চক্রভেদ (অর্থাৎ কুটিল চক্রীদিগের মন্ত্রভেদে অসমর্থ হইলেও ঘটনাচক্রে সমস্ত প্রকাশের রহস্য!)

চক্রভেদ (অর্থাৎ কুটিল চক্রীদিগের মন্ত্রভেদে অসমর্থ হইলেও ঘটনাচক্রে সমস্ত প্রকাশের রহস্য!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

কয়েক বৎসর অতীত হইল। একসময় একখানি দরখাস্ত অনুযায়ী একটি অনুসন্ধানে আমাকে নিযুক্ত হইতে হয়। বালিগঞ্জের কয়েকজন প্রজা একত্র হইয়া উক্ত দরখাস্ত আলিপুরের মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করেন। উক্ত দরখাস্তের যথাযথ অনুসন্ধান হওয়া আবশ্যক, এই বিবেচনায় মাজিষ্ট্রেট সাহেব উহা আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট পাঠাইয়া দেন, এবং ক্রমে উহা আমার হস্তে অনুসন্ধানার্থ অর্পিত হয়। উক্ত দরখাস্তের মর্ম্ম এইরূপ : 

“নিম্ন স্বাক্ষরকারী বালিগঞ্জ নিবাসী প্রজাগণের নিবেদন এই যে, বিলায়েত হোসেন নামক এক ব্যক্তি এই স্থানে বহু দিবস হইতে বাস করিতেন। ইনি একজন নিতান্ত দরিদ্র প্রজা ছিলেন না। ইদানীং তিনি বার্দ্ধক্য দশায় উপস্থিত হইয়াছিলেন সত্য; কিন্তু যৌবনে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিয়া সংসারযাত্রা নির্ব্বাহার্থ বিলক্ষণ সংস্থান করিয়া রাখিয়াছিলেন। ইষ্টক নিৰ্ম্মিত প্ৰকাণ্ড বাড়ী। তৎসংলগ্ন বৃহৎ উদ্যান ও পুষ্করিণী, অসংখ্য তৈজসপত্র ব্যতীত নগদ অর্থও বিস্তর রাখিয়াছেন। এককথায় বালিগঞ্জের যে অংশে তাঁহার জন্মস্থান, সেইস্থানের মুসলমান প্রজাগণের মধ্যে ইনি সর্ব্বাপেক্ষা ধনশালী না হইলেও কোন ব্যক্তি অপেক্ষা ন্যন নহেন। পরিবারের মধ্যে একমাত্র পুত্র মনসুর আলি ভিন্ন অপর আর কেহই নাই। অতি অল্প দিবস হইল,—হেসারূদ্দিন নামক এক ব্যক্তির কন্যার সহিত আপন পুত্রের বিবাহ দিয়াছেন। 

“পুত্র মনসুর আলি এখন নিতান্ত বালক নহে, তাহার বয়ঃক্রম এখন বিংশতি বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে। বৃদ্ধ পিতার যথেষ্ট অর্থ থাকায় ও ইচ্ছামত অর্থ মনসুরের করায়ত্ত হইবার সুযোগ থাকায়, সে ভালরূপ লেখাপড়া শিক্ষা করিতে পারে নাই। লেখাপড়া না শিখিলে বালকগণ যেরূপভাবে অর্থ নষ্ট করিয়া সময় অতিবাহিত করিয়া থাবে মনসুরও তাহাই করিত। মনসুরের বিপক্ষে অনেক কথা অনেক স্থান হইতে বৃদ্ধের কর্ণে উপস্থিত হইলেও একমাত্র পুত্র বলিয়া তিনি মনসুরকে কিছুই বলিতেন না। এইরূপে নানাস্থানে নানা প্রকার দুষ্কর্ম করিতে করিতে মনসুরের মতিগতি ক্রমে ফিরিয়া গেল। “দুষ্কর্মের দিকেই ক্রমে তাহার মন ধাবিত হইতে লাগিল। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইবার পর একদিবস মনসুর বিনাকারণে অপর আর এক ব্যক্তিকে এরূপ গুরুতরভাবে প্রহার করিল যে, তাহাতে তাহার মস্তক ভাঙ্গিয়া গেল। উক্ত ব্যক্তি ইহার পূর্ব্বে আরও কয়েকবার মনসুর কর্তৃক বিশেষরূপে অবমানিত হইলেও, উহার বিপক্ষে কোনরূপ অভিযোগ উপস্থিত করে নাই। এবার কিন্তু সে কোনরূপে সহ্য করিতে না পারিয়া, অগত্যা রাজদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

“আলিপুরের মাজিষ্ট্রেটের কোর্টে এই মোকদ্দমার বিচার হয়। বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন পুত্রকে বাঁচাইবার নিমিত্ত যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করিয়া বিশেষরূপে চেষ্টা করেন; কিন্তু কোনরূপেই কিছু করিয়া উঠিতে পারেন নাই। বিচারে মনসুর কঠিন পরিশ্রমের সহিত ছয় মাসের নিমিত্ত কারাগারে গমন করেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের রায় পরিবর্তিত করিবার অভিপ্রায়ে পরিশেষে জজসাহেবের নিকট এই মোকদ্দমার আপীল হয়। প্রথমতঃ জজসাহেব উহার আপীল মঞ্জুর করিয়া পুনর্বিচারের জন্য একটি দিন স্থির করিয়া দেন, এবং মনসুরকে বিচারের দিবস পর্য্যন্ত এক হাজার টাকা জামিনে মুক্তি প্রদান করেন। 

“নির্দিষ্ট দিবসে আপীলের বিচার হইয়া নিম্ন আদালতের রায় অর্থাৎ ছয় মাস কারাদণ্ডই অক্ষুণ্ণ রহিল। সেইদিবস আসামী মনসুর আলি হাজির ছিল না, বা এ পর্যন্ত হাজিরও হইল না। অধিকন্তু যে ব্যক্তি মনসুরের জামিন হইয়াছিলেন, তাঁহার নিকট হইতে গবর্ণমেণ্ট সহস্ৰ মুদ্রা আদায় করিয়া লইলেন। 

“এই ঘটনার কিছুদিবস পরে মনসুর আলির শ্বশুর হেসারূদ্দিন এইস্থানের প্রধান বায়েস রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও অপরাপর দুই একজনের সহায়তায় মনসুরের পিতা বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে কোথায় লইয়া যায়। কি নিমিত্ত যে উহাকে লইয়া যায়, এবং কোথায়ই বা লইয়া যায়, তাহা এইস্থানের কোন ব্যক্তিই অবগত নহেন। এই অবস্থা দেখিয়া আমরা প্রথম প্রথম মনে করিয়াছিলাম যে, কোন কাৰ্য্যবশতঃ বৃদ্ধ কোনস্থানে গমন করিয়াছে, কার্য্য শেষ হইলেই পুনরায় আগমন করিবেন কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমরা যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহা হইল না; এ পর্য্যন্ত বৃদ্ধ আর প্রত্যাগমন করিল না। অধিকন্তু বৃদ্ধের যাহা কিছু অস্থায়ী সম্পত্তি ছিল, তাহার সমস্তই উহারা অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, এবং স্থাবর সম্পত্তি সকল দখল করিয়া লইবার নিমিত্ত চেষ্টা করিতেছে। এরূপ অবস্থায় বালিগঞ্জ নিবাসী ব্যক্তি মাত্রই মনে করিতেছেন যে, হেসারূদ্দিন, রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি ব্যায়েসগণ, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে হত্যা করিয়া তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়াছে। রাজদণ্ড ভয়ে মনসুর আলি লুক্কায়িত; সুতরাং সে ইহার কিছুমাত্র অবগত হইতে পারে নাই। এতদিবস পর্য্যন্ত যখন বিলায়েত হোসেন আপনার স্থানে প্রত্যাগমন করেন নাই, অথচ তাহার বিষয় বৈভব প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যই অপর ব্যক্তি কর্তৃক স্থানান্তরিত হইয়াছে, তখন আমাদিগের অনুমান হয় যে, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন এ জগতে আর নাই, এবং যে সকল লোক তাহাকে এই বালিগঞ্জ হইতে স্থানান্তর লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের কর্তৃক সে হত হইয়াছে। এই সকল কারণবশতঃ আমরা ধর্ম্মাবতারের নিকট এই নিবেদন করিতেছি যে, গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক এই বিষয়ের যথাযথ অনুসন্ধান হইয়া ইহার প্রকৃত তত্ত্ব বাহির করা হয়, এবং প্রকৃতই যদি বৃদ্ধ হত হইয়া থাকে, তাহা হইলে হত্যাকারীগণ ধৃত হইয়া রাজদ্বারে যাহাতে দণ্ড প্রাপ্ত হয়, তদ্বিষয়ে যেন যত্ন করা হয়। এই সুশাসিত ইংরাজ রাজত্বে বাস করিয়া এইরূপে যদি কোন ব্যক্তি হত ও তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহৃত হয়, তাহা হইলে কেহই মানসম্ভ্রম এবং ধনপ্রাণ লইয়া এইস্থানে বাস করিতে সাহসী হইবে না। বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে হত্যা করা অপরাধে যাহাদিগের উপর এখন আমাদিগের সন্দেহ হইতেছে, তাহারা নিতান্ত দরিদ্র হইলেও বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের ধনে এখন তাহারা ধনশালী হইয়াছে। সুতরাং বিনা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিতে সেই সকল লোক কোনক্রমেই কুণ্ঠিত হইবে না। এরূপ অবস্থায় আমাদিগের আরও নিবেদন যে, এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার ভার যেন কোন কর্তব্য-পরায়ণ বিশ্বাসী কর্মচারীর হস্তে অর্পণ করা হয়।” 

দরখাস্তের মর্ম্ম অবগত হইয়া ভাবিলাম যে, এরূপ ঘটনা আমাদিগের দেশে এ পর্যন্ত ঘটে নাই। দরখাস্ত লিখিত সকল কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে ইহা যে একটি গুরুতর বিষয়, তাহার আর কোন সন্দেহ নাই। 

এ বিষয়ের অনুসন্ধানে হস্তক্ষেপ করিবার পূর্ব্বে একবার মনে হইল যে, হেসারূদ্দিন কে, তাহা আমি জানি না, বা তাহার সহিত আমার পরিচয় নাই। কিন্তু রামেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে আমি উত্তমরূপে জানি। তাহার দ্বারা না হইতে পারে, এমন কার্য্যই এ জগতে নাই। কিন্তু সে হিন্দু হইয়া মুসলমানদিগের সহিত যোগ দিয়া কি প্রকারে এরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবে? দিবাভাগে সৰ্ব্বসমক্ষে বিলায়েত হোসেনকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া তাহাকে হত্যাপূর্ব্বক পুনরায় সর্ব্বসমক্ষে তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইতে সে যে সাহসী হইবে, ইহা যেন কেমন কেমন বোধ হয়। রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় সৰ্ব্বজনবিদিত প্রসিদ্ধ বদমায়েস কিন্তু সে নির্ব্বোধ নহে। বিশেষতঃ কয়েকজন বুদ্ধিমান্ ও গণ্যমান্য ব্যক্তি তাহার পৃষ্ঠপোষক, এবং পরামর্শদাতা। এরূপ অবস্থায় রামেশ্বর যে এইরূপ কার্য্যে প্রকাশ্যরূপে হস্তক্ষেপ করিবে, তাহা অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে। কিন্তু অপ্রকাশ্য ভাবে এরূপ কার্যে লিপ্ত থাকা রামেশ্বরের পক্ষে একবারে অসম্ভব নহে। 

হেসারূদ্দিনের সহিত আমার পরিচয় না থাকিলেও, দরখাস্ত অনুযায়ী অনুমান হইতেছে যে, হেসারূদ্দিন বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের বৈবাহিক। বৃদ্ধ বিলায়েতের মৃত্যুর পর তাহার জামাতা ও তাহার কন্যা সমস্ত বিষয়ের অধিকারী হইবে, অথচ বৃদ্ধের যেরূপ বয়ঃক্রম অনুমান হইতেছে, তাহাতে তাহার মৃত্যুরও অধিক কাল বিলম্ব নাই। এরূপ অবস্থায় বৃদ্ধকে হত্যা করিয়া তাহার সমস্ত বিষয় হেসারূদ্দিন কেন অপহরণ করিবে, এবং রামেশ্বর প্রভৃতি অপরাপর লোকদিগকে কেনই বা আপন কন্যার ভাবি বিষয়ের অংশ প্রদান করিবে, তাহাও অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে।

রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় সৰ্ব্বজন-বিদিত বদমায়েস; সুতরাং তাহার শত্রুও অধিক। এইরূপ অবস্থায় দরখাস্তকারীগণ তাহাকে বিপদাপন্ন করিবার নিমিত্ত এইরূপ ষড়যন্ত্র করে নাই ত? যাহা হউক, অনুসন্ধানের পূর্ব্বে এ বিষয়ের এইরূপ আলোচনা আর না করিয়া, সবিশেষ সতর্কতার সহিত এ বিষয়ের অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এই ভাবিয়া পরদিবস হইতেই ইহার অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

দরখাস্তে দশজন লোক সাক্ষী ছিল। প্রথমতঃ বালিগঞ্জে উপস্থিত হইয়া সেই স্বাক্ষরকারীগণের অনুসন্ধান করিলাম। দেখিলাম, উহারা সকলেই বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের বাড়ীর চতুষ্পার্শ্বে বাস করিয়া থাকে। সংবাদ পাইবামাত্র তাহারা সকলেই আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইল। যে বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই বিষয় সম্বন্ধে কে কি অবগত আছে, তাহা তাহাদিগকে এক এক করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ও তাহারা যাহা যাহা কহিল, তাহা সেইস্থানেই বসিয়া লিখিয়া লইলাম। উহাদিগের মধ্যে যে যে প্রকার বলিয়াছিল, তাহার সারমর্ম এই প্রকার :—

প্রথম স্বাক্ষরকারী। আমার বাল্যকাল হইতেই বিলায়েত হোসেন আমার নিকট পরিচিত। তাহার পুত্র মনসুর আলি আমার সম্মুখেই জন্মগ্রহণ করে। একমাত্র পুত্র মনসুর আলি ব্যতীত বৃদ্ধের আর কেহই নাই। অনুমান ছয় মাস হইল, হেসারূদ্দিন নামক এক ব্যক্তির কন্যার সহিত মনসুর আলির বিবাহ হইয়াছে। শুনিয়াছি, যে, মনসুরের স্ত্রী এখন হেসারূদ্দিনের বাড়ীতেই আছেন। মনসুর এখন কোথায়, তাহা আমি অবগত নহি। শুনিয়াছি, মারপিট মোকদ্দমায় মনসুর আলি ছয় মাসের নিমিত্ত কারাগারে প্রেরিত হয়; কিন্তু আপীল করায় সেই সময় জামিনে খালাস পায়। আপীলের বিচারে উহার পূর্ব্বের দণ্ডই বহাল থাকে। বিচারের দিবস মনসুর আলি আদালতে হাজির হয় নাই, সেইদিবস হইতেই সে লুক্কায়িত ভাবে কোথায় বাস করিতেছে। তাহাকে ধৃত করিবার নিমিত্ত তাহার বিপক্ষে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে, এবং স্থানীয় পুলিস উহাকে ধৃত করিবার নিমিত্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন; কিন্তু কোনরূপে কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। আরও শুনিয়াছি যে, যে সময় মনসুর আলি এক হাজার টাকার জামিনে অব্যাহতি পান, সেই সময় আলিপুর কোর্টের উকীল তাহার নিমিত্ত জামিন হন। মনসুর আলি হাজির না হওয়ায় গবর্ণমেণ্ট উক্ত উকীল মহাশয়ের নিকট হইতে সহস্রমুদ্রা আদায় করিয়া লইয়াছেন। সুতরাং মনুসর আলিকে ধরাইবার নিমিত্ত উকীল মহাশয়ও যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছেন; কিন্তু কেহই তাহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না।

“কারাদণ্ড হইতে মনসুর আলি কোনরূপে অব্যাহতি না পাওয়ায় বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন নিতান্ত মনঃকষ্টে জীবনযাপন করিয়া আসিতেছিলেন। আমি প্রায় সৰ্ব্বদা বিলায়েত হোসেনের বাটীতে গমন করিতাম; ও দিবসের অধিকাংশ সময়ই তাঁহার নিকট উপবেশন করিয়া গল্প গুজবে অতিবাহিত করিতাম। বিলায়েত হোসেন হেসারূদ্দিনের কন্যার সহিত মনসুর আলির বিবাহ দিয়াছিলেন সত্য; কিন্তু হেসারূদ্দিন প্রায়ই বিলায়েত হোসেনের বাড়ীতে আসিতেন না। কেন আসিতেন না, তাহা আমি অবগত নহি। বৃদ্ধও সে সম্বন্ধে কখন কোন কথা আমাকে বলেন নাই; কিন্তু পাড়ার অনেকেই অনুমান করিত যে, বৃদ্ধের সহিত হেসারূদ্দিনের মনোমালিন্য নাই। যাহা হউক, ইদানীং কিন্তু মধ্যে মধ্যে তাহাকে বৃদ্ধের বাড়ীতে দেখিতে পাইতাম। কোন দিন তাহাকে একাকী দেখিতাম, কোন দিন বা রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাহার সঙ্গে আগমন করিত। তাহারা যে কি নিমিত্ত আগমন করিত, তাহা আমি অবগত নহি। প্রায় দুই মাস অতীত হইল,—একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি নিয়মিতরূপে বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের বাড়ীতে গমন করি। বিলায়েত হোসেন প্রায়ই বাড়ী হইতে বহির্গত হইতেন না; সর্ব্বদাই তাঁহার দলিজে বসিয়া থাকিতেন। সেইদিবস কিন্তু আমি তাঁহাকে তাঁহার বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম না। নিকটবর্তী কোনস্থানে গমন করিয়াছেন, এই ভাবিয়া কিয়ৎক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার পুষ্করিণীর বাঁধা ঘাটে বসিয়া রহিলাম; কিন্তু বৃদ্ধ আর প্রত্যাগমন করিল না। সেই সময় পাড়ার অপর দুই একজন লোকের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, হেসারূদ্দিন, রামেশ্বর ও অপর দুইজন লোকের সমভিব্যাহারে বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন কোথায় গমন করিয়াছেন। এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি আমার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম। সেইদিবস হইতে আমি আর বৃদ্ধকে দেখিতে পাই নাই। কিন্তু হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বরকে তাহার পর অনেকবার দেখিয়াছি, এবং বৃদ্ধের কথা উহাদিগকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করিয়াছি সত্য; পরন্তু ভালরূপ সন্তোষজনক উত্তর এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হই নাই। উহারা কখনও বলিয়াছে, বৃদ্ধ কোথায় গিয়াছে, তাহা আমরা অবগত নহি; কখনও বলিয়াছে, বৃদ্ধ তাহার পুত্রের সহিত গোপনে অবস্থান করিতেছে; কখনও বা বলিয়াছে, বৃদ্ধ ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। এই সকল কারণে আমার মনে সবিশেষরূপে সন্দেহ হইয়াছে, নিশ্চয়ই ইহার ভিতর কোনরূপ রহস্য আছে, এবং প্রকৃতই বৃদ্ধ হত হইয়া তাহার সমস্ত সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইয়াছে, তাহার আর সন্দেহ নাই। 

দ্বিতীয় স্বাক্ষরকারী। আমি বিলায়েত হোসেনের প্রজা ও তাঁহার বাড়ীর সম্মুখে আমার পাঠশালা আছে। প্রায় দুই মাস অতীত হইল, একদিবস বৈকালে হেসারূদ্দিন, রামেশ্বর ও দুইজন লোকের সহিত আমি বিলায়েত হোসেনকে গমন করিতে দেখিয়াছি। তাহারা যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি; কিন্তু সেইদিবস হইতে আর আমি বিলায়েত হোসেনকে দেখিতে পাই নাই। আট দশ দিবস অতীত হইল, একদিবস প্রাতঃকালে যখন আমি আমার পাঠশালায় বসিয়াছিলাম, সেই সময় হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর কয়েকজন জেলিয়া সঙ্গে লইয়া এইস্থানে আগমন করে। আসিয়া বিলায়েত হোসেনের বাড়ীর সংলগ্ন যে দুই তিনটি পুষ্করিণী আছে, তাহার সমস্ত মৎস্য ধরাইয়া বিক্রয় করিয়া ফেলে। বহুদিবস হইতে বৃদ্ধ যে সকল মৎস্য সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল, উহারা তাহার একটিমাত্রও রাখে নাই, সমস্তই বিক্রয় করিয়া তাহার মূল্য আত্মসাৎ করিয়াছে। অপরের মৎস্য কেন বিক্রয় করিল, এই কথা জিজ্ঞাসা করায় তাহারা সৰ্ব্বসমক্ষে বলিয়াছিল যে, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের আদেশ মত তাহারা এই কার্য্য করিতেছে, এবং মৎস্য সকল বিক্রয় করিয়া যে অর্থ পাওয়া যাইবে, তাহা তাহারা গ্রহণ করিবে না, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের হস্তে অর্পণ করিবে। উহাদিগের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমরা আর কিছু না বলিয়া, আপন আপন স্থানে প্রস্থান করি। উহারাও এইরূপ অর্থ সংগ্রহ করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। 

“এই ঘটনার দুইদিবস পূর্ব্বে এইরূপ উহারা বিলায়েত হোসেনের বাগানের ফল সকল বিক্রয় করিয়া তাহারও মূল্য লইয়া প্রস্থান করে। সেই সময় যে সকল ব্যক্তি উহাদিগকে সেই সকল ফল বিক্রয় করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তাহাদিগকেও মৎস্য বিক্রয় করিবার কারণ প্রদর্শনের মত বুঝাইয়াছিল, একথাও শুনিতে পাওয়া যায়। 

“ফল বিক্রয় করিয়া লইবার একদিবস কি দুইদিবস পূর্ব্বে বেলা আন্দাজ দ্বিপ্রহরের সময় আমি বিলায়েত হোসেনের বাড়ীর সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছিলাম। সেই সময় দেখিতে পাই যে, হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর অনেক লোকের সহায়তায় বিলায়েত হোসেনের বাড়ী হইতে তৈজসপত্র, ধান্য, চাউল প্রভৃতি বাহির করিয়া কয়েকখানি গরুর গাড়িতে বোঝাই দিয়া লইয়া যাইতেছে। এই সকল দ্রব্যাদি কেন স্থানান্তরিত হইতেছে, এই কথা আমি রামেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিলাম। উত্তরে রামেশ্বর আমাকে এই বলিয়া বুঝাইয়া দিল যে, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন আমার একজন অতি পুরাতন বন্ধু। তিনি তাঁহার পুত্রের নিমিত্ত নিতান্ত অস্থির হইয়াছেন, এবং তাঁহার বাড়ীতে একাকী অবস্থান করিতে না পারিয়া, তাঁহার বৈবাহিক হেসারূদ্দিনের বাড়ীতে গিয়া বাস করিতেছেন। এই নিমিত্ত তাঁহারই আদেশ-মত তাঁহার দ্রব্যাদি, তাঁহার বৈবাহিকের বাড়ীতে লইয়া যাওয়া হইতেছে। রামেশ্বরের কথার উত্তরে আমি আর কোন কথা না বলিয়া, সেইস্থান হইতে আপন কার্য্যে প্রস্থান করিলাম। সেই সময় আমাদিগের মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং অদ্য তিনদিবস হইল, আমরা সকলে পরামর্শ করিয়া বৃদ্ধের সহিত সাক্ষাৎ করিবার ভানে হেসারূদ্দিনের বাড়ীতে গমন করি। কিন্তু সেইস্থানে বিলায়েত হোসেনের সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই; অধিকন্তু প্রতিবেশীবর্গের নিকট হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন সেইস্থানে দুই তিন মাসের মধ্যে গমন করেন নাই। এই সকল কারণে এখন আমাদিগের মনে সন্দেহ হইতেছে যে, রামেশ্বর প্রভৃতি বদমায়েসগণ একত্র হইয়া বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে হত্যাপূর্ব্বক তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়াছে! 

তৃতীয় স্বাক্ষরকারী। আমি বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের দূর কুটুম্ব, এবং তাহার বাড়ীর সন্নিকটেই আমি বাস করিয়া থাকি। পূর্ব্বোক্ত দুই ব্যক্তি যাহা আপনাকে কহিলেন, তাহার সমস্তই আমি অবগত আছি। ইহা ব্যতীত একদিবস দিবা দুই প্রহরের সময় যখন আমি আপন কাৰ্য হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, সেই সময়ে পথে হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। তাহারা একখানি গরুর গাড়ি করিয়া তালাবদ্ধ একটি লোহার সিন্ধুক লইয়া গমন করিতেছিল। আমি পূৰ্ব্ব হইতে সেই সিন্ধুক চিনিতাম, উহা বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের সিন্ধুক। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত ছিলাম যে, ইহারা বিলায়েত হোসেনের সমস্ত দ্রব্যাদি স্থানান্তরিত করিতেছে; সুতরাং সেই সিন্ধুকের কোন কথা উহাদিগকে আমি বলি নাই। তৎপরে আমি আপন বাড়ীতে গমন করিলাম। উহারাও আপনাদিগের গন্তব্যস্থানে প্রস্থান করিল। উহাদিগের চাল-চলন দেখিয়া ও উহাদিগের কথাবার্তা শুনিয়া আমার অনুমান হয় যে, বিলায়েত হোসেন তাঁহার জীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। 

চতুর্থ স্বাক্ষরকারী। পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তিগণ যাহা যাহা আপনার নিকট কহিলেন, আমি তাহার প্রায় সমস্তই অবগত আছি। অধিকন্তু যে দিবস হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের বাড়ী হইতে তাঁহার লোহার সিন্ধুক বাহির করিয়া লইয়া যায়, সেদিবস আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সেই লোহার সিন্ধুক কোথায় লইয়া যায়, তাহা জানিবার নিমিত্ত কৌতূহল আসিয়া উপস্থিত হয়। যে গরুর গাড়িতে সিন্ধুক বোঝাই করিয়া উহারা লইয়া যায়, আমি দূর হইতে সেই গাড়ির অনুসরণ করিলে দেখিতে পাই যে, উহারা সেই সিন্ধুক লইয়া হেসারূদ্দিনের বাটীতে গমন করিতেছে, পরে সেই সিন্ধুক উঠাইয়া তাহারা তাহারই গৃহের ভিতর রাখিয়া দিল। এই সমস্ত অবস্থা আমি স্বচক্ষে দর্শন করিয়া আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম। ইহার যে সকল অবস্থা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, ও লোকমুখে যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে আমার অনুমান হয় যে, হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর প্রভৃতি কয়েকজন দুষ্টলোক একত্র হইয়া বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে হত্যা করিয়াছে, এবং তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া আপনারা অজস্র খরচপত্র করিতেছে। 

পঞ্চম স্বাক্ষরকারী। রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় বহুদিবস হইতে আমার নিকট পরিচিত। পূর্ব্বে তাহার অবস্থা যাহাই থাকুক, ইদানীং কিন্তু তাহার নিতান্ত দুরবস্থা আসিয়া উপস্থিত হয়। এমন কি, সকল দিবস তাহার যে নিয়মিতরূপ আহারাদি জুটিত, তাহাও আমার বোধ হয় না। কিন্তু আজকাল দেখিতেছি যে, তাহার আর সে অবস্থা নাই। সে আপনার অবস্থার বিশেষরূপ পরিবর্ত্তন করিয়া লইয়াছে, এবং আজকাল ইচ্ছামত যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করিতেছে। আমার অনুমান হয় যে, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে হত্যা করিয়া তাহারই অর্থে সে আপন অবস্থার পরিবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছে। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্ব পরিচ্ছেদে বর্ণিত ব্যাপার অবগত হইয়া অপর পাঁচজন স্বাক্ষরকারীরও জবানবন্দী গ্রহণ করিলাম। তাহারা পূর্ব্বোক্ত সাক্ষীগণের উক্তির সমর্থন করিল মাত্র। এতদ্ভিন্ন পল্লীবাসীগণের মধ্যে যাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহার নিকট হইতেই ঐরূপ একই প্রকারের উত্তর প্রাপ্ত হইলাম। 

এইরূপ অনুসন্ধানের পর আমার মনে বিশ্বাস হইল যে, ইহারা যাহা যাহা বলিতেছে, তাহার সকল কথাই প্রকৃত। হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর প্রভৃতি ব্যক্তিগণ একত্র হইয়া বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে যে স্থানান্তরে লইয়া গিয়াছে, এবং পরিশেষে তাহার যথাসর্বস্ব যে স্থানান্তরিত করিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া পরিশেষে আমি বিলায়েত হোসেনের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সাক্ষীগণ যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহার সমস্তই প্রকৃত সমস্ত কক্ষই শূন্য, কোন স্থানে কোন দ্রব্যের চিহ্নমাত্রও নাই। 

এই সকল অবস্থা দেখিয়া মনে করিলাম যে, এখন বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন জীবিত আছে কি না, তাহার অনুসন্ধান করাই আমার প্রধান কাৰ্য্য। যদি সে জীবিত থাকে, তাহা হইলে সে এখন কোথায় আছে, এবং কেনই বা সেইস্থানে অবস্থিতি করিতেছে, তাহা অনায়াসেই অবগত হইতে পারিব। আর যদি তাহার মৃত্যু হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে মৃত্যুর কারণই বা কি, এবং তাহার দ্রব্যাদিই বা স্থানান্তরিত হইল কেন, এ বিষয়ের বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন হইবে। আরও স্থির করিলাম, এই সকল বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার পূর্ব্বেই যে হেসারূদ্দিন, রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি ব্যক্তিগণ এই উপস্থিত বিষয়ে সংমিলিত আছে বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহাদিগকে একবার জিজ্ঞাসা করা নিতান্ত আবশ্যক। কারণ, এ বিষয়ে তাহারা কি প্রকার উত্তর প্রদান করে, তাহা জানিতে পারিলে অনুসন্ধানের অনেক সুবিধা হইবার সম্ভাবনা। 

মনে মনে এই সকল বিষয় স্থির করিয়া, রাত্রি অধিক হওয়া প্রযুক্ত সে দিবস আপনার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। এবং পরদিবস অতি প্রত্যূষে রামেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। রামেশ্বর সেই সময় বাড়ীতেই ছিল। আমাকে দেখিবামাত্র সে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “অনেক দিবস আপনার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। আমার বড়ই সৌভাগ্য যে, আপনি আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।” এই বলিয়া আমাকে একখানি বসিবার আসন প্রদান করিল। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিয়া তাহার কথার উত্তরে কহিলাম, “তোমার সৌভাগ্যবশতঃ তোমার বাড়ীতে আজ আমার আগমন হয় নাই। বোধ হয়, তোমার নিতান্ত দুর্ভাগ্য উপস্থিত, হইয়াছে বলিয়া তোমার বাড়ীতে আজ আমি আগমন করিয়াছি। 

রামেশ্বর। ইদানীং আমি এমন কোন কার্য্য করি নাই যে, যাহাতে আমার দুর্ভাগ্য আসিয়া উপস্থিত হইতে পারে। কি কার্য্যের নিমিত্ত আসিয়াছেন বলুন, আমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতেছি। 

আমি। তোমাকে আমার সহিত একস্থানে গমন করিতে হইবে। 

রামেশ্বর। কোথায় গমন করিতে হইবে? 

আমি। হেসারূদ্দিনের বাড়ীতে। 

রামেশ্বর। আপনার এইস্থানে আগমন করিবার উদ্দেশ্য কি, তাহা আপনি আমাকে বলুন বা নাই বলুন, কিন্তু এখন আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াছি। আমি ইতিপূর্বে আপনাকে বলিয়াছিলাম, “আমার বড়ই সৌভাগ্য যে আপনি আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।” এখন দেখুন দেখি, আমার সেই কথা প্রকৃত, কি না। কারণ, যে বিষয়ের অনুসন্ধানের জন্য আপনি এখানে আগমন করিয়াছেন, তাহার অনুসন্ধান করিবার ভার যদি অপর কাহারও হস্তে পতিত হইত, তাহা হইলে বোধ হয়, প্রকৃত তত্ত্ব নিরূপণ করা কঠিন হইয়া দাঁড়াইত, এবং আমরা অপরাধী না হইয়াও বিশেষরূপ লাঞ্ছনা ভোগ করিতাম। আপনি হেসারূদ্দিনের বাড়ীতে গমন করিতে চাহিতেছেন, সে স্থানে এখন গমন করিবার প্রয়োজন নাই। যে স্থানে গমন করিলে আপনার সকল কাৰ্য্য অনায়াসে সম্পন্ন হইয়া যাইবে, চলুন—সেইস্থানে আপনাকে লইয়া যাইতেছি। তিনিও আপনার বিশেষরূপে পরিচিত ও বন্ধু। তাঁহার নিকট গমন করিলেই আপনি সমস্ত বিষয়ই অবগত হইতে পারিবেন। কারণ, আমি জানি যে, আপনার উপর তাঁহার যেরূপ বিশ্বাস আছে, সেরূপ বিশ্বাস অপর কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারীর উপর তাঁহার আছে কি না, সন্দেহের কথা। 

রামেশ্বরের কথা শ্রবণ করিয়া আমার আর কোন কথা বলিবার উপায় রহিল না। পূর্ব্বে আমি ভাবিয়াছিলাম যে, রামেশ্বরকে দরখাস্তের কথা না বলিয়া তাহার ও তাহার সঙ্গী হেসারূদ্দিনের নিকট হইতে যতদূর পারি, প্রকৃতকথা জানিয়া লইব, এবং আবশ্যক হইলে তাহাদিগের বিপক্ষে যে কিরূপ অভিযোগ উপস্থিত হইয়াছে, পরিশেষে তাহা তাহাদিগকে বলিব। কিন্তু আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, কার্য্যে তাহা করিতে পারিলাম না। হেসারূদ্দিনের নাম করিবামাত্রই রামেশ্বর সকল কথা বুঝিয়া লইল। ইহাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে, মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট তাহাদিগের বিপক্ষে যে একখানি দরখাস্ত প্রেরণ করা হইয়াছে, তাহার বিষয় পূর্ব্ব হইতেই ইহারা অবগত আছে। 

রামেশ্বরের কথায় আমি কোনরূপ প্রতিবাদ না করিয়া, যে স্থানে সে আমাকে লইয়া যাইতে চাহে, সেই স্থানেই তাহার সহিত গমন করিতে প্রস্তুত হইলাম। রামেশ্বরও আমাকে সঙ্গে লইয়া তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত হইল, এবং পরে জনৈক প্রধান উকীলের বাড়ীতে আমাকে লইয়া গেল। সেই উকীলের বাটীতে উপনীত হইয়া দেখিলাম যে, রামেশ্বর পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছিল, তাহা প্রকৃত;—উক্ত উকীল মহাশয় আমার বহুদিবসের পুরাতন বন্ধু। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

যে সময় আমি উকীল মহাশয়ের বাড়ীতে গমন করিলাম, সেই সময়ে তিনি অনেকগুলি মক্কেলে পরিবেষ্টিত হইয়া তাহাদিগের মোকদ্দমা সম্বন্ধে পরামর্শ করিতেছিলেন। আমাকে দেখিবামাত্র সাদর সম্ভাষণ করিয়া তিনি আমাকে সেইস্থানে বসাইলেন, এবং রামেশ্বরকেও সেইস্থানে বসিতে কহিলেন। যখন আমি তাঁহার বাড়ীতে গমন করি, সেই সময় রামেশ্বর আমার সঙ্গেই ছিল। সুতরাং সেইদিবস সেইস্থানে আমার গমন করিবার কারণ তিনি অনায়াসেই বুঝিতে পারিলেন। অন্যান্য মিষ্ট আলাপের পর তিনি আমাকে কহিলেন, “এ বিষয়ের অনুসন্ধানের ভার আপনার উপর অর্পিত হইয়াছে, ইহাতে আমি যে কতদূর সন্তুষ্ট হইয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, এ বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব আপনি ব্যতীত অপর কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী যে অবগত হইতে পারিবেন, সে আশা আমি করি না। সে যাহা হউক, এখন অনেকগুলি লোক এইস্থানে উপস্থিত আছেন, তাঁহাদিগের সম্মুখে আপনার কার্য্য যে সুচারুরূপে সম্পন্ন হইবে, সে ভরসা আমার নাই। আমার বিবেচনায় সন্ধ্যার পর আপনি এইস্থানে আগমন করিবেন। হেসারূদ্দিন, রামেশ্বর প্রভৃতি যে সকল ব্যক্তি ইহাতে সংলিপ্ত, তাহাদিগকেও আমি এইস্থানে আনাইয়া রাখিব, এবং আমার অপরাপর মক্কেলগণ যাহাতে সেই সময় এইস্থানে আগমন না করেন, তাহারও বন্দোবস্ত করিব।” 

উকীল বাবুর কথা নিতান্ত অযুক্তি-সঙ্গত নহে বিবেচনায়, আমি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। রামেশ্বর সেইস্থানেই বসিয়া রহিল। এই অনুসন্ধান সম্বন্ধে সমস্ত দিবস আর কিছুই না করিয়া, সন্ধ্যার পরেই সেই উকীলবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। দেখিলাম, উকীলবাবু আমার প্রত্যাশায় বাড়ীতেই বসিয়া আছেন, এবং রামেশ্বরের সহিত এই সম্বন্ধেই কথাবার্তা কহিতেছেন। যে গৃহে উকীলবাবু বসিয়াছিলেন, সেই গৃহের সম্মুখবর্তী রোয়াকের উপর আরও দুই তিন জন মুসলমান বসিয়া রহিয়াছেন। অনুমানে বুঝিলাম যে, ইঁহাদিগের মধ্যে কোন না কোন ব্যক্তি হেসারূদ্দিন হইবেন। 

আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলে অপরাপর দুই চারিটি কথার পর উকীল বাবু আমাকে কহিলেন, “আপনি কি কি বিষয় জানিতে চাহেন, তাহা এখন আমাকে বলিতে পারেন।” 

আমি। আমি কি বিষয়ের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছি, তাহার সবিশেষ বিবরণ আপনি অবগত আছেন কি?

উকীল। বিশেষরূপ অবগত নহি; কেবল এইমাত্র শুনিয়াছি যে, রামেশ্বর, হেসারূদ্দিন প্রভৃতি কয়েকজন লোকের নামে, বিলায়েত হোসেনকে হত্যা করিয়া তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করা অপরাধে নালিস রুজু হইয়াছে। 

আমি। আপনি যেরূপ শুনিয়াছেন, অভিযোগ সেইরূপই বটে; তথাপি যদি আপনি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আপনার মক্কেলগণের বিপক্ষে যে দরখাস্ত হইয়াছে, তাহা আপনাকে দেখাইতে পারি। 

উকীল। সেই দরখাস্ত আমাকে দেখাইতে যদি আপনার কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে আমিও একবার দেখিতে ইচ্ছা করি। 

উকীল মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া সেই দরখাস্তখানি বাহির করিয়া আমি তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি সবিশেষ মনোযোগের সহিত উহা ক্রমান্বয়ে দুই তিন বার পাঠ করিলেন। পরিশেষে আমাকে কহিলেন, “এই দরখাস্তে যে দশজন লোকের নাম স্বাক্ষর আছে দেখিতেছি, সেই সকল নামের লোক প্রকৃতই বৰ্ত্তমান আছে, কি কতকগুলি মিথ্যা নাম লিখিয়া দিয়া দরখাস্তের কলেবর পুষ্টি করা হইয়াছে?” 

আমি। দরখাস্ত স্বাক্ষরকারী সমস্ত লোকই বালিগঞ্জে বিদ্যমান আছে। তাহাদিগের সকলের সহিতই আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে। 

উকীল। দরখাস্তে যে যে বিষয় লিখিত আছে, তাহারা সকলেই কি সেই সকল কথার পোষকতা করে? 

আমি। কেবল তাহারা নহে, বালিগঞ্জের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই একবাক্যে দরখাস্ত লিখিত সমস্ত বিষয়ই উত্তমরূপে প্রমাণ করিতেছে। তাহারা যে যে বিষয় অবগত আছে, ও আমার নিকট যাহা যাহা বলিয়াছে, তাহা আমি লিখিয়া লইয়াছি। আপনি ইচ্ছা করেন ত তাহাও দেখিতে পারেন। 

উকীল। আপনি যতদূর অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবং এ সম্বন্ধে যতদূর প্রমাণ প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহাতে আপনার কি অনুমান হয়? 

আমি। যাহাদিগের নামে এই ভয়ানক অভিযোগ, প্রমাণ গ্রহণের পর যখন তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রয়োজন হইয়াছে, তখন আপনিই অনুমান করিয়া দেখুন, উহাদিগের উপর আমার সন্দেহ হইয়াছে, কি না। 

উকীল। উহাদিগের বিপক্ষে কি প্রকার প্রমাণ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছেন, আমার নিকট প্রকাশ করিতে কোন আপত্তি নাই, ইহা ইতিপূৰ্ব্বেই বলিলেন। যাহাতে সাক্ষীগণের জবানবন্দী লিখিয়া লইয়াছেন, সেই কাগজপত্র আপনার নিকটেই আছে কি? 

আমি। আছে বই কি। 

এই বলিয়া সমস্ত কাগজপত্র উকীল মহাশরের হস্তে অর্পণ করিলাম। তিনি একাগ্রমনে সমস্ত কাগজ উত্তমরূপে দেখিয়া পরিশেষে কহিলেন, “ইহাতে আমার মক্কেলগণের বিপক্ষে এমন কোন কথা নাই যে, যাহা ইহাদিগের বিপক্ষে প্রমাণস্বরূপ হইবে। সাক্ষীগণ যে সকল কথা বলিয়াছে, তাহার অধিকাংশই আমরা অস্বীকার করিতে পারি না। আপনি যেমন সাক্ষীগণের জবানবন্দী লিখিয়া লইয়াছেন, আসামীগণের জবানবন্দীও একে একে গ্রহণ করুন, তাহা হইলেই প্রায় সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন। তাহার পর আরও কোন বিষয় অবগত হইবার যদি আপনার আবশ্যক হয়, তাহা আমাকে কহিবেন, আমি আমার সাধ্যমত সমস্ত কথা আপনাকে বলিয়া দিব।” 

আমি। সাক্ষীগণের মুখে যে সকল কথা প্রকাশ হইয়াছে, বা দরখাস্তে যে সকল বিষয়ে লিখিত আছে, সেই সমস্ত কথাই কি আপনার মক্কেলগণ স্বীকার করিয়া লইবেন? 

উকীল। সমস্ত কথা না হউক, আমার বোধ হয় যে, অধিকাংশ কথাই স্বীকার করিয়া লইবে। 

আমি। এই সকল কথার অধিকাংশই যদি উহারা স্বীকার করিয়া লয়, তাহা হইলে উহারা যে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ, তাহা আপনি কিরূপে বলিতেছেন? 

উকীল। আমার সামান্য বুদ্ধিতে যতদূর বুঝিতে পারিতেছি, তাহাতে উহাদিগকে নির্দোষ বলিয়াই আমি স্থির করিয়া রাখিয়াছি। উহাদিগের নিকট হইতে সমস্ত কথা শুনিলে, আপনাকেও হয় ত আমার মতে মত দিতে হইবে।

আমি। উহারা প্রকৃতই তবে কি বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে তাঁহার বাড়ী হইতে স্থানান্তরে লইয়া গিয়াছিল?

উকীল। আমি যেরূপ শুনিয়াছি, তাহাতে বৃদ্ধকে উহারা লইয়া গিয়াছিল বলিয়াই আমার বোধ হয়।

আমি। বৃদ্ধ এখন কোথায়? 

উকীল। এ কথার উত্তর আপনি আপনার আসামীগণের নিকট হইতেই ভালরূপ প্রাপ্ত হইবেন। 

আমি। আপনার কথার ভাবে অনুমান হইতেছে যে, বৃদ্ধ এখনও জীবিত আছে। আমার এই অনুমান যদি সত্য হয়, তাহা হইলে তাহার দ্রব্যাদি ওরূপ ভাবে স্থানান্তরিত করিবার প্রয়োজন কি? 

উকীল। কেন যে উহারা বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের দ্রব্য সামগ্রী স্থানান্তরিত করিয়াছে, তাহাও বোধ হয়, উহারা আপনাকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিতে সমর্থ হইবে। 

আমি। যে যে ব্যক্তির বিপক্ষে এই দরখাস্ত হইয়াছে, তাহারা সকলেই এইস্থানে উপস্থিত আছে কি? 

উকীল। উহাদিগকে আনাইবার নিমিত্ত আপনাকে কষ্ট সহ্য করিতে হইবে না। কারণ, সকলকেই আমি এইস্থানে আনাইয়া রাখিয়াছি। 

উকীল মহাশয়ের সহিত এইরূপ কথোপকথনের পর তাহাদিগের জবানবন্দী লিখিতে আরম্ভ করিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

উকীল মহাশয়ের সহিত পূর্ব্ব পরিচ্ছেদে বর্ণিত কথাবার্তার পর, উপস্থিত মোকদ্দমা সম্বন্ধে যে ব্যক্তিগণের বিপক্ষে দরখাস্ত হইয়াছে, সেইস্থানে বসিয়া একে একে তাহাদিগের জবানবন্দী লিখিয়া লওয়াই স্থির করিলাম। 

রামেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে সর্ব্বপ্রথমে আমার নিকট ডাকিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম,—“তুমি হিন্দু, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ। তুমি মুসলমানদিগের সহিত মিলিত হইয়া এরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে কেন?” 

রামেশ্বর। কোন কাৰ্যে? 

আমি। বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে হত্যা করিয়া তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়াছ, এই কাৰ্য্য। 

রামেশ্বর। আমি বিলায়েত হোসেনকে হত্যাও করি নাই, বা তাহার যথাসর্বস্ব অপহরণও করি নাই, তবে স্থানান্তরিত করিয়াছি সত্য। 

আমি। কেন স্থানান্তরিত করিলে? 

রামেশ্বর। হেসারূদ্দিন বালিগঞ্জে একজন মান্যমান লোক। বিশেষতঃ তাঁহার সহিত আমার বহুদিবসের প্রণয়। তাঁহারই উপকারের নিমিত্ত আমি এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলাম; কিন্তু ইহাতে আমি যে কোন প্রকার অন্যায় কার্য্য করিয়াছি, তাহা আমার বোধ হয় না। 

আমি। তুমি এ সম্বন্ধে কি কি কার্য্য করিয়াছ, এবং কেনই বা করিয়াছ, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ আমার নিকট ক্রমে ক্রমে বর্ণন কর দেখি। 

রামেশ্বর। আপনি বোধ হয়, অবগত হইতে পারিয়াছেন যে, বিলায়েত হোসেন হেসারূদ্দিনের বৈবাহিক। কয়েক মাস পূৰ্ব্বে বিলায়েত হোসেনের পুত্র মনসুর আলির সহিত হেসারূদ্দিনের কন্যার বিবাহ হয়। 

আমি। একথা আমি পূৰ্ব্বেই শুনিয়াছি। 

রামেশ্বর। বিবাহের কিছুদিবস পরেই একটি মারপিট মোকদ্দমায় মনসুর আলি আসামী হয়, ও তাহাতে ছয় মাসের নিমিত্ত তাহার কারাবাসের আজ্ঞা হয়। 

আমি। একথাও আমি অবগত আছি। উহার সহিত তোমাদিগের এ মোকদ্দমার কোনরূপ সংস্রব আমি দেখিতেছি না। তোমাদিগের উপর যে অভিযোগ উপস্থিত হইয়াছে, তাহারই বৃত্তান্ত বল। 

রামেশ্বর। সবিশেষ সংস্রব আছে বলিয়াই আমি আপনাকে কহিতেছি। কারণ, আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা আপনাকে না বলিলে, আপনি সমস্ত অবস্থা ভালরূপে বুঝিতে পারিবেন না। 

আমি। আচ্ছা, তাহা হইলে যাহা তুমি বলিতে চাহ, তাহা সমস্ত বল। আমিও সমস্তই লিখিয়া লই। 

রামেশ্বর। মনসুর আলির দণ্ডের বিরুদ্ধে পরে আপীল হয়, এবং যে পর্য্যন্ত আপীলের বিচার শেষ না হয়, সেই পর্য্যন্ত মনসুর আলি হাজার টাকার জামিনে অব্যাহতি পায়। বিচারের দিবস মনসুর আলি আদালতে উপস্থিত হয় নাই। আপীল আদালত নিম্ন আদালতের দণ্ডই বাহাল করিল। ছয় মাসকাল কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইবে, এই ভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া সে আর হাজির হইতেই পারে নাই। সুতরাং জামিনদারের নিকট হইতে তাহার জামিনের হাজার টাকা আদায় হয়, এবং তাহাতে ধৃত করিবার নিমিত্ত গ্রেপ্তারী ওয়ারেন্ট বাহির হয়। ওয়ারেন্ট বাহির হইবার পর কিছুদিবস পর্য্যন্ত সে লুক্কায়িত ভাবে আপনার বাড়ীতেই অবস্থান করে। ক্রমে একথা প্রকাশ হইয়া পড়ে, এবং পুলিসের নিকট গিয়া পরে একথা উপস্থিত হয়। সেই সময় একদিন রাত্রিযোগে মনসুর আলি আপনার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া তাহার শ্বশুর হেসারূদ্দিনের বাড়ীতে গমন করে, ও লুক্কায়িত ভাবে সেইস্থানেও কিছুদিবস বাস করে। এ সংবাদও পুলিস জানিতে পারিয়া, তাহাকে ধৃত করিবার নিমিত্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে থাকেন। 

“হেসারূদ্দিন আমার বহুদিবসের পুরাতন বন্ধু। তিনি প্রায় আমার বাড়ীতে সর্ব্বদা আসিতেন, আমিও যখন তখন তাহার বাড়ীতে গমন করিতাম; সুতরাং এ সমস্ত বিষয়ই আমি হেসারূদ্দিনের নিকট হইতে অবগত হইতে পারি। সেই সময় একদিবস হেসারূদ্দিন আমাকে কহিলেন, “সেই জামাতাটি জেলের ভয়ে যখন নিতান্ত ভীত হইয়া পড়িয়াছেন, তখন কোনক্রমেই উহাকে পুলিসের হস্তে অর্পণ করা যায় না। অথচ তাহারা যদি আমার বাড়ী হইতে উহাকে ধরিয়া লইয়া যায় সেও বড় লজ্জা ও অপমানের কথা। এরূপ অবস্থায় জামাতাকে স্থানান্তরিত করাই কৰ্ত্তব্য। তারকেশ্বরের নিকটবর্ত্তী কোন এক পল্লীগ্রামে আমার একজন দূর কুটুম্ব বাস করেন। তিনি আমার নিতান্ত বশীভূত লোক। আমার বিবেচনায় মনসুর আলিকে সেইস্থানে রাখিয়া আসিতে পারিলে বোধ হয়, মন্দ হয় না। কারণ, সেইস্থানের পুলিস ইহার কিছুমাত্র অবগত নহেন, অথচ এইস্থানের পুলিসের পক্ষে সেই সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া নিতান্ত সহজে হইবে না।” হেসারূদ্দিনের প্রস্তাব নিতান্ত অযৌক্তিক নহে বিবেচনা করিয়া আমি তাহাতে সম্মত হইলাম, এবং একদিবস রাত্রিকালে আমি ও হেসারূদ্দিন উভয়ে মনসুর আলিকে সঙ্গে লইয়া, তারকেশ্বরের নিকটবর্তী সেই পল্লীগ্রামে উপনীত হইলাম। হেসারূদ্দিনের সেই আত্মীয় সেই সময় বাড়ীতেই ছিলেন। তাঁহাকে সমস্ত কথা পরিষ্কার করিয়া বলায় এবং মাসে মাসে তাঁহাকে অর্থ সাহায্য করিতে স্বীকৃত হওয়ায়, তিনি মনসুর আলিকে আপন বাড়ীতে স্থান প্রদান করিতে স্বীকার করিলেন। আমরাও দুই এক দিবস সেইস্থানে থাকিয়া তাঁহাকে আপাততঃ কিছু অর্থ প্রদান পূৰ্ব্বক সেইস্থান হইতে আপন আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। মনসুর আলি প্রাণের ভয়ে সেই স্থানেই অবস্থান করিতে লাগিল। “এই প্রকারে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর, একজন লোক আসিয়া হেসারূদ্দিনকে সংবাদ প্রদান করিল যে, মনসুর আলি অতিশয় পীড়িত হইয়া পড়িয়াছেন। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমি ও হেসারূদ্দিন পুনরায় সেইস্থানে গমন করিলাম। দেখিলাম,—মনসুর আলি প্রকৃতই পীড়িত হইয়া পড়িয়াছে। আমরা সেইস্থানে তিন চারি দিবস অবস্থিতি পূৰ্ব্বক তাহার চিকিৎসার যতদূর সম্ভব, বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম। ক্রমে রোগের উপশম বোধ হইতে লাগিল। সেইস্থানে আমাদিগের অধিক দিবস থাকিলে চলে না; সুতরাং মনসুর আলির রোগের একটু উপশম হইলেই আমরা সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিলাম। 

“বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিবার পর হেসারূদ্দিন, বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে তাঁহার পুত্রের পীড়ার সংবাদ প্রদান করেন। পুত্রের পীড়ার সংবাদ পাইয়া তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত বৃদ্ধ একবারে অধীর হইয়া উঠিলেন, এবং সেইস্থানে গমন করিয়া পুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। হেসারূদ্দিন ও আমি অনেকরূপ প্রবোধ বাক্যে তাঁহাকে বুঝাইবার চেষ্টা করি; কিন্তু তিনি কিছুতেই আমাদিগের বাক্যে সান্ত্বনা পাইলেন না। যখন দেখিলাম যে, বৃদ্ধ তাঁহার পুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, কোনরূপেই আমাদিগের প্রবোধ বাক্য মানিতেছেন না; তখন তাঁহাকে আজ লইয়া যাইব, কাল লইয়া যাইব, করিয়া ক্রমে দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। সেই সময় হেসারূদ্দিন মনসুর আলির লিখিত একখানি পত্র প্রাপ্ত হইলেন। 

আমি। পত্র লোকের হস্তে আসিয়াছিল কি? 

রামেশ্বর। না, কোন লোক উক্ত পত্ৰ লইয়া আইসে নাই। ডাকযোগে তাহা আসিয়া হেসারূদ্দিনের হস্তে পতিত হইয়াছিল। 

আমি। সে পত্রখানি এখন কোথায়? 

রামেশ্বর। উহা এখন উকীল মহাশয়ের নিকটেই আছে। আপনি ইচ্ছা করেন ত দেখিতে পারেন। 

রামেশ্বরের কথা শ্রবণ করিয়া উকীল মহাশয় তাঁহার বাক্স হইতে পত্রখানি বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। 

পত্রখানি একবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া আমি দেখিলাম যে, উহা বাঙ্গালায় লিখিত। সেই সময় আমি হেসারূদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই পত্রখানি কাহার হস্তলিখিত বলিয়া বোধ হয়?” উত্তরে সে কহিল, “আমি আমার জামাতার হস্তের লেখা উত্তমরূপে চিনি, এ পত্র তাহার নিজের হস্তে লেখা।” 

আমি। পত্র প্রাপ্ত হইলে পরে তোমরা কি করিলে? 

রামেশ্বর। পত্রের কথা বৃদ্ধকে বলিতেই হইল। তিনি পত্রখানি দেখিয়া আরও উদ্বিগ্ন হইলেন এবং যাহাতে শীঘ্র তিনি তাঁহার পুত্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারেন, তাহার নিমিত্ত তাঁহার বৈবাহিককে বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যে পত্র দেখিয়া বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন সবিশেষরূপে উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন, সেই পত্রখানি আমিও পাঠ করিয়া দেখিলাম। উহার সারমর্ম্ম এইরূপঃ—

“আপনি আমার শরীরের অবস্থা যেরূপ দর্শন করিয়া গিয়াছিলেন, সেইরূপ অবস্থায় আমি দুই তিন দিবস অতিবাহিত করি। তাহার পর হইতে পুনরায় আমার অসুখ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে, এবং দিন দিন উত্তরোত্তর আরও বাড়িতেছে। শরীরের গতি কখন কি হয়, তাহা বলা যায় না। পিতাকে একবার দেখিবার নিমিত্ত আমার মন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িয়াছে। বাড়ীতে গিয়া তাঁহাকে যে একবার দেখিয়া আসিব, সে ক্ষমতা আমার এখন হয় নাই। সুতরাং অভাব পক্ষে এক দিবসের নিমিত্তও পিতা যদি একবার আসিতে পারেন, তাহা হইলেও আমার মনস্কামনা পূর্ণ হয়। আপনি আমার এই পত্রখানি আমার পিতাকে দেখাইবেন, এবং তাঁহাকে একবার এখানে আসিতে বলিবেন, যদি তিনি অভাব পক্ষে এক দিবসের নিমিত্তও এখানে আসিতে পারেন, তাহা হইলে আপনি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া এখানে লইয়া আসিবেন। কারণ, আমি যে কোথায় অবস্থান করিতেছি, তাহা বোধ হয়, তিনি অবগত নহেন। আমি এ পর্যন্ত তাঁহাকে কোন পত্রাদি লিখি নাই, বা লিখিতেও ইচ্ছা করি না। কি জানি, পিতার নামে পত্র যদি কোন গতিতে অপর কাহারও হস্তে পতিত হয়, তাহা হইলেই সৰ্ব্বনাশ! আপনিও যদি কাৰ্য্যবশতঃ না আসিতে পারেন, তাহা হইলে রামেশ্বরবাবুর সহিত পিতাকে এইস্থানে পাঠাইয়া দিলেও চলিতে পারে ইতি।” 

উক্ত পত্র পাঠ সমাপ্ত হইলে আমি রামেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন পুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত সেইস্থানে গমন করিয়াছিল কি?” 

রামেশ্বর। এই পত্র দেখিয়া পুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত বৃদ্ধ যে কিরূপ ব্যস্ত হইয়া পড়েন, তাহা আপনাকে আর কি বলিব? বৃদ্ধের অবস্থা দেখিয়া তাহাকে সেইস্থানে লইয়া যাওয়াই স্থির করিলাম। তথাপি কোন গতিতে আরও দুই চারি দিবস বিলম্ব হইয়া পড়িল। সেই সময়ে হেসারূদ্দিন আরও একখানি পত্র পাইলেন। সেই পত্র পাইয়া আমরা আর বিলম্ব করিতে না পারিয়া, বৃদ্ধের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং বৃদ্ধকে সেই পত্রখানি দেখাইলাম। পত্রখানি দেখিয়া বৃদ্ধ আরও অস্থির হইয়া পড়িল। 

আমি। সে পত্রখানি কোথায়? 

রামেশ্বর। সে পত্রখানিও উকীল মহাশয়ের নিকট আছে। 

উকীলবাবু রামেশ্বরের কথা শ্রবণ করিয়া সেই পত্রখানিও আপনার বাক্স হইতে বাহির করিয়া, আমার হস্তে প্রদান করিলেন। 

আমি উহা আদ্যোপান্ত পাঠ করিলাম। উহাতে নিম্নলিখিতরূপ লেখা ছিল :—

“পূর্ব্বে আমি আপনাকে একখানি পত্র লিখিয়াছি, বোধ হয় পাইয়া থাকিবেন। কিন্তু এ পর্যন্ত আপনি কি আমার পিতা কেহই এখানে আসিলেন না। আমার অসুস্থতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। এ যাত্রা আমি যে রক্ষা পাইব, সে বিশ্বাস আমার নাই। পত্রাদি লিখিবার ক্ষমতাও আমার আর নাই। আপনি আমার পিতাকে বলিবেন যে, যদি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার তাঁহার বাসনা থাকে, তাহা হইলে যত শীঘ্র পারেন, তিনি আসিয়া আমার সহিত যেন সাক্ষাৎ করিয়া যান। বিলম্বে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই, ইতি।” 

রামেশ্বর। যে দিবস এই পত্র বৃদ্ধ দেখিতে পাইলেন, সেইদিবস তাঁহাকে আর কোনরূপেই সান্ত্বনা দান করিয়া রাখিতে পারিলাম না; তিনি নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া সেইদিবসই আমাদিগের সহিত বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। আমরা তাঁহাকে লইয়া যে গ্রামে তাঁহার পুত্র ছিল, সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমরা সেইস্থানে গিয়া দেখিলাম, মনসুর আলি প্রকৃতই অতিশয় পীড়িত হইয়া পড়িয়াছে। আমরা সেইস্থানে দুই চারি দিবস অবস্থিতি করিয়া, সেই গ্রামের একজন চিকিৎসকের দ্বারা চিকিৎসা করাইতে লাগিলাম। দিন দিন রোগে উপশম হইতে লাগিল, ক্রমে মনসুর আলি সুস্থ হইল। আমরা সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিলাম; কিন্তু বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন আমাদিগের সহিত আগমন করিলেন না; সেইস্থানেই অবস্থান করিতে লাগিলেন। আমরা যখন সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম, তখন বৃদ্ধ আমাদিগকে কহিলেন, ‘আমি আরও কিছুদিবস এইস্থানে থাকিব। পুত্র উত্তমরূপে আরোগ্য লাভ করিলে, আমি বালিগঞ্জে গমন করিব।’ 

“আমরা প্রত্যাবর্তন করিয়া কিছুদিবস পর্যন্ত আপন আপন কৰ্ম্মে নিযুক্ত রহিলাম; কিন্তু বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন বা মনসুর আলির আর কোন সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম না। তাঁহাদিগের সংবাদ না পাইয়া, পরিশেষে হেসারূদ্দিনও ক্রমে চিন্তিত হইয়া উঠিতে লাগিল। তখন মনে মনে স্থির করিল যে, সেইস্থানে গমন করিয়া উভয়কে দেখিয়া আসিবে, এবং বৃদ্ধ যদি প্রত্যাগমন করেন, তাঁহাকেও সঙ্গে করিয়া আনিবে। মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিয়া পরিশেষে স্থির করা হইল যে, আরও তিন চারি দিবস বৃদ্ধের নিমিত্ত অপেক্ষা করা হইবে। ইহার মধ্যে যদি বৃদ্ধ প্রত্যাগমন না করেন, বা কোনরূপে সংবাদ প্রাপ্ত না হওয়া যায়, তাহা হইলে আমরা উভয়েই পুনরায় সেইস্থানে গমন করিব। 

“সেইস্থানে গমন করিবার পরামর্শ স্থির হইবার একদিবস পরেই হঠাৎ একখানি টেলিগ্রাফ আসিয়া হেসারূদ্দিনের হস্তে উপস্থিত হইল।” 

রামেশ্বরের নিকট হইতে এই টেলিগ্রাফের কথা প্রকাশ হইবামাত্র উকীলবাবু পূর্ব্বের ন্যায় তাঁহার বাক্স হইতে সেই টেলিগ্রাফখানি বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমিও উহা তৎক্ষণাৎ পাঠ করিলাম। বুঝিলাম, মনসুর আলি এই টেলিগ্রাফখানি হেসারূদ্দিনের নামে পাঠাইতেছেন। উহাতে এইরূপ লিখিত ছিল, “এখানে আমার পিতা অতিশয় পীড়িত, যদি পারেন—একবার আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।” 

রামেশ্বর। হেসারূদ্দিন এই টেলিগ্রাফখানি পাইবামাত্র আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং আমার হস্তে উহা প্রদান করিলেন। আমি উহা পাঠ করিয়া স্থির করিলাম যে, সেইদিবস সন্ধ্যার পরই আমরা উভয়ে বৃদ্ধকে দেখিবার নিমিত্ত গমন করিব। 

পরামর্শ-মত সন্ধ্যার পরই আমরা উভয়ে সেইস্থানে গমন করিবার মানসে হেসারূদ্দিনের বাড়ী হইতে বহির্গত হইতেছি, এমন সময় আর একজন টেলিগ্রাফ পিয়নকে হেসারূদ্দিনের বাড়ী-অভিমুখে আগমন করিতে দেখিলাম। ক্রমে সেও আমাদিগের নিকটবর্তী হইয়া হেসারূদ্দিনের হস্তে আর একখানি টেলিগ্রাফ অর্পণ করিল। 

“এই সময় উকীলবাবু পূর্ব্বের ন্যায় তাঁহার বাক্স হইতে আর একখানি টেলিগ্রাফ বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমিও সবিশেষ আগ্রহের সহিত উহা পাঠ করিলাম। বুঝিলাম যে, উহাও মনসুর আলি হেসারূদ্দিনের নামে প্রেরণ করিতেছেন। উহাতে লেখা আছে, “পিতার মৃত্যু হইয়াছে। আপনি এই টেলিগ্রাফ পাইবামাত্র এখানে আগমন করিবেন।” 

রামেশ্বর। এই শেষ টেলিগ্রাফ পাইয়া আমাদিগের মনের গতি সে সময় যে কি প্রকার হইল, তাহা আপনিই অনুমান করিয়া দেখুন। যাহা হউক, আমরা বাড়ী হইতে যেমন বহির্গত হইতেছিলাম, আর প্রত্যাবর্তন না করিয়া, অমনি সেইস্থানে প্রস্থান করিলাম। 

“সময়-মত সেই গ্রামে উপনীত হইয়া দেখিলাম, মনসুর আলি আমাদিগকে যে সংবাদ প্রেরণ করিয়াছিল, তাহা প্রকৃত। বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন প্রকৃতই সেইস্থানে ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন, এবং তাঁহার কবরও সেইস্থানে হইয়া গিয়াছে। জিজ্ঞাসার উত্তরে মনসুর আলি কহিল, হঠাৎ বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া তাহার পিতার এই দশা ঘটিয়াছে। যে পর্য্যন্ত মৃত বিলায়েত হোসেনের ঔদ্ধদৈহিক ক্রিয়া সম্পন্ন না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত মনসুর আলিকে সেইস্থানে থাকিবার পরামর্শ দিয়া দুই এক দিবস পরেই আমরা একবার বালিগঞ্জে আগমন করিলাম, এবং আপন আপন বিষয় কর্ম্মের বন্দোবস্ত করিয়া পুনরায় সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সময় মত সেই স্থানেই দশ পাঁচ জন স্বজাতীয় ও ফকীর আদিকে খাওয়াইয়া মনসুর আলিকে সঙ্গে লইয়া, পুনরায় হেসারূদ্দিনের বাড়ীতে আসিয়া উপনীত হইলাম। যে সময় আমরা বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের দ্রব্যাদি তাঁহার বাড়ী হইতে হেসারূদ্দিনের বাড়ীতে আনয়ন করিয়াছিলাম, এবং তাঁহার পুষ্করিণীর মৎস্যাদি বিক্রয় করিয়াছিলাম, সেই সময় মনসুর আলি হেসারূদ্দিনের বাড়ীতেই ছিল। সেই সময় আমরা যাহা কিছু করিয়াছিলাম, তাহার আদেশ অনুযায়ীই করিয়াছি। কারণ, যখন তাহার নিজের বাহির হইবার উপায় নাই, তখন আমরা ব্যতীত তাহাকে আর কে সাহায্য করিবে? অথচ আমরা সাহায্য না করিলে তাহার সমস্ত দ্রব্যই নষ্ট হইয়া যাইবে, ও যে যাহা পাইবে, সে তাহা অপহরণ করিয়া লইবে। 

“যে সকল অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা আনুপূর্ব্বিক বিবরণ যথাযথরূপে আপনার নিকট বর্ণন করিলাম। আপনি বিচারক, এখন বিবেচনা করিয়া দেখুন যে, আমরা বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনকে হত্যা করিয়া তাহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়াছি, কি আমাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়াছি। 

আমি। বৃদ্ধ তবে প্রকৃতই মরিয়া গিয়াছে? 

রামেশ্বর। হাঁ মহাশয়! বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের প্রকৃতই মৃত্যু হইয়াছে। 

আমি। মনসুর আলি এখন জীবিত, কি মৃত? 

রামেশ্বর। মনসুর আলি এখন জীবিত আছে। 

আমি। যদি সে জীবিত থাকে, তাহা হইলে সে এখন কোথায় আছে? 

রামেশ্বর। তাহার পিতার মৃত্যুর পর যে পর্য্যন্ত সে হেসারূদ্দিনের বাটীতে অবস্থান করিত, সেই পৰ্য্যন্ত আমি তাহার সন্ধান রাখিতাম। আজকাল যে সে কোথায় আছে, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি। 

উক্ত শেষ কথা কয়েকটি রামেশ্বর একটু ইতস্ততঃ করিয়া কহিল। তাহার ভাব ভঙ্গীতে বোধ হইল, সে মিথ্যা কথা কহিতেছে। মনসুর আলি এখন কোথায়, তাহা সে অবগত আছে; কিন্তু আমার নিকট প্রকাশ করিতে চাহে না। রামেশ্বরের কথা শেষ হইলে হেসারূদ্দিনের জবানবন্দী গ্রহণ করিলাম। রামেশ্বর যাহা যাহা বলিয়াছিল, হেসারূদ্দিনও সেই প্রকার কহিল। 

সেই সময় উকীলবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন মহাশয়! এখন আপনি বুঝিতে পারিতেছেন, আমার মক্কেলগণ এই মোকদ্দমায় কোন দোষে দোষী, কি না?” 

উত্তরে আমি কহিলাম, “আমি এখনও ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এ বিষয়ে বিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া পরে আমি আপনাকে কহিব, এবং অপর কোন বিষয় জানিবার যদি প্রয়োজন হয়, তাহাও অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক আমাকে জানাইবেন।” এই বলিয়া সমস্ত কাগজপত্র লইয়া, আমি সেইদিবস সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

আমি উকীলবাবুর বাসা পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু আপন বাসায় গমন না করিয়া, বালিগঞ্জের যে স্থানে বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের বাসস্থান ছিল, পুনরায় সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে আমার গমন করিবার প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, যে দুইখানি পত্র উকীল মহাশয় আমাকে প্রদান করিলেন, এবং রামেশ্বর ও হেসারূদ্দিন যে পত্র মনসুর আলির লেখা বলিয়া আমার নিকট পরিচয় প্রদান করিল, তাহা প্রকৃতই মনসুরের লেখা কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার মনে অতিশয় কৌতূহল আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং সেই কৌতূহল নিবারণের নিমিত্তই আমি পুনরায় বালিগঞ্জে গমন করিলাম। বালিগঞ্জের যে সকল ব্যক্তি দরখাস্তে স্বাক্ষর করিয়াছিল, এবং অপরাপর যাহাদিগকে সেইস্থানে উপস্থিত পাইলাম, তাহাদিগকে সেই পত্র দুইখানি দেখাইলাম। কেহ কহিল, এ পত্র মনসুর আলির লিখিত হইতে পারে না। কেহ কহিল, ইহা মনসুর আলির লেখার মত দেখাইতেছে বটে; কিন্তু মনসুর আলির লেখা কি না, তাহা নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি না। এইরূপ নানাজনে নানাকথা বলিতে লাগিল। তাহাদিগের কথা শুনিয়া কোনমতে স্থির করিতে পারিলাম না যে, উহা মনসুর আলির স্বহস্তলিখিত পত্র কি না। 

যাহা হউক, সেই রাত্রিকালে বালিগঞ্জ হইতে আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিতে করিতে মনে মনে কতকগুলি ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। 

১ম। পত্র দুইখানি মনসুর আলির লেখা, কি না। 

২য়। ইহা যদি মনসুর আলির স্বহস্ত-লিখিত না হয়, তাহা হইলে ইহা তাহার লেখার মত কি না? 

৩য়। টেলিগ্রাফ দুইখানি কাহার প্রেরিত? 

৪র্থ। উহা কি প্রকৃতই মনসুর আলির প্রেরিত টেলিগ্রাফ? 

৫ম। প্রকৃতই কি বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন বিসূচিকা রোগে লোকান্তরিত হইয়াছে? 

৬ষ্ঠ। হয় ত ইহারা যাহা বলিতেছে, তাহার সমস্তই প্রকৃত। পুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন সেইস্থানে গমন করিয়াছিল, সেইস্থানেই বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া, সেইস্থানেই পুত্রের সম্মুখে সে ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। 

৭ম। আবার ইহাও হয় ত হইতে পারে, ইহারা যাহা বলিতেছে, তাহার সমস্তই মিথ্যা। ইহারা ষড়যন্ত্র করিয়া দুইখানি পত্র লিখিয়া ডাকে ফেলিয়া দেয়। পরে উক্ত পত্রদ্বয় পুনরায় হস্তগত হইলে উহা বৃদ্ধকে দেখাইয়া বৃদ্ধের মনে এই বিশ্বাসের উৎপাদন করিয়া দেয় যে, তাহার পুত্র প্রকৃতই পীড়িত হইয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া পুত্রকে দেখিবার জন্য বৃদ্ধ পিতা অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়ে; সুতরাং বাটী পরিত্যাগ করাইয়া তাহাকে স্থানান্তরে লইয়া যাইবার নিমিত্ত কোন কষ্টই হয় নাই। এইরূপে দুষ্টগণ তাহাদিগের সুবিধামত স্থানে বৃদ্ধকে লইয়া গিয়া তাহাদিগের মনস্কামনা পূৰ্ণ করিয়া লয়, এবং পরিশেষে ভবিষ্যৎ ভাবিয়া পুলিস ও বিচারকগণের চক্ষুতে ধূলি নিক্ষেপ করিবার মানসে সেই দুইখানি টেলিগ্রাফ প্রেরণ করে। কারণ, ইহারা উত্তমরূপে অবগত আছে যে, মনসুর আলি জেলের ভয়ে এখন লুক্কায়িত। সুতরাং সেই পত্রদ্বয় তাহার লিখিত কিনা, বা সেই টেলিগ্রাফ দুইখানি তাহার প্রেরিত কি না, তাহা আপাততঃ জানিবার কোন সুযোগ নাই। অতএব এই উপায় অবলম্বন করিলে এখন উহারা অনায়াসেই বাঁচিয়া যাইতে পারে। ভবিষ্যতে অর্থাৎ মনসুর আলি ধৃত হইবার পর যদি প্রকাশ হইয়া পড়ে, তখন পুনরায় উহাদিগের বিপক্ষে দোষ প্রমাণ করা নিতান্ত সহজ হইবে না। বিশেষতঃ মনসুর আলি কত বৎসর পরে যে ধৃত হইবে, কি আদৌ ধৃত হইবে না, তাহাই বা এখন কে বলিতে পারে? অথবা ইহারাই যদি অর্থলোভে বৃদ্ধকে হত্যা করিতে পারে, তাহা হইলে আপন আপন জীবন বাঁচাইতে মনসুর আলিকেই বা তাহারা হত্যা না করিতে পারে কিসে? 

এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে আপন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম; কিন্তু মনে সুখ পাইলাম না। এইরূপ প্রবল চিন্তাতেই সে রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। পরদিবস অতি প্রত্যূষে পুনরায় সেই উকীলবাবুর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

আমাকে দেখিবামাত্র উকীলবাবু কহিলেন, “এখন আপনার কি বিবেচনা হইতেছে? সর্ব্বপ্রথমে আপনার মনে যে ধারণা হইয়াছিল, এখন তাহা দূরীভূত হইয়াছে কি?” 

আমি। আপনার মক্কেলগণ যেরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছে, তাহাতে উহাদিগের যে কোনরূপ দোষ আছে, তাহা সহজে বলা যায় না। তথাপি আমার মনের সন্দেহ দূর করিতে পারিতেছি না। 

উকীল। এখন ও এমন কি সন্দেহ আছে যে, তাহা দূর করিতে পারিতেছেন না। 

আমি। সেই পত্র দুইখানি যে মনসুর আলির লিখিত, এবং টেলিগ্রাফ দুইখানি যে তাহারই প্রেরিত, তাহা আমি বিশ্বাস করি কি প্রকারে? 

উকীল। কেন, সে সম্বন্ধে রামেশ্বর ও হেসারূদ্দিন আপনার নিকট যে এজাহার দিয়াছে, আমার বিবেচনায় তাহাই যথেষ্ট। 

আমি। যথেষ্ট স্বীকার করি; কিন্তু এই গুরুতর অভিযোগ উহাদিগের নামেই উপস্থিত হইয়াছে। সুতরাং আপনার জীবন রক্ষার নিমিত্ত উহারা মিথ্যা বলিতে পারে না কি? 

উকীল। উহারাই যেন মিথ্যা কথা কহিল; কিন্তু বালিগঞ্জের ভিতর এমন কি কোন লোক নাই যে, মনসুর আলির হস্তের লেখা চিনিতে পারে? 

আমি। সে চেষ্টা আমি দেখিয়াছি; কিন্তু বালিগঞ্জের ভিতর এমন কোন লোক পাই নাই যে, মনসুর আলির হাতের লেখা দেখিলে চিনিতে পারে। আরও এক কথা, মনে করুন, যদি কোন ব্যক্তি সেই লেখা দেখিয়া কহিত যে, ইহা মনসুর আলির লেখার মত; তাহা হইলেই বা আমি কিরূপে উহা মনসুর আলির লেখা স্থির করিয়া লইতে পারি? কারণ, এই কলিকাতা সহরে এমন লোক বিস্তর পাওয়া যায়, একজনের লেখা দেখিলে অপরে ঠিক সেইরূপ লিখিয়া দিতে পারে। 

উকীল। এরূপ অবস্থায় আপনার মনের সন্দেহ আমি কিরূপে দূর করিতে পারি? 

আমি। দূর করিবার উপায় আছে, এবং আমার বিশ্বাস যে, আপনি মনে করিলে সে উপায় পাইতে পারিব। 

উকীল। এমন উপায় কি আছে? আমি ত ভাবিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। 

আমি। মনসুর আলি এখন উপস্থিত না হইলে এ সন্দেহ সহজে মিটিয়া যাইবার আর কোন উপায় নাই।

উকীল। ইহা আমি স্বীকার করি; কিন্তু আপনি মনে করেন কি যে, যে ব্যক্তি জেলের ভয়ে এতদূর ভীত, সে এখন সহজে আসিয়া আপনার হস্তে পতিত হইবে। 

আমি। আপনি একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন, পিতা বর্ত্তমানে মনসুর আলি যখন যে স্থানে লুক্কায়িত ভাবে বাস করিত, হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর সর্ব্বদাই তাহা জানিতে পারিত। এখন তাহার পিতা মরিয়া গিয়াছে; সুতরাং নিতান্ত আত্মীয় স্বজনের মধ্যে হেসারূদ্দিন ভিন্ন তাহার আর কেহই নাই। এরূপ অবস্থায় আপনি মনে করেন কি যে, মনসুর আলি এখন কোথায়, তাহার বিন্দু বিসর্গও ইহারা অবগত নহে? রামেশ্বর ও হেসারূদ্দিন এখন বিশেষরূপে বিপদাপন্ন; এরূপ অবস্থায় মনসুর আলিকে হাজির করিয়া এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার হওয়া তাহাদিগের কর্তব্য কৰ্ম্ম নয় কি? আমার যদি এ বিশ্বাস থাকিত যে, ইংরাজ রাজত্বে বাস করিয়াও মনসুর আলি কখন ধৃত হইবে না, তাহা হইলে আমি কখন একথা বলিতাম না। যখন কোন না কোন দিবস তাহাকে ধৃত হইতেই হইবে, তখন এই সময়ে উপস্থিত হওয়াই মনসুর আলির পক্ষে একান্ত কৰ্ত্তব্য। 

উকীল। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা প্রকৃত। আর ইহাও আমার বিশ্বাস যে, মনসুর আলি যে স্থানে লুক্কায়িত ভাবে বাস করিতেছে, তাহা হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর অবগত আছে। কিন্তু তাহারা উহা স্বীকার করিবে কি? অথবা উহাকে আনিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিতে স্বীকৃত হইবে কি? 

আমি। উহারা আমাদিগের প্রস্তাবে স্বীকৃত হউক বা না হউক, একবার চেষ্টা করিয়া দেখা বোধ হয়, আমার মতে কৰ্ত্তব্য। 

উকীল। আপনি চেষ্টা করিলে হইবে না। আমি উহাদিগকে ডাকাইয়া বিশেষরূপে চেষ্টা করিয়া দেখিব। এইস্থানে আমার আর একটি কথা জিজ্ঞাস্য আছে যে, যদি উহারা একান্তই উহাকে ধরাইয়া দিতে সম্মত না হয়, তাথচ আপনার সম্মুখে উহাকে আনিয়া উপস্থিত করে, তাহা হইলে উহাকে ধৃত না করিয়া কেবলমাত্র উহার নিকট হইতে সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারিবেন কি? 

আমি। এ বড় শক্ত কথা। এ বিষয়ে এখন আমি প্রতিজ্ঞা করিতে পারি না। কারণ, যখন আমি স্বয়ং পুলিস—কর্ম্মচারী, এবং এখন আমি অবগত হইতে পারিয়াছি যে, মনসুর আলির ছয় মাসের নিমিত্ত কারাদণ্ড হইয়াছে, এবং সে সেই কারাদণ্ডের ভয়ে পলায়ন করিয়াছে, বিশেষতঃ তাহাকে পুনরায় ধৃত করিবার নিমিত্ত ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে; তখন সেই ব্যক্তি আমার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাহার যাহা কিছু বলিবার আছে তাহা বলিবে, এবং আমি উহা লিখিয়া লইব, অথচ তাহাকে ধৃত না করিয়া তাহাকে যদৃচ্ছা গমন করিতে দিব, ইহা নিতান্ত সামান্য কথা নহে। 

উকীল। কথা নিতান্ত সামান্য নহে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি। কিন্তু কি করি, সর্ব্বশেষে এই প্রকার প্রস্তাব করিলেও যদি উহারা মনসুর আলিকে আনিয়া উপস্থিত করে, তাহা হইলে বর্তমান মোকদ্দমা সম্বন্ধে সমস্ত কথা পরিষ্কার হইয়া যায়। 

আমি। এরূপ প্রস্তাবে অন্য আর কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী প্রথমতঃ সম্মত হইলেও হইতে পারেন। বস্তুতঃ পরিশেষে সেই প্রতিজ্ঞা যে কতদূর রক্ষা করিতে পারেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু আপনি আমাকে বহুদিবস হইতে অবগত আছেন; আমি এরূপ প্রস্তাবে কখনই সম্মত হইতে পারিব না। 

উকীল। আপনার স্বভাব চরিত্র আমি উত্তমরূপে অবগত আছি বলিয়াই, আপনার নিকট এইরূপ প্রস্তাব করিতে সাহসী হইলাম। আমার অপরিচিত অপর কোন পুলিস কর্মচারী হইলে তাঁহার নিকট এরূপ কথা কখনই উল্লেখ করিতে পারিতাম না। 

আমি। এ বিষয় সম্বন্ধে আমি বিশেষরূপে চিন্তা করিয়া দেখিব, ও পরিশেষে আপনাকে ইহার উত্তর প্রদান করিব। কিন্তু সহজে যাহাতে কার্য্য উদ্ধার হইতে পারে, সে বিষয়ে আপনি প্রথমতঃ চেষ্টা দেখুন। সকল কার্য্য সহজে মিটিয়া যাওয়া যেমন বাঞ্ছনীয় ও সুবিধাজনক, তাহা আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন। 

উকীলবাবুর সহিত এইরূপ কথাবার্তার পর, সন্ধ্যার সময় আসিয়া পুনরায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এই বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

উকীলবাবু যেরূপ গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবার প্রস্তাব করিয়াছেন, সেইরূপ প্রস্তাবে সম্মত হইলে আমার নিজের বিশেষরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা আছে কি না; সেই বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না! 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

উকীলবাবুর সহিত আমার যেরূপ কথা ছিল, ঠিক সেই সময়ে পুনরায় তাঁহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, তিনি একাকী আমার অপেক্ষায় বসিয়া আছেন। আমি তাঁহার নিকট গিয়া উপবেশন করিলে তিনি কহিলেন, “আপনি এইস্থান হইতে গমন করিবার পরেই আমি, হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর উভয়কেই ডাকাইয়াছিলাম। তাহাদিগের কথার ভাবে আমার অনুমান হইল যে, মনসুর আলি লুক্কায়িত ভাবে কোথায় অবস্থান করিতেছে, তাহা তাহারা অবগত আছে; কিন্তু তাহাকে আপনার সম্মুখে উপস্থিত করিতে উহারা কোনরূপেই সম্মত হইল না। যে যে প্রস্তাব আমি আপনার নিকট করিয়াছিলাম, পরিশেষে উহাদিগের নিকটও সেই প্রস্তাব করিলাম। কিন্তু তাহাতেও উহাদিগের মন লওয়াইতে পারিলাম না। আমি তাহাদিগকে পুনরায় আমার নিকট আসিতে বলিয়া দিয়াছি, বোধ হয়, এখনই উহারা আগমন করিবে। আসিলে আপনার সম্মুখে পুনরায় আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব।” 

আমার সহিত এইরূপ কথা হইতে হইতে, রামেশ্বর ও হেসারূদ্দিন আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। তাহাদিগকে দেখিবামাত্র উকীলবাবু কহিলেন, “প্রিয়বাবু আগমন করিয়া তোমাদিগের অপেক্ষায় বসিয়া আছেন। আমার প্রস্তাব সম্বন্ধে তোমরা কি বিবেচনা করিয়াছ?” 

রামেশ্বর। নূতন করিয়া আর কি বিবেচনা করিব? আপনাকে পূর্ব্বাপরই বলিয়া আসিতেছি যে, মনসুর আলি এখন কোথায়, তাহার বিন্দু বিসর্গও আমরা অবগত নহি। 

উকীল। দেখ রামেশ্বর! যাহাতে তোমাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হয়; সে কাৰ্য্য আমা-কর্তৃক হইবে না। তোমরা এখন বিশেষরূপে বিপদগ্রস্ত; সুতরাং আমার কর্তব্য—যাহাতে এই বিপদ হইতে তোমরা উদ্ধার হইতে পার, সেই দিকে দৃষ্টি রাখা। 

রামেশ্বর। আপনি আমাদিগের শুভাকাঙ্ক্ষী, তাহা আমরা অবগত আছি। কিন্তু আপনি ত জানিতে পারিতেছেন যে, মনসুর আলি জেলের ভয়ে কিরূপ ভীত। 

উকীল। মনসুর আলি জেলের ভয়ে যে কিরূপ ভীত, তাহা আমি অবগত আছি। কিন্তু ইহাও আমি নিশ্চিত বলিতে পারি যে, একদিবস না একদিবস তাহাকে ধৃত হইতেই হইবে, এবং সেইদিবস তাহাকে জেলেও গমন করিতে হইবে। তাহা অপেক্ষা এখন যদি যে উপস্থিত হয়, তাহা হইলে তোমাদিগের বিপদের সম্ভাবনা থাকিবে না। 

রামেশ্বর। আপনি আমাদিগের ভালর নিমিত্তই যাহা বলিতেছেন, তাহা বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু বুঝিয়া কি করিব? আমরা একবারে উপায়হীন হইয়া পড়িয়াছি। 

উকীল। এই যে অনুসন্ধানকারী কর্মচারীকে তোমরা এইস্থানে দেখিতেছ, ইঁহার পরামর্শ-মত না চলিলে ইনি পদে পদে তোমাদিগকে নানারূপ কষ্ট দিতে পারেন, তাহা বোধ হয়, তোমাদিগকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি কথা তোমাদিগকে বলিতেছি, মনোযোগের সহিত শ্রবণ কর। যে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে এখন ইনি নিযুক্ত আছেন, ইচ্ছা করিলে সেই মোকদ্দমা অনেক দিবস পর্য্যন্ত ইনি তদারকে রাখিতে পারেন। ওদিকে তোমাদিগের এজাহারে তোমরাই প্রকাশ করিয়াছ যে,—

১ম। মনসুর আলির কারাবাসের আদেশ হইলেও সে লুক্কায়িত হইয়াছে, তাহা তোমরা অবগত আছ।

২য়। মনসুর আলিকে ধৃত করিবার নিমিত্ত পুনরায় গ্রেপ্তারী ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে, তাহা তোমরা অবগত আছ।

৩য়। তাহাকে ধৃত করিবার নিমিত্ত পুলিস তাহার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছে, তাহা তোমরা অবগত আছ। অথচ সেই মনসুর আলিকে তোমরা লুকাইয়া রাখিয়াছ, একস্থান হইতে স্থানান্তরে তাহাকে লইয়া গিয়াছ, আইনের দণ্ড হইতে তাহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা করিয়া তাহার পলায়নের সহায়তা করিয়াছ। এইরূপ অবস্থায় এই সকল দোষে তোমাদিগকে দণ্ডিত করান ইঁহাদিগের পক্ষে নিতান্ত কঠিন কথা নহে। ঈশ্বর না করুন, তোমরা যদি এইরূপ দোষে দণ্ডিত হও, তাহা হইলে বল দেখি, মনসুর আলি কয়দিবস লুকাইয়া থাকিতে পারিবে? এরূপ অবস্থায় যখন কোনরূপেই তোমাদিগের নিষ্কৃতি নাই, তখন আমার পরামর্শ স্মরণ করা তোমাদিগের একান্ত কৰ্ত্তব্য। 

উকীলবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। পরিশেষে হেসারূদ্দিন কহিল, “আপনি একবার যেরূপ প্রস্তাব করিয়াছিলেন, কর্মচারী মহাশয় মনসুর আলিকে ধৃত না করিয়া, তাঁহার যাহা কিছু বক্তব্য আছে, কেবলমাত্র তাহাই শ্রবণ করিয়া যদি তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করেন, তাহা হইলে আমরাও মনসুর আলির অনুসন্ধান করিয়া দেখি। যদি কোনস্থানে তাহার সন্ধান পাই, তাহা হইলে তাহাকে আনিয়া আপনাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিব।” 

হেসারূদ্দিনের কথা শ্রবণ করিয়া উকীলবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন মহাশয়! এ সম্বন্ধে এখন আপনি কি বলিতে চাহেন? আমি যতদূর বুঝিতে পারিতেছি, তাহাতে এইরূপ প্রস্তাবে সম্মত হইতে না পারিলে, মনসুর আলিকে কোনরূপেই দেখিতে পাইবেন না। আপনি বিবেচক, এখন সবিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া আপনি ইহার সদুত্তর প্রদান করুন।” 

উকীলবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া আমিও অতিশয় চিন্তিত হইলাম। কিন্তু তাহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হওয়া ব্যতিরেকে বর্তমান অনুসন্ধানের প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হইতে পারিবার আর কোন উপায় নাই বিবেচনায়, অনিচ্ছা হইলেও পরিশেষে তাহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। 

আমার নিকট হইতে আশ্বাস বাক্য প্রাপ্ত হইয়া হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর উভয়েই উকীলবাবুর সহিত নির্জ্জনে কি পরামর্শ করিল, এবং পরিশেষে আমাকে সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে কহিয়া উহারা উভয়েই সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

আমি সেইস্থানে উপবেশন করিয়া উকীলবাবুর সহিত কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলাম। এইরূপে প্রায় অর্দ্ধঘণ্টাকাল অতিবাহিত হইতে না হইতেই হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর উভয়েই একটি যুবককে সঙ্গে লইয়া সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “ইহারই নাম মনসুর আলি। যাহা আপনার ইচ্ছা হয়, তাহা আপনি ইহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া ইহাকে অব্যাহতি প্রদান করুন।” 

উহাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া আমি উকীলবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি মনসুর আলির নিকট কি পূর্ব্ব হইতে পরিচিত?” 

উকীল। না, ইতিপূৰ্ব্বে আমি তাহাকে কখনও দেখি নাই। 

আমি। আপনি যখন ইহাকে চিনেন না, তখন ইনিই যে মনসুর আলি, তাহা কি প্রকারে স্থির করিয়া লইব?

উকীল। আপনার মনের ভাব আমি সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিয়াছি। এই ব্যক্তি প্রকৃতই বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের পুত্র মনসুর আলি কি না, তাহা জানিয়া লওয়া একান্ত কর্তব্য। কারণ, বিপদ্ হইতে উদ্ধার হইবার নিমিত্ত অপর কোন ব্যক্তিকে মনসুর আলি সাজাইয়া আনিলেও উহারা আনিতে পারে। 

উকীলবাবুর কথা আমার অন্তরের সহিত মিলিল দেখিয়া আমি সকলকে সেইস্থানে রাখিয়া দ্রুতপদে বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের বাসস্থানের নিকট গমন করিলাম। যে সকল ব্যক্তি হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বরের নামে দরখাস্ত করিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্য হইতে একজনকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় সেই উকীলবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে গিয়া দেখিলাম যে, একটি গৃহের ভিতর উহারা তিনজনেই বসিয়া রহিয়াছে। আমি যে ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম, উহাদিগকে দেখিবামাত্রই সে কহিল, “আমরা যাহাদিগের বিপক্ষে দরখাস্ত করিয়াছিলাম, ইহারাই সেই হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর মুখোপাধ্যায়, এবং এই যুবকই বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের পুত্র মনসুর আলি।” 

আমাদিগের মনে যে একটু সন্দেহ ছিল, আমার আনীত সে দরখাস্তকারীর কথা শুনিয়া সে সন্দেহ মিটিয়া গেল। তৎপরে, কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা মনসুরকে জিজ্ঞাসা করিলাম। আমার কথার উত্তরে মনসুর আলি, রামেশ্বর যেরূপ কহিয়াছিল, সেইরূপই কহিল। পত্র দুইখানি তাহার স্বহস্ত-লিখিত বলিয়া স্বীকার করিল, এবং টেলিগ্রাম দুইখানি তাহারই প্রেরিত, ইহাও স্পষ্টরূপে কহিল, আরও কহিল যে, তাহার বৃদ্ধ পিতা বিলায়েত হোসেন প্রকৃতই বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। মনসুর আলির নিকট হইতে এইসকল বিষয় অবগত হওয়াতে যাহাদিগের বিপক্ষে দরখাস্ত হইয়াছিল, তাহাদিগের উপর আর কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। মনসুর আলি যাহা যাহা কহিল, তাহা লিখিয়া লইয়া তাহাকে তাহার ইচ্ছামত স্থানে গমন করিবার আদেশ দিয়া আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিলাম! আদেশ প্রাপ্ত হইবামাত্র উহারা সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

মনসুর আলিকে এইরূপে সম্মুখে পাইয়া তাহাকে ধৃত না করার নিমিত্ত পরিশেষে আমাকে বিস্তর জবাবদিহি করিতে হইয়াছিল সত্য; কিন্তু তাহাতে আমার সবিশেষ কোনরূপ অনিষ্ট হয় নাই। একটি গুরুতর বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব নির্ণয় করিবার মানসে আমি মনসুর আলিকে ধৃত করি নাই, কর্তৃপক্ষীয়গণ এইরূপ যখন বুঝিতে পারিলেন, তখন আমাকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। 

মনসুর আলিও যে তাহার পর আর অধিক দিবস লুকাইয়া থাকিতে পারিলেন, তাহা নহে। দরখাস্ত ঘটিত গোলযোগ মিটিয়া যাইবার কিছুদিবস পরেই একদিবস সন্ধ্যার পর হেসারূদ্দিন ও রামেশ্বর আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “পূর্ব্বে আপনি মনসুর আলিকে ধৃত না করিয়া আমাদিগের যে কিরূপ উপকার করিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। এখন আমাদিগের বিবেচনায় মনসুর আলির আর লুকাইয়া থাকা কর্তব্য নহে, তাহার উপস্থিত হওয়াই উচিত। কারণ, চিরদিবসই লুক্কায়িত ভাবে তাহাকে যদি অবস্থান করিতে হইল, তাহা হইলে সে স্বাধীন ভাবে বিচরণ করিতে কিরূপে সমর্থ হইবে, এবং তাহার সুখভোগের আশাই বা কি? আমরা পূর্ব্বে স্বপ্নেও ভাবিয়াছিলাম না যে, আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা পালন করিতে সমর্থ হইবেন। কিন্তু যখন দেখিলাম, আপনি অনায়াসেই আপনার প্রতিজ্ঞা পালন করিয়া মনসুর আলিকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন, সেই সময় হইতে আপনার উপর আমাদিগের যে কিরূপ ভক্তি জন্মিয়াছে, তাহা বলিতে পারি না। এই নিমিত্তই আজ আমরা মনসুর আলিকে সঙ্গে করিয়া আনয়ন করিয়াছি, এবং উহাকে আপনার হস্তে প্রদান করিতেছি। এখন যাহা আপনার কর্তব্য কৰ্ম্ম, তাহা আপনি করিতে পারেন।” এই বলিয়া মনসুর আলিকে আমার নিকট রাখিয়া তাহারা প্রস্থান করিল। পরদিবস দিবা দশটার সময় আমিও মনসুর আলিকে আলিপুরে পাঠাইয়া দিলাম। তখন হইতে সে ছয় মাসের নিমিত্ত কারাগারে আবদ্ধ হইল। মনসুর আলির নিকট হইতে পূৰ্ব্ব কথিত বিষয় সকল অবগত হইয়া, সেই দরখাস্ত সম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের বিবরণ মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করিবার মনস্থ করিলাম। কারণ, এখন আমার সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস হইয়াছিল যে, হেসারূদ্দিন বা রামেশ্বর কোনরূপ দোষে দোষী নহে। আমি আমার অনুসন্ধান বিবরণী লিখিয়াও প্রস্তুত করিলাম; কিন্তু মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট উহা প্রেরণ করিবার পূর্ব্বে মনে হইল যে, যে গ্রামে বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের মৃত্যু হইয়াছে, সেইস্থানে একটু অনুসন্ধান হওয়া আবশ্যক, নতুবা এই অনুসন্ধান কিয়ৎ পরিমাণে অসম্পূর্ণ থাকে। এই ভাবিয়া যে স্থানে বৃদ্ধের মৃত্যু হইয়াছিল, সেই গ্রামের স্থানীয় পুলিসের নিকট একখানি পত্র লেখাইলাম। উহাতে কোন্ কোন্ বিষয়ের অনুসন্ধান করা আবশ্যক, তাহাও তাহার মধ্যে লিখিয়া দেওয়া হইল। স্থানীয় পুলিস সেইস্থানে অনুসন্ধান করিয়া সময় মত তাহাদিগের অনুসন্ধানের ফল আমাদিগকে জ্ঞাপন করিলেন। উহাতে আমরা জানিতে পারিলাম যে, মনসুর আলি নামক একজন লোক সেইস্থানের জনৈক মুসলমানের বাড়ীতে কিছুদিবস অবস্থিতি করে। সেইস্থানে তাহার পীড়া হওয়ায় তাহার বৃদ্ধ পিতা বিলায়েত হোসেন তাহাকে দেখিতে আইসে। বৃদ্ধের সেইস্থানে গমন করিবার কয়েক দিবস পরে পুত্রের পীড়া আরোগ্য হইয়া যায়; কিন্তু বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেন বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হইয়া সেইস্থানেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। গ্রামের একজন চিকিৎসক পীড়িত অবস্থায় বৃদ্ধের চিকিৎসা করিয়াছিল, এবং মৃত্যুর পর গ্রামের আট দশ জন লোক একত্র হইয়া সেই মৃতদেহ গ্রামের বাহিরে লইয়া যায়। সেইস্থানে কবরের ভিতর উহাকে প্রোথিত করে। সেই সময়ের আবশ্যকীয় কার্য্য সকল সেই গ্রামের একজন মোল্লার দ্বারা সম্পাদিত হয়। পরিশেষে গ্রামস্থ অনেকগুলি মুসলমান ও ফকীরকে নিমন্ত্রিত করিয়া আহারাদিও করান হয়। 

স্থানীয় পুলিসের অনুসন্ধানে উপরি-উক্তি বিষয়গুলি অবগত হইয়া আমার মনে আর কোনরূপ সন্দেহই রহিল না। তখন রামেশ্বর ও হেসারূদ্দিনকে নির্দোষ সাব্যস্ত করিয়া আমার অনুসন্ধান-বিবরণী মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করিলাম। দরখাস্তের সমস্ত গোলযোগ সেইস্থানেই মিটিয়া গেল। 

নবম পরিচ্ছেদ 

রামেশ্বর মুখোপাধ্যায় বালিগঞ্জে বাস করিত সত্য; কিন্তু ভবানীপুরে তাহার একজন বারবনিতা ছিল। পূৰ্ব্ববর্ণিত ঘটনার প্রায় সাত আট বৎসর পরে সেই স্ত্রীলোকটির যথাসর্বস্ব অপহৃত হয়। আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে অপরাপর কর্মচারীর সহিত আমাকে গমন করিতে হয়। যে সময় এবং যেরূপভাবে অপহৃত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া আমি অপরের উপর সন্দেহ করিতে পারিলাম না। রামেশ্বরের উপরই আমার সবিশেষ সন্দেহ হয়। কিন্তু অপহৃত দ্রব্য না পাইলে উহার কিছুই করিতে পারিব না, এই ভাবিয়া কয়েক দিবস পর্য্যন্ত গুপ্তভাবে রামেশ্বরের গতিবিধি আমি সবিশেষরূপে দেখিতে থাকি। কালীঘাটে রামেশ্বরের একজন বন্ধু বাস করিত। একদিবস সন্ধ্যার পর রামেশ্বর তাহার বন্ধুর বাড়ীতে গমন করেন, তাহা দেখিতে পাই। আরও জানিতে পারি, সেই রাত্রি সে সেই স্থানেই অতিবাহিত করিবে। বন্ধুর সহিত কিরূপ কথাবার্তায় সে রাত্রি অতিবাহিত করিবে, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার মনে নিতান্ত কৌতূহল আসিয়া উপস্থিত হয়! সুতরাং সেই পরিচিত বন্ধুর গৃহের পশ্চাতেই গুপ্তভাবে আমি রাত্রিযাপন করি। সেইস্থানে থাকিতে থাকিতেই শুনিলাম,—আহারাদি করিয়া শয়ন করিবার পূর্ব্বে বন্ধু রামেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিল, “পুলিস সেই চুরির অনুসন্ধান এখন পরিত্যাগ করিয়াছে, কি এখনও অনুসন্ধান করিতেছে?” 

রামেশ্বর। অনুসন্ধান এখনও পরিত্যাগ করে নাই। এতদিবস পরে একজন কর্ম্মচারী আমাকেই সন্দেহ করিয়াছেন, শুনিতে পাইতেছি। 

বন্ধু। অতঃপর যদি তোমার উপর এই সন্দেহ হইয়া থাকে, তাহা হইলে এখন হইতে তোমার বিশেষরূপে সতর্ক হওয়া আবশ্যক। 

রামেশ্বর। যে কর্মচারী আমাকে সন্দেহ করিতেছেন, তাঁহার নিমিত্ত সেরূপ সতর্ক হওয়ার কোন প্রয়োজন নাই। আবশ্যক হইলে, তাঁহার চক্ষুতে আমি অনায়াসেই ধুলি নিক্ষেপ করিতে পারিব। 

বন্ধু। সে কি? পুলিস-কর্মচারীর চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করা কি নিতান্ত সহজ কাৰ্য্য? 

রামেশ্বর। আমার বিবেচনায় অতি সহজ কার্য্য। কারণ, একবার তাঁহারই চক্ষে আমি ধূলি নিক্ষেপ করিয়াছি।

বন্ধু। কিরূপে তাঁহার চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিলে? 

রামেশ্বর। বালিগঞ্জের বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের কথা তোমার মনে হয় কি? 

বন্ধু। বেশ মনে হয়? পুত্রকে দেখিতে গিয়া বিসূচিকা রোগে বৃদ্ধ ইহজীবন পরিত্যাগ করে। 

রামেশ্বর। সে মিথ্যা কথা। আমাদিগের কর্তৃক বৃদ্ধ গঙ্গাজলে নিক্ষিপ্ত হয়। পরিশেষে তাহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া মহাসুখে কিছুদিবস আমরা অতিবাহিত করি। 

বন্ধু। সে কি? বৃদ্ধ বিসূচিকা রোগে মরিয়া গিয়াছে, একথা শুনিয়াছি। তাহার পুত্র নিজমুখে একথা বলিয়াছে।

রামেশ্বর। নিজমুখে পুত্র যে সত্য কথা বলিয়াছে, তাহা তুমি কি প্রকারে জানিলে? অর্থ ও চেষ্টায় না হইতে পারে, এমন কার্য্যই নাই। 

বন্ধু। তবে কি বৃদ্ধ তোমাদিগের হস্তে হত হইয়াছিল? 

রামেশ্বর। তাহা নহিলে এতদিবস পৰ্য্যন্ত এত অর্থ ব্যয় করিতাম কোথা হইতে? তাহার আপন পুত্র আমাদিগের চক্রান্তে পড়িয়া গেল, গ্রামের লোক তার্থে বশীভূত হইল; সুতরাং পুলিস-চক্ষেও অবলীলাক্রমে ধূলি প্রদান করিলাম। এত বড় একটি কার্য্য করিয়া যখন পরিত্রাণ পাইয়াছি, তখন এই সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত আমি ভয় করিব? পুলিস আমাকে সন্দেহ করে—করুক; কিন্তু তাপহৃত দ্রব্য আমার নিকট না পাইলে আমার কি করিতে পারিবে? 

রামেশ্বর ও তাহার বন্ধুর কথা শ্রবণ করিয়া ভাবিলাম, কি সৰ্ব্বনাশ! নানা অনুসন্ধানে আমি যে রামেশ্বরকে নির্দোষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছি, এখন দেখিতেছি, সেই ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে দোষী! সে-ই বৃদ্ধ বিলায়েত হোসেনের হত্যাকারী! কি সর্ব্বনাশ! না বুঝিতে পারিয়া এইরূপ ভাবে কত অন্যায় কার্য্যই আমরা করিয়া থাকি!! 

ইহার পর আমি মনসুর আলির সহিত আর একদিবস সাক্ষাৎ করিলাম। ইহার বহুপূর্ব্বে সে জেল হইতে খালাস হইয়া আসিয়াছে। তাহাকে তাহার পিতার কথা পুনরায় জিজ্ঞাসা করায়, সে আমার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না, কেবল চক্ষুজলে আপন বক্ষঃস্থল ভাসাইয়া দিল। বুঝিলাম যে, রামেশ্বর প্রভৃতি বদমায়েসগণের চক্রান্তে পড়িয়া সে নিজেই তাহার সর্ব্বনাশ করিয়াছে। 

চুরি মোকদ্দমায় রামেশ্বর সম্পূর্ণরূপে আমাদিগের চক্ষুতে ধূলি নিক্ষেপ করিতে না পারিলেও যে একেবারে ধূলি প্রদান করিতে পারিল, তাহা নহে; সেইদিবস হইতেই সে সহর পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল। কিন্তু কোথায় যে গমন করিল, তাহা কেহই বলিতে সমর্থ হইল না। এমনকি, আজ পর্যন্তও সে পলায়িত। 

[ বৈশাখ, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *