জুয়াচুরি (অর্থাৎ জুয়াচোরদিগের অত্যাশ্চর্য্য অভেদ্য কতিপয় কাৰ্য্য-কৌশল!)

জুয়াচুরি (অর্থাৎ জুয়াচোরদিগের অত্যাশ্চর্য্য অভেদ্য কতিপয় কাৰ্য্য-কৌশল) 

উপক্রমণিকা 

ভারতবর্ষের প্রধান সহর এই কলিকাতা নগরী ধনী, দরিদ্র, পণ্ডিত, মূর্খ, সৎ, অসৎ, ধাৰ্ম্মিক, অধাৰ্ম্মিক প্রভৃতি নানাপ্রকার লোক দ্বারা পূর্ণ থাকিলেও, জুয়াচোর সকলের অত্যাচার ক্রমেই বৃদ্ধি হইতেছে। সহরের ভিতর জুয়াচুরির সংখ্যা দিন দিন কেন বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহাতে নানা লোক নানাপ্রকার মত প্রকাশ করিয়া থাকেন। কেহ বলেন যে, আমাদিগের দেশে পাশ্চাত্য সভ্যতা অধিক পরিমাণে প্রচারিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নানা বিষয়ে মস্তিষ্ক পরিচালনায় সমর্থ হইতেছি; সুতরাং যে ব্যক্তি যে পন্থা অবলম্বন করিতেছেন, তিনি সেই পথেই নূতন নূতন বিষয়ের উদ্ভাবন করিতেছেন। যিনি সাহিত্য লইয়া আছেন, তিনি সাহিত্যের উন্নতি করিতেছেন; যিনি বিজ্ঞান লইয়া আছেন, তিনি সেই বিষয়ের নূতন কাণ্ড উদ্ভাবন করিতেছেন। সেইরূপ যে সকল ব্যক্তি কেবল অসৎ উপায় অবলম্বনেই দিন যাপন করিয়া থাকে, তাহারা কি প্রকারে সেই সকল অসৎ কার্য্যের উন্নতি সাধন করিতে সমর্থ হয়, কেবল তাহারই চিন্তা করিতেছে, ও নূতন নূতন পন্থা অবলম্বন করিয়া নিরীহ লোকদিগের সর্ব্বনাশ সাধন করিতেছে। 

কেহ বলেন যে, জুয়াচুরিজনিত অপরাধের নিমিত্ত ইংরাজ আইনে কঠিন দণ্ডের বিধান থাকিলেও সেই অপরাধ—কারীর উপর পুলিসের কোনরূপ ক্ষমতা নাই, বা জুয়াচুরি জনিত অপরাধ তাঁহারা অনুসন্ধান করিতেও সমর্থ হন না। যে অপরাধ করিলে অপরাধীগণের পুলিসের হস্তে পতিত হইবার ভয় নাই, সেই অপরাধ দিন দিন বর্দ্ধিত না হইবেই বা কেন, এবং সেই সকল অপরাধ সুচারু রূপে সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত দিন দিন নূতন উপায়ের সৃষ্টিই বা না হইবে কেন? 

নিরীহ পল্লিগ্রামবাসী,—যাঁহাদিগকে সৰ্ব্বদা কলিকাতায় আগমন করিতে হয়, ও যে সকল লোকের সহিত কলিকাতার কিছু না কিছু সংস্রব আছে, অথবা যাঁহারা এই কলিকাতা সহরেই বাস করিয়া থাকেন, তাঁহারা সহজে জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়। যাহাতে সৰ্ব্বস্বান্ত না হন, তাহারই নিমিত্ত কতকগুলি জুয়াচুরির ব্যাপার আমি তাহাদিগকে বলিয়া দিতে মনস্থ করিয়াছি। যদি পাঠকগণ একটু মনোযোগের সহিত এইগুলি পাঠ করেন, তাহা হইলে জুয়াচোরগণ সহজে তাহাদিগকে বঞ্চনা করিতে পারিবে না। এইরূপ উপায়ে যদি আমি অন্ততঃ একজন পাঠককেও জুয়াচোরের হস্ত হইতে উদ্ধার করিতে পারি, তাহা হইলেও আমি বুঝিব যে, এই দারোগার দপ্তরের উদ্দেশ্য কতক পরিমাণে সিদ্ধ করিতে সমর্থ হইয়াছি। 

ইতিপূর্ব্বে এই দারোগার দপ্তরের যতগুলি সংখ্যা বাহির হইয়াছে, তাহার মধ্যে অনেক সংখ্যাতে অনেক প্রকার জুয়াচুরির কথা আমি বর্ণনা করিয়াছি; বিশেষতঃ প্রথম বৎসরের অনেকগুলি সংখ্যাতে এ বিষয় বিশেষরূপে প্রদর্শিত হইয়াছে। তথাপি আরও কতকগুলি নূতন ধরণের জুয়াচুরির বিষয় আমি একে একে পাঠকবর্গকে দেখাইয়া দিব। বর্তমান সংখ্যায় যে কয়েকটির স্থান হইল, তাহা এই স্থানে বিবৃত করিলাম, অবশিষ্টগুলি সময়-ক্রমে অপরাপর সংখ্যায় প্রকাশ করিবার ইচ্ছা রহিল। 

এক – ব্যবসার নামে জুয়াচুরি 

অনাথনাথ ও গিরিজাভূষণ—দুই ব্যক্তিই জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া বহু দিবস হইতে জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করিয়া আসিতেছে। ইহারা দুই জন জুয়াচুরির পুরাতন প্রথা প্রায়ই অবলম্বন করে না; একটি নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়া যত দিবস পর্য্যন্ত সেই উপায় অপরে জানিতে না পারে, তত দিবস পৰ্য্যন্ত সেই নব উদ্ভাবিত উপায়ে জুয়াচুরির ব্যবসা চালাইয়া থাকে। পরিশেষে যখন সেই উপায় ক্রমে সকলে জানিয়া লয়, তখন সেই উপায় পরিত্যাগ করিয়া অপর আর একটি নূতন উপায়ের উদ্ভাবন করিবার চেষ্টা করে। 

অনাথনাথ ও গিরিজাভূষণের মধ্যে কোনরূপ সম্পর্ক না থাকিলেও, তাহাদের উভয়ের মধ্যে মনের বিলক্ষণ মিল আছে; এমনকি যদিও উভয়ে একজাতি নহে, তথাপি উহাদিগকে দেখিলে কোন ব্যক্তি মনে করিতে পারেন না যে, ইহাদিগের মধ্যে আচার ব্যবহার, চাল চলন প্রভৃতি কোন বিষয়ে কোনরূপ পার্থক্য আছে। 

একরূপ জুয়াচুরি করিয়া উহারা অনেক দিবস পর্য্যন্ত অর্থ উপার্জ্জন করিয়া আসিতেছিল; কিন্তু সেই জুয়াচুরির বিষয় ক্রমে সকলে অবগত হইতে পারায়, এক দিবস উভয়ে একটি নির্জ্জন স্থানে বসিয়া, এখন কি উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে, তাহারই পরামর্শ করিতেছে। 

অনাথনাথ কহিল, “যে উপায় অবলম্বন করিয়া আমরা প্রায় এক বৎসর কাল অতিবাহিত করিলাম, সেই উপায় এখন প্রায় সমস্ত লোকে অবগত হইতে পারিয়াছে; সুতরাং অন্য কোনরূপ নূতন উপায় অবলম্বন করিতে না পারিলে আর চলে না।” 

গিরিজা। তুমি যাহা কহিলে তাহা আমি অনেক দিবস হইতে ভাবিতেছি, কিন্তু সহরের লোকদিগকে সহজে ভুলাইতে পারা যায়, এমন কোন উপায় এ পর্যন্ত স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। 

অনাথ। তুমি যাহা বলিলে, তাহা সত্য। কোন একটা নূতন পন্থা অবলম্বন করিবার নিমিত্ত আমিও অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু এ পর্যন্ত আমিও কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। 

গিরিজা। আমি একটি উপায় স্থির করিয়াছি; কিন্তু সেই উপায়ে এক বারের অধিক অর্থ উপার্জ্জন হইতে পারে না।

অনাথ। দুই পাঁচ বারও হইতে পারিবে না? 

গিরিজা। দুই পাঁচ বার যে হইতে পারিবে না, তাহা নহে; কিন্তু এ কাৰ্য্য একাদিক্রমে অধিক দিবস চলিবার নহে।

অনাথ। তবে কিরূপ চলিতে পারিবে? 

গিরিজা। অধিক দিবস অন্তর এক একবার হইতে পারিবে। বোধ হয়, এক বৎসরের মধ্যে একবারের অধিক করিতে গেলেই ধরা পড়িতে হইবে। 

অনাথ। এক বৎসরের মধ্যে কেবল মাত্র একবার জুয়াচুরি করিলে সংসার চালাইব কি প্রকারে? একবারে কত টাকারই বা সংস্থান করিতে পারিব? 

গিরিজা। যে পরিমিত মূলধন লইয়া ব্যবসায় প্রবৃত্ত হইবে, লাভও সেই পরিমাণে হইবে। 

অনাথ। আমাদিগের এ ব্যবসায় অধিক মূলধনের ত প্রয়োজন হয় না। কি পরিমিত মূলধন হইলে তোমার সংকল্পিত ব্যবসা চলিতে পারিবে? 

গিরিজা। তাহা ত আমি পূৰ্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছি যে, আমার সংকল্পিত ব্যবসায়ে যত পরিমাণ মূলধন প্রদান করিতে পারিবে, লাভও সেই পরিমাণ হইবে। 

অনাথ। অল্প মূলধনে এ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে পারিবে না? 

গিরিজা। কেন পারিবে না। তবে মূলধন অল্প হইলে, লাভও সেই পরিমাণে অল্প হইবে। 

অনাথ। তোমার সংকল্পিত কার্য্যের নিমিত্ত যদি আমি কেবলমাত্র পঁচিশ, কি ত্রিশ টাকা প্রদান করি, তাহা হইলে আমাদিগের কি পরিমাণে লাভ হইবার সম্ভাবনা? 

গিরিজা। বোধহয়, তিন চারি শত টাকা লাভ হইতে পারে। 

অনাথ। আমি জানি যে, আজ কাল তোমার নিকট কিছুমাত্র অর্থ নাই, অথচ আমিও যে বিশ পঁচিশ টাকা সংগ্রহ করিতে পারিব, তাহাও আমার বোধ হয় না। এরূপ অবস্থায় এই অল্প পরিমাণ টাকা দ্বারা আপাততঃ কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ করিয়া দেখা যাউক,—কিরূপ অবস্থা ঘটে। তুমি কিরূপ সংকল্প করিয়াছ, তাহা এখন আমি জানিতে পারি না কি?

গিরিজা। কেন পারিবে না? আমার সংকল্পিত বিষয় যদি তুমি জানিতে না পারিবে, তাহা হইলে কাৰ্য্য চলিবে কি প্রকারে? 

এই বলিয়া গিরিজাভূষণ অনাথনাথের কাণে কাণে কি বলিল। অনাথনাথ অতীব মনোযোগের সহিত তাহা শ্রবণ করিয়া পরিশেষে কহিল, “তুমি যে সংকল্প করিয়াছ, তাহা নিতান্ত মন্দ নহে। এরূপ উপায় আজ পর্যন্ত অপর আর কেহ বাহির করিতে সমর্থ হইয়াছে বলিয়া আমার বোধ হয় না। যাহা হউক একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব, ইহাতে আমি কতদূর কৃতকার্য্য হইতে পারি। যদি দেখি যে, সহজেই আমাদিগের সংকল্পিত কার্য্য শেষ হইয়া যায়, তাহা হইলে মধ্যে মধ্যে এই উপায় অবলম্বন করিয়া অনায়াসেই অনেক অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারিব। আর আমাদিগের অদৃষ্টগুণে যদি আমাদিগের কার্য্য প্রকাশ হইয়া পড়ে, তাহা হইলেও আইনানুসারে আমাদিগের দণ্ড হইবারও সম্ভাবনা নাই।” 

এইরূপ পরামর্শ করিয়া সেই দিবস উভয়েই সেই স্থান পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিল। পর দিবস হইতেই সহরের মধ্যে কেরোসিন তৈলের দোকান করিবার উপযোগী একখানি ঘরের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। দুই তিন দিবস অনুসন্ধানের পর সুবিধামত একখানি ঘর প্রাপ্ত হইয়া সেই ঘরে, কেরোসিন তৈলের দোকান খুলিতে হইলে যে সকল দ্রব্যের প্রয়োজন হয়, তাহার সংস্থান করিয়া লইল, এবং আইন অনুসারে যে সকল লাইসেন্স প্রভৃতি লইবার প্রয়োজন, তাহা লইয়া উক্ত গৃহে একখানি কেরোসিন তৈলের দোকান খুলিয়া দিল। 

 এই দোকান হইল—অনাথনাথের নামে, গিরিজাভূষণের সহিত উক্ত দোকানের কোন রূপ প্রকাশ্য সংস্রব রহিল না।

দোকান খুলিবার সঙ্গে সঙ্গে একজন কেরোসিন তৈলের মহাজনও ঠিক হইয়া গেল। এই ব্যবসা উপলক্ষে অনাথনাথ যে টাকার সংস্থান করিয়া উঠিতে পারিয়াছিল, সেই টাকা দিয়া মহাজনের নিকট হইতে প্রথম প্রথম নগদ টাকায় কেরোসিন তৈল খরিদ করিয়া আনিতে লাগিল ও পরিশেষে দেনা পাওনায় চলিতে লাগিল। এইরূপ মাসাবধি—কাল কেরোসিন তৈলের কারবার করিতে করিতে পাড়ার সকলেই জানিতে পারিল যে, অনাথনাথ বেশ যশের সহিত কারবার করিতেছে, এবং অপরাপর দোকানদার অপেক্ষা একটু সস্তা দরেও তৈল বিক্রয় করিয়া থাকে। এইরূপে কারবার করিতে করিতে ক্রমে অনাথনাথের ঘরে অনেকগুলি টিন ও বাক্স জমিয়া গেল। অনাথনাথ তৈল বিক্রয় করিত বটে; কিন্তু টিন বা বাক্স কাহারও নিকট বিক্রয় করিত না, বা কাহাকেও প্রদান করিত না। অধিকন্তু কেরোসিন তৈলের বাক্স ও টিন সুবিধামত প্রাপ্ত হইলে খরিদ করিয়া আপন দোকানে রাখিয়া দিত। 

এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইলে, গিরিজাভূষণ এক দিন ছোট-আদালতে গিয়া অনাথনাথের নামে এই অর্থে এক নালিস করিল যে, যে সময়ে অনাথনাথ প্রথম কেরোসিন তৈলের দোকান খুলিয়াছিল, সেই সময় তাহার নিকট অধিক অর্থ না থাকায় গিরিজাভূষণের নিকট হ্যাগুনোট লিখিয়া দিয়া পাঁচ শত টাকা কর্জ্জ লইয়াছিল, কিন্তু এখন ইচ্ছা পূৰ্ব্বক সে গিরিজাভূষণের ন্যায্য টাকা প্রদান করিতেছে না। 

গিরিজাভূষণের আবেদন গ্রাহ্য হইলে, অনাথনাথের নিকট হইতে নগদ পাঁচ শত টাকা ও তাহার সুদ প্রভৃতি পাওনা হিসাবে অনাথনাথের নামে এক সমন বাহির হইল। 

গিরিজাভূষণ আদালতের জনৈক পেয়াদাকে সঙ্গে লইয়া অনাথনাথের সমন জারি করিয়া দিল। যে সময় সমন জারি হয়, সেই সময় অনাথনাথ আপন দোকানেই উপস্থিত, সুতরাং আপন হস্তেই সে সমন গ্রহণ করিল ও নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইয়াছে, এইরূপ ভাব দেখাইয়া কহিল, “তোমার টাকা আমি যত শীঘ্র পারি, প্রদান করিব, ইহা আমি মনে করিয়াছিলাম, ও আমি পূৰ্ব্বেই তাহা তোমাকে বলিয়াছিলাম; এবং যাহাতে শীঘ্র টাকা সংগ্রহ করিতে পারি, তাহার চেষ্টাও করিতেছিলাম। এরূপ অবস্থায় তুমি আর কিছু দিবস অপেক্ষা করিতে পারিলে না। এখন জানিও যে, তুমি যেমন আমার উপর নালিস করিয়াছ, আমিও তাহার প্রতিশোধ লইবার চেষ্টা করিব। আদালতে উপস্থিত হইয়া বলিব যে, আমি সুদ সমেত সমস্ত টাকা পরিশোধ করিয়া দিয়াছি; ও সাক্ষ্য দ্বারাও আমার কথার সত্যতা প্রতিপন্ন করাইব।” অনাথনাথের কথায় গিরিজাভূষণ কিছুমাত্র তাসন্তুষ্ট না হইয়া পেয়াদার সহিত সেই স্থান পরিত্যাগ করিল। মোকদ্দমার ধার্য্য দিবস সমন হাতে অনাথনাথ আদালতে গিয়া উপস্থিত হইল। মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে সকলেই দেখিল যে, সমন ধরাইবার সময় অনাথনাথ মুখে যাহা কহিয়াছিল, কার্য্যে তাহার বিপরীত করিল। 

বিচারক অনাথনাথকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গিরিজাভূষণ যে টাকার দাবীতে তোমার উপর নালিস করিয়াছে, সেই টাকা তোমার প্রকৃত দেনা কি না?” 

অনাথনাথ। টাকা আমি প্রকৃত ধারি, কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থা যেরূপ, তাহাতে আমি সকল টাকা শোধ করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

গিরিজাভূষণ। ধর্ম্মাবতার! এ মিথ্যা কথা কহিতেছে। ইহার অবস্থা আজকাল খুব ভাল। ইহার কেরোসিন তৈলের কারবার খুব ভালরূপ চলিতেছে। আজ কাল ইহার দোকানে নগদ টাকা ব্যতীত দুই তিন হাজার টাকা মূল্যের কেরোসিন তৈল প্রায়ই মজুত থাকে। মনে করিলে, আমার এই সামান্য টাকা এ অনায়াসেই প্রদান করিতে পারে। 

বিচারক। (অনাথনাথকে) কেমন এ কথা প্রকৃত? তোমার দোকানে এখন দুই তিন হাজার টাকা মূল্যের কেরোসিন তৈল মজুত আছে? 

অনাথনাথ। মজুত আছে বটে, কিন্তু দুই তিন হাজার টাকা হইবে না। 

গিরিজা। তবে তুমি পাঁচ শত টাকা প্রদান করিতে কিসে অসমর্থ? 

অনাথনাথ। দোকানে যেমন কিছু তৈল মজুত আছে, তেমনি যাহাদিগের নিকট হইতে কেরোসিন তৈল খরিদ করিয়া থাকি, তাহাদিগের নিকট আমার অনেকগুলি টাকা দেনাও আছে। 

বিচারক। তোমার ও আপত্তি আমি শুনিতে চাহি না। তোমার উপর যত টাকার নালিস হইয়াছে, সুদ খরচা সমেত আমি সেই সমস্ত টাকার ডিক্রী দিলাম। যেরূপে পার, টাকা সংগ্রহ করিয়া আদালতে জমা করিয়া দাও। 

বিচারকের আদেশ শুনিয়া অনাথনাথ যেন অতিশয় দুঃখিত হইয়াছে, এইরূপ ভান করিয়া বিচারালয় হইতে বাহির হইয়া গেল। 

“এখন তোমার নিকট হইতে টাকা আদায় করিতে পারি কি না পারি, তাহা শীঘ্রই দেখিতে পাইবে।” এই বলিয়া গিরিজাভূষণও সেই স্থান পরিত্যাগ করিল। 

আদালত হইতে যে টাকার ডিক্রী হইল, নিয়মিত সময় মধ্যে অনাথনাথ সেই টাকা গিরিজাভূষণকে প্রদান করিল না ও আদালতেও সেই টাকা জমা করিয়া দিল না। কাজেই বাধ্য হইয়া ডিক্রী জারি করিবার নিমিত্ত গিরিজা-ভূষণকে পুনরায় আদালতে যাইতে হইল। ডিক্রী-জারি করিবার উপযোগী সমস্ত খরচ গিরিজাভূষণ জমা করিয়া দিল; তদনুসারে নিয়মিত রূপে ডিক্রী-জারি হইল। ডিক্রীজারির সময়ও অনাথনাথ নগদ টাকা প্রদান না করায়, তাহার দোকান হইতে কেরোসিন-তৈল-পূর্ণ যতগুলি বাক্স ছিল, তাহা ক্রোক করিয়া আদালতে লইয়া গেল। 

দেনার নিমিত্ত মালামাল ক্রোক হইলে যে কয়েক দিবস আদালতে উহা রাখিবার নিয়ম আছে, সেই কয় দিবস পৰ্য্যন্ত উহা আদালতে রাখা হইল। সেই সময়ের মধ্যেও অনাথনাথ টাকাগুলি জমা করিয়া দিয়া, আপনার দ্রব্যাদি ফেরত লইবার কোনরূপ চেষ্টাই করিল না। 

ক্রমে নিলামের দিন আসিয়া উপস্থিত হইল। কেরোসিনের সেই সমস্ত বাক্স আদালতের প্রকাশ্য নিলামে বিক্রীত হইয়া গেল। বড়-বাজারের জনৈক মাড়ওয়ারি নিতান্ত সুলভ মূল্যে সমস্ত বাক্সই খরিদ করিয়া লইলেন। 

সেই সকল দ্রব্য বিক্রয় করিয়া যে পরিমিত টাকা আদার হইল, তাহাতে গিরিজাভূষণের প্রাপ্য সমস্ত টাকা আদায় না হইলেও, নিতান্ত সামান্যই বাকী রহিয়া গেল। 

গিরিজাভূষণ আদালত হইতে বিক্রয়-লব্ধ টাকাগুলি বাহির করিয়া লইল, ও নিতান্ত হৃষ্টমনে হাসিতে হাসিতে অনাথনাথের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। তখন সমস্ত টাকা দুইভাগে বিভক্ত করিয়া অৰ্দ্ধেক আপনি গ্রহণ করিল, অর্দ্ধেক অনাথনাথকে প্রদান করিয়া কহিল, “আমাদিগের নব-উদ্ভাবিত এই জুয়াচুরির পন্থা মন্দ নহে!” 

পূৰ্ব্ব কথিত উপায়ে উভয়েই কিছু কিছু উপার্জ্জন করিয়া লইল, তাহা পাঠকগণ আপনারা দেখিলেন; কিন্তু ইহার ভিতর কিরূপ জুয়াচুরি হইল, তাহার বিষয় কিছু আপনারা বুঝিতে পারিলেন কি? যদি না পারেন, তাহা হইলে, কিছু সময় লইয়া একটু ভাবিয়া দেখুন দেখি, এই জুয়াচুরি কাণ্ডের ভিতর আপনারা কোনরূপে প্রবেশ করিতে পারেন কি না। 

ভাবিয়া চিন্তিয়াও যদি আপনারা ইহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতেনা পারেন, তাহা হইলে আমি সেই জুয়াচুরির ব্যাপার আপনাদিগকে নিতান্ত সহজেই বুঝাইয়া দিতেছি। 

আপনারা পূর্ব্বেই অবগত হইয়াছেন যে, জুয়াচুরির অভিসন্ধিতেই অনাথনাথ ও গিরিজাভূষণ উভয়ে মিলিয়া সেই দোকানের সৃষ্টি করে। আরও আপনারা অবগত আছেন যে, যেরূপেই হউক, উহারা কেরোসিনের খালি টিন ও খালি বাক্স সংগ্রহ করিয়া আপন দোকানে রাখিত। এইরূপে যখন দেখিল যে, উহারা উপযুক্ত পরিমিত টিন ও বাক্সের সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছে, তখন তৈলের পরিবর্ত্তে প্রত্যেক টিনে জল বোঝাই করিয়া ও কেবল মাত্র গন্ধের নিমিত্ত তাহার সহিত একটু একটু কেরোসিন দিয়া, কেরোসিনের কেনেস্তারা যেরূপ বন্ধ থাকে, সেইরূপে বন্ধ করিল। পরে দুই দুইটি কেনেস্তারা এক একটি বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া, কেরোসিনের তৈল সহিত যেমন বাক্স বন্ধ থাকে, সেইরূপ ভাবে উহা বন্ধ করিয়া আপন দোকানে রাখিয়া দিল, এবং বাক্সের উপর কেরোসিন তৈল এরূপ ভাবে লাগাইয়া রাখিল, যাহাতে সেই বাক্স দেখিলে কাহারও মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় না হয়। 

এদিকে আদালতে নালিস হইয়া ডিক্রী হইবার পর সেই সকল জলভরা বাক্স কেরোসিনের বাক্স বলিয়া ক্রোক করা হইল ও পরিশেষে কেরোসিনের মূল্যে আদালত হইতে জল বিক্রীত হইয়া গেল। 

এইরূপ উপায়ে অনাথনাথ ও গিরিজাভূষণ জুয়াচুরি করিয়া বিলক্ষণ লাভ করিল। কিন্তু যে মাড়ওয়ারি নিলামে উহা খরিদ করিয়াছিলেন, তাঁহার বিস্তর লোকসান হইল। যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, তৈলের পরিবর্তে কেনেস্তারাগুলি জলে পূর্ণ, তখন তিনি আদালতে গিয়া উহা জানাইলেন; কিন্তু তাঁহার কথায় কেহই প্রথমে কর্ণপাত করিল না। পরিশেষে নিতান্ত পীড়াপীড়ি করায় আদালত হইতে হুকুম হইল যে, তিনি প্রকাশ্য নিলামে যে দ্রব্য খরিদ করিয়াছেন, তাহার নিমিত্ত আদালত কোন প্রকারেই দায়ী নহেন। খরিদ করিবার পূর্ব্বে দ্রব্যাদি উত্তমরূপে দেখিয়া এবং বুঝিয়া খরিদ করাই উচিত ছিল। 

পাঠকগণ! ইহা একরূপ নূতন ধরণের জুয়াচুরি নয় কি? 

দুই – বিজ্ঞাপনে জুয়াচুরি 

আজ কাল আমাদিগের দেশে চাকরির অবস্থা যেরূপ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে সহজে কোনরূপ না কোনরূপ একটি চাকরির সংগ্রহ করিয়া লওয়া নিতান্ত সুসাধ্য নহে। 

পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদিগের মধ্যে যেরূপ ভাবে প্রবেশ করিতেছে, তাহাতে ক্রমে যে একটি ভয়ানক বিপর্যায় না ঘটিবে, তাহাই বা কে বলিতে পারেন? পাশ্চাত্য সভ্যতার গুণে আজ কাল দেশ মধ্যে কেহই আর অশিক্ষিত থাকিতে চাহেন না। লেখা পড়া শিখিতে পারেন বা না পারেন, বাল্যকালে কিন্তু সকলকেই একবার ইংরাজি স্কুলে প্রবিষ্ট হইতেই হইবে, এবং যতদূর সাধ্য, তাঁহাদিগকে ইংরাজি শিক্ষা করিতেই হইবে। 

এই সকল কারণে আজ কাল প্রায় সকলকেই জাতি-ব্যবসা পরিত্যাগ করিতে হইতেছে। যাঁহারা সামান্য লেখা পড়া শেখেন, তাঁহারা তাঁহাদিগের জাতি-ব্যবসায় হস্তক্ষেপ করিতে আর কোনরূপেই সমর্থ হন না, বা অপর কোনরূপ ব্যবসা-বাণিজ্য করিয়াও কোনরূপে দিনপাত করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের আর প্রবৃত্তি হয় না। কাজেই সকলকেই চাকরির নিমিত্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িতে হয়। 

দেশস্থ সমস্ত লোকেই যদি চাকরির নিমিত্ত লালায়িত হইয়া পড়েন, তাহা হইলে সকলেরই চাকরি কিছুতে হইতে পারে না; কারণ এত চাকরি কোথা হইতে আসিবে? যাঁহাদিগের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইল, তাঁহারা কোনরূপ একটি না একটি চাকরির সংগ্রহ করিয়া লইলেন। আর যাঁহারা কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া কোন প্রকার চাকরির উপায় করিতে পারিলেন না, তাঁহারা বিষম বিপদে পড়িলেন। তাঁহাদিগের মান অভিমান—তাঁহারা লেখা পড়া শিখিয়াছেন! সুতরাং জাতি-ব্যবসা অবলম্বন করিতে আর তাঁহারা কোনরূপে সমর্থ হইলেন না। অথচ কোন প্রকারে উদর পূর্ত্তির ব্যবস্থা করিতেই হইবে। সুতরাং সৎ উপায়ে হউক বা অসৎ উপায়ে হউক, তাঁহার অর্থ উপার্জ্জনের প্রয়োজন উপস্থিত হয়। এই প্রকার নানারূপ কারণে ক্রমে তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকে জুয়াচোর হইয়া পড়েন। কেহ বা ইচ্ছা করিয়াই জুয়াচোর হয়েন, আর কেহ বা অনিচ্ছা থাকিলেও দায়ে পড়িয়া জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া নিজের ও পরিবারবর্গের ভরণ পোষণ করিতে প্রবৃত্ত হয়েন। 

এই সকল শিক্ষিত বা অর্দ্ধ-শিক্ষিত ব্যক্তিগণ যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া আজ কাল জুয়াচুরি করিতেছেন, তাহার কতকগুলি দৃষ্টান্ত পূৰ্ব্বে দেখাইয়া দিয়াছি। অদ্য কতকগুলি নিম্নে লিপিবদ্ধ করিলাম, ও সময়-মত আরও লিখিবার ইচ্ছা রহিল। 

হরিদাস, নাপিতের পুত্র। যে গ্রামে তাহার বাড়ী, সেই গ্রামে একটি ইংরাজি স্কুল ছিল। সুতরাং হরিদাসের পিতা হরিদাসকে একটু লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন। কিন্তু লেখাপড়া শিখিলে কি হইবে? হরিদাস অনেক স্থানে অনেক রূপ চেষ্টা করিয়া একটি সামান্য চাকরিও লাভ করিয়া উঠিতে পারে নাই। দেশে বসিয়া হরিদাস যখন কোনরূপ চাকরির সন্ধান করিতে পারিল না, তখন চাকরির উমেদারীতে সে কলিকাতায় আসিল। এখানেও বিশিষ্ট চেষ্টা করিয়া কোনরূপ চাকরির সংগ্রহ হইল না। কিছুদিন এই স্থানে থাকিতে থাকিতেই ক্রমে তাহারই সদৃশ নীচ-বংশ-সম্ভূত অপর আর একজন অৰ্দ্ধ-শিক্ষিত জুয়াচোরের সহিত তাহার প্রথমে পরিচয় হইল। ক্রমে উভয়ের মধ্যে বিশেষরূপ বন্ধুত্ব স্থাপিত হইল। 

হরিদাস ও তাহার বন্ধু উভয়েই সমান শিক্ষিত, অথচ উভয়েরই অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং কোন উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিতে না পারিলে, চলিবে কি প্রকারে? বিশেষতঃ তাহারা উভয়েই এখন কলিকাতায় আসিয়াছে, কলিকাতার চাল চলন শিখিয়াছে, কলিকাতার ধরণ ধরিয়াছে, সন্ধ্যার পর বেড়াইতে শিখিয়াছে, বাসা ছাড়িয়া অপর স্থানে রাত্রিবাস আরম্ভ করিয়াছে; সুতরাং অর্থের নিতান্ত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। এখন যে কোন উপায়েই হউক, সাধু ভাবে কিম্বা অসাধু ভাবেই হউক, অর্থ উপার্জ্জন করিতে না পারিলে আর কিছুতেই চলে না। 

কিরূপে কিছু অর্থের সংস্থান করিতে পারা যায়, উভয়ে মিলিয়া তাহার পরামর্শ করিয়া ঔষধের একটি কারবার করিতে মনস্থ করিলেন। পরে উভয়ে এক হইয়া ভাবিয়া চিন্তিয়া একটি বিজ্ঞাপন লিখিলেন। সেই বিজ্ঞাপনের মা এইরূপঃ—

“সন্ন্যাসী প্রদত্ত
চক্ষু রোগের মহৌষধ।
 

চক্ষু ফুলা, চক্ষু জ্বালা, চক্ষু লাল হওয়া, প্রভৃতি চক্ষুর সামান্য সামান্য পীড়া, দুই দিবস মাত্র এই ঔষধ ব্যবহারেই আরোগ্য হয়। চক্ষুতে ফুলি পড়া, ছানি পড়া, প্রভৃতি ব্যাধিতে এই ঔষধ সাত দিবসের অধিক ব্যবহার করিতে হয় না। যাহার কোনরূপ চক্ষু পীড়া নাই, তিন মাস অন্তর এই ঔষধ একবার করিয়া ব্যবহার করিলে, চক্ষু উঠা প্রভৃতি কোনরূপ চক্ষুর পীড়া কখনই হয় না। জনৈক সন্ন্যাসীর নিকট হইতে, এই ঔষধ কেবলমাত্র দুই বৎসর হইল, আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি। কিন্তু এই সামান্য সময়ের মধ্যে যে, কত লোক চক্ষুর পীড়া হইতে আরোগ্যলাভ করিয়াছেন, তাহার সংখ্যা নাই। প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণের নিকট হইতে এ সম্বন্ধে আমরা যে কত প্রশংসা পত্র প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহার হিসাব নাই। স্থূল কথায় চক্ষুরোগের এমন উৎকৃষ্ট ঔষধ, এ পর্যন্ত আর আবিষ্কৃত হয় নাই, এবং হইবার সম্ভাবনাও নাই। মূল্য অতি সামান্য, কেবল মাত্র একটি মুদ্রা ও ডাক মাশুল ও প্যাকিং খরচা প্রভৃতি।।০ আনা। পত্র পাইলে ভিঃ পিঃ পোষ্টে ঔষধ পাঠান হইয়া থাকে।” 

এইরূপ ভাবে বিজ্ঞাপনটি লেখা হইলে, হরিদাস ওই বিজ্ঞাপন লইয়া কোন একখানি প্রধান বাঙ্গালা সংবাদ পত্রের আফিসে গমন করিল, ও তাঁহাদিগের কাগজের নিয়মানুসারে দক্ষিণা দিয়া বিজ্ঞাপনটি সেই স্থানে রাখিয়া আসিল। 

পর সপ্তাহে যখন সেই কাগজখানি বাহির হইল, তখন দেখা গেল, উহাতে পূৰ্ব্ব কথিত বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হইয়াছে। 

মফস্বলের অনভিজ্ঞ ব্যক্তি সকল, যাঁহারা বহুদিবসাবধি কোন না কোন প্রকার চক্ষু রোগে আক্রান্ত হইয়া বিশেষরূপে কষ্ট পাইতেছেন, ক্রমে তাঁহারা সেই বিজ্ঞাপনের বিষয় অবগত হইতে পারিলেন। এইরূপ মহোপকারী ঔষধ ব্যবহার করিতে মনস্থ করিয়া, অতি শীঘ্র উক্ত ঔষধটি পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত বিজ্ঞাপন-দাতাকে পত্র লিখিলেন। বলা বাহুল্য যে, পত্র পাইবামাত্র হরিদাস ও তাহার বন্ধু ভিঃ পিঃ পোষ্টে এক এক শিশি ঔষধ পাঠাইয়া প্রত্যেক পত্র প্রেরকের নিকট হইতে দেড় টাকা করিয়া আদায় করিতে লাগিল। 

হরিদাস ও তাহার বন্ধুর এই নূতন ব্যবসা কিছু দিবস অতি উত্তম রূপেই চলিল, অর্থাৎ যে পর্য্যন্ত সুদূর মফস্বলবাসীগণের মধ্যে চক্ষু রোগাক্রান্ত ব্যক্তিগণ একে একে প্রায় সকলেই না ঠকিলেন, সেই পর্যন্ত হরিদাস ও তাহার বন্ধু বেশ দুই পয়সা উপার্জ্জন করিয়া আপন আপন খরচ পত্রের সংস্থান ও অসৎ প্রবৃত্তি সকল চরিতার্থ করিতে লাগিল। 

পাঠকগণ হয় ত এই স্থানে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, “হরিদাস ও তাহার বন্ধু যখন ঔষধ পাঠাইয়া তাহার পরিবর্ত্তে দেড় টাকা আদায় করিয়া লইতেছেন, তখন তাহারা জুয়াচুরি করিতেছেন কি প্রকারে?” 

ইহার পূর্ব্বেই বোধ হয়, পাঠকগণ অবগত হইতে পারিয়াছেন যে, হরিদাস বা তাহার বন্ধু কেহই চিকিৎসক নহে, বা চিকিৎসা শাস্ত্রও কখন অধ্যয়ন করে নাই, অথবা কোন সন্ন্যাসীর সহিত তাহাদিগের পরিচয় নাই, বা কোন সন্ন্যাসীর নিকট হইতে কখন কোন প্রকার ঔষধ প্রাপ্ত হয় নাই, কিম্বা কোন সুবিজ্ঞ চিকিৎসক দয়া করিয়া, তাহাদিগকে কখনও কোন ঔষধের ব্যবস্থা লিখিয়া দেন নাই। কেবল মাত্র নিরীহ মফস্বল-বাসীগণের রোগাক্রান্ত চক্ষুতে ধূলি-মুষ্টি নিক্ষেপ করিয়া ঔষধের পরিবর্তে কেবল মাত্র একটু একটু পরিষ্কার জল পাঠাইয়া, তাহাদিগকে প্রতারিত করিয়াছে। 

এইরূপে ক্রমে ক্রমে যখন অনেকেই ঠকিলেন; তখন তাহাদিগের ব্যবসাও বন্ধ হইয়া আসিল। কারণ মফস্বল হইতে আর পত্র আইসে না; সুতরাং ঔষধও আর পাঠান হয় না। 

ঔষধের ব্যবসা বন্ধ হইয়া গেলে, পুনরায় আর কোন প্রকার নূতন উপায়ের উদ্ভাবন করিতে হইল। কারণ অর্থ বিনা তাহাদিগের এক দিবসও চলিবার উপায় নাই। পূৰ্ব্ব-বর্ণিত অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া তাহারা যে সকল অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিল, সেইরূপ অসৎ কাৰ্য্যেই সেই সকল অর্থ ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে; সুতরাং পুনরায় কোনরূপ নূতন উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করিতে হইল। 

উভয়ে তখন ভাবিল যে, মফস্বল-বাসীগণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও সহজে ও শীঘ্র প্রতারিত করা দুঃসাধ্য। অতএব পুনর্ব্বার পূর্ব্বরূপে অথচ বিভিন্ন উপায়ে প্রতারণা করিবার পন্থা ভাবিতে হইবে। 

উভয়ে পরামর্শ করিয়া ও অনেক-রূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া পুনরায় আর একটি বিজ্ঞাপনে হস্তক্ষেপ কবিল। উক্ত বিজ্ঞাপনের মর্ম এইরূপ:—

বিশেষ বিজ্ঞাপন 
সকলেরই দ্রষ্টব্য। 

এই কলিকাতা সহরের ভিতর বিস্তর সওদাগরি আফিস আছে। কিন্তু আমাদিগের এমনি দুরদৃষ্ট যে, তাহার প্রায় সমস্তগুলিই ভিন্ন-দেশবাসী লোকের দ্বারা পরিচালিত। যদিও এ দেশের কোন কোন ধনী ব্যক্তির দুই একটি সওদাগরি আফিস আছে; কিন্তু তাহা যে এ দেশের লোকের, তাহা সহজে কাহারও বোধগম্য হয় না। কারণ সেই সকল আফিসের কার্য্যাদি বিদেশী ও বিধম্মিদিগের দ্বারা পরিচালিত। আমরা এই সকল অভাব দূর করিবার অভিপ্রায়ে এ দেশীয় কতকগুলি ধনী ব্যক্তির সাহায্যে একটি নূতন সওদাগরি আফিস প্রতিষ্ঠিত করিতেছি। উক্ত আফিসের সমস্ত কাৰ্য্যই এ দেশীয় লোকদিগের দ্বারা পরিচালিত হইবে। ভিন্ন দেশীয় কোন ব্যক্তি কোন কার্য্যের নিমিত্তই এই আফিসে স্থান পাইবেন না। সুতরাং এই আফিসের কার্য্য নির্ব্বাহের নিমিত্ত বহুলোকের প্রয়োজন হইয়াছে। কি বেতনে কত লোকের প্রয়োজন হইবে, তাহারও একটি তালিকা আমরা মুদ্রিত করিয়াছি। যাঁহারা সেই তালিকার এক এক খণ্ড পাইতে প্রার্থনা করেন, বা যাঁহারা কোন বিষয় জানিতে চাহেন, বা চাকরির নিমিত্ত যাঁহারা আবেদন করিতে ইচ্ছুক হয়েন, তাঁহারা অর্দ্ধ আনা মূল্যের এক একখানি টিকিট সহিত নিম্ন স্বাক্ষর-কারীর নিকট আবেদন করিলে সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন। 

শ্রীহরিদাস দাস 
৩৬ নং—লেন।” 

পূর্ব্ব বিজ্ঞাপন যেরূপ উপায়ে সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল ইহাও সেইরূপ উপায়ে সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইল। পূৰ্ব্ব বিজ্ঞাপন কেবল মাত্র একখানি প্রধান বাঙ্গালা সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল, বৰ্ত্তমান বিজ্ঞাপন কিন্তু এ দেশীয় অধিকাংশ সংবাদ পত্রেই প্রকাশিত হইল। 

বিজ্ঞাপন বাহির হইবার পর হইতেই, হরিদাসের নামে রাশি রাশি পত্র আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। ক্রমে সমস্ত পত্রই হরিদাস ও তাহার বন্ধু খুলিয়া ফেলিল, দেখিল যে, প্রত্যেক পত্রের ভিতরই অর্দ্ধ আনা মূল্যের এক এক খানি ডাকের টিকিট আছে। পত্র-লেখকগণের মধ্যে কেহবা মুদ্রিত তালিকা চাহিয়া পাঠাইয়াছেন, কেহবা কোন বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইয়াছেন, কেহবা চাকরির নিমিত্ত আবেদন করিয়াছেন। 

যিনি যে বিষয়ই প্রার্থনা করুন না কেন, কাহারও প্রার্থনা কোনরূপেই রক্ষা করা হইল না; কেবল মাত্র প্রত্যেক পত্র হইতে টিকিটগুলি বাহির করিয়া টিকিট-বিক্রেতা দিগকে কিছু কিছু কমিশন দিয়া বিক্রয় করা হইল। কোন কোন ব্যক্তি বলেন যে, এইরূপ উপায়ে হরিদাস ও তাহার বন্ধু এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় তিন শত টাকার সংস্থান করিয়া লইয়াছিল। পত্র-লেখকগণ কিছু দিবস পর্য্যন্ত পত্রের উত্তর পাইবার নিমিত্ত ব্যগ্র থাকিয়া, পরিশেষে বুঝিতে পারিলেন যে, ইহা কোন জুয়াচোরের জুয়াচুরি। জুয়াচুরি জানিতে পারিয়াও কিন্তু কোন ব্যক্তি তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাই করিলেন না। কারণ দুইটি মাত্র পয়সার নিমিত্ত কোন ভদ্র লোক মামলা মোকদ্দমা করিয়া বেড়াইতে পারেন? 

হরিদাস ও তাহার বন্ধু যখন দেখিল যে, এইরূপ উপায় অবলম্বনে আর কোনরূপ লাভের প্রত্যাশা নাই, তখন সেই উপায় পরিত্যাগ পূর্ব্বক অপর কোনরূপ নূতন উপায় অবলম্বনের পন্থা অনুসন্ধান করিতে লাগিল। যে সময়ে তাহারা জুয়াচুরির নূতন পন্থা অনুসন্ধান করিতেছিল, সেই সময় আমাদিগে বাঙ্গালা বৎসর প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল; বোধ হয়, চৈত্র মাস কেবল মাত্র আরম্ভ হইয়াছিল। সেই সময়ে উভয়ে পরামর্শ করিয়া পুনরায় আর একটি বিজ্ঞাপন লিখিল। উক্ত বিজ্ঞাপনের মর্ম্ম এই প্রকার :—

“বিনা মূল্যে
নূতন পঞ্জিকা বিতরণ!
 

এই কলিকাতা সহরের জনৈক প্রসিদ্ধ ধনীর সাহায্যে আমরা একখানি উৎকৃষ্ট ও বৃহৎ নূতন পঞ্জিকা প্রকাশিত করিয়াছি। এরূপ বিশুদ্ধ পঞ্জিকা এ পর্যন্ত বঙ্গদেশে কেহই বাহির করিতে পারেন নাই। সময় সময় পঞ্জিকাকারগণের মধ্যে যেরূপ মতভেদ পরিলক্ষিত হয়, তাহাতে কোনটি শাস্ত্র-সম্মত, কোটিই বা অশাস্ত্রীয়, তাহা স্থির করা নিতান্ত কষ্টকর হইয়া পড়ে ও তজ্জন্য সময় সময় বিশেষরূপ অসুবিধা ভোগ করিতে হয়। এই প্রকার নানা কারণে প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ পণ্ডিত-মণ্ডলীর সাহায্যে আমরা এই বৃহৎ নূতন পঞ্জিকা প্রকাশ করিলাম। সুতরাং উহার মূল্য এ প্রদেশীয় প্রচলিত সমস্ত পঞ্জিকা অপেক্ষা অধিক হইল। কিন্তু বৰ্ত্তমান চৈত্র সংক্রান্তি পৰ্য্যন্ত বিনা মূল্যে আমরা উহা সকলকে প্রদান করিব। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যিনি ডাকমাশুল স্বরূপ কেবল মাত্র চারিটি পয়সা আমাদিগের নিকট পাঠাইয়া দিবেন, কেবল তাঁহারই নিকট উক্ত নূতন পঞ্জিকা প্রেরিত হইবে। পঞ্জিকা পাঠাইবার খরচা অর্থাৎ ডাক মাশুল না পাঠাইলে কাহারও নামে এই বৃহৎ নূতন পঞ্জিকা প্রেরিত হইবে না। পঞ্জিকা গ্রহণেচ্ছুকগণ সত্বর হউন, কারণ চৈত্র মাসের পর কোন ব্যক্তিই এই পঞ্জিকা আর বিনামূল্যে প্রাপ্ত হইবেন না। 

দাস এণ্ড কোম্পানি। 
১০২ নম্বর—ষ্ট্রীট, কলিকাতা।” 

ইহার পূর্ব্বে তাহারা যে সকল নামে বিজ্ঞাপন বাহির করিয়াছিল, এবার সেই সকল নামের পরিবর্তন করিয়া “দাস এণ্ড কোম্পানি” এই নূতন নাম অবলম্বন করিল। কারণ ইতিপূর্ব্বে যাঁহারা প্রতারিত হইয়াছেন, তাঁহারা সেই নাম দেখিলে পাছে বুঝিতে পারেন যে, ইহাও আর একটি জুয়াচুরি। সুতরাং নাম পরিবর্তনের বিশেষ প্রয়োজন হইল। 

নিয়মিতরূপে এই বিজ্ঞাপনও বাঙ্গালা সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইল। পল্লিগ্রাম-বাসী নিরীহ লোক সকল পুনরায় এই বিজ্ঞাপন ভুলিলেন। বৃহৎ নূতন পঞ্জিকা পাইবার প্রত্যাশায় পুনরায় তাঁহারা একখানি পত্র লিখিলেন, আর সেই পত্রের মধ্যে পঞ্জিকা পাঠাইবার ডাক মাশুল স্বরূপ পুনরায় চারি পয়সার ষ্টাম্প পাঠাইয়া দিলেন। 

বলা বাহুল্য যে, তাঁহারা কোনরূপ নূতন পঞ্জিকা প্রাপ্ত হইলেন না, বা তাঁহাদের লিখিত পত্রেরও কোনরূপ উত্তর পাইলেন না। ক্রমে চৈত্র মাস অতীত হইয়া গেল, তখন তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন যে, ইহাও জুয়াচোরের জুয়াচুরি। পূর্ব্ব পূর্ব্ব উপায়ে হরিদাস ও তাহার বন্ধু মফস্বল-বাসীগণের নিকট হইতে যে পরিমিত অর্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিল, এবার কিন্তু তাহারা ততদূর পারিল না। তথাপি বোধ হয়, এইরূপ উপায়ে তাহারা দুই শত টাকা হস্তগত করিল। 

হরিদাস ও তাহার বন্ধু যেরূপ উপায়ে এই অর্থ উপার্জ্জন করিল, বলা বাহুল্য, সেইরূপ উপায়েই উহা ব্যয়িত হইয়া গেল। তখন তাহাদিগকে পুনরায় অন্য কোনরূপ উপায় অবলম্বনের চেষ্টা দেখিতে হইল। 

জুয়াচুরির নূতন উপায় অবলম্বন করিবার মানসে, হরিদাস ও তাহার বন্ধুকে এবার অনেক ভাবিতে হইল। কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া এমন এক উপায় বাহির করিল, যাহাতে অন্যান্য কার্য্যের ন্যায় এই অবলম্বিত কাৰ্য্যটি সহজে বন্ধ হইল না। অনেক দিবস হইল, তাহারা এই জুয়াচুরির সৃষ্টি করিয়াছে; কিন্তু আমাদিগের দেশের এমনই দুর্ভাগ্য যে, সেই উপায় এখন পৰ্য্যন্ত চলিয়া আসিতেছে, ও এই জুয়াচুরি-উপলব্ধ অর্থ হইতে হরিদাস ও তাহার বন্ধু অনায়াসে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছে। আর তাহাদিগের দেখাদেখি অপরাপর জুয়াচোরগণও এই উপায় অবলম্বন করিয়া মফস্বলস্থ কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, সমস্ত লোকের চক্ষুতে ধূলি-মুষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতেছে। 

বলিতে লজ্জা হয়, এইরূপ জুয়াচোরের সংখ্যা এই কলিকাতা নগরীতে প্রায় শতাধিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এবং উক্ত রূপ একই প্রকারের জুয়াচুরি অবলম্বন করিয়া তাহারা অনায়াসেই দিনপাত করিয়া আসিতেছে। 

কি রূপে এই জুয়াচুরি-কাণ্ড এত দিবস পর্য্যন্ত এই সহরে চলিয়া আসিতেছে, তাহা বিশদরূপে পাঠকগণকে বুঝাইতে চেষ্টা করিব; কিন্তু ইহাতে কতদূর যে কৃতকার্য হইব, তাহা বলিতে পারি না। 

এই কলিকাতা সহরে যতগুলি প্রধান প্রধান ইংরাজ সওদাগর আছেন, তাঁহাদিগের প্রায় প্রত্যেকেরই একটি না একটি ক্যাটালগ বা বিজ্ঞাপনী পত্রিকা আছে। পাঠকগণের মধ্যে সেই সকল ক্যাটালগ অনেকেই দেখিয়াছেন। কারণ মূর কোম্পানি, হোয়াইটওয়ে লেড্‌ল প্রভৃতি কতকগুলি সওদাগর তাঁহাদিগের ক্যাটালগ যেরূপ ভাবে সর্ব্বসাধারণমধ্যে বিলি করিয়া থাকেন, তাহাতে এমন লোক তাতি অল্পই আছেন, যাঁহার হাতে উহা কখন না কখন পতিত না হইয়াছে। 

যে সকল দ্রব্য বিক্রয়ার্থ তাঁহাদিগের দোকানে রক্ষিত আছে, তাহার অনুরূপ চিত্র, তাহার গুণাগুণ, এবং তাহার মূল্য প্রভৃতি বিষয় সকল এই ক্যাটালগে ছাপা থাকে। উহা দেখিয়া দূর-দেশস্থ ক্রেতাগণ দ্রব্যের গুণাগুণ ও মূল্যাদি জানিতে পারিয়া, তাঁহাদিগের মনোমত দ্রব্য তাঁহাদিগের নিকট পাঠাইয়া দিতে উক্ত সওদাগরগণকে লিখিয়া থাকেন। তাঁহারাও ঠিক ক্যাটালগ লিখিত দ্রব্য পাঠাইয়া উহার উপযুক্ত পরিমিত মূল্য আদায় করিয়া লয়েন। ইহার ভিতর জুয়াচুরি প্রভৃতি কিছুই নাই; সুতরাং এই উপায়ে ক্রেতার ও বিক্রেতার উভয়েরই সুবিধা হয়। 

হরিদাস ও তাহার বন্ধু এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া, আর স্থির থাকিতে পারিল না। প্রধান প্রধান সওদাগরদিগের এক একখানি ক্যাটালগ সংগ্রহ করিয়া, তাহা হইতে উত্তম উত্তম দ্রব্য সকল বাছিয়া লইয়া, সেইরূপ একখানি ক্যাটালগ প্রস্তুত করিল। সওদাগরদিগের ক্যাটালগে যে সকল চিত্র আছে, ইহারাও সেই প্রকার চিত্র সকল প্রস্তুত করাইয়া আপনাদের ক্যাটালগে স্থান প্রদান করিল। ইংরাজদিগের ক্যাটালগে যে সকল দ্রব্যের গুণাগুণ যেরূপ ভাবে বর্ণিত আছে, তাহাও ঠিক সেইরূপ ভাবে আপনাদিগের ক্যাটালগে অনুকরণ করিয়া লইল। প্রভেদের মধ্যে রহিল—কেবল মাত্র ওই সকল দ্রব্যের মূল্য, অর্থাৎ যে সওদাগর যে দ্রব্য যে মূল্যে দিতে প্রস্তুত আছেন, তাহারা আপনাদিগের ক্যাটালগে সেই সকল দ্রব্যের মূল্য তাঁহাদিগের অপেক্ষা অনেক কম দেখাইল। অথচ এই ক্যাটালগের মধ্যে উল্লেখ নাই, এরূপ কোন উৎকৃষ্ট দ্রব্যই দেখিতে পাওয়া গেল না। 

হরিদাস ও তাহার বন্ধুর ক্যাটালগ এইরূপ ভাবে ছাপা হইয়া গেল। কিন্তু এই ক্যাটালগে এবার তাহারা আপন নাম প্রকাশ করিল না, বা এ দেশীয় কোন নামও ব্যবহার করিল না। এবার উহাতে নাম রহিল, ডব্লিউ মারটিন এণ্ড কোম্পানি (W. Martin & Co.) ঠিকানা দেওয়া হইল, গ্লাডষ্টোন হাউস কলিকাতা। (Gladstone House, Calcutta) 

মফস্বল-বাসীগণ যাহাতে ইহা এ দেশীয়ের কারবার বুঝিতে না পারে, এই নিমিত্ত এবার ইংরাজী নাম ব্যবহার করা হইল। এরূপ করিবার উদ্দেশ্য এই যে, উহা বিলাতী সওদাগরের কারবার বুঝিতে পারিলে, আর কেহই অবিশ্বাস করিবে না। সুতরাং অনায়াসেই জুয়াচোরেরা আপন আপন মনস্কামনা সিদ্ধ করিয়া লইতে পারিবে। 

ইচ্ছা করিয়া না হউক, আপনাদের নিয়মের বশীভূত হইয়া, এই স্থানের পোষ্টাফিস বা ডাক ঘর—হরিদাস ও তাহার বন্ধুর এই জুয়াচুরি কারবারের সহায়তা করিতে লাগিলেন। 

নিম্নলিখিত দুই প্রকারে হরিদাস ও তাহার বন্ধু ডাক ঘরের নিকট হইতে সাহায্য প্রাপ্ত হইল। 

প্রথমতঃ। তাহারা যে ক্যাটালগ প্রস্তুত করিল, তাহা ডাকযোগে কোন স্থানে প্রেরণ করিতে হইলে, অর্দ্ধ আনা ‘ ডাক মাশুলের কম কোনরূপেই যাইতে পারে না, কিন্তু প্রিভিলেজ নিয়ম অনুসারে ওই সকল ক্যাটালগ এক পয়সা মাশুলে মাসে মাসে মফস্বলে প্রেরিত হইতে লাগিল। এইরূপ উপায়ে তাহারা অর্দ্ধেক ডাক মাশুল বাঁচাইয়া যাইতে লাগিল। 

দ্বিতীয়তঃ তাহারা ডাকঘরে এক পত্র লিখিল যে, “ডব্লিউ মার্টিন, গ্লাডষ্টোন হাউস, কলিকাতা” এই ঠিকানার চিঠি পত্র মণিঅর্ডার হরিদাসের নামে তাহার ঠিকানায় বিলি হইবে। ডাকঘরের নিয়ম অনুসারে হরিদাসের এই আবেদনও গ্রাহ্য হইল। সে আপন ঘরে বসিয়া ডব্লিউ মার্টিনের নামের টাকাকড়ি ও পত্রাদি সমস্তই গ্রহণ করিতে লাগিল। 

আজ কাল নানা প্রদেশীয় নানারূপ ডিরেক্টরীর অভাব নাই; সুতরাং সেই সকল ডিরেক্টরী হইতে মফস্বল-বাসী ইংরাজ, বাঙ্গালী প্রভৃতি নানাজাতীয় লোকের নাম সংগ্রহ করিয়া প্রত্যেক মাসে নূতন নূতন নামে আপনাদিগের ক্যাটালগ পাঠাইতে লাগিল। যাঁহাদিগের হস্তে এই সকল ক্যাটালগ গিয়া পতিত হইতে লাগিল, তাঁহারা আপনাদিগের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সকল অপেক্ষাকৃত অল্প মূল্যে পাইবার প্রত্যাশায় ডব্লিউ মার্টিন কোম্পানিকে পত্র লিখিতে লাগিলেন। হরিদাস ও তাহার বন্ধু সেই সকল দ্রব্যের অনুরূপ কম মূল্যের দ্রব্য সকল বা লোকসানী দ্রব্য সকল নিতান্ত সামান্য মূল্যে খরিদ করিয়া, ভেলু-পেয়েবল পোষ্টে সেই সকল দ্রব্যাদি পাঠাইয়া, ক্যাটালগ লিখিত মূল্য আদায় করিয়া লইতে লাগিল। 

মূল্য প্রদান করিয়া ক্রেতাগণ যখন প্যাক খুলিয়া সেই সকল দ্রব্য দেখিলেন, তখন বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহারা উত্তমরূপে প্রতারিত হইয়াছেন। যেরূপ উৎকৃষ্ট দ্রব্য পাঠাইতে লিখিয়াছিলেন, ইহা সেই প্রকারের উৎকৃষ্ট দ্রব্য নহে, অথবা একবারেই অব্যবহার্য্য। এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া তাঁহারা পুনরায় ডব্লিউ মার্টিনকে পত্র লিখিলেন, কিন্তু পত্রের উত্তর আর প্রাপ্ত হইলেন না। কেহবা সেই সকল দ্রব্য পুনঃ-প্রেরণ করিলেন; কিন্তু তাহার পরিবর্তে অপর আর কিছুই পাইলেন না, বা পত্রের উত্তরও প্রাপ্ত হইলেন না। 

যাঁহারা ভেলু-পেয়েবল পোষ্টে দ্রব্য লইতে চাহিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের অবস্থা এইরূপ হইল! আর যাঁহারা রেজেষ্টারি করিয়াই হউক, বা মণিঅর্ডার করিয়াই হউক, প্রথমেই মূল্য প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের নিকট কিছুই প্রেরণ করা হইল না। পত্রের উপর পত্র লিখিয়া, তাঁহারা এক খানিরও উত্তর প্রাপ্ত হইলেন না। মার্টিন কোম্পানির নিকট এইরূপে অনেকেই প্রতারিত হইয়াছেন এবং এখন পর্যন্তও হইতেছেন। এদিকে মার্টিন কোম্পানির দেখাদেখি সেইরূপ কোম্পানির বিস্তর সৃষ্টি হইয়াছে, ও মফস্বল-বাসী লোকগণ তাহাদিগের নিকটও নিত্য নিত্য ঠকিতেছেন। কিন্তু সামান্য টাকার নিমিত্ত কেহই তাহার প্রতি-বিধানের চেষ্টা করিতেছেন না। সুতরাং এই সহরের মধ্যে উক্তরূপ জুয়াচুরির দিন দিন বৃদ্ধিই পাইতেছে, ও ক্রমে বিশ্বাসী ও সৎ-ব্যবসায়ী সওদাগর পর্যন্ত মফস্বল-বাসীদিগের অবিশ্বাস ভাজন হইয়া পড়িতেছেন। ইহাতে সৎ-ব্যবসায়ের যে নিতাস্ত ক্ষতি হইতেছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া সওদাগর সমিতি (Chamber of Commerce) এখন পর্যন্ত ইহার প্রতিবিধানের যে কেন চেষ্টা করিতেছেন না, তাহা বলা যায় না। 

তিন – চাকরিতে জুয়াচুরি 

চারি পাঁচ বৎসর অতীত হইল, ষ্টেটস্ম্যান সংবাদ পত্রে ইংরাজীতে একটি বিজ্ঞাপন বাহির হয়, উক্ত বিজ্ঞাপনের মর্ম্ম এই প্রকার :—

কর্ম খালি। 

আমার একটি প্রকাণ্ড জমিদারির বন্দোবস্ত করিবার নিমিত্ত জনৈক উপযুক্ত ম্যানেজারের আবশ্যক। বেতন পারদর্শিতা অনুসারে তিন শত টাকা হইতে পাঁচ শত টাকা পৰ্য্যন্ত। জামিন, নগদ পাঁচ সহস্ৰ মুদ্রা। নীলগিরির সন্নিকটে এই জমিদারি। যে স্থানে ম্যানেজারকে থাকিতে হইবে, সেই স্থানের জলবায়ু অতি মনোহর। থাকিবার “বাঙ্গলা” সরকারী, উহার নিমিত্ত কোনরূপ ভাড়া দিতে হয় না। উক্ত “বাঙ্গলা” খানি একটি উৎকৃষ্ট পুষ্পোদ্যানের মধ্যে স্থাপিত। কৰ্ম্মপ্রার্থীগণ আপন আপন প্রশংসা-পত্র সহ অদ্য হইতে এক মাসের মধ্যে আবেদন করিবেন। জামিনের টাকা প্রথমে দিতে হইবে না। যাঁহার আবেদন গ্রাহ্য হইবে, তাঁহার ঢাকরি স্থানে গমন করিবার পূর্ব্বে জামিনের টাকা জমা দিলেই চলিবে। 

এ, সি, বার্ক।
নাইনিতাল।” 

সংবাদপত্রে এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হইবার পর হইতেই ভারতবর্ষের নানা স্থান হইতে নানা দরখাস্ত এ. সি. বার্ক সাহেবের নামে প্রেরিত হইতে লাগিল। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, মাদ্রাজ, বোম্বাই, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, এবং বাঙ্গালা দেশের অনেক স্থান হইতে অনেক দরখাস্ত প্রেরিত হইয়াছিল। দরখাস্ত কারিগণের মধ্যে দেশীলোক এবং বিদেশীয় ইংরাজও ছিলেন। তাহার মধ্যে কলিকাতা-বাসী একজন ইংরাজও উক্ত কৰ্ম্ম পাইবার প্রত্যাশায় একখানি দরখাস্ত করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম মূর। মূর থাকিতেন, ধর্ম্মতলার একটি বাটীতে। 

মূর সাহেব বার্ক সাহেব কর্তৃক প্রতারিত হইয়া মাজিষ্ট্রেটের কোর্টে তাঁহার নামে নালিস করেন, ও পরিশেষে এ বিষয়ের অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে অর্পিত হয়। অনুসন্ধান করিয়া আমি জানিতে পারি যে, যে সময় বার্ক সাহেব কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞাপন মূর সাহেবের নয়নগোচর হয়, সেই সময় তিনি বেকার অবস্থায় বসিয়াছিলেন। ইহার পূৰ্ব্বে তিনি কয়েক খানি জমিদারির ম্যানেজারি কার্য্যও করিয়াছিলেন, সুতরাং জমিদারি সংক্রান্ত কার্য্য সকল তিনি এক রূপ বুঝিতেন। 

বিজ্ঞাপন দৃষ্টে মুর সাহেব একখানি দরখাস্ত লিখিয়া বার্ক সাহেবের ঠিকানায় নাইনিতালে পাঠাইয়া দিলেন, ও সেই সঙ্গে যে যে স্থানে তিনি পূর্ব্বে কৰ্ম্ম করিয়াছিলেন, তাহার বৃত্তান্ত লিখিয়া দিলেন; এবং যে সকল প্রশংসাপত্র ছিল, তাহারও অবিকল নকল দরখাস্তের সহিত প্রেরণ করিলেন। 

এই দরখাস্ত বার্ক সাহেবের হস্তগত হইবার কিছুদিবস পরেই মূর সাহেব এক খানি পত্র পাইলেন, উহা বার্ক সাহেবের লিখিত। উহাতে লেখা ছিল, “আপনার দরখাস্ত আমার হস্তগত হইয়াছে। আপনার দরখাস্ত এবং প্রশংসা-পত্র প্রভৃতির নকল দেখিয়া, আমার অনুমান হইল যে, অন্য সমস্ত দরখাস্ত কারিগণের মধ্যে আপনিই সর্ব্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক। আপনি এক মাসের মধ্যে আপনার জামিনের টাকা সংগ্রহ করিয়া, আমার নিকট পাঠাইয়া দিবেন। জামিনের টাকা আমার হস্তগত হইলেই আপনার নামে নিয়োগ-পত্র পাঠাইয়া দিব। নিয়োগ-পত্র পাইবামাত্র আপনাকে এই কাৰ্য্য—ভার গ্রহণ করিতে হইবে; কিন্তু কৰ্ম্মস্থানে গমন করিবার পূর্ব্বে আমার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিয়া যাওয়ার প্রয়োজন। যে সময় আপনি আমার নিকট আগমন করিবেন, সেই সময় যে সকল প্রশংসা পত্রের নকল আমার নামে দরখাস্তের সহিত পাঠাইয়া দিয়াছেন, তাহার আসলগুলি সঙ্গে করিয়া আনিবেন; কারণ ওই-গুলি আমি একবার দেখিতে ইচ্ছা করি। টাকা যত শীঘ্র পারেন, সংগ্রহ করিবেন; কারণ এই চাকরির নিমিত্ত আরও অনেক ব্যক্তি উপস্থিত আছেন, এবং আবেদন করিয়াছেন। শীঘ্র টাকার সংগ্রহ করিতে না পারিলে, অন্য লোককে আমি এই কার্য্যে নিযুক্ত করিব। কি পৰ্য্যন্ত আপনি জামিনের টাকা প্রেরণ করিতে পারিবেন, পত্র দ্বারা যত শীঘ্র পারেন, তাহা আমাকে জানাইবেন।” এই পত্র খানি পাঠ করিয়া মূর সাহেব জানিতে পারিলেন যে, পূর্ব্বে বার্ক সাহেব নাইনিতালের যে স্থান হইতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিয়াছিলেন, এখন সেই স্থানে নাই। কারণ এখন যে পত্র প্রাপ্ত হইলেন, তাহাতে মসূরির ঠিকানা লেখা ছিল। 

পত্র প্রাপ্ত হইবামাত্র তিনি উক্ত পত্রের উত্তর লিখিলেন, উহার মর্ম্ম এইরূপ :—

“আপনার পত্র পাইয়া সকল সমাচার অবগত হইলাম। পূর্ব্বে আপনার নিকট যখন দরখাস্ত প্রেরণ করিয়াছি, তখন বোধ হয়, আপনি নাইনিতালে ছিলেন। কিন্তু এখন আপনার পত্র দেখিয়া প্রতীয়মান হইতেছে যে, এখন আপনি মসুরিতে গমন করিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আমাকে কোন স্থানে গমন করিতে হইবে? নীলগিরিতে গমন করিলে আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইবে, কি নাইনিতালে গমন করিলে হইবে, অথবা মসুরিতে আপনার সাক্ষাৎ পাইব? তাহা পরিষ্কার করিয়া লিখিবেন। জামিনের টাকা আমি সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছি, আপনার পত্র পাইলে টাকা সঙ্গে লইয়া আমি আপনার নিকট গমন করিব, ও সেই স্থানে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া জামিনের টাকা আপনাকে প্রদান পূর্ব্বক আপনার নিকট হইতে নিয়োগপত্র গ্রহণ করিয়া কৰ্ম্মস্থানে গমন করিব। যখন আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আমাকে গমন করিতেই হইবে, তখন ডাকযোগে বা অন্য কোন উপায়ে টাকা পাঠাইয়া দিবার আমি কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না।” 

মূর সাহেবের লিখিত পত্র বার্ক সাহেবের নিকট প্রেরিত হইবার কয়েক দিবস পরেই সেই পত্রের উত্তর আসিল। পত্র লিখিত স্থানে নাম দেখিয়া বোধ হইল যে, এ পত্র খানিও মসুরি হইতে আসিতেছে। উহাতে লেখা আছে—“আপনার পত্র পাইয়া সকল সমাচার অবগত হইলাম। আপনি টাকা সঙ্গে লইয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিবেন লিখিয়াছেন, কিন্তু তাহাতে কার্য্যের বিশেষরূপ সুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই; কারণ আমার শরীর নিতান্ত পীড়িত বলিয়াই একজন উপযুক্ত ম্যানেজার রাখিবার প্রয়োজন হইয়াছে। এত দিবস আমার কোন ম্যানেজার ছিলেন না; আমি নিজেই আমার সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিতাম। শরীরের অসুস্থতা নিবন্ধন চিকিৎসকগণের পরামর্শ অনুযায়ী আমাকে নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতে হইতেছে। সুতরাং কোন্ সময় আমি কোন্ স্থানে থাকিব, তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। পূর্ব্বে আমি মনে করিয়াছিলাম, প্রথমে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেই কার্য্যের সুবিধা হইবার সম্ভাবনা; কিন্তু এখন দেখিতেছি যে, তাহাতে বিশেষরূপ অসুবিধা ঘটিবে। প্রথমে আমার সহিত আপনার সাক্ষাৎ করিতে হইবে না, আপনি একবারে কর্ম্মস্থানে নীলগিরিতেই গমন করিয়া আপনার কার্য্যে নিযুক্ত হইতে পারিবেন। সুতরাং জামিনের টাকা যেরূপ উপায়ে হউক প্রথমে আপনি আমার নিকট প্রেরণ করিবেন। টাকা পাইবামাত্র আপনার নিয়োগপত্র প্রেরণ করিব, এবং কোন্ স্থান দিয়া গমন করিলে বিনাক্লেশে আপনি কৰ্ম্মস্থানে উপস্থিত হইতে পারিবেন, তাহাও আপনাকে লিখিয়া পাঠাইব। অদ্যই আমার বোম্বে গমন করিবার সম্ভাবনা। নিম্নলিখিত ঠিকানায় বোম্বাই সহরে আপনি জামিনের টাকা, যত শীঘ্র পারেন, পাঠাইয়া দিবেন। না পাঠাইতে পারেন, তাহাও লিখিবেন; কারণ আমি অপর একজন লোককে উক্ত কর্ম্মে নিযুক্ত করিতে মনে মনে স্থির করিয়াছি। আপনি সব টাকার সংস্থান করিতে না পারিলে, আমি তাঁহাকেই সেই কর্ম্মে নিযুক্ত করিব।” 

বার্ক সাহেবের এই পত্র পাইবামাত্র মূর সাহেব টাকার সংস্থান করিয়া, পাঁচ খানি পাঁচ হাজার টাকার নোটের অর্দ্ধেক অর্দ্ধেক কাটিয়া রেজেক্টরি করিয়া বোম্বাই সহরের ঠিকানায় বার্ক সাহেবের নামে প্রেরণ করিলেন। উক্ত নোটের সহিত যে, একখানি পত্র লিখিলেন, তাহার মর্ম্ম এইরূপ :—

“আপনার পত্রানুযায়ী আমার জামিন স্বরূপ পাঁচ হাজার টাকার অর্দ্ধ-নোট আপনার নিকট প্রেরণ করিলাম। যেরূপ হয়, সংবাদ লিখিবেন, এবং কোন প্রকার প্রতিবন্ধক না থাকিলে নিয়োগ-পত্র খানি প্রেরণ করিবেন। নিয়োগ—পত্র সহিত আপনার পত্র পাইলেই, পঞ্চ সহস্র মুদ্রা মূল্যের অপরার্দ্ধ নোটগুলি আপনার নামে প্রেরণ করিব। উহা কোন্ ঠিকানায় পাঠাইতে হইবে, তাহা পরিষ্কার করিয়া পত্রে লিখিবেন। আপনার পত্র পাইলেই টাকা প্রেরণ করিয়া কর্ম্মস্থানে রওনা হইব।” 

এই টাকা পাঠাইবার কয়েক দিবস পরেই পত্রের উত্তর আসিল। তাহার মর্ম্ম এইরূপ,—“আপনার পত্র ও পাঁচ হাজার টাকার ডার্দ্ধ-নোট পাইয়া সকল সমাচার অবগত হইলাম। নোটের অপরার্দ্ধ অংশ প্রেরণ করিলেই আপনার নিয়োগপত্র প্রেরণ করিব, এবং যে সকল বিষয়ে উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন, সেই সকল বিষয়ে উপদেশ দিয়া আপনাকে এক পত্র লিখিব। নিয়োগ-পত্র সহিত আমার লিখিত পত্র প্রাপ্ত হইবামাত্র, আপনি যত শীঘ্র পারেন, কর্ম্মস্থানে গমন করিবেন। জামিনের টাকা অগ্রে জমা না হইলে আদেশ-পত্র দিবার নিয়ম নাই বলিয়া, আপনার অনুরোধ রক্ষা করিতে পারিলাম না। আমি আপাততঃ বোম্বাই সহরেই কিছু দিবস অবস্থিতি করিব, সুতরাং পূর্ব্ব ঠিকানায় আপনি টাকা পাঠাইয়া দিতে পারেন।” 

এই পত্র পাইবামাত্র মূর সাহেব কাল বিলম্ব না করিয়া নোটগুলির অবশিষ্ট অর্দ্ধ অংশ পুনরায় রেজেষ্টরি করিয়া বার্ক সাহেবের লিখিত ঠিকানায় পাঠাইয়া দিলেন। 

ইহার পর মূর সাহেব, বার্ক সাহেবের আর কোন পত্র পাইলেন না। বলা বাহুল্য—নিয়োগ-পত্ৰ প্ৰভৃতি কিছুই আসিল না। এই ব্যাপার দেখিয়া বার্ক সাহেব নিতান্ত চিন্তিত হইয়া পত্রের উপর পত্র লিখিতে লাগিলেন। কিন্তু এক খানিরও উত্তর না পাইয়া পরিশেষে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। 

এই অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত হইয়া সৰ্ব্ব প্রথম, প্রথম প্রেরিত রেজেষ্টারি পত্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। জানিতে পারিলাম যে, কলিকাতার ডাকঘর হইতে সেই পত্র একবারে বোম্বাই সহরে প্রেরিত হয়। কিন্তু বোম্বাই সহরে ডাকঘর হইতে উক্ত পত্র বার্ক সাহেবকে প্রদত্ত হয় না; কারণ সেই ডাকঘরে বার্ক সাহেব এক পত্র লিখিয়াছিলেন যে, তাঁহার নামে পত্র প্রভৃতি যাহা কিছু আসিবে, তাহা মান্দ্রাজ সহরে প্রেরিত হইবে। তাঁহার পত্রানুসারে বোম্বাই হইতে উক্ত রেজেস্টারি-পত্র মাদ্রাজে প্রেরিত হয়, ও সেই স্থান হইতে উহা বার্ক সাহেবকে প্রদান করা হয়। 

দ্বিতীয় রেজেষ্টারি পত্রের অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, পূর্ব্বের ন্যায় উক্ত পত্র বোম্বাই ডাকঘর হইয়া, মাদ্রাজ ডাক ঘরে গমন করে; ও পরিশেষে বার্ক সাহেবের পত্রানুযায়ী মাদ্ৰাজ হইতে সেই পত্র মুঙ্গেরে আসিয়া উপনীত হয়। পরে মুঙ্গেরের ডাকঘর হইতে উহা বার্ক সাহেবকে প্রদান করা হয়। 

অনুসন্ধানে আরও জানিতে পারিলাম যে, বিজ্ঞাপন সৰ্ব্ব প্রথমে কলিকাতার ষ্টেটসম্যান পত্রে প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল। উক্ত বিজ্ঞাপন বার্ক সাহেব বোম্বাই সহরের একটি হোটেলে বসিয়া প্রথম লিখিয়াছিলেন; পরে উহা প্রকাশিত হয়—কলিকাতার সংবাদ পত্রে। সেই সংবাদ পত্র দৃষ্টি করিয়া যে সকল দরখাস্ত বার্ক সাহেবের নিকট প্রেরিত হয়, তাহার কতক তিনি নাইনিতালে বসিয়া গ্রহণ করেন; কতক মসূরি পাহাড়েও প্রাপ্ত হয়েন। নীলগিরিতে তাঁহার কোনরূপ জমিদারী বা “বাঙ্গলা” প্রভৃতি কিছুই নাই। 

পরিশেষে ইহাও জানিতে পারিলাম যে, জুয়াচুরি ব্যবসাই বার্ক সাহেবের প্রধান অবলম্বন; নানারূপ জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়াই তিনি দিন যাপন করিয়া থাকেন। 

আরও জানিতে পারিলাম যে, অনেক বার জুয়াচুরি করিতে করিতে ইতিপূর্ব্বে তিনি দুই তিন বার পুলিশের হস্তে পতিত হন, এবং কারাগারের দৃশ্য ভালরূপে দর্শন করিয়া আসেন। 

মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট হইতে পূর্ব্বেই তাঁহার নামে এক ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছিল, কিন্তু তাঁহাকে ধৃত করিতে কোনরূপ কষ্টই হইল না। মুঙ্গেরে আসিবামাত্র একটি হোটেলে তাঁহাকে পাওয়া গেল। আমা কর্তৃক ধৃত হইবামাত্র তিনি তাঁহার সমস্ত দোষ স্বীকার করিলেন। পরিশেষে যখন তিনি মাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে আনীত হইলেন, তখনও তিনি তাঁহার দোষ কোনরূপে অস্বীকার করিলেন না; এক কথায় পুলিশ বলুন, উকীল বলুন, বা বিচারকই বলুন, যিনি তাঁহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহারই নিকট তাকপটে তিনি সকল কথা স্বীকার করিতে লাগিলেন। 

বার্ক সাহেব একে আসল বিলাতী সাহেব, তাহার উপর যে কোন ব্যক্তি তাঁহাকে যে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, তিনি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে লাগিলেন। সুতরাং তাঁহার উপর সকলেরই কেমন একটু দয়ার উদ্রেক হইল। সকলেই মনে করিলেন যে, উচ্চ আদালত পৰ্য্যন্ত এ আপনার দোষ স্বীকার করিয়া যাইবে। সুতরাং মাদ্রাজ, বোম্বাই, নাইনিতাল, মসূরি ও নীলগিরি প্রভৃতি দূরবর্তী স্থান সকল হইতে কোন সাক্ষী বিচারালয়ে উপস্থিত করা হইল না। কলিকাতা ও মুঙ্গেরে যে সকল সাক্ষী ছিল, কেবল মাত্র তাঁহাদিগের জবানবন্দী লওয়া হইল, এবং সেই সঙ্গে আসামীর স্বীকার-বাক্য লিখিয়া লইয়া, বিচারার্থ আসামীকে দায়রায় প্রেরণ করা হইল। এই মোকদ্দমার প্রথম সূচনা যদিচ কলিকাতাতেই আরম্ভ হইয়াছিল, কিন্তু মুঙ্গেরের মাজিষ্ট্রেটের কোর্টে এই মোকদ্দমার সত্যাসত্য প্রথম বিবেচিত হয় ও পরিশেষে মুঙ্গেরের মাজিষ্ট্রেটই এই মোকদ্দমা দায়রায় প্রেরণ করেন। 

নিয়মিত সময়ে মুঙ্গেরের দায়রা বসিলে অন্যান্য মোকদ্দমার পর জজসাহেব এই মোকদ্দমার বিচার করিতে মনস্থ করিয়া, বার্ক সাহেবকে আপনার সম্মুখে আনাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি যে অভিযোগে অভিযুক্ত, তাহাতে এখন কোন কথা বলিতে চাহ কি? কারণ আমি এখনই তোমার মোকদ্দমার বিচার করিতে প্রবৃত্ত হইব।” 

বিচারকের কথা শুনিয়া বার্ক সাহেব কহিলেন, “এ সম্বন্ধে এখন আমার অধিক কথা বলিবার নাই, কিন্তু একটি কথা আমি বলিতে ইচ্ছা করি। যদিচ আমি ইংলণ্ড-বাসী সত্য, তথাপি এদেশের আইনের বিষয় আমি উত্তম রূপে অবগত নহি; বিশেষতঃ আমি কখনও আইনের ব্যবসা অবলম্বন করি নাই, বা উত্তম রূপে আইন পাঠও করি নাই। তথাপি আমি আপনাকে এইমাত্র জিজ্ঞাসা করিতে চাহি যে, এখন যেরূপ অবস্থা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে আমার এই মোকদ্দমার বিচার করিবার ক্ষমতা আপনার আছে কি না? যে ব্যক্তি ফরিয়াদী, তিনি বলিতেছেন, কলিকাতায় বসিয়া তিনি সংবাদ-পত্রের বিজ্ঞাপন পাঠ করেন, কলিকাতা হইতেই আমার নামে টাকা পাঠাইয়া দেন। অথচ মুঙ্গেরের সাক্ষীর দ্বারা জানা যাইতেছে যে, প্রেরিত নোটের অর্দ্ধ-অংশ আমি মুঙ্গেরে বসিয়া গ্রহণ করি, এবং মুঙ্গেরে বসিয়াই উক্ত টাকার রসিদ লিখিয়া দি। এরূপ অবস্থায় আমার এই মোকদ্দমার বিচার আইন অনুসারে কোন স্থানে হওয়া আবশ্যক,—কলিকাতায় না মুঙ্গেরে? আর এক কথা,—আমি যে দেশীয় লোক, সেই দেশীয় বিচারক এবং সেই দেশীয় জুরিগণের দ্বারা আমার মোকদ্দমার বিচার হউক। এই অধিকার প্রার্থনা করিবার ক্ষমতা, বোধ হয়, আমার আছে। এই দুইটি কারণে আমার নিবেদন যে, আমার এই মোকদ্দমা বিচারার্থ কলিকাতায় প্রেরণ করা হউক।” 

বার্ক সাহেবের এই প্রার্থনা ন্যায়সঙ্গত কি না, তাহা বিচার করিবার আমাদিগের প্রয়োজন নাই। কিন্তু জজ সাহেব তাঁহার প্রার্থনা শুনিলেন, ও বিচারার্থ উক্ত মোকদ্দমা কলিকাতার দায়রায় প্রেরণ করিলেন। 

নিয়মিত সময়ে কলিকাতার দায়রায় এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল। ইংরাজ বিচারপতি, এবং সাতজন ইংরাজ ও দুইজন এদেশীয় জুরি, এই মোকদ্দমার বিচার করিবার নিমিত্ত আপন আপন আসনে উপবেশন করিলেন। প্রথমেই বিচারপতি বার্ক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার বিপক্ষে যে সকল অভিযোগ আনীত হইয়াছে, তাহাতে তুমি দোষী কি নির্দোষ?”

বার্ক সাহেব। এ মোকদ্দমায় আমি সম্পূর্ণ রূপে নির্দোষ। 

বার্ক সাহেবের এই কথা শুনিয়া সকলেই অন্ধকার দেখিলেন। কারণ সকলের মনেই দৃঢ়-বিশ্বাস ছিল যে, বার্ক সাহেব কখনই মিথ্যা কথা কহিবেন না, সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়া লইবেন। এইরূপ বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়াই নিম্ন আদালতে বিচারক এবং উকীলগণ, দূরদেশ হইতে সাক্ষীগণকে আনয়ন করেন নাই। সুতরাং যেরূপ ভাবে মোকদ্দমার প্রমাণ করান আবশ্যক, তাহার কিছুই হয় নাই। 

বার্ক সাহেব জজসাহেবকে সম্বোধন করিয়া আরও কহিলেন, “যে অভিযোগে অভিযুক্ত হইয়া আজ আমি আপনার সম্মুখে আনীত হইয়াছি, কাগজ-পত্র দেখিয়া প্রতীয়মান হইতেছে যে, সেই অভিযোগ সম্বন্ধে অনুসন্ধান একজন পুলিশ—কর্ম্মচারী দ্বারা করান হইয়াছে। তাহার অনুসন্ধান প্রকৃত কি অপ্রকৃত, তাহা আমি বলিতে চাহি না। তাহারই রিপোর্টে প্রকাশ হইতেছে যে, যে বিজ্ঞাপন দৃষ্টি করিয়া, ফরিয়াদী প্রতারিত হইয়াছেন, সেই বিজ্ঞাপন প্রথমতঃ আমা কর্তৃক বোম্বাই সহরের একটি হোটেলে বসিয়া লিখিত হয়। সুতরাং যে সময় এই অপরাধের প্রথম সৃষ্টি হইয়াছে, সেই সময় কলিকাতা হাইকোর্টের এলাকার মধ্যে কোনরূপ অপরাধ হয় নাই। যদি কোন অপরাধ হইয়া থাকে, তাহা বোম্বাই হাইকোর্টের এলাকার মধ্যে হইয়াছে। 

“দ্বিতীয়তঃ ফরিয়াদীর সহিত পত্রাদি লেখা পড়া যাহা কিছু হইয়াছে, তাহাও কলিকাতা হাইকোর্টের মধ্যে হয় নাই। কারণ নাইনিতাল, মসুরি প্রভৃতি স্থান এই মহামান্য কোর্টের এলাকাধীন নহে। 

তৃতীয়তঃ ফরিয়াদী তাঁহার জামিনের টাকার স্বরূপ যে সকল নোটের অর্দ্ধ অংশ রেজেষ্টরি করিয়া, প্রথমতঃ আমার নামে পাঠাইয়া দেন, তাহা এই হাইকোর্টের এলাকা হইতে পাঠান হইলেও মাদ্ৰাজ হাইকোর্টের এলাকায় উহা আমাকে প্রদান করা হয়। 

চতুর্থতঃ সেই সকল নোটের অপরার্দ্ধ সম্বলিত রেজেষ্টরি পত্র এই হাইকোর্টের এলাকার মধ্যস্থিত মুঙ্গেরে আমাকে প্রদত্ত হইলেও উহা কিন্তু বোম্বাই ও পরিশেষে মাদ্রাজ হইয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হয়। 

“এরূপ অবস্থায় যে সকল অপরাধে আমি অভিযুক্ত হইয়াছি, সেই সমস্ত অপরাধ এই মহামান্য হাইকোর্টের এলাকার মধ্যে না হওয়ায়, আমার এই মোকদ্দমার বিচার করিবার ক্ষমতা বোধ হয়, এই হাইকোর্টের নাই। এই সকল কারণে আমার সানুনয় নিবেদন এই যে, আমার প্রস্তাবিত বিচারটি সম্বন্ধে প্রথমতঃ ন্যায্য বিচার করিয়া তাহার পরে আমার উপর আনীত অভিযোগ সকলের বিচার করা হয়।” 

আসামীর কথা শুনিয়া সকলেই স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। সরকারী কৌন্সিলি কহিলেন, “যেরূপ অবস্থায় এই মোকদ্দমা বিচারার্থে এই স্থানে অর্পিত হইয়াছে, তাহাতে আসামীর প্রস্তাবিত বিষয়ের বিচার করিবার কোন প্রয়োজনই নাই। কারণ এই মোকদ্দমা প্রমাণিত করিতে হইলে, যে সকল সাক্ষীকে ডাকিবার নিতান্ত প্রয়োজন, দূরবর্তী স্থান-সকল হইতে সেই সকল সাক্ষীগণকে একেবারেই আনা হয় নাই। এরূপ অপ্রমাণিত অবস্থায় আদালতের অনুমতি ক্রমে আসামীর বিপক্ষ হইতে এই মোকদ্দমা উঠাইয়া লইতে আমি মনস্থ করি।” 

সরকারী কৌন্সিলির প্রস্তাবিত বিষয়ে জজসাহেব কোন প্রকার আপত্তি না করায় উক্ত মোকদ্দমা বিচারালয় হইতে একবারে উঠাইয়া লওয়া হইল। সুতরাং বার্ক সাহেব নিষ্কৃতি পাইয়া সহাস্য বদনে আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। 

ইহাকে বিজ্ঞাপনে জুয়াচুরি না বিলাতী জুয়াচুরি কহিব? 

চার – বাড়ী মেরামতে জুয়াচুরি 

ললিতমোহনের বাসস্থান এই কলিকাতা সহরেই। মৃত্যুকালে তাহার পিতা যে সকল অর্থ রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা অতি অল্প দিবসের মধ্যেই ললিতমোহন নিজের চরিত্র দোষেই নষ্ট করিয়া ফেলে। সমস্ত অর্থ নষ্ট হইয়া গেলেও তাহার চরিত্র দোষের কিছুমাত্র লাঘব হয় নাই। সুতরাং জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া তাহার নীচ প্রবৃত্তি সকলকে পরিতৃপ্ত করিতে হইয়াছিল। 

ললিতমোহন যখন প্রথম এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, সেই সময় কেবল মাত্র তাহার একজন মুসলমান অনুচর ভিন্ন আর কেহই এ কার্য্য জানিত না। এখন তাহার দেখাদেখি অনেকেই এই ব্যবসা অবলম্বন করিয়াছে। 

যাহা হউক, একদিন কোট-পেন্টলেন বা পেন্টুলেন চাপকান পরিয়া ললিতমোহন তাহার অনুচর আবদুল গফুরকে সঙ্গে লইয়া একটি ভাড়াটিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। বলা বাহুল্য, যে বাড়ীতে তাহারা প্রবেশ করিল, সেই বাড়ীর স্বত্বাধিকারীকে তাহার পূর্ব্বেই জানিয়া লইয়াছিল। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া সেই বাড়ীতে যাঁহারা বাস করেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কোন ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ করিল ও তাঁহাকে কহিল, “এই বাড়ীর কোনরূপ মেরামতের প্রয়োজন আছে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত এই বাড়ীর স্বত্বাধিকারী আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন। যদি কোন স্থানে কোনরূপ মেরামতের প্রয়োজন থাকে, তাহা হইলে আমি তাহা করিব।” 

ললিতমোহনের কথা শুনিয়া এবং তাহাকে কন্ট্রাক্টার বিবেচনা করিয়া ভাড়াটিয়া মহাশয় তাহাকে কতকগুলি মেরামতের কার্য্য দেখাইয়া দিতে লাগিলেন; কন্ট্রাক্টার বেশধারী জুয়াচোর ললিতমোহন ও মিস্ত্রী বেশধারী আবদুল গফুর তৎক্ষণাৎ তাহা আপনাদিগের পকেট বহিতে লিখিয়া লইতে লাগিল। তৎপরে মাপ লওয়া হইলে, ললিতমোহন, আবদুল গফুরকে কহিল, “মিস্ত্রী! যে যে কাৰ্য্য করিতে হইবে, তাহা তুমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছ কি?” 

আবদুল গফুর। হাঁ মহাশয়, বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। 

ললিতমোহন। এ কার্য্যগুলি কত দিবসের মধ্যে তুমি শেষ করিয়া দিতে পারিবে? 

আবদুল গফুর। দশ পনর দিবসের মধ্যেই সমস্ত কৰ্ম্ম শেষ করিয়া দিব? 

ললিতমোহন। অত দেরি করিলে কোনরূপেই চলিতে পারে না, দুই তিন দিবসের মধ্যে উহা তোমাকে শেষ করিয়া দিতে হইবে। 

আবদুল গফুর। দুই তিন দিবসের মধ্যে যে হইতে পারিবে না, তাহা আমি বলিতে পারি না। শীঘ্র কার্য শেষ করিতে হইলে, এখনই সে বিষয়ের বন্দোবস্ত করার প্রয়োজন। কারণ আজ কাল রাজ মজুর পাওয়া যেরূপ কঠিন হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা আপনি উত্তম রূপে অবগত আছেন। আমার হাতে যে সকল কাৰ্য্য ছিল, তাহা শেষ হইয়া যাওয়ায়, আমার রাজ মজুরের মধ্যে অনেককেই কল্য জবাব দিয়াছি। তাহারা অতি নিকটেই থাকে, এখনই সেই স্থানে গমন করিতে পারিলে, বোধ হয়, তাহাদিগকে পাইতে পারিব। কারণ, বোধ হয় যে, এ পর্যন্ত তাহারা অপরের নিকট নিযুক্ত হয় নাই। কিন্তু মহাশয় এক কায করুন, এখন আমাকে সামান্য দশ বিশ টাকা প্রদান করুন, সেই টাকা বায়না স্বরূপ এখনি আমি তাহাদিগকে প্রদান করিয়া আসি। 

ললিতমোহন। এ উত্তম কাৰ্য্য; কিছু টাকা আমি তোমাকে এখনই প্রদান করিতেছি, সেই টাকা লইয়া তুমি শীঘ্র গমন কর, এবং লোকজন সব ঠিক করিয়া রাখ। কল্য হইতেই যেন কার্য্য আরম্ভ হয়। 

এই বলিয়া ললিতমোহন আপনার পকেটের ভিতর কিয়ৎক্ষণ অনুসন্ধান করিয়া কহিল, “ভুলক্রমে আমি আমার মণিব্যাগ বাড়ীতে ফেলিয়া আসিয়াছি। যাহা হউক ভাড়াটিয়া মহাশয়ের নিকট হইতে আমি আপাততঃ কিছু লইয়া তোমাকে প্রদান করিতেছি।” 

এই বলিয়া ভাড়াটিয়া মহাশয়কে সকল কথা সে বুঝাইয়া বলিল ও তাঁহার নিকট হইতে আপাততঃ কিছু টাকা হাওলাত স্বরূপ চাহিল। ললিতমোহনের পোষাক পরিচ্ছদ, চেন ঘড়ি প্রভৃতি দেখিলে কেহই সহজে তাহাকে অবিশ্বাস করিতে পারেন না। কাজেই ভাড়াটিয়া মহাশয় ললিতমোহনের কথায় বিশ্বাস করিয়া কিছু টাকা আনিয়া তাহার হস্তে প্রদান করিলেন। ললিতমোহন সেই টাকা আবদুল গফুরকে প্রদান করিবামাত্র, সে দ্রুতবেগে সেই স্থান হইতে বাহির হইয়া গেল। পর দিবস প্রাতঃকালে সেই টাকা সহিত ললিতমোহন পুনরায় আগমন করিবে, এই বলিয়া ভাড়াটিয়া মহাশয়ের নিকট হইতে বিদায় লইয়া সেও প্রস্থান করিল। 

ইহার পর ভাড়াটিয়া মহাশয়, ললিতমোহন কি আবদুল গফুর কাহাকেও আর দেখিতে পাইলেন না, বা টাকাও আর ফেরত পাইলেন না। 

এইরূপ বাড়ী মেরামতের ভানে জুয়াচুরি এখন পর্য্যন্ত কলিকাতার ভিতর খুব চলিয়া আসিতেছে। 

[শ্রাবণ, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *