আসমানী লাস (ভয়ানক লোমহর্ষণকর অদ্ভূত ঘটনা!!)

আসমানী লাস (ভয়ানক লোমহর্ষণকর অদ্ভুত ঘটনা!!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

বর্ষাকাল। অরুণদেব সমস্ত দিবস আপনার কিরণজাল সমভাবে বিকীর্ণ করিতে না পারিয়াই, যেন নিতান্ত বিষন্নমনে বেলা থাকিতেই অন্তর্হিত হইয়াছেন। তিমির-বসনা নিশাদেবী এ সুযোগ পরিত্যাগ করিতে না পারিয়া, শশব্যস্তে আসিয়া আপন স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছেন। পর্জ্জন্যদেবও সেই সময় টিপি টিপি বৃষ্টির সহিত উপস্থিত হইয়া রহিয়া রহিয়া গৰ্জ্জন করিতেছেন। সেই ভীষণ গর্জ্জনে মানবের মনে আতঙ্ক আসিয়া উপস্থিত হইতেছে; বোধ হইতেছে, আজ যেন মহাপ্রলয় আসিয়া উপস্থিত হইবে এমন ভয়ানক সময়ে আমি থানার ভিতরস্থিত আমার কক্ষে একাকী বসিয়া প্রকৃতির ভাবগতিক দেখিতে দেখিতে কি যেন ভাবিতেছি, হঠাৎ দেখিলাম, এক ব্যক্তি দৌড়িতে দৌড়িতে থানার ভিতর প্রবেশ করিল। উহার পরিধেয় বসন সমস্তই বৃষ্টিজলে ভিজিয়া গিয়াছে। সেই সময় আমি থানায় উপস্থিত আছি কি না, সে থানার ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমে তাহারই অনুসন্ধান করিল। অনুসন্ধানে সে যখন অবগত হইল—আমি থানায় উপস্থিত আছি, তখন সে দ্রুতপদে আসিয়া আমার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। আমাকে দেখিয়া আমার হস্তে একখানি পত্র প্রদানপূর্ব্বক সে স্থিরভাবে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। 

আমি পত্রখানি খুলিলাম ও পড়িলাম। জানিলাম, উহা আমার পরিচিত কলিকাতাবাসী একজন বড়লোকের পত্র। এই পত্র যাঁহার দ্বারা লিখিত, তাঁহার নাম আমি গোপনে রাখিব। কারণ, যে বিষয় বর্ণন করিতে আজ আমি প্রবৃত্ত, তাহার ভিতর লজ্জা-জনক রহস্য অনেক আছে; সুতরাং তাঁহার নাম উল্লেখপূর্ব্বক জনসমাজে তাঁহাকে অবমানিত করিতে আমার বাসনা নাই। বিশেষতঃ তিনি আমার বিলক্ষণ পরিচিত। যাহা হউক, ঐ পত্র পাঠ করিয়া বিশেষ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। পত্র-বাহককে জিজ্ঞাসা করায় সে কোন কথার উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইল না, বা ইচ্ছা করিয়া আমার নিকট তখন কোন কথা প্রকাশ করিল না। 

ঐ পত্রে লেখা ছিল, “আমি সবিশেষ বিপদগ্রস্ত। পত্র পাঠ মাত্র পত্রবাহক সহিত এখানে আসিয়া বাধিত করিবেন। এখানে আসিলে সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন। এক কথায় আমি নিতান্ত বিপদাপন্ন জানিবেন।” 

পত্র পড়িয়া ভাবিলাম, পত্রলেখক নিশ্চয়ই বিপদগ্রস্ত নতুবা তিনি বড়লোক হইয়া এরূপভাবে আমাকে পত্র লিখিবেন কেন? আমার সহিত যদিও তাঁহার বিশিষ্ট পরিচয় আছে সত্য, কিন্তু তিনি এরূপভাবে কখনও আমাকে পত্র লেখেন নাই। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া তৎক্ষণাৎ সেইস্থানে গমন করাই স্থির করিলাম। তখনই একখানি ঠিকা গাড়ি আনাইয়া, সেই পত্রবাহক সমভিব্যাহারে সেই বাবুর গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। 

বাবুর বাড়ীর সম্মুখে গমন করিয়া দেখি, তাঁহার সদর বাড়ী পুলিস-কর্মচারী দ্বারা পরিপূর্ণ। সেখানে পুলিসের প্রধান কৰ্ম্মচারী হইতে কনষ্টেবল পর্যন্ত, পশ্চিম-দেশবাসী, বঙ্গনিবাসী, এবং বিলাতবাসী প্রভৃতি অনেক জাতীয় এবং অনেক শ্রেণীরই কৰ্ম্মচারী আছেন। এই অবস্থা দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, এইস্থানে কোন বিশিষ্ট দুর্ঘটনাই ঘটিয়াছে; নহিলে এক সময়ে এক স্থানে এত কর্ম্মচারীর সমাবেশ হইবে কেন? এইরূপ ভাবিয়া আমি সেইস্থানে আমার গাড়ি হইতে অবতরণ পূর্ব্বক সদর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

সেখানকার সকলেই আমাকে চিনিতেন। আমাকে দেখিবামাত্র একজন প্রধান কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “এত শীঘ্র তুমি এখানে কি প্রকারে আসিতে সমর্থ হইলে? এখনও বোধ হয়, দশ মিনিট অতীত হয় নাই, তোমাদিগের সাহায্য পাইবার নিমিত্ত আমি পত্র প্রেরণ করিয়াছি। এই অল্প সময়ের মধ্যে তুমি কিরূপে এখানে আসিতে সমর্থ হইয়াছ?” উত্তরে আমাকে মিথ্যা কথা কহিতে হইল। এইস্থানে বিনাকারণে যে কেন আমাকে মিথ্যা কথা কহিতে হইল, তাহার উত্তর প্রদান করিতে আমি অপারক। পাঠকগণের মধ্যে যদি কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী থাকেন, তাহা হইলে তিনি এ মিথ্যা কথার তাৎপর্য্য বুঝিতে পারিবেন। সাধারণ পাঠকের পক্ষে তাহা বুঝিতে পারা অসম্ভব হইলেও, আমি প্রকাশ করিতে পারিলাম না। যাহা হউক, উত্তরে কহিলাম, “আমি অন্য কর্ম্মে কোনস্থানে গমন করিয়াছিলাম, এইপথ দিয়া প্রত্যাগমনকালে দেখিলাম, আপনারা সকলেই এই স্থানে। এখানে আবার কি নূতন ঘটনা ঘটিল, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।” 

“আসিয়াছ—ভালই হইয়াছে, আর প্রত্যাগমন করিবার প্রয়োজন নাই। এখন একবার সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখ দেখি, যদি ইহার কোনো উপায় বাহির করিতে সমর্থ হও। যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে সহজে যে ইহার কোন কথা বাহির করিতে পারা যাইবে, তাহার বিশেষ সম্ভাবনা দেখি না। একে বড়লোকের বাড়ী, তাহাতে অনুসন্ধানের প্রথম হইতেই আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চারি পাঁচজন উকীল ফিরিতেছেন। তাহার উপর যাহাদের নিকট এই বিষয়ের কোন কথা পাইবার সম্ভাবনা, তাহাদিগকে স্পষ্ট রূপে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার উপায় নাই। কারণ, তাঁহারা সকলেই অন্তঃপুর-আবদ্ধা স্ত্রীলোক। এরূপ অবস্থায় কি করা যাইতে পারে? আমাদিগের দ্বারা যাহা হইবার, তাহা বোধ হয় হইয়াছে; এখন তুমি একটু চেষ্টা করিয়া দেখ দেখি। তুমি অনেক মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছ, এবং অনেক সূত্র-বিহীন মোকদ্দমায় যশোলাভও করিয়াছ; এখন দেখ দেখি, ইহারও যদি কোন প্রকার সন্ধান করিয়া উঠিতে পাৰু।” এই বলিয়া তিনি আমাকে একটি ডবল টিনের বাক্স দেখাইয়া দিয়া কহিলেন, “যাও, প্রথমে একবার ঐ বাক্সটি খুলিয়া দেখিয়া লও। তাহার পর ইহার অবস্থা আমরা যতদূর জানিতে পারিয়াছি, তাহা তোমাকে বলিয়া দিব।” 

সেই সময় উপর হইতে একজন দ্বারবান্ আসিয়া আমাকে কহিল, “বাবু আপনার প্রতীক্ষায় বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। আপনাকে সেলাম দিয়াছেন ও বলিয়া দিয়াছেন, তাঁহার সহিত প্রথম সাক্ষাৎ করিয়া, পরিশেষে এই বিষয়ের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হউন।” 

দ্বারবানের কথা শ্রবণ করিয়া কহিলাম, “তুমি বাবুকে বল, আমি এই বাক্সটি একবার দেখিয়া তাঁহার নিকট গমন করিতেছি।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া দ্বারবান্ এক লম্বা সেলাম করিয়া, সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

পূৰ্ব্বকথিত বাক্সটি দেখিবার নিমিত্ত আমি উহার নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম, উহা একটি ডবল টিনের বাক্স, চারি ফুট লম্বা, আড়াই ফুট চওড়া ও আড়াই ফুট উচ্চ। উহার গা চাবি ভাঙ্গা। ডালা খুলিলাম, দেখিলাম, উহার ভিতর হাত পা মোড়া একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। সেই মৃতদেহ এরূপভাবে পচিয়া গিয়াছে যে, তাহাতে হস্ত প্রদান করিলে মাংস ও চর্ম্ম উঠিয়া যায়। দেহ হইতে মস্তক বিভিন্ন, মুখ বিকৃত, চক্ষু গলিয়া গিয়াছে। সেই মৃতদেহ হইতে এরূপ দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে যে, কাহার সাধ্য সেইস্থানে তিলাৰ্দ্ধকাল দণ্ডায়মান থাকিতে সমর্থ হয়। সেই মৃতদেহ দেখিয়া বলা সহজ নহে যে, সে কাহার মৃতদেহ? একখানি কালাপেড়ে শাটীদ্বারা সেই দেহের কতক অংশ আবৃত। শরীরে কোন অলঙ্কার নাই, কেবলমাত্র বামহস্তে একগাছি লোহার চিকণ চুড়ি রহিয়াছে। মৃতদেহ সম্বলিত সেই টিনের বাক্সের তাবস্থা দেখিয়া পূর্ব্বোক্ত কর্ম্মচারীর নিকট প্রত্যাগমন করিলাম। তিনি কহিলেন, “কেমন মৃতদেহ দেখিলে?” 

আমি। দেখিয়াছি মহাশয়! কিন্তু দেহের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে ঐ দেহ সনাক্ত হওয়া একেবারেই অসম্ভব। কাহার দেহ জানিতে না পারিলেই বা ইহার অনুসন্ধান কিরূপে হইতে পারে? যাহা হউক, ইহার অবস্থা কি? ইহা কোথায় পাওয়া গেল? 

প্রধান কর্ম্মচারী। মৃতদেহ সহিত ঐ বাক্স এই বাবুর বাড়ীর অন্তঃপুরের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে। 

আমি। বাড়ীর লোক কি বলিতেছেন? 

প্রধান কর্ম্মচারী। তাঁহারা বলিতেছেন, তাঁহারা কেহই বলিতে পারেন না যে, উহা কিরূপে তাঁহাদিগের বাড়ীর ভিতর আসিল। 

আমি। বাড়ীর কোন স্ত্রীলোক অনুপস্থিত হয় নাই কি? 

প্রধান কৰ্ম্মচারী। ইঁহারা বলিতেছেন, সকলেই উপস্থিত আছে। অনুপস্থিত কেহই নাই। 

আমি। কোন নূতন স্ত্রীলোক সম্প্রতি এ বাড়ীতে আসিয়াছিল কি না, সে বিষয়ে অনুসন্ধান হইয়াছে কি?

প্রধান কর্ম্মচারী। অন্য কোন স্ত্রীলোকের এ বাড়ীতে আসিবার কথা কেহই বলেন না। 

সাহেবের নিকট এই কয়েকটি কথা শ্রবণ করিয়া, আমি বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত উপরের বৈঠকখানায় গমন করিলাম। দেখিলাম, বাবু সেইস্থানে নিতান্ত দুঃখিত ও চিন্তিত অন্তঃকরণে বসিয়া আছেন। দুইজন উকীল ও পাড়ার আরও পাঁচ সাতজন ভদ্রলোক সেইস্থানে উপবিষ্ট। সকলেই ভাবনায় নিবিষ্ট, কাহারও মুখে কোন প্রকার কথা নাই, সকলেই নিস্তব্ধ ও বাক্যশূন্য। আমাকে দেখিবামাত্র বাবু সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া অভিবাদন পূৰ্ব্বক তাঁহার নিকট বসাইলেন। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলে বাবু কহিলেন, “মহাশয়! আমি বড়ই বিপদগ্রস্ত।” 

আমি। তাহা ত দেখিতেছি, কিন্তু আপনি এরূপ চিত্তিত হইবেন না। আমি এখানে উপস্থিত থাকিতে আপনাকে বা আপনার পরিবারস্থ কাহাকেও সহজে বিপদে পড়িতে হইবে না। 

বাবু। দেখুন, যদি আপনি আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে চিরকাল আপনার নিকট কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকিব। এখন বলুন দেখি, কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে এই বিপদ হইতে উদ্ধার পাইতে পারি। 

আমি। সমস্ত উপায় আমি বলিয়া দিব, ও নিজেও আপনার উদ্ধারের চেষ্টা দেখিব। এখন ইহার অবস্থা কি, বলুন দেখি। আমি এখনও সবিশেষ কিছুই অবগত হইতে সমর্থ হই নাই। সকল কথা আগাগোড়া না শুনিয়া আমি কি পরামর্শ দিব? 

বাবু। ইহার অবস্থা অধিক কিছুই আমি অবগত নহি। যে সামান্যরূপ জানি, তাহাই আপনাকে বলিতেছি। প্রায় দুই তিন দিবস হইতে বাড়ীর ভিতরে কেমন দুর্গন্ধ বাহির হয়। কিসের দুর্গন্ধ, তাহা প্রথমে ঠিক করিতে পারা যায় নাই। এই তিনদিবস পর্য্যন্ত বাড়ীর ভিতর ও বাহিরের নিকটবর্তী স্থান সকল সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করা হয়; কিন্তু কোথা হইতে এই দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে, তাহার সামান্যমাত্র সন্ধান পাওয়া যায় নাই। অদ্য সেই দুর্গন্ধ এরূপ প্রবল হইয়াছিল যে, বাড়ীর ভিতর কেহই থাকিতে সমর্থ হন নাই। সেই সময়ে পুনরায় সবিশেষরূপ অনুসন্ধান আরম্ভ হইয়াছিল। অনুসন্ধান করিতে করিতে বোধ হইল, যেন উপরকার একটি গৃহের ভিতর দুর্গন্ধ অধিক। তাহাতে আমাদের সকলেরই মনে সন্দেহ হয় যে, উক্ত গৃহের ভিতর কিছু না কিছু দ্রব্য পচিয়া দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। সেই গৃহের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করায় একটি টিনের বাক্সে অতিশয় পচাগন্ধ অনুভূত হয়। তখন সেই বাক্স বন্ধ ছিল। উহার চাবি অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু সেই বাক্স আপনার বলিয়া কেহই স্বীকার করিল না; কাজেই উহার চাবি না পাওয়ায় সেই বাক্স বাহির বাড়ীতে আনা হইল। একজন কর্মকারকে ডাকাইয়া যখন সেই বাক্স ভাঙ্গা হইল, তখন দেখা গেল যে, উহার ভিতর ঐ মৃতদেহ ঐরূপ অবস্থাতেই রহিয়াছে। তখন কি করা কর্তব্য, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, পুলিসে সংবাদ পাঠাইয়া দিলাম, সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র এই সকল পুলিস আসিয়া অনুসন্ধান করিতেছেন। তাঁহারা বলিতেছেন, আমরাই এই খুন করিয়াছি। আমি কিন্তু ঐ বাক্স ও মৃতদেহ সম্বন্ধে আর অধিক কিছুই অবগত নহি। বাড়ীর প্রত্যেক স্ত্রীলোককে বিশেষরূপে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু কেহই কিছু বলিতে পারেন না। ইহাও বড় আশ্চর্য্য যে, ঐ বাক্স আমার বাড়ীর ভিতর, কাহার দ্বারা এবং কি প্রকারে আনীত হইল, তাহার কিছুই আমরা বলিতে পারিতেছি না। এখন বলুন দেখি, কোন উপায় অবলম্বন করিলে, এ বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারি। 

আমি। আমি আপনাকে প্রথমে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি, যদি আপনি রাগ না করেন।

বাবু। আপনি যদিও পুলিস-কৰ্ম্মচারি, তথাপি আমি আপনাকে সেরূপভাবে দেখি না, তাহা আপনিও অবগত আছেন। এরূপ অবস্থায় আপনার কথায় আমার রাগ করা নিতান্ত অসম্ভব। 

আমি। আমার সহিত আপনার যদিও বিশিষ্ট পরিচয় আছে সত্য, কিন্তু আমি আপনার পারিবারিক কোন কথা কখন জিজ্ঞাসা করি নাই। সেই সম্বন্ধে আমি আপনাকে প্রথম দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি। 

বাবু। আপনি আমাকে সকল কথা অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। চলুন, নির্জ্জন গৃহে আপনি ও আমি গমন করি। 

আমি। নিৰ্জ্জন গৃহে গমন করিবার প্রয়োজন নাই। আমি যে সকল বিষয় অবগত হইতে চাই, তাহা আপনি সৰ্ব্ব—সমক্ষেই বলিতে সমর্থ হইবেন। 

বাবু। তাহা হইলে এইস্থানেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। 

আমি। আপনার পরিবারবর্গের মধ্যে এখন বাড়ীতে কে কে উপস্থিত আছেন? 

বাবু। আমার পরিবার অতি সামান্য; আমি, আমার স্ত্রী, আমার ভগিনী, আমার দুইটি কন্যা, এবং একটিমাত্র পুত্র ভিন্ন পরিবারের মধ্যে আর কেহই নাই। 

আমি। আপনার ভগিনী, তাঁহার স্বামী-গৃহে থাকেন না। 

বাবু। না। তিনি প্রাচীনা এবং বিধবা, তাঁহার বয়ঃক্রম বোধ হয় ষাট বৎসরের কম নহে। শুনিয়াছি, যখন আমি নিতান্ত শিশু, সেই সময়ে তিনি বিধবা হইয়াছেন, ও সেই সময় হইতেই তিনি আমাদিগের গৃহে অবস্থিতি করিতেছেন। 

আমি। আপনার দুইটি কন্যার কথা যাহা বলিলেন, তাঁহারা উভয়েই কি বিবাহিতা? 

বাবু। না, বড়টির বিবাহ হইয়াছিল; কিন্তু বিবাহের কয়েক বৎসর পরেই তিনি বিধবা হয়েন। বিধবা হওয়ার পর হইতে তিনি এইস্থানেই আছেন, শ্বশুরালয়ে গমন করেন নাই। ছোট কন্যাটির এখনও বিবাহ হয় নাই, তাহার বয়ঃক্রম দশ বৎসর হইবে। 

আমি। আপনার বড় কন্যাটি কত বয়সের সময় বিধবা হইয়াছেন, আর এখনই বা তাঁহার বয়ঃক্রম কত? বাবু। যখন তাঁহার বয়ঃক্রম নয় বৎসর, সেই সময় তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল। তের বৎসর বয়সের সময় তিনি বিধবা হইয়াছেন। এখন তাঁহার বয়ঃক্রম বোধ হয়, পঁচিশ ছাব্বিশ বৎসর হইবে। 

আমি। পুত্রটি কত বড়? 

বাবু। ছোট কন্যার ছোট; বোধ হয়, ছয় সাত বৎসর তাহার বয়ঃক্রম হইবে। 

আমি। যে কয়েকটি স্ত্রীলোকের কথা কহিলেন, তাঁহারা সকলেই এখন বাড়ীতে উপস্থিত আছেন কি? 

বাবু। তাঁহারা সকলেই এখন বাড়ীর ভিতর আছেন। 

আমি। আপনি যে কয়েকজনের কথা বলিলেন, তদ্ব্যতীত আর কে কে আপনার বাড়ীতে আছেন? 

বাবু। একটি ব্রাহ্মণ ও একজন ব্রাহ্মণী। ইঁহারা উভয়ে রন্ধন করেন। চারিজন চাকরাণী, বাড়ীর প্রয়োজনীয় কাৰ্য্যে এবং বালক-বালিকার সেবার জন্য নিযুক্ত থাকে। দুইজন চাকর, আমার কর্ম্মের নিমিত্ত সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকে, ও চারিজন দ্বারবান্ দেউড়ীতে বসিয়া থাকে। ইহা ব্যতীত আর কেহই আমার বাড়ীতে থাকে না। 

আমি। এই চাকর চাকরাণী, এবং দ্বারবানগণের মধ্যে অন্দরমহলে কোন কোন্ ব্যক্তির গমনের অধিকার আছে?

বাবু। দ্বারবান ব্যতীত আর কাহারও অন্দরমহলে যাইবার কোন বাধা নাই। 

আমি। চাকর চাকরাণীদিগের মধ্যে সকলেই কি রাত্রিতে বাড়ীর ভিতর থাকে, না বাহিরে তাহাদিগের আপন আপন বাসায় গমন করে? 

বাবু। না, কেহই বাহিরে থাকে না, সকলেই আমার বাড়ীতে থাকে। 

আমি। ইহার মধ্যে অন্য কোন স্ত্রীলোক আপনাদিগের আত্মীয়াই হউন, বা চাকর চাকরাণীদিগের পরিচিতাই হউক, এখানে আগমন করিয়াছিলেন কি? 

বাবু। আমি যতদূর অবগত আছি, তাহাতে আমার বাড়িতে এক মাসের মধ্যে কেহই আগমন করে নাই। বাবুকে এই কয়টি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া, যে গৃহে সেই বাক্স পাওয়া গিয়াছিল, সেই গৃহটি একবার দেখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। আমার প্রস্তাবে বাবু সম্মত হইলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

অন্দরের ভিতর যে স্থানে সেই বাক্স পাওয়া গিয়াছিল সেইস্থানে বাবু ও আমি গমন করিলাম। বাড়ীর উত্তর অংশে দোতালার উপর কেবল তিনটিমাত্র গৃহ আছে। পূর্ব্বদিকের গৃহটিতে বাবুর ভগিনী থাকেন। উহার সংলগ্ন পশ্চিম পার্শ্বের গৃহে কেহই শয়ন করেন না, উহার ভিতর কতকগুলি আলমারি, বাক্স ও সিন্ধুক আছে। কতকগুলি কাপড় ও তৈজসপত্র দ্বারা সেইগুলি পরিপূর্ণ। সেই গৃহেই মৃতদেহ সহিত উক্ত বাক্স পাওয়া যায়। সেই গৃহের পশ্চিমে যে কুঠারি, তাহাতে থাকেন, বাবুর সেই বিধবা কন্যা। এই কুঠারির পশ্চিমে, অথচ উহার সহিত সংলগ্ন একটি ছাদ আছে; উহা প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। যেই ছাদের উপর কেহ দণ্ডায়মান হইলে, বাহির হইতে কেহই দেখিতে পায় না। এই গৃহশ্রেণীর পশ্চাতেই খিড়কীর বাগান, ও সম্মুখে উঠান; উঠানের দক্ষিণে সেই প্রকারের তিনটি গৃহ। বাবু ও তাঁহার স্ত্রী দ্বারা সেইগুলি অধিকৃত। ইহাই অন্দরমহল। 

বাড়ীর এই অবস্থা দেখিয়া আমরা পুনরায় বাহিরে আসিলাম। বাবুকে কহিলাম, “আপনার ভাবিবার কোন আবশ্যক নাই। যাহাতে আপনি কোনরূপে বিপদগ্রস্ত না হন, আমি তাহার সবিশেষ চেষ্টা করিব। অথচ দেখিব, আমি এই বিষয়ের রহস্যোদঘাটন করিতে কোনক্রমে সমর্থ হই কি না।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া বাবু একটু আশ্বস্ত হইলেন, ও আমাকে বহুবিধ অনুনয় বিনয় করিতে লাগিলেন। যতদূর পারি, আমি তাঁহার সাহায্য করিব প্রতিজ্ঞা করিয়া, সেই স্থান হইতে নীচে আসিলাম; যে স্থানে অন্যান্য কর্ম্মচারিগণ ছিলেন, আমিও সেই স্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম। 

এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত কোন্ কৰ্ম্মচারী কোন্ উপায় অবলম্বন করেন, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। দেখিলাম, সকলেই আমার মত অন্ধকার-পথে বিচরণ করিতেছেন। কেহই ভাবিয়া কোন কথা স্থির করিতে পারিতেছেন না, বা কোন পথ অবলম্বন করিতেও সমর্থ হইতেছেন না। 

সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া কিয়ৎক্ষণ ঐ সকল দেখিলাম। পরিশেষে সেই বাড়ীর বাহিরে গমন করিয়া এদিকওদিক্ একবার দেখিয়া লইলাম, ও পশ্চাদ্ভাগস্থিত বাগানের দিকে গমন করিলাম। বাগানের ভিতর প্রথমে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, সেই পুরাতন লতাগুল্মের ভিতর ভাল রূপে দেখিলাম; কিন্তু কোনস্থানে এমন কিছুই দেখিতে পাইলাম না, যে, যাহা দ্বারা মনের ভিতর কোন প্রকার সন্দেহের আবির্ভাব হইতে পারে। 

সেই বাগানের উত্তরে কয়েকখানি বাড়ী ছিল। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, ঐ স্থান আমার উত্তমরূপ পরিচিত। চারি পাঁচ দিবস পূর্ব্বে একটি সিঁদচুরি মোকদ্দমা অনুসন্ধান-উপলক্ষে সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম। সকল স্থান আর দেখা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া, আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

এই হত্যা কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, সেই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বেই আমাদিগের দেখা উচিত, এই মৃতদেহ কাহার। এ কাহার মৃতদেহ ও উহা কোথা হইতেই বা আনীত হইল, ইহা যদি জানিতে পারা না যায়, তাহা হইলে এইরূপ অবস্থায়, এরূপ হত্যাকাণ্ডের সন্ধান হওয়া একেবারেই অসম্ভব। 

বাড়ীর চাকর-চাকরাণী, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, প্রভৃতি সকলকেই সবিশেষরূপে জিজ্ঞাসা করা হইল, দ্বারবাদিগকেও জিজ্ঞাসা করিতে বাকি থাকিল না; কিন্তু কেহই কোন কথা বলিতে পারিল না, বা বলিল না। সেই মৃতদেহ যে কাহার, তাহার কোন সন্ধানই হইল না। সেই বাড়ীর চতুষ্পার্শ্বস্থিত সকল ব্যক্তিকেই সেই মৃতদেহ দেখান হইল, সকলকে জিজ্ঞাসাও করা হইল; কিন্তু সেই মৃতদেহ যে কাহার, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। 

এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক কে? কোন ব্যক্তি কর্তৃক এই দুঃসাহসিক কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে? আমরা সেই অনুসন্ধান পরিত্যাগপূর্ব্বক সেই মৃতদেহ কাহার, তাহারই অনুসন্ধানে এখন প্রবৃত্ত হইলাম। 

“সেই মৃতদেহ কাহার,—যে বলিয়া দিতে পারিবে, সে গবর্ণমেন্ট হইতে পঞ্চাশ টাকা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইবে।” এইরূপ ঘোষণা চারিদিকে ঘোষিত হইল। ভিন্ন ভিন্ন কর্ম্মচারী, ভিন্ন ভিন্ন দিকে প্রেরিত হইলেন। সকলেই অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন যে, কোন স্ত্রীলোক কোনস্থান হইতে হঠাৎ অন্তর্হিত হইয়াছে কি না। কিন্তু অনুসন্ধানে কোন ফলই ফলিল না। কেহই এরূপ কোন সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না, যাহা দ্বারা এই মোকদ্দমার কোনরূপ সন্ধান হইতে পারে। মৃতদেহ যেরূপভাবে পচিয়া গিয়াছে, তাহা যে কেহ চিনিতে পারিবে, সে আশা করা অন্যায়। কাজেই সেই মৃতদেহের সৎকার যে কীভাবে হইবে তাহা চিন্তার বিষয়। মৃতদেহের মধ্যে থাকিল, উহার পরিহিত একটি বস্ত্র এবং সেই টিনের বাক্স। 

ইহার পূর্ব্বে আমি অনেক মোকদ্দমায় অনুসন্ধান করিয়াছি, ঈশ্বরানুগ্রহে অনেক মোকদ্দমার গুপ্তবিষয় বাহির করিতে সমর্থও হইয়াছি; কিন্তু এবার যেরূপ বিপদ দেখিতেছি, সেরূপ বিপদে আর কখনও পড়ি নাই। সে সকল অনুসন্ধানের পূর্ব্বে একটি না একটি এমন সামান্য সূত্রও পাওয়া গিয়াছে, যাহা দ্বারা পরিশেষে সেই মোকদ্দমার আদ্যন্ত ঘটনা প্রকাশ হইয়াছে। এবার কিন্তু সেরূপ কোন সূত্রই বাহির হইতেছে না, যাহা অবলম্বন পূর্ব্বক অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া যায়। তথাপি অনুসন্ধানের ত্রুটী হইল না। যিনি যেরূপ বিবেচনা করিলেন, তিনি সেইরূপেই অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু সেই রাত্রিতে কেহই কোন প্রকার সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

পরদিবস প্রাতঃকালে সেইস্থানে উপবেশন পূৰ্ব্বক মনে মনে চিন্তা করিতেছি, “এখন কোন উপায় অবলম্বন করি?” এমন সময়ে হঠাৎ আমার মনে উদয় হইল যে, সেই মৃতদেহে যে বস্ত্র পাওয়া গিয়াছে, তাহা রাত্রি কালে পাইতে সমর্থ হই নাই; উক্ত বস্ত্র যদি পুরাতন হয়, তাহা হইলে তাহা ধোপার ঘরে গমন করিয়াছিল। অতএব ইহাতে যদিকোন মার্কা থাকে, তাহা হইলে অনুসন্ধানের একটি পথ পাওয়া যাইতে পারে। যদি কোন প্রকারে সেই ধোপার অনুসন্ধান পাই, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই বলিতে পারিবে, কাহার বস্ত্রে সে ঐ প্রকার মার্কা দিয়া থাকে। আর বস্ত্রের অধিকারী যদি প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা হইলে সেই মৃতদেহ কাহার, তাহা স্থির হইবে, এবং হয়ত এই হত্যাকাণ্ডের নায়কও বাহির হইয়া পড়িবে। 

মনে মনে এই প্রকার ভাবিয়া সেই বস্ত্রখানি সেইস্থানে আনাইলাম, কিন্তু যখন উহা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, তখন আমার মনের সকল আশা তিরোহিত হইল। যে ভরসায় বুক বাঁধিয়া অনুসন্ধানে অগ্রসর হইব ভাবিয়াছিলাম, এখন সেই ভরসা মন হইতে সুদূরে পলায়ন করিল। দেখিলাম, উক্ত বস্ত্রখানি কোরা ধোপের ফরাশ—ডাঙ্গার শাটী। উহাতে ধোপার মার্কা প্রভৃতি এমন কিছুই নাই যে, যাহাতে আমাদিগের অভীষ্ট-সিদ্ধির উপায় হইতে পারে। এইরূপে নূতন উদ্ভাবিত পন্থা রুদ্ধ হইয়া গেল। পুনরায় সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। 

আজ অনুসন্ধানের মূর্ত্তি কিছু রূপান্তর ধারণ করিল। বোধ হইতে লাগিল, সকলেই যেন আজ বাবুর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান। সকলেই সন্দেহ করিতেছেন, এ হত্যা বাবুদ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, বা ইহার প্রকৃত অবস্থা তিনি উত্তমরূপে অবগত থাকিয়াও ইচ্ছাপূর্ব্বক গোপন করিতেছেন। আমি বাবুকে পূর্ব্ব হইতে উত্তমরূপে জানিতাম। তিনি যে কি প্রকৃতির লোক, তাহা আমার নিকট অবিদিত ছিল না; সুতরাং আমি অপর সকলকে কহিলাম, “এ কার্য্য বাবুদ্বারা কোন প্রকারেই সম্পন্ন হইতে পারে না।” কিন্তু আমার কথায় কেহই কর্ণপাত করিলেন না; আমার বিশ্বাস ভ্রমাত্মক বলিয়া সকলে উড়াইয়া দিলেন। বাবুকে লইয়াই অতঃপর অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। নানাদিক্ হইতে নানা প্রকারের কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইতে লাগিল। আমার কিন্তু ঐ সকল ভাল লাগিল না। আমি সেইস্থান হইতে উঠিয়া যে স্থানে চাকরাণী কয়েকজন ছিল, সেইস্থানে গমন করিলাম। ভাবিলাম, চাকরাণীদিগকে একবার উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখি, যদি তাহাদিগের ভিতর হইতে হঠাৎ কোন কথা বাহির হইয়া পড়ে। এইরূপ ভাবিয়া কামিনীনাম্নী চাকরাণীকে প্রথমে অন্তরালে লইয়া গেলাম। তাহাকে অনেকরূপ জিজ্ঞাসা করিলাম,—বাবুর পরিবারবর্গের মধ্যে কাহার কি প্রকার চরিত্র, তাহা জানিবার সবিশেষ চেষ্টা করিলাম, কিন্তু সকলের চরিত্রই ভাল বলিয়া সে একে একে ব্যাখ্যা করিল। আর কহিল, সেই বাড়ীতে তাহার কোন আত্মীয় বা অপর কাহারও পরিচিত স্ত্রীলোক দশ পনর দিবসের মধ্যে আইসে নাই। কেবল একমাস পূর্ব্বে বামা-ঝির একটি নাতিনী দেশ হইতে আসিয়া তাহার নিকট দুইদিবস মাত্র ছিল, পরিশেষে কোথায় তাহার চাকরী হওয়ায় সেইস্থানে গমন করিয়াছে। কামিনীর কথা শেষ হইলে, তাহাকে একটু দূরে রাখিয়া বামাকে ডাকিলাম। বামাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করায় তাহারও নিকট হইতে প্রথমে কোন কথা পাইলাম না; পরিশেষে তাহাকে কহিলাম, “বামা! এখন তুমি আর মিথ্যা কথা কহিও না, কামিনী আমাকে সমস্ত বলিয়া দিয়াছে। তোমার নাতিনী তাহাকেই ত মারিয়া বাক্সের ভিতর পুরিয়া রাখিয়াছ?” 

আমার এই কথা শুনিবামাত্র বামা, কামিনীকে প্রথমে সহস্র গালি দিল। পরিশেষে কহিল, “আমার নাতিনী আসিয়া এইস্থানে দুইদিবস ছিলমাত্র, সেও একমাস পূর্ব্বে। ইহাতেই সে বলে, আমি আমার নাতিনীকে মারিয়া ফেলিয়াছি! আর উহার ভগিনী আসিয়া যে সাতদিবস পূর্ব্বে এইস্থানে ছিল, সে কথা বলিতে বুঝি ভুলিয়া গিয়াছে?” এই বলিয়া কামিনীর সহিত সে তুমুল ঝগড়া লাগাইয়া দিল। আমি সেইস্থানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া উহাদিগের ভাবগতিক দেখিতে লাগিলাম, এবং বিশেষ মনোযোগের সহিত উহাদিগের ঝগড়াও শুনিতে লাগিলাম। এত ঝগড়া হইলেও কামিনী কিন্তু তাহার ভগিনীর সেইস্থানে আগমনের কথা কোনক্রমেই স্বীকার করিল না। ইহাতে কামিনীর উপর আমার বড়ই সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি এই ঘটনা অপর সকলকেই কহিলাম; সকলেই এই কথা শ্রবণ করিয়া বিস্মিত হইলেন। বাবুকে ছাড়িয়া দিয়া তখন সকলেই আসিয়া সেই কামিনী চাকরাণীর উপর পড়িলেন। বামা এই গোলযোগে বহির্গত হইয়া গেল, কিন্তু শীঘ্রই তাহার নাতিনীর সহিত ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “মহাশয়! আমি আমার নাতিনীকে এই হাজির করিলাম, এখন কামিনী উহার ভগিনীকে আনয়ন করুক।” 

এত গোলমালের পরও কামিনী কিন্তু তাহার ভগিনী যে সেইস্থানে আগমন করিয়াছিল, তাহা স্বীকার করিল না। চাকর চাকরাণীদিগকে জিজ্ঞাসা করায় তাহার ভগিনীকে যে আর কেহ দেখিয়াছে, একথাও আর কেহ বলিল না। কেবল রামসিংহ দ্বারবান্ কহিল, “প্রায় সাত দিবস হইবে, একটি স্ত্রীলোক এইস্থানে আগমন করিয়া কামিনীর সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করায়, আমি কামিনীকে ডাকিয়া দিই। কামিনী উহাকে সঙ্গে করিয়া বাটীর ভিতর লইয়া যায়, কিন্তু তাহাকে বহির্গত হইয়া যাইতে আমি আর দেখি নাই।” 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

বামার নিকট হইতে একটিমাত্র কথা বাহির হওয়ায় তদারকের স্রোত অন্যদিকে ফিরিল। সকলেই তখন বাবুকে ছাড়িয়া দিয়া কামিনীর উপর পড়িলেন, অনেকেই কামিনীকে অনেক প্রকারের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কামিনী কোনক্রমেই তাহার ভগিনীর কথা স্বীকার করিল না, বলিল যে, বামা ও রামসিং মিথ্যা কথা কহিতেছে। যাহা হউক, কামিনীর ভগিনী আছে কি না, যদি থাকে, তাহা হইলে সে কলিকাতায় আসিয়াছিল, কি না? আর এখনই বা সে কোথায় আছে? এখন এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধান করাই স্থির হইল। জানা গেল, কামিনীর বাসস্থান মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে। এখন ঐ সমস্ত বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত এইস্থান হইতে একজন কর্মচারী মেদিনীপুরে প্রেরিত হইলেন। আমরা এইস্থানে অন্যান্য প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। 

সপ্তাহ পরে সেই কৰ্ম্মচারী মেদিনীপুর হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কহিলেন, কলিকাতা হইতে মেদিনীপুরে গমন করিয়া অনেক অনসন্ধানের পর, আমি কামিনীর বাসস্থানের ঠিকানা করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখি, কামিনীর বাড়ীতে কেবলমাত্র দুইখানি চালা ঘর। উভয় ঘরই বাহির হইতে তালাবদ্ধ। অনুসন্ধানে অবগত হইলাম, প্রায় ছমাস পূর্ব্বে কামিনী একবার তাহার দেশে গমন করিয়াছিল। প্রায় মাসাবধি সেইস্থানে থাকিয়া পরিশেষে কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিয়াছিল। তাহার সুন্দরীনাম্নী একটি ভগিনী ছিল সত্য, কিন্তু গত দশ বৎসরের ভিতর কেহ তাহাকে সেই গ্রামে দেখিতে পায় নাই। সেই গ্রাম হইতে প্রায় কুড়ি ক্রোশ দূরে রামহরি নামক এক ব্যক্তির সহিত তাহার বিবাহ হয়। বিবাহের পর সে আর তাহার ভগিনীর বাড়িতে গমন করে নাই। এইরূপ অবগত হইয়া কুড়ি ক্রোশ পথ চলিয়া, পরিশেষে সেই রামহরির বাড়ী পাইলাম। দেখিলাম, সে বাটীতে নাই; কিন্তু অনুসন্ধানে অবগত হইলাম যে, রামহরির স্ত্রী ‘সুন্দরী’ সেই গ্রামের আরও কয়েকটি স্ত্রীলোকের সহিত গঙ্গাস্নান উপলক্ষে কলিকাতায় আগমন করিয়াছিল; অপর স্ত্রীলোকগণ প্রতিগমন করিয়াছে, কিন্তু রামহরির স্ত্রী তাহাদের সহিত ফিরিয়া যায় নাই। সেই স্ত্রীলোকগণের মধ্যে অনেকেই সেই স্থানে উপস্থিত দেখিতে পাইলাম। তাহাদিগকে উত্তমরূপে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম যে, তাহারা সকলেই ষ্টীমার যোগে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হয়। পরে সকলে পদব্রজে কালীঘাটে গমন করিবার সময় রাস্তায় গাড়ির ভিড়ে সুন্দরীর সঙ্গ ছাড়িয়া যায়। কলিকাতায় তাহারা সুন্দরীর অনেক অনুসন্ধান করে, কিন্তু কোনস্থানে তাহার কোন প্রকার সন্ধান প্রাপ্ত না হইয়া পরিশেষে সকলেই আপন আপন বাটীতে প্রত্যাগমন করে। রামহরি এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া, এ পর্যন্ত নানাস্থানে তাহার সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। সেইস্থান হইতে আমার প্রত্যাগমনের কিয়ৎক্ষণ পূর্ব্বে রামহরি আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হয়; আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া এইস্থানে আনিয়াছি, এই সে রামহরি।” এই বলিয়া কর্ম্মচারী রামহরিকে সৰ্ব্বসমক্ষে উপস্থিত করিয়া দিলেন। 

রামহরি কামিনীকে চিনিত। তাহাকে দেখিয়া সে কহিল, “ইনিই আমার স্ত্রীর ভগিনী। বৎসরের মধ্যে দুই একবার ইনি আমাদিগের বাটীতে গমন করিয়া থাকেন। মধ্যে মধ্যে পত্রাদিও লিখিয়া থাকেন।” 

কামিনী শুনিল, তাহার ভগিনী গঙ্গাস্নান উপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়াছিল, আর দেশে প্রত্যাগমন করে নাই, অনেক অন্বেষণ করিয়াও তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যায় নাই। এই সকল কথা শুনিয়াও কামিনী দুঃখিত হইল না, ও ভগিনী শোকে তাহার চক্ষু দিয়া একবিন্দু জলও বাহির হইল না। কামিনীর এই প্রকার ভাব ভাল লাগিল না, নানা প্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে কামিনীর উপর বিশেষ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। কেহ স্পষ্টই কহিলেন, উক্ত মৃতদেহ কামিনীর ভগিনী সুন্দরীর দেহ ভিন্ন অপর কাহারও নহে। 

সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত কর্ম্মচারীগণের মনে সন্দেহ উপস্থিত হইল সত্য, কিন্তু এখন কি করা যাইতে পারে? মৃতদেহ আর নাই, উহার সৎকার কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে। রামহরি হয় ত সেই দেহ দেখিতে পাইলে বলিতে সমর্থ হইত যে, উহা তাহার স্ত্রীর মৃতদেহ, কি না। সে উপায় ত আর এখন নাই, এখন কি করা যাইতে পারে। যাহা হউক, যে বস্ত্র ও লোহা তুলিয়া রাখা হইয়াছিল, সেই বস্ত্র ও লোহা রামহরিকে দেখান হইল, উহা দেখিয়া সে বলিতে সমর্থ হইল না যে, উহা তাহার স্ত্রীর কি না। 

কামিনী কেন মিথ্যা কথা কহিতেছে, অতঃপর এই সন্দেহ মিটাইতে সকলেই যত্নবান হইলেন। এবার আর কামিনীকে বড়লোকের চাকরাণী বলিয়া কেহ বিবেচনা করিল না—তখন যাহার মনে যাহা উদয় হইতে লাগিল, তিনি সেইরূপেই উহাকে উৎপীড়ন করিতে লাগিলেন। ক্রমে কামিনীকে সেইস্থান হইতে থানায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত একজন কনষ্টেবলের জিম্মা করিয়া দেওয়া হইল। কনষ্টেবল উহাকে লইয়া থানা-অভিমুখে প্রস্থান করিল। এখন কামিনী বুঝিতে পারিল যে, এবার আর তাহার রক্ষা নাই; তাহার ভগিনী সুন্দরীকে হত্যা করার অপরাধে সে অভিযুক্তা। এখন সে সকলের নানাপ্রকার বাক্যবাণে জর্জরিতা হইয়া, কনষ্টেবলের মধুরবাক্যে বিশেষরূপ অবমানিতা হইয়া, অধোবদনে কাঁদিতে কাঁদিতে কনষ্টেবলের সহিত সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। সকলেই ভাবিলেন, কনষ্টেবল উহাকে থানায় লইয়া যাইবে। কিন্তু পরে সেই কনষ্টেবল প্রত্যাগমন করিয়া যাহা বলিল, তাহা শ্রবণ করিয়া সকলেই অবাক্ হইলেন। বিস্মিতনেত্রে সকলেই সেই পশ্চিম-দেশবাসী বীরপুরুষের দিকে দেখিতে লাগিলেন। সে কহিল যে, কামিনীকে থানায় লইয়া যাইবার কালে সে পথ হইতে পলায়ন করিয়াছে। অনেক অন্বেষণ করিয়াও তাহার সন্ধান করিতে সমর্থ হয় নাই। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

কামিনী পলাইল কেন? তবে কি সে প্রকৃতই এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের সংস্রবে আছে? যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তবে কি উহা নিশ্চয়ই তাহার ভগিনী সুন্দরীর মৃতদেহ? আরও দেখা যাইতেছে, সেই মৃতদেহ যাহার, তাহার স্বামী এখনও বর্তমান। যদি সে বিধবা বা অবিবাহিতা হইত, তাহা হইলে তাহার বামহস্তে সেই লৌহচুড়ি কখনই থাকিত না। এদিকে আবার রামহরি বলিতেছে, তাহার স্ত্রীও কলিকাতা হইতে নিরুদ্দেশ। এরূপ অবস্থায় কামিনীর উপর সকলেরই বিশেষ সন্দেহ হইল। অন্য কর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক কামিনীকে অন্বেষণ করাই সকলে স্থির করিলেন। অনেক স্থানে কামিনীর অনুসন্ধান হইল, কিন্তু সেই দিবস কোনস্থানেই তাহাকে পাওয়া গেল না। এক রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল, তথাপি কেহই কামিনীর সন্ধান সংগ্রহে সমর্থ হইল না। উহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত যে সকল কর্মচারী প্রেরিত হইয়াছিলেন, একে একে তাঁহারা সকলেই প্রত্যাগমন করিলেন; কিন্তু কামিনীর সংবাদ কেহই আনিতে সমর্থ হইলেন না। 

পরদিন প্রাতঃকালে আমরা সকলে বাবুর বাড়ীর দ্বারের সম্মুখে বসিয়া আছি, এমন সময় দেখিলাম, দুইটি স্ত্রীলোক সেই দিকে আগমন করিতেছে। উহাদিগের একজনকে দেখিয়া কেহ কহিলেন, “ঐ কামিনী আসিতেছে।” কেহ কহিলেন, না, ঐ রমণী কামিনী নহে, তবে উহার চাল-চলন কামিনীর মত।” কেহ বা কহিলেন, “এ কামিনীই বটে।” সকলের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা চলিতে লাগিল; দেখিতে দেখিতে উহারাও ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইল। নিকটে আসিলে দেখিলাম, সেই রমণী তাপর আর কেহই নহে, যাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমরা সকলেই ব্যগ্র, এ সেই কামিনী। উহার সহিত অপর যে অবগুণ্ঠনবতী রমণী ছিল, তাহাকে দেখিবামাত্রই রামহরি কহিল, এই আমার স্ত্রী, ইহার নামই সুন্দরী। 

কামিনীকে দেখিয়া এবং রামহরির কথা শুনিয়া আমরা সকলেই অবাক্ হইলাম। ক্ষণকালের নিমিত্ত আমাদিগের কাহারও মুখ হইতে কোন কথা বহির্গত হইল না। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাইতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে আমি কামিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি যে প্রথম হইতে এত মিথ্যা কথা কহিলে, তোমার ভগিনীর এখানে আসার কথা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হইলেও তুমি কোনক্রমে তাহা স্বীকার করিলে না। কিন্তু যখন সকলেই তোমাকে সন্দেহ করিল, সকলেই ভাবিল যে, তুমি তোমার ভগিনীকে হত্যা করিয়াছ, তখন তুমি কনষ্টেবলের নিকট হইতে পলায়ন করিলে, এবং এখন দেখিতেছি, তুমি তোমার সেই ভগিনীকে কোথা হইতে আনিয়া এখানে উপস্থিত করিলে এই সকলের উদ্দেশ্য কি?” 

আমার কথা শুনিয়া কামিনী কহিল, “আমার উদ্দেশ্য যাহাই থাকুক না কেন, আপনারা সকলে স্থির করিয়াছিলেন যে, আমি আমার ভগিনী সুন্দরীকে হত্যা করিয়াছি; কিন্তু এখন আমি তাহাকে আনিয়া আপনাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিয়া দিলাম, এখন ত আপনাদিগের সন্দেহ মিটিয়া গেল? আমার ভগিনীর সম্বন্ধে আমার মনে মনে যে কোন রূপ অভিসন্ধিই থাকুক, যে উদ্দেশ্যই থাকুক, তাহা আপনাদিগের জানিয়া প্রয়োজন কি, আর জানিতে চাহিলেই বা আমি আপনাদিগকে বলিব কেন?” 

কামিনীর উত্তর শুনিয়া আমরা অবাক হইলাম। তাহার কথার প্রতি উত্তর করিতে আমরা সমর্থ হইলাম না; বরং বিশেষ লজ্জিত হইয়াই তাহাকে কহিলাম, “যাও, তুমি এখন বাড়ীর ভিতর যাও।” কামিনী তাহার ভগিনীর সহিত বাবুর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। 

রামহরি সেইদিবস সেইস্থানে অবস্থান পূর্ব্বক পরদিবস তাহার স্ত্রীর সহিত আপনার দেশে গমন করিল। আমরা যে কার্য্যে নিযুক্ত ছিলাম, যাহাতে তাহার আর কোন পন্থা বাহির করিতে পারি, সেই বিষয়ে সকলে যত্নবান হইলাম। এই খুনি মোকদ্দমার সন্ধান করিতে লাগিলাম সত্য; কিন্তু কামিনী যে কি নিমিত্ত মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগকে প্রতারিত করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, তাহার গূঢ় রহস্য জানিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত কৌতূহল জন্মিল। পরিশেষে যদিও আমি আমার সেই কৌতূহল নিবারণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, কিন্তু আমি নিতান্ত দুঃখিত হইতেছি যে, কৌতূহলাক্রান্ত পাঠকগণের মনোবাঞ্ছা সম্যকরূপে পূর্ণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। কামিনী-সুন্দরী-সম্বন্ধীয় সমস্ত বিষয় পরিষ্কাররূপে বর্ণন করিয়া লেখনীকে অপবিত্র করিতে চাহি না। তবে এক কথায় পাঠকগণকে এইমাত্র বলিতে পারি যে, কামিনীর আন্তরিক ইচ্ছা ছিল,—সে তাহার ভগিনীর অমূল্য গৌরবের ধন বিনষ্ট করিয়া তাহার সর্ব্বনাশ—সাধন করে। এইরূপ গোলযোগে না পড়িয়া যদি তাহাকে এখন বাহির করিতে না হইত, তাহা হইলে সে যে তাহার দুরভিসন্ধি নিশ্চয় পূর্ণ করিতে সমর্থ হইত, তাহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

বাবুর বাড়ীর বাগানের উত্তর অংশে যে সকল বাড়ীর কথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, তাহার মধ্যে একখানা বাড়ী রামগোপাল বিশ্বাসের। রামগোপাল কলিকাতায় থাকেন না, ময়মনসিংহ অঞ্চলে কনট্রাক্টের কর্ম করেন। রামগোপালের বৃদ্ধা জননী, এবং একমাত্র যুবতী ভাৰ্য্যা এই দুইজনে এই বাড়ীতে সৰ্ব্বদা থাকেন। রামগোপাল বৎসরের মধ্যে দুই তিন বার বাড়ীতে আসিয়া, দশ পাঁচ দিবস অতিবাহিত করেন মাত্র। সপ্তাহ অতীত হইল, রামগোপাল বাড়ীতে আগমন করিয়াছেন। পাড়ায় প্রকাশ যে, এবার রামগোপাল তাঁর স্ত্রীর নিমিত্ত কিছু সোণার অলঙ্কার আনিয়াছেন, এবং যেরূপ পরিমাণ অর্থ পূর্ব্বে পূর্ব্বে আনিতেন, এবার তাহার অপেক্ষা অনেক বেশী অর্থও আনিয়াছেন। 

রামগোপাল বাড়ীতে আসিবার দুই তিন দিবস পরেই তাঁহার গৃহে সিঁদ হইল। রাত্রিতে যখন রামগোপাল তাঁহার গৃহে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলেন, সেই সময় সিঁদ কাটার শব্দে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, চোর তাঁহার গৃহের পশ্চাদ্ভাগে, অর্থাৎ পূর্ব্বকথিত বাগানের উত্তর অংশে বসিয়া, তাঁহার গৃহে সিঁদ কাটিতেছে। বুঝিতে পারিয়াও রামগোপাল কোন প্রকার কোন গোলযোগ করিলেন না, চুপ করিয়া শয়ন করিয়াই রহিলেন। 

রামগোপাল বাল্যকাল হইতেই দেশ-বিদেশে কর্ম্ম-কার্য্য করিয়া আসিতেছেন; সুতরাং অনেক প্রকার দেখিয়াছেন, অনেক প্রকার শ্রবণ করিয়াছেন, এবং অনেক লোকের সঙ্গে সংসারক্ষেত্রে বিচরণ করিয়াছেন। এই সকল কারণেই হউক বা তাঁহার স্বভাব-গুণেই হউক, তিনি কিন্তু সাহসী পুরুষ। রামগোপাল শুইয়া শুইয়া মনে মনে নানাপ্রকার ভাবিতে লাগিলেন, মনে করিলেন—চোর সিঁদ কাটিয়া যেমন তাঁহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিবে, অমনি তিনি তাহাকে ধরিয়া উত্তমরূপে শিক্ষা প্রদান করিবেন। 

এদিকে কিছুক্ষণ পরে সিঁদকাটা সমাপন হইলে, চোর আস্তে আস্তে অতি সন্তর্পণে সেই সিঁদের ভিতর অগ্রে যেমন পদযুগল প্রবেশ করাইয়া দিল, অমনি রামগোপাল তাঁহার শয্যা হইতে একলম্ফে সেইস্থানে গিয়া, চোরের সেই পদযুগল সবলে চাপিয়া ধরিলেন, ও চোর চোর বলিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন। চোরের দেহ গৃহের বাহিরে, পদদ্বয় গৃহের ভিতরে; সুতরাং বেকায়দায় পড়িয়া সে ধরা পড়িল। রামগোপালের চীৎকারে তাঁহার স্ত্রী উঠিল, পাড়ার লোকজন জমিয়া গেল; সুতরাং অনায়াসেই চোর ধরা পড়িল। তাহাকে উত্তমরূপে বাঁধিয়া রামগোপাল পাহারাওয়ালা ডাকাইলেন, ও সেই পাহারাওয়ালার জিম্মায় তাঁহাকে থানায় পাঠাইয়া দিলেন। 

থানায় গমন করিয়া চোর যে প্রকার উত্তর করিল তাহাতে প্রথমে অনেকেই তাহার কথা বিশ্বাস করিলেন। সেই বিষয়ের সত্যাসত্য অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত পরিশেষে আমিই নিযুক্ত হইলাম। এই নিমিত্তই আমি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম, আর তাই বলিয়াই সেইস্থানের অবস্থা অবগত ছিলাম। 

চোর বলিয়াছিল, “রামগোপাল প্রায়ই বাড়ীতে থাকেন না, তাঁহার যুবতী-ভাৰ্য্যা বাড়ীতে থাকেন। প্রায় পাঁচ বৎসর গত হইল, কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে একদিবস আমি সেই স্থানে গিয়াছিলাম। সেইদিবস আমি তাঁহার স্ত্রীকে প্রথম দর্শন করি, ও সেইদিবস হইতেই তাঁহার স্ত্রীর দোষেই হউক বা আমার দোষেই হউক, আমি উহার সহিত অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হই। সেইদিবস হইতে প্রায় প্রত্যহই রাত্রিতে আমি উহার গৃহে গমন করিয়া থাকি। রামগোপাল বাবু বাড়ীতে আসিয়াছেন, এই কথা আমি জানিতে না পারিয়া যেরূপভাবে অন্যদিন গমন করিতাম, সে দিনও সেই রূপে একেবারে উহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম। সুতরাং প্রবেশ করিয়াই সম্মুখে রামগোপাল বাবুকে দেখিতে পাইলাম। তিনি আমার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার স্ত্রীকে অধিক কিছু না বলিয়া, আমাকে ধরিয়াই উত্তম রূপে প্রহার করিলেন। সেইস্থানে আমাকে বাঁধিয়া রাখিয়া, তিনি নিজে তাঁহার গৃহের পশ্চাদ্ভাগে একটি সিঁদ কাটিলেন, এবং আমিই সিঁদ কাটিয়াছি’ এইরূপ গোলযোগ করিলে, পাড়ার কতকগুলি লোক আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। পরে তিনি বন্ধন অবস্থাতেই আমাকে থানায় প্রেরণ করিলেন। এইরূপ পরিষ্কার জ্যোৎস্না-রাত্রিতে কোন চোর সিঁদ কাটে, একথা পূর্ব্বে কখন শুনিয়াছেন কি?” 

অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, রামগোপাল যাহা যাহা বলিয়াছে, আমরা পূর্ব্বে যাহা লিখিয়াছি, তাহার সমস্তই সত্য, বিন্দুমাত্রও মিথ্যা নহে। আর চোর প্রাণের দায়ে যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহার সমস্তই মিথ্যা; অণুমাত্রও সত্য নহে। এই মোকদ্দমা যখন প্রকৃত বলিয়া সাব্যস্ত হইল, তখন সেই চোর বিচারার্থ মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। 

এই মোকদ্দমার প্রধান সাক্ষী—সেই রামগোপাল বিশ্বাস। রামগোপালের হঠাৎ পীড়া হওয়ায় মোকদ্দমার শেষ নিষ্পত্তি হইল না। রামগোপালের সাক্ষ্য লওয়া নিতান্ত আবশ্যক বিবেচনা হওয়াতে, এই মোকদ্দমা পনর দিবসের নিমিত্ত মুলতুবি রহিল। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

আজ চোরের মোকদ্দমার দিবস। রামগোপাল আসিয়া আজ মাজিষ্ট্রেট সাহেবের কোর্টে উপস্থিত হইয়াছেন, এবং সেই পাড়ার অনেক লোক সেই চোরের কি হয়, দেখিতে আসিয়াছেন। সময় মত মাজিষ্ট্রেট সাহেব এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ করিলেন। রামগোপাল প্রভৃতি সেই পাড়ার অনেক লোকের সাক্ষ্য গৃহীত হইল। পরিশেষে দেখিলাম যে, মহেন্দ্রনাথ দাস নামক এক ব্যক্তি সাক্ষীমঞ্চে দণ্ডায়মান হইলেন। অনুসন্ধানের সময় আমি ইঁহাকে দেখি নাই, এবং কোন বিষয়ে যে ইনি সাক্ষ্য প্রদান করিবেন, তাহাও আমি অবগত নহি। মহেন্দ্ৰনাথ কি সাক্ষ্য প্রদান করেন, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমি একটু ব্যস্ত হইলাম, এবং মনোযোগের সহিত তাঁহার কথাগুলি শ্রবণ করিতে লাগিলাম। মহেন্দ্রনাথের জবানবন্দী এইরূপে গৃহীত হইল;—

উকীল। তোমার নাম কি? 

মহেন্দ্র। আমার নাম শ্রীমহেন্দ্রনাথ দাস। 

উকীল। তুমি কোথায় থাক, এবং কি কার্য্য কর? 

মহেন্দ্র। রামগোপাল বিশ্বাসের বাড়ীর নিকট আমার বাড়ী। বড়ম্ ব্রাদারের বাড়ীতে আমি কেরাণীগিরি কর্ম্ম করি। 

উকীল। যে দিবস এই চোর ধৃত হয়, সেই দিবসের ঘটনা তোমার মনে হয় কি? 

মহেন্দ্র। হ্যাঁ মহাশয়! উত্তমরূপ মনে আছে। 

উকীল। কি ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহা তুমি বিস্তৃত রূপে বল। 

মহেন্দ্র। আজ প্রায় পনর কি ষোল দিবস অতীত হইল, একদিবস রাত্রিকালে কোন সামান্য কথা উপলক্ষে আমার স্ত্রীর সহিত আমার বিবাদ হয়। আমার স্ত্রী অতিশয় অভিমানিনী। সে আমার কথা শুনিয়া ক্রোধে একবারেই অধীরা হইয়া পড়ে, ও আত্মহত্যা করিবে, এই সঙ্কল্প করিয়া আমার গৃহ হইতে বহির্গত হয়। সেই সময়ে আমারও অন্তঃকরণে ক্রোধের সঞ্চার হইয়াছিল, সুতরাং আমিও কোন প্রকারে তাহার গতিরোধ করি নাই, বা সে যে কোথায় গমন করিল, তখন তাহারও কোন প্রকার অনুসন্ধান লই নাই। মনে করিয়াছিলাম, আমার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া সে নিশ্চয়ই অন্য গৃহে গিয়া শয়ন করিবে। স্ত্রী আমার গৃহ পরিত্যাগ করিবার কিয়ৎক্ষণ পরে আমার ক্রোধের কথঞ্চিৎ শান্তি হইল। তখন ভাবিলাম, যখন সে আত্মহত্যা করিবে বলিয়া আমার গৃহ পরিত্যাগ করিয়াছে, তখন আমার অনুসন্ধান করিয়া দেখা উচিত যে, সে কোথায় গমন করিল। স্ত্রীলোকের ক্রোধ অতি প্রচণ্ড, এবং জীবনের মায়াও অতি সামান্য। তাহারা সামান্য কথায় বা সামান্য কারণে সংসারের মায়া পরিত্যাগ করিয়া, অমূল্য জীবনকে নষ্ট করিতে ক্ষণকালের নিমিত্তও বিচলিত হয় না। এরূপ অবস্থায় আমার স্ত্রী কোথায় গমন করিল—তাহা এখনই আমার দেখা কৰ্ত্তব্য; এই ভাবিয়া তখনই আমি আমার গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। বাড়ীর ভিতর সমস্তই সন্ধান করিলাম, কিন্তু কোনস্থানেই তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। বাড়ীর ভিতর অন্যান্য গৃহে আমার মাতা, এবং ভগিনী শয়ন করিয়াছিলেন। নিকটে গিয়া দেখিলাম, সেই সকল গৃহের দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। দ্বারের নিকট কিয়ৎক্ষণ দণ্ডায়মান থাকিলাম, ভাবিলাম, আমার স্ত্রী যদি উঁহাদিগের কাহারও গৃহে প্রবেশ করিয়া থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাঁহাদিগের কথোপকথন শ্রবণ করিতে পাইব; আমার কিন্তু সে আশা সফল হইল না। কাহারও গৃহ হইতে কোন কথাই শুনিতে পাইলাম না। বরং বোধ হইল যে, তাঁহারা সকলেই নিদ্রায় অভিভূতা। এই অবস্থায় আমার অন্তরে অতিশয় ভয় হইল, আতঙ্কে হৃদয় কাঁপিতে লাগিল। কি করি, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, ক্ষণকাল সেইস্থানে দণ্ডায়মান রহিলাম। একবার, ভাবিলাম, আমার মাতা ও ভগিনীকে উঠাই, তাঁহাদিগকে সমস্ত কথা বলি; কিন্তু ঘোর লজ্জা আসিয়া আমার সেই ইচ্ছার গতি রোধ করিল, উহাদিগকে ডাকিতে পারিলাম না। 

“পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম যে সকল খালি গৃহ ছিল, তাহা দেখিলাম। রান্নাঘরে অনুসন্ধান করিলাম, পায়খানার ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু কোনস্থানেই তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। এইরূপ অবস্থায় পড়িয়া হঠাৎ আমার বুদ্ধিভ্রম হইয়াছে বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কোন স্থানে তাহার সন্ধান করা উচিত, কোন্ স্থানে সন্ধান করিলে সফলতা লাভ করা যাইতে পারে, তাহা ভুলিয়া গেলাম। মনে ভাবিলাম, হয়ত সে আমার গৃহেই আছে। পুনরায় আমার গৃহে প্রবেশ করিলাম, শয্যার উপর তাহার অনুসন্ধান করিলাম, খাটের নীচে গিয়া খুঁজিলাম, গৃহের ভিতর একটি বড় বাক্স ছিল তাহাও খুলিয়া দেখিলাম; কিন্তু কোনস্থানে তাহাকে না পাইয়া পুনরায় আমার গৃহের বাহিরে আসিলাম। যে সকল স্থানে পূর্ব্বে অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, একবার দুইবার করিয়া ক্রমে অনেকবার সেইসকল স্থানে পুনরায় তাহাকে খুঁজিতে লাগিলাম; কিন্তু কোনস্থানেই তাহাকে দেখিতে পাইয়া নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে একস্থানে বসিয়া পড়িলাম। আমি যে ইচ্ছা করিয়া সেইস্থানে বসিলাম, তাহা নহে; বোধ হইল, কে যেন আমাকে জোর করিয়া সেইস্থানে বসাইয়া দিল।” 

“সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া আমি নানাপ্রকার ভাবিতে লাগিলাম, নানাপ্রকার অমঙ্গল ঘটনার আশঙ্কা করিতে লাগিলাম। সেই সময়ে হঠাৎ খিড়কী দ্বারের উপর আমার দৃষ্টি পতিত হইল। তখন পরিষ্কার জ্যোৎস্নালোকে দেখিতে পাইলাম যে, আমাদের বাড়ীর খিড়কীদ্বার খোলা। এই অবস্থা দেখিয়া হৃদয় আশায় পূর্ণ হইল। ক্ষণকালের নিমিত্ত ভাবিলাম, আমার স্ত্রী দ্বার খুলিয়া বাড়ীর বাহিরে বসিয়া আছে। অমনি সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া খিড়কী দ্বারের নিকট গমন করিলাম। আশায় বুক বাঁধিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম; কিন্তু সে স্থানে কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তাহার নিকটবর্তী স্থান সকল দেখিলাম, বাটীর চতুষ্পার্শ্ব অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনস্থানেই আমার স্ত্রীকে দেখিতে পাইলাম না। যে আশায় হৃদয় হঠাৎ উৎসাহিত হইয়াছিল, সেই আশা হৃদয় হইতে সুদূরে পলায়ন করিল। অনন্যোপায় হইয়া পাগলের ন্যায় একস্থানে পুনরায় উপবেশন করিলাম। বসিয়া বসিয়া কত প্রকার ভাবী অমঙ্গল চিন্তা করিতে লাগিলাম।” 

নবম পরিচ্ছেদ 

“সেই খিড়কী দ্বারে আমি যে কতক্ষণ বসিয়া রহিলাম, তাহা বলিতে পারি না। সেই সময় পরিষ্কার জ্যোৎস্নালোকে নিকটবর্ত্তী সমস্ত স্থানই ভালরূপ দেখা যাইতেছিল। নিকটবর্ত্তী বাগানের ভিতর একটি আম্র বৃক্ষতলে বোধ হইল, কে যেন অতি স্থিরভাবে বসিয়া আছে। আমি সাহসে বুক বাঁধিয়া উঠিলাম, ধীরে ধীরে সেইস্থানে গমন করিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মনের সমস্ত আবেগ চলিয়া গেল। পাগলের ন্যায় হইয়া এতক্ষণ যাহার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছিলাম, দেখিলাম, এই আম্র-বৃক্ষতলে আমার সেই অঙ্কলক্ষ্মী। যেরূপ ক্রোধের বশীভূতা হইয়া সে আমার গৃহ পরিত্যাগ করিয়াছিল, এখন আর সেই ক্রোধের চিহ্নমাত্র নাই। বরং ইহাকে আরও অধিক ভীতা বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কথা কহিতে সে আমায় ইঙ্গিতে নিষেধ করিয়া গাত্রোত্থান করিল, ও আমার কাণে কাণে কয়েকটি কথা বলিল; পরে সেই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমার স্ত্রীর কথায় আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম। সেই বাগানের অপর প্রান্তাভিমুখে একবার চাহিলাম; কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে রামগোপালের গৃহের পশ্চাদ্ভাগে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলাম, সৰ্ব্বনাশ! ভাবিলাম, আমার স্ত্রী যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহার দেখিতেছি—কতক প্রকৃত। দেখিলাম, এই চোর রামগোপালের গৃহের পশ্চাদ্ভাগে বসিয়া সিঁদ কাটিতেছে। দেখিতে দেখিতে সিঁদকাটা শেষ হইয়া গেল। চোর গৃহের ভিতর যেমন তাহার পদদ্বয় প্রথমে প্রবেশ করাইয়া দিল, অমনি সে রামগোপাল কর্তৃক ধৃত হইল। পাড়ার অনেকে একত্র হইয়া তাহাকে বাঁধিল। আমিও সেইস্থান হইতে আপন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক দ্বার বন্ধ করিয়া দিলাম। যে ব্যক্তিকে আমি সিঁদ কাটিতে দেখিয়াছিলাম, এ সেই ব্যক্তি, ইহা আমি শপথ করিয়া নিশ্চয় বলিতে পারি।” 

মহেন্দ্রনাথের এই কথা শ্রবণ করিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিলেন: চোরকে দোষী সাব্যস্ত করিয়াও সেইদিবস তাহার দণ্ডাজ্ঞা প্রদান করিলেন না; পুনরায় সাতদিবসের জন্য তাহার বিচার স্থগিত থাকিল। ইতিপূর্ব্বে ঐ ব্যক্তি আরও দুই তিন বার শাস্তি পাইয়া জেলে গমন করিয়াছিল, সেই সকল পুরাতন শাস্তির তারিখ সংগ্রহ করিবার নিমিত্তই পুনরায় মোকদ্দমার দিন পড়িল। 

মহেন্দ্রনাথ তাহার স্ত্রীর নিকট হইতে অবগত হইয়াছিল যে, চোর রামগোপালের গৃহে সিঁদ দিতেছে। একথা সহজেই ত বুঝিতে পারিলাম, কিন্তু তাহার স্ত্রী আরও যে কি বলিয়াছিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। বাগানের অপর প্রান্তে যে কি দেখিবার নিমিত্ত মহেন্দ্ৰনাথ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়াছিল, তাহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে সমর্থ হইলাম না। তাহার স্ত্রী যে কি বলিয়াছিল, তাহাই জানিবার নিমিত্ত তখন আমার একান্ত কৌতূহল জন্মিল। হঠাৎ তাহার সেই প্রচণ্ড ক্রোধ কেনই বা অন্তর্হিত হইয়াছিল, তাহাও জানিবার নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইলাম। 

আমি মহেন্দ্রনাথের বাড়ী জানিতাম। সন্ধ্যার পূর্ব্বে একাকী তাহার বাড়ীতে গমন করিলাম। মহেন্দ্রনাথ তাহার বাড়ীতেই ছিল, তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইল। মহেন্দ্রনাথ আমাকে চিনিত, প্রায় দুই ঘণ্টাকাল তাহার বাড়ীতে বসিয়া বসিয়া উভয়ে অনেক গল্প করিলাম। পরিশেষে কহিলাম “তুমি মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট আজ যে সকল কথা বলিয়াছিলে, তাহার দুই একটি কথা বিশেষ করিয়া জানিবার নিমিত্ত আমার একান্ত কৌতূহল জন্মিয়াছে, সেই জন্য আজ আমি তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। তুমি সেই রাত্রিতে সেই বাগানের ভিতর তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে কি কি কথা অবগত হইতে পারিয়াছিলে, তোমাকে তিনি কি দেখাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহাই জানিবার নিমিত্ত জানি না, কেন আমার মন অস্থির হইয়াছে।” 

আমার কথা শুনিয়া মহেন্দ্রনাথ প্রথমে সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে যেন একটু অসম্মত হইল; কিন্তু আমার অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া, পরিশেষে সম্মত হইল। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট সে যে সকল কথা বলিয়াছিল, ক্রমে ক্রমে তাহার সমস্তই আমার নিকট পুনরায় কহিল, এবং তাহার স্ত্রী সেই আম্র-বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া তাহাকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, এবং যাহা যাহা দেখাইয়া দিয়াছিল, তাহাও বিস্তৃতরূপে কহিল। মহেন্দ্রের কথা শুনিয়া আমার সমস্ত কৌতূহলই নিবৃত্ত হইল। মনে মনে একটু আনন্দ এবং আশাও হইল। কি কারণে আমার মনে আনন্দ হইল, এবং কিসের আশা আসিয়া আমার হৃদয়ে প্রবেশ করিল তাহা মহেন্দ্রনাথ কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারিল না। পাঠকগণ বুঝিতে পারিয়াছেন কি না, জানি না। 

সন্ধ্যার পর আপনার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম। নিয়মিত সময়ে শয়নও করিলাম, কিন্তু সমস্ত রাত্রির ভিতর কোন প্রকারে নিদ্রা আসিল না। মহেন্দ্রনাথ আমাকে যাহা বলিয়াছিল, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে এবং কোন উপায় অবলম্বন করিলে আমার অভিলাষ সুসিদ্ধ হইতে পারে, তাহাই চিন্তা করিতে করিতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। 

দশম পরিচ্ছেদ 

পরদিবস প্রাতঃকালে হরিণবাড়ীর জেলে গমন করিয়া, সেই চোরের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাহাকে কহিলাম, সিঁদের মোকদ্দমায় মাজিষ্ট্রেট সাহেব তোমার দোষ সাব্যস্ত করিয়াছেন, একথা সে দিবস তুমি বুঝিতে পারিয়াছ কি?” 

উত্তরে চোর কহিল, “ মোকদ্দমায় আমার আর নিস্তার নাই, একথা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি।”

আমি। যখন তুমি বুঝিতে পারিয়াছ, এই মোকদ্দমায় তোমার জেল নিশ্চয়, তখন যদি আমি তোমাকে কোন প্রকারে বাঁচাইবার চেষ্টা করি, তাহাতে তোমার কোনরূপ আপত্তি আছে কি? 

চোর। আপনার প্রস্তাবে আমার কোনরূপ আপত্তি নাই, কিন্তু এখন এই মোকদ্দমা-সম্বন্ধে যদি আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে তাহার ঠিক উত্তর আমার নিকট হইতে কোনরূপেই পাইবেন না। 

আমি। আমি তোমাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব সত্য, কিন্তু এই মোকদ্দমা-সম্বন্ধে তোমাকে এমন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিব না, যাহাতে তোমার কোন প্রকার অনিষ্ট হইতে পারে। 

চোর। তবে আমাকে কি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন? 

আমি। যে দিবস তুমি মহেন্দ্রনাথ কর্তৃক ধৃত হও, সেই দিবস যে তুমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলে, সে কথা তুমি কোন প্রকারেই অস্বীকার করিতে পার না। কারণ, ইহা স্থির যে, তুমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলে; তবে চুরি করিবার অভিপ্রায়েই যাও, বা অন্য কোন অভিসন্ধিই থাকুক। 

চোর। হাঁ মহাশয়! আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম সত্য; কিন্তু চুরি করিবার অভিপ্রায়ে গমন করি না। যে নিমিত্ত আমি গমন করিয়াছিলাম, তাহা আপনাদিগকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি। 

আমি। তুমি যখন সেইস্থানে দণ্ডায়মান ছিলে সেই সময়ের অবস্থা একবার মনে করিয়া দেখ দেখি। সেই সময়ে দুইটি লোক সেইস্থান দিয়া চলিয়া যাইতেছিল। তাহারা তোমার পরিচিত, তোমাকে দেখিবামাত্র তাহারা সেইস্থানে দাঁড়াইল, এবং তোমার সহিত দুই একটি কথা বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। 

চোর। কেন মহাশয়! সেই লোকদিগের কথায় আপনার প্রয়োজন কি? পুনরায় কি তাহাদিগকে ডাকাইয়া আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়াইতে চাহেন? 

আমি। এই মোকদ্দমায় তোমার বিপক্ষে প্রমাণ হইয়া গিয়াছে; সুতরাং তোমার বিরুদ্ধে অপর সাক্ষীর আর প্রয়োজন নাই। অন্য কর্ম্মের নিমিত্ত আমি তাহাদিগের সন্ধান করিতেছি। যে অভিলাষে আমি উহাদিগের সন্ধান করিতেছি, আমার যদি সেই অভিলাষ সুসিদ্ধ হয়, তাহা হইলে বোধ হয়, তোমারও বিশেষ উপকার দর্শিতে পারে। 

চোর। আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা ত হইবেই হইবে। কিন্তু উহাদিগের নাম জানিতে পারিলে যদি আপনার উপকার হয়, তাহা হইলে আমি আপনাকে উহাদিগের নাম বলিয়া দিতেছি, আপনি লিখিয়া লউন। উহাদিগের নাম সাতকড়ি দাস, এবং মাখমলাল দত্ত। 

আমি। সেই দুই ব্যক্তি কোথায় থাকে, বলিতে পার কি? 

চোর। তাহাও বলিতে পারি। যে স্থানে আমি দণ্ডায়মান ছিলাম, তাহার কিয়দ্দূর পূর্ব্বে প্রসন্ন বাড়ীওয়ালীর বাড়ী; উভয়েই সেই বাড়ীর ভাড়াটিয়া। 

সেই চোরের নিকট হইতে এই কয়েকটি কথা অবগত হইয়া, আমি আপনার স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। স্নান আহার প্রভৃতি সমাপন পূর্ব্বক যাঁহার অন্তঃপুরের ভিতর লাস পাওয়া গিয়াছিল, সেই বাবুর বাড়ীতে উপনীত হইলাম। বাবু বাড়ীতেই ছিলেন, একান্তে লইয়া গিয়া আমি তাঁহাকে বন্ধুভাবে দুই চারিটি কথা কহিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনি নিতান্ত দুঃখিত ও মর্মাহত হইলেন। কোন উপায় অবলম্বন করিলে, তিনি এই লজ্জাজনক অবমাননা হইতে আপনাকে রক্ষা করিতে পারেন, তাহারই পরামর্শ এবং উপায় জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি কোন উপায় অবলম্বন করিয়া তাহাকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিব, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিলাম, এবং তাঁহার অন্তঃপুরের ভিতর আর একবার গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। বাবু আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। যে গৃহে লাস পাওয়া গিয়াছিল, উভয়েই পুনরায় সেই গৃহে গমন করিলাম। সেই গৃহ বিশেষ করিয়া পুনরায় অনুসন্ধান করিলাম। আমাদিগের অনুসন্ধানোপযোগী আর কোন দ্রব্যই পাইলাম না, কেবলমাত্র দেখিলাম, সেই গৃহের ভিতর অতি মজবুত এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি সদৃশ স্কুল দুই গাছি বড় দড়ি রহিয়াছে। এক হস্ত-পরিমিত লম্বা এবং সচরাচর যেরূপ কাষ্ঠের ‘রুল’ আমরা ব্যবহার করিয়া থাকি, তাহা অপেক্ষা কিছু মোটা, একখানি কাষ্ঠের টুকরা সেই দড়ির এক এক প্রান্তে আবদ্ধ। 

পূর্ব্বে যে ছাদের কথা পাঠকগণকে বলিয়াছি, সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, কাষ্ঠনির্ম্মিত একখানি উচ্চবেঞ্চ সেই ছাদের উপর রহিয়াছে। প্রাচীরের নিকট সেই বেঞ্চখানি লইয়া গেলাম। উহার উপর দণ্ডায়মান হইলাম, দেখিলাম তাহার উপর দাঁড়াইলে সেই প্রাচীরের উপর দিয়া সেই বাগানের অনেক স্থান দৃষ্টিগোচর হয়। সেই প্রাচীরের উপর দিয়া ভাল করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, উহার বাহির দিকের কোন কোন স্থানের বালুকা যেন উঠিয়া গিয়াছে এবং লম্বা লম্বা চিহ্ন পড়িয়াছে। ঐ সকল চিহ্নের অধিকাংশই প্রাচীরের উপর হইতে আরম্ভ হইয়া বাহিরে দিকে কিয়দ্দূর পৰ্য্যন্ত নামিয়া শেষ হইয়াছে। এই সকল ব্যাপার দেখিয়া আমরা উভয়েই বাহির বাড়ীতে গমন করিলাম। বাবু নিতান্ত বিষণ্নমনে আপনার বৈঠকখানায় উপবেশন করিলেন। আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

প্রসন্ন বাড়ীওয়ালী যে বাড়ীতে থাকে, তাহা ব্যতীত তাহার আরও একখানি বাড়ী আছে; সেই বাড়ীর ভাড়াটিয়া সাতকড়ি দাস, ও মাখমলাল দত্ত। মাখমলাল দত্ত বাহিরের একখানি গৃহে থাকে, তাহার এখানে আর কেহই নাই, সে একাকী সেইস্থানে থাকিয়া রেলওয়ে আফিসে কর্ম্ম করে। উক্ত বাড়ীর ভিতর তিনটিমাত্র গৃহ আছে, তাহাতে সাতকড়ি দাস, এবং তাহার পত্নী অবস্থিতি করিয়া থাকে। সাতকড়িও রেলওয়ে আফিসে চাকরী করিয়া থাকে। ইহারা উভয়েই দিবা দশটার সময় আপন আপন কৰ্ম্মস্থানে গমন করে, কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টার পূর্ব্বে প্রত্যাগমন করে না। সমস্তদিন কেবলমাত্র সাতকড়ির স্ত্রী—বিরাজ বাড়ীতে থাকে। 

সন্ধ্যা সাতটার পর আমি তাহাদিগের বাড়ীতে গমন করিলাম। সেই সময়ে উভয়েই বাড়ীতে উপস্থিত ছিল, উভয়েরই সহিত সাক্ষাৎ হইল, উভয়কেই কোন কথা জিজ্ঞাসা করাতে তাহারা অস্বীকার করিল। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, সাতকড়ির স্ত্রী সেই বাড়ীর ভিতর নাই। জিজ্ঞাসা করায় উভয়েই উত্তর করিল যে, বিরাজ তাহার পিতার বাড়ীতে গমন করিয়াছে। এই কথা আমার বিশ্বাস হইল না; আমি তাহাদিগের গৃহের ভিতর অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। অনুসন্ধান করিয়া যে সকল দ্রব্য প্রাপ্ত হইলাম, তাহাতে আমার মনে আরও সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম, একটি বাক্সের ভিতর কতকগুলি পুরাতন এবং ব্যবহৃত তালঙ্কার রহিয়াছে। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, সেই তালঙ্কারগুলি সাতকড়ির স্ত্রী বিরাজের। এদেশীয় স্ত্রীলোক তাহার পরিহিত সমস্ত অলঙ্কার পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক যে পিত্রালয়ে গমন করিবে, তাহা আমার বুদ্ধিতে সহজে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। অপর একটি বাক্সের মধ্যে একখানি কোরা-কাচা কালাপেড়ে শাড়ী পাইলাম। লাসের সহিত প্রাপ্ত যে শাড়ীখানি থানায় ছিল, তাহা তখন আনাইয়া মিলাইয়া দেখিলাম, যে উভয় শাড়ী একই প্রকারের ও একই জোড়ার। আরও বেশ বুঝিতে পারা গেল যে, উভয় বস্ত্রই জোড়াভাবেই ধোপাবাড়ী হইতে কাচা হইয়া আইসে। পরিশেষে কাঁচিদ্বারা সেই জোড়া কাটিয়া দুই খণ্ড পৃথক করা হয়। কাটিবার সময় স্থানে স্থানে ছিলাও প্রায় কাটিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে, স্থানে স্থানে সমান কাটাও হইয়াছে। এইরূপে কাটিবার ব্যতিক্রম অনুসারে উভয় বস্ত্রের ছিলা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, উক্ত উভয় বস্ত্ৰ একই জোড়ার। 

উহাদিগের নিকট হইতে যখন প্রকৃত উত্তর পাইলাম না, তখন উভয়কেই সঙ্গে লইয়া মহেন্দ্রনাথের বাড়ীতে গমন করিলাম। মহেন্দ্রনাথ তাহার স্ত্রীর নিকট যে সকল কথা শ্রবণ করিয়াছিল, তখন সেই সকল কথা পুনরায় তাহাকে ইহাদিগের সম্মুখে কহিতে কহিলাম। মহেন্দ্রনাথ আমাকে ভালরূপ জানিত, আমিও যে বিষয়ের অনুসন্ধানে নিযুক্ত তাহাও এখন তাঁহাকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিলাম। মহেন্দ্রনাথ প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত কথা একে একে কহিতে লাগিলেন। পাঠকগণ যে সকল বিষয় পূর্ব্বেই শ্রবণ করিয়াছেন, মহেন্দ্রনাথ প্রথমে তাহাই বর্ণন করিলেন, এবং পরিশেষে কহিলেন, “যখন আমার স্ত্রী ক্রোধভরে বাড়ী হইতে বহির্গত হয়, সেই সময় সে দেখিতে পায়,—দুইটি মনুষ্য সেইস্থান দিয়া গমন করিতেছে। উহাদিগের একজনের মস্তকে একটি টিনের বড় বাক্স, অপর ব্যক্তি সেই বাক্স-বাহীর পশ্চাৎ পাচাৎ গমন করিতেছে। উহারা উভয়েই উক্ত বাক্স-সমেত বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল ও ক্রমে বাবুর অট্টালিকার পশ্চাদ্ভাগে উপনীত হইল। সেইস্থানে সেই বাক্স মাটিতে রাখিয়া উভয়েই ক্ষণকালের নিমিত্ত উপবেশন করিল। সেই সময় দেখা গিয়াছিল, বাবুর ভিতর বাড়ীর প্রাচীরের উপর হইতে একখানি কাষ্ঠে বাঁধা দুইগাছি মোটা রজ্জু ঝুলিতেছে। উহারা সেই কাষ্ঠের সহিত উক্ত বাক্সটি উত্তমরূপে বাঁধিয়া দিয়া একটু অন্তরালে দাঁড়াইল। ক্ষণকাল মধ্যে রজ্জুসহিত কাষ্ঠে বাঁধা সেই বাক্সটি ক্রমে উপরে উঠিতে লাগিল। বোধ হইল, উপর হইতে যেন কোন ব্যক্তি সেই রজ্জু ধরিয়া উহা ক্রমে উপরে উঠাইয়া লইতেছে। দেখিতে দেখিতে বাক্স প্রাচীরের উপরে উঠিয়া গেল, এবং প্রাচীরের উপর হইতে কে যেন উহা ভিতরে নামাইয়া লইল। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই ব্যক্তিদ্বয় পূর্ব্বোক্ত স্থান হইতে বহির্গত হইয়া যে দিক্ হইতে আগমন করিয়াছিল, সেইদিকে প্রত্যাগমন করিল। পথে একটি চোরের সহিত তাহাদিগের সাক্ষাৎ হয়। সেই চোর উহাদিগের পরিচিত বলিয়া বোধ হইল। কারণ, সেই চোরের সহিত তাহারা দুই একটি কথা বলিয়া, সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল।” 

সাতকড়ি ও মাখমলাল মহেন্দ্রনাথ-প্রমুখাৎ ঐ সকল কথা শ্রবণ করিলে, পূর্ব্বোক্ত চোর আমাকে যাহা যাহা বলিয়াছিল তাহাও উহাদিগকে বলিলাম। আরও কহিলাম, “সেই চোরই তোমাদিগের নাম ও ঠিকানা আমাকে বলিয়া দিয়াছে বলিয়া আমি তোমাদিগকে ধৃত করিতে সমর্থ হইয়াছি।” 

উহারা আরও দেখিল যে, সাতকড়ির শ্বশুর বাড়ীতে একজন কর্ম্মচারী তখনই প্রেরিত হইল। সেইস্থানে কৰ্ম্মচারী গমন করিলেই অবগত হইবে যে, তাহার স্ত্রী—বিরাজ সেইস্থানে গমন করে নাই। 

এই সকল ব্যাপার দেখিয়া, এবং উক্ত সকল কথা শ্রবণ করিয়া, দেখিলাম, উহারা যেন কিছু ম্লান হইয়া পড়িল, ও পরিশেষে আপন আপন দোষ স্বীকার করিয়া সমস্ত কথা সৰ্ব্ব সমক্ষে বলিয়া ফেলিল। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

মাখমলাল দত্ত প্রথমেই কহিল, “মহাশয়! আমি এখন সমস্ত কথাই প্রকাশ করিব, কোন কথা গোপন করিব না। আপনি যাহা বলিলেন, এবং মহেন্দ্র বাবুর নিকট যাহা শ্রবণ করিলাম, তাহার সমস্তই সত্য; উহার একবর্ণও মিথ্যা নহে। যে দিবস এই ঘটনা ঘটে, সেইদিবস নিয়মিত সময়ে আমি আমার কর্ম্মস্থান হইতে প্রত্যাগমন করি। বাড়ী আসিয়া, দেখি, সাতকড়ি বাড়ীর সদর দ্বারের উপর বসিয়া আছে। আজ তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ, অথচ গভীর চিন্তায় নিবিষ্ট। আমি তাহার নিকট গিয়া দণ্ডায়মান হইলাম; কিন্তু সে কিছুই বুঝিতে পারিল না যে, কেহ তাহার নিকট আগমন করিয়াছে। আমি তাহাকে ডাকিলে সে যেন নিদ্রোত্থিতের ন্যায় গাত্রোত্থান করিয়া সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইল; কিন্তু আমার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না, কেবলমাত্র আমার হস্তধারণ করিয়া যে গৃহে শয়ন করিত, সেই গৃহের ভিতর লইয়া গেল। সে যে আমাকে সেইরূপ ভাবে ধরিয়া কেন তাহার গৃহের ভিতর লইয়া গেল, তাহা প্রথমে বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া আমার বুদ্ধিলোপ হইল, অজ্ঞান হইয়া সেইস্থানে ক্ষণকালের নিমিত্ত বসিয়া পড়িলাম। পরে দেখিলাম, সেই গৃহের মেজের সাতকড়ির স্ত্রী—বিরাজ গড়াগড়ি যাইতেছে। তাহার ধড় একস্থানে পড়িয়া রহিয়াছে, মস্তক অপর স্থানে দেখা যাইতেছে। মৃতদেহ যে কেবলমাত্র দুইভাগে বিভক্ত—তাহা নহে, উহার উপর বোধ হয়, শত কোপের দাগ বসিয়াছে। এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ কি?” উত্তরে সাতকড়ি কহিল, “আর কি? আমি আমার স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছি! আজ সেই পাপীয়সী কুল-কলঙ্কিনী যেমন কার্য্য করিয়াছে, তাহার সেইরূপ উপযুক্ত প্রতিফল আমি স্বহস্তে প্রদান করিয়াছি!” 

“তোমার স্ত্রীর উপযুক্ত পুরস্কার ত দিয়াছ। কিন্তু এখন তোমার উপায় কি?” 

“উপায় আর আমি কি বলিব? যাহা করিতে হয় কর; নতুবা অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহাই হইবে। আপনার প্রাণের মায়া করিয়া কে তাহার স্ত্রীর ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখিতে সমর্থ হয়?” 

“এই অবস্থা দেখিয়া এবং সাতকড়ির মুখে এই কয়েকটি কথা শ্রবণ করিয়া, আমারও হৃদয়ে বাস্তবিক কষ্টের উদয় হইল। যদি উহাকে কোন প্রকারে বাঁচাইতে পারি, তখন তাহারই উপায় উদ্ভাবন করিতে চেষ্টা করিলাম। একবার ভাবিলাম, পুলিসে সংবাদ দিই; কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম পুলিসে এই বিষয় অবগত হইতে পারিলেই সাতকড়ির ফাঁসী নিশ্চয়। এরূপ অবস্থায় সংবাদ প্রদান না করাই ভাল যদি কোনরূপ কৌশলে উক্ত লাস স্থানান্তরিত করিয়া অন্য কাহারও উপর সন্দেহ জন্মাইয়া দেওয়া যাইতে পারে, তাহা হইলে সাতকড়ি বাঁচিলেও বাঁচিতে পারে। এই ভাবিয়া আমি সাতকড়িকে সাহস দিয়া বহির্গত হইয়া গেলাম। একটি ভাল রকমের টিনের বাক্স ক্রয় করিয়া আনিয়া উহার ভিতর উক্ত মৃতদেহ উত্তমরূপে প্রবেশ করাইয়া দিলাম। তাহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কারাদি ছিল, তাহা সমস্তই খুলিয়া লইলাম। 

মনে করিলাম, রাত্রিতে এই বাক্স লইয়া গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করিব। কিন্তু সে পথ অবলম্বন করিতে মনে মনে ভয় হইল। কারণ, বড় রাস্তার উপর দিয়া সেই বাক্স লইয়া গমন করিবার কালে কোন প্রহরীহস্তে যদি ধৃত হই, তাহা হইলে আমাদিগের উভয়েরই বাঁচিবার আর প্রত্যাশা থাকিবে না। বিশেষতঃ সেই ভারী বাক্স বহন করিয়া এত পথ লইয়া যাইতেও আমাদিগের মধ্যে কেহই সমর্থ নহে। এরূপ অবস্থায় এখন আমাদিগের কি করা কর্তব্য, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। সেই সময় হঠাৎ আমার মনে একটি কথার উদয় হইল। তখনই বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। দেখিলাম, মনে যে পথাবলম্বনের চেষ্টা করিতেছিলাম, সেই পথ পরিষ্কার অবস্থাতেই আমাদিগের সম্মুখে বর্তমান রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া পুনরায় বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম।” 

“বাবুদের বাগানের পার্শ দিয়া যে সঙ্কীর্ণ পথ আছে, সেই পথ দিয়া আমি কখন কখন গমনাগমন করিয়া থাকি। উহা সর্ব্বসাধারণের গমনাগমনের পথ নহে। একদিবস রাত্রিতে কোন কার্য্যোপলক্ষে আমি উক্ত পথ দিয়া গমন করিতে ছিলাম, সেই সময় দেখিলাম, একটি মনুষ্য পূর্ব্বোক্ত বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। উহাকে অধিক রাত্রিতে সেইস্থানে প্রবেশ করিতে দেখিয়া, আমার মনে হঠাৎ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, আমাকে দেখিতে হইবে এত রাত্রিতে এ কোথায় গমন করে। এই ভাবিয়া আমি সেইস্থানে চুপ করিয়া দণ্ডায়মান রহিলাম। দেখিলাম, সে ব্যক্তি ক্রমে সেই উদ্যান-সংলগ্ন দ্বিতল অট্টালিকার নিকট গমন করিল। আরও দেখিলাম, সেইস্থানে দুইগাছি রজ্জু-সংবদ্ধ একখানি কাষ্ঠ উপর হইতে ঝুলিতেছিল। সে উক্ত কাষ্ঠের উপর আপনার পদযুগল স্থাপন পূৰ্ব্বক সেই রজ্জু ধরিয়া নাড়া দিল, আর কে যেন তাহাকে উপর হইতে আস্তে আস্তে উঠাইয়া লইল। এই অবস্থা দেখিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম, ও অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সেইস্থানে দণ্ডায়মান রহিলাম; কিন্তু তাহাকে অবতরণ করিতে আর দেখিলাম না। এইরূপ প্রায় প্রতি রাত্রিতে আমি দেখিয়াছি, সেই রজ্জু সেইস্থানে লম্বিত রহিয়াছে। কথিত দিবসেও গমন করিয়া দেখিলাম যে, উহা পূৰ্ব্বমতই সেই বাগানের ভিতর উপর হইতে ঝুলান রহিয়াছে। মনে করিলাম, লাস—সমেত যদি টিনের বাক্স কোন প্রকারে উহাদিগের উপরে উঠাইয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে আমাদিগের বিপদের আর কোন সম্ভাবনা নাই। পরে যখন লাস বাহির হইয়া পড়িবে তখন সকলেই বাবুদিগকে লইয়া পীড়াপীড়ি করিবে; উঁহারা বড় মানুষ, সুতরাং কিছু না হইলেও হইতে পারে। এই ভাবিয়া আমরা উভয়ে উক্ত টিনের বাক্স লইয়া সেইস্থানে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেই রজ্জু পূর্ব্বের মত লম্বমান রহিয়াছে। সেই বাক্স তখন উত্তমরূপে সেই রজ্জু-সংবদ্ধ কাষ্ঠের সহিত উত্তমরূপে বাঁধিয়া, সেই রজ্জু ধরিয়া একটু নাড়া দিলাম। দেখিলাম, কে উপর হইতে উহা ক্রমে ক্রমে উঠাইয়া লইল। আমরা সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিয়া গৃহের রক্ত প্রভৃতি উত্তমরূপে ধৌত করিয়া ফেলিলাম। রক্তাক্ত বস্ত্র প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল, সমস্ত অগ্নিদেবকে প্রদান করিলাম। ইহাই আমি অবগত আছি। এখন আপনাদিগের যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই আপনারা করিতে পারেন।” 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ 

মাখমলালের কথায় সকলেই বিশ্বাস করিলেন। এই মোকদ্দমায় মাখমলাল সাক্ষী হইল। আসামী হইল,—সাতকড়ি। 

মাজিস্ট্রেট সাহেব যখন জিজ্ঞাসা করিলেন, সাতকড়ি তখনও আত্মদোষ স্বীকার করিয়া এই কয়েকটিমাত্র কথা কহিল, “হুজুর! আমি আফিস হইতে সেইদিবস দিবা দুইটার সময় বাটীতে ফিরিয়া যাই। গিয়া দেখি, বাড়ীর সদর দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ, কিন্তু একটু জোর করিয়া ঠেলিতেই খুলিয়া গেল। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। আমার গৃহের দ্বার দেখিলাম, কেবলমাত্র ভিড়ান আছে। তার ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক আমি যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পাইল। দেখিলাম, আমার স্ত্রী একটি অপরিচিত পুরুষের সহিত আমার শয্যার উপর শয়ন করিয়া আছে। এই ব্যাপার দেখিয়া হঠাৎ আমার যে প্রচণ্ড ক্রোধের উদয় হইল, কোনরূপেই তাহা সংযত করিতে পারিলাম না। গৃহের বাহিরেই একখানি দা ছিল, দ্রুতপদে যেমন আমি উহা আনিতে গেলাম, দেখিলাম, সেই অবকাশে পুরুষটি পলায়ন করিল। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি আমার স্ত্রীকে সেই দা দিয়া কাটিয়া ফেলিলাম। জানি না, সেই অবস্থায় আমি উহাকে কতবার আঘাত দ্বারা হত্যা করিয়াছি। পরিশেষে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আপনি মাখমলালের নিকট অবগত হইয়াছেন।” 

ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব সমস্ত ঘটনার কথা শ্রবণ করিয়া, এই মোকদ্দমা দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেইস্থানে জুরির বিচারে দণ্ডবিধান হইল। এ দণ্ডে সাতকড়ির প্রাণদণ্ড হইল না, দুই বৎসরের নিমিত্ত কারাগারমাত্র। 

আমাদের পূর্ব্বকথিত বাবুর বাড়ীর কোন্ লোকের যোগে, এবং কি কারণে যে সেই বাক্স বাড়ীর ভিতর উঠিয়া গেল, তাহা জানিবার নিমিত্ত বিস্তরলোক হাইকোর্টে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কোর্টে সেই বাড়ীর একটি চাকরাণী ভব এইরূপ সাক্ষ্য দিল, “আমার মনিবের আদেশ অনুযায়ী রাত্রি দিনের মধ্যে বাড়ীর ভিতর হইতে বাহিরে গমন করিবার অধিকার আমার ছিল না। তথাপি বলিতে লজ্জা হয়, আমি একটি লোকের সহিত অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হই। যখন কোনক্রমেই আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার সুযোগ দেখিলাম না, তখন আপনি যেরূপ শ্রবণ করিয়াছেন, সেই উপায় অবলম্বন করিয়া গভীর রাত্রিতে আমি সেই লোককে উঠাইয়া লইতাম, এবং সময় মত তাঁহাকে সেই উপায়ে পুনরায় নামাইয়া দিতাম। রজ্জুসহিত কাষ্ঠ যতক্ষণ বাহিরে লম্বমান থাকিত, আমি ততক্ষণ সেই ছাদের উপর রজ্জুর নিকট বসিয়া থাকিতাম। রজ্জু নড়িলেই বুঝিতে পারিতাম যে, সেই ব্যক্তি আগমন করিয়াছেন। তখন সেই রজ্জু টানিয়া আস্তে আস্তে তাঁহাকে উঠাইয়া লইতাম। দোতালা ছাদের একখানি কড়িকাষ্ঠ বাগানের দিকে বাহির করাছিল। দৈবাৎ সেই কড়িতে একটি কড়া আঙ্কান ছিল। সেই কড়ায় একটি কপি কলের ভিতর উক্ত রজ্জু গলাইয়া সহজেই টানিতে পারিতাম। যাহা হউক, এইরূপে একদিবস সেই ব্যক্তিটি আগমন করিয়াছেন বিবেচনা পূর্ব্বক, যখন পূর্ব্বরূপ উপায়ে আস্তে আস্তে রজ্জু টানিয়া লইলাম, তখন দেখিলাম, মানুষের পরিবর্তে আজ একটি টিনের বাক্স। ভাবিলাম, কোন কারণবশতঃ তিনিই সেই বাক্স উপরে উঠাইয়া দিয়াছেন। এই ভাবিয়া সেই বাক্সটি একটি গৃহের ভিতর রাখিয়া দিলাম। মনে মনে করিলাম, তিনি না আসিলে সেই বাক্স খুলিব না। কিন্তু তাঁহাকে আর দেখিতে পাইলাম না, তিনি আর আগমন করিলেন না। এই মোকদ্দমায় আসামী, সাক্ষী বা দর্শকগণের মধ্যে তিনি নাই। তাঁহার নাম ‘রাম’ এইমাত্র জানি, কিন্তু তিনি যে কোথায় থাকেন, তাহা আমি অবগত নহি। তিনি কখনও আমাকে তাহা বলেন নাই। সেই বাক্স উক্ত গৃহে তিন চারি দিবস থাকিবার পর যেরূপে সেই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়ে, তাহা আপনারা সকলেই অবগত আছেন!” 

ভবর কথা কেহ কেহ বিশ্বাস করিল, কেহ কেহ বা মনে মনে অন্যরূপ ভাবিতে লাগিল। 

সেই সময় হইতে বাবুর সেই বিধবা কন্যাকে এখানে আর কেহ দেখিতে পান নাই। পরিশেষে সকলেই শ্রবণ করিয়াছিলেন, তিনি কাশীবাসিনী হইয়াছেন। কিন্তু ইহাও কাহাকে কাহাকে বলিতে শুনা গিয়াছে যে, বাবুর কন্যাকে এই লজ্জাজনক ব্যাপার হইতে বাঁচাইবার নিমিত্ত, ভব সেই কুলকামিনীকৃত সমস্ত কার্য্যই নিজের বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে, এবং ইচ্ছা করিয়া সেই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করে নাই। 

উপরোক্ত মোকদ্দমায় হত্যাকারী নির্ণয়ের উদ্দেশে আমরা সাধ্যমত নানা উপায় অবলম্বনে অনুসন্ধান করিয়াছিলাম বটে; কিন্তু ঘটনা-চক্রে চুরি মোকদ্দমা না উঠিলে আমরা কোনক্রমেই অনুসন্ধানের সামান্যমাত্র সূত্রও ধরিতে পারিতাম না। বিশেষতঃ পূৰ্ব্বকথিত চোর যদি সাতকড়ি ও মাখমের নাম ও ঠিকানা বলিয়া না দিত, তাহা হইলে প্রকৃত হত্যাকারীকে হয় ত আমরা ধরিতে পারিতাম না। সেই চোরের দ্বারা এই মোকদ্দমার সমুদায় রহস্য প্রকাশ হইল বলিয়া, মাজিষ্ট্রেট সাহেব দয়া করিয়া সেই দাগী চোরের শাস্তি কমাইবার জন্য গবর্ণমেণ্টকে অনুরোধ করিলেন। গবর্ণমেণ্টও মাজিষ্ট্রেট সাহেবের কথা রক্ষা করিয়া, তাহার তিন মাসের কারাগার-দণ্ড কমাইয়া দিলেন। 

[জ্যৈষ্ঠ, ১৩০০] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *