রেলে যম (অর্থাৎ রেলওয়ে যাত্রীর মহাদুর্ঘটনার একটি লোমহর্ষণকর দৃষ্টান্ত!)

রেলে যম (অর্থাৎ রেলওয়ে যাত্রীর মহাদুর্ঘটনার একটি লোমহর্ষণকর দৃষ্টান্ত!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

কয়েক বৎসর অতীত হইল, শারদীয়া পূজার সময় পশ্চিমাঞ্চলে একটি বাঙ্গালী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া যায়।

এলাহাবাদ ও কাণপুর রেলওয়ে ষ্টেসনের মধ্যবর্তী একটি ক্ষুদ্র ষ্টেসনের সন্নিকটে একটি প্রকাণ্ড জঙ্গল আছে। জনৈক গোরক্ষক একদিবস প্রত্যূষে গরু চরাইবার অভিলাষে সেই জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করে, এবং সেই জঙ্গলের ভিতর একটি দুর্গন্ধময় মৃতদেহ দেখিতে পাইয়া সকলের নিকট প্রকাশ করিয়া দেয়। 

ক্রমে এই কথা চৌকিদারের কর্ণগোচর হয়। সে সেই রাখালকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় সেই জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করে। 

সেই স্থানে গমন করিয়া চৌকিদার দেখিতে পায়, একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ বাস্তবিকই সেই জঙ্গলের ভিতর পতিত আছে। কিন্তু উহার ভয়ানক পচা দুর্গন্ধ এরূপ ভাবে বাহির হইয়াছে যে, সহজে তাহার নিকট যাওয়া একবারে অসম্ভব। কিন্তু সবিশেষ আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সেই জঙ্গলের ভিতর কয়েক দিবস পৰ্য্যন্ত সেই মৃতদেহ পতিত থাকিলেও শৃগাল, কুকুর বা অপর কোন হিংস্র জন্তু উহার মাংস ভক্ষণ করা দূরে থাকুক, উহার সন্নিকটে গমন করিয়াছে বলিয়াও বোধ হয় না। 

স্ত্রীলোকটির অবয়ব ও তাহার পরিধেয় বস্ত্রাদি দেখিবামাত্র সহজেই অনুমান হয় যে, উহা কোন বাঙ্গালী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। উহার পরিধানে একখানি পাছাপেড়ে সাড়ী। ঐরূপ সাড়ী পশ্চিম দেশের কোন স্ত্রীলোক ঐরূপ ভাবে পরিধান করে না। বঙ্গদেশের স্ত্রীলোদিগকে সেইরূপ সাড়ী সেইরূপ ভাবে পরিধান করিতে দেখা যায়। উহার শরীরে অলঙ্কারাদি কিছুই নাই। কেবল বাম হস্তে এক গাছি লোহা আছে মাত্র। দেখিয়া বোধ হয়, গলা টিপিয়া উহার জীবন নষ্ট করা হইয়াছে। 

এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া চৌকিদার থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করে। সংবাদ পাইয়া সেই থানার দারোগা আসিয়া এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হন। মৃতদেহের অবস্থা দেখিয়া তাঁহারও বিলক্ষণ অনুমান হইল যে, সেই মৃতদেহ বাঙ্গালী স্ত্রীলোক ভিন্ন অপর কোন স্ত্রীলোকের হইতে পারে না। 

তিনি সেই স্থানের আবশ্যক অনুসন্ধান সকল সম্পন্ন করিয়া, পরিশেষে সেই মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত ডাক্তারখানায় পাঠাইয়া দিলেন। মৃতদেহ যদিচ অতিশয় পচিয়া গিয়াছে, তথাপি সেই লাস পরীক্ষা করিয়া ডাক্তার সাহেব তাঁহার অভিমতি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “গলা টিপিয়া ইহাকে মারিয়া ফেলা হইয়াছে।” 

যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থানের অনুসন্ধান শেষ হইল। ডাক্তারের দ্বারা মৃতদেহের পরীক্ষাও শেষ হইয়া গেল। কিন্তু সেই মৃতদেহ যে কাহার, তাহার কিছুমাত্রই জানিতে পারা গেল না। 

যে দারোগার হস্তে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হইয়াছিল, তিনি সেই প্রদেশীয় একজন উপযুক্ত কর্ম্মচারী বলিয়া পরিচিত ছিলেন। সুতরাং আপনার পূর্ব্ব নাম অক্ষুণ্ণ রাখিবার নিমিত্ত তিনি প্রাণপণে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। 

যে ষ্টেসনের নিকট এই মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার সন্নিকটে বা তাহার চতুর্দিকে বহুদূর পর্য্যন্ত কোন বাঙ্গালীর বসবাস নাই, বা তীর্থাদি উপলক্ষে সেই স্থান দিয়া কোন বাঙ্গালী স্ত্রীলোকের গমনাগমন করিবার কোনরূপ সম্ভাবনাও নাই। 

ষ্টেসনটি বহুদূর বিস্তৃত একটি ময়দানের উপর, অথচ ষ্টেসনের কর্ম্মচারীগণের মধ্যে বাঙ্গালী কৰ্ম্মচারী কেহই নাই। সামান্য খালাসী হইতে ষ্টেসন মাষ্টার পর্যন্ত সকলেই পশ্চিমদেশ-বাসী। 

যে জঙ্গলের ভিতর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই জঙ্গলটি ষ্টেসনের নিকটবর্তী হইলেও কিছু এরূপ নিকটবর্ত্তী নহে যে, গাড়ি হইতে কোন মৃতদেহ সেই স্থানে নিক্ষেপ করা যায়, বা গাড়ি হইতে কোন স্ত্রীলোককে নামাইয়া সকলের অজ্ঞাতসারে সেই স্থানে লইয়া যাওয়া যায়। 

এই সকল নানা কারণে অনুসন্ধানকারী দারোগার মনে নানাপ্রকারে সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। কখনও তিনি মনে করিলেন, হয় ত কোন বারবনিতা অলঙ্কার পত্রাদির সহিত গাড়িতে গমন করিতেছিল, রেলওয়ের কোন কর্ম্মচারী হয় ত কোনরূপ দুরভিসন্ধি করিয়া, গাড়ি হইতে তাহাকে এই স্থানে অবতরণ করাইয়া, তাহার অলঙ্কার প্রভৃতি অপহরণ করিয়াছে, ও পরিশেষে তাহাকে হত্যা করিয়া সেই জঙ্গলের ভিতর তাহার মৃতদেহ লুক্কায়িত করিয়া রাখিয়াছে। 

কিম্বা—ষ্টেসনের কোন পশ্চিম-দেশীয় কৰ্ম্মচারী এই ষ্টেসনে আগমন করিবার পূর্ব্বে হয় ত এরূপ কোন ষ্টেসনে ছিল, যে স্থানে বাঙ্গালী বারবনিতাগণের বাস আছে। সেই স্থানের কোন বাঙ্গালী বারবনিতার সহিত হয় ত ইহার পত্রাদি লিখিয়া বা কোনরূপ সংবাদ পাঠাইয়া সেই কৰ্ম্মচারী উক্ত স্ত্রীলোকটিকে এইস্থানে আনয়ন করে, এবং পরিশেষে তাহাকে হত্যা করিয়া তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়াছে। 

অথবা—কোন স্ত্রীলোক গাড়ি হইতে এই স্থানে অবতরণ করে, এবং পরিশেষে কোন কর্মচারীর হস্তে পতিত হইয়া এইরূপ দশায় উপনীত হইয়াছে। 

এরূপও হইতে পারে যে, মল মুত্রাদি পরিত্যাগ করিবার মানসে কোন হতভাগিনী গাড়ি হইতে এই স্থানে অবতরণ করে, এবং তাহার কার্য্য সম্পন্ন হইবার পূৰ্ব্বেই ষ্টেসন হইতে গাড়ি ছাড়িয়া দেয়। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া তাহাকে ষ্টেসনের মহাপ্রভুদিগের করায়ত্ত্ব হইতে হয়, এবং পরিশেষে তাহার পরিণাম এইরূপ হয়। 

কিম্বা কোন কারণে কোন ব্যক্তি এই স্ত্রীলোকের উপর অসন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে হত্যা করিবার মানসেই এই স্থানে আসিয়া উপনীত হয় ও সুযোগমতে তাহাকে হত্যা করিয়া সে জঙ্গলের ভিতর উহার মৃতদেহ নিক্ষেপ করিয়া এই স্থান হইতে প্রস্থান করে। কারণ, অপরিচিত স্থানে সেই মৃতদেহ প্রাপ্ত হইলেও উহা যে কাহার দেহ, তাহা কোনরূপেই নিরাকৃত হইবে না। সুতরাং প্রকৃত অপরাধী অনায়াসেই পরিত্রাণ পাইতে পারিবে। 

অথবা ইহার ভিতর এরূপ কোন কারণ নিহিত রহিয়াছে যে, এ পর্যন্ত আমরা তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী মহাশয় মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া প্রথমতঃ ষ্টেসনের ভিতরেই অনুসন্ধান করা নিতান্ত আবশ্যক বিবেচনা করিলেন। সুতরাং সেই স্থানেই অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

অনুসন্ধানকারী কর্মচারী ষ্টেসনের ভিতর এই অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিবামাত্রই এই সংবাদ ক্রমে চতুৰ্দ্দিকে প্রচারিত হইয়া পড়িল। ক্রমে সংবাদ পত্রেও এই সংবাদ নিম্নলিখিতরূপে প্রকাশিত হইল :—

“**** ষ্টেসনের নিকটবর্ত্তী জঙ্গলের ভিতর একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। পোষাক, পরিচ্ছদ ও অবস্থা দৃষ্টি করিয়া অনুমান হয় যে, উহা কোন বাঙ্গালী সধবা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। ডাক্তারের পরীক্ষায় জানা গিয়াছে যে, গলা টিপিয়া উহাকে মারিয়া ফেলা হইয়াছে। উহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহা এ পর্য্যন্ত জানিতে পারা যায় নাই। পুলিশ ইহার তদন্তে নিযুক্ত আছেন।” 

একখানি সংবাদ পত্রে এইরূপ সংবাদ প্রকাশিত হইবার পর এক এক করিয়া ক্রমে অপরাপর সংবাদ পত্রেও এই সংবাদ প্রকাশিত হইয়া গেল। সুতরাং সেই মৃতদেহ প্রাপ্ত হইবার সংবাদ ক্রমে অনেকের কর্ণগোচর হইল। 

যে ষ্টেসনের সন্নিকটে এই মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া যায়, সেই ষ্টেসনের ষ্টেসনমাষ্টার একজন অতিশয় পুরাতন কৰ্ম্মচারী। রেলওয়ে বিভাগে চাকরী করিয়া ইনি আপন জীবন প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছেন। ইহার বয়ঃক্রম এখন বোধ হয়, ষাট বৎসরের কম হইবে না। ইঁহার বাসস্থান পশ্চিম প্রদেশে। ইনি জাতিতে কায়স্থ। 

অনুসন্ধানকারী পুলিশ-কর্মচারীর সহিত ইঁহার পূর্ব্ব হইতেই পরিচয় ছিল। ষ্টেসনের ভিতর অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবার পূর্ব্বে কর্ম্মচারী ষ্টেসনমাষ্টারের সহিত একান্তে সাক্ষাৎ করিয়া যেরূপ অবস্থায় সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁহার নিকট বর্ণন করিলেন, এবং পরিশেষে তাঁহাকে কহিলেন, “যেরূপ অবস্থায় ও যে স্থানে এই মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, সেইরূপ অবস্থায় ও সেই স্থানে কোন মৃতদেহ নিকটবর্ত্তী কোন গ্রাম হইতে কোনরূপে আনীত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। কারণ, একে এই বিস্তৃত ময়দানের অপর পার্শ্বে উপনীত হইতে না পারিলে, কোন গ্রামই দৃষ্টিগোচর হয় না; তাহাতে কোন গ্রাম হইতে এই মৃতদেহ এই স্থানে আনয়ন করিবার কোন প্রয়োজন দেখিতে পাওয়া যায় না। কারণ, গ্রামের সন্নিকটবর্তী ইহা অপেক্ষা অনেক নিৰ্জ্জন স্থান, জঙ্গল এবং পাহাড় আছে। সেই স্থানে এই মৃতদেহ অনায়াসেই লুক্কায়িত অবস্থায় রাখা যাইতে পারে। আরও দেখুন, এই স্ত্রীলোকের মৃতদেহ দেখিয়া অনুমান হয় যে, ইহা এ দেশের স্ত্রীলোকের মৃতদেহ নহে। ইহার পোষাক পরিচ্ছদ ও অপরাপর লক্ষণ দেখিয়া অনুমান হয় যে, ইহা বাঙ্গালী রমণীর মৃতদেহ। আমাদিগের অনুমান যদি প্রকৃত হয়, অর্থাৎ সেই মৃতদেহ যদি কোন বাঙ্গালী স্ত্রীলোকের হয়, তাহা হইলে নিকটবর্তী কোন গ্রামে বা এ প্রদেশীয় কোন স্থান হইতে এই মৃতদেহ কোনরূপেই এই স্থানে আনীত হইতে পারে না। এরূপ অবস্থায় আপনার ষ্টেসন দিয়া উহা যে আনীত হইয়াছে, তাহার আর কোন সন্দেহ নাই। আর মৃতদেহই যদি কোনরূপে আনীত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে কোন বাঙ্গালী স্ত্রীলোক গাড়ি হইতে যে এই স্থানে অবতরণ করিয়াছে, এবং যেরূপেই হউক, পরিশেষে তাহার পরিণাম যে এইরূপ হইয়াছে, তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ হইতে পারে না। এরূপ অবস্থায় এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান সম্বন্ধে আপনি যদি আন্তরিকভাবে আমাকে সাহায্য করেন, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, এই লোমহর্ষণকারী হত্যার প্রকৃত রহস্য অনায়াসেই বাহির হইয়া পড়িবে। 

দারোগাবাবুর এই কথা শুনিয়া, ষ্টেসনমাষ্টার মহাশয় কিয়ৎক্ষণ একটু স্থিরভাবে চিন্তা করিলেন এবং পরিশেষে কহিলেন, “আমি সাহায্য করিলেই যদি আপনি এই মোকদ্দমার তত্ত্ব বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলে আপনি নিশ্চয় জানিবেন যে, আমি আপনার সাহায্য করিতে সম্পূর্ণরূপ প্রস্তুত। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন!” 

দারোগা। আপনি আপনার কর্মচারীবর্গের মধ্যে একটু ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন দেখি যে, ইতিমধ্যে কোন বাঙ্গালী রমণী এই স্থানে অবতরণ করিয়াছিল, কি না। আর যদি অবতরণ করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে কোথায়ই বা গমন করিয়াছিল? 

ষ্টেসনমাষ্টার। একটি বাঙ্গালী রমণীর এই স্থানে অবতরণ করা সম্বন্ধে, বোধ হয়, আমি আপনাকে কোন কথা বলিতে পারিব। আপনি, বোধ হয়, অবগত আছেন যে, আজ কাল প্রত্যেক ষ্টেসনে দুই জন করিয়া ষ্টেসনমাষ্টার আছেন, এক জনকে ষ্টেসনমাষ্টার কহে, অপর আর এক জনকে এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার কহে। সমস্ত দিবসের মধ্যে যে সকল কাৰ্য্য হইয়া থাকে, তাহা ষ্টেসনমাষ্টার করিয়া থাকেন। কিন্তু রাত্রিকালের কোন কার্য্যের সহিত তাঁহার কোনরূপ সংস্রব নাই। সেই কার্য্যের নিমিত্ত এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারই দায়ী। আমি এই ষ্টেসনের ষ্টেসনমাষ্টার, সুতরাং আমার কাৰ্য্য দিন মানেই শেষ হইয়া যায়। আজ কয়েক দিবস অতীত হইল, এক দিবস রাত্রি আন্দাজ দশটার সময় আমার নিজের কোন প্রয়োজন বশতঃ আমাকে ষ্টেসনে আসিতে হয়। যে সময় আমি ষ্টেসনে আগমন করি, তাহার অতি অল্পক্ষণ পূৰ্ব্বেই একখানি ট্রেন পূৰ্ব্ব হইতে পশ্চিমে গমন করে। আমার যতদূর মনে আছে, তাহাতে আমার বেশ বোধ হইতেছে যে, সেই সময় একটি বাঙ্গালী স্ত্রীলোককে যেন আমি ষ্টেসনের প্ল্যাটফর্ম্মের উপর দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখিয়াছিলাম। সেই সময় আমার কোন বিষয়ে কোনরূপ সন্দেহ না হওয়ায় আমি তাহার দিকে বিশেষরূপ লক্ষ্য করি নাই। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি, তিনি কোন কথা বলিতে পারেন, কি না। 

এই বলিয়া এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারকে ডাকিবার নিমিত্ত তিনি একজন লোককে প্রেরণ করিলেন। ষ্টেসনের সন্নিকটেই এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারের বাসা ছিল। সংবাদ পাইবামাত্র এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার মহাশয় তাঁহাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

ইনি অতি অল্প দিবসের কর্ম্মচারী। ইঁহার বয়ঃক্রমও ত্রিশ বৎসরের অধিক হয় নাই। ধরণধারণটা যেন একটু বাবুগিরি রকমের। পশ্চিম দেশবাসী হইলেও ইঁহার পোষাক পরিচ্ছদ পশ্চিম দেশবাসী দিগের সদৃশ নহে, কতকটা বাঙ্গালী ধরণের বলিয়া বোধ হয়। কুকুরের উপর ইঁহার বড় ভালবাসা, একটি না একটি কুকুর সর্ব্বদাই ইঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ বেড়ায়। যে ষ্টেসনের এখন তিনি এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার, সেই ষ্টেসনে তিনি অধিক দিবস আগমন করেন নাই, এক মাস অতীত হইয়াছে কি না সন্দেহ। ইহার পূর্ব্বে অপর কোন ষ্টেসনে তিনি টিকিট মাষ্টার Booking Clerk ছিলেন; সেই স্থান হইতেই তিনি এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারের পদে উন্নীত হইয়া এই স্থানে আগমন করিয়াছেন। স্ত্রীপুত্রাদি কিম্বা অপর কেহই ইঁহার সঙ্গে নাই। ইনি একাকীই নিজের বাসায় অবস্থিতি করিয়া থাকেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার মহাশয় ষ্টেসনমাষ্টারের নিকট আসিয়া উপনীত হইলে, ষ্টেসনমাষ্টার তাঁহাকে কহিলেন, “দেখুন মহাশয়! আজ কয়েক দিবস হইল, রাত্রি দশটার সময় কোন কাৰ্য্যবশতঃ যখন আমি ষ্টেসনে আগমন করি, সেই সময় একটি বাঙ্গালী স্ত্রীলোক গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া প্ল্যাটফর্ম্মের এক স্থানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, ইহা আমি দেখিয়াছিলাম। সেই সময় আপনিও প্ল্যাটফর্ম্মের উপর ছিলেন। আপনার মনে হয় কি যে, সেই স্ত্রীলোকটি কোথা হইতে আসিয়াছিল, কোন দিকে গমন করিয়াছিল এবং কোন ব্যক্তি তাহার সহিত ছিল, কি না?” 

এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার। না মহাশয়! আমার ত কোন কথা স্মরণ হইতেছে না। দুই চারি দিবসের মধ্যে কেন, এখানে আসিবার পর, আমি যে কোন বাঙ্গালী স্ত্রীলোককে এই স্থানে দেখিয়াছি, ইহাও আমার মনে হয় না। 

ষ্টেসনমাষ্টার। আমি স্বচক্ষে একটি বাঙ্গালী স্ত্রীলোককে এখানে দেখিয়াছি। ইহা আমার বেশ মনে আছে। কিন্তু বড়ই আশ্চর্য্য! আপনি সেই সময় প্ল্যাটফর্মের উপর উপস্থিত থাকিয়াও সে দিকে দৃষ্টিপাত করেন নাই! 

এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার। আমি ত কিছুই মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না; কিন্তু যদি বলেন, তাহা হইলে অপরাপর কর্ম্মচারীগণ যাঁহারা রাত্রিকালে ষ্টেসনে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া আমি উহার সবিশেষ বৃত্তান্ত বলিতে পারি। 

ষ্টেসনমাষ্টার। ক্ষতি নাই। সেই সময় যাঁহারা ষ্টেসনে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিয়া, যত শীঘ্র পারেন জানিয়া আসুন। আমরা আপনার অপেক্ষায় এই স্থানে বসিয়া থাকিলাম। 

ষ্টেসনমাষ্টারের এই কথা শুনিয়া এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার মহাশয় সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন এবং প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে প্রত্যাগমন করিয়া কহিলেন, “আপনি যাহা বলিয়াছেন, তাহা সত্য। আজ কয়েক দিবস হইল, একটি বাঙ্গালী স্ত্রীলোক এই স্থানে অবতরণ করিয়াছিল। কিন্তু তাহার সহিত একটি বাঙ্গালী পুরুষ মানুষও ছিল। তাহারা যে কোথা হইতে আসিয়াছিল, তাহা কাহারও স্মরণ হয় না, বা তাহারা যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহাও কেহ বলিতে পারে না। কিন্তু তাহারা উভয়েই যে ষ্টেসন হইতে বাহিরে গমন করিয়াছে, সে কথা অনেকেই বলিতেছেন। 

ষ্টেঃ মাষ্টার। এ কথা আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন? 

এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার। “টিকিট বাবুকে” (Booking Clerk ) জিজ্ঞাসা করায়, তিনি এ কথা কহিলেন, ও তাঁহার কথা শুনিয়া পরিশেষে আমারও বেশ মনে পড়িল। 

ষ্টেসনমাষ্টার। নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীগণ যাহারা সেই সময় প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত ছিল, তাহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন কি? 

এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার। না, সকলকে এ কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। কিন্তু দুই এক জনকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাহারাও ঐরূপ বলে। এখন উহাদিগের নিকট এই কথা শুনিয়া আমারও সমস্ত কথা মনে হইয়াছে। সেই স্ত্রীলোকটি প্রথমতঃ প্ল্যাটফর্ম্মের উপর একাকিনী দণ্ডায়মান ছিলেন, অপরাপর আরোহীগণ প্রায়ই চলিয়া গিয়াছিল। আমার এখন বেশ মনে হইতেছে যে, সেই স্ত্রীলোককে একাকিনী দেখিয়া আমি তাঁহার নিকট গমন করি। এরূপ অবস্থায় তিনি একাকিনী কেন দাঁড়াইয়া আছেন ও কোথায় গমন করিবেন, তাহাও আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কিন্তু আমার কথায় তিনি কোনরূপ উত্তর প্রদান করেন নাই। সেই সময় অপর আর একটি বাঙ্গালী পুরুষ আসিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং আমার কথার উত্তরে তাঁহারা কোথায় গমন করিবে, তাহাও আমাকে বলে। কিন্তু আমি ভালরূপ তাহার কথা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। কোন্ স্থানে তাহারা গমন করিবে, তাহাও সে আমাকে বলিয়াছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে স্থানের নাম আমার মনে নাই। 

এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারের কথা শুনিয়া ষ্টেসনমাষ্টার মহাশয় অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া কহিলেন, “এ বিষয়ে আপনাকে আর অধিক অনুসন্ধান করিতে হইবে না, অপরাপর কর্মচারীগণকে যাহা কিছু জিজ্ঞাসা করিতে হইবে, তাহা আমরাই জিজ্ঞাসা করিতেছি। দারোগা বাবু আপনাকে আরও দুই এক কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন। আপনি বেশ মনে করিয়া যতদূর পারেন, প্রকৃত উত্তর প্রদান করুন। কারণ, আপনি বোধ হয় অবগত হইতে পারিয়াছেন যে, আমাদিগের এই ষ্টেসনের অতি সন্নিকটে একটি জঙ্গলের ভিতর কোন বাঙ্গালী রমণীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, এবং ডাক্তারের পরীক্ষায় জানা গিয়াছে যে, সেই স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করিয়া কেহ জঙ্গলের ভিতর নিক্ষেপ করিয়াছে। পুলিশ-কর্মচারীগণ ইহার অনুসন্ধান করিতেছেন, সুতরাং এ বিষয়ে আমাদিগের দ্বারা যতদূর সাহায্য হইবার সম্ভবানা, তাহা আমাদিগের করা একান্ত কৰ্ত্তব্য।” 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ আমাদিগের ষ্টেসনের সন্নিকটস্থ জঙ্গলের ভিতর যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, সে কথা ত আমাকে এ পর্যন্ত কেহই বলেন নাই। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। এ বিষয় লইয়া এত গোলমাল ও এত অনুসন্ধান হইতেছে, তথাপি আপনি ইহার কিছুমাত্র অবগত হইতে পারেন নাই? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। না মহাশয়! আমি কিছুই জানিতে পারি নাই। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। পূর্ব্বেও যদি জানিতে না পারিয়া থাকেন, এখন ত জানিতে পারিলেন। আমি আপনাকে আরও দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি। 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। যে সকল বিষয় আমি যতদূর অবগত আছি, তাহার যথাযথ উত্তর আমি প্রদান করিব। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। যে স্ত্রীলোকটির কথা আপনি কহিলেন, সে যে বাঙ্গালী, তাহা কিরূপে জানিতে পারিলেন? এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। জানিবার দুইটি কারণ আছে। প্রথমতঃ উহার পরিহিত বস্ত্র আমাদিগের দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পরিহিত বস্ত্রের সদৃশ নহে। সেরূপ পরিচ্ছন্ন ও চিক্কণ বস্ত্র আমাদিগের দেশীয় কোন স্ত্রীলোককে কখনও পরিধান করিতে দেখি নাই। দ্বিতীয়তঃ উহার সমভিব্যাহারী পুরুষটির পোষাকও বাঙ্গালীর, এবং সে বাঙ্গালা ভাষায় আমার 

সহিত কথা কহিয়াছিল। বিশেষতঃ আমি অনেক দিবস পর্য্যন্ত ষ্টেসনে কর্ম্ম করিতেছি, এবং অনেক বাঙ্গালী পুরুষ ও স্ত্রীলোককে দেখিয়াছি। সুতরাং বাঙ্গালী স্ত্রীলোক কি বাঙ্গালী পুরুষ দেখিলে, কি আমি চিনিতে পারি না? 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে আপনার নিশ্চয় অনুমান হইতেছে যে, যে স্ত্রীলোক এই প্ল্যাটফর্ম্মে দাঁড়াইয়াছিল, সে বাঙ্গালী স্ত্রীলোক? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। আপনার সহিত সেই বাঙ্গালীর কি কথা হইয়াছিল, তাহা আপনার মনে হয় কি? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। যদিও তাহা আমার ঠিক মনে হয় না, তথাপি অনুমান করিতেছি যে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাঁহারা কোথা হইতে আসিতেছেন ও কোথায় যাইবেন। আমার কথার উত্তরে তিনি যে কি বলিয়াছিলেন, তাহা আমার মনে হয় না। বিশেষতঃ তিনি বাঙ্গালা ভাষায় কথা কহিয়াছিলেন বলিয়া আমি সম্পূর্ণরূপ বুঝিতেও পারি নাই। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। উহার পরিধানে কিরূপ কাপড় ছিল, তাহা আপনার মনে হয় কি? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। চিক্কণ ও পরিষ্কার একখানি কাপড় ছিল মনে হয়। কিন্তু কি প্রকারের কাপড়, ঠিক তাহা মনে হয় না। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। সেই কাপড়ের কি রঙের পাইড় ছিল, তাহা মনে করিতে পারেন কি? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। তাহা আমার ঠিক মনে হইতেছে না। 

পুলিশ কৰ্ম্মচারী। সেই কাপড়খানি দেখিলে, আপনি চিনিতে পারিবেন? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। চিনিতে পারিব বলিয়া বোধ করি না। কারণ, বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া সেই কাপড় আমি দেখি নাই। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। সেই স্ত্রীলোকটির অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কার ছিল কি না, আপনার মনে হয়? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। আমার মনে হইতেছে, উহাকে যতদূর আমি দেখিতে পাইয়াছি, তাহাতে যেন উহার পরিধানে কয়েকখানি অলঙ্কার ছিল। 

পুলিশ—কর্ম্মচারী। কিসের অলঙ্কার দেখিয়াছেন বলিয়া বোধ হয়, সোণার না রূপার? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। রূপার অলঙ্কার দেখিয়াছি বলিয়া আমার বোধ হয় না। যে কয়েকখানি অলঙ্কারের উপর আমার দৃষ্টি পতিত হইয়াছিল, সেই কয়েকখানিই সোণার অলঙ্কার বলিয়া আমার বোধ হয়। 

পুলিশ-কৰ্ম্মচারী। সেই স্ত্রীলোকটির অঙ্গে কি কি অলঙ্কার দেখিয়াছিলেন, বলিতে পারেন? 

এঃ ষ্টেঃ মাষ্টার। বাঙ্গালী স্ত্রীলোক যে সকল অলঙ্কার ব্যবহার করে, তাহার নাম আমি জানি না। কিন্তু তাহার গলায়, হাতে, এবং কনুয়ের উপর সোনার গহনা দেখিয়াছি বলিয়া আমার বোধ হয়। 

এসিসটেন্ট ষ্টেসন মাষ্টার মহাশয়ের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, পুলিশ-কৰ্ম্মচারী বুকিংক্লার্ক এবং অপরাপর নিম্নপদস্থ কর্মচারীগণকে ডাকাইয়া তাহাদিগের সকলকে উত্তমরূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার যাহা বলিয়াছিল, বুকিংক্লার্কও ঠিক তাহাই কহিল; নিম্নপদস্থ দুই একজন কর্ম্মচারীও তাহাদিগের পোষকতা করিল। অপরাপর সকলে কহিল যে, তাহারা কিছুই অবগত নহে। 

ষ্টেসনের ভিতর এইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া পুলিসকর্ম্মচারীর মনে স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিল যে, রাত্রি দশটার সময় একটি বাঙ্গালী স্ত্রীলোক জনৈক বাঙ্গালী পুরুষের সহিত রেল হইতে সেই ষ্টেসনে অবতরণ করে, এবং সেই বাঙ্গালীর সহিত ষ্টেসন হইতে বাহির হইয়া যায়। যে সময় সেই স্ত্রীলোকটি ষ্টেসনের বাহিরে গমন করে, তখন তাহার অপরাপর দ্রব্য সামগ্রী ব্যতীত তাহার অঙ্গে কতকগুলি সোণার অলঙ্কার ছিল। এরূপ অবস্থায় সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে যে, যে ব্যক্তি সেই স্ত্রীলোককে লইয়া এই স্থানে আগমন করিয়াছিল, সে অলঙ্কারের লোভ কোনরূপে সম্বরণ করিতে না পারিয়া তাহাকে হত্যা-পূর্ব্বক এই জঙ্গলের ভিতর তাহার মৃতদেহ নিক্ষেপ করিয়া, তাহার দ্রব্যাদির সহিত সমস্ত অলঙ্কার অপহরণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। এরূপ অবস্থার সেই বাঙ্গালী কে? তাহারই অনুসন্ধান করা নিতান্ত আবশ্যক। কিন্তু এই অনুসন্ধান করিতে হইলে, সেই মৃত স্ত্রীলোকটি কে? তাহারই অনুসন্ধান করা সর্ব্বাগ্রে কর্তব্য। কারণ, উহা কাহার মৃতদেহ, তাহা যদি জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে কোথা হইতে এবং কাহা কর্তৃক সেই স্ত্রীলোকটি এখানে আনীত হইয়াছে, তাহা সহজেই জানিতে পারিবার সম্ভাবনা। কোন ব্যক্তি উহাকে আনিয়াছে, তাহা যদি অবগত হইতে পারিলাম, তাহা হইলে সেই লোককে অনায়াসেই ধরিতে পারিব। 

অনুসন্ধানকারী কর্মচারী মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই মৃতদেহ কোন্ স্ত্রীলোকের, তাহা অবগত হইবার মানসে নানারূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন এবং পত্রাদি লিখিয়া নানাস্থানে এই সংবাদ প্রচার করিলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

ষ্টেসনের সন্নিকটস্থ জঙ্গলের ভিতর সেই মৃতদেহ যেরূপে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, তাহার কতক বিবরণ সেই সময়ের একখানি সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা পাঠকগণ ইতিপূর্ব্বে অবগত হইতে পারিয়াছেন। 

যে সংবাদ পত্রে সেই সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল, সেই সংবাদ পত্র একদিবস বামনদাস বসুর হস্তে পতিত হইল। বামনদাস বসু নিয়মিতরূপে উহা পাঠ করিলেন; কিন্তু এই সংবাদটির উপর তাঁহার সবিশেষ দৃষ্টি পতিত হইল না। সবিশেষ দৃষ্টি আকৃষ্ট হইবার কোন কারণও সে সময় ছিল না। 

বামনদাস বসু বাঙ্গালী। কিন্তু তাঁহার বাসস্থান বঙ্গদেশে নহে; উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে আগ্রার নিকট কোন স্থানে তিনি বাস করেন। তাঁহার পিতার বাসস্থান বঙ্গদেশে ছিল; কিন্তু চাকরীর নিমিত্ত তাঁহাকে দেশ পরিত্যাগ করিয়া বহুকাল আগ্রাতেই বাস করিতে হয়। সেই স্থানে তিনি বাড়ীঘর প্রস্তুত করেন, এবং সেই স্থানেই বামনদাসের জন্ম হয়। বামনদাসের পিতার যে সকল বিষয় সম্পত্তি এ দেশে ছিল, পশ্চিম দেশে অবস্থিতি করিবার সময় তাঁহার জ্ঞাতিগণ তাহা বেদখল করিয়া লন। বৃদ্ধ বয়সে স্বদেশে বাস করিবার ইচ্ছা থাকিলেও এইরূপ অবস্থায় বামনদাসের পিতা এ প্রদেশে বাস করিতে সমর্থ হন না। সুতরাং তাঁহার জীবনের অবশিষ্টকাল আগ্রাতেই তাঁহাকে অতিবাহিত করিতে হয়। 

বামনদাস আগ্রাতেই জন্ম গ্রহণ করেন, সেই স্থানেই লেখাপড়া শিক্ষা করেন, এবং পরিশেষে সেই স্থানেই চাকরি করিতে প্রবৃত্ত হন। সেই স্থানের কোন সওদাগরের আফিসে কর্ম্ম করিয়া অনেক দিবস অতিবাহিত হইবার পর, তাঁহাকে কলিকাতায় আসিতে হয়। যে ইংরাজ সওদাগরের আফিসে তিনি কৰ্ম্ম করিতেন, তিনি বামনদাসকে বিশেষ উপযুক্ত লোক বলিয়া জানিতেন ও তাঁহাকে বিশেষরূপ অনুগ্রহও করিতেন। 

সেই সময় বামনদাসের মনিব সাহেব কলিকাতায় আর একটি নূতন আফিস খোলেন। বামনদাসকে উপযুক্ত কর্ম্মচারী বিবেচনা করিয়া তিনি এই সময় তাঁহার বেতন বৃদ্ধি করিয়া দেন, এবং আগ্রার আফিস হইতে তাঁহাকে কলিকাতায় নূতন আফিসে আনয়ন করেন। সুতরাং বাধ্য হইয়া তাঁহাকে কলিকাতার আফিসে আগমন করিতে হয়। 

আগ্রায় বামনদাসের পিতা যে বাড়ী প্রস্তুত করিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন, সেই বাড়ীতেই এতদিবস বামনদাস সপরিবারে বাস করিতেন। পরিবারের মধ্যে কেবল তাঁহার বৃদ্ধা মাতা, একটি ভগিনী, তাঁহার স্ত্রী ও তাঁহার পিতার সময়ের একান্ত বিশ্বাসী একজন বৃদ্ধ সরকার ছিলেন। 

যখন বামনদাস কলিকাতায় আগমন করেন, সেই সময় তাঁহার পত্নী বিধুমুখীকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় লইয়া আসেন, এবং কলিকাতায় একটি বাড়ী লইয়া এই স্থানেই অবস্থান করেন। 

এইরূপে প্রায় ছয় মাস কাল অতিবাহিত হইবার পর শারদীয়া পূজার সময় বামনদাসের মাতা অতিশয় পীড়িতা হইয়া পড়েন, এবং তাঁহার পুত্রবধূকে আগ্রায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের পুরাতন বিশ্বাসী সরকার রামদাসকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দেন। 

মাতার পীড়ার বিষয় অবগত হইয়া বামনদাস সপরিবারে আগ্রায় গমন করিবার মানসে আপনার মনিব সাহেবের নিকট কয়েক দিবসের নিমিত্ত বিদায় প্রার্থনা করেন। সেই সময় আফিসের কাজ কর্ম্মর অতিশয় ভিড় ছিল; সুতরাং বামনদাস সেই সময় কোন প্রকারেই বিদায় গ্রহণ করিতে সমর্থ হন নাই। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া রামদাসের সমভিব্যাহারে তাঁহার স্ত্রী বিধুমুখীকে আগ্রায় পাঠাইয়া দেন। 

রামদাসের সহিত বিধুমুখীকে বিদেশে পাঠাইতে বামনদাসের মনে কোনরূপ ভয়ের কারণ উদয় হয় নাই। কারণ, তিনি নিজে রামদাস কর্তৃকলালিত পালিত, তাহার উপর তাঁহার স্ত্রীও বাল্যকাল হইতে রামদাসের দ্বারা পালিত। এক কথায় রামদাস নামে বামনদাসের সরকার, কার্য্যে সেই বাড়ীর কর্তা। বামনদাস ও বিধুমুখী উভয়েই তাঁহাকে পিতার সদৃশ দেখিয়া থাকেন। তিনিও উভয়কেই আপনার পুত্র ও কন্যার ন্যায় যত্ন করিয়া থাকেন। 

বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়াও বামনদাস যখন কোনরূপেই সেই সময় কিছু দিবসের নিমিত্ত বিদায় প্রাপ্ত হইলেন না, . তখন অনন্যোপায় হইয়া রামদাসের সহিত তাঁহার স্ত্রীকে আগ্রায় প্রেরণ করিলেন। কারণ, সেই সময় যদি তাঁহার স্ত্রীকে আগ্রায় না পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে তাঁহার পীড়িতা মাতার বিশেষরূপ কষ্ট হইবার সম্ভাবনা। রামদাসের সহিত তিনি আপনার স্ত্রীকে প্রেরণ করিলেন সত্য; কিন্তু মনে করিলেন যে, আফিসের কার্য্যের গোলযোগ একটু কমিলে, যে প্রকারেই হউক, ছুটী লইয়া তিনি আগ্রায় গমন করিবেন, এবং যদি আবশ্যক বিবেচনা করেন, তাহা হইলে, কিছু দিবসের নিমিত্ত মাতা, ভগিনী ও স্ত্রী প্রভৃতি সকলকে লইয়া পুনরায় কলিকাতায় আগমন করিবেন। 

রামদাস বিধুমুখীকে লইয়া আগ্রায় গমন করিবার নিমিত্ত কলিকাতা পরিত্যাগ করিলেন। বামনদাস হাওড়া ষ্টেসন পর্যন্ত তাঁহাদিগের সঙ্গে গমন করিয়া, তাঁহাদিগকে গাড়িতে উঠাইয়া দিলেন। গাড়ি ষ্টেসন ছাড়িয়া গমন করিবার পর তিনি কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলেন। 

এক দিবস দুই দিবস করিয়া ক্রমে কয়েকদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। যে সময় রামদাস আগ্রায় পৌঁছিতে পারিবেন, এবং সেই স্থান হইতে তাঁহাদিগের পৌঁছান সংবাদ লিখিলে, যে কয় দিবসে সেই পত্র কলিকাতায় আসিয়া পৌঁছিবার সম্ভাবনা, সেই সময়ও ক্রমে অতীত হইয়া গেল। কিন্তু রামদাস বা বিধুমুখীর কোন সংবাদ প্রাপ্ত না হইয়া, বামনদাস ক্রমে অস্থির হইয়া পড়িলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

এইরূপে আরও কয়েক দিবস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর, বামনদাস আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। একবার ভাবিলেন, রামদাস আগ্রায় পৌঁছিয়া নিশ্চয়ই পৌঁছান সংবাদ লিখিয়াছেন; কিন্তু কোন কারণ বশতঃ সেই পত্র তাঁহার হস্তগত হয় নাই। আবার ভাবিলেন, পত্র নিয়মিত সময়ে না পাইবার কারণই বা কি? 

মনে মনে এই প্রকার নানারূপ চিন্তা করিয়া পরিশেষে আগ্রার ঠিকানায় রামদাসকে একখানি টেলিগ্রাফ করিলেন। কিন্তু তাহারও কোনরূপ উত্তর প্রাপ্ত না হইয়া বামনদাস একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন, এবং পরিশেষে সমস্ত অবস্থা বিবৃত করিয়া আগ্রাবাসী তাঁহার জনৈক বন্ধুর নিকট পুনরায় আর একখানি টেলিগ্রাফ প্রেরণ করিলেন, এবং সেই টেলিগ্রাফের উত্তর আসিবার নিমিত্ত টাকাও জমা দিলেন। সময়মত তাঁহার বন্ধুর নিকট হইতে সেই টেলিগ্রাফের উত্তর আসিল। উত্তর প্রাপ্ত হইয়া বামনদাস জানিতে পারিলেন যে, রামদাস বা বিধুমুখী কেহই আগ্রায় গিয়া উপস্থিত হন নাই। অধিকন্তু তাঁহাদিগের সংবাদ না পাইয়া তাঁহার মাতা নিতান্ত অধীর হইয়া পড়িয়াছেন। এরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হওয়ায় বামনদাসের মনের গতি যে কিরূপ হইয়াছিল, তাহা বিবাহিত পাঠকমাত্রেই অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন। 

কোন ষ্টেসনের সন্নিকটবর্তী জঙ্গলের ভিতর একটি বাঙ্গালী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়ার সংবাদ ইতিপূর্ব্বে তিনি সংবাদপত্রে পাঠ করিয়াছিলেন, সে কথা বামনদাস বাবুর এখন মনে পড়িল। তিনি ভাবিলেন, ‘তবে কি উহা আমার স্ত্রীরই মৃতদেহ? তাহার নিকট যে সকল টাকাকড়ি ও অলঙ্কার-পত্র ছিল, তাহার লোভে আমাদিগের সেই পুরাতন সরকার রামদাস কি তাহাকে হত্যা করিয়া সেই জঙ্গলের ভিতর তাহার মৃতদেহ নিক্ষেপ করিয়া প্রস্থান করিল? না! রামদাসের দ্বারা এ কার্য্য কখনই হইতে পারে না। অতদূর অবিশ্বাসী রামদাস নহে।’ 

বামনদাস বাবু মনে মনে এ সম্বন্ধে যে কতই চিন্তা করিলেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। পরিশেষে যে স্থানে সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থানে নিজেই গমন করিয়া মনের সন্দেহ মিটাবার বাসনা করিলেন। এবার তাঁহার মনির সাহেব সমস্ত অবস্থা অবগত হইবামাত্রই বামনদাসকে দশ দিবসের নিমিত্ত বিদায় দিলেন। বামনদাস কাহারও সহিত আর কোনরূপ পরামর্শ না করিয়া, সেই দিবসের মেলট্রেণেই আপনার প্রিয়তমার উদ্দেশ করিবার নিমিত্ত পশ্চিম যাত্রা করিলেন। 

যে ষ্টেসনের সন্নিকটে বাঙ্গালী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, বামনদাস প্রথমেই সেই ষ্টেসনে গিয়া অবতরণ করিলেন। অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী সেই সময় সেই স্থানেই উপস্থিত থাকিয়া অনুসন্ধান করিতেছিলেন। সুতরাং তাঁহার সহিত অনায়াসেই বামনদাসবাবুর সাক্ষাৎ হইল। তাঁহার নিকট হইতে সেই মৃত স্ত্রীলোকের আকৃতি প্রভৃতির বিষয় যতদূর অবগত হইতে পারিলেন, তাহাতে বামনদাসের মনে স্পষ্টই অনুমান হইল যে, সেই মৃতদহে তাঁহার বনিতা বিধুমুখীর দেহ হইবারই সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। 

সেই মৃতদেহের সহিত কেবল একখানি সাড়ী ও এক গাছি মাত্র লোহা পাওয়া গিয়াছিল, তাহা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইতে পারিয়াছেন। লাস পরীক্ষা হইবার পরই অনুসন্ধানকারী কর্মচারী সেই সকল দ্রব্য সবিশেষ যত্নের সহিত থানাতে রাখিয়া দিয়াছিলেন। বামনদাসবাবু সেই স্থানে উপনীত হইবার পরেই তিনি সেই সকল দ্রব্য থানা হইতে আনাইয়া বামনদাসবাবুকে দেখাইলেন। সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া বামনদাসবাবু উহা দেখিলেন, এবং কহিলেন যে, ঠিক এই প্রকারের একগাছি লোহা তাঁহার স্ত্রীর হস্তে সর্ব্বদা থাকিত, এবং সেইরূপ একখানি সাড়ীও তাঁহার ছিল। 

বামনদাস বাবু দারোগাকে এই কথা বলিবার পর, পুনরায় সেই সাড়ীখানি আপন হস্তে লইয়া আরও উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। দেখিলেন যে, সেই সাড়ীর এক প্রান্তে রজক প্রদত্ত একটি কাল রংঙ্গের চিহ্ন আছে। সেই চিহ্ন দেখিয়া তিনি আরও উদ্বিগ্ন হইলেন, এবং আপনার পরিহিত বস্ত্রে রজক প্রদত্ত কিরূপ চিহ্ন আছে, তাহা দেখিলেন। দেখিলেন যে, তাঁহার পরিহিত বস্ত্রে যে প্রকারের চিহ্ন আছে, মৃতদেহের সহিত প্রাপ্ত সাড়ীতেও সেই চিহ্ন। এই ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার মনে বা অনুসন্ধানকারী পুলিশ-কর্মচারীর মনে নিশ্চয় প্রতীতি জন্মিল যে, যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই মৃতদেহ বামনদাসবাবুর বনিতা বিধুমুখীর মৃতদেহ ভিন্ন আর কাহারই হইতে পারে না। 

এই অনুসন্ধানের প্রধান কাৰ্য্য সমাপ্ত হইল। লাস সনাক্ত হল। এখন অনায়াসেই মোকদ্দমার উপায় হইবার সম্ভাবনা। সুতরাং দারোগা মহাশয়ের মনে আনন্দের উদয় হইল, তাঁহার চক্ষু দিয়া যেন জলধারাও পড়িল। 

ওদিকে বামনদাসবাবুর চক্ষুও জলে পূর্ণ হইয়া গেল। আর দাঁড়াইতে না পারিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে সেই স্থানের মৃত্তিকার উপর বসিয়া পড়িলেন। 

অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারীর ও স্ত্রীবিয়োগ-কাতর স্বামীর চক্ষু জলের যে কি প্রভেদ, তাহা পাঠকগণই অনুমান করিবেন, আমার বলিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না। 

বামনদাসবাবুর ব্যাপার দেখিয়া অনুসন্ধানকারী দারোগা কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, এবং পরিশেষে কহিলেন, “যে বাঙ্গালী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই মৃতদেহ যে আপনার স্ত্রী, সে বিষয়ে বোধ হয়, আপনার মনে আর কোনরূপ সন্দেহ নাই।” 

বামনদাস। এরূপ অবস্থায় আর কি প্রকারেই বা সন্দেহ করি? আমার নিশ্চয় প্রতীতি হইতেছে যে, উক্ত মৃতদেহ আমার স্ত্রীর। তিনিই এইরূপ অবস্থায় ইহলোক হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়াছেন! 

দারোগা। আপনার স্ত্রীর নাম কি? 

বামন। তাহার নাম বিধুমুখী। 

দারোগা। বিধুমুখী কিরূপ অবস্থায় এখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন? 

বামন। এখানে তিনি কিরূপে আগমন করিলেন, তাহা আমি কি প্রকারে বলিব? তিনি আগ্রায় গমন করিতেছিলেন, ইহাই আমি জানি। 

দারোগা। কোথা হইতে আগ্রায় গমন করিতেছিলেন? 

বামন। আমরা সকলে কলিকাতায় থাকিতাম। কিন্তু আমার বাসস্থান এখন আগ্রায়। তাই তিনি কলিকাতা হইতে আগ্রায় আগমন করিতেছিলেন? 

দারোগা। তিনি কি একাকী আগমন করিতেছিলেন? 

বামন। না, একাকী নহেন! আমাদিগের অত্যন্ত বিশ্বাসী রামদাস সরকার নামক এক ব্যক্তির সহিত আগমন করিতেছিলেন। 

দারোগা। রামদাসের বয়ঃক্রম কত? 

বামন। সে বৃদ্ধ, তাহার বয়ঃক্রম বোধ হয় ষাট বৎসরের কম হইবে না। 

দারোগা। তাহার বাসস্থান কোথায়? 

বামন। আমাদিগের বাড়ীতেই সে আজীবন কাটাইয়াছে, তাহার অপর কোন স্থান আমি দেখি নাই। 

দারোগা। আপনার স্ত্রীকে আপনি নিজে সঙ্গে করিয়া না লইয়া আসিয়া, একজন সরকারের সহিত এরূপ ভাবে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন কেন? 

বামন। আমার মাতা আগ্রাতেই আছেন। তিনি পীড়িত হওয়ায় কলিকাতা হইতে আমার পত্নীকে আগ্রায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত আমার সেই পুরাতন ও বিশ্বস্ত সরকারকে আমার নিকট প্রেরণ করেন। লইয়া যাইবার নিমিত্ত রামদাস গমন করিলেও আমি ইচ্ছা করিয়াছিলাম যে, কয়েক দিবসের ছুটি লইয়া আমি আগ্রায় গিয়া তাহাকে রাখিয়া আসিব। কিন্তু আফিসের কার্য্যের গতিতে আমি ছুটি পাইলাম না। সুতরাং আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতেও সমর্থ হইলাম না। কাযেই রামদাসের সহিত তাহাকে পাঠাইয়া দিতে হইল। বিশেষতঃ রামদাসের উত্তর কোনরূপে আমাদিগের অবিশ্বাস নাই। তিনি আমাদিগকে তাঁহার পুত্র ও কন্যার মত দেখিয়া থাকেন। 

দারোগা। যে সময় আপনার স্ত্রী রামদাসের সহিত আগ্রায় গমন করিতেছিলেন, সেই সময় তাঁহার পরিধানে এই সাড়ী ভিন্ন অপর কোন দ্রব্যাদি ছিল কি? 

বামন। তাহার পরিধানে এই সাড়ীখানি ছিল কি না, তাহা আমার ঠিক মনে নাই। তাহার সহিত বস্ত্রাদি অনেক ছিল। 

দারোগা। বস্ত্রাদি ব্যতীত আর কোন দ্রব্য তাঁহার কাছে ছিল কি? 

বামন। ছিল বৈকি। 

দারোগা। কি কি ছিল? 

বামন। নগদ টাকা, সোণারূপার অনেকগুলি অলঙ্কার ও পরিধেয় বস্ত্রাদি অনেক দ্রব্য ছিল। 

দারোগা। অনেকগুলি অলঙ্কার ও নগদ টাকা ছিল, বলিতেছেন। কি কি অলঙ্কার, কত টাকা নগদ এবং বস্ত্র প্রভৃতি অপরাপর যে সকল দ্রব্যাদি সঙ্গে করিয়া তিনি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ আমাকে প্রদান করুন দেখি? 

বামন। তাহার সহিত কিরূপের কি কি দ্রব্য ছিল, তাহার সমস্ত বিষয় আমি অবগত নহি। কিন্তু আমি যতদূর অবগত আছি, তাহার বিবরণ আমি যতদূর বলিতে পারিব, তাহা আপনাকে ক্রমে ক্রমে বলিতেছি। ইচ্ছা করেন, ত আপনি লিখিয়া লউন। কিন্তু মহাশয়! প্রথমেই আমার বলিয়া রাখা কর্তব্য যে, সকল কথা এখন আমার মনে পড়িবার সম্ভাবনা নাই। কারণ, আমার অবস্থা এখন যেরূপ হইয়াছে, তাহার সম্পূর্ণ না হউক, কতক আপনি অনুমান করিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় আমার ভুল হইবার বিশেষ সম্ভাবনা। তথাপি যতদূর মনে করিতে পারি, ক্রমে ক্রমে তাহা আমি আপনাকে বলিয়া দিতেছি। 

দারোগার সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর বামনদাস যতদূর মনে করিতে পারিলেন, তাহা সেই অনুসন্ধানকারী পুলিশ-কৰ্ম্মচারীকে বলিয়া দিতে লাগিলেন। তিনিও বামনদাসবাবুর কথা মত এক এক করিয়া লিখিয়া লইতে লাগিলেন। বিধুমুখীর সহিত অলঙ্কারাদি যে সকল দ্রব্য ছিল, এইরূপে তাহার একটি তালিকা প্রস্তুত হইলে দেখা গেল যে, তাহার মূল্য অনুমান তিন সহস্র মুদ্রার কম নহে। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

বামনদাসবাবুর নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া অনুসন্ধানকারী কর্মচারী একটু উগ্রমূর্তি ধারণ করিয়া, ষ্টেসনের ভিতর পুনরায় অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। ষ্টেসন মাষ্টার বাবুর নিকট হইতে পূর্ব্বে যাহা অবগত হইতে পারিয়াছিলেন, এখন তাহার অধিক আর কোন কথা প্রাপ্ত হইলেন না। কিন্তু এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার, বুকিং ক্লার্ক ও ষ্টেসনের অপরাপর দুই একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারীর সুর এখন একটু পরিবর্তিত হইল, একবাক্যে এখন তাহারা সকলেই কহিতে লাগিল যে, যে রজনীতে স্ত্রীলোকটি গাড়ি হইতে সেই ষ্টেসনে অবতরণ করে, সেই রাত্রিতে তাহারা সকলেই ষ্টেসনের উপর উপস্থিত ছিলেন। তাহার সকলেই দেখিয়াছে যে, একটি প্রবীণ বাঙ্গালী পুরুষও কতকগুলি দ্রব্যাদি লইয়া তাঁহার সহিত অবতরণ করেন, এবং নিয়মিতরূপে টিকিট প্রদান করিয়া উভয়েই ষ্টেসন হইতে বহির্গত হইয়া যান। দ্রব্যাদি বহন করিবার নিমিত্ত কোন কুলি তাহারা ষ্টেসন হইতে গ্রহণ করেন নাই। বোধ হয়, ষ্টেসনের বাহির হইতে কোন কুলিকে তাহারা সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া থাকিবেন। 

ষ্টেসনের ভিতর এই সকল অবগত হইয়া অনুসন্ধানকারী কর্মচারীর মনে কয়েকটি চিন্তার উদয় হইল। প্রথমতঃ,—এ হত্যার উদ্দেশ্য কি? চুরি করা ভিন্ন অপর কোন উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত দেখিতে পাওয়া যায় না। যদি বামনদাস—বাবুর কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে বিধুমুখীর সহিত বহুমূল্যের দ্রব্যাদি ছিল; অথচ তাঁহার নিকট কিছুই পাওয়া যাইতেছে না। এরূপ অবস্থায় চুরি ভিন্ন এই হত্যার আর কি উদ্দেশ্য হইতে পারে? 

দ্বিতীয়তঃ—এ হত্যার উদ্দেশ্য যদি চুরিই হয়, তাহা হইলে যে কাৰ্য্য কাহার দ্বারা হইবার সম্ভাবনা? ইঁহারা ষ্টেসনের বাহির হইতে যদি কোন কুলিকে লইয়া গিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাহার দ্বারা এই হত্যা সম্পন্ন হইতে পারে, কিনা? যদি তাহাই হয়, যদি প্রলোভন সম্বরণ করিতে না পারিয়া, সেই অপরিচিত কুলিই এই কার্য্য সম্পন্ন করিয়া থাকে, তাহা হইলে রামদাস সরকার কোথায় গমন করিল? সে যে স্থানেই গমন করুক, এত দিবস নিশ্চয়ই সে প্রত্যাগমন করিত, বা পত্রাদি লিখিয়া আপন মনিবকে সংবাদ প্রদান করিত। কিন্তু যদি রামদাসও হত হইয়া থাকে, তাহা হইলে প্রকৃত কথা কিরূপে অবগত হইতে পারা যাইবে? কিন্তু রামদাসও যে হত হইয়াছে, এ কথা সহজে বিশ্বাস করিতে পারা যায় না। কারণ, যখন একজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তখন অপরের মৃতদেহ প্রাপ্ত না হইবার কারণ কি? তৃতীয়তঃ—রামদাস এত দিবস মনিবের বিশ্বাসী ছিল বলিয়াই যে এখন অবিশ্বাসী হইতে পারে না, তাহাই বা কেমন করিয়া বলিতে পারি? অর্থ লোভে মানুষের মন কখন যে কিরূপ হয়, তাহা আমরা কেন, সময় সময় দেবতাগণও বুঝিয়া উঠিতে পারেন না। বিশেষতঃ যদি রামদাসের উদ্দেশ্য মন্দই না হইবে, তাহা হইলে কলিকাতা হইতে যখন সে আগ্রায় গমন করিতেছিল, তখন সে এই ক্ষুদ্র ষ্টেসনে অবতরণ করিবে কেন? এবং দ্রব্যাদি লইয়া বিধুমুখীর সহিত ষ্টেসনের বাহির হইয়া যাইবেই বা কেন? 

এরূপ অবস্থায় রামদাস কর্তৃক যে, এই হত্যা সম্পন্ন হইয়াছে, এবং রামদাস কর্তৃক যে বিধুমুখীর সমস্ত দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তৎসম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

বামনদাসবাবু যখন দেখিলেন, অনুসন্ধানকারী কর্মচারী রামদাস সরকারকে বিধুমুখীর হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করিতেছেন, তখন তিনি যে কি করিবেন, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। কারণ, অর্থলোভে রামদাস সরকার বিধুমুখীকে যে হত্যা করিতে পারে, ইহা বামনদাস কোন প্রকারেই তাহার মনকে বুঝাইয়া উঠিতে পারিলেন না। অথচ অনুসন্ধানকারী কর্মচারী যে সকল যুক্তি ও প্রমাণে নির্ভর করিয়া রামদাসের উপর সন্দেহ করিতেছেন, সেই সকল যুক্তি ও প্রমাণের বিরুদ্ধে কোন কথা বলিতেও সমর্থ হইলেন না। 

অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী অপরাপর আবশ্যক অনুসন্ধান সম্পন্ন করিয়া, বিধুমুখীকে হত্যা করা অপরাধে পরিশেষে রামদাস সরকারের উপর মোকদ্দমা রুজু করিলেন। তাঁহার লিখিত রিপোর্ট প্রভৃতি দেখিয়া এবং তৎকর্তৃক লিখিত সাক্ষীগণের জবানবন্দী পাঠ করিয়া তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীগণ ও বিচারক প্রভৃতি সকলেই তাঁহার মতের সম্পূর্ণরূপ পোষকতা করিলেন। 

রামদাসের বিপক্ষে হত্যাপরাধে এক ওয়ারেন্ট বাহির হইল। অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী নানা স্থানে বিশেষরূপে তাহার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন; কিন্তু তাঁহার সমস্ত যত্ন ও পরিশ্রম নিষ্ফল হইল। রামদাস সরকার ধৃত হওয়া দূরে থাকুক, কোন স্থানে তাহার কোনরূপ সংবাদও প্রাপ্ত হওয়া গেল না। 

বামনদাসবাবু কিছু দিবস সেই স্থানে অবস্থিতি করিয়া রামদাসের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারীকে সাহায্য করিতে লাগিলেন। কিন্তু যখন কোন প্রকারেই রামদাসের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না, তখন কর্ম্মচারীর অনুমতি লইয়া তিনি আগ্রায় গমন করিলেন। 

বামনদাসবাবুর বৃদ্ধ মাতা বামনদাসবাবুর প্রমুখাৎ সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া অতীব শোকাতুরা হইয়া পড়িলেন। একে তাঁহার পুত্রবধূ হত হইয়াছে, তাহার অলঙ্কারপত্র সমস্তই অপহৃত হইয়াছে, তাহার উপর বিশ্বাসী ও বৃদ্ধ কৰ্ম্মচারী রামদাস কর্তৃক এই ঘটনা ঘটিয়াছে, এই সকল বিষয় বৃদ্ধা যতই ভাবিতে লাগিলেন, ততই তাঁহার শোকাবেগ আরও বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। 

এইরূপ অবস্থায় বামনদাসবাবু যতদূর পারিলেন, তাঁহার মাতাকে সুস্থির করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন, ও কয়েক দিবস আগ্রায় অবস্থিতি করিয়া মাতাকে সঙ্গে লইয়া চাকরি স্থান কলিকাতায় আগমন করিলেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

এইরূপ অবস্থায় দুই তিন মাস অতিবাহিত হইয়া গেল। বামনদাসবাবু ক্রমে বিধুমুখীর শোক ভুলিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ মাতার সেবা-শুশ্রূষা করিয়া দিনযাপন করিতে লাগিলেন। 

অনুসন্ধানকারী পুলিশ-কৰ্ম্মচারী কিছু দিবস পর্যন্ত রামদাসের অনুসন্ধান করিয়া যখন তাহার কোন সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন না, তখন তিনিও অপরাপর কার্য্যে হস্তার্পণ করিলেন। রামদাসের নামে কিন্তু ওয়ারেন্ট রহিয়া গেল। মধ্যে মধ্যে চিঠিপত্র লিখিয়া দূর দেশের অনুসন্ধানও চলিতে লাগিল। 

যে সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছিল, তাহার তিন মাস অতীত হইয়া যাইবার পর, রামদাস সরকার হঠাৎ এক দিবস বামনদাসবাবুর কলিকাতার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাকে দেখিবামাত্র রামনদাসবাবু একবারে বিস্মিত হইলেন, এবং কহিলেন, “আমার স্ত্রীকে হত্যা করিয়া তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছিলে। কিন্তু কোন্ সাহসে তুমি পুনরায় আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে?” 

উত্তরে রামদাস কহিল, “বিধুমুখী আপনার পত্নী সত্য; কিন্তু আমি তাঁহাকে আমার কন্যা বলিয়াই জানিতাম, এবং সেইরূপ ভাবে আমি তাঁহার সহিত ব্যবহার করিয়া আসিতেছিলাম। আমি বিধুমুখীকে হত্যা করি নাই, বা তাঁহার অলঙ্কার পর্যন্ত আমাকর্তৃক অপহৃত হয় নাই। গহনার লোভে কোন পিতা আপন কন্যাকে হত্যা করিয়াছে, এ কথা আপনি কখনও শ্রবণ করিয়াছেন কি?” 

পূর্ব্বে রামদাসের উপর বামনদাসবাবুর যদিও অত্যন্ত বিশ্বাস ছিল, কিন্তু এই ঘটনার পর হইতেই সেই বিশ্বাস তাঁহার হৃদয় হইতে একবারে স্থানান্তরিত হইয়াছিল। রামদাস যাহা কহিল, তাহা তিনি শ্রবণ করিলেন সত্য; কিন্তু তাহার কোন কথা বিশ্বাস না করিয়া উহাকে আমার হস্তে অর্পণ করিলেন। রামদাসের নামে হত্যাপরাধে এক ওয়ারেন্ট ছিল। পূৰ্ব্ব হইতে তাহা আমি জানিতাম। সুতরাং রামদাসকে পাইবামাত্র আমি তাহাকে ধৃত করিয়া থানায় আনয়ন করিলাম। 

কিরূপ অবস্থায় রামদাস বিধুমুখীকে হত্যা করিয়াছে, এবং অপহৃত অলঙ্কারগুলিই বা কোথায়, এই কথা আমি রামদাসকে বার বার জিজ্ঞাসা করিলাম। রামদাস একই প্রকারের উত্তর বার বার আমাকে প্রদান করিল! কহিল “এ হত্যা আমা কর্তৃক হয় নাই, অলঙ্কার পত্র আমি অপহরণ করি নাই।” রামদাস যখন আমাকে এইরূপ উত্তর প্রদান করিল, তখন আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সত্য বল দেখি, তুমি অনেক দিবস হইতে এই বামনদাসবাবু কর্তৃক প্রতিপালিত হইয়া আসিতেছ কি না?” 

রামদাস। বামনদাসবাবু কেন? বামনদাসবাবুর পিতার নিকট আমি প্রতিপালিত হইয়া আসিয়াছি, এবং এখন বামনদাসবাবু আমাকে প্রতিপালন করিতেছেন। 

আমি। বামনদাসবাবু যখন কলিকাতায় থাকিতেন, সেই সময় তুমি তাঁহার আগ্রার বাড়ীতে অবস্থিতি করিতে কি না? 

রামদাস। আমি আগ্রাতেই থাকিতাম। 

আমি। বামনদাসবাবুর বৃদ্ধ মাতাও সেই স্থানে থাকিতেন না? 

রামদাস। হাঁ, তিনিও আগ্রায় থাকিতেন। 

আমি। বিধুমুখী, বামনদাসবাবুর পত্নী? 

রামদাস। হাঁ, আমিই বামনদাসবাবুর সহিত তাঁহার বিবাহ দেই। 

আমি। তিনি বামনদাসবাবুর সঙ্গে কলিকাতায় থাকিতেন? 

রামদাস। পূর্ব্বে তিনি আগ্রায় থাকিতেন; কিন্তু অতি অল্পদিবস হইতে কলিকাতায় স্বামীর নিকটেই থাকিতেন।

আমি। বামনদাসবাবুর মাতা তোমাকে কলিকাতায় পাঠাইয়াছিলেন কি? 

রামদাস। পাঠাইয়াছিলেন। 

আমি। কেন তোমাকে কলিকাতায় পাঠাইয়াছিলেন? 

রামদাস। তাঁহার শরীর অসুস্থ হওয়ায় বিধুমুখীকে কলিকাতা হইতে আগ্রায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত আমাকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। 

আমি। তুমি কলিকাতায় আসিয়াছিলে? 

রামদাস। আসিয়াছিলাম। 

আমি। বামনদাসবাবুকে তুমি তোমার কলিকাতায় আসার উদ্দেশ্য বলিয়াছিলে? 

রামদাস। বলিয়াছিলাম। 

আমি। তাহাতে বামনদাসবাবু তাঁহার পত্নী বিধুমুখীকে তোমার সহিত আগ্রায় পাঠাইয়া দিয়াছিলেন?

রামদাস। দিয়াছিলেন। 

আমি। কয় দিবস পরে তুমি বিধুমুখীকে সঙ্গে লইয়া আগ্রায় পৌঁছিতে পারিয়াছিলে? 

রামদাস। আগ্রায় গিয়া পৌঁছিতে পারি নাই। 

আমি। যদি আগ্রায় গিয়া উপস্থিত হইতে না পারিলে, তাহা হইলে কোথায় গমন করিয়াছিলে, এবং বিধুমুখীকেই বা কোথায় লইয়া গিয়াছিলে? 

রামদাস। বিধুমুখীকে কোন স্থানে আমি লইয়া যাইতে সমর্থ হই নাই। 

আমি। এ কিরূপ কথা, হাওড়া ষ্টেসন হইতে বিধুমুখীকে সঙ্গে লইয়া রেলগাড়িতে তুমি প্রস্থান কর নাই কি?

রামদাস। আমরা হাওড়া হইতে গমন করিয়াছিলাম; কিন্তু আগ্রায় গিয়া উপনীত হইতে পারি নাই।

আমি। তবে তোমরা কোথায় গিয়াছিলে? 

রামদাস। কেবল স্ত্রীলোকদিগের নিমিত্ত যে গাড়ি, সেই গাড়িতে আমি বিধুমুখীকে উঠাইয়া দি। অলঙ্কারের বাক্স ও অপরাপর দ্রব্যাদি যাহা তিনি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেছিলেন, তাহাও তাঁহার সহিত সেই স্ত্রীলোকের গাড়িতে দেওয়া হয়। স্ত্রীলোকদিগের গাড়ি হইতে দুই তিন গাড়ি ব্যবধানে অপর আর একখানি গাড়িতে আমি আরোহণ করি। গাড়ির যে অংশে আমি আরোহণ করিয়াছিলাম, সেই অংশে কেবল মাত্র অপর দুইজন আরোহী ছিলেন। গাড়ি যখন বৰ্দ্ধমান ষ্টেসনে গিয়া উপনীত হইল, সেই সময় সেই দুই ব্যক্তিও গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া প্রস্থান করিলেন। অপর কোন ব্যক্তি আর সেই গাড়িতে আরোহণ করিল না। সুতরাং সেই অংশে আমি একাকীই রহিলাম। বর্দ্ধমান ষ্টেসন ছাড়িয়া গাড়ি ক্রমে পশ্চিমাভিমুখে গমন করিতে লাগিল। আমি বেঞ্চের উপর শয়ন করিয়া কখন অনায়াসেই নিদ্রা যাইতে লাগিলাম, কখন বসিয়া বসিয়া দুই পার্শ্বের স্বাভাবিক শোভা সকল সন্দর্শন করিতে করিতে গমন করিতে লাগিলাম। ক্রমে রাত্রি আসিয়া উপস্থিত হইল, আমিও বেঞ্চের উপর শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতে আরম্ভ করিলাম। যাঁহারা রেলগাড়িতে গমন করিতে করিতে নিদ্রা গিয়াছেন, তাঁহারা অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন, কিরূপ নিদ্রায় আমি নিদ্রিত হইয়াছিলাম। গাড়ি চলিতেছে, তাহা জানিতে পারিতেছি, অথচ নিদ্রা যাইতেছি। ষ্টেসনে গিয়া গাড়ি থামিতেছে, তাহাও অনুমান হইতেছে, অথচ নিদ্রা যাইতেছি। ষ্টেসনের ঘণ্টার শব্দ, গাড়ির দরজা খুলিবার ও বন্ধ করিবার শব্দ কর্ণে প্রবেশ করিতেছে, জানিতে পারিতেছি, অথচ নিদ্রা যাইতেছি। গাড়ি ছাড়িয়া দিল, অথচ নিদ্রিত অবস্থায় আছি। চক্ষু উন্মীলিত হইতেছে না, বোধ হইতেছে সমস্তই যেন দেখিতে পাইতেছি। এইরূপ অর্দ্ধ জাগরিত অবস্থায় নিদ্রা যাইতে যাইতে আমি গমন করিতে লাগিলাম। 

ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া পড়িল। এক ষ্টেসনে বোধ হইল যে, গাড়ির যে অংশে আমি নিদ্রা যাইতেছিলাম, সে অংশের দ্বার খুলিয়া কে যেন আমার গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল। আমি কিন্তু চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখিলাম না, আপন বেঞ্চের উপর চুপ করিয়া শয়ন করিয়া রহিলাম। এইরূপ অবস্থায় আর কয় ষ্টেসন আমি গমন করিলাম, তাহা বলিতে পারি না। পরে একটি ষ্টেসনে যখন গাড়ি গিয়া পৌঁছিল, সেই সময়ে আমার বোধ হইল যে, কে যেন আমাকে ডাকিতেছে। আমি চক্ষু উন্মীলিত করিলাম; দেখিলাম, দুই জন পুলিশ কর্মচারী আমার সন্নিকটে দণ্ডায়মান হইয়া আমাকে বার বার ডাকিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি উঠিয়া সেই বেঞ্চের উপর উপবেশন করিলাম। তখন দেখিলাম যে, আমার গাড়ির ভিতর আমি একাকীই আছি; মধ্যে যে ব্যক্তি উহাতে আরোহণ করিয়াছিল, সে কিংবা অপর কোন ব্যক্তিই নাই। আমি উঠিবামাত্র পুলিশ কর্ম্মচারীদ্বয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার কি কি দ্রব্যাদি আছে?” উত্তরে আমি কহিলাম, “আমার সহিত এই গাড়ির ভিতর কোন দ্রব্যই নাই। আমরা যে সকল দ্রব্যাদি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, তাহার সমস্তই স্ত্রীলোকদিগের গাড়ির ভিতর আছে।” আমার এই কথা শুনিবামাত্র, কৰ্ম্মচারীদ্বয় আলোক হস্তে আমার গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল, ও বেঞ্চের নিম্নদেশ প্রভৃতি স্থান সকল উত্তমরূপে দেখিয়া সেই স্থান হইতে একটি ব্যাগ বাহির করিয়া আমাকে কহিল, “এ ব্যাগটি কাহার?” ব্যাগের কথা বাস্তবিকই আমি কিছুই জানিতাম না। সুতরাং আমি বলিলাম, “এ কাহার ব্যাগ, তাহা আমি অবগত নহি।” দেখিলাম যে, আমার কথার উত্তরে উহারা বিশ্বাস না করিয়া সেই ব্যাগের সহিত আমাকে গাড়ি হইতে নামাইয়া আনিল। গাড়ি হইতে নামিতে নামিতে গাড়িও ছাড়িয়া দিল। 

সেই সময় আমি সেই কর্মচারীদ্বয়কে বার বার কহিলাম “গাড়ির ভিতর একটি স্ত্রীলোক আছে। আমি তাহাকে লইয়া আগ্রায় গমন করিতেছি। এরূপ অবস্থায় আমাকে রাখিলে সেই স্ত্রীলোকটির উপায় কি হইবে? আমাকে রাখিলে সেই স্ত্রীলোকটির উপায় কি হইবে? আমাকে ছাড়িয়া দিন। নতুবা তারযোগে আমাকে সংবাদ পাঠাইতে দিন।” আমার এ কথায় কেহই কর্ণপাত করিল না; অধিকন্তু জনৈক প্রহরীর বিশ্বাসাধীনে আমি একটি ঘরের ভিতর আবদ্ধ অবস্থায় রহিলাম। কি নিমিত্ত যে আমাকে গাড়ি হইতে নামাইয়া আনা হইল, কি নিমিত্তই যে আমাকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখা হইল ও কেনই বা কোন স্থানে আমার এই বিপদের সংবাদ প্রেরণ করিবার অনুমতি পাইলাম না, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমি আমার নিজের জন্য বিশেষ ভাবিত হইলাম না, কিন্তু বিধুমুখীর নিমিত্ত আমি অতিশয় চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। সেই অবলা কিরূপে কোথায় একাকী অবতরণ করিবে, কিরূপেই বা আপনার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবে, এই ভাবনায় আমার মন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল। কি করিব, তাহার কোন উপায়ও স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিরূপে বামনদাসবাবুর নিকট এই সংবাদ প্রদান করিব, তাহারও কোন পন্থা খুঁজিয়া পাইলাম না। পরদুঃখ কাতর বা সদাশয় কোন ব্যক্তিকে দেখিতেও পাইলাম না। যে দুই এক জন পুলিশ কর্মচারীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল, তাহাদিগের মধ্যে কেহই আমার কথায় কর্ণপাতও করিল না; অধিকন্তু আমার কথায় সম্পূর্ণরূপ অবিশ্বাস করিয়া আমাকে নানারূপ উপহাস করিতে লাগিল। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া আমাকে সমস্তই সহ্য করিতে হইল। ভগবানের উপর সমস্তই নির্ভর করিয়া বন্দীভাবে আমি সেই স্থানেই অবস্থিতি করিলাম। 

আমি যে কি অপরাধে ধৃত হইলাম, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না সত্য; কিন্তু ইহা বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, আমি সম্পূর্ণরূপে বিপদগ্রস্ত ও আমার উপর কোনরূপ অভিযোগ আনা হইয়াছে। পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম যে, রেলওয়ে পুলিশের হস্তে যদি কোন ব্যক্তি ধৃত হয় ও তাহার চরিত্র সম্বন্ধীয় যথাযথ বিবরণ যদি তাঁহারা সেই সময় অবগত হইতে না পারেন, তাহা হইলে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া তাহার সমস্ত অবস্থা অবগত হইবার নিমিত্ত তাহার বাড়ী বা তাহার থাকিবার স্থানে লইয়া গিয়া থাকে; কিন্তু আমার ভাগ্যে তাহা ঘটিল না। বুঝিলাম, আমার কথায় তাহারা বিশ্বাস করিল না, অথচ আমা সম্বন্ধীয় অনুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত আমাকে লইয়া তাহারা কলিকাতায় কি আগ্রায় বা অপর কোন স্থানে গমন করিল না। ভাবিয়াছিলাম যে, আমাকে লইয়া উহারা কোন স্থানে গমন করিলে কোন রূপ উপায় অবলম্বন করিয়া বামনদাসবাবুর নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দিব; কিন্তু আমার অদৃষ্টক্রমে তাহাও ঘটিল না। 

পরদিবস রবিবার ছিল, সুতরাং সেই দিবসও আবদ্ধ অবস্থায় আমাকে সেই স্থানে অবস্থান করিতে হইল। সোমবারে আমি জনৈক ইংরাজ বিচারকের নিকট প্রেরিত হইলাম। সেই সময় আমি জানিতে পারিলাম যে, যে গাড়িতে আমি ধৃত হইয়াছি ও যে গাড়ির ভিতর হইতে একটি ব্যাগও প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, কোন চোর অপর গাড়ি হইতে চুরি করিয়া সেই ব্যাগ আনিয়া সেই গাড়ির ভিতর রাখিয়া দিয়াছিল। যে স্থানে ব্যাগ পাওয়া যায়, সেই স্থানে কেবলমাত্র আমি ব্যতীত অপর আর কোন ব্যক্তিই সেই সময় ছিল না, সুতরাং উক্ত ব্যাগ আমিই অপহরণ করিয়া আনিয়াছি, ইহাই সকলে বিশ্বাস করেন। বিচারকও পরিশেষে ঐরূপ বিশ্বাস করিয়া চুরি করা অপরাধে আমাকে তিন মাসের নিমিত্ত কারাগারে প্রেরণ করেন। তাঁহার নিকটেই আমি আমার দুঃখের কথা বলিয়াছিলাম। বিধুমুখী যেরূপে রেলগাড়িতে একাকী গমন করিতেছেন, তাহাও তাঁহার নিকট প্রকাশ করিয়াছিলাম; কিন্তু তিনিও আমার কথায় কোনরূপে কর্ণপাত করেন নাই। জেলের ভিতর গমন করিয়াও জেলের যে কোন কর্মচারীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাঁহাকেই আমি আমার দুঃখের কথা কহিয়াছিলাম, ও উক্ত বিপদের কোনরূপ প্রতিবিধান করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগকে উপরোধ করিয়াছিলাম। তাঁহাদিগের মধ্যেও কোন ব্যক্তিই আমার কথায় বিশ্বাস করেন নাই; অধিকন্তু আমাকে পাগল বিবেচনা করিয়া আমাকে নানা রূপ উপহাস করিয়াছিলেন। 

এইরূপ অবস্থায় অনন্যোপায় হইয়া তিন মাস কাল আমাকে জেলের ভিতর অবস্থিতি করিতে হয়। তিন মাস পরে যেমন আমি কারামুক্ত হই, অমনি আমি আগ্রায় গমন না করিয়া কলিকাতায় বামনদাসবাবুর বাসায় আসিয়া উপনীত হই; ও বামনদাসবাবুর নিকট বিধুমুখীর কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারি যে, আমা কর্তৃক বিধুমুখী হত হইয়াছেন, তাঁহার অলঙ্কার প্রভৃতি যথা-সৰ্ব্বস্ব আমি অপহরণ করিয়াছি, ও আমার নামে হত্যাপরাধে এক ওয়ারেন্টও বাহির হইয়াছে। 

প্রকৃত কথা আমি যতদূর অবগত আছি, তাহাই আমি আপনার নিকট প্রকাশ করিলাম। ইচ্ছা হয়, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করিতে পারেন; ইচ্ছা না হয় বিশ্বাস করিবেন না। এ অবস্থায় আমার কথায় বিশ্বাস না করিলেও আমার কোন ক্ষতি নাই। কারণ, যে বিধুমুখীকে আমি আপনার কন্যা অপেক্ষাও ভালবাসিতাম, আমার বিবেচনার দোষে যখন তাহারই এই অবস্থা ঘটিয়াছে, তখন তাহাকে হত্যা করা অপরাধে আমি এখনই দণ্ড গ্রহণ করিতে প্রস্তুত। 

বৃদ্ধ সরকার রামদাসের কথা শুনিয়া আমি যে কি পৰ্য্যন্ত বিস্মিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু তাহার কথার উপর নির্ভর করিয়া তাহাকে মুক্তি প্রদান করিতেও সমর্থ হইলাম না। সৰ্ব্বপ্রথম অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারীকে সংবাদ প্রদান করিতে হইল। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র তিনি আসিয়া কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন; ও রামদাসের প্রমুখাৎ সমস্ত কথা অবগত হইয়া তিনিও সমধিক বিস্মিত হইলেন। 

রামদাস সরকার যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহার সত্যাসত্য অবগত হইবার নিমিত্ত আমরা উভয়ে মিলিয়া সবিশেষ তাহার অনুসন্ধান করিলাম, ও জানিতে পারিলাম যে, তাহার কথার প্রত্যেক বর্ণ সত্য, সে প্রকৃতই চৌর্য্যাপরাধে ধৃত হইয়া জেলে গমন করিয়াছিল। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

বিধুমুখীকে হত্যা করা সম্বন্ধে পূর্ব্বে যে সকল বিষয় অনুসন্ধানে স্থিরীকৃত হইয়াছিল, তখন তাহার সমস্তই ব্যর্থ হইয়া গেল। এখন পুনরায় নবভাবে উক্ত মোকদ্দমার অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। সময় সময় পুলিশ যেরূপ ভীষণ ভাব অবলম্বন করিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়া থাকেন, এবার সেইরূপ ভাবেই অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। 

অনুসন্ধানকারী কর্মচারীদিগের অনুসন্ধানের ভাবগতি দেখিয়া ষ্টেসনের নিম্নপদস্থ কর্ম্মচারীগণের মধ্যে অনেকেই ভীত হইয়া পড়িল, ও তাহাদিগের মধ্যে এক জন কর্মচারী ষ্টেসন মাষ্টার মহাশয়ের নিকট গমন করিয়া, এই হত্যাকাণ্ড—ঘটিত যাহা কিছু সে অবগত ছিল, তাহার সমস্তই প্রকাশ করিয়া দিল। যখন একজনের নিকট হইতে প্রকৃত কথা অবগত হইতে পারা গেল, তখন যে সকল ব্যক্তি কর্তৃক এই ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহাদিগের সকলের নাম প্রকাশ হইয়া গেল। তখন সকলেই অবগত হইতে পারিলেন যে, এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডে এসিসটেন্ট ষ্টেসন মাষ্টার, বুকিং ক্লার্ক এবং নিম্নপদস্থ দুই তিন জন ষ্টেসনের কর্ম্মচারী মিশ্রিত ছিল। তাহারা সকলেই ধৃত হইল। 

কিরূপে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছিল, তাহা সাক্ষীগণ ও আসামীগণের নিকট হইতে সেই সময় যেরূপ অবগত হইতে পারা গিয়াছিল, তাহা নিম্নে বিবৃত হইল। ইহা পাঠ করিলেই পাঠকগণ অবগত হইতে পারিবেন যে, সময় সময় কিরূপ ভাবে ভয়ানক ভয়ানক কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন হইয়া থাকে। 

কোন্ ষ্টেশনে ও কোন স্থানে রামদাস যে ধৃত হন, তাহার কিছুমাত্র বিধুমুখী অবগত হইতে পারেন নাই। কিছু দূর গমন করিলে কোন কার্য্যের নিমিত্ত তাঁহার রামদাসকে প্রয়োজন হয়; সেই সময় বিধুমুখী তাহার অনুসন্ধান লন। বিধুমুখী যে গাড়িতে উঠিয়াছিলেন, সেই গাড়িতে অপর আর এক জন প্রবীণা স্ত্রীলোকও ছিলেন। বিধুমুখীর কথা মত সেই স্ত্রীলোকটি কোন এক ষ্টেশনে গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া তন্ন তন্ন করিয়া রামদাসের অনুসন্ধান করেন, কিন্তু কোনরূপে তাহার সন্ধান প্রাপ্ত হন নাই। এই অবস্থায় রামদাসের কি হইল, বিধুমুখী তাহার কিছুই অবগত হইতে না পারিয়া নিজেই বা একাকী কেমন করিয়া গমন করিবেন ও কোন্ স্থানে অবতরণ করিবেন, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, অতিশয় চিন্তিত হইলেন। কিন্তু কি করিবেন, অনন্যোপায় হইয়া সেই গাড়ির ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। 

সেই গাড়ির ভিতর অপরাপর যে সকল স্ত্রীলোক ছিল, তাহারা ক্রমে ক্রমে আপনাপন গন্তব্যস্থানে নামিয়া গেল। কেবলমাত্র বিধুমুখী একাকী সেই গাড়িতে রহিলেন। গাড়ি ক্রমে চলিতে লাগিল, এক ষ্টেসনে উপনীত হইতে লাগিল। পুনরায় সেই ষ্টেসন পরিত্যাগ করিল। এইরূপে ক্রমে কিছুদূর গমন করিবার পর, নানা প্রকার ভাবিতে ভাবিতে বিধুমুখী বেঞ্চের উপর শয়ন করিলেন, এবং ক্রমে নিদ্রিতা হইয়া পড়িলেন। যখন তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন রাত্রি প্রায় দশটা। যে স্টেসনের নিকট তাঁহার মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই ষ্টেসনে গাড়ি গিয়া পৌঁছিবামাত্র বিধুমুখীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। কোন স্থানে তিনি আগমন করিয়াছেন, ও কোন্ স্থানে তাঁহাকে অবতরণ করিতে হইবে, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আপন লজ্জা পরিত্যাগ-পূর্ব্বক তাঁহার সন্নিকটবর্ত্তী প্ল্যাটফর্মের উপর দণ্ডায়মান এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারকে দেখিতে পাইয়া, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! আমি আগ্রায় গমন করিব। আগ্রা ষ্টেসন এখান হইতে কতদূর?” উত্তরে এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার কহিলেন, “কেন? আপনার সঙ্গে কোন লোকজন নাই?” বিধুমুখী তাহার উত্তরে কহিলেন “ছিল, কিন্তু তাঁহাকে অনুসন্ধান করিয়া পাইতেছি না। জানি না, তাঁহার কি হইয়াছে।” 

বিধুমুখীর এই কথা শুনিয়া এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার কহিল “আগ্রা ষ্টেসন আপনি অনেক দূর পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন। আপনি এই স্থানেই অবতরণ করুন। আগ্রা যাইবার একখানি গাড়ি শীঘ্রই আসিবে, সেই গাড়িতে আপনাকে উঠাইয়া দিব, আপনি গমন করিবেন।” 

এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারের এইরূপ মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করিয়া বিধুমুখী আপনার দ্রব্যাদির সহিত সেই স্থানেই গাড়ি হইতে তাবতরণ করিলেন। গাড়িও ষ্টেসন পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। 

গাড়ি চলিয়া যাইবার পর, এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টার ও বুকিং ক্লার্ক কি পরামর্শ করিয়া উভয়েই বিধুমুখীর নিকট গমন করিলেন, ও বিধুমুখীকে কহিলেন, “আগ্রায় গমন করিবার গাড়ি আজ রাত্রিতে আর পাইবেন না। কল্য প্রত্যূষে একখানি গাড়ি আসিবে, সেই গাড়িতে আপনাকে উঠাইয়া দিব। বুকিংক্লার্ক বাবুর পরিবার এই স্থানে আছেন, তাঁহারই নিকট অবস্থান করিয়া আপনি রাত্রি যাপন করুন। কারণ, আপনার সদৃশ স্ত্রীলোককে এই ষ্টেসনের ভিতর এরূপ অবস্থায় একাকী রাত্রি যাপন করিবার পরামর্শ, আমি প্রদান করিতে পারি না।” 

অনন্যোপায় হইয়া এসিসটেন্ট ষ্টেসনমাষ্টারের কথায় বিধুমুখী সম্মত হইলেন, এবং তাহাদিগের সহিতই তিনি বুকিং ক্লার্কের বাসায় গমন করিলেন। সেই স্থানে গমন করিয়া বিধুমুখী অবগত হইতে পারিলেন যে, কর্ম্মচারীদ্বয় তাহাকে যাহা বলিয়াছিল, তাহার সমস্তই মিথ্যা: সেই বাসায় কোন স্ত্রীলোক বাস করে না। 

এইরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া বিধুমুখী বড়ই বিপদগ্রস্ত হইলেন। কিন্তু ইচ্ছা থাকিলেও চারি পাঁচজন কর্মচারীর হস্ত হইতে কোনরূপেই নিষ্কৃতি পাইয়া স্থানান্তরে গমন করিতে পারিলেন না। অধিকন্তু সেই নিভৃত বাসার মধ্যে সেই পাষণ্ডেরা তাঁহার ধর্ম্ম নষ্ট করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল; কিন্তু কোনরূপেই যখন তাহাদিগের মনস্কামনা সিদ্ধ করিতে পারিল না, তখন কেহ কেহ বলপূর্বক উহার গলা চাপিয়া ধরিল, কেহ বা বলপূর্ব্বক উহার হস্তপদ ধারণ করিয়া আপনাপন নীচ প্রবৃত্তি পরিতৃপ্ত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগের মনস্কামনা পূর্ণ হইল না। গলদেশে ভয়ানক চাপ পড়ায় বিধুমুখী ইহজীবন পরিত্যাগ করিল। 

উহারা যখন দেখিল যে, বিধুমুখী মরিয়া গিয়াছে, তখন অনন্যোপায় হইয়া উহার যথাসর্ব্বস্ব সকলে বণ্টন করিয়া লইল, এবং সেই মৃতদেহ পূৰ্ব্ববর্ণিত স্থানে নিক্ষেপ করিল। 

কর্মচারীগণ এই সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়া উত্তমরূপে প্রত্যেক আসামীর খানাতল্লাসী করিলেন। তল্লাসিতে প্রায় সকলের নিকট হইতে কিছু না কিছু অপহৃত দ্রব্য পাওয়া গেল, এবং সেই সকল দ্রব্য পরিশেষে বামনদাসবাবু কর্তৃক সনাক্ত হইল। 

নিয়মিত সময়ে আসামীগণ বিচারার্থে বিচারকের নিকট প্রেরিত হইল, এবং বিচারে সকলেই আজীবন দ্বীপান্তরে গমন করিল। 

[কার্তিক, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *