মুণ্ডচুরি (অর্থাৎ একটি মস্তকহীন মনুষ্যের আশ্চর্য্য রহস্য!)

মুণ্ডচুরি (অর্থাৎ একটি মস্তকহীন মনুষ্যের আশ্চর্য্য রহস্য!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

রামচন্দ্র ঘোষ একজন কুলীন কায়স্থ। ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে ইহার জন্মস্থান। রামচন্দ্রকে আমরা সেকেলে লোক বলিতে পারি না; কারণ তাহার বয়ঃক্রম এখন চল্লিশ বৎসর পূর্ণ হইয়াছে কিনা সন্দেহ। রামচন্দ্র কখনও ইংরাজী ভাষা শিক্ষা করে নাই। বাঙ্গালাও ভালরূপ জানিত না। বাল্যকালে পাঠশালার গুরুমহাশয়ের নিকট পাঠ সমাপন করিয়া, সে সংসারক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হয়। যে প্রদেশে তাহার জন্মস্থান, সেই প্রদেশের একজন জমীদারের সরকারে কিছুদিন উমেদারি করিয়া, পরিশেষে রামচন্দ্র বিনা বেতনে একটি চাকরির সংস্থান করিয়া লয়। সৎ উপায়েই বলুন বা অসৎ উপায়েই বলুন, এই চাকরী করিয়া সে যাহা উপার্জন করিত, তাহা দ্বারাই আপনার জীবিকা নির্ব্বাহ ও পরিবার প্রতিপালন করিত। পরিবারের মধ্যে তাহার একমাত্র স্ত্রী ভিন্ন আর কেহই ছিল না। 

রামচন্দ্র অতিশয় চতুর ছিল। তাহার উপর যখন যে কার্য্যের ভার পড়িত, সে তৎক্ষণাৎ তাহা সমাপন করিত। জমীদার মহাশয় উহার কার্য্য পটুতা দেখিয়া কয়েকবৎসর পরেই একেবারে উহার পাঁচটাকা বেতন অবধারিত করিয়া দেন। ও ক্রমে ক্রমে এই বেতন বৰ্দ্ধিত করিয়া দিতেও ত্রুটী করেন না। যে সময়ের ঘটনা আমরা পাঠকবর্গকে জানাইতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সেই সময় রামচন্দ্র ঘোষ বার টাকা বেতনে সেই জমীদার সরকারে কার্য্য করিত। 

রামচন্দ্র ঘোষ যে জমীদারের নিকট কার্য্য করিত, তাঁহাদের সরিকদিগের মধ্যে বহুদিবসাবধি নানারূপ মনোবিবাদ চলিয়া আসিতেছিল। উভয় পক্ষে অনেক দেওয়ানি, অনেক ফৌজদারি মোকদ্দমা চলিয়াছে; অনেক টাকার অযথা—শ্রাদ্ধ হইয়া গিয়াছে; অনেক অনেক প্রজা। অনেক অনুগত ব্যক্তি এবং অনেক ভৃত্য জেলে পৰ্য্যন্ত গমন করিয়াছে; তথাপি সেই বিবাদের নিবৃত্তি না হইয়া, সংক্রামক রোগের ন্যায় ক্রমে ক্রমে উভয় দলের মধ্যে সবেগে পরিব্যাপ্ত হইতেছে। 

রামচন্দ্র ঘোষের মনিবের নাম-গিরীন্দ্রনাথ রায়। প্রায় সাত বৎসর পূর্ব্বে গিরীন্দ্রনাথ, একটি জোত বেদখল উপলক্ষে তাঁহার সরিক ও ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথ রায়ের নামে স্থানীয় মুনসেফি আদালতে নালিশ করন। মুনসেফি কোর্টে সেই মোকদ্দমার বিচার হইতে অনেক দিবস অতিবাহিত হইয়া যায়; কিন্তু বিচার নিষ্পত্তিকালে নগেন্দ্রনাথই অযথা জয়লাভ করেন। রামচন্দ্র ঘোষ এই মোকদ্দমায় একজন প্রধান সাক্ষী ছিল। গিরীন্দ্রনাথ এই মোকদ্দমায় পরাজিত হইয়া জজের কোর্টে আপীল করেন। সেইস্থানে তিনি যোগাড়যন্ত্রের কিছুমাত্র ত্রুটী করেন নাই, এবং উকিল ও মোক্তারগণকে অজয় মুদ্রা প্রদানেও কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হয়েন নাই। তথাপি এ আদালতেও তিনি পরাজিত হন। ও নগেন্দ্রের নিকট অনেক টাকার খরচার দায়ী হইয়া পড়েন। 

গিরীন্দ্রনাথ তাহাতেও ছাড়িবার পাত্র নহেন; অনন্যোপায় হইয়াও পরিশেষে তিনি কলিকাতা হাইকোর্টে এই মোকদ্দমার বিচার প্রার্থনায় আপীল করেন। নগেন্দ্রনাথও প্রথম হইতেই যোগাড় করিতে প্রবৃত্ত হন। আবেদনের দিবসেই উভয় পক্ষীয় কৌন্সলীর বাদ-প্রতিবাদ আরম্ভ হয়। অনেক শওয়াল উত্তরের পর, গিরীন্দ্রনাথের আবেদন গ্রাহ্য হয়, ও হাইকোর্টে এই মোকদ্দমার বিচার হওয়াই সাব্যস্ত হয়। 

হাইকোর্টের নিয়মানুযায়ী সময় অতিবাহিত হইলে, হাইকোর্টের বোর্ডে এই মোকদ্দমার ধার্য্য দিবস দেখিতে পাওয়া যায়। এই মোকদ্দমা উপলক্ষে গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ উভয়েই কলিকাতায় আগমন করেন। রামচন্দ্র ঘোষ আপনার মনিব গিরীন্দ্রনাথের সঙ্গেই আসিয়াছিলেন। গিরীন্দ্রনাথ এই স্থানে একটি বাড়ী ভাড়া লইয়া তাঁহার সরকার রামচন্দ্র ঘোষের সহিত উহাতে অবস্থিতি করিতে থাকেন। গিরীন্দ্রনাথ যে বাড়ী ভাড়া লন, তাহা নিতান্ত ক্ষুদ্র। উহাতে দুইটিমাত্র গৃহ। নীচের একটিমাত্র গৃহভিন্ন আর কোন স্থান নাই; উপরেও একটি গৃহ, উহা নীচের গৃহের উপরেই স্থাপিত। নীচের গৃহে প্রবেশ করিবার কেবল একটিমাত্র দ্বার পথের উপর আছে। উপরে উঠিতে হইলে এই দ্বার দিয়া প্রথমে নীচের গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে হয়; এই গৃহের ভিতরে সংলগ্ন একটি কাষ্ঠনির্ম্মিত সোপানাবলি আছে, সেই সোপানশ্রেণী ভিন্ন উপরে উঠিবার আর কোন উপায় নাই। 

গিরীন্দ্রনাথ উক্ত উপরের গৃহে শয়ন করিয়া থাকেন। রামচন্দ্রের থাকিবার স্থান—নীচের সেই গৃহটি। রন্ধনাদি এ বাড়ীতে হয় না। আহারের কার্য্যটা উভয়েই বাহিরে বাহিরে সারিয়া লন। 

নগেন্দ্রনাথও এখন কলিকাতায় আছেন। তিনি কিন্তু এইস্থানে থাকেন না। অন্যস্থানে আর একটি বাড়ী ভাড়া করিয়া, সেইস্থানে অবস্থিতিপূর্ব্বক মোকদ্দমার জোগাড় করিতেছেন। 

হাইকোর্টে মোকদ্দমার যেদিন স্থির হইয়াছিল, সেই দিবস মোকদ্দমা হইল না। আজি হইবে, কালি হইবে, করিয়া ক্রমে মাসাধিক গত হইয়া যাওয়ার পর, মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল। ক্রমাগত দুই দিবস উভয় পক্ষীয় কৌন্সলীর বক্তৃতার পর বিচার শেষ হইল। এবার গিরীন্দ্রনাথ জয়লাভ করিলেন। উভয় নিম্ন আদালতের রায় এবার পরিবর্তিত হইল। বহুদিনব্যাপী মোকদ্দমায় জয়লাভ করিয়া। গিরীন্দ্রনাথ ও রামচন্দ্র বিশেষরূপ আনন্দ প্রকাশ করিতে করিতে সন্ধ্যার পর বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন, ও মনে মনে স্থির করিলেন, যে, পরদিবস প্রাতঃকালে কালীঘাটে গমন করিয়া ষোড়শোপচারে মহামায়ার পূজা দিবেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

সন ১২৯১ সালের ২০শে বৈশাখ তারিখের সন্ধ্যার পর হাইকোর্ট হইতে আসিয়া গিরীন্দ্রনাথ ও রামচন্দ্র আপনাদিগের বাসায় প্রবেশ করিলেন। 

২০শে বৈশাখের রাত্রি অতিশয় গরম বোধ হইয়াছিল। এই রাত্রিতে যে কেহ গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইতে পারিয়াছিলেন, তাহা আমার বোধ হয় না। কারণ ভয়ানক গ্রীষ্মের জ্বালায় সমস্ত রাত্রির ভিতর আমি আমার নয়নযুগল একবারের নিমিত্তও মুদিত করিতে সমর্থ হই নাই। ছটফট করিয়াই আমাকে প্রায় সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল। সমস্ত রাত্রি জাগরণ নিবন্ধন নিতান্ত ক্লান্ত দেখিয়াই বুঝি; প্রাতঃকালে নিদ্রাদেবী একটু অনুকম্পা প্রকাশ করিলেন। সেই সময় আমি গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইলাম। 

২১শে বৈশাখ প্রত্যূষে সাতটার সময় একজন পুলিস প্রহরীর ডাকাডাকিতে আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। কারণ অনুসন্ধানের নিমিত্ত বাহিরে আসিলাম। দেখিলাম, সেই প্রহরী একখানি পত্র হস্তে করিয়া আমাকে ডাকাডাকি করিতেছে। আমাকে দেখিয়াই সে সেই পত্রখানি আমার হস্তে প্রদান করিল। কৌতূহলাক্রান্ত অথচ মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হইয়া তখনই সেই পত্রখানি খুলিয়া পাঠ করিলাম। তখনও আমার চক্ষুতে অল্প অল্প নিদ্রা ছিল; কিন্তু পত্রপাঠ করিবামাত্র উহা সুদূরে পলায়ন করিল, নিদ্রার জড়তার পরিবর্তে অন্য একটি ভাবনা আসিয়া হৃদয় অধিকার করিল। পত্রখানি আমার একজন ঊর্ধ্বতন ইংরাজ কর্মচারীর লিখিত। পাঠকগণের কৌতূহল নিবারণ করিবার নিমিত্ত, সেই পত্রের মর্ম্ম সংক্ষেপে নিম্নে প্রদত্ত হইল। 

“অদ্য প্রাতঃকালে সাড়ে পাঁচটার সময় দত্তের লেনস্থিত ২৫ নম্বর বাড়ির ভিতর একটি মুণ্ডবিহীন মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। বোধ হইতেছে, এই মৃতদেহ সেই বাড়ীর বর্তমান অবস্থানকারীর সরকার—রামচন্দ্র ঘোষের। পত্রপাঠমাত্র তুমি সেইস্থানে গমন করিয়া, এই খুনের রহস্যভেদ করিতে বিশেষ যত্ন করিবে। আমিও সেইস্থানে গমন করিতেছি।” 

পত্রপাঠ করিয়া আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না। তৎক্ষণাৎ আমার থাকিবার স্থান পরিত্যাগ পূর্বক যেস্থানে পূর্ব্বোক্ত মুণ্ডবিহীন মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেইস্থান উদ্দেশে চলিলাম। সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম যে, সেই রাস্তায় আর লোকের স্থান হইতেছে না। একটু দাঁড়াইলাম। কি করিব, তাহাও একটু ভাবিয়া লইলাম। পরিশেষে সেই জনতার ভিতর প্রবেশ করিয়া, অনেক কষ্টে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে সমর্থ হইলাম। 

যে বাড়ীতে এই ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার অবস্থা পাঠক পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। সেই নীচের গৃহ অর্থাৎ যে গৃহে রামচন্দ্র ঘোষ শয়ন করিত, সেই গৃহের মেজের উপর, সেই মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। সেই গৃহের ভিতর এরূপভাবে রক্তস্রোত প্রবাহিত যে, তাহার ভিতর পদবিক্ষেপ করা সহজ নহে; একখানি মোটা বস্ত্রদ্বারা সেই মৃতদেহ আবৃত রহিয়াছে। যেরূপভাবে সেই দেহ আবৃত দেখিলে বোধ হয়, উহা যত্নের সহিত আবৃত করা নহে; একখানি কাপড় উপর হইতে কে যেন উহার উপর ফেলিয়া দিয়াছে। সেইস্থানে একজন মুসলমান কনষ্টেবল ছিল, তাহাকে সেই কাপড়ের একপ্রান্ত ধরিয়া আস্তে আস্তে উঠাইতে কহিলাম। সে আমার আদেশ অনুযায়ী কার্য্য করিলে, আমি দেখিলাম, একটি মস্তকহীন মৃতদেহ সেইস্থানে পতিত রহিয়াছে। সেই মৃতদেহ উলঙ্গ, উহার পরিধানে কোন বস্ত্রাদি নাই। সেই গৃহের ভিতর ছিন্ন মস্তকের বিশেষ অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু সমস্ত অনুসন্ধানই ব্যর্থ হইল। মস্তকের চিহ্নমাত্রও পাওয়া গেল না। সেই মৃতদেহের অনতিদূরে একখানি রক্তাক্ত ভোজালি পড়িয়াছিল দেখিলাম, উহা যত্নের সহিত উঠাইয়া লইলাম। 

সেই গৃহে রামচন্দ্র ঘোষের যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহার সমস্তই রহিয়াছে; উহার কিছুমাত্র বিপর্যস্ত বা স্থানান্তরিত হয় নাই। তবে রামচন্দ্র ঘোষের পরিধানে যে কাপড় ছিল, এবং যে চাদর লইয়া সে হাইকোর্টে গমন করিত। অনুসন্ধানে কেবলমাত্র তাহাই পাওয়া গেল না। গিরীন্দ্রনাথ খরচের নিমিত্ত সর্ব্বদাই কিছু অর্থ রামচন্দ্রের নিকট রাখিতেন। হিসাব করিয়া দেখা গেল যে, এখন সাত টাকা কয়েক আনা রামচন্দ্রের নিকট থাকা উচিত; কিন্তু সেই গৃহের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া, তাহার একটি পয়সাও পাওয়া গেল না। 

যে গৃহে রামচন্দ্র শয়ন করিত, সেই গৃহের একটিমাত্র দ্বার আছে, ইহা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। সেই দ্বারটী যে পথের উপরেই স্থাপিত তাহাও পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই জানিয়াছেন। দ্বার ব্যতীত পথের দিকে আরও একটি জানালা আছে, উহার গরাদিয়া কাষ্ঠনির্মিত। সেই জানালার নিকট গমন করিয়া দেখিতে পাইলাম, যে, উহার একটি গরাদিয়া ভগ্ন অবস্থায় রহিয়াছে। 

আমি যখন মৃতদেহ অবলোকন করি, সেই সময়ে উহা উপুড় হইয়া পড়িয়াছিল। পরিশেষে যখন সেই মৃতদেহ উল্টান হয়, তখন দেখা গেল যে, উহার পেটের উপর একটি সাংঘাতিক আঘাতের চিহ্ন রহিয়াছে, ও সেইস্থান দিয়া নাড়ীভুঁড়ি প্রভৃতি বাহির হইয়া পড়িয়াছে। গিরীন্দ্রনাথ সেই স্থানেই উপস্থিত ছিলেন, একদৃষ্টিতে সেই মৃতদেহের দিকে বারবার লক্ষ্য করিতেছিলেন। কি যে দেখিতেছিলেন, তাহা তিনিই অবগত ছিলেন। কেবল একবার তাঁহাকে বলিতে শুনিয়াছিলাম—“রামচন্দ্রের বর্ণ যেরূপ ছিল, এখন আর সেরূপ নাই, মৃত্যুর পর তাহাকে যেন আরও অধিক কৃষ্ণকায় বলিয়া বোধ হইতেছে।” 

এই ভয়ানক হত্যার কথা ক্রমে এক কান দুই কান করিয়া, সকলের কানেই উঠিল। সকলেই জানিতে পারিল যে, গিরীন্দ্রনাথের সরকার রামচন্দ্র ঘোষকে কে হত্যা করিয়াছে। কেহ বলিল, গিরীন্দ্রনাথই উহার সরকারকে হত্যা করিয়াছে; কেহ বলিল, চোরে মারিয়া গিয়াছে; আর যাঁহারা সকলের নিকট একটু বিবেচক ও বুদ্ধিমান্ বলিয়া পরিচিত, তাঁহার বলিলেন যে, এ হত্যা নগেন্দ্রনাথ ভিন্ন আর কাহারও দ্বারা সম্ভব হইতে পারে না। এইরূপে যাঁহার মনে যাহা আসিতে লাগিল, তিনি তাহাই বলিতে লাগিলেন, যিনি যেরূপ বুঝিলেন, তিনি তাহাই অপরকে বুঝাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

যে গৃহে মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেই গৃহটি উত্তমরূপে দেখিয়া, পূর্ব্ববর্ণিত কাষ্ঠের সিঁড়ি দিয়া, গিরীন্দ্রনাথ যে গৃহে শয়ন করিতেন, সেই গৃহে উঠিলাম। সেই গৃহের ভিতর যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা উত্তমরূপে দেখা হইল; কিন্তু কোন দ্রব্যই অপহৃত বা স্থানান্তরিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল না। সেই গৃহে দেওয়ালের গায়ে একখানি ভোজালী ছিল, কেবল উহাই দেখিতে পাওয়া গেল না। এই ভোজালীখানি গিরীন্দ্রনাথের। গিরীন্দ্রনাথ যখন কলিকাতায় আগমন করেন, সেই সময়ে সেই অস্ত্রখানি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। রামচন্দ্রও উহা জানিত, কোন আবশ্যক হইলে উহা লইয়া সে ব্যবহারও করিত। নীচের গৃহে মৃতদেহের নিকট যে রক্তাক্ত ভোজালীখানি পাওয়া গিয়াছিল, তাহা তখন গিরীন্দ্রনাথকে দেখান হইল। দেখিবামাত্র গিরীন্দ্রনাথ চিনিলেন যে, উহা সেই ভোজালী; কিন্তু কি প্রকারে ও কাহাদ্বারা উহা যে নীচের গৃহে আনীত হইয়াছে, তাহা তিনি কিছুই বলিতে পারিলেন না। 

গিরীন্দ্রনাথ এই হত্যাকাণ্ডে কোনরূপে লিপ্ত আছেন কি না, তাহা আমি এখন বলিতে চাহি না। কিন্তু পাঠক! গিরীন্দ্রনাথের বর্তমান অবস্থা একবার ভাবুন দেখি! এই বাড়ীতে দুইজন লোক ভিন্ন অন্য আর কেহই নাই; দুইজনেই সেই রাত্রিতে একত্র বাহির হইতে আহার করিয়া আসিয়াছেন, উভয়েই একত্র বাড়ীর ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক সদর দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। অপর লোক যে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, তাহারও কোন প্রমাণ নাই। বিশেষ যে ভোজালী গিরীন্দ্রনাথের গৃহে ছিল, সেই ভোজালী দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। এরূপ অবস্থায় সহজেই গিরীন্দ্রনাথকে যে অনেকেই সন্দেহ করিতে পারেন, তাহার আর ভুল নাই। কিন্তু একটু বিশেষ বিবেচনা করিয়া যিনি দেখিবেন, তিনি মনে করিতে পারেন,—যদি গিরীন্দ্রনাথ দ্বারাই এই কার্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে জানালার গরাদিয়া ভাঙ্গা থাকিবে কেন? রামচন্দ্রের পরিধেয় কাপড়ই বা কোথায় গেল, রামচন্দ্রের মস্তকই বা গিরীন্দ্রনাথ কোথায় রাখিলেন? 

এতদ্দেশীয় পুলিসের নিয়মানুসারে প্রথমেই গিরীন্দ্রনাথকে লইয়া একটু পীড়াপীড়ি হইল, কিন্তু পরিশেষে সকলেই তাঁহাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করিয়া ছাড়িয়া দিলেন। গিরীন্দ্রনাথের সহিত নগেন্দ্রনাথের যেরূপ সদ্ভাব, তাহা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। একে রামচন্দ্র ঘোষ গিরীন্দ্রের সরকার, তাহাতে আবার সরিকী মোকদ্দমার প্রধান উদযোগী হইয়া, নগেন্দ্রের বিপক্ষে ক্রমাগত যোগাড় করিয়া আসিতেছিল; সুতরাং নগেন্দ্রনাথ তাহাকে দুইচক্ষে দেখিতে পারিতেন না। এরূপ অবস্থায় নগেন্দ্রনাথ নির্দোষী হইলেও, আর কতক্ষণ তাঁহার উপর সন্দেহ না হইয়া থাকিতে পারে? সুতরাং পুলিসের সন্দেহ তখন তাঁহার উপরেই পতিত হইল। নগেন্দ্রনাথ কলিকাতায় আছেন; কিন্তু কোন্ স্থানে এবং কোন্ বাড়ীতে আছেন, তখন তাহারই অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। গিরীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করায়, তিনিও নগেন্দ্রনাথের ঠিকানা বলিতে পারিলেন না। 

আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইবার কিয়ৎক্ষণ পরেই, যিনি আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন, আমার সেই ঊর্দ্ধতন ইংরাজ কৰ্ম্মচারী সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। এখনও তিনি সেইস্থানে উপস্থিত থাকিয়া অনুসন্ধান—কাৰ্য্য স্বচক্ষে দর্শন করিতেছেন। 

গিরীন্দ্রনাথ যখন নগেন্দ্রনাথের ঠিকানা বলিতে পারিলেন না, তখন সেই ইংরাজ কর্মচারী আমাকে নগেন্দ্রনাথের অনুসন্ধান করিতে অনুমতি প্রদান করিলেন। পুলিসের ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীগণের আদেশ নিম্ন-কর্ম্মচারীর অলঙ্ঘনীয়; সুতরাং কোনরূপ আপত্তি না করিয়া, আমি নগেন্দ্রনাথের অনুসন্ধান করিতে সম্মত হইলাম। 

অনুসন্ধান করিতে সম্মত হইলাম সত্য; কিন্তু ভাবিবার সময় পাইলাম না যে, কিরূপে নগেন্দ্রনাথের সন্ধান করিতে সমর্থ হইব। একে গিরীন্দ্রনাথ তাঁহার ঠিকানা অবগত নহেন, অপর রামচন্দ্র ত মরিয়াই গিয়াছে; কাজেই একটু ভাবিতে হইল। সেই সময় হঠাৎ আমার মনে হইল,—এই সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত এত ভাবিতেছি কেন? ইহার ঠিকানা পাইবার নিতান্ত সহজ উপায় যে রহিয়াছে! নগেন্দ্রনাথের উকীলকে পাইলে, সহজেই তাঁহার ঠিকানা পাওয়া যাইবে; কারণ, তাঁহার উকীল নিশ্চয়ই তাঁহার ঠিকানা অবগত আছেন। এই ভাবিয়া গিরীন্দ্রনাথকে একবার ডাকিলাম, এবং তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া নগেন্দ্রনাথের উকীলের নাম ও ঠিকানা পাইলাম। সেই উকীল মহাশয়ের থাকিবার স্থান—ভবানীপুরে; আর কালবিলম্ব না করিয়া সেই ভবানীপুরেই চলিলাম। সন্ধান করিয়া উকীল মহাশয়ের গৃহও পাইলাম। আমি যখন উকীল মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা প্রায় দশটা। দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, উকীল মহাশয় এখন স্নান-আহার করিতে গিয়াছেন। কাছারী গমন করিবার সময় প্রায় হইয়া উঠিয়াছে; এখন আর তিনি বাহিরে আসিবেন না, একেবারে কাছারী গমনোপযোগী পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া বাহিরে আসিবেন। দ্বারবানকে আর কিছু না বলিয়া, উকীল মহাশয়ের প্রত্যাশায় সেইস্থানেই দাঁড়াইয়া রহিলাম। দ্বারবান দ্বারের পার্শ্বে নিজে একখানি ছোট টুলের উপর বসিয়া রহিল। সেইস্থানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বেলা এগারটা বাজিয়া গেল। এগারটার পর সামলাধারী উকীল মহাশয় বাড়ীর ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া যেমন তাঁহার গাড়ীতে উঠিতে যাইবেন, অমনি আমি তাঁহার নিকট গমন করিয়া আমার যাহা কিছু বক্তব্য ছিল, তাহা তাঁহাকে বলিলাম। প্রায় দশ মিনিটকাল পর্যন্ত তিনি আমার সমস্ত কথা শ্রবণ করিলেন; কিন্তু যখন বুঝিতে পারিলেন যে, আমার কার্য্যে তাঁহার কোন লাভ নাই—বিনা ‘ফি’তে আমার কথার উত্তর প্রদান করিতে হইতেছে, তখন কহিলেন, “মহাশয়! এখন আমার কাছারীর সময়, আমি আর বিলম্ব করিতে পারিতেছি না। আপনি সময়-মত আফিসে যাইবেন; সেইস্থানেই আপনার কথার উত্তর দেওয়া যাইবে।” এই বলিয়া তিনি কোচমানকে গাড়ি হাঁকাইতে কহিলেন। সে ঘোড়ার পৃষ্ঠে এক চাবুক লাগাইল, ঘোড়া ঊর্দ্ধশ্বাসে আফিসমুখে ছুটিল। 

উকীল মহাশয়ের কথা শুনিয়া মনে বড়ই কষ্ট হইল। একঘণ্টাকাল তাঁহার দ্বারে দাঁড়াইয়া উমেদারীর পর যদিও তাঁহার দেখা পাইলাম, কিন্তু যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি তাঁহার নিকট গিয়াছিলাম, তাহার কিছুই হইল না। আমি আপনার কার্য্যে গমন করিয়াছি; সুতরাং তাঁহাকে অধিক কিছু বলিতে সমর্থ হইলাম না। অগত্যা আফিসে গিয়াই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সম্মত হইলাম। 

বেলা বারটার সময় তাঁহার আফিসে গিয়া আমি উপস্থিত হইলাম। উকীলবাবু আমাকে দেখিয়াই চিনিলেন। বৈশাখ মাসের রৌদ্রে আমাকে ক্লান্ত দেখিয়া, এবার তাঁহার বোধ হয়, একটু দয়া হইল। তিনি আপন মুহুরী বিজয়কে ডাকিলেন। বিজয় আগমন করিলে নগেন্দ্রনাথের ঠিকানা আমাকে বলিয়া দিতে কহিলেন। বিজয় নগেন্দ্রের ঠিকানা জানিতেন। আমার নিকট হইতে কিছু পাইবার প্রত্যাশায় তিনি তখনই তাঁহার ঠিকানা আমাকে দিলেন। কিন্তু যখন জানিতে পারিলেন, আমি কিসের নিমিত্ত তাঁহার অনুসন্ধান করিতেছি, তখন আমার নিকট হইতে পুরস্কার চাওয়া দূরে থাকুক, আস্তে আস্তে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। ভয়—পাচ্ছে আমি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া নগেন্দ্রনাথের বাসায় লইয়া যাই। 

চিৎপুরে নগেন্দ্রের বাসা ছিল। চিৎপুরে গমন করিয়া নগেন্দ্রকে পাইলাম। তাঁহাকে কিন্তু হত্যা-সম্বন্ধে কোন কথা বলিলাম না। তাঁহাকে বলিলাম, “মহাশয়! গত কলা হাইকোর্টে আপনার যে মোকদ্দমার নিষ্পত্তি হইয়া গিয়াছে, ও যাহাতে আপনি পরাজিত হইয়াছেন, এখন দেখা যাইতেছে যে, সেই মোকদ্দমার আপনার জয়লাভ করিবার এক প্রধান উপায় বাহির হইয়াছে। কি উপায়, তাহা আমি অবগত নহি; আপনার উকীল মহাশয়ই তাহা জানেন। তিনিই আপনাকে তাঁহার নিকট লইয়া যাইবার নিমিত্ত আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন ও বলিয়া দিয়াছেন, এখনই আমার সহিত আপনাকে সেইস্থানে যাইতে হইবে। যে পর্য্যন্ত আপনি গমন না করিবেন, সেই পর্য্যন্ত তিনি আপনার প্রত্যাশায় বাসায় থাকিবেন। আমি কখনও আপনার নিকট আসি নাই, বিজয়ই সর্ব্বদা আপনার নিকট আগমন করিত। কিন্তু অদ্য বিজয়ের অসুখ হওয়ায় আমাকে অনেক ঘুরিয়া এখানে আসিতে হইয়াছে বলিয়াই, এত অধিক বেলা হইয়া গিয়াছে। আর বিলম্ব না করিয়া আপনি আমার সহিত আগমন করুন।” আমার কথা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথ তখনই আমার সঙ্গে বহির্গত হইলেন। আমি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া ভবানীপুরের উকীল মহাশয়ের বাসার পরিবর্তে যে স্থানে আমার ঊর্দ্ধতন সাহেব-কর্মচারী খুনি মোকদ্দমায় অনুসন্ধানে লিপ্ত ছিলেন, সেইস্থানেই লইয়া গেলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে যে সকল কর্ম্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সকলেই নগেন্দ্রের অপেক্ষায় বসিয়াছিলেন। নগেন্দ্ৰকে পাইয়া সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন। সকলেই তখন আপন আপন ক্ষমতা দেখাইবার নিমিত্ত নগেন্দ্রকে নানাকথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। নগেন্দ্রনাথ এইস্থানে আসিয়া সেই মৃতদেহ স্বচক্ষে অবলোকন করিলেন; এবং জানিতে পারিলেন যে, এই হত্যাকাণ্ড তাঁহার দ্বারাই সম্পন্ন হইয়াছে বলিয়া সকলে তাঁহাকে সন্দেহ করিয়াছেন, ও সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়াই তাঁহাকে আনা হইয়াছে। নগেন্দ্রনাথ ভদ্রলোক জমীদারের পুত্র এবং কলিকাতায় অপরিচিত ও নিঃসহায়; কাজেই তিনি অতিশয় ভীত ও ভাবিত হইলেন। তাঁহার বুদ্ধি লোপ পাইল। তাঁহাকে যে সকল প্রশ্ন করা হইতেছিল, তাহার বিপরীত ও অসংলগ্ন উত্তর দিতে লাগিলেন। কৰ্ম্মচারীগণ তাঁহাকে যত কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, তাঁহাদের মনে ততই সন্দেহ হইতে লাগিল যে, এই হত্যা তাঁহার দ্বারা বা তাঁহার অভিমতে সম্পন্ন হইয়াছে। একজন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি বলিতেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের কিছুই আপনি অবগত নহেন। আচ্ছা, গতরাত্রিতে আপনি কোথায় ছিলেন, তাহার প্রমাণ করিতে পারিবেন কি?” 

উত্তর। হাঁ মহাশয়! প্রমাণ করিতে পারিব বৈ কি! রাত্রিতে আমি আমার বাসায় ছিলাম। 

প্রশ্ন। বাসায় আর কে ছিল? 

উত্তর। আমার চাকর মহেশ ও পাচক উমেশ আমার সহিত বাসায় ছিল। 

প্রশ্ন। যে গৃহে আপনি শয়ন করিয়াছিলেন, সেই গৃহে উহারা দুইজনেই কি শয়ন করিয়াছিল? 

উত্তর। না, যে গৃহে আমি শয়ন করি, সেই গৃহে মহেশ শুইয়াছিল। উমেশ ছিল, নীচের গৃহে। কিন্তু উভয়েই বলিতে পারিবে যে, আমি আমার বাসায় ছিলাম। 

এই কথার পর সকলেই স্থির করিলেন যে, নগেন্দ্রের বাসায় গিয়া এই বিষয়ের প্রথম অনুসন্ধান করা আবশ্যক। তখন নগেন্দ্রনাথকে বাসায় লইয়া যাওয়া হইল। বলা বাহুল্য যে, যে সকল কৰ্ম্মচারী সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, সকলেই সেই সঙ্গে গমন করিলেন। গাড়ির ভিতর সকলের স্থান হইল না; তথাপি কেহ কোচবাক্সে, কেহ সহিসের দাঁড়াইবার স্থানে, কেহ ছাদের উপর বসিয়া, কেহ বা পায়দানের উপর দাঁড়াইয়া, গমন করিতে লাগিলেন। আমি গাড়ির ভিতরেই একটু স্থান পাইয়াছিলাম। গাড়ি চিৎপুরে নগেন্দ্রনাথের বাসার নিকট উপস্থিত হইল। নগেন্দ্রকে গাড়ির ভিতর রাখিয়া উমেশ ও মহেশকে ডাকিয়া আনা হইল। তিনজনকে তিন স্থানে রাখিয়া প্রথমে মহেশকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “আমার মনিব সমস্ত রাত্রি বাসায় উপস্থিত ছিলেন। কোনস্থানে গমন করেন নাই। অদ্য যখন একটি বাবু আসিয়া তাঁহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছেন, সেই সময় তিনি বাহিরে গমন করিয়াছেন। আমি এবিষয় বিশেষরূপে অবগত আছি; কারণ, আমি সমস্ত রাত্রি বাবুর গৃহে উপস্থিত ছিলাম।” কিন্তু উমেশকে জিজ্ঞাসা করায় সে তাহার বিপরীত বলিল। সে বলিল, “গতরাত্রিতে আহারাদি সমাপন হইলে, অতিশয় গ্রীষ্মের জ্বালায় আমি বাড়ীর বাহিরে পথের উপর বসিয়াছিলাম। রাত্রি যখন এগারটা, সেই সময় প্রথমে নগেন্দ্রবাবু বাহির হইয়া যান; উহার প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে মহেশও বাহিরে গমন করে। রাত্রি দুইটা পৰ্য্যন্ত আমি উহাদিগের অপেক্ষায় দ্বার খুলিয়া বসিয়াছিলাম; পরে যখন দেখিলাম, কেহই ফিরিলেন না, তখন দ্বারবন্ধ করিয়া আমি শয়ন করি। রাত্রি আন্দাজ চারিটার সময় মহেশের ডাকা-ডাকিতে আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়, আমি দ্বার খুলিয়া দিই। মহেশ উপরে গিয়া শয়ন করে। বাবু সমস্ত রাত্রির ভিতর প্রত্যাগমন করেন না; অদ্য প্রাতঃকালে সাতটার সময় আগমন করেন।” 

“উমেশের কথা শুনিয়া নগেন্দ্রের উপর সন্দেহ আরও দৃঢ়ীভূত হইল। মহেশও যে তাঁহার সঙ্গে ছিল, একথাও কেহ কেহ মনে করিলেন। উমেশের কথা যখন নগেন্দ্রনাথ শ্রবণ করিলেন, তখন পূর্ব্বে তিনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহারও পরিবর্ত্তন করিলেন; এবং কহিলেন, “পূর্ব্বে যে সকল কথা আমি বলিয়াছি, তাহার সমস্তই মিথ্যা। লোকলজ্জার ভয়ে পড়িয়াই কেবল আমি মিথ্যা কথা বলিয়াছি। উমেশ যাহা বলিয়াছে, তাহার অণুমাত্রও মিথ্যা নহে। গতরাত্রিতে আহারাদির পর আমি বাহির হইয়া গিয়াছিলাম, একথা প্রকৃতই। রাত্রিতে আমি সোনাগাছির বেশ্যা ‘হরির’ গৃহে ছিলাম; অদ্য প্রাতঃকালে সেইস্থান হইতে উঠিয়া এখানে আগমন করিয়াছি। ‘হরি’ সামান্য বেশ্যামাত্র; ভয়ে পাছে তাহার গৃহে আমার থাকার কথা অস্বীকার করে, এই নিমিত্ত আমি সেই কথা পূৰ্ব্বে গোপন করিয়াছিলাম। বিশেষ আমার চরিত্রের কথা সকলে জানিতে পারিবে বলিয়াও, এই কথা প্রকাশ করিতে সাহস হয় নাই। এখন দেখিতেছি, এই খুনি মোকদ্দমার সন্দেহ ক্রমেই আমার উপর পড়িতেছে; সুতরাং এখন লোকলজ্জা পরিত্যাগ করিয়া প্রকৃতকথা বলাই শ্রেয়ঃ।” 

মহেশকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করায় মহেশ কহিল, “আমি যাহা বলিয়াছি, তাহাই সত্য। আমি ও বাবু উভয়ে সমস্ত রাত্রি বাসায় উপস্থিত ছিলাম। উমেশ মিথ্যা কথা বলিতেছে, বাবুও দেখিতেছি, ভীত হইয়া কি বলিতেছেন।” 

পাঠক! এখন একবার ভাবুন দেখি, আমরা কিরূপ সমস্যায় পড়িয়াছি। কাহাকে বিশ্বাস করিব? উমেশ যাহা বলিল, তাহা বিশ্বাস করিব? না মহেশের কথার উপর নির্ভর করিয়া নগেন্দ্রনাথকে ছাড়িয়া দিব? আর নগেন্দ্রনাথের দুই প্রকারের কথার কোন প্রকার কথাই বা বিশ্বাসযোগ্য? আপনাদিগের মধ্যে যিনি সর্ব্বদাই পুলিসের অনুসন্ধানে দোষারোপ করিয়া থাকেন, তখন তিনি বলুন দেখি, কাহার কথা বিশ্বাস করি? 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

নগেন্দ্রনাথকে সঙ্গে লইয়া সোণাগাছিতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দুর্গাচরণ মিত্রের ষ্ট্রীটের একটি বাড়ী নগেন্দ্রনাথ দেখাইয়া দিলেন, আমরা সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। আমাদিগকে দেখিয়া একটি স্ত্রীলোক সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল, কহিল, “তোমরা কি চাও? কাহার অনুসন্ধানে একেবারে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে?” 

এই স্ত্রীলোকটি কে তাহার পরিচয় এইস্থানে একটু দেওয়া বোধ হয় আবশ্যক। এই বাড়ীর ইনি অধিকারিণী। লোকে ইঁহাকেই ‘বাড়িওয়ালী’ কহিয়া থাকে, ইঁহার নাম ‘ক্ষেমা বাড়িওয়ালী’। ক্ষেমার বয়ঃক্রম পঞ্চান্ন বৎসরের ন্যূন নহে, বর্ণ গৌর, কলেবর স্থূল। যেরূপ স্থূল হইলে উঠিতে কষ্ট হয়, বসিতে কষ্ট হয়, চলিতে কষ্ট হয়, সেইরূপ স্থূল। কেশ আলুলায়িত, কিন্তু শ্বেত-কৃষ্ণ-মিশ্রিত। কতকগুলি কেশ শ্বেত এবং কতকগুলি কেশ কৃষ্ণ, তাহা নহে। প্রত্যেক কেশই শ্বেত এবং কৃষ্ণ-মিশ্রিত, অর্থাৎ চুলে কলপ দেওয়া; কিন্তু কলপ ভালরূপ ধরে নাই, কাজেই শ্বেত-কৃষ্ণ-মিশ্রিত। ইহার পরিধানে একখানি চওড়া কালাপেড়ে সিমলার পরিষ্কার মিহি সূতী শাড়ী। হস্তে সুবর্ণ-বলয় এবং অনন্ত, গলায় সোণার হেলেহার, কোমরে সোণার গোট, নাসিকায় শ্বেত চন্দনের রসকলি, পায়ে আলতা, দক্ষিণ হস্তে একটি হরি নামের ঝুলি। ইনি আমাদিগকে দেখিয়া প্রথমেই কহিলেন, “ তোমরা কাহার অনুসন্ধানে এখানে আসিয়াছ?” 

আমাদিগের মধ্যে একজন কহিলেন, “আমরা হরিকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি।”

বাড়িওয়ালী। হরি! হরি আবার কে? আমার বাড়ীতে হরি নামে কেহই নাই। 

“সে কী? হরিনাম্নী তোমার কোন ভাড়াটিয়া নাই?” 

বাড়িওয়ালী। না, হরি-টরি আমার বাড়ীতে কেহ থাকে না। কেন গা, তোমাদের কি দরকার?

হরি কি করেছে? “হরি যাহাই করুক না কেন, তোমার বাড়ীতে হরি বলিয়া যখন কোন মেয়ে মানুষ থাকে না, তখন তোমার শুনিয়া আবশ্যক কি? আচ্ছা, দেখ দেখি, এই বাবুটি কখনও তোমাদের বাড়ী আসিয়াছিলেন কি না?” 

বাড়িওয়ালী। না বাপু, একে আমরা কখনও দেখিনি। আমাদের বাড়ীতে চোর-টোর কেহ জায়গা পায় না।

বাড়িওয়ালীর সহিত যখন আমাদিগের এইরূপ কথাবার্তা হয়, সেই সময় বাড়ীর ভাড়াটিয়া স্ত্রীলোকগণ প্রায় সকলেই বাহির হইয়া, বাড়িওয়ালীর পশ্চাতে আসিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছিল। উহাদিগের মধ্যে একটি স্ত্রীলোককে দেখাইয়া দিয়া নগেন্দ্ৰনাথ কহিলেন, “এই স্ত্রীলোকটির নাম ‘হরি’। ইহারই গৃহে আমি রাত্রিতে ছিলাম।” 

হরি। ডেক্রা বলে কি! বেটা চোর! তোর একটু লজ্জা নেই যে, তুই মিছামিছি আমার নাম করছিস্? না মহাশয়! এ বেটাকে আমি কখনও দেখি নাই, এ আমার গৃহে কখনও আসে নাই।” 

“তবে বাড়িওয়ালী, তুমি এতক্ষণ কেমন করিয়া বলিতেছিলে যে, তোমার বাড়ীতে হরিনাম্নী কোন স্ত্রীলোক নাই?” 

বাড়িওয়ালী। উহার নাম কি হরি যে, আমি উহাকে দেখাইয়া দিব? উহার নাম হরিমতী। যদি হরিমতীর কথা জিজ্ঞাসা করিতে, তাহা হইলে আমি উহাকে দেখাইয়া দিতাম। 

হরি ও ক্ষেমার এই প্রকার কথা শুনিয়া, উহাদিগের সহিত তর্ক-বিতর্ক করা অনাবশ্যক ভাবিয়া, সেইস্থান হইতে তখন আমরা চলিয়া আসিলাম। যে যেরূপ বুঝিল, সে সেইরূপ নগেন্দ্রনাথ ও তাঁহার চাকরের বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে লাগিল। আমার উপরও আদেশ হইল, “তুমিও দেখ; যেরূপ অনুসন্ধান ভাল বিবেচনা কর, সেইরূপই কর; মোটকথা এই মোকদ্দমার কিনারা হওয়া আবশ্যক।” বলা বাহুল্য যে, নগেন্দ্রনাথ ও তাঁহার চাকর মহেশ কয়েদী অবস্থায় রহিলেন। বেলা চারিটার সময় স্নান-আহার করিবার নিমিত্ত আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

বাসায় আসিয়া আহারাদি করিতে প্রায় ছটা বাজিয়া গেল। সে সময় আর বাহির হইলাম না, বাসা হইতে একেবারে রাত্রি আটটার সময় বাহির হইলাম। অন্য কোনস্থানে গমন না করিয়া একেবারে সেই “ক্ষেমা বাড়িওয়ালীর” বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। আমাকে দেখিয়া পুলিসকর্ম্মচারী বলিয়া কেহই বুঝিতে পারিল না; কারণ, এবার আমার বেশ পূর্ব্বের মত ছিল না। সুতরাং কেহ আমাকে চিনিতে পারিল না। 

হরি যে গৃহে থাকে, আমি তাহার পার্শ্বের গৃহে গিয়া উপবেশন করিলাম। সেই গৃহের সম্মুখের বারান্দায় ক্ষেমা বসিয়াছিল, আর তাহার নিকট বাড়ীর প্রায় অধিকাংশ ভাড়াটিয়া বসিয়া, দিবসের পুলিস-হাঙ্গামার বিষয় সমালোচনা করিতেছিল। আমি পূর্ব্বকথিত গৃহে উপবেশন করিলে, সেই গৃহের অধিকারিণী আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং আমি যেন তাহার পূর্ব্ব-পরিচিত এইরূপ ভাব দেখাইয়া, এক ছিলুম তামাকু সাজিয়া একটি রৌপ্য-নির্ম্মিত ফসি আমার হস্তে প্রদান করিল। আমি ধূমপান করি না, কিন্তু কি করি—চাকরীর দায়ে বসিয়া বসিয়া আস্তে আস্তে সেই তামাক টানিতে লাগিলাম। সুন্দরী সেইস্থানে বসিয়া পান সাজিতে লাগিল। 

যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সে কার্য্য আমার সহজেই সম্পন্ন হইল। যখন আমি সেই গৃহে গিয়া উপবেশন করি, সেই সময় বাড়িওয়ালীর মজলিসে যে সকল গল্প চলিতেছিল, তাহাতে আমার মনকে আকৃষ্ট করিল। আমি শুনিলাম, একজন বলিল—“বাবুটী ভাগ্যিস্ প্রাতঃকালে চলিয়া গিয়াছিল! নতুবা পুলিস আসিয়া তাহাকে যদি এখানেই পাইত, নিশ্চয়ই আমাদিগকে লইয়া টানাটানি করিত।’ অপর একটি স্ত্রীলোক কহিল, ‘তা’ ভাই, যখন সমস্ত রাত্রি সে এখানে ছিল, তখন প্রকৃত কথা বলিলেই হইত।’ আর একটি স্ত্রীলোক কহিল, “তুমি ত ভাই বড় মজার মানুষ দেখছি? আমি সেই কথা বলি, আর উহার মতন আমারও হাতে দড়ি পড়ুক।” 

এই কথার পর ক্রমে কথার স্রোত ফিরিল, আমারও কার্য্যোদ্ধার হইল। সেইস্থানে আমার আর অধিকক্ষণ বসিবার প্রয়োজন নাই ভাবিয়া, যাহার গৃহে আমি উপবেশন করিয়াছিলাম, তাহাকে পান তামাকের দাম বলিয়া একটি টাকা প্রদানপূর্ব্বক সেইস্থান হইতে উঠিয়া প্রস্থান করিলাম। 

যেস্থানে মুণ্ডহীন মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেইস্থানে যখন আমি পুনরায় গমন করিলাম, তখন রাত্রি এগারটার ন্যূন নহে। গিয়া দেখি, নগেন্দ্র ও মহেশের কষ্টের লাঘব তখনও পর্যন্ত হয় নাই। নগেন্দ্র শেষে যে কথা বলিয়াছিলেন, এখন পর্যন্তও তাহাই বলিতেছেন; কিন্তু মহেশ এখন বলিতেছে যে, সে বাড়ীতে ছিল না; আহারাদির পর তাহার মনিব বাহির হইয়া গেলে সে বাহিরে গমন করিয়াছিল, এবং সে রাত্রিটা একটি স্ত্রীলোকের গৃহেই অতিবাহিত করিয়াছিল; কিন্তু লজ্জায় পড়িয়া উহা পূর্ব্বে স্বীকার করিতে পারে নাই। 

নগেন্দ্র ও মহেশের কথা কেহ বিশ্বাস করে নাই; তাহাদিগের দ্বারাই যে এই ভয়ানক কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, এই বিশ্বাসই কাহারও কাহারও মনে স্থান পাইয়াছে। উহাদিগকে প্রকৃতকথা বলাইবার নিমিত্ত অর্থাৎ এই খুন যে তাহাদের দ্বারা হইয়াছে, এই কথা স্বীকার করাইবার নিমিত্ত অনেকেই বিশেষরূপে চেষ্টা করিতেছেন। কেহ বা তাহাদিগকে বিশেষরূপে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছেন যে, সমস্ত অবস্থা স্বীকার করিলেই তাহাদের মঙ্গল; নতুবা সমূহ বিপদ। ‘এক্রার’ করিলেই যে নিষ্কৃতি পাইবে, তাহা বুঝাইবার নিমিত্ত কেহ বা কত উদাহরণ প্রদান করিতেছেন, কত কত খুনি মোকদ্দমায় ‘একারী’ আসামীকে যে তিনি বাঁচাইয়া দিয়াছেন, এক এক করিয়া তাহার উল্লেখ করিতেছেন। কেহ বা অনেক মিথ্যা গল্প সাজাইয়া, সেই সকল গল্প উদাহরণ-স্থলে আনিয়া, সত্য বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন। কেহ বা তাঁহাকে সমর্থন করিয়া তিনি যে কখনও মিথ্যা কথা কহেন না,—‘এক্বারী’ আসামীকে কোন না কোন উপায়ে বাঁচাইয়া দেন, তাহাই বুঝাইতে চেষ্টা করিতেছেন। কেহ বা দুই একটি মিষ্টকথা বলিতেও ত্রুটি করিতেছেন না; আর কেহ বা মিষ্টি জলযোগের সংগ্রহ করিয়া দিতেছেন। এইরূপ যাঁহার মনে যে ভাবের উদয় হইতেছে, তিনি তাহাই বলিতেছেন, তাহাই করিতেছেন। 

আমি যখন সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন উক্তরূপ অনুসন্ধান চলিতেছিল। আমার সেই ঊর্দ্ধতন—কৰ্ম্মচারী নিকটেই ছিলেন। তাঁহার নিকট গমন করিয়া সোণাগাছিতে যে সকল কথা শুনিয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্ব্বিক সমস্ত বলিলাম। দেখিলাম, আমার কথা শুনিয়া তিনিও আমার মতে মত দিলেন; নগেন্দ্র ও তাঁহার চাকর যে নির্দোষ, এই বিশ্বাস তাঁহারও মনে উদয় হইল। কিন্তু সে দিবসের নিমিত্ত উহাদিগকে একেবারে ছাড়িয়া দিতে পারিলেন না; অথচ থানাতেও লইয়া গেলেন না। সেইস্থানেই তাঁহারা রাত্রিযাপন করিবার অনুমতি পাইলেন। 

সেই সময় সেই ঊর্দ্ধতন সাহেব-কর্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া, রামচন্দ্র ঘোষের বাড়ীতে তাহার স্ত্রীর নিকট একটি টেলিগ্রাম পাঠাইলাম। তাহার মর্ম্ম এই;– “এইস্থানে তোমার স্বামী হত হইয়াছেন, তুমি সংবাদ পাইবামাত্র এখানে আগমন করিবে। এখানে আসিলেই সমস্ত বিষয় বিশেষরূপে অবগত হইতে পারিবে।” আমি যে মৰ্ম্মে টেলিগ্রাম পাঠাইলাম, সেই মর্ম্মে আর একখানি টেলিগ্রাম রামচন্দ্রের মনিব গিরীন্দ্রনাথও করিলেন, ও তাহাকে এখানে আসিবার নিমিত্ত বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন। টেলিগ্রাম সেই রাত্রিতেই পাঠান গেল। আমাদিগের অনুসন্ধানও সেই রাত্রির মত শেষ হইল। আমরা কিন্তু কেহই সেইস্থান পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না, সেইস্থানেই বসিয়া বসিয়া ঢুলিতে ঢুলিতে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

রাত্রি প্রভাত হইল। পুনরায় অনুসন্ধান আরম্ভ হইল, পুনরায় সকলে আপন আপন ইচ্ছানুযায়ী অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। নগেন্দ্রনাথ ও তাঁহার ভৃত্যের উপর যাঁহার যাঁহার সন্দেহ ছিল, তাঁহারা সেই পথ অবলম্বনেই চলিতে লাগিলেন। যাঁহার সন্দেহ গিরীন্দ্রনাথের উপর, তাঁহার দৃষ্টি সেইদিকেই পড়িল। এইরূপে যিনি যাহা বুঝিতে লাগিলেন, তিনি সেই পথই অবলম্বন করিলেন। আমি কোন পথই অবলম্বনে সমর্থ হইলাম না, পূর্বোল্লিখিত ব্যক্তিগণের মধ্যে কাহারও উপর আমার সন্দেহ না হওয়াতে, আমি বসিয়া বসিয়া অন্যান্য সকলের অনুসন্ধান-কার্য্য দেখিতে লাগিলাম, ও কি করিব, তাহাই কেবল চিন্তা করিতে লাগিলাম। এইরূপে সাতদিবস গত হইয়া গেল, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের কোন নিগূঢ় তত্ত্ব বাহির হইল না। 

রামচন্দ্র ঘোষের স্ত্রী, টেলিগ্রাম পাইবার চারি পাঁচ দিবসের মধ্যে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইবে, এই আশা সকলেরই মনে ছিল। কিন্তু ক্রমে যখন সাতদিবস গত হইয়া গেল, অথচ তাহার এখানে আসা দূরে থাকুক, কোন সংবাদ পৰ্য্যন্তও পাওয়া গেল না, তখন আমার মনে নানাপ্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রথমে ভাবিলাম, সে টেলিগ্রাম পায় নাই। কিন্তু সে সন্দেহ অধিকক্ষণ থাকিল না। সেইস্থানের টেলিগ্রাম আফিসে ‘প্রিপেড টেলিগ্রাম’ করিয়া জানিতে পারিলাম যে, নিয়মিত সময়ের মধ্যে সেই টেলিগ্রাম রামচন্দ্রের স্ত্রীর হস্তে অর্পিত হইয়াছে। 

রামচন্দ্র হিন্দু, তাহার একমাত্র স্ত্রী ভিন্ন আর কেহই নাই। সেই হিন্দুরমণী তাহার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পাইয়া কি প্রকারে বসিয়া থাকিল? যে দেশে হিন্দুরমণীর একমাত্র স্বামী ভিন্ন আর গতি নাই, যে দেশে এখন পর্যন্তও হিন্দুরমণী অনন্যমনে বৈধব্য-যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারেন, যে দেশে এখনও হিন্দুরমণী স্বামী-পদ-পূজা ভিন্ন অন্য পূজা অবগত নহেন, যাঁহারা এখনও স্বামীসেবায় আপন দেহ ক্ষয়, আপন শরীর পাতন করিতেও ক্ষণমাত্রের নিমিত্ত কুণ্ঠিত নহেন, যে দেশের হিন্দুরমণী হাসিতে হাসিতে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের ভিতর প্রবেশ করিয়া মৃতস্বামীর সহ সহ-গমন করিয়া থাকেন, সেই হিন্দুর দেশের হিন্দুরমণী, স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পাইয়া কি কখন চুপ করিয়া থাকিতে পারেন? ইহ ত সম্ভবপর নহে! কুলটা স্ত্রী ভিন্ন সেকার্য আর কাহারও সম্ভবে না। তবে কি রামচন্দ্র কুলটা স্ত্রীর সংসর্গে এতদিবস অতিবাহিত করিয়াছে? না, তাহা ত নহে! গিরীন্দ্রনাথই যে সে বিষয়ের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছেন! গিরীন্দ্রনাথ বলিতেছেন, “রামচন্দ্রের স্ত্রীর কোন দোষ নাই। সে প্রকৃত হিন্দুরমণী, হিন্দুরমণীর যে যে গুণ থাকা আবশ্যক, তাহার সমস্তই তাহাতে আছে।” তবে স্বামীর মৃত্যুসংবাদে সে কেন আসিল না? ভিন্ন দেশে স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে, সেইস্থানে গমন করিলে আর মৃতস্বামী জীবিত হইবেন না, তবে কি করিতে আসিবেন—এই ভাবিয়াই কি তবে আসে নাই? তাহাও সম্ভবে না। গিরীন্দ্রনাথ সেই দেশের বড়লোক—জমীদার, তাঁহার দ্বারাই উহারা প্রতিপালিত। যিনি যখন উহাকে এখানে আসিবার জন্য বিশেষরূপে অনুরোধ করিয়াছেন, তখন সে আসিল না কেন? সে বিশেষরূপে অবগত আছে যে, গিরীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হইলে তাহাকে অনশনে মরিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় উহার এখানে না আসার কারণ বুঝিয়া উঠা নিতান্ত সহজ নহে। 

এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া, পরিশেষে সেইস্থানে যাওয়াই স্থির করিলাম। এই হত্যাকাণ্ড-সম্বন্ধে আমার মনে এক অভিনব ভাবের উদয় হইয়াছিল। আমি আমার সেই মনের ভাব আমার সেই ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারীর নিকট বলিলাম। তিনিও আমার কথার অনুমোদন করিলেন, এবং রামচন্দ্র ঘোষের দেশে যাইবার নিমিত্ত অনুমতি প্রদান করিয়া কহিলেন, “তুমি অদ্যই ময়মনসিংহ যাইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হও। কারণ, এখন সেইস্থানে যত শীঘ্র যাইতে পার, ততই ভাল।” কিন্তু সে দিবস আর হইল না, পরদিবস সন্ধ্যার সময় একটিমাত্র লোক সমভিব্যাহারে শিয়ালদহ-ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। গোয়ালন্দ-মেলে আরোহণ পূর্ব্বক কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম। পরদিবস অতি প্রত্যূষে দেখিলাম, আমি গোয়ালন্দে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। বাল্যকাল হইতে যে পদ্মানদীর কথা শুনিয়া আসিতেছি, দেখিলাম, সেই নদীর তীরে আমাদিগকে অবতরণ করিতে হইল। শুনিলাম, উহাই গোয়ালন্দ-ঘাট—ষ্টেশন। কিন্তু দেখিলাম, কেমন বালুকারাশি-সমাচ্ছন্ন উচ্চ-নীচ জমির ভিতর আমাদিগের গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে, আর নিকটে উত্তাল-তরঙ্গমালা-সমাচ্ছন্ন বহুদূরব্যাপী সেই পদ্মা আপন অহঙ্কারে মাতিয়া, বৃহৎ বৃহৎ তরণী ও ষ্টীমারগণকে অবহেলাক্রমে একপার্শ্বে রাখিয়া, নাচিতে নাচিতে সাগরাভিমুখে গমন করিতেছে। নিকটে কয়েকখানি ষ্টীমার সুসজ্জিত, মধ্যে মধ্যে এক একবার চীৎকার করিয়া আরোহীগণকে যেন সতর্ক করিয়া দিতেছে। আমরা আস্তে আস্তে গমন করিয়া বিস্তারিত-কাষ্ঠ-সজ্জিত অস্থায়ী পথ দিয়া গমন পূর্ব্বক, তাহার একখানিতে আরোহণ করিলাম। আরও অনেক লোক উঠিল, অনেক মালপত্র বোঝাই হইল, সরকারী ‘ডাকও’– দেখিলাম, তাহাতে আসিল! ক্রমে প্রাতঃ সাতটা বাজিয়া গেল। তখন সেই ষ্টীমার একবার উচ্চরবে সকলের নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক ঢাকা-অভিমুখে ছুটিল; পদ্মার সেই বেগবান্ স্রোত বিদীর্ণ করিয়া মধ্যে মধ্যে ভয়ানক আবৰ্ত্ত বামে ও দক্ষিণে ফেলিয়া, হেলিতে দুলিতে চলিতে লাগিল। সন্ধ্যার সময় ঢাকায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, ইহার পূর্ব্বে ঢাকা সহর আর কখনও দেখি নাই। ষ্টীমারে গমন-কালীন ঢাকা-নিবাসী একটি বন্ধুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। কলিকাতার ঢাকাপটিতে ইঁহার ঢাকাই কাপড়ের দোকান আছে। সবিশেষ যত্নের সহিত তিনি আমাকে তাঁহার বাসায় লইয়া গেলেন। তাঁহার যত্নে আমি বিশেষ উপকৃত হইলাম। ঢাকায় আমার পরিচিত কেহই ছিল না; সুতরাং তাঁহার সহিত দেখা না হইলে বোধ হয়, আমাকে বিশেষ কষ্টই পাইতে হইত। বন্ধুর বাসায় গমন করিলে তিনি চাকরদিগকে জলযোগের সংগ্রহ করিতে কহিলেন, এবং ব্রাহ্মণকে ডাকাইয়া আহারের উত্তমরূপ বন্দোবস্তের নিমিত্ত আদেশ প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, সমস্ত দিবসের পর জলযোগ উত্তমরূপেই হইল। ঢাকাই ‘পাতখিরা’ প্রভৃতি সেইস্থানের ভাল ভাল দ্রব্যেরই আয়োজন হইয়াছিল; সুতরাং বুঝিয়াই লউন, জলযোগের ব্যাপারটা! নিয়মিত সময়ে অন্নব্যঞ্জন প্রস্তুত হইলে, বাবুর সহিত একস্থানে আহার করিতে বসিলাম। কিন্তু আপনারা আমাকে বিশ্বনিন্দুক বলিতে চাহেন—বলুন, তথাপি আমি যথার্থ কথা বলিব। বিশেষ উপকার পাইলাম বলিয়াই যে প্রকৃতকথা বলিতে সাহসী হইব না, তাহা নহে। আহারের আয়োজন দেখিয়া আমার মনে অতীব আনন্দ হইয়াছিল; কিন্তু কিঞ্চিৎ আহারীয় দ্রব্য মুখে প্রদান করিতে করিতেই আনন্দের পরিবর্তে চক্ষু দিয়া জলধারা বাহির হইল। মস্তক ঘুরিতে লাগিল, মুখ দিয়া লাল ঝরিতে আরম্ভ করিল। আমার আর আহার করা হইল না, তখনই উঠিয়া পড়িলাম। বাবুটি আমার অবস্থা দেখিয়া বিশেষ লজ্জিত হইলেন, এবং ব্রাহ্মণকে গালি দিয়া বলিতে লাগিলেন, “মূর্খ! আমরা যে পরিমাণে ঝাল খাইয়া থাকি, কলিকাতার লোকেও কি সেইরূপ ঝাল ব্যবহার করেন যে, তুমি উহার খাদ্যেও সেইরূপ ঝাল প্রদান করিয়াছ?” আহারের ব্যবস্থা সেদিন সেই পর্যন্তই রহিল। পরদিবস প্রত্যূষেই পুনরায় আহারের সংগ্রহ হইতে লাগিল। আমি সহর পরিদর্শনে বহির্গত হইলাম। বাজার, নবাব-বাড়ী প্রভৃতি ঢাকার দর্শনোপযোগী সমস্ত স্থান দর্শনপূর্ব্বক বন্ধুর বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। সময়ে আহারের কার্য সম্পন্ন করিলাম। অদ্য আর সেরূপ ঝালের ব্যবস্থা ছিল না, কাজেই উত্তমরূপে আহার করিয়া ঢাকার ষ্টেশনে গমন করিলাম। সেইস্থান হইতে টিকিট লইয়া, রেলগাড়িতে ময়মনসিংহ যাত্রা করিলাম। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

যে দিবস আমি ঢাকা হইতে বহির্গত হইলাম, সেই রাত্রিতেই ময়মনসিংহ পৌঁছিলাম। ময়মনসিংহ একটি ছোট সহর। ব্রহ্মপুত্র নদীর একটি শাখা উহার নীচে দিয়া প্রবাহিত। বাজারের ভিতর তঅথচ সেই নদী-সন্নিকটে, একটি ব্রাহ্মণের হোটেল ছিল, রাত্রিতে সেইস্থানেই অবস্থান করিলাম। পরদিবস প্রাতঃকালে উঠিয়া সেই ব্রহ্মপুত্র-শাখা পার হইয়া, রামচন্দ্রের গ্রামাভিমুখে চলিলাম। সন্ধ্যার সময় সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যাইবার সময় আমি নগেন্দ্রনাথের নিকট হইতে তাঁহার নায়েবের উপর একখানি পত্ৰ লইয়া গিয়াছিলাম। উহাতে আমার পরিচয় ছিল না, আমি নগেন্দ্রনাথের একজন বন্ধু—এইমাত্র উল্লেখ ছিল; আরও এই কথা লেখা ছিল যে, যতদিবস ইচ্ছা, ততদিবস আমি সেইস্থানে থাকিব। নায়েব মহাশয় আমার তত্ত্বাবধান করিবেন, এবং যখন যে বিষয়ের সাহায্য প্রার্থনা করিব, লোকজন বা অর্থদ্বারা তখনই তিনি তাহা পূরণ করিবেন। 

পত্রহস্তে নায়েব মহাশয়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই সময় কিন্তু তাঁহার বাসায় আরও অনেকলোক থাকিলেও, তাঁহাকে চিনিয়া লইতে আমার কোন কষ্টই হইল না। তাঁহার প্রকাণ্ড ভুঁড়ি, ফরসির পেঁচাও নল, এবং পরিষ্কার তাকিয়াই তাঁহাকে চিনাইয়া দিল। সেই পত্র আমি তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি উহা পাঠ করিয়া বিশেষ যত্নের সহিত আমায় অভ্যর্থনা করিলেন। কাছারী গৃহেই আমার থাকিবার স্থান স্থির হইল। আমি সেইস্থানেই অবস্থান করিতে লাগিলাম। বিনাকাৰ্য্যে ক্রমে দুই তিনদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। 

কাছারী হইতে রামচন্দ্রের বাড়ী অর্দ্ধমাইলের অধিক নহে, একদিন সন্ধ্যার সময় তাঁহার বাড়ীতে গমন করিলাম। দেখিলাম, রামচন্দ্রের স্ত্রী গৃহকার্য্যে ব্যস্ত; কিন্তু তাহার শোক বা কষ্টের কোন লক্ষণই বুঝিতে পাইলাম না। বিশেষ আমাকে দেখিয়া, আমি কে, কি নিমিত্ত কোথা হইতে গিয়াছি প্রভৃতি অনেক কথা আমায় জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে আমি কেবল এইমাত্র কহিলাম, “শুনিয়াছিলাম, রামচন্দ্র কলিকাতায় গমন করিয়াছে; কিন্তু ফিরিয়া আসিয়াছেন কি না, তাহা জানি না, এই নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি। যদি ফিরিয়া আসিয়া থাকেন, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা।” উত্তরের রামচন্দ্রের স্ত্রী “আমি কিছু জানি না” এই বলিয়া প্রস্থান করিল। আমার মনে যে সন্দেহ উপস্থিত হওয়ায়, এতদূর আগমন করিয়াছি, এতক্ষণে রামচন্দ্রের স্ত্রীর ভাব দেখিয়া আমার সেই সন্দেহ আরও দৃঢ়ীভূত হইল। আমি তখন আর কোন কথা না বলিয়া, সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিলাম। 

বাসায় আসিয়া ভাবিলাম,—আমি এখানে যে কার্য্যের নিমিত্ত আসিয়াছি, সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত নায়েব মহাশয়ের সাহায্য গ্রহণ করা উচিত কি না? সবিশেষ বিবেচনার পর স্থির করিলাম,—নায়েব মহাশয়ের নিকট গোপন করা অপেক্ষা সমস্ত অবস্থা বলিয়া, তাঁহার সাহায্য গ্রহণপূর্ব্বক কার্য্য করাই যুক্তিসঙ্গত। 

সেইদিবস সন্ধ্যার সময় আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা তাঁহাকে বলিলাম। তাঁহার মনিব যেরূপ বিপদ্‌গ্রস্ত, তাহাও বলিলাম। আরও বলিলাম—আমি কে, আমার অভিপ্রায় কি, এবং তাঁহার নিকট কি প্রকার সাহায্য পাইবার আশা করি? আমার কথা শুনিয়া তিনি অতিশয় বিস্মিত হইলেন, এবং তাঁহার মনিবের উপকারার্থে আমার সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। 

আমাদের অনুসন্ধানের প্রথম কার্য্য হইল যে, টেলিগ্রাম পিয়নের অনুসন্ধান করা। অনুসন্ধানে তাহাকে পাওয়া গেল। তাহার নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, দুইখান টেলিগ্রামই সে রামচন্দ্রের স্ত্রীর হস্তে প্রদান করিয়াছে, এবং রামচন্দ্রের স্ত্রী তাহাকে দিয়া সেই টেলিগ্রাম পড়াইয়া লইয়া উহার মর্ম্ম অবগত হইয়াছে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পাইয়া কোন প্রকার দুঃখ প্রকাশ করে নাই। 

অনুসন্ধানের দ্বিতীয় কার্য্য—সেইস্থানের ডাকপিয়নকে কিছু জিজ্ঞাসা করা। ডাকপিয়নের বাড়ী সেই কাছারীর নিকট, তাহাকে সহজেই পাওয়া গেল। জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “দশ পনর দিবসের মধ্যে আমি দুইখানি পত্ৰ রামচন্দ্র ঘোষের স্ত্রীকে প্রদান করিয়াছি। শেষ পত্র বোধ হয়, বেনারস হইতে আসিয়াছিল। আর সেই দুই পত্রের উপর লেখা ছিল, ‘মালিক এই পত্র গোপালচন্দ্র বসু ব্যতীত আর কাহারও দ্বারা পড়াইবে না।” 

আমাদিগের অনুসন্ধানের তখন তৃতীয় কাৰ্য্য হইল—গোপালচন্দ্র বসুর নিকট সেই পত্রের বিষয় অবগত হওয়া। প্রথম দুইটি কাৰ্য্য যত সহজে সম্পন্ন হইয়াছিল, এটি যে সেইরূপ সহজে হইবে, তাহা ভাবিলাম না। কারণ, অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, রামচন্দ্র ঘোষ গোপালচন্দ্র বসুর ভাগিনেয়, এবং পরস্পরের মধ্যে অতিশয় প্রণয় গোপালচন্দ্রের বিশেষ অনিষ্ট হইলেও সে অনিষ্টকে অনায়াসে সহ্য করিবে, কিন্তু রামচন্দ্রের বিপক্ষে কোন কথা বলিবে না। এই সকল বিষয় অবগত হইয়া নায়েব মহাশয় এক জমিদারী চাল চালিলেন। গোপালচন্দ্র সেই গ্রামের প্রজা—কিছু জমী-জমাও আছে। উপর্যুপরি দুই বৎসর অজন্মা হওয়ায় একেবারে খাজানা দিয়া উঠিতে পারে নাই—জমীদার সরকারে দুই বৎসরের সমস্ত খাজানাই বাকি পড়িয়াছে। এই খাজানা আদায়ের ভানে নায়েব মহাশয় তাহাকে ডাকাইয়া আনিলেন, ও খাজানার নিমিত্ত বিশিষ্টরূপে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। কিন্তু সে সেই সময় খাজানা দিবে কোথা হইতে? কাজেই সেই কাছারী গৃহে সমস্ত দিবসের নিমিত্ত সে কয়েদে রহিল, খাজানা সংগ্রহ কোনমতে করিতে পারিল না। সন্ধ্যার সময় নায়েব মহাশয় তাহাকে আপনার গৃহে আনাইলেন ও কহিলেন, “দেখ গোপাল! তুমি সমস্তদিন কয়েদী আছ, কিন্তু খাজানা সংগ্রহ কোনমতে করিয়া উঠিতে পারিলে না। আমি গোমস্তার নিকট শুনিলাম যে, তুমি পনর দিবস সময় প্রার্থনা করিতেছ; কিন্তু তুমি যদি আমাকে একটি প্রকৃতকথা বল, তাহা হইলে আমি তোমাকে পনর দিবসের অবসর দিতে পারি, এই সময়ের মধ্যে তুমি টাকা সংগ্রহ করিয়া দিও।” নায়েব মহাশয়ের কথা শুনিয়া গোপালচন্দ্র কহিল, “মহাশয়! আমি কবে আপনার নিকটে মিথ্যা কথা বলিয়াছি যে, এখন মিথ্যা বলিব। আপনি আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, করুন; আমি যাহা জানি, তাহার সমস্তই আপনার নিকট বলিতেছি।” তখন নায়েব মহাশয় ডাকপিয়নের নিকট যাহা অবগত হইয়াছিলেন, তাহা সমস্ত বলিয়া পরিশেষে কহিলেন, “সেই পত্রদ্বয় তুমি পাঠ করিয়াছ, আর যাহারা তোমাকে পড়িতে দেখিয়াছে, তাহারাও আমাকে বলিয়াছে। এখন তোমাকে আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, সেই পত্রদ্বয়ে কি লেখা ছিল, এবং কেই বা সেই পত্র লিখিয়াছিল?” 

নায়েব মহাশয়ের এই কথা শুনিয়া গোপাল ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিল; পরিশেষে অনেক ইতস্ততঃ করিবার পর যাহা কহিল, তাহা শুনিয়া আমার অতিশয় আনন্দ হইল। ভাবিলাম, আমি কি ভবিষ্যদ্বক্তা? মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, সাহেবকে যাহা বলিয়া এতদূর আগমন করিয়াছি, এখন দেখিতেছি, উহাই প্রকৃত পথ। আর অন্যান্য কর্ম্মচারীগণ বিপথ অবলম্বন করিয়া কেবল নিরর্থক ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। 

অনুসন্ধানের তৃতীয় কার্য্য এইরূপে শেষ হইলে, আমরা চতুর্থ কার্য্যে হস্তার্পণ করিলাম। কাছারী হইতে কয়েকজন লোক সংগ্রহ পূর্ব্বক পুনরায় রামচন্দ্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। এবার আর আমি রামচন্দ্রের বন্ধু নহি, বা গুপ্তবেশী অনুসন্ধানকারীও নহি। এবার আমি পুলিসের পোষাক পরিধান পূর্ব্বক, প্রকাশ্যে রামচন্দ্রের বাড়ীতে গমন করিলাম। প্রথমে রামচন্দ্রের স্ত্রীকে সেই পত্রের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, সে একেবারে অস্বীকার করিল। তখন তাহাকে ডাকওয়ালা ও গোপালের কথা বলিয়া অনেক বুঝাইলাম; কিন্তু তাহাতেও সে কহিল, “আমি পত্রের বিষয় কিছুই অবগত নহি।” তখন অনন্যোপায় হইয়া উহার খানা-তল্লাসি, অর্থাৎ গৃহ প্রভৃতি সমস্ত স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। ক্রমে একটি বাক্সের ভিতর সেই পত্র দুইখানি, ও টেলিগ্রাম দুইখানি প্রাপ্ত হইলাম। আমার উদ্দেশ্য সফল হইল। আমি কাছারীতে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক সেই রাত্রিটা মাত্র সেইস্থানে অবস্থান করিলাম। পরদিবস প্রত্যূষে সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক কলিকাতা অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। নায়েব মহাশয় তাঁহার মনিবের বিপদের কথা পূর্ব্বে আমার নিকট শ্রবণ করিয়াছিলেন; সুতরাং তিনিও আমার সহিত আসিলেন। আরও আসিল—গোপাল ও রামচন্দ্রের স্ত্রী। ইহাদিগকে যে কেন আনিলাম, তাহার কারণ বোধ হয় সকলেই বুঝিয়া লইতে পারিবেন; আর যদি না পারেন, তাহা হইলে সময়মত অবগত হইবেন। 

নবম পরিচ্ছেদ 

সময়-মত আমরা সকলে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই দিবসই সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা বলিলাম, ও পত্র দুইখানি তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম। পত্র দুইখানি বাঙ্গালায় লেখা। সাহেব বাঙ্গালা জানেন না, কিন্তু অপরে বাঙ্গালা কথা কহিলে বা বাঙ্গালা পত্রাদি পাঠ করিলে, তিনি তাহা বুঝিতে পারেন। সেই পত্র দুইখানি তিনি আমার হস্তে প্রত্যর্পণ করিয়া কহিলেন, “এই পত্র দুইখানি পাঠ কর।” 

একে একে পত্র দুইখানি পাঠ করিলাম। প্রথম পত্রে এইরূপ লেখা ছিল; 

“বিশিষ্ট কারণবশতঃ হঠাৎ আমি কলিকাতা হইতে চলিয়া আসিয়াছি। আপাততঃ যে কোথায় যাইব, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই। যেস্থানে অবস্থিতি করিব, তাহা পরে জানিতে পারিবে। আমার কলিকাতা হইতে চলিয়া আসার কথা কেহই অবগত নহেন; এমন কি, আমার মনিব মহাশয় পর্য্যন্তও তাহা জানেন না। এরূপ অবস্থায় হঠাৎ যে কেন আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম, তাহা যদি কখন ঈশ্বর বলিতে দেন, তাহা হইলে বলিব। তুমি হয়ত আমার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনিবে; অনেকে হয় ত তোমার নিকট গমন করিয়া আমার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবে। কিন্তু তুমি আমার সম্বন্ধে কোন কথা কাহাকেও বলিও না, ও কিছুতেই ভয় পাইও না, বা কাহারও কথা বিশ্বাস করিও না। আমার এই পত্রাদি গোপাল মামা ভিন্ন আর কাহাকেও দেখাইও না, এবং কাহাকেও বলিও না। আমি তোমাকে যে সকল পত্রাদি লিখিব, তাহা রাখিও না; পাঠ করিয়াই নষ্ট করিয়া ফেলিও। আমি তোমাকে যে সকল কথা লিখিলাম, কিছুতেই ইহার অন্যথা করিও না; অন্যথা করিলে জানিও যে, ভয়ানক বিপদ্ উপস্থিত হইবে। আর ভবিষ্যতে আমি যে সকল পত্রাদি লিখিব, তাহাতে আমার নাম থাকিবে না; আমার নামের পরিবর্তে ‘নবীনচন্দ্র দফাদার’ এই নাম লিখিব। তোমরা আমায় যে পত্রাদি লিখিবে, তাহাও ঐ নামে লিখিবে। ইতি। 

আশীর্ব্বাদক, শ্রীরামচন্দ্র ঘোষ। 

“পুনশ্চ, গোপাল মামা মূল পত্রে সমাচার অবগত হইবেন। আপনি আমার লিখিত পত্রাদি পাঠ করিবেন; কিন্তু অন্য কাহারও নিকট কোন কথা প্রকাশ করিবেন না। যদি প্রকাশ হয়, তাহা হইলে জানিবেন, আমার ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হইবে। আর আমি যতদিবস বাড়ীতে না যাইতে পারি, কিম্বা খরচপত্রও পাঠাইতে না পারি, সে পর্যন্ত আমার বাড়ীর আবশ্যক খরচপত্র আপনি প্রদান করিবেন। আমি যে কেন হঠাৎ দেশত্যাগী হইলাম, তাহা এখন লিখিতে অক্ষম। কিন্তু জানিবেন, বিশেষ কোন অলঙ্ঘনীয় কারণবশতঃ আমি এরূপ অবস্থায় আশ্রয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিরাশ্রয়ে ভ্রমণ করিতেছি। আর আর সমাচার সময়-মত জানিতে পারিবেন। ইতি।” 

দ্বিতীয় পত্র, যথা;– 

“পূর্ব্ব পত্রে সমাচার অবগত হইয়াছ। এখন আমি “কাশীধামে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। শারীরিক কোন কষ্ট নাই, কোন বিষয়ে ভয় করিও না। অনেকে অনেক কথা বলিবে, তাহা শুনিও না; ওখানকার সংবাদ সর্ব্বদা লিখিবে। 

শ্রীনবীনচন্দ্র দফাদার। 
২৩নং বাঙ্গালীটোলা, কাশীধাম।” 

সাহেব এই পত্র দুইখানি শ্রবণ করিলেন, এবং আমাকে আরও দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। পরিশেষে কাশী গমনপূর্ব্বক নবীনচন্দ্র দফাদারের অনুসন্ধান করিতে কহিলেন। অতঃপর গোপাল ও রামচন্দ্রের স্ত্রীকে অন্য আর একজন কর্মচারীর হস্তে অর্পণ করিয়া তাহাকে বলিয়া দেওয়া হইল, “যে পর্য্যন্ত পুনরায় হুকুম না পাও, সেই পৰ্য্যন্ত ইহাদিগকে আটক রাখিও। ইহারা যেন কোন প্রকারে কাহারও নিকট কোন সংবাদ বা পত্রাদি প্রেরণ করিতে না পারে।” 

দশম পরিচ্ছেদ 

আমি সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া, আপনার বাসায় চলিয়া আসিলাম। দিনমানে আর কোনস্থানে গমন না করিয়া একটু বিশ্রাম করিলাম। সন্ধ্যা উপস্থিত হইলে আহারাদি করিয়া, রাত্রি নয়টার সময় মেলট্রোনে পশ্চিমযাত্রা করিলাম, নিয়মিত সময়ে বেনারসৃষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। একখানি খেয়ার নৌকা ঘাটে বাঁধা ছিল; রেলগাড়ি হইতে অবতরণ পূর্ব্বক নৌকা-আরোহণে ভাগীরথী পার হইলাম। কাশীর নিম্নে যে প্রকাণ্ড ‘পুল’ এখন ভাগীরথীর শোভাবর্দ্ধন করিতেছে, আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময় সেই ‘পুল’ হয় নাই, এবং বেনারস সিটিষ্টেশন ও উক্ত রেলের কথা স্বপ্নেও ভাবেন নাই। ঘাট হইতে উপরে উঠিয়াই দেখিলাম, প্রায় দশ পনরখানি ‘একা’ দাঁড়াইয়া আছে। তাহারও একখানি ছয় আনা দিয়া ভাড়া করিলাম, ও এক্কা-চালককে বাঙ্গালীটোলায় যাইতে কহিলাম। এক্কা-চালক এই এক্কায় যোজিত ছোট অশ্বের পৃষ্ঠে সজোরে এক কশাঘাত করাতে সে প্রাণপণে দৌড়িতে লাগিল। তাহার গলায় এবং এক্কায় যে সকল ছোট ছোট ঘণ্টা বাঁধা ছিল, তাহা টুন টুন শব্দে বাজিতে লাগিল। কিন্তু আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভয়ানক নড়িতে লাগিল; প্রাণ এক প্রকার ওষ্ঠাগত হইয়া উঠিল। বোধ হয়, এক্কার ঝাঁকুনিতে আমার পেটের সমস্ত নাড়ি ছিঁড়িয়া গেল, বক্ষের ও পৃষ্ঠের সমস্ত হাড় ভাঙ্গিয়া গেল; এই আমার প্রথম এক্কারোহণ। যিনি কখন এক্কায় চড়েন নাই, তিনি একবার চড়িলেই বুঝিতে পারিবেন যে, আমার কথা সত্য কি মিথ্যা! আমি অনেক কষ্টে এক্কার উপর বসিয়া রহিলাম। এক্কা চলিতে লাগিল। 

ক্রমে চকের নিকট দিয়া যখন আমাদের এক্কা চলিয়াছে, তখন একটি বাহির দ্বারে একজন পুলিস-প্রহরীকে দেখিতে পাইয়া, এক্কা-চালককে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এটা কা’র বাড়ী?” সে বলিল, “এটা কাশীর সদর-পুলিস থানা।” সেইস্থানে আমি তাহাকে এক্কা থামাইতে কহিলাম। সে এক্কা রাখিলে, আমার নিকট যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা সেইস্থানে রাখিয়া এবং “কোতোয়াল সাহেবকে” আমার একটু সামান্য পরিচয় দিয়া, পুনরায় সেই এক্কায় আরোহণ করিলাম। 

এক্কা ক্রমে বাঙ্গালীটোলায় গিয়া উপস্থিত হইল। আমি এক্কা হইতে অবতরণ করিলাম এবং ভাবিলাম, আর সহসা এক্কারোহণ করিব না। এক্কা-চালককে ভাড়া মিটাইয়া দিলাম; সে আপন এক্কা লইয়া প্রস্থান করিল। আমি ২৩ নম্বর বাড়ীর অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। 

ইহার পূর্ব্বে যদিও কখন বেনারস গমন করি নাই, তথাপি সেই বাড়ী খুঁজিয়া লইতে আমার সবিশেষ বিলম্ব বা কষ্ট হইল না। সেই বাড়ীর অধিকারী একটি ভদ্রলোক; তিনি সেই বাড়ীতেই অবস্থিতি করেন। তাঁহার নিকট নবীনচন্দ্ৰ দফাদারের কথা জিজ্ঞাসা করাতে জানিতে পারিলাম যে, নবীনচন্দ্র চাকরীর চেষ্টায় আসিয়া সেইস্থানে অবস্থিতি করিতেছে। নবীনের সহিত আমি সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব করায়, তিনি নবীনকে ডাকিলেন; সেই সময় নবীন বাড়ীর ভিতর ছিল। নবীন বাহিরে আসিলে পর আমি তাহাকে কহিলাম, “গোপালচন্দ্র বসু নামে একটি ভদ্রলোক, এবং একটি স্ত্রীলোক আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত কল্য এখানে আগমন করিয়াছেন। কিন্তু কল্য তাঁহারা অনেক অনুসন্ধান করিয়াও, আপনার বাসা ঠিক করিতে পারেন নাই। পরিশেষে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া আমাকে বাঙ্গ ালী দেখিয়া, আমার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, তাঁহারা এখন আমার বাসায় আছেন। তাঁহাদের কষ্ট দেখিয়া আমি নিজেই আপনার অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়াছি। তাঁহাদের সহিত যদি সাক্ষাৎ করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমার সহিত আগমন করুন।” 

নবীনচন্দ্র দফাদার ওরফে রামচন্দ্র ঘোষ নিতান্ত চতুর, এবং অনেক দিবস হইতে জমীদার সরকারে বিশেষ চতুরতার সহিত কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছে। কিন্তু অদ্য সে আমার চাতুরীর নিকট পরাজিত হইয়া আমার সহিত বিনা—বাক্যব্যয়ে আগমন করিল। আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া সেই সদর থানার ভিতর লইয়া গেলাম। তখন রামচন্দ্র অবশ্যই বুঝিল, আমি কে? এবং ইহাও বুঝিল যে, সে এখন আমার হস্তে বন্দী। 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

থানার ভিতর লইয়া গিয়া “আমি নবীনচন্দ্র দফাদারকে কহিলাম, “রামচন্দ্র! তুমি কতদিবস এখানে আছ?” আমার কথা শুনিয়া রামচন্দ্র কহিল, “কি মহাশয়। আপনি রামচন্দ্র বলিতেছেন কাহাকে? আমার নাম রামচন্দ্র নহে—আমার নাম নবীনচন্দ্র দফাদার।” রামচন্দ্রের কথা শুনিয়া আমি তখন তাহাকে আর কিছুই বলিলাম না। থানার ভিতর যে হাজত গৃহ ছিল, রামচন্দ্রকে তখন তাহার ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিতে বলিলাম। সে সেই মহালের পুলিস-প্রহরীর পাহারায় আবদ্ধ রহিল। 

অতঃপর আমি বাজার হইতে কিছু খাবার আনাইয়া আহার করিলাম। কোতোয়াল সাহেবের হুকুম-মত আমার নিমিত্ত একখানি চারিপায়া আসিল; আমি তাহারই উপর শয়ন করিয়া কয়েক দিবসের ক্লান্তিদূর করিলাম। সেদিবস রামচন্দ্রের আর কোন সন্ধানই লইলাম না। সে কিছু খাইতে পাইল কি না, তাহাও দেখিলাম না। 

পরদিবস প্রাতঃকালে হাজত-গৃহ হইতে তাহাকে বাহির করিলাম। দেখিলাম, অদ্য তাহার মুখ শুষ্ক হইয়াছে, পূর্ব্বদিবসের মত আর স্ফূর্ত্তি নাই, মনে অতিশয় ভয় হইয়াছে। রামচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, যে দিবস সে হাজতে বদ্ধ ছিল, সেদিবস তাহার আহার হয় নাই। তখন বাজার হইতে কিছু আহার্য দ্রব্য আনাইয়া তাহাকে প্রদান করিলাম। সে উহা আহার করিল, ও জল পান করিয়া আমার নিকট বসিল। তখন আমি পুনরায় রামচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন বল দেখি, তোমার নাম রামচন্দ্র কি নবীন?” রামচন্দ্র তখনও কহিল, “আমার নাম রামচন্দ্র নহে—আমার নাম নবীন।” 

রামচন্দ্রকে তখন আর কিছু না বলিয়া, সেই পত্র দুইখানির মধ্যে দ্বিতীয় পত্রখানি আমার ব্যাগ হইতে বাহির করিলাম, ও পত্রখানি রামচন্দ্রের হাতে প্রদান করিয়া কহিলাম, “নবীন দেখ দেখি, এ পত্রখানি কাহার লেখা?” 

নবীন পত্রখানি দেখিয়া বিশেষ ভীত অন্তঃকরণে কহিল, “হাঁ মহাশয়! এ পত্রখানি আমার লিখিত ও আমারই নাম স্বাক্ষরিত। এখন এই পত্র দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছেন ত, আমার নাম নবীন, রামচন্দ্ৰ নহে?” 

রামচন্দ্রের এই কথা শুনিয়া তখন আমি প্রথম পত্রখানি বাহির করিলাম, ও উহা রামচন্দ্রের হস্তে প্রদান করিয়া কহিলাম, “দেখ দেখি, এই পত্রখানিই বা কাহার লিখিত?” রামচন্দ্র পত্রখানি দেখিয়াই কাঁপিতে লাগিল। পরে উহা হস্তে লইয়া পড়িতে গেল; কিন্তু পড়িতে পারিল না, হস্ত কাঁপিতে লাগিল, ও পরিশেষে উহা তাহার হস্ত হইতে পড়িয়া গেল। মুখের দিকে দেখিলাম, রামচন্দ্রের মুখ ম্লান ও শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। রামচন্দ্রের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কহিলাম, “কি রামচন্দ্র! পত্রপাঠ করিলে? উহা কাহার লেখা?” রামচন্দ্র কোন উত্তর করিতে পারিল না; আমার কথার কি উত্তর দিবে, তাহাই ভাবিতে লাগিল। তখন আমি উহাকে কহিলাম, “রামচন্দ্র! তুমি জানিও, আমরা সমস্ত জানিতে পারিয়াছি; এখন আর লুকাইয়া কোন ফল নাই। যদি এখন আপনার প্রাণ বাঁচাইতে চাও, তাহা হইলে আমার নিকট সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া বল। নতুবা তোমার অদৃষ্টে যে কি আছে, তাহা আমি বলিতে পারি না।” আমার কথা শুনিয়া রামচন্দ্র অতিশয় ভীত ও ভাবিত হইল এবং কহিল, “মহাশয়! আপনারা পুলিস-কৰ্ম্মচারী, আমাকে বিশেষ কষ্ট দিবেন না। আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা ত হইবেই, কিন্তু যদি আমাকে বিশেষ পীড়ন না করেন, তাহা হইলে আমি সমস্ত কথা আপনার নিকট বলিতে সম্মত আছি।” রামচন্দ্রের কথা শুনিয়া আমার হৃদয়ে আনন্দ উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, “রামচন্দ্র যদি প্রকৃতকথা বলে, তাহা হইলে সমস্ত কথাই অবগত হইতে পারিব—সেই মৃতদেহ কাহার, কিরূপে সে হত হইয়াছে, তাহার মস্তকই বা কোথায় গেল, এবং কাহার দ্বারাই বা সেই কাৰ্য্য সংসাধিত হইল, তাহা হইলে কিছুই আর জানিতে বাকি রহিবে না।” তখন আমি রামচন্দ্রকে কহিলাম, “দেখ রামচন্দ্র! যদি তুমি আমার নিকট প্রকৃতকথা বল, তাহা হইলে জানিও যে, তোমার উপর কোনরূপ পীড়ন হইবে না; অথচ আমি সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখিব, যদি তোমার কোন প্রকার উপকার করিতে পারি। আরও এক করা, যে পত্র দুইখানি তুমি দেখিলে, উহা আমি তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছি। সুতরাং তিনিও যে আমাদের হস্ত—বহির্ভূতা, তাহা তুমি ভাবিও না। বিশেষতঃ ইহাও তোমার মনে কথা কর্তব্য যে, আমরা মনে করিলে তাঁহারও আপাততঃ যথেষ্ট অবমাননা করিতে পারি। অতএব আমার বিবেচনায় এখন প্রকৃত কথা বলাই তোমার কর্তব্য।” আমার কথা শুনিয়া রামচন্দ্র একটু ভাবিল। পরিশেষে একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক কহিল, “মহাশয়! আমি যাহা অবগত আছি, তাহা বলিতেছি—শ্রবণ করুন।” 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

রামচন্দ্র কহিল, “মহাশয়! আমার নাম নবীনচন্দ্র দফাদার নহে, আমার প্রকৃত নাম রামচন্দ্র ঘোষ। আমার নিবাস ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে। আমি বাল্যকাল হইতে আমাদিগের জমীদারবাবু গিরীন্দ্রনাথ রায়ের সরকারেই প্রতিপালিত। বাবুর ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথ রায়ের সহিত বাবুর মনোবিবাদ থাকায়, অনেক মামলা মোকদ্দমা উপস্থিত হয়। পরিশেষে হাইকোর্টে একটি মামলার আপীল হওয়ায়, উহার যোগাড় করিতে আমরা কলিকাতায় গমন করি, ও একটি গৃহ ভাড়া লইয়া, সেই গৃহে আমি ও আমার মনিব অবস্থান পূর্ব্বক মোকদ্দমার জন্য প্রস্তুত হইতে থাকি। পরিশেষে হাইকোর্টে মোকদ্দমার শেষ নিষ্পত্তি হইয়া যায়—মোকদ্দমায় আমরা জয়লাভ করি। 

“যেদিবস মোকদ্দমার বিচার শেষ হয়, সেইদিবস সন্ধ্যার পর আমরা হাইকোর্ট হইতে বাসায় প্রত্যাগমন করি, ও নিয়মিত আহারাদি করিয়া আপন-আপন স্থানে শয়ন করি—অর্থাৎ জমীদার মহাশয় শয়ন করেন—উপরের গৃহে আর আমি শয়ন করি—নীচের গৃহে। রাত্রি আন্দাজ দশটার সময় আমি নিদ্রিত হইয়া পড়ি। 

“কোন সময়ে ও কি কারণে হঠাৎ আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু যখন আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন দেখিলাম, আমার গৃহের জানালার গরাদিয়া ভাঙ্গিয়া একটি লোক সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। গৃহের ভিতর একটি প্রদীপ অল্প অল্প জ্বলিতেছিল। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াই উক্ত প্রদীপের দিকে সে যেমন গমন করিবে, অমনি আমি আমার শয্যার উপর উঠিয়া বসিলাম ও সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে তুমি?’ সেই ব্যক্তি নিতান্ত কর্কশস্বরে উত্তর করিল, ‘তোর বাপ।’ উত্তরে আমার মনে ক্রোধ হইল। দেখিলাম, এ ব্যক্তি চোর, চুরি করিবার অভিপ্রায়েই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে। উহাকে আর কিছু না বলিয়া শয্যা পরিত্যাগ পূর্ব্বক উঠিলাম, ও পশ্চাৎ হইতে উহার কোমর জড়াইয়া ধরিলাম। মহাশয়, সেই সময়ে আমি যে কি দুঃসাহসিক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, তাহা একবারের নিমিত্ত ভাবি নাই। আমি যেমন উহাকে ধরিলাম,—উহার নিকট কি অস্ত্র ছিল, জানি না—সে অমনি সেই অস্ত্রের দ্বারা আমাকে এক আঘাত করিল। উহা আমার বামহস্তের উপর লাগাতে সেইস্থান কাটিয়া গেল, দরদর-বেগে রক্তধারা বহিতে লাগিল। আমি উহাকে ছাড়িয়া দিলাম। এই দেখুন মহাশয়! সেই ক্ষত এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে, এখনও উহা সম্পূর্ণরূপে শুখায় নাই। আমার শয্যার নিকট একখানি ভোজালী ছিল, তখন ক্রোধান্ধ হইয়া আমি সেই ভোজালী গ্রহণ করিলাম, ও উহা দ্বারা তাহাকে সবলে আঘাত করিলাম। বলিতে পারি না যে, উহার কোন স্থানে সেই আঘাত লাগিয়াছিল; কিন্তু সে ‘মাগো মলেম গো’ বলিয়া, সেইস্থানেই পড়িয়া গেল। 

“সেই সময় সেই ভাঙ্গা জানালা দিয়া আরও দু তিনজন লোক গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, দেখিলাম। এবার আমার অন্তঃকরণে নিতান্ত ভয়ের উদয় হইল। ভাবিলাম, ‘এবার আর আমার নিস্তার নাই, আমি একা তিনজনের সহিত কোন ক্রমেই পারিব না, এবার আমার মৃত্যু নিশ্চয়।’ এই ভাবিয়া সেই ভোজালী সেইস্থানে ফেলিয়া দিয়া, সেই গৃহের ভিতর যে সিঁড়ি ছিল, তাহার পশ্চাতে গিয়া চুপ করিয়া এরূপভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম যে, আমার যেন উহারা দেখিতে না পায়। উহারা গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াই দেখিল যে, উহাদের সঙ্গী সেই গৃহের ভিতর পড়িয়া রহিয়াছে। উহাকে উক্তরূপ অবস্থায় পতিত দেখিয়া, প্রথমে দুই একবার আস্তে আস্তে ডাকিল, কিন্তু কোন উত্তর পাইল না! পরিশেষে উহার গাত্র ঠেলিয়া ডাকিতে লাগিল, তাহাতেও কোন উত্তর নাই! তখন গৃহের প্রজ্বলিত প্রদীপটি একজন উহার নিকট আনিল, এবং সেই প্রদীপের সাহায্যে উহাকে দেখিতে পাইল। আমিও আমার লুক্কায়িত স্থান হইতে দেখিলাম যে, সেইস্থান একেবারে রক্তে ভাসমান এবং উহার পেটের নাড়ীভুঁড়ি বহির্গত হইয়া পড়িয়াছে—উহার জীবন-বায়ুও শেষ হইয়াছে। যাহা হউক, তাহারা বিশেষরূপে নাড়িয়া চাড়িয়া ও পরীক্ষা করিয়া যখন বুঝিতে পারিল যে, উহার দেহে আর প্রাণ নাই, তখন একজন কহিল, ‘উহাকে এইরূপ অবস্থায় রাখিয়া যাওয়া উচিত নহে; কারণ, এই লাস দেখিলে অনেকে উহাকে চিনতে পারিবে। আর তাহা হইলে পুলিস উহার সঙ্গী জানিয়া, আমাদিগকেই সন্দেহ করিবে। যাহাতে কেহ উহাকে চিনিতে না পারে, তাহাই আমাদের করা কর্তব্য। উহার মস্তকটি কাটিয়া লইয়া গেলে, কেহ আর উহাকে চিনিতে পারিবে না; সুতরাং আমাদের ভয়েরও আর কোন কারণ থাকিবে না। 

“এই পরামর্শ সুপরামর্শ বলিয়া স্থির হইলে, উহার মস্তকটি একজন কাটিয়া লইল। অপর আর একজন উহার পরিধানে যে বস্ত্র, এবং উহার নিকট যে অস্ত্রাদি ছিল, তাহা লইয়া দ্রুতগতি সেই জানালা দিয়া, বহির্গত হইয়া প্ৰস্থান করিল। 

“সেই অবস্থা দেখিয়া আমি অতিশয় ভীত হইলাম। আমার শয্যার চাদর দিয়া সেই মৃতদেহটি ঢাকিয়া রাখিয়া একবার ভাবিলাম, ‘আমি আমার মনিবকে সেই সকল কথা বলি।’ কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল,—আমারই অস্ত্রাঘাতে এই ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে; এখন মনিবকে বলিয়াই বা আর কি করিব? একটু গোলযোগ হইলেই পুলিস আসিয়া উপস্থিত হইবে, তখন আমার হস্তেই দড়ি পড়িবে, আমি ফাঁসী যাইব। এইরূপ ভাবিয়া আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া, সেই জানালা দিয়া আমিও বহির্গত হইলাম। ক্রমে অদ্য কয়েক দিবস হইল, এখানে পৌঁছিয়াছি। ইহা প্রকৃতকথা। ইহা অপেক্ষা অধিক আর কিছুই আমি জানি না! যাহা জানিতাম, তাহা আপনার নিকট সমস্ত বলিলাম; কিন্তু অপর কাহারও নিকট এই সকল কথা আমি বলিব কি না, তাহার কিছুই আমি এখন বলিতে পারিতেছি না।” 

রামচন্দ্রের এই সকল কথা শুনিয়া তাহাতে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল। পুনরায় তাহাকে কহিলাম, “রামচন্দ্র! তুমি যাহা বলিলে, তাহা সমস্তই আমি শুনিলাম। কিন্তু তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি বলিলে যে, সেই ভোজালী তোমার শয্যার নিকট ছিল, কিন্তু তাহা ত প্ৰকৃত কথা নহে! সেই ভোজালী তোমার মনিবের উপরের গৃহে ছিল, তুমি কিরূপে সেই ভোজালী পাইলে?” 

উত্তরে রামচন্দ্র কহিল, “আমি মিথ্যা কথা বলি নাই; অথচ আপনি যাহা বলিলেন, তাহাও প্রকৃতকথা। সেই ভোজালী উপরেই ছিল সত্য, কিন্তু সেইদিবস প্রাতঃকালে কোন দ্রব্য কাটিবার নিমিত্ত সেই ভোজালী আমি নীচে আনিয়াছিলাম; সেই সময় হইতেই উহা আমার গৃহেই ছিল। আমি যখন সেই ভোজালী নীচে আনি, সেই সময় আমার মনিব গৃহে ছিলেন না; সুতরাং তিনি এ বিষয় অবগত নহেন।” 

আমি ইহা শুনিয়া রামচন্দ্রকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। বেলা দশটার সময় তাহাকে সঙ্গে লইয়া, সেইস্থানের মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট গমন করিলাম। মাজিষ্ট্রেট সাহেব আমার নিকট সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া, রামচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমার নিকট কোন কথা বলিতে চাও?” 

রামচন্দ্র। হাঁ মহাশয়! আমি এই বলিতে চাই যে, আপনি এই কর্ম্মচারীকে বলিয়া দেন—ইনি যেন আমাকে কোনরূপ কষ্ট না দেন। 

মাজিষ্ট্রেট। উনি তোমাকে কোন প্রকার কষ্ট দিবেন না, কিন্তু তুমি এখন ওঁর কয়েদী; সুতরাং তোমাকে কায়দা—মাফিক লইয়া যাইবেন। যে মোকদ্দমায় তুমি ধৃত হইয়াছ, সে সম্বন্ধে তুমি কোন কথা আপন ইচ্ছায় বলিতে চাও কি? 

রামচন্দ্র। আমি যদি কিছু বলি, তাহাতে আমার কোন অনিষ্ট আছে কি? 

মাজিষ্ট্রেট। হাঁ। আমার নিকট তুমি যাহা বলিবে, তাহা তোমার বিপক্ষে প্রমাণরূপে গণ্য হইবে। 

রামচন্দ্র। না মহাশয়! তবে আমি কিছু বলিতে চাহি না। আমায় যাহা কিছু বলিতে হইবে, তাহা আমার শেষ বিচার যিনি করিবেন, তাঁহারই নিকট বলিব। 

রামচন্দ্র যাহা বলিল, মাজিষ্টেট তাহাই লিখিয়া আমাকে প্রদান করিলেন, এবং তাহাকে লইয়া কলিকাতায় গমন করিবার আদেশ দিলেন। 

রামচন্দ্রকে লইয়া কলিকাতায় আগমন করিলাম। গিরীন্দ্রনাথ প্রভৃতি উহাকে রামচন্দ্র বলিয়া চিনিলেন। মৃতদেহ যাহার বলিয়া এতদিন এত অনুসন্ধান হইতেছিল, সেই ব্যক্তিকে দেখিয়া কৰ্ম্মচারীমাত্রেই অতিশয় বিস্মিত হইলেন। সাহেব আমার নিকট সমস্ত কথা শুনিলেন। রামচন্দ্র আমাকে এই হত্যাকাণ্ড-সম্বন্ধে যে যে কথা প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিল, তাহা আনুপূর্ব্বিক আমার নিকট শ্রবণ করিয়া তিনি সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; এবং এক্ষণে সেই কথিত দস্যুদলের যদি কোনরূপ সন্ধান হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত কর্মচারী নিয়োগ করিলেন। 

এই হত্যা যদিও রামচন্দ্রের দ্বারা সাধিত হইয়াছে, কিন্তু তাহাকে উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত করিবার কোন প্রমাণই নাই। প্রথমতঃ আমার নিকট রামচন্দ্রের সমস্ত স্বীকার করা; কিন্তু তাহা আদালতে প্রমাণ বলিয়া গ্রাহ্য হইতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ যদি বিচারকের নিকটে রামচন্দ্র স্বীকার করে; কিন্তু তাহাও নিতান্ত অসম্ভব। কারণ, এখন রামচন্দ্র কলিকাতায় আসিয়াছে—তাহার মনিব তাহার নিমিত্ত উকীল নিযুক্ত করিয়াছেন। সে উকীলের পরামর্শ পাইয়া কোন্ কথা বলিলে কি হইবে, তাহা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিয়াছে। এরূপ অবস্থায় রামচন্দ্র কি আর তাহার দোষের কথা স্বীকার করিতে পারে? 

সাহেব রামচন্দ্রকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রামচন্দ্র! তুমি এ সম্বন্ধে কি জান?” উত্তরে রামচন্দ্র আমার নিকট যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহার প্রথম অংশ সেইরূপই কহিল; কিন্তু পরের অংশ সম্বন্ধে এইরূপ কহিল, “জানালা ভাঙ্গিয়া চারিজন চোর আমার গৃহে প্রবেশ করায় আমার নিদ্রাভঙ্গ হইয়া যায়! কিন্তু আমার অতিশয় ভয় হওয়ায় আমি চুপ করিয়াই থাকি। সেই সময়ে সেই গৃহের ভিতর উহাদিগের দুইজনের মধ্যে বিবাদ আরম্ভ হয়। একজন বলে,—‘তুমি উপরে উঠ।’ অপর এক ব্যক্তি বলে,—তুমি উপরের গৃহে গমন কর।’ এই সামান্য কথায় পরস্পরের বিবাদ উপস্থিত হয়। একজনের হস্তে একখানি ছরি ছিল, সে তাহা দ্বারা অপরকে আঘাত করে। অপর ব্যক্তি—আমাদিগের ভোজালীখানি দেখিতে পাইয়া তাহা উঠাইয়া লয়, ও তাহা দ্বারা উক্ত ব্যক্তির পেটে এমন আঘাত করে যে, তাহাতেই উহার প্রাণবায়ু বহির্গত হয়। এই ব্যাপার ঘটায় উহারা আর চুরি করিতে সাহস না করিয়া চলিয়া যায়। যাইবার সময় একজন উহার মস্তক কাটিয়া লইয়া যায়, অপর এক ব্যক্তি আমাকে আঘাত করিয়া বহির্গত হয়। এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমি অতিশয় ভয় পাই, এবং মনে মনে ভাবি, যখন আমার গৃহের ভিতর এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, তখন পুলিস আসিয়া আমাকে লইয়াই পীড়াপীড়ি করিবে—হয় ত আমারই উপর এই খুনি-মামলা চাপাইবে। এই ভাবিয়া প্রাণের ভয়ে আমি পলায়ন করি।” 

সাহেব উহার কথা শুনিয়া অবাক্ হইলেন। যাহা হউক, উহার উপর আর কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে না পারায়, পরিশেষে উহাকে ছাড়িয়া দিতে হইল। 

গিরীন্দ্র, নগেন্দ্র, রামচন্দ্র প্রভৃতি সকলেই এই ঘটনার পর আরও দুইচারিদিবস কলিকাতায় থাকিয়া, আপন আপন স্থানে গমন করিলেন। 

আমরা কিছুদিবস সেই দস্যুদলের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপ সন্ধান না পাওয়ায়, সে অনুসন্ধান পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্য কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইলাম। 

[বৈশাখ, ১৩০২] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *