আবীর-জান (কামিনীর কুটিলচক্র ভেদ)

আবীর-জান (কামিনীর কুটিলচক্র ভেদ) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

ইংরাজী ১৮৭৯ সালে ফিনিক বাজার থানায় আমি একজন নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী ছিলাম। বেলসাহেব সেই থানায় আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারী ছিলেন। একদিবস সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে আমি আমার থাকিবার স্থানে বসিয়া আছি, এমন সময় একজন কনষ্টেবল আসিয়া আমাকে কহিল, “সাহেব আপনাকে ডাকিতেছেন।” 

আমি। সাহেব এখন কোথায়, এবং কোথা হইতে ডাকিতেছেন? 

কনষ্টেবল। তিনি অফিসে বসিয়া আছেন, সেইস্থানে আপনাকে ডাকিতেছেন। 

আমি। আমাকে কেন ডাকিতেছেন, তাহা তুমি কিছু বলিতে পার কি? 

কনষ্টেবল। না মহাশয়। তিনি কেন ডাকিতেছেন, আমি তাহার কিছুই অবগত নহি। 

এই বলিয়া কনষ্টেবল সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া আফিসের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, টেবিলের সম্মুখে বেলসাহেব, তাঁহার বসিবার স্থানে চেয়ারের উপর উপবিষ্ট। তাঁহার সম্মুখে টেবিলের অপর পার্শ্বে একখানি বেঞ্চির উপর দুইজন মুসলমান যুবক বসিয়া আছেন। ইহাদিগের পোষাক’ পরিচ্ছদ প্রভৃতি হঠাৎ দেখিলে বোধ হয়, ইঁহারা নিতান্ত দরিদ্র বা নীচবংশ-সম্ভূত নহেন। 

আফিসের ভিতর গমন করিবামাত্র বেলসাহেব আমাকে কহিলেন, “ইঁহাদিগের পকেট হইতে চেন ও ঘড়ী চুরি গিয়াছে, ও সেই চুরির নালিস করিবার নিমিত্ত ইঁহারা থানায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। এ সম্বন্ধে যাহা কিছু অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন বিবেচনা হয়, তাহা তুমি কর। কারণ, ইহার অনুসন্ধানের ভার আমি তোমারই হস্তে অর্পণ করিলাম। কিরূপে ইঁহাদিগের চেন ও ঘড়ী চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহার সমস্ত অবস্থা তুমি ইঁহাদিগের নিকট অবগত হইতে পারিবে। ইঁহারা যে প্রকার কহিতেছেন, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে দিবাভাগে এইরূপ প্রকাশ্য স্থান হইতে এরূপভাবে চুরি হওয়া পুলিসের পক্ষে সামান্য লজ্জার বিষয় নহে। ইঁহাদিগকে আমি যেরূপ দেখিতেছি, এবং ইহাদিগের নিকট হইতে যেরূপ অবস্থা আমি শ্রবণ করিয়াছি, তাহাতে ইহাদিগের কথার উপর অবিশ্বাস করিবার বিশিষ্ট কোন কারণ ও আমি দেখিতেছি না।” 

সাহেবের কথা শেষ হইলে, তাঁহাদিগকে সঙ্গে করিয়া যে গৃহে আমি থাকিতাম, সেই গৃহে লইয়া গেলাম। সেইস্থানে তাঁহারা উভয়ে উপবেশন করিলেন। তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, উহাদিগের একজনের নাম আবদুল আজিজ, অপর ব্যক্তির নাম জলে রসিদ; উভয়েই মেহেদি-বাগানে থাকেন। আবদুল আজিজ একজন জমীদারের পুত্র বলিয়া, আমার নিকট পরিচয় প্রদান করিলেন। তিনি কোন প্রকার কর্ম-কার্য্য করেন না, পিতাই তাঁহার সমস্ত খরচ-পত্র প্রদান করিয়া থাকেন। আর ইনিই অপহৃত চেন ও ঘড়ীর অধিকারী। অপর ব্যক্তি কহিলেন যে, তিনি মাদ্রাসা কলেজের উচ্চশ্রেণীর একজন ছাত্র, এবং আবদুল আজিজের অতীব পরিচিত বন্ধু। 

কিরূপ অবস্থায় এবং কোথা হইতে চেন ও ঘড়ী চুরি গিয়াছে, তাহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা আমার নিকট বিবৃত করিতে বলিলে, আবদুল আজিজ কহিলেন, “মহাশয়! অদ্য আহারাদি করিয়া অনুমান দিবা দশটার সময় আমরা,, উভয়েই আপন আপন বাটী হইতে বহির্গত হই। সহরের ভিতর নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে আমরা ইডেন গার্ডেনে গিয়া উপনীত হই। ইতিপূর্ব্বে আমরা অনেকবার ইডেন গার্ডেনে গমন করিয়াছিলাম, কিন্তু দিবাভাগে সেইস্থানে গমন করা আমাদিগের একবারও ঘটিয়া উঠে নাই। পূর্ব্বে আমরা যখন সেইস্থানে গমন করিয়াছি, তখনই সন্ধ্যা হয় আগত প্ৰায় হইয়াছে, না হয় সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সুতরাং উহার ভিতর ঘুরিয়া ফিরিয়া ভাল করিয়া দেখা আমাদিগের ভাগ্যে কখনই ঘটিয়া উঠে নাই। এই নিমিত্ত পরামর্শ করিয়া, আজ সকাল সকাল আহারাদি শেষ করিয়া উক্ত ইডেন গার্ডেনের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিবার মানসে আমরা বাড়ী হইতে বহির্গত হই, এবং সহরের ভিতর নানস্থানে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে সেই বাগানে গিয়া উপনীত হই। অদ্য যখন আমরা সেই বাগানের ভিতর প্রবেশ করি, তখন বোধ হয়, বেলা দ্বিপ্রহর হইবে। সেই সময় হইতে আমরা সেই বাগানের ভিতর নানাস্থানে পরিভ্রমণ করিয়া লতা, বৃক্ষ, পল্লব, জলাশয়, এবং নানাপ্রকারের সুগন্ধময় ও মনোমুগ্ধকারী সুদৃশ্য পুষ্প, লতাকুঞ্জ, প্রস্রবণ, “প্যাগোডা” প্রভৃতি যে সকল দর্শন-উপযোগী দ্রব্যাদি সেইস্থানে আছে, এক এক করিয়া তাহার সমস্তই দর্শন করিতে আরম্ভ করি। এইরূপে সেই বাগানের ভিতর ভ্রমণ করিয়া দর্শন করিতে প্রায় তিন ঘণ্টাকাল অতিবাহিত হইয়া যায়। এই তিন ঘণ্টাকাল অবিশ্রান্ত ঘুরিয়া ঘুরিয়া পরিশেষে আমরা উভয়েই নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়ি। সেই বাগানের ভিতর একটি কৃত্রিম কুঞ্জবনের সন্নিকটে একস্থানে দুইখানি বেঞ্চ রাখা আছে। যাঁহারা বাগানের ভিতর পরিভ্রমণ করিতে করিতে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়েন, তাঁহারা উহার উপর উপবেশন করিয়া শ্রান্তিদূর করিতে পারিবেন বলিয়া বোধ হয়, সেই বেঞ্চের স্থাপনা। আমরা উভয়েই নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম; সুতরাং সেই বেঞ্চের নিকটে গমন করিলাম, ও উভয়েই দুইখানির উপর উপবেশন করিলাম। সেইস্থানে কিয়ৎক্ষণ উপবেশন করিয়া, পরিশেষে আমরা উভয়েই সেই বেঞ্চের উপর শয়ন করিলাম। আমাদিগকে নিতান্ত ক্লান্ত দেখিয়া নিদ্রাদেবীও আমাদিগের উপর একটু করুণা বিতরণ করিলেন। দেখিতে দেখিতে আমরা উভয়েই নিদ্রায় অভিভূত হইয়া, অচেতন অবস্থায় সেইস্থানেই শয়ন করিয়া রহিলাম। 

“জানি না, সেইরূপ ভাবে আমরা কতক্ষণ বাগানের ভিতরস্থিত সেই বেঞ্চের উপর নিদ্রিত ছিলাম। পরিশেষে যখন আমাদিগের নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন বোধ হইল, যেন আর অধিক বেলা নাই। বেলা তখন কত, তাহা ঠিক জানিবার নিমিত্ত আমার চাপকানের পকেট হইতে আমার ঘড়ীটি বাহির করিতে গিয়া দেখি, উহাতে না আছে ঘড়ী, না আছে চেন। প্রথমে ভাবিলাম, শয়ন-কালীন পকেট হইতে উহা পড়িয়া গিয়া থাকিবে। এই ভাবিয়া সেই বেঞ্চের নিম্ন, এবং নিকটবর্ত্তী স্থান সকল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; কিন্তু ঘড়ী বা চেন কিছুরই কোনরূপ অনুসন্ধান পাইলাম না। 

“এখন মহাশয়! আমার বোধ হইতেছে, যে সময় আমরা নিদ্রিত ছিলাম, সেই সময়ে অবকাশ পাইয়া কোন্ ব্যক্তি আমার পকেট হইতে সেই ঘড়ী ও চেন নিশ্চয়ই চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় পড়িয়া আমরা থানায় আগমন করিয়াছি, চুরির নালিস করিয়াছি, এবং আপনার সাহায্যও পাইয়াছি। এখন আপনি যেরূপ ভাল বিবেচনা করেন, তাহাই করুন।” 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

আবদুল আজিজের কথাগুলি আমি একান্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। তাঁহার কথায় অবিশ্বাসোপযোগী কোন কথা নাই, বুঝিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার যে চেন ও ঘড়ী চুরি হইয়াছে বলিতেছেন, তাহা কিসের ঘড়ী, সোণার না রূপার?”

আবদুল আজিজ। সোণার নহে—রূপার। 

আমি। সেই ঘড়িটী দেখিতে কি প্রকার? 

আবদুল আজিজ। সে প্রকার ঘড়ী সাধারণ লোকে সর্ব্বদা ব্যবহার করিয়া থাকে, ইহাও সেই প্রকারের অল্প মূল্যের ঘড়ী। ইহা খোলামুখ নহে, ঢাকনাওয়ালা। কিন্তু তাহার একটু বিশেষত্ব এই আছে যে, ইহার পশ্চাদ্ভাগে কালরঙ্গের একটি প্রজাপতির চিত্র চিত্রিত আছে। 

আমি। সেই ঘড়িটা কাহার নির্ম্মিত, এবং তাহার কত নম্বর, তাহা আপনি বলিতে পারেন কি? 

আবদুল আজিজ। তাহার যে কত নম্বর, তাহা যদিও আমি বলিতে পারিব, এখন কিন্তু আমি বলিতে পারিতেছি না। আমার বাড়িতে সেই ঘড়ীর নম্বর লেখা আছে, আমি পশ্চাৎ সেই নম্বর আপনাকে প্রদান করিতে পারিব। সেই ঘড়ী কাহার দ্বারা নিৰ্ম্মিত, তাহা আমি জানি না। কিন্তু আমার বোধ হয় যে, উহা “জেনিভা” ঘড়ী। 

ফজলে রসিদ। যে ঘড়ী আজ আপনার পকেট হইতে চুরি গিয়াছে, উহা কোন্ ঘড়ী? যে ঘড়িটি সে দিবস আমি মেরামত করিয়া আনিয়া দিয়াছিলাম, এটি কি সেই ঘড়ী, আপনার কি তাহা মনে আছে? 

আবদুল আজিজ। হাঁ সেই ঘড়িটি। 

ফজলে রসিদ। উহা যদি সেই ঘড়িটি হয়, তাহা হইলে সেই ঘড়ীর নম্বর আমি এখনই বলিতে পারিব।

এই বলিয়া ফজলে রসিদ আপনার পকেট হইতে একখানি ছোট পকেট বহি বাহির করিলেন। এক এক পাত করিয়া ক্রমে উহার পাতাগুলি প্রায় সমস্ত উল্টাইলেন, ও পরিশেষে কহিলেন, “পাইয়াছি মহাশয়! উহার নম্বর ১৩৩৭২৫। সে দিবস মেরামত করিতে দিবার সময় ভাগ্যে আমি সেই নম্বর টুকিয়া রাখিয়াছিলাম।” 

উভয়ের কথা শুনিয়া পরিশেষে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, সেই ঘড়ীর এখন বর্তমান মূল্য কত?” 

আবদুল আজিজ। উহার প্রকৃত মূল্য কত, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু আমার বোধ হয়, তাহার বর্তমান মূল্য পনর কি কুড়ি টাকার অধিক হইবে না। 

আমি। চেন ছড়াটি কিসের? 

আবদুল আজিজ। তাহাও রূপার, কিন্তু সোণার গিল্টি করা। তাহার মূল্যও বোধ হয়, পাঁচ কি সাত টাকার অধিক নহে।

আবদুল আজিজের কি প্রকারে ঘড়ী হারাইয়াছে, তাহা তাঁহার নিকট অবগত হইয়া, পরিশেষে ফজলে রসিদকে সেই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। দেখিলাম, আবদুল আজিজ যে সকল কথা পূর্ব্বে বলিয়াছিলেন, উঁহার কথাও তাঁহার কথার সহিত বর্ণে বর্ণে মিলিয়া গেল। 

এইস্থানে একটি কথা আমি পাঠকগণকে পূৰ্ব্বে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। আমার গৃহে উক্ত ব্যক্তিদ্বয় গমন করিবার পর কী প্রকারে চেন ও ঘড়ী চুরি হইয়াছে, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ আবদুল আজিজকে জিজ্ঞাসা করিবার সময় ফজলে রসিদ আমার গৃহে উপস্থিত ছিলেন না। সেই সময়ে এমন এক কৰ্ম্মোপলক্ষে বাধ্য হইয়া, তাঁহাকে হঠাৎ আমার গৃহ পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল যে, সে কর্ম্ম অপর কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হইবার উপায় ঈশ্বর করিয়া দেন নাই। আবদুল আজিজের সহিত আমার কথোপকথন শেষ হইবার কিছু পূর্ব্বে ফজলে রসিদ তাঁহার সেই অরক্ষণীয় কার্য্য সম্পন্ন করিয়া আমার গৃহে প্রত্যাগমন করেন। 

উভয়ের কথায় যখন কোনরূপ অনৈক্য দেখিতে পাইলাম না, তখন ইহাদের কথায় আমার আর কোন প্রকার সন্দেহ রহিল না। আমি পুনরায় তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনারা যখন সেই বেঞ্চের উপর উপবেশন বা শয়ন করেন, সেই সময়ে সেইস্থানে অপর কোন ব্যক্তিকে দেখিতে পাইয়াছিলেন কি?” 

উভয়েই। না মহাশয়! সেইস্থানে সেই সময়ে আমরা জনপ্রাণীকেও দেখিতে পাই নাই। 

আমি। এই ঘড়ী চুরি করা সম্বন্ধে কাহারও উপর আপনাদিগের সন্দেহ হয়? 

আবদুল আজিজ। না মহাশয়! কাহারও উপর আমাদিগের সন্দেহ হয় না। এইরূপ অবস্থায় কাহারও উপর সন্দেহ কি প্রকারে হইতে পারে? 

উহাদিগের নিকট আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনায়, অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম। কিন্তু মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, ইহার অনুসন্ধান কি করিব, এবং কোথায়ই বা গমন করিয়া কাহাকে জিজ্ঞাসা করিব। 

যাহা হউক, অতঃপর থানা হইতে তাঁহাদিগের সহিত বহির্গত হইলাম। যে স্থান হইতে ঘড়ী চুরি গিয়াছে, সেই স্থানটি প্রথমে দেখিবার ইচ্ছা করিলাম। সেইস্থানে গমন করিবার দুইটি কারণ তখন মনে হইল। প্রথম,—ইঁহারা যে স্থানের কথা বলিতেছেন, সেইস্থানে একত্র দুইখানি বেঞ্চ আছে কি না! যদি থাকে, তাহা হইলে ইহাদিগের কথার সত্যতা সম্বন্ধে অনেকটা বিশ্বাস হইবে। আর যদি সেইরূপ স্থানে সেই প্রকার বেঞ্চ না থাকে, তাহা হইলে জানিব,—ইঁহারা মিথ্যা কথা কহিতেছেন। দ্বিতীয় কারণ যদি চুরি সম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ না হয়, তাহা হইলে সেই উদ্যানের মালী অথবা অপরাপর কর্মচারীগণের নিকট উত্তমরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করিব, যদি তাহারা কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে পারে। 

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে ক্রমে ইডেন গার্ডেনে গিয়া উপনীত হইলাম। তাঁহারা আমাকে উহার ভিতর একস্থানে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, তাঁহারা যেরূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন, সেইরূপ একটি সুন্দর কুঞ্জবন সেইস্থানে রহিয়াছে, ও উহার নিকট বাস্তবিকই দুইখানি বেঞ্চ স্থাপিত আছে। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া তাঁহাদিগের কথার উপর অবিশ্বাস করিবার আর কোনরূপ কারণই পাইলাম না। প্রথমে আমি সেই বেঞ্চের চতুষ্পার্শ্বে মৃত্তিকার উপর পুনরায় উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু কোনস্থানে কিছু না পাইয়া, এক এক করিয়া সেই বাগানের মালী প্রভৃতি সমস্ত কর্ম্মচারীকে একস্থানে সমবেত করাইলাম, এবং তাহাদিগের প্রত্যেককেই উত্তমরূপে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম; কিন্তু কোন ব্যক্তিই চেন ও ঘড়ি সম্বন্ধে কোনরূপ সংবাদ দিতে পারিল না, কিম্বা বলিতে পারিল না যে, সেই বাগানের ভিতর সেই সময়ে অপর কোন ব্যক্তিকে তাহারা কেহ ঘুরিয়া বেড়াইতে বা বাগান হইতে বহির্গত হইতে দেখিয়াছে। এইরূপে বাগানের ভিতর অনুসন্ধান শেষ হইয়া গেল। এখন যে অপর কি উপায় অবলম্বন করিব, তাহাই সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া ক্ষণকালের নিমিত্ত ভাবিতে লাগিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

বাগানের কোন ব্যক্তির নিকট হইতে অপহৃত চেন ও ঘড়ীর কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া ক্ষুণ্নমনে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। ভাবিলাম, এ সম্বন্ধে যতদূর অনুসন্ধান আমাদ্বারা হইতে পারে, তাহা হইল। এখন আর কোথায় গমন করিব, থানায় প্রত্যাগমন করাই উচিত। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হইল, যে সকল দোকানে ঘড়ী বন্ধক, বিক্রয় বা মেরামত হয়, সেই সকল স্থানে একবার সংবাদ দেওয়া মন্দ নহে, কারণ সেই সকল দোকানদারদিগের মধ্যে যদিও সকলে সমান নহে, তথাপি এমন অনেক দোকানদার আছে, যাঁহারা সেই দ্রব্য অপহৃত জানিতে পারিলে, তাহা কখনই গ্রহণ করেন না। অধিকন্তু সেইরূপ যদি কেহ বিক্রয় করিতে বা বন্ধক দিতে তাঁহাদিগের নিকট লইয়া যায়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাঁহারা পুলিসে সংবাদ দিয়া, সেই দ্রব্যসমেত তাঁহাকে ধরাইয়া দেন। 

এই ভাবিয়া কলিঙ্গা, ওয়েলস্লী স্ট্রীট, ধৰ্ম্মতলা স্ট্রীট, মিসন রোড প্রভৃতি স্থানীয় অনেক দোকানে সেই ঘড়ীর নম্বর লেখাইয়া দিয়া, পরিশেষে রাধাবাজারে গিয়া উপনীত হইলাম। যে সময়ে আমরা রাধাবাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময়ে রাত্রি প্রায় নয়টা। সুতরাং অধিকাংশ দোকানই বন্ধ হইয়া গিয়াছে, তথাপি কয়েকখানি দোকান খোলা ছিল। তাহাদিগকে ঘড়ীর নম্বর লেখাইয়া দিয়া সেই দিবসের নিমিত্ত অনুসন্ধান শেষ করিবার প্রস্তাব করিলাম। আমার সমভিব্যাহারী ব্যক্তিদ্বয়ও দেখিলাম, আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন এবং কহিলেন, “আজ রাত্রি ক্রমে অধিক হইয়া আসিতে লাগিল, সুতরাং আজ যে আর অধিক কিছু হইতে পারিবে, তাহা আমাদিগের বোধ হয় না। বিশেষতঃ আমরাও নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িতেছি। অতএব আজ আমরা আপন আপন স্থানে গমন করি; কল্য প্রাতঃকালে পুনরায় আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইব। সেই সময় যে প্রকার অনুসন্ধান করা আপনি ভাল বিবেচনা করেন, তাহাই করিবেন।” এই বলিয়া তাঁহারা আমাকে সেই স্থানেই পরিত্যাগ পূর্ব্বক গমন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন, আমিও তাঁহাদের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া আপনার থানা অভিমুখে গমন করিতে প্রস্তুত হইলাম। আমরা তিনজনেই সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া যেমন গমন করিব, সেই সময় ফজলে রসিদ আমাকে কহিলেন, “মহাশয়! যখন আপনি এত দোকানে সংবাদ প্রদান করিলেন, এবং যখন এতদূর আসিয়াছেন, তখন লালবাজারের যে সকল পোদ্দারের দোকান এখনও খোলা আছে, তাহাদিগকে সংবাদ দিয়া গেলে হয় না?” উত্তরে আমি কহিলাম, “যদি সোণা ও রূপার কোনরূপ অলঙ্কার হইত, তাহা হইলে ইহাদিগকে সংবাদ দিলে, কোন ফল হইলেও হইতে পারিত।” ঘড়ী লইয়া উহারা কি করিবে? 

আবদুল আজিজ। উহারা যদিও সোণা ও রূপা ক্রয় বিক্রয় করে সত্য, কিন্তু আমি জানি, চেন ও ঘড়ী ইহারা সর্ব্বদা বন্ধক রাখিয়া তাহার পরিবর্তে টাকা প্রদান করিয়া থাকে। 

উভয়ের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “যখন আমরা লালবাজারে আসিয়াছি, তখন তর্ক-বিতর্ক করিয়া মিথ্যা সময় নষ্ট করা অপেক্ষা ইহাদিগকে সংবাদ প্রদান করা মন্দ নহে।” এই বলিয়া রাধাবাজারের দিক হইতে আরম্ভ করিয়া যাহার যাহার দোকান খোলা ছিল, তাহাদিগকে ঘড়ীর নম্বর লেখাইয়া দিতে দিতে ক্রমে লালবাজারের চৌরাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময়ে লালবাজারে যে স্থানে এখন নূতন পুলিস কোর্ট হইয়াছে, তাহার সম্মুখে সারি সারি অনেকগুলি দোকান ছিল। গবর্ণমেণ্ট এই জমি ক্রয় করিয়া লওয়ার পর, এখন আর তাহার চিহ্নমাত্রও নাই। মোড়ের উপর যে দোকান ছিল, সেই দোকানে যখন আমি সেই ঘড়ীর নম্বর লেখাইয়া দি সেই সময় দেখিলাম, একজন মুসলমান যুবক আমার নিকট আসিয়া গা’ ঘেঁসিয়া দাঁড়াইল, এবং আমাকে কহিল, “ স্থাশয়! কিসের নম্বর লেখাইয়া দিতেছেন?” 

আমি। একটি ঘড়ি চুরি হইয়াছে, তাহারই নম্বর আমি লিখাইয়া দিতেছি। 

মুসলমান যুবক। সেই ঘড়িটির আকার বাহির হইতে দেখিতে কেমন? 

আমি। ঢাকনীওয়ালা রূপার ঘড়ী; উহার পশ্চাদ্ভাগে কালরঙ্গের একটি প্রজাপতির মূর্ত্তি চিত্রিত আছে। কেন মহাশয়! ইহার আকার প্রকার জানিয়া আপনার লাভ কি? 

মুসলমান যুবক। আমার লাভ কিছুই নাই, যদি আপনাদিগের কোন লাভ হয়; সেই নিমিত্তই জিজ্ঞাসা করিতেছি। সেই ঘড়ীর সঙ্গে একগাছি সোণার চেন আছে না? 

আমি। না সোণার চেন নাই, কিন্তু একগাছি রূপার চেন আছে। উহাতে সোনার গিল্টি করা। কেন মহাশয়! আপনি কি সেই চেন ও ঘড়ী কোনস্থানে দেখিয়াছেন? 

মুসলমান যুবক। দেখিয়াছি বলিয়াই, আপনাকে এত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি। 

আমি। কোনস্থানে দেখিয়াছেন মহাশয়? 

মুসলমান যুবক। উহা আমি যেখানে দেখিয়াছি, তাহা বলিলে আমার কি লাভ হইবে? উহার নিমিত্ত কোন বক্সিস আছে কি? 

আমি। চেন ও ঘড়ীর দাম অতি সামান্য, সুতরাং উহাতে আর কি বক্সিস থাকিবে? তবে যাঁহার ঘড়ী চুরি গিয়াছে, তিনি এখানেই আছেন। তাঁহার দ্রব্য পাইলে বোধ হয়, তিনি আপনাকে কিছু দিলেও দিতে পারেন। 

মুসলমান যুবক। সেই অপহৃত ঘড়ীর অধিকারী আপনাদিগের মধ্যে কে? 

আবদুল আজিজ। যে ঘড়ী চুরি গিয়াছে, উহা আমার ঘড়ী। সেই ঘড়ীর দাম অতি সামান্য; তথাপি যদি আপনার অনুগ্রহে আমি আমার চেন ও ঘড়ী প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে সেই দ্রব্যের মূল্য অনুযায়ী পারিতোষিক দিতে আমি প্রস্তুত আছি। 

মুসলমান যুবক। আপনি কি পারিতোষিক দিবেন, জানিতে পারি না কি? 

আবদুল আজিজ। আমি আপনাকে পাঁচ টাকা দিতে প্রস্তুত আছি। 

মুসলমান যুবক। যদি আমার অনুমান সত্য হয়, এবং আপনি যদি আপনার চেন ও ঘড়ী পুনরায় প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে পাঁচ টাকায় হইবে না। 

আমি। ইনি আপনাকে পাঁচ টাকা দিতে চাহিতেছেন। যদি আপনার অনুগ্রহে ইঁনি ইঁহার অপহৃত দ্রব্য পুনরায় প্রাপ্ত হন, এবং আমিও এই কষ্ট হইতে পরিত্রাণ পাই, তাহা হইলে ইনি আপনাকে যাহা প্রদান করিবেন, তাহা ব্যতীত আমিও আমার নিকট হইতে আপনাকে দুই টাকা প্রদান করিব। 

ফজলে রসিদ। মহাশয়! আমিও আপনাকে আমার নিকট হইতে তিন টাকা দিব। 

মুসলমান যুবক যখন বুঝিলেন, এই সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত তিনি এক-কালীন দশ টাকা পাইতে চলিলেন, তখন কহিলেন, “মহাশয়! আপনারা এই দোকান হইতে একটু দূরে, রাস্তার উপর আসুন। আমি যাহা অবগত আছি, তাহা আপনাদিগকে বলিয়া দিতেছি। কিন্তু মহাশয় দেখিবেন—আমার নাম যেন প্রকাশ না হয়।” 

মুসলমান যুবকের কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে একরূপ আনন্দের উদয় হইল। আর কোন কথা না বলিয়া, সেই দোকানের নিকট হইতে একবারে আমরা পথের মধ্যস্থলে গিয়া উপনীত হইলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

পথের মধ্যস্থলে গমন করিলে সেই মুসলমান যুবক কহিলেন, “মহাশয়! একটি লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে প্রায় দুইঘণ্টা কাল আমি এইস্থানে দাঁড়াইয়া আছি। রাত্রি প্রায় আটটা কি সাড়ে আটটার সময় আমি দেখিলাম যে একটি লোক পূৰ্ব্বদিক হইতে আগমন করিয়া, এই স্থানের ঐ ফুটপাথের উপর কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইল। সেই সময় দেখিলাম যে, পুলিশের ভিতর হইতে সহিসদিগের জমাদার বাহির হইয়া এই পথের উপর আসিল। সে পথে আসিয়া উপস্থিত হইবামাত্র, যে লোকটি প্রথম আসিয়াছিল, সে দ্রুতপদে তাহার নিকট গমন করিল, এবং প্রায় দশমিনিট কাল তাহার সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিল। পরিশেষে তাহার পকেট হইতে চেনসংযুক্ত একটি ঘড়ী বাহির করিয়া সেই জমাদারের হস্তে অর্পণ করিল। জমাদার সেই ঘড়ী হস্তে, যে স্থানে আমি দাঁড়াইয়াছিলাম, তাহার নিকটবর্তী গ্যাসের নিকট আসিয়া গ্যাসালোকে উহা ভালরূপে দেখিল। আমি সেই সুযোগে উহা উত্তমরূপে দেখিতে পাইলাম। আপনারা যেরূপ ঘড়ীর কথা বলেতিছেন, উহা ঠিক সেই প্রকারের ঘড়ী ও উহাতেও ঠিক সেই প্রকার প্রজাপতির চিত্র চিত্রিত আছে। ঘড়িটি উত্তমরূপে দেখিয়া ও ঘড়িটি হস্তে করিয়া, জমাদার পুনরায় পুলিসের ভিতর প্রবেশ করিল। যে ব্যক্তি ঘড়িটি আনয়ন করিয়াছিল, সেও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। পরিশেষে যে আর কি হইল, তাহা আমি অবগত নহি। আমার বিশ্বাস যে, পুলিসের সহিসদিগের সেই জমাদারকে জিজ্ঞাসা করিলে, আপনারা অনেক বিষয় অবগত হইতে পারিবেন।” 

আমি। আপনি সেই জমাদারকে চিনেন কি? 

মুসলমান যুবক। আমি যদিও উহার নাম জানি না; কিন্তু তাহাকে উত্তমরূপে চিনি। দুই সহস্র লোকের মধ্য হইতে আমি তাহাকে চিনিয়া বাহির করিতে পারি। 

আমি। সে যে সহিসদিগের প্রধান জমাদার, তাহা আপনি জানিলেন কি প্রকারে? 

মুসলমান যুবক। যে প্রকারেই আমি জানি না কেন, আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, সে সহিসদিগের জমাদার। আমি। যে ব্যক্তি ঘড়ী লইয়া আসিয়াছিল, তাহাকে আপনি চিনেন কি? 

মুসলমান যুবক। তাহাকে আমি চিনি না। ইতিপূর্ব্বে আমি যে তাহাকে আর কখন দেখিয়াছি, তাহাও আমার মনে হয় না। 

আমি। যদি আপনি পুনরায় তাহাকে দেখিতে পান, তাহা হইলে চিনিতে পারিবেন কি? 

মুসলমান যুবক। তাহাকে পুনরায় দেখিলে চিনিতে পারিব কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। কারণ, রাত্রিকালে যাহাকে একবারমাত্র দেখিয়াছি, পুনরায় তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারা নিতান্ত সহজ নহে। 

আমি। মহাশয়! ক্ষমা করিবেন, আপনার নাম কি, তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি? 

মুসলমান যুবক। আমার নাম জানিয়া আপনার প্রয়োজন কি? চলুন—আমি আপনার সঙ্গে যাইতেছি। জমাদারকে জিজ্ঞাসা করিলে ক্রমেই জানিতে পারিবেন, আমার কথা সত্য, কি মিথ্যা। বিশেষতঃ এ সম্বন্ধে মিথ্যা বলিয়া, আপনাদিগকে নিরর্থক কষ্ট দিয়া আমার লাভ কি? 

মুসলমান যুবক যখন তাঁহার নাম প্রকাশ করিতে অসম্মত হইলেন, তখন আমিও তাঁহাকে আর অধিক পীড়াপীড়ি না করিয়া, সকলকেই সঙ্গে লইয়া সেই রাত্রিতে পুলিসের ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

সেই সময় হঠাৎ আমার মনে হইল, যদি এই মুসলমান যুবকের কথা সত্য হয়, তাহা হইলে হয় ত সেই জমাদার এই চুরি-কার্যে লিপ্ত থাকিলেও থাকিতে পারে। এরূপ অবস্থায় একবারে তাহার নিকট গমন করিয়া, সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত নহে। এই ভাবিয়া যে প্রধান ইংরাজ কর্মচারীর অধীনে উহারা কর্ম্ম করে, প্রথমে তাঁহার নিকট গমন করিলাম। তাঁহার থাকিবার স্থানও সেই পুলিসের ভিতর। সেইস্থানে গমন করিয়া সংবাদ প্রদান করিলে, সেই প্রধান কর্ম্মচারী উপর হইতে নীচে আসিলেন। এই ঘটনার আদ্যোপান্ত বৃত্তান্ত তাঁহাকে এক এক করিয়া বলিলাম। আমার কথা শেষ হইলে, তিনি আমার সমভিব্যাহারী সেই মুসলমান যুবককে নানাকথা জিজ্ঞাসা করিলেন। যুবক আমার নিকট যেরূপ বলিয়াছিল, তাঁহার নিকটেও তাহাই কহিল। 

যুবকের কথায় আমার মনে যেরূপ বিশ্বাস হইয়াছিল, বুঝিলাম, সাহেবের মনেও সেইরূপ বিশ্বাস জন্মিল। সেইস্থানে একজন পুলিস প্রহরী ছিল, জমাদারকে ডাকিবার নিমিত্ত তিনি সেই প্রহরীকে প্রেরণ করিলেন। দেখিতে দেখিতে প্রহরীর সহিত জামাদার আগমন করিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। 

জমাদারকে দেখিয়া সাহেব কহিলেন, “ইনি তোমাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান কর। যদি আমি বুঝিতে পারি যে, তুমি মিথ্যা কথা কহিতেছ, তাহা হইলে, পরে তোমার যাহা হইবার, তাহা ত হইবেক, আপাততঃ এখনই আমি তোমাকে চাকরি হইতে জবাব দিব।” 

সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া জমাদার কহিল, “আমি কিসের নিমিত্ত মিথ্যা কথা কহিব? আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, করুন। আমি সে বিষয়ে যতদূর বলিতে পারিব, তাহা প্রকৃতই কহিব; মিথ্যা কথা কহিবার আমার প্রয়োজন কি?” 

জমাদারের কথা শুনিয়া সেই প্রধান ইংরাজ-কর্ম্মচারী আমাকে কহিলেন, “তুমি ইহাকে আমার সম্মুখে এক এক করিয়া সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা কর। দেখি, এ যথার্থ উত্তর প্রদান করে, কি মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগকে বঞ্চনা করিতে চেষ্টা পায়।” 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া আমি জমাদারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?” 

জমাদার। আমার নাম হোসেন বক্স। 

আমি। তুমি পুলিসের সহিসদিগের জমাদার? 

হোসেন বক্স। হাঁ মহাশয়! 

আমি। আজ সন্ধ্যার সময় তোমার নিকট কেহ কোন চেন ও ঘড়ী আনিয়াছিল? 

হোসেন বক্স। হাঁ, আনিয়াছিল। 

আমি। কে আনিয়াছিল? 

হোসেন বক্স। পীর বক্স নামক এক ব্যক্তি। 

আমি। পীর বক্স তোমার নিকট চেন ও ঘড়ী কি নিমিত্ত আনিয়াছিল? 

হোসেন বক্স। সেই চেন ও ঘড়ী বন্ধক দিয়া, কিছু টাকা কর্জ্জ লইবার মানসে আনিয়াছিল। 

আমি। সেই চেন ও ঘড়ী বন্ধক হইয়াছে? 

হোসেন বক্স। হাঁ, সে বন্ধক দিয়া গিয়াছে। 

আমি। কাহার নিকট বন্ধক দিয়াছে? 

হোসেন বক্স। আমার নিকট। 

আমি। কত টাকার বন্ধক দিয়াছে? 

হোসেন বক্স। পনর টাকায়। 

আমি। সেই চেন ও ঘড়ী এখন কোথায়? 

হোসেন বক্স। আমার নিকট আছে। 

হোসেন বক্সের কথা শুনিয়া সাহেব কহিলেন, “সেই চেন ও ঘড়ী তোমার নিকট আছে বলিতেছ। কোথায় আছে, আন দেখি।” 

সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া হোসেন বক্স সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমরা সকলেই সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরেই হোসেন বক্স চেন ও ঘড়ি সহিত আগমন করিয়া, উহা সাহেবের হস্তে প্রদান করিল। সাহেব উহা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া উত্তমরূপে দেখিলেন, এবং পরিশেষে আমার হস্তে প্রদান করিলেন। ঘড়ীর পশ্চাদ্ভাগে দেখিলাম, ফরিয়াদী যেরূপ বলিয়াছিল, সেইরূপ কালরসের প্রজাপর্তি-মূর্ত্তি উহার উপর অঙ্কিত আছে, এবং চেনের যে প্রকার গঠন বলিয়াছিল, ইহাও সেই প্রকারের চেন। সেই চেন ও ঘড়ী আমার হস্তে দেখিবামাত্র ফরিয়াদী কহিল, “আমার বোধ হইতেছে যে, এই চেন ও ঘড়ি আমার।” ফরিয়াদীর এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি ঘড়িটি খুলিলাম; উহাতে খোদিত নম্বরের সহিত আমার পকেট বহিতে লিখিত অপহৃত ঘড়ীর নম্বরের সহিত মিলাইয়া দেখিলাম, উভয় নম্বরই মিলিয়া গেল। তখন এই চেন ও ঘড়ী সম্বন্ধে আমার মনে আর কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। তাহার পর আমি হোসেন বক্সকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে পীর বক্স তোমার নিকট এই চেন ও ঘড়ী বন্ধক দিয়া গিয়াছে, তাহাকে তুমি ভালরূপে চেন কি? 

হোসেন বক্স। তাহাকে ভালরূপে চিনি, সে আমার নিজ গ্রামের লোক। 

আমি। সে এখন কোথায়? 

হোসেন বক্স। সে এখন কলিকাতায় নাই, অদ্য রাত্রিতে মেলট্রেণে সে আপনার দেশে গমন করিয়াছে। 

আমি। আজ সে দেশে গমন করিয়াছে? তাহার দেশ কোথায়? 

হোসেন বক্স। বড়বাঁকী জেলার ভিতর, কোরফা নামক একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে তাহার ঘর। 

আমি। কলিকাতায় সে কোথায় থাকিত, এবং কি করিত? 

হোসেন বক্স। সে পিরু খানসামার গলিতে বিবিজান বাড়ীওয়ালীর বাড়ীর ভাড়াটিয়া ছিল। জাহাজে কি কাজ করিত, তাহা আমি অবগত নহি। 

আমি। আজ হঠাৎ তোমার নিকট সে চেন ও ঘড়ী বন্ধক দিল কেন? 

হোসেন বক্স। আজ সন্ধ্যার পর সে আমার নিকট আগমন করিয়া কহিল, “আজ আমি আমার দেশ হইতে পত্ৰ পাইয়াছি। সেইস্থানে আমার মাতা নিতান্ত পীড়িতা, এ যাত্রা রক্ষা পান, কি না। সুতরাং আমাকে হঠাৎ বাড়ি গমন করিতে হইতেছে। কিন্তু আমার নিকট এখন প্রচুর অর্থ নাই; এই নিমিত্ত আমার এই চেন ও ঘড়ীটি কোন স্থানে রাখিয়া, যদি পনরটি টাকার সংস্থান করিয়া দিতে পার, তাহা হইলেই আমার দেশে গমন করা হয়। নতুবা টাকার অভাবে মাতার সহিত আর দেখা হইবে না।” পীর বক্সের এই কথা শুনিয়া আমার মনে নিতান্ত কষ্ট হইল। সেই সময় আমার নিকট টাকাও ছিল, সুতরাং তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া পনরটি টাকা আমি তাহাকে প্রদান করিলাম। টাকা থাকিতে এরূপ অবস্থায় বন্ধক রাখিয়াও, যদি গ্রামস্থ লোককে সাহায্য করিতে না পারি, তাহা হইলে আর আমার বাঁচিয়া লাভ কি? কেন মহাশয়! এ চেন ও ঘড়ীর কি হইয়াছে? 

আমি। এমন কিছুই হয় নাই। তবে বোধ হইতেছে তোমার গ্রামবাসী, এই চেন ও ঘড়ী চুরি করিয়া আনিয়া তোমার নিকট বন্ধক দিয়া, কিছু টাকার সংস্থান পূর্ব্বক প্রস্থান করিয়াছে। 

হোসেন বক্স। চুরি করিয়া আনিয়াছে! সে যে চোর, তাহা ত আমি জানিতাম না। 

আমি। জান আর নাই জান, তাহার সন্ধান করিবার নিমিত্ত আমাদিগকে এখন তোমায় সাহায্য করিতে হইবে। ইহা ব্যতীত এখন দেখিতেছি, তোমার সেই টাকা পনরটিও এখন মারা যায়। 

এই বলিয়া আর কালবিলম্ব না করিয়া, সাহেবের অনুমতিতে হোসেন বক্সকে সঙ্গে লইলাম, এবং পিরু খানসামার গলির যে বাড়ীতে পীর বক্স থাকিত, সেই বাড়ীতে গমন করিলাম। সেইস্থানে সন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, বাস্তবিকই পীর বক্স আজ দেশে যাইবার নাম করিয়া, সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াছে। 

চুরি-মোকদ্দমার আসামী পাইলাম না সত্য; কিন্তু মালের সন্ধান পাইয়া এই মোকদ্দমার সুবিধা হওয়ায়, মনে মনে আমার যে কিরূপ আনন্দ হইল, তাহা প্রকাশ করিতে আমি অক্ষম। লেখক যে ব্যবসায়ী, সেই ব্যবসায়ী যদি কোন পাঠক থাকেন, তাহা হইলে তিনিই আমার মনের ভাব কতক পরিমাণে বুঝিতে পারিবেন, অপর পাঠকের মনে সে ভাবের কখনই উদয় হইবে না। 

এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মুসলমান যুবকও আমাদিগের সঙ্গে ছিলেন। আমাদিগের আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিবার উদ্যোগ দেখিয়া তিনি কহিলেন, “মহাশয়! আমার কার্য্য ত শেষ হইয়া গিয়াছে। আপনার অপহৃত চেন ও ঘড়ী এখন প্রাপ্ত হইলেন; কিন্তু এখন আর বিলম্ব করিতেছেন কেন? আপনাদিগের অঙ্গীকৃত পুরস্কারের টাকা আমাকে প্রদান করিলে, আমিও আপন স্থানে প্রস্থান করিতে পারি।” 

যুবকের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আপনার পুরস্কার কোনস্থানে যাইবে না। এখন আমাদিগের কাহারও সহিত টাকা নাই, থাকিলে এখনই উহা আপনাকে প্রদান করিতাম। কল্য বৈকালে আপনি আমার নিকট আগমন করিবেন, আমি অঙ্গীকৃত সমস্ত টাকাই আপনাকে প্রদান করিব।” আমার কথায় যুবক সম্মত হইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। আমরা সেই রাত্রির মত অনুসন্ধান শেষ করিয়া আপন আপন স্থানে গমন করিলাম 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

ফরিয়াদী ও তাহার সঙ্গী আমাকে সেইস্থানে পরিত্যাগ করিয়া, আপন আপন আলয়ে গমন করিবেন এইরূপ বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন। নাম প্রকাশ করিতে অনিচ্ছুক মুসলমান-যুবকও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেন। আমিও সেইস্থান হইতে থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। দেখিলাম, বেলসাহেব অফিসে বসিয়া লেখা-পড়া করিতেছেন। আমি তাঁহার নিকট গমন করিয়া সেই চেন ও ঘড়ী তাঁহার হস্তে অর্পণ করিলাম, এবং যেরূপভাবে অনুসন্ধান করিতে করিতে সেই চেন ও ঘড়ী প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহার আদ্যোপান্ত সমস্ত কথা এক এক করিয়া তাঁহাকে কহিলাম। তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং কহিলেন, “আগামী কল্য রবিবার ও তাহার পর দুইদিবস কাছারী বন্ধ আছে, এই তিন দিবস সহরের ভিতর উত্তমরূপে পীর বক্সের সন্ধান কর। যদি পাও ভালই, না পাও, তা যে দিবস কাছারী খুলিবে, সেই দিবস তাহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া, তাহার দেশে পাঠাইয়া দিব। যদি সে প্রকৃতই দেশে গিয়া থাকে, তাহা হইলে সেইস্থানের পুলিস তাহাকে ধরিয়া এইস্থানে পাঠাইয়া দিবে।” বেলসাহেব এই কথা বলিয়া পুনরায় আপন কার্য্যে মনঃসংযোগ করিলেন। আমিও আমার থাকিবার স্থানে গমন করিয়া আহারাদি করিয়া শয়ন করিলাম। 

পরদিবস দিবা এগারটার সময় আহারান্তে ফরিয়াদী আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া পীর বক্সের অনুসন্ধানে পুনরায় বহির্গত হইলাম। প্রথমে পুলিসে গিয়া সেই জমাদারকে সঙ্গে লইলাম, এবং পরিশেষে সহরের নানাস্থানে তাহার অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু কোনস্থানেই তাহার সন্ধান না পাইয়া, সন্ধ্যার সময় থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। 

থানায় আসিয়া দেখি যে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মুসলমান-যুবক আসিয়া আমাদিগের অপেক্ষায় বসিয়া আছে। তাহাকে দেখিবামাত্র ফরিয়াদী কহিলেন, “তুমি তোমার পারিতোষিকের নিমিত্ত আসিয়া এখানে বসিয়া আছ? যাহা দিব বলিয়া আমরা অঙ্গীকার করিয়াছি, তাহা তুমি প্রাপ্ত হইবে। আর যদি আমার কথায় তোমার বিশ্বাস না হয়, তাহ হইলে সেই টাকা এখনি আমি তোমাকে প্রদান করিতেছি। কারণ, আজ আমি তোমার বিষয় ভুলি নাই, বাড়ী হইতে আসিবার কালীন তোমার টাকা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।” এই বলিয়া পকেট হইতে দশটি টাকা বাহির করিয়া তিনি তাহার হস্তে অর্পণ করিলেন। 

উহাকে দশ টাকা প্রদান করিতে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি মহাশয়! আপনি সমস্ত টাকাই কি প্ৰদান করিলেন?” 

আবদুল আজিজ উত্তরে কহিলেন, “দশ টাকাই আমি প্রদান করিলাম। আমার কার্য্যের নিমিত্ত আপনারা নিজ অর্থ প্রদান করিবেন, তাহা কি কখন হইতে পারে?” 

আবদুল আজিজের কথা শুনিয়া ভাবিলাম, ‘হইতে পারে’ বা না পারে, আমার পকেট হইতে যে দুই টাকা বাহির করিতে হইল না, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। 

মুসলমান-যুবক টাকা কয়েকটি পাইয়া একান্ত পুলকিত চিত্তে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। সে দিবস অধিক আর কিছু হইতে পারিবে না দেখিয়া, আবদুল আজিজও তাঁহার পশ্চাদ্‌গামী হইলেন। জমাদার ইতিপূৰ্ব্বেই চলিয়া গিয়াছিল। 

রবিবার এইরূপে গত হইল। তাহার পরদিবসও সেইরূপভাবে সহরের ভিতর নানাস্থানে পীর বক্সের অনুসন্ধান করিতে করিতে অতিবাহিত করিলাম। কিন্তু সহরের ভিতর যে সে আছে, সেই সম্বন্ধে কোন স্থানেই তাহার সন্ধান পাইলাম না। বরং আরও ইহাই জানিতে পারিলাম যে, পীর বক্স নিশ্চয়ই শনিবারের মেলট্রেণে আপন দেশে প্রস্থান করিয়াছে। 

সেইদিবস বেলসাহেব ফরিয়াদীর সহিত পরামর্শ করিলেন। বেলসাহেব পূৰ্ব্বে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই স্থির হইল, অর্থাৎ যে দিবস কাছারী প্রথমে খুলিবে, সেইদিবস পীর বক্সের নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া, তাহার দেশে পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে। 

যখন এই পরামর্শ স্থির হইল, সেই সময়ে ফরিয়াদীর মনের ভাব দেখিয়া আমি অনুমান করিলাম, পীর বক্সের নামের ওয়ারেন্ট লইয়া যদি কোন পুলিস কর্ম্মচারী এইস্থান হইতে তাহার দেশে গমন করে, ও সেইস্থানে উহাকে ধৃত করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করে, তাহা হইলে যে কিছু ব্যয় হইবে, তাহার সমস্ত ভারই ফরিয়াদী তাহার নিজের স্কন্ধের উপর বহন করিতে প্রস্তুত। এ ইচ্ছা কিন্তু ফরিয়াদীর অন্তরে থাকিলেও, কাৰ্য্যে কিছুই হইল না। ডাকযোগে ওয়ারেন্ট পাঠানই বেলসাহেব স্থির করিলেন। 

আমাদিগের এই পরামর্শ স্থির হইলে, ফরিয়াদী তাঁহার নিজের বাটীতে যাইবার নিমিত্ত সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন। যাইবার সময় ইহা স্থির হইল যে, বুধবারের প্রাতঃকালে তিনি আমাদিগের থানায় আগমন করিবেন, ও সেইস্থান হইতে আমাদিগের সহিত একত্র বিচারালয়ে গমন করিবেন। 

আমি আমার নিয়মিত কার্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া শয়ন করিলাম। অন্য দিবস নিদ্রাদেবী আমাকে যেরূপ অনুগ্রহ করিয়া থাকেন, আজ কিন্তু তাহা করিলেন না। অনেক চেষ্টা করিয়াও আজ নিদ্রাদেবীর শরণ লইতে সমর্থ হইলাম না। কি কারণে জানি না, নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া আমার হৃদয় অধিকার করিল। অনেক প্রকারের চিন্তার পর হঠাৎ আমার মনে হইল, সেই ঘড়ী চুরি মোকদ্দমার ফরিয়াদী এরূপ ব্যবহার করিলেন কেন? পনর কি কুড়ি টাকা মূল্যের দ্রব্যের নিমিত্ত এক কথাতেই দশ টাকা পারিতোষিক প্রদান করিলেন। তাহার উপর দেখিতেছি, এইস্থান হইতে কৰ্ম্মচারী পাঠাইয়া ন্যূনাধিক শত টাকা ব্যয় করিয়া আসামীকে ধরিয়া আনিতেও প্রস্তুত। ইনি এই সামান্য দ্রব্যের নিমিত্ত এত টাকা ব্যয় করিতে প্রস্তুত কেন? কে বলিবে কেন, কে তাঁহার অন্তরের কথা জানে যে, আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইবে, তবে যদি সাধারণের হিতের নিমিত্ত আপনার অর্থ ব্যয় করিয়া, সেই অসাধারণ সাহসী চোরকে উত্তমরূপে শিক্ষাপ্রদান করিতে তিনি প্রবৃত্ত হন, তাহা হইলেই হইতে পারে। নতুবা তাঁহার অপর কোন অভিসন্ধি আমাদিগের এই সামান্য বুদ্ধির সম্মুখে এখন পর্য্যন্ত উপস্থিত হইতেছে না। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

মঙ্গলবার দিবা দশটার সময় আমি থানার ভিতরেই আমার থাকিবার স্থানে উপবিষ্ট, এমন সময়ে ডাকপিয়ন আসিয়া উপস্থিত হইল। পিয়নটি নূতন লোক। সে আমার নিকট আগমন করিয়া আমাকেই জিজ্ঞাসা করিল, “প্রিয়নাথ কা’র নাম?” উত্তরে কহিলাম, “আমারই নাম। কেন?” পিয়ন আর কোন কথা না বলিয়া, আমার হস্তে একখানি পত্র দিয়া প্রস্থান করিল। 

পত্র পাইয়া ভাবিলাম, বাড়ির পত্র; সুতরাং উপর ভাল করিয়া না দেখিয়াই উহা খুলিয়া ফেলিলাম, ও একান্ত ব্যগ্রঅন্তঃকরণে উহা পাঠ করিলাম; কিন্তু কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। পুনরায় পাঠ করিলাম, তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া আবার পড়িলাম। উহা নিতান্ত ক্ষুদ্র পত্র, তাহাতে কেবলমাত্র লেখা ছিল। “তোমার বুদ্ধিকে ধন্যবাদ। আর তোমারই বা দোষ কি, একের দোষ অপরের স্কন্ধে চাপানই তোমাদিগের কর্ম। চিৎপুর রোডের আবীর-জান বাইজীর নামও কি কখন শুন নাই।” 

এ পত্রের অর্থ কি? কোথা হইতে বা কাহার দ্বারা এই পত্র লিখিত, তাহাও জানিবার উপায় নাই। যদি উহাতে লেখকের নাম ও ঠিকানা থাকিত, তাহা হইলে সেইস্থানে গমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেই ইহার অর্থ বুঝিতে পারিতাম! কিন্তু যখন তাহা নাই, তখন সে উপায়ও নাই। আমি সম্প্রতি এমন কি বুদ্ধির কার্য্য করিয়াছি, যাহাতে লেখক আমাকে ধন্যবাদ করিতেছেন। গত ছয় মাসের মধ্যে আমার যতদূর স্মরণ আছে, তাহাতে একের অপরাধ অপরের মস্তকে যে চাপান হইয়াছে, তাহা ত আমি দেখিতেছি না। এক ঘড়ী চুরির মোকদ্দমা আপাততঃ আমার হস্তে। ইহাতেই বা কি করিয়া বলি, পীর বক্স অপরাধী নহে। ফরিয়াদী বা তাহার কোন লোক পীর বক্সের নাম পর্যন্তও লয় নাই। নিঃস্বার্থভাবে অনুসন্ধান করিতে করিতে অপহৃত দ্র বাহির হইয়াছে, তাহাও আবার পীর বক্সের স্বগ্রামবাসী লোকের নিকট হইতে। যদি জমাদারের কথা বিশ্বাস করিতে হয়, তাহা হইলে কি প্রকারে বলি, পীর বক্সের দ্বারা এই কাৰ্য্য হয় নাই। যখন হঠাৎ এই পত্র পাইলাম, তখন ইহা যদি বর্ত্তমান ঘড়ী চুরি সম্বন্ধেই প্রযুজ্য হয়, তাহা হইলে জমাদারকে কতদূর বিশ্বাস করিতে পারা যায়, তাহাও একবার সবিশেষরূপ চিন্তা করা উচিত। যদি এরূপ হয় যে, জমাদার নিজেই তাহা চুরি করিয়াছে; আর যখন দেখিয়াছে—পুলিস অনুসন্ধান করিতে করিতে তাহার নিকট পর্য্যন্ত অসিয়া উপস্থিত, তখন চেন ও ঘড়ীর বিষয় হঠাৎ অস্বীকার করিতে পারে নাই। কারণ, সে সেই সময় মনে মনে জানিত, যদি তাহার বাক্স অনুসন্ধান করা হয়, তাহা হইলে সেই চেন ও ঘড়ি তাহার বাক্স হইতে বাহির হইবে; সুতরাং সেই সময়ে তাহার নির্দোষতা প্রমাণের কোন কথাই আর খাটিবে না। এই প্রকার ভাবিয়া হয়ত সে মিথ্যা করিয়া পীর বক্সের নাম বলিয়া দিয়াছে। কারণ, পীর বক্স যে সেই দিবস আপনার দেশে গমন করিয়াছে, ইহা স্থির; অথচ জমাদারের পক্ষে আপনার গ্রামের লোকের দেশ-গমনের সংবাদ রাখা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব নহে। যদি আমার এই অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে একের দোষ অপরের স্কন্ধে পড়িতে পারে সত্য; কিন্তু যে পর্য্যন্ত পীর বক্সকে না পাওয়া যায়, সেই পৰ্য্যন্ত তাহাই বা কি প্রকারে বিশ্বাস করিয়া লইতে পারি? অপরন্তু কিরূপে আমরা এই ঘড়ির সন্ধান পাইলাম, তাহা যদি একটু স্থির অন্তঃকরণে ভাবিয়া দেখা যায়, যদি সেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুসলমান যুবকের কথা বিশ্বাস করিতে হয়, তাহা হইলে জমাদারকে চোর বলিয়াই বা কি প্রকারে স্থির করি? যখন সেই মুসলমান যুবক হাতে হাতে তাহার কথার সত্যতা প্রমাণ করিয়া দিয়াছে, তখন তাহাকে অবিশ্বাস করি কি প্রকারে? তবে একটি বিষয় নিতান্ত অসম্ভব নহে—মুসলমান যুবকের কথা যখন মিথ্যা ভাবিতে পারিতেছি না, তখন হয় ত তাপর আর এক ব্যক্তি সেই চেন ও ঘড়ী আনিয়া জমাদারকে অর্পণ করিয়াছে। জমাদার তাহাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত তাহার নাম গোপন করিতেছে; অথচ যে পীর বক্সের দেশ-গমনের বিষয় সে অবগত আছে, সেই পীর বক্সের নাম করিয়া, যে পর্য্যন্ত পাঁর বক্স ধৃত না হয়, সেই পর্যন্ত আমাদিগের চক্ষুতে ধূলিনিক্ষেপ করিতেছে। 

ভাল, এই সকল অনুমানকেই মনে মনে স্থান দিলাম; কিন্তু চিৎপুর রাস্তায় আবীর-জান বাইজীর নাম ইহার মধ্যে আসিল কি প্রকারে? এই চেন ঘড়ী, আসামী ফরিয়াদী, প্রভৃতি কাহারও সহিত আবীর-জানের কোনরূপ সম্বন্ধই দেখিতেছি না। 

যাহা হউক, আবীর-জানকে একবার দেখা মন্দ নহে। কিন্তু তাহাকে কি ভাবে দেখা যাইতে পারে? এই মোকদ্দমায় আবীর-জান কিরূপ ভাবে সংলিপ্ত, তাহা এই পত্র দেখিয়া অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব। যে পৰ্য্যন্ত জানিতে না পারা যাইবে, –––এই মোকদ্দমার সহিত আবীর-জানের কিরূপ সম্বন্ধ আছে, সে আসামী, কি ফরিয়াদী কোন্ পক্ষের মঙ্গলাকাঙ্খী, সেই পর্য্যন্ত তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে না। 

এই প্রকার নানা ভাবনা ভাবিতে দিবা প্রায় দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গেল। পরিশেষে একবার ভাবিলাম, এইরূপ বেনামী পত্র দুষ্টলোকে সর্ব্বদাই লিখিয়া থাকে। সুতরাং এ সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, অন্য কোনরূপ অনুসন্ধান করি, বা না করি, যখন আবীর-জানের নাম জানিতে পারিতেছি, তখন তাহার সম্বন্ধে গোপনে একটু অনুসন্ধান করা মন্দ নহে। তাহাতে আমাদিগের কোনরূপ অনিষ্টাশঙ্কা হইবার সম্ভাবনা নাই, বরং কোনরূপ ইষ্ট হইলেও হইতে পারে। বিশেষতঃ পীর বক্সের সহিত যদি আবীর-জানের জানা শুনা থাকে, তাহা হইলে হয়ত দেশে না গিয়া, পীর বক্স তাহার গৃহেই লুক্কায়িত অবস্থায় থাকিলেও থাকিতে পারে। যাহা হউক, আবীর-জান নাম্নী যদি কোন বাইজী থাকে, তাহা হইলে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করাই এখন আমার প্রথম কৰ্ত্তব্য। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

আমি যে সময়ে পিয়নের নিকট হইতে সেই পত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, সেই সময়ে বেলসাহেব থানায় উপস্থিত ছিলেন না। তিনি প্রত্যাগমন করিলে তাঁহাকে আমি সেই পত্রের কথা কহিলাম, এবং মনে মনে আমি যে প্রকার সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, তাহাও তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলাম। দেখিলাম, তিনিও আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, আমার মতেরই অনুমোদন করিলেন। 

সেই দিবস আহারান্তে আমি থানা হইতে একাকী বহির্গত হইয়া, চিৎপুর রোডে গিয়া উপনীত হইলাম। মেছুয়া বাজারের সন্নিকটে চিৎপুর রাস্তার পশ্চিমপার্শ্বে সারি সারি কয়েকখানি জুতার দোকান আছে। সেই দোকানদারদিগের মধ্যে একজনের সহিত আমার চেনা শুনা ছিল। আমি যখন সেই দিকে গমন করিতাম, তাহারই দোকানে গিয়া কিয়ৎক্ষণ উপবেশন করিতাম। সেই দোকানদারে নাম খইরূদ্দিন। আজও সেইস্থানে গিয়া আমি উপবেশন করিলাম, এবং খইরূদ্দিনের সহিত নানারূপ কথাবার্তার পর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি বলতে পার, আবীর-জান বাইজী এইস্থানের কোন বাড়ীতে থাকে?” উত্তরে খইরুদ্দিন কহিল, ‘না, আমি তাহা জানি না। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আমি তাহার সন্ধান বলিয়া দিতে পারিব। আপনি আমার দোকানে বসিয়া থাকুন, যাহার নিকট হইতে সমস্ত সংবাদ পাইবেন, তাহাকে একটু পরেই এই রাস্তার উপর দেখিতে পাওয়া যাইবে। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে আপনি তাহার সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিবেন।” খইরুদ্দিনের প্রস্তাবে আমি সম্মত হইয়া সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। ক্রমে অপরাহ্ন চারিটা বাজিয়া গেল। 

দিবা অনুমান সাড়ে চারিটার সময় খইরূদ্দিন একটি বৃদ্ধ মুসলমানকে দেখাইয়া দিয়া আমাকে কহিল, “ঐ আসিতেছে।” এই বলিয়া পথের উত্তর দিকে মুখ করিয়া দুই তিন বার ডাকিল “মিরসাহেব! এদিকে আইস, মিরসাহেব! এদিকে আইস।’ 

দেখিতে দেখিতে একটি নিতান্ত বৃদ্ধ মুসলমান আসিয়া খইরূদ্দিনের দোকানের সম্মুখে উপস্থিত হইল। 

এই বৃদ্ধের অবস্থা এবং যে কার্য্য করিয়া সে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া থাকে, তাহা জানিবার পূর্ব্বে পাঠকগণ আপনারা উহার অবয়ব একবার দেখিয়া লউন। ইহার বয়ঃক্রম আমার বিবেচনায় সত্তর পঁচাত্তর বৎসরের কম হইবে না। গোঁপ, দাড়ি ও লম্বা লম্বা চুল দেখিয়া কেহ অনুমান করিতে পারেন না যে, কখন ইহা কৃষ্ণবর্ণ ছিল। বর্ণ—উজ্জ্বল শ্যাম, গঠন পাতলা ও কিছু লম্বা; কিন্তু এখন তাহার দেহের সরলভাব বক্রভাবে পরিণত হইয়াছে। বার্দ্ধক্য—সুলভ নিয়মে তাহার কোমর ভাঙ্গিয়া পড়ায়, তাহার মস্তক এখন আর মৃত্তিকা হইতে তিন ফুটের অধিক উচ্চ নহে। যষ্টির আশ্রয় না লইলে, এখন আর বৃদ্ধ পদমাত্র চলিতে সমর্থ হয় না। এই ত গেল তাহার বর্ত্তমান আকৃতি। পোষাকের বিষয় যাহা আমি সেই সময়ে স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছিলাম, তাহাই বলিতেছি। উহার পরিধানে লংক্লথের চুড়িদার পায়জামা। অঙ্গে সাদা ফুরফুরে তাঞ্জেবের একটি চাপকান, উহার মধ্যে মধ্যে সোনার জরিতে বোনা ছোট ছোট গোলাপ ফুল ঝক্‌ ঝক্ করিতেছে, এবং এই চাপকানের পকেট হইতে, একখানি লালবর্ণের রুমালের চাবি অঙ্গুলি পরিমাণ বাহিরে ঝুলিতেছে। মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে অর্দ্ধহস্ত পরিমিত লম্বিত সেই শ্বেতবর্ণের কেশের উপর সুবর্ণ—খচিত ও সবিশেষ চাক্‌চিক্যময় একটি গোল টুপি বা তাজ। পায় একজোড়া জরির লক্কাদার দিল্লীর জুতা, হাতে লালবর্ণের একগাছি খুব মজবুত বাঁশের ছড়ি বা লঠি। কিন্তু উহার নানাস্থানে চাঁদির কাজ করা। লাঠি গাছটি অধিক লম্বা নহে, উহাতেই ভর দিয়া বৃদ্ধ নানাস্থানে গমনাগমন করিয়া থাকে। 

এই ত ইহার পোষাক পরিচ্ছদাদি স্বচক্ষে দেখিলাম; কিন্তু পরে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছিলাম, উহার বাসস্থান লক্ষ্মৌ সহরে। ইহার নাম কেহই অবগত নহে। তবে সকলেই ইহাকে মিরসাহেব বলিয়া ডাকে; সুতরাং ইনি মিরসাহেব নামেই পরিচিত। বহুকাল হইতে ইনি আপনার বাসস্থান লক্ষ্মৌনগরী পরিত্যাগ করিয়া, কলিকাতায় বাস করিতেছেন। ইঁহার কার্য্যের মধ্যে—সকাল বৈকাল সকল সময়েই চিৎপুর মেছুয়াবাজার বা ফৌজদারী বালাখানায় বাইজী-মহলে ঘুরিয়া বেড়ান। কোন্ বাইজী কোথা হইতে আসিল, কোন্ বাইজী কোথায় গমন করিল, কোন্ ব্যক্তি কোন্ বাইজীর নিকট যাতায়াত করে, কে কোন্ বাইজীর নিমিত্ত কিরূপ লোলুপ, প্রভৃতি সমস্ত তত্ত্ব রাখাই ইঁহার কার্য্য। ইঁহার আরও প্রধান কার্য্য, চিৎপুর রাস্তায় বৈকাল হইতে রাত্রি দশটা এগারটা পর্য্যন্ত ঘুরিয়া বেড়ান। কোন বাইজীর নিকট গমনেচ্ছুক ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া, তাহাকে পথ দেখাইয়া সেই বাইজীর ঘরে লইয়া যাতায়াত, ইঁহার আর একটি প্রধান কার্য্য। এই কার্য্যের উপর নির্ভর করিয়া হয় বাইজীর নিকট, বা সেই সকল আগন্তুকের নিকট যাহা প্রাপ্ত হন, তাহা দ্বারাই আপনার জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন। 

যাহা হউক মিরসাহেব খইরূদ্দিনের দোকানের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলে, তিনি আমার সহিত মিরসাহেবের পরিচয় করিয়া দিলেন, এবং যে সকল বিষয় অবগত হইতে চাহি, সেই সকল বিষয় আমাকে বলিয়া দিবার নিমিত্ত তাহাকে উপরোধ করিলেন। খইরূদ্দিনের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, মিরসাহেব আমার নিকট উপবেশন করিল। আমার প্রয়োজনোপযোগিনী অনেক কথা এক এক করিয়া আমি মিরসাহেবকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, এবং সময়ে সময়ে অনেক বাজে কথাও আনিয়া তাহার ভিতর ফেলিলাম। মিরসাহেব আমার প্রত্যেক কথারই উত্তর, তাহার সাধ্যমত প্রদান করিতে লাগিল, এবং এক কথা বলিতে গিয়া তাহার সঙ্গে অনেক প্রকারের কথা, অনেক প্রকারের গল্প, আনিয়া উপস্থিত করিল। কিন্তু সমস্ত কথা বা গল্প, কেবল বাইজী-ঘটিত। এইরূপে মিরসাহেবের সহিত অনেক কথাবার্তার পর, আমি জানিতে পারিলাম, আবীর-জান বাইজীর থাকিবার স্থান চিৎপুর রাস্তার উপর মসজিদের ঠিক সম্মুখে। আবীর-জান সম্বন্ধে বৃদ্ধের নিকট হইতে আরও যে সকল কথা আমি ক্রমে শুনিতে পাইলাম, তাহাতে ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার বুদ্ধিলোপ পাইল, আমি যেন পাগলের ন্যায় হইলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ 

মিরসাহেব কহিল, “আবীর-জান বেগম অতি অল্পদিবস হইল, কলিকাতায় আগমন করিয়াছে। আমার বোধ হয় তাহার কলিকাতায় বাস-কাল, এখনও দুই বৎসর পূর্ণ হইয়াছে, কি না সন্দেহ। ইহার পূর্ব্বে সে থাকিত দিল্লীতে। দিল্লী হইতে আসিবার কিছুদিবস পর হইতেই সে বর্তমান বাড়ীতে বাস করিতেছে। দিল্লী হইতে যখন সে এইস্থানে আগমন করে, তখন তাহার সঙ্গে জহরনাম্নী একটি বালিকা ও একজনমাত্র পরিচারিকা ব্যতীত অপর আর কেহই ছিল না। সে কলিকাতায় আসিয়া, প্রথমে কয়েক দিবস কলুটোলায় মেহের-জানের বাড়ীতে ছিল। এই মেহের-জানের সহিত আবীর-জানের প্রথম হইতে জানাশুনা ছিল। কলিকাতায় আগমন করিবার পরামর্শ যখন তাহার স্থির হয়, সেই সময়ে পত্র দ্বারা দিল্লী হইতে সে মেহেরজানের মত জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠায়। মেহেরজান তাহার মতে মত দিয়া, এই স্থানে আসিতে অনুরোধ করিলে, আবীর-জান আপনার পালিতা কন্যাটিকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতায় আগমন করে, এবং মেহের-জানের বাড়ীতেই কয়েক দিবস অবস্থিতি করে। পরিশেষে তাহার বর্ত্তমান বাড়ি স্থির হইলে, মেহেরজানের বাড়ী হইতে নূতন ঘরে উঠিয়া আইসে। 

“আবীর-জান বাইজীর বয়ঃক্রম এখন প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর হইয়াছে, শরীরও কিছু স্থূল হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু তাহার গলার স্বর কিছুমাত্র বিকৃত হয় নাই। দূর ইহতে তাহার গীত শ্রবণ করিলে কে বলিতে পারিবে যে, এই গীতধ্বনি কোন অষ্টাদশ বৎসর বয়স্কা রমণীর কণ্ঠ হইতে বহির্গত হইতেছে না। আবীর-জানের সঙ্গে যে কন্যাটি আসিয়াছিল, সে অতিশয় কুশ্রী না হউক, কিন্তু তাহাকে কুরূপা বলা যায় না। অধিকন্তু সেই প্রকারের বালিকা অনেক ভদ্রলোকের ঘরেও সহজে খুঁজিয়া পাওয়া সহজ নহে। যখন প্রথম সে আগমন করে, তখন তাহার বয়ঃক্রম ছিল—-এগার কি বার বৎসর। এখন জহরের বয়ঃক্রম বোধ হয়, তের বা চৌদ্দ বৎসরের কম নহে। আবীর-জানের গলার স্বর যেরূপ মিষ্ট ও সুশ্রাব্য, সে যেরূপ গীতবাদ্যে নিপুণ, সে জহরকেও সেইরূপ কোকিল-কণ্ঠী ও তৌর্য্যত্রিক-নিপুণা করিয়া তুলিয়াছিল। ইহারই মধ্যে কলিকাতায় জহরের নাম ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িতেছিল। কিন্তু আবীর-জানের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন নহে বলিয়াই, তাহার এই দশা ঘটিয়াছে। 

“প্রায় দুই বৎসরকাল আবীর-জান এইস্থান অবস্থিতি করিতেছে। ইহার মধ্যে কতলোক যে তাহার বাড়ীতে গমনাগমন করিয়াছে, তাহার সংখ্যা কে করিতে পারে? উহারা সকলেই যে সুমধুর গীতধ্বনি শ্রবণে নিৰ্ম্মল আনন্দের উপভোগ করিতে এইস্থানে আগমন করিত, তাহা নহে। অনেকের লক্ষ্য ছিল—সেই জহরের উপর। 

“সেই সকল ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই জহরকে লইয়া, আবীর-জানের বাড়ী হইতে প্রস্থান করিবার চেষ্টা করিয়াছিল; কিন্তু আবীর-জানের কঠোর শাসনে কেহই তাহাতে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিয়াছিল না। যাহা হউক, অদ্য তিন চারি দিবসমাত্র গত হইল, উহাদিগের মধ্যে কে তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইয়াছে। রাত্রিকালে আবীর-জান যখন নিদ্রিতা ছিল, সেই সময়ে কে জহরকে লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। 

“এই কয়েক দিবস আবীর-জান কত স্থানে যে তাঁহার কত অনুসন্ধান করিয়াছে, তাহার স্থিরতা নাই। কিন্তু কোন স্থানেই জহরের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারে নাই। 

“আবীর-জান কিন্তু এক ব্যক্তিকে সন্দেহ করে। সে ব্যক্তি জহরকে নিতান্ত ভালবাসিত, এবং প্রাণের সহিত যত্ন করিত। সে জহর ব্যতীত একদণ্ডও থাকিতে পারিত না, জহরও সর্ব্বদা তাহার নিকটে থাকিতে ভালবাসিত। আবীর—জান কিন্তু তাহা দেখিতে পারিত না; সুতরাং যাহাতে সেই ব্যক্তি তাহার বাড়িতে প্রবেশ করিয়া জহরের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিতে না পারে, তাহার নিমিত্ত সৰ্ব্বদা সতর্ক থাকিত।” 

মিরসাহেব এই পর্যন্ত বলিলেই আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে ব্যক্তির উপর আবীর-জান সন্দেহ করিতেছে, বা যে ব্যক্তি জহরকে অতিশয় ভালবাসিত, তাহার নাম বলিয়া দিতে পার কি?” 

“না, তাহার নাম আমি জানি না। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আমি তাহার নাম জানিয়া আপনাকে বলিয়া দিতে পারি।” 

“তাঁহার নাম জানিবার প্রয়োজন হইবে কি না, তাহা তোমাকে পরে বলিব। এখন তুমি যাহা বলিতেছিলে, তাহা আগে বলিয়া শেষ কর।” 

“আর কি বলিব? আবীর-জান ও জহর সম্বন্ধে আমি যতদূর জানিতাম, তাহা বলিলাম, আর অধিক কি বলিব? যদি তুমি আবীর-জানের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহ, তাহা হইলে আমার সহিত আইস। আমি এখনই তোমাকে সঙ্গে করিয়া সেইস্থানে লইয়া যাইতেছি, আর যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিবার বা জানিবার প্রয়োজন হয়, তাহা তাহার নিকটই অবগত হইতে পারিবে।” 

মিরসাহেবের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “মিরসাহেব! আবীর-জানের বাড়ীতে আমার এখন গমন করিবার কোন প্রয়োজন নাই; পরে যদি আবশ্যক হয়, তোমাকে বলিব। এখন তুমি একটু কার্য্য কর দেখি। জহরকে লইয়া পলায়ন-সূত্রে আবীর-জান যাহার উপর সন্দেহ করিতেছে, তাহার নামটি কি, এবং সে কোথায় থাকে, তাহা জানিয়া আসিয়া আমাকে বল দেখি। তুমি যে পৰ্য্যন্ত প্রত্যাগমন না করিবে, সেই পৰ্য্যন্ত আমি এইস্থানেই বসিয়া তোমার অপেক্ষা করিব।” 

আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া অনেক কষ্টে বৃদ্ধ সেইস্থান হইতে উঠিল, এবং সেই লাঠিতে ভর দিয়া অতি ধীরে ধীরে চলিল। 

আমি সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। বৃদ্ধের নিকট যতদূর অবগত হইতে পারিলাম, তাহাতে কেবল এইমাত্র জানিতে পারিলাম যে, আবীর-জানের বাটী হইতে তাহার পালিতা কন্যা পলায়ন করিয়াছে, এবং অপর কোন ব্যক্তি তাহাকে বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে। ইহাতে আমার ঘড়ী-চুরি মোকদ্দমার কি হইতে পারে? আবীর—জানের কন্যা চুরি হইল—তাহার বাড়ী হইতে। আর ঘড়ী চুরি হইল –ইডেন গার্ডেন হইতে। তাহাও আবীর—জানের নহে, বা যতদূর দেখিতে পাইতেছি, তাহাতে আবীর-জানের সম্পর্কীয় কোন লোকেরই নহে। যদি চুরি-ব্যাপারে এই বিষয়ের কোন সম্বন্ধ না থাকে, তাহা হইলে ইহা কোন দুষ্টলোকের নষ্টামী। অথবা তাহার এই উদ্দেশ্য আছে যে, সেই পত্র পাঠ করিয়া অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত পুলিস যদি আবীর-জানের বাড়ীতে যায়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সে বালিকা-চুরির কথা জানিতে পারিবে, এবং ইচ্ছা করিয়াই হউক বা প্রলোভনে পড়িয়াই হউক, যদি সে উহার অনুসন্ধান করে, তাহা হইলে আবীর-জানের কোনরূপ উপকার হইলেও হইতে পারিবে। 

আমি সেইস্থানে বসিয়া এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় দেখিলাম, মিরসাহেব ফিরিয়া আসিল ও আমাকে কহিল “জানিতে পারিয়াছি, উহার নাম পীর বক্স।” 

দশম পরিচ্ছেদ 

যে ব্যক্তি জহরকে ভালবাসিত, বা তাহাকে বাহির করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত যাহার উপর সন্দেহ হইতেছে, মিরসাহেবের নিকট জানিতে পারিলাম, তাহার নাম পীর বক্স! কিন্তু ঘড়ী চুরি মোকদ্দমার আসামী পীর বক্স, ও এই পীর বক্স, একই ব্যক্তি কি না? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলেই ঘড়ী চুরি মোকদ্দমায় যে সে নির্দোষ, তাহা কি প্রকারে অনুমান করিয়া লই? অধিকন্তু তাহাকে দুইটি পৃথক্ পৃথক্ অপরাধে অপরাধী স্থির করিয়া লওয়াই উচিত। যে অপরের কন্যা বাহির করিতে পারে, সে অপরের দ্রব্য চুরিও করিতে পারে, ইহা নিতান্ত অসম্ভব নহে। জহরকে বাহির করিয়া পলায়ন করিবার কালে বোধ হয়, তাহার পথ খরচের কিছু অভাব ছিল বলিয়া, সে সেই ঘড়ী চুরি করে, ও তাহা বন্ধক দিয়া প্রয়োজনীয় অর্থের সঙ্কুলান করিয়া লয়। যাহা হউক, যখন একটা গোলযোগ আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন এ অনুসন্ধান আরও একটু সতর্কতার সহিত করা কর্ত্তব্য। এই ভাবিয়া আমি প্রথমেই ফরিয়াদীর বন্ধু সেই ফজলে রসিদ সম্বন্ধে একটু গোপনে ভালরূপে অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু তাহার চরিত্র সম্বন্ধে বিশিষ্ট কোন দোষ পাইলাম না। আবীর-জান, জহর বা পীর বক্সের সহিত তাহার যে কোনরূপ আলাপ-পরিচয় বা চেনা-শুনা আছে, তাহাও কেহ বলিতে সমর্থ হইল না। 

আমার দ্বিতীয় অনুসন্ধান সেই জমাদার সম্বন্ধে। সেই ঘড়ীর বন্ধক সম্বন্ধে জমাদার যে কোনরূপ মিথ্যা কথা বলিতেছে, তাহা বোধ হইল না। বিশেষতঃ আরও একটু ভাল করিয়া অনুসন্ধান করাতে জানিতে পারিলাম যে, যখন পীর বক্স চেন ও ঘড়ী বন্ধক দিয়া, তাহার নিকটা হইতে টাকা গ্রহণ করিয়াছে, সেই সময়ে আরও দুই তিন জন লোক উপস্থিত ছিল। জমাদারের কথার সহিত তাহাদিগের কথা মিলাইয়া একটু বিবেচনা করিয়া দেখিলে বোধ হয় না যে, জমাদারের কথা মিথ্যা। 

তখন আমার তৃতীয় অনুসন্ধানের লক্ষ্য-স্থল হইল, সেই নাম-প্রকাশে অনিচ্ছুক মুসলমান-যুবক। পরিশেষে তাহাকে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোনস্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না। জিজ্ঞাসা করায় আবদুল আজিজ ও ফজলে রসিদ উভয়েই কহিলেন, তাহারা তাহাকে ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দেখে নাই। সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে আমি অনুসন্ধান করিলাম সত্য, কিন্তু আমার মনের সন্দেহ মিটিল না। এই মোকদ্দমায় আমাদিগকে সাহায্য করিয়া যে ব্যক্তি কিছু উপার্জ্জনও করিয়া লইল, সেই ব্যক্তি তাহার নাম ও ঠিকানা প্রকাশ করিতে অসম্মত কেন? 

আমার চতুর্থ অনুসন্ধান ফরিয়াদীকে লইয়া। তাহার সম্বন্ধে আমি গোপনে বিশিষ্টরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু আবীর-জান, জহর, পীর বক্স প্রভৃতি কাহারও সহিত তাহার জানা শুনা আছে, একথা কেহই বলিতে সমর্থ হইল না। পরিশেষে আমি আবদুল আজিজের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, ও তাহাকে প্রকাশ্যরূপে সৰ্ব্বসমক্ষে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে ঘড়ী চুরির মোকদ্দমা এখন উপস্থিত, সেই ঘড়ী আপনার নিজের কি অপর আর কাহারও?” 

আবদুল আজিজ। এ চেন ও ঘড়ী পরের হইবে কেন? আমার নিজের। কেন? এই কয়েক দিবস পরে আজ তাহা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি? 

আমি। প্রয়োজন আছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতেছি। এই অপহৃত ঘড়ীই যে আপনার, তাহা প্রমাণ করিবার আবশ্যক বলিয়াই এই কথা জিজ্ঞাসা করিতে হইতেছে; অপর কোন কারণ নাই। আরও একটি কথা, আপনি বলিতেছেন, এই ঘড়ী আপনার। আপনি এই ঘড়ী কোথায় পাইলেন? 

আবদুল আজিজ। আমি এই ঘড়ী খরিদ করিয়াছিলাম। 

আমি। কতদিবস হইল, এবং কাহার নিকট হইতে উহা খরিদ করা হয়? 

আবদুল আজিজ। সে অনেক দিবসের কথা। কত টাকায় বা কাহার নিকট হইতে এই ঘড়ী যে ক্রয় হইয়াছে, তাহা আমার এখন স্মরণ হইতেছে না। যদি স্মরণ হয়, তাহা হইলে পরে আমি বলিতে পারিব। 

আমি। কাহার নিকট হইতে এই ঘড়ী ক্রয় করিয়াছেন, তাহা যখন আপনি বলিতে পারিতেছেন না, তখন এই ঘড়ী যে আপনার, আপনি কি প্রকারে প্রমাণ করিতে সমর্থ হইবেন? 

আবদুল আজিজ। কেন, সেই বিষয় ফজলে রসিদ প্রমাণ করিতে পারিবে। এই ঘড়ী যে আমার এবং উহা যে আমার নিকট ছিল, তাহা সে পূৰ্ব্বেও বলিয়াছে, এবং আবশ্যক হইলে এখনও সে বলিতে প্রস্তুত আছে। 

আমি। পূর্ব্বে যেন আমি আপনাদিগের কাহারও নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছি যে, উক্ত ঘড়ী একবার মেরামত করিয়া লওয়া হয়, একথা কি প্রকৃত? 

আবদুল আজিজ। হাঁ তাহা প্রকৃত, এই ঘড়ী একবার মেরামত করা হয়। 

আমি। কোন্ দোকান হইতে মেরামত হয়? 

আবদুল আজিজ। আমি কোন দোকানে মেরামত করিতে দেই নাই। একজন ঘড়ীওয়ালা আমাদিগের বাড়ী হইতে সেই ঘড়ী লইয়া যায়, এবং মেরামত হইলে সেই আসিয়া পুনরায় উহা দিয়া যায়। সে ঘড়ীওয়ালার নাম আমি জানি না, বা সে কোথায় থাকে, তাহাও আমি অবগত নহি। সেই ব্যক্তি পূর্ব্বেও সর্ব্বদা আমাদিগের বাড়িতে আসিত; কিন্তু আজ কয়েক মাস হইতে তাহাকে আর দেখিতে পাইতেছি না। ঈশ্বর জানেন যে, সে জীবিত আছে কি না? 

এতক্ষণ চোরের সন্ধান পাইয়া আর অধিক অনুসন্ধানের আবশ্যকতা নাই, ইহা মনে মনে ভাবিলাম সত্য, কিন্তু মনকে স্থির করিতে পারিলাম না। রাত্রি নয়টা কি দশটার সময় পুনরায় থানা হইতে বহির্গত হইয়া, একবারে আবীর—জান বাইজীর বাড়ীর সম্মুখে গেলাম। মনে ভাবিলাম, এই মোকদ্দমা-সংস্কৃষ্ট ব্যক্তিগণের মধ্যে যদি কাহাকেও আবীর—জানের বাড়ীতে গমন করিতে দেখিতে পাই, তাহা হইলে সেই বেনামীপত্রের মর্ম্ম কতক পরিমাণে বুঝিলেও বুঝিতে পারিব। এই ভাবিয়া কখন সেই বাড়ীর বিপরীত দিকের ফুটপাথে দাঁড়াইয়া, কখন বসিয়া, কখনও বা পদচারণা করিয়া রাত্রি দুইটা পর্য্যন্ত অতিবাহিত করিলাম। কিন্তু সেই সকল ব্যক্তিগণের মধ্যে বা আমার পরিচিতের মধ্যে, কাহাকেও সেই বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিলাম না। 

যখন রাত্রি প্রায় আড়াইটা, সেই সময় দেখিলাম, আমার পরিচিত একজন হিন্দু সম্ভ্রান্ত-বংশোদ্ভব যুবক সেই বাড়ির ভিতর হইতে বহির্গত হইলেন। ইনি কখন যে সেই বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলেন, তাহা দেখি নাই। ভাবিলাম, আমি সেইস্থানে আসিবার পূর্বেই তিনি সেইস্থানে আসিয়াছিলেন। বাড়ী হইতে আসিয়াই একখানি চলতি গাড়ি পাইলেন, সেই গাড়ি ভাড়া করিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন। 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া, আমি সেই যুবকের বাটীতে গমন করিলাম। সেই সময় তিনি নিদ্রিত ছিলেন। বেহারাকে দিয়া আমার নাম তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দেওয়ার পর তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি তৎক্ষণাৎ বাহিরে আগমন করিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, এবং অতি প্রত্যূষে তাঁহার নিকটে গমন করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে আমি কহিলাম, “আপনার নিকট সবিশেষ কোন প্রয়োজন আছে বলিয়াই, এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করিতে আসিয়াছি। তবে এ স্থান একটু নির্জ্জন হইলে ভাল হয়?” 

হিন্দু-যুবক। এ আমার বসিবার স্থান, এখানে আর কেহ আগমন করিবেন না। এইস্থানেই আপনি সকল কথা আমাকে বলিতে পারেন। যে বেহারা এখানে আপাততঃ উপস্থিত আছে, তাহাকে আমি এখনই এইস্থান হইতে বিদায় করিয়া দিতেছি। 

এই বলিয়া তিনি তাঁহার চাকরকে কোন কর্ম্মের ভান করিয়া, সেইস্থান হইতে স্থানান্তরে প্রেরণ করিলেন। সে স্থানে অপর কেহই আর উপস্থিত ছিল না। 

হিন্দু-যুবক। আপনার কার্য্যের নিমিত্ত আমি বিরক্ত নহি। আপনার কি প্রয়োজন বলুন। 

আমি। গত রাত্রিতে যখন আপনি আবীর-জানের বাড়ী হইতে আগমন করেন, তখন আমাকে দেখিতে পাইয়াছিলেন কি? 

হিন্দু-যুবক। কে বলিল, আমি আবীর-জানের বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম? 

আমি। আমি আপনাকে স্বচক্ষে দেখিয়াছি। অনুমান রাত্রি আড়াইটার সময় যখন আপনি তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া, একখানি ঠিকা গাড়িতে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, তখন আমি সেইস্থানে উপস্থিত ছিলাম। 

হিন্দু-যুবক। আপনাদিগের অত্যাচারে যে লুকাইয়া চুকাইয়া কোনস্থানে গমন করিব, তাহারও উপায় নাই। সে যাহা হউক, এখন কথাটা কি বলুন দেখি। 

আমি। কথা এমন কিছুই নহে, আবীর-জানের পালিতা কন্যা জহরকে আপনি জানিতেন কি? সে এখন কোথায়?

হিন্দু-যুবক। জানিতাম বৈ কি। সে ত এখন ওখানে নাই। তবে যতদূর জানিতে পারিয়াছি বোধ হয়, পীর বক্স নামক এক ব্যক্তি জহরকে বাহির করিয়া তাহার দেশে গমন করিয়াছে। 

আমি। পীর বক্স কি চরিত্রের লোক? সে কি চোর? 

হিন্দু-যুবক। সে চোর নহে বটে; কিন্তু কার্য্যের গতিক্রমে সে চোর হইয়া দাঁড়াইতেছে। 

আমি। সে কিরূপে এখন চোর হইয়া দাঁড়াইতেছে? 

হিন্দু-যুবক। সে যে এখন কি প্রকারে চোর হইয়া দাঁড়াইতেছে, তাহা এখন আমি আপনাকে বলিব কেন? আপনি যাহা যাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা জিজ্ঞাসা করুন। তাহা হইলেই আমি আপনার মনের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিব, এবং তখন যদি আপনার প্রশ্নের উত্তর ব্যতিরেকে আরও কোন কথা বলিবার থাকে, তখন আপনাকে বলিব। প্রথমে কিন্তু বলিতেছি না। 

আমি। শুনিয়ছি, আবীর-জান পীর বক্সকে দেখিতে পারিত না, এমন কি তাহাকে বাড়িতে প্রবেশ করিতে দিত না। তবে সে কিরূপে জহরকে বাহির করিতে সমর্থ হইল? 

হিন্দু-যুবক। দেখুন মহাশয়! আবীর-জান আমাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে, এবং আমার নিকট কোন কথা গোপন করে না। আপনার সহিত আমার সবিশেষরূপ বন্ধুত্ব আছে বলিয়াই, আপনার নিকটে আমি সকল কথা বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি। কিন্তু দেখিবেন, আমার নাম যেন কোনরূপে কেহ অবগত হইতে না পারে। জহরকে পীর বক্স বাহির করিয়া লইয়া যায় নাই, জহরই আপন ইচ্ছায় আবীর-জানের গৃহ পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। এইস্থান হইতে পলাইবার পূর্ব্বে, পত্র লিখিয়া জহর পীর বক্সের সহিত বন্দোবস্ত করে। তাহার দুই এক খানি পত্র এখন আবীর—জানের হস্তগত হইয়াছে। পীর বক্সের সহিত পরামর্শ স্থির হইলে রাত্রি নয়টার পূর্ব্বে জহর বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়। পূর্ব্বের বন্দোবস্তু অনুসারে পীর বক্স হাবড়া ষ্টেশনে গিয়া তাহার অপেক্ষা করিতেছিল, যেমন জহর গিয়া উপস্থিত হয়, অমনি উহারা টিকিট খরিদ করিয়া মেল-গাড়িতেই হাবড়া হইতে প্রস্থান করে। আবীর-জান আরও সংবাদ পাইয়াছে যে, জহর এখন পীর বক্সের বাড়ীতেই আছে। কিন্তু কিরূপে যে তাহাকে পুনরায় এইস্থানে আনয়ন করিতে সমর্থ হইবে, তাহার কোন উপায় স্থির করিতে পারিতেছে না। 

আমি। কেন, সে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট নালিস করিয়া, উহাকে আনিবার চেষ্টা দেখিতেছে না? 

হিন্দু-যুবক। সে চেষ্টাও সে দেখিয়াছিল, উকীল-কৌন্সলীর পরামর্শও লইয়াছিল। তাঁহারা সকলেই কহেন যে, এক জহর বিবাহিতা নহে, তাহাতে তাহার বয়ঃক্রম ষোল বৎসরের উপর। এরূপ অবস্থায় সে যদি আপন ইচ্ছার কাহারও সহিত গমন করে, বা ইচ্ছার সহিত তাহার নিকট থাকে, তাহা হইলে মোকদ্দমায় কিছুই হইতে পারে না। বিশেষতঃ পলায়ন করিবার সময় জহর এইরূপ একখানি পত্র লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছিল। “আমি আর তোমার নিকট থাকিতে চাহি না।। আমি এখন বড় হইয়াছি, সুতরাং ইচ্ছামত স্থানে থাকিব। আমার জন্য কোন চেষ্টা করিও না, করিলেও আমি আসিব না।” 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

সেই হিন্দু যুবকের সমস্ত কথা আমি অতীব মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিয়া, পরিশেষে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আবদুল আজিজ নামে কোন ব্যক্তিকে আপনি আবীর-জানের বাড়ীতে কখনও দেখিয়াছেন কি?” 

হিন্দু-যুবক। না, আবদুল আজিজকে আমি কখন আবীর-জানের বাড়ীতে দেখি নাই, বা আমি তাহাকে চিনি না।

আমি। ফজলে রসিদ নামক কোন ব্যক্তি কখন আবীর-জানের বাড়ীতে দেখিয়াছেন?

হিন্দু-যুবক। না মহাশয়! 

আমি। আবীর-জান কাহার একান্ত অনুগত? 

হিন্দু-যুবক। যে তাহাকে রাখিয়াছে, সেই গোলাম ছোবানের সে নিতান্ত অনুগত। এত কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি? আপনার জ্ঞাতব্য বিষয় স্পষ্ট করিয়া বলুন; দেখি, আমি তাহার কিছু বলিতে পারি কি না। 

আমি। আচ্ছা, তাহাই হইতেছে। আমি আপনাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না, যাহা আমার জানিবার প্রয়োজন, তাহার সমস্ত অবস্থা আপনাকে বলিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। 

এই বলিয়া আবদুল আজিজের ঘড়ী চুরি হইতে আরম্ভ করিয়া পীর বক্স কর্তৃক জহরের অপহরণ-বৃত্তান্ত যাহা শুনিয়াছিলাম, একে একে বর্ণন করিলাম। পরিশেষে কহিলাম, “এইরূপ অবস্থায় ইহার ভিতর কোন রহস্য আছে কি না, তাহার কিছুই অনুমান করিয়া স্থির করিতে পারিতেছি না। এ বিষয় যদি আপনি কিছু অবগত হইতে পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার এই সংশয় দূর করুন।” 

হিন্দু-যুবক। এ বিষয়ে আমি নিজে যতদূর অবগত আছি,এবং যতদূর ক্রমে জানিতে পারিয়াছি, তাহার ভিতর রহস্য বেশ আছে। আবীর-জান অতিশয় বুদ্ধিমতী রমণী। তাঁহার বুদ্ধিকৌশলে পরাস্ত না হন, এমন লোক অতি অল্পই আছেন। জমাদার যে তারিখে ঘড়ী ও চেন বন্ধক রাখিয়াছে বলিতেছে তাহা ঠিক নহে; সে হয় তারিখের ভুল করিতেছে, না হয় আপনারা ভালরূপ অনুধাবন করিয়া দেখেন নাই। যে তারিখে আপনাদিগের থানায় ঘড়ী চুরির নালিস হয়, তাহার পূৰ্ব্বদিবস সেই চেন ও ঘড়ী জমাদারের নিকট বন্ধক হয়। আবীর-জান যখন দেখিল, তাহার বৃদ্ধ অবস্থার সম্বল সেই পালিতা কন্যা জহরকে পীর বক্স লইয়া পলায়ন করিয়াছে, তখন তাহার নামে নালিস করিবার অভিপ্রায়ে সেই রাত্রিতে উকীল—কৌশলীর পরামর্শ লয়। কিন্তু আমি পূর্ব্বে আপনাকে যাহা বলিয়াছি, সেইরূপ পরামর্শ পাইয়া নালিস করিবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে, এবং পরিশেষে তাহার পরিচিত ও বশীভূত অনেক লোক নিযুক্ত করিয়া উহাদিগের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়। উহাদিগের মধ্যে একজন সংবাদ পায় যে, পীর বক্স তাহার চেন ও ঘড়ী পূর্ব্বকথিত জমাদারের নিকট বন্ধক দিয়া, জহরকে লইয়া সেই রাত্রিতেই আপনার দেশে প্রস্থান করিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া সে পীর বক্সকে বিলক্ষণরূপে জব্দ ও আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত এই নতুন উপায় উদ্ভাবন করে। তাহারই কোন প্রণয়ীর পরিচিত, অথচ যাহারা কখনও আবীর-জানের বাড়ীতে যায় নাই, এইরূপ লোক স্থির করিয়া অর্থব্যয়ে তাহাদিগকে বশীভূত করে। তাহারাই ইহার পরামর্শে পরিশেষে থানায় গিয়া, এই মিথ্যা মোকদ্দমা রুজু করে। যে চেন ও ঘড়ী জমাদারের নিকট পাওয়া গিয়াছে, তাহা পীর বক্স প্রকৃতই বন্ধক দেয়, কিন্তু সেই ঘড়ী চোরা ঘড়ী নহে, তাহার নিজের। যে সময় পীর বক্স আবীর-জানের বাড়ীতে জহরের নিকট আসিত, সেই সময় সেই ঘড়ী প্রায়ই সে ব্যবহার করিত। সুতরাং সেই ঘড়ীর আকৃতি কি প্রকার, তাহা তাহাদের উত্তমরূপে জানা ছিল। সেই ঘড়ী কাহার দ্বারা নির্মিত ও তাহার নম্বরই বা কত তাহাও আবীর-জান জানিত। সুতরাং মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইতে, বা সেই ঘড়ীর নম্বর প্রভৃতি পূর্ব্বে আপনাদিগকে প্রদান করিতে কোনরূপ অসুবিধা ঘটে নাই। যে ব্যক্তি প্রকারান্তরে আপনাকে সেই ঘড়ীর সংবাদ প্রদান করে, সেও ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে একজন। চতুরা আবীর-জান দূরে থাকিয়া যেরূপভাবে ঘড়ী চুরি মোকদ্দমার জোগাড় করিয়া দিয়াছিল, তাহাতে পীর বক্সের নামে যে ওয়ারেন্ট বাহির হইত, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। ধৃত হইয়া মোকদ্দমার সময়ে তাহার অদৃষ্টক্রমে যদি সে খালাস হইয়া যাইত, তাহা হইলেও আবীর-জানের কোনরূপ ক্ষতি হইত না। ইহার মধ্যেই সে আপনার অভিসন্ধি পূর্ণ করিয়া লইত, অর্থাৎ যেমন পীর বক্সের নামে ওয়ারেন্ট তাহার দেশে যাইত, অমনি এইস্থান ইহতে কোন বিশ্বাসী লোককে আবীর-জান গোপনে সেইস্থানে পাঠাইয়া দিত। চুরির অপরাধে ওয়ারেন্ট বাহির হইলে তাহাতে জামিন হয় না; সুতরাং পীর বক্স যেমন ধৃত হইয়া হাজতে যাইতেন, অমনি আবীর-জানের সেই বিশ্বাসী লোক জহরকে লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিত; সুতরাং আবীর-জানের অভিসন্ধি পূর্ণ হইত। ইহাই আবীর-জানের ষড়যন্ত্রও সেই ষড়যন্ত্রের নিমিত্তই এই ঘড়ী-চুরি মোকদ্দমার সৃষ্টি। 

হিন্দু যুবকের নিকট এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া তখন আমি বুঝিতে পারিলাম, এই ঘড়ী চুরি মোকদ্দমার রহস্য কি? পীর বাক্সের নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিবার ইচ্ছা তখন আমাদিগের হৃদয় হইতে দূর হইল। সমস্ত অবস্থা বিকৃত করিয়া পীর বক্সকে তাহার সংবাদ পাঠান হইল। সংবাদ পাঠাইবামাত্র কোনস্থানে জহরকে রাখিয়া পীর বক্স কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইল। কোথা হইতে সেই ঘড়ী খরিদ করিয়াছিল তাহারও সন্তোষজনক প্রমাণ উপস্থিত করিল। 

আমরা আসামী পীর বক্সের পরিবর্তে ফরিয়াদী আবদুল আজিজ ও তাহার বন্ধু ফজলে রসিদের নামে, পুলিসের নিকট মিথ্যা সংবাদ দেওয়ার অপরাধে, ওয়ারেন্ট বাহির করিলাম। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া আর তাহাদিগকে পাইলাম না, আজ পর্যন্তও তাহারা পলায়িত। আবীর-জান সমস্ত যড়যন্ত্রের পশ্চাতে ছিল। সুতরাং আইনমতে তাহাকে কোনরূপে দোষী করিতে না পারায়, তাহার আর কিছুই করিতে পারিলাম না। আবীর-জান এখনও কলিকাতায় আছে। কিন্তু তাহার পর জহরকে আর এখানে কেহ দেখে নাই। 

[ চৈত্র, ১৩০০ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *