময়ে অনুসন্ধানে দামুকে পাওয়া যাইত না। এমন কি, যতদিবস সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান হইত, ততদিবস দামুর কোন খোঁজখবরই কেহ বলিয়া উঠিতে পারিত না। প্রকৃষ্টরূপে অনুসন্ধান করিয়াও তাহার কোন সন্ধানই মিলিত না। 

কোন কোন সময় কোন কোন মোকদ্দমার অনুসন্ধান কালে পুলিস যেমন তাহাকে সন্ধান করিতেন, অমনি কোথা হইতে সে আসিয়া উপস্থিত হইত। পুলিস যতদিবস সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত থাকিতেন, ততদিবস সে ছায়ার ন্যায় পুলিসের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘুরিত। বাস্তবিক সকল চুরি ব্যাপারেই তাহার বিপক্ষে অনুসন্ধানটা প্রথমেই শেষ করিয়া, পুলিস পরিশেষে অন্যদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেন। 

পাড়ার লোক হইতে অনুসন্ধানকারী পুলিস পর্য্যন্ত কাহারও নিকট দামু অপরিচিত ছিল না। কেবল পরিচিত নহে, তাহার জ্বালায় সকলেই জ্বালাতন হইত। 

হরি নামক একটি হিন্দু বালক, এবং করিম নামে একটি মুসলমান নন্দন দামুর আন্তরিক বন্ধু ছিল। দামুকে সৰ্ব্বদাই উহাদিগের কাহারও না কাহার সহিত একটা পাওয়া যাইত। উহারা উভয়েই বদমাইসিতে দামু অপেক্ষা ন্যূন ছিল না। দুই এক বার শ্রীমন্দিরে বাস উহাদিগের ভাগ্যে ঘটিয়াছিল। 

যে সময়ে চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইল আমাকে হরিহরের বাড়িতে গমন করতে হয়, সেই সময় হরি, করিম এবং দামোদর তিনজনেই জেল হইতে খালাস হইয়া, অতি অল্পদিনমাত্র আগমন করিয়াছে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবার পূর্ব্বে পুলিস যেরূপ অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, তাহারই সমস্ত কাগজপত্র প্রথমে দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। এই কাগজ পত্রের মধ্যে দুইটি বিষয় পাঠকগণ জানিতে পারিলেই সমস্ত বিষয় উত্তম রূপে বুঝিতে সমর্থ হইবেন। প্রথম ফরিয়াদীর জবানবন্দী দ্বিতীয় তদারক-কারী পুলিস-কর্ম্মচারীর ডায়েরী। ফরিয়াদী যেরূপ জবানবন্দী দিয়াছিল, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ:—

“আমার নাম হরিহর দাস, পিতার নাম মৃত কালাচাঁদ দাস। নিবাস শুনিয়াছি, যশোহর জেলায়, আমি কিন্তু থাকি কলিকাতায় সিমলায়। সিমলায় আমার পৈতৃক একখানি একতলা পাকা বাড়ী আছে। সেই বাড়ীতে কেবল দুইটিমাত্র গৃহ। একটি গৃহ আমা দ্বারা অধিকৃত, অপর গৃহখানি মাসিক তিন টাকা ভাড়ায় দামোদর দাসের মাতাকে বসবাস করিতে দিয়াছি। সেই বিধবা একাকী উক্ত গৃহে থাকে। দামোদর তাহার পুত্র, কিন্তু সে কখনও তাহার মাতার গৃহে রাত্রিযাপন করে না। সে যে কোথায় থাকে, কি করে, তাহা আমরা অবগত নহি। শুনিয়াছি, দামুর মাতার কিছু টাকাকড়ি আছে; কিন্তু যে কি আছে, বা কোথায় আছে, তাহা আমি অবগত নহি। দামু বড় বদ্-ছোক্বা। শুনিতে পাই, সে আজ উহাকে মারিয়াছে, কালি উহার অঙ্গের বস্ত্র বা অলঙ্কার কাড়িয়া লইয়াছে, পরশ্ব অমুকের গৃহে প্রবেশ করিয়া যথাসৰ্ব্বস্ব চুরি করিয়া লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। এইরূপে যে স্থানে যাই, সেইস্থানে তাহার দুর্নাম শুনিতে পাই। তাহাকে কেহ দেখিতে পারে না, সকলেই ঘৃণা করে। যাহার বাড়ী যায়, সেই তাহাকে তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত করিয়া দেয়। পুলিসেও তাহাকে উত্তমরূপে চিনে। সে চুরি করা অপরাধে দুই তিন বার জেলে পর্যন্তও গমন করিয়াছে। 

“গত রবিবারে কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হইয়াছিল। ঘটনাক্রমে আমি সে দিবস প্রত্যাগমন করিতে পারি নাই। যে সময় আমি বাড়ী হইতে বহির্গত হই, সেই সময়ে আমার গৃহের দ্বার তালাবদ্ধ করিয়া যাই। আমার যে কোন দ্রব্যাদি বা টাকাকড়ি ছিল, তাহার সমস্তই আমার গৃহের ভিতর থাকে। 

“সোমবার দিবা তিনটার সময় আমি প্রত্যাগমন করি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার পূর্ব্বেই বাড়ীর বাহিরে একটি ছোক্রাকে দেখিতে পাইয়াছিলাম। তাহাকে দেখিয়া আমার মনে কোনরূপ সন্দেহ উদয় হয় নাই। আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক গৃহের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া দেখি, দ্বারের বাহিরের চাবি ভাঙ্গা, কিন্তু দ্বার ভিতর হইতে বদ্ধ রহিয়াছে। সেই গৃহে একমাত্র দ্বার আছে; সুতরাং গৃহমধ্য হইতে কাহারও বহির্গত হইতে হইলে সেই দ্বার ব্যতিরেকে অন্য স্থান দিয়া বহির্গত হইবার উপায় নাই। গৃহের সেই প্রকার অবস্থা দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। কাহাকেও কিছু না বলিয়া, আমি সেইস্থানে চুপ করিয়া দণ্ডায়মান রহিলাম। দশ মিনিট পরে দেখিলাম, সেই দ্বার হঠাৎ খুলিয়া গেল, সেই গৃহের ভিতর হইতে দামু একটি বস্ত্রের গাঁট্‌হিস্তে বহির্গত হইল। এইরূপ অবস্থায় দামুকে দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, দামু আমার অসাক্ষাতে দ্বারের তালা ভাঙ্গিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, ও আমার যাহা ছিল, সমস্তই চুরি করিয়া লইয়া প্রস্থান করিতেছে। সেই সময়ে দামুকে কিছুই না বলিয়া উক্ত গাঁটরির দ্রব্যাদির সহিত তাহাকে আমার গৃহের সম্মুখে ধরিয়া ফেলিলাম, ও ‘চোর চোর’ বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিলাম। আমার চীৎকার শ্রবণে এক এক করিয়া চারি পাঁচজন প্রতিবেশী আসিয়া আমাদের বাড়ীতে প্রবেশ করিল। সেই সময় আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, আমার যে দুই একটি সিন্ধুক বাক্স আছে, তাহার সমস্ত ভাঙ্গা ও তাহার মধ্যস্থিত টাকা পয়সা, পোষাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্য ঐ গাঁরি ভিতর। 

“দামু আমার গৃহে প্রবেশ পূর্ব্বক গৃহের যেরূপ অবস্থা করিয়া চুরি করিয়া পলায়ন করিতেছিল, তাহা তাহার মাতাকে দেখাইবার ইচ্ছা করিয়া তখন তাহাকে ডাকিলাম। কিন্তু দামুর মাতার কোন প্রকার উত্তর না পাইয়া স্থির করিলাম, বিধবা এখন বাড়ীতে নাই। 

“কিয়ৎক্ষণ পরে দামুর মাতা বাহির হইতে বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিল। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া যাহা শুনিল, এবং যাহা স্বচক্ষে দেখিল, তাহাতে আপনার পুত্রকে শত সহস্ৰ গালি দিতে দিতে আপনার গৃহে প্রবেশ করিল। আপনার গৃহে প্রবেশমাত্র ‘আমারও সর্ব্বনাশ হইয়াছে, দামু আমারও সর্ব্বনাশ করিয়াছে বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিল। 

“তাহার ক্রন্দন শ্রবণে আমরা সকলেই তাহার গৃহে প্রবেশ করিলাম। তাহার গৃহে দেখিলাম, তাহারও বাক্স পো প্রভৃতি যাহা কিছু সেই গৃহের ভিতর ছিল, তাহার সমস্তই ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে! বস্ত্র প্রভৃতি অন্যান্য দ্রব্যাদি ঘরময় ছড়ান। বিধবা অবিরত রোদন করিতেছে, বুকে করাঘাত করিতে করিতে কহিতেছে, ‘দামু আমার সর্ব্বনাশ করিলি, আমার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিলি! যতদিন বাঁচবি, কি খাইয়া দিনপাত করিব?’ 

“বিধবাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল ‘আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে, আমার যথাসৰ্ব্বস্ব গিয়াছে। এই বাক্সের ভিতর আমার পাঁচশত টাকার নোট ছিল, এই বাক্সের ভিতর আমার সোণা রূপার গহনা ছিল, তাহারও দাম প্রায় আট নয় শত টাকা হইবে। এই সমস্তই চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। এখন আমার উপায় কি হইবে? যতদিন বাঁচিব, ততদিন কি উপায়ে জীবন ধারণ করিব?’ দামু আমার গৃহে চুরি করিয়াছে সত্য, কিন্তু কোন দ্রব্যই লইয়া যাইতে সমর্থ হয় নাই। সুতরাং সেরূপ অবস্থায় প্রথমে আমি মনে করিয়াছিলাম যে, ‘আমার সমস্ত দ্ৰব্য লইয়া উহাকে বাড়ী হইতে বহির্গত করিয়া দেই; কিন্তু এখন যখন দেখিতেছি, দামু তাহার মাতারও সর্ব্বনাশ করিয়াছে তখন তাহাকে ছাড়িয়া দি কি প্রকারে?’ এইরূপ নানা প্রকার ভাবিয়া ও সকলের সতি পরামর্শ করিয়া দামুকে পুলিসের হস্তে অর্পণ করিলাম।” ইহাই হরিহরের জবানবন্দী। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

হরিহরের জবানবন্দী পাঠ সমাপন হইলে, যে পুলিস কর্ম্মচারী প্রথমে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, তাঁহার ডায়েরী পাঠ করিলাম। তাহার সারমর্ম্ম এই;—

“কনষ্টেবল শিউশরণ সিং, আসামী দামোদর দাস, এবং প্রথম নম্বর ফরিয়াদী হরিহর দাস, ও দ্বিতীয় নম্বর ফরিয়াদী আসামীর জননী এই তিনজনকে থানায় আনিয়া আমার নিকট উপস্থিত করায়, আমি উভয় ফরিয়াদীর জবানবন্দী লিখিয়া লইয়া, তদারক করিবার নিমিত্ত উহাদিগের সহিত সরেজমিনে গমন করি। সেইস্থানে হরিহরের গৃহের ভিতর বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি ভাঙ্গা দ্রব্যাদি ছড়ান, এবং একটি গাঁরিতে বাঁধা কতকগুলি দ্রব্যাদি দেখিতে পাইলাম। গৃহের তালাও ভগ্ন অবস্থায় ছিল। 

“আসামীর মায়ের গৃহের তালাও ভাঙ্গা ছিল; গৃহের ভিতরের কয়েকটি বাক্স, পেট্রা প্রভৃতিও আমি ভগ্নাবস্থায় দেখিতে পাইলাম। বাদিনী কহে, সেই বাক্স ও পেট্রার ভিতর হইতে তালিকায় লিখিত সমস্ত দ্রব্যাদি চুরি গিয়াছে। তাহার যে সেই সকল দ্রব্যাদি ছিল, সে সম্বন্ধে সে ভালরূপ কোন প্রমাণ প্রদান করিতে পারিতেছে না; কিন্তু তাহার সমস্ত সন্দেহ তাহার পুত্র দামোদরের উপর। বাদিনী যেরূপ অবস্থায় থাকে, তাহাতে তাহার এক টাকা এবং গহনা থাকা অসম্ভব বলিয়া বোধ হয়। বিশেষতঃ যখন হরিহরের গৃহে চুরি করিয়া দামু দ্রব্যাদির সহিত বাহিরে গমন করিতেছিল, সেই সময় যখন সে ধৃত হইয়াছে, তখন তাহার মায়ের গৃহে যে সে চুরি করিয়াছে, তাহা এক প্রকার অসম্ভব বলিয়া আমার বোধ হয়। তাহার সহিত অন্য কোন ব্যক্তি সেই সময়ে যে বাড়ীর ভিতর আসিয়াছিল, সে সম্বন্ধেও কোনরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় না। দামু নিতান্ত বদ্‌ছোকরা। তাহার মাতা তাহাকে “দুই চক্ষে দেখিতে পারে না”, এমনকি আপনার গৃহে তাহাকে থাকিতে পৰ্য্যন্ত দেয় না। 

তাহার আন্তরিক ইচ্ছা—দামু কেবল জেলে থাকে। এইরূপ নানাকারণে যাহাতে দামোদর অনেক দিবস জেলের ভিতর থাকিতে পারে, সেই অভিপ্রায়ে তাহার মাতা তাহার নামে এই মিথ্যা নালিস উপস্থিত করিয়াছে। বিশেষতঃ তাহার এত এত টাকা বা গহনা থাকিত, তাহা হইলে এইরূপ সামান্য গৃহে থাকিয়া এইরূপ কষ্টে কখনও জীবন যাপন করিত না। আমি প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য নানা অনুসন্ধান করিয়া যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে, তাহার তালিকায় বর্ণিত অলঙ্কারাদি বা টাকা কড়ি বাস্তবিক কিছুই নাই। এরূপ অবস্থায় আমি সাহস করিয়া বেশ বলিতে পারি যে, এই মোকদ্দমা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং তালিকায় লিখিত কোন দ্রব্যাদি অপহৃত হয় নাই। 

“হরিহর যে মোকদ্দমায় ফরিয়াদী, সে মোকদ্দমাও আমি বিলক্ষণরূপ অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, যে হরিহর যাহা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই সত্য। বিশেষতঃ মানগণ্য অনেক ভদ্রলোকের সাক্ষ্যদ্বারা স্পষ্টই অবগত হইতে পারিয়াছি যে, এই চুরি পুরাতন চোর দামোদর দাস ভিন্ন আর কাহারও দ্বারা হয় নাই। সুতরাং এই চুরি মোকদ্দমায় দামোদর দাসকে হুজুরে চালান দেওয়া হইল। হরিহর দাস তাহার অপহৃত দ্রব্যের মূল্য অনুমানে চল্লিশ টাকা পূর্ব্বে মিলাইয়া দিয়াছিল, তাহা কিন্তু ঠিক নহে। কারণ, সরেজমিনে অনুসন্ধান করিয়া, এবং দ্রব্যাদি নিজে দেখিয়া ও অপরকে দেখাইয়া এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, অপহৃত দ্রব্যের মূল্য দুই শত টাকার ন্যূন নহে। এমতে নিবেদন, পূৰ্ব্বলিখিত মূল্য কাটিয়া দিয়া তাহার পরিবর্তে দুই শত টাকা লিখিয়া লইবার আদেশ হয়; নতুবা বাৎসরিক হিসাবে পুনঃপ্রাপ্ত মালের সংখ্যা অন্যায়রূপে ন্যূন দেখাইতে হইবে। আর আসামীর মাতা যে মোকদ্দমায় বাদিনী হইয়া আসামীর নামে মোকদ্দমা দায়ের করিয়াছে, এবং অযথা মূল্যের এক মিথ্যা তালিকা দিয়াছে, সেই মোকদ্দমা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় নিবেদন এই যে, মিথ্যা মোকদ্দমা দায়ের করা অপরাধে তাহার নামে একটি মোকদ্দমা রুজু করিবার আদেশ হয়। হুজুরে নিবেদন ইতি।” 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

ন্যায়-সঙ্গত বলুন, আর অন্যায় বলুন, সৎ বলুন বা অসৎ বলুন, এইরূপ ধরণের মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার আমাদিগের হস্তে পতিত হইলে, আমাদিগের মধ্যে অনেকেই এতদ্দেশীয় পুরাতন প্রথা অবলম্বন করিয়া থাকেন। এই মোকদ্দমার অবস্থা শ্রবণ করিয়া প্রথমে ভাবিয়াছিলাম,—পাছে আমাকেও বা সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিতে হয়। কারণ, দামোদর একে পুরাতন চোর, বার বার জেলে গমন করায় তাহার মনের গতি ফিরিয়াছে, সহজে যে কোন কথা স্বীকার করিতে হয়, তাহা সে ভুলিয়া গিয়াছে। এরূপ অবস্থায় তাহাকে লইয়া একটু পীড়াপীড়ি না করিলে, তাহার দ্বারা সেই কাৰ্য্য অনুষ্ঠিত হইলেও, সে কোনক্রমেই উহা স্বীকার করিবে না, বা অপহৃত দ্রব্যাদি কখনই বাহির করিয়া দিবে না। সুতরাং (আমাদের আইনে বলে) এরূপ অবস্থায় সকলে অসাক্ষাতে একটু চড়া কথার প্রয়োজন, একটু বিশিষ্ট পীড়াপীড়িও আবশ্যক। 

এই অনুসন্ধানে গমন করিবার পূর্ব্বেই আমি মনে করিয়াছিলাম, আজ বোধ হয়, আমাকেও আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কার্য্য করিতে হইবে! যে কাৰ্য্যকে আমি নিতান্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকি, হাসিতে হাসিতে অবলীলাক্রমে আমাকে সেই কার্য্য সমাপন করিতে হইবে। কিন্তু সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, ঈশ্বর আমার মনের ভাব বুঝিয়াছেন; যে কার্য্য আমাকে করিতে হইত, অপরকে দিয়া তিনি সেই কার্য্য শেষ করিয়া রাখিয়াছেন। জানিলাম, যে সময়ে দামোদর ধৃত হয়, সেই সময়ে প্রথমে হরিহর পরে পল্লী-প্রতিবেশী, পরিশেষে স্বয়ং তাহার মাতা সেই কার্য্য শেষে করিয়াছে। ইহার পরও যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাহা প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী আসিবামাত্রই শেষ হইয়া গিয়াছে। 

দামোদরের আর উঠিবার শক্তি নাই, উত্তমরূপে কথা কহিতে সে অসমর্থ। কিন্তু কি করে? ডাকিলেই উত্তর দিতেছে, দাঁড়াইতে বলিলে দাঁড়াইতেছে, হুকুমে বসিতেছে। তাহার মনে ভয়, যদি আমরা অসন্তুষ্ট হই, যদি আমরা তাহার উপর আমাদিগের প্রধান অস্ত্র নিক্ষেপ করি, তাহা হইলে তাহার আর প্রাণের আশা থাকিবে না, অসময়ে অসহ্য যন্ত্রণাভোগ করিয়া তাহাকে সকলের নিকট বিদায় লইতে হইবে। আমি ঘটনাস্থানে গমন করিবামাত্র দামোদর জানিতে পারিল, সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অতঃপর আমার হস্তে পতিত হইয়াছে। তাহার জননীর গৃহ হইতে যদি অলঙ্কারাদি প্রকৃতই চুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই সকল দ্রব্য বাহির করিবার নিমিত্ত যে আমি আগমন করিয়াছি, তাহাও সে বেশ বুঝিতে পারিল। আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া সম্মুখেই দামোদরকে দেখিতে পাইলাম। দেখিয়াই কহিলাম,—“দামোদর!” 

দামোদর। আজ্ঞে মহাশয়? 

আমি। তোর মায়ের ঘরে তুই কেন চুরি করিলি? তোর মা’র সমস্ত দ্রব্যই তোর। তাহার মৃত্যুর পর সকলই তুই পাইবি। তবে কেন এখন চুরি করিয়া উহাকে বিপদাপন্ন করিতেছিস্? বুঝিতে না পারিয়া যাহা করিবার তাহা ত করিয়াছিস্ই। এখনও আমার পরামর্শ শোন, সেই সকল দ্রব্যাদি কোথায় রাখিয়াছিস, তাহা বাহির করিয়া দে। 

দামোদর। মহাশয়! আমি চুরি করি নাই। আমার মায়ের দ্রব্যাদি আমি চুরি করিব কেন? হরিহর বলিতেছে যে, তাহার গৃহ হইতে চুরি করিয়া বহির্গত হইবার সময় সে আমাকে ধরিয়াছে, একথা সমস্তই মিথ্যা। আমি না করিয়াছি চুরি—আমার গৃহে; না করিয়াছি চুরি—তাহার গৃহে। হরিহর মিথ্যা কথা বলিয়া আমাকে এইরূপে বিপদাপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে। 

আমি। কি? তবে তুই চুরি করিনি? তুই কি ভাবছিস্, সেই সমস্ত দ্রব্য তুই হজম করবি, আর আমরা বোকার মত তোর সমস্ত কথা বিশ্বাস করবো? আয় আমার নিকটে, এখনি আমি তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি যে, তুই চুরি করিয়াছিস, কি না? 

দামোদর। (কাঁদিতে কাঁদিতে) আজ্ঞে হাঁ। আমাকে কিছু বোলবেন না, আমি চুরি ক’রেছি। 

আমি। ঠিক্ বলছিস। তুই চুরি করি’ছিস্? 

দামোদর। আজ্ঞে হাঁ, ঠিক্ বলছি। 

আমি। চুরি করে ছিস্ ত মাল কোথায়? 

দামোদর। আজ্ঞে, আমি চুরি ক’রেছি; কিন্তু মাল কোথায়, তা’ জানি না। 

আমি। কি! আমার সঙ্গে চালাকি? এখনও তুই আমাদিগকে বোকা ঠাওরাচ্ছিস্। বোল্‌ছিস্ ‘চুরি ক’রেছি, কিন্তু মাল কোথায় তা’ জানি না!’ আমি এমন মন্ত্র জানি যে এখনি তুই মাল দেখিয়ে দেওয়ার পথ পাবিনে, আয় ত দেখি আমার কাছে। 

দামোদর। না মহাশয়! আমাকে কিছু বোলবেন না, চলুন, আমি মাল দেখিয়ে দিচ্ছি গে। 

আমি। মাল কোথায় আছে যে, তুই দেখিয়ে দিবি? 

দামোদর। হরিহরের কাছে, আমি চুরি করিয়া সমস্তই হরিহরের নিকট রেখেছি। (হরিহরের প্রতি) দেনা দাদা; আর আমাকে কষ্ট দিনে, মালগুলি বের্ ক’রে দে। 

হরিহর। বেটা বলে কি? 

আমি। দেখ দামু! আমাদিগকে মিথ্যা কষ্ট দিস্ না। মাল কোথায় রেখেছিস্, এখনও ব’লে দে। 

দামোদর। ঐ পুকুরধারে পুঁতে রেখেছি। 

আমি। চল্, আমরা সেখানে যাচ্ছি। কিন্তু যদি আমরা সেখানে গিয়া মাল না পাই, তা’ হ’লে বুঝতেই পাচ্ছিস্ যে, তোর অদৃষ্টে তখন কি হবে? 

দামোদর। মহাশয়! আমি চুরি করিনি। 

আমি। তবে কেন বোল্‌ছিস্ যে, পুকুরধারে মাল পোঁতা আছে? 

দামোদর। কি করি মহাশয়। প্রাণের দায়ে না বোলে আপনাদের হাত থেকে আর বাঁচি কই? আমাকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকটে নিয়ে চলুন। মহাশয়! সেখানে আমি স্পষ্টই বোলবো, আমি চুরি করেছি। দোহাই মহাশয়! আমাকে নিয়ে চলুন, আমাকে এখানে আর কষ্ট দিবেন না। 

দামোদরের এই প্রকার নানারূপ কথা শ্রবণ করিয়া আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, এখন এ বিষয়ে একটু ভালরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখা আবশ্যক যে, এই চুরি প্রকৃত, কিনা? এবং দামোদর কর্তৃকই এই চুরি হইয়াছে, কি না? এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া পরিশেষে আমাকে সেইস্থানে বসিতে হইল। হরিহর তাহার গৃহ হইতে একটি পাটা ও একটি বড় বালিস আনিয়া দিল। আমি সেই উপাধানে ভর দিয়া সেই পাটীর উপর উপবেশন পূর্ব্বক নানারূপ চিন্তা করিতে লাগিলাম। আসামী, ফরিয়াদীদ্বয় এবং পল্লীর দর্শকবৃন্দও সেইস্থানে উপবেশন করিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

হরিহরের বাড়ীতে উপবেশন করিয়া এই অনুসন্ধানে বিশিষ্টরূপে প্রবিষ্ট হইবার পূর্ব্বে আমার মনে প্রথমে এই কয়েকটি চিন্তার উদয় হইল :—

প্রথম চিন্তা,–দামোদরের মাতার যে সকল দ্রব্যাদি চুরি হইয়াছে বলিয়া নালিস হইয়াছে, সেই সকল দ্রব্য প্রকৃতই চুরি হইয়াছে, কি না। 

এই সম্বন্ধে দেখা যাইতেছে, যে সময়ে দামোদর হরিহরের গৃহে চুরি করা অপরাধে হরিহর কর্তৃক ধৃত হয়, সে সময় দামুর মাতা বাড়ীতে ছিল না। সে বাড়ীতে আসিয়াই যখন দেখিল, তাহার গৃহের বাক্স, পেটরা সমস্তই ভাঙ্গা তখন তাহার গৃহে যে চোর প্রবেশ করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে আর ভুল নাই; কিন্তু তাহার কথিত দ্রব্যাদি সকল অপহৃত হইয়াছে, কি না? দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে, কি না, এ বিষয় বিবেচনা করার পূর্ব্বে আমাদিগের ভাবা উচিত যে, তাহার উক্ত দ্রব্যাদি ছিল, কি না? 

তাহার দ্রব্যাদি ছিল কি না, সে সম্বন্ধে কেবল তাহার কথা ব্যতীত যদিও আর অধিক কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, তথাপি দেখা যাইতেছে যে, তাহার একটিমাত্র পয়সা কোনরূপে আয় নাই, অথচ তাহার অন্ন বস্ত্রের সংস্থান এবং ঘরের মাসিক ভাড়া সে নিয়মিতরূপে কোথা হইতে সংগ্রহ করিতেছে? এরূপ অবস্থায় সে যে একবারে রিক্তহস্তে ছিল, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? তাহার কিছু সংস্থান ছিল, একথা যদি বিশ্বাস করিতে পারি, তাহা হইলে তাহার কথামত সমস্ত দ্রব্যই যে ছিল না, তাহাই বা বিশ্বাস করি কি প্রকারে? 

আবার অন্যদিকে দেখিতে গেলে দেখা যায় যে, দামোদর তাহার মাতার এমন কি অপরাধ করিয়াছে যে, মিথ্যা মোকদ্দমা করিয়া সে তাহার পুত্রকে অনায়াসেই জেলে প্রেরণ করিবে? হইতে পারে, কোন কারণে সে তাহার উপর সবিশেষরূপে অসন্তুষ্ট হইয়াছে বলিয়া, তাহার নামে মিথ্যা নালিস উপস্থিত করিয়াছে; কিন্তু মনে যখন সে নিশ্চয় জানিতে পারিতেছে যে, তাহার কোন দ্রব্যাদি অপহৃত হয় নাই, তখন সে তাহার পুত্রের নিকট কোন দ্রব্য নাই জানিয়াও, সেই সকল দ্রব্যাদি পাইবার অভিপ্রায়ে আপনার পুত্রকে নির্দয়রূপে প্রহার করিবে কেন? পুত্র যতই বদমায়েস হউক না কেন, বা যেরূপ চোরই কেন হউক না, যে কোনরূপ অনিষ্টই করুক না, এদেশীয় মাতার হৃদয় কিন্তু তত কঠিন নহে। এদেশীয় স্ত্রীলোক তাহার পুত্রের উপর ঐরূপ কঠিন ব্যবহার করিতে কখনই সমর্থ নহে। 

দ্বিতীয় চিন্তা,—দামুর মাতার গৃহ হইতে যদি প্রকৃতই চুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই চুরি দামু দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, কি না? 

এই বিষয় ভাবিতে ভাবিতে আমার মনে এক এক করিয়া কয়েকটি কথার উদয় হইল। 

১ম। হরিহরের গৃহে চুরি করিয়া বহির্গত হইবার সময় হরিহর কর্তৃক সে ধৃত হইয়াছে। একথা যদি সত্য হয়। তাহা হইলে সে তাহার মাতার গৃহে প্রথমেই চুরি করিয়াছে। 

২য়। যদি সে সেই বাড়ীর ভিতর একই সময়ে দুইটি চুরি করিল, অথচ বাটী হইতে বহির্গত হইবার পূর্ব্বে মাল—সমেত ধরা পড়িল, তাহা হইলে প্রথম চুরির মাল তাহার নিকট পাওয়া গেল না কেন? 

৩য়। প্রথম চুরিতেই যদি সে তাহার আশাতীত অলঙ্কার এবং নগদ মুদ্রা প্রাপ্ত হইয়া থাকে, তাহা হইলে পুনরায় সে হরিহরের গৃহ ভাঙ্গিয়া কতকগুলি বস্ত্র প্রভৃতি চুরি করিতে গেল কেন? 

৪র্থ। বাড়ির বাহিরে আর একটি বালক দণ্ডায়মান ছিল, একথা হরিহর তাহার জবানবন্দীতে স্পষ্টই বলিয়াছে। একথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে প্রথম চুরির মাল দামু কি তাহারই হস্তে অর্পণ করিয়াছে? যদি তাহাই হইত তাহা হইলে সে বাহিরে কিসের নিমিত্ত অপেক্ষা করিতেছিল? আর সেই বালকই বা কে? দামুকে তন্ন তন্ন করিয়া জিজ্ঞাসা করা হইলেও সে সেই বালক সম্বন্ধে কোন কথা বলিতেছে না। হরি ও করিম সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা হইয়াছে দেখিতেছি, সে দিবসে তাহারা কেহই দামুর সহিত ছিল না, তাহারও বেশ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। 

৫ম। দামু চোর হইলেও বালক। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে প্রথমে সে অস্বীকার করিতেছে; কিন্তু একটু ভয় প্রদর্শন করিবামাত্রই কহিতেছে, এ চুরি তাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় তাহার কথার উপর নির্ভর করিয়া তাহাকে চোর কি সাধু স্থির করা সহজ নহে। যাহা হউক, এ মোকদ্দমা পূর্ব্বাপর সকলই গোলযোগে পূর্ণ দেখিতেছি। যে পৰ্য্যন্ত অপহৃত দ্রব্য পুনঃপ্রাপ্ত না হইতে পারি, সে পর্য্যন্ত কি প্রকারেই বা বলি, দামুর মাতা মিথ্যা কথা কহে নাই, এবং প্রথম অনুসন্ধানকারী পুলিস-কর্মচারীর ডায়েরী ঠিক নহে? 

এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তার প্রবল স্রোত আমার হৃদয়ে বহিতে লাগিল। কি করা উচিত বা অনুচিত, কোন্ পথ অবলম্বন করা কর্তব্য, এবং কোন্ পথই বা পরিত্যাগ করা শ্রেয়, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিত না পারিয়া অনুসন্ধানের যে সকল বিষয় পূৰ্ব্ব-কর্মচারী পরিত্যাগ করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হইল, প্রথমে তাহাই দেখিবার ইচ্ছা করিলাম। 

যে বালক হরিহরের বাড়ীর সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল, সেই বালক কোথায় থাকে, এবং অপর আর কোন ব্যক্তি সেইস্থানে উহাকে দাঁড়াইতে দেখিয়াছে কি না, সেই বিষয়ে ভালরূপ অনুসন্ধান করার প্রয়োজন বিবেচনায়, প্রথমে হরি-হরের বাড়ীর বাহিরে গমন করিলাম। সেইস্থানে অনেক লোক দাঁড়াইয়াছিল। কলিকাতার কোনস্থানে পুলিস কোন বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলে যেরূপ লোকের ভিড় হয়, তাহা কলিকাতাবাসী পাঠকমাত্রই সবিশেষরূপ অবগত আছেন। সেইস্থানে সেই বালকের কথা জিজ্ঞাসা করাতে একজন কহিলেন, “হাঁ মহাশয়! সেইদিবস এইস্থানে আমি বিনোদ গোয়ালাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিলাম।” 

বিনোদ গোয়ালা অপর পাড়ার একটি বালক। বিনোদকে অনেকেই উত্তমরূপে অবগত আছেন। যে স্থানে কোন প্রকার গোলযোগ উপস্থিত হয়, সন্ধান করিলে সেইস্থানেই বিনোদকে দেখিতে পাওয়া যায়। ঘুড়ি উড়াইতে, মারবেল খেলিতে, পায়রা উড়াইতে, এবং অপর বালকদিগের সহিত ঝগড়া করিতে, বিনোদ খুব মজবুত। বিনোদ স্কুলে যায় না, পিতা মাতার কথার বাধ্য নহে, বিনোদের এতগুলি দোষ থাকিলেও, কিন্তু একথা কেহই কখন শ্রবণ করেন নাই যে, বিনোদ চোর। বিনোদ কিন্তু কাহাকেও ভয় করে না, গুরুজনকে দেখিয়াও তাহার লজ্জা নাই, অথচ যাহার তাহার সঙ্গে সামান্য কথায় তুমুল ঝগড়া বাধাইয়া দেয়। 

সেই সময়ে বিনোদ হরিহরের বাড়ীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, একথা শ্রবণ করিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলাম না বিনোদ সম্বন্ধে সবিশেষ অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হইলে তখনই তাহাকে সন্ধান করিতে লাগিলাম। প্রায় একঘণ্টা কাল অনুসন্ধানের পর তাহাকে পাইলাম। জিজ্ঞাসা করায় সে, সকল কথা অস্বীকার করিল; তথাপি তাহাকে লইয়া অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। পরিশেষে অনেক কষ্টে অবগত হইলাম, পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি বিনোদের উপর মিথ্যা কথা আরোপণ করিয়াছে। এক সপ্তাহ পূর্ব্বে তাহার সহিত বিনোদের বিবাদ হয়। বিনোদ তাহাকে নিতান্ত অন্যায়রূপে গালি দেয়, ও পরিশেষে দূর হইতে প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া উহাকে প্রহার করে, এই কারণেই বিনোদের উপর যে নিতান্ত অসন্তুষ্ট। তাহার আন্তরিক ইচ্ছা যে, বিনোদ কোন রূপে বিষম বিপদে পতিত হয়। চুরি মোকদ্দমায় পুলিসের হস্তে পতিত হইয়া বিনোদ বিলক্ষণরূপে অবমানিত ও বিপদগ্রস্ত হইবে ভাবিয়া, সে মিথ্যা করিয়া বিনোদের নাম বলিয়া দিয়াছিল। এই সকল বিষয় জানিতে পারিয়া বিনোদকে ছাড়িয়া দিলাম। সে উহার প্রতিশোধ লইবে বলিয়া উহাকে ভয় প্রদর্শন পূর্ব্বক সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

বিনোদকে ছাড়িয়া দেওয়ার পর মনে আর এক ভাবনার উদয় হইল। ভাবিলাম, দামোদর কর্তৃক যদি সেই চুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে অপহৃত দ্রব্য বাড়ীর বাহিরে যে গমন করিয়াছে, তাহা বোধ হয় না। বাড়ীর ভিতর কোন স্থানে না কোন স্থানে সেই সকল দ্রব্য নিশ্চয়ই আছে। বাড়ীর ভিতর যদি থাকে, তাহা হইলে উত্তমরূপে সন্ধান করিলে, এখনই বাহির হইলেও হইতে পারিবে। এদিকে কিন্তু দামোদর বলিতেছে, এ চুরি তাহা দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। যদি দামুর কথা বিশ্বাস করি, তাহা হইলে এ চুরি কাহার দ্বারা হইল, তাহা স্থির করাও নিতান্ত সহজ দেখিতেছি না। আবার হরিহরের কথা বিশ্বাস করিলে দামোদরকেই চোর বলিয়া বোধ হয়। এরূপ অবস্থায় প্রকৃতকথা যে কি, তাহা ভাবিয়া স্থির করা নিতান্ত সহজ নহে। 

প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে না পারিয়া মানবগণ সময়ে সময়ে যেমন মহাভ্রমে পতিত হয়, হরিহর ত সেইরূপ ভ্রমে পতিত হয় নাই? এরূপ অবস্থা ত ঘটে নাই যে, যে সময়ে হরিহর গৃহে ছিল না, সেই সময়ে দামুর মাতাও আপন বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্য স্থানে গমন করিয়াছিল; উভয়ের অনুপস্থিতিতে চুরি করিবার উত্তম সুযোগ দেখিয়া কোন চোর এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, ও আপনার ইচ্ছামত দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া বাড়ী হইতে চলিয়া গিয়াছিল, দৈবগতিতে সেই সময় দামোদরও আসিয়া উপস্থিত হইল এবং হরিহরের গৃহের অবস্থা দেখিয়া তাহার লোভ সম্বরণ করিতে পারে নাই। কাপড়, চাদর প্রভৃতি যাহা কিছু সম্মুখে পড়িয়াছিল, তাহাই লইয়া প্রস্থান করিবার সময় হরিহর কর্তৃক ধৃত ও পুলিশের হস্তে অর্পিত হয়? 

এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে হরিহরের বাড়ীতে উত্তমরূপে খানা-তল্লাসি আরম্ভ করিলাম। দেখিবার উপযুক্ত যে সকল স্থান ছিল, তাহা উত্তমরূপে দেখা হইল। কিন্তু কোনস্থানেই সেই অপহৃত দ্রব্যের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। এইরূপ সন্ধান করিতে করিতে ক্রমে আমি ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম, ক্লান্ত হইয়া সেই উপাধানে মস্তক রাখিয়া সেই মাদুরের উপর শয়ন করিলাম। বাড়ীর ভিতর স্থিত যে যে স্থানের মৃত্তিকা খনন করিয়া দেখা উচিত বিবেচনা করিলাম, সেই সকল স্থান ক্রমে খনন করা হইতে লাগিল; কিন্তু কোনস্থানেই সেই অপহৃত দ্রব্যের কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গেল না। 

অনুসন্ধানে যখন কোন দ্রব্যই পাওয়া গেল না, তখন কোন উপায় অবলম্বন করিব, তাহাই স্থিরভাবে ভাবিতে লাগিলাম। একবার ভাবিলাম, যদি আমার অনুমানই সত্য হয়, তাহা হইলে পুরাতন চোরদিগকে সবিশেষরূপে দেখার প্রয়োজন; কিন্তু কোন্ চোরকে দেখিব? কলিকাতায় কি দুই এক জন মাত্র চোর যে, তাহাদিগকে লইয়া অনুসন্ধান করিব? এই সহস্র সহস্র চোরের মধ্যে অনুসন্ধান কি প্রকারে হইতে পারে? 

এইরূপ কোন উপায় না দেখিয়া ভাবিলাম, আমি এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত যে অনুসন্ধান করিতেছি, তাহা অপরের প্রদর্শিত পথে অর্থাৎ প্রথমে যিনি অনুসন্ধান করিয়াছেন, তাঁহারই লিখিত কাগজ-পত্র দেখিয়া ইহার প্রকৃত অবস্থা বাহির করিবার চেষ্টা দেখিতেছি। তিনি যে সকল জবানবন্দী লিখিয়াছেন, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই অনুসন্ধান ক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছি। যখন এই অনুসন্ধানে আমাকে নিযুক্ত হইতে হইল, তখন প্রথম হইতে নূতন ভাবেই অনুসন্ধান করা উচিত এই ভাবিয়া সেই বাড়ী হইতে পুলিস-কৰ্ম্মচারী ব্যতিরেকে আর সকলকেই বহির্গত করিয়া দিলাম, অপর লোকের মধ্যে কেবল দামুর মাতা আমার নিকট রহিল। আমি তাহাকে একটি একটি কথা যেমন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, অমনি তাহা লিখিতে লাগিলাম। 

আমি। দামুর মা! তোমার নাম কি?

দামু মা। আমার নাম তারামণি বেওয়া।

আমি। তুমি কতদিবস বিধবা হইয়াছ? 

তারামণি। যখন আমার দামুর বয়স কেবল ছয় মাস মাত্র, সেই সময় আমি বিধবা হইয়াছি। জ্বরবিকারে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। 

আমি। অনেকদিন হইল, তোমার স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে দেখিতেছি। তোমার স্বামীর মৃত্যুর পর কি প্রকারে তুমি তোমার জীবন ধারণ ও এই পুত্র দামুকে প্রতিপালন করিয়া আসিয়াছে? অন্য কোনরূপে তোমার কিছু যে আয় আছে, তাহা ত আমার বোধ হয় না। তবে কিরূপে সংসারের সমস্ত খরচপত্র নির্ব্বাহ করিয়া থাক? 

তারামণি। মহাশয়! পুরাতন কথা মনে করিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়, চক্ষু দিয়া জলধারা বাহির হইয়া পড়ে। ঈশ্বর আমাদিগকে এখন যেরূপ দরিদ্র করিয়াছেন, পূর্ব্বে কিন্তু আমাদিগের সেরূপ অবস্থা ছিল না। যতদিবস ‘তিনি’ জীবিত ছিলেন, ততদিবস বিলক্ষণ সুখস্বচ্ছন্দের সহিত জীবনযাত্রা অতিবাহিত করিয়াছি। বড় বাজারের পগেয়াপটীতে তাঁহার একখানি কাপড়ের দোকান ছিল। দোকান হইতে লাভও যে বিলক্ষণ না হইত, তাহা নহে। যতদিবস তিনি জীবিত ছিলেন, অজস্র খরচপত্র করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত ছিলেন না। তদ্ব্যতীত যখন যে অলঙ্কার বা যত নগদ টাকা আমি চাহিয়াছি, তখনই তাহা তিনি আমাকে দিয়াছেন। কলিকাতার ভিতর একখানি দোতালা বাড়ীও তিনি রাখিয়া গিয়াছিলেন। যখন তাঁহার মৃত্যু হয়, সেই সময় বাড়ী ও অলঙ্কার ব্যতীত নগদ টাকাই প্রায় দশ সহস্ৰ আমার নিকট ছিল। তাঁহার মৃত্যুর পর দোকানের কর্মচারীগণ নিতান্ত অন্যায় ব্যবহার আরম্ভ করিল; যে যাহা চাইল, সে তাহা অপহরণ করিয়া আপনার পেট ভরাইতে লাগিল। ক্রমে দোকান উঠিয়া গেল, দোকান হইতে আর একটি পয়সাও পাইলাম না। অধিকন্তু মহাজনের দেনায় ভদ্রাসন বাটিটুকু পৰ্য্যন্তও বিক্রিত হইয়া গেল। নগদ টাকা এবং অলঙ্কার-পত্র যাহা আমার নিকট ছিল, তাহাই কেবল আমার নিকট রহিয়া গেল। সেই সময় হইতে সেই টাকা লইয়া ক্রমে আপনার খরচপত্র চালাইয়া আসিতেছি, এবং দামুকেও এতবড়টি করিয়াছি। এইরূপ খরচপত্র ব্যতীত অবশিষ্ট আমার নিকট যাহা ছিল, তাহাই আমার দামু অপহরণ করিয়াছে। এখন দামু যদি সেই সকল দ্রব্যাদি আমাকে না দিয়া অযথা অপব্যয় করিয়া ফেলে, তাহা হইলে কাল হইতেই দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতে হইবে, নাহয়, অনাহারে প্রাণ বাহির হইবে। 

এই বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল, চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। অতিকষ্টে মনোবেগ সম্বরণ করিয়া, পুনর্ব্বার আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আরম্ভ করিল। 

আমি। এখন তোমার পূর্ব্ববৃত্তান্ত ত আমি জানিতে পারিলাম; কিন্তু আমাকে যথার্থ বল দেখি, তোমার নিকট যে এতগুলি টাকা ও অলঙ্কার ছিল, তাহা তোমার পুত্র দামোদর জানিত কি না? 

তারামণি। দামু আমার এ সকল বিষয় অবগত আছে কি না, তাহা আমি জানি না। কারণ, আমি কখন দামুকে বলি দেখি নাই যে, আমার কিছু সংস্থান আছে; বরং তাহাকে সর্ব্বদা বলিয়া থাকি আমার কিছুই নাই। যাহাতে সে ভাল হয়, ও দশ টাকা আনিতে পারে, এই কথা তাহাকে কহিতাম। আরও বলিতাম, “সংসারের সাহায্য না করিলে এই বৃদ্ধবয়সে বা কে আমাকে খাইতে দিবে, কেই বা তোমাকে খাওয়াইবে?” 

আমি। তোমার কথা শুনিয়া দামোদর তখন কি বলিত? 

তারামণি। পূর্ব্বে দামু আমার কথায় কর্ণপাতও করিত না। পাড়ার বদমায়েস ছেলেদের সহিত কেবল বদমাইসি করিয়া বেড়াইত, সেই নিমিত্ত দোষ করিয়াই হউক বা বিনাদোষেই হউক, কয়েকবার জেলে পর্যন্তও গিয়াছে। আমার যেমন সঙ্গতি, সামান্যরূপ খরচপত্র করিয়াও তাহাকে বাঁচাইতে পারি নাই। এখন কিন্তু দামুর মতি-গতি যেন একটু ফিরিতেছিল বলিয়া বোধ হইতেছিল। ইদানীং দেখিতাম সে আমার কথায় কর্ণপাত করিত। পাড়ার ছেলেদের সহিত বেড়ান ক্রমেই কমিয়া আসিতেছিল, ও কাজ কর্ম্মের চেষ্টায় বোধ হয়, তাহার মতি-গতি ফিরিতেছিল। এইরূপে তাহার মনের ভাব পরিবর্তিত হইতে হইতে পরিশেষে আমার এই সর্ব্বনাশ সাধন করিল। 

আমি। দামোদর কি এখন বাড়ীতেই আহারাদি শয়ন করিত? 

তারামণি। ইতিপূর্ব্বে তাহার আহারের স্থির ছিল না, রাত্রিতে বাড়িতেও থাকিত না। এখন কিন্তু সে বাড়ীছাড়া নহে, রাত্রি বাড়ীতেই অতিবাহিত করে, আহারাদিও আমার নিকট করিয়া থাকে। 

আমি। যে দিবস চুরি হয়, সেই দিবস দামু কোথায় ছিল? 

তারামণি। আহারাদি করিয়া দামু গমন করিলে আমি কোন কার্য্যোপলক্ষে বাহিরে গমন করিয়াছিলাম। প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলাম, আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। 

আমি। তুমি বাহির হইতে আসিয়া যেরূপ অবস্থা দেখিয়াছিলে বা শুনিয়াছিলে, তাহা বেশ মনে করিয়া ঠিক্ আমাকে বল দেখি। 

তারামণি। যখন আমি বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম, তখন দেখিলাম, হরিহরের গৃহের সম্মুখে দামুকে বসাইয়া রাখা হইয়াছে। একটি গাঁটরি সেইস্থানে পড়িয়া রহিয়াছে, এবং পাড়ার আরও একজন কি জন্য সেইস্থানে দাঁড়াইয়া দামুকে গালাগালি দিতেছে। আমি যেমন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, অমনি হরিহর আমাকে কহিল, “দেখ দামুর মাতা! দামু আমার গৃহ হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি চুরি করিয়া পলায়ন করিতেছিল। সেই সময়ে আমিও বাড়ীতে আগমন করিতেছিলাম, তাই ধরিয়া ফেলিয়াছি। যদি আমার বাড়ী আসিতে আর একটু বিলম্ব হইত, তাহা হইলে আর আমার কোন দ্রব্যই পাইতাম না। দামু আমার অবস্থাত এইরূপ করিতেছিল, এখন তোমার গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখ, তোমারও কোন দ্রব্যাদি সে চুরি করিয়াছে, কি না?” হরিহরের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি দ্রুতপদে আমার গৃহের দিকে গমন করিলাম; দেখিলাম, দ্বারের তালা ভাঙ্গা। ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি সকলগুলিরই কল ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। কাপড়, চাদর প্রভৃতি কতকগুলি মেজেতে ছড়ান রহিয়াছে, অলঙ্কার ও টাকাকড়ি প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল, তাহার কিছুমাত্র নাই। তখন বুঝিলাম, দামু আমারও সর্ব্বনাশ করিয়াছে। সেই সময়ে আমার মনে যেমন দুঃখ হইল, দামুর উপর রাগও তেমনি হইল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া, স্বহস্তে তাহাকে অত্যন্ত প্রহার করিলাম। ‘আমি চুরি করি নাই’ বলিয়া দামু কিন্তু বার বার আমার পায় ধরিতে লাগিল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

তারার জবানবন্দী লইতে লইতে সেইদিবস ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া আসিল, কাজেই সেইদিবস অনুসন্ধান স্থগিত করিয়া থানায় গমন করিলাম। আহারাদি সমাপন করিবার পর অবশিষ্ট যে রাত্রিটুকু ছিল, তারামণি যেরূপ জবানবন্দী দিয়াছিল, মনে মনে তাহারই আদ্যোপান্ত আন্দোলন করিতে করিতে, তাহাও অতিবাহিত হইয়া গেল। 

তাহার জবানবন্দী আমি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিয়াছিলাম। উহার প্রত্যেক ছত্র আমার হৃদয়ের ভিতর অঙ্কিত করিয়াছিলাম বলিয়া, আমার হৃদয়ে অন্য একটি নূতন ভাবের উদয় হইল, নূতন ভাবনার সূত্রপাত হইল। সেই ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলাম। 

শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই সম্মুখে দেখিলাম, পাঠক বংশীয় আহম্মদ নিকটে বসিয়া আছেন। ইনিও একজন পুরাতন ডিটেকটিভ-কৰ্ম্মচারী, কর্ম্মের বাজারে ইঁহার একটু বেশ নাম-যশও আছে। সময়ে সময়ে আবশ্যক হইলে, তিনি আমার নিকট পরামর্শ লইয়া থাকেন, আমিও মধ্যে মধ্যে তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করিয়া থাকি। শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বসিবামাত্রই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কল্য কোন্ মোকদ্দমার অনুসন্ধানে দিন রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছেন?” তাঁহার কথা শ্রবণ করিয়া এক এক করিয়া সমস্ত কথা তাঁহাকে বলিলাম। কি প্রকারে হরিহর কর্তৃক দামোদর ধৃত হয়, কি প্রকারে উভয়ের দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে জানিতে পারা যায়, দামোদর কিরূপে অবমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। পুলিস প্রথম অনুসন্ধান করিয়া কিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন, তাহার সমস্ত কথা এক এক করিয়া তাঁহাকে কহিলাম। পরিশেষে আমি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া যাহা যাহা করিয়াছিলাম, এবং তারামণিও আমাকে এখন যেরূপ এজাহার দিয়াছে, সমস্ত কথাই তাঁহাকে কহিলাম। কোন কথাই গোপন করিলাম না। তবে আমার মনে এখন কি এক প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, তাহাই কেবল তাঁহাকে কহিলাম না। সমস্ত কথা উত্তমরূপে শ্রবণ করিয়া তিনিও, সে সময় আমার হৃদয়ে যেরূপ সন্দেহ বর্তমান ছিল, সেইরূপ ভাব প্রকাশ করিলেন। আমার মনের সহিত তাঁহার মনের ভাবের মিলন দেখিয়া আমার একটু আনন্দ বোধ হইল। 

পাঠক! আপনারা কি বুঝিতে পারিয়াছেন, আমাদিগের মনে এখন কি সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে? যদি বুঝিতে না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে তারামণির জবানবন্দীটা আর একবার সবিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করুন। তা হইলে আমার বিশ্বাস যে, আপনাদিগের মনেও আমার ন্যায় সন্দেহ উপস্থিত হইবে। জবানবন্দী পুনরায় পাঠ করিয়া যদি আপনাদিগের মনে কোন প্রকার ভাবের উদয় না হয় তাহা হইলে আমি আর কি করিব? তবে আমি কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, তারামণির জবানবন্দীর মধ্য দিয়া একটি ছত্র আমার মনে সতত জাগিতেছিল, “এখন তোমার গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখ, তোমারও কোন দ্রব্যাদি সে চুরি করিয়াছে কি না?” এই কথাটি তারামণি হরিহরের মুখে প্রথম শ্রবণ করে, ও পরিশেষে আপনার গৃহে গিয়া দেখে যে, তাহার সমস্ত দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে। পাঠক! কথাটি আপনাদিগের চক্ষুতে না পড়ুক, কিন্তু আমাদিগের অন্তরে বিলক্ষণ লাগিয়াছিল। বলিতে কি, এই একটিমাত্র কথাতে আমরা মনে মনে একরূপ স্থির-সিদ্ধান্ত করিয়াছিলাম যে, এই চুরির যে ফরিয়াদী হইয়াছে, সেই হরিহরই এই কার্য্যে বিশিষ্টরূপে লিপ্ত। 

মনে মনে আমাদিগের এইরূপ সন্দেহ হইল সত্য; কিন্তু যে পর্য্যন্ত অলঙ্কারগুলি বাহির করিতে না পারি, সেই পর্যায় একথা আর কাহাকেও বলিব না, ইহাই সিদ্ধান্ত করিলাম সুতরাং প্রথমেই আমি হরিহর সম্বন্ধে কতকগুলি অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। অনুসন্ধানে যাহা জানিতে পারিয়াছিলাম তাহা পাঠকগণকে সংক্ষেপে বলিয়া দিতেছি। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

হরিহর দাস সিমলার একজন বাড়ীওয়ালা। হরিহরের পিতা—কালাচাঁদের বাসস্থান যশোহর জেলার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে ছিল। তিনি প্রায় কুড়ি বৎসরকাল কলিকাতায় ছিলেন। মাধববাবুর বাজারে তাঁহার একখানি মসলার দোকান ছিল। সেই দোকান হইতে যে অর্থ তিনি উপার্জ্জন করিতেন, তাহা দ্বারা পরিবার প্রভৃতি প্রতিপালন ব্যতীত কিছু সংস্থানও করিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর প্রায় দুই বৎসর পূর্ব্বে তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছিল। হরিহর তাঁহারই একমাত্র সন্তান। হরিহরের পিতা যখন পরলোক গমন করেন, সেই সময় নগদ প্রায় দুই সহস্রমুদ্রা, স্ত্রীর পরিত্যক্ত প্রায় পাঁচশত টাকার অলঙ্কার, এবং একখানি একতালা পাকা বাড়ী রাখিয়া যান। পিতার মৃত্যুর পরেই হরিহর বিষয় সম্পত্তি আপন হাতে পাইয়া একবারে বাবু হইয়া পড়ে; সুতরাং কিছু দিবসের মধ্যেই বাড়ীখানি ব্যতীত সমস্তই নিঃশেষিত হইয়া যায়। হরিহর উক্ত অর্থের কপর্দকও সৎকার্য্যে ব্যয় করে নাই। কোন কুহকিনীর কুহকজালে পতিত হইয়াই সে আপন হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া ফেলে এবং শীঘ্র তাহারই পাদপদ্মে সমস্ত অর্থ অর্পণ করে। 

হরিহর “তাহার” পশ্চাতে আপনার সমস্ত অর্থ অনর্থক নষ্ট করিয়া, পরিশেষে “তাহার” নিয়মিত খরচ যোগাইতে অপারক হইল; সুতরাং তাহার সেইস্থানে যাওয়া একবারে নিষিদ্ধ হইল। . 

যে হতভাগ্য একবার কুহকিনীদের মহামায়ায় ভুলিয়াছে, তাহার পক্ষে সেইস্থান সহজে পরিত্যাগ করা কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে। হরিহরের অদৃষ্টেও তাহাই ঘটিল, বিনাঅর্থে সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিতে নিষেধ থাকিলেও সে তাহার অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে কোনক্রমেই সমর্থ হইল না। সেই একতালা পাকা বাড়ীখানিও পরিশেষে বন্ধক পড়িল। হরিহরের হস্তে যতদিবস অর্থ থাকিল, ততদিবস পুনরায় তাহার আদর হইল। পুনরায় অতিশয় যত্নের সহিত হরিহর সেইস্থানে স্থান পাইল; কিন্তু যেমন অর্থ ফুরাইয়া গেল, অমনি তাহার পূর্ব্ব দশা আরম্ভ হইল। সে সেইস্থান হইতে পুনরায় তাড়িত হইবার উপক্রম হইল। 

হরিহরের যাহা কিছু ছিল, সমস্তই গিয়াছে। তাহার মাতার পরিত্যক্ত অলঙ্কার, পিতার উপার্জিত অর্থ, এবং বাড়ী সমস্তই শেষ হইয়াছে সত্য; কিন্তু যাহার জন্য সমস্ত ফুরাইয়াছে, এখন অর্থ না দিতে পারিলে সে দেখিতে পারে না, আর স্থান দিতে চাহে না। এইরূপ অবস্থায় উক্ত প্রকার প্রকৃতিবিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পরিশেষে যাহা হইয়া থাকে, ইহার অদৃষ্টেও তাহাই ঘটিল। অসৎ উপায়ে উপার্জ্জন করিয়া এমন কি, সময় মত চৌর্যবৃত্তি পর্য্যন্ত অবলম্বন করিয়াও পরিশেষে “তাহার “ মনঃস্তুষ্টি করিতে লাগিল। 

হরিহর তাহার কু-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত যে কতগুলি চুরি করিয়াছিল, এবং সেই সকল অপহৃত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া কত টাকা যে ‘তাহার’ পাদপদ্মে অর্পণ করিয়াছিল, তাহার হিসাব প্রদান করিতে আমরা অসমর্থ। কিন্তু একদিবসের কথা মনে আছে, পাঠকগণ যদি তাহা জানিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি বলিতে পারি। 

এই ঘটনার প্রায় ছয় মাস পূর্ব্বে একদিবস চিৎপুর রোডের কোন এক চরিত্রহীনা হতভাগী থানায় গিয়া নালিস করে যে, রাত্রি প্রায় বারটার সময় একটি অপরিচিত লোক তাহার গৃহে আগমন করে, এবং সেই রাত্রির অবশিষ্টাংশ সেইস্থানে অতিবাহিত করিবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে। হতভাগী দুই টাকা নগদ পাইয়া তাহার প্রস্তাবে সম্মত হয়। পরিশেষে তাহারই আগ্রহে ও ব্যয়ে কিছু মদ্য আনীত হয়, উভয়ে সেই মদ্য পান করিয়া, সেই গৃহে শয়ন করে। প্রাতঃকালে যখন হতভাগীর নিদ্রাভঙ্গ হয়, তখন সে দেখিতে পায়, তাহার গৃহের দ্বার যাহা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, তাহা খোলা রহিয়াছে, এবং সেই অপরিচিত লোকটি গৃহে নাই। কোমরে হাত দিয়া দেখে, কোমরে যে চাবি ছিল, তাহা কোমরে নাই, কিন্তু আমারিতে লাগান আছে। আলমারির ভিতর সোণার একছড়া চিক ও একজোড়া বালা ছিল, তাহাও নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সে থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করে। তৎপরে সন্ধান করিয়া পুলিস জানিতে পারিল যে, উহার অলঙ্কারগুলি প্রকৃতই অপহৃত হইয়াছে। কিন্তু যে ব্যক্তি সেই রাত্রিতে গৃহে ছিল, তাহাকে অপর কেহই দেখে নাই, বা কেহ বলিতে পারে না যে সে কে, বা কোথায় থাকে। 

প্রায় পনর দিন ধরিয়া উহার অনুসন্ধান হয়, কিন্তু কোন ফলই লক্ষিত হয় নাই। অপহৃত দ্রব্য পুনরুদ্ধার করা পরের কথা, সেই ব্যক্তি যে কে, তাহারও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। 

এই ঘটনার প্রায় এক মাস পরে একদিবস সেই হতভাগী হরিহরকে চিৎপুর রাস্তা দিয়া গমন করিতে দেখিতে পায়, ও সেই বাড়ীর অপর দুই চারি জন স্ত্রীলোকের সাহায্যে তাহাকে ধরিয়া থানায় আনয়ন করে। উহাকে লইয়া পুলিস অনেক অনুসন্ধান করেন, কিন্তু কোনক্রমেই সেই অপহৃত দ্রব্যের পুনরুদ্ধার করিতে সমর্থ হন না। তাহাকে বাদিনীর গৃহে অপর কেহই দেখিয়াছিল না, সুতরাং কেবলমাত্র সেই হতভাগীর কথায় হরিহরের সাজা হইতে পারে না বলিয়া, দোষী জানিয়াও তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করিতে বাধ্য হন। 

যাহা হউক, পিতৃবিয়োগের পর প্রায় দুই তিন বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। এতদিবসেও হরিহরের কোনরূপ চৈতন্য হইল না। সে ‘তাহার’ বাটিতে যাওয়া আসা কোন ক্রমেই পরিত্যাগ করিতে পারিল না। অসৎ উপায়েই বা আর কত অর্থ তাহা দ্বারা সংগ্রহ হইতে পারে? কাজেই সেইস্থানে তাহার আর স্থান হইল না, সে সেইস্থান হইতে বিতাড়িত হইল। অন্য উপায় আর না পাইয়া হরিহরকে পরিশেষে আপনার সেই আবাসস্থানে আসিতে হইল। প্রথম প্রথম হরিহর প্রতিজ্ঞা করিল যে, আর সেইস্থানে যাইবে না, তাহার বাড়িতে যাওয়া দূরে থাকুক, তাহার বাড়ীর নিকটবর্তী রাস্তা দিয়াও চলিবে না। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করা হরিহরের পক্ষে নিতান্ত সহজ হইল না। পরদিবস অতিবাহিত হইতে না হইতে কে যেন তাহার মাকে বলপূর্ব্বক টানিয়া ‘তাহার’ বাড়ীতে লইয়া গেল। হরিহর সেইস্থানে গমন করিল সত্য, কিন্তু রিক্তহস্তে গমন করিয়াছিল বলিয়া, নিতান্ত অবমানিত হইয়া পুনরায় তাহাকে আপন বাড়ীতে ফিরিতে হইল। হরিহর পুনরায় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইল—এবার দৃঢ় পণ করিল যে, “আর কখনও সেই স্থানে গমন করিব না।” একদিন দুইদিন করিয়া দেখিতে দেখিতে ক্রমে পনর দিন অতিবাহিত হইয়া গেল। এবার হরিহর আর সেইস্থানে গমন করিল না। এবার তাহাকে দেখিয়া সকলেই ভাবিল, এতদিবস পরে হরিহরের মতি-গতি ফিরিয়াছে। এখন সে বুঝিতে পারিয়াছে যে, এতদিবস পর্য্যন্ত কিরূপ অন্যায় কার্য্য করিয়া তাহার পিতার পরিত্যক্ত অর্থ সম্পত্তি প্রভৃতি সমস্তই অনর্থক হারাইয়াছে। 

নবম পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্ব পরিচ্ছেদ-বর্ণিত অবস্থা জানিয়া হরিহরের বিপক্ষে আমাদিগকে বর্তমান ব্যাপারে কার্য্যতঃ একটু অনুসন্ধান করিতে হইল। 

যে হতভাগীর গৃহে হরিহরের যাতায়াত ছিল, অনুসন্ধান করিয়া তাহার বাড়ীর বাহির করিলাম। উহার একটি বৃদ্ধা চাকরাণী আছে, শ্রবণ করিলাম। যে সকল আগন্তুক ব্যক্তি তাহার গৃহে গিয়া উপবেশন করে, তাহাদিগকে মুহুর্মুহুঃ তামাক সাজিয়া দেওয়া ইহার প্রধান কার্য্য ছিল। ইহার মাহিনা পত্র কিছুই নাই, বাবুরা সন্তুষ্ট হইয়া যে দুই চারি আনা ইহাকে প্রদান করিয়া থাকেন, তাহারই দ্বারা সে আপন জীবিকা নির্বাহ করে। 

তাহার বাড়ীর সম্মুখে পথের উপরে প্রায় দুই ঘণ্টাকাল দাঁড়াইয়া থাকিলাম; ইচ্ছা—হঠাৎ তাহার বাড়ীতে গমন না করিয়া কোন প্রকারে উক্ত বুড়ির নিকট হইতে যদি কোনরূপ সংবাদ সংগ্রহ করিতে পারি। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, বুড়ি সেই বাড়ীর ভিতরেই আছে। প্রায় দুই ঘণ্টাকাল পরে বাজার করিবার নিমিত্ত একটি চুপড়ি হস্তে করিয়া বুড়ি বাড়ীর বাহিরে আসিল, ও বাজার অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। আমিও বুড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। যখন দেখিলাম, যে বাজারের ভিতর প্রবেশ করিতেছে, তখন একবারে তাহার সম্মুখে গিয়া উপনীত হইলাম, এবং নিতান্ত পরিচিতের ন্যায় তাহাকে কহিলাম, “কি গো ভাল আছ?” 

“হাঁ বাবা! আমাদিগের আর ভালই বা কি, আর মন্দই বা কি, এখন তোমাদিগকে রেখে যেতে পারলেই বাঁচি।”

বুড়ির এই কথার পরেই তাহার হস্তে একটি টাকা প্রদান করিয়া কহিলাম, “বোধ হয়, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ, সে দিন তোমাদিগের ওখানে আমি গিয়াছিলাম। কিন্তু আমার নিকট যাহা ছিল, তাহা সমস্তই খরচ হইয়া যাওয়ায়, আসিবার সময় তোমাকে কিছুই দিয়া আসিতে পারি নাই। যাহা হউক, অনেকদিন পরে আজ দেখা হইল, ভাল হইয়াছে। এই লও তোমার সে দিনের বক্সিস। ইহার পর আবার যে দিন গমন করিব, সেই দিন তোমাকে আরও ভালরূপে সন্তুষ্ট করিব।” 

ইতিপূৰ্ব্বে সেই বুড়ি আমাকে কখন দেখে নাই, কিন্তু আমার কথা শ্রবণ করিয়া এবং টাকাটি হস্তে পাইয়া কহিল, “সে কি বাবা, তোমাকে চিনতে পারবো না? কতদিন তুমি আমাকে কত বক্সিস দিয়াছ। তা’ বাবা ভাল আছ’? আবার কবে আসবে?” 

বুড়ির কথা শ্রবণ করিয়া এবং তাহার ভাবগতি দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম—বুড়ি নিশ্চয়ই আমাদের কৌশল চক্রে পড়িয়াছে। এখন ইহার নিকট হইতে আমাদিগের কতক ইচ্ছা পূর্ণ করিতে পারিব। তখন তাহাকে পুনরায় কহিলাম, “হ্যাঁগো, হরিহর সেই যে পনর কুড়ি দিন চলে গেছে, তারপর কি আর সে আসে নাই।” 

বুড়ি। আসবে না কেন বাবা? হরিহর খুব ভাল ছেলে। পরশু এসে সে অনেকক্ষণ ছিল, যাবার সময় আমাকে আট আনা বক্সিস দিয়ে গেছে। 

আমি। তোমাকে ত আট আনা বক্সিস দিল, কিন্তু তোমার বিবি সাহেবকে এবার কত দিয়ে গেল? 

বুড়ি। এবার বুঝি একবারে কুড়ি টাকা দিয়া গেছে। আরও বলে গেছে, এবার যে দিন আসবে, সেইদিন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে যাবে। 

বুড়ির কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল। বুড়ি বাজারের ভিতর প্রবেশ করিল, আমি সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিয়া সেই “বিবি” সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। উহাকে হরিহরের কথা জিজ্ঞাসা করাতে দুই এক দিবসের মধ্যে হরিহর যে তাহার বাড়িতে আসিয়াছিল, তাহা প্রথমে সে অস্বীকার করিল; কিন্তু অনেক বুঝাইয়া বলায় ও বুড়ির নিকট হইতে আমরা সকল কথা অবগত হইতে পারিয়াছি জানিতে পারিয়া, পরিশেষে সকল কথা স্বীকার করিল। দেখিলাম, বুড়ির কথার সহিত তাহার সমস্ত কথা মিলিয়া গেল। হরিহর সম্বন্ধে যাহা কিছু সংগ্রহ করিতে পারিলাম, তাহা পকেট বহিতে নোট করিয়া লইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

দশম পরিচ্ছেদ 

সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া একবারে হরিহরের বাড়ীতে উপনীত হইলাম। এবার আমি একাকি নহি, সেই পাঠানবংশের আহাম্মদ আমার সঙ্গে। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই হরিহর দ্রুতপদে সেই মাদুর ও বালিসটি আনিয়া আমাদিগকে বসিতে দিল। আমরা সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। সেইস্থানে উপবেশন করিলে হরিহরও আসিয়া আমাদিগের নিকট বসিল। 

আমরা সেই বাড়ী হইতে সকলকে বহির্গত করিয়া দিয়া সদর দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ করিলাম। বাড়ীর ভিতর থাকিলাম,—কেবল আমরা দুইজন এবং হরিহর। তখন অন্যান্য কথা পরিত্যাগ করিয়া হরিহরকে কহিলাম, “ দেখ হরিহর! তুমি খুব এক খেলাই খেলিয়াছিলে। আহা! যদি ঈশ্বর তোমার উপর বিমুখ না হইতেন, তাহা হইলে তুমি যে এক হাত মারিয়াছিলে, তাহা অনায়াসেই হজম করিতে পারিতে। এখন আর তাহা হইতেছে না, আমরা সকল কথা অবগত হইতে পারিয়াছি। যেখানে যে টাকা তুমি দিয়াছ এবং যাহা দিবার জন্য প্রতিজ্ঞা করিয়া আসিয়াছ, তাহা সমস্তই আমরা জানিতে পারিয়াছি। এখন যনি মঙ্গল চাও, তাহা হইলে সমস্তই এই দণ্ডে বাহির করিয়া দেও।” 

আমাদিগের কথা শ্রবণে হরিহর যেন কিছুই জানে না, এইরূপ ভাবে সতেজে উত্তর প্রদান করিতে লাগিল।

হরিহরের কথা শ্রবণ করিয়া আহাম্মদ একবারে চটিয়া উঠিলেন ও কহিলেন, “ দেখ হরিহর! তুমি যদি এখনও প্রকৃতকথা না বল, তাহা হইলে এই নিৰ্জ্জন বাড়ীতে তোমার কিরূপ অবস্থা করিব, তাহা এখনই বুঝিতে পারিবে। যদি তোমার প্রাণের মায়া থাকে, তাহা হইলে আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া সমস্ত দ্রব্যাদি এখনই বাহির করিয়া দেও।” এইরূপ নানাপ্রকারে—কখন মিষ্টকথা বলিয়া, কখন গালিমন্দ দিয়া, কখন ভয় দেখাইয়া, কখন বা ভরসা দিয়া তাহাকে অনেকরূপে বুঝাইলাম, কিন্তু কিছুতেই তাহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করিতে সমর্থ হইলাম না। বুঝিলাম, পীড়াপীড়ি করিয়া ইহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারিব না তবে যদি কোন প্রকার ছল অবলম্বন করিয়া উহার মনের কথা অবগত হইতে পারি, তখন তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। 

মিষ্টকথায় উহাকে অনেক প্রকারে বুঝাইয়া পরিশেষে তাহাকে কহিলাম, “দেখ হরিহর! যাহা করিবার তাহা তুমি করিয়াছ। তারামণির অদৃষ্টেও যাহা ছিল, তাহাও হইয়া গিয়াছে; কিন্তু অতঃপর যখন অমরা সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছি, তখন আর তুমি আমাদিগকে ফাঁকি দিতে পারিতেছ না। এখন যদি বাঁচিতে চাহ, তবে যাহাতে তোমার মঙ্গল হয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদিগেরও কিছু উপকার হয়, সেইরূপ কার্য্য কর। আরও দেখ হরিহর আমরা চাকরী করিতে আসিয়াছি, যাহাতে দুই পয়সা উপার্জ্জন করিতে পারি, সেই দিকেই আমরা সতত লক্ষ্য করিয়া থাকি। মনে করিলে যতদূর প্রমাণ আমরা পাইয়াছি তাহাতেই তোমাকে জেলে প্রেরণ করিতে পারিব; কিন্তু তাহা আমরা ইচ্ছা করি না। বুড়ির যাহা গিয়াছে, সে আর তাহা পাইবে না; অথচ তোমার মোকদ্দমাতেই দামোদরকে সহজেই জেলে প্রেরণ করিব। এরূপ অবস্থা যার আমরা তোমাকে কি বলিব? এখানে আর কেহই নাই, যে সকল দ্রব্য তুমি অপহরণ করিয়াছ, তাহা এখন বাহির করিয়া তুমি অর্দ্ধেক গ্রহণ কর, আর বক্রী অর্দ্ধেক আমাদিগকে প্রদান কর। আমরা উহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিব।” এইরূপ ভাবে দামোদরকে অনেকরূপ বুঝাইতে বুঝাইতে পরিশেষে অনেক কষ্টে সেই নির্ব্বোধ আমাদিগের মতে মত দিয়া কহিল, “অলঙ্কারগুলি এখানে নাই; কিন্তু টাকাগুলিমাত্র এখানে আছে, যদি বলেন ত বাহির করিয়া দেই।” আমরা তখন তাহাতেই সম্মত হইলাম। যে বালিসে ভর দিয়া আমরা তখন বসিয়াছিলাম, এবং পূর্ব্বে যে বালিস অবলম্বনে পুলিস কৰ্ম্মচারীমাত্রই বসিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছেন, সাহেব কর্ম্মচারীগণ চৌকির পরিবর্তে ক্রমে আসিয়া যে বালিসের উপর উপবেশন করিয়াছিলেন, সেই বালিস দেখাইয়া দিয়া হরিহর কহিল, “উহার ভিতর নোটগুলি আছে।” হরিহরের কথা শ্রবণ করিয়া আমরা বিস্মিত হইলাম। তখনই সেই বালিসটি শত ভাগে ছিঁড়িয়া ফেলিলাম, দেখিলাম, বাস্তবিক তাহার ভতর তাড়াবাঁধা নোটগুলি প্রায় সমস্তই রহিয়াছে। আমরা বিশেষ বিস্মিত হইয়া নোটগুলি গ্রহণ করে কহিলাম, “এখন অলঙ্কারগুলি কোথায় আছে, বাহির করিয়া দেও।” 

হরিহর এড়াইতে না পারিয়া পরিশেষে অলঙ্কারগুলিও বাহির করিয়া দিল। যে স্থান হইতে সেগুলি বাহির করিয়া আনিয়াছিল তাহাও বালিস অপেক্ষা কিছু মন্দস্থান নহে। 

হরিহর অলঙ্কারগুলি বাহির করিয়া দিবার নিমিত্ত আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। যে পাড়ায় হরিহরের বাড়ী, সেই পাড়ায় এক ঘর বড়মানুষ ছিলেন। প্রথমে হরিহর তাঁহার পূজার বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল, পরে সেইস্থান হইতে তাঁহার বৈঠকখানার ভিতরে গমন করিল। 

হরিহরকে পুলিস-কৰ্ম্মচারী সমভিব্যাহারে, এবং বিনানুমতিতে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিয়া, বাড়ীর কর্তা বিশেষ কুপিত হইলেন, এবং নিতান্ত ক্রুদ্ধভাবে কহিলেন “আপনারা কিরূপ লোক? আপনারা একে অপরিচিত তাহাতে পুলিস-কৰ্ম্মচারী হইয়া আমাদিগের কাহারও অনুমতি না লইয়া, কিরূপে এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে সাহসী হইলেন? আপনারা আইন জানিয়াও যখন এইরূপ বে-আইনি কর্ম্ম করেন, তখন তাহার উপযুক্ত দণ্ড আপনাদিগের গ্রহণ করা কর্ত্তব্য। যদি আপনারা ভদ্রলোক হয়েন, তাহা হইলে বলিতেছি, এখনও আপনারা আমার বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান; নতুবা এখনই আমাদিগের নিকট অবমানিত ও পরিশেষে বিচারকের নিকট নিশ্চয়ই দণ্ডিত হইবেন, জানিবেন।” 

উক্ত ভদ্রলোকের কথায় আমরা কর্ণপাতও না করিয়া হরিহরকে কহিলাম, “যে স্থানে তুমি গমন করিতেছ, চল ইহার কথায় কর্ণপাত করিবার আমাদিগের কোন প্রয়োজন দেখিতেছি না।” আমার কথায় ভদ্রলোক আরও চটিয়া উঠিলেন, চীৎকার করিয়া আমাদিগকে অযথা গালি দিতে লাগিলেন, এবং বলপূর্ব্বক আমাদিগকে সেইস্থান হইতে বাহির করিয়া দিবেন বলিয়া, ভৃত্যবর্গকে ডাকিতে লাগিলেন। 

সেই বৈঠকখানার ভিতর অনেকগুলি বাদ্যযন্ত্র ছিল। সেই যন্ত্রবৃন্দের মধ্য হইতে হরিহর একটি অর্দ্ধভঙ্গ বৃহৎ তানপুরা বাহির করিয়া আনিল, এবং সর্বসমক্ষে স্থাপন পূর্ব্বক কহিল, “ইহার ভিতর অনুসন্ধান করিলেই সমস্ত পাইবেন।” হরিহরের কথা শ্রবণ করিয়া সেই ভগ্ন তানপুরা আমরা হস্তে উঠাইয়া দেখিলাম, বাস্তবিকই তাহার ভিতর সমস্ত অলঙ্কার রহিয়াছে। তখন আমরা সেই ভদ্রলোককে কহিলাম, “মহাশয়! আপনি বড়ই চীৎকার করিয়া আমাদেরকে আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে যে কেন নিষেধ করিতেছিলেন, এখন তাহার মর্ম্ম অবগত হইতে পারিতেছি। চোরামাল গ্রহণ করা যে আপনার কর্ম্ম, তাহা আমরা পূর্ব্বে জানিতাম না। চোরামাল গ্রহণ করিলে যে কি হয়, তাহা আপনি এখন বুঝিতে পারিবেন। দেখুন ত মহাশয়! আপনার এই তানপুরার ভিতর এ সকল কি রহিয়াছে।” 

আমার কথায় তাঁহার চীৎকারধ্বনি বন্ধ হইল। তখন তানপুরার ভিতর লক্ষ্য করিয়া অলঙ্কারগুলি যেমন তিনি দেখিতে পাইলেন, কাঁপিতে কাঁপিতে অমনি তিনি সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার বাক্য বন্ধ হইয়া গেল। অনেকক্ষণ পরে তিনি কাঁপিতে কাঁপিতে কহিলেন, “মহাশয়! আমি ইহার কিছুমাত্র অবগত নহি। আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করুন।” 

ইহার কথা শ্রবণ করিয়া ও ভাব দেখিয়া মনে করিলাম যে, এরূপ অবস্থায় আর একটু ভয় পাইলেই বোধ হয়, ইনি মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িবেন। আরও ভাবিলাম যে, ইনি আমাদিগের উপর প্রথমে যেরূপ অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা ইঁহার পক্ষে অন্যায় কার্য্য বলিতে পারিলাম না। কারণ, বিনা অনুমতিতে অপর কোন লোক বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে কোন ভদ্রলোক তাহা সহ্য করিতে পারেন? এইরূপ ভাবিয়া তাঁহাকে কহিলাম, “আপনার ভয় নাই, আপনাকে চোরামাল রাখা-অপরাধে আমি আসামী করিব না। কারণ আমার বিশ্বাস হইয়াছে, এবং হরিহরও বলিতেছে যে আপনি ইহার সবিশেষ কিছুমাত্র অবগত নহেন।” আমার কথা শ্রবণ করিয়া তখন তিনি একটু শান্ত হইলেন। 

সে যাহা হউক, যখন নোট ও অলঙ্কারগুলি আমাদিগের হস্তগত হইল, তখন হরিহর আর যায় কোথায়? তাহাকে উত্তমরূপে বন্ধন করিলাম। দেখিয়া সে কহিল, “এইরূপে মিথ্যা প্রলোভন দিয়া তোমরা আমার সর্ব্বনাশ করিলে! এই কি তোমাদের ধর্ম্ম?” 

আমাদিগের ধর্ম্ম যাহাই হউক, অতঃপর কিন্তু হরিহর মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। মাজিষ্ট্রেট সাহেব তাহাকে দুই বৎসরের নিমিত্ত কঠিন পরিশ্রমের সহিত জেলে প্রেরণ করিলেন। দামোদর নির্দোষ সাব্যস্ত হওয়াতে মাতার সহিত অলঙ্কার ও টাকাকড়ি লইয়া আপন বাড়ীতে প্রস্থান করিল আর যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী পূর্ব্বে অনুসন্ধান করিয়া সেই মোকদ্দমা মিথ্যা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তিনি বিলক্ষণ লজ্জিত হইলেন, ও তিন মাসের জন্য বিদায় গ্রহণ করিয়া আপন দেশে প্রস্থান করিলেন। 

[ ভাদ্র, ১৩০০ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *