কাটামুণ্ড (বেওয়ারিস মালের অনুসন্ধান!)

কাটামুণ্ড (বেওয়ারিস মালের অনুসন্ধান!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

আজ ১লা কার্ত্তিক, শারদীয়া পূজার প্রথম দিবস। সপ্তমীপূজা উপলক্ষে আজ আমার হিন্দু পাঠকগণ সকলেই আনন্দিত। কুটীরবাসী দরিদ্র হইতে অট্টালিকাবাসী হিন্দুসম্রাট পৰ্য্যন্ত সকলেই আজ মহামায়ার দর্শন-লালসায় একান্ত ব্যস্ত। আজ সকলের হৃদয় আনন্দে নৃত্য করিতেছে। সম্বৎসর পরে ভগবতীকে দর্শন করিবার আশায় আজ বিধবা বৈধব্যযন্ত্রণা ভুলিয়াছেন, স্নেহময়ী মাতা কাল-কবলিত পুত্রের শোক বিস্মৃত হইয়াছেন। বিদেশবাসী সকলেই আজ আপন আপন আলয়ে উপস্থিত। এক বৎসর পরে সকলেই কৰ্ম্মস্থান হইতে আগমন করিয়া আপন আপন বন্ধুবান্ধবের সহিত দেখা সাক্ষাৎ ও মিষ্টালাপে প্রবৃত্ত। এক বৎসর পরে সকলেই আপনার আদরের সামগ্রী, গৌরবের ধন প্রাপ্ত হইয়া স্বর্গ-সুখ ভোগ করিতেছেন। এক কথায় আজ সকলের মনই আনন্দমদে মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছে। প্রকৃতি সতীও সেই আনন্দে যোগ দিয়াছেন। 

যে হত্যাকাণ্ডের বিষয় আজ পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থাপিত করিতে যাইতেছি, সেই বিষয় বর্ণন করিবার পূর্ব্বে সপ্তমী পূজার কথা আসিয়া উপস্থিত হইল কেন, এ ঘটনার সহিত মহামায়ার পূজার কি সম্বন্ধ? এ প্রশ্ন অনেকেই হয়ত মনে মনে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। তাহার উত্তরে আমি পাঠকগণকে কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, এই প্রবন্ধ-লেখক যে বিভাগে কর্ম্ম করে, সেই বিভাগে কাহারই শারদীয়া পূজা বা অন্য কোন পূজা উপলক্ষে ছুটি নাই; সুতরাং সে সময়ে বিদেশ হইতে আগত বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের সহিত দেখা শুনা হইবার সম্ভাবনাও নাই। 

কয়েক বৎসর সবিশেষ চেষ্টা করিয়াও মহামায়া পূজার সময় কোনরূপে ছুটি লইয়া আপন মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হই নাই। আজ আমি যে বৎসরের ঘটনা বিবৃত করিতে প্রস্তুত, সেই বৎসর অনেক যোগাড়-যন্ত্র করিয়া অতীব কষ্টে পনর দিবসের ছুটি লইয়াছিলাম। পূজার দুই দিবস পূর্ব্বে অর্থাৎ পঞ্চমীর দিবস হইতে আমার ছুটি আরম্ভ হয়। ষষ্ঠীর দিবস কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনার প্রিয় জন্মভূমিতে গিয়া উপনীত হইলাম। সে দিবস দুই এক জন ব্যতীত অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। পরদিবস অর্থাৎ সপ্তমী পূজার দিবস প্রাতঃকালে সকলের সহিত দেখা শুনা করিবার প্রত্যাশায় যেমন বাটী হইতে বহির্গত হইতেছি, এমন সময় একজন টেলিগ্রাফ পিয়নকে দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, একখানি টেলিগ্রাফ হস্তে সে আমারই সন্ধান করিতেছে। রসিদ সহি করিয়া সেই টেলিগ্রাফ গ্রহণ করিলাম। টেলিগ্রাফ পাঠ করিয়া আমার সর্ব্বশরীর ক্রোধে ও দুঃখে পূর্ণ হইয়া গেল। 

পাঠকগণ! আপনারা বলুন দেখি, আজ এই সপ্তমী পূজার দিবস যদি কেহ আপনাদিগের এক বৎসরের সেবিতা আশা লতাকে সমূলে উৎপাটন করিয়া ফেলেন, তাহা হইলে আপনাদিগের মনে কিরূপ ভাবের উদয় হয়? 

যে বৎসরের ঘটনা আজ আমি বিবৃত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সেই বৎসরের সপ্তমী পূজার দিবস সেই টেলিগ্রাফ প্রাপ্ত হইয়া আমার মনে যে কিরূপ ভাবের উদয় হইয়াছিল, তাহা বর্ণন করিবার ক্ষমতা আমার নাই। আজ একটু ভাবিয়া দেখিলে, আপনারা সহজেই আমার সেই ক্রোধের ভাব অনুভব করিতে সমর্থ হইবেন। 

উক্ত টেলিগ্রাফে লেখা ছিল, “অদ্ভুত অবস্থায় একটি লাস পাওয়া গিয়াছে। তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত তোমার ছুটি আপাততঃ রদ হইল। এখন টেলিগ্রাফ পাইবামাত্র কলিকাতায় চলিয়া আইস।” 

পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী সাহেব এই টেলিগ্রাফ প্রেরণ করিতেছেন। চাকরি পরিত্যাগ করিলে চলিবে না, সপরিবারে অনশনে মরিতে হইবে; সুতরাং এমন সুখের দিবসেও নিতান্ত অসুখের কারণ উপস্থিত হইল। চক্ষুজল মোচন করিতে করিতে সেই দিবসেই আমাকে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইতে হইল। 

কলিকাতায় আসিয়া আমার ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমাকে দেখিয়া তিনি বিলক্ষণ সন্তুষ্ট হইলেন এবং কহিলেন, “একটি ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। কোথায় যে এই ভয়াবহ কাণ্ডের সূত্রপাত হইয়াছে, বা কোথায় যে এই নৃশংসকাৰ্য সংসাধিত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। কিন্তু কোন গতিতে মৃতদেহ আসিয়া আমাদিগের ঘাড়ে চাপিয়াছে, সুতরাং উহার অনুসন্ধানের ভার আমাদিগের হস্তে পতিত হইয়াছে। অদ্য প্ৰত্যূষে মাত্র সেই লাস আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি। এখন পর্য্যন্ত কোনরূপ পথ বাহির হয় নাই যে, সেই পন্থা অবলম্বন করিয়া গমন করিলে আমরা এই মোকদ্দমার উপায় করিতে সমর্থ হইব। তুমি টেলিগ্রাফ পাইবামাত্র চলিয়া আসিয়াছ, ভালই করিয়াছ; না আসিলে, তোমার উপর বড়ই অসন্তুষ্ট হইতাম। এই মোকদ্দমার উপায় হইয়া গেলে, পনর দিবসের পরিবর্তে যাহাতে তুমি এক মাসের ছুটি পাও, আমি তাহার সবিশেষ বন্দোবস্ত করিব। এখন যে স্থানে সেই লাস রহিয়াছে, সেইস্থানে গমন করিয়া প্রথমে উহা দেখিয়া লও। পরে কি প্রকারে, এবং কোথায় সেই লাস পাওয়া গিয়াছে, তাহা জানিয়া লইয়া ইহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত নিযুক্ত হও।” 

কর্ম্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া আর বাঙনিষ্পত্তি করিলাম না। যে স্থানে সেই লাস দেখিতে পাইব, ও সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিব, সেইস্থানে গমন করিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

প্রহরীর কথা শুনিয়া আর আলস্য করিতে পারিলাম না; আমি যে স্থানে বসিয়াছিলাম, সেইস্থান হইতে আফিসের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। থানার প্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব সেই সময়ে থানায় উপস্থিত ছিলেন না, তিনি রাত্রিতে রোঁদে গমন করিয়াছিলেন। অনন্যোপায় হইয়া কাজেই আমাকে সেই বাক্সের নিকট গমন করিতে হইল। চাপরাসী সেই বাক্সের নিকটেই দণ্ডায়মান ছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, রাত্রি দুইটার সময় গঙ্গার নিকটবর্ত্তী মাল—গুদামে আমার পাহারার পালা হয়। আমি পাহারায় গিয়া যখন সেই খোলা গুদামের ভিতর বেড়াইতেছিলাম, তখন সেই বাক্সটি আমার নয়ন আকৃষ্ট করে। আমি সেইস্থানে গমন করিয়া সেই বাক্সটি দেখিতে পাইলাম সত্য; কিন্তু তাহার নিকট কোন লোকজন দেখিতে পাইলাম না। প্রথমে মনে করিলাম, সেই বাক্সের অধিকারী কোন কার্য্যোপলক্ষে কোনস্থানে গমন করিয়াছেন, এখনই প্রত্যাগমন করিবেন। এইরূপ ভাবিয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার প্রতীক্ষা করিলাম; এমন কি, চারিটা বাজিয়া গেল, কিন্তু কেহই সেই বাক্স লইবার নিমিত্ত আগমন করিলেন না। সেই সময়ে আমার, একজন ঊর্দ্ধতন-কর্মচারী ঘুরিতে ঘুরিতে সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হন। তাঁহাকে সেই বাক্স দেখাইয়া দিয়া সমস্ত কথা বলিলাম। তিনি আমার কথা শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘যখন এ বাক্সের কোন ওয়ারিস নাই, তখন তুমি উহা লইয়া গিয়া নিকটবর্তী থানায় জমা করিয়া দেও।’ কর্ম্মচারীর আদেশমত একটা মুটিয়ার সাহায্যে উহা আমি এখানে আনয়ন করিয়াছি। আপনি জমা করিয়া লইয়া আমাকে অব্যাহতি প্রদান করুন। কারণ, যে স্থানে আমার পাহারা ছিল, সেইস্থানে এখন অপর আর কেহই নাই। চাপরাসীর কথা শ্রবণ করিয়া ভাবিলাম, এই বাক্স জমা করিয়া লইয়া চাপরাসীকে বিদায় করিয়া দেওয়াই কৰ্ত্তব্য। এই ভাবিয়া পুস্তক আনাইয়া সেইস্থানেই বসিয়া উক্ত বাক্স জমা করিয়া লইবার মাত্র উদযোগ করিতেছি, এমন সময়ে প্রধান কর্ম্মচারী সাহেব থানার ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

আমি পুনরায় সেই কৰ্ম্মচারীকে প্রশ্ন করিলাম, “প্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব আসিয়া এই বাক্স জমা করিয়া লইয়াছিলেন!” 

কৰ্ম্মচারী। না মহাশয়! জমা আর হইল কৈ? সময় অবস্থা আমি ক্রমে বলিতেছি—একটু স্থির হইয়া শ্রবণ করিলে এখনই বুঝিতে পারিবেন। প্রধান কর্মচারী সাহেব আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কিসের বাক্স?” উত্তরে আমি যতদূর জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই কহিলাম এবং ইহাও কহিলাম, “এই বাক্স আমি জমা করিয়া লইয়া চাপরাসীকে বিদায় করিয়া দিতেছি।” উত্তরে প্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব কহিলেন, “কেবল বাক্স জমা করিয়া লইলে চলিবে না। উহার ভিতর কি আছে খুলিয়া দেখ, এবং সেই চাপরাসীর সম্মুখে একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া তদনুযায়ী সমস্ত দ্রব্য জমা করিয়া লও। কারণ, ভবিষ্যতে কেহ যেন বলিতে না পারেন—উহার ভিতর যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহার সমস্ত পাওয়া যাইতেছে না।” প্রধান কর্ম্মচারী সাহেবের পরামর্শ সুপরামর্শ বিবেচনা করিয়া তাঁহার আদেশ প্রতিপালনের জন্য হাতের পুস্তক সেইস্থানে রাখিয়া সেই বাক্সটি খুলিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আপনি দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন, উক্ত বাক্সটি কি প্রকার দৃঢ় ও মজবুত। বাক্স বন্ধ ছিল, সুতরাং সহজে উহা খুলিতে না পারিয়া, ভাঙ্গিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাহাতেও কৃতকার্য হইতে না পারিয়া, পরিশেষে একজন লৌহকারের সাহায্য অবলম্বন করিলাম। লৌহকার অনেক কষ্টে উক্ত বাক্সটি খুলিয়া দিল। বাক্সটি খোলা হইলে কাগজ কলম লইয়া তালিকা প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত বাক্সের নিকট দণ্ডায়মান হইয়া সেই চাপরাসীকে উক্ত বাক্সের ডালা উন্মোচন করিতে কহিলাম। চাপরাসী যেমন বাক্সের ডালা তুলিল, অমনি উহা পরিত্যাগ পূর্ব্বক চীৎকার করিতে করিতে দূরে গিয়া দণ্ডায়মান হইল। 

“চাপরাসীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমিও নিতান্ত বিস্মিত হইলাম ও নিজেই সেই বাক্সের ডালা উন্মোচন পূৰ্ব্বক যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মনে ভয় ও ভাবনা যুগপৎ উদিত হইল। হস্তের কাগজ কলম হস্তচ্যুত হইয়া সেইস্থানে পড়িয়া গেল। আমি কি করিব, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, উচ্চৈঃস্বরে সেই প্রধান কৰ্ম্মচারীকে ডাকিতে লাগিলাম। কৰ্ম্মচারী সাহেব সেই সময়ে তাঁহার থাকিবার স্থানে গমন করিয়াছিলেন; আমার চীৎকারে তিনি দ্রুতপদে বাহিরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হইয়াছে?” সেই সময় আমার মনের গতি এরূপ হইয়াছিল যে, আমি তাঁহার কথার উত্তর প্রদানে সমর্থ না হইয়া, কেবলমাত্র অঙ্গুলি নির্দ্দেশ দ্বারা সেই বাক্সটি তাঁহাকে দেখাইয়া দিলাম। তিনি পুনরায় সেই বাক্সের ডালা উন্মোচন করিলেন। সেই সময়ে আমরা সকলেই সবিশেষ করিয়া দেখিলাম যে, বাক্সের ভিতর একটি স্ত্রীলোকর মৃতদেহ নিতান্ত সঙ্কুচিতভাবে বন্ধনাবস্থায় রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আর সেই বাক্স জমা করিলাম না। চাপরাসীও আপন কর্ম্মে গমন করিতে পারিল না। পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট এই সংবাদ প্রেরিত হইল। দেখিতে দেখিতে তিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং একে একে অনেক কৰ্ম্মচারী আসিয়া, এই মৃতদেহ কাহার এবং কোথা হইতে কাহার দ্বারা আনীত হইল, তাহার অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলেন। আমার উপর আদেশ হইল—-বাক্স সহিত সেই দেহ মেডিকেল কলেজে লইয়া যাইতে। আমি সেই আদেশ পালন করিলাম। এই গৃহে বাক্স সহিত দেহ আনিয়া স্থাপন করিলাম, এবং নিজেও এইস্থানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রথমে করোনার সাহেব জুরিগণের সহিত আগমন করিয়া এই দেহ দর্শন পূৰ্ব্বক প্রস্থান করিলেন; পরিশেষে ডাক্তার সাহেব আসিয়া উহাকে বাক্সের বাহির করিলেন। সেই সময়ে দেখিলাম, একগাছা রজ্জু দ্বারা উহার গলা জোর করিয়া বাঁধা আছে।”

আমি। লাস দেখিতেছি মস্তক-বিহীন! ইহার গলা যে কিরূপে রজ্জু দ্বারা বাঁধা ছিল, তাহা ত বুঝিতে পারিতেছি না।

কর্ম্মচারী। সকল কথা শ্রবণ করুন, তাহা হইলে জানিতে পারিবেন। ডাক্তার সাহেব লাসের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া যে ডোমের সাহায্যে তিনি শবচ্ছেদ কার্য্য সম্পন্ন করিলেন, সেই ডোমকে উক্ত রজ্জু খুলিতে কহিলেন। আদেশমাত্র ডোম উহার গলা হইতে উক্ত রজ্জু ক্রমে খুলিয়া ফেলিল। সেই সময়ে আমরা সকলেই দেখিতে পাইলাম, এ রজ্জু সামান্য রজ্জু নহে, উহা রজ্জুর নির্ম্মিত একগাছি “সিকা।” সিকা গাছটি যত্নের সহিত ডাক্তার সাহেব রাখিয়া দিলেন, ও পরিশেষে শবচ্ছেদ করিয়া তাহার পরীক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। পরীক্ষা শেষ হইলে ডাক্তার সাহেব আমাকে কহিলেন, “এই স্ত্রীলোকটিকে গলায় রজ্জু বাঁধিয়া মারিয়া ফেলা হইয়াছে।” পরে ডোমকে কহিলেন, “পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর অনুরোধ এই মাসের মস্তক রাখিতে হইবে। কারণ, এখন পর্যন্ত এ লাস সনাক্ত হয় নাই। লাসের গতি হইয়া গেলে সনাক্ত হইবার আর কোনরূপ আশাই থাকিবে না; সুতরাং এই খুনি মোকদ্দমার চূড়ান্ত বিচার হওয়াও নিতান্ত সহজ হইবে না।” ডাক্তার সাহেবের কথা শ্রবণমাত্র সেই ডোম একখানি ছুরি বাহির করিল, উহা দ্বারা সেই মৃতদেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করিয়া একটি বড় কাঁচপাত্রের ভিতর স্থাপন করিল, এবং ডাক্তার সাহেবের আদেশ-মত কি একটি আরক আনিয়া উহা দ্বারা উক্ত কাচপাত্র পূর্ণ করিয়া দিল। ডাক্তার সাহেব নিজে সেই মৃতমুণ্ড—পূর্ণ কাঁচপাত্রের মুখবন্ধ করিয়া দিয়া উহা আপনার গাড়িতে উঠাইয়া লইলেন। সিকা গাছটি এবং টিনের বাক্সটি কেবল আমার হস্তে অর্পণ করিলেন। এই সেই সিকা, আর এই দেখুন সেই বাক্স। এই ত মহাশয় অবস্থা! ইহা ব্যতীত আর কোন কথাই আমি অবগত নহি। 

কর্মচারীর কথা শ্রবণে সেই মস্তক-বিহীন দেহটি আর একবার দেখিলাম। বাক্সটি এবং সিকা গাছটিও উত্তমরূপ দেখিয়া লইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিবার ইচ্ছা করিলাম। তখন আমার মনে একটি ভাবের উদয় হইল। ভাবিলাম, ইহার পূর্ব্বে এই প্রকার দুই তিনটি অপরিচিত লাসের পরিচয়ের সূত্র, তাহার পরিহিত বস্ত্র হইতেই পাইয়াছি, সুতরাং এবারই বা সেই উপায় অবলম্বন না করিব কেন? এই ভাবিয়া সেই কৰ্ম্মচারীকে কহিলাম, “যখন বাক্সের ভিতর সেই শব পাওয়া গিয়াছিল, তখন উহার পরিধানে কি প্রকার বস্তু ছিল, এবং সেই বস্ত্রই বা কোথায়?” 

কর্ম্মচারী। লাসের পরিধানে প্রায়ই বস্ত্র থাকে সত্য, কিন্তু এই লাসটি যখন বাক্সের ভিতর প্রথম দেখিতে পাইলাম, তখন উহার পরিধানে কোনরূপ বস্ত্রই ছিল না। উলঙ্গ অবস্থাতেই এই লাস পাওয়া যায়। 

আমি। উহার অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কার ছিল কি? 

কর্ম্মচারী। অলঙ্কার ত পরের কথা, উহার অঙ্গে কিছুই ছিল না। এমন কি একগাছি কাঁচের চুড়ি বা একগাছি লোহার বালা পর্য্যন্তও দেখিতে পাই নাই। 

আমি। তুমি মস্তক সহিত এই লাস পূর্ব্বেই দেখিয়াছ, দেখিয়া উহাকে সধবা কি বিধবা বলিয়া বোধ হয়?

কৰ্ম্মচারী। সধবা বিধবা বুঝিবার উপায় নাই, কপালে কোন প্রকার সিন্দুরের চিহ্ন আমি দেখিতে পাই নাই।

আমি। উহার চুলগুলি কিরূপ অবস্থায় ছিল? 

কর্ম্মচারী। উহার মস্তকের চুলগুলি খুব ঘন এবং লম্বা। যখন এই লাস দেখিতে পাইলাম, তখন উহা আলুলায়িত অবস্থাতেই ছিল। 

আমি। মস্তক সহিত তুমি এই লাস দেখিয়াছ, এবং তুমি একজন পুরাতন ও উপযুক্ত কর্ম্মচারী। এক্ষণে এই লাস দেখিয়া তুমি কি কিছু স্থির করিতে পারিয়াছ যে, এই মৃত স্ত্রীলোকটি কোন্ জাতীয়া। সে পশ্চিম-দেশবাসিনী, কি বঙ্গ বাসিনী, কি মুসলমানী, কি হিন্দুরমণী? 

কর্ম্মচারী। আমার বোধ হয়, এই স্ত্রীলোকটি পশ্চিমদেশবাসিনী নহে, বঙ্গদেশবাসিনী। কিন্তু মুসলমানী বলিয়া বোধ হয় না, যেন হিন্দুর ঘরের স্ত্রীলোক বলিয়াই বোধ হয়। 

যখন আমি ডেডহাউসে উপস্থিত হইয়া এই কৰ্ম্মচারীর সহিত এইরূপ কথোপকথনে নিযুক্ত হইলাম, সেই সময় সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। পূজার বাড়ীতে সপ্তমী পূজার আরতী আরম্ভ হইয়াছে। হিন্দুমাত্রেই মনের সুখে সমবেত হইয়া ভগবতীর সম্মুখে যোড়হস্তে দণ্ডায়মান হইয়া এক মনে আরতী দর্শন করিয়া, আপনার হৃদয়কে চরিতার্থ ও মনকে আনন্দরসে আপ্লুত করিতেছেন। আর হতভাগ্য আমি এমন সময়ে আমোদ-আহ্লাদে জলাঞ্জলি দিয়া, ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম অধর্ম্মের অগাধজলে নিক্ষেপ করিয়া, পূজার দালানের পরিবর্তে ডেডহাউসে দণ্ডায়মান হইয়া মহামায়ার পরিবর্তে পাপীয়সী শবমূর্তি দর্শন করিতেছি! হায়! আমরা কি নরাধম!! 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

সন্ধ্যার পর ডেডহাউস হইতে বহির্গত হইয়া, ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সেই কাটামুণ্ড একবার দেখিতে চাহিলাম। যে স্থানে উহা রক্ষিত ছিল, সেইস্থানে গমন করিয়া পূর্ব্বে যেরূপ শ্রবণ করিয়াছিলাম, সেইরূপই দেখিলাম। দেখিলাম একটি বৃহৎ কাঁচপাত্রের ভিতর জীবিত মুণ্ডের ন্যায় সেই মুক্ত রহিয়াছে। তাহাতে সংবদ্ধ অলকগুচ্ছ সেই কাঁচাপাত্রের ভিতর সেই তরল পদার্থের উপর ভাসিতেছে। সেই মুখমণ্ডল দেখিয়া আমার বেশ বোধ হইল যে, ইহা কোন সুন্দরী বঙ্গ-যুবতীর মুণ্ড; কিন্তু সধবা কি বিধবা, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ নহে। কাটামুণ্ডের এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া এবং ডাক্তার সাহেবকে উহার মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধীয় দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম! 

যে সকল বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ পুলিস-কৰ্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, পরিশেষে তাঁহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। দেখিলাম, তাঁহারা এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়া তাহার সূত্রান্বেষণ করিতে সমর্থ হইয়াছেন, কিরূপে সেই বাক্স মালগুদামে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা জানিতে পারিয়াছেন। যখন তাঁহারা সেই মালগুদামের নিকট এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিতেছিলেন, সেই সময়ে একটি কুলি আসিয়া তাঁহাদিগকে সংবাদ প্রদান করিয়াছে যে, রাত্রি দুইটার সময় জাহাজে কর্ম্ম করিবার উদ্দেশে সে সেই পথ দিয়া গমন করিতেছিল। সেই সময় সে দেখিতে পায়, একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ির উপর হইতে একটি লোক সেই বাক্সটি নামাইয়া লইবার উদযোগ করিতেছে। কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছে না। সেই গাড়িতে সহিস ছিল না, কেবল একমাত্র কোচমান। ঘোড়াটি নূতন বলিয়া বোধ হয়; সুতরাং তাহার বল্গা পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই বাক্স নামাইয়া দিবার জন্য কোচমান কোনরূপে সাহায্য করিতে পারিতেছে না। সেই সময়ে উক্ত কুলিকে সেইস্থান দিয়া গমন করিতে দেখিতে পাইয়া উক্ত লোকটি তাহাকে ডাকিয়া লয়, এবং তাহারই সাহায্যে সেই বাক্সটি গাড়ির উপর হইতে নামাইয়া প্রথমে মৃত্তিকার উপর স্থাপনপূর্ব্বক সেই গাড়িবানকে একটি টাকা প্রদান করে। গাড়িবান্ টাকা লইয়া তাহার গাড়ি ঘুরাইয়া উত্তর দিকে গমন করে। গাড়িবান্ গাড়ি লইয়া প্রস্থান করিলে উক্ত কুলির সাহায্যে সেই ব্যক্তি সেই বাক্সটি মালগুদামের ভিতর রাখিয়া দেয় ও কুলিকে চারিটি পয়সা প্রদান করে। পয়সা পাইয়া কুলি নিজের কার্যে প্রস্থান করে। সেই ব্যক্তিও একখানি নৌকাভাড়া করিবে বলিয়া, গঙ্গার কিনারা দিকে চলিয়া যায়। 

কর্ম্মচারীগণ সেই কুলির নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছেন, এবং আরও জানিতে পারিয়াছেন যে, যে ব্যক্তি সেই বাক্সটি আনিয়াছিল, সে একজন বাঙ্গালী যুবক। তাহাকে দেখিলে সেই কুলি চিনিলেও চিনিতে পারে। 

সেই কুলির কথা শুনিয়া পরিশেষে তাঁহারা সেই গাড়ির সন্ধান আরম্ভ করেন। সমস্ত দিবস আস্তাবলে আস্তাবলে ঘুরিয়া সেই গাড়িরও সন্ধান করিতে সমর্থ হইয়াছেন। সেই গাড়ি সহরের নহে, কিন্তু সহরতলীর গাড়ি; কাশীপুরের একটি আস্তাবলে সেই গাড়ি পাওয়া যায়। গাড়িবানকে জিজ্ঞাসা করায় সে পূর্ব্ববর্ণিত কুলির কথার পোষকতা করে; আরও কহে যে, তাহার গাড়ি যখন কাশীপুরের আড্ডায় দাঁড়াইয়াছিল, সেই সময় একটি লোক আসিয়া তাহার গাড়ি ভাড়া করিয়া লইয়া যায়। সেই গাড়ি ভাড়া করিয়া কোন বাড়ীতে লইয়া যায় নাই। সেই পথের উপর একস্থানে গাড়ি রাখিয়া সেই গাড়ির উপর একটি বাক্স স্থাপন করে। যখন গাড়ি সেই স্থানে উপস্থিত হয়, সেই সময়ে আর একটি লোক সেই বাক্সটি লইয়া পথে দাঁড়াইয়াছিল। উভয়ে ধরাধরি করিয়া বাক্সটি গাড়ির উপর উঠাইয়া দেয়। যে ব্যক্তি গাড়ি ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল, বাক্স উঠাইবার পরেই সে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। যে ব্যক্তি বাক্স লইয়া সেইস্থানে দাঁড়াইয়া ছিল, সেই ব্যক্তি সেই গাড়ির ভিতর উপবেশন করিয়া একবারে কলিকাতায় গমন করে, এবং পূর্ব্ববর্ণিত কুলির সাহায্যে গাড়ি হইতে সেই বাক্স নামাইয়া লইয়া তাহার ভাড়া দিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দেয়। 

গাড়িবানের নিকট এই বিষয় অবগত হইয়া, কাশীপুরের পথের উপর কি প্রকারে কোথা হইতে এবং কোন্ ব্যক্তি কর্তৃক সেই বাক্স আনীত হইয়াছিল, কর্মচারীগণ সে বিষণ্ণ সবিশেষরূপ সন্ধান করিলেন। অতঃপর কিন্তু সেই সন্ধানে কোন ফলই ফলিল না। কোথা হইতে এবং কোন ব্যক্তি কর্তৃক কিরূপ উপায়ে সেই বাক্স সেইস্থানে আনীত হইয়াছিল, সে বিষয়ের আর কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া সেইদিবস সকলে প্রত্যাগমন করিলেন। 

এদিকে সৰ্ব্বপ্রধান পুলিস-কর্মচারীর আদেশ অনুযায়ী সহর এবং সহরতলীর সমস্ত থানার এলাকাস্থিত সমস্ত স্থানের অধিবাসীগণকে আনাইয়া সেই মৃতদেহ দেখান হইতে লাগিল; কিন্তু উহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহা কেহই বলিতে সমর্থ হইলেন না। এইরূপে নানাস্থানের নানাজাতীয় নানালোককে আনাইয়া, প্রথমে সেই মৃতদেহ ও পরিশেষে কাটামুণ্ড দেখাইতে দেখাইতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। সপ্তমী পূজার সমস্ত রাত্রি এইরূপে অতিবাহিত করিতে হইল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

অষ্টমীর দিবস প্রাতঃকালেও এইরূপে নানালোককে সেই কাটামুণ্ড দেখান হইতে লাগিল। যে সকল লোক প্রাতঃকালে সেই কাটামুণ্ড দেখিতে আসিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে একজন কহিল, “কাশীপুরের গোপাল বিশ্বাসের কন্যার মুখের ন্যায় ইহার মুখ।” এই কথা শ্রবণে আর কালবিলম্ব করিতে পরিলাম না, তখনই একখানি গাড়ি আনাইয়া কাশীপুরে গমন করিলাম। গোপাল বিশ্বাস তাঁহার বাড়ীতেই ছিলেন; তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিলাম, এবং সেই কাটামুও তাঁহাকে দেখাইলাম। গোপালবাবু অনেকক্ষণ পর্যন্ত এক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া পরিশেষে কহিলেন, “মহাশয়! আমার বোধ হইতেছে, এ আমার কন্যার মুখ।” তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আরও অবগত হইতে পারিলাম যে, কোন কারণবশতঃ তাঁহার জামাতার সহিত অকৌশল হওয়ায় প্রায় চারি বৎসর তিনি তাঁহার কন্যাকে শ্বশুরালয়ে পাঠান নাই। কিন্তু চারি পাঁচ দিবস মাত্র গত হইল, তাঁহার জামাতা তাঁহার বাটীতে আগমন করিয়া তাহার স্ত্রীকে লইয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ পূর্ব্বক শ্বশুরকে বিশেষরূপে অনুরোধ করে। গোপালবাবুও জামাতার অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া, কেবলমাত্র গত যষ্ঠীর দিবসে জামাতার সহিত তাঁহাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন। জামাতা সেইদিবস তাহার বাড়ীতে গমন করিবার অভিপ্রায়ে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে; কিন্তু তাহারা বাড়ীতে যে প্রত্যাগমন করিতে পারিয়াছে, অদ্যাপি সে বিষয়ের কোনরূপ সংবাদ শ্বশুরকে প্রদান করে নাই। এইরূপ বলিতে বলিতে বৃদ্ধ আর কোন প্রকারে চক্ষু জল সম্বরণ করিতে পারিলেন না; তখন সেই কাটামুণ্ডের দিকে লক্ষ্য করিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। 

বৃদ্ধ একটু সুস্থ হইলে, তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার জামাতার নাম ও বাসস্থান প্রভৃতি অবগত হইলাম। জামাতার বাসস্থান বহুদূরে নহে, সেওড়াফুলি ষ্টেশনের প্রায় তিন চারি ক্রোশ দূরবর্তী একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। সেই অষ্টমীর দিবস পূৰ্ব্বাহ্নে যেমন এই সংবাদ পাইলাম, কালবিলম্ব না করিয়া সেই বৃদ্ধ গোপালবাবুকে সঙ্গে লইয়া, সেওড়াফুলি গমন করিবার নিমিত্ত হাবড়া ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেওড়াফুলি গমনোপযোগী যে গাড়ি প্রথমেই প্রাপ্ত হইলাম, তাহাতে আরোহণ করিয়া সেওড়াফুলি অভিমুখে চলিলাম। দেখিতে দেখিতে গাড়ি সেওড়াফুলিতে গিয়া উপনীত হইল। আমরা গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া সেই গ্রামাভিমুখে চলিলাম। বৃদ্ধকে লইয়া সেই চারি পাঁচ ক্ৰোশমাত্র পথ অতিবাহিত করিতে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিল। সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমরা তাঁহার জামাতার বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। কিন্তু সেইস্থানে গিয়া কি দেখিলাম! যাহা দেখিলাম, তাহাতে অনেক বলিয়া বুঝাইয়া বৃদ্ধকে চুপ করিয়া রাখা দায় হইয়া উঠিল। আমি যতই নিষেধ করিতে লাগিলাম, বৃদ্ধ ততই রোদন করিতে লাগিলেন। 

আমরা সেইস্থানে উপনীত হইয়া জানিতে পারিলাম যে, বৃদ্ধের জামাতা তাহার স্ত্রীকে আনিবার নিমিত্ত সেইস্থান হইতে গমন করার পর আর প্রত্যাগমন করে নাই। তাহার স্ত্রীকে লইয়াও আইসে নাই, এবং বাড়ী পরিত্যাগের পর একখানি পত্র দ্বারাও সংবাদ দেয় নাই যে, সে এখন কিরূপে কোথায় আছে বা কোথায় গমন করিয়াছে, অথবা তাহার স্ত্রীকে লইয়া আগমন করিতেছে কি না। 

বুদ্ধকে বলিব কি, এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনেও দৃঢ়বিশ্বাস হইল যে, বৃদ্ধের জামাতা বৃদ্ধকে বঞ্চনা করিয়া, যাহার নিমিত্ত চারি বৎসর হইতে মনোবিবাদ চলিতেছে, তাহাকে বৃদ্ধের নিকট হইতে আনিয়াছে, এবং সেই বিবাদের প্রতিশোধ লইবার মানসে এইরূপ নৃশংস পৈশাচিক কাণ্ড সমাধা করিয়া প্রাণভয়ে পলায়ন করিয়াছে। 

আমাদিগকে সেইস্থানে দেখিয়া এক এক করিয়া গ্রামের অনেকগুলি ভদ্রলোক আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন। আমার মুখে তাঁহারা আনুপূর্বিক সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলে দেখিলাম, আমাদিগের মনে যেরূপ ধারণা হইয়াছিল, তাঁহাদিগের মনেও সেইরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলাম, দেখিলাম, পরিশেষে তাঁহারাও সেই সিদ্ধান্তে পদার্পণ করিলেন। 

বৃদ্ধের মুখে অবগত হইয়াছিলাম যে, যখন তিনি তাঁহার কন্যাকে জামাতার সহিত প্রেরণ করেন, সেই সময়ে কন্যার অঙ্গে প্রায় পাঁচশত টাকার অলঙ্কার ছিল। এদিকে মৃতদেহের শরীরে কিছুই পাওয়া যায় নাই। ভাবিলাম, যদি তাঁহারই কন্যা হতা হইয়া থাকে, তাহা হইলে যে সে তাঁহার জামাতা কর্তৃকই হতা হইয়াছে, তাহার আর কোন ভুল নাই। আর নিশ্চয়ই তাঁহার জামাতা সেই অলঙ্কারগুলি খুলিয়া লইয়াছে। এদিকে জামাতা তাহার বাড়ীতে আগমন করে নাই, একথা যদিও নিঃসংশয়িতরূপে অবগত হইতে পারিলাম, তথাপি তাহার বাড়ীতে ভালরূপে অনুসন্ধান না করিয়া প্রত্যাগমন করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, যদি গুপ্তভাবে সে আপনার বাড়ীতে আসিয়া অলঙ্কারগুলি লুকাইয়া রাখিয়া চলিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে গৃহ-সন্ধান করিলেই উহা বাহির হইয়া পড়িবে। এই ভাবিয়া সেই সন্ধার সময়েই তাহার গৃহ-সন্ধান করাই স্থির করিলাম। 

পাড়ার দুই তিন জন ভদ্রলোকের সম্মুখে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই বাড়ীতে তাহার মাতা এবং একটি বিধবা ভগিনী, ভিন্ন কেহই ছিল না। তাহাদিগকে সংবাদ দেওয়ায় তাহারা আমাদিগের সম্মুখে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া অন্যস্থানে গিয়া দণ্ডায়মান হইল। আমরা তাহার গৃহ সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোন স্থানেই অলঙ্কারাদির কোন চিহ্ন পাইলাম না। তবে গৃহের মেজের একস্থান দেখিয়া বোধ হইল যে, সেই স্থানের মৃত্তিকা যেন অল্প দিবসের মধ্যে খাদিত হইয়াছিল। সুতরাং সেইস্থানের উপর বিলক্ষণ সন্দেহ হইল। সেইস্থান খনন করিতে করিতে পিতলের একটি হাঁড়ী বাহির হইয়া পড়িল। উহার মুখ অপর একটি পিতলের বাসন দ্বারা আবৃত ছিল। সৰ্ব্বসমক্ষে সেই হাঁড়ীর আবরণ মোচন করিয়া দেখিলাম, নগদ টাকা, কিছু নোট, এবং সোণা ও রূপার অলঙ্কারে উক্ত হাঁড়ী পরিপূর্ণ। বৃদ্ধ যে যে প্রকার অলঙ্কার তাহার কন্যার শরীরে থাকার কথা বলিয়াছিলেন, সেইরূপ বাজু, বালা, মল প্রভৃতি কয়েকখানি অলঙ্কারও উহার ভিতর পাওয়া গেল। 

মৃত্তিকার ভিতর হইতে এই অলঙ্কারগুলি বাহির হইতে দেখিয়া সকলে আরও বিস্মিত হইলেন। এই হত্যা সম্বন্ধে যাঁহার যাঁহার মনে একটু সন্দেহ ছিল, এখন তাঁহাদিগের সকলের সন্দেহই মিটিয়া গেল। সকলেই একবাক্যে কহিলেন যে, এই ব্যক্তিই তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছে। 

মহাষ্টমীর দিন এই রূপে বিদেশে পথে পথে কাটিয়া গেল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

উহার গৃহে যে সকল অলঙ্কারাদি পাওয়া গেল, তাহার একটিতালিকা প্রস্তুত করিয়া, অলঙ্কারগুলির সহিত সেই রাত্রিতেই সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। ছুটি লইয়া সেই ছুটি ভোগ করিতে না পারিয়া মনে যে কষ্ট হইয়াছিল, পূজার সময় আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সহিত বহুদিবস পরে দেখা করিবার সুযোগ পাইলেও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ না হইয়া মনে মনে যে দুঃখ হইয়াছিল, এই অলঙ্কারগুলি পাইবার পরেই সেই কষ্ট ও দুঃখের কতক লাঘব হইল। ভাবিলাম, আমার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত যেমন আমাকে আমার বাড়ী হইতে আনয়ন করিয়াছিলেন, সামান্য সূত্রে আমা হইতে এই মোকদ্দমার উপায় হওয়ায় আজ ঈশ্বর আমার মান রক্ষা করিলেন। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে সেই রাত্রিতেই সেওড়াফুলির ষ্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। রাত্রি অধিক হওয়া প্রযুক্ত কলিকাতায় আসিবার উপযোগী কোন গাড়ি না পাইয়া, রাত্রির অবশিষ্টাংশ সেইস্থানেই থাকিলাম। পরদিবস অর্থাৎ নবমী পূজার দিবস সর্ব্বপ্রথমে যে গাড়ি পাইলাম, তাহাতে আরোহণ করিয়া সেই অলঙ্কারগুলি লইয়া মনের উল্লাসে হাবড়া ষ্টেশনে আসিয়া অবতরণ করিলাম। বৃদ্ধ গোপালবাবুও আমার সহিত প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন। 

বাষ্পীয় শকট হইতে অবতরণ করিয়া যখন আমরা বাহিরে আসিলাম, সেই সময় বৃদ্ধ দ্রুতপদে আমার নিকট আগমন করিলেন। গোপালবাবুকে দ্রুতপদে আসিতে দেখিয়া আমি সেইস্থানে দাঁড়াইলাম। বৃদ্ধ আমার নিকট আগমন করিয়া আস্তে আস্তে আমাকে কহিলেন, “মহাশয়! দেখুন! ঐ আমার জামাতা দাঁড়াইয়া আছে।” 

বৃদ্ধের কথা শ্রবণ করিয়া আমি ভাবিলাম, যে, যখন কোন মোকদ্দমার পথ পরিষ্কার হইবার হয়, তখন এইরূপেই হইয়া থাকে। লাস সনাক্ত হইয়াছে, মাল বাহির হইয়াছে, কেবল বাকি ছিল—আসামীকে ধৃত করা। কিন্তু ঈশ্বরের কি মহিমা! দেখিতে দেখিতে সেও আসিয়া উপস্থিত হইল! এই ভাবিয়া দ্রুতপদে গিয়া বৃদ্ধের নির্দ্দেশ-মত জামাতাকে সেইস্থানেই ধৃত করিলাম। ধরিবামাত্র সে যেন বিস্মিতের ন্যায় কহিল, “কি মহাশয়! আমি কি করিয়াছি, যে আমাকে ধৃত করিতেছেন?” 

আমি। কেবল ধৃত নহে, তোমাকে বন্ধন করিয়া এ স্থান হইতে লইয়া যাইব। 

জামাতা। তুমি কে, যে আমাকে বন্ধন করিয়া লইয়া যাইতে চাও? 

আমি। আমি পুলিস-কৰ্ম্মচারী। তোমাকে কেন আমি ধৃত করিয়াছি, এবং কেনই বা বন্ধন করিব, তাহা তুমি নিজেই মনে ভাবিয়া দেখ না কেন? 

জামাতা। সে কি মহাশয়! আমি এমন কি অপরাধ করিয়াছি যে, আপনি পুলিস হইয়া আমাকে ধৃত করিয়াছেন এবং বাঁধিতে চাহিতেছেন? 

আমি। মিথ্যা ভান করিয়া ভাবিতেছ, আমার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইবে? কিন্তু তাহা মনে করিও না। আমার হস্ত হইতে হত্যাকারীর নিষ্কৃতিলাভ করা নিতান্ত সহজ নহে। 

জামাতা। হত্যাকারী? সে কি মহাশয়! আমি কি হত্যা করিয়াছি? আপনার ভ্রম হইয়াছে, কাহাকে ধরিতে ভ্রমক্রমে কাহাকে ধরিয়া বসিয়াছেন। 

আমি। আমার ভ্রমই হউক বা যাহাই হউক, এইস্থানে তোমার সহিত আর মিথ্যা বাক্যব্যয় করিতে চাহি না। তোমাকে এখনই আমাদিগের সহিত কলিকাতায় গমন করিতে হইবে। উঠ—এই গাড়িতে উঠিয়া ব’স। 

জামাতা। মহাশয়! আপনি যখন সরকারী কর্ম্মচারী, তখন আপনার সহিত আমি আর অধিক বাক্যব্যায় করিতে চাহি না। আপনি আমাকে যে স্থানে লইয়া যাইবেন, আমি সেইস্থানেই গমন করিতে বাধ্য। কিন্তু মহাশয়! আমার একটি নিবেদন আছে, আমার সহিত একটি স্ত্রীলোক আছেন, আমি যদি আপনার সহিত গমন করি, তাহা হইলে সেই স্ত্রীলোকটিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে পারে, এরূপ আর কেহই আমার সঙ্গে নাই। অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক যদি তাহার একটা বন্দোবস্ত করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে ভাল হয়। নতুবা তাহার দশা কি হইবে, তাহা আমি ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছি না। 

আমি। তুমি যে স্ত্রীলোকটির কথা বলিতেছ, তিনি তোমার কে হন? 

জামাতা। কেন মহাশয়! তিনি আমার পত্নী। 

বৃদ্ধ এতক্ষণ পর্যন্ত নীরবে আমার গাড়ির ভিতর বসিয়া ছিলেন। তাঁহার জামাতার শেষ কথা শ্রবণ করিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। দ্রুতপদে গাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া জামাতাকে লক্ষ্য করিয়া আগ্রহ সহকারে কহিলেন, বাবা! তুমি কহিলে, তোমার স্ত্রী তোমার সমভিব্যাহারে আছেন; কিন্তু তিনি কে, তিনি কোথায়? 

জামাতা। তিনি কে, তাহা আপনি জানেন না? কে আমার স্ত্রী, তাহা আপনি ভুলিয়া গিয়াছেন? সে কি! আপনি পাগল হইয়াছেন না কি? আমার আর কয়টি স্ত্রী আছে? আপনার কন্যাই আমার স্ত্রী? ঐ দেখুন, সে বসিয়া আছে।

জামাতার এই কথা শ্রবণ করিয়া আমরা বিস্মিত হইলাম। বৃদ্ধ দ্রুতপদে সেই স্ত্রীলোকটির নিকট গমন করিয়া তাহাকে উত্তমরূপে দেখিলেন, এবং উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, “মহাশয়! এই আমার কন্যা জীবিত আছে, হত হয় নাই!”

বৃদ্ধের কথা আমার কর্ণে প্রবেশ করিতে করিতেই জামাতাকে আমি ছাড়িয়া দিলাম। লজ্জায় ও ঘৃণায় আর একপদও চলিতে না পারিয়া, সেই গাড়ির ভিতর গিয়া উপবেশন করিলাম। 

উক্ত ব্যক্তি আমাকে বারম্বার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “মহাশয়! এ সকল গোলযোগের কারণ কি?” উহার কথার উত্তর দিতে তখন আমার লজ্জা বোধ হইতে লাগিল। আমি কোন কথা না বলিয়া সেই গাড়ির ভিতরেই বসিয়া রহিলাম। তখন সে আপনার শ্বশুরের নিকট গমন করিয়া, এই সকল বিষয়ের কারণ কি জিজ্ঞাসা করিল। বৃদ্ধ গোপাল তাহাকে আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা কহিলেন। তিনি কাটামুণ্ড দেখিয়া উহাকে আপনার কন্যার মুণ্ড বলিয়া যেরূপ স্থির করিয়াছিলেন, তাহার সমস্ত কথা জামাতার নিকট প্রকাশ করিলেন। আমরা কিরূপভাবে অনুসন্ধান করিয়া পরিশেষে তাহার বাড়ী পর্য্যন্ত গমন করিয়াছিলাম, এবং তাহার গৃহের মেজে খুঁড়িতে খুঁড়িতে যে সকল দ্রব্য বাহির হইয়াছিল, তাহাও আনুপূর্বিক সমস্ত তাহাকে একে এক একে কহিলেন। পরিশেষে কহিলেন, “আজ কয়েক দিবস অতীত হইল, তুমি তোমার স্ত্রীকে লইয়া বাড়ীতে গমন করিবে বলিয়া আমাদিগের বাড়ী হইতে আসিয়াছিলে, কিন্তু সময়ে বাড়ীতে ফিরিয়া যাইতে না পারায় এই গোলযোগ এতদূর বাড়িয়া পড়িয়াছে।” 

উত্তরে কিন্তু তাঁহার জামাতা কহিল, “মহাশয়! কি করি? আপনার বাটী হইতে আমরা আমার বাড়ীতে গমন করিবার নিমিত্ত সোজা হাবড়া ষ্টেশনে আগমন করিতেছিলাম, পথিমধ্যে আমার খুল্লতাত-পুত্রের সহিত সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার বাড়ী-কলিকাতায়। তাঁহার বাড়ীতে এ বৎসর শারদীয়া পূজা হইতেছে। পথে আমাদিগকে দেখিতে পাইয়া কোনক্রমেই তিনি আমাদিগকে আসিতে দিলেন না। আমাদিগের অনিচ্ছা থাকিলেও একরূপ জোর করিয়াই তিনি আমাদিগের উভয়কেই নিজের বাটীতে লইয়া গেলেন। সেইস্থানেই তিন চারি দিবস বিলম্ব হইয়া গেল বলিয়া সময়ে বাড়ীতে পৌঁছিতে পারি নাই। আজও তিনি আমাদিগকে আসিতে দিতে ছিলেন না, কিন্তু অনেক বলিয়া কহিয়া কোনরূপে তাঁহার মত করিয়া অদ্য বাড়ীতে গমন করিতেছিলাম, এমন সময় পথিমধ্যে এই বিপদ উপস্থিত। আপনি কহিলেন, আমার গৃহের মেজেতে যে দ্রব্য পোঁতা ছিল; তাহা আপনারা দেখিতে পাইয়াছিলেন। কিন্তু উহা কি করিয়াছেন বা কোথায় রাখিয়া আসিয়াছেন?” 

বৃদ্ধ। যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে, তাহা রাখিয়া আসা হয় নাই, ঐ কৰ্ম্মচারী মহাশয় সমস্তই সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন। 

এই বলিয়া বৃদ্ধ আমাকে দেখাইয়া দিলে, সে আমার নিকট আগমন পূর্ব্বক সেই সকল দ্রব্য প্রত্যর্পণ করিতে কহিল। আমি তাহার কথায় আর কোনরূপ প্রতিবাদ না করিয়া, তালিকার লিখিত সমস্ত দ্রব্যই তৎক্ষণাৎ তাহার হস্তে প্রদান করিয়া উক্ত তালিকার উপরেই রসিদ গ্রহণ করিলাম। উহারা তিনজনেই হাসিতে হাসিতে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া কাশীপুর-অভিমুখে গমন করিল। আমি নিতান্ত ক্ষুণ্ণ অথচ লজ্জিত মনে আপন স্থানে প্রত্যাবৃত্ত হইলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

যে অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত ছিলাম, সে বিষয় অপর কর্ম্মচারীগণ কেহই অবগত ছিলেন না। সুতরাং সে কথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিলাম না, মনের ক্ষোভ মনেই মিটাইলাম। মনে মনেই আপনার বুদ্ধিকে শত সহস্র গালি প্রদান করিলাম। যে সময়ে আমি এ বিষয়ের অনুসন্ধানে নিযুক্তি হইয়া সেওড়াফুলিতে গমন করিয়াছিলাম, এখন শুনিলাম, অপর আর একজন কর্মচারী সেই সময়ে অপর আর একটু সন্ধান পাইয়াছেন, এবং এখন পর্যন্ত সেই অনুসন্ধানেই নিযুক্ত আছেন। 

আমরা সেইস্থানে বসিয়া এখন কোন উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে, সেই বিষয়ে পরামর্শ করিতেছি, এমন সময়ে দেখিলাম, সেই কৰ্ম্মচারীও প্রত্যাবর্তন করিলেন। কি সংবাদ পাইয়া তিনি অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, আমারই ন্যায় তিনি অপর আরএকজনের কথায় বিশ্বাস করিয়াছিলেন। তাঁহাকেও গণেশ নামক একজন বলিয়াছিল, সেই কাটামুণ্ড গণেশের স্ত্রীর। প্রায় একমাস হইল, পাড়ায় দুই তিন ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করিয়া গণেশের স্ত্রীকে বাহির করিয়া লইয়া যায়। গণেশ যদিও উত্তমরূপে অবগত ছিল যে, কে তাহার স্ত্রীকে বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে; তথাপি সে যে উহাকে কোনস্থানে রাখিয়াছিল, অনেক অনুসন্ধান করিয়াও গণেশ তাহার কিছুমাত্র সন্ধান করিয়া উঠিতে পারে নাই। তাই ইচ্ছা করিয়া গণেশ সেই মৃতদেহকে আপনার স্ত্রীর দেহ বলিয়া সনাক্ত করিয়াছিল। তাহার ইচ্ছা—যাঁহারা তাহার স্ত্রীকে বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছিল, পুলিস তাহাদিগকে লইয়া নিশ্চয়ই সবিশেষ পীড়াপীড়ি করিবে, আর খুনি মোকদ্দমায় আসামী হইবার ভয়ে হয়ত তাহারা তাহার স্ত্রীকে বাহির করিয়া দিবে। আর বিনাক্লেশে গণেশ আপনার অভিপ্রায় পূর্ণ করিয়া লইবে। 

গণেশ যে পরামর্শ করিয়াছিল, কার্য্যেও তাহা পূর্ণ হইল। গণেশের কথা শ্রবণ করিয়া কর্মচারী আর কোনরূপেই স্থির থাকিতে পারিলেন না। যে যে ব্যক্তির উপর গণেশ তাহার স্ত্রীকে বাহির করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত সন্দেহ করিয়াছিল, তাহাদিগের সকলকেই ধৃত করিলেন। আর তাহাদিগের দ্বারা গণেশের স্ত্রী যে হত হইয়াছে, তাহাই তাহাদিগকে এবং তাহাদিগের আত্মীয়বন্ধু সকলকে বুঝাইয়া দিলেন। যখন তাহারা দেখিল যে, তাহারা খুনি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত, তখন গণেশের স্ত্রীকে আর গোপনে রাখা যুক্তি-যুক্ত নহে ভাবিয়া, যে স্থানে তাহাকে লুকাইয়া রাখিয়াছিল, সেইস্থান হইতে বাহির করিয়া সর্ব্বসমক্ষে আনিয়া উপস্থিত করিয়া দিল। গণেশের স্ত্রী যে হত হয় নাই, তখন সকলে তাহা জানিতে পারিয়া মিথ্যা সংবাদ প্রদানের নিমিত্ত গণেশকে সকলে গালি প্রদান করিতে লাগিল। গণেশ কিন্তু তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া হসিতে হাসিতে কহিল, “কাটামুও দেখিয়া আমি ঠিকচিনিতে পারিয়াছিলাম না। আমার মনে বিশ্বাস হইয়াছিল, ঐ মুণ্ড আমার স্ত্রীর। কাজেই আমি পুলিসে সংবাদ প্রদান করিয়াছিলাম। আমি ইচ্ছা করিয়া মিথ্যা কথা বলিয়া পুলিসকে অযথা কষ্ট দিই নাই।” 

যে কৰ্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তিনিও আমার ন্যায় অপ্রস্তুত হইয়া প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহার অনুসন্ধানের বিষয় সেই সময়েই সকলে অবগত হইতে পারিলেন; কিন্তু আমি যেরূপে অপ্রস্তুত হইয়াছিলাম, তাহা তখন কেহই অবগত হইতে পারিলেন না। আমিও ইচ্ছা করিয়া কাহাকেও কিছু বলিলাম না। এই বিষয় আমি যদিও গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু তার অধিক দিবস গুপ্তভাবে থাকে নাই। একজন দুইজন করিয়া ক্রমে অনেকেই সেই বৃদ্ধ গোপাল বাবু ও তাঁহার জামাতার নিকট হইতে এই বিষয় জানিতে পারিয়াছিলেন, এবং ক্রমে তাঁহারাও অনেকের নিকট উহার গল্প করেন। এইরূপে এক কান দুই কান করিয়া ক্রমে সকলেরই কৰ্ণে এই বিষয় উঠিয়াছিল; এমন কি ক্রমে সেই সংবাদ আমার উর্দ্ধতন কর্মচারীরও কর্ণে পৰ্য্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। 

সত্য হউক মিথ্যা হউক, যে পন্থা পাওয়া গিয়াছিল তাহা অবলম্বন করিয়া এতক্ষণ পর্য্যন্ত অনুসন্ধান চলিতেছিল। এখন আর কোন পথই দৃষ্টিগোচর হইল না যে, অতঃপর আমরা তাহা অবলম্বন করিতে পারি। অনন্যোপায় হইয়া আমরা সকলেই সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া কেবল চিন্তা ও পরামর্শ করিতে লাগিলাম। দেখিতে দেখিতে বেলাও ক্রমে একটা বাজিয়া গেল। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

সেই নবমী পূজার দিবস বেলা একটার সময় সকলে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া আপন আপন ইচ্ছানুযায়ী স্থানে গমন করিলেন। আমিও আপনার বাসায় আসিয়া নিয়মিত সন্ধ্যা আহ্নিক এবং আহারাদি সমাপন করিয়া বেলা বারটার সময় যে থানায় স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া গিয়াছিল, সেই থানায় গমন করিলাম। পূর্ব্বকথিত বাক্স ও সিকা গাছটি আমি সপ্তমী পূজার দিবস সন্ধ্যার সময় দর্শন করিয়াছিলাম; সুতরাং দিবাভাগে সেই দ্রব্যদ্বয় ভালরূপে আর একবার দেখিবার নিমিত্ত আমার ইচ্ছা হইল। থানায় গমন করিয়া সেই দ্রব্যদ্বয় পুনরায় উত্তমরূপে দেখিলাম। সচরাচর সকলের গৃহে যেরূপ ‘সিকা’ থাকে, উহা সেরূপ নহে; উহা বেশ টান-সহ রজ্জু দ্বারা নির্ম্মিত। উহা কাহারও গৃহে তুলিয়া রাখিবার দ্রব্য নহে; গোয়ালা বা অন্যরূপ ভার-বাহী তাহাদিগের বাঁকের সহিত যে প্রকারের সিকা সৰ্ব্বদা ব্যবহার করিয়া থাকে, হইা সেই প্রকারের সিকা। 

বাক্সটি হঠাৎ দেখিলে নূতন বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু বিশিষ্টরূপ মনোযোগ পূৰ্ব্বক দেখিলে বুঝিতে পারা যায় যে, ইহা যদিও ডবল টিনের খুব একটা মজবুত বাক্স, তথাপি একবারে নূতন নহে। পুরাতন বাক্সের উপর নূতন করিয়া রং করিলে যেরূপ দেখায়, ইহাও সেইরূপ বোধ হইতেছে। যখন বুঝিতে পারিলাম যে, ইহা একটি রং-করা পুরাতন বাক্স, তখন সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া সৰ্ব্বস্থান উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলাম। কারণ, পুরাতন বাক্সের গায় যদি কোন প্রকার পুরাতন চিহ্ন বাহির হইয়া পড়ে, তাহা হইলে সেই চিহ্ন আমার অনুসন্ধান কার্য্যে সাহায্য করিলেও করিতে পারে। 

উক্ত বাক্সটি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিতে করিতে বোধ হইল যে, উহার গাত্রে যেন কি লেখা ছিল। উহার উপর নূতন রং পড়ায় সেই লেখা আর সহজে দেখিবার উপায় নাই, পাঠ করা ত পরের কথা। অনুমানে বোধ হইতে লাগিল, যেন উহাতে লেখা ছিল, কাহার নাম এবং সে নামের নিম্নে কোন গ্রামের নাম। সহজ চক্ষু দ্বারা প্রথমে উহা পড়িবার নিমিত্ত সবিশেষরূপে চেষ্টা করিলাম; কিন্তু কোন প্রকারেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না। পরিশেষে একখানি উৎকৃষ্ট আইগ্লাস আনিয়া তাহারই সাহায্যে সেই লেখা পড়িবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু যে নাম লেখা ছিল কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। সেই নামের নিম্নে বোধ হইল, “নিতা” এই কথাটি লেখা আছে; কিন্তু নিতা শব্দের কোনরূপ অর্থই করিয়া উঠিতে পারিলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া যে অপর কোন্ পন্থা অবলম্বন করিব তাহাই বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। 

অনেকক্ষণ চিন্তার পর হঠাৎ মনে হইল যে, কাশীপুরের কয়েক ক্রোশ দূরে নিতা বলিয়া একটি ক্ষুদ্র পল্লী আছে। এই বাক্স যদি সেই স্থানেরই হয়, ইহা ভাবিয়া নিতায় গিয়া একটু সন্ধান করাই মনে মনে স্থির করিলাম। 

একখানি ভাল গাড়ি লইয়া যতদূর পর্য্যন্ত গাড়ি চলে ততদূর গাড়িতে গমন করিলাম, এবং পরিশেষে পদব্রজে গিয়া সেই নিতা গ্রামে উপনীত হইলাম। নিমতা একটি অতিশয় ক্ষুদ্র পল্লী, উহাতে লোকজনের বাসস্থান অধিক নাই। তিন চারি ঘর ব্রাহ্মণ, এবং দশ বিশ ঘর অপর জাতীয় লোক লইয়া উক্ত গ্রাম। 

নিমতায় গিয়া দুই চারি জন ইতর লোককে, এবং দুই চারি জন বালক-বালিকাকে আমার আবশ্যকীয় দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু কাহারও নিকট কোন কথা অবগত হইতে পারিলাম না। বিফল মনোরথ হইয়া সেইস্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার মনস্থ করিতেছি, এমন সময় একটি সামান্য দৃশ্যের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। ইহা অপর আর কিছুই নহে, একস্থানে কতকগুলি রন্ধনের চিহ্নযুক্ত পুরাতন হাঁড়ী পড়িয়া আছে। 

পাঠকগণ! এই সামান্য দৃশ্যে আপনাদিগের মনে কোনরূপ নূতন ভাবের উদয় হয় কি না, জানি না; কিন্তু আমার মনে হঠাৎ একটা নূতন ভাবের আবির্ভাব হইয়াছিল, সেই জন্য এইস্থানে এই সামান্য বিষয়ের উল্লেখ করিতে হইল। একবার মনে হইল, ইহার শেষ ফল কিছুই হইবে না। তথাপি আমার হৃদয়ে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, তাহা সহজে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। 

আমার মনে যে কি ভাবের উদয় হইয়াছিল, তাহা পাঠকগণ বুঝিতে পারিয়াছেন কি? যদি না বুঝিতে পারিয়া থাকেন, আমি বলিতেছি—আপনারা শ্রবণ করুন। 

আমার মনে উদয় হইল যে, এই হাঁড়ী কয়েকটি যাহা পড়িয়া আছে, দেখিয়া বোধ হইতেছে, অধিক দিবস ইহা পরিত্যক্ত হয় নাই, দুই এক দিবসের মধ্যেই কে উহা পরিত্যাগ করিয়াছে। পুরাতন হাঁড়ী হিন্দুতেই পরিত্যাগ করিয়া থাকে। আমার এত বয়ঃক্রম হইয়াছে, ইহার মধ্যে কখন দেখি নাই বা কখন শ্রবণও করি নাই যে, কোন হিন্দু মহামায়া পূজার এই কয়েক দিবসের মধ্যে একান্ত অলঙ্ঘনীয় কোন কারণ না ঘটিলে, পুরাতন হাঁড়ী অভগ্ন অবস্থায় পরিত্যাগ করে। যদি আমার অনুমান সত্য হয় যদি এই গ্রামের কোনস্থানে কোন হিন্দুর বাড়ীতে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে দেখিতেছি যে, আমার অনুমানের সহিত হাঁড়ী ফেলার রহস্য কতক পরিমাণে মিলিতে পারে। যে মৃত্যু স্বভাবের নিয়মের বহির্ভূত অর্থাৎ সর্প-দংশন দ্বারা যে মৃত্যু হয়, অথবা বৃক্ষ প্রভৃতি কোন উচ্চস্থান হইতে পতিত হইয়া যে মৃত্যু হয়, কিম্বা উদ্বন্ধনে বা বিয-সেবনে যে আত্মহত্যা সাধিত হয়, অথবা অপর কাহার দ্বারা হত হইলে যে মৃত্যু হয়, তাহাকে স্বাভাবিক মৃত্যু কহে না, অপমৃত্যু কহে। স্বাভাবিক মৃত্যুতে ব্রাহ্মণদিগকে এগার দিবস “অশৌচ” গ্রহণ করিতে হয়, কিন্তু অপমৃত্যুতে কেবল তিনদিবস পৰ্য্যন্ত অশৌচ থাকে। অশৌচ যে দিবসে আরম্ভ হয়, ও যে দিবসে শেষ হয়, উভয় দিবসে হিন্দুমাত্রেই রন্ধনের নিমিত্ত পুরাতন হাঁড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাহার পরিবর্ত্তে নূতন হাঁড়ী ব্যবহার করিয়া থাকেন। 

যদি এ ক্ষেত্রে তাহাই হইয়া থাকে, যদি আমার অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে পূৰ্ব্বকথিত কোন এক কারণে যে উক্ত হাঁড়ী সকল পরিত্যক্ত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সংশয় নাই। যাহা হউক, এ বিষয়ের একটু অনুসন্ধান না করিয়া আমি সহজে এইস্থান পরিত্যাগ করিতেছি না। এইরূপ ভাবিয়া উক্ত হাঁড়ী সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। সেই গ্রামের ভিতর দুই চারি জনকে জিজ্ঞাসা করিবামাত্রই সহজেই জানিতে পারিলাম যে, সেই সকল হাঁড়ী সেইস্থানে একজন ব্রাহ্মণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াছে। সেই ব্রাহ্মণের নাম গোরাচাঁদ চক্রবর্ত্তী। অনুসন্ধান করিয়া আরও জানিতে পারিলাম যে, গোরাচাঁদ চক্রবর্তীরা চারি ভাই ছিলেন। প্রথম গোরাচাঁদ এক্ষণে জীবিত, দ্বিতীয় রামচাঁদ প্রায় পাঁচ বৎসর হইল পরলোক গমন করিয়াছেন, তৃতীয় ও চতুর্থ কেবলচাঁদ ও রূপচাঁদ সেই বাড়ীতেই থাকেন। তৃতীয় ও চতুর্থের বিবাহ হয় নাই, রামচাঁদের এক বিধবা পত্নী বর্ত্তমান। গোরাচাঁদের স্ত্রী ও দুইটি ছোট ছোট বালক সেই বাড়ীতেই থাকে। সকলেই একান্নবর্ত্তী। তাঁহারা চাকরি করিয়া কেহই জীবন ধারণ করেন না, চাষের উপরেই তাঁহাদের সকলের ভরসা। 

নবম পরিচ্ছেদ 

গুপ্ত অনুসন্ধান করিয়া এই সকল বিষয় অবগত হইয়া গোরাচাঁদ চক্রবর্তীর বাড়ীতে গমন করিলাম। গোরাচাঁদ বাড়ীতেই ছিলেন, ডাকিবামাত্র বাহিরে আসিলেন; আসিয়া আমাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে, কোথায় থাকেন, এবং কি নিমিত্তই বা এ স্থানে আসিয়াছেন?” গোরাচাঁদ আমাকে এই কয়েকটি কথা কহিলেন সত্য; কিন্তু তাঁহার ভাবভঙ্গী আমার ভাল লাগিল না। কথা কহিবার সময় কেমন তাঁহাকে এক প্রকার ভীত ভীত বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার কথা যেন জড়াইয়া জড়াইয়া বাহির হইতে লাগিল। 

আমি। আমি পুলিস কর্ম্মচারী। কোন বিষয়ের অনুসন্ধান উপলক্ষে আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। যে বিষয় অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহা বোধ হয়, আপনি বুঝিতেও পারিয়াছেন। 

গোরাচাঁদ। আপনি কিসের অনুসন্ধানের নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন? আমরা এমন কি করিয়াছি, যাহাতে পুলিস-অনুসন্ধানের আবশ্যক হইয়াছে? 

আমি। যাহা করিয়াছেন, তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। সে বিষয়ে ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন কি? আপাততঃ আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, আপনাদিগের রাঁধিবার পুরাতন হাঁড়ী সকল এখন পরিত্যাগ করিলেন কেন? 

গোরাচাঁদ। ইহার মধ্যে রন্ধনের পুরাতন হাঁড়ী ত আমরা পরিত্যাগ করি নাই। একথা আপনাকে কে বলিল?

আমি। মহাশয়! মিথ্যা কথা কহিবেন না। মিথ্যা কথা কহিলে আমি সহজে পরিত্যাগ করিব না। এখনই আমি আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিব যে, যে হাঁড়ীতে এখন আপনাদিগের রন্ধন হইতেছে, তাহা পুরাতন হাঁড়ী কি নূতন হাঁড়ী। আপনি জানেন যে, আমার সন্দেহ হইলে এখনই আমি আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া খানা-তল্লাসি করিতে পারি। 

দেখিলাম, আমার কথা শুনিয়া গোরাচাঁদ যেন একটু দমিয়া গেল, এবং ধীরে ধীরে কহিল, “কেন মহাশয়! কি হইয়াছে? পুরাতন হাঁড়ী পরিত্যাগ করিয়া তাহার পরিবর্তে নূতন হাঁড়ী ব্যবহার করিলে কি কোন দোষ হয়?” 

আমি। সেই পুরাতন হাঁড়ী সকল একবারে পরিত্যাগ করিলে যে কোন দোষ হয় না, তাহা আমি জানি। কিন্তু তাহা বলিয়াই কি আপনি আমার চক্ষে ধূলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিতে চাহেন? আমি বিদেশবাসী ইংরাজ নহি, আপনার স্বদেশবাসী ব্রাহ্মণ; সুতরাং যাহা তাহা বলিয়া সহজে আমাকে ভুলাইতে পারিবেন না। কি কারণে একবারে এই পূজার দিনে সকল হাঁড়ী পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাহা যদি সন্তোষরূপে আমাকে বুঝাইতে না পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আপনাদিগের বিপদ্ নিকটবর্তী। 

দেখিলাম, গোরাচাঁদ আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইলেন না; কিন্তু পুরাতন হাঁড়ী সকল যে তাঁহারা পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাহা ক্রমে আমার নিকট স্বীকার করিলেন। 

সেই সময় গোরাচাদের অপর দুই ভ্রাতাও কোথা হইতে আগমন করিলেন। তাঁহারাও আমাকে দেখিয়া এবং আমার পরিচয় পাইয়া যেন কিছু চিন্তিত হইলেন, বোধ হইল। 

আমি যখন যে স্থানে গমন করি, একটি লোক সর্ব্বদা আমার সঙ্গে থাকে। আজও আমার সঙ্গে একটি লোক ছিল। তাহাকে চুপি চুপি বলিয়া দিলাম, “নিকটবর্তী কোন থানায় গমন করিয়া, আরও দুই চারি জন লোক সঙ্গে করিয়া যত শীঘ্র পার, প্রত্যাগমন কর। রাত্রি আগত প্রায়, সুতরাং কখন কি আবশ্যক হয়, বলা যায় না।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া সে প্রস্থান করিল। আমাকে আপাততঃ সাহায্য করিবার নিমিত্ত সেই গ্রামের দুইজন চৌকিদারকে ডাকাইয়া আনিলাম। আমি সেইস্থানে উপবেশন পূৰ্ব্বক আপন উদ্দেশ্যের উপর লক্ষ্য রাখিয়া পাড়ার অন্যান্য লোকজনের সহিত নানাপ্রকার গল্প করিতে লাগিলাম। বলা বাহুল্য যে, পাড়ার সেই সকল লোক এক এক করিয়া আপনারাই সেইস্থানে আগমন করিয়াছিলেন। 

একজন চৌকিদার আমার নিকটেই রহিল। অপর আর একজনকে গোপনে বলিয়া দিলাম যে, “গোরাচাঁদের বিধবা ভ্রাতৃবধূ এখন কোথায়, সেই বিষয় গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যত শীঘ্র পার, আমার নিকট উপস্থিত হও।” সে আমার কথা শ্রবণ করিয়া প্রস্থান করিল। 

প্রায় এক কি দুইঘণ্টা পরে সেই চৌকিদার প্রত্যাগমন করিল, ও গোপনে আমাকে কহিল, “আমি সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইলাম যে, গোরাচাঁদ ঠাকুরের বিধবা ভ্রাতৃবধূ তাঁহাদিগের এই বাড়ীতেই থাকিতেন। কিন্তু গত চারি পাঁচ দিবস হইতে কেহই আর তাঁহাকে দেখিতে পাইতেছে না। তাঁহার চরিত্র ভাল ছিল না। তাঁহার বিপক্ষে অনেকে অনেক কথা বলিয়া তাঁহার চরিত্রের উপর সন্দেহ করিত। এমন কি মধ্যে মধ্যে তিনি তাঁহার ভাসুর বা দেবরগণ কর্তৃক বিলক্ষণরূপে লাঞ্ছিতাও হইতেন। আমি একটি স্ত্রীলোককে ইঁহাদিগের বাড়ীর ভিতর পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। সে দেখিয়া আসিয়া কহিল যে, সেই বিধবা বাড়ীতে নাই। কেহ বলিতেছে, সে লোকের লাঞ্ছনা সহ্য করিতে না পারিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। কেহ আবার বলিতেছে,—সে চরিত্র সংযত করিতে না পারিয়া, কুলে জলাঞ্জলি দিয়া এই গ্রাম পরিত্যাগ করিয়াছে। এইরূপ অনেকে অনেক কথা বলিতেছে, কিন্তু প্রকৃত কথা যে কি, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ নহে।” 

আমার হৃদয়ে যে সন্দেহের ছায়া পড়িয়াছিল, তাহা সেই চৌকিদারের কথা শুনিয়া আরও গাঢ়ভাবে ধারণ করিল। মনে হইল, উহাদিগের কর্তৃকই সেই বিধবা হতা হইয়াছে। পরক্ষণেই আবার গোপালবাবুর কথা মনে পড়িল, তাঁহার জামাতা ও কন্যাকে লইয়া যেরূপ বিপদে পড়িয়াছিলাম, তাহাও একবার ভাবিলাম। এই সময়ে যে লোককে আমি নিকটবর্তী থানায় প্রেরণ করিয়াছিলাম, সে আরও চারিজন পুলিস-কৰ্ম্মচারীর সহিত আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। 

ইহাদিগের সাহায্যে এখন ইচ্ছামত কার্য্য করিতে পারিব ভাবিয়া মনে একটু সাহসও হইল। তখন আপন অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিয়া মহামায়া যাহা করেন, তাহাই হইবে ভাবিয়া, নিজের মনকে দৃঢ় করতঃ আবশ্যকীয় অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। 

দশম পরিচ্ছেদ 

এই সময়ে আমরা আটজন, –আমি আমার সমভিব্যাহারী সেই ব্যক্তি, নবাগত চারিজন পুলিস কর্মচারী, এবং দুইজন চৌকিদার মিলিয়া সেই বাড়ী ঘেরিয়া ফেলিলাম। ইচ্ছা, বাড়ীর ভিতর হইতে কেহ কোন দ্রব্য বাহির করিয়া লইয়া যাইতে না পারে। বাড়ীর চতুষ্পার্শ্বে পুলিসের পাহারা পড়িল দেখিয়া, গোরাচাঁদ ও তাঁহার ভ্রাতৃদ্বয় বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। সেই সময়ে আমি স্পষ্টতঃই উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়! আপনারা মোট চারি সহোদর ছিলেন না?”

গোরাচাঁদ। হাঁ মহাশয়! আমরা চারি সহোদর ছিলাম সত্য, কিন্তু আমার কনিষ্ঠ অনেক দিবস হইল, লোকান্তর গমন করিয়াছেন। 

আমি। আপনার কনিষ্ঠের বিধবা স্ত্রী, যিনি আপনার এই বাটীতে বরাবরই থাকিতেন, তিনি এখন কোথায়? আমার কথা শুনিয়া দেখিলাম, গোরাচাঁদ ও তাঁহার অপর ভ্রাতাদ্বয়ের মুখ শুষ্ক হইয়া গেল। কেহই আমার এই কথার উত্তর সহজে প্রদান করিতে সমর্থ হইলেন না। গোরাচাঁদের মুখে আর কথা সরিল না। কিয়ৎক্ষণ পরে রূপচাঁদ কহিলেন, “তিনি এখানে থাকিতেন সত্য, কিন্তু আজ কয়েক দিবস হইতে তিনি তাঁহার পিত্রালয়ে গমন করিয়াছেন।” 

একথা আমাদিগের মনে লাগিল না, তাঁহাদিগের বাটী অনুসন্ধান করাই অতঃপর স্থির করিলাম। 

পাঠকগণ! এইস্থানে আপনাদিগকে একটি কথা আমার জিজ্ঞাসা করিতে হইল। বলুন দেখি, আমি কিসের নিমিত্ত তাঁহাদের বাটী অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা করিলাম? আমার প্রয়োজনোপযোগী কোন দ্রব্য এইস্থানে প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব কি না? এক এই বাটীর ভিতর গিয়া দেখা যাইতে পারে, সেই বিধবা বাড়ীতে আছেন কি না। কিন্তু তাহা ত জানিতে পারিলাম, তিনি এখানে নাই। হয় তিনি তাঁহার পিত্রালয়ে গমন করিয়াছেন, না হয়, তাঁহার কাটামুণ্ড কাঁচপাত্রে বিদ্যমান রহিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ এই হত্যার উদ্দেশ্য চুরি নহে যে, অনুসন্ধান করিলে অপহৃত দ্রব্যাদি বাহির হইবার সম্ভাবনা। তৃতীয়তঃ এক হাঁড়ীর গোলযোগ। তাহা ত উঁহারা স্বীকারই করিলেন যে, এখন নূতন হাঁড়ীতে রন্ধন হইতেছে, এবং পুরাতন হাঁড়ী পরিত্যক্ত হইয়াছে। তবে কি নিমিত্ত এখন খানা তল্লাসির প্রয়োজন হইল? এই প্রশ্নের উত্তর প্রদানে যদি আপনারা সমর্থ হয়েন, তবেই বুঝিব, এতদিবস পর্য্যন্ত যে নিমিত্ত আমি ‘দারোগার দপ্তর’ লিখিতেছি, তাহার উদ্দেশ্য সফল হইবার উপক্রম হইয়াছে। আর যদি আপনারা আমার এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর প্রদানে সমর্থ না হয়েন, তাহা হইলে আমাকে জিজ্ঞাসা করুন। আমি যথাসাধ্য ইহার উত্তর প্রদান করিব এবং কহিব যে, যে সময় সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই সময়ের অবস্থা একবার মনে করিয়া লউন। উহার গলায় যে একগাছি সিকা বাঁধা ছিল, তাহা একবার ভাবিয়া দেখুন। আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, সেই প্রকারের সিকা একগাছি কাহারও দ্বারাই প্রায় ব্যবহৃত হয় না, দুইগাছি প্রায়ই থাকে। এই অবস্থায় ইঁহাদিগের বাটী সন্ধান করিয়া সেই সিকার জোড়া অপর সিকা গাছটি যদি পাওয়া যায়, তাহা হইলে ভাবুন দেখি পাঠকগণ! উহার শেষ ফল কি হইতে পারে? এই ভাবিয়াই সেই বাটীর খানা-তল্লাসি করিতে ইচ্ছা করিলাম কেবল ইচ্ছা নয়, কার্য্যেও তাহা পরিণত হইল, আমার উদ্দেশ্যও সফল হইল। সন্ধান করিয়া সেই সিকার জোড়া সেই বাটী হইতে বাহির হইয়া পড়িল। 

আমার মনে মধ্যে মধ্যে যে সকল সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতেছিল, সেই সিকা প্রাপ্তির পর হইতে সন্দেহ একবারে হৃদয় হইতে দূর হইয়া গেল। তখন আমি তিন ভ্রাতাকেই এক প্রকার আটক করিলাম। আমার বিনা-অভিপ্রায়ে তাহাদের গতিবিধি বন্ধ হইয়া গেল। সেই সময়ে একখানি পত্র লিখিয়া আমার সমভিব্যাহারী সেই লোকের দ্বারা কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। সে পদব্ৰজে গ্রাম্যপথ অতিবাহিত করিয়া, পরিশেষে আমার আনীত সেই গাড়ি লইয়া দ্রুতগতি গমন করিল। আমরা সকলে সেইস্থানেই অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

রাত্রি প্রায় তিনটার সময় আমার প্রেরিত লোক প্রত্যাগমন করিল। তাহার সহিত দেখিলাম, আমার ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীও আগমন করিয়াছেন; আরও আসিয়াছেন—উক্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত প্রায় সমস্ত কৰ্ম্মচারীই। আর যে সকল দ্রব্য সঙ্গে করিয়া আনিবার নিমিত্ত আমি পত্রে অনুরোধ করিয়াছিলাম, দেখিলাম, তাহাও তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে আসিয়াছে। পাঠক বুঝিতে পারিয়াছেন, ঐ দ্রব্য কি? উহা আর কিছুই নহে সেই কাটামুণ্ড, সেই টিনের বাক্স এবং সেই সিকা। গ্রামস্থ আবাল-বৃদ্ধবনিতা সকলকেই সেই কাটামুণ্ড দেখান হইল। যাহারা সেই বিধবাকে চিনিত তাহারা সকলেই একবাক্যে কহিল যে, ইহা সেই বিধবার মুণ্ড। একজন কি দুইজন সেই কাটামুণ্ড সনাক্ত করিলে ভাবিতাম, হয় ত তাহাদিগের পূর্ব্বের ন্যায় ভ্রম হইয়াছে। কিন্তু যখন গ্রামের সমস্ত লোক একই কথা বলিতেছে, তখন সকলেরই ভ্রম হইয়াছে, একথা কি প্রকারে ভাবিতে পারি। তাহাদিগের বাটীর চাকর চাকরাণীদিগের মধ্যে কেহ কেহ ইহাও কহিল যে, আমাদের আনীত সেই বাক্স ও সিকা ইহাদের বাটীতে তাহার পূর্ব্বে দেখিয়াছে। ইহাদিগের মধ্যে যে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, বা হত্যা করিতে কেহ কেহ ইহাদিগকে দেখিয়াছে, তাহা কিন্তু কেহই বলিল না, কিম্বা ইঁহারাও তাহা স্বীকার করিলেন না। 

এরূপ অবস্থায় আমরা যাহা করিয়া থাকি, তাহাই করিলাম। তিন ভ্রাতাকেই ধৃত করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করিলাম। 

পরিশেষে সন্ধান করিয়া সেই বিধবার জন্মস্থান বাহির করিলাম। সেই হতভাগিনীর পিতামাতা এখনও বৰ্ত্তমান; তাঁহাদিগকে সেই কাটামুণ্ড দেখাইলে, তাঁহারাও আপনার কন্যা বলিয়া চিনিতে পারিলেন। 

পূৰ্ব্বকথিত সেই দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ির গাড়িবাও উহাদিগকে দেখিয়া কহিল যে, রূপচাঁদ তাহার গাড়ি ডাকিয়া আনিয়াছিল, এবং কেবলচাদ সেই বাক্সের নিকট প্রথমে দাঁড়াইয়াছিল, ও পরিশেষে বাক্স লইয়া তাহার সেই গাড়িতে কলিকাতায় আগমন করিয়াছিল। 

প্রথমোক্ত মুটে আসিয়াও কেবলচাঁদকে সনাক্ত করিয়া কহিল, বাক্স নামাইতে সে ইহাকেই সাহায্য করিয়াছিল।

এই মোকদ্দমায় তিন ভ্রাতাই আসামী হইলেন। বিচারাদি হইবার নিমিত্ত তাঁহারা তিনজনেই মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইলেন। কিছুদিবস ধরিয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেব এই মোকদ্দমার সাক্ষীগণের জবানবন্দী লইয়া তিনজনকে দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। 

সময়ে দায়রায় ইঁহাদিগের বিচার হইল। ইহারা উপযুক্ত আইন-জীবির সাহায্যে মোকদ্দমা চালাইতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের দ্বারা যে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা কিন্তু স্বীকার করিলেন না। বিচারে হত্যার কোন প্রমাণ না হওয়ায় প্রথম ভ্রাতা গোরাচাঁদ অব্যাহতি পাইলেন। কেবলচাদ লাস গোপন করা অপরাধে কেবলমাত্র দুই বৎসরের নিমিত্ত জেলে গমন করিলেন, এবং রূপচাঁদ কেবলচাঁদের সহায়তা করা অপরাধে এক বৎসরের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হইলেন। 

ইঁহারা চরিত্রহীন স্ত্রীলোকের এই দশা করিয়াছিলেন বলিয়া এইরূপে দণ্ডিত হইলেন, কিন্তু আমি বিনাদোষে মহামায়ার মহাপূজা দর্শনে বিমুখ হইলাম। ভাবিলাম, কর্ম্মের অনুরোধে জ্ঞান ও অজ্ঞানবশতঃ নিত্য নিত্য যে সকল পাপকার্য সম্পন্ন করিতেছি, তাহারই ফলস্বরূপ জগদীশ্বরী আমার উপর অসন্তুষ্টা হইয়া, মায়াচক্রে ফেলিয়া তাঁহার দর্শন-সুধাপানে আমাকে বঞ্চিত করিলেন। 

[ কাৰ্ত্তিক, ১৩০০ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *