পথে খুন! (১) (অর্থাৎ রাজবর্তে গাড়ির ভিতর হত্যা ও তৎ হত্যাকারী ধৃত করিবার অদ্ভুত কৌশল!)

পথে খুন! (১) (অর্থাৎ রাজবর্তে গাড়ির ভিতর হত্যা ও তৎহত্যাকারী ধৃত করিবার অদ্ভুত কৌশল!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

কলিকাতা সহরের মধ্যস্থিত কোন এক থানার নিকটবর্ত্তী গির্জ্জার ঘড়ীতে ঢং ঢং করিয়া দুইটা বাজিয়া গেল। রাত্রি দুইটার সময় সহর নিস্তব্ধ, কিন্তু থানার ভিতর গোলযোগ। 

রাত্রি দুইটার সময় পাহারার বদলি হয়। থানার যে সকল প্রহরী বিশ্রাম করিতেছিল, গির্জ্জার ঘড়ী বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা আপন আপন চারিপায়া পরিত্যাগ করিয়া ও আপন আপন পোষাক পরিধান করিয়া থানার সম্মুখে আসিয়া শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইল, এবং আদেশ মত পরিশেষে সকলেই থানা হইতে বহির্গত হইয়া গেল। 

যে সকল প্রহরী বাহিরে পাহারায় নিযুক্ত ছিল, তাহারা তখনও থানায় প্রত্যাগমন করে নাই। সুতরাং সেই সময়ে থানার ভিতর লোকজনের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। 

দ্বিতীয় শ্রেণীর একখানি ঠিকা ঘোড়ার গাড়ি সেই সময় থানার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল। গাড়ি খানি এক ঘোড়ার। উহাতে সহিস নাই, কেবলমাত্র গাড়িবান কোচবাক্সে বসিয়া আছে। 

থানার দ্বারে যে প্রহরীর পাহারা ছিল, গাড়ি দেখিয়া সে ভাবিল যে, তাহার কোন সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী রাউণ্ডে (রোঁদে) আসিয়াছে; সুতরাং প্রহরী দ্রুতপদে গিয়া গাড়ির নিকট উপস্থিত হইল। 

প্রহরী মনে মনে যাহা ভাবিয়াছিল, গাড়ির নিকট গিয়া তাহার বিপরীত দেখিল। দেখিল 

গাড়ির ভিতর তাহার কোন সৰ্ব্বপ্রধান কর্মচারী নাই, কেবলমাত্র অজ্ঞান অবস্থায় একটি লোক গাড়ির ভিতর পড়িয়া রহিয়াছে। 

এই ব্যাপার দেখিয়া প্রহরীর মনে একটু ক্রোধের সঞ্চার হইল। কারণ, তাহার মনে মনে ইচ্ছা ছিল যে, যে পর্য্যন্ত প্রহরীগণ পাহারা হইতে প্রত্যাগমন না করে, সেই পর্যন্ত থানার দ্বারে বসিয়া বসিয়া সে একটু ঘুমাইয়া লয়। 

তাহার অভিলষিত নিদ্রায় ব্যাঘাত হওয়াতেই তাহার মনে একটু ক্রোধের সঞ্চার হইল। কিন্তু মনের ভাব গোপন করিয়া গাড়িবানকে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে? এত রাত্রিতে কি নিমিত্ত সকলকে জ্বালাতন করিতে আসিয়াছ?” উত্তরে গাড়িবান কহিল, “আমার গাড়ি ভাড়া করিয়া ইহার ভিতর দুইজন লোক আরোহণ করিয়াছিল। একজন কখন নাবিয়া গিয়াছে, জানিতে পারি নাই। অপরটিকে দেখিতেছি, সে মৃতাবস্থায় গাড়ির ভিতর পড়িয়া রহিয়াছে। সেই জন্যই এই মৃতদেহ পায় আনিয়া উপস্থিত করিয়াছি। দারোগা জমাদারদিগকে সংবাদ দিয়া যাহা কৰ্ত্তব্য হয়—কর।” 

গাড়িবানের কথা শুনিয়া প্রহরী একটু চিন্তিত হইল, এবং দ্রুতবেগে থানার ভিতর প্রবেশ করিয়া দারোগা জমাদার প্রভৃতি যে সকল কৰ্ম্মচারী সেই সময় থানায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগকে উঠাইয়া দিল। গাড়িবানের মুখে যাহা শুনিয়াছিল, এবং স্বচক্ষে যাহা দেখিয়াছিল, তাহা তাঁহাদিগের নিকট বর্ণন করিল। 

প্রহরীর কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারীগণ শয্যা পরিত্যাগ পূর্ব্বক থানার বাহিরে আসিয়া গাড়ির মধ্যস্থিত সেই মৃতব্যক্তিকে দর্শন করিলেন, ও গাড়িবান সংক্ষেপে যাহা কহিল, তাহাও শ্রবণ করিলেন। 

বৈদ্যুতিক বলে এই সংবাদ কলিকাতার সমস্ত প্রধান প্রধান পুলিস-কর্মচারীর নিকট গিয়া উপনীত হইল। আমাদিগের থানার বৈদ্যুতিক ঘণ্টাও বাজিয়া উঠিল। যে অবস্থায় ও যে স্থানে সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহাও আমরা তৎক্ষণাৎ জানিতে পারিলাম। 

বৈদ্যুতিক বলে যত শীঘ্র সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইল, তত শীঘ্র সেইস্থানে আমাদিগের উপস্থিত হইবার উপায় এ পর্যন্ত বাহির হয় নাই। সুতরাং রাত্রি দুইটার পর বহুকষ্টে একখানি ঠিকা গাড়ি সংগ্রহ করিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইতে একটু বিলম্ব হইয়া পড়িল। 

আমরা যখন সেইস্থানে উপনীত হইলাম, সেই সময়ে তাপরাপর দুই চারি জন প্রধান কৰ্ম্মচারী সেইস্থানে আসিয়া উপনীত হইলেও কেহ কোনরূপে সেই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করেন নাই। যেরূপ অবস্থায় সেই মৃতদেহ থানায় আনীত হইয়াছিল, এখন পর্যন্ত উহা সেইরূপ ভাবেই সেই গাড়ির ভিতর রহিয়াছে। 

আমরা সেইস্থানে উপনীত হইবার অতি অল্প সময় পরেই আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী মহাশয় আসিয়া সেইস্থানে উপনীত হইলেন। 

সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী মহাশয় সেইস্থানে আসিয়া উপনীত হইবার পর তাঁহার সম্মুখে গাড়ীর মধ্যস্থিত সেই লাসের অবস্থা উত্তমরূপে দেখা হইল। 

সকলে অনুমান করিলেন যে, মৃতব্যক্তির বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অধিক হইবে না। তাহার বর্ণ গৌর, দাড়ি আছে। পরিধানে সাদা পাজামা, গায়ে কামদার চাকান, মস্তকের সন্নিকটে গাড়ির উপর একটি লাল টর্কি টুপি, পায়ে একজোড়া বার্নিস করা জুতা। জাতিতে মুসলমান বলিয়া অনুমান হয়। 

চাপকানের নিম্নে একটি সাদা কামিজ। চাপকানের ঘড়ীর পকেটে একটি সোণার ঘড়ী, এবং একছড়া সোণার চেন, ঘড়ীর সহিত সংলগ্ন। অপর পকেটে পাঁচটি সিগারেট, এক বাক্স দেশলাই, এবং চামড়ার একটি ছোট ব্যাগ। 

উক্ত বাক্সের মধ্যে দুইখানি দশ দশ টাকার নোট, চারিটি টাকা, একটি সিকি ও পাঁচটি পয়সা আছে। সেই মৃতব্যক্তির হস্তদ্বয় একখানি সাদা রেশমী রুমাল দ্বারা সবলে আবদ্ধ। উহার মুখশ্রী বিবর্ণ হইয়া যেন লালবর্ণে পরিণত হইয়াছে। চক্ষুদ্বয় অর্দ্ধমুদিত। তারাযুগল অস্বাভাবিক বড়। মুখ দিয়া ফেনা ধারা বিনির্গত হইতেছে। 

মৃতদেহের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া সৰ্ব্বপ্রধান কর্মচারী মহাশয় সেই স্থানেই এই আদেশ প্রদান করিলেন যে, যে ডাক্তার সাহেব এই শব ছেদ করিয়া ইহার পরীক্ষা করিবেন, তাঁহাকে এইস্থানে আনাইয়া এই অবস্থাতেই মৃতদেহ দেখান হউক। 

সর্বপ্রধান কর্মচারীর আদেশ পাইবামাত্র তৎক্ষণাৎ অপর একজন কর্ম্মচারী একখানি গাড়ী লইয়া ডাক্তার সাহেবের উদ্দেশে চলিলেন। 

প্রায় একঘন্টা পরে ডাক্তার সাহেব আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন। তিনি সেই মৃতদেহ উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, “হাইড্রোসেনিক নামক মহা তেজস্কর বিষ পানই ইহার মৃত্যুর কারণ বলিয়া আমার অনুমান হয়। এই শব ছেদ করিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিব যে, আমার অনুমান প্রকৃত কি না।” এইরূপ মত প্রকাশ করিয়া ডাক্তার সাহেব সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন। 

মৃতদেহের অবস্থা দেখিয়া ও ডাক্তার সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া সেইস্থানে যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই অতিশয় চিন্তিত হইলেন। 

অনেকেই মনে করিতে লাগিলেন যে, প্রকৃতই যদি হাইড্রোসেনিক এসিড সেবনে ইহার মৃত্যু হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই ব্যক্তি যে আত্মহত্যা করিয়াছে, তাহা কিছুতেই অনুমান করা যায় না। 

আত্মহত্যা করিলে হাইড্রোসেনিক এসিডের শিশি গাড়ীর ভিতর না পাওয়া যাইবার কারণ কি? 

যেরূপ অবস্থায় রুমাল দ্বারা উহার হস্তদ্বয় বাঁধা রহিয়াছে, জীবিতাবস্থায় সে নিজে এরূপ ভাবে আপনার হস্তদ্বয় বাঁধিতে কখনই সমর্থ হয় না। বিশেষতঃ এরূপ থাকিলে স্বহস্তে বিষপান করা একবারেই অসম্ভব। ইহা যে আত্মহত্যা, এরূপ অবস্থায় তাহা কোন প্রকারেই অনুমান করা যাইতে পারে না, বা সম্ভবপর বলিয়াও বোধ হয় না। 

ইহা যদি আত্মহত্যা না হয়, তাহা হইলে হত্যা ব্যতীত আর কিছুই হইতে পারে না। 

শেষোক্ত অনুমান যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে এই ব্যক্তি কাহা-কর্তৃক হত হইল? কি নিমিত্তই বা ইহাকে হত্যা করা হইল? এবং হতব্যক্তিই বা কে? 

চুরির অভিপ্রায়ে এই হত্যাকাৰ্য্য সংসাধিত হয় নাই। ইহার নিকট যে সকল অর্থ পাওয়া গিয়াছে, চোর-কর্তৃক সেই হত্যাকাৰ্য সংসাধিত হইলে সেই সকল অর্থ কখনই পাওয়া যাইত না। বিশেষতঃ এ দেশীয় সাধারণ চোরের পক্ষে হাইড্রোসেনিক এসিড সংগ্রহ করা নিতান্ত সহজ নহে। 

চুরির অভিপ্রায়ে যদি এই হত্যা না হইয়া থাকে, তাহা হইলে যাহা আমাদিগের বুদ্ধিতে স্থান পাইতেছে, না, এরূপ কোন অলক্ষিত কারণ নিশ্চয়ই ইহার ভিতর গুপ্তভাবে রহিয়াছে। সেই অলক্ষিত কারণ কি? এবং কি প্রকারেই বা সর্ব্বসাধারণে সেই কারণ প্রচারিত হইতে পারিবে? 

কৰ্ম্মচারীগণ এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া পরিশেষে সকলেই একবাক্যে স্থির করিলেন যে, এ বিষয়ে গাড়িবান যতদূর অবগত আছে, প্রথমেই তাহা বিশেষরূপে সকলেরই জানা কর্তব্য ও অনুসন্ধান করিয়া দেখা আবশ্যক; গাড়িবান যাহা যাহা বলিতেছে, তাহা প্রকৃত, কি না? 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

সকল কর্মচারী মিলিয়া গাড়িবানকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, গাড়িবান তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিল। গাড়িবান যাহা যাহা কহিল, তাহার সারমর্ম্ম লিখিত হইল। তাহা এইরূপ :—

“রাত্রি আন্দাজ দেড়টার সময় আমি ভবানীপুরের দিক হইতে চৌরঙ্গি রোড বাহিয়া আগমন করিতেছিলাম। যে সময় আমি ধৰ্ম্মতলার মোড়ে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় দেখিলাম যে, একটি লোক ফুটের উপর দাঁড়াইয়া আছে। সে আমাকে দেখিয়া খালি গাড়ি বলিয়া ডাকিল। উহার কথা শুনিয়া আমি আমার গাড়ি লইয়া তাহার নিকট গিয়া উপনীত হইলাম। তাহাকে দেখিয়া আমার বোধ হইল যে, সেই ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতিস্থ নহে, যেন নেসার ঘোরে বিভোর হইয়া রহিয়াছে। উহার এই অবস্থা দেখিয়া আমি আমার গাড়ি লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার উদযোগ করিতেছি, এমন সময় ফুটের বিপরীত দিক হইতে অপর আর এক ব্যক্তি আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল, ও আমাকে কহিল, “তুমি ইহাকে না লইয়া চলিয়া যাইতেছ কেন? এই ব্যক্তি সামান্য একটু মাতয়ালা হইয়াছে বলিয়া এরূপ ভাবে পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া গাড়িবানের কর্তব্য নহে। চল, আমিও ইহার সহিত গমন করিতেছি ইহার বাড়ীতে আমাদিগকে পৌঁছাইয়া দেও।” সেই ব্যক্তির কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনাদিগের বাড়ী কোথায়? আপনাদিগকে লইয়া আমাকে কতদূর গমন করিতে হইবে?” উত্তরে সেই ব্যক্তি কহিল, “শ্যামবাজারের একটু উত্তরে আমাদিগের বাড়ী, সেইস্থানে তুমি আমাদিগকে পৌঁছাইয়া দেও। ভাড়া যাহা লইবে, তাহাই আমরা দিতে প্রস্তুত আছি।” সেই ব্যক্তির এই কথা শুনিয়া ধৰ্ম্মতলার গাড়ির আড্ডার দিকে আমি একবার দেখিলাম। দেখিলাম, আড্ডায় একখানিও গাড়ি নাই। সুতরাং একটু সুযোগ পাইয়া আমি কহিলাম, “এত রাত্রিতে দেড় টাকার কমে আমি কিছুতেই শ্যামবাজারে গমন করিতে পারিব না।” সেই ব্যক্তি দেড় টাকা প্রদান করিতেই সম্মত হইয়া, যে ব্যক্তি একটু নেসার ঘোরে ছিল, তাহাকে আমার গাড়ির ভিতর উঠাইয়া দিল, এবং পরিশেষে আপনিও গাড়ির ভিতর আরোহণ করিয়া গাড়ির দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আমিও আমার গাড়ি লইয়া শ্যামবাজার অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম। শ্যামবাজারের চৌরাস্তায় উপনীত হইয়া কোন দিকে গমন করিতে হইবে, তাহা কোচবাক্সে বসিয়া আরোহীদ্বয়কে বার বার জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু কোনরূপ উত্তর না পাইয়া সেইস্থানে আমি গাড়ি দাঁড় করাইয়া কোচবাক্স হইতে নিম্নে অবতরণ করিলাম। সেই সময় দেখিলাম, যে ব্যক্তি পরিশেষে আমার গাড়ি ভাড়া করিয়াছিল, সেই ব্যক্তি গাড়ির ভিতর নাই। পথিমধ্যে কোনস্থানে আমার অলক্ষিত ভাবে গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে, এবং যে ব্যক্তি অল্প নেসার ঘোরে ছিল, সে মৃত অবস্থায় আমার গাড়ির ভিতর পড়িয়া রহিয়াছে। 

“যেরূপ অবস্থায় আমি এই মৃতব্যক্তিকে আমার গাড়ির ভিতর দেখিতে পাইলাম, ঠিক সেইরূপ অবস্থায় আমি উহাকে থানায় আনয়ন করিলাম। এই মৃতদেহ থানায় আনিবার পূর্ব্বে আমি একবার মনে করিয়াছিলাম যে, এরূপ অবস্থায় এই মৃতদেহ থানায় লইয়া গেলে, পরিশেষে হয় ত আমাকেই বিপদে পড়িতে হইবে। সুতরাং ইহাকে থানায় না লইয়া গিয়া পথে কোনস্থানে ইহাকে ফেলিয়া রাখিয়া পলায়ন করাই কর্তব্য। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া উহাকে গাড়ি হইতে নামাইবার ইচ্ছা করিতেছি, এমন সময় হঠাৎ মনে হইল যে, এই মৃতদেহ পথে রাখিবার সময় যদি কোন ব্যক্তি দেখিতে পায়, তাহা হইলে এই হত্যাকাণ্ড আমার দ্বারা সাধিত হইয়াছে, এই কথা সকলেই বিশ্বাস করিবে। সুতরাং বাঁচিবার আমার আর কোন উপায়ই থাকিবে না। এইরূপ সাত পাঁচ ভাবিয়া এই মৃতদেহ থানায় আনিয়া প্রকৃতকথা বলাই সাব্যস্ত করিলাম, এবং এই মৃতদেহ থানায় আনিয়া উপস্থাপিত করিলাম।” 

এইরূপ বলিয়া গাড়িবান চুপ করিল 

গাড়িবানের এই কথা শেষ হইলে একজন কর্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে ব্যক্তি তোমার গাড়ি ভাড়া করিয়াছিল, এবং পরিশেষে তোমার অলক্ষিত ভাবে যে ব্যক্তি পলায়ন করিয়াছে, সেই ব্যক্তির আকৃতি ও পোষাক পরিচ্ছদ কি প্রকার ছিল?” 

কর্মচারীর এই কথার উত্তরে গাড়িবান কহিল, “আমার যতদূর স্মরণ হয়, তাহাতে সেই ব্যক্তিকে মুসলমান বলিয়া বোধ হয়। উহার পরিধানে সাদা পাজামা ও কাল চাপকান, মস্তকে একটু কাল রঙ্গের টুপি। অনুমানে বোধ হয়, উহার বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর হইবে। উহার দাড়ি ও গোঁপ কাল, কিন্তু দাড়ি ছাঁটা নহে—বেশ লম্বা। আকৃতি দেখিয়া বোধ হয় যে, সেই ব্যক্তি নিতান্ত দরিদ্র নহে। উহার দক্ষিণ হস্তের অনামিকা অঙ্গুলিতে একটি হীরার আংটা ছিল, সেই হীরাখানি খুব বড়। এমন কি, সহজেই উহার প্রতি সকলেরই নয়ন আকৃষ্ট হয়।” 

গাড়িবানের কথা শুনিয়া অপর আর একজন কম্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই ব্যক্তির অঙ্গগুলিতে যে আংটী ছিল, তাহা যে হীরার আংটী, তাহা তুমি কি প্রকারে জানিতে পারিলে? উহা যে কাচ নহে, তাহা তুমি কি প্রকারে বলিতে পার? 

উত্তরে গাড়িবান কহিল, “আমি নিজে নিতান্ত দরিদ্র লোক সত্য; কিন্তু গাড়িবানী করিতে করিতে আমি অনেক বড় বড় সাহেব ও বাবুদিগকে আমার এই গাড়িতে চড়াইয়াছি, এবং তাহাদিগের অঙ্গুলিস্থিত হীরার আংটী অনেক দেখিয়াছি। সুতরাং আমি বলিতে পারি যে, সেই আংটী হীরা ভিন্ন কিছুতেই কাচের হইতে পারে না। রাত্রিকালে উহার যেরূপ ঔজ্জ্বল্য আমার চক্ষে লাগিয়াছে, সেরূপ চাকচিক্য কখনই কাচ হইতে বহির্গত হইতে পারে না; উহা নিশ্চয়ই একখানি খুব ভাল হীরা হইবে।” 

এই সময় আর একজন কর্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই ব্যক্তি যে সময় গাড়ি ভাড়া করিয়াছিল, সেই সময় কোন ভাষায় সে তোমার সহিত কথা কহিয়াছিল?” 

“আমার সহিত তাহার যে কোন কথা হইয়াছিল, তাহা সমস্তই হিন্দী ভাষায়।” 

অপর আর একজন কর্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহার সহিত তোমার অনেক কথা হইয়াছিল; সুতরাং তাহার স্বর তোমার উত্তমরূপে মনে থাকিবার সম্ভাবনা?” 

“তাহার স্বর আমার উত্তমরূপ মনে আছে। তাহাকে দেখিতে না পাইলেও তাহার গলার স্বর শ্রবণ করিয়া আমি উত্তমরূপে তাহাকে চিনিতে পারিব।” 

এইরূপ ভাবে যে কোন কর্ম্মচারীর মনে যে কোন প্রশ্ন উদয় হইতে লাগিল, তিনি তাহাই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। গাড়িবানও যথাযথরূপে তাহার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। 

গাড়িবানের কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারীমাত্রই মনে করিলেন যে, গাড়িবান কোনরূপেই এই হত্যাকাণ্ডে সংমিশ্রিত নহে। বরং সে যে সকল কথা বলিতেছে, তাহার সমস্তই প্রকৃত বলিয়া অনুমিত হয়। 

এইরূপে গাড়িবানের নিকট যাহা কিছু অবগত হইতে পারা গেল, তাহা অবগত হইয়া এক এক করিয়া ক্রমে কর্ম্মচারীমাত্রই সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন। কারণ, সেইস্থানে অনুসন্ধান করিবার বা অপর কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিবার আর কোন উপায় ছিল না; অথচ রাত্রি প্রভাত হইয়া আসিয়াছিল। 

যে গাড়িতে করিয়া গাড়িবান মৃতদেহ থানায় আনয়ন করিয়াছিল, সেই গাড়িতে করিয়াই সেই মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত ডেডহাউসে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। 

আমি সেইস্থানে আরও একটু অপেক্ষা করিয়া, সেই মৃতদেহ কাহার, তাহার যদি কোনরূপ অনুসন্ধান করিতে পারি, এই অভিপ্রায়ে সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু কি উপায়ে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে পারিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

গাড়ির ভিতর একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, এই সংবাদ অতি প্রত্যূষেই সহরময় প্রকাশ হইয়া পড়িল, এবং অনেকেই সেই মৃতদেহ দেখিবার মানসে, পরীক্ষার্থ যে স্থানে সেই মৃতদেহ রাখা হইয়াছিল, সেইস্থানে একে একে গমন করিতে লাগিলেন। 

অনুসন্ধানার্থ আমি কোন দিকে গমন করিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, পরীক্ষার্থ যে স্থানে মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, সেইস্থানে গিয়া উপনীত হইলাম। কারণ, দর্শকবৃন্দের মধ্যে যদি কোন ব্যক্তি ইহাকে চিনিতে পারে, তাহা হইলে অনুসন্ধানের একটি পথ অনায়াসেই পাওয়া যাইবার সম্ভাবনা। 

ক্রমে বেলা দশটা বাজিয়া গেল। যে স্থানে মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, সেইস্থান লোকে পূর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু “ সেই মৃতদেহ যে কাহার, তাহা কেহই চিনিতে পারিল না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

দর্শকবৃন্দের মধ্যে দর্শকরূপে আমি দাঁড়াইয়া আছি, এবং কোন ব্যক্তি কি বলিতেছে, তাহা সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতেছি, এমন সময় নিকটবর্তী ঘড়ীতে এক এক করিয়া তিনটা বাজিয়া গেল। বুঝিলাম, বেলা অধিক হইয়াছে। ভাবিলাম যে, এই সময় একবার বাসায় গিয়া স্নান আহারাদি কার্য্যটা শীঘ্র সারিয়া লওয়া কর্তব্য আবার ভাবিলাম, যে পর্য্যন্ত মৃতদেহ এইস্থানে রক্ষিত থাকে সেই পৰ্য্যস্ত এইস্থান পরিত্যাগ করা কোনক্রমেই উচিত নহে। 

এইস্থান পরিত্যাগ করিয়া এখন চলিয়া যাই কি না, মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় তিনজন লোকের উপর হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম যে, এই তিন ব্যক্তি সবিশেষ আগ্রহের সহিত সেই মৃতদেহ দেখিতেছে। অতীব স্থিরভাবে সেই মৃতদেহ কিয়ৎক্ষণ দর্শন করিবার পর উক্ত তিন ব্যক্তির মধ্য হইতে হঠাৎ একজন বলিলেন, “ইহাকে যেন চেনা চেনা বোধ হইতেছে না?” 

উত্তরে দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিলেন, “ইহাকে কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে।” 

উভয় ব্যক্তির কথা শ্রবণ করিয়া তৃতীয় ব্যক্তি কহিলেন, “কেবলমাত্র যে কোথায় দেখিয়াছি, তাহা নহে। এই ব্যক্তি আমাদিগের নিকট উত্তমরূপে পরিচিত বলিয়া বোধ হইতেছে। কিন্তু কি কারণে বা কোথায় এই ব্যক্তি আমাদিগের নিকট পরিচিত, তাহা ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।” 

এইস্থানে পাঠকগণকে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক যে, যে তিন ব্যক্তির মধ্যে এইরূপ ভাবে কথাবার্তা হইতেছে, তাঁহারা সকলেই মুসলমান। 

ইহাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাঁহাদিগের আরও সন্নিকটবর্ত্তী হইয়া তাঁহাদিগের কথাবার্তা বিশেষরূপ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে লাগিলাম। 

প্রথম ব্যক্তি কহিলেন, “কোন হোটেলে ইহার সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হয় নাই কি?” 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। থিয়েটার বা কোন আমোদ-প্রদ স্থানে ইহার সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়।

তৃতীয় ব্যক্তি। কোন হোটেলে আমরা ইহাকে দেখিয়াছি বলিয়া আমার অনুমান হয় না, বা থিয়েটার প্রভৃতি কোন স্থানে দেখিয়াছি বলিয়া আমার বোধ হয় না। আমার বোধ হয়, কলিঙ্গা বাজারের কোন বাড়ীতে ইহাকে দেখিয়াছি।

প্রথম ব্যক্তি। তুমি যাহা অনুমান করিয়াছ, তাহা সত্য। কলিঙ্গা বাজারের নছিবন বাড়ীওয়ালীর বাড়ীতে উহাকে দেখিয়াছি বলিয়া আমার অনুমান হইতেছে। 

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যক্তি। ঠিক্ মনে করিয়াছ। নছিবনের বাড়ীতেই উহাকে দেখিয়াছি সত্য। উহার সহিত আরও এক ব্যক্তিকে দেখিয়াছি বলিয়া আমাদিগের বোধ হইতেছে। 

এই তিন ব্যক্তির মধ্যে পরস্পর যেরূপ কথাবার্তা হইল, তাহা আমি বিশেষরূপ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। পরিশেষে তাঁহারা যখন সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন, আমিও অমনি সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া যে স্থানে তাঁহারা গমন করিলেন, আমিও তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেইস্থানে গমন করিয়া, ক্রমে তাঁহাদিগের বাসস্থান দেখিয়া লইলাম। কারণ, ভবিষ্যতে যদি তাঁহাদিগের মধ্যে কাহারও প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে তখন কোথায় অনুসন্ধান করিব? 

সেই তিন ব্যক্তির বাসস্থান অবগত হইবার পর আমি তাঁহাদিগের সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া একবারে কলিঙ্গা বাজারে গিয়া উপনীত হইলাম। 

এ পর্যন্ত আমার যে স্নান আহারাদি হয় নাই, তাহা আর আমার মনে আসিল না। আমি কলিঙ্গা বাজারে গমন করিয়া নছিবনের অনুসন্ধান করিলাম, এবং অনুসন্ধান করিয়া নছিবনের বাটীও প্রাপ্ত হইলাম। 

দেখিলাম, নছিবন আমাদিগের নিকট একেবারে অপরিচিত নহে। পূর্ব্বে সে নিতান্ত ঘৃণিত-ব্যবসা অবলম্বন করিয়া কোন প্রকারে দিনপাত করিয়া আসিয়াছে। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাহার সেই ঘূণিত-ব্যবসাও তাহাকে বাধ্য হইয়া ত্যাগ করিতে হইয়াছে। 

যে বাড়ীতে এখন নছিবন বাস করে, তাহাতে চারি পাঁচ খানি ঘর আছে। উহার যে দুইখানি ঘর একবারে পথের উপর, তাহা অপর দুইজন হতভাগিনীর দ্বারা অধিকৃত। ভিতরের একখানি ঘরে নছিবন বাস করে, অপর দুইখানি অপরিচিত ব্যক্তিদিগের থাকিবার নিমিত্ত অধিকাংশ সময়ই প্রায় খালি থাকে। ভিন্ন দেশীয় কোন অপরিচিত ব্যক্তি কিছু দিবসের নিমিত্ত কলিকাতায় আগমন করিলে, তাহারা অনায়াসেই এই ঘরে থাকিতে পায় সত্য; কিন্তু সেই সকল ব্যক্তিগণের নিকট হইতে নছিবন এক টাকার স্থলে সময় সময় দশ টাকা পর্যন্তও আদায় করিয়া লয়। এই নিমিত্ত এই দুইখানি ঘরে নছিবন প্রায়ই স্থায়ী ভাড়াটিয়াকে স্থান প্রদান করে না। ভিন্ন-দেশীয় ব্যক্তিগণ যাহারা এইরূপে এই স্থানে আসিয়া অল্প সময়ের নিমিত্ত বাস করে, ইচ্ছা করিলে নছিবন তাহাদিগের আহারাদিও পর্য্যন্ত প্রস্তুত করিয়া দেয়। ইহাও নছিবনের অর্থ উপার্জ্জনের অপর একটি উপায়। 

যে স্থানে নছিবনের বাড়ী, বহুদিবস পূর্ব্বে কয়েক বৎসর আমি সেই স্থানের থানায় ছিলাম; সুতরাং সেই সময় হইতে নছিবন আমাকে চিনিত। যদিও বহুদিবস সে আমাকে দেখে নাই, কিন্তু আমাকে দেখিবামাত্র সে চিনিতে পারিল ও বলিল, “আজ কিসের নিমিত্ত আপনি এখানে আগমন করিয়াছেন?” 

উত্তরে আমি বলিলাম, “সবিশেষ প্রয়োজন আছে বলিয়াই আজ আমি তোমার নিকট আগমন করিয়াছি।” নছিবন। যে প্রয়োজনে নিমিত্ত আপনি আসিয়াছেন, তাহা আমার নিকট অনায়াসেই বলিতে পারেন।

আমি। বিদেশীয় ব্যক্তিদিগের থাকিবার নিমিত্ত পূর্ব্বে তোমার যে দুইখানি ঘর ছিল, তাহা এখন পর্যন্ত সেইরূপ অবস্থাতেই আছে কি? 

নছিবন। বিদেশীয় কোন ভদ্র মুসলমান এইস্থানে আগমন করিলে, তাহাদের সুবিধার জন্য এখনও তাহাদিগকে থাকিবার স্থান প্রদান করিয়া থাকি। 

আমি। সেই প্রকার অপরিচিত ভদ্রলোক এখন কয়জন তোমার বাটীতে অবস্থিতি করিতেছেন? 

নছিবন। কেবলমাত্র একজন আছেন। 

আমি। তাহাকে একবার ডাকিতে পার? 

নছিবন। তিনি এখন এখানে নাই। 

আমি। এখন তিনি কোথায় গমন করিয়াছেন? 

নছিবন। কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহা আমি অবগত নহি। গত কল্য সন্ধ্যার সময় তিনি বাহিরে গমন করিয়াছেন, এ পর্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই। রাত্রিকালে যে সকল আহারীয় তাঁহার নিমিত্ত প্রস্তুত করিয়াছিলাম, তাহা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অদ্য দিবসের নিমিত্ত সে আহারীয় প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহা এখন পৰ্য্যন্ত তাহার ঘরে রক্ষিত আছে। কেন যে তিনি এ পর্যন্ত প্রত্যাগমন করিলেন না, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

আমি। তাহার যে সকল দ্রব্যাদি এইস্থানে ছিল, তাহা তিনি লইয়া গিয়াছেন, কি এইস্থানে রাখিয়া গিয়াছেন?

নছিবন। যে গৃহ তাহা দ্বারা অধিকৃত, তাঁহার সমস্ত দ্রব্যই সেই গৃহে আছে। তিনি কিছুই লইয়া গমন করেন নাই। কেবল তাঁহার পরিধানে যে সকল বস্ত্র ছিল, তাহাই তাঁহার সহিত আছে মাত্র। 

আমি। সেই ব্যক্তির নাম কি?

নছিবন। উহার নাম রেয়াজুদ্দিন। 

আমি। উহার বাসস্থান কোথায়? 

নছিবন। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

আমি। কতদিবস হইতে রেয়াজুদ্দিন এইস্থানে অবস্থিতি করিতেছেন? 

নছিবন। প্রায় এক মাস হইতে। 

আমি। তিনি এইস্থানে একাকী থাকেন কি? 

নছিবন। একাকী। 

আমি। তাঁহার সহিত তাঁহার ভৃত্যাদি কেহই নাই? 

নছিবন। কেহই না—একাকী। 

আমি। তাঁহাকে তুমি দেখিলে চিনিতে পারিবে? 

নছিবন। যে ব্যক্তি প্রায় মাসাবধি আমার বাড়ীতে অবস্থান করিতেছেন, এবং প্রত্যহ দুইবেলা আমার নিকট যিনি আহারাদি করিয়া থাকেন, তাঁহাকে দেখিলে আর আমি চিনিতে পারিব না? তাঁহার নিমিত্ত আমাকে আপনি এত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? 

আমি। জিজ্ঞাসা করিবার বিশিষ্ট কারণ আছে বলিয়াই এত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি। 

নছিবন। সে কারণ আমি জানিতে পারি না কি, মহাশয়? 

আমি। কেন পারিবে না? তোমাকে বলিব বলিয়াই আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি। গত রজনীতে মৃত অবস্থায় একটি লোককে পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু সেই ব্যক্তি যে কে, তাহা আমরা এ পর্য্যন্ত স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। কেহ কেহ বলিতেছে, সেই ব্যক্তি তোমার বাড়ীতে বাস করে। সেই জন্যই তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। 

নছিবন। কি? রেয়াজুদ্দিন মরিয়া গিয়াছে! তাহার মত ভদ্রলোক আমি এ পর্যন্ত দেখি নাই। আমার অনেকগুলি টাকা তাহার নিকট পাওনা হইয়াছে! সেই সকল টাকা আমি কি প্রকারে পাইতে পারিব? 

আমি। সে পরের কথা। রেয়াজুদ্দিনই যে মরিয়া গিয়াছে, তাহার এখন নিশ্চয়তা কি? প্রথমে দেখ যে, সেই মৃতব্যক্তি রেয়াজুদ্দিন কি না। যদি রেয়াজুদ্দিনই মরিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে তোমার পাওনা টাকার পরিশেষে বন্দোবস্ত হইতে পারিবে। এখন তুমি আমার সহিত আগমন কর, আমি তোমাকে সেই মৃতদেহ দেখাইব। উহা দেখিলেই তুমি বুঝিতে পারিবে যে, উহা রেয়াজুদ্দিনের মৃতদেহ, কি না। 

নছিবন। আপনার সহিত আমাকে কতদূর গমন করিতে হইবে? আমি অনেক দূর হাঁটিতে পারিব না।

আমি। তোমাকে অধিক দূর গমন করিতে হইবে না, ও হাঁটিতেও হইবে না। আমার সহিত গাড়ি আছে, তুমি উহাতেই গমন করিতে পারিবে, এবং পুনরায় আমি তোমাকে তোমার বাড়ীতে রাখিয়া যাইব। 

আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া নছিবন আমার সহিত গমন করিতে সম্মত হইল। কিন্তু এক ঘণ্টার কম তাহাকে তাহার বাড়ী হইতে বাহির করিতে পারিলাম না। এই কাজটি সারিয়া লই, এই দ্রব্যটি রাখিয়া যাই, এ ঘরটিতে চাবি বন্ধ করিয়া দি, প্রভৃতি নানাপ্রকার সামান্য সামান্য কার্য্যে প্রায় একঘণ্টা কাল বিলম্ব করিয়া, পরিশেষে আমার গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

যে স্থানে সেই মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, নছিবনকে লইয়া আমি সেইস্থানে উপনীত হইলাম। যে বস্ত্রাদি দ্বারা উহা আচ্ছাদিত ছিল, তাহা উন্মোচিত করাইয়া আমি নছিবনকে বলিলাম, “দেখ দেখি নছিবন! এই মৃতব্যক্তিকে তুমি চিনিতে পার কি না?”

আমার কথা শ্রবণ করিয়া নিতান্ত সঙ্কুচিত ভাবে এক পা’ দুই পা’ করিয়া নছিবন তাহার নিকট গমন করিল, এবং সেই মৃতদেহ দেখিয়া পরিশেষে পশ্চাদপদ হইয়া বলিল, “হাঁ মহাশয়! আমার বেশ বোধ হইতেছে যে, ইনিই আমার বাড়ীর ভাড়াটিয়া রেয়াজুদ্দিন। আমার পাওনা টাকার এখন কি উপায় হইবে?” 

এই সময়ে নছিবনের ভাব দেখিয়া সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, রেয়াজুদ্দিনের মৃত্যু হওয়ায় নছিবন কিছুমাত্র দুঃখিত নহে। কিন্তু তাহার নিকট যে টাকা পাওনা আছে, সেই টাকার নিমিত্তই নছিবন দুঃখিত! 

নছিবনের মনের ভাব যাহাই হউক, আমাদিগের কিন্তু একটি মহৎ কাৰ্য্য সাধিত হইল। মুহূর্তের নিমিত্ত যে কথা মনে উদয় হয় নাই, নিতান্ত সামান্য পরিশ্রমেই সেই মহৎ কাৰ্য্য সাধিত হইয়া গেল। এখন সকলেই অবগত হইতে পারিলেন যে, এই মৃতব্যক্তি কে। 

অধিকাংশ স্থলেই দেখা যায় যে, যে সকল মোকদ্দমার প্রথমে মৃতদেহ সনাক্ত হয় না, এবং মোকদ্দমা প্রমাণিত করিবার কোনরূপ উপায় দেখিতে পাওয়া যায় না, সেই মোকদ্দমায় পরিশেষে কোন গতিতে সেই মৃতদেহ সনাক্ত হইলে, কিরূপে সেই ব্যক্তি হত হইয়াছে, এবং কোন্ ব্যক্তি তাহাকে হত্যা করিয়াছে, প্রভৃতি তাহার সমস্ত কথাই আনুপূর্বিক প্রকাশ হইয়া পড়ে। 

এই মোকদ্দমা প্রমাণিত হওয়ার কোনরূপ উপায়ই পূর্ব্বে দেখিতে পাওয়া যায় নাই; কিন্তু এখন মৃতদেহ সনাক্ত হইবার পর কর্ম্মচারীমাত্রেরই মনে পুনরায় আশার সঞ্চার হইল। তখন সকলেই মনে করিতে লাগিলেন, অতঃপর এই ভয়ানক হত্যার নায়ক বাহির হইলেও হইতে পারে। 

নছিবন কর্তৃক সেই মৃতদেহ সনাক্ত হওয়ায়, তাহাকে সঙ্গে লইয়া পূর্ব্বে গাড়িবান যে থানায় সেই মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিল, সেই থানায় গিয়া উপনীত হইলাম। এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত কর্ম্মচারীগণও ক্রমে সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

যে সকল কর্মচারী ক্রমে সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন, বলা বাহুল্য, তাঁহাদিগের মধ্যে আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীও কয়েকজন ছিলেন। 

যেরূপ উপায়ে আমি নছিবনের অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম, যেরূপ উপায়ে সেই মৃতদেহ সনাক্ত হইবার প্রথম সূত্রপাত হয়, এবং পরিশেষে যে সকল কথা নছিবনের নিকট হইতে অবগত হইতে পারি, তাহার সমস্ত বৃত্তান্ত আমি আমার ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীদিগের নিকট একে একে বর্ণনা করিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহার নছিবনকে ডাকিলেন, এবং আমার সাক্ষাতে তাহাকে আরও দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে যেরূপ কথাবার্তা হইল, তাহার সারাংশ এই প্রকার :—

কর্ম্মচারী। মৃতদেহটি তুমি উত্তমরূপে দেখিয়াছ ত?

নছিবন। হাঁ মহাশয়! উত্তমরূপে দেখিয়াছি। 

কর্ম্মচারী। উহা কাহার মৃতদেহ? 

নছিবন। আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, উহা রেয়াজুদ্দিনের মৃতদেহ। 

কর্ম্মচারী। তুমি বেশ চিনিতে পারিয়াছ যে, উহা তোমার বাড়ীর ভাড়াটিয়া রেয়াজুদ্দিনের মৃতদেহ? 

নছিবন। যে ব্যক্তি আমার বাড়ীতে অবস্থিতি করিতেছে, বিশেষতঃ যাঁহার নিকট আমার টাকা পাওনা আছে, তাহাকে আর আমি চিনিতে পারিব না? 

কৰ্ম্মচারী। তুমি পূর্ব্বে বলিয়াছ যে, প্রায় মাসাবধি রেয়াজুদ্দিন তোমার বাড়ীতে বাস করিতেছেন, একথা কি সত্য বলিতেছ? 

নছিবন। আমার মিথ্যা কথা বলিবার কোন প্রয়োজন নাই, তিনি প্রকৃতই আমার বাড়ীতে প্রায় মাসাবধি বাস করিতেছিলেন। 

কর্ম্মচারী। যখন তিনি প্রথম তোমার বাড়ীতে আগমন করেন, সেই সময় কিরূপ অবস্থায় তিনি তোমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন? 

নছিবন। ভাল অবস্থায় আসিয়াছিলেন। 

কর্ম্মচারী। তাহা আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি না। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, কিরূপ ভাবে তিনি তোমার বাড়ীতে প্রথম আসিয়াছিলেন? 

নছিবন। বেশ সুস্থ শরীরে আসিয়াছিলেন। 

কর্ম্মচারী। আমার কথা তুমি বুঝিতে পারিতেছ না। ইহার পূর্ব্বে সেই ব্যক্তি আর কখনও কি তোমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন? 

নছিবন। আর কখনও তিনি আমাদিগের বাড়ীতে আগমন করেন নাই। 

কর্ম্মচারী। পূর্ব্বে কখনও যদি তিনি তোমার বাড়ীতে না আসিয়া থাকেন, তাহা হইলে তোমার বাড়ীতে থাকিবার যে ঘর পাওয়া যাইবে, তাহা তিনি কি প্রকারে জানিতে পারিলেন?

নছিবন। তিনি কিরূপে জানিতে পারিয়াছিলেন, তাহা আমি কি প্রকারে জানিব? তিনি আমার বাড়ীতে যখন আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় আমার ঘর খালি ছিল। তিনি আমার বাড়ীতে থাকিতে চাহিলেন, আমিও তাঁহার কথায় সম্মত হইয়া ঘরের চাবি খুলিয়া দিলাম। তিনি এই ঘর দেখিয়া মনোনীত করিলেন, এবং উহাতে থাকিতে সম্মত হইয়া চলিয়া গেলেন। 

কৰ্ম্মচারী। কোথায় চলিয়া গেলেন? 

নছিবন। তাহা জানি না। বলিয়া গেলেন,—“আমি আমার দ্রব্যাদি লইয়া পুনরায় আগমন করিব।” 

কর্ম্মচারী। প্রথম তিনি কোন্ সময়ে ঘর দেখিবার জন্য আসিয়াছিলেন; প্রাতঃ, মধ্যাহ্ন কি সন্ধ্যা?

নছিবন। প্রাতঃকালে আসিয়াছিলেন। বোধ হয়, তখন বেলা আটটা। 

কৰ্ম্মচারী। দ্রব্যাদি লইয়া পুনরায় তিনি কোন সময়ে আগমন করেন? 

নছিবন। সন্ধ্যার পূর্ব্বে। সেই সময় অতি অল্প বেলা ছিল বোধ হয়। 

কর্ম্মচারী। প্রাতঃকালে যখন তিনি প্রথম আগমন করেন, সেই সময় তাঁহার সহিত অপর কেহ ছিল?

নছিবন। না, তিনি একাকী আসিয়াছিলেন। 

কর্ম্মচারী। তিনি প্রথমে আসিয়া তোমাকে কি বলিলেন? 

নছিবন। যখন যিনি প্রথমে আগমন করেন, সেই সময় আমি আমার বাড়ীর দ্বারে দাঁড়াইয়াছিলাম। তিনি আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এইটি কি নছিবনের বাড়ী?” উত্তরে আমি বলিলাম, “কেন মহাশয়! আপনি কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?” আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া তিনি পুনরায় বলিলেন, “আমি নছিবনের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহি।” আমি বলিলাম, “আমার নামই নছিবন। যাহা বলিবার, তাহা আমাকে বলিতে পারেন।” সেই সময় তিনি আমাকে বলিলেন, “আমি শুনিলাম যে, আপনি ভদ্র মুসলমানদিগকে আপনার গৃহে স্থান প্রদান করিয়া থাকেন, ইহা কি প্রকৃত?” আমি বলিলাম, “হাঁ মহাশয়! কোন ভদ্র মুসলমান অল্প দিবসের নিমিত্ত যদি আমার বাড়ীতে থাকিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি তাঁহাকে আমার বাড়ীতে স্থান প্রদান করিয়া থাকি। আর যদি তিনি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তাঁহার আহারাদিও প্রস্তুত করিয়া দিয়া থাকি।” আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া তিনি আমার বাড়ীতে কিছু দিবসের নিমিত্ত থাকিবেন, এইরূপ কথা আমাকে বলিলেন; এবং সন্ধ্যার পূর্ব্বে তাঁহার দ্রব্যাদি সহিত আমার বাটীতে আগমন করিবেন বলিয়া চলিয়া গেলেন। 

কর্ম্মচারী। তাঁহার দ্রব্যাদি তিনি কোথা হইতে আনয়ন করিবেন, তাহা কিছু বলিয়াছিলেন? 

নছিবন। না মহাশয়! ও সম্বন্ধে আমি তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই, বা তিনিও আমাকে কিছুমাত্র বলেন নাই। 

কর্ম্মচারী। সন্ধ্যার সময় যখন তিনি তাঁহার দ্রব্যাদি সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তখন তাঁহার সহিত অপর কোন ব্যক্তি আগমন করিয়াছিল? 

নছিবন। কেবলমাত্র দুইজন কুলি—যাহারা দ্রব্যাদি বহন করিয়া আনিয়াছিল। তাহারা ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তি তাঁহার সহিত আগমন করেন নাই। 

কর্ম্মচারী। তিনি কি কার্য্যের নিমিত্ত এই কলিকাতায় আগমন করিয়াছিলেন, তাহা কিছু বলিতে পার? 

নছিবন। না মহাশয়! তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু একদিবস তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, যে, হাইকোর্টে তাঁহার একটি মোকদ্দমা আছে, তাহারই যোগাড় করিবার নিমিত্ত তিনি এইস্থানে আগমন করিয়াছিলেন। 

কর্ম্মচারী। তাঁহার বাসস্থান কোথায়, তাহা তুমি কিছু বলিতে পার? 

নছিবন। না মহাশয়! তাহা কোন দিবস তিনি আমাকে বলেন নাই। 

কৰ্ম্মচারী। ডাকে হউক, কি লোক মারফতে হউক, কখনও তাঁহার নামে কোন পত্রাদি আসিত? 

নছিবন। এ পর্যন্ত তাঁহার নিকট কোন পত্রাদি আসিতে আমি দেখি নাই। 

কর্ম্মচারী। তাঁহার কোন বন্ধুবান্ধব কখনও তাঁহার নিকট আগমন করিত? 

নছিব। একটি লোক সর্ব্বদা তাঁহার নিকট আগমন করিত। আমার বোধ হয়, এ ব্যক্তির সহিত তাঁহার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। 

কর্ম্মচারী। সেই ব্যক্তির নাম কি বলিতে পার? 

নছিবন। না, তাঁহার নাম আমি জানি না। 

কর্ম্মচারী। তিনি কোথায় থাকেন, বলিতে পার? 

নছিবন। তাহাও আমি জানি না। 

কর্ম্মচারী। রেয়াজুদ্দিনের নিকট তিনি সর্ব্বদাই আগমন করিতেন কি? 

নছিবন। পূর্ব্বে তিনি প্রায় প্রত্যহই আগমন করিতেন, কিন্তু অদ্য দুই তিন দিবস পূৰ্ব্ব হইতে আর তাঁহাকে দেখিতে পাই নাই। ইহার মধ্যে তিনি আমার বাড়ীতে আর আগমন করেন নাই। 

কর্ম্মচারী। যে ব্যক্তি প্রত্যহ তোমার বাটীতে আগমন করিতেন, তুমি তাঁহার নাম ধাম অবগত নহ, ইহা বড়ই আশ্চর্য্যের কথা! 

নছিবন। তিনি কখনও আমার নিকট আগমন করেন নাই, রেয়াজুদ্দিনের নিকট আগমন করিতেন। সুতরাং তাঁহার নাম ধাম জানিয়া লইবার আমার কখনও কোনরূপ প্রয়োজন হয় নাই; সুতরাং জানি না। 

কর্ম্মচারী। তুমি তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারিবে? 

নছিবন। দেখিলে উত্তমরূপে চিনিতে পারিব। 

কর্ম্মচারী। একটু পূর্ব্বে তুমি বলিয়াছ যে, রেয়াজুদ্দিন যখন তোমার বাড়ীতে দ্রব্যাদি সহিত আগমন করেন, সেই সময় দুইজন কুলি তাহার সহিত আগমন করিয়াছিল। তুমি এই কুলিদিগের কাহাকেও চেন কি? 

নছিবন। না মহাশয়! আমি তাহাদিগের কাহাকেই চিনি না, বা পরে দেখিলেও যে চিনিতে পারিব, তাহা আমার বোধ হয় না। 

কর্ম্মচারী। রেয়াজুদ্দিন তাহার দ্রব্যাদি কোথা হইতে আনয়ন করিয়াছিল, তাহা কিছু তোমাকে বলিয়াছিল?

নছিবন। না। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসাও করি নাই বা তিনি আমাকে কিছু বলেনও নাই। 

কর্ম্মচারী। রেয়াজুদ্দিনের যে বন্ধু সর্ব্বদা রেয়াজুদ্দিনের নিকট আগমন করিত, তাহার অঙ্গুলিতে হীরা বা অপর কোন প্রস্তর বসান আংটী পরিতে কখনও দেখিয়াছ? 

নছিবন। তাহা আমার মনে হয় না। আমি বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া তাঁহার অঙ্গুলি কখনও দেখি নাই। সুতরাং তাঁহার হস্তে কোনরূপ আংটী আছে কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। 

কর্ম্মচারী। রেয়াজুদ্দিনকে তাহার নিজের অঙ্গুলিতে কখনও আংটা পরিতে দেখিয়াছ? 

নছিবন। তাঁহাকে আংটী পরিতে কখনও দেখিয়াছি বলিয়া আমার মনে হয় না। 

কৰ্ম্মচারী মহাশয় নছিবনকে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিয়া, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ যাঁহারা সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আপনারা এ সম্বন্ধে আর কোন কথা যদি নছিবনকে জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা হইলে এই সময় তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে পারেন।” 

উত্তরে একজন কর্মচারী কহিলেন, “আপাততঃ জিজ্ঞাসা করিবার আর কোন কথা এখন দেখিতে পাইতেছি না। যদি কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে পরে জিজ্ঞাসা করিয়া লইব।” 

এই সময় নছিবন কহিল, “মহাশয়! আপনারা দেখিতেছি, আপন আপন কাৰ্য্য লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন; কিন্তু আমার কার্য্যের নিমিত্ত কাহাকেও কোনরূপ কথা বলিতে শুনিতেছি না।” 

কর্ম্মচারী। তোমার আবার কি কার্য্য? 

নছিবন। আমার কার্য্য অত্যন্ত গুরুতর! রেয়াজুদ্দিন মরিয়া গিয়াছে; কিন্তু তাহার নিকট আমার যে সকল টাকা পাওনা আছে, তাহা আমি কিরূপে আদায় করিয়া লইতে পারিব? তাহার একটি কথাও আপনাদিগের মুখে শুনিতে পাইতেছি না। 

কর্ম্মচারী। রেয়াজুদ্দিন মরিয়া গিয়াছে সত্য; কিন্তু তোমায় টাকা কোনরূপে লোকসান হইবে না। তোমার সাধ্যমত এই মোকদ্দমায় তুমি আমাদের সাহায্য কর, তাহা হইলে যাহাতে তুমি তোমার টাকা পাইতে পারিবে, আমারও বিশেষরূপে তাহার চেষ্টা করিব। তোমার গৃহে রেয়াজুদ্দিনের যে সকল দ্রব্যাদি আছে, তাহা বিক্রয় করিয়া দিলে, তোমার টাকা পরিশোধ হইতে পারিবে কি? 

নছিবন। যাহা আছে, সেই সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া ফেলিলে বোধ হয়, আমার টাকা প্রায় হইতে পারিবে। তবে যদি কিছু কম পড়ে। 

কর্ম্মচারী। সমস্ত দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া দিলেও যদি তোমার সমস্ত ঋণ পরিশোধ না হয়, তাহা হইলে তাহার নিকট যাহা কিছু পাওয়া গিয়াছে, তাহাও তোমাকে আমি দেওয়াইয়া দিব। কিন্তু যদি তুমি কোনরূপে আমাদিগের সাহায্য না কর, তাহা হইলে তুমি কোন প্রকারেই এক পয়সাও পাইবে না। 

নছিবন। আমাদ্বারা কোন সাহায্য হইতে পারিবে না। কারণ, কোন্ ব্যক্তি রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। সুতরাং আমি কিরূপে আপনাদিগের সাহায্য করিব? 

কৰ্ম্মচারী। সাহায্য করিবার অনেক উপায় আছে। তাহা পরিশেষে তুমি জানিতে পারিবে। 

নছিবন। তবে কি আমি আমার টাকা পাইব না? এ আমার অনেক কষ্টের টাকা! 

নছিবনের শেষ কথা শুনিয়া আমি তাহাকে বলিলাম, “তুমি তোমার টাকার ভাবনা করিও না। যে প্রকারে পারি, আমি তোমার টাকা দেওয়াইয়া দিব। যদি দেওয়াইয়া দিতে না পারি, তাহা হইলে আমি নিজে তোমাকে প্রদান করিব। এখন তুমি আমার সহিত আইস, আমি তোমাকে তোমার বাড়ীতে রাখিয়া আসি।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া নছিবনের মনে একটু আনন্দের সঞ্চার হইল। তখন সে সেইস্থান হইতে উঠিয়া আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিল। আমিও তাহাকে আমার গাড়িতে উঠাইয়া লইয়া তাহার বাড়ী-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম! 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

নছিবনকে তাহার বাড়ী হইতে আনিবার সময় আমি তাহার নিকট প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ ছিলাম যে, পুনরায় আমি তাহাকে তাহার বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিব। আমি সেই প্রতিজ্ঞা প্রতিপালনের নিমিত্তই যে কেবল তাহাকে আমার গাড়িতে করিয়া তাহার বাড়ীতে লইয়া গেলাম, তাহা নহে। প্রথম উদ্দেশ্য ব্যতীত আমার মনে মনে আরও একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্য আর কিছুই নহে, কেবল রেয়াজুদ্দিনের গৃহটি একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখা। কারণ, যদি তাহার গৃহে পত্র প্রভৃতি কোন কাগজপত্র পাইতে পারি, তাহা হইলে অনুসন্ধান করিতে করিতে আরও অনেক দূর অগ্রসর হইতে পারিব, এবং হয় ত তাহার প্রকৃত পরিচয় জানিলেও জানিতে পারিব। 

মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া নছিবনকে লইয়া আমি তাহার বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। যে গৃহে রেয়াজুদ্দিন থাকিত, সেই গৃহ তালাবদ্ধ ছিল। বাহিরে গমন করিবার কালে রেয়াজুদ্দিন সর্ব্বদাই তাহার গৃহে তালা বন্ধ করিয়া চাবি নছিবনের নিকট রাখিয়া রাইত। 

রেয়াজুদ্দিনের গৃহের ভিতর কি কি দ্রব্যাদি আছে, তাহা দেখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, নছিবন সেই গৃহের দ্বার খুলিয়া দিল। আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

যে সময় আমি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, সেই সময় রাত্রি হইয়া পড়িয়াছিল। নছিবন একটি আলো আনিয়া দিল। তাহার সাহায্যে সেই গৃহের অবস্থা একরূপ মোটামুটি দেখিতে পাইলাম সত্য; কিন্তু ইচ্ছামত দেখিতে সমর্থ হইলাম না। ভাবিলাম যে, রাত্রিকালে গৃহের ভিতর অনুসন্ধান না করিয়া দিবাভাগে দেখাই কৰ্ত্তব্য। এই ভাবিয়া সেই গৃহে পুনরায় তালাবন্ধ করিয়া দিয়া চাবি সহিত আমি আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। 

এই ভয়ানক হত্যার উদ্দেশ্য কি, তাহা ভাবিতে ভাবিতে সমস্ত রাত্রিই অতিবাহিত করিয়া ফেলিলাম। কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

চুরি করিবার উদ্দেশে প্রায়ই এইরূপ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়া থাকে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাহার কোন প্রকার প্রমাণই প্রাপ্ত হইলাম না। 

মনোবিবাদ-সূত্রে সময় সময় এইরূপ ভাবে হত্যা হইয়া থাকে সত্য; কিন্তু যে ব্যক্তির বাসস্থান এইস্থানে নহে, বিশেষতঃ অধিক দিবস পর্য্যন্ত যে ব্যক্তি এই সহরে আগমন করে নাই, তাহার সহিত কোন্ ব্যক্তির এমন বিষম মনোবিবাদ হইবার খুব সম্ভাবনা যে, সে অনায়াসে এইরূপ ভয়ানক হত্যাকাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হয়? 

এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া যখন কিছুমাত্র স্থির করিতে পারিলাম না, তখন আপন শয্যা পরিত্যাগ পূর্ব্বক বাহিরে আগমন করিলাম। দেখিলাম, রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছে। 

সেইদিন প্রত্যূষে নছিবনের বাড়ীতে গিয়া রেয়াজুদ্দিনের থাকিবার গৃহটি একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিব; মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। কিয়দ্দূর গমন করিবার পরই, জানি না, কি কারণে আমার মনের গতির হঠাৎ পরিবর্তন হইল। আমি সেইস্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া যে থানায় সেই লাস সৰ্ব্বপ্রথম আনীত হইয়াছিল, সেই থানায় গিয়া উপনীত হইলাম। 

অনুসন্ধানে থানার ইনস্পেক্টার বাবুর নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, ডাক্তার সাহেব কর্তৃক লাস ছেদিত হইয়া উহার পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে, এবং ডাক্তার সাহেব তাহার মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, হাইড্রোসেনিক নামক মহা তেজস্কর বিষ সেবনেই উহার মৃত্যু হইয়াছে। সেই সময় আরও জানিতে পারিলাম যে, গত রাত্রিতেই সেই লাসের অন্তিম কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে, এবং সেই মৃতব্যক্তির পরিধানে যে সকল বস্ত্রাদি ছিল, তাহার সমস্ত সেই থানাতেই জমা করিয়া রাখা হইয়াছে। 

ইনস্পেক্টার বাবুর নিকট এই সকল বিষয় ভাবগত হইয়া যে সমস্ত বস্ত্ৰ সেই মৃতব্যক্তির পরিধানে ছিল, তাহা আর একবার উত্তমরূপে দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। 

আমার আদেশমাত্র সেই সকল বস্ত্র একজন কাচারী আমার সম্মুখে আনিয়া উপস্থাপিত করিল। সেই সকল বস্ত্র আমি এক এক করিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলাম। 

দেখিলাম, যে সকল বস্ত্ৰ মৃতব্যক্তির পরিধানে ইতিপূৰ্ব্বে দেখিয়াছিলাম, তাহা ব্যতীত আর একটি ‘ফতুই’ উহার সহিত রহিয়াছে। সেই ফতুই দেখিয়া একবার মনে হইল, উহা হয় ত অপর আর কোন মোকদ্দমার হইবে। কর্ম্মচারী ভ্রমক্রমে মৃতব্যক্তির বস্ত্রের সহিত আনিয়া আমার নিকট উপস্থাপিত করিয়াছে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই কর্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, আমি যে অনুমান করিয়াছিলাম, তাহা ঠিক্ নহে। সেই ফতুই-ও মৃতব্যক্তির, উহা তাহার বস্ত্র সকলের নিম্নে পরিহিত ছিল। 

এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া সেই ফতুইটি আমি ভালরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, উহাতে একটি বড় গোছের পকেট আছে। যে সময় সেই ফতুইটি সেলাই করা হইয়াছে, সেই সময় সেই পকেটটি প্রস্তুত করান হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। উহার কাপড়—ফতুইয়ের কাপড় হইতে স্বতন্ত্র। সেলাই স্বতন্ত্র, যে সূতায় সেলাই করা হইয়াছে, তাহাও স্বতন্ত্র। আরও দেখিলাম যে, পকেটটি ছিন্ন অবস্থায় রহিয়াছে। দেখিলে বোধ হয়, যেন কোন ব্যক্তি সবলে সেই পকেট হইতে কোন দ্রব্য বাহির করিয়া লইবার সময় উহা ছিঁড়িয়া গিয়াছে। ছিন্ন স্থান দেখিলেও বোধ হয় যে, উহা অধিক দিবসের ছেঁড়া নহে, দুই এক দিবসের মধ্যে সেইস্থান ছিঁড়িয়া গিয়াছে। 

পকেটের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার মনে হইল যে, মৃতব্যক্তি তাহার ফতুইয়ের এই পকেটের মধ্যে কোনরূপ বহুমূল্য দ্রব্য রাখিয়া দিয়াছিল। হত্যাকারী সেই দ্রব্যের লোভে রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়া তাহার সেই বহুমূল্য দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়াছে। 

হত্যার কারণ মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া সেই সমস্ত বস্ত্র পুনরায় কৰ্ম্মচারীর হস্তে প্রদান করিলাম। কৰ্ম্মচারী সেই সকল বস্তু যথাস্থানে রাখিয়া দিলেন। 

এইরূপে হত্যার কারণ কিয়ৎ পরিমাণে অবগত হইয়া তৎক্ষণাৎ আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম, এবং পূর্ব্ব দিবসের প্রস্তাব অনুযায়ী পুনর্ব্বার নছিবনের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

পাঠকগণ অবগত আছেন যে, গত রজনীতে নছিবনের বাড়ী হইতে প্রত্যাগমন করিবার কালে যে গৃহে রেয়াজুদ্দিন বাস করিতেন, সেই গৃহ তালাবদ্ধ করিয়া আসিয়াছিলাম, এবং চাবি আমি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম। 

নছিবনের বাড়ীতে উপনীত হইয়া রেয়াজুদ্দিনের গৃহের চাবি খুলিয়া তাহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। রেয়াজুদ্দিনের গৃহে যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা একে একে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলাম; কিন্তু আমার প্রয়োজনীয় চিঠি পত্র কিছুই দেখিতে পাইলাম না। 

রেয়াজুদ্দিনে গৃহে প্রয়োজনানুযায়ী কোন দ্রব্যাদি প্রাপ্ত না হইয়া, এখন অনুসন্ধানের কোন্ পন্থা অবলম্বন করিব, মনে মনে তাহাই ভাবিতেছি, এমন সময় নছিবন আমার নিকট আসিয়া উপনীত হইল। 

নছিবনকে দেখিয়া আমি আমার পূর্ব্ব চিন্তা ভুলিয়া গিয়া নছিবনকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে বাকি আছে কি না, তাহাই একবার চিন্তা করিলাম। কিন্তু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে বাকি আছে, এমন কোন কথাই আমার মনে আসিল না। 

আমি যে সময় নছিবনের বাড়ীতে প্রবেশ করি, সেই সময় বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়াছিলাম। যে সময় নছিবন আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল, সেই সময় সেই দ্বারে কড়া নাড়ার শব্দ আমাদের কর্ণে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

“কে ডাকিতেছে দেখি” এই বলিয়া নছিবন সদর দ্বারের নিকট গমন করিয়া উহা খুলিয়া দিল। 

দ্বার খুলিবামাত্র একজন মুসলমান যুবক বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া যে গৃহে রেয়াজুদ্দিন থাকিত, সেই গৃহের দিকে আগমন করিল, অর্থাৎ একবারে সে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। নছিবনও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিল। 

আমার সন্নিকটে আসিয়া নছিবন কহিল, “মহাশয়! রেয়াজুদ্দিনের যে বন্ধুর কথা আমি আপনাদিগকে ইতিপূৰ্ব্বে বলিয়াছিলাম, ইনিই সেই ব্যক্তি।” মুসলমান যুবক গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহার বন্ধু রেয়াজুদ্দিনকে দেখিতে না পাইয়া আমাকে কহিল, “রেয়াজুদ্দিন কোথায়?”

আগন্তুকের এই প্রশ্নের উত্তরে আমি কহিলাম, “আপনি এইস্থানে উপবেশন করুন। পরে রেয়াজুদ্দিন কোথায়, তাহা জানিতে পারিবেন।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া সেই আগন্তুক ব্যক্তি আমার সন্নিকটে উপবেশন করিল। তখন আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়ের নাম কি?” 

উত্তরে তিনি কহিলেন, ‘আমার নাম আবদুল ছোভান।’ 

আমি। রেয়াজুদ্দিনের সহিত আপনার কত দিবসের পরিচয়? 

আগন্তুক ছোভান। অনেক দিবস হইতে রেয়াজুদ্দিন আমার নিকট পরিচিত। কেন মহাশয়! আপনি এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন? রেয়াজুদ্দিন কোথায়? 

আমি। রেয়াজুদ্দিন সম্বন্ধে কোন কথা আপনি অবগত নহেন কি? 

আঃ ছোঃ। তাহার সমস্ত বিষয়ই আমি অবগত আছি। তিনি আমার একজন আত্মীয় বন্ধু। 

আমি। রেয়াজুদ্দিনের সমস্ত কথাই যদি আপনি অবগত আছেন, তাহা হইলে আপনি বলিতে পারেন যে, তিনি এখন কোথায় আছেন? 

আঃ ছোঃ। না মহাশয়! তাহা আমি অবগত নহি বলিয়াই আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।

আমি। আপনি কি শুনেন নাই যে, আপনার বন্ধু—রেয়াজুদ্দিন আর এ জগতে নাই? 

 আঃ ছোঃ। কি বলিলেন মহাশয়! রেয়াজুদ্দিন মরিয়া গিয়াছে! কবে মরিয়া গিয়াছে? না আমার সহিত আপনি পরিহাস করিতেছেন? 

আমি। পরিহাস নহে! রেয়াজুদ্দিনকে কোন ব্যক্তি হত্যা করিয়াছে। 

আঃ ছোঃ। রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়াছে! কে তাহাকে হত্যা করিয়াছে মহাশয়? 

আমি। কোন্ ব্যক্তি কর্তৃক রেয়াজুদ্দিন হত হইয়াছে, তাহা এ পর্যন্ত অবগত হইতে পারা যায় নাই। আমি তাহারই অনুসন্ধান করিতেছি। 

আঃ ছোঃ। তবে প্রকৃতই রেয়াজুদ্দিন হত হইয়াছে? 

আমি। আমি প্রকৃত কথাই বলিতেছি। আপনার সহিত মিথ্যা বলিবার আমার প্রয়োজন কি? এই নছিবন তাহার মৃতদেহ দেখিয়া আসিয়াছে, উহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই তাহা জানিতে পারিবেন। 

আঃ ছোঃ। নছিবন! প্রকৃতই কি তুমি রেয়াজুদ্দিনের মৃতদেহ দেখিয়া আসিয়াছ? 

নছিবন। হাঁ মহাশয়! 

এই কথা শুনিয়া আবদুল ছোভান আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। একখানি রুমাল তাহার পকেট হইতে বাহির করিয়া উহা দ্বারা আপনার মুখ চোখ চাপিয়া ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। 

তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া আমার অতিশয় কষ্ট বোধ হইতে লাগিল। 

এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে আবদুল ছোভান কোনরূপে তাহার চক্ষুজল সম্বরণ করিয়া বলিলেন, “মহাশয়! কিরূপে রেয়াজুদ্দিন হত হইয়াছেন, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ আমার নিকট বর্ণন করুন।” 

আবদুল ছোভানের অনুরোধ ক্রমে যেরূপ অবস্থায় উহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তাহার সমস্ত ব্যাপার আমি তাঁহার নিকট বর্ণন করিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনি একটু স্থিরভাবে উপবেশন করিলেন। তখন আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ সম্বন্ধে আপনি যতদূর সমর্থ হইবেন, আমাকে সাহায্য করিলে বড়ই ভাল হয়।” 

আঃ ছোঃ। যে ব্যক্তি আমার বন্ধুকে হত্যা করিয়াছে, যেরূপে পারি, আমিও তাহার সর্ব্বনাশ করিব! 

আমি। যেরূপ অবস্থা আপনি অবগত হইলেন, তাহাতে আপনার অনুমান হয়, এ হত্যা কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা? 

আঃ ছোঃ। যাহার উপর আমার সন্দেহ, সন্দেহ কেন, আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, তাহার দ্বারা বা তাহার ষড়যন্ত্রে এই হত্যা সম্পন্ন হইয়াছে। 

আমি। কোন ব্যক্তি রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া আপনার অনুমান হয়? 

আঃ ছোঃ। অনুমান কেন, আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, এ হত্যা আবদুল হাই ভিন্ন তাপর আর কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। 

আমি। আবদুল হাই কে? 

আঃ ছোঃ। তাহা আপনি পরে জানিতে পারিবেন। 

আমি। আবদুল হাই রেয়াজুদ্দিনকে যে হত্যা করিয়াছে, তাহার কারণ কি? 

আঃ ছোঃ। কারণ আছে। 

এই বলিয়া আবদুল ছোভান রেয়াজুদ্দিনের গৃহ হইতে একখানি পুস্তক বাহির করিয়া আমার সম্মুখে আনিলেন। দেখিলাম, সেই পুস্তকের ভিতর কতকগুলি পুরুষ ও স্ত্রীলোকের ছবি (ফটোগ্রাফ) আছে। সেই পুস্তকখানি আমার সম্মুখে আনিয়া আবদুল ছোভান তাহার পত্রগুলি এক এক খানি করিয়া উল্টাইতে আরম্ভ করিলেন, এবং পরিশেষে তাহার ভিতর হইতে একখানি ছবি বাহির করিয়া সেই পুস্তকখানি আমার হস্তে প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন, “এই দেখুন, রেয়াজুদ্দিন হত হইবার কারণ এই।” 

আবদুল ছোভানের কথা শুনিয়া আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না; কিন্তু তাঁহার প্রদর্শিত সেই ছবিখানি উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, উহা নয় দশ বৎসর বয়স্কা একটি সুশ্রী বালিকার ছবি। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি আবদুল ছোভানকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই নয় দশ বৎসর বয়স্কা বালিকা রেয়াজুদ্দিনের মৃত্যুর কারণ হইল কি প্রকারে?” 

আঃ ছোঃ। যে সময় এই ছবিখানি (ফটোগ্রাফ) উঠান হইয়াছিল, তখন সেই বালিকার বয়ঃক্রম নয় দশ বৎসর ছিল সত্য; কিন্তু এখন আর উহার সে বয়ঃক্রম নাই। এখন বোধ হয়, তাহার বয়ঃক্রম পনর ষোল বৎসর হইয়াছে আমি। এ বালিকাটি কে? 

আঃ ছোঃ। ইনি আশানুল্লা নামক একজন ধনবানের কন্যা। 

আমি। আশানুল্লা ও তাহার কন্যা এখন কোথায়? 

আঃ ছোঃ। তাঁহারা উভয়ে এখন কলিকাতাতেই আছেন। প্রয়োজন হয়, তাঁহাদের বাড়ী আমি আপনাকে দেখাইয়া দিব। 

আমি। আপনি বলিলেন যে, এ হত্যা আবদুল হাইয়ের দ্বারা হইবার সম্ভাবনা। আবদুল হাই কে? 

আঃ ছোঃ। আবদুল হাই যে কে, তাহার সবিশেষ বিবরণ আমি অবগত নহি; কিন্তু তাহাকে আমি উত্তমরূপে চিনি। তিনি যে কোথায় অবস্থিতি করেন, তাহাও আমি অবগত আছি। আপনি তাহাকে ধৃত করুন, তাহা হইলে দেখিবেন যে, আমার কথা প্রকৃত কি না। 

আমি। যখন আপনি তাহাকে চিনেন, এবং তাহার বাসস্থানও অবগত আছেন, তখন তাহাকে ধৃত করা নিতান্ত দুরূহ ব্যাপার নহে। তাহাকে ধৃত করিবার অগ্রে, কি কারণে আপনি তাহার উপর সন্দেহ করিতেছেন, তাহা আমাকে বুঝাইয়া দিন। তাহা হইলে দেখিবেন, তাহাকে ধৃত করিতে কত সময়ের আবশ্যক হয়। 

আঃ ছোঃ। যে কারণে আমি তাহার উপর সন্দেহ করিতেছি, তাহার আদ্যোপান্ত ব্যাপার আমি আপনার নিকট বর্ণন করিতেছি, তাহা হইলে আপনি বুঝিতে পারিবেন যে, আমার অনুমান সত্য কি না। আপনাকে বোধ হয় আর বলিতে হইবে না যে, রেয়াজুদ্দিন আমার একজন প্রাণের বন্ধু। বিশিষ্ট কোন কাৰ্য্য সংঘটিত না হইলে এমন দিন নাই, যে দিবস অভাব পক্ষে আমি একবারও তাহার নিকট আগমন না করি। সবিশেষ কাৰ্য্যবশতঃ দুই দিবসের নিমিত্ত—আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হয় বলিয়া আমি এইস্থানে আগমন করিতে পারি নাই, এই নিমিত্তই সৰ্ব্বনাশ ঘটিয়াছে। যদি আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে না হইত, তাহা হইলে বোধ হয়, রেয়াজুদ্দিন এইরূপে কখনই হত হইতে পারিত না। 

এই কথা বলিতে বলিতে আবদুল ছোভানের চক্ষুদ্বয় জলে পূর্ণ হইয়া আসিল, এবং পুনরায় তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। এইরূপে প্রায় পনর মিনিটকাল অতিবাহিত হইলে আবদুল ছোভান একটু সুস্থ হইলেন, এবং নছিবনকে এক গ্লাস জল প্রদান করিতে বলিলেন। 

নছিবন সেই স্থানেই উপস্থিত ছিল, তখন সে আপনার গৃহ হইতে এক গ্লাস জল আনিয়া আবদুল ছোভানকে অর্পণ করিল। আবদুল ছোভান সেই জল পান করিয়া একটু সুস্থ হইলেন, এবং পরিশেষে বলিতে লাগিলেন, “যেরূপ ভাবে আজ আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, আট দশ দিন পূর্ব্বে আমি সেইরূপ ভাবে এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি। প্রবেশ করিয়াই একবারে রেয়াজুদ্দিনের গৃহের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হই। কিন্তু দেখিতে পাই যে, রেয়াজুদ্দিনের গৃহের দ্বার ভিতর হইতে বদ্ধ। সেই সময় শুনিতে পাই, গৃহের ভিতর দুই ব্যক্তি কথোপকথনে নিযুক্ত। 

“যে পর্য্যন্ত রেয়াজুদ্দিনের সহিত আমার পরিচয় হইয়াছে, যে পর্য্যন্ত আমি তাহার নিকট আগমন করিতেছি, তাহার মধ্যে এরূপভাবে দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া, তাহাকে অপরের সহিত কথা কহিতে আমি আর কখনও দেখি নাই বা শুনি নাই; সুতরাং স্বভাবতই আমার মনে একটু কৌতূহল জন্মিল। আমি রেয়াজুদ্দিনকে না ডাকিয়া বা তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ না করিয়া, ভিতর হইতে আবদ্ধ সেই গৃহের নিকটে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইয়া গৃহের ভিতরস্থ উভয়ের মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইতেছিল, যতদূর সম্ভব, তাহা শ্রবণ করিতে লাগিলাম। 

“প্রথম আমি মনে করিয়াছিলাম, হয় ত কোন স্ত্রীলোকের সহিত আমার বন্ধু কথোপকথনে নিযুক্ত আছেন; কিন্তু সেই স্থানে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইবার অতি অল্প সময় পরেই জানিতে পারিলাম যে, আমার অনুমান সম্পূর্ণরূপে ভ্রমাত্মক। বুঝিলাম, যাঁহার সহিত রেয়াজুদ্দিন কথা কহিতেছেন, তিনি স্ত্রীলোক নহেন—পুরুষ 

“উভয়ের মধ্যে উক্ত কথোপকথনের যতদূর আমি শুনিতে পারিয়াছিলাম, এবং তাহার বিষয় যতদূর আমার মনে আছে, তাহার সারাংশ আমি আপনার নিকট বর্ণন করিতেছি। শ্রবণ করিলে কাহার দ্বারা এবং কি অভিপ্রায়ে এই হত্যাকাণ্ড সংসাধিত হইয়াছে, তাহা আপনি সহজেই অনুমান করিয়া লইতে পারিবেন। 

“রেয়াজুদ্দিন কহিলেন, “আমি কোনরূপেই আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিব না। যে প্রলোভনে পতিত হইয়া আমি আমার ঘর বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া নিতান্ত সামান্য লোকের ন্যায় এইস্থানে বাস করিতেছি, আপনার কথায় তাহার আশা কি কখনও আমি পরিত্যাগ করিতে পারি?’ 

“আবদুল হাই। আপনি মিথ্যা আশায় বুক বাঁধিয়া আমার পথের কণ্টক হইতেছেন কেন? আমার বোধ হয়, আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, করিমন-নেসা আপনার উপর কোনরূপেই সন্তুষ্ট নহেন! 

“রেয়াজুদ্দিন। করিমন-নেসা নিতান্ত সামান্য লোকের কন্যা নহে। সে কখনও তাহার পিতার অন্তঃপুর পরিত্যাগ করে নাই, বা তোমাকে কি আমাকে সে কখনও দেখিতেও পায় নাই। এরূপ অবস্থায় তুমি কি প্রকারে জানিতে পারিলে যে, সে আমার উপর সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট? বিশেষতঃ এদেশে হিন্দু বা মুসলমানের মধ্যে যখন পাশ্চাত্য সভ্যতা অনুসারে বিবাহের প্রথা এখনও প্রচলিত হয় নাই, তখন করিমন নেসার মতামত অনুসারে কিছুই নির্ব্বাহ হইতে পারে না। তাহার পিতা আশানুল্লা যাহা করিবেন, তাহাই হইবে। 

“আবদুল হাই। আমি আশানুল্লা সাহেবের নিকট নিজে গমন করিয়াছিলাম। তাঁহার কথানুযায়ী আমার অনুমান হইল যে, আপনিও তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। বুঝিলাম যে, কন্যার বিবাহ লইয়া তিনি নিতান্ত বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহার ইচ্ছা—তিনি তাঁহার কন্যাকে আমার হস্তে অর্পণ করেন। কিন্তু আপনি তাহার প্রতিবন্ধক হওয়ায় তিনি হঠাৎ তাহা করিয়াও উঠিতে পারিতেছেন না। এই বিবাহোপলক্ষে আমরা উভয়েই যদি এইরূপ গোলযোগে লিপ্ত হই, তাহা হইলে আমাদিগের উভয়েরই স্বার্থের ব্যাঘাত জন্মিবে। বৃদ্ধ আশানুল্লা আমাদিগের উভয়ের উপরই অসন্তুষ্ট হইয়া, হয় ত আমাদিগের উভয়কেই বঞ্চিত করিয়া, অপর কাহারও হস্তে তাঁহার কন্যাকে অর্পণ করিবেন। এরূপ অবস্থায় আপনি আপনার আশা পরিত্যাগ করিয়া, যাহাতে আমার উপকার হয়, তাহার চেষ্টা দেখুন। নতুবা জানিবেন, আমি জীবিত থাকিতে আপনার মনোবাঞ্ছা আমি কিছুতেই পূর্ণ করিতে দিব না; ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহাই ঘটুক না কেন! 

“রেয়াজুদ্দিন। আপনি যাহা ভাবিতেছেন, তাহা কিছুতেই হইবে না। আমি প্রাণের আশা পরিত্যাগ করিতে পারি; কিন্তু করিমনের আশা কিছুতেই পরিত্যাগ করিতে পারি না। আপনি আমার পরামর্শ শুনুন, আপনিই করিমনের আশা পরিত্যাগ করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করুন। আমি দেখিতেছি, আপনিই আমার চিরদিবসের সঞ্চিত আশাকে সমূলে উৎপীড়িত করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। কিন্তু আপনি জানেন কি যে, আমার সেই আশালতার মূল আমার হৃদয়েরপরতে পরতে প্রবেশ করিয়াছে? হৃদয় ছিন্ন না হইলে সে মূল উৎপাটিত করিবার ক্ষমতা কাহারও নাই। 

“আবদুল হাই। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা কিছুতেই হইতে পারিবে না। আপনি যদি সহজে আশা পরিত্যাগ করিতে না পারেন, যেরূপ উপায়ে হউক, আপনার সেই আশা আমি পরিত্যাগ করাইব। যে আশায় এতকাল বুক বাঁধিয়া আছি, আপনার কথা শুনিয়া সে আশা আমি কখনই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা হয়—হউক। 

“রেয়াজুদ্দিন। তোমার অদৃষ্টে যাহা হইবার—তাহা হইবে; কিন্তু আমিও আমার অদৃষ্ট পরীক্ষা করিতে এই সময় কিছুতেই ক্ষান্ত হইব না। জানিও, আমার প্রাণ থাকিতে আমি কিছুতেই তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিব না। 

“আবদুল হাই। আমার উদ্দেশ্য আমি নিশ্চয় সফল করিবই করিব। প্রয়োজন হইলে করিমনের নিমিত্ত মহাপাপের সঞ্চয় করিতেও পরামুখ হইব না। 

“রেয়াজুদ্দিন। যদি প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আমাকে হত্যা করিয়া তোমার কার্য্যোদ্ধার করিতেও তুমি প্রস্তুত আছ? 

“আবদুল হাই। প্রয়োজন হয়, তাহাও করিব। তোমাকে কেন, প্রয়োজন হইলে করিমনের নিমিত্ত তোমার বন্ধুবান্ধবের পর্য্যন্ত সর্ব্বনাশ সাধন করিতে আমি প্রস্তুত আছি। সুতরাং তোমাকে এখনও বলিতেছি যে, যদি তুমি ভাল চাহ, যদি অক্ষত শরীরে তুমি তোমার দেশে প্রত্যাগমন করিতে চাহ, তাহা হইলে নিজের অভিসন্ধি এখনও ভুমি পরিত্যাগ কর। নতুবা তুমি যাহা কখন স্বপ্নেও ভাব নাই, জানিবে, আমার দ্বারা তাহাই সম্পন্ন হইবে। 

“রেয়াজুদ্দিন। আমার প্রাণ পরিত্যাগ করিতে হয়—করিব, তথাপি আশা পরিত্যাগ করিতে পারিব না।”

“এইরূপ কথাবার্তার পর উভয়ের মধ্যে তুমুল বাগবিতণ্ডা উপস্থিত হইল। পূর্ব্বে পরস্পর আস্তে আস্তে কথা কহিতেছিলেন, এখন উভয়েই আপন আপন অবস্থা বিস্মৃত হইয়া অতিশয় উচ্চৈঃস্বরে বচসা আরম্ভ করিলেন। তাঁহাদিগের এইরূপ উচ্চ কথা শ্রবণ করিয়া বাড়ীর অপরাপর লোকজন ক্রমে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। এই নছিবন বাড়ীওয়ালিও সেই সময়ে আসিয়া আমার নিকট দণ্ডায়মান হইল। উভয়ের মধ্যে ক্রোধভরে যে সকল কথা হইয়াছিল, এ তাহাও শ্রবণ করিয়াছিল।

“এইরূপ অতি অল্পক্ষণ বাগ্-বিতণ্ডার পর গৃহের দ্বার খুলিয়া আবদুল হাই ক্রোধভরে বাহিরে আসিলেন। বাড়ী পরিত্যাগ করিবার সময় বলিয়া গেলেন, ‘আমি যে প্রকারে পারি, আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিব। জানিও, আমার হস্তেই তোমার সৰ্ব্বনাশ হইবে!” 

“উভয়ের মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, এবং আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, ও যতদূর আমার মনে আছে, তাহা আপনার নিকট আমি বর্ণন করিলাম। এখন ইহাতেই আপনি অনুমান করিয়া লইতে পারিবেন যে, এরূপ অবস্থায় রেয়াজুদ্দিন কাহার দ্বারা হত হইবার সম্ভাবনা।” 

এই বলিয়া আবদুল ছোভান চুপ করিল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

আবদুল ছোভানের কথা শুনিয়া আমার মনেও আবদুল হাইয়ের উপর সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল।

চুরি অভিপ্রায়ে এই হত্যাকাণ্ড সাধিত হইয়াছে বলিয়া আমার মনে যে সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, ক্রমে তাহা আমার অন্তঃকরণ হইতে দূরে পলায়ন করিল। এখন আমার মনে অন্য ভাবের উদয় হইল। বুঝিতে পারিলাম যে, এ হত্যাকাণ্ডের মূল স্ত্রীলোক। করিমন-নেসার নিমিত্তই এই ভয়ানক কাৰ্য্য সাধিত হইয়াছে। কিন্তু করিমন-নেসা কে, তাহার পিতা আশানুল্লাই বা কে, এবং কেনই বা উভয়ের মধ্যে এরূপ গোলযোগ উপস্থিত হইল, তাহার কিছুমাত্র বিশেষরূপে অবগত হইতে পারিলাম না। সেই সময় আমি আবদুল ছোভানকে পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, “করিমন নেসা কে?” 

আঃ ছোঃ।ইতিপূর্ব্বে আমি যে ফটোগ্রাফ আপনাকে দেখাইয়াছিলাম, সেই ফটোগ্রাফ করিমন-নেসার। বাল্যকালে করিমন-নেসার এই ছবি (ফটোগ্রাফ) উঠান হয়। এখন আর তিনি বালিকা নহেন, এখন তাঁহাকে যুবতী বলিলেও বলা যায়। ইনি আশানুল্লার একমাত্র কন্যা : 

আমি। আশানুল্লা কে? 

আঃ ছো। তিনি কে, তাহা বিশেষরূপে জানি না। তাঁহার বাসস্থান যে কোথায়, তাহাও আমি অবগত নহি। কিন্তু এইমাত্র বলিতে পারি যে, তিনি কলিকাতায় অনেক দিবস হইতে বাস করিতেছেন। সওদাগরির কার্য্য দ্বারা জীবন অতিবাহিত করিয়া থাকেন। তিনি অর্থেরও যথেষ্ট সংস্থান করিয়াছেন, এবং এই স্থানের মুসলমানদিগের মধ্যে তাঁহার বেশ মানসম্ভ্রম আছে। 

আমি। তিনি কোথায় থাকেন? 

আঃ ছোঃ। তাঁহার বাড়ী আমি চিনি, প্রয়োজন হইলে দেখাইয়া দিতে পারিব। 

আমি। তাঁহার অপরাপর পরিবারের মধ্যে কে আছে? 

আঃ ছোঃ। তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু এইমাত্র শুনিয়াছি, করিমন-নেসা তাঁহার একমাত্র কন্যা। 

আমি। আপনি কহিলেন না, করিমন-নেসাকে এখন যুবতী বলিলেও বলা যায়? 

আঃ ছোঃ। হ্যাঁ, তিনি এখন যৌবনে পদার্পণ করিয়াছেন শুনিয়াছি। আরও শুনিয়াছি, তাঁহার ন্যায় সুশ্রী স্ত্রীলোক অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। 

আমি। করিমন-নেসা যদি যৌবনে পদার্পণ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আজ পর্যন্ত উহার বিবাহ হয় নাই, এ কিরূপ কথা হইল? বিশেষতঃ তাহার পিতা আশানুল্লার অবস্থা মন্দ নহে, তাহাও আপনি বলিতেছেন। 

আঃ ছোঃ। ইহা হইলেও হইতে পারে; কারণ, আমাদিগের মুসলমানের ঘরে সময় সময় বয়স অনেক বড় করিয়া কন্যার বিবাহ দেওয়া হয়, তাহাতে আমাদের মধ্যে কোনরূপ প্রতিবন্ধক নাই। 

আমি। রেয়াজুদ্দিনের সহিত এ পর্য্যন্ত করিমনের যদি দেখা সাক্ষাৎ না হইয়া থাকে, তাহা হইলে রেয়াজুদ্দিন করিমনের ছবি (ফটোগ্রাফ) কিরূপে সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন? 

আঃ ছোঃ। তাহা আমি অবগত নহি। রেয়াজুদ্দিনের নিকট এই ছবি (ফটোগ্রাফ) আমি অনেকবার দেখিয়াছি, এবং তাহারই মুখে আমি শুনিয়াছি যে, উহা বৃদ্ধ আশানুল্লার কন্যা করিমনের ফটোগ্রাফ। 

আমি। আশানুল্লা তাঁহার কন্যা করিমন-নেসাকে রেয়াজুদ্দিনের সহিত বিবাহ দিতে সম্মত হইয়াছেন, ইহা আপনি কখনও রেয়াজুদ্দিনের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন কি? 

আঃ ছোঃ। আমার সহিত রেয়াজুদ্দিনের বন্ধুত্ব ছিল সত্য; কিন্তু তিনি একথা আমাকে ইতিপূর্ব্বে কখন বলেন নাই। কেবলমাত্র মধ্যে মধ্যে এই ফটোগ্রাফ ছবিখানি আমাকে দেখাইতেন ও বলিতেন, “এরূপ সুশ্রী কন্যা তুমি কি কখনও দেখিয়াছ?” 

আমি। সেই কন্যাকে রেয়াজুদ্দিন যে বিবাহ করিতে চাহেন, একথা আপনি সৰ্ব্বপ্রথম কবে জানিতে পারিলেন?

আঃ ছোঃ। যে দিবস উভয়ের মধ্যে সেই কন্যা উপলক্ষে বাগবিতণ্ডা হয়, সেইদিবস আমি প্রথম জানিতে পারিলাম যে, রেয়াজুদ্দিন প্রণয়ের আশায় এইস্থানে আসিয়া বাস করিতেছেন। 

আমি। রেয়াজুদ্দিনের বাসস্থান তবে কি এই কলিকাতা রাজধানীতে নহে? 

আঃ ছোঃ। একথা আমি বোধ হয়, আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, রেয়াজুদ্দিনের বাসস্থান পূৰ্ব্ব বঙ্গে। 

আমি। আবদুল হাইকে আপনি কতদিবস হইতে চিনেন? 

আঃ ছোঃ। যে দিবস উভয়ের মধ্যে সেই বাগবিতণ্ডা উপস্থিত হয়, সেইদিবস আমি উহাকে সৰ্ব্বপ্রথম দেখিতে পাই, এবং পরিশেষে ক্রমে উহার বাসস্থান পর্যন্ত জানিতে পারিয়াছি। 

আমি। আবদুল হাই কোন্ দেশীয় লোক, তাহা কি আপনি বলিতে পারেন? 

আঃ ছোঃ। না মহাশয়! তাহা আমি অবগত নহি। আমার বোধ হয়, উহার বাসস্থান কলিকাতাতেই হইবে।

আমি। এই বিবাহের নিমিত্ত আবদুল হাই ও রেয়াজুদ্দিন উভয়েই এরূপ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন কেন?

আঃ ছোঃ। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

আমি। বৃদ্ধ আশানুল্লাই বা উভয়কেই এরূপ আশায় আশ্বাসিত করিয়া রাখিয়াছিলেন কেন? 

আঃ ছোঃ। তাহাও আমি অবগত নহি। কারণ, একথা রেয়াজুদ্দিন কখনও আমাকে বলেন নাই। 

আমি। আপনার অনুমান হয়, আবদুল হাই করিমন নেসাকে বিবাহ করিবার প্রত্যাশায় তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিয়াছে? 

আঃ ছোঃ। হাঁ মহাশয়! ইহাই আমার দৃঢ়বিশ্বাস হয়। আবদুল হাই নিজে হউক বা অপর কোন লোক দ্বারাই হউক, রেয়াজুদ্দিনকে যে হত্যা করিয়াছে, তাহাতে আমার মনে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

আমি। আপনার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে আমারও এখন বিশ্বাস হইতেছে যে, আবদুল হাই কর্তৃকই আপনার বন্ধু রেয়াজুদ্দিন হত হইয়াছে। 

আবদুল ছোভানের সহিত এইরূপ কথোপকথনের পর, তাহার কথা প্রকৃত কি না, তাহা জানিবার জন্য নছিবন ও যাহাকে যাহাকে আবদুল ছোভান দেখাইয়া দিয়া বলিয়াছিলেন, তাহারা সেই গোলযোগের সময় তাঁহার নিকট আসিয়া উপনীত হইয়াছিল, তাহাদিগের সকলকেই একত্র করিয়া প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহারা সকলেই আবদুল ছোভানের শেষ কথাগুলির পোষকতা করিল। উহাদিগের কথা শুনিয়া আবদুল ছোভান যে প্রকৃতকথা বলিয়াছে, তাহা সহজেই আমি অনুমান করিয়া লইলাম। 

ইহার পর নছিবনের বাড়ীতে আর কোনরূপ অনুসন্ধান না করিয়া; আবদুল ছোভানকে সঙ্গে লইয়া একবারে আবদুল হাইয়ের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। 

সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিতে পাইলাম যে, আবদুল হাই ইষ্টক-নির্ম্মিত একখানি দ্বিতল বাড়ীতে বাস করিলেও তাঁহার অবস্থা অতিশয় হীন। যে সময় আমি তাঁহার বাড়ীতে উপনীত হইলাম, সেই সময় তিনি তাঁহার বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন। তাঁহাকে ডাকিবামাত্র তিনি আমার সম্মুখে আসিয়া উপনীত হইলেন। বলা বাহুল্য, তাঁহাকে দেখিবামাত্র আমি তাঁহাকে ধৃত করিলাম ও কহিলাম, “রেয়াজুদ্দিনকেহত্যা করা অপরাধে আজ আপনি আমা-কর্তৃক ধৃত হইলেন।” 

উত্তরে আবদুল হাই কহিল, “আমি রেয়াজুদ্দিনকে হত্যা করিব কেন?” 

আমি। করিমনের নিমিত্ত? 

আবদুল হাই! মিথ্যা কথা। 

এই দুইটি কথার পরই আমি তাঁহার অঙ্গুলিগুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া বলিলাম, “আপনার সেই হীরার আংটী কোথায়?” 

আবদুল হাই আমার কথা শ্রবণ করিয়া একটু হাসিল ও কহিল, “যাহার অবস্থা আপনি স্বচক্ষে দেখিতে পাইতেছেন, তাহার হীরার আংটা থাকিবার সম্ভাবনা বলিয়া আপনার বোধ হয় কি?” 

আবদুল হাইয়ের এই কথায় আমি কোনরূপ কর্ণপাত না করিয়া, তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহা উত্তমরূপে দেখিলাম। 

দেখিলাম, পুরাতন ও ভগ্ন একটি আলমারির মধ্যে একটি অতিশয় পুরাতন শিশি আছে। দেখিয়া উহার উপরস্থিত অখণ্ড ময়লা কাগজখানির উপর যে লেখা আছে, তাহা সবিশেষ কষ্টের সহিত পড়িয়া জানিতে পারিলাম যে, উহা হাইড্রোসেনিক এসিড নামক ভয়ানক বিষের শিশি। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে আরও সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। অতীব মনোযোগের সহিত সেই গৃহ উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে করিতে একটি বাক্সের ভিতর হইতে করিমন নেসার আর একখানি ফটোগ্রাফ ছবি প্রাপ্ত হইলাম। সেই ফটোগ্রাফ ও রেয়াজুদ্দিনের গৃহ হইতে প্রাপ্ত ফটোগ্রাফ ছবি মিলাইয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, উভয়ই এক প্রকারের ফটোগ্রাফ। 

সেই ফটোগ্রাফ ছবিখানি কাহার, জিজ্ঞাসা করায় আবদুল হাই কহিল, “আমি জানি না।” 

হীরা সদৃশ পাথর বসান আংটীর নিমিত্ত অনেক অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু তাহা প্রাপ্ত হইলাম না।

পাঠকবর্গের বোধ হয় স্মরণ থাকিতে পারে যে, যে গাড়ির ভিতর রেয়াজুদ্দিনের মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া যায়, সেই গাড়ির গাড়িবান বলিয়াছিল যে, যে ব্যক্তি গাড়ি ভাড়া করিয়াছিল, তাহার হস্তে একটি বৃহৎ হীরার অঙ্গুরী ছিল। এই জন্যই আংটির নিমিত্ত এত অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু উহা প্রাপ্ত না হইলেও, আবদুল হাইয়ের উপর সেই হত্যা বিষয়ের বিশেষরূপ সন্দেহ উদয় হইল। কেবল সন্দেহ হইল, তাহা নহে; মনে করিলাম যে, বিচারকগণ এই সকল কথা বিশ্বাস করিলে হত্যা-অপরাধে আবদুল হাইকে অনায়াসেই দণ্ডিত করিতে পারিবেন। 

আবদুল হাইকে যতবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ততবারই তিনি কহিলেন যে, যে অপরাধে তিনি ধৃত হইয়াছেন, সে অপরাধে তিনি অপরাধী নহেন; কিন্তু তাঁহার মনের কথা কিছুমাত্র কহিলেন না। এমন কি, তিনি যে আশানুল্লার নিকট পরিচিত, কি করিমন-নেসার নিমিত্ত তিনি লালায়িত, তাহা পৰ্য্যন্ত আমাদিগের নিকট গোপন রাখিলেন। 

এই অবস্থাতেই আমি তাঁহাকে ধৃত করিয়া যে থানার মোকদ্দমা, সেই থানায় আনিয়া উপস্থিত করিলাম। এই ভয়ানক খুনি মোকদ্দমার আসামী ধৃত হইয়াছে, এই কথা ক্রমে যত প্রচার হইতে লাগিল, হত্যাকারীকে দেখিবার নিমিত্ত থানার সম্মুখে তত লোকের জনতা হইতে লাগিল। 

[জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *