বিষম সমস্যা (হৃত সর্বস্বা বারাঙ্গনার মৃতদেহের অদ্ভুত রহস্য!)

বিষম সমস্যা (হৃত সর্বস্বা বারাঙ্গনার মৃতদেহের অদ্ভুত রহস্য!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

কার্তিক মাসের একদিবস দিবা দুইটার সময় সহরের ভিতর গোল উঠিল–খুন হইয়া গিয়াছে। কোন ব্যক্তি সৰ্প কর্তৃক দংশিত হইয়াছে, এই কথা শ্রবণ করিলে, সাপের ওঝার যেমন আর স্থির থাকিবার যো নাই, শ্রবণমাত্রই যেমন তাহাকে সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া সর্পাঘাতের চিকিৎসায় প্রবৃত্ত হইতে হয়; সেইরূপ খুনের কথা শ্রবণ করিলে, সাপের ওঝার মত আমাদিগকেও সেই হত্যা-স্থানে উপস্থিত হইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হয়। এই নিয়ম বহুকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। খুন হইয়াছে, যখন এই কথা আমার কর্ণে প্রবেশ করিল, তখনই সেইস্থানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম; কিন্তু কোথায় যে যাইব, তাহা জানি না। কোনস্থানে খুন হইয়াছে, পথে অনেক লোককে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু কেহই প্রকৃত উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইল না। কেহ বলিল—“খুনের কথা শুনি নাই।” কেহ কহিল, “খুন হইয়াছে, তাহা শুনিয়াছি; কিন্তু কোথায় তাহা জানি না।” এইরূপে অনেকে অনেক কথা বলায় কোন স্থানে গমন করিতে হইবে, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া থানায় উপস্থিত থাকিলাম। ভাবিলাম, যদি এই অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আদেশ পাই, তাহা হইলে সেইস্থানে গমন করিব। নতুবা থানাতেই উপস্থিত থাকিব, অপর কোনস্থানে গমন করিব না। 

প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল থানাতে বসিয়া রহিলাম, কোন সংবাদ আসিল না। ভাবিলাম, খুনের গোলযোগ মিথ্যা, কোন স্থানে খুন হয় নাই; কোন মিথ্যা জনরব উঠিয়া সহরের স্থানে স্থানে বিকীর্ণ হইয়াছে মাত্র। কারণ প্রকৃত খুন হইলে, আমাদিগের নিকট সংবাদ আসিতে এত বিলম্ব কখনই হইত না। স্থানীয় পুলিস সংবাদ পাইবার সঙ্গে সঙ্গেই এই সংবাদ আমাদিগের নিকট প্রেরণ করিতেন। 

থানায় বসিয়া এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আরও এক ঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল। ইহার পরই দেখিলাম যে একজন কনষ্টেবল খুনের সংবাদ লইয়া আমাদের থানায় উপস্থিত হইল। তখন তাহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, খুন হইয়াছে কলিকাতার নাথের বাগানে। 

সংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্র নাথের বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তথায় যে স্থানে চরিত্রহীনা স্ত্রীলোকদিগের সারি সারি খোলার ঘর, এই খুন সেইস্থানেই হইয়াছে জানিতে পারিলাম। সেইস্থানে উপস্থিত হইবামাত্র যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহ একজন আমাকে দেখাইয়া দিল। দেখিলাম যে, সেইস্থান অনেক পুলিস কর্ম্মচারী দ্বারা সমাচ্ছাদিত আমি গিয়া ক্রমে তাঁহাদের সহিত মিলিত হইলাম। একজন কর্ম্মচারী আমাকে সঙ্গে লইয়া, যে গৃহে মৃতদেহ পড়িয়া আছে, সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম যে, ইহা একখানি ক্ষুদ্র খোলার ঘর। এই গৃহের ভিতরস্থিত একখানি তক্তাপোসের উপর একটি স্ত্রীলোক চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে। উহার মস্তক দক্ষিণে, পদযুগল উত্তরে। বামহস্ত মৃতার বুকের উপর, দক্ষিণহস্ত সেই তক্তাপোসের বাহিরে ঝুলিতেছে। মৃতার চক্ষু মুদিত, দত্ত দত্তে সংলগ্ন। শরীরের কোনস্থানে কোন প্রকার আঘাতের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে না, কেবলমাত্র কণ্ঠের তিন চারি স্থানে চামড়ার উপর নখের ছিলাদাগ আছে বলিয়া বোধ হয়! 

মৃতার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উত্তমরূপ পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কোনস্থানে অলঙ্কার প্রভৃতি সবিশেষ মূল্যবান দ্রব্য কিছুই দেখিতে পাইলাম না। কেবল বামকর্ণের নিম্নে একটি সোণার মাকড়ি ও কোমরে রূপারগোটের কিয়দংশ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। বিছানার উপর একটি সোণার কাঁটাও পড়িয়াছিল। 

মৃতদেহের নিকট বিছানার উপর একটি গ্লাসে একটু জল ও তাহার নিকট একটি কাঁসার বাটি। বাটিতে কোন দ্রব্যাদি ছিল না, কিন্তু বাটির নিকট একখানি সাল পাতার ঠোঙ্গায় মিষ্টদ্রব্যের কিয়দংশ রহিয়াছে। 

যে গৃহে এই মৃতদেহ ছিল, সেই গৃহটি পথের উপর। সেই গৃহে দুইটিমাত্র দ্বার, একটি পথের উপর, অপরটি গৃহের পার্শ্বভাগে একটি অতি সঙ্কীর্ণ গলির উপর। উত্তর দ্বার দিয়াই গৃহ হইতে বহির্গত হইতে পারা যায়। এই স্ত্রীলোকটির জীবিতাবস্থায় গলির দ্বার প্রায় সর্ব্বদাই বন্ধ থাকিত। গৃহের ভিতর যাতায়াত প্রভৃতি সমস্তই পথের সেই দ্বার দিয়াই চলিত। 

পথ হইতে দক্ষিণমুখ করিয়া সদর দ্বার দিয়া সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে হয়। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেই দক্ষিণে সেই তক্তাপোস, এবং বামে সেই গলির দ্বার। এই দ্বারের নিকট সেই গৃহের ভিতর একটি কাষ্ঠের আলমারি আছে। পরিধেয় বস্ত্রাদি ও অলঙ্কার এবং টাকা, পয়সা প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যই রাখিবার নিমিত্ত এই আমারি ভিন্ন অপর কোন দ্রব্যাদি সেই গৃহের ভিতর নাই। 

আলমারির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলাম। দেখিলাম যে, উহার গায় চাবি লাগান আছে, উহার ভিতরস্থিত সমস্ত দ্রব্যাদি যেন স্থানভ্রষ্ট হইয়াছে বোধ হইল। আরও বোধ হইল, যেন উহার ভিতর সমস্ত দ্রব্যাদি নাই। যে সকল বস্ত্ৰ আলমারির ভিতর থাকা উচিত বলিয়া বোধ হয়, তাহার দুই এক খানি অযথাভাবে সেই গৃহের ভিতর আলমারির নিকট পড়িয়া রহিয়াছে। গৃহের তৈজসপত্র দেখিলেও যেন বোধ হয়, তাহার মধ্যে কোন কোন দ্রব্য নাই। 

আলমারিতে যে চাবিটি লাগান ছিল, তাহাতে একটু কাল ফিতা সংবদ্ধ রহিয়াছে। এই ফিতা দেখিলে বোধ হয়, উহা যেন জোর করিয়া টানিয়া ছেঁড়া। মৃতার কোমরে দেখিলাম, একটি লালরঙ্গের ঘুন্সী, উক্ত চাবি-সংলগ্ন কার ফিতার অপর অংশ এই ঘুন্সীতে সংবদ্ধ আছে। আলমারির ভিতর অনুসন্ধান করায় কোন অলঙ্কার বা টাকা, পয়সা প্রভৃতি কিছুই দেখিতে পাইলাম না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, সেই মৃতার নাম চাঁপা। চাঁপা একজন চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক। যে গৃহে চাঁপা থাকে, সেই গৃহ চাঁপার নিজের নহে; সেই বাড়িটি ভব বাড়ীওয়ালীর। ভব বাড়ীর ভিতরের একখানি গৃহে থাকে। ভব ব্যতীত আরও ছয় সাতটি স্ত্রীলোক সে বাড়ীতে বাস করে। তাহারাও আপন আপন চরিত্র হারাইয়া, এইস্থানে অবস্থিতি করিয়া পাপের স্রোত বৃদ্ধি করিতেছে। চাঁপা ব্যতীত আর কেহই বাহিরে থাকে না। এই একখানি গৃহ ব্যতীত বাহিরে আর গৃহও নাই। 

ভব ও ভবর ভাড়াটিয়াদিগের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম,—চাঁপা নিতান্ত সামান্য স্ত্রীলোক হইলেও, কিন্তু সে কতকগুলি সোণা ও রূপার অলঙ্কারের অধিকারিণী ছিল। যে দিবস দিবা দ্বিপ্রহরের সময় তাহাকে মৃতাবস্থায় পাওয়া যায়, সেই দিবস প্রাতঃকালে সকলেই তাহার শরীরে নিম্নলিখিত অলঙ্কারগুলি দেখিয়াছে। (১) এক জোড়া সোণার পাকদেওয়া বালা। (২) এক জোড়া সোণার পালংপাতা নক্সার অনন্ত। (৩) এক ছড়া সোণার ডায়মণ্ড কাটা চিক। (৪) আটটা সোণার ডায়মণ্ডকাটা মাড়ি। (৫) তিনটা সোণার ও কাঁটা। (৬) এক ছড়া রূপার উল্টা গোট। (৭) চারিগাছি রূপার পাকদেওয়া মল। 

এই অলঙ্কার ব্যতিরেকে তাহার নগদ কিছু অর্থ ছিল; একথাও কাহার কাহারও নিকট হইতে অবগত হইলাম। আরও জানিতে পারিলাম,—চাঁপা আজ প্রাতঃকালে ছয়টার সময় নিদ্রা হইতে উত্থিত হয়। প্রথমে একবার সেই বাড়ীর ভিতর গমন করে, সেইস্থানে বাড়ীর সকলেই তাহাকে দেখিতে পায়। সেই সময়ে পূৰ্ব্ববর্ণিত অলঙ্কার সমস্তই তাহার শরীরে ছিল। চাঁপা বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া গোলাপের দ্বারে গিয়া উপবেশন করে। সেই সময়ে একটি লোক বাহির হইতে চাঁপা চাঁপা’ বলিয়া ডাকাতে চাঁপা বাড়ীর বাহিরে গমন করে। ইহার পরই দেখিতে পাওয়া যায়, চাঁপার গৃহের দ্বার বন্ধ; কিন্তু গৃহের ভিতর হইতে বাদ্য ও গীতধ্বনি হইতে আরম্ভ হয়। 

কে যে বাদ্য বাজাইতেছিল, তাহা সেই বাড়ীর কেহই বলিতে পারিল না। কারণ সেই লোকের স্বর শ্রবণ ভিন্ন বাড়ীর কেহই তাহাকে দর্শন করে নাই। গীত গাহিতে ছিল-চাঁপা। প্রায় দুইঘণ্টা কাল জোর করিয়া চাঁপা যে গীত গাহিতেছিল, তাহা কিন্তু সকলেই শ্রবণ করিয়াছে। কখন যে গীতবাদ্য শেষ হইয়াছে, কখন যে সেই ব্যক্তি চাঁপার গৃহ হইতে প্রস্থান করিয়াছে, তাহা কিন্তু বাড়ীর কেহই বলিতে পারিল না। সেই ব্যক্তি প্রস্থান করিলে, পরেও কিন্তু চাঁপা সেই বাড়ীতে ছিল। দিবা দশটার সময় সকলে দেখিয়াছিল যে, চাঁপা পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াছে, এবং সেই সময়েও তাহার শরীরে পূৰ্ব্বলিখিত অলঙ্কারগুলি সমস্তই ছিল। 

চাঁপার গৃহের সম্মুখে পথের উত্তরপার্শ্বে হর-বাড়ীওয়ালীর বাড়ী। সেই বাড়ীতেও কতকগুলি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোকের বাস। তাহাদিগের মধ্যে একজনের নিকট হইতে অবগত হওয়া গেল—দিবা প্রায় এগারটার সময় সে চাঁপাকে তাহার নিজের গৃহে প্রবেশ করিয়া, সদর দ্বার বন্ধ করিয়া দিতে দেখিয়াছে। তাহার পর যে পর্য্যন্ত চাঁপা জীবিত ছিল, সেই পর্যন্ত তাহাকে সেই দ্বার খুলিতে, সে কিম্বা আর কেহই দেখে নাই। যে সময় চাঁপা তাহার গৃহের দ্বার বন্ধ করে, সেই সময়ে সেই গৃহের ভিতর অপর কোন লোককে সে দেখিতে পায় নাই। সে গৃহে যে কোন ব্যক্তি একবারেই ছিল না, তাহা কিন্তু সে নিশ্চয় বলিতে পারিল না। 

এই কয়েকটি বিষয় অবগত হইয়া, কি প্রকারে সেই মৃতদেহের প্রথম আবিষ্কার হয়, এবং কি প্রকারেই বা কোন ব্যক্তি এই মৃতদেহ প্রথম দেখিতে পায়, তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। আমার কথা শুনিয়া আমার সমভিব্যাহারী একজন পুলিস কর্ম্মচারী আমাকে কহিলেন :—

“অদ্য দিবা একটার সময় ভব থানায় গিয়া প্রথম সংবাদ প্রদান করে, তাহার ভাড়াটিয়া চাঁপা মৃতাবস্থায় তাহার গৃহে পড়িয়া আছে, ও তাহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার-পত্র ছিল, তাহার অধিকাংশ‍ই নাই। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমরা এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত, এবং অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত অনুসন্ধান করিয়া আমরা এইমাত্র জানিতে পারিয়াছি—দিবা এগারটার সময় চাঁপা সর্ব্বশেষে তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়া দেখিতে পায়, গৃহের দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। এই অবস্থা দেখিয়া সে প্রথমে চাঁপাকে বাহির হইতে ডাকিতে আরম্ভ করে, কিন্তু তাহার কোনরূপ উত্তর না পাইয়া, নিকটবর্তী কেবলরাম খিলিওয়ালার পানের দোকানে গমন করে। কেবলরাম সেই সময় দোকানেই উপস্থিত ছিল, সে এই আগন্তুকের নিকট হইতে সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, তাহার সমভিব্যাহারে চাঁপার গৃহের নিকট গমন করে। কেবলরাম কহে যে, সেও প্রথমে তাহাকে ডাকিয়াছিল, কিন্তু কোনরূপ উত্তর না পাইয়া, সদর রাস্তা ছাড়িয়া সেই গলির ভিতর দিয়া অপর দ্বারের নিকট গমন করে। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখে যে, উক্ত দ্বার মুক্ত। উহারা উভয়েই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিতে পায়, চাঁপা এইরূপ অবস্থায় তাহার তক্তাপোসের উপর শুইয়া আছে। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কেবলরাম প্রথমে তাঁহাকে ডাকে, কিন্তু উত্তর না পাইয়া সে তাহার গাত্রে হস্ত প্রদান করে। সেই সময় কেবলরাম বুঝিতে পারে,—চাঁপা জীবিত নাই। চাঁপার এই অবস্থা দেখিয়া, উহারা বাহিরে আগমন করে। সেই সময় রাস্তার উপর হর-বাড়ীওয়ালীর বাড়ীর ভাড়াটিয়া কামিনী, বিধু ও তারামণি বসিয়াছিল। কেবলরামের কথা শুনিবামাত্র তাহারা সকলেই চাঁপার গৃহে সেই গলির দ্বার দিয়া প্রবেশ করে, এবং তাহাদের মধ্যে কেহ ভিতর হইতে সদর দ্বার খুলিয়া দেয়। পরে গোলমালে অনেক লোকের সমাগম হয়, ক্রমে ভব-বাড়িওয়ালী ও তাহার বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়াগণ বাহিরে আসিয়া এই অবস্থা দেখিতে পায়, এবং পরিশেষে ভব গিয়া থানায় সংবাদ প্রদান করে। এ পর্যন্ত কেবল এইমাত্র অবগত হইতে পারা গিয়াছে। ইহা ব্যতীত এ বিষয়ে আর কিছুই এখন জানিতে পারা যায় নাই।” 

প্রশ্ন। এখন যতদূর পর্যন্ত অবগত হইতে পারা গিয়াছে, তাহাতে বোধ হইতেছে, যে ব্যক্তি কেবলরামকে সংবাদ প্রদান করিয়াছিল, সেই ব্যক্তিই চাঁপার গৃহের নিকট প্রথম গমন করিয়াছিল। সে ব্যক্তি এখন কোথায়? তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কি বলিতেছে? 

উত্তর। সে কে, জানি না, তাহাকে পাওয়া যায় নাই। 

প্রশ্ন। তাহাকে পাওয়া যায় নাই কেন? সে ত কেবলরামের সহিত একত্র ছিল? 

উত্তর। প্রথমে একত্র ছিল সত্য; কিন্তু গোলযোগের সময় যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহা কেহই বলিতে পারিতেছে না।

প্রশ্ন। উহার নাম ও ঠিকানা পাওয়া গিয়াছে কি? 

উত্তর। উহার নাম ও ঠিকানা কেহই বলিতে পারে না। কেবলরাম কহে –– সে তাহাকে পূর্ব্বে কখনও দেখে নাই! 

এই সকল অবস্থা দেখিয়া ও শুনিয়া, আমরা উভয়েই সেই গৃহ হইতে বাহিরে আসিলাম। সেই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিবার উপযোগী চারিপায়া প্রভৃতি সমস্তই ঠিক ছিল। গৃহ হইতে ক্রমে সেই মৃতদেহ বাহির করিয়া আনা হইলে, আমরা পুনরায় এই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; কিন্তু সন্দেহসূচক আর কোন বিষয়ই দেখিতে পাইলাম না। 

ভব-বাড়ীওয়ালীর ভাড়াটিয়া স্ত্রীলোকগণ একত্র মিলিয়া, সেই মৃতদেহ বহন করিয়া ডেড্‌হাউসে লইয়া গেল। কিন্তু আমরা সেইস্থানেই বসিয়া ইহার প্রকৃত তত্ত্ব সন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। এই অনুসন্ধান করিতে প্রথমে কোনরূপ গুপ্ত অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখিলাম না। সেইস্থানে বসিয়া প্রকাশ্য ভাবে পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ যেরূপ অনুসন্ধান করিয়া থাকেন, প্রথমে সেইরূপ অনুসন্ধানেই প্রবৃত্ত হইলাম। এক এক করিয়া প্রত্যেককেই সেইস্থানে ডাকিয়া তাহাদিগের জবানবন্দী লিখিতে আরম্ভ করিলাম। সেই সকল জবানবন্দীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা ক্রমে পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিব। এই সকল জবানবন্দী সুখপাঠ্য না হইলেও পাঠকগণের জানা আবশ্যক। নতুবা আমরা কি প্রকারে মোকদ্দমার সূত্র প্রাপ্ত হই, তাহা তাঁহারা জানিতে সমর্থ হইবেন না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

পাঠকগণ! এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে আমাদিগের একবার ভালরূপ বিবেচনা করা উচিত যে, ইহা আত্মহত্যা, কি খুন, অথবা স্বাভাবিক মৃত্যু। 

প্রথমে ভাবিয়া দেখুন, আত্মহত্যা হইতে পারে, কি না? মৃতার বিছানার উপর একটি বাটি ও কিছু জল-সমেত একটি জলপাত্র ছিল। আত্মহত্যা করিবার অভিপ্রায়ে কোন বিষাক্ত দ্রব্য জলে গুলিয়া এই বাটিতে করিয়া খাওয়া অসম্ভব নহে। কিন্তু হঠাৎ আত্মহত্যা করিবার কারণ কি? যে স্ত্রীলোক দশটা পৰ্য্যন্ত আমোদ-আহ্লাদও গীতবাদ্য করিয়াছে, তাহার হৃদয়ে হঠাৎ এমন কি মর্মান্তিক দুঃখ উদয় হইতে পারে, যাহাতে সে এইরূপে আত্মহত্যা করিবে? ভাল, সে যেন আত্মহত্যাই করিল; কিন্তু সকলের কথা যদি প্রকৃত হয় তাহা হইলে তাহার অলঙ্কারগুলি কি হইল? কোমরের চাবি কোথা হইতে আলমারিতে কিরূপে গমন করিল? এ বড় ‘বিষম সমস্যা’। প্রকৃত আত্মহত্যা হইলেও অবস্থা দেখিয়া আত্মহত্যা স্থির করিয়া লওয়া সহজ নহে। 

যদি আত্মহত্যা না হয়, তবে কি এ খুন? যদি খুন হয়, তাহা হইলে খুন করিবার কারণ নিশ্চয়ই আছে। আর যে সকল কারণ দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, তাহা অপেক্ষা খুনের কারণ, আর অধিক কিছুই হইতে পারে না। ইহা যদি খুন হয়, তাহা হইলে এই খুনের প্রধান উদ্দেশ্য চুরি। এখন দেখা যাউক, কি কি কারণে আমরা ইহাকে খুন বলিতে পারি। 

১ম। দিবা দশটা পৰ্য্যন্ত যে স্ত্রীলোক সুস্থ শরীরে গীতবাদ্য করিতে পারে, তাহার হঠাৎ মৃত্যু হইলে, সেই মৃত্যুতে কাজেই নানাপ্রকার সন্দেহ হয়। 

২য়। মৃতার শরীরে যে সকল অলঙ্কার ছিল, সেই সকল অলঙ্কার কোথায় গেল? মৃত্যুর পূর্ব্বে অলঙ্কারগুলি খুলিয়া সে যদি স্থানান্তরে রাখিয়া থাকে, তাহা হইলে কাণে একটিমাত্র মাড়ি থাকিবে কেন? কোমরে ছিন্ন গোটের কিয়দংশ থাকিবে কেন? বিছানায় মাথার কাঁটা একটিমাত্র পড়িয়া থাকিবে কেন? আর কোমরের চাবি কেন ছিঁড়িয়া লওয়া হইবে, ও সেই চাবি পরিশেষে আলমারিতে লাগান অবস্থায় কেনই বা পাওয়া যাইবে? 

৩য়। যে গৃহের দ্বার ভিতর হইতে বদ্ধ ছিল, সেই গৃহের গলির ভিতরের দ্বার উন্মুক্ত অবস্থায় পাওয়া গেল কেন? 

৪র্থ। আমারি খোলা কেন? তাহার ভিতরস্থিত দ্রব্যাদি অযথাভাবে রাখা কেন? এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কে বলিতে পারে-চুর করিবার অভিপ্রায়ে কেহই সেই গৃহে প্রবেশ করে নাই? 

এই চারিটি বিষয় বিশিষ্টরূপে মনোযোগ পূর্ব্বক দেখিলে সহজেই অনুমান হয়, চাঁপা চোর কর্তৃক হতা হইয়াছে, এবং সেই চোর ইহার অলঙ্কার পত্র এবং মূল্যবান দ্রব্যাদি সমস্তই অপহরণ করিয়া, গলির দ্বার খুলিয়া প্রস্থান করিয়াছে। 

এইরূপ অবস্থায় যদিও মনে মনে স্থির করিলাম, চাঁপা হতা হইয়াছে; তথাপি নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় সকলেরই মনে উদয় হইবার সম্ভাবনা 

১ম। মৃতার শরীরে যখন কোন প্রকার বিশিষ্ট আঘাতের চিহ্ন দেখা যাইতেছে না, তখন কি প্রকারে এই হত্যা সম্পন্ন হইয়াছে? 

২য়। হত্যা করিবার নিমিত্ত চোরে সময়ে সময়ে অস্ত্র ব্যবহার না করিয়া, গলা চাপিয়া মারিয়া পেলে। এইরূপ অবস্থা আমি অনেকবার দেখিয়াছি সত্য; কিন্তু সেই প্রকার হত্যায় মৃতার গলায় চাপিয়া মারার কোন না কোন প্রকার চিহ্ন সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার গলা আমি বিলক্ষণ করিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু সেই প্রকারের কোনরূপ চিহ্ন দেখিতে পাই নাই। গলার স্থানে স্থানে নখের দ্বারা আঁচড়ান কয়েকটিমাত্র চিহ্ন আছে সত্য; কিন্তু সে চিহ্ন দেখিয়া বোধ হয় —গলা চাপিয়া মারিলে সচরাচর যেরূপ চিহ্ন হয়, এ সেরূপ চিহ্ন নহে। ইহা নখের অতি সামান্য আঘাত লাগার চিহ্ন। 

৩য়। যদি গলা চাপিয়াই উহাকে মারিয়া ফেলা হইয়া থাকে, তাহা হইলে চক্ষু মুদিত অবস্থায় কেন? আর উভয় দত্তপংক্তি পরস্পর সংবদ্ধ অবস্থাতেই বা রহিয়াছে কেন? 

৪র্থ। হত্যাকারীর হৃদয়ে হত্যার সময় কি এতই দয়া উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা যে, সে শেষ অবস্থায় চাঁপার মুখে জল প্রদান করিয়াছে? নতুবা মৃতার মস্তকের নিকট বিছানার উপর পানাবশিষ্ট জল থাকারই বা কারণ কি? 

৫ম। পুলিস বিভাগে আমার যতদূর পর্যন্ত অভিজ্ঞতা আছে এবং এইরূপ ধরণের যত মোকদ্দমা আমি সন্ধান করিয়াছি, তাহার মধ্যে কখন দেখি নাই যে, খুন করিয়া চুরি করিবার অভিপ্রায়ে কোন চোর দিবাভাগে চেষ্টা করিয়াছে। লোকজন সমাকীর্ণ রাস্তার ধারে যাহার ঘর, যাহার চতুষ্পার্শ্বে স্ত্রীলোক পরিপূর্ণ সারি সারি খোলার ঘর, দিবাভাগে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিতে, ও পরে বিনাবাধায় সেই গৃহের ভিতর হইতে এবং মৃতার অঙ্গ হইতে দ্রব্যসামগ্রী ও অলঙ্কারাদি চুরি করিতে, এবং সকলের চক্ষুতে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া পলায়ন করিতে সমর্থ হয়, এরূপ সাহসী চোর বা হত্যাকারী এ দেশে সহজে দেখিতে পাওয়া যায় না। 

এতদ্দেশীয় হত্যাকারীগণ সর্ব্বদাই এইরূপ চেষ্টা করিয়া থাকে, যাহাতে তাহারা হত্যাপরাধে সহজে ধৃত না হয়। সুতরাং তাহারা সর্ব্বদাই এরূপ ভাবে কার্য্য করিতে চেষ্টা করে, যাহাতে তাহারা সহজে কাহারও চক্ষুতে বা পুলিশের হস্তে পতিত না হয়। এদিকে দিবাভাগে সকল লোকের কাণের কাছে এরূপ কার্য্য সম্পাদনের চেষ্টা করিলে, হত্যাকারীর নিষ্কৃতি নাই; কারণ, হত্যা করিবার সময় যদি আসন্ন-হতের কণ্ঠ হইতে ঈষৎ অস্ফুট শব্দও বাহির হয়, তখন একবারে অনেক লোকের সমাগম হইবার সম্ভাবনা। সুতরাং সে সময়ে হঠাৎ হত্যাকারীর পলায়নের চেষ্টা করাও নিতান্ত অসাধ্য। এইরূপে ভাবিয়া যাহারা চুরি-ব্যবসায়ী হত্যাকারী, তাহারা রাত্রিকালে প্রায়ই আপন আপন দুষ্ক্রিয়ার চেষ্টা করিয়া থাকে। কারণ, তাহাদিগের মনে এইমাত্র সাহস সৰ্ব্বদা দেখিতে পাওয়া যায় যে, যদি কোন ব্যক্তি তাহাদিগের এইরূপ অসৎকার্য্য সম্পন্ন করিবার সময় জানিতেও পারে, তাহা হইলে রাত্রির অন্ধকারের সহায়তায় তাহারা অনায়াসেই পলায়ন করিলেও করিতে পারে। 

তবে কি স্বাভাবিক মৃত্যুতে উহার মৃত্যু হইয়াছে? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে সেই পুরাতন কথার উত্তর কি? অলঙ্কার-পত্র ও দ্রব্যাদি সমস্ত তবে কোথায় গেল? কেই বা সেই সকল দ্রব্য অপহরণ করিল? 

তবে হইতে পারে, স্বাভাবিক মৃত্যুতে উহার মৃত্যু হইয়াছে, কোন প্রবলরোগে উহার আয়ু শেষ করিয়া দিয়াছে, এবং উহার মৃত্যুর পর কোন ব্যক্তি সুযোগ পাইয়া উহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়াছে। 

যদি আমার এই শেষোক্ত অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে ভিতর হইতে যে সদর দ্বার বদ্ধ ছিল, তাহা সেই ব্যক্তি কি প্রকারে খুলিতে সমর্থ হইল? মৃতদেহ পূর্ব্বে না দেখিয়া কি প্রকারে সে জানিতে পারিল যে, চাঁপা মরিয়া গিয়াছে? আর পূর্ব্বে অবগত না হইয়াই বা সে কি প্রকারে উহার গৃহের ভিতর হইতে আবদ্ধ দ্বার খুলিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে সাহসী হইল? মৃত্যুসংবাদ পুৰ্ব্বে না পাইলে এরূপভাবে চুরি করা সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয় না। 

তবে যে সময়ে চাঁপার মৃত্যু হয়, সেই সময়ে তাহার গৃহে কি অপর কোন ব্যক্তি ছিল? সেই কি অন্তিমকালে উহার মুখে জল প্রদান করিয়াছে? আর চাঁপার জীবনবায়ু শেষ হইলে সুযোগ পাইয়া উহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া গলির দ্বার খুলিয়া পরিশেষে বহির্গত হইয়া গিয়াছে? ইহা নিতান্ত অসম্ভব নহে। 

সম্ভব হউক বা অসম্ভব হউক, কোন বিষয় একবারে সিদ্ধান্ত করা কর্তব্য নহে। এ যে খুন নহে, আত্মহত্যা বা স্বাভাবিক মৃত্যু, তাহাও এই সকল সামান্য কারণের উপর নির্ভর করিয়া বলা সহজ নহে। যাহা হউক, চাঁপা যে প্রকারেই মরিয়া থাকুক, তাহার মৃত্যুর কারণ যাহাই হউক, তাহার অলঙ্কারপত্র মূল্যবান দ্রব্যাদি সমস্ত যে তাহার গৃহ হইতে অপহৃত হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। এখন আমাদিগের কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম—সেই সকল মালের অনুসন্ধান করা। মালের অনুসন্ধান করিতে করিতেই ক্রমে আসল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। যাহাদিগের নিকট হইতে অলঙ্কারাদি বাহির হইবে, তাহাদিগের বক্তব্য বিষয় একান্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলেই, এই ঘটনার যথার্থ অবস্থা জানিতে আর কাহারও বাকি থাকিবে না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

এই বিষয়ের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া আমরা পর পর যে সকল ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহার সারমর্ম্ম পাঠকগণের জানা আবশ্যক বলিয়া, উহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল। ভবনাম্নী যে বারবিলাসিনী বাড়ীওয়ালি থানায় গিয়া প্রথমে সংবাদ প্রদান করিয়াছিল, প্রথমে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। 

প্রশ্ন। তোমার নাম কি? 

উত্তর। আমার নাম ভব বাড়ীওয়ালী। 

প্রশ্ন। চাঁপা তোমার বাড়ীর কতদিবসে ভাড়াটিয়া? 

উত্তর। প্রায় চারি বৎসর পর্য্যন্ত সে আমার বাড়িতে বসবাস করিতেছে। 

প্রশ্ন। যে সকল অলঙ্কারের কথা আমরা পূর্ব্বে জানিতে পারিয়াছি, সেই সকল অলঙ্কার প্রকৃতই কি উহার ছিল?

উত্তর। হাঁ মহাশয়! সেই সকল গহনা উহার ছিল। 

প্রশ্ন। তুমি সৰ্ব্বশেষে সেই সকল গহনা করে দেখিয়াছ? 

উত্তর। আজ দিবা দশটা কি সাড়ে দশটার সময় আমি সেই সকল গহনা তাহার অঙ্গে দেখিয়াছি। 

প্রশ্ন। উহার মৃত্যু-সমাচার কোন সময়ে তুমি প্রথমে জানিতে পারিলে, এবং জানিয়াই বা কি করিলে?

উত্তর। দিবা আন্দাজ বারটার সময় আমি বাড়ীর ভিতর গৃহকার্য্যে ব্যস্ত ছিলাম। সেই সময় বাহিরে হঠাৎ গোলযোগ শুনিতে পাইলাম, শুনিবামাত্র আমি বাহিরে আসিলাম। আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আমার বাড়ীর আরও কয়েকজন ভাড়াটিয়া বাহিরে আসিল। বাহিরে আসিয়া দেখি, চাঁপার গৃহের সম্মুখে গোলযোগ, সেইস্থানে প্রায় কুড়ি পঁচিশজন স্ত্রী-পুরুষ দাঁড়াইয়া আছে। আমরাও এইস্থানে আসিয়া দেখিলাম যে, চাঁপার গৃহের উভয় দ্বার খোলা, এবং চাঁপা তক্তাপোসের উপর মৃত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। বাহির হইতে এই অবস্থা দেখিয়া, আমিও উহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, উহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার কিছুই নাই; আলমারিও খোলা। এই অবস্থা দেখিয়া আমি পুনরায় বাহিরে আসিলাম। সেই স্থানের সকলেই আমাকে থানায় সংবাদ দিতে কহিল। আমিও থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিলাম। 

প্রশ্ন। তুমি প্রথমে যখন চাঁপার গৃহের নিকট গিয়াছিলে, সেই সময়ে উহার গৃহের ভিতর কে ছিল?

উত্তর। তখন আমি কোন ব্যক্তিকেও এই গৃহের ভিতর দেখিতে পাই নাই। 

প্রশ্ন। কাহাকেও গৃহ হইতে বাহির হইতে দেখিয়াছ? 

উত্তর। না। 

প্রশ্ন। আজ চাঁপার গৃহে গীতবাদ্য কিছু হইয়াছিল, শুনিয়াছ? 

উত্তর। আজ প্রাতঃকালে দশটা পর্যন্ত চাঁপার গৃহে গীতবাদ্য হইতেছিল। চাঁপা গাইতেছিল; কিন্তু কে যে বাজাইতেছিল, তাহা জানি না। কারণ, গৃহের দ্বার বন্ধ ছিল, আর আমরা বাড়ীর ভিতরেই ছিলাম। 

প্রশ্ন। তুমি যখন প্রথম বাহিরে আইস, সেই সময়ে কেবলরাম কোথায় ছিল? 

উত্তর। সেই সময়ে কেবলরাম কোথায় ছিল, তাহা আমি দেখি নাই। 

প্রশ্ন। কামিনী, বিধু ও তারামণিকে সেই সময়ে সেই স্থানে দেখিয়াছিলে কি না, মনে করিয়া বলিতে পার?

উত্তর। কামিনী, বিধু ও তারামণিকে আমি সেইস্থানে দেখিয়াছিলাম; কিন্তু প্রথমে আমি যখন বাড়ী হইতে বহির্গত হই, সেই সময়ে উহাদিগকে সেইস্থানে দেখিয়াছি বলিয়া, বোধ হয় না। আমার বোধ হয়, উহারা সেই সময়ে সেইস্থানে ছিল না। 

প্রশ্ন। আমি তোমাকে আর একটিমাত্র কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি কিন্তু তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিও মিথ্যা কথা বলিও না। তুমি যে সকল গহনার কথা বলিলে, তাহা কি প্রকৃতই চাঁপার ছিল? 

উত্তর। আমি মিথ্যা কথা কহি নাই। প্রকৃতই উহার অলঙ্কার ছিল, একথা আমি কেন, এই পাড়ার সকলেই জানেন। রামপোদ্দারের দোকান হইতে এক এক খানি করিয়া গহনাগুলি সে ক্রমে খরিদ করিয়াছিল। বোধ হয়, রামপোদ্দার এখনও তাহার নিকট কিছু টাকা পাইবে। 

প্রশ্ন। তুমি গহনাগুলি যদি পুনরায় দেখিতে পাও, তাহা হইলে চিনিতে পারিবে কি? 

উত্তর। পারিব বই কি, একশত গহনার মধ্য হইতে আমি চাঁপা গহনাগুলি বাছিয়া বাহির করিয়া লইতে পারি। 

ভবকে এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার পর কেবলরামকে ডাকিলাম। কেবলরাম আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম;—

প্রশ্ন। তোমার নাম কি? 

উত্তর। আমার নাম শ্রীকেবলরাম বারিক। 

প্রশ্ন। তুমি কতদিবস এইস্থানে দোকান করিয়াছ? 

উত্তর। প্রায় দুইমাস হইবে। 

প্রশ্ন। ইহার পূর্ব্বে তোমার দোকান কোথায় ছিল? 

উত্তর। হাবড়ায়। 

প্রশ্ন। হাবড়া ছাড়িলে কেন? 

উত্তর। সেইস্থানের অপর পানওয়ালার সহিত আমার বনিবনাও না হওয়ায়, আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া এইস্থানে দোকান করিয়াছি। 

প্রশ্ন। হাবড়ায় তুমি একবার কি মোকদ্দমায় পড়িয়াছিলে? 

উত্তর। আমি কখনও কোন মোকদ্দমায় পড়ি নাই। 

প্রশ্ন। তোমার নাম কেবলরাম বলিলে না? 

উত্তর। হাঁ মহাশয়। 

প্রশ্ন। তবে তুমি কিরূপে বলিতেছ, যে, কখনও তুমি কোন মোকদ্দমায় পড় নাই? 

উত্তর। হাঁ মহাশয়! একবার গোলযোগ হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাহাতে আমার কিছু হয় নাই। 

প্রশ্ন। অপর কিছু হয় নাই, কেবল মেয়াদ হইয়াছিল মাত্র! কি বল—কথা সত্য নয় কি? মনে করিয়া দেখ দেখি, তুমি আমাকে এখন চিনিতে পার কি না? 

উত্তর। না মহাশয়! আমি আপনাকে চিনিতে পারিতেছি না। আমি অপর কোন দোষ করি নাই, মারপিট মোকদ্দমায় একবার মেয়াদ হইয়াছিল মাত্র। 

প্রশ্ন। মারপিট মোকদ্দমায়, না চুরি মোকদ্দমায়? খামকা এখনও কেন মিথ্যা বলিয়া ত্যক্ত করিতেছ? ঈশ্বর কি তোমাকে সত্য কথা বলিতে শিখান নাই? 

উত্তর। ভাবিয়াছিলাম, আপনি জানেন না। তাই মিথ্যা কথা বলিতেছিলাম, আর মিথ্যা কথা বলিব না। চুরি মোকদ্দমাতেই আমার জেল হইয়াছিল। 

প্রশ্ন। আচ্ছা এখন বুঝিব, তুমি সত্য কথা বলিতেছ, কি না। এখন বল দেখি, কোথা হইতে কি চুরি করায় তোমার জেল হয়? 

উত্তর। একটি স্ত্রীলোকের গৃহ হইতে তাহার অলঙ্কার চুরি করার অপরাধে আমার ছয়মাস জেল হয়। 

প্রশ্ন। আচ্ছা, এখন তুমি এই বৰ্ত্তমান ঘটনা সম্বন্ধে কি জান, প্রকৃতকথা বল। 

উত্তর। আমি সবিশেষ কিছুই জানি না। অদ্য দিবা আন্দাজ বারটার সময় একটি লোক আসিয়া আমাকে কহিল, আমি চাঁপার গৃহে যাইবার নিমিত্ত উহাকে অনেক ডাকিলাম, কিন্তু চাঁপা কোনক্রমেই দ্বার খুলিতেছে না।” এই কথা শুনিয়া আমি তাহার সহিত চাঁপার গৃহের নিকট গমন করিলাম; তাহাকে বারম্বার ডাকিলাম, কিন্তু উত্তর পাইলাম না। পরিশেষে গলির দ্বারের নিকট গমন করিয়া দেখি, সেই দ্বার খোলা। সেইস্থান হইতে দেখিতে পাইলাম, চাঁপা মরিয়া গিয়াছে। আমি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করি নাই। চাঁপার সেই অবস্থা দেখিয়া তখন আমরা বাহিরে আসিলাম। কামিনী, বিধু ও তারামণিকে সম্মুখে দেখিতে পাইলাম। তাহাদিগকে বলিবামাত্র তাহারা গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল ও সদর দ্বার খুলিয়া দিল। তাহার পর ক্রমে পথের উপর জনতা হইতে আরম্ভ হইল। ভব প্রভৃতি সকলেই ক্রমে বাটির বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইল। ক্রমে আপনারা সকলে আসিয়াও এখানে উপস্থিত হইলেন। আমি জানি মহাশয়। 

প্রশ্ন। যে ব্যক্তি চাঁপার গৃহে গমন করিতে চাহিয়াছিল তাহার নাম কি? 

উত্তর। তাহার নাম আমি অবগত নহি। 

প্রশ্ন। সে থাকে কোথায়? 

উত্তর। তাহাও আমি জানি না। 

প্রশ্ন। তুমি তাহাকে তবে একবারে চেনই না? 

উত্তর। না মহাশয়! সে আমার পরিচিত নহে। 

প্রশ্ন। সে কোন্ প্রদেশীয় লোক? হিন্দু না মুসলমান, বাঙ্গালী না হিন্দুস্থানী? 

উত্তর। সে হিন্দু। তাহাকে বাঙ্গালী বলিয়া বোধ হয়। 

প্রশ্ন। তুমি বলিতেছ—সে বাঙ্গালী; কিন্তু অপর যাহারা তাহাকে দেখিয়াছে, তাহারা সকলে উহাকে হিন্দুস্থানী কি প্রকারে বলিতেছে? 

উত্তর। সে হিন্দুস্থানী হইলেও হইতে পারে; কিন্তু দেখিতে ঠিক বাঙ্গালীর মত। 

প্রশ্ন। সে তোমার অপরিচিত বলিলে, না? যদি সে তোমার অপরিচিতই হইবে, তাহা ইহলে তুমি তোমার দোকান—পত্র ফেলিয়া অপরিচিতের সঙ্গে গমন করিয়াছিলে একথা কে বিশ্বাস করিবে? 

উত্তর। আপনারা বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, আমি কিন্তু তাহার সহিত গমন করিয়াছিলাম। 

প্রশ্ন। তুমি যখন সেই অপরিচিত লোকের সঙ্গে চাঁপার গৃহে গমন করিয়াছিলে, সেই সময় তোমার দোকানে যে ব্যক্তি বসিয়াছিল, তাহার নাম কি? 

উত্তর। সেই সময়ে দোকানে অপর কেহই ছিল না। 

প্রশ্ন। তুমি দেখিতেছি, বড় মিথ্যাবাদী। তোমার দোকানের নিকটবর্তী সকলেই বলিতেছে যে, সেই সময়ে তোমার দোকানে আর একজন লোক ছিল। 

উত্তর। আমার দোকানে কেহই ছিল না। দোকানের নিকট একজন লোক দাঁড়াইয়াছিল সত্য সে এক পয়সার পান খরিদ করিতে আসিয়াছিল। 

প্রশ্ন। তাহার নাম কি? 

উত্তর। তাহার নাম প্রেমধারী। 

প্রশ্ন। প্রেমধারী কোথায় থাকে? 

উত্তর। বড়রাস্তার উপর দত্তবাবুদের বাড়ীর সে দরওয়ান। 

প্রশ্ন। যখন সেই অপরিচিত ব্যক্তি তোমার নিকট আসিয়াছিল, তখন প্রেমধারী তাহাকে দেখিয়াছিল? 

উত্তর। বোধহয় দেখিয়া থাকিবে। 

প্রশ্ন। চাঁপার বাড়ী হইতে যখন তুমি তোমার দোকানে ফিরিয়া যাও, তখন প্রেমধারী সেইস্থানে উপস্থিত ছিল?

উত্তর। আমি ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে দেখিতে পাই নাই। 

প্রশ্ন। তোমার নিকট হইতে সংবাদ পাইয়া কামিনী, বিধু, ও তারামণির মধ্যে কে অগ্রে চাঁপার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল? 

উত্তর। উহারা সকলেই একবারে প্রবেশ করিয়াছিল। 

এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া সেই সময়ের জন্য উহার জবানবন্দী শেষ করিলাম, এবং অপর আরএকজন কর্ম্মচারীর সহিত উহাকে প্রেমধারীর থাকিবার স্থান দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। কর্ম্মচারীর উপর বিশিষ্ট আদেশ রহিল যে, কেবলরাম কোন প্রকারে প্রেমধারীর সহিত কথা কহিতে না পারে। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

কেবলরাম চলিয়া গেলে, প্রথমে ডাকিলাম—কামিনীকে। 

প্রশ্ন। তোমার নাম কি? 

উত্তর। আমার নাম কামিনী। 

প্রশ্ন। চাঁপার মৃত্যু-সংবাদ তুমি প্রথমে কাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হও? 

উত্তর। খিলিওয়ালার নিকট হইতে। 

প্রশ্ন। যখন তুমি এই সংবাদ প্রাপ্ত হও, তখন তুমি কোথায় ছিলে? 

উত্তর। আমি রাস্তার উপর বসিয়াছিলাম। 

প্রশ্ন। সেই সময় তুমি একলা ছিলে, কি অপর কেহ তোমার নিকট ছিল?

উত্তর। বিধু ও তারামণি সেইস্থানে উপস্থিত ছিল।

প্রশ্ন। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র তোমরা কি করিয়াছিলে?

উত্তর। আমরা চাঁপাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। প্রশ্ন তুমি সকলের অগ্রে গৃহের ভিতর গিয়াছিলে না?

উত্তর। না মহাশয়! আমি গৃহের ভিতর যাই নাই। 

প্রশ্ন। কে গৃহের ভিতর গিয়াছিল? 

উত্তর। বিধু কি তারামণি, ইহাদের মধ্যে কে যে প্রথমে গৃহের ভিতর গিয়াছিল, তাহা ঠিক আমার মনে নাই।

প্রশ্ন। তুমি নিশ্চয় বলিতেছ যে, তুমি একবারে গৃহের ভিতর প্রবেশ কর নাই? 

উত্তর। না, আমি গৃহের ভিতর যাই –নাই। 

প্রশ্ন। আচ্ছা, মনে করিয়া বলিতে পার যে, তোমরা কে চাঁপার গৃহের সদর দ্বার খুলিয়াছিলে? 

উত্তর। আমি সদর দ্বার খুলি নাই। আমি যখন চাঁপার গৃহের নিকট গমন করিয়াছিলাম, সেই সময়ে সদর দ্বার খোলা ছিল। 

প্রশ্ন। যে সকল খিলিওয়ালা তোমাকে প্রথম সংবাদ প্রদান করে, সেই সময়ে তাহার সহিত তুমি আর কোন ব্যক্তিকে দেখিয়াছিলে কি? 

উত্তর। আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। খিলিওয়ালার সহিত আর কেহ ছিল বলিয়া আমার বোধ হয় না। 

প্রশ্ন। তুমি ত চাঁপার গৃহের সম্মুখেই বসিয়াছিলে; বলিতে পার, উহার গৃহের দ্বার কে খুলিয়াছিল?

উত্তর। আমি ঐ দ্বার কাহাকেও খুলিতে দেখি নাই। কিন্তু আমার বোধ হয়, খিলিওয়ালাই প্রথমে দ্বার খুলিয়াছিল। কামিনীকে এই কয়েকটিমাত্র কথা জিজ্ঞাসা করার পর ডাকিলাম বিধুকে। 

প্রশ্ন। তুমি কাহার নিকট চাঁপার মৃত্যু-সংবাদ প্রথম শুনিতে পাও? 

উত্তর। আমি আমার গৃহের ভিতর ছিলাম, রাস্তার গোলযোগ শুনিয়া আমি বাহিরে আসিয়াছিলাম। কাহার নিকট যে আমি এই সংবাদ শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহা আমি বলিতে পারিব না। 

প্রশ্ন। তুমি যখন তোমার গৃহের ভিতর ছিলে, সেই সময়ে কামিনী ও তারামণি কোথায় ছিল? 

উত্তর। উহারা যে কোথায় ছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি আমার গৃহ হইতে বাহিরে আসিলে উহাদিগকে রাস্তার উপর দেখিতে পাই। 

প্রশ্ন। তুমি যে তোমার গৃহের ভিতর ছিলে, একথা আমি কি প্রকারে বিশ্বাস করি? কে বলিবে যে, সেই সময়ে তুমি তোমার গৃহের ভিতর ছিলে? 

উত্তর। আমি যে সেই সময়ে আমার গৃহের ভিতর ছিলাম, তাহার প্রমাণ আছে। গোয়াবাগানের রামবাবু সেই সময়ে আমার গৃহে উপস্থিত ছিলেন। 

প্রশ্ন। রামবাবু তোমার কে হয়? 

উত্তর। তিনি আমার কেহ হয়েন না, আমার পরিচিত মাত্র। 

প্রশ্ন। রামবাবু এখন কোথায়? 

উত্তর। সেই সময় তিনি এইস্থান হইতে চলি: গিয়াছেন। এখন যে কোথায় আছেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। বোধ হয়, তাঁহার বাড়ীতেই থাকিতে পারেন। 

এ কয়েকটি কথা বিধুকে জিজ্ঞাসা করিয়া একজন কর্মচারীর সহিত তাহাকে রামবাবুর গৃহ দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। তখন তারামণিকে ডাকিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—

প্রশ্ন। তারমণি! তুমি এ সম্বন্ধে কি জান, বল দেখি? 

উত্তর। আমি ইহার কিছুই জানি না। 

প্রশ্ন। চাঁপার মৃত্যু-সংবাদ তুমি প্রথমে কখন ও কাহার নিকট শুনিতে পাইয়াছিলে? 

উত্তর। আমি আমার গৃহে শুইয়াছিলাম। গোলমাল শুনিয়া যখন আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন শুনিতে পাইলাম যে, চাঁপা মরিয়া গিয়াছে বলিয়া চারিদিকে মহা গোলযোগ হইতেছে। সেই সময় আমি আমার গৃহ হইতে বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, রাস্তায় অনেক লোকের গোলযোগ। জমাদার পাহারাওয়ালায় এইস্থান একবারে পরিপূর্ণ। 

প্রশ্ন। পুলিস আসিবার পূর্ব্বে তুমি গৃহের বাহিরে আইস নাই। 

উত্তর। না মহাশয়। 

প্রশ্ন। তুমি যে তোমার গৃহে সেই সময়ে শয়ন করিয়া ছিলে একথা আর কেহ জানে?

উত্তর। আর কেহ জানে কি না, তাহা আমি জানি না। 

এই কয়েকটি কথা তারামণিকে জিজ্ঞাসা করিয়া তাহাকে বিদায় দিলাম, ও সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম, কাহার কথা বিশ্বাস করি? খিলিওয়ালা যে প্রকার কহিল, তাহাতে এই স্ত্রীলোক তিনটিই চাঁপার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল; কিন্তু স্ত্রীলোক তিনটি তিন প্রকার কহিল। এরূপ অবস্থায় ইহাদিগের কথা কাহারও বিশ্বাস করা যুক্তিসঙ্গত নহে। সেইস্থানে বসিয়া যখন আমি এই প্রকার ভাবিতেছি, সেই সময় প্রেমধারী দ্বারবান্ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলামঃ—

প্রশ্ন। তোমার নাম প্রেমধারী? 

উত্তর। আমার নাম প্রেমধারী সিংহ। 

প্রশ্ন। আজ তুমি কি এই খিলিওয়ালার দোকানে আসিয়াছিলে? এবং কি জন্যই বা আসিয়াছিলে?

উত্তর। হাঁ মহাশয়! আজ আমি এক পয়সার পান খরিদ করিবার নিমিত্ত ইহার দোকানে আসিয়াছিলাম।

প্রশ্ন। যে সময়ে তুমি খরিদ করিতে গিয়াছিলে, সেই সময়ে উহার দোকানে আর কোন ব্যক্তি গিয়াছিল কি?

উত্তর। একটি বালক গিয়াছিল। 

প্রশ্ন। সে কি নিতান্ত বালক? 

উত্তর। না, নিতান্ত বালক নহে। তাহার বয়স বোধ হয় পনর ষোল বৎসর হইবে। 

প্রশ্ন। সে কোন্ দেশীয় লোক? 

উত্তর। সে পশ্চিম-দেশবাসী। 

প্রশ্ন। তাহার সঙ্গে খিলিওয়ালার যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা মনে করিয়া বিস্তারিতরূপে বল দেখি।

উত্তর। সেই লোকটি খিলিওয়ালার দোকানে আসিলেই খিলিওয়ালা তাহাকে দেখিবামাত্র কহিল, “কি করে খেদেরণ! কোথা হইতে?” খিলিওয়ালার কথা শুনিয়া সে কহিল ‘বেড়াইতে বেড়াইতে এইদিকে আসিয়াছিলাম। ভাবিলাম একবার চাঁপার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যাই; কিন্তু চাঁপার গৃহের নিকট দাঁড়াইয়া তাহাকে এত ডাকিলাম, কোন প্রকারে তাহার উত্তর পাইলাম না। সে ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া নিদ্রা যাইতেছে বোধ হয়।” তারপর এই কথা শুনিবামাত্র খিলিওয়ালা কহিল, “চল দেখি, চাপা কেমন ঘুমাইয়া আছে দেখি।” এই বলিয়া উভয়েই প্রস্থান করিল। আমি পানের নিমিত্ত সেইস্থানে দাঁড়াইয়াছিলাম; যাইবার সময় খিলিওয়ালা আমাকে বলিয়া গেল, ‘তুমি একটু দাঁড়াও, আমি এখনই আসিতেছি।’ আমি সেইস্থানে দাঁড়াইয়া রহিলাম, কিন্তু উহারা আর কেহই প্রত্যাগমন করিল না। এইরূপে প্রায় একঘণ্টাকাল আমি সেইস্থানে দাঁড়াইয়া থাকিয়া, পরিশেষে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। এইমাত্র আমি অবগত আছি, ইহার অধিক আমি আর কিছুই জানি না। 

প্রেমধারীকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন ভাবিয়া, তাহাকে বিদায় দিলাম। খিলিওয়ালা প্রেমধারীর সমস্ত কথা শ্রবণ করিল। 

সেই সময় রামবাবুও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি বিধুকে চিনেন, এবং মধ্যে মধ্যে তাহার নিকট আসিয়াও থাকেন। কিন্তু গত দুই দিবস ইহতে তিনি একবারে এদিকে আগমন করেন নাই। সেই দিবস বিধুর গৃহে তাহার আসা সম্বন্ধে বিধু যাহা বলিয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

কেবলরামের কথা শুনিয়া আমার মনে নানাপ্রকারের সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতেছিল। এখন আবার প্রেমধারীর নিকট হইতে যাহা অবগত হইতে পারিলাম, তাহাতে সেই সন্দেহ আরও দৃঢ়ীভূত হইল। এখন মনে হইতে লাগিল, কেবলরাম ও খেদেরণ উভয়ে পরামর্শ করিয়া চাঁপাকে হত্যা করিয়াছে; তাহার সমস্ত অলঙ্কারগুলি উহারাই অপহরণ করিয়াছে। আরও মনে হইল যে, খেদেরণ কেবলরামের কোন আত্মীয় বা বিশিষ্ট বন্ধু হইবে। অপহৃত অলঙ্কার পত্র তাহার নিকট রাখিয়াছে বলিয়া, কেবলরাম কোনক্রমেই তাহার নাম প্রকাশ করিতেছে না, এবং তাহার ঠিকানাও বলিয়া দিতেছে না। এমন কি প্রেমধারী যখন তাহার নাম বলিল, যখন সে দেখিল, আমরা সকলেই তাহার নাম জানিতে পারিলাম, তখন পর্যন্তও সে সে বিষয়ের কোন কথা স্বীকার করিল না; অধিকন্তু কহিল যে, প্রেমধারী মিথ্যা কথা কহিতেছে। 

প্রেমধারীর কথা যদি সত্যি হয়, তাহা হইলে যখন উভয়েই একত্র গমন করিয়াছে, এবং শীঘ্র প্রত্যাগমন করিবে বলিয়া প্রায় একঘণ্টাকাল বিলম্ব করিয়াছে, তখন কি প্রকারেই বা বিশ্বাস করিব যে, এই হত্যা এই উভয় ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই? 

আবার এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের দ্বারা এরূপ ভাবে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হওয়া সহজ নহে জানিয়াও, কি প্রকারে কেবলরামের কথা বিশ্বাস করিয়া, তিনটি স্ত্রীলোকের দ্বারা যে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা স্থির করিয়া লই? 

এই ঘটনা সম্বন্ধে সেই স্ত্রীলোক তিনটির কোন প্রকার দোষ আছে কি না, তাহাও স্থির করা নিতান্ত সহজ নহে। তাহাদিগের তিনজনের কথা শুনিয়া কোন বিষয় স্থির করিতে পারিতেছি না। যখন দেখিতেছি, তিনজনেই তিন প্রকারের কথা বলিতেছে, তখন কাহার কথা সত্য, কাহার মিথ্যা, তাহা স্থির করিই বা কি প্রকারে? 

এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা ভাবিয়া পরিশেষে স্থির করিলাম, কেবলরাম ও তাহার সহচর খেদেরণ কর্তৃকই এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে; স্ত্রীলোকগণ ভয় পাইয়া কি বলিতে কি বলিতেছে। এখন খেদেরণের অনুসন্ধান করাই আমাদিগের প্রধান কার্য্য স্থির করিলাম; কিন্তু কি প্রকারে খেদেরণের অনুসন্ধান পাইতে পারিব, ভাবিয়া তাহার কোনরূপ উপায় হঠাৎ স্থির করিতে পারিলাম না। 

কেবলরামের দোকানে থাকিবার স্থান প্রভৃতি উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু অপহৃত দ্রব্যের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। 

কামিনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকত্রয়ের উপর এই বিষয়ের সন্দেহ যদিও পরিত্যাগ করিলাম, তথাপি তাহাদিগকে একবারে পরিত্যাগ করিলাম না। তাহাদিগকে একজন কর্মচারীর জিন্মায় একস্থানে রাখিয়া দিলাম। 

খেদেরণের সন্ধান পাইবার আর কোন প্রকার উপায় না দেখিয়া কেবলরামের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং তাহার দেশীয় ব্যক্তিগণ যে যে স্থানে আছে, তাহাদিগকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে লাগিলাম, এবং তাহাদিগের নিকট ইহতে অপর যে সকল লোকের নাম পাইতে লাগিলাম, ক্রমে তাহাদিগকেও খুঁজিয়া বাহির করিলাম। কিন্তু খেদেরণ যে কে, তাহার কোন সন্ধান সে দিবস প্রাপ্ত হইলাম না। ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া পড়িল, অনন্যোপায় হইয়া ঘটনাস্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। 

সেই নিশীথরাত্রিতে সেইস্থানে প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলাম যে, তখনও সেই স্ত্রীলোক তিনটি সেইস্থানে রক্ষিত আছে। উহাদিগকে দেখিয়া ভাবিলাম, যখন ইহারা নানাপ্রকারের কথা বলিয়াছে, তখন ইহাদিগের থাকিবার স্থান প্রভৃতি সমস্ত সন্ধান করিয়া দেখা মন্দ নহে। এই ভাবিয়া এক এক করিয়া তিনজনের গৃহ উত্তমরূপে দেখিলাম, তাহাদিগের বাক্স, পেটরা প্রভৃতি সমস্তই দেখিলাম। কিন্তু কাহারা গৃহে কোনরূপ দ্রব্য প্রাপ্ত হইলাম না, কেবল তারামণির বাক্সের ভিতর হইতে একজোড়া সোণার বালা বাহির হইল। তারামণিকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, এ বালা তাহার। কিন্তু ভব-বাড়ীওয়ালি ও তাহার বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়া প্রভৃতি সকলে কহিল, ‘এ বালা চাঁপার। এই প্রকার কথা শুনিয়া প্রথমে কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। পরিশেষে রামপোদ্দার আসিয়া সেই সন্দেহ মিটাইয়া দিল; সে কহিল এই ‘বালা’ সে চাঁপাকে প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিল। উহা চাঁপার বালা। এই বালা ওজন করিয়া দেখা গেল, রামপোদ্দারের খাতায় চাঁপার বালায় যে ওজন লেখা ছিল, সেই ওজনের সহিত এই বালার ওজনও মিলিয়া গেল। 

এই বালা যে চাঁপার বালা, তারামণি কিন্তু কোনক্রমেই সে কথা স্বীকার করিল না। সে বারম্বার কহিতে লাগিল, এ বালা তাহার। বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়ামাত্রই কিন্তু কহিল, তাহারা তারামণির নিকট এ বালা কখন দেখে নাই। বালা পাইবার পর আমরা বিষম গোলে পড়িলাম। ভাবিলাম, কেবলরাম ও খেদেরণের উপর আমরা যে সন্দেহ করিয়া আসিতেছি, তাহা কি তবে মিথ্যা? চাঁপাকে হত্যা করা সম্বন্ধে তবে কি তাহারা কিছুই অবগত নহে? তারামণিই কি তবে এই হত্যার নায়িকা? তাহার দ্বারাই কি তবে এই নৃশংস হত্যাকাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে? 

আবার ভাবিলাম, যদি তারামণির দ্বারাই এই কাৰ্য্য হইয়া থাকে, অলঙ্কারের লোভে যদি সে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়া থাকে, তাহা হইলে কেবল একজোড়া বালা তাহার বাক্সের ভিতর পাওয়া গেল, কিন্তু অপর অলঙ্কারগুলি সে কি করিল? অপহৃত দ্রব্য সকল যদি সে লুকাইয়া রাখিয়া থাকে, তাহা হইলে বালা অপহৃত জানিয়াও সে লুকাইয়া রাখিল না কেন? এইরূপ নানা প্রকার ভাবিতে ভাবিতে রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল। সে রাত্রিতে আর অধিক কোন কার্য্য করিতে সমর্থ হইলাম না। সেইস্থানে বসিয়া থাকিতে থাকিতেই রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

তারামণি যে বাড়ীতে থাকে, সেই বাড়ীর অপর আর একটি স্ত্রীলোকের নিকট হইতে পরদিবস প্রাতঃকালে অবগত হইলাম—যে সময় চাঁপার মৃত্যুজনিত গোলযোগ হয়, সেই সময়ে তারামণির গৃহে একজন পুরুষ মানুষ বসিয়াছিল। তারামণি বাহির হইতে যেমন ভিতরে আসিল, এই পুরুষটি অমনি তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিল। আরও জানিতে পারিলাম, পুরুষটি কে এবং কোথায়ই বা তাহার বাসস্থান; ক্রমে সন্ধান করিয়া আমি তাহার বাড়ী খুঁজিয়া বাহির করিলাম। কিন্তু সেইস্থানে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম যে, যাহার সন্ধানে আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সে এই ঘটনার দুইদিবস পূৰ্ব্ব হইতে কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনার দেশে চলিয়া গিয়াছে। তাহার সহিত আরও যে যে ব্যক্তি গমন করিয়াছিল, তাহাদের নিকট অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে, বাস্তবিকই সে কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক দেশে গমন করিয়াছে। 

শঠের শঠতার ভিতর প্রবেশ করা নিতান্ত সহজ নহে। সন্ধান করিয়া পরিশেষে জানিতে পারিলাম, যে স্ত্রীলোকটি আমাকে এই সংবাদ প্রদান করিয়াছিল, কোন কারণবশতঃ তাহার সহিত সেই লোকটির একটু মনোবিবাদ ছিল। সেই মনোবিবাদের প্রতিশোধ লইবার নিমিত্ত, এই মিথ্য কথার অবতারণা করিয়া তাহাকে বিপজালে জড়ীভূত করিবার অভিপ্রায়ে আমাকে এই সংবাদ প্রদান করিয়াছে। পরিশেষে যখন সে জানিতে পারিল যে, অনুসন্ধানে তাহার সংবাদ মিথ্যায় পরিণত হইয়াছে, তখন হইতে আর তাহাকে আমি দেখিতে পাইলাম না। 

প্রাতঃকাল সাতটার সময় এই অনুসন্ধান করিয়া যখন আমি প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, সেই সময় প্রসন্ননাম্নী একটি স্ত্রীলোকের সহিত হঠাৎ আমার সাক্ষাৎ হইল। ইহার সহিত পূর্ব হইতে আমার জানা-শুনা না থাকিলেও আমাকে দেখিয়া সে কহিল, “মহাশয়! আমি আপনার নিকটই গমন করিতেছিলাম। রাস্তায় আপনার সহিত আমার সাক্ষাৎ হওয়াতে ভালই হইয়াছে। কাল বিধু আমার নিকট এই গহনাগুলি রাখিয়াছিল; বলিয়া দিয়াছিল, যে পৰ্য্যন্ত আমি ইহা না লইয়া যাই, সেই পর্য্যন্ত তুমি আর কাহাকেও ইহা দিও না, এবং কাহাকেও ইহার কথা বলিও না। কিন্তু আমি শুনিলাম, সে কি গোলযোগে পড়িয়াছে। এ কিসের গহনা আমি জানি না। কি জানি, ইহার নিমিত্ত যদি আমার কোনরূপ বিপদ্ ঘটে, এই ভয়ে ইহা লইয়া আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আপনি ইহা গ্রহণ করিয়া যাহা কৰ্ত্তব্য হয়, তাহা করুন। এই বলিয়া একগাছি সোণার অনন্ত আমার হস্তে প্রদান করিল। 

এই তানন্ত ভবকে দেখাইলাম। সে উহা দেখিবামাত্র কহিল, এ অনন্ত চাঁপার। ভবর বাড়ির অন্যান্য স্ত্রীলোকগণ ও কহিল এ অনন্ত তাহারা চিনে, ইহা চাঁপার অনন্ত। 

এতক্ষণ পর্যন্ত তারামণির উপরই সন্দেহ ছিল, এখন আবার বিধুর উপরও সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। বিধুকে জিজ্ঞাসা করিয়া সে অনন্তের কথা অস্বীকার করিল ও কহিল, “প্রসন্ন মিথ্যা কথা কহিতেছে। আমি প্রসন্নকে চিনি সত্য; কিন্তু আমি তাহার নিকট এই অনন্ত বা অন্য কোন অলঙ্কার রাখি নাই।” 

স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, বিধু মিত্যা কথা কহিতেছে। আরও বুঝিলাম, যে ব্যক্তি প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্যন্ত অনবরত মিথ্যা বলিয়াছে, এবং এখন পর্যন্তও বলিতেছে, তাহার নিকট হইতে সত্য কথা বাহির করা নিতান্ত সহজ নহে। 

কেবলরাম দেখিল, যে মোকদ্দমায় আমরা তাহাকে সন্দেহ করিয়া অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছি, ও তাহার নিকট হইতে যে সকল অপহৃত দ্রব্যাদি পাইবার প্রত্যাশায় সবিশেষ পরিশ্রম ও চেষ্টা করিতেছি, সেই মোকদ্দমায় সেই দ্রব্য সকলের কিয়দংশ তারামণি ও বিধুর নিকট হইতে পাওয়া গেল। এতক্ষণ কেবলরামের মুখে কথা ছিল না, কিন্তু এখন তাহার মুখ ফুটিল। সে সতেজে বলিতে লাগিল, “মহাশয়! এখন আপনারা জানিতে পারিলেন, আমি অপরাধী, কি না। নিরপরাধকে এতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা নিরর্থক কষ্ট দিয়া আসিতেছেন এবং কোন প্রকারেই বিশ্বাস করিতেছেন না যে, আমা-কর্তৃক এই কাৰ্য্য কখনই সম্পন্ন হয় নাই। এখন ত আপনারা দেখিলেন যে, আমি দোষী কি নির্দোষ। এখন আমাকে আর কেন কষ্ট দেন, আমাকে ছাড়িয়া দিন, আমি আমার কাজকর্ম্মের চেষ্টা দেখি। আমি দরিদ্র নিরপরাধ দরিদ্রের উপর আর অত্যাচার করিবেন না। এখন যাহাদিগকে দোষী বলিয়া জানিতে পারিতেছেন, তাহাদিগকে লইয়া অনুসন্ধান করুন, এবং আমাকে এ মোকদ্দমা হইতে ছাড়িয়া দিন। 

কেবলরামের এই কথা আমার ভাল লাগিল না, আমি তাহাকে কহিলাম, “দেখ, কেবলরাম! যে পর্য্যন্ত সমস্ত অলঙ্কার অপরের নিকট হইতে পাওয়া না যাইবে, সে পর্য্যন্ত আমি কোন প্রকারেই তোমাকে অব্যাহতি প্রদান করিতে সমর্থ হইব না। তুমি এখন যতই আপনার নির্দোষিতা প্রমাণের চেষ্টা কর না কেন, আর যতই তুমি আপনাকে নিতান্ত সাধু বলিয়া পরিচয় দেও না কেন, আমি কিন্তু কিছুতেই ইহা বিশ্বাস করিতে পারিব না যে, তুমি ইহার বিন্দুবিসর্গমাত্রও অবগত নহ।” 

এই বলিয়া কেবলরামকে নিরস্ত করিলাম সত্য; কিন্তু মনের সন্দেহ মিটিল না। এ বিষয়ে কে দোষী, কে নির্দোষ, তাহা একান্তমনে চিন্তা করিলাম বটে, কিন্তু সেই চিন্তার কোনরূপ নির্দিষ্ট ফল পাইলাম না। কে অপরাধী, আর কেই বা নিরপরাধ, তাহা কোনরূপেই স্থির করিতে না পারিয়া, সকলের বিপক্ষেই অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম। কামিনীর নিকট অলঙ্কার প্রভৃতি কিছুই প্রাপ্ত হই নাই, কিন্তু এবার কামিনীকেও পরিত্যাগ করিলাম না। সকলকেই পৃথক পৃথক বসাইয়া পৃথক পৃথকরূপে নানাপ্রকার কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। কখন কামিনীকে কহিলাম, “বিধ সমস্ত কথা বলিয়া দিয়াছে, তুমি কিছু বলিবে কি না?” কখন বা বিধুকে কহিলাম, “তারামণি সকল কথা স্বীকার করিয়াছে, তুমি অস্বীকার করিলে আর কি হইবে?” কখন বা তারামণিকে কহিলাম, “বিধু ও কেবলরাম আর কোন কথাই গোপন করিতেছে না, সমস্ত কথা স্পষ্ট করিয়া বলিতেছে। এইরূপে সকলকে নানাপ্রকারে বঞ্চনা করিবার নিমিত্ত, নানাপ্রকার উপায় বাহির করিলাম। কিন্তু কেহই কিছু বলিল না, কেহই কোন কথা স্বীকার করিল না, কেবল কামিনীকে যেন একটু নরম নরম বোধ হইতে লাগিল। বোধ হইল, সে যেন একটু অধিক ভীতা হইয়াছে। 

কেবলরামকে কহিলাম, “এখন আর তোমার কি বলিবার আছে? খেদেরণকে আমরা বাহির করিয়াছি। সে যেরূপ কথা বলিতেছে, তাহাতে আর তোমার বাঁচিবার উপায় দেখি না। এখনও যদি তুমি সকল কথা স্বীকার কর, তাহা হইলেও তোমার পক্ষে কতক মঙ্গল, নতুবা এ যাত্রা তোমার আর কিছুতেই রক্ষা নাই!” 

আমার কথা শুনিয়া কেবলরাম কহিল, “খেদেরণ কি বলিতেছে? আমার সম্মুখে আসিয়া বলুক, তাহা হইলে আপনারা বুঝিতে পারিবেন যে, সে সত্য বলিতেছে, কি মিথ্যা বলিতেছে।” 

“সময়ে আমি খেদেরণকে তোমার সম্মুখেই আনিব” এই বলিয়া কেবলরামের নিকট হইতে চলিয়া আসিলাম।

ভাবিলাম, যেরূপ গতি দেখিতেছি, তাহাতে সহজে অপর কাহারও নিকট হইতে কোন কথা বাহির হইবার সম্ভাবনা নাই; কেবলমাত্র কামিনী যদি কোন কথা বলে। আরও ভাবিলাম, আমরা কামিনীকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিব না; যাহার কথা সে বিশ্বাস করিতে পারে, এইরূপ কোন ব্যক্তিকে যদি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে সমর্থ হই, তাহা হইলে বোধ হয়, তাহার নিকট কামিনী মনের কথা বলিলেও বলিতে পারে। এই ভাবিয়া কামিনীর সহিত যাহার সবিশেষ হৃদ্যতা আছে, এইরূপ এক ব্যক্তির সন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, শোভাবাজারের হরিনাথ দত্ত নামক একটি লোকের দ্বারা কামিনী প্রতিপালিতা। হরিনাথ মাসে মাসে দশ টাকা করিয়া কামিনীকে প্রদান করিয়া থাকে, এবং প্রায় প্রত্যহই দুই এক ঘণ্টা কামিনীর গৃহে অতিবাহিত করে। হরিনাথের ঠিকানা পাইয়া একজন কর্মচারীকে হরিনাথের নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। হরিনাথ সে সময় গৃহেই ছিল। ডাকাইবামাত্র সে আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। 

হরিনাথ আমার নিকট আসিবামাত্র তাহাকে চিনিলাম। দেখিলাম, হরিনাথ আমার, পূর্ব্ব-পরিচিত। আমার মনের কথা স্পষ্ট করিয়া হরিনাথকে কহিলাম, আরও কহিলাম “তুমি ভাল করিয়া কামিনীকে বুঝাইয়া বল, সে সমস্ত কথা আমার নিকট অকপটে প্রকাশ করুক। যদি সে নিজেও কোন দোষ করিয়া থাকে, তাহা হইলে আমি তাহাকে তাহার সে অপরাধ হইতে পরিত্রাণ দিবার উপায় করিব, দেখিব যাহাতে তাহার কোনরূপ বিপদ্ না ঘটে। আমি কিন্তু প্রকৃতকথা জানিতে চাহি। ভাল হউক, মন্দ হউক, বা সে দোষী হউক বা নির্দোষীই হউক, আমার নিকট যেন কোন কথা গোপন না করে। চাঁপার মৃত্যু সম্বন্ধে যে কি রহস্য আছে, বা কে তাহাকে হত্যা করিয়াছে, একথা যদি কামিনী আমাকে সবিশেষ বলিয়া দিতে পারে, তাহা হইলে তাহার কোন প্রকার অনিষ্ট ত হইবেই না, বিশেষতঃ আমাদ্বারা সে যে কতদূর উপকৃতা হইবে, তাহা তোমরা পরিশেষে জানিতে পারিবে।” 

হরিনাথ অনেক দিবস হইতে আমাকে সবিশেষরূপে জানিত, সুতরাং আমার প্রস্তাবে সে সম্মত হইয়া কামিনীকে লইয়া কামিনীর গৃহে প্রবেশ করিল। আমরা সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। দেখিতে দেখিতে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা অতীত হইয়া গেল। অর্দ্ধঘণ্টা পরে হরিনাথ আমার নিকট আগমন করিল এবং কহিল, “মহাশয়!” কামিনী যাহা বলিতেছে, তাহা আপনি একাকী আগমন করিয়া প্রথমে শ্রবণ করুন। পরিশেষে যাহা করিবার হয়, তাহা করিবেন।” 

হরিনাথের কথা শুনিয়া আমি তাহার সহিত কামিনীর গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং কামিনী যে স্থানে বসিয়াছিল, সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। 

হরিনাথ কহিল, “কামিনী! তুমি যাহা যাহা অবগত আছ, তাহা অকপটে ইহার নিকট প্রকাশ কর; তোমার কোন ভয় বা বিপদের আশঙ্কা নাই। তুমি আমাকে যেরূপ বিশ্বাস কর, ইঁহাকেও সেই প্রকার বিশ্বাস করিতে পার। 

হরিনাথের কথা শুনিয়া কামিনী হরিনাথকে কহিল, “আমি যখন আপনার অন্নে প্রতিপালিত, এবং যখন আপনি আমাকে এইরূপ বলিতেছেন, তখন ভাল হউক বা মন্দ হউক, আমার কোনরূপ বিপদ ঘটুক বা না ঘটুক, আমি যতদূর অবগত আছি, তাহা অবশ্যই বলিব। ইহাতে যাহা আমার অদৃষ্টে আছে, তাহাই হইবে।” 

এই বলিয়া কামিনী আমার দিকে ঘুরিয়া বসিল, এবং আমাকে বলিতে আরম্ভ করিল, “মহাশয়! কল্য দিবা আন্দাজ বারটার সময় আহার করিয়া আমি গৃহের বাহিরে আসিলাম। আমাদিগের বাড়ীর দ্বারের সম্মুখে একটু দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় দেখিলাম, একটি লোক আসিয়া রাস্তা হইতে চাঁপা চাপা করিয়া ডাকিতে লাগিল। কিন্তু কোন প্রকার উত্তর না পাইয়া পরিশেষে চাঁপার গৃহদ্বারে বার বার আঘাত করিতে লাগিল। তাহাতেও চাঁপার কোনরূপ উত্তর না পাইয়া সে কেবলরামের পানের দোকানের দিকে গমন করিল। কেবলরাম তাহার দোকানেই ছিল, ও অপর আরএক ব্যক্তি তাহার দোকানের নিকট দাঁড়াইয়া ছিল।” 

কামিনী এই পৰ্য্যন্ত বলিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে ব্যক্তি কেবলরামের দোকানে দাঁড়াইয়াছিল তুমি তাহাকে পুনরায় দেখিয়াছ কি?” 

কামিনী। হাঁ মহাশয়! দেখিয়াছি। কাল আপনারা যে দরওয়ানকে এখানে আনাইয়াছিলেন, সেই দরওয়ানই কেবলরামের দোকানের নিকট দাঁড়াইয়াছিল। 

আমি। সেই দরওয়ানের নাম তুমি বলিতে পার কি? 

কামিনী। উহার নাম আমি পূর্ব্বে জানিতাম না, এখন শুনিতেছি, উহার নাম প্রেমধারী। 

আমি। আচ্ছা, তোমার পর কি হইল বল। 

কামিনী। যে ব্যক্তি প্রথমে চাঁপাকে ডাকিতেছিল, যে কেবলরামের নিকট গিয়া তাহাকে কি বলিলে, কেবলরাম দোকান ছাড়িয়া তাহার সহিত চাঁপার দ্বারের নিকট আসিল। 

আমি। যে ব্যক্তি কেবলরামের সহিত আগমন করিল, এবং যে ব্যক্তি প্রথমে চাঁপাকে ডাকিতেছিল, সে কোন্ প্রদেশীয় লোক বলিয়া তোমার বোধ হয়? 

কামিনী। সে খোট্টা। কেবলরাম যে দেশের লোক, উহাকেও সেই দেশের লোক বলিয়া বোধ হয়।

আমি। তাহার পর কি হইল? 

কামিনী। কেবলরাম চাঁপার দ্বারের নিকট আসিয়া চাঁপাকে বার বার ডাকিল। কিন্তু কোন প্রকার উত্তর না পাইয়া, পরিশেষে গলির ভিতরে যে দ্বার আছে, তাহার নিকট গমন করিল। সেইস্থান হইতেও চাঁপাকে দুই এক বার ডাকিল; কিন্তু তাহাতেও কোন প্রকার উত্তর না পাইয়া গলির ভিতরের সেই দ্বার খুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। 

আমি। গলির ভিতরের যে দ্বারের কথা তুমি বলিতেছ, তাহা সেই সময়ে বন্ধ ছিল, কি খোলা ছিল?

কামিনী। উহা খোলা ছিল না, বন্ধ ছিল। 

আমি। বাহির হইতে বন্ধ ছিল, না গৃহের ভিতর হইতে বন্ধ ছিল? 

কামিনী। গৃহের ভিতর হইতে বন্ধ ছিল। 

আমি। তাহার পর কি হইল? 

কামিনী। সেই দ্বার খুলিবার নিমিত্ত প্রথমে কেবলরাম তাহার হাতের দ্বারা চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু কোন প্রকারেই কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া, পরিশেষে এদিক ওদিক্ দেখিতে লাগিল। সেই গলির ভিতর একখানি লোহার পাত বা যে প্রকার লোহা দিয়া কাপড়ের গাঁইট বাঁধা থাকে, সেই প্রকার লোহার একখানি টুকরা পড়িয়া ছিল। সেইখানি উঠাইয়া লইয়া সেই দ্বারের দুই কপাটের ভিতর প্রবেশ করাইল, ও তাহারই দ্বারা সেই দ্বার খুলিয়া উভয়েই চাঁপার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। 

আমি। যে লোহার পাত উহারা চাঁপার গৃহের দ্বার খুলিবার নিমিত্ত ব্যবহার করিয়াছিল, তাহা উহারা কি করিল, বলিতে পার? 

কামিনী। দ্বার খুলিয়া গেলে, সেই লোহা যে স্থানে ছিল, সেইস্থানেই ফেলিয়া দিল। 

আমি। সেই লোহা এখনও কি সেইস্থানে পড়িয়া আছে, তাহা কি তুমি বলিতে পার? 

কামিনী। আমার বোধ হয়, উহা এখনও সেইস্থানে পড়িয়া আছে। আজ একঘণ্টা পূর্ব্বে আমি দেখিয়াছি, উহা সেইস্থানে পড়িয়া ছিল। 

আমি। উহারা উভয়েই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, তাহার পর কি হইল? 

কামিনী। উহারা গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া যে কি করিল, তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত উহারা গৃহের ভিতর থাকায়, এবং দ্রব্যাদি নাড়িলে যে এক প্রকার শব্দ হয়, গৃহের ভিতর সেইরূপ শব্দ হওয়ায় আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহ হইল। আমি আস্তে আস্তে ঐ গলির ভিতর প্রবেশ করিলাম। দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখিলাম, চাঁপা মৃত অবস্থায় তাহার তক্তাপোসের উপর পড়িয়া আছে। তাহার গাত্রে যে সকল অলঙ্কারাদি ছিল, তাহা নাই। কেবলরাম ও তাহার সমভিব্যাহারী সেই ব্যক্তি আমারি হইতে দ্রব্যাদি বাহির করিয়া বাণ্ডিল বাঁধিতেছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মস্তক ঘুরিয়া গেল। আমি কহিলাম, “তোমরা এ কি করিতেছ, আমি এখনই সকলকে বলিয়া দিতেছি।” আমার এই কথা শুনিয়া এবং সম্মুখেই আমাকে দেখিতে পাইয়া, কেবলরাম যেন একটু ভীত হইয়াছে বোধ হইল। কিন্তু সে আমাকে সম্বোধন করিয়া আস্তে আস্তে কহিল, “যদি তুমি এখন গোলযোগ কর, তাহা হইলে এখনই সমস্ত দোষ তোমার উপর চাপাইয়া দিব। এই সমস্ত দ্রব্যাদির সহিত তোমাকে পুলিসের হস্তে অর্পণ করিয়া, আমরা উভয়েই তোমার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিব। আর যদি তুমি চুপ করিয়া থাক, এবং কাহারও নিকট এই কথা প্রকাশ না কর, তাহা হইলে আমরা তোমাকে কিছু অংশ প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। উহাদিগের এই কথা শুনিয়া আমার মনে ভয়ও হইল, লোভও হইল; সুতরাং আমি চুপ করিয়া সেইস্থানে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইলাম। কেবলরাম একগাছি সোণার অনন্ত আমার হস্তে প্রদান করিয়া কহিল, “এই অনন্ত গাছটি তুমি লইয়া যাও, কিন্তু সাবধান! একথা যেন প্রকাশ না হয়।” কেবলরামের এই কথা শুনিয়া অনন্তগাছটি গ্রহণ করিয়া, আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। গলির ভিতর হইতে বাহির হইয়া যেমন আমি সদর রাস্তার উপর আসিলাম, দেখিলাম, সম্মুখে বিধু ও তারামণি। আমাকে সেই গলির ভিতর হইতে বাহির হইতে দেখিয়া কি জানি কি ভাবিয়া, উহারাও সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিল, আমিও আমার গৃহের ভিতর গমন করিলাম। সেই সময় আমি গৃহ হইতে আর বাহিরে আসিলাম না, আপনার গৃহের ভিতরেই বসিয়া রহিলাম। পরিশেষে চাঁপার মৃত্যু-সংবাদ যখন প্রকাশ হইয়া পড়িল, রাস্তার উপর যখন লোকের ভিড় জমিয়া গেল, সেই সময় আমি গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। পরিশেষে পুলিস আসিয়া উপস্থিত হইল, অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। আমি এইমাত্র জানি, ইহা ব্যতীত অধিক আর আমি কিছুই জানি না। 

আমি। বিধু ও তারামণি কি কি পাইয়াছিল, তাহা তুমি কিছু জানিতে পারিয়াছ কি? 

কামিনী। না মহাশয়! আমি তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই। আমার মনে অতিশয় ভয় হওয়ায় বিধু কি তারামণিকে আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করি নাই। 

আমি। তুমি কেবলমাত্র একগাছি অনন্ত পাইয়াছ? 

কামিনী। একগাছি অনন্ত ব্যতিরেকে আর কোন দ্রব্য আমাকে দেয় নাই। 

আমি। সে অনন্তগাছটি কোথায়? 

কামিনী। সেই অনন্ত আমার নিকটেই আছে। 

এই বলিয়া কামিনী তাহার গৃহের ভিতরের একস্থানের মৃত্তিকার নিম্ন হইতে অনন্তগাছটি বাহির করিয়া দিল। পূৰ্ব্বে যে একগাছি অনন্ত পাওয়া গিয়াছিল, দেখিলাম, ইহা তাহারই জোড়া। 

কামিনীর কথা কতদূর বিশ্বাস করা যাইতে পারে, তাহা পূর্ব্বে ভাবিয়াছিলাম। কারণ, যে চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক একবার মিথ্যা কথা বলিতে পারে, সে যে দ্বিতীয়বার সকলই সত্য কথা বলিতেছে, তাহা কি প্রকারে অনুমান করা যাইতে পারে? কিন্তু যখন সে তাহার সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়া তাহারই গৃহ হইতে সেই অপহৃত দ্রব্যের কিয়দংশ বাহির করিয়া দিল, তখন কামিনীর কথায় আর অবিশ্বাস করিতে পারিলাম না। এখন সে যে সকল কথা বলিল, তাহার সমস্তই প্রকৃত বলিয়া বিশ্বাস করিলাম। 

কামিনীর নিকট যখন এই সকল বিষয় অবগত হইতে পারিলাম, তখন বেলা দশটা বাজিয়াছে। সেই সময় অনুসন্ধান কিছুক্ষণের নিমিত্ত স্থগিত রাখিয়া, আমি সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। কিন্তু অপর কোনস্থানে না গিয়া একবারে ডেড্‌হাউসে গিয়া উপনীত হইলাম। কামিনী এবার প্রকৃত কথা বলিয়াছে কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত ডেড্‌হাউসে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেইস্থানে চাঁপার মৃতদেহ তখনও পড়িয়া রহিয়াছে; ডাক্তার সাহেব তখন পর্যন্তও উক্ত শব ছেদ করিয়া পরীক্ষা করেন নাই। এই অবস্থা দেখিয়া আমিও সেইস্থানে অতঃপর ডাক্তার সাহেবের অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় এগারটার সময় ডাক্তার সাহেব তথায় আগমন করিয়া সেই শব ছেদ পূর্ব্বক পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিলেন, পরীক্ষা শেষ হইতে প্রায় দুইঘন্টা লাগিল। পরীক্ষাবসানে আমি ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়! ইহার মৃত্যুর কারণ কি?” 

উত্তরে ডাক্তার সাহেব করিলেন, “ যে কারণে উহার মৃত্যু হইয়াছে, আমার পোষ্টমারটম (Postmortem) রিপোর্ট দেখিলেই আপনি তাহা জানিতে পারিবেন।” এই বলিয়া একখানি কাগজ আমার হস্তে প্রদান করিলেন। উহা পাঠ করিয়া আমি অবগত হইতে পারিলাম বহুদিবস হইতে চাঁপার হৃদরোগ (Heart disease) ছিল, সেই রোগেই তাহার হঠাৎ মৃত্যু হইয়াছে। 

এতক্ষণে বুঝিতে পারিলাম, কামিনী শেষবারে প্রকৃতকথা বলিয়াছে। কামিনীর নিকট যে অনন্ত পাওয়া গিয়াছিল তাহা আমি আর গ্রহণ করিলাম না, উহা কামিনীর নিকটেই রহিল। আমিও এইস্থানে আমার অনুসন্ধান শেষ করিয়া আপন স্থানে গমন করিলাম 

পাঠকগণের মধ্যে হয়ত অনেকে কহিবেন, এইরূপ অবস্থায় এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান শেষ হইয়া গেল কেন? উহার উত্তরে আমি কেবল এইমাত্র বলিতে পারি, যদি আপনারা অনুগ্রহপূর্ব্বক দণ্ডবিধি আইনের ৪০৪ ধারার দিকে একবার লক্ষ্য করেন, তাহা হইলেই বুঝিতে পারিবেন যে, এই অনুসন্ধান করিবার ক্ষমতা আমাদিগের আর কতদূর আছে। আর যে পাঠকের সহিত দণ্ডবিধি আইনের কোনরূপ সম্পর্ক নাই, বা যিনি ঐ আইন কখন পড়েন নাই, বা শুনেন নাই, তাহাকে বুঝাইবার নিমিত্ত আমাকে আরও স্পষ্ট করিয়া এইমাত্র বলিলেই বোধ হয় চলিবে যে, কোন কোন অপরাধে পুলিসের নিজের অনুসন্ধান করিবার ক্ষমতা আইন-কর্তাগণ দেন নাই। সুতরাং সেই সকল অনুসন্ধান ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বিনা অনুমতিতে সম্পন্ন করা একবারেই নিষিদ্ধ। ৪০৪ ধারাও উহার মধ্যে একটি। উহার মা এইরূপঃ 

“কোন ব্যক্তির মরণকালে তাহার অধিকারে সম্পত্তি ছিল, তৎপরে সেই সম্পত্তিতে যাহার আইনমতে অধিকার থাকে, এমত কোন ব্যক্তির হস্তগত হয় নাই জানিয়া, কোন ব্যক্তি কুটিলভাবে সেই সম্পত্তির অবৈধ ব্যবহার করিলে, কি আপনার কর্ম্মে খাটাইলে” যে অপরাধ হয়, তাহা পুলিস একাইক অনুসন্ধান করিতে পারেন না। 

[মাঘ, ১৩০০ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *