ডাকাত সর্দ্দার (অর্থাৎ প্রসিদ্ধ দস্যু দলপতি কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরীর বীভৎস কাহিনী)

ডাকাত সর্দ্দার (অর্থাৎ প্রসিদ্ধ দস্যু-দলপতি কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরীর বীভৎস কাহিনী) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

ইংরাজি ১৮৮৯ সালের মার্চ মাসের শেষে মেদিনীপুর জেলা হইতে জনৈক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্ম্মচারীর একখানি পত্র আসিল। উক্ত পত্রের লিখিত বিষয় সকল কতদূর সত্য, অনুসন্ধান করিয়া তাহা অবগত হইবার নিমিত্ত, সেই পত্র আমার হস্তে প্রদত্ত হইল। পত্রের সার মা এইরূপ :—

মেদিনীপুর ও হুগলী জেলার মধ্যে আজ কাল ভয়ানক ডাকাইতি হইতে আরম্ভ হইয়াছে। এমন কি, নিতান্ত অল্প সময়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে লোমহর্ষণ-কর প্রায় পনরটি ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে। উক্ত সমস্ত ডাকাইতি প্রায় একই প্রকারের, সকলগুলিতেই প্রজ্বলিত মসাল ব্যবহার করা হইয়াছে, ঢেঁকী দ্বারা বাড়ীর সদর দরজা ও অপরাপর মজবুত দরজা সকল ভঙ্গ করা হইয়াছে। অনেক সময়ে বাড়ীর পুরুষদিগকে বিশেষরূপে যন্ত্রণা দিয়া তাহাদিগের নিকট হইতে জানিয়া লইয়াছে যে, তাহাদিগের গুপ্তধন ও অলঙ্কারাদি কোথায় আছে। কোন কোন স্থানে স্ত্রীলোকদিগের উপরও অশেষ বল প্রয়োগ করা হইয়াছে ও পরিশেষে বাড়ীর সমস্ত স্ত্রীলোককে একত্র সমবেত করিয়া একটি গৃহের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছে। যাহাতে স্ত্রীলোকগণ কোনরূপে গোলযোগ করিতে না পারে, বা গোলযোগ করিলেও প্রতিবেশীবর্গ প্রভৃতি তাহার কিছুমাত্র অবগত হইতে না পারে, সেই বিষয়ে বিশেষরূপ যত্ন লওয়া হইয়াছে। ইহা ব্যতীত সমস্ত ডাকাইতিগুলির অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারা গিয়াছে যে, যাহার বাড়ীতে যখন ডাকাইতি হইয়াছে, তাহার দুই এক দিবস পূর্ব্বে বৈষ্ণববেশী কোন লোক ভিক্ষা করিবার অভিপ্রায়ে সেই বাড়ীতে গমন করিয়াছে, সুযোগমতে আতিথ্য গ্রহণ করিয়া সেই বাড়ীতেই রাত্রি যাপন করিয়াছে, এবং পরদিবস প্রত্যূষে কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেই গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া গমন করিয়াছে। যে দিবস অতিথি বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াছে, অনেক স্থানে সেই রাত্রিতেই ও কোন কোন স্থলে তাহার দুই এক দিবস পরেই ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে। 

যে যে বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছে, সেই সেই বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগের যথাসর্বস্ব অপহৃত হইয়াছে সত্য, এবং তাহাদিগকে এক ঘরের ভিতর বদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহাদিগকে বিশেষরূপে যন্ত্রণা প্রদান করা হয়। নাই। পুরুষ মাত্রকেই মসালের আগুনের ছেঁকা সহ্য করিতে হইয়াছে, প্রায় সকলের শরীরে মসালের আগুনে ফোসকা পড়িয়াছে; কিন্তু কোন স্ত্রীলোকের উপর সেরূপ অত্যাচার করা হয় নাই, কাহারও শরীরে মসালের আগুন স্পর্শ পর্যন্ত করে নাই। 

কোন কোন স্ত্রীলোকের শরীর কোন কোন অংশে ক্ষত হইয়াছে সত্য, কিন্তু ইচ্ছা করিয়া সেই সকল স্থান আহত করা হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয় না। শরীর হইতে অলঙ্কারপত্র সকল বলপূর্ব্বক উন্মোচিত করিবার সময় যেরূপ ভাবে ক্ষত হইবার সম্ভাবনা, সেইরূপ ভাবে ক্ষত হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়। 

এই সকল কারণে ও সামান্য সামান্য অন্যান্য কারণে অনুসন্ধানকারী কর্মচারী মাত্রেই অনুমান করেন যে, একইমাত্র ডাকাইত-দল দ্বারা মেদিনীপুর ও হুগলী জেলার এই সমস্ত ডাকাইতি হইতেছে। কিন্তু উক্ত দলের নেতা কে, ও কোন্ কোন্ ব্যক্তিই বা সেই দলভুক্ত, তাহা এ পৰ্য্যন্ত কেহই স্থির করিয়া উঠিতে পারেন নাই। 

পূর্ব্বে মেদিনীপুর জেলার মধ্যবর্তী কোন স্থানে কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী নামক একজন ডাকাইত-দলপতি বাস করিত। সে তাহার দলভুক্ত কতকগুলি ডাকাইতের সাহায্যে পূর্ব্বে অনেকগুলি ডাকাইতি করিয়াছিল। সেই সমস্ত ডাকাইতি যেরূপ ভাবে হইত, বৰ্ত্তমান ডাকাইতিগুলিও প্রায় সেইরূপ ভাবে হইতেছে। কৃষ্ণ চৌধুরী যখন যে বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়াছে, তখন সেই বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগকে বিশেষরূপ যন্ত্রণা দেয় নাই, তাথচ সকলকেই একই ঘরের ভিতর আবদ্ধ পূর্ব্বক পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। ডাকাইতি সকল হইবার কিছু দিবস পরে কৃষ্ণ কতকগুলি অলঙ্কারপত্রের সহিত ধৃত হয় এবং পরিশেষে তাহার দলভুক্ত অনেকগুলি লোকও ধরা পড়ে। উক্ত মোকদ্দমায় কৃষ্ণ চৌধুরী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। 

যে সময় কৃষ্ণ জেলের মধ্যে আবদ্ধ, সেই সময় নানাস্থানে নানাপ্রকারে ডাকাইতি হইলেও এরূপ ভাবের ডাকাইতি হইতে দেখা যায় নাই, অর্থাৎ সেই সকলের কোন ডাকাইতিতেই বাড়ীর সমস্ত স্ত্রীলোককে একই ঘরের মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় নাই। 

আজ কয়েক বৎসর হইল, কৃষ্ণ চৌধুরী জেল হইতে খালাস হইয়া আসিয়াছে, অথচ সেইরূপ ভাবের ডাকাইতি পুনরায় আরম্ভ হইয়াছে। এই কারণে অনুসন্ধানকারী কর্মচারীগণের মধ্যে অনেকেই সন্দেহ করিলেন যে, বর্ত্তমান ডাকাইতি সকলও দলপতি কৃষ্ণ চৌধুরীর কার্য্য। 

কৃষ্ণ যে এখন কোথায়, তাহা কেহ বলিতে পারে না। জেল হইতে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়ার পর, সে যে তাহার বাড়ীতে আগমন করিয়াছিল, তাহারও কোনরূপ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। লোক-পরম্পরায় অবগত হইতে পারা যায় যে, সে আজ কাল বৈষ্ণবের বেশ ধারণ করিয়া কলিকাতার কোন স্থানে বাস করিতেছে, ও মধ্যে মধ্যে সেই স্থান হইতে আগমন করিয়া এই প্রদেশে ডাকাইতি করিয়া প্রস্থান করিতেছে। 

কলিকাতা নিতান্ত ক্ষুদ্র স্থান নহে, অথচ কলিকাতার কোন্ স্থানে সে বাস করিতেছে, তাহার ঠিক সংবাদ আমরা অবগত নহি, তথাপি আশা করি, কলিকাতার কোন উপযুক্ত কর্ম্মচারীর হস্তে কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধানের ভার প্রদান করা হয়। কোনরূপে যদি দস্যু-দলপতি কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান পাওয়া যায়, তাহা হইলে আমাদিগের বিশ্বাস যে, এই সকল ডাকাইতির কারণ-নির্দ্দেশ হইয়া এইরূপ ডাকাইতি পুনর্ব্বার না হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। 

কৃষ্ণ চৌধুরীর বয়ঃক্রম এখন অনুমান পঞ্চাশ বৎসর হইবে। তাহার বলিষ্ঠ গঠন, দোহারা শরীর, প্রশস্ত কপাল, গঠন দীর্ঘ—বোধ হয় ৭ ফিটের কাছাকাছি হইবে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

যে দস্যু-দলপতি কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরীর নাম পূর্ব্বে দুই একবার শুনিয়াছিলাম মাত্র, কিন্তু চক্ষুতে কখন দেখি নাই, সেই কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধানের ভার পূর্ব্ব পরিচ্ছেদ বর্ণিত পত্রের অনুরোধ ক্রমে পরিশেষে আমার হস্তে পতিত হইল। কলিকাতার কোন স্থানে ও কিরূপ ভাবে সে বাস করে, তাহা কেহই অবগত নহেন। প্রকৃত সে এখানে অবস্থিতি করে কি না, তাহারও স্থিরতা নাই। এরূপ অবস্থায় কোনস্থানে তাহার অনুসন্ধান করিব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির-সিদ্ধান্ত করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

পাঠকগণ সকলেই অবগত আছেন যে, পল্লীগ্রামের যেরূপ অবস্থা, এই কলিকাতা সহরের অবস্থা সেরূপ নহে। নিকটবর্ত্তী দশখানা গ্রামের মধ্যে কোন অপরিচিত লোক আসিয়া কিছু দিবস অবস্থিতি করিলে, ক্রমে সকলেই তাহা অবগত হইতে পারেন। কিন্তু কলিকাতার কোন বাড়ীতে কোন ব্যক্তি দশ বৎসর বাস করিলেও তাহার পার্শ্ববর্তী বাড়ীর কোন লোকই বলিতে পারেন না যে, ঐ ব্যক্তি কে, তাহার বাসস্থান কোথায়, বা কোথা হইতে সে আগমন করিয়া এই স্থানে বাস করিতেছে,– কিরূপ কার্য্য অবলম্বন করিয়া সে জীবন ধারণ করিয়া থাকে। এরূপ অবস্থায় বিনা—ঠিকানায় কলিকাতার ভিতর অনুসন্ধান করিয়া কৃষ্ণ চৌধুরীকে বাহির করা আমার পক্ষে যে কতদূর সহজ কাৰ্য্য, তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই বিবেচনা করিতে পারেন। কিন্তু উচ্চ কর্ম্মচারীবর্গের আদেশ প্রতিপালিত করিতেই হইবে। কৃষ্ণ চৌধুরীর কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি, বা না পারি, প্রাণপণে তাহার অনুসন্ধান করিতেই হইবে। 

কোন্ স্থানে গমন করিব ও কোন্ স্থানে গিয়া কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে না পারিলেও তাহার অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার উদ্‌যোগ করিতেছি, এমন সময় আমার উচ্চপদস্থ কৰ্ম্মচারী আমাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সংবাদ পাইবামাত্র আমি তাঁহার নিকট গমন করিয়া, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমাকে দেখিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কৃষ্ণ চৌধুরী সম্বন্ধীয় কাগজ তুমি প্রাপ্ত হইয়াছ?” 

আমি। পাইয়াছি। 

কর্ম্মচারী। উহা উত্তমরূপে পাঠ করিয়া দেখিয়াছ? 

আমি। দেখিয়াছি। 

কর্ম্মচারী। যে সকল ডাকাইতি হইতেছে, তাহা কাহার কার্য্য বলিয়া অনুমান হয়? 

আমি। যে সকল ডাকাইতি হইয়াছে, তাহার একটিও আমি অনুসন্ধান করি নাই; সুতরাং কাহার দ্বারা সেই সকল কাৰ্য্য হইতেছে, তাহা বলা আমার পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। 

কর্ম্মচারী। কাগজ পত্র পড়িয়া কি অনুমান হয়? 

আমি। কাগজপত্র দেখিয়া আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে বোধ হইতেছে যে, কৃষ্ণ চৌধুরী যেরূপ ভাবে পূর্ব্বে ডাকাইতি করিত এ যে সকল ডাকাইতিতে সে ধৃত হইয়া কারাগারে প্রেরিত হইয়াছিল, সেই সকল ডাকাইতি যে প্রকারে সম্পাদিত হইত, বর্তমান ডাকাইতিগুলির অধিকাংশই সেইরূপ ভাবে সম্পাদিত হইয়াছে। ইহাতে সহজেই মনে হয় যে, এই সকল ডাকাইতি কৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বারা হইবার সম্ভাবনা; অথবা পূর্ব্বে যে সকল লোক তাহার দলভুক্ত ছিল, তাহার মধ্যে যদি কেহ এখন দলপতি হইয়া থাকে ও তাহার পূর্ব্ব দলপতির প্রথা অবলম্বন করিয়া সে যদি ডাকাইতি করিতে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার দ্বারা হইবারও অসম্ভাবনা নহে 

কর্ম্মচারী। তাহা হইতে পারে; কিন্তু আমার বোধ হয়, এই সকল ডাকাইতি কৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বারা হইতেছে। 

আমি। অসম্ভব নহে। 

কর্ম্মচারী। সে এখন জেল হইতে খালাস হইয়া লুক্কায়িত ভাবে কোন স্থানে বাস করিতেছে। 

আমি। যদি সে মরিয়া গিয়া না থাকে, তাহা হইলে কাগজ পত্র দৃষ্টি করিয়া তাহাই অনুমিত হয়। 

কর্ম্মচারী। কলিকাতার ভিতর তাহার থাকিবারই খুব সম্ভাবনা। 

আমি। অসম্ভব নহে। 

কৰ্ম্মচারী। অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করিতেই হইবে। 

আমি। প্রাণপণে চেষ্টা করিব। কিন্তু কিছুমাত্র ঠিকানা পূৰ্ব্বে অবগত হইতে না পারিলে, কলিকাতার ভিতর সন্ধান করিয়া বাহির করা নিতান্ত সহজ নহে। 

কর্ম্মচারী। তাহা আমি জানি, তথাপি অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করিতেই হইবে। 

আমি। সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিতে আমার কিছুমাত্র ত্রুটী হইবে না। কিন্তু আমি তাহাকে চিনি না। পূৰ্ব্বে আমি তাহাকে কখনও দেখি নাই। 

কর্ম্মচারী। তুমি তাহার নাম অবগত হইতে পারিয়াছ? 

আমি। তাহার পূর্ব নাম অবগত হইতে পারিয়াছি সত্য, কিন্তু যদি সে এখন তাহার নাম পরিবর্তিত করিয়া থাকে?

কর্ম্মচারী। সে কিরূপ চেহারার লোক, তাহা পত্রের ভিতর বর্ণিত আছে। 

আমি। তাহার চেহারা যেরূপ ভাবে বর্ণন করা আছে, তাহাতে বিশেষ কিছুই বুঝিবার উপায় নাই। অনুসন্ধান করিলে কলিকাতার ভিতর হইতে সেই প্রকার চেহারার লোক সহস্র সহস্র বাহির হইতে পারে। 

কর্ম্মচারী। তবে তুমি অনুসন্ধান করিয়া কিরূপে তাহাকে বাহির করিবে? 

আমি। আমি বৈষ্ণবদিগের মধ্যে প্রথমতঃ উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিব, ও যাহাতে কৃষ্ণকে বাহির করিতে পারি, তাহার চেষ্টা করিব। কিন্তু আপনার নিকট আমার একটি প্রার্থনা আছে। 

কর্ম্মচারী।কি? পারিতোষিক? কৃষ্ণকে বাহির করিতে পারিলে, যাহাতে তুমি পারিতোষিক প্রাপ্ত হও, আমি তাহার বিশেষরূপ চেষ্টা দেখিব। 

আমি। আমি পারিতোষিকের নিমিত্ত আপনার নিকট প্রার্থনা করিতেছি না। 

কর্ম্মচারী। তবে কি? 

আমি। আমার প্রার্থনা এই যে, যে কৰ্ম্মচারী, কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধানের নিমিত্ত এই পত্র লিখিয়াছেন, আপনি তাঁহাকে একখানি পত্র লিখিয়া তাঁহাকে বলিয়া দিন যে, কলিকাতার কোন কর্ম্মচারী কৃষ্ণ চৌধুরীকে চিনে না, অথচ কলিকাতায় থাকিবার ঠিক ঠিকানাও এ পর্যন্ত জানিতে পারা যায় নাই। এরূপ অবস্থায় কৃষ্ণ চৌধুরীকে দেখিবামাত্রই উত্তমরূপে চিনিতে পারিবে, এরূপ একটি লোককে কলিকাতায় যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়। 

আমার কথা শুনিয়া কর্ম্মচারীও আমার কথার অনুমোদন করিলেন ও তৎক্ষণাৎ একখানি পত্র লিখিয়া ডাকযোগে প্রেরণ করিলেন। 

আমিও তাঁহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান করিবার মানসে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

এইরূপ অবস্থায় এই কলিকাতা মহানগরীর ভিতর অনুসন্ধান করিয়া কৃষ্ণ চৌধুরীর সন্ধান করা যে কতদূর সহজ, তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই অনুভব করিতে পারেন। 

একে কৃষ্ণ চৌধুরী আমার নিকট পরিচিত নহে, দ্বিতীয়তঃ তাহাকে দেখিলে অনায়াসেই চিনিতে পারে, এরূপ কোন লোক আমার সহিত নাই, অথচ তাহার অবয়বের ভিতর এমন প্রকাশ্য বিশেষ চিহ্ন নাই, যাহা দেখিবামাত্রই আমি তাহাকে কৃষ্ণ চৌধুরী বলিয়া অনুমান করিয়া লইতে পারি। সে একটু দীর্ঘায়তনের লোক সত্য; কিন্তু কলিকাতার ভিতর ওরূপ দীর্ঘ আয়তনের লোক যে কত শত আছে, তাহার সংখ্যা কে করে? এরূপ অবস্থায় কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান করা নিষ্প্রয়োজন, তাহা জানিয়াও সরকারী কার্য্যের অনুরোধে তাহার অনুসন্ধানে আমাকে গমন করিতে হইল। 

মেদিনীপুরের পত্রানুযায়ী অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, কৃষ্ণ চৌধুরী বৈষ্ণবের বেশে কলিকাতায় বাস করিতেছে; সুতরাং অনায়াসেই অনুমান করিলাম যে, বৈষ্ণব বেশে বাস করিতে হইলে, বৈষ্ণব ধর্ম্মাবলম্বী মনুষ্যদিগের সহিতই কৃষ্ণ চৌধুরীর বাস করিবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সহর ও সহরতলীর মধ্যে যে যে স্থানে বৈষ্ণবগণ বাস করে, প্রথমে সেই সেই স্থানেই কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সৰ্ব্বদা আমি যে বেশ পরিধান করিয়া দিন অতিবাহিত করিয়া থাকি, সেই বেশে বৈষ্ণব বৈষ্ণবীদিগের সহিত মিলিত হইয়া তাহাদিগের নিকট হইতে কোন কথা অবগত হওয়া সহজ নহে বিবেচনায়, আমার বেশেরও একটু পরিবর্ত্তন করিতে হইল। পরিহিত ধুতি পরিত্যাগ করিয়া তাহার পরিবর্তে “কৌপীন” ও “বহির্ব্বাস” ধারণ করিতে হইল। শরীরের ঊর্দ্ধভাগের অধিকাংশ স্থানে রাধাকৃষ্ণের ছাপ মারিতে হইল, তুলসীর মালা ক্রয় করিয়া গলায় পরিতে হইল। কপালে ও নাসিকার অগ্রভাগে তিলক মাটীর ছাপ কাটিয়া ভিক্ষোপযোগী একটি ঝোলা স্কন্ধে করিয়া শূন্য পদে বাহির হইতে হইল। 

এইরূপে বৈষ্ণববেশে বহির্গত হইয়া বৈষ্ণবদিগের মধ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া একাদিক্রমে চারি পাঁচ দিবস কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইলাম; কিন্তু প্রথমতঃ কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। পরে কৃষ্ণ নামক অনেকগুলি বৈষ্ণবের এক এক করিয়া সন্ধান পাইলাম সত্য, কিন্তু তাহাদিগের আকৃতি প্রকৃতি কৃষ্ণ চৌধুরীর আকৃতি প্রকৃতি অপেক্ষা অধিক বিভিন্ন হইয়া পড়িল। তথাপি ভবিষ্যতের নিমিত্ত তাহাদিগের নাম ধাম, আমার ঝোলার মধ্যস্থিত পকেট বহিতে লিখিয়া রাখিতে লাগিলাম। 

ক্রমে আরও দুই চারি দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, তথাপি আমার বৈষ্ণব বেশ ঘুচিল না, বা কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধানও পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। সেই সময় জানিতে পারিলাম যে, গোকুল মিত্রের লেনের কতক অংশকে লালবাগান কহে। এই লালবাগানে ভব নাম্নী একটি স্ত্রীলোক তাহার নিজের একখানি খাপরেলের ঘরে বাস করে। উক্ত ভব পূর্ব্বে একজন নিতান্ত সামান্য বেশ্যা ছিল, কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে তাহার পূর্ব্ববৃত্তি অনেকটা এখন পরিত্যাগ করিয়াছে,—এখন সে একজনের আশ্রয়ে বাস করিতেছে। ভব এখন বৈষ্ণবী। তাহার গলায় তুলসীর মালা, নাকে তিলক, হাতে কৃষ্ণনামের ঝুলি ও মুখে রাধাকৃষ্ণ বুলি সৰ্ব্বদাই লাগিয়া আছে। যাহার আশ্রয়ে ভব এখন বাস করে, তাহার নাম গোপালদাস মোহান্ত। গোপালদাস একটু লম্বা ধরণের লোক, ও তাহার আকৃতি প্রকৃতি কিয়ৎপরিমাণে কৃষ্ণ চৌধুরীর আকৃতি প্রকৃতির সহিত মিলে। কিন্তু গোপালদাস মোহান্তই যে আমাদিগের কৃষ্ণ চৌধুরী, তাহা বলা আমার পক্ষে সহজ নহে। 

যাহা হউক ভব ও গোপালদাস সম্বন্ধে আমাকে গোপনে একটু অনুসন্ধানও করিতে হইল। অনুসন্ধানে অবগত হইলাম যে, প্রায় এক মাস গত হইল, গোপাল ও ভব তীর্থ পর্য্যটন উপলক্ষে বৃন্দাবন প্রভৃতি স্থানে গমন করিবার মানসে, কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে; কিন্তু প্রতিবেশী ও বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটীয়াদিগকে বলিয়া গিয়াছে যে, এক মাস দেড় মাসের মধ্যে তীর্থ পর্য্যটন করিয়া তাহারা প্রত্যাগমন করিবে। 

গোপালদাস মোহান্ত যে কোন প্রদেশীয় লোক, তাহার বাসস্থান কোথায়, গুপ্ত অনুসন্ধানে তাহার কিছুমাত্র অবগত হইতে পারিলাম না; কেবল এইমাত্র জানিতে পারিলাম যে, গোপালদাস মোহান্ত প্রায় এক বৎসর কাল পর্য্যন্ত ভবর বাড়ীতে বাস করিতেছে। মধ্যে মধ্যে সে তাহার শিষ্যদিগের সহিত কলিকাতা সহর পরিত্যাগ করিয়া ভিক্ষার্থ গমন করিয়া থাকে, ও সময় সময় আট দশ দিবস পরে প্রত্যাগমন করে। তাহার শিষ্যগণ কে, বা কোথায় থাকে, তাহাও কেহ বলিতে পারিল না। কিন্তু সকলেই কহিল যে, গোপালদাস মোহান্ত একজন বিশেষ ধার্ম্মিক পুরুষ, ধর্ম্মকৰ্ম্ম ও তীর্থ পর্য্যটন করিয়াই প্রায় সে দিন অতিবাহিত করে। তুলসী-মঞ্চের উপর তাহার ভয়ানক ভক্তি, রাত্রি দিনের মধ্যে প্রায় সৰ্ব্বক্ষণই সে তুলসী-মঞ্চের নিকট পড়িয়া থাকে। 

গোপালদাস মোহান্ত ও ভবর কথা অবগত হইয়াই আমি যে কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান একবারে পরিত্যাগ করিলাম, তাহা নহে। কারণ, গোপালই যে কৃষ্ণ, তাহা আমি সম্পূর্ণরূপে স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার মনে করিলাম, কৃষ্ণই আপনার নাম গোপন করিয়া, গোপাল নামে ভবর বাড়ীতে অবস্থিতি করিতেছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবিলাম যে, গোপাল ধর্ম্মকৰ্ম্ম ও তীর্থ পর্য্যটন রিয়াই যখন দিন অতিবাহিত করিয়া থাকে, তখন সে সেই দস্যুদলপতি কৃষ্ণ চৌধুরী কিরূপে হইতে পারে? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান করিতে বিরত হইলাম না। কৃষ্ণকে চিনিতে পারে, ক্রমে সেইরূপ একটি লোকও মেদিনীপুর হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

কৃষ্ণ চৌধুরীকে দেখিলেই চিনিতে পারিবে, এরূপ একটি লোক মেদিনীপুর হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল সত্য, কিন্তু ভব বা গোপালদাস মোহান্ত এ পর্য্যন্ত বৃন্দাবন হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল না। যে পৰ্য্যন্ত গোপালদাস পশ্চিম হইতে প্রত্যাগমন না করে, সেই পর্য্যন্ত সেই লোকটি আমার নিকটেই অবস্থিতি করিতে লাগিল। আমি সহরের নানাস্থানে কৃষ্ণ চৌধুরীর অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। 

এইরূপে আরও পাঁচ সাত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এক দিবস আমি সংবাদ পাইলাম যে, গোপালদাস মোহান্ত ও ভব বৃন্দাবন হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছে। সংবাদ পাইবামাত্র আমি বৈষ্ণব বেশে ভবর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাকে পরম ভক্ত বৈষ্ণব ভাবিয়া, ভব বিশেষ যত্নের সহিত আমাকে বসাইল। সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া রাধাকৃষ্ণ প্রেম সম্বন্ধীয় অনেক কথা ভবর সহিত হইল। বৃন্দাবনের অনেক কথাও ক্রমে আসিয়া পড়িল। আমার কথা শুনিয়া ভব অতিশয় প্রীতিলাভ করিল। কথা-প্রসঙ্গে সে ও তাহার বৈষ্ণব গোপালদাস মোহান্ত বৃন্দাবনে গমন করিয়া, যে সকল স্থান ভ্রমণ করিয়া আসিয়াছে, ও যাহা যাহা দর্শন করিয়া আসিয়াছে, তাহা ক্রমে ক্রমে আমার নিকট বর্ণন করিতে আরম্ভ করিল। আমিও বিশেষ মনোযোগের সহিত তাহার সমস্ত কথা শ্রবণ করিতে লাগিলাম। 

যে সময় আমি ভবর বাটীতে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় গোপালদাস মোহান্ত বাড়ীতে উপস্থিত ছিল না। যে সময় আমি বসিয়া বসিয়া ভবর সহিত গল্প করিতেছিলাম, সেই সময় গোপালদাস আসিয়া উপস্থিত হইল। আমাকে একজন গোঁড়া বৈষ্ণব স্থির করিয়া, গোপালদাসও আমার নিকট আসিয়া উপবেশন করিল, এবং আমার পরিচয় আদি গ্রহণ করিয়া আমার কথায় বিশ্বাস করিল। পরে সেও ভবর নিকট তুলসী-তলায় উপবেশন করিয়া আমার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইল। 

মেদিনীপুর হইতে প্রাপ্ত পত্রে কৃষ্ণ চৌধুরীর যেরূপ বর্ণনা ছিল, গোপালদাসের আকৃতি-প্রকৃতিও ঠিক সেইরূপ বলিয়া আমার অনুমান হইল। আমি মনে মনে একরূপ স্থিরই করিলাম যে, এই গোপালদাস বাবাজীই দস্যু-দলপতি সেই কৃষ্ণ চৌধুরী। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া ভব ও গোপালদাসের নিকট হইতে সে দিবসের জন্য বিদায় গ্রহণ করিলাম, ও “পরদিবস পুনরায় আসিয়া তোমাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিব” এইরূপ বলিয়া সেই দিবসের নিমিত্ত সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

পরদিবস নিয়মিত সময়ে পুনরায় গোপালদাস মোহান্তের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আজ আমি একাকী নহি; যে ব্যক্তি কৃষ্ণ চৌধুরীকে চিনিবার নিমিত্ত মেদিনীপুর হইতে আগমন করিয়াছিল, আজ তাহাকেও বৈষ্ণবের বেশে উত্তমরূপে সজ্জিত করিয়া, তাহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া ভবর বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। আজ সঙ্গে করিয়া কয়েকজন প্রহরীকেও লইয়া গিয়াছিলাম। গোপালদাসের বাড়ীতে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে তাহাদিগকে গোপালদাসের বাড়ীর সন্নিকটবর্তী একস্থানে লুক্কায়িতভাবে রাখিয়া, আমরা গোপাল দাসের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। প্রহরীদিগের সহিত কেবলমাত্র এই বন্দোবস্ত রহিল যে, আমার সমভিব্যাহারী মেদিনীপুরের সেই লোকটি গিয়া তাহাদিগকে সংবাদ দিবামাত্র তাহারা সকলে গোপালদাস মোহান্তের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবে, ও আমার নির্দেশ মত কৃষ্ণকে ধৃত করিবে। আর আমরা উভয়েই একত্র যদি বহির্গত হইয়া চলিয়া যাই, তাহা হইলে তাহারাও সেইস্থান হইতে আপন স্থানে প্রস্থান করিবে, গোপালদাস মোহান্তের বাড়ীতে প্রবেশ করিবার আর প্রয়োজন হইবে না। 

এইরূপে সমস্ত স্থির করিয়া আমরা উভয়েই ভবর বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। যে সময় আমরা বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলাম, সেই সময় ভব ও গোপালদাস মোহান্ত উভয়েই বাড়ীতে ছিল। পূৰ্ব্ব-কথিত তুলসী মঞ্চের নিকট তাহারা উভয়েই উপবেশন করিয়া কথোপকথনে নিযুক্ত ছিল। গোপালদাসকে দেখিবামাত্র আমার সমভিব্যাহারী তাহাকে কৃষ্ণ চৌধুরী বলিয়া চিনিতে পারিল ও সঙ্কেতানুযায়ী আমাকে বলিয়া দিল যে, এই-ই দস্যুদলপতি কৃষ্ণ চৌধুরী। যেস্থানে গোপালদাস ওরফে কৃষ্ণ চৌধুরী ও ভব বসিয়াছিল, আমিও গিয়া সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। “অপর আর এক ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, আমি এখনই প্রত্যাগমন করিতেছি” এই বলিয়া আমার সমভিব্যাহারী সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। 

দেখিতে দেখিতে পূৰ্ব্ব-কথিত প্রহরীগণ আসিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, ও আমার নির্দ্দেশ মত কৃষ্ণ চৌধুরীকে ধৃত করিল। কৃষ্ণ চৌধুরী প্রধান দস্যুদলপতি হইলেও, যেরূপ অবস্থায় সে ধৃত হইল, তাহাতে সে আপনার পরাক্রম দেখাইতে কোন প্রকারেই সমর্থ হইল না। 

এইরূপ অবস্থায় কৃষ্ণ চৌধুরীকে ধৃত করিয়াই যে আমি নিশ্চিন্ত হইলাম, তাহা নহে। ভবর বাড়ী উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। তৈজসপত্র, অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা কিছু তাহার বাড়ীতে পাওয়া গেল, তাহার সমস্তই সন্দেহের মাল বলিয়া, একটি তালিকা প্রস্তুত করিলাম, ও সমস্ত দ্রব্যই পরিশেষে আমাদিগের থানায় আনিলাম। বলা বাহুল্য যে, কৃষ্ণ ও ভব উভয়েই এখন আবদ্ধ অবস্থায় আমাদিগের নিকট রহিল। 

যে সময় গোপালদাস মোহান্ত ওরফে কৃষ্ণ চৌধুরী জানিতে পারিল যে, আমি প্রকৃত বৈষ্ণব নহি, পুলিশ কৰ্ম্মচারী হইয়া বৈষ্ণব বেশে আপনার কার্য্য উদ্ধার করিয়া লইলাম, তখন সে আমাকে সহস্র গালি প্রদান করিল, ও কহিল, “তোমার মত ভণ্ড আমি এ পর্যন্ত দেখি নাই।” 

উত্তরে আমি কহিলাম, “তুমি কিরূপে জানিলে যে, আমি ভণ্ড?” 

কৃষ্ণ। ধর্ম্মের ভাণ করিয়া তোমার এইরূপ অধর্ম্ম আচরণ করাকে কি ভণ্ডামি কহা যায় না? 

আমি। আমি কি অধর্ম্ম আচরণ করিলাম? 

কৃষ্ণ। বিনাপরাধে আমাকে ধৃত করিলে। যদি আমি পূর্ব্বে জানিতে পারিতাম যে, তুমি বৈষ্ণব নহ, ভণ্ড পুলিশ কৰ্ম্মচারী, তাহা হইলে কি তুমি আমাকে এইরূপ নিঃসহায় অবস্থায় আমাকে ধরিতে পারিতে? কখনই না। 

আমি। তোমাকে ধরিয়া আমি অধর্ম্ম আচরণ করি নাই। যে ধর্ম্মের ভাণ করিয়া যে ব্যক্তি দস্যুতাচরণ করিতে পারে, সেই ধর্ম্মের ভাণ করিয়া তাহাকে ধৃত করায় যে কোনরূপ পাপাচার হয়, তাহা আমার বোধ হয় না। কারণ শঠের সহিত শঠতা করায় কোন পাপ নাই। 

কৃষ্ণ। আমি দস্যুদলপতি এ কথা তোমাকে কে বলিল? 

আমি। আমাকে যেই বলুক, আমি জানি, তুমি দস্যুদলপতি। তোমার নাম গোপালদাস মোহান্ত নহে। তোমার প্রকৃত নাম কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী। 

 কৃষ্ণ। মিথ্যা কথা। আমার নাম কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী নহে, বা কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী নামক কোন ব্যক্তিকে আমি চিনিও না।

আমি। যদি তুমি কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী না হও, তাহা হইলে তোমার প্রকৃত নাম কি? 

কৃষ্ণ। আমার নাম গোপালদাস মোহান্ত। 

আমি। মিথ্যা কথা। তোমার নাম কৃষ্ণ চৌধুরী, ইহা আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি। আমার কথা প্রকৃত, কি না, তাহা তুমি একটু পরেই অবগত হইতে পারিবে। 

কৃষ্ণ। একটু পরে আমি কিরূপে অবগত হইবে? 

আমি। যে মেদিনীপুর জেলার ভিতর তোমার বাসস্থান, সেই মেদিনীপুর জেলার যে সকল লোক তোমাকে উত্তমরূপে চিনিতে পারে, তোমাকে তাহাদিগের নিকট লইয়া গেলেই তখন বুঝিতে পারিবে, আমার কথা প্রকৃত, কি তোমার কথা প্রকৃত 

কৃষ্ণ। তখন দেখিবেন, আমার কথা প্রকৃত হইবে। 

আমি। তোমার কথা প্রকৃত হয়, তখন তোমাকে ছাড়িয়া দিব। 

কৃষ্ণ। কেবলমাত্র আমাকে ছাড়িয়া দিবেন। বিনাপরাধে যে আমাকে ধৃত করিলেন, ও নিরর্থক আমাকে যে কষ্ট প্রদান করিলেন, তাহার নিমিত্ত তখন কে দায়ী হইবে? 

আমি। তাহার নিমিত্ত তোমাকে ভাবিতে হইবে না। তখন আমিই তাহার দায়ী হইব। আইনানুযায়ী যাহা কিছু করিতে হয়, তখন তাহা আমার উপরেই করিও। 

কৃষ্ণ। এখন আমাকে কোথায় লইয়া যাইবেন? 

আমি। হাজতে। 

কৃষ্ণ। হাজতে! আমি এমন কি অপরাধ করিয়াছি যে, আমাকে হাজতে যাইতে হইবে? 

আমি। হাজতে থাকিবার উপযুক্ত অপরাধ করিয়াছ, সুতরাং হাজতে থাকিতে হইবে। 

কৃষ্ণ। আমি কি অপরাধ করিয়াছি? 

আমি। এমন বিশেষ কিছু অপরাধ কর নাই, তবে কয়েক স্থানে ডাকাইতি করিয়াছ মাত্ৰ! 

কৃষ্ণ। আমি কোথায় ডাকাইতি করিয়াছি, বা কোন ডাকাইতির দ্রব্য আমার নিকট পাওয়া গিয়াছে? 

আমি। যেস্থানে ডাকাইতি করিয়াছ, তাহা সময় মত তুমি জানিতে পারিবে। আর যে সকল দ্রব্য তোমার ও তোমার উপপত্নী ভবর ঘরে পাওয়া গিয়াছে, সেই সমস্ত দ্রব্যই ডাকাইতির। 

কৃষ্ণ। ও কথা আপনি মনেও করিবেন না। যে সকল দ্রব্য আমাদিগের নিকট পাওয়া গিয়াছে, তাহার প্রত্যেক দ্রব্য আমি কোন না কোন স্থান হইতে খরিদ করিয়াছি, তাহা এক এক করিয়া আমি আপনাদিগকে দেখাইয়া দিব। তখন জানিতে পারিবেন যে, ঐ সকল দ্রব্য অপহৃত দ্রব্য, কি না। 

আমি। তবে কি তুমি বলিতে চাহ যে, যে সকল দ্রব্য তোমার ঘরে পাওয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যে একখানি দ্রব্যও অপহৃত দ্রব্য নহে? 

কৃষ্ণ। আমি যখন কখনও কাহার দ্রব্য অপহরণ করি নাই, তখন আমার ঘরে অপহৃত দ্রব্য আসিবে কি প্রকারে? কৃষ্ণ চৌধুরী যেরূপ ভাবে আমার কথার উত্তর প্রদান করিল, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত দ্রব্য সকলের মধ্যে কোন দ্রব্য অপহৃত দ্রব্য বলিয়া আমরা যে পর্য্যন্ত প্রতিপন্ন করিতে না পারিব, বা যে পর্য্যন্ত কৃষ্ণ চৌধুরীর প্রতীতি না জন্মিবে যে, এবার আর তাহার অব্যাহতি নাই, সেই পর্য্যন্ত সে স্পষ্ট করিয়া কোন কথাই আমাদিগের নিকট প্রকাশ করিবে না। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া গোপালদাস মোহান্ত ওরফে কৃষ্ণ চৌধুরী ও তাহার উপপত্নী ভবকে কয়েদী অবস্থায় আপাততঃ হাজত গৃহে স্থান প্রদান করা হইল। 

মেদিনীপুর পুলিশের যে কর্ম্মচারীর আদেশ মত কৃষ্ণ চৌধুরীকে ধৃত করা হইয়াছিল, সেই পুলিশ কৰ্ম্মচারীকে, কৃষ্ণ ও ভব কিরূপে ধৃত হইয়াছে, তাহা, ও তাহাদিগের নিকট যে সকল দ্রব্য প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তাহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা, বিবৃত করিয়া, এক পত্র লেখা হইল। উক্ত পত্রে আরও লেখা হইল যে, যে সকল বাড়ীতে কৃষ্ণ ডাকাইতি করিয়াছে, বা যে সকল লোক অপহৃত দ্রব্য সকল চিনিতে পারিবে, যত শীঘ্র সম্ভব, তাহাদিগকে এইস্থানে প্রেরণ করা কর্তব্য। কারণ কৃষ্ণ চৌধুরীর নিকট হইতে প্রাপ্ত দ্রব্যাদি অপহৃত দ্রব্য বলিয়া যদি সনাক্ত না হয়, তাহা হইলে কৃষ্ণ ও ভবকে কিরূপে আবদ্ধ করিয়া রাখা যাইতে পারিবে? 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

মেদিনীপুরে পত্র প্রেরিত হইবার কয়েক দিবস পরেই, যে কর্ম্মচারী সেই স্থানের ডাকাইতি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, দুই জন ফরিয়াদীর সহিত তিনি আসিয়া, কলিকাতায় উপনীত হইলেন। যে দুই জন তাঁহার সমভিব্যাহারে আগমন করিল, তাহার একজনের নাম পার্ব্বতী বেওয়া। মেদিনীপুর জেলার মধ্যস্থিত পদনপুর গ্রামে তাহার বাসস্থান। এই পার্ব্বতী বেওয়ার সোনা রূপার অলঙ্কার, তৈজস পত্র প্রভৃতি অনেক দ্রব্য ছিল; কিন্তু কৃষ্ণ চৌধুরী ও তাহার দলভুক্ত ডাকাইতদিগের অনুগ্রহে সে এখন পথের ভিখারিণী হইয়া পড়িয়াছে। তাহার বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া তাহার দ্রব্যাদি ও অর্থাদি এরূপভাবে অপহরণ করা হইয়াছে যে, ভিক্ষা ব্যতীত তাহার জীবনধারণের আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই! 

অপর আর এক ব্যক্তির নাম রামদয়াল বন্দ্যোপাধ্যায়। ইঁহার বাসস্থান শিবানীপুর, সবডিবিজান জাহানাবাদ, জেলা হুগলী। দস্যুগণ পাবর্তী বেওয়ার যেরূপ অবস্থা করিয়াছিল, ইঁহার অবস্থা ততদূর না হইলেও, ইঁহার চির—সঞ্চিত সমস্ত দ্রব্যই ডাকাইতগণ অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছিল। 

গোপালদাস বাবাজীর ঘরে যে সকল দ্রব্যাদি পাওয়া গিয়াছিল, তাহার সমস্তই এক এক করিয়া পার্ব্বতী বেওয়া ও রামদয়াল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখান হইল। সেই সকল দ্রব্যাদি তাঁহারা উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, “আমাদিগের বাড়ী হইতে যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার এক খানিও ইহার মধ্যে নাই।” 

তবে আমার সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস ছিল, গোপালদাসের ঘরে যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে, তাহার সমস্তই অপহৃত দ্রব্য। কিন্তু যখন দেখিলাম যে, ফরিয়াদীদ্বয় তাহার একখানিও চিনিতে পারিল না, তখন আমার মনে হইল, কি আমরা কৃষ্ণ চৌধুরী ভ্রমে অপর আর এক ব্যক্তিকে ধৃত করিয়াছি?—গোপালদাস যাহা বলিয়াছিল, তবে কি তাহার কথাই প্রকৃত সে বাস্তবিকই কৃষ্ণ চৌধুরী নহে, ও তাহার ঘর হইতে প্রাপ্ত দ্রব্যাদি অপহৃত দ্রব্য নহে? 

আমি মনে মনে এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে যে কর্ম্মচারী মেদিনীপুর হইতে ফরিয়াদীদ্বয়কে এখানে আনয়ন করিয়াছিলেন, তিনি আমার নিকট আগমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফরিয়াদীদ্বয় কোন দ্রব্য চিনিতে পারিল কি?” 

আমি। না। এতগুলি দ্রব্যের মধ্যে একখানিও তাহারা নিজের বলিয়া চিনিতে পারিল না। উহাদিগের কথার ভাবে অনুমান হইতেছে যে, এই সকল দ্রব্যের মধ্যে একখানি দ্রব্যও উহাদিগের নহে। 

কর্ম্মচারী। বড়ই দুঃখের বিষয়! তবে কি আমাদিগের এত কষ্ট সমস্তই ব্যর্থ হইবে? 

আমি। আমিও তাহাই ভাবিতেছি। আরও ভাবিতেছি,—এত কষ্ট করিয়াও তবে কি আমরা প্রকৃত কৃষ্ণ চৌধুরীকে ধৃত করিতে পারি নাই? 

কর্ম্মচারী। আপনারা যাহাকে ধৃত করিয়াছেন, ও যাহার গৃহ হইতে এই সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে, সেই ব্যক্তি এখন কোথায়? 

আমি। সে এখন হাজতে আছে। 

কর্ম্মচারী। তাহাকে আমি একবার দেখিতে পাই না? 

আমি। কেন পাইবেন না? ইচ্ছা করিলে, এখনই তাহাকে হাজত হইতে আনাইয়া লইতে পারি। কিন্তু একটি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি,—এখনই তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার বিশেষ কিছু প্রয়োজন আছে কি?

কর্ম্মচারী। এমন বিশেষ প্রয়োজন কিছুই নাই, তবে যাত্রাকে আপনারা ধৃত করিয়াছেন, সে প্রকৃত কৃষ্ণ চৌধুরী, কি না, তাহাই জানিবার ইচ্ছা ছিল। 

আমি। ধৃত ব্যক্তি প্রকৃত কৃষ্ণ চৌধুরী কি অপর কোন ব্যক্তি, তাহা আপনি কিরূপে জানিতে পারিবেন? আপনি কৃষ্ণ চৌধুরীকে চিনেন কি? 

কর্ম্মচারী। আমার বিশ্বাস, আমি কৃষ্ণ চৌধুরীকে চিনি। তাহাকে দেখিলে, আমি তাহাকে চিনিতে পারিব, সেও আমাকে চিনিতে পারিবে। পূর্ব্বে যে মোকদ্দমায় কৃষ্ণ চৌধুরীর কারাদণ্ড হয়, সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান সময়ে আমিও সেই স্থানে উপস্থিত ছিলাম। পরিশেষে কৃষ্ণ চৌধুরী যখন জেল হইতে মুক্ত হয়, সেই সময় আমার নিকটেই সে প্রেরিত হইয়াছিল, আমিই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। সুতরাং আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস যে, কৃষ্ণ চৌধুরীকে দেখিলেই আমি চিনিতে পারিব। 

কর্মচারীর কথা শুনিয়া আমার মনে একটু আনন্দের উদয় হইল। ভাবিলাম,—আমি মনে মনে যে সন্দেহ করিতেছিলাম, এখনই আমার সেই সন্দেহ দূর হইবে,—এখনই আমি অবগত হইতে পারিব যে, আমরা প্রকৃত কৃষ্ণ চৌধুরীকে ধৃত করিতে সমর্থ হইয়াছি, কি ভ্রমক্রমে অপর কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে ধৃত করিয়া অনর্থক তাহাকে হাজত গৃহে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, গোপালদাস মোহান্ত ও ভব উভয়কে তখনই হাজত হইতে আনাইয়া লইলাম। গোপাল দাসকে দেখিবামাত্রই কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “কি হে কৃষ্ণ! তুমি পুনরায় ধৃত হইয়াছ?” 

কৃষ্ণ। হাঁ মহাশয়! ধৃত হইয়াছি। পূৰ্ব্বে দোষ করিয়াছিলাম, কাজেই ধৃত হইয়াছিলাম। সুতরাং সে সময়ে আমার কোনরূপ আক্ষেপ হইয়াছিল না। এবার কিন্তু মহাশয়! একান্ত বিনাদোষে ধৃত হইয়াছি। 

কর্ম্মচারী। কিরূপ বিনাদোষে ধৃত হইয়াছ? দোষ করিয়াছ বলিয়া তোমার নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে, সুতরাং তুমি ধৃত হইয়াছ। 

কৃষ্ণ। আমি কি দোষ করিয়াছি, যে, আমার নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইবে? 

কর্ম্মচারী। ডাকাইতি করিয়াছ। 

কৃষ্ণ। আমি কোথায় ডাকাইতি করিয়াছি? 

কর্ম্মচারী। মেদিনীপুর জেলার মধ্যে এক স্থানে ডাকাইতি করিবার সময় তোমাকে এক ব্যক্তি চিনিতে পারিয়াছিল। তদ্‌ব্যতীত তোমার দলের যে সকল লোক সেই ডাকাইতিতে সেই সময় ধৃত হয়, তাহার মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি তোমার নামও বলিয়া দিয়াছিল। 

কৃষ্ণ। মিথ্যা কথা। জেল হইতে খালাস হইবার পর, আমি যখন কোন ডাকাইতিতে মিশ্রিত হই নাই, তখন ডাকাইতি করিবার সময়, আমাকে কিরূপে চিনিতে পারিবে? আর যাহারা ধৃত হইয়াছিল, তাহারাই বা মিথ্যা করিয়া আমার নাম কেন বলিয়া দিবে? 

কর্ম্মচারী। তবে কি তুমি এখন ডাকাইতি ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়াছ? 

কৃষ্ণ। অনেক দিবস হইতে আমি ওরূপ কার্য্য পরিত্যাগ করিয়াছি। বুঝিতে না পারিয়া যৌবনকালে যাহা করিয়াছিলাম, তাহার আর কোন কথা নাই; কিন্তু এখন আমি ক্রমেই বৃদ্ধ হইয়া পড়িতেছি, সুতরাং পাপকাৰ্য্য সকল পরিত্যাগ করিয়া, এখন যাহাতে কিছু ধৰ্ম্ম উপার্জ্জন করিতে পারি, তাহারই চেষ্টায় আছি। তীর্থে তীর্থে ঘুরিয়াই এখন দিন কাটাই। 

কৰ্ম্মচারী। এখন যদি ডাকাইতি ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়া, ধর্ম্ম-কর্ম্মে মনঃসংযোগ করিয়া থাক, তাহা হইলে ঘর বাড়ী, এমন কি দেশ পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া, অপর নামে আপনার পরিচয় দিয়া, লুক্কায়িতভাবে কলিকাতায় বাস করিতেছ কেন? 

কৃষ্ণ। আপনাদিগের অত্যাচারে জেল হইতে খালাস হইবার পর, কিছু দিবস দেশে বাস করিয়াও দেখিয়াছি, যে স্থানে ও যাহা কর্তৃক ডাকাইতি হইবে, আপনারা অমনি আসিয়া আমার অনুসন্ধান লইবেন, আমার খানাতল্লাসি করিবেন ও বিনা-দোষে আমাকে লইয়া যথেষ্ট কষ্ট প্রদান করিবেন। এরূপ অবস্থায় কাজেই আমাকে দেশ পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে; আর নামও পরিবর্তিত করিয়া এখন গোপালদাস মোহান্ত নামে এইস্থানে বাস করিতেছি। 

কর্ম্মচারী। আমি তোমাকে উত্তমরূপে চিনি; সুতরাং তোমার ওরূপ মিষ্ট কথায়, তুমি আমাকে কখনই ভুলাইতে পারিবে না। এখন বল দেখি কৃষ্ণ! ইদানীং যে সকল ডাকাইতিতে তুমি দলপতির কার্য্য করিয়াছ, সেই সকল ডাকাইতির কোন দ্রব্য এখন পর্য্যন্ত তোমার নিকট আছে, কি না? 

কৃষ্ণ। আমার ঘরে যে সকল অলঙ্কার -পত্র বা দ্রব্যাদি ছিল, তাহার সমস্তই এইস্থানে আনীত হইয়াছে। যে সকল বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছে, তাহাদিগের প্রত্যেককে আনাইয়া ঐ সকল দ্রব্যাদি দেখান, তাহা হইলেই জানিতে পারিবেন যে, কোন ডাকাইতির মাল আমার ঘরে আছে, কি না। 

কর্ম্মচারী। যে সকল দ্রব্য সর্ব্বদা তোমার ঘরে সকলেই দেখিতে পাইবে, অপহৃত দ্রব্যের মধ্য হইতে সেরূপ দ্রব্য প্রকাশ্যরূপে রাখিবার পাত্র তুমি নহ। অপহৃত কোন দ্রব্য যদি তোমার নিকট থাকে, তাহা তুমি প্রকাশ্য ভাবে রাখ নাই, কোন গুপ্তস্থানে লুক্কায়িত ভাবে তুমি সেই সকল দ্রব্য রাখিয়াছ। ডাকাইতি ব্যতীত অপর কোন কার্য্য, তোমার জীবনে কখনও তুমি কর নাই, অথচ তীর্থে তীর্থে পর্য্যটন করিতে তুমি যে সকল অর্থ ব্যয় করিয়া থাক, তাহাই বা তুমি কোথা হইতে পাইয়া থাক? অপহৃত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া, তীর্থ পর্যটন প্রভৃতির সমস্ত ব্যয় তুমি নির্ব্বাহ করিয়া থাক না কি? 

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া কৃষ্ণ আর কোন কথা কহিল না; নিতান্ত মৌনভাবে সেই স্থানে বসিয়া রহিল। কর্ম্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া, পরিশেষে আমি স্থির করিলাম যে, কৃষ্ণ চৌধুরীর গৃহ পুনরায় আর একবার উত্তম রূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখা আবশ্যক। প্রকাশ্যভাবে কৃষ্ণ চৌধুরী যে সকল দ্রব্য রাখিয়াছিল, তাহার সমস্তই আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি। এখন দেখা আবশ্যক যে, গুপ্তভাবে কোন দ্রব্য সে বাড়ীর কোন স্থানে রাখিয়া দিয়াছে, কি না। লুক্কায়িত দ্রব্য যদি কিছু পাওয়া যায়, তাহা হইলে সেই সমস্ত দ্রব্য নিশ্চয়ই অপহৃত দ্রব্য হইবার সম্ভাবনা। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

কৃষ্ণ চৌধুরী যে বাড়ীতে বাস করিয়া থাকে, উত্তমরূপে পুনরায় সেই বাড়ীর অনুসন্ধান করা আবশ্যক, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, মেদিনীপুর হইতে যে কৰ্ম্মচারী আগমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে, কৃষ্ণ চৌধুরীকে, ভবকে, ফরিয়াদীদ্বয়কে ও অপরাপর কয়েকজন লোককে সঙ্গে লইয়া পুনরায় ভবর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

সিন্ধুক, বাক্স প্রভৃতি গৃহের প্রকাশ্য পদার্থ সকল পূর্ব্বেই অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, পুনরায় সেই সকল দ্রব্যের অনুসন্ধান করিবার আর প্রয়োজন হইল না। এবার প্রথম হইতেই ঘরের মেজের উপর আমাদিগের দৃষ্টি পড়িল। যে ঘরে কৃষ্ণ ও ভব শয়ন করিত, প্রথমতঃ সেই ঘরের মেজে একদিক হইতে উত্তমরূপে খনন করিতে আরম্ভ করিলাম। প্রায় অর্দ্ধেক আন্দাজ খনন করা হইলে পর, একস্থানে একটি মৃত্তিকা নির্ম্মিত হাঁড়ীর উপর আমাদিগের নয়ন আকৃষ্ট হইল। যত্নের সহিত উক্ত হাঁড়িটি উঠাইলাম; দেখিলাম যে, স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্ম্মিত অলঙ্কার দ্বারা উহা পরিপূর্ণ। 

এইরূপ অবস্থায় যে সকল অলঙ্কার প্রাপ্ত হওয়া গেল, তাহার মধ্যে অনেকগুলি অলঙ্কার পাবর্তী বেওয়া সনাক্ত করিল, ও কহিল, “আমার ঘর হইতে যে সকল অলঙ্কার ডাকাইতগণ কর্তৃক অপহৃত হইয়াছে, তাহার সমস্তগুলি দেখিতে পাইতেছি না; কিন্তু অধিকাংশই এই হাঁড়ীর ভিতর আছে। আমার অলঙ্কারগুলি ব্যতীত অপরাপর যে সকল অলঙ্কার দেখিতে পাইতেছি, তাহা আমার নহে, বা উহা কাহার, তাহাও আমি অবগত নহি।” 

রামদয়াল বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমাদিগের সহিত সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও উক্ত অলঙ্কারগুলি উত্তমরূপে দেখিলেন, ও পরিশেষে কহিলেন, “আমার বাড়ী হইতে অপহৃত অলঙ্কারের মধ্যে কোন অলঙ্কারই ইহার মধ্যে নাই।” মৃত্তিকার ভিতর হইতে এক হাঁড়ী স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্ম্মিত অলঙ্কার প্রাপ্ত হইয়া, আমাদিগের মনে অনেক আশা হইল। ভাবিলাম, উত্তমরূপ অনুসন্ধান করিলে, আরও অনেক অলঙ্কার কৃষ্ণ চৌধুরীর বাড়ীতে প্রাপ্ত হইতে পারিব। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, ঘরের সমস্ত স্থান তন্ন তন্ন করিয়া খুঁড়িয়া ফেলিলাম; কিন্তু আর কোন স্থান হইতে অপর কোন দ্রব্য প্রাপ্ত হইলাম না। 

বাড়ীর সমস্ত স্থানই প্রায় একরূপ খনন করার হইয়াছিল, কেবলমাত্র অবশিষ্ট ছিল—তুলসীমঞ্চ। যে তুলসীমঞ্চের নিকট কৃষ্ণ চৌধুরী সৰ্ব্বদা বসিয়া থাকিত, সেই স্থানটি খনন করিয়া দেখা কর্তব্য কি না, ও তুলসী গাছ উঠাইয়া ফেলিয়া তাহার নিম্নে মৃত্তিকার মধ্যে উত্তমরূপে সন্ধান করিয়া দেখা উচিত, কি না, মনে মনে তখন এই চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল। একটু চিন্তার পর এক রূপ স্থির করিলাম যে, তুলসী-মঞ্চের নিম্নভাগ উত্তমরূপে খনন করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য। 

কর্তব্য কর্ম্মের অনুরোধে যাহা কর্তব্য বলিয়া মনে মনে স্থির করিলাম, সেই কার্য্য সমাধা করিতে কিন্তু হঠাৎ সাহস হইল না। কৃষ্ণ চৌধুরী ডাকাইত হইলেও সে হিন্দু। যেস্থানে বসিয়া সে ঈশ্বর আরাধনা করিয়া থাকে, আমি হিন্দু হইয়া হঠাৎ সেই স্থানের উপর কিরূপে হস্তক্ষেপ করিতে পারিব, মনে সেই ভাবনার উদয় হইল। বিশেষতঃ হিন্দুর আরাধ্য তুলসীর অবমাননা করিতেও মন সহসা প্রবৃত্ত হইল না। এইরূপ অবস্থায় পতিত হইলে, হিন্দুর কিরূপ মনের ভাব হইয়া থাকে, তাহা হিন্দুমাত্রেই সহজে অনুমান করিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় আমার কি কর্তব্য, হঠাৎ‍ তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমি একটু দূরে গিয়া উপবেশন করিলাম। 

মেদিনীপুর হইতে যে কর্ম্মচারী আগমন করিয়াছিলেন, তিনি মুসলমান। সুতরাং তাঁহার অবস্থা ও আমার অবস্থায় অনেক প্রভেদ। তাঁহার মনের ভাব অপেক্ষা আমার মনের ভাবের পার্থক্য বিস্তর। আমাকে দূরে গিয়া উপবেশন করিতে দেখিয়া, তিনি কি বুঝিলেন, তাহা বলিতে পারি না, বা আমার মনের ভাব তিনি কিছু বুঝিতে পারিলেন কি না, তাহা আমি অবগত নহি; কিন্তু আমার দিকে লক্ষ্যপাত না করিয়া বা আমাকে কোন কথা আর জিজ্ঞাসাও না করিয়া, তিনি স্বহস্তে তুলসীমঞ্চ হইতে তুলসী বৃক্ষ উৎপাটন করিয়া ফেলিলেন, ও তুলসীমঞ্চ ভাঙ্গিয়া ফেলিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তুলসীমঞ্চের অত্যল্প মাত্র ভাঙ্গিবামাত্রই দেখিতে পাওয়া গেল, উহার ভিতরও একটি মৃত্তিকা নিৰ্ম্মিত বেশ বড় রকমের হাঁড়ী রহিয়াছে। উক্ত হাঁড়ীর অধিকাংশ সুবর্ণময় অলঙ্কারে পরিপূর্ণ, অবশিষ্টাংশ রৌপ্য নিৰ্ম্মিত অলঙ্কার ও নগদ টাকায় পূর্ণ। 

উক্ত মৃৎপাত্রের মধ্যে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার কতকগুলি রামদয়াল বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সনাক্ত হইল। অবশিষ্টগুলি কাহার, তাহা পরে জানিতে পারিলেও তখন কিন্তু তাহা অবগত হইতে পারিলাম না। 

কৃষ্ণ চৌধুরী ও ভবর বাড়ী হইতে প্রায় সমস্ত দ্রব্যাদির সহিত কৃষ্ণ চৌধুরী ও ভবকে লইয়া পুনরায় থানায় আগমন করিলাম। 

এখন কৃষ্ণ চৌধুরী বুঝিতে পারিল যে, এ যাত্রা তাহার আর কোনরূপেই নিস্তার নাই। তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, সে সকল কথা স্বীকার করিল। কিরূপে সে প্রথম ডাকাইতি কার্য্য আরম্ভ করে ও পরিশেষে কিরূপে সে দলপতি পর্য্যন্ত হইয়াছিল, কিরূপে ও কোন্ কোন্ স্থানে সে ডাকাইতি করিয়াছে, এক এক করিয়া, সমস্ত কথাই সে পরিশেষে আমাদিগের নিকট স্বীকার করিল। 

কৃষ্ণ চৌধুরী সম্বন্ধে এখানে অপরাপর আর যে কোন অনুসন্ধান বাকী ছিল, দুই তিন দিবসের মধ্যে ক্রমে তাহাও শেষ হইয়া গেল। সমস্ত অলঙ্কার-পত্রের সহিত পরিশেষে কৃষ্ণ চৌধুরীকে মেদিনীপুরে প্রেরণ করা হইল। 

মেদিনীপুরে গমন করিয়াও কৃষ্ণ চৌধুরী অনুসন্ধানকারী পুলিশ কর্মচারীগণকে বা বিচারকদিগকে আর কোনরূপে কষ্ট প্রদান করিল না; যিনি তাহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, সে তাঁহাকে তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিল। 

কৃষ্ণ চৌধুরীর নির্দ্দেশ মত পরিশেষে আরও অনেক গুলি ডাকাইত ধৃত হয়, ও তাহাদিগের নিকট হইতেও অনেকগুলি ডাকাইতির অনেক মাল বাহির হইয়া পড়ে। 

মেদিনীপুরের মাজিষ্ট্রেটের নিকট কৃষ্ণ চৌধুরীর মোকদ্দমা প্রথমে শুনানি হয়। তিনি উপস্থিত মত সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করিয়া দলবলের সহিত কৃষ্ণকে মেদিনীপুরের দায়রায় প্রেরণ করেন। দায়রার বিচারে পরিশেষে কৃষ্ণ চৌধুরী চিরদিনের নিমিত্ত নির্ব্বাসিত হয়। আণ্ডামান হইতে প্রত্যাগত লোকদিগের মুখে শুনিতে পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণ চৌধুরী সেইস্থানে এখন পৰ্য্যন্ত জীবিত আছে। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী তাহার বাল্যকাল হইতে আরম্ভ করিয়া, এই বৃদ্ধাবস্থা পর্য্যন্ত যে সকল কার্য্য করিয়াছে, তাহার যথাযথ পরিচয় আমার নিকট প্রদান করিয়াছিল। আমিও তাহার জবানবন্দীচ্ছলে আমার দৈনিক লিপিতে লিখিয়া রাখিয়াছিলাম। তাহার জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইস্থানে পাঠকগণকে উপহার প্রদান করা, বোধ হয়, আমার নিতান্ত কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম। কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী বলিয়াছিল—

“আমার নাম কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী। আমার বাসস্থান মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত সালবনি থানার এলাকাস্থিত সালবনি গ্রামে। আমার বিবাহ হইবার অল্পদিবস পরেই আমার পিতার মৃত্যু হয়। পিতা যতদিবস বর্তমান ছিলেন, তত দিবস সাংসারিক কোন কার্য্যে আমি কখন হস্তক্ষেপ করি নাই। পিতার উপার্জিত অর্থে অনায়াসে দিন যাপন করিতাম। আমার নিত্য নৈমিত্তিক কার্য্যের মধ্যে প্রধান কার্য্য ছিল—কুস্তিকরা ও লাঠিখেলা। বাল্যকালেই লাঠি খেলিতে আমি এরূপ নিপুণ হইয়াছিলাম যে, গ্রামের মধ্যে সেই সময় যে সকল ব্যক্তি লাঠি খেলিতে জানিতেন, তাঁহারা আমার নিকট পরাজয় স্বীকার করিতেন। 

“পিতা বৰ্ত্তমান থাকিতে এমন কোন কর্ম্ম-কার্য আমি শিক্ষা করি নাই যে, পিতার অবর্তমানে সেই কার্য্য করিয়া আমি অনায়াসে দিনপাত ও পরিবার প্রতিপালন করিতে সমর্থ হই। পিতার পরলোকপ্রাপ্তিতে সংসারের সমস্ত ভারই আমার উপর পতিত হইল; কিন্তু সংসারের ব্যয় নির্ব্বাহ করিবার অপর কোন উপায় না জানায়, বাধ্য হইয়া আমার বাল্য-সহায় লাঠির আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইল। 

“আমাদিগের প্রদেশস্থ জমিদার, মহাজন, বা অপরকোন ধনশালী লোকের কোনরূপে লাঠিয়ালের প্রয়োজন হইলে, আমার দ্বারাই তাঁহাদিগের সামান্য সামান্য লাঠিয়ালের কার্য্য নিৰ্ব্বাহ হইত; কিন্তু তাঁহাদিগের নিকট যেরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হইতাম, তাহাতে কোনরূপে দিনযাপন হইত মাত্র। পিতার জীবিতাবস্থায় আমি যেরূপ ভাবে খরচ-পত্র করিয়া আসিতে ছিলাম, এখন সেই সকল খরচ ক্রমেই বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল; সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া, অৰ্থ উপার্জ্জনের নিমিত্ত আমাকে অপর পন্থা অবলম্বন করিতে হইল। 

যে সময় আমি জমিদার মহাশয়ের নিকট ঠিকা কাৰ্য্যে নিযুক্ত ছিলাম, সেই সময় বলপূর্ব্বক একখণ্ড জমী জমিদার মহাশয়ের দখল করিবার প্রয়োজন হয়। উক্ত কার্য্য কেবলমাত্র আমার দ্বারা সম্পন্ন হইবার আশা না থাকায়, অপরাপর স্থান হইতে তিনি আরও কয়েকজন লাঠিয়ালকে আনয়ন করেন। উক্ত লাঠিয়ালগণের মধ্যে গোপাল নামক এক ব্যক্তির সহিত আমার একটু ভালবাসা জন্মায়। তাহার পর হইতে সময় সময় গোপাল আমার বাড়ীতে আগমন করিত, আমিও মধ্যে মধ্যে তাহার বাটীতে গমন করিতাম। আমার তাবস্থা দেখিয়া গোপাল সৰ্ব্বদা বলিত, ‘চলাচলের পক্ষে তোমার অত্যন্ত অনটন। কিন্তু তুমি যেরূপ উপযুক্ত লোক, তাহাতে অন্নবস্ত্রের কষ্ট হওয়া নিতান্ত অন্যায়। সুযোগমতে আমি সঙ্গে করিয়া অপর আর এক কার্য্যে লইয়া যাইব, ও দেখিব, তোমার কষ্ট আমি কোন প্রকারে দূর করিতে পারি, কি না।’ গোপাল মধ্যে মধ্যে আমাকে এইরূপ বলিত সত্য; কিন্তু কি কার্য্যে যে আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবে, তাহা কোনমতে আমাকে বলিত না; অথচ সঙ্গে করিয়াও কোনস্থানে লইয়া যাইত না। 

“এইরূপে কিছু দিবস গত হইবার পর, এক দিবস সন্ধ্যার পর গোপাল আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল, ও কহিল, ‘আমরা বিশেষ লাভজনক কোনরূপ কার্য্যে অদ্যই গমন করিতেছি, তুমিও আমাদিগের সহিত আগমন কর।’ গোপাল কি কার্য্যে গমন করিতেছে, তাহা বিশেষরূপে জানিতে না পারিলেও, সেই রাত্রিতে আমি তাহার সহিত গমন করিলাম। রাত্রি দুই প্রহরের পর জানিতে পারিলাম যে, আমরা কি কার্য্যে গমন করিয়াছি। সেই সময়ে একবার মনে হইল,—এরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা কর্তব্য নহে। কিন্তু গোপালের পরামর্শমতে, ও নিজের অবস্থার দিকে দৃষ্টি করিয়া, পরিশেষে গোপালের প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। 

“আমি গোপালের সহিত কি কার্য্যের নিমিত্ত গমন করিয়াছি, তাহা বোধ হয়, পাঠকগণ এতক্ষণে বুঝিতে পারিয়াছেন। উক্ত কার্য্য আর কিছুই নহে, ডাকাইতি। আমরা প্রায় পঁচিশজন লোক এইরূপে দলবদ্ধ হইয়া, সেই রাত্রিতেই একজন গৃহস্থের বাড়ীতে ডাকাইতি করিলাম। কিরূপে ডাকাইতি করিতে হয়, ইহার পূর্ব্বে তাহা আমি জানিতাম না; এই আমার প্রথম ডাকাইতি। মসাল সকল প্রজ্বলিত করিয়া বাড়ীর দরজা জানালা ভাঙ্গিয়া, ভয়ানক বিকট চীৎকার করিয়া অনেকেই সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। কয়েকজন অস্ত্র শস্ত্র লইয়া বাহিরে রহিল মাত্র। অস্ত্রের মধ্যে আমার হস্তে কেবলমাত্র একগাছি লাঠি ছিল। উহাদিগের সহিত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে আমার সাহস হইল না, লাঠি হস্তে আমি বাড়ীর বাহিরে একস্থানে দণ্ডায়মান রহিলাম। ইচ্ছা—যদি কেহ আমার উপর আক্রমণ করেও আমি কোনরূপে যদি আত্ম-রক্ষা করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে, আমি সেই স্থান হইতে অনায়াসেই পলায়ন করিতে পারি। 

“আমি যে দলের সহিত গমন করিয়াছিলাম, তাহাদিগের অবস্থা দৃষ্টি করিয়া, ও তাহাদিগের ভয়ানক চীৎকার শব্দ শ্রবণ করিয়া গ্রামস্থ সমস্ত লোকই বিশেষরূপে ভীত হইয়া পড়িল; সুতরাং আমাদিগকে আক্রমণ করিবার অভিপ্রায়ে কেহই আমাদিগের নিকট আগমন করিল না। কিন্তু বাটীর ভিতর হইতে কেবল ভয়ানক শব্দ মধ্যে মধ্যে বাহির হইতে লাগিল। যাহারা লুঠ করিতে বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াছিল, এইরূপে প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টাকাল গত হইলে পর, তাহারা সকলেই বাহিরে আগমন করিল, ও আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। ক্রমে সেই গ্রাম হইতে বহির্গত হইয়া, আমরা আমাদিগের সাধ্যমত দ্রুতপদে চলিতে লাগিলাম। এইরূপে ক্রমাগত দুই ঘণ্টাকাল চলিয়া একটি পুষ্করিণীর ধারে গিয়া, আমরা সকলে উপবেশন করিলাম। লুণ্ঠন করিয়া যে সকল দ্রব্য আনীত হইয়াছিল, সেই পুষ্করিণীর ধারে বসিয়া সকলে সেই সকল দ্রব্য বণ্টন করিয়া লইলাম। কোন ব্যক্তি কি পাইল, তাহা আমি জানিতে পারিলাম না; কিন্তু গোপাল আমাকে পঁচিশ টাকা প্রদান করিল, ও কহিল, ‘খুব সাবধানে থাকিও। আর এই কথা যেন কাহারও নিকট কোনরূপে প্রকাশ করিয়া ফেলিও না। যে দিবস আমরা এইরূপ কার্য্যে পুনরায় গমন করিব, সেই দিবস তোমাকেও সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব।’ গোপালের কথা শুনিয়া ও একবারে নগদ পঁচিশ টাকা প্রাপ্ত হইয়া, আমি যে কি পৰ্য্যন্ত সন্তুষ্ট হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। যাহা হউক, ক্রমে উক্ত পুষ্করিণীর নিকট হইতে আমরা সকলেই পৃথক্ হইয়া পড়িলাম, ও যাহার যে দিকে ইচ্ছা, সে সেই দিকেই গমন করিল। আমি আমার গ্রামাভিমুখেই আগমন করিলাম, ও প্রভাত হইবার অগ্রেই আমার বাড়ীতে আসিয়া উপনীত হইলাম। 

“এইরূপে কিছু দিবস অতীত হইবার পর গোপালের সহিত পুনরায় আর একস্থানে গমন করিলাম। এবার প্রথম বার অপেক্ষা আমার অধিক সাহস হইয়াছিল। স্বহস্তে সম্পূর্ণ রূপে ডাকাইতি না করিলেও এবার কিন্তু বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, ও কিরূপে ডাকাইতি করিতে হয়, তাহা স্বচক্ষে দর্শন করিলাম। এবার আমার তাংশে প্রায় চল্লিশ টাকা পড়িল। 

“তৃতীয় বারও গোপালের সহিত গমন করিলাম। এবার স্বহস্তে ডাকাইতিও করিলাম। অংশ করিয়া নগদ প্রায় একশত টাকা ও কয়েকখানি সোণা রূপার অলঙ্কারও পাইলাম কিন্তু এবার শুনিয়াছিলাম যে, পুলিস এই ডাকাইতির কিছু সন্ধান প্রাপ্ত হইয়াছে, গোপাল প্রভৃতি চারি পাঁচজন লোক ধৃতও হইয়াছে, ও তাহাদিগের নিকট হইতে কিছু কিছু অপহৃত দ্রব্যও পাওয়া গিয়াছে। এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিয়া, আমার মনে মনে অতিশয় ভয় হইল। ভাবিলাম—এইবার বুঝি ধরা পড়িলাম; কিন্তু দেখিলাম, যাহারা ধৃত হইয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহই আমার বা অপরাপর কোন ব্যক্তির নাম প্রকাশ করিল না। সুতরাং আমাদিগের বিষয় পুলিস কিছুমাত্রই অবগত হইতে পারিল না। গোপাল প্রভৃতি যে কয় ব্যক্তি ধৃত হইয়াছিল, তাহারা সকলেই কারাগারে প্রেরিত হইল, ও কিছু দিবস পরেই জেলের মধ্যে গোপাল মরিয়া গেল 

“দলের অবশিষ্ট আমরা যে কয় ব্যক্তি ছিলাম, এই ঘটনার পর কিছু দিবস আমরা চুপ করিয়া রহিলাম। কিন্তু পরিশেষে আরও কয়েকজন লোক সংগৃহীত হইলে পুনরায় আমরা কার্য্য-ক্ষেত্রে অবতরণ করিলাম, ও একাদিক্রমে চারি স্থানে উপর্যুপরি চারিটি ডাকাইতি করিলাম। বলা বাহুল্য যে, এই কয়েকটি ডাকাইতি করিয়া আমরা বিস্তর অর্থের সংস্থান করিয়া লইলাম। কিন্তু এই ডাকাইতি মোকদ্দমা সকলের অনুসন্ধান, পুলিসও প্রাণপণে করিতে লাগল, ও ক্রমে ক্রমে আমাদিগের দলস্থিত অনেক ব্যক্তিকেই ধৃত করিয়া কারাগারে প্রেরণ করিল। এবারও আমার নাম প্রকাশিত হইল না, সুতরাং আমি ধৃতও হইলাম না। 

“এইরূপে ক্রমান্বয়ে পাঁচ সাতবার ডাকাইতি করিয়া, আমিও একজন পাকা ডাকাইত হইয়া পড়িলাম। এইরূপে কিছুদিন গত হইলে পর, নিজেই দলবল সংগ্রহ করিয়া ক্রমে আমি দলপতি হইয়া পড়িলাম। 

“দলপতি হইয়া একাদিক্রমে নানাস্থানে আমি ছয়টি ডাকাইতি করিলাম। আমি যখন যে বাটীতে ডাকাইতি করিতাম, তখন কিছু দিবস পূর্ব্বে কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, সেই বাড়ীতে গমন করিতাম। কখন ভিখারীবেশে ভিক্ষাচ্ছলে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, বাড়ীর সমস্ত অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া লইতাম; কখন গণক সাজিয়া অন্তঃপুরের ভিতর পর্যন্ত গমন করিতাম; কখন বা অতিথিবেশে সেই বাড়ীতে রাত্রিযাপন করিতাম। এইরূপ উপায়ে সেই বাড়ীর অবস্থা উত্তমরূপে অবগত হইয়া দুই চারি দিবস মধ্যেই সদলবলে রাত্রিযোগে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া অভিলষিত কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়া আসিতাম। এইরূপে ডাকাইতি করিতে গিয়া সকল সময়েই যে নির্ব্বিবাদে কাৰ্য্য শেষ করিতে পারিয়াছি, তাহা নহে,—সময় সময় গ্রামের লোকজন একত্র হইয়া, আমাদিগকে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছে—কখন বা সদলবলে পুলিস আসিয়া, আমাদিগের সম্মুখীন হইয়াছে; কিন্তু কখন কাহাকেও গ্রাহ্য করি নাই, নিজ হস্তস্থিত লাঠির জোরে সকলকেই পরাস্ত করিয়া সদলবলে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছি; পরে কেহ অনুসরণ করিয়া, আমাদের সন্ধান করিতে সমর্থ হয় নাই। 

“আমি যত দিবস দলপতির কার্য্য করিয়াছি, তাহার মধ্যে কখন কোন স্ত্রীলোককে বিশেষরূপে যন্ত্রণা দিয়াছি বলিয়া, আমার মনে হয় না; কিন্তু নিশ্চয় বলিতে পারি, ডাকাইতি করিবার কালীন কখন কোন স্ত্রীলোকের সতীত্ব নষ্ট করি নাই। কিন্তু সকল সময়েই বাড়ীর সমস্ত স্ত্রীলোককে এক ঘরের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। বৃদ্ধ বা বালকের উপরও কখন বিশেষরূপে অত্যাচার করি নাই; কিন্তু যুবকদিগের উপর যে কিরূপ ভয়ানক অত্যাচার করিয়াছি, তাহা বর্ণনা করিবার ক্ষমতা আমার নাই। 

“এইরূপে উপর্যুপরি কয়েকটি ডাকাইতি করিবার পরই ক্রমে আমার নাম প্রকাশিত হইয়া পড়িল। পুলিস জানিতে পারিল যে, সেই প্রদেশের দস্যুদিগের প্রধান দলপতিই এখন আমি। সুতরাং আমরা এখন পুলিসের বিশেষরূপ দৃষ্টিতে পতিত হইলাম। ক্রমে তাহারা আমার বাড়ীর খানাতল্লাসী করিল; কিন্তু আমার নিকট অপহৃত কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইল না। সেই সময়ে আমার দলস্থিত অনেকেই ধৃত হইয়া রাজার বিচারে কারাগারে প্রেরিত হইল; কিন্তু আমার বিপক্ষে কোন প্রমাণ প্রাপ্ত না হওয়ায় পুলিস আমাকে আইনানুসারে অব্যাহতি প্রদান করিল। 

“এই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবামাত্র, আবশ্যকীয় কয়েকজন লোক সংগ্রহ করিয়া ও আমার পূর্ব্ব গঠিত দলের অবশিষ্ট লোকদিগকে লইয়া, পুনরায় আর একটি দলের সৃষ্টি করিলাম, ও উপর্যুপরি দুইস্থানে ডাকাইতিও করিলাম। বলা বাহুল্য, এবারও পুলিস আমাকে সন্দেহ করিয়া, আমার খানাতল্লাসী করিল; কিন্তু কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইল না, আমার দলস্থিত কয়েকজন লোক এবারও ধৃত হইল, তাহাদিগের নিকট হইতে কিছু কিছু অপহৃত দ্রব্যও বাহির হইল। এইবার তাহাদিগের মধ্যে দুইজন আমার নামও করিয়াছিল। পুলিস এ সুযোগ পরিত্যাগ না করিয়া উক্ত ডাকাইতি মোকদ্দমায় অন্যান্য সকলের সহিত আমাকেও আসামী করিয়া চালান দিল। বিচারে অপর সকলেরই মেয়াদ হইয়া গেল, কেবলমাত্র আমিই অব্যাহতি পাইলাম। আমার বিপক্ষে বিশেষরূপ প্রমাণ না থাকায়, জজ সাহেব আমাকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। আমি আনন্দিত মনে নিজের বাটীতে আসিয়া উপনীত হইলাম। 

“এতগুলি ডাকাইতি করিবার পরে যদিচ এইবার ধৃত হইলাম, তথাপি বিচারে অব্যাহতি পাইয়া, আমার সাহস আরও দ্বিগুণ বর্দ্ধিত হইল। দলবল সংগ্রহ করিয়া পুনরায় ডাকাইতি করিতে আরম্ভ করিলাম। আমার নেতৃত্বে যে কয়েকটি ডাকাইতি হইল, তাহার একটিতেই আমি ধৃত হইলাম না; কিন্তু যে ডাকাইতির সহিত আমার কোনরূপ সংস্রব ছিল না, সেইরূপ একটি ডাকাইতি মোকদ্দমায় পুলিস আমাকে ধৃত করিল, ও আমার বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া বিচারার্থ আমাকে প্রেরণ করিল। আমার মনে মনে অত্যন্ত সাহস ছিল যে, যখন প্রকৃত মোকদ্দমায় অব্যাহতি পাইয়াছি, তখন মিথ্যা মোকদ্দমায় আমার কোনরূপেই দণ্ড হইবে না। কিন্তু কার্য্যে দেখিলাম যে, আমার বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপ ভ্রমাত্মক, উক্ত মিথ্যা মোকদ্দমায় আমি দশ বৎসরের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হইলাম। সেই সময় আমার মনে হইল যে, আমি যে সকল পাপকার্য্য করিয়া, এতদিবস পর্য্যন্ত মানবচক্ষুতে ধূলিক্ষেপ করিয়া, বিনা-দণ্ডে অব্যাহতি পাইয়া আসিতেছি, বর্তমান মোকদ্দমা মিথ্যা হইলেও সেই সকল পূর্ব্বসঞ্চিত পাপের দণ্ড এইবার প্রাপ্ত হইলাম। 

“জেলের ভিতর যেরূপ ভাবে দিন অতিবাহিত করিলাম, তাহা আর এইস্থানে কি বলিব? ক্রমে আমার কারাবাসের সময় অতিবাহিত হইয়া গেল, ইংরাজি ১৮৮৫ সালে আমি জেল হইতে মুক্ত হইলাম। জেল হইতে বহির্গত হইবার পর, আমি আমার গ্রামে গিয়া বাস করিতে লাগিলাম। পূৰ্ব্বে ডাকাইতি করিয়া, আমি যে সকল অর্থ সঞ্চিত করিয়া গিয়াছিলাম, জেল হইতে বহির্গত হইয়া বাটীতে গিয়া দেখিলাম যে, আমার স্ত্রী তাহার সমস্ত খরচ করিয়া উঠিতে পারে নাই, এখনও তাহার কিছু অবশিষ্ট আছে। জেল হইতে বহির্গত হইবার পর কয়েক বৎসর পর্য্যন্ত বসিয়া বসিয়া, সেই অর্থই আমি খরচ করিতে লাগিলাম। সঙ্গে সঙ্গে যদি কোনরূপে সুবিধাক্রমে পুনরায় লোকজনের সংগ্রহ করিতে পারি, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। 

“এই সময় পুলিস আমার উপর নানারূপে উৎপাত আরম্ভ করিল। কোনস্থানে চুরি, ডাকাইতি হইলেই সৰ্ব্বাগ্রে আমার খানাতল্লাসী করিতে লাগিল, ও আমাকে লইয়া কোনরূপ কষ্ট প্রদান করিতে লাগিল; এমন কি রাত্রিকালেও স্থির ভাবে আমাকে নিদ্রা যাইতে দিত না, আমি গৃহে উপস্থিত আছি কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত অন্ততঃ তিন চারি বার করিয়া, আমার নিদ্রার ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। পুলিসের এইরূপ ব্যবহারে, আমি নিতাত্ত জ্বালাতন হইয়া, কাহাকেও কিছু না বলিয়া, আমি আমার বাসস্থান পরিত্যাগ করিলাম 

“গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া, এবার আমি কলিকাতায় আগমন করিলাম। যে সময় আমি গ্রাম পরিত্যাগ করি, সেই সময় আমার দুইটি সন্তান। সুতরাং স্ত্রী ও সন্তানদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া আসিতে হইল। কিন্তু মধ্যে মধ্যে গুপ্ত ভাবে গমন করিয়া, স্ত্রী ও সন্তানদ্বয়কে দেখিয়া আসিতাম, ও তাহাদিগের ব্যয় নির্ব্বাহার্থে যথেষ্ট অর্থও প্রদান করিয়া আসিতাম। 

“কলিকাতায় আসিয়া, আমি প্রথমতঃ ভবর বাড়ীতে এক খানি ঘর ভাড়া লইয়া ভাড়াটিয়া অবস্থায় বাস করি। এখানে আমার প্রকৃত নাম গোপন করিয়া, গোপালদাস মোহাত্ত বলিয়া আমার পরিচয় দিই। ভবর বাড়ীতে কিছু দিবস ভাড়াটীয়ারূপে বাস করিতে করিতেই পরিশেষে তাহার সহিত আমার আসক্তি জন্মে। পরে গত দুই বৎসর পর্যন্ত আমরা স্ত্রী—পুরুষরূপে বাস করিতেছি। কলিকাতায় আসিয়াই পুনরায় আমি একটি দলের সৃষ্টি করি। গত ফাল্গুন মাসের পূর্ব্ব ফাল্গুনে, মানিকবন্দ সাকিমের সদাই মহাদেন্দু ও মোহন মহাদেন্দু, গোপীনাথপুরের কালা মহাদেন্দু, গোকুল গঞ্জের দিনু গোয়ালা ও কৃত্তিবাস নাপিত, মহাদেশ গ্রামের গোবিন্দ গোয়ালা ও অপর পাঁচ ছয় জনের সাহায্যে হুগলী জেলার মধ্যবর্তী ধনিয়াখালি থানার অধীনস্থ খানপুর নামক গ্রামে এক ডাকাইতি করি। গত পৌষ মাসে জসনা গ্রাম সাকিমের উমা নাপিত, গোকুল গঞ্জের কৃত্তিবাস নাপিত ও কাত্তি দলুই, বড়ইবনি গ্রামের গোপাল দলুই ও ফকীর দলুই ও আরও কয়েকজন লোকের সাহায্যে শিবানীপুর গ্রামে রামদয়াল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ীতে ডাকাইতি করি। পরে গত ফাল্গুন মাসে নাথপুর গ্রামের উমা নাপিত ও পূর্ণ ঘোষ, গোকুল গঞ্জের কান্তি দলুই, বড়ইবনি গ্রামের গোপাল দলুই, ফকীর দলুই, দীনু দলুই ও কিনু দলুই, ধারাবল্লভপুরের নফর মাজি, ও অপরাপর আরও কয়েকজনের সাহায্যে মেদিনীপুর জেলার অন্তবর্তী দাসপুর থানার এলাকাস্থিত পদমপুর গ্রামে পঞ্চানন দত্তর বাড়ীতে ডাকাইতি করি। ইহা ব্যতীত হুগলী জেলার খুরাট গ্রামে এবং মেদিনীপুর জেলার মধ্যস্থিত আরও কয়েকখানি গ্রামে ডাকাইতি করিয়া বিস্তর অর্থের সংস্থান করিয়া লই। 

“আমি কিরূপ উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিয়া থাকি, তাহা ভব পূর্ব্বে জানিত না; কিন্তু পরিশেষে সে সমস্তই অবগত হইতে পারিয়াছিল, ও অপহৃত দ্রব্যাদি সে অতীব সতর্কতার সহিত লুকাইয়া রাখিত। 

“ডাকাইতি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া আমি যে পরিমিত অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছি, তাহা যদি সমস্ত সংগ্রহ করিয়া রাখিতে পারিতাম, তাহা হইলে এই কলিকাতা সহরের মধ্যে আমি একজন ধনবান ব্যক্তির মধ্যে পরিগণিত হইতাম। কিন্তু আমি তাহা করি নাই। আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—দেশ-পৰ্য্যটন। কোন স্থানে ডাকাইতি করিয়া, কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিলেই, তাহার কিয়দংশ ভবকে ও কিয়দংশ আমার স্ত্রীর হস্তে প্রদান করিতাম, অবশিষ্ট অর্থ লইয়া দেশ-পৰ্যটনে বহির্গত হইতাম। ভারতবর্ষের মধ্যে এমন কোন তীর্থই নাই, যেস্থানে অন্ততঃ দুই একবারের নিমিত্তও গমন না করিয়াছি, বা যে স্থানে আমি ইচ্ছামত অর্থ ব্যয় না করিয়াছি। দেবসেবা, অতিথি-সেবা, সাধু-সেবা প্রভৃতি কাৰ্য্যে আমি যে কত অর্থ ব্যয় করিয়াছি, তাহার হিসাব নাই। আমি বৈষ্ণব-বেশ করিতাম, সুতরাং কত বৈষ্ণব যে আমার নিকট সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহার হিসাব কে দিবে? “মচ্ছবে” (মহোৎসবে) আমার যে কত অর্থ ব্যয় হইয়াছে, তাহার সংখ্যাই বা কে করিবে? ইহা ব্যতীত অনেক দরিদ্র লোকও সময় সময় আমার নিকট সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াছে। আমি দরিদ্রের ঘরে কখনও ডাকাইতি করি নাই। ধনবান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যাহারা বিশেষ কৃপণ, তাহাদিগের অর্থের উপরই আমার অত্যন্ত লক্ষ্য ছিল। 

“আমার বয়ঃক্রম এখন অনেক হইয়াছে, ও আমি এবার যেরূপ ভাবে ধৃত হইয়াছি, তাহাতে আমার কোনরূপেই নিষ্কৃতি পাইবার উপায় নাই। তাই বলিয়াই আজ আপনার নিকট এত কথা কহিলাম। নতুবা একাল পর্য্যন্ত অপর কোন ব্যক্তির নিকট আমি ভ্রমক্রমেও এত কথা কহি নাই। 

“আমি ত এখন যাইতে বসিয়াছি; কিন্তু আপনাকে একটি কথা বলিয়া যাইবার ইচ্ছা করি। আমি ডাকাইত বটে, কিন্তু আপনি বিশ্বাসঘাতক। ধর্ম্মের ভাণ করিয়া, আপনি যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতার কার্য্য করিলেন, যতদিন বাঁচিব, ততদিন আর তাহা ভুলিতে পারিব না।” 

[অগ্রহায়ণ, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *