বামুন ঠাকুর (বিদ্যার অভাবে অবিদ্যার প্রভাব)

বামুন ঠাকুর (বিদ্যার অভাবে অবিদ্যার প্রভাব) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একদিবস আমার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী আমাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কয়েক দিবস হইল, শ্রীনাথ দাসের লেন-স্থিত একটি বাড়ি হইতে প্রায় আড়াই শত টাকা মূল্যের কতকগুলি সোণা ও রূপার অলঙ্কার চুরি গিয়াছে। তুমি ইহার ব্যাপার কিছু শুনিয়াছ কি?” 

উত্তরে আমি কহিলাম, “না মহাশয়! আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।” 

প্রধান কর্ম্মচারী। তুমি ১।১ নম্বর শ্রীনাথ দাসের লেনে গমন করিয়া, বাবু গোপালচন্দ্র ঘোষের সহিত সাক্ষাৎ কর। তাঁহারই কতকগুলি দ্রব্য চুরি গিয়াছে। প্রথমে তাঁহার নিকট সমস্ত বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইয়া, পরিশেষে তাহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হও। আমি শুনিয়াছি, চারিদিবস গত হইল, এই চুরি হইয়া গিয়াছে, এবং স্থানীয় পুলিশ এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়া কিছুই করিয়া উঠিতে পারেন নাই। গোপালবাবু যে বাসায় থাকেন, সেই বাসায় ব্রাহ্মণের উপর এই সম্বন্ধে সবিশেষ সন্দেহ হয়। কিন্তু তাহাকে পাওয়া দূরে থাকুক—বড়ই লজ্জাকর কথা যে, এ পর্য্যন্ত সেই ব্রাহ্মণের নাম পর্যন্তও ঠিক হয় নাই। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অতঃপর আমি তোমার হস্তে অর্পণ করিতেছি। আশা করি, যাহাতে তুমি কৃতকার্য্য হইতে পার, তাহার নিমিত্ত সবিশেষ চেষ্টা করিবে। 

এই ঘটনার অতি অল্পদিবস পূৰ্ব্বেই আমি ডিটেকটিভ পুলিসে আগমন করিয়াছি; সুতরাং আমার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে অতিশয় চিন্তা হইল। ভাবিলাম, স্থানীয় পুলিশ যে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই, সেই কার্য্য আমার দ্বারা কিরূপে সম্পন্ন হইবে? কিন্তু কি করি? সাহেবকে কিছুই বলিতে না পারিয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম, এবং জগদীশ্বরের নাম স্মরণ করিতে করিতে গোপালবাবুর বাসার উদ্দেশে চলিলাম। 

দিবা দুইটার সময় সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। গোপালবাবুর সন্ধান করিলাম, কিন্তু তখন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল না। তিনি বাসায় ছিলেন না, যে অফিসে কর্ম্ম করেন, সেই অফিসে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রতীক্ষায় কাজেই সন্ধ্যা সাতটা পৰ্য্যন্ত আমাকে সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে হইল। সেইস্থানে বসিয়া কলিকাতার “ভাড়াটিয়া বাসাড়িয়া বাড়ীর” অবস্থা মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলাম। স্বচক্ষে দর্শন করিয়া এবং পরিশেষে অনুসন্ধান করিয়া বাসাড়িয়া বাড়ীর অবস্থা যতদূর জানিতে পারিয়াছিলাম, এইস্থানে পাঠকগণকে তাহার কতকটা আভাস দেওয়া বোধ হয় মন্দ নহে। 

কলিকাতার ভিতর কতকগুলি বাড়ি আছে, উহাদিগকে “ভাড়াটিয়া বাসাড়ে বাড়ি” কহে। ভিন্ন ভিন্ন দেশীয় বালকগণ যাহারা লেখাপড়া শিখিবার মানসে কলিকাতায় আগমন করে, এবং যাহাদিগের আত্মীয়স্বজন প্রভৃতি কোন ব্যক্তি স্ত্রী-পরিবার লইয়া এই কলিকাতায় থাকেন না তাঁহারা, ও যাঁহারা লেখাপড়া বন্ধ বা শেষ করিয়া এইস্থানের কোন না কোন অফিসে চাকরি করিয়া দিন কাটাইতেছেন, অথচ যাঁহাদিগের পরিবার প্রভৃতি নিকটে রাখিবার ক্ষমতা নাই তাঁহারা, দশ পনর জন একত্র মিলিত হইয়া, এক একটি বাড়ি ভাড়া লইয়া সেইস্থানে অবস্থান পূৰ্ব্বক আপন আপন উদ্দেশ্যানুযায়ী কার্য্য করিয়া থাকেন। তাঁহাদের অধিকৃত ঐ প্রকারের বাড়িগুলিকেই “ভাড়াটিয়া বাসাড়ে বাড়ি” কহে। এই সকল বাড়িতে যে সকল চাকরি-উপজীবী ব্যক্তি অবস্থান করেন, তাঁহারাই প্রায় বালকদিগের উপর একাধিপত্য ও বাসার সমস্ত কার্য্যে কর্তৃত্ব করিয়া থাকেন। 

ব্যয়-সংক্ষেপ অভিপ্রায়ে এইরূপ কোন বাসাতেই কেহ প্রায় দুইজনের অধিক চাকর-চাকরাণী নিযুক্ত করেন না। তাহার মধ্যে একজন “পাচক-ব্রাহ্মণ” ও অপর একজন “ঝি”। পাচক-ব্রাহ্মণগণের অধিকাংশেরই আমদানী স্থান—মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলা। ব্রাহ্মণ বা “বামুন ঠাকুরের” কার্য—সকাল ও সন্ধ্যা দুইবেলা বাবুদের নিমিত্ত আহার প্রস্তুত করা। অতি প্রত্যূষে বাসায় আসিয়া ইহারা রন্ধনাগারে প্রবেশ করেন, ও বেলা দশটা হইতে না হইতেই আপনার কার্য্য সমাপ্ত করেন। সেই সময়ের মধ্যে বাবুদিগেরও আহারাদি শেষ হয়, আহারান্তে বাবুরা সকলে আপন আপন স্কুল ও আফিস প্রভৃতি স্থানে গমন করিলে “বামুন ঠাকুর” স্নান করিয়া আপনার আহারের কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। বাবুরা আহার করিতে বসিয়া যে দ্রব্য বার বার চাহিয়াও “আর নাই” ব্রাহ্মণের নিকট এই উত্তর পাইয়াছেন ও অর্দ্ধাশনে উঠিয়া গিয়াছেন, “বামুন ঠাকুর” এখন সেই সকল দ্রব্য তাঁহার লুক্কায়িত স্থান হইতে বাহির করিয়া নিজে পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করেন। বলা বাহুল্য, সেই সকল দ্রব্যের কতক অংশ ঝির ভাতের থালার উপর রাখিতে ভুলেন না। কারণ মনে ভয়, ঝিকে অংশ প্রদান না করিলে পাছে সে বাবুদিগের নিকট বলিয়া দেয়। আহারান্তে “বামুন ঠাকুর” যে কোথায় চলিয়া যান, তাহা আর কেহ বলিতে পারেন না। কিন্তু কোন কোন ব্রাহ্মণের কথা কোন কোন ঝি ইচ্ছা করিলে বলিতে পারে, সে জানে যে “ঠাকুর” কোথায় থাকে। সন্ধ্যার পূর্ব্বে বামুন ঠাকুর পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হন, এবং আপনার নিয়মিত কর্তব্য-কৰ্ম্ম ও আহারাদি পূর্ব্বাহ্নের ন্যায় সম্পন্ন করিয়া রাত্রি দশটার সময় প্রস্থান করেন। 

এই ত গেল একজনের কার্য্যের বিবরণ। অন্যের অর্থাৎ ঝির কার্য-প্রণালী অতীব সাবধানের সহিত আমাকে বলিতে হইবে; নতুবা বাসাড়িয়া ভাড়াটে বাড়ির অনেক কর্তার কোপানলে পড়িয়া আমাকে ভস্মীভূত হইতে হইবে। 

ঝি-দিগের মধ্যে অধিকাংশেরই আমদানী স্থান—মেদিনীপুর এবং বর্দ্ধমান। ইহারা আপন দেশের নাম উজ্জ্বল করিয়া ও পিতা মাতার মুখ হাসাইয়া, পরিশেষে কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হয়। বিশেষতঃ ভয়ানক চৌদ্দ আইনের * ভয়ে প্রকাশ্যরূপে আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে না পারিয়া, প্রথমে আসিয়াই একস্থানে আড্ডা করে, ও পরে এই সকল ভাড়াটিয়া বাসাড়ে বাড়ির কোন ঝির পদশূন্য হইলে, পায়ের আল্লা মুছিয়া, পরিধেয় পাছাপেড়ে শাড়ি ছাড়িয়া, নাক-কাণের গহনা খুলিয়া চাকরীর উমেদারীতে সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হয়। ইহাদিগের মধ্যে যাহার বয়স অল্প, এবং দেখিতে যে নিতান্ত কুৎসিতা নহে, তাহাদিগের আবেদন প্রথমেই মঞ্জুর হয়; কর্তা মহাশয় তাহাকেই সেই কার্য্যে নিযুক্ত করেন। বলা বাহুল্য যে, অতি অল্প দিবসের মধ্যেই ইহারা কর্তার একান্ত প্রিয়পাত্র হইয়া উঠে। কৰ্ত্তা আফিস হইতে আসিতে না আসিতেই ঝি তাঁহার নিমিত্ত তামাক প্রস্তুত করিয়া রাখে, জল চাহিতে না চাহিতেই কর্তার সম্মুখে জলের গ্লাস আনিয়া উপস্থিত করে। কর্তার কোন প্রকার অসুখ হইলে, বা না হইলেও হাত পা টিপিতে আর কাহাকেও ডাকিতে হয় না। এদিকে অপর কেহ সাতবার না চাহিলে এক গ্লাস জল পায় না, সতের বার না চাহিলে এক ছিলাম তামাক আসে না। 

সন্ধ্যার সময় প্রায়ই ঝিকে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বাজার করা, জলখাবার আনা প্রভৃতি কোন না কোন কার্য্যের ভান করিয়া সন্ধ্যার সময় একেবারে উহাদিগকে বাহিরে গমন করিতে হইবে। বাসার অপর কেহ নিষেধ করিয়া কোনক্রমেই সন্ধ্যার সময় তাহাদিগকে বাড়ির ভিতর রাখিতে সমর্থ হইবেন না। বাসার কর্তা মহাশয়ও সেই সময় প্রত্যহ সন্ধ্যা-সমীরণ সেবনে বহির্গত হন। কিন্তু সকল ঝিই যে এই প্রকারের বা সেই সকল বাসার সকল কৰ্ত্তাই যে এইরূপ, তাহা অবশ্য আমি বলিতেছি না। ইহাদিগের মধ্যে ভাল লোকও অনেক আছেন। 

প্রতিদিনই রাত্রিটা নিজের আড্ডায় কাটাইয়া প্রাতঃকালে চক্ষু মুছিতে মুছিতে ঝি আসিয়া বাসায় উপনীত হয়। হাট-বাজার করা, রন্ধনাদির উদযোগ করা, আহারের স্থান প্রভৃতি পরিষ্কার করাই ঝির প্রধান কার্য্য। বাবুরা সকলে কাজ-কর্ম্মে বাহির হইয়া গেলে, দুই তিন জনের আহারের উপযোগী ভাত-সমেত থালা হস্তে করিয়া ঝিও আস্তে আস্তে তাহার আড্ডায় চলিয়া যায়। ইহার পর বেলা তিনটার পর ভিন্ন আর কেহই তাহাকে দেখিতে পায় না। দিবা তিনটা হইতে রাত্রি দশটা পর্যন্ত আপনার কাজ কৰ্ম্ম সম্পন্ন করিয়া, পূর্ব্বোক্তরূপ আহারীয় দ্রব্যাদি লইয়া পুনরায় প্রস্থান করে। 

ঝি আপনার নিমিত্ত অধিক পরিমাণে খাদ্য-সামগ্ৰী কেন লইয়া যায়, তাহা আর আমি স্পষ্ট করিয়া বলিব না; পাঠকগণ তাহা আপনা হইতেই বুঝিয়া লইবেন। আর যদি কেহ উত্তমরূপে বুঝিয়া উঠিতে না পারেন, তাহা হইলে একদিবস ঝির অলক্ষিতভাবে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিবেন। সেরূপ করিলে সমস্তই নিজের চক্ষু দ্বারা দর্শন করিয়া মনকে সন্তুষ্ট করিতে সমর্থ হইবেন। 

যাহা হউক, সেইস্থানে বসিয়া নানারূপ দেখিতে দেখিতে ক্রমে রাত্রি সাতটা বাজিয়া গেল। সাড়ে সাতটার সময় গোপালবাবু তাঁহার আফিস হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

অফিস হইতে গোপালবাবু প্রত্যাগমন করিলে, আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, ও তাঁহার নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিলাম। সেইস্থানে আমার গমন করিবার অভিপ্রায় তাঁহাকে কহিলাম, এবং কি প্রকারে তাঁহার গহনাগুলি চুরি গিয়াছে, তাহার সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। 

গোপালবাবু বলিলেন, “অদ্য প্রায় আটদিবস অতীত হইল, আমার গ্রাম হইতে একজন এইস্থানে আগমন করেন। যে গহনাগুলি এখন চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহা তিনিই এই স্থানে আনয়ন করিয়াছিলেন। তিনি যখন কলিকাতায় আগমন করেন, সেই সময়ে আমাদিগের বাড়ির কোন স্ত্রীলোক এই সকল গহনা তাঁহার সমভিব্যাহারে এই স্থানে প্রেরণ করেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল যে, আমি গহনাগুলি এইস্থানে বিক্রয় করিয়া তাহার পরিবর্তে অপর কতকগুলি অলঙ্কার প্রস্তুত করাইয়া দেই। যিনি অলঙ্কারগুলি আনয়ন করিয়াছিলেন, তিনি অলঙ্কারগুলি আমাকে প্রদান করিয়া সেই দিবসেই আপন কাৰ্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গিয়াছেন। সেই অলঙ্কারগুলির মূল্য আড়াই শত টাকার কম হইবে না। 

“যে দিবস সেই অলঙ্কারগুলি আমার হস্তে পড়িল, সেই দিবসেই আমি উহা আমার এই টিনের বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলাম। বাক্সের চাবি সততই আমার নিকটে থাকে। আজ পাঁচদিবস অতীত হইল, একদিবস প্রাতঃকালে আমাদিগের “বামুন ঠাকুর” আসিয়া আমার নিকট কোন একটি দ্রব্য প্রার্থনা করেন। তাহার সম্মুখে আমি আমার এই বাক্স খুলিয়া সেই দ্রব্য তাহাকে বাহির করিয়া দিলাম, এবং সেই বাক্স পুনরায় বন্ধ করিয়া চাবি পূর্ব্বমত আমার নিকটেই রাখিলাম। সেইদিবস আফিসে গমন করিবার সময় পূর্ব্ব-প্রথানুযায়ী এই গৃহ তালাবন্ধ করিয়া, তাহার চাবি এই স্থানেই রাখিয়া গেলাম। নিয়মিত সময়ে আমি আমার আফিস হইতে প্রত্যাগমন করিলাম, ও যে স্থানে গৃহের চাবি আমি রাখিয়া গিয়াছিলাম, সেইস্থান হইতে উহা লইয়া গৃহের দ্বার খুলিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

“সেই সময়ে ঝি আসিয়া সংবাদ দিল, ‘আজ বামুন ঠাকুর রন্ধন করিতে আসেন নাই। তাহার অনুসন্ধানে আমি গমন করিয়াছিলাম, কিন্তু খুঁজিয়া তাহার কোন ঠিকানা স্থির করিতে পারিলাম না।’ 

“তাহার কোন প্রকার অসুখ হইয়া থাকিবে বলিয়াই, কৰ্ম্ম করিতে আইসে নাই, এইরূপ স্থির করিয়া, একরূপ উপবাস করিয়াই বাসার সকলে সেই রাত্রিটা যাপন করিলাম। পরদিবস প্রাতঃকালেও বামুন ঠাকুর আসিলেন না, এবং অনুসন্ধানেও তাহার কোনরূপ সন্ধান না পাওয়ায় কাজেই অন্য আর একজন ব্রাহ্মণকে নিয়োজিত করিতে হইল। 

“সেইদিবস বেলা নয়টার সময় কোন কার্য্যোপলক্ষে আমি আমার সেই টিনের বাক্স খুলিতে গিয়া দেখিলাম যে, উহার ভিতর আমার অলঙ্কারগুলির একখানিও নাই। সেই বামুন ঠাকুরের উপর তখন আমাদিগের সবিশেষ সন্দেহ হওয়ায় স্থানীয় পুলিসে গিয়া তাহার নামে নালিস করিলাম সত্য, কিন্তু আজ চারিদিবস পর্য্যন্ত অনুসন্ধান করিয়া পুলিস তাহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারেন নাই; লাভের মধ্যে কেবল আমার দুইদিবস অফিস কামাই হইয়াছে, আর গাড়িভাড়া প্রভৃতিতে আরও কিছু ঘরের টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছে।” 

গোপালবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া কহিলাম, “সেই বামুন ঠাকুরের নাম ও ঠিকানা আপনারা কিছু অবগত আছেন কি?” 

গোপাল। না মহাশয়! তাহার নাম এবং বাসস্থানের কথা সে আমাদিগের জিজ্ঞাসা করিবারও কোন আবশ্যক হয় নাই। 

আমি। উহার নাম ও ঠিকানা ত আপনারা অবগত নহেন, কিন্তু কি প্রকারে এবং কতদিবস অতীত হইল, সে কাহা-কর্তৃক এইস্থানে আনীত, এবং আপনাদিগের কর্ম্মে নিয়োজিত হইয়াছিল? 

আমার এই কথার উত্তরে গোপালবাবু কহিলেন, প্রায় এক মাস অতীত হইল, আমাদিগের পুরাতন ব্রাহ্মণ হঠাৎ দেশে গমন করায় আমাদিগের অতিশয় কষ্ট হয়। সেই সময়ে হঠাৎ কোন ব্রাহ্মণ না পাওয়ায় আমাদিগের ঝিকে একটি ব্রাহ্মণের সন্ধানে পাঠাইয়া দেই। সেই খুঁজিয়া খুঁজিয়া একটি হোটেল হইতে উহাকে আনিয়াছিল। সেই ব্রাহ্মণের যে নাম কি, তাহা পৰ্য্যন্তও আমরা অবগত নহি। আমরা সকলেই উহাকে বামুন ঠাকুর বলিয়া জানিতাম। যে দিবস বামুন ঠাকুর আমার দ্রব্যাদি লইয়া পলায়ন করে, সেইদিবস আমি স্থানীয় পুলিসে গিয়া তাহার উপর অভিযোগ করি। যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছিলেন, আমাদিগের ঝি, যে হোটেল হইতে বামুন ঠাকুরকে আনিয়াছিল, সেই কৰ্ম্মচারীকে সেই হোটেল দেখাইয়া দেয়। পুলিসও সেই স্থানে গমন করিয়া সন্ধান আরম্ভ করেন; কিন্তু হোটেলে সকলেই সেই ব্রাহ্মণের কথা একবারে অস্বীকার করে এবং বলে,—“আমাদিগের জানা কোন ব্রাহ্মণকে এইস্থান হইতে কোন ঝি আসিয়া কখনও ডাকিয়া লইয়া যায় নাই। হোটেলের লোকজনদিগের নিকট হইতে সেই ব্রাহ্মণের কোনরূপ সন্ধান পাইবার যে আশা আমরা করিয়াছিলাম উহাদিগের উক্ত কথা শুনিয়া অবধি আমাদিগের যে আশা সুদূরে পলায়ন করিয়াছে।” 

গোপালবাবুকে আমি আর অধিক কিছু জিজ্ঞাসা করিলাম না; কেবল তাহার আকৃতি-প্রকৃতি কি প্রকার, অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ কিরূপভাবে গঠিত, শরীরের কোনস্থানে কোনরকম চিহ্নাদি আছে কি না, যাহা দেখিবামাত্র বোধ হইতে পারে এই সেই “বামুন ঠাকুর” ও সে কিরূপ ভাবে স্বাভাবিক কথাবার্তা কহিয়া থাকে, প্রভৃতি তাহার সমস্ত বিবরণ, এবং কি প্রকারের কি কি অলঙ্কার গোপালবাবুর বাসা হইতে অপহৃত হইয়াছে, তাহারও সমস্ত বিবরণ উত্তমরূপে জানিয়া লিখিয়া লইলাম, এবং সেই ঝিকে সমভিব্যাহারে সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। ঝি আমার সহিত গমন করিয়া, দূর হইতে সেই হোটেল আমাকে দেখাইয়া দিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমি সেই হোটেল দেখিয়া লইলাম, কিন্তু কাহাকেও আর কিছু না বলিয়া আমাদিগের আফিস অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। আফিসে আমার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যে উপায় আমি মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে কহিলাম। তিনি আমার প্রস্তাবে অনুমোদন করিলেন এবং কহিলেন, “পাঁচ সাত দিবস আমি তোমার কোনরূপ অনুসন্ধান লইবার চেষ্টা করিব না।” 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

পরদিবস প্রাতঃকালে একটি ব্যাগ হস্তে করিয়া ধীরে ধীরে সেই হোটেলে গিয়া আমি উপনীত হইলাম। সেই দিনের প্রত্যূষের গাড়িতে আমি আমার দেশ হইতে আগমন করিয়াছি, হোটেলে আমি এই পরিচয় প্রদান করিলাম ও কহিলাম, “কলিকাতা আমার অপরিচিত স্থান, অথচ এই স্থানে থাকিয়া আমি আমার বিষয়-কর্ম্মের চেষ্টা দেখিব সঙ্কল্প করিয়াছি। কিন্তু যে কয়েক দিবস আমি আমার থাকিবার স্থান স্থির করিতে না পারি, সেই কয়েক দিবস আমি এই হোটেলে থাকিতে ইচ্ছা করি।” আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া একটি ব্রাহ্মণ, যাহাকে পরিশেষে আমি সেই হোটেলের কৰ্ত্তা বলিয়া জানিতে পারিয়াছিলাম, তিনি রন্ধনশালা হইতে মল্লবেশে একখানি হাতাহতে বহির্গত হইয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন ও আমাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “এই হোটেলে আমরা কোন অপরিচিত ব্যক্তিকে থাকিবার স্থান প্রদান করি না; সুতরাং আপনি এখানে থাকিতে পারিবেন না। আসিয়াছেন, নগদ পয়সা ফেলুন, আহার করুন ও চলিয়া যান।” সেই ব্রাহ্মণের কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে চিন্তা হইল। ভাবিলাম, ব্রাহ্মণ বোধ হয়, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে দেয় না। ব্রাহ্মণের কথা শ্রবণ করিয়া উল্কি-পরা, মোটাসোটা একটি স্ত্রীলোক আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। পরিশেষে জানিয়াছিলাম, এই স্ত্রীলোকটিই এই হোটেলের কর্ত্রী-ঠাকুরাণী এবং কর্তারও কর্ত্রী—ঠাকুরাণী। ইনিই প্রকৃত কর্ত্রী আর কর্তাঠাকুর ইহার ক্রীতদাস। যখন দেখিলাম, কর্তাঠাকুর সেই হোটেলের ভিতর আমাকে থাকিবার স্থান দিতে অনিচ্ছুক, তখন কর্তা ও কর্ত্রী উভয়কেই সবিশেষরূপে অনুনয়-বিনয় করিতে লাগিলাম, এবং তাহারা আমাকে থাকিবার স্থান প্রদান না করিলে এই অপরিচিত স্থানে আমার যে কিরূপ দুরবস্থা হইবে, তাহাই তাহাদিগকে কাতরকণ্ঠে বুঝাইতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, আমার অনুনয়-বিনয়ের ফল ফলিল। উভয়েই অন্তরালে গমন করিয়া কি পরামর্শ করিলেন, এবং পরক্ষণেই সেইস্থানে প্রত্যাগমন করিয়া কর্ত্রী-ঠাকুরাণী আমাকে কহিলেন, “আপনি দেখিতেছি, ভদ্রলোক এবং ব্রাহ্মণ; তাহাতে কলিকাতায় আপনি অপরিচিত এবং এখানে আপনার থাকিবার স্থান নাই, এরূপ অবস্থায় আপনাকে থাকিবার স্থান না দিলে আপনাকে অতিশয় কষ্ট পাইতে হইবে। আমরা এখানে কাহাকেও থাকিতে দেই না, কিন্তু আপনার যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে যদি আপনাকে থাকিবার স্থান প্রদান না করি, তাহা হইলে আপনার কষ্টের শেষ থাকিবে না। এরূপ অবস্থায় কাজেই আপনাকে স্থান প্রদান করিতে হইল, আপনি এইস্থানেই থাকুন। আপনাকে থাকিবার স্থান আমরা প্রদান করিলাম সত্য, কিন্তু আমাদিগের এমন ইচ্ছা নহে যে, ব্রাহ্মণের নিকট হইতে আমরা কিছু গ্রহণ করি; কিন্তু যখন আমরা এই কার্য্য করিতে বসিয়াছি, তখন পেটে ক্ষুধা ও মুখে লজ্জা করিয়া কি করিব? তবে আপনার নিকট হইতে আমরা অধিক কিছু গ্রহণ করিব না, আপনি অতি সামান্য দিলেই চলিবে। যে কয়েক দিবস আপনি এখানে থাকিবেন, সেই কয়েক দিবস রোজ আট আনা হিসাবে দিলেই হইবে।” 

কর্ত্রী-ঠাকুরাণীর কথা শ্রবণ করিয়া আমি রোজ আট আনা হিসাবেই প্রদান করিতে সম্মত হইলাম, এবং কর্ত্রী—ঠাকুরাণীর নির্দেশমত আমার ব্যাগটি একস্থানে রাখিয়া দিয়া একখানি চৌকির উপর উপবেশন করিলাম। কর্ত্রী—ঠাকুরাণী ঝিকে ডাকিয়া তামাক দিতে কহিলেন। আমি ঝিকে তামাক দিতে নিষেধ করিলাম ও কহিলাম, “আমার ধূমপান করার অভ্যাস নাই।” 

আমি যে হোটেলের কথা বলিলাম, তাহা যে কোথায়, এবং তাহার অবস্থাই বা কিরূপ, তাহা আমি এ পর্য্যন্ত বলি নাই। কলেজ স্ট্রীটের একটি একতালা বাড়ীতে এই হোটেল স্থাপিত। এই বাড়ীর যে কত নম্বর, তাহা আমি ভুলিয়া গিয়াছি; কিন্তু এইমাত্র বলিতে পারি যে, বহুবাজারের চৌরাস্তা হইতে অতি অল্পদূর উত্তরে রাস্তার পশ্চিমপার্শ্বে এই হোটেলটি স্থাপিত। হোটেলের দরজার উপর একখানি কাষ্ঠে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘ভদ্রলোকের আহার করিবার ও থাকিবার স্থান।’ কলিকাতার ভিতর যতগুলি হিন্দুদিগের আহারের স্থান আছে, তাহার অধিকাংশই যেরূপ এবং যাহাদিগের দ্বারা স্থাপিত, ইহাও সেইরূপ, অর্থাৎ ‘কর্ত্তাঠাকুর’ একজন পূৰ্ব্বকথিতমত ‘ভাড়াটে বাসাড় বাড়ীর’ ভূতপূর্ব্ব ব্রাহ্মণ, এবং কর্ত্রী-ঠাকুরাণীও সেইস্থানের ঝি। উভয়ে একস্থানে ও একত্র কর্ম্ম করিবার সময় উভয়ের মনপ্রাণ এক হইয়া গিয়াছিল। যেমন ভিন্ন ভিন্ন দিক হইতে নদ-নদী আসিয়া একত্র মিলিত হইয়া ক্ৰমে সমুদ্রে গিয়া লীন হয়, সেইরূপ উক্ত উভয়ে ভিন্ন জাতি হইলেও উভয়ের মনের গতি এক হইয়া ক্ৰমে হোটেলে গিয়া লীন হইয়া যায়। নব্যসম্প্রদায়ের বাবুরা যেমন কখনও “সতী” বাক্য অবহেলা করিতে সমর্থ হন না, আমাদিগের সেই পাচক দেবতাও সেইরূপ কর্ত্রী-ঠাকুরাণীর আদেশ লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হন না। কারণ তাঁহারও মনে ভয়, হুকুম অমান্য করিলে পাছে ভীষণ বাক্য-দংশনজ্বালা সহ্য করিতে হয়। কর্ত্রী-ঠাকুরাণীর কৰ্ম্ম –সমস্ত কার্য্যের তত্ত্বাবধান করা, সমস্ত লোকের নিকট হইতে খোরাকীর পয়সা আদায় করা, ও তাহা তাঁহার নিজের বাক্সজাত করা। আর কর্তা-ঠাকুরের কৰ্ম্ম-ইস্তক প্রাতঃকাল নাগাইত রাত্রি বারটা পর্য্যন্ত হাতাবেড়ি লইয়া রন্ধনক্ষেত্রে অগ্নির সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিয়া কর্ত্রী—ঠাকুরাণীকে সন্তুষ্ট করা, এবং উপস্থিত আহারার্থী ব্যক্তিগণকে অভ্যস্ত ‘মিষ্টকথা’ বলিয়া অৰ্দ্ধানশনে বিদায় দেওয়া। 

যাহা হউক, সেই বাড়ীর একটি গৃহের কতক অংশ আমার বাসস্থানরূপে নিরূপিত হইল। আমি সেইস্থানেই অবস্থান করিতে লাগিলাম। আমার কার্য্যের মধ্যে কেবল কর্তা ও কর্ত্রী ঠাকুরাণীর সহিত যাহাতে সৌহৃদ্য-স্থাপন করিতে পারি, তাহারই চেষ্টা দেখা, নূতন আমদানী ব্রাহ্মণগণের সহিত অধিক পরিমাণে মেশামিশি করা, এবং আহারার্থী ব্যক্তিগণের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করা। এইরূপ কর্ম্ম করিতে করিতে দুই তিন দিবস অতীত হইয়া গেল। কিন্তু আমার আসল কর্ম্মের কিছুই হইল না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

এইস্থানে যে সকল ব্যক্তি আহার করিতে আসিত তাহাদের ভিতর কোন লোককে ভদ্রলোকের মত প্রায়ই দেখিতে পাইতাম না। তবে দুই এক জন ভদ্রলোকের ছেলে, যাহারা এখন পেটের ও ‘পরের’ জ্বালায় ছাপাখানা প্রভৃতি কোনস্থানে সামান্য বেতনে কর্ম করে, তাহাদিগকেই দেখিতে পাইতাম। তদ্ভিন্ন যে সকল ব্যক্তিকে দেখিতে পাইতাম, তাহাদের চরিত্র প্রভৃতির কথা বর্ণনা করিতে হইলে একখানি স্বতন্ত্র পুস্তক লিখিবার আবশ্যক হয়। ইহাদিগের সকলেরই প্রায় এক একটি থাকিবার স্থান আছে। কিন্তু ইহারা যাহাদের নিকট থাকে, সমাজের দিকে চক্ষু রাখিয়া দিনের বেলা তাহাদের হস্তের অন্ন খাইতে সাহস করে না। তবে অন্ধকার রাত্রিতে গৃহের দ্বার বন্ধ করিয়া যে কি করিয়া থাকে, তাহা তাহারাই বলিতে পারে। যাহা হউক, এইমাত্র দেখা যাইত যে, দিনমানে যে সকল ব্যক্তি আহার করিতে আসিত, রাত্রিতে তাহাদের অধিকাংশই আসিত না। 

একদিবস রাত্রি প্রায় নয়টার সময় দশ পনের জন আহারার্থী ব্যক্তি আসিলেন। ইঁহারাই কেবল প্রত্যহ দুইবেলা এইস্থানে আহার করিয়া থাকেন। একটি গৃহে ইঁহাদের আহারের স্থান হইল। কতগুলি টুকরো টুকরো কলার পাতা ও শালপাতা সারি সারি রাখিয়া কর্তামহাশয় তাহাতে ভাত আনিয়া দিলেন। ভাতের উপর এক এক হাতা অর্দ্ধ সেদ্ধ খেসারির ডাল ও একটু একটু ব্যঞ্জন। এই ব্যঞ্জনের ভিতর অনুসন্ধান করিলে না পাওয়া যায়, এমন দ্রব্যই নাই। ইস্তক কুমড়ার খোলা ও বিচি, নাগাইত বেগুনের ছোঁটা প্রভৃতি সমস্তই ইহাতে আছে। কর্ত্রী-ঠাকুরাণী সকলকে আহারার্থ আহ্বান করিলেন। সকলেই গিয়া সেই পাতের নিকট উপবেশন করিলেন। ইহাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা শালপাতা মোড়া এক পয়সার ঘৃত, কেহ বা একটু দধি, কেহ বা আধখানি লেবু প্রভৃতি যাঁহার যেমন সাধ্য, সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। আহারের সময় তাঁহারা পাতের নিকটেই ঐ সকল লইয়া বসিলেন। সকলে উপবেশন করিলে দেখা গেল যে, একখানা পাতা অধিক হইয়াছে। সুতরাং কর্ত্রী-ঠাকুরাণীর অনুরোধ-মত আমিও গিয়া সেই পাতায় আহার করিতে বসিলাম। আহার করিতে বসিয়া সকলেই নানারূপ গল্প-গুজব আরম্ভ করিলেন। 

একজন বলিলেন, “ভাই! আজ রাস্তায় বড় আমোদ হইয়া গিয়াছে। একজন জুয়াচোর রাস্তার ধারে বসিয়া নূতন তাস খেলিতেছিল, এমন সময় হঠাৎ কোথা হইতে একজন পুলিস আসিয়া তাহাকে ধরিল, ও মারিতে মারিতে থানার দিকে লইয়া গেল। কিন্তু পরে শুনিলাম, থানায় কেহই যায় নাই।” আর একজন বলিলেন, “ইহা ত সৰ্ব্বদাই হইয়া থাকে। গত কল্য আমি শ্যামবাজার হইতে আসিবার সময় দেখি, রাস্তার একস্থানে ভয়ানক ভিড়; সুতরাং আমিও আস্তে আস্তে সেইস্থানে গমন করিলাম। কিন্তু দেখিলাম, কয়েকজন লোক রাস্তার উপর ভয়ানক মারামারি করিতেছে: কাহারও নাক ও মুখ দিয়া রক্ত পড়িতেছে, কাহারও মস্তক ফাটিয়া গিয়াছে; আর সমস্ত লোক সেইস্থানে দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতেছে। ইহার ভিতর একজন লোক দৌড়িয়া গিয়া নিকটস্থিত একটি পাহারাওয়ালাকে সংবাদ দিল। কিন্তু পাহারাওয়ালা সাহেব কহিলেন, ‘ তোমারা ইস্মে কেয়া কাম হ্যায়? তোম্ যাকে আপনা কাম দেখ।’ এই বলিয়া নিকটস্থিত একটি গলির ভিতর আস্তে আস্তে পাহারাওয়ালা সাহেব প্রস্থান করিলেন। আর একজন বলিলেন, -”সকল পুলিসই কি সমান? সকল স্থানেই ভাল ও মন্দ সকল প্রকার লোকই আছে। সে দিন আমার বাসার নিকট একটি চুরি হয়, এবং চোর ধরা পড়ে। কিন্তু দ্রব্যের বিষয় সে অস্বীকার করে। পুলিস যে কত কষ্ট ও পরিশ্রম করিয়া সেই সকল দ্রব্য বাহির করিয়া দিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না; সেরূপ কষ্ট আমরা কিছুতেই সহ্য করিতে পারি না।” 

কর্ত্রী-ঠাকুরাণী সেইস্থানেই বসিয়া বসিয়া পান সাজিতেছিলেন। এই কাজটি তিনি নিজেই করিতেন, ঝি প্ৰভৃতি আর কাহারও তাহাতে অধিকার ছিল না। এই সকল গল্প-গুজব শ্রবণ করিয়া তিনিও আর চুপ করিয়া থাকিতে না পারিয়া বলিলেন, “আজকাল ভাল-লোক মন্দ-লোক চেনাও দায়! এই সে দিবস উমেশ কি কাণ্ডটাই না করিল! বেচারা বেকার অবস্থায় এইস্থানে কতদিবসই বসিয়াছিল। যদি বা কোনরূপে তাহার একটি চাকরির যোগাড় করিয়া দেওয়া গেল, অমনি একমাস যাইতে না যাইতেই সেইস্থান হইতে চুরি করিয়া পলায়ন করিয়াছে! পুলিস তাহার সন্ধান করিবার নিমিত্ত আমার নিকট পর্য্যন্তও আসিয়াছিল। কিন্তু আমি যেই বলিলাম যে, আমি তাহাকে জানি না, তাই সে এখন বাঁচিয়া গেল; তাহার এ পর্য্যন্ত কোন সন্ধানই হইল না। কিন্তু সে যেরূপ কার্য্য করিয়াছে, তাহাতে যদি আমি তাহার নাম ও ঠিকানা বলিয়া দিতাম, তাহা হইলে এবার আবার তাহার দশা কি হইত?” 

এই কথা শ্রবণ করিয়া অপর এক ব্যক্তি কহিলেন, “কোন উমেশ? বনবিষ্ণুপুরের গোবিন্দ রায়ের পুত্র! আমি তাহাকে ত এখনই বৈঠকখানার কানাই ঠাকুরের হোটেলে দেখিয়া আসিলাম। তাহার পক্ষে ইহা আর নূতন কি? সে চুরি না করিলে কোনরূপেই থাকিতে পারে না। নহিলে কামিনীর চলিবে কি প্রকারে? সে ইহার পূর্ব্বে আরও দুইবার চুরি করিয়া জেল পর্যন্তও দেখিয়া আসিয়াছে। সে সকল কার্য্যই করিতে পারে।” 

অন্য আর এক ব্যক্তি কহিলেন,—“কোন্ কামিনীর সহিত উমেশের এত প্রণয়? তাহার চরিত্র কতদিন এরূপ হইল? তাহাকে দেখিলে ত একটি নিরীহ ভাল মানুষ বলিয়াই বোধ হয়!” 

“আরে তুমিও যে দেখছি, নূতন হইলে! সেই কামিনীকে আর চিনিতে পারিলে না? চুনুরিপুকুরের রামদাসের বাড়ীতে যে কামিনী থাকে, সে সেই। উমেশ তাহার নিমিত্ত একবারে পাগল; আর তাহার নিমিত্ত কোন কার্য্যই করিতে সে পরাঙ্মুখ হয় না।” 

এই কথা হইতে হইতে কথার স্রোত ফিরিল। অন্য কথা আসিয়া সেইস্থানে পড়িল। আমি দেখিলাম, আর আমার মনস্কামনা পূর্ণ হইল। এই কয়েক দিবসের কষ্ট সার্থক হইবার আশা হইল। হৃদয়ে এক প্রকার আনন্দ আসিয়া উপস্থিত হইল। পাঠকগণ দেখুন, আমার হৃদয় ক্রমে ক্রমে কিরূপ পথ অবলম্বন করিতেছে! কোন বিপদে পতিত ব্যক্তিকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিবার উপায় যদি আপনারা প্রাপ্ত হয়েন, তবে আপনাদিগের মনে নিশ্চয়ই আনন্দের উদয় হয়; কিন্তু আমি এখন একটি ব্রাহ্মণকে বিপজালে জড়ীভূত করিবার উপায় পাইয়াছি বলিয়াই আমার হৃদয়ে আনন্দ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। 

যাহা হউক, সকলের আহার সম্পন্ন হইল। সকলেই হোটেল হইতে বহির্গত হইয়া আপন আপন ইচ্ছানুযায়ী স্থানে গমন করিলেন। আমিও সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

সেইস্থান হইতে গোপালবাবুর বাসা অধিক দূরে নহে। আমি প্রথমেই তাঁহার বাসায় গমন করিলাম, ও তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। পরে তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া তখনই বৈঠকখানায় কানাই ঠাকুরের উদ্দেশে চলিলাম। হোটেলের ভিতর আর প্রবেশ করিতে হইল না। বাহির হইতেই দেখা গেল, একটি লোক সেইস্থানে বসিয়া আছে। গোপালবাবু তাহাকে দেখিয়াই আমাকে আস্তে আস্তে কহিলেন, “এই সেই।” আমি গোপালবাবুকে অনতিদূরে রাখিয়া সেই হোটেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং সেই ব্যক্তির নিকট গিয়া উপবেশন করিলাম। আমি যে সেইস্থানে আহারার্থ গমন করিয়াছি, ইহাই সকলে বুঝিল। আমি এখন সেই ব্যক্তির নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহাতে সে যেন একটু ইতস্ততঃ করিয়া কহিল,—“আমার নাম শ্রী ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায়।” আমি কহিলাম, “ক্ষেত্রবাবু! আমি যখন এইস্থানে আহারার্থ প্রবেশ করিতেছিলাম, তখন একটি স্ত্রীলোক পথ হইতে আপনাকে দেখাইয়া দিয়া বলিয়া দিলেন, ‘ঐ লোকটিকে একবার ডাকিয়া দিবেন।’ সেই স্ত্রীলোকটি ঐ পথের উপর আপনার নিমিত্ত দাঁড়াইয়া আছেন।” এই বলিয়া যে দিকে গোপালবাবু দণ্ডায়মান ছিলেন সেইদিক দেখাইয়া দিলাম। ক্ষেত্রনাথ আর কিছু না বলিয়া সেই দিকেই চলিল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। ক্রমে গোপালবাবুকে দেখাইয়া দিয়া বলিলাম, “দেখ দেখি, এই স্ত্রীলোকটিকে চেন কি না?” 

উমেশচন্দ্র রায় (ওরফে) ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গোপালবাবুকে দেখিয়া সেইস্থানেই বসিয়া পড়িল। তাহার মুখ দিয়া আর কোন কথাই বহির্গত হইল না। তখন আমি তাহাকে কহিলাম, “উমেশ! যাহা করিবার করিয়াছ, যাহা হইবার হইয়াছে। এখন অলঙ্কারগুলি কোথায় আছে, দেও। নতুবা তোমাকে পুলিসের হস্তে অর্পণ করিব। তাহা হইলে তোমাকে অলঙ্কারগুলি ত দিতেই হইবে; বেশীর ভাগ লাভের মধ্যে তোমাকে জেলে পর্য্যন্ত যাইতে হইবে।” 

এই কথা শ্রবণ করিয়া উমেশ কহিল,—“মহাশয় অলঙ্কারের কথা কি বলিতেছেন? আমি কোন অলঙ্কারের কথা জানি না। আমি এই গোপালবাবুর নিকট কর্ম্ম করিতাম; আমার এক মাসের বেতন পাওনা আছে। সেই বেতন আমাকে না দিয়া উনি জবাব দিয়াছেন। আর, এখন বুঝি যাহাতে আমাকে সেই বেতন না দিতে হয় তাহারই নিমিত্ত এই এক মিথ্যা দোষ বাহির করিয়াছেন। দেখুন গোপালবাবু! আপনি আমার বেতন দেন আর না দেন, কিন্তু মিথ্যা কথা বলিবেন না।” 

উমেশের এই কথাগুলি শ্রবণ করিয়া, সে যে সহসা অলঙ্কারগুলি প্রদান করিবে, সে ভাবনা আমার হৃদয় হইতে একবারে অন্তর্হিত হইল। তখনই একখানি গাড়ির ভিতর উহাকে লইয়া থানা-অভিমুখে গমন করিলাম। গোপাল—বাবুও সেই সঙ্গে রহিলেন। 

থানায় উমেশকে রাখিয়া, আমি ও গোপালবাবু দুইজনেই আবার বহির্গত হইলাম। চুনুরিপুকরে গিয়া, সন্ধান করিয়া রামদাসের বাড়ী পাইলাম। গোপালবাবুকে বাহিরে রাখিয়া আমি সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

এটি একখানি খোলার বাড়ী। ইহার ভিতর ছোট ছোট চারি পাঁচ খানি গৃহ আছে; তাহারই একখানিতে কামিনী থাকে। আমি আস্তে আস্তে কামিনীর গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, উক্ত গৃহের একপার্শ্বে একখানি তক্তাপোস, এবং তাহার উপর একখানি পরিষ্কার চাদরে মোড়া একটি গদি। উহার চতুষ্পার্শ্বে চারিটি ধপধপে সাদা বালিস। এই তক্তাপোসের সংলগ্ন আর একখানি তক্তাপোস; ইহা অন্যখানির অপেক্ষা কিছু নীচু ও ছোট। উহার উপর একটি পাটা বিছান। তাহার উপর একপার্শ্বে উপর্যুপরি ছয় সাতটি তাকিয়া। তাহার নিকট একটি কাষ্ঠের শেল্ফও দুইখানি কাষ্ঠের চৌকি। আর তাহার উপর কতকগুলি পিতল কাঁসার বাসন সাজান রহিয়াছে। তাহার পার্শ্বে একখানি কাপড়ে আচ্ছাদিত একটি কাষ্ঠের দেরাজ; তাহার উপর কয়েকটি বোতল সাজান রহিয়াছে। উহা ছাড়া বেড়ার গায়ে কতকগুলি কাগজের ছবি বেড়ার সহিত সংবদ্ধ রহিয়াছে। ছোট তক্তাপোসের উপর একটি পিতলের পিলসুজে প্রদীপ জ্বলিতেছে; আর তাহার সম্মুখে কামিনী বসিয়া পান সাজিতেছে। কামিনী আমাকে দেখিয়াই কহিল,—”আপনি কাহার সন্ধান করিতেছেন? এখানে বসিবার যো নাই।” আমি এই কথা শুনিয়া কহিলাম,—“কামিনী! আমি এখানে বসিতে আসি নাই। তোমাদের বড়ই বিপদ্ উপস্থিত, সেই নিমিত্তই এইস্থানে আসিয়াছি। কোন প্রকার গোলযোগ করিও না; স্থিরচিত্তে শ্রবণ কর। উমেশ সে দিবস যে কতকগুলি অলঙ্কার আনিয়াছিল, তাহার নিমিত্ত থানায় নালিস হয়। এই কয়েক দিবস পর্য্যন্ত কেহই উমেশকে সন্ধান করিয়া পায় নাই; আজ আমরা উভয়ে যখন বহুবাজার স্ট্রীট দিয়া আসিতেছিলাম, সেই সময় একজন পুলিস কর্মচারী তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। সে এখন সেই স্থানেই আছে, তাহাকে এখনও পর্যন্ত থানায় লইয়া যায় নাই। কারণ উমেশ অনেকরূপ অনুনয়-বিনয় করিয়া পুলিস কর্ম্মচারীকে পঞ্চাশটি টাকা দিতে সম্মত হওয়ায়, কর্মচারী তাহাকে অব্যাহতি দিতে চাহিয়াছেন। এখন উমেশ আমাকে তোমার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছে, এবং বলিয়া দিয়াছে যে, “কামিনীকে এই সংবাদ দেও, তাহা হইলে টাকা সহিত এখনই আসিয়া সে আমাকে লইয়া যাইবে।” সে আরও বলিয়াছে যে, ‘কামিনী সহসা যদি টাকার যোগাড় নাও করিতে পারে, তাহা হইলে কোনস্থানে সেই অলঙ্কারের কতক বন্ধক দিয়াও যেন এই টাকার যোগাড় করিয়া লইয়া আইসে। আর এই নিমিত্তই আমি এখানে আসিয়াছি। তুমি যত শীঘ্র পার, টাকা পঞ্চাশটি লইয়া আমার সহিত আইস; আমি সেইস্থানটি তোমাকে দেখাইয়া দেই।” 

আমার এই কথা শুনিয়া কামিনী কত কথাই বলিল। উমেশের পিতৃপুরুষ-উপলক্ষে কত গালি দিল, কত সুখাদ্য তাঁহাদিগের জন্য ব্যবস্থা করিল, এবং ‘এত টাকা কোথায় পাইব’ বলিয়া, কত প্রকার ছলনাই করিতে লাগিল। আমি তখন তাহাকে কত বুঝাইলাম, কত কথা বলিলাম। কিন্তু সে প্রথমে কিছুতেই তাহা শুনিল না। তাহার এই ভাব দেখিয়া, আমি যেন একটু কৃত্রিম ক্রোধভাব প্রকাশ করিয়াই সেইস্থান পরিত্যাগ করিবার উদযোগ করিতেছিল, এমন সময় কামিনী আমাকে বলিয়া কহিয়া বসাইল, এবং ক্রোধভরে তাহার দেরাজ খুলিয়া একটি বাক্স বাহির করিল। উহার ভিতর দেখিলাম, কতকগুলি সোণা-রূপার অলঙ্কার আছে। দেখিয়াই বুঝিলাম, উহা গোপালবাবুর অলঙ্কার; কিন্তু সমস্তগুলি দেখিতে পাইলাম না। যাহা হউক, উহার ভিতর হইতে কতগুলি অলঙ্কার লইয়া, আমাকে তাহার গৃহে বসাইয়া কামিনী টাকা সংগ্রহার্থ বহির্গত হইল। আমিও তাঁহার অলক্ষিতভাবে পশ্চাৎ পশ্চাৎ কিয়দ্দূর গমন করিয়া গোপালবাবুকে উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে বলিলাম। সে কোথায় যায়, এবং কোথা হইতে টাকা সংগ্রহ করিয়া আনে, তাহা দেখিবার নিমিত্তই গোপালবাবু তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গেলেন। আমি ফিরিয়া আসিয়া পূর্ব্বমত আবার তাহার গৃহে বসিয়া রহিলাম। 

অর্দ্ধঘণ্টা অতীত না হইতেই কামিনী টাকা লইয়া আসিল। এবার গোপালবাবুও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। কামিনী গোপালবাবুকে দেখিয়া কহিল, “ইনি আবার কে?” আমি তাহাকে কহিলাম, “ইহাকে চিনিতে পারিলে না! আচ্ছা, এখনই চিনিতে পারিবে। ইহারই গহনার নিমিত্ত আমি তোমাকে যে সকল কথা বলিয়াছি, সকলই মিথ্যা বলিয়াছি। আমি তোমার উমেশের প্রেরিত লোক নহি, আমি পুলিস কর্ম্মচারী। গহনাগুলি লইবার নিমিত্তই তোমার নিকট আসিয়াছি, এবং ছল অবলম্বন করিয়া সমস্তই আপনার চক্ষে দেখিয়া লইয়াছি। এখন তুমি ভাল চাহ, ত সহজে গহনাগুলি বাহির করিয়া দেও।” 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

পাঠক মহাশয়! দেখিলেন, আমরা কিরূপ সৎপথ অবলম্বন করিয়া কার্য্য উদ্ধার করিয়া থাকি? আপনারা যদি ভ্রমক্রমেও একটি মিথ্যা কথা বলেন, তাহা হইলে তাহার জন্য অনুশোচনা আপনাদিগের হৃদয় হইতে সহসা দূর হয় না। আর আমরা ভ্রমক্রমেও একটি সত্য কথা বলিতে শিখি নাই। পলে পলে মুহূর্তে মুহূর্তে কেবল মিথ্যা কথাই বলিয়া থাকি! আর এই নিমিত্তই আপনারা আমাদিগের বোধ হয়, এত বিশ্বাস করেন!! 

কামিনী তখন আর কি করিবে? অগত্যা তাহাকে সমস্ত অলঙ্কারগুলি বাহির করিয়া দিতে হইল। যে স্থান হইতে সে টাকা আনিয়াছিল, তাহাও দেখাইয়া দিল। অধিকন্তু ইতিপূর্ব্বে আর যে যে দ্রব্যাদি সেইস্থানে বন্ধক দিয়াছিল, তাহাও বলিল। যাঁহার নিকট অলঙ্কারগুলি বন্ধক ছিল, তিনি পুলিসের নাম ও চোরাও দ্রব্যের কথা শ্রবণমাত্রই সেই সমস্ত অলঙ্কার আনিয়া দিলেন। তখন অলঙ্কারগুলি লইয়া আমরা তিনজনেই থানা-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। গোপাল বাবুর আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। উমেশ অলঙ্কারগুলি দেখিয়া একবারে অবাক্ হইল, এবং অগত্যা তখন তাহাকে সমস্ত কথা স্বীকার করিতে হইল। 

তখন সাহেবের নিকট অলঙ্কারগুলি সমেত উমেশকে উপস্থাপিত করিলাম। তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিলাম। কি প্রকারে উমেশের নাম পাইলাম, কি প্রকারে তাহার ঠিকানা পাইলাম, কিরূপে তাহাকে ধরিলাম, এবং কিরূপেই বা অলঙ্কারগুলি বাহির করিলাম, এই সমস্ত বিষয় তিনি আনুপূর্ব্বিক শ্রবণ করিলেন, ও অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারীর নিকট আমার অশেষ প্রশংসা করিলেন। 

সেই রাত্রিতে উমেশ আমার নিকটেই রহিল। আমি তাহাকে কহিলাম,—“দেখ উমেশ! তোমার কোন কথাই জানিতে আমার বাকি নাই; আমি সমস্তই জানিতে পারিয়াছি। কিন্তু এখন তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি; দেখি, তুমি সত্য বল, কি মিথ্যা বল। ইতিপূর্ব্বে তোমার যে আরও দুই তিন বার কারাবাস হইয়াছে, সেই দুই তিন বার তুমি কি কি অপরাধ করিয়াছিলে? তুমি যদি সমস্ত সত্য না বল, তাহাতে তোমারই বিলক্ষণ অনিষ্ট হইবে; অথচ আমার কিছুই জানিতে বাকি থাকিবে না। কারণ, তোমার সকল কথাই থানার কাগজ-পত্রে প্রকাশ আছে। কেবল পরীক্ষার জন্য জিজ্ঞাসা করিতেছি।” 

আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া উমেশ কহিল,—“যাহাতে কোন লাভ নাই, সে বিষয়ে মিথ্য বলিয়া ফল কি? আমি সমস্তই বলিতেছি—-আপনি শ্রবণ করুন।” 

এই বলিয়াই উমেশ বলিতে লাগিল, “মহাশয়! আমার বাসস্থান বাঁকুড়া জেলায় বনবিষ্ণুপুর গ্রামে। আমার নাম শ্রী উমেশচন্দ্র রায়। আমার পিতার নাম গোবিন্দচন্দ্র রায়। আমি পিতার প্রথম পক্ষের সন্তান। যখন আমার বয়ঃক্রম চারি বৎসর, সেই সময় আমার মাতার প্রাপ্তি হয়। ইহার অতি অল্পদিবস পরেই আমার পিতা পুনরায় বিবাহ করেন। পূর্ব্বে পিতা আমাকে অতিশয় ভালবাসিতেন, এবং যত্ন করিতেন। কিন্তু এই বিবাহের পর হইতে সেই অপত্যস্নেহ ক্রমে ক্রমে তাঁহার হৃদয় হইতে লোপ পাইতে আরম্ভ হয়। আর জানি না, কি জন্য বিমাতাও আমাকে দেখিতে পারিতেন না। তাঁহার নিকট ভাল কাজ করিলেও বিপদ, মন্দ কাজ করিলে ত কথাই নাই! তিনি সর্ব্বদাই আমার উপর খিট্ খিট্ করিতেন। তিনি রাত্রিদিনই আমাকে গালি দিতেন; খাবার চাহিলে মারিতে আসিতেন, জল চাহিলে বকিতেন। এই সকল কথা যদি পিতার নিকট কখনও বলিতাম, তিনিও আবার বিমাতার পক্ষ অবলম্বন করিয়া আমার লাঞ্ছনার একশেষ করিতেন। ইহার উপর যদি আবার তিনি আমার বিমাতার চক্ষে জল দেখিতেন, (কারণ, আমার বিপক্ষে কোন কথা পিতাকে বলিতে হইলে প্রায়ই তাঁহার চোখের জলে বুক ভাসিয়া যাইত। জানি না, এত জল বিনাকারণে কোথা হইতে আসিত!) তাহা হইলে সে দিন আমার যে কি ভয়ানক অবস্থা হইত, তাহা আমিই তখন জানিতাম; আর পাড়ার প্রতিবেশিগণের মধ্যেও কেহ কেহ জানিতেন। 

“এইরূপে উদর পূরিয়া খাইতে না পাইয়া, বস্ত্রদ্বারা শরীর আচ্ছাদন করিতে না পরিয়া, ভয়ানক দুঃখে ও কষ্টে প্রায় পনর বৎসর কাটাইলাম। এই সময়ে আমার একটি বৈমাত্রেয় ভ্রাতা জন্মগ্রহণ করিলেন; আর সেই সঙ্গে সঙ্গে আমার দুঃখ-কষ্ট আরও বৃদ্ধি হইল। কিন্তু এখন আর আমি বালক নহি; সুতরাং সেই সকল কষ্ট কোন প্রকারেই সহ্য করিতে না পারিয়া, পিতামাতাকে কিছু না বলিয়াই, আমি বাটী হইতে বহির্গত হইলাম। সেই সময়ে আমাদিগের গ্রামের একটি লোক কলিকাতায় আসিতেছিলেন; আমিও তাঁহারই সহিত কলিকাতায় আগমন করিলাম। 

“কলিকাতায় একটি হোটেলে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। লেখাপড়া শিখি নাই যে, অন্য কোন উপায়ে আপনার উদরান্নের সংস্থান করিব। অগত্যা সেই হোটেলের কার্য্য শিখিতে লাগিলাম; রন্ধন করিতে আরম্ভ করিলাম। সেই হোটেলটি একটি স্ত্রীলোকের। অতি অল্পদিবসের মধ্যেই আমার কাৰ্য্য দেখিয়া তিনি অতিশয় সন্তুষ্টা হইলেন। তাঁহার একটি প্রণয়ী ব্রাহ্মণ ছিলেন, তিনিও আমাকে অতিশয় ভালবাসিতে ও যত্ন করিতে লাগিলেন; তবে তাহা আন্তরিক কি না, জানি না। কারণ, কর্ত্রী-ঠাকুরাণী যখন আমাকে আন্তরিক ভালবাসিতেন, তখন তাঁহাকে ত বাধ্য হইয়াই ভালবাসিতে হইবে। এখন আমার আহারের আর কোন কষ্ট নাই; কর্ত্রী ঠাকুরাণীর নিজের তত্ত্বাবধানেই আমার আহারের আয়োজন হইতে লাগিল। ঘৃত দুগ্ধের ‘রোজ’ হইল, বড় বড় মৎস্যের মস্তক আমার একচেটিয়া হইল। পরিধেয় বস্ত্রেরও কষ্ট নাই; ভাল ভাল কাপড় ও জুতা দেখিলেই কর্ত্রী ঠাকুরাণী আমার নিমিত্ত ক্রয় করিতেন। এই সময় তাঁহার সেই প্রণয়ী ব্রাহ্মণ স্বদেশে গমন করিলেন; কিন্তু আর ফিরিলেন না। কেন যে আর ফিরিলেন না, তাহার কারণ কিছুই বুঝিতে পরিলাম না। 

“কর্ত্রী-ঠাকুরাণীর বয়ঃক্রম প্রায় পঞ্চাশ বৎসর হইবে। আর আমি তখন কেবল বিংশতি বৎসরে উপনীত হইয়াছি। কিন্তু তখন তাঁহার সহিত আমার যেরূপ সম্বন্ধ হওয়া উচিত, তাহার বিপরীত হইল। আমিই সেই ব্রাহ্মণের স্থান অধিকার করিলাম। কেন যে আমি সেইস্থানে বসিলাম, তাহা বলিতে পারি না। কর্ত্রী ঠাকুরাণী নিজেই আমাকে সেইস্থানে বসাইলেন, কাজেই আমি বসিলাম। এইরূপে তিন চারি বৎসর অতীত হইতে না হইতেই কর্ত্রী-ঠাকুরাণী মরিয়া গেলেন। আর তখন তাঁহার যাহা কিছু ছিল, সেই সঙ্গে সঙ্গে দেনার দায়ে সমস্তই বিক্রয় হইয়া গেল। 

“এখন আর আমার উপায় কি? যাহা হউক, অনেক খুঁজিয়া পাতিয়া আর এক উপায় অবলম্বন করিলাম। আমাদিগের দেশের একটি ব্রাহ্মণ কলিকাতার ভিতর একজন বড়লোকের বাড়ীতে রন্ধন করিতেন। তিনি যাঁহার বাটীতে কর্ম্ম করিতেন, তাঁহার নাম বলিব না, অথবা তিনি কোন জাতি, তাহাও আমি প্রকাশ করিব না। তবে যে জাতির ঘরের কথা লইয়া সকলেই আমোদ করিয়া থাকেন, কলিকাতার ভিতর আজকাল যে জাতির প্রাধান্য অধিক, যাহাদের ঘরের স্ত্রীলোকগণ ফুরফুরে শান্তিপুরে ‘বাসি-করা’ ধুতি পরিয়া আপন আপন অঙ্গের সৌষ্ঠব (যাহার ভাগ্যে ঘটে, তাহাকে) দেখাইয়া থাকেন, যে ঘরে স্ত্রীলোকদিগের পরিহিত সূক্ষ্মবস্ত্রের ভিতর দিয়া অলক্তক-রঞ্জিত শরীরের আভা বহির্গত হইয়া যুবকগণের মস্তক ঘুরাইয়া দেয়, ইনিও সেই শ্রেণীর একজন বড়লোক। 

“আমাদিগের দেশের সেই ব্রাহ্মণটি আমাকে সঙ্গে করিয়া তাঁহার মনিবের বাটীতে লইয়া গেলেন; এবং কর্তা ও গিন্নির আদেশ লইয়া, তাঁহার কার্য্যে আমাকে তিন মাসের জন্য নিযুক্ত করিয়া তিনি দেশে চলিয়া গেলেন। আমি রন্ধনাগারের সমস্ত কৰ্ম্ম দেখিয়া লইলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

“প্রাগুক্ত বাড়ীর নিয়ম এই যে, প্রাতঃকালে বেলা দশটার মধ্যে সমস্ত রন্ধন শেষ করিতে হইবে। প্রথমে বালকগণ আহার করিয়া বিদ্যালয়ে যাইবে। তাহার পর যাঁহারা কোন আফিসে কর্ম্ম করেন, তাঁহারা আহার করিয়া আফিসে যাইবেন। তাহার পর স্ত্রীলোকগণ আহারাদি করিয়া শয়ন করিবেন। সকলের শেষ কর্তারা আহার করিলে পর সেই বেলার কার্য্য শেষ হইবে। ইহার পর বেলা দুইটার সময় আবার জলখাবার প্রস্তুত করিয়া কি স্ত্রী, কি পুরুষ, সকলের ঘরেই দিয়া আসিতে হইবে। তৎপরে সন্ধ্যার সময় আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত হইলে, পুরুষগণ আহার করিয়া কোথায় চলিয়া যাইবেন; বালকগণ আহারান্তে শয়ন করিবে; আর স্ত্রীলোকগণের মধ্যে কেহ কেহ রন্ধনাগারে আসিয়া উপবেশনপূর্ব্বক আহার করিবেন। আর যারা না আসিবেন, তাঁহাদের আহারীয় দ্রব্যের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করিতে হইবে, অর্থাৎ সমস্ত কার্য্য সমাপ্ত করিয়া বাসায় যাইবার সময় যিনি আহার করেন নাই, তাঁহার গৃহে আমাদিগকে সেই আহারীয় দ্রব্য রাখিয়া যাইতে হইবে। 

“এই বাড়ীর সকল স্ত্রীলোকই সন্ধ্যার পর রন্ধনাগারে আসিয়া আহার করিতেন। কর্তা মহাশয়ের কেবল একটি ষোল সতর বৎসর বয়স্কা সধবা কন্যা আহার করিতে আসিতেন না। কেবল তাঁহারই আহারীয় দ্রব্য রাত্রিকালে তাঁহার গৃহে রাখিয়া আসিতে হইত। 

“প্রথম দিবস সকলের আহার সম্পন্ন হইলে, উক্ত কন্যার আহারীয় দ্রব্য লইয়া তাঁহার শয়ন গৃহে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে, আর তিনি সেই গৃহ-মধ্যস্থিত দুগ্ধফেননিভ পালঙ্কের উপর শয়ন করিয়া আছেন। তাঁহার শরীরের বসন অর্দ্ধচ্যুত অবস্থায় রহিয়াছে। আমি ইহা দেখিয়া কিছু লজ্জিত ও ভীত হইলাম; এবং তাড়াতাড়ি তাঁহার আহারীয় দ্রব্য রাখিয়া, গৃহের দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া, আস্তে আস্তে চলিয়া আসিলাম। 

পরদিবস প্রাতঃকালে যখন আমি রন্ধন কাৰ্য্যে ব্যস্ত আছি, সেই সময় তাঁহার পরিচারিকা আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইল, ও আমাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, ‘গত রাত্রিতে ‘মেয়েবাবুর’ যে আহার হয় নাই! তিনি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন, আর তুমি সেইস্থানে খাবার রাখিয়া আসিয়া ছিলে। তাঁহাকে ডাকিয়া দেও নাই; সুতরাং তাঁহার আহার হয় নাই। বড় মানুষের মেয়েদের ভাব তুমি জান না, তাঁহারা অল্পেতেই নিদ্রা যান। আজ যখন তাঁহার আহারীয় দ্রব্য রাখিয়া আসিবে, সেই সময়ে তাঁহাকে উঠাইয়া দিও। দেখিও, আজও যেন তাঁহাকে উপবাস না করিতে হয়।’ আমি তাহাতেই সম্মত হইলাম। পরিচারিকাও চলিয়া গেল। 

“সেই দিবস রাত্রিকালে পুনরায় তাঁহার আহারীয় দ্রব্য লইয়া তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিলাম; এবং তাঁহাকে পূৰ্ব্বরূপ নিদ্রিত অবস্থাতেই দেখিতে পাইলাম। তখন নির্দিষ্ট স্থানে আহারীয় দ্রব্য রাখিয়া, “মেয়েবাবু”, “মেয়েবাবু” বলিয়া তাঁহাকে কতই ডাকিলাম; কিন্তু কিছুতেই মেয়েবাবুরুনিদ্রাভঙ্গ হইল না। তখন অন্য উপায় না দেখিয়া, অগত্যা কর্ত্রী—ঠাকুরাণীর গৃহের নিকট গিয়া তাঁহাকে ডাকিলাম। তিনি বাহিরে আসিলেন, আমি তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিলাম। তিনি আসিয়া ‘মেয়েবাবুর’ গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন; আমিও প্রস্থান করিলাম। 

“পরদিবস প্রাতঃকালে ‘মেয়েবাবুর’ পরিচারিকা পুনরায় আমার নিকট আসিল; পূর্ব্বদিন কর্ত্রী ঠাকুরাণীকে ডাকিয়া দিয়াছিলাম বলিয়া, কতকগুলি মিষ্ট মিষ্ট ভর্ৎসনা করিল। আর যাহাতে ভবিষ্যতে পুনরায় এইরূপ কার্য্য না করি, তাহারও উপদেশ প্রদান করিল; বলিল,—বড় মানুষের মেয়েদের অবস্থা তুমি জান না। তাহাদের নিদ্রা অতিশয় খারাপ। এখন হইতে পুনরায় যখন তুমি আহারীয় দ্রব্য লইয়া তাঁহার গৃহে গমন করিবে, তাঁহাকে নিদ্রিত দেখিলে, প্রথমে তাঁহাকে ডাকিবে। তাহাতেও যদি তিনি না উঠেন, তাহা হইলে তাঁহার গায়ে হাত দিয়া নাড়িবে। ইহাতেও যদি তাঁহার ঘুম না ভাঙ্গে, তাহা হইলে তাঁহার হস্ত ধরিয়াই হউক বা মস্তক ধরিয়াই হউক, উঠাইয়া বসাইয়া দিবে। তাঁহাকে বসাইয়া দিতে পারিলে তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইবে, তিনি আহার করিতে বসিবেন। যতক্ষণ তাঁহার আহার শেষ না হয়, ততক্ষণ আপনি সেইস্থানে থাকিবেন। তিনি আহার করিয়া শয়ন করিলে তবে আপনি চলিয়া যাইবেন। 

“পরিচারিকার এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি ভাবিলাম যে, অত বড় মাগীকে এইরূপ করিয়া ঘুম ভাঙ্গাইতে হইবে! বড়মানুষের কি সকলই আশ্চর্য্য! যাহা হউক, প্রকাশ্যে তাহাকে বলিলাম, -”তুমি যাহা বলিলে, তাহা সমস্তই শুনিলাম; কিন্তু তিনি যেরূপভাবে শয়ন করিয়া থাকেন, তাহাতে বিশেষতঃ তাত বড় ভদ্রলোকের কন্যার গায়ে আমি কিরূপে হাত দিয়া তাঁহাকে ডাকিব? পরে তিনিই বা কি মনে করিবেন? আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া পুনরায় পরিচারিকা কহিল, “কেহ কিছু মনে করিবে না। বড়মানুষের মেয়েদিগকে প্রায় এইরূপেই ঘুম ভাঙ্গাইতে হয়। আমি যাহা যাহা বলিয়া দিলাম, তাহার যদি আজ কোনরূপ ব্যতিক্রম হয়, তাহা হইলে ভাল হইবে না।’ এই বলিয়া পরিচারিকা প্রস্থান করিল। 

‘নিয়মিত সময়ে আহারীয় দ্রব্য লইয়া তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, তিনি পূৰ্ব্বমত নিদ্রায় অভিভূত। অধিকন্তু অন্য দিবস তাঁহার শরীরে যে অল্প পরিমাণ বস্ত্র থাকে, আজ আবার তাহাও নাই। আমি আহারীয় দ্রব্য সেইস্থানে রাখিয়া দিলাম ও তাঁহাকে বার বার ডাকিলাম। কিন্তু তাঁহার কোন প্রকারেই ঘুম ভাঙ্গিল না। তখন আস্তে আস্তে বিছানা হইতে তাঁহার কাপড় উঠাইয়া লইয়া তাঁহার শরীরের যে যে স্থান অনাবৃত ছিল, তাহা ঢাকিয়া দিলাম। এবং অনেক ভাবিয়া চিওয়া পরিশেষে তাঁহার পায়ে হাত দিলাম; ডাকিতে ডাকিতে পা ধরিয়া টানিতে লাগিলাম। তাহাতে তিনি আস্তে আস্তে পা গুটাইয়া লইয়া পাশ ফিরিয়া পালঙ্কের অন্য ধারে ফিরিয়া শুইলেন; কিন্তু নিদ্রা ভাঙ্গিল না। বড় পালঙ্ক; সুতরাং নীচে দাঁড়াইয়া আর তাঁহাকে হাতে পাইলাম না। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া আবার পরিচারিকার কথা স্মরণ করিলাম। আস্তে আস্তে তখন পালঙ্কের উপরে উঠিলাম; তাঁহার পৃষ্ঠে হাত দিয়া ঠেলিতে ঠেলিতে ডাকিতে লাগিলাম। কিন্তু তাঁহার যে কি ভয়ানক নিদ্রা, কিছুতেই ভাঙ্গিল না। যাহা হউক, তখনও ভাবিলাম, তাঁহাকে উঠাইয়া বসাইতে পারিলেই তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিবে। সুতরাং তাঁহার স্কন্ধের নীচে হাত দিয়া তাঁহাকে উঠাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কিন্তু কি বিপরীত ঘটনা! 

মনে মনে ভাবিলাম, বড়মানুষের মেয়েদের ঘুম ভাঙ্গাইতে সহসা সাহস করাও আমাদিগের দ্বারা হইতে পারে না। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

“এইরূপে প্রতিদিনই তাঁহার ঘুম ভাঙ্গাইয়া তাঁহাকে খাবার দিয়া, প্রায় তিন মাস কাটাইলাম। সেই সময় মেয়েবাবুর শ্বশুরবাড়ী হইতে লোক আসিয়া তাঁহাকে লইয়া গেল। তাঁহাদের সেই পুরাতন ব্রাহ্মণও আসিল, আমারও জবাব হইল। যাহা হউক, সেইদিন হইতে সেইরূপ আর একটি চাকরি জুটাইবার জন্য আমি কতই সন্ধান করিলাম; কিন্তু কিছুতেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলাম না। কারণ, সেরূপ চাকরি প্রায়ই খালি হয় না; সেরূপ ব্রাহ্মণদিগের প্রায়ই জবাব হয় না। 

‘ইহার কিছুদিন পরে একজন ব্রাহ্মণের বাড়ীতে আমার কর্ম্ম হইল। সেই বাড়ীতে আর কেহই ছিলেন না, কেবল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, আর তাঁহার বৃদ্ধা স্ত্রী। উভয়েই আমাকে অতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন, পুত্র-সদৃশ ভালবাসিতে লাগিলেন। সেই বাড়ীতে একটি ঝি ছিল, তাহার নাম কামিনী। কামিনীকে আপনি অদ্য দেখিয়া আসিয়াছেন। সেই কামিনীর সহিত আমার ক্রমে ভালবাসা জন্মিল। আর ইহা জানিতে পারিয়া, বৃদ্ধাব্রাহ্মণ আমাদিগকে জবাব দিলেন। আমরা উভয়েই তাঁহার বাড়ী হইতে চলিয়া আসিলাম। আসিবার সময় উপস্থিতমত যে সকল দ্রব্যাদি পাইলাম, তাহাই চুরি করিয়া লইয়া আসিলাম। বৃদ্ধাব্রাহ্মণ জানিতে পারিয়াও আমাদের অবস্থার বিষয় স্মরণ করিয়া, আর আমাদিগকে কিছুই বলিলেন না; থানায় গিয়া নালিসও করিলেন না। সেই সকল দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া কিছু দিবস অতিবাহিত করিলাম। 

“ইহার কিছুদিবস পরে আর একস্থানে আমার চাকরি হইল। সে বাড়ীতে “রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের” মূর্ত্তি ছিল, এবং ঐ মূর্ত্তির কতকগুলি সোণা-রূপার অলঙ্কার ছিল। কিছুদিন সেইস্থানে কর্ম্ম করিতে করিতে সুযোগমত একদিন রাত্রিযোগে চাবি ভাঙ্গিয়া সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, বিগ্রহদ্বয়ের সমস্ত গহনা খুলিয়া লইয়া পৃথক্‌ পৃথক্‌ কয়েক স্থানে লুকাইয়া রাখিলাম। প্রাতঃকালে ভয়ানক গোলযোগ হইল। থানায় সংবাদ দেওয়া হইল। পুলিস আসিয়া তদারকে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং পরিশেষে আমাকেই সন্দেহ করিয়া ধরিলেন। একস্থান হইতে কতক পরিমাণ অলঙ্কারও বাহির হইল। সেই মোকদ্দমায় আমার একমাস কারাবাস হইল। কামিনী আমাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত সাধ্যমত চেষ্টা করিল; কিন্তু কিছুতেই বাঁচাইতে পারিল না। এক মাস পরে জেল হইতে খালাস হইলাম। যে যে স্থানে অপর অপর অলঙ্কারগুলি ছিল, তখন তাহা বাহির করিয়া লইয়া, কামিনীর হস্তে অর্পণ করিলাম। কামিনী অতিশয় সন্তুষ্টা হইল। আর চাকরির যোগাড় দেখিলাম না; সেই সকল দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া ক্রমে ক্রমে খাইতে লাগিলাম। যখন সমস্ত ফুরাইয়া গেল, তখন কামিনী খরচের নিমিত্ত পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিল। কিন্তু কোন স্থানেই আর চাকরির যোগাড় করিতে পারিলাম না। সুতরাং আমাকে অন্য উপায় দেখিতে হইল। 

“প্রত্যহ বেলা বারটার সময় কামিনীর বাটী হইতে বহির্গত হইতে আরম্ভ করিলাম। সেই সময় যে কোন ভদ্রলোকের বাটীতে প্রবেশ করাই আমার কর্ম হইল। বৈঠকখানায় যদি কাহাকেও দেখিতে পাইতাম, তাহা হইলে আমার মনে যাহা উদয় হইত, অঁহাকে তাহাই জিজ্ঞাসা করিয়া আস্তে আস্তে বহির্গত হইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতাম। আর যদি কাহাকেও দেখিতে না পাইতাম, তাহা হইলে রূপার হুঁকা, কাপড় প্রভৃতি যাহা সম্মুখে দেখিতাম, তাহাই লইয়া প্রস্থান করিতাম। সেই সকল দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া যাহা কিছু পাইতাম, কামিনীকে দিতাম; কামিনী সন্তুষ্টা হইত। গ্রীষ্মকালে এই উপায়ে বড় অধিক লাভ হইত না, কোন প্রকারে নিতান্ত আবশ্যক খরচমাত্র নির্ব্বাহ হইত। শীতকালে বিলক্ষণ উপার্জ্জন করিতাম। কারণ, সেই সময়ে ভাল ভাল বস্ত্র ও শাল প্রায়ই বাবুদিগের বৈঠকখানায় পাইতাম। সেই সকল বস্ত্র পরিধান করিয়া বহির্গত হইলে আর কেহই কোন সন্দেহ করিত না। এইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া কিছু দিবস অতিবাহিত করিলাম। কামিনীর গৃহও নানা দ্রব্যে পূর্ণ করিয়া দিলাম। কিন্তু কিছুদিবস অতিবাহিত হইতে না হইতেই লোকের বৈঠকখানা হইতে যে এইরূপে চুরি আরম্ভ হইয়াছে প্রায় সমস্ত লোকই তাহা জানিতে পারিল। এই চোর ধরিবার নিমিত্ত পুলিস অতিশয় সতর্ক হইল, গুপ্তবেশে সকলের দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে লাগিল। এই সময় একদিবস একটি বাবুর বৈঠকখানা হইতে বহির্গত হইবার সময় হঠাৎ একজন গুপ্তবেশী পুলিসের সম্মুখে পড়িলাম। আমার হস্তে একটি রূপার হুঁকা দেখিয়া সন্দেহ-প্রযুক্ত তিনি আমাকে ধৃত করিয়া থানায় লইয়া গেলেন। সন্ধান করিয়া হুঁকার অধিকারীকে পাওয়া গেল। আমার নামে চুরির মোকদ্দমা উপস্থিত করা হইল। সেই সময় আমার বাসস্থান জানিবার নিমিত্ত আমাকে লইয়া কত পীড়াপীড়ি হইয়াছিল; কিন্তু আমি কিছুতেই তাহা প্রকাশ করিলাম না, কামিনীর বাড়ী কিছুতেই তাঁহাদিগকে দেখাইলাম না। তখন তাঁহারা অনন্যোপায় হইয়া আমাকে মাজিস্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে লইয়া গেলেন। সেইস্থান হইতে আমার প্রতি তিন মাস কারাবাসের আজ্ঞা হইল। 

“তিন মাস পরে জেল হইতে বহির্গত হইলাম। আবার কামিনীর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কামিনী আদরের সহিত আমাকে তাহার গৃহে স্থান দিল। আমি সেইস্থানেই থাকিলাম। কিন্তু এক মাস অতীত হইতে না হইতেই কামিনী খরচের নিমিত্ত আবার পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিল। কাজেই তাহাকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত আমি যত্ন করিতে লাগিলাম; অর্থ সংগ্রহের উপায় দেখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। পূর্ব্ব উপায়ে চুরি করিলেই যে ধরা পড়িব, তাহাও ভাবিলাম। 

“সেই সময়ে আমি অতি প্রত্যূষে উঠিয়া কখনও হাবড়া ষ্টেশনে, কখন বা শিয়ালদহের ষ্টেশনে ভদ্রলোকের বেশে গমন করিতাম; ও যে স্থানে তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট দেওয়া হয়, সেইস্থানেই উপস্থিত হইতাম। টিকিট লইবার সময় এই সকল স্থানে যে কিরূপ ভয়ানক ভিড় হয়, তাহা যাঁহারা দেখিয়াছেন, তাঁহারাই জানেন। সহজে তাহার ভিতর প্রবেশ করিয়া টিকিট ক্রয় করা কাহার সাধ্য! বিশেষতঃ তাহার উপর রেলওয়ে কর্মচারীগণের আবার অত্যাচার আছে। যাঁহারা বলবান, তাঁহারা কোন উপায়ে সেই ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিয়া টিকিট ক্রয় করিতে সমর্থ হন। আর যাঁহারা বৃদ্ধ, রুগ্ণ ও স্ত্রীলোক, তাঁহারা কোনক্রমেই সেই ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিতে সমর্থ হন না। তাঁহারা কোন ভদ্রলোককে টিকিট খরিদ করিতে যাইতে দেখিলে, তাঁহাকেই তোষামোদ করিয়া টিকিটের মূল্য দিয়া টিকিট ক্রয় করিয়া আনিবার জন্য অনুরোধ করেন। সেই ভদ্রলোকও তাঁহাদিগের অবস্থা দেখিয়া দয়া করিয়া তাঁহাদিগের অনুরোধক্রমে টিকিট ক্রয় করিয়া আনিয়া দেন। 

“ষ্টেশনে গিয়া এইরূপ কোন স্ত্রীলোক বা বৃদ্ধ প্রভৃতি কাহাকেও দেখিলে আমি তাঁহার নিকট গিয়া বসিতাম; এবং তিনি কোথায় যাইবেন, তাহা জিজ্ঞাসা করিতাম। পরে আমিও সেইস্থানে গমন করিব বলিয়া তাঁহাকে প্রতারিত করিতাম ও নানারূপ গল্প করিয়া আমার উপর তাঁহার বিশ্বাস স্থাপনের চেষ্টা করিতাম। টিকিট লইবার সময় হইলে আমি আমার নিমিত্ত টিকিট লইতে যাইতেছি, এই কথা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিতাম; তিনিও আমার অনুগ্রহের প্রার্থনা করিতেন। তাঁহার টিকিট ক্রয় করিবার মূল্য আমাকে প্রদান করিতেন। তখন আমিও সেই মূল্যসহ টিকিট ক্রয় করিবার ছলে তথাকার ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিতাম। আমি ষ্টেশনের গতিবিধি ভালরূপ জানিতাম বলিয়া সেইস্থানে প্রবেশ করিতে আমার কোন কষ্টই হইত না। শীঘ্র টিকিটও পাইতাম। আমি যে স্থানের টিকিট ক্রয় করিব বলিয়া যাইতাম, তাহা ক্রয় না করিয়া নিকটবর্তী কোন এক ষ্টেশনের টিকিট অতি অল্প মূল্যে ক্রয় করিতাম, এবং বক্রী মূল্য সমস্তই সাবধানে নিজের পকেটে রাখিতাম। পরে সে স্থান হইতে বাহির হইয়া সেই টিকিট উক্ত স্ত্রীলোক বা বৃদ্ধের হস্তে অর্পণ করিতাম। এইরূপে আমার উপর তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস জন্মাইতে, তিনি আর কোন প্রকার সন্দেহ না করিয়া সেই টিকিট আপন বস্ত্রে বাঁধিয়া রাখিতেন। আমি এদিকওদিক্ বেড়াইতে বেড়াইতে সেইস্থান হইতে অন্তর্হিত হইতাম। আমাকে সে দিবস আর কেহই সেইস্থানে দেখিতে পাইতেন না। পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি তখন অন্য সকলের সহিত গাড়িতে উঠিতেন, এবং তাঁহার নিরূপিত স্থানে গিয়া উপনীত হইতেন। কিন্তু যে ষ্টেশনে তিনি অবতরণ করিতেন, সেইস্থানে সেই টিকিট দিবার সময় সমস্ত কথা প্রকাশ হইত। সুতরাং তখন তাঁহাকে সবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইত, রেলওয়ে কোম্পানী তাঁহারই নিকট হইতে পুনরায় মাশুল আদায় করিয়া লইতেন। 

এইরূপে কিছুদিবস নানাপ্রকার জুয়াচুরি করিতে করিতে পুনরায় একদিবস ধরা পড়িলাম। ‘দাগী চোর’ বলিয়া এবার আমার ছয়মাস কারাদণ্ড হইল। সেই ছয়মাস পরে কারামুক্ত হইয়াই পুনরায় আসিয়া কামিনীর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। কিন্তু অর্থের অনটন ঘুচিল না। 

“কিছুদিবস কামিনীর বাড়ীতে থাকিয়াই এবার চাকরির উমেদারী করিতে লাগিলাম। বহুবাজারের আপনার সেই পরিচিত হোটেলে নিত্য গমনাগমন করিতে লাগিলাম। পরিশেষে এই গোপালবাবুর বাসায় কৰ্ম্ম হইল। তাহার পর যাহা যাহা হইয়াছে, তাহা আপনি নিজেই জানেন; আমি আর কি বলিব? 

পরদিবস উমেশকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট লইয়া গেলাম। গোপালবাবুও গমন করিলেন। আদালতেও উমেশ কোন কথাই অস্বীকার করিল না। যাহা হউক, মাজিষ্ট্রেট সাহেবের বিচারে তাহার ছয়মাস কারাবাস হইল। আর গোপাল বাবু অলঙ্কারগুলি ফিরিয়া পাইয়া আমাকে কৃতজ্ঞহৃদয়ে ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন, এবং হাসিতে হাসিতে আপন বাসা অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী, নতুন-ব্রতী আমার এই কার্যে আমার উপর সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন, এবং আমাকে একখানি প্রশংসাপত্র প্রদান করিলেন। 

[অগ্রহায়ণ, ১৩০০] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *