বাঃ গ্রন্থকার! (অর্থাৎ পুস্তক-প্রণেতার অদ্ভূত জুয়াচুরি রহস্য!)

বাঃ গ্রন্থকার! (অর্থাৎ পুস্তক-প্রণেতার অদ্ভুত জুয়াচুরি রহস্য!) 

একদিবস আদেশ পাইলাম, বহুদিবস হইতে রেজেষ্টারী আফিসে যে একটি জুয়াচুরি হইয়া আসিতেছে, আজ সেই জুয়াচুরির অনুসন্ধানে আমাকে নিযুক্ত হইতে হইবে। 

আদেশ পাইয়া রেজেষ্টারী আফিসে গমন করিলাম। সেইস্থানে গিয়া দেখিলাম, এ জুয়াচুরি কোনরূপ দলিল পত্র ঘটিত নহে, ইহা অন্য প্রকারের। ইহা শিক্ষিত লোকের জুয়াচুরি, প্রকাশিত পুস্তক লইয়া জুয়াচুরি। 

আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে অধিক দিবসের কথা নহে। তথাপি এখন রেজেষ্টারী আফিসের যেরূপ নিয়ম হইয়াছে, সেরূপ নিয়ম তখন ছিল না। তখন নিয়ম ছিল, এতদ্দেশে যে কোন পুস্তক প্রকাশিত হইবে, প্রকাশক তাহার তিনখানি রেজেষ্টারী আফিসে প্রদান করিবেন। সেই পুস্তকের উপর যে মূল্য লিখিত থাকিবে, গবর্ণমেণ্ট তাহা প্রকাশককে প্রদান করিবেন; এখনও প্রকাশককে তাঁহার প্রকাশিত সমস্ত পুস্তক পূর্ব্বের মত অর্পণ করিতে হয় সত্য, কিন্তু গবর্ণমেণ্ট এখন আর তাহার মূল্য প্রদান করেন না। যে ঘটনা অবলম্বনে আমাকে এই প্রবন্ধ লিখিতে হইতেছে, উক্ত ঘটনা ঘটিবার পর হইতেই গবর্ণমেন্ট এক নূতন আইন পাস করেন। সেই সময় হইতেই প্রকাশকদিগকে প্রদত্ত পুস্তকের মূল্য পাইতে বঞ্চিত হইতে হয়। 

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে আমাকে বিশেষ কষ্ট পাইতে হয় নাই, বা বুদ্ধি-বৃত্তির বিশেষ প্রয়োজন হয় নাই। আমি সহজেই এই জুয়াচুরি কাণ্ডে পরিলিপ্ত পূর্ণানন্দ ভক্তকে ধৃত করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। সে এই জুয়াচুরি এবং অপরাপর কয়েকটি জুয়াচুরি সম্বন্ধে আমাকে যাহা বলিয়াছিল, তাহা শুনিলেই পাঠকগণ জানিতে পারিবেন, -এতদ্দেশীয় শিক্ষিত গ্রন্থকারদিগের মধ্যেও অনেকে কিরূপে জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া দিনযাপন করিয়া থাকেন। 

পরবর্ণিত জুয়াচুরিগুলি পূর্ণানন্দের দ্বারা সম্পন্ন হইলেও তিনি কিন্তু কখন রাজদ্বারে দণ্ডিত হয়েন নাই। কিন্তু বর্তমান জুয়াচুরিতে তিনি অব্যাহতি পান নাই, বিচারক তাঁহাকে ছয়মাসের নিমিত্ত কঠিন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। 

কারারুদ্ধ হইবার পূৰ্ব্বে পূর্ণানন্দ আমাকে যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার সারমর্ম্ম এই :—

(এক) 

“আমি যখন দেখিলাম, আর কোন প্রকারেই আপন সংসারের ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে পারি না, তখন নূতন জুয়াচুরির এক অপূর্ব্ব উপায় বাহির করিলাম। ইহা অতি সহজ ও নিতান্ত সামান্য। সাহিত্য-সমাজের সহিত আমি বিশেষরূপে পরিচিত ছিলাম বলিয়া, রেজেষ্টারী আফিসের যে সকল নিয়ম আছে, তাহা আমি অতি উত্তমরূপেই জানিতাম। জানিতাম, কোন নূতন পুস্তক সেইস্থানে লইয়া গেলেই তাহার তিন খণ্ডের মূল্য বিনাক্লেশেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। 

“যে সময়ে আমার মনে এই নূতন ভাবের উদয় হইল, এখন আমার নিকট একটিমাত্রও পয়সা ছিল না, বা কেহ আমাকে কর্জ্জ দিবে, সেরূপলোকও খুঁজিয়া পাইলাম না। অথচ অভাব পক্ষে দুই তিন টাকা মূলধন স্বরূপ না পাইলে, এই নূতন ব্যবসা চালাইতে পারি না। কিরূপে এই টাকার সংস্থান করিতে পারিব এই ভাবিয়া, আমি নিতান্ত চিন্তিতান্তঃকরণে বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। কোথায় যে গমন করিব, তাহার ঠিকানা নাই; কি উপায় যে অবলম্বন করিব, তাহারও স্থিরতা নাই। তথাপি একমনে নানারূপ ভাবিতে ভাবিতে গমন করিতে লাগিলাম, ক্রমে আমি নিমতলা ষ্ট্রীটে গমন করিলে দেখিলাম, একজন কাবুলবাসী রেপার প্রভৃতি বিক্রয় করিবার মানসে সেইস্থান দিয়া গমন করিতেছে। তাহা দেখিয়া আমি উহাকে ডাকিলাম, সে আমার নিকটে আগমন করিলে তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থানের একটি বৃহৎ অথচ পুরাতন বাড়ীর দরজায় গিয়া উপবেশন করিলাম। কহিলাম, “আখা সাহেব! তোমার নিকট ভাল রেপার আছে, একখানি দিতে পার?” আমার কথা শুনিয়া আখাসাহেব যেন হস্তে স্বর্গ পাইলেন, তাড়াতাড়ি তাহার গাঁটরি খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে দুই তিনখানি রেপার বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি উহার মূল্য জিজ্ঞাসা করায় তিনি যে দর বলিলেন, তাহাতে আমি বুঝিলাম, প্রকৃত দর অপেক্ষা ইনি প্রায় তিনগুণ অধিক চাহিতেছেন। যাহা হউক, তাহাতেও আমি কোনরূপ আপত্তি না করিয়া, সেই রেপার-বিক্রেতাকে সেইস্থানে বসাইয়া রাখিয়া সেই রেপার বাড়ীর ভিতর দেখাইয়া আনিবার ভানে রেপার সহিত সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। আখাসাহেব আমার প্রত্যাশায় সেই দরজার উপরেই বসিয়া রহিল। 

“এই বাড়ীর ভিতরের অবস্থা আমি উত্তমরূপে জানিতাম, বাহির বাড়ীর একটা সোপানশ্রেণী অবলম্বন করিয়া আমি বৈঠকখানার উপরে উঠিলাম। উপরের বারান্দা দিয়া আমি অপর আর একখণ্ডে গমন করিলাম, সেইস্থান হইতে অন্য প্রকোষ্ঠে অবতরণ পূর্ব্বক অপর আর একটি দরজা দিয়া একটি অপ্রশস্ত গলির ভিতর গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই রেপার তিনখানিই আমার হস্তে রহিল। 

“আমি যে বাড়ীর কথা বলিতেছি, উহা কোন বনিয়াদি বড়মানুষের বাড়ী। এখন নানা অংশীদার হওয়ায়, সেই বাড়ী নানাখণ্ডে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে। অথচ একখণ্ড হইতে অপরখণ্ডে গমনাগমনের বেশ সুযোগ আছে। অনেক অংশীদার, সুতরাং অনেক লোক সৰ্ব্বদা যাতায়াত করে, এইজন্য কেহই কাহারও কোন সংবাদ লন না। কোন ব্যক্তি কে, কি প্রয়োজনে সেইস্থানে আগমন করিয়াছে, তাহা কেহই জিজ্ঞাসা করেন না। 

“সেই রেপার তিনখানি হস্তে করিয়া ক্রমে আমি সেই গলি অতিক্রম করিয়া চলিলাম। গলির ভিতর দিয়া ক্রমে নূতন বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে একজন বস্ত্র বিক্রেতার দোকানে সেই তিনখানি রেপার সাড়ে চারি টাকামূল্যে বিক্রয় করিয়া, আমার নূতন ব্যবসায়ের মূলধনের সংস্থান করিলাম। 

“কাবুলির যে কি দশা ঘটিল, তাহা আমি অবগত নহি। কারণ ইহার পর প্রায় তিনমাস কাল আমি সেই পথে পদার্পণ করি নাই। সত্য মিথ্যা জানি না, কিন্তু পরে শুনিয়াছিলাম, সেই বাড়ীর একটি লোকের নিকট হইতে অন্যায়রূপে জোর-জবরদস্তি করিয়া সে কিছু অর্থ আদায় করিয়া লইয়াছিল। 

“এই অসৎ উপায়ে উপার্জিত সাড়ে চারি টাকা সঙ্গে লইয়া, পরদিবস আমি বটতলায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে বাজে পুস্তকের অভাব নাই, বাছিয়া বাছিয়া অতি অল্পমূল্যে তিনখানি বৃহদাকারের পুস্তক “বটতলার দরে” খরিদ করিলাম। সেই পুস্তকের উপর মূল্য লেখা ছিল পাঁচ টাকা, কিন্তু আমি খরিদ করিলাম—পাঁচ আনা হিসাবে। “কেবলমাত্র পনের আনা খরচ করিয়া তিনখানি পুস্তকের সংস্থান হইল। পুস্তক কয়েকখনি লইয়া আমি আমার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম। 

“পরদিবস প্রাতঃকালে আমার পরিচিত একটি ছাপাখানায় গমন করিলাম। সেইস্থানে দেড় টাকা ব্যয় করিয়া পুস্তকের মলাট অর্থাৎ পুস্তকের সর্ব্বপ্রথম এবং সর্ব্বশেষ পৃষ্ঠা ছাপাইয়া লইলাম। আমার পূর্ব্ব-সংগৃহীত পুস্তকের মলাটে পুস্তকের যে নাম লেখা ছিল, নূতন প্রস্তুত মলাটের উপর সেই মর্ম্মের অপর একটি নাম লিখিত হইল; এবং অপর গ্রন্থকারের নামের পরিবর্তে আমার নিজের নাম সন্নিবেশিত হইল। আর পুস্তকের মূল্য লিখিত হইল, প্রত্যেক পুস্তক দশ টাকা। 

“বটতলা হইতে যে পুস্তক ক্রয় করা হইয়াছিল, তাহার উপরিস্থিত মলাটগুলি ছিঁড়িয়া ফেলিয়া তাহার পরিবর্তে আমার প্রস্তুত সেই নূতন মলাট উহাতে লাগাইয়া দিলাম। এবং একজন দপ্তরীকে দুই চারি পয়সামাত্র দিয়া সেই পুস্তকের তিনদিক উত্তমরূপে কাটাইয়া লইলাম। এখন সেই পুরাতন পুস্তকত্রয় নূতন কলেবর ধারণ করিল। সেই পুস্তক যে দেখিল, তাহারই উহা নূতন বলিয়া ভ্রম হইল। 

“কোন নূতন পুস্তক প্রস্তুত হইলে যেরূপভাবে উহা রেজেষ্টারী আফিসে প্রদত্ত হয়, ইহাও সেইরূপ ভাবে রেজেষ্টারী আফিসে লইয়া গেলাম, এবং পুস্তকের উপর যেরূপ লেখা ছিল, সেইরূপ মূল্যও প্রাপ্ত হইলাম। অর্থাৎ এইরূপ অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া তিনখানি পুস্তকের মূল্য ত্রিশ টাকা আদায় করিলাম। কেবলমাত্র আড়াই টাকা ব্যয় করিয়া দুই দিবসের মধ্যে ত্রিশ টাকা উপার্জ্জন করা নিতান্ত সামান্য নহে। 

এইরূপ উপায় অবলম্বনে আমি বহুদিবস হইতে এই ব্যবসা চালাইয়া আসিতেছি। এমন কোন মাসই যায় নাই, যে মাসে আমি ত্রিশ টাকা হইতে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত উপার্জ্জন না করিয়াছি। কিন্তু জানিনা—এতদিবস পরে কিরূপে আমার জুয়াচুরি কাণ্ড প্রকাশ হইয়া পড়িল, আর কাহারইইঙ্গিত ক্ৰমে আমি ধৃত হইলাম। আমাকে ধরিতে অবশ্য আপনাদিগের কোন কষ্টই হয় নাই। কারণ সেই সকল পুস্তকের উপর আমার নাম মুদ্রিত আছে; এবং যে ছাপাখানা হইতে সেই সকল নূতন মলাট ছাপা হইয়াছে, সেই সকল ছাপাখানার নাম এবং ঠিকানা উহারই উপর লেখা আছে। সুতরাং ছাপাখানার সন্ধান পাইলেই আমাকে ধরিতে আর বিলম্ব হইবে কেন?” 

(দুই) 

“উপরে আমি যে জুয়াচুরিকাণ্ডের বর্ণনা করিলাম, ইহাই আমার শেষ অপরাধ। আমার প্রথম জুয়াচুরি যে কিরূপে আরম্ভ হয়, তাহা আমি এই বলিতেছি। বাঙ্গালা সাহিত্য জগতে প্রবেশ করিয়া আমি অনেকদিন পর্য্যন্ত বিচরণ করিলাম। প্রথমে আমার ইচ্ছা ছিল, বঙ্গভাষার সেবা করিয়া জীবন অতিবাহিত করিব। কিছুদিবস করিলামও তাহাই। কিন্তু উহাতে যৎসামান্য উপার্জ্জন করিতে লাগিলাম, তাহাতে সংসারের অনটন কোনরূপেই কমিল না। তখন বিপদে পড়িয়া আমাকে জুয়াচুরিকাণ্ড অবলম্বন করিতে হইল, কিন্তু মহাশয় তাহাতেও সুখ পাইলাম না। জুয়াচুরি করিয়া মধ্যে মধ্যে অনেক অর্থ উপার্জ্জন করিতে লাগিলাম সত্য, কিন্তু তাহাতেও আমার সাংসারিক কষ্টের কোনরূপ লাঘব হইল না। জুয়াচুরি যদি বড়মানুষই হইবে, জুয়াচুরির উপার্জিত অর্থে যদি তাহার কষ্টের লাঘব হইবে, তাহা হইলে জগতে “সৎ ও অসৎ” এই শব্দদ্বয়ের প্রভেদ কি কেহ কখন জানিতে পারিতেন? 

“এই সময়ে আমি বঙ্গীয় উপন্যাসক্ষেত্রে প্রথম উপস্থিত হইলাম। দেখিয়া শুনিয়া, ভাবিয়া, চিন্তিয়া, চুরি করিয়া, নকল করিয়া “চিরন্মদা” নামক একখানি ক্ষুদ্র উপন্যাস বাহির করিলাম। বলা বাহুল্য, আমার বিবেচনায় ইহাতে কিছুরই অভাব রহিল না। বন, উপবন, নদ, নদী, সরোবর, পদ্ম, উদ্যান, প্রভৃতির বর্ণন করিয়া উহাদিগের স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য সকল পাঠকদিগের সম্মুখে উপস্থাপিত করিলাম। দেবমন্দির দেবতাস্থান প্রভৃতি পবিত্র স্থান সকলের বর্ণন করিয়া সকলকে মোহিত করিলাম। পাপিয়া, কোকিল, প্রভৃতির সুমধুররবে পাঠকগণের শ্রবণেন্দ্রিয় পরিতৃপ্ত করিলাম, যুবক-যুবতীর প্রণয় ভালবাসা প্রভৃতির বর্ণন করিয়া সকলকেই প্রণয় সমুদ্রে ভাসাইলাম। যুদ্ধ বিগ্রহের কৌশল-সকল সকলের হৃদয়ে প্রবেশ করাইয়াছিলাম, এবং পাপীকে ভীষণ দণ্ডে দণ্ডিত করিয়া সকলের মনে ত্রাসের উদ্রেক করিলাম, এক কথায় আমার বিবেচনায় এই এক উপন্যাসেই সকল অভাবই পূর্ণ হইল। কেবল অভাবের মধ্যে আমি পাঠক পাইলাম না। এই পুস্তকের সুমধুর রস কোন পাঠক বুঝিল না, কেহ ইহা পড়িল না। কিন্তু তাহা বলিয়া যে কেহ কখন এই পুস্তক পাঠ করিবে না, তাহা নহে। সেক্ষপিয়রের পুস্তকের রস প্রথমে কেহ বুঝে নাই বলিয়া, কি আর তাহার আদর হয় নাই? মেঘনাদবধ বাহির হইলে, মাইকেলকে প্রথমে সকলে উপহাস করিয়াছিল বলিয়া, কি তিনি তাঁহার সমস্ত পুস্তক ব্রহ্মার হস্তে অর্পণ করিয়াছিলেন? 

“সময়ে আমার পুস্তকের বিশেষ আদর হইবে বলিয়া আমি স্থির থাকিতে পারিলাম না; কারণ আমার সে ধৈর্য্য কৈ? আমার বর্ত্তমান সংস্থানের মধ্যে কেবলমাত্র এই পুস্তক, ইহা বিক্রয় করিতে না পারিলে, আমার দিনপাতের আর কোন উপায়ই নাই। কাজেই সেই সকল পুস্তক যেরূপ উপায়ে বিক্রয় করিতে পারি, তাহার উপায় আমাকে দেখিতে হইল। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া যাহাতে সেই পুস্তক গুলি বিক্রয় করিতে পারি, তাহার এক উপায় বাহির করিলাম। সেই সময়ের একখানি বাঙ্গালা সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে আমি নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটি বাহির করিলাম। 

চিরন্মদা। 

জনৈক প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার কর্তৃক লিখিত। 
প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রে প্রশংসিত।
স্ত্রীপাঠ্য সুলভ-পুস্তক! 

প্রত্যেক রমণীর অবশ্য পাঠ্য ও যত্নের ধন! এরূপ পুস্তক এই প্রথম প্রকাশিত হইয়াছে। মূল্য কেবলমাত্র এক টাকা, ডাকমাশুল অৰ্দ্ধ আনা। 

প্রকাশক 
শ্রীপূর্ণানন্দ ভক্ত। 
—নং চিৎপুর রোড, কলিকাতা 

“সেই বাঙ্গালা সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে এই বিজ্ঞাপন ক্রমে একবার, দুইবার তিনবার বাহির হইল, কিন্তু ইহার একখণ্ডও বিক্রয় হইল না। 

“আমি ইহা বেশ জানিতাম যে, পুস্তক বিক্রয় করিয়া লাভ হওয়া দূরে থাকুক, বিজ্ঞাপনের খরচও উঠিবে না। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র ছিল বলিয়াই, এই বিজ্ঞাপন মাসাবধি প্রকাশিত হইল। 

“অন্য উপায়ে উপার্জিত যে কিছু অর্থ আমার নিকট এতদিবস ছিল, ক্রমে তাহার শেষ পয়সাটি পর্য্যন্ত খরচ হইয়া গেল। সুতরাং বাধ্য হইয়া আমার পরিচিত এক ব্যক্তির নিকট হইতে দশ টাকা ঋণ করিয়া আমি আমার উদ্দেশ্য সফল করিবার ইচ্ছা করিলাম। 

“সেই দশটি টাকা সঙ্গে করিয়া কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের এক জন প্রসিদ্ধ পুস্তক-বিক্রেতার দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে সেই দোকানদার বাবুর নিকট আমি এই বলিয়া পরিচয় প্রদান করিলাম, “আমি ঢাকার একজন পুস্তক বিক্রেতা। কতকগুলি পুস্তক ক্রয় করিবার মানসে আমি সেইস্থান হইতে এখানে আগমন করিয়াছি। আপনি আমাদিগের নিকট আপনার নামে উত্তমরূপে পরিচিত হইলেও, আপনার সহিত আমাদিগের দেখা সাক্ষাৎ নাই। সেই নিমিত্ত আমার আরও ইচ্ছা—আপনার সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া যাই। ইহার পরে যখন আমাদিগের যে পুস্তকের আবশ্যক হইবে, তখন আপনাকে পত্র লিখিলেই তাহা পাইতে পারিব। আপাততঃ সামান্য কয়েকখানি পুস্তকের প্রয়োজন আছে, এই তাহার তালিকা। যদি সমস্ত পুস্তক আপনার নিকট থাকে, তাহা হইলে উহা আমাকে প্রদান করুন। 

উপযুক্ত কমিশন পাইলে, আমি নগদ মূল্য প্রদান করিব।” এই বলিয়া আমার পকেট হইতে একখানি তালিকা বাহির করিয়া সেই দোকানদার বাবুটির হস্তে অর্পণ করিলাম। তখন সেই দোকানদার মহাশয় সেই তালিকাটি পড়িয়া দেখিলেন। উহাতে লেখা ছিল :—

প্রথমভাগ, বিদ্যাসাগর প্রণীত ১০০ খণ্ড 

দ্বিতীয় ভাগ, বিদ্যাসাগর প্রণীত ৫০ খণ্ড 

দুর্গেশ নন্দিনী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ৫ খণ্ড 

বিষ-বৃক্ষ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ৫ খণ্ড 

চিরন্মদা, পূর্ণানন্দ ভক্ত প্রণীত ১০০ খণ্ড 

মাধবী-কঙ্কণ, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রণীত ৪ খণ্ড 

ভারত-উদ্ধার, ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ৩ খণ্ড 

গোচারণের মাঠ, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রণীত ৩ খণ্ড 

মৃণ্ময়ী, দামোদর মুখোপাধ্যায় প্রণীত ৩ খণ্ড 

মেঘনাদবধ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রণীত ৩ খণ্ড 

মালিনী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ৩ খণ্ড 

ঘোড়ার ডিম, রাজকৃষ্ণ রায় প্রণীত ৩ খণ্ড 

তান্তিয়া ভীল, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত ২ খণ্ড 

স্বর্ণলতা, তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রণীত ২ খণ্ড 

দোকানদার এই ফদ দেখিয়া বলিলেন, “মহাশয় আপনার ফদ লিখিত সমস্ত পুস্তকই আমার দোকানে আছে, কেবল নাই “চিরন্মদা”। এ পুস্তকের নাম আমি এ পর্যন্ত শুনি নাই, এ গ্রন্থকারও আমার নিকট পরিচিত নহেন।” 

দোকানদারের এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “সে কি মহাশয়! পূর্ণানন্দ বাবুর প্রণীত “চিরন্মদা” পুস্তকের নাম আপনি শুনেন নাই? আমাদিগের ঢাকা অঞ্চলে সেই পুস্তকের যে কতদূর কাতি, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমার ফদ দেখিলেই, তাহা আপনি বেশ বুঝিতে পারিবেন। আপনি যদি সমস্ত পুস্তক প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে আমার ফদ ফেরত দিউন, আমি চিৎপুর রোডে পূর্ণানন্দ বাবুর বাড়ীতে গমন করিয়া, তাঁহার পুস্তক খরিদ করিয়া আনিব। দেখুন দেখি, এই ঠিকানায় গমন করিতে হইলে কোন্ পথ দিয়া গমন করিতে হইবে?” এই বলিয়া যে সংবাদপত্রে সেই পুস্তকের বিজ্ঞাপন ছাপা হইয়াছিল, তাহার একখণ্ড দোকানদারের হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি উহা উত্তমরূপে দেখিয়া আমাকে কহিলেন, “ইহার নিমিত্ত আপনাকে সেইস্থানে গমন করিতে হইবে না। আমি লোক পাঠাইয়া সেই পুস্তক আনাইয়া লইব, এবং আপনার ফদ অনুযায়ী সমস্ত পুস্তক ঠিক করিয়া রাখিব। আপনি সন্ধ্যার পূর্ব্বে আসিয়া সমস্ত পুস্তক লইয়া যাইবেন। কিন্তু বায়নার স্বরূপ আপাততঃ যদি কিছু আমাকে দিয়া যান, তাহা হইলে ভাল হয়।” 

দোকানদারের কথা শুনিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম, যখন তিনি পূর্ণানন্দ বাবুর ঠিকানা জানিতে পারিলেন, তখন এ সুযোগ তিনি কেন পরিত্যাগ করিবেন? এই পুস্তকগুলি বেচিতে পারিলে, একে কমিশন পাইবেন, তাহার উপর তাঁহার ঘরে অপরাপর যে সকল পুস্তক আছে, তাহার মধ্য হইতে ফদ-লিখিত পুস্তকগুলিও বিক্রয় হইয়া যাইবে। তখন তাঁহাকে কহিলাম, “আমি সমস্ত পুস্তকের নিমিত্ত বায়না দিতে প্রস্তুত আছি। বোধ হয়, দশ টাকা দিলেই যথেষ্ট হইবে। কিন্তু মহাশয়! অদ্য রাত্রির গাড়িতে আমাকে ঢাকায় প্রস্থান করিতে হইবে, আমি সন্ধ্যার পূর্ব্বে আসিলে পুস্তকগুলি যেন ঠিক পাই।” এই বলিয়া যে দশটি টাকা সংগ্রহ করিয়া, আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই টাকা দশটি দোকানদারবাবুর হস্তে প্রদান করিয়া আপনার বাসায় অর্থাৎ চিৎপুর রোডের সেই বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম। 

প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা পরে দেখিলাম, একটি লোক আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল। বুঝিলাম, ইনি সেই দোকানদারের প্রেরিত লোক হইবেন। তাঁহাকে আমি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম। যদিও আমি বেশ বুঝিলাম, যখন আমি সেই পুস্তকের দোকানে গমন করিয়াছিলাম, তখন ইনি সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন না, তথাপি তাঁহার সম্মুখে যাইতে আমার সাহস হইল না। আমি পূৰ্ব্বেই মহেশ নামক এক ব্যক্তিকে স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম। কোন ব্যক্তি পুস্তক খরিদ করিতে আসিলে তাহাকে কি বলিতে হইবে, বা তাহার সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, তাহা মহেশকে উত্তমরূপে শিখাইয়া দিয়াছিলাম। 

সেই অপরিচিত ব্যক্তিটি আগমন করিলে, আমি একটু অন্তরালে রহিলাম। মহেশ তাঁহার সম্মুখে গমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয়! আপনি কাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন?” 

আগন্তুক। পূর্ণানন্দবাবু কি এই বাড়ীতে থাকেন? আমি তাঁহারই অনুসন্ধান করিতেছি। 

মহেশ। এই তাঁহার বাড়ী বটে; কিন্তু তিনি এখন এখানে নাই, তিনি মুঙ্গেরে আছেন। কেন মহাশয়! আপনি কি জানেন না যে, তিনি মুঙ্গেরের একজন প্রসিদ্ধ উকীল? তিনি প্রায়ই সেইস্থানে থাকেন, বাড়ীর যে কোন কাজকৰ্ম্ম তাহা আমিই সম্পন্ন করিয়া থাকি, এবং তাঁহার পুস্তকাদি প্রভৃতি সমস্তই এইস্থান হইতে বিক্রয় করা হয়। মহাশয়ের যে কোন প্রয়োজন আছে, আমাকে বলিলে, আমার দ্বারাই তাহা সম্পন্ন হইতে পারিবে। 

আগন্তুক। আমি পূর্ণানন্দবাবুর প্রণীত চিরন্মদা নামক পুস্তক একশত খণ্ড লইতে আসিয়াছি। আমার মনিব—কর্ণওয়ালীস স্ট্রীটের একজন প্রধান পুস্তক বিক্রেতা। তাঁহার নাম যে আপনি না জানেন, তাহা নহে। যে পুস্তক আমি আপনার নিকট হইতে গ্রহণ করিব, তাহা কিরূপ কমিসন ও কতদিবস পরে তাহার মূল্য গ্রহণ করিবেন, তাহা প্রথমে জানিতে ইচ্ছা করি। 

মহেশ। চিরণ্মদা পুস্তক আর অধিক নাই, সমস্তই প্রায় বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। বোধ হয়, দুই তিনশত পুস্তকের অধিক আছে কি না সন্দেহ? ইহার যেরূপ কাটতি হইয়াছে, তাহাতে বোধ হয়, দুই তিন দিবসের মধ্যেই সমস্ত পুস্তক শেষ হইয়া যাইবে। এই পুস্তক পুনর্মুদ্রাঙ্কণের নিমিত্ত লিখিয়াছি, কিন্তু তাহার উত্তর এ পর্যন্ত পাই নাই। পূর্ণানন্দবাবুর যে সমস্ত পুস্তক বিক্রয় হইয়া থাকে, তাহার কমিশন আমরা কাহাকেও প্রদান করি না। আপনি যাঁহার নিকট হইতে আগমন করিয়াছেন, তিনি একজন সর্ব্ব-পরিচিত এবং বড় দোকানদার। এই নিমিত্ত আপনাকে আমরা শতকরা দশ টাকা হিসাবে কমিশন দিতে পারি, কিন্তু আমাদিগের কোন পুস্তক দেনা পাওনায় বা কমিশন সেলে বিক্রয় হয় না। সুতরাং সমস্ত মূল্য অগ্রিম না পাইলে, আমরা কোনরূপেই পুস্তক বিক্রয় করিতে সমর্থ হইব না।” 

এই কথা শুনিয়া সেই আগন্তুক অনেক কসা-মাজার পর শতকরা পনর টাকা কমিসন স্থির করিলেন। এবং নগদ টাকা দিয়া একশত পুস্তক খরিদ করিয়া আপনার মনিবের দোকানে লইয়া গেলেন। 

দোকানদার মহাশয় ফর্দের লিখিত অপরাপর পুস্তকগুলি সংগ্রহ করিলেন; সমস্ত পুস্তক বাঁধিয়া ছাঁদিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়া দিলেন। 

বৈকালে কেহই তাঁহার দোকানে পুস্তক লইবার নিমিত্ত গমন করিলেন না। ক্রমে সন্ধ্যা হইল; তথাপি আমি সেই স্থানে আর গমন করিলাম না। ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল। দোকানদার আপনার দোকান বন্ধ করিয়া দিলেন; কিন্তু নিশ্চয়ই তিনি মনে করিলেন, বোধ হয়, তাপর কোন বিশেষ কার্য্যের নিমিত্ত আমি সেইস্থানে গমন করিতে পারিলাম না। পরদিবস প্রাতঃকালে নিশ্চয়ই আসিয়া সমস্ত মূল্য প্রদান পূৰ্ব্বক পুস্তকগুলি লইয়া আসিব। 

যেরূপ সময়ে দোকানদার প্রত্যহ তাঁহার দোকান খুলিয়া থাকেন, আজ তাহার অনেক পূর্ব্বে দোকান খুলিলেন। কারণ যদি আমি পুস্তকগুলি লইবার মানসে সকালেই তাঁহার দোকানে গমন করি। কিন্তু আমি আর সেই দোকানের দিকে দৃষ্টিপাতও করিলাম না, বা সেই পথে গমনও করিলাম না। সে দিবস কাটিয়া গেল, পরদিবসও অতিবাহিত হইল, ক্রমে একদিন দুইদিন করিয়া এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল। কিন্তু সেই দোকানদার তাহার ক্রেতার আর কোন সন্ধানই পাইলেন না। তখন দোকানদার অনন্যোপায় হইয়া তাঁহার সংগৃহীত সমস্ত পুস্তকই বিক্রয় করিয়া ফেলিতে লাগিলেন। 

অপরাপর যে সকল পুস্তক ছিল, তাহার সমস্তই বিক্রয় হইয়া গেল, কিন্তু “চিরন্মদা” নামক পুস্তকের একখানিও কেহ খরিদ করিল না। একমাস চেষ্টা করিয়াও, যখন তিনি একখানি পুস্তকও বিক্রয় করিতে পারিলেন না, তখন সেই পুস্তকগুলি ফেরৎ দিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার সরকারকে পুনরায় আমার বাসায় পাঠাইয়া দিলেন; এবার আমি নিজেই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে চিনিতে পারিলেন না। পূর্ব্বে যে সকল কথা আমি পাঠকগণকে জানাইয়াছি, তিনি তাহার সমস্ত কথা আমার নিকট কহিলেন, এবং পুস্তকগুলি যাহাতে আমি ফেরৎ লই, তাহার নিমিত্ত আমাকে তিনি বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু তাঁহার অনুরোধ কে শুনে? সুতরাং দোকানদারকে পঁচাশী টাকা লোকসান সহ্য করিতে হইল, পাইবার মধ্যে তিনি কেবল পাইলেন, আমার প্রদত্ত বায়না সেই দশটাকা। 

আমি যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, একজন দোকানদারের নিকট হইতে পঁচাত্তর টাকা উপার্জ্জন করিলাম, তাহা আপনারা সকলেই অনুমান করিতে পারেন; কিন্তু এইরূপ উপায়ে যে কেবলমাত্র পঁচাত্তর টাকাই যে আমার লাভ হইল, তাহা নহে। ২০০০ দুই সহস্র খণ্ড চিরন্মদা পুস্তক ছাপাইতে আমার প্রায় ১৭৫ টাকা ব্যয় পড়িল। কিন্তু পূৰ্ব্বকথিত উপায়ে প্রায় সমস্ত পুস্তক-বিক্রেতাকে ঠকাইয়া আমি সমস্ত পুস্তকই বিক্রয় করিয়া ফেলিলাম, এবং ছাপা খরচ প্রভৃতি বাদে লাভও করিলাম, প্রায় দেড় হাজার টাকা। নিরীহ পুস্তক-বিক্রেতাগণ এইরূপে আমার নিকট ঠকিলেও লজ্জায় পড়িয়া তাহা আর অপর দোকানদারদিগের নিকট প্রকাশ করিতে পারিলেন না। সুতরাং আমি আমার মনোবাঞ্ছা সুসিদ্ধ করিতে কোনরূপ প্রতিবন্ধক পাইলাম না। অনেক দোকানদার এইরূপে আমার নিকটে ঠকিয়া সতর্ক হইলেন সত্য, কিন্তু আমি শুনিয়াছি, “পূর্ণানন্দ ভক্ত” ও “চিরন্মদা” এই নাম দুইটি তাহাদের হৃদয়ে অনেকদিবস পর্য্যন্ত জাগরিত ছিল } 

(তিন) 

পূৰ্ব্বকথিত উপায়ে কিছুদিবস অতীত করিয়া আমার প্রণীত “চিরন্মদা” নামক পুস্তকগুলি সমস্তই বিক্রয় করিয়া ফেলিলাম। যখন দেখিলাম, এই উপায়ে দোকানদারদিগকে আমি পুনর্ব্বার কোনরূপে প্রতারিত করিতে পারিব না, তখন আমাকে অন্য আর এক উপায় অবলম্বন করিয়া আপন দুরভিসন্ধি সাধন করিতে প্রবৃত্ত হইতে হইল। চারি পাঁচদিবস পরিশ্রম করিয়া “চতুৰ্দ্দশরত্ন” নামক অপর আর একখানি পুস্তকের সঙ্কলন করিলাম। এই পুস্তকে ১৪ জন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির জীবন চরিত বর্ণিত হইল। এই পুস্তকের সঙ্কলনে আমাকে বিশেষ কোন কষ্টই পাইতে হইল না। ১৪ জন লেখকের লিখিত, ১৪ জন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির জীবন চরিত, ১৪ খানি ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত করিয়া এই পুস্তক সঙ্কলিত করিলাম। 

আজকাল ছাপাখানার অভাব নাই। অল্পদরে বিশেষতঃ দেনা পাওনায় পুস্তক প্রভৃতি ছাপা অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারে। কাজেই চতুৰ্দ্দশরত্ন ছাপাইতে আমার বিশেষ কোন কষ্টই হইল না, এক এক ফৰ্ম্মা ছাপা হইতে হইতে ক্রমে প্রায় সমস্ত পুস্তকই ছাপা হইয়া গেল। পুস্তক বাহির হইতে অতি অল্পদিন বিলম্ব থাকিতে আমি পুনরায় কোন একজন প্রধান পুস্তক বিক্রেতার নিকট গমন করিলাম। চতুৰ্দ্দশরত্ন নামক একখানি পুস্তক আমি প্রকাশ করিতেছি, একথা আমি তাঁহাকে কহিলাম। আরও কহিলাম, “আমি এই পুস্তক আপনার দোকানে বিক্রয়ার্থ রাখিতে ইচ্ছা করি। আপনার নিকট হইতে যত পুস্তক বিক্রয় হইবে, আপনি তাহা হইতে শতকরা ২৫ টাকা কমিসন গ্রহণ করিবেন। কারণ আপনি সর্ব্ব-পরিচিত এবং মফঃস্বলের লোকদিগের আপনার উপর বিশেষ আস্থা আছে। আপনার নামে বিজ্ঞাপন বাহির হইলে, অপর দোকানদার অপেক্ষা আপনি যে অধিক পুস্তক বিক্রয় করিতে পারিবেন, তাহার আর কোন সন্দেহ নাই।” 

আমার প্রস্তাবে দোকানদার মহাশয় সম্মত হইলেন। এইরূপ সাব্যস্ত হইল, এই পুস্তক বিক্রয় করিবার নিমিত্ত যে কোন বিজ্ঞাপনাদি প্রকাশ করিবার প্রয়োজন হইবে, তাহাও সেই দোকানদারের নামে বাহির হইবে। আমার প্রস্তাবে দোকানদার মহাশয়ের সম্মত হইবার কারণ—একে তিনি একটু খোসামদপ্রিয়, তাহাতে “কমিসন সেলে” পুস্তক বিক্রয় করার প্রলোভন কোন দোকানদারই সহজে পরিত্যাগ করিতে পারেন না। কারণ কমিসন সেলে পুস্তক বিক্রয় করিলে, কোন দোকানদারকে কোনরূপেই ঠকিতে হয় না। যাহা কিছু বিক্রয় হয়, তাহা হইতেই দোকানদার তাঁহার প্রাপ্য কমিসনসূত্রে কাটিয়া লইয়া, পরিশেষে গ্রন্থকারকে অবশিষ্ট মূল্য দিয়া থাকেন। তাহার উপর, সকল দোকানদার সমান নহেন, কেহ কেহ “দিব, দিচ্চি” করিয়া কেবল দিন অতিবাহিত করেন, পরিশেষে হয়ত একেবারেই দেন না, বা যদিও দেন, তাহা হইলে দুই একটাকা করিয়া এরূপভাবে দেন যে, সে এক প্রকার না দেওয়া বলিলেও চলে। ইহা ব্যতীত গ্রন্থকর্তার সহিত যে একটা হিসাবের প্রয়োজন, কোন কোন দোকানদার তাহা একেবারেই জানেন না। “পুস্তকের কিছুই বিক্রয় হয় নাই, বিজ্ঞাপন খরচ পর্যন্ত তাঁহার গৃহ হইতে দিতে হইয়াছে” ইত্যাদি প্রকার বচনেই গ্রন্থকর্তাকে সন্তুষ্ট করিয়া বিদায় করিয়া দিয়া থাকেন। কাজেই কমিসন সেলে কোন দোকানদারের কোনরূপেই লোকসান হয় না। এই সকল কারণে উপরিউক্ত দোকানদার মহাশয় নিজের নামে বিজ্ঞাপন দিয়াও আমার চতুর্দ্দশরত্ন কমিসন সেলে বিক্রয় করিতে যে অনায়াসেই সম্মত হইবেন, তাহার আর আশ্চর্য্য কি? 

দোকানদারের সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত হইবার দুই তিনদিবস পরেই একখানি প্রধান বাঙ্গালা সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন বাহির করিলাম, তাহার মর্ম্ম এইরূপঃ—

“বিশেষ বিজ্ঞাপন 

লউন, বা না লউন, একবার সকলেরই পাঠ করা কর্ত্তব্য।

চতুর্দ্দশরত্ন 

যন্ত্রস্থ, শীঘ্রই প্রকাশিত হইবে। ইহাতে এতদ্দেশীয় ১৪ জন সৰ্ব্বজন-প্রসিদ্ধ, সৰ্ব্বজাতি-সমাদৃত, সৰ্ব্ব বিদ্যায় পারদর্শী, প্রধান ব্যক্তির জীবনচরিত বর্ণিত আছে। ইহা পাঠে নীচান্তঃকরণে উচ্চভাবের পরিস্ফুট হইবে, অসৎ ব্যক্তি তাসৎসঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া সৎসঙ্গে মিলিত হইবে। বালকগণ এই চরিত্র পাঠে কিরূপে আপন চরিত্র রক্ষা করিতে হয়, তাহার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেখিতে পাইবে। এক কথায় কি বালক, কি যুবা, কি বৃদ্ধ, কি বালিকা সকলেরই পাঠ করা উচিত। মূল্য নিতান্ত সামান্য, এক টাকামাত্র, ডাকমাশুলও ভ্যালুপেয়েবল খরচা তিন আনামাত্র। 

শ্রী **** পুস্তক বিক্রেতা।
** স্ট্রীট, কলিকাতা।” 

এই বিজ্ঞাপন বাহির হইবামাত্র চতুৰ্দ্দিক হইতে ডাকযোগে পত্র আসিতে লাগিল। কেহ একখানি, কেহ দুইখানি, কেহ বা পাঁচখানি পৰ্য্যস্ত পুস্তক চাহিয়া পাঠাইলেন। এমন কি সাতদিবসের মধ্যে প্রায় শতাধিক পত্ৰ আসিয়া উপস্থিত হইল, উহাতে প্রায় তিন শতের অধিক লোক পুস্তকের গ্রাহক হইলেন। এইরূপ রাশি রাশি পত্র আসিতে দেখিয়া, দোকানদার মনে করিতে লাগিলেন, এই পুস্তক নিশ্চয়ই অধিক বিক্রয় হইবে। 

সেই সময় একদিবস আমি সেই দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়! আপনার নামে পুস্তকের বিজ্ঞাপন ত বাহির হইয়াছে, কিন্তু এই পুস্তক লইবার মানসে কোনস্থান হইতে কোন ব্যক্তি পত্রাদি লিখিয়াছেন কি না?” আমার কথা শুনিয়া দোকানদার মহাশয় কহিলেন, “এখন বোধ হইতেছে, আপনার পুস্তক অধিক বিক্রয় হইবে। কিন্তু পরে যে কি হইবে, তাহা এখন কে বলিতে পারে?” এই বলিয়া সেই পৰ্য্যন্ত তিনি যে সকল পত্র পাইয়াছিলেন, তাহা আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। 

সেই সমস্ত পত্র দেখিয়া কৃত্রিম আহ্লাদ প্রকাশ করিলাম। কহিলাম, “বোধ হইতেছে, আমার এই পুস্তক সর্ব্বসাধারণে বিশেষ যত্নের সহিত গ্রহণ করিবেন। এই পুস্তক বিক্রয় করিয়া বেশ দশটাকা উপার্জ্জন করিবার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু আমি দেখিতেছি, আমার পরিশ্রমই ব্যর্থ হইল; লাভের অংশ আমার অদৃষ্টে কিছুই ঘটিল না। যে আশা করিয়া আমি এই পুস্তক লিখিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, ঈশ্বর সে আশায় নিরাশ করিলেন।”

আমার কথা শুনিয়া দোকানদার মহাশয় কহিলেন, “সে কি মহাশয়! আপনার পুস্তক যদি অধিক পরিমাণে বিক্রয় হয়, তাহা হইলে আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না কেন? পুস্তক যত অধিক বিক্রয় হইবে, আপনি ততই লাভ করিতে সমর্থ হইবেন।” 

উত্তরে আমি কহিলাম, “আপনি যাহা বলিলেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু হঠাৎ আমার এরূপ টাকার আবশ্যক হইয়াছে যে, সেই টাকা শীঘ্র সংগ্রহ না করিতে পারিলেই নয়, অথচ কোনরূপেই আমি তাহার সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। গত কল্য সন্ধ্যার সময় আমি আমার জনৈক বন্ধুর নিকট বসিয়াছিলাম, এবং কি প্রকারে প্রয়োজনীয় টাকার সংগ্রহ করিতে পারি, সেই সম্বন্ধে নানাপ্রকার পরামর্শ করিতেছিলাম; সেই সময়ে আরও একজন লোক সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। আমার বোধ হইল, তিনি কোন পুস্তক-ব্যবসায়ী হইবেন। আমাদিগের কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “মহাশয়! শুনিলাম, আপনি “চতুৰ্দ্দশরত্ন” নামক একখানি পুস্তকের দুই সহস্র খণ্ড প্রকাশিত করিতেছেন। ইহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে কোন পুস্তক-ব্যবসায়ীর নিকট অল্পমূল্যে সেই পুস্তকগুলি একেবারে বিক্রয় করিয়া ফেলুন না কেন? তাহাতে আপনি যে টাকা পাইবেন, তাহাদ্বারাই আপনার এই কার্য্য অনায়াসেই শেষ হইতে পারিবে।” 

এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আপনি যাহা কহিলেন, সে উপায় মন্দ নহে। কিন্তু কে আমার সমস্ত পুস্তক একেবারে খরিদ করিয়া লইবেন?”

আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “আপনি যদি এই প্রস্তাবে সম্মত হন, তাহা হইলে সেই পুস্তক বিক্রয়ের ভার আমি গ্রহণ করিতে পারি।” 

তাঁহার কথা শুনিয়া তাঁহার প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম। “সময় মত আসিয়া সাক্ষাৎ করিব” এই বলিয়া সেই লোকটি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। অদ্য প্রাতঃকালে একজন অপর লোকের সহিত তিনি আমার নিকট আগমন করেন এবং কহেন, “আপনার কথামত আপনার পুস্তক বিক্রয় করিবার সমস্ত ঠিক করিয়া আসিয়াছি। এই পুস্তক—বিক্রেতাকে সঙ্গে করিয়াও আনিয়াছি, আপনার দুই সহস্র পুস্তক ইনি পাঁচশত টাকায় লইতে প্রস্তুত আছেন। পুস্তকগুলি যদি বাস্তবিকই বিক্রয় করা স্থির হয়, তাহা হইলে আমি এখনই নগদ টাকা দিয়া পুস্তকগুলি ছাপাখানা হইতে লইয়া যাইতে পারি।” আমার টাকার নিতান্ত প্রয়োজন বলিয়া আমি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম ও কহিলাম, “আপনার নিকট আমার এই সকল পুস্তক বিক্রয় করা একরূপ স্থিরই হইল। আপনি কল্য আসিবেন, সেই সময়ে আমার যাহা কর্তব্য, তাহা করিব।” মহাশয়! বলিতে কি, তাঁহার কথা শুনিয়া প্রথমে আমি নিতান্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিলাম, এই সামান্য পুস্তকের নিমিত্ত তাঁহাদিগের এত আগ্রহ কেন? অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া তখন ইহার কোন কারণ স্থির করিয়া উঠিতে পারিয়া ছিলাম না। কিন্তু আপনার নিকট এই সকল পত্র দেখিয়া, এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি—এই সমস্ত অল্পমূল্যে একেবারে খরিদ করিতে তাঁহাদিগের এত যত্ন কেন?” 

আমার ঐ সকল কথা শুনিয়া প্রথমোক্ত দোকানদার ভাবিলেন, “পাঁচশত টাকায় এই পুস্তকগুলি খরিদ করিলে, ইহাতে বড় অল্পলাভ হইবে না। আমার নিকট যে পত্র আসিতেছে, তাহা বোধ হয়, সেই দোকানদার জানিতে পারিয়াই সেই পুস্তকগুলি একেবারে খরিদ করিয়া লইবার নিমিত্ত এত চেষ্টা করিতেছেন। আমিই যদি সেই পুস্তকগুলি খরিদ করিয়া লই, তাহা হইলে আমারও লাভ হইবার সম্ভাবনা। পুস্তক প্রকাশিত না হইতেই যখন তিনশত পুস্তক বিক্রয়ের সম্ভাবনা হইয়াছে, তখন পুস্তক প্রকাশিত হইলে যে আরও অধিক লোক গ্রাহক হইবে, তাহার আর সন্দেহ মাত্রই নাই। এখন যতগুলি গ্রাহক হইয়াছে, পুস্তক পাঠাইবামাত্রই তাহাদিগের নিকট হইতে তিনশত টাকা পাইতে পারিব। এরূপস্থলে ব্যবসাদারের পক্ষে এরূপ সুযোগ পরিত্যাগ করা কোনরূপেই উচিত নহে।” এইরূপ ভাবিয়াই বোধ হয়, দোকানদার মহাশয় কহিলেন, “মহাশয়! যদি পুস্তকগুলি একেবারে বিক্রয় করাই আপনার সাব্যস্ত হইয়া থাকে, তাহা হইলে উহা তান্য লোকের নিকট বিক্রয় করিবার আর প্রয়োজন কি? আমার নামে যখন বিজ্ঞাপন বাহির হইয়াছে, তখন সেই পুস্তকগুলি অন্যের পরিবর্ত্তে আমাকে প্রদান করাই আপনার কর্তব্য। আর অপরে যে মূল্য দিতেছে, আমার নিকট হইতে তাহা অপেক্ষা কিছু অল্প লওয়াও আপনার উচিত। কিন্তু যখন মূল্য একরূপ স্থির হইয়া গিয়াছে, ও পাঁচশত টাকা আপনি একেবারে প্রাপ্ত হইতেছেন, তখন কাজেই আমাকে তাহাতেই সম্মত হইতে হইল। আপনি সেই টাকা আমার নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া সেই দুই সহস্ৰ পুস্তক আমার নিকট বিক্রয় করুন, আমি ছাপাখানা হইতে সমস্ত পুস্তক আনাইয়া লইব।” 

দোকানদারের কথা শুনিয়া আমি প্রথমে অনেকরূপ ওজর আপত্তি করিলাম। যখন একজন দোকানদারের সহিত কথা স্থির হইয়া গিয়াছে, তখন কিরূপে সেই পুস্তক তাহাকে না দিয়া কথার অন্যথাচরণ করিতে পারি; প্রভৃতি নানাপ্রকার মিথ্যা আপত্তি উত্থাপন করিয়া মোটের উপর আরও পঞ্চাশ টাকা অধিক করিয়া, তবে দোকানদারের কথায় সম্মত হইলাম, এবং আবশ্যক-অনুযায়ী লেখাপড়া করিয়া দিয়া টাকা পাঁচশত পঞ্চাশটি গুণিয়া লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

পুস্তকের ছাপা শেষ হইয়া গিয়াছিল, দোকানদার মহাশয় ছাপাখানা হইতে পুস্তকগুলি আপনার দোকানে লইয়া গেলেন। 

এইস্থানে একটি কথা বোধ হয়, আমার বলা আবশ্যক যে, যে সকল কথা বলিয়া আমি আমার পুস্তকগুলি দোকানদারের নিকট বিক্রয় করিলাম, তাহার সমস্ত কথাই মিথ্যা, সত্যের মধ্যে কেবল পুস্তক বিক্রয়, এবং অর্থ গ্রহণ।” কোন দোকানদারের সহিত সেই সকল পুস্তক বিক্রয় সম্বন্ধে কোন কথাই হইয়াছিল না, বা কেহই পাঁচশত টাকা দিয়া সেই পুস্তকগুলি ক্রয় করিতে সম্মত ছিলেন না। 

যে দিবস পুস্তক বিক্রয় করিয়া আমি টাকাগুলি হস্তগত করিলাম, সেইদিবস হইতেই দোকানদারের নামে পত্র আসা বন্ধ হইল। কেন বন্ধ হইল, তাহা কেবল আমিই জানিতে পারিলাম, দোকানদার বা অপর কেহ তাহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। 

“দোকানদার মহাশয় পুস্তকগুলি আনাইয়া প্যাক বাঁধিয়া গ্রাহকগণের নামে ভ্যালুপেয়েবলে পুস্তক সকল পাঠাইতে লাগিলেন। ক্রমশঃ পুস্তকই যাইতে লাগিল, টাকা আর আইসে না। দোকানদার প্রথম প্রথম কয়েকদিবস টাকার আশায় ডাকপিয়নের আসাপথ চাহিয়া রহিলেন। ডাকপিয়ন অন্য পত্রাদি লইয়া আইসে, কিন্তু সেই টাকা আর আসে না। এইরূপে পাঁচ সাতদিবস অতীত হইয়া গেল, টাকা আসিল না। কিন্তু তাহার পরিবর্তে অন্য দ্রব্য আনিয়া ডাকপিয়ন দোকানদারকে প্রদান করিতে লাগিল। পাঠক বলুন দেখি, উহা কি? উহা অপর আর কিছুই নহে, যে সকল পুস্তকের মালিকের অনুসন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই, সেই সমস্ত পুস্তক এক এক করিয়া প্রেরকের নিকট ফেরত আসিতে লাগিল। যত পুস্তক পাঠাইয়াছিলেন, ক্রমে সমস্তই ফেরত আসিল। তখন দোকানদার মহাশয় মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন, পাঁচশত পঞ্চাশ টাকা দিয়া তিনি যে সকল পুস্তক ক্রয় করিয়াছিলেন, তাহার একখানিও বিক্রয় হইল না! লাভের মধ্যে তাঁহার গৃহ হইতে ডাকমাশুল প্রভৃতি আরও কিছু বাহির হইয়া গেল! 

এই সমস্ত কথা দোকানদার একদিন তাঁহার একজন বন্ধুর নিকট বলিলেন, তিনি সমস্ত শুনিয়া সমস্ত পত্রগুলি বিশেষ সতর্কতার সহিত মিলাইয়া দেখিলেন। তাহাতে তাঁহার বোধ হইল, সমস্ত পত্রই যেন একহস্তের লেখা। কেবল ভিন্ন ভিন্ন আকারে লেখা হইয়াছে, কিন্তু একই কালি, ও একই কলমের দ্বারা লিখিত। পত্রের উপর ডাকঘরের যে সকল মোহর ছিল, তাহা উত্তমরূপ পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, দেখিয়া আরও আশ্চর্যান্বিত হইলেন। পত্রে লেখকের যে সকল ঠিকানা অর্থাৎ যে গ্রাম, যে পোষ্টাফিস ও যে জেলা লিখিত আছে, পত্ৰ কিন্তু সেইস্থান হইতে আইসে নাই। কলিকাতার নিকটস্থিত কোন না কোন ডাকঘর হইতে সেই পত্রগুলি আসিয়াছে। এইরূপ যত পত্র পরীক্ষা করিলেন, দেখিলেন, তাহার সমস্তগুলিই কলিকাতার নিকটবর্তী কোন না কোন ডাকঘরের মোহরযুক্ত, অথচ সকল পত্রগুলিতেই দূরদেশীয় পোষ্টাফিস সকলের নাম লেখা আছে। এই সকল অবস্থা দেখিয়া তখন তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন, জুয়াচোরের জুয়াচুরি ভিন্ন ইহা আর কিছুই নহে। তাঁহার তখন বুঝিলেন, জুয়াচোর পূর্ণানন্দেরই এই আর এক নূতন খেলা! তিনিই দোকানদার দিগকে প্রলোভিত করিবার মানসে এই খেলা খেলিয়াছেন। পুস্তকের অনেক কাতি হইবে, ইহাই দেখাইবার নিমিত্ত মিথ্যা নাম ও ঠিকানা দিয়া। রাশি রাশি পত্র লিখিয়া কলিকাতার নিকটবর্ত্তী কোন না কোন ডাকঘর হইতে ক্রমে ক্রমে পত্রগুলি পাঠাইয়াছেন। তিনিই এই সকল পত্রের দ্বারা ও নিজের বাক্-চাতুরী দ্বারা এই নিরীহ দোকানদারকে ঠকাইয়া তাহার নিকট পাঁচশত পঞ্চাশটাকা আত্মসাৎ করিয়াছেন। 

দোকানদার এইরূপে প্রতারিত হইয়া কি করিবেন, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। পূর্ণানন্দের নিকট এই কথা বলিলে, তিনি উহা আমলেই আনিতে দিলেন না। অবশেষে দোকানদার মহাশয় উকীল মোক্তারের সহিত পরামর্শ করিয়াও, টাকা আদায়ের কোনরূপ সৎ পন্থা অবলম্বন করিতে পারিলেন না। সুতরাং মনে মনে আপনিই আপনার বুদ্ধির নিন্দা করিতে লাগিলেন। আর কাহারও নিকট আপনার নির্বুদ্ধির কথা প্রকাশ না করিয়া নিতান্ত দুঃখিতান্তঃকরণে টাকাগুলি বাজে খাতায় খরচ লিখিয়া লইলেন। 

(চার) 

আমি পূৰ্ব্বকথিত উপায়ে যে কেবল একটিমাত্র দোকানদারকে ঠকাইয়া নিবৃত্ত হইলাম, তাহা নহে। এইরূপ যত দিবস পারিলাম, ততদিবস পর্য্যন্ত কয়েকজন দোকানদারকে ঠকাইয়া আমি কিছু উপার্জ্জন করিলাম। কিন্তু পরে যখন সে উপায় বন্ধ হইল, তখন বাধ্য হইয়া আমাকে অন্য আর এক উপায় অবলম্বন করিতে হইল। 

এইস্থানে আমাদিগের দেশীয় পাঠক-শ্রেণীর একটি দোষ উল্লেখ না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। ইহাদিগের মধ্যে অনেকেই অশ্লীল পুস্তকের নাম শুনিলে, কর্ণে হস্তপ্রদান করিয়া থাকেন বটে; কিন্তু যদি সুযোগ পান, তাহা হইলে নির্জ্জন রাত্রিতে ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া অন্যের অলক্ষিতে নিজে অন্ততঃ একবার সেই সকল পুস্তক অন্য পুস্তকের অপেক্ষা চতুর্গুণ মূল্যে ক্রয় করিতেও তাঁহারা কোনরূপ আপত্তি করেন না। 

এদেশীয় পাঠকগণের অবস্থা আমি উত্তমরূপে অবগত আছি, সুতরাং আমি আর সুযোগ পরিত্যাগ করিলাম না। বসিয়া বসিয়া নিম্নলিখিতরূপে একটি বিজ্ঞাপন লিখিলাম। 

“বিশেষ বিজ্ঞাপন। 
সকলে তৎপর হউন, 
বিলম্বে কাৰ্য্যসিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা নাই। 

অনেক বাধাবিপত্তি উল্লঙ্ঘন করিয়া অনেক কষ্টে আমি নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি প্রকাশ করিতে সমর্থ হইয়াছি। কিন্তু বিক্রয় করিতে যে কতদূর সমর্থ হইব, তাহা বলিতে পারি না। কারণ শুনিলাম, আমাকে বিপদাপন্ন করিতে গবর্ণমেন্ট নিতান্ত চেষ্টা করিতেছেন। যাহা হউক, বিপদের তর করিয়া নিম্নলিখিত দুষ্প্রাপ্য পুস্তকগুলি প্রকাশ করিতে যদি বিরত হই, তাহা হইলে এ সকল পুস্তক একেবারেই প্রকাশিত হয় না। এইরূপ নানাপ্রকার কারণে নিম্নলিখিত কয়েকখানি পুস্তক মুদ্রিত করিয়া বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করিয়াছি, যাঁহার প্রয়োজন হয়, শীঘ্র শীঘ্র নগদ মূল্য দিয়া লইয়া যাইবেন। বিলম্বে পুস্তক পাইবার আশা নাই। একে পুস্তক অল্প আছে, তাহাতে পুলিস এই সকল পুস্তকের বিক্রয় বন্ধ করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছেন। যে সকল গ্রাহক ইহার মধ্যে কোন পুস্তক গ্রহণ করিবেন, তাঁহার নাম কোনরূপে প্রকাশ হইবার সম্ভাবনা নাই। 

পুস্তক যথা :—

১। রতিশাস্ত্র …. মূল্য ২ দুই টাকা

২। সম্ভোগ-রত্নাকার … মূল্য ৫ পাঁচটাকা 

৩। কামরত্ব … মূল্য ২।।০ আড়াই টাকা

৪। লজ্জাতন্নেসা …. মূল্য ৮ আট টাকা। 

প্রকাশক 
শ্রীপূর্ণানন্দ ভক্ত। 

—নং, চিৎপুর রোড, কলিকাতা।” 

এই পুস্তকগুলি নিতান্ত অশ্লীল, সুতরাং কেহ প্রকাশ করিলে তিনি আইন-অনুসারে দণ্ডিত হন। কিন্তু সেইরূপ পুস্তকের পাঠকগণ এরূপ সুযোগ কোন প্রকারেই পরিত্যাগ করিতে পারিবেন না, ইহা আমি বেশ জানিতাম। 

পুস্তকের বিজ্ঞাপন লিখিলাম সত্য, কিন্তু সেই বিজ্ঞাপন প্রচার করা নিতান্ত কঠিন হইয়া পড়িল। কলিকাতা হইতে যতগুলি সংবাদপত্র বাহির হয়, এক এক করিয়া তাহাদিগের প্রত্যেকের আফিসেই গমন করিলাম; এবং সেই সকল পত্রিকায় যাহাতে সেই বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তাহার চেষ্টাও করিলাম, এবং যাঁহার যেরূপ নিয়ম আছে, তাঁহাকে সেইরূপ মূল্য দিতেও চাহিলাম; আবশ্যক হইলে অধিক মূল্য প্রদানেও সম্মত হইলাম। কিন্তু বিজ্ঞাপন দেখিয়া কেহই তাঁহার পত্রিকায় সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিতে সম্মত হইলেন না। 

যখন দেখিলাম, কেহই আমার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিতে সম্মত হইলেন না, তখন বাধ্য হইয়া আমাকে অন্য এক উপায় অবলম্বন করিতে হইল। যে বিজ্ঞাপনটি কাগজে বাহির করিব ভাবিয়াছিলাম, তাহা স্বতন্ত্র কাগজে হ্যাণ্ডবিলের আকারে ছাপাইয়া লইলাম। আরও একটি স্বতন্ত্র হ্যাণ্ডবিল সেইরূপ কাগজে ছাপাইলাম। প্রথমোক্ত হ্যাণ্ডবিলে যে সকল কথা ছিল, ইহাতেও তাহাই রহিল; প্রভেদের মধ্যে—কেবল অশ্লীল পুস্তকের নামগুলি উঠাইয়া দিয়া তাহার পরিবর্ত্তে কয়েকখানি ভাল পুস্তকের নাম বসাইয়া দিলাম। শেষোক্ত হ্যাণ্ডবিল ছাপা হইলে, যে কাগজের সর্ব্বাপেক্ষা গ্রাহক সংখ্যা অধিক, সেই কাগজের আফিসে গমন করিলাম। এবং সেই হ্যাণ্ডবিল দেখাইয়া তাহাদিগের সহিত যাহাতে মফঃস্বলে পাঠান হয়, নিয়মিত মূল্য দিয়া তাহারই বন্দোবস্ত করিলাম। সেই হ্যাণ্ডবিলে কোনরূপ অশ্লীল কথা বা অশ্লীল পুস্তকের নাম না থাকায়, তাঁহারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। মূল্য হিসাবে অগ্রিম টাকা আমার নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া সেই সংবাদপত্র-প্রকাশক তাঁহার দপ্তরীকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন যখন কাগজের মোড়ক বাঁধা হইবে, সেই সময় এই হ্যাণ্ডবিল যেন একখানি সেই সংবাদপত্রের ভিতর পুরিয়া দেওয়া হয়। মনিবের কথায় দপ্তরী সম্মত হইয়া আপনার কার্য্যে মনোনিবেশ করিল এবং আমাকে বলিয়া দিল, সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি যেন হ্যাণ্ডবিলগুলি প্রেরণ করি; কারণ সেই রাত্রিতেই সমস্ত কাগজের মোড়ক শেষ হইয়া যাইবে। দপ্তরীর প্রস্তাবে আমি সম্মত হইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

সন্ধ্যার পর হ্যাণ্ডবিলগুলি লইয়া আমি নিজেই সেইস্থানে গমন করিলাম। দেখিলাম, দপ্তরী সংবাদপত্রগুলি প্যাক করিবার উদযোগ করিতেছে। আমি যে সকল হ্যাণ্ডবিল লইয়া সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, তাহার মধ্যে কয়েকখানিমাত্র ভাল পুস্তকের হ্যাণ্ডবিল প্রত্যেক তাড়ার উপরে ছিল; আর তাড়ার ভিতরের সমস্তই অশ্লীল পুস্তকের হ্যাণ্ডবিল। 

আমি সেইস্থানে গমন করিয়া দপ্তরীর পরিশ্রমের নিমিত্ত পুরস্কারস্বরূপ তাহার হস্তে দুইটি মুদ্রা প্রদান করিলাম। দপ্তরী বক্সিস পাইয়া একেবারে ভুলিয়া গেল, আমার প্রদত্ত হ্যাণ্ডবিলের উপর কোনরূপ সন্দেহ না করিয়া এক একখানি করিয়া সমস্তগুলিই সেই সংবাদপত্রের ভিতর দিয়া প্যাক বাঁধিয়া দিল। আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল, অনায়াসেই হ্যাণ্ডবিলগুলি বিলি হইয়া গেল, সংবাদপত্রের সহিত সমস্তগুলিই দূরদেশে গিয়া উপস্থিত হইল। অবশিষ্ট যাহা রহিল, তাহার কতক বা ডাকযোগে, কতক বা লোকের দ্বারা, এবং কতক বা অন্য উপায় অবলম্বনে বিলি করিয়া দিলাম 

বিজ্ঞাপন দেখিয়া পুস্তক পাইবার প্রত্যাশায় অনেকেই শীঘ্র টাকা পাঠাইতে লাগিলেন। আমার নামে যত টাকা আসিতে লাগিল, তাহার সমস্তই আমি নিজ কার্য্যে ব্যয় করিতে লাগিলাম। কাহারও নিকট পুস্তক পাঠাইলাম না, কেহই সেই সকল পুস্তক প্রাপ্ত হইলেন না। পুস্তক পাঠাইব কোথা হইতে? সেই পুস্তক আমার নিকট একখানিও ছিল না, বা আমা-কর্তৃক উহা কখন মুদ্রিতও হয় নাই। 

যে সকল ব্যক্তি অশ্লীল পুস্তকের নিমিত্ত টাকা প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে অধিকাংশই ভদ্রলোক সুতরাং একটু মানসম্ভ্রমের ভয় করিয়া থাকেন। তাঁহারা আমার নিকট ঠকিয়া সেই বিষয়ের পুনরুত্থাপন আর কাহারও নিকট করিলেন না। মনের কথা মনে রাখিয়াই, আপনার আপনার নির্বুদ্ধিতাকে গালি দিতে লাগিলেন। 

যে সকল ব্যক্তি অশ্লীল পুস্তকের নিমিত্ত টাকা পাঠাইয়া ছিলেন, তাঁহারা সকলেই যে ভদ্রলোক বা সকলেই লজ্জাসম্ভ্রমের ভয় করিয়া থাকেন, তাহা নহে। যাঁহারা একটু নির্লজ্জের মত, লজ্জাসম্ভ্রমের ধার যাঁহারা প্রায়ই ধারেন না, তাঁহারা পুস্তকের নিমিত্ত আমাকে বার বার পত্র লিখিতে লাগিলেন। যখন তাঁহাদিগের লিখিত কোন পত্রের উত্তর আমার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইলেন না, তখন অভিযোগ করিবার ভয় প্রদর্শন করিয়া আমাকে পত্র লিখিতে লাগিলেন। তাহাতেও যখন কোন উত্তর দিলাম না, তখন দুই একজন বাস্তবিকই বঞ্চনা করা অপরাধে আমার নামে নালিস করিলেন। এখন বুঝিলাম, এতদিবস পরে আমাকে বিশেষ বিপদগ্রস্ত হইতে হইবে। যদি উহারা আমাকে টাকা দিয়াছে, এরূপ প্রমাণ করিতে পারে, তাহা হইলে বঞ্চনা করা অপরাধে আমাকে নিশ্চয়ই দণ্ডগ্রহণ করিতে হইবে। এই ভাবিয়া আমি এক অদ্ভুত উপায় বাহির করিলাম। 

প্রায় পনরদিবস পরিশ্রম করিয়া আমি চারিটি ক্ষুদ্র গল্প লিখিলাম। তাহার একটির নাম দিলাম, “রতিশাস্ত্র” অপরটি “সম্ভোগ-রত্নাকর” তৃতীয়টি “কামরত্ন” এবং চতুর্থটি “লজ্জাতন্নেসা”। পুস্তক চারিখানিতে অশ্লীল পুস্তকের নাম রহিল সত্য, কিন্তু উহার ভিতর অশ্লীল নাম মাত্রও রহিল না। মোকদ্দমার দিন স্থির হইবার পূর্ব্বেই শীঘ্র শীঘ্র পুস্তক কয়েকখানি মুদ্রিত করিয়া ফেলিলাম, এবং ডাকে রেজেষ্টারী করিয়া শেষোক্ত গ্রাহকশ্রেণীর নিকট পাঠাইয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, আমার পুস্তক পাইয়া কেহই সন্তুষ্ট হইলেন না, বরং গালি দিয়া সকলেই এক একখানি পত্ৰ লিখিতে লাগিলেন। 

সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন দেখিয়া পুলিস জানিতে পারিলেন, পূর্ণানন্দ ভক্ত চারিখানি নিতান্ত অশ্লীল পুস্তক মুদ্রিত করিয়া বিক্রয় করিতেছে। এবং গুপ্ত অনুসন্ধানে ইহাও জানিতে পারিলেন, তিনি সেই পুস্তকগুলি বিক্রয় করিবার নিমিত্ত আপন বাড়ীতেই রাখিয়াছেন। এই সংবাদ পাইয়া একদিবস সদল বলে পুলিস আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন এবং কাহাকেও কিছু না বলিয়া আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। সম্মুখেই পুস্তকগুলি রাখা ছিল। তাঁহারা আমার সহিত সেই সকল পুস্তক লইয়া গমন করিলেন। বিক্রয়ের নিমিত্ত অশ্লীল পুস্তক রাখা, এবং অশ্লীল পুস্তক বিক্রয় করা অপরাধে আমার নামে মোকদ্দমা রুজু হইল। আমি কিছুই বলিলাম না, আদ্যন্তই চুপ করিয়া রহিলাম; আমাকে জামিনে ছাড়িয়া দিল। মোকদ্দমার দিন সময়-মত কাছারিতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, মোকদ্দমা চলিতে লাগিল।

বিচারক একজন দেশীয় লোক ছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এই সকল পুস্তক প্রকাশ, বিক্রয় এবং বিক্রয়ের নিমিত্ত আপন গৃহে তাহার স্থান দিয়াছ?” 

উত্তরে আমি কহিলাম, “হাঁ মহাশয়! আমি এই সকল পুস্তক প্রকাশ করিয়াছি, বিক্রয় করিয়াছি, বিক্রয় করিবার অভিলাষে গৃহে স্থান দিয়াছি, এবং ক্রয়কারী পাইলে এখনও বিক্রয় করিতেছি। কিন্তু এ সকল পুস্তক অশ্লীল নহে, বা ইহাতে অশ্লীলভাবের কোন কথাও নাই। তবে এদেশে যে সকল অশ্লীল পুস্তকের নাম অনেকের মুখে শুনিতে পাওয়া যায়, আমার প্রণীত এই পুস্তক কয়েকখানির সেই নাম দিয়াছি সত্য, কিন্তু ইহার ভিতর কোন অশ্লীল কথা নাই।” এই বলিয়া আমি একখানি পুস্তক গ্রহণ করিলাম, সৰ্ব্বসমক্ষে সেই আদালতের ভিতর উহা পাঠ করিলাম। তখন সকলেই দেখিলেন, সেই পুস্তকের ভিতর বাস্তবিকই অশ্লীলতার নামমাত্রও নাই, উহা এক একটি ছোট ছোট উপন্যাসমাত্র। এই ব্যাপার দেখিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আমাকে আর কিছুই করিতে পারিলেন না, বাধ্য হইয়া তৎক্ষণাৎ আমাকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। বরং পুলিসের উপর একটু অসন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, না দেখিয়া শুনিয়া একজনের উপর এরূপ মোকদ্দমা আনা নিতান্ত অন্যায়। 

(পাঁচ) 

পূর্ব্বকথিত নানাপ্রকার উপায় অবলম্বনে আমি যত অর্থ উপার্জ্জন করিতে লাগিলাম, অর্থ-পিপাসা দিন দিন ততই প্রবল হইতে লাগিল। কোন উপায় অবলম্বন করিলে, একেবারে অধিক অর্থের সংস্থান করিতে পারিব, তখন সেই উপায় উদ্ভাবনে নিযুক্ত হইলাম, এবং অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া পরিশেষে এক নূতন উপায় স্থিরও করিলাম। 

পুনরায় আমি আমার সেই অমোঘ লেখনীর সাহায্য গ্রহণ করিলাম। তাহারই সাহায্যে পুনরায় আর একটিবিজ্ঞাপন লিখিত হইল। উহার মর্ম্ম ছিল এইরূপ :—

“এদেশে নূতন! এই প্রথম!! 
পাঁচ টাকায় পঞ্চাশ হাজার! 
পূর্ব্বে কেহ কখন পান নাই, কিরূপে পাইতে হয়, 
তাহা [….] শ্রবণ করেন নাই। 

অনেক যোগাড় যন্ত্রে সবেমাত্র গবর্ণমেণ্ট হইতে কেবল একমাসের নিমিত্ত অনুমতি প্রাপ্ত হইয়াছি। মাস গত হইলে এমন উপায় আর থাকিবে না, বিনা-সম্বলে বড় মানুষ হইতে আর কেহই পারিবেন না। 

১লা বৈশাখ হইতে একখানি সাপ্তাহিক বাঙ্গালা সংবাদপত্র বাহির করিব। উহাতে রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য, সংবাদ প্রভৃতি আবশ্যকীয় সমস্ত বিষয়ই উপযুক্ত লেখকগণ কর্তৃক লিখিত হইয়া সুচারুরূপে যে পরিচালিত হইবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যে লেখক যে বিষয়ে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ, তিনিই সেই বিষয়ের প্রবন্ধ লিখিবার ভার গ্রহণ করিয়াছেন। বর্তমান সুপ্রসিদ্ধ লেখকদিগের মধ্যে অনেকেই গবর্ণমেন্টের কোন না কোন কর্ম্মে নিযুক্ত, তাহা দেশশুদ্ধ সমস্ত লোকেই অবগত আছেন। কিন্তু সরকারী কর্মচারীগণের সংবাদপত্রে প্রবন্ধাদি লিখিবার নিষেধ আছে, তাহাও সকলে জানেন। এই কারণবশতঃ লেখকদিগের নাম এইস্থানে প্রকাশ করিতে পারিলাম না। তবে এইমাত্র সাহস করিয়া বলিতে পারি যে, এই পত্রিকা নিশ্চয়ই সৰ্ব্বজনের মনোরঞ্জন করিতে সমর্থ হইবে। ইহার বাৎসরিক মূল্য মায় ডাকমাশুল সৰ্ব্বশুদ্ধ পাঁচ টাকামাত্র নির্দ্ধারিত হইল। চৈত্রমাসের মধ্যে গ্রাহকশ্রেণীভুক্ত না হইলে, তিনি প্রস্তাবিত পঞ্চাশ হাজার টাকায় কোনরূপেই অংশীদার হইতে পারিবেন না। পত্রের সহিত অগ্রিম মূল্য প্রেরণ না করিলে কাহাকেও গ্রাহকশ্রেণীভুক্ত করা যাইবে না। 

যে কার্য্যে রাজা মহারাজার সহানুভূতি পাওয়া যায়, সে কার্য্যের কখনই পতন হয় না, তাহাতে লাভ হউক, বা লোক্সান হউক, সাধারণকে কিন্তু কোনরূপেই ক্ষতি সহ্য করিতে হয় না। তাহার প্রমাণ, এই প্রস্তাবিত কর্ম্মে আমাদিগের লাভের সম্পূর্ণ আশা থাকিলেও, সে আশার উপর নির্ভর না করিয়া তাগ্রেই প্রস্তাবিত পঞ্চাশ সহস্রমুদ্রা এই সহরের প্রধান এবং বিশ্বাসী ব্যাঙ্কে জমা রাখা হইয়াছে। যদি আশানুরূপ ফল পাওয়া না যায়, তাহা হইলে সেই টাকাই গ্রাহককণের মধ্যে নিয়মিতরূপে বিতরিত হইবে। 

আমাদিগের সম্পূর্ণ আশা আছে, অভাব পক্ষে পঁচিশ হাজার লোক অগ্রিম পাঁচ টাকা পাঠাইয়া আমাদিগের প্রকাশিত এই পত্রিকার গ্রাহক হইবেন। তাহা হইলে এক মাসের মধ্যে ১২৫০০০ টাকা আমাদিগের হস্তগত হইবে। এই অর্থের ভিতর হইতে পঞ্চাশ হাজার বা তাহার অধিক টাকা বিতরণ করা কিছু কষ্টকর নহে। 

পঁচিশ হাজার গ্রাহক না হইয়া যদি তাহার অর্দ্ধেক বা তাহারও কম, অর্থাৎ দশ হাজারমাত্র গ্রাহকই হয়, তাহা হইলেও আমাদিগের গৃহ হইতে টাকা বাহির করিতে হইবে না। যদি ঈশ্বর একেবারে বিমুখ হয়েন, যদি আমাদিগের শতমাত্র গ্রাহকও না হয়, তাহা হইলেও গ্রাহকগণের কিছুমাত্র ক্ষতি হইবে না। রাজা মহারাজগণ কর্তৃক যে টাকা ব্যাঙ্কে জমা আছে, সেই টাকা হইতেই আমাদিগের অঙ্গীকার পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব। কিন্তু আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, পঁচিশ হাজার কেন, তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী গ্রাহক হইবে। 

গ্রাহকগণ কিরূপে টাকা পাইবেন—

দশ হাজার বা তাহার অল্প গ্রাহক হইলে সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা নিম্নলিখিতরূপে গ্রাহকগণের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়া যাইবে। 

১ম ব্যক্তি ১০০০০ 

২য় ব্যক্তি ৫০০০ 

৩য় ব্যক্তি ৩০০০

৪র্থ ও ৫ম ২০০০ হিসাবে ৪০০০

৬ষ্ঠ ও ৭ম ১৫০০ হিসাবে ৩০০০

 ৮ম হইতে ১৭ তম পৰ্য্যন্ত ১০০০ হিসাবে ১০০০০

১৮ম হইতে ২৭ তম পৰ্য্যন্ত ৫০০ হিসাবে ৫০০০

৪০ জন ২৫০ হিসাবে ১০০০০

অর্থাৎ ৬৭ জন লোকের মধ্যে এই পঞ্চাশ হাজার টাকা বিলি করিয়া দেওয়া যাইবে। যাঁহার অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইবে, তিনি দশ হাজার টাকা হইতে আড়াইশত টাকার মধ্যে কোন না কোন উপহার প্রাপ্ত হইবেন; অথচ বিনাব্যয়ে বিনামাশুলে এক বৎসরকাল গৃহে বসিয়া একখানি উচ্চদরের সাপ্তাহিক সংবাদপত্র পাঠ করিতে সমর্থ হইবেন। একবার ভাবুন দেখি, এই সুযোগ বঙ্গবাসীমাত্র কাহারও পরিত্যাগ করা উচিত কি না? 

আরও সুবিধা—

উপরি-উক্ত দশহাজার গ্রাহকের নিকট হইতে যে অর্থ সংগৃহীত হইবে, তাহা উপরি-উক্তরূপে বন্টন করিয়া দেওয়া যাইবে। ইহা ব্যতীত যদি আমাদিগের আশানুযায়ী আরও অধিক গ্রাহক হয়, তাহা হইলে গ্রাহকগণের মধ্যে সেই ৬৭ জন ব্যতীত আরও অনেকে উপহারস্বরূপ প্রত্যেকে সহস্রমুদ্রা প্রাপ্ত হইবেন। অর্থাৎ দশ হাজার ব্যতীত অপর গ্রাহকের নিকট হইতে যত টাকা আসিবে, তাঁহার অর্দ্ধেক আমাদিগের অন্যান্য খরচ এবং লাভের হিসাবে রাখিয়া অবশিষ্ট সমস্ত টাকাই গ্রাহকগণের মধ্যে হাজার টাকার হিসাবে বন্টন করিয়া দেওয়া যাইবে। আমাদিগের অর্দ্ধেক বাদে যদি পাঁচ হাজার টাকা থাকে, তাহা হইলে আরও পাঁচজন গ্রাহক হাজার টাকার হিসাবে পাইবেন। দশ হাজার টাকা থাকিলে ১০ জন, পঁচিশ হাজার টাকা থাকিলে আরও ২৫ জন পাইবেন। সুতরাং যত গ্রাহক অধিক হইবে, সেই ৬৭ জন ব্যতীত আরও অধিক লোক সেইরূপে উপহার প্রাপ্ত হইবেন। সুতরাং গ্রাহক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের আশাও বৃদ্ধি পাইবে। 

গ্রাহকগণের মধ্যে কোন্ কোন্ ব্যক্তি কিরূপে উপহার প্রাপ্ত হইবেন, তাহা যদি কেহ জানিতে চাহেন, তাহাও আমি বলিতে পারি। 

যেমন গ্রাহকের নাম ও টাকা আসিয়া আমাদিগের হস্তে পড়িবে, অমনি তাহাদিগের নাম গ্রাহকশ্রেণীভুক্ত করা যাইবে। প্রত্যেক গ্রাহকের নামে পর পর একটি একটি নম্বর পড়িবে। এইরূপ ৩০শে চৈত্র পর্য্যন্ত যত নম্বর হইবে, উহার প্রত্যেক নম্বর এক এক টুকরা স্বতন্ত্র কাগজে লিখিয়া একটি পাত্রে স্থাপিত হইবে। এইরূপভাবে যত নম্বর স্বতন্ত্র কাগজে লিখিত হইবে, সেইরূপ ততগুলি সাদা কাগজের টুকা প্রস্তুত করিয়া অপর আর একটি পাত্রে স্থাপিত করা যাইবে। যতগুলি লোকে উপহার পাইবেন, সেই সাদা কাগজের মধ্য হইতে ততগুলি কাগজে কেবল উপহারের টাকা লিখিত থাকিবে; অর্থাৎ একখানিতে দশ হাজার, একখানিতে পাঁচ হাজার, একখানিতে তিন হাজার, দুইখানিতে দুই হাজার প্রভৃতি। পরিশেষে যে সকল কাগজে টাকা লেখা আছে, তাহা সেই সাদা কাগজগুলির সহিত উত্তমরূপে মিশাইয়া দেওয়া হইবে। 

উক্ত দুইটি পাত্র দুইস্থানে স্থাপিত করিয়া দুইজন অশিক্ষিত লোক দ্বারা একই সময়ে সেই দুই পাত্র হইতে এক একখানি কাগজ সৰ্ব্বসমক্ষে উঠান যাইবে। যে নম্বরের কাগজের সহিত সাদা কাগজ উঠিবে, তিনি এক বৎসর কাল সংবাদপত্র ভিন্ন আর কিছুই পাইবেন না। আর যে নম্বরের সহিত টাকার অঙ্কসংযুক্ত কাগজ উঠিবে, তিনি সেই কাগজের লিখিত টাকা উপহারস্বরূপ প্রাপ্ত হইবেন। এক কথায় আমাদিগের দেশে সচরাচর যেরূপভাবে সুরতি খেলা হইয়া থাকে, ইহাও সেইরূপ নিয়মে সম্পন্ন হইবে। ১০ই হইতে সৰ্ব্বসমক্ষে এই সুরতি খেলা আরম্ভ হইয়া যে কয়েকদিবস সমাপন না হয়, সেই কয়েকদিবস চলিবে। এই কার্য্যের নিমিত্ত একটিবৃহৎ বাড়ী লওয়া যাইবে। গ্রাহকগণের মধ্যে যিনি উপস্থিত থাকিয়া ইহা দেখিতে চাহিবেন, তিনি দেখিতে পাইবেন।” 

এইরূপভাবে বিজ্ঞাপন লিখিয়া তাহার নিম্নে আমার নাম ও ঠিকানা লিখিয়া দিলাম। আজকালকার সুলভ ছাপাখানার সাহায্যে সেই বিজ্ঞাপনটি একটি স্বতন্ত্র কাগজে ছাপাইয়া ফেলিলাম, দুইখানি দশখানি নয়, একেবারে এক লক্ষ বিজ্ঞাপন ছাপাইয়া লইলাম। আমি পূর্ব্বে কয়েকবার সংবাদপত্রে নানারূপ বিজ্ঞাপন বাহির করিয়া লোকদিগকে ঠকাইয়াছিলাম, সুতরাং সংবাদপত্রের সম্পাদকমাত্রই আমাকে চিনিয়া লইয়াছিলেন। কাজেই এবার তাঁহাদিগের নিকট গমন না করিয়া, পৃথক্ কাগজে সেই বিজ্ঞাপন ছাপাইতে হইল। 

ডাকঘরের কল্যাণে এক পয়সা খরচে এক এক তাড়া বিজ্ঞাপন মফঃস্বলে বিলি করা আজকালকার দিনে কঠিন নহে। সুতরাং এক মাসের মধ্যে সেই বিজ্ঞাপনগুলি সমস্তই মফঃস্বলে পাঠাইয়া দিলাম। ডাইরেক্টরী দেখিয়া, পোষ্টাফিসের তালিকা দেখিয়া, রেলওয়ে ষ্টেশনের নাম দেখিয়া, গ্রামের তালিকা দেখিয়া যেখানে সেখানে এই বিজ্ঞাপনগুলি একরূপ দেশের মধ্যে ছড়াইয়া ফেলিলাম। 

দেখিলাম, আমার লিখিত বিজ্ঞাপনে সরলহৃদয়, মফঃস্বল বাসী অনেকেই ভুলিয়া গেলেন। বিজ্ঞাপন যে সকল মিথ্যা কথা লিখিয়া লোক ভুলাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, দেখিলাম, অনেকেই সেই সকল মিথ্যা কথা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলেন। তাঁহারা ভাবিলেন, প্রকৃতই কাগজ বাহির হইবে, গবর্ণমেন্টের কর্ম্মচারীবর্গের মধ্যে অনেকেই লিখিবেন। আরও দেখিলাম, আমার মিথ্যা ছলনায় অনেকে ভুলিয়া বিশ্বাস করিয়াছেন যে, ইহার ভিতর প্রকৃতই রাজা মহারাজারা আছেন, প্রকৃতই পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যাঙ্কে জমা রাখা হইয়াছে। ইহা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা, লোক ভুলাইবার যে কেবল ইহা স্তোকবাক্য, তাহা কিন্তু অনেকেই ভাবিলেন না। 

ক্রমশঃ টাকা আসিতে আরম্ভ হইল। বিজ্ঞাপন বিলি হইবার পর হইতেই মনিঅর্ডার করিয়া অনেকেই আমার নামে টাকা পাঠাইতে লাগিলেন, এবং সেই সঙ্গে এক একখানি পত্র লিখিয়া গ্রাহক হইতে লাগিলেন। আমি যত আশা করিয়াছিলাম, কাজে কিন্তু ততটা না হইলেও একেবারে বিফল মনোরথ হইলাম না। বিজ্ঞাপন ছাপাইয়া মফঃস্বলে বিলি করিতে আমার যাহা খরচ হইয়াছিল, তাহা বাদে চৈত্রমাসের শেষে আমার হস্তে নগদ পাঁচ সহস্র টাকা জমিয়া 

গেল। 

পূর্ব্ব হইতেই আমার ইচ্ছা ছিল,—আমি যে কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহা সহরবাসী কাহারও নিকট প্রকাশ করিব না, মফঃস্বলের লোকদিগের নিকট হইতে বাহিরে বাহিরে যাহা কিছু পারি মারিয়া লইব; কিন্তু আমার সে ইচ্ছা সফল করিতে পারিলাম না। মফঃস্বলবাসীদিগের বন্ধুবান্ধব প্রভৃতি যাঁহারা কলিকাতায় আছেন, ক্রমে তাঁহারা জানিতে পারিলেন। এবং তাঁহাদিগের নিকট হইতে এককাণ দুইকাণ করিয়া এই কথা ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িল। তখন দেখিলাম, আমাকে এই সময় হইতে একটু সাবধান হইয়া চলিতে হইবে। কারণ এই কথা যখন সহরের লোকে জানিতে পারিয়াছে, তখন সুরতি খেলার দিন নিশ্চয়ই অনেক কলিকাতার লোক সেইস্থানে উপস্থিত হইবে। এবং আমি জুয়াচুরি করিয়া লোক ঠকাইতেছি জানিতে পারিলে, আমাকে কোন না কোন গোলযোগে ফেলিলেও ফেলিতে পারে। এ পর্যন্ত আমি মফঃস্বল হইতে যে সকল টাকা প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহার কোন হিসাবই রাখিয়াছিলাম না, বা আমার অঙ্গীকৃতরূপে নম্বর অনুযায়ী তাঁহাদিগের নামও গ্রাহকশ্রেণীভুক্ত করিয়া কোন খাতাতেও লিখিয়াছিলাম না। কলিকাতাবাসীগণ জানিতে পারিল দেখিয়া, অতঃপর সেই সকল চিঠিপত্র দেখিয়া আমাকে একটি গ্রাহকের তালিকা প্রস্তুত করিতে হইল; এবং প্রত্যেক গ্রাহকের নামে পর পর নম্বরও দিতে হইল। এই তালিকায় গ্রাহকের নাম ও ঠিকানা প্রভৃতি সমস্তই ঠিক রহিল; কিন্তু সকলের চক্ষে ধূলি দিবার মানসে সেইরূপ আরও একখানি খাতা বাঁধিলাম। প্রকৃত খাতায় যতগুলি নাম লেখা হইয়াছিল, এই খাতাতেও ততগুলি নাম লিখিলাম। কিন্তু বলা বাহুল্য, যে সেই খাতায় লিখিত একটিমাত্রও নাম বা ঠিকানা প্রকৃত নহে, সকলই স্বকপোল-কল্পিত। 

নিয়মিত দিবস সুরতি খেলা আরম্ভ হইল। বিজ্ঞাপনে যেরূপ বলিয়াছিলাম, সেইরূপভাবেই সুরতি খেলা চলিতে লাগিল। কিন্তু গ্রাহক সংখ্যা অল্প হইয়াছিল বলিয়া, একই দিবসে সমস্ত শেষ হইয়া গেল। সুরতি খেলা শেষ হইলে, সকলেই দেখিলেন যে, ভিন্ন ভিন্ন নম্বরের মধ্যে ৬৭ জনের নামে প্রস্তাবিত টাকার টিকিট উঠিল। কিন্তু সেই সকল নম্বরের প্রকৃত গ্রাহক কে, তাহা তখন কেহ জানিতে পারিলেন না। সকলকেই কহিলাম, খাতার সহিত মিলাইয়া দেখিয়া যিনি যত টাকা পাইবেন, তাহা পরদিবসের সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইবে। 

যাহা হউক, আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সকলেই সেইদিবস সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন। পরদিবস কোন সংবাদপত্রেই কোন কথা বাহির হইল না, যে সকল নম্বরের গ্রাহক যে পরিমাণ টাকা পাইবেন, তাহাদিগের একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া কয়েকখানি সংবাদপত্রে পাঠাইয়া দিলাম। কিন্তু কেহই আমার সেই তালিকা প্রকাশ করিলেন না, কেন করিলেন না, তাহা পাঠকগণ বোধ হয় সহজেই বুঝিতে পারেন। বিনা অর্থে এইরূপ সংবাদ বাহির করা সংবাদপত্র সম্পাদকের পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব হইলেও, কোন কোন সম্পাদক তাহা প্রকাশ করিয়া থাকেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ এ সংবাদটি কেহই প্রকাশ করিলেন না। এদিকে সমস্ত লোক আমাকে একরূপ পাগল করিয়া তুলিল, দলে দলে লোক আসিয়া কেবল সংবাদ জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতে লাগিল। আমি কিন্তু মুখে কাহাকেও কিছু বলিলাম না, পরদিবস বা তাহার পরদিবস যাহাতে এই সংবাদ কোন না কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তাহার বন্দোবস্ত করিব বলিয়া তাহাদিগের নিকট প্রতিজ্ঞা করিলাম। 

“এই সংবাদ প্রকাশ করিবার নিমিত্ত পরিশেষে আমাকে কিছু পয়সা বাহির করিতে হইল। বিজ্ঞাপনের নিয়মিত মূল্য দিয়া, একখানি সংবাদপত্রে পরদিবস আমি সেই সংবাদ প্রকাশ করিলাম। কত নম্বরের গ্রাহক কত টাকা প্রাপ্ত হইলেন, তাহা পরদিবস সকলেই জানিতে পারিলেন। আরও জানিলেন—সেই গ্রাহকের নাম এবং বাসস্থান; কিন্তু পোষ্টাফিস বা জেলা প্রভৃতি কিছুই তাহাতে লিখিত হইল না, অর্থাৎ সকলের নাম নিম্নলিখিতরূপে প্রকাশিত হইল। যথাঃ—

২৩৪ নম্বর রামচন্দ্র ঘোষ – কলিকাতা – ১০০০ টাকা 

৭৯২ নম্বর গোপাল ঘোষ – বেরূণ – ২৫০ টাকা 

ইত্যাদি। পাঠকগণকে বলিতে হইবে না, যে সকল নাম এইরূপে প্রকাশিত হইল, তাহাদিগের প্রত্যেকের নাম আমার স্বপোলকল্পিত নামের তালিকা পুস্তক হইতে গৃহীত হইয়াছিল। সেই অনুসারে নাম দেখিবার সময় ভ্রমক্রমে আমি আমার সেই প্রকৃত নাম ধাম সম্বলিত পুস্তক খুলি নাই; সুতরাং আমার সঞ্চিত সেই পাঁচ সহস্ৰমুদ্রা হইতে কপদকমাত্রও কেহ পাইলেন না। এইরূপে সমস্ত লোককে বঞ্চনা করিয়া, আমি আমার উদর পূর্ণ করিলাম। 

“এদিকে সম্বৎসরকাল বিনামূল্যে গ্রাহকগণকে যে সংবাদপত্র প্রদান করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, তাহা কেবল মাত্র প্রতিজ্ঞাতেই রহিয়া গেল, কার্য্যে কিন্তু তাহার কিছুই হইল না। সাধারণকে এই বলিয়া বুঝাইলাম যে, গবর্ণমেন্ট কেবলমাত্র চৈত্রমাস পর্যন্ত “সুরতি খেলার” আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। সুতরাং সুরতি খেলার সংসৃষ্ট সংবাদপত্র বৎসরাবধি কোনরূপেই বাহির হইতে পারে না, গবর্ণমেন্ট এই আদেশ প্রদান করিয়াছেন, সুতরাং সংবাদপত্র বাহির করিতে পারিলাম না। 

“আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া যাঁহারা আমার নিকট টাকা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই এইরূপে আমার নিকট প্রতারিত হইলেন।” 

[আষাঢ়, ১৩০১] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *