প্রমদা (কুলবধূ ব্যভিচারে ঘটায় প্রমাদ!)

প্রমদা (কুলবধূ ব্যভিচারে ঘটায় প্রমাদ!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

সন্তোষপুর গ্রামে বোসপাড়ার এক প্রান্তে নবকুমার বসুর বাড়ী। এই বাড়ীই বোসপাড়ার পশ্চিমসীমা। এই বাড়ীর পশ্চিম অংশ হইতেই বাঁশবাগান আরম্ভ হইয়া ক্রমে মুসলমান পাড়ায় গিয়া শেষ হইয়াছে। মুসলমান পাড়া হইতে বোসপাড়ায় আসিতে হইলে, সেই বাঁশবাগানের মধ্যস্থিত একটি সঙ্কীর্ণ পথ দিয়া আসিতে হয়। এই পথ নবকুমারের খিড়্গ কী দরজার নিকট দিয়া গমন করিয়াছে। সন্তোষপুর গ্রামের কাহারই এই পথ দিয়া সময়ে অসময়ে গমনাগমনের নিষেধ নাই। 

নবকুমারের বাড়ীর পশ্চিম খিড়্গ কী দরজার নিকটে একটি পুরাতন পুষ্করিণী আছে। বর্ষাকাল ব্যতীত অপর সময়ে প্রায়ই ইহাতে জল থাকে না, কিন্তু নানাপ্রকার আগাছা প্রভৃতির দ্বারা উহা পূর্ণ হইয়া আছে। সেই গ্রাম্য পথের পার্শ্বে, অথচ পুষ্করিণীর মধ্যে একটি মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। সেই পথের ধারে একটি মোড়ার উপর বসিয়া বাঁশিরাম দারোগা সেই মৃতদেহের “সুরতহাল” করিতেছেন। 

বাঁশীরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাদিগের মধ্যে কেহ কি বলিতে পারেন, এ কাহার মৃতদেহ?”

দারোগার চতুদিক বেষ্টন করিয়া যে সকল লোক দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাঁহাদের মধ্য হইতে উত্তর হইল, “নবকুমার সকলেরই পরিচিত, পুরুষানুক্রমে তিনি এই গ্রামে বাস করিয়া আসিতেছেন। সুতরাং, আমরা সকলেই বেশ চিনিতে পারিতেছি, এই মৃতদেহ নবকুমার বোসের।” 

গ্রামের চৌকীদার ছয় জন, সেইস্থানে উপস্থিত ছিল। তাহারাও বাঁশীরামের চতুষ্পার্শে বেষ্টিত ব্যক্তিগণের পোষকতা করিল। দারোগা লিখিয়া লইলেন, “গ্রামস্থ সমস্ত লোকের দ্বারা এই লাস সনাক্ত হওয়ায় জানিতে পারা গেল যে, এই সন্তোষপুর গ্রামে যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা এই গ্রামের প্রজা নবকুমার বোসের মৃতদেহ।” 

ইহার পরেই বাঁশীরাম মোড়া পরিত্যাগ করিয়া উঠিলেন। যে স্থানে সেই মৃতদেহটি পড়িয়াছিল, ধীরে ধীরে সেইস্থানে গমন করিলেন। সেই মৃতদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উত্তমরূপে দেখিয়া, বাঁশীরাম সেই গ্রামের পঞ্চায়েৎকে কহিলেন, “আপনিও ত এই মৃতদেহ উত্তমরূপে দেখিলেন, এখন বলুন দেখি, এই হত্যাসম্বন্ধে আপনার কি অনুমান হয়?” 

পঞ্চায়েৎ। কোন ব্যক্তি কর্তৃক যে নবকুমার হত হইয়াছেন, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

বাঁশীরাম। তাহা ত দেখিতেই পাইতেছি। কিন্তু ইহার শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে, তাহা কি প্রকার অস্ত্রের চিহ্ন বলিয়া বোধহয়? 

পঞ্চায়েৎ। কোন ধারাল অস্ত্রের আঘাত বলিয়া নিশ্চয় অনুমান হয়। বোধ হয়, তরবারি হইবার সম্ভাবনা; কারণ মৃতব্যক্তির দক্ষিণ স্কন্ধের উপর অস্ত্রের প্রথম আঘাত পতিত হইয়া, ঈষৎ বক্রভাবে বামদিক অবলম্বন করিয়া বক্ষঃস্থল পৰ্য্যন্ত কাটিয়া গিয়াছে। 

বাঁশীরাম। এ যে কোন প্রখর অস্ত্র, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। কিন্তু বোধ হয়, তরবারির আঘাত নহে। দক্ষিণ স্কন্ধের সম্মুখদিকের কিয়দংশ বোধ হইতেছে, একবারে দ্বিখণ্ডিত হইয়া যায় নাই, একটু যেন বাঁধিয়া আছে। তরবারির আঘাত হইলে এরূপ হইবার সম্ভাবনা নহে। বোধ হয়, তরবারি অপেক্ষা কোনরূপ ছোট, অথচ ভারি অস্ত্র, ভাল দা হইবারই খুব সম্ভাবনা। 

পঞ্চায়েৎ। হইতে পারে, কিন্তু এই আঘাত কোনদিক্ হইতে হইল, এবং আঘাতের সময় নবকুমার কিরূপ অবস্থায় ছিলেন? 

বাঁশীরাম। যাহা আমি জিজ্ঞাসা করিব ভাবিতেছিলাম, আপনি তাহাই জানিতে চাহিতেছেন। আপনার বিবেচনায় কি হয়? 

পঞ্চায়েৎ। আমার বোধ হয়, শয়নকালীন নবকুমার এ আঘাত প্রাপ্ত হন নাই। যখন তাঁহাকে আঘাত করিয়াছে, তখন তিনি বোধ হয় বসিয়াছিলেন। বসিয়া থাকিবার সময় সম্মুখ হইতে আঘাত করিলে, এই ভাবে কাটিয়া যায় না কি? দেখা যাইতেছে, সম্মুখে গলার হাড় উত্তমরূপে না কাটিয়া পশ্চাদ্ভাগ অধিক পরিমাণে কাটিয়া গিয়াছে। 

বাঁশীরাম। আর যদি ইহার বিপরীত হয়, অর্থাৎ চলিয়া যাইবার সময়ে, নবকুমারের পশ্চাৎ হইতে যদি কোন ব্যক্তি তীক্ষ্ণ ‘দা’র দ্বারা সবলে আঘাত করে, তাহা হইলে এইরূপ অবস্থায় হইতে পারে না কি? বিশেষ পথের উপর নবকুমারের বসিয়া থাকার কোন কারণ দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না। আর এই হত্যা যে পথের উপরেই সংসাধিত হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। নতুবা পথের উপরস্থিত ঐ স্থানের মৃত্তিকা এরূপ রক্তাক্ত থাকিবে কেন?

পঞ্চায়েৎ। আপনার কথা অসম্ভব বলিয়া বোধ হয় না। এইরূপ অবস্থায় যদি এই হত্যা সংসাধিত হইয়া থাকে তাহা হইলে হত্যাকারী বালক বা ক্ষুদ্রাবয়বের লোক হইতে পারে না। 

বাঁশীরাম। তাহা ত নিশ্চয়ই। নবকুমারের আকৃতি কিছু অতিশয় দীর্ঘ নহে, এরূপ অবস্থায় তাহারই মত বা তাহার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উচ্চ কোন বলিষ্ঠ লোকের আঘাতে এই হত্যা হইয়াছে। আঘাতের চিহ্ন দেখিলে বোধ হয়, যেন একই কোপে তাহার জীবন শেষ হইয়া গিয়াছে। 

পঞ্চায়েৎ। পথের উপর যদি এই হত্যাকাণ্ড সমাধা হইল, তাহা হইলে উহার মৃতদেহ পুষ্করিণীর মধ্যে গমন করিল কিরূপে? 

বাঁশীরাম। এ অতি সহজ কথা। মৃতদেহ পথের উপর পড়িয়া থাকিলে, এই ঘটনা শীঘ্র প্রকাশ হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা; এই বিবেচনায় হত্যাকারী সেই মৃতদেহটি একটু সরাইয়া পুষ্করিণীর ভিতর ফেলিয়া দিয়াছে। 

পঞ্চায়েৎ। যদি এইরূপ অবস্থা ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে এ কার্য্য একজন লোকের দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে না। এত বড় মৃতদেহ একজন উঠাইয়া পুষ্করিণীর ভিতর নিক্ষেপ করিতে কখনই সমর্থ হয় না। এরূপ অবস্থায় আমার বোধহয়, উহারা দুইজন বা আরও অধিক লোক ছিল। 

বাঁশীরাম। একাকী যে এই কার্য্য না করিতে পারে, এমন নহে। কারণ, দেখিতে পাইতেছেন না, ঐ রক্তাক্ত মৃত্তিকার উপর কিরূপ দাগ পড়িয়াছে? বোধ হইতেছে, মানবের মৃতদেহ সদৃশ কোন গুরুবস্তু উহার উপর দিয়া যেন ঘড়াইয়া টানিয়া লইয়া গিয়াছে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি হইলে এরূপে লইয়া যাইবার কোন প্রয়োজন হইত না। একাকী বলিয়াই তাহাকে টানিয়া ফেলিতে এরূপ দাগ পড়িয়াছে। 

পঞ্চায়েৎ। মহাশয়! আপনি যদি রাগ না করেন, তাহা হইলে আপনাকে আমি একটি কথা বলি। কথাটি একটু কর্কশ, সুতরাং ইহাতে আপনার রাগ হইবারই সম্ভাবনা। 

বাঁশীরাম। আপনি আমার প্রকৃতি অবগত নহেন বলিয়াই, একথা বলিতেছেন। আপনার একটি কথায় আমি ক্রোধান্বিত হইব? আপনি আমার সম্মুখে আমাকে সহস্র গালিবর্ষণ করুন, দেখিবেন, তাহাতেও আমার চিত্ত কিছুমাত্র বিচলিত হইবে না। আপনি যাহা বলিতে চাহেন, অকপটে তাহা বলিতে পারেন। 

পঞ্চায়েৎ। আমি যে পৰ্য্যন্ত পঞ্চায়তী কৰ্ম্ম করিতেছি, সেই পর্য্যন্ত আমার এলাকার মধ্যে যখন যে অনুসন্ধান হইয়াছে, আমি তখনই সেই অনুসন্ধান-কারীর নিকটে উপস্থিত থাকিয়া এতকাল পৰ্য্যন্ত তাঁহাদিগের অনুসন্ধান দেখিয়া আসিতেছি। তাঁহাদিগের মধ্যে এ পর্যন্ত কেহই সেই সম্বন্ধে আমার মতামত জিজ্ঞাসা করেন নাই; সুতরাং আমিও তাঁহাদিগের কোন বিষয়েই কোন কথা বলি নাই। আপনি আমাকে দুই এক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন বলিয়াই আমি সাহসী হইয়া আপনাকে দুই এক কথা কহিতেছি। আপনারা কোন সন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে, কোন্ ব্যক্তির দ্বারা সেই সকল কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার দিকে একেবারেই লক্ষ্য না করিয়া, প্রথমে অনাবশ্যক কথার আন্দোলনে যে কেন সময় নষ্ট করিয়া থাকেন, তাহা আমরা এ পর্য্যন্ত বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। তাহার দৃষ্টান্ত দেখুন, নবকুমার হত হইয়াছেন; কোন ব্যক্তি তাহাকে হত্যা করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। আপনি সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হওয়া পর্য্যন্ত একবারের নিমিত্তও ভাবিয়াছেন কি যে, কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইল? সে দিকে আপনার লক্ষ্য একবারের নিমিত্তও পতিত হয় নাই। কেবল মিথ্যা বিষয় লইয়া, অর্থাৎ কিরূপ অস্ত্রের দ্বারা নবকুমারকে আঘাত করা হইয়াছে, নবকুমার সেই সময় বসিয়াছিল, কি দাঁড়াইয়াছিল, সম্মুখ হইতে মারিয়াছে, কি পশ্চাৎ হইতে মারিয়াছে, প্রভৃতি নানারূপ বাজে কথায় সময় নষ্ট করিতেছেন। এ সকল বিষয় তর্ক দ্বারা অনুমান করিয়া লওয়া অপেক্ষা যদি হত্যাকারীকে ধরিতে পারেন, তাহা হইলে তখন আপনার প্রয়োজন মত তাহারই নিকট সকল কথা জানিয়া লইতে পারিবেন। আমার বিবেচনায় এই সকল বিষয়ে সময় নষ্ট করা অপেক্ষা, কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, সেই বিষয় অনুসন্ধান করা কর্তব্য। 

পঞ্চায়েতের কথা শুনিয়া বাঁশীরাম একটু হাসিলেন ও কহিলেন, “আপনারা যেরূপ সরল প্রকৃতির লোক, সেইরূপ ভাবেই আমাকে বলিলেন। কাহার দ্বারা এই হত্যা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহাকে একেবারে ধরিবার যদি চেষ্টা করি, তাহা হইলে এই সকল বাজে কথার প্রয়োজন কি? পুলিস-কৰ্ম্মচারী যদি সৰ্ব্বজ্ঞ হইতেন, ভূত ভবিষ্যৎ স্বচক্ষে দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে কোন বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার আবশ্যকই হইত না। যেমন কোন অপরাধ সংঘটিত হইত, অমনি পুলিস-কৰ্ম্মচারী দ্রুতপদে গমন করিয়া সেই অপরাধীকে রাজদ্বারে লইয়া উপস্থিত করিতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই ক্ষমতা, ঈশ্বর পুলিশ-কৰ্ম্মচারীকে প্রদান করেন নাই বলিয়া, প্রথমে এই সকল অনুসন্ধান যাহাকে আপনারা বাজে অনুসন্ধান বলিয়া বিবেচনা করেন—আমাদিগকে করিতে হয়। নতুবা ইহার প্রকৃত পথ আমরা কোনরূপেই প্রাপ্ত হইতে পারি না। যে সকল বিষয় আপনারা অকিঞ্চিৎকর বলিয়া উড়াইয়া দেন, সেই সকল বিষয় হইতেই আমরা ইহার প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হইতে সমর্থ হই। তাহার দৃষ্টান্ত, এই বৰ্ত্তমান অনুসন্ধানেই কেন দেখুন না? যদি স্থির হইত, এই হত্যা তরবারির দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা হইলে বলুন দেখি, আপনিই বলিতে পারেন কি না, এই গ্রাম ও চতুঃপার্শ্বের গ্রাম সকলের মধ্যে কোন্ কোন্ ব্যক্তির তরবারি আছে? আর যদি সেই সকল তরবারির মধ্যে কোন তরবারির দ্বারা এই হত্যা সম্পন্ন হইত, তাহা হইলে সেই কথা প্রকাশ হইতে কত বিলম্ব হইত? 

“যদি স্থির হইত, হত্যাকারী সম্মুখ হইতে তাহাকে আক্রমণ করিয়াছে, তাহা হইলে বলুন দেখি, আপনিই বলিতেন কি না—এই হত্যার উদ্দেশ্য গুপ্ত হত্যা নহে—হত্যাকারী প্রকাশ্যে বীরের মত সম্মুখ যুদ্ধে ইহাকে আক্রমণ করিয়াছে? তখন কাহারও কোনরূপ আক্রোশ যে ইহার উপর আছে, তাহা আপনি এখনই বলিতে পারিতেন। আরও বলিতেন, নবকুমার সম্মুখ হইতে যখন হত্যাকারীকে দেখিতে পাইয়াছেন, তখন তিনি তাহার কোনরূপ প্রতিবিধান করিতে সমর্থ হউন, বা না হউন, অভাব পক্ষে চীৎকার করিয়া পাড়ার লোকজনকে অবশ্যই জাগাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু, যখন অনুমান হইতেছে, পশ্চাৎ হইতে নবকুমারকে আঘাত করিয়াছে, তখন তাহার কোন গুপ্ত শত্রু ভিন্ন এ কার্য্য আর কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে? যদি গুপ্ত শত্রু দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে স্থির হইল, তাহা হইলে গুপ্ত অনুসন্ধানে সেই গুপ্ত শত্রুর অনুসন্ধান হইতে বাকি থাকিবে, আপনি বিবেচনা করেন কি? 

“আরও দেখুন, যদি স্থির হইত যে, এই হত্যা একের অধিক ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা হইলে যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করা আবশ্যক হয়, এক ব্যক্তির দ্বারা হত্যা হইলে সেরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না। একথা আমি আপনাকে সম্পূর্ণরূপে বুঝাইতে সমর্থ হইব না; কারণ সে ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু, যাঁহারা এই কার্য্যের নিমিত্তই আপন জীবন অর্পণ করিয়াছেন, তাঁহারাই ইহা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন। 

“এইরূপ সামান্য সামান্য অবস্থা দৃষ্টি করিয়া, এই সকল মোকদ্দমার নায়ক স্থির করিতে হয় বলিয়াই, যে বিষয় আপনাদিগের ভাল লাগে না, আমাদিগকে সেই সকল বিষয়ই বিশেষ সতর্কতার সহিত দেখিতে হয়। এই নিমিত্ত আমরা দোষী ব্যক্তির অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে, যে সকল বিষয়কে আপনারা অনাবশ্যক বিবেচনা করেন, সেই সকল বিষয়কেই আমাদিগকে প্রথমে লক্ষ্য করিতে হয়। যদি সেই সকল অবস্থা হইতে কোন সূত্র পাওয়া যায়, তাহা হইলে মোকদ্দমার উপায় হয়, ও দোষী ব্যক্তি পরিত্রাণ পায় না। যদি কোন সূত্র পাওয়া না যায়, তাহা হইলে উহার অনুসন্ধান কিছু কঠিন হইয়া উঠে।’ 

বাঁশীরামের কথা শুনিয়া পঞ্চায়েৎ আর কোন কথা কহিলেন না। চুপ করিয়াই বাঁশীরামের সঙ্গে সঙ্গে সেই মৃতদেহের অবস্থা, স্থানের অবস্থা, প্রভৃতি উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্ববর্ণিত একটি চিহ্ন ব্যতীত নবকুমারের শরীরে আরও একটি আঘাত দৃষ্টিগোচর হইল, উহা মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে। সেই আঘাত দেখিয়া বোধ হয়, প্রথম আঘাত প্রাপ্ত হইয়া নবকুমার যেমন উপুড় হইয়া পড়িয়া যান, তাহার উপর অমনি আর একটি আঘাত করা হয়। প্রথম আঘাতেই নবকুমার পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সুতরাং, দ্বিতীয় আঘাত ব্যতীত তাঁহার উপর আর কোন আঘাতের প্রয়োজন হয় নাই। এই দুইটি স্থান ভিন্ন অপর কোন স্থানে আর কোন আঘাতের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইল না। 

কয়েকজন লোকের সাহায্যে বাঁশীরাম নবকুমারের মৃতদেহ সেই পুষ্করিণীর ভিতর হইতে উঠাইয়া পথের উপর স্থাপিত করিলেন। যে স্থান হইতে মৃতদেহ উঠাইয়া আনা হইল, অতঃপর বাঁশীরাম সেইস্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলেন। কারণ তাঁহার ইচ্ছা যদি সেই স্থানে সাংঘাতিক অস্ত্র প্রভৃতি অপর কোন দ্রব্য প্রাপ্ত হন। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও অস্ত্রের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। পাইবার মধ্যে কেবল পাইলেন—একজোড়া চটি জুতা, এবং একখানি গামছা। উভয় দ্রব্য দেখিবামাত্র সকলেই কহিলেন, তাহা নবকুমারের দ্রব্য। জুতায় রক্তের চিহ্ন প্রভৃতি কিছুই দেখিতে পাওয়া গেল না। কিন্তু গামছা দেখিয়া বোধ হইল, রক্তাক্ত হস্ত এবং রক্তাক্ত অস্ত্র তাহাতেই মোছা হইয়াছে। 

যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেইস্থানের অনুসন্ধান আপাততঃ স্থগিত করিয়া, বাঁশীরাম নবকুমারের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

এই বাড়ীতে নবকুমার এবং তাঁহার যুবতীভার্য্যা প্রমদা ভিন্ন তাপর কেহই থাকিতেন না। নবকুমার বৃদ্ধ না হইলেও কিন্তু দেখিতে বৃদ্ধ; বয়স পঞ্চাশ বৎসরের অধিক না হইলেও, প্রায় বিশ বৎসর ধরিয়া নানাপ্রকার রোগ তাঁহাকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়া নিতান্ত বৃদ্ধ করিয়া তুলিয়াছে। প্রমদার বয়ঃক্রম পঁচিশ বৎসরের ন্যূন নহে। যখন প্রমদার বিবাহ হয়, তখন সে বালিকা। কিন্তু প্রমদার পিতার কোনরূপ অর্থের সংস্থান না থাকায়, নবকুমারের বয়স অধিক হইলেও, তাঁহার সহিত আপন কন্যার বিবাহ দিয়াছিলেন। নবকুমারের গৃহে আপনার লোক না থাকায়, এবং একটি বৈষ্ণবের কন্যা এই সংসারের একমাত্র কর্ত্রীরূপে পরিগণিত হওয়ায়, সময়ে কেহই নবকুমারের সহিত আপন কন্যার বিবাহ দেয় নাই। বিশেষতঃ যতদিবস সেই বৈষ্ণবী জীবিত ছিল, ততদিবস নবকুমার বিবাহের কোন চেষ্টাও করেন নাই। তাহার মৃত্যুর পর হইতেই এই বিবাহের সূচনা হয়, এবং সেই গ্রামের জনৈক কায়স্থের সাহায্যে ক্রমে সেই বিবাহ সম্পন্ন হইয়াও যায়। 

বাঁশীরাম নবকুমারের বাড়ীর ভিতর যখন প্রবেশ করিলেন, সেই সময় আরও অনেক লোকজন তাঁহার সহিত গমন করিল। যখন বাঁশীরাম সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেছিলেন, সেই সময়ে প্রমদা বাড়ীর ভিতর প্রাঙ্গনে বসিয়া অপরাপর স্ত্রীলোকদিগের নিকট আপনার স্বামীর নিমিত্ত অশেষ দুঃখপ্রকাশ করিতেছিল। কিন্তু বাঁশীরাম প্রভৃতি সকলে যেমন বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন, অমনি প্রমদা অপরাপর স্ত্রীলোকগণের সহিত বাড়ীর সেই একমাত্র গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। বাঁশীরাম সেই প্রাঙ্গনে দণ্ডায়মান হইয়া তাহাকে যে কয়েকটি স্থূল বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহার উত্তর তিনি অপর আর একজন প্রবীণা স্ত্রীলোকের মুখ হইতে প্রাপ্ত হইলেন। বাঁশীরাম জানিতে পারিলেন, সন্ধ্যার পরই নবকুমার বাড়ীর বাহিরে গমন করিয়াছিলেন, সেই সময়ে তাঁহার নিকট কোন দ্রব্যই ছিল না। কেবলমাত্র পরিধানে একখানি থানফাড়া ধুতি, পায়ে একজোড়া চটি জুতা, এবং স্কন্ধে একখানি গামছা ছিল মাত্র। তিনি যে সেইদিনেই সন্ধ্যার পর বাহির হইয়া গিয়াছিলেন, তাহা নহে; ইহা তাঁহার নিত্যকর্ম্মের মধ্যে পরিগনিত। সেই সময় প্রত্যহই তিনি বহির্গত হইয়া রামসুন্দর ঘোষের বৈঠকখানায় গিয়া উপবেশন করিতেন। এবং কোনদিবস রাত্রি নয়টা, কোনদিবস দশটার সময় আপনার বাড়ীতে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক আহারাদি করিয়া শয়ন করিতেন। 

তৎপরে বাঁশীরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “গত রাত্রিতে তিনি প্রত্যাগমন করিয়া আহার করিয়াছিলেন কি?”

প্রবীণা। (প্রমদার প্রতিধ্বনি) না, গত রাত্রিতে তিনি প্রত্যাগমনই করেন নাই। আহার করিবেন কোথা হইতে?

বাঁশীরাম। যখন আপনি দেখিলেন, ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া গেল, নবকুমার আর প্রত্যাগমন করিলেন না, তখন আপনি তাঁহার কোনরূপ সন্ধান লইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন কি? 

প্রবীণা। আমি স্ত্রীলোক, রাত্রিকালে তাঁহার সন্ধানের নিমিত্ত কি চেষ্টা করিব? 

বাঁশীরাম। যে স্থানে নবকুমার হত হইয়াছেন, সেইস্থান আপনার গৃহ হইতে বহুদুরে নহে। আর যখন তিনি হত হন, তখন নিশ্চয়ই তিনি প্রাণরক্ষার চেষ্টা করিয়াছিলেন, বা পড়িয়া গিয়াছিলেন; সুতরাং কোনরূপ না কোনরূপ শব্দ নিশ্চয়ই হইয়াছিল। এরূপ অবস্থায় আপনি তাঁহার কিছুই জানিতে পারেন নাই কি? 

প্রবীণা। না মহাশয়! আমি কিছুই সন্ধান পাই নাই। আমি সন্ধ্যার পরই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। 

বাঁশীরাম। আপনি কখন এই অবস্থা জানিতে পারিলেন? তখন রাত্রি কত হইয়াছিল? 

প্রবীণা। প্রাতঃকালে যখন আমি গোলযোগ শুনিলাম, তখন বাহিরে গিয়া দেখিলাম, আমারই সর্ব্বনাশ হইয়াছে!

বাঁশীরাম। আপনি কহিলেন, নবকুমার রাত্রিতে ফিরিয়া আসিয়া আহার করিতেন। গত রাত্রিতে ফিরিয়াও আসেন নাই, আহারও করেন নাই? তাঁহার আহারীয় দ্রব্য কি ছিল, দেখি। 

প্রবীণা। কাল রাত্রিতে আমার শরীর সুস্থ ছিল না বলিয়া, তাঁহার নিমিত্ত আহার প্রস্তুত করিতে পারি নাই।

বাঁশীরাম। হিন্দু স্ত্রীলোকের ইহা ত নিয়ম নহে। তাহারা মরিতে বসিয়াও, আপনার স্বামীর আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিতে ভুলে না। আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিতে না পারিলে, আহারের নিমিত্ত অন্য কোন দ্রব্যও অভাব পক্ষে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া দেয়। আপনার কি অসুখ হইয়াছিল? 

প্রবীণা। অত্যন্ত মাথা ধরিয়াছিল, বলিয়া, আমি আহার প্রস্তুত করিতে পারি নাই। 

বাঁশীরাম। এইমাত্র আপনি কহিলেন, সকালে সকালে আপনি নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিলেন; কিন্তু, মাথা ধরিলে সহজে ত নিদ্রা আসে না? 

এই কথার কোন উত্তর না দিয়া, প্রমদা উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিল। সুতরাং তাহাকে অপর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া, সকলে সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক বাহিরে গমন করিলেন। 

এইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া বাঁশীরাম রামসুন্দর ঘোষের বৈঠকখানায় গমন করিলেন। সেইস্থানে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইলেন—বাস্তবিকই নবকুমার সন্ধ্যার পর সেইস্থানে গমন করিয়াছিলেন। রাত্রি নয়টা পর্য্যন্ত সেইস্থানে থাকিয়া বাড়ি গমন করিবার নিমিত্ত, তিনি একাকী সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। ইহা তাঁহার নিত্য কর্তব্য কৰ্ম্ম। 

ইহার পর বাঁশীরাম পুলিশের নিয়মিত যে সকল অনুসন্ধান আছে, তাহাতেই নিযুক্ত হইলেন; লাসের সুরতহাল করিয়া লাস চালান দিলেন। এক একদিবস করিয়া অনবরত তিনদিবস কাল সেই গ্রামে বসিয়া বসিয়া গ্রামের অনেক লোকের জবানবন্দী গ্রহণ করিলেন। কিন্তু কে যে সেই লাস প্রথমে দেখিয়াছে, তাহা স্থির হইল না। সকলেই কহিল, “তাহারা সেইস্থানে যাইবার পূর্ব্বে অনেকেই সেইস্থানে গিয়াছিল।” সুতরাং, কে যে মিথ্যা কহিতেছে, তাহা বাহির করা বাঁশীরামের পক্ষে একেবারে অসম্ভব হইয়া উঠিল। 

একা বাঁশীরামের কেন, যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী যখন যে অনুসন্ধানে নিযুক্ত হন, তখন তাঁহার ভাগ্যে প্রায়ই এইরূপ ঘটনা ঘটিয়া থাকে। এতদ্দেশীয় পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণের উপর প্রজাবর্গের একে আস্থা নাই, মনের কথা সাহস করিয়া তাহাদিগের নিকট কেহই বলিতে চাহে না। তাহার উপর প্রকৃত কথা বলিয়া কে পুলিসের টানাটানিতে পড়িবে? “বোবার শত্রু নাই” ইহা অপেক্ষা সদুপদেশ আর কি আছে? 

তিন চারিদিবস অনুসন্ধান করিয়া যখন বাঁশীরাম কোন কথাই বাহির করিতে পারিলেন না, তখন কি করিবেন, বসিয়া বসিয়া তাহাই ভাবিতেছেন, এমন সময় অপর আর একজন কর্মচারী তাঁহার সাহায্যের নিমিত্ত আসিয়া উপস্থিত হইল। ইনিও বাঁশীরামের একজন সমকক্ষ, নাম শ্যামাচরণ দারোগা। শ্যামাচরণ এবং বাঁশীরামের মধ্যে সরকারী কাৰ্য্যোপলক্ষে বেশ প্রণয় আছে, উভয়ে একত্র মিলিত হইয়া অনেক সময়ে অনেক অসাধ্য সাধন করিয়াছেন। গবর্ণমেন্টের নিকট উভয়ের খাতিরও যথেষ্ট আছে। যাহা হউক, শ্যামাচরণকে দেখিয়া বাঁশীরামের একটু সাহস হইল; পরামর্শ করিবার উপযুক্ত লোক পাইলেন বলিয়া তিনি অতিশয় আনন্দিত হইলেন। নিৰ্জ্জনে উভয়ে অনেকক্ষণ পরামর্শ করিয়া পরিশেষে বাহিরে আসিয়া উপবেশন করিলেন। এই মোকদ্দমার যে সকল কাগজপত্র ছিল, তিন চারি দিবস ধরিয়া বাঁশীরাম যাহা কিছু লিখিয়া পড়িয়া রাখিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই তিনি শ্যামাচরণকে অর্পণ করিলেন ও কহিলেন, “আমার দ্বারা যাহা কিছু হইবার, তাহা হইয়াছে; এ মোকদ্দমা আমার দ্বারা প্রমাণ-সিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা নাই। আপনি যদি কিছু করিতে পারেন, করুন, আমি এইস্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি।” এই বলিয়া বাঁশীরাম আপনার সহিসকে তাঁহার ঘোটক প্রস্তুত করিতে কহিলেন। 

এক দারোগা না পারায়, অপর আর এক দারোগা অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছেন, দেখিতে দেখিতে এই কথা গ্রামময় প্রকাশ হইয়া পড়িল। গ্রামস্থ অধিকাংশ লোকই আপন আপন কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, ক্রমে শ্যামাচরণ দারোগার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। ছোট ছোট বালক-বালিকাগণ ক্রমে তাঁহাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইতে লাগিল। এই কয়েকদিবস পর্য্যন্ত যাঁহারা বাঁশীরামের নিকট উপস্থিত থাকিয়া তাঁহার অনুসন্ধানের প্রণালী স্বচক্ষে দর্শন করিতেছিলেন, এখন তাঁহারা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া শ্যামাচরণের দিকেই লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। 

সেকালের দারোগাগণের অনুসন্ধানের যেরূপ ‘ধরণ ধারণ’ ছিল, শ্যামাচরণ সেইরূপ ভাবেই অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। আসর জাঁকাইয়া সেইস্থানে বসিয়াই, খুব সরগরম আরম্ভ করিলেন। এই অনুসন্ধানের প্রথম আক্রমণ সেইস্থানের একজন নিরীহ ও দরিদ্র চৌকীদারের উপর গিয়া পড়িল। একটি অতিসামান্য কথা অবলম্বন করিয়া প্রথমেই শ্যামাচরণ সেই চৌকীদারের উপর দশ বিশবার পাদুকাঘাত করিলেন। সেই দরিদ্র চৌকীদার তাহার সেই কঙ্কালাবশিষ্ট শরীর ঝাড়িতে ঝাড়িতে ও ভয়ে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে দূরে গিয়া উপবেশন করিল। অপরাপর চৌকীদারগণও নিতান্ত জড়সড় হইয়া দূরে গিয়া বসিল। কি দোষে শ্যামাচরণ সেই চৌকীদারকে অপমানিত করিলেন, তাহার কারণ অপর কাহারও বোঝা ত পরের কথা, সেই চৌকীদার নিজেই তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। দেশের মধ্যে যাঁহার একটু মানসম্ভ্রম আছে, যাঁহাকে সকলে একটু ভীতিচক্ষে অবলোকন করিয়া থাকে, তাঁহার পক্ষে ইহা কিছু নূতন কথা নহে। নিত্য নিত্য এরূপ কত দরিদ্রলোক যে তাহাদিগের নিকট বিশেষরূপে অবমানিত হয়, তাহার সংখ্যা কে করিবে? 

শ্যামাচরণ কেন যে এই চৌকীদারকে এরূপভাবে অবমানিত করিলেন, তাহা অপর কেহ বুঝিতে না পারুন, স্বয়ং চৌকীদার তাহা জানিতে না পারুন, আমরা কিন্তু তাহার কারণ বেশ অবগত আছি। শ্যামাচরণ বুঝিতে পারিলেন,—চৌকীদারগণ গ্রামের লোকের পক্ষ অবলম্বন করিয়া, যে বিষয় তাহারা উত্তমরূপে অবগত আছে, তাহা গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে; এবং কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে “আমরা তাহার কিছুই অবগত নহি” বলিয়া উত্তর প্রদান করিতেছে। এই নিমিত্তই শ্যামাচরণ ভাবিলেন,—উহাদিগকে দুই এক ঘা না দিলে, উহারা প্রকৃত কথা কহিবে না। 

সহিস বাঁশীরামের ঘোড়া আনিয়া উপস্থিত করিল। তিনি সকলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া আপনার অশ্বের পৃষ্ঠে উঠিলেন। উঠিয়াই অশ্বের পৃষ্ঠে এক চাবুক মারিলেন, চাবুক খাইয়া অশ্ব আপনার আরোহীকে পৃষ্ঠে করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া গেল। যতদূর পর্য্যন্ত দৃষ্টি চলিতে লাগিল, ততদূর পর্যন্ত সকলেই সেই অশ্বের দিকে দৃষ্টি করিয়া রহিলেন। দেখিতে দেখিতে অশ্ব সকলের দৃষ্টিপথের অতীত হইয়া পড়িল? 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

সন্তোষপুর গ্রামের নিম্নে একটি ক্ষুদ্র নদী আছে। সময়ে এই নদীতে অনেক জল থাকিত, রাত্রিদিন বেশ স্রোত বহিত। বাণিজ্য উপলক্ষে অনেক নৌকা এইস্থান দিয়া যাতায়াত করিত, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এই নদীর অবস্থারও পরিবর্ত্তন হইয়াছে। স্রোত বন্ধ হইয়া গিয়াছে, স্থানে স্থানে চড়া পড়িয়া লোকজনের পারাপারের, সুবিধা হইয়াছে। নদীর আর এখন অধিক গভীরতা নাই; কিন্তু, উহার মধ্যে মধ্যে স্থানে স্থানে বেশ জল আছে। তবে বিলের ন্যায় যে স্থানের জল সেইস্থানেই আবদ্ধ। বর্ষাকালে নদীর সৰ্ব্বস্থান পূর্ণ হয়, কিন্তু গ্রীষ্মকালে জল ক্রমে শুখাইয়া গিয়া অতি অল্পই অবশিষ্ট থাকে মাত্র। 

সন্তোষপুর গ্রামের লোকজন, গরু বাছুর প্রভৃতির উক্ত নদীর জল ভিন্ন আর উপায় নাই। সকলে এই জলে স্নান করে। এই জল ভিন্ন নিকটবর্ত্তী পাঁচক্রোশের মধ্যে পানীয় জলের আর সংস্থান নাই। দিবাভাগে সন্তোষপুর গ্রামের বালক-বৃদ্ধ-বনিতা প্রভৃতি সকলেই সেই মৃত নদীতে গমন করিয়া স্নান করিয়া থাকেন। বৈকালে গ্রামের সমস্ত যুবতী এইস্থানে আগমন করেন, এবং গা’ হাত পা ধুইয়া কলসী করিয়া, এই নদীর জলও লইয়া যান। ইহাই এইস্থানের নিয়ম। 

যে দিবস নবকুমারের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে তাহার সাত কি আটদিবস পরে সন্ধ্যার সময় উক্ত মরা নদীতে চারি পাঁচটি স্ত্রীলোক আপন-আপন গা’ হাত পা ধৌত করিতেছেন। পাঠক-পাঠিকাগণ! আপনারা এদেশীয় স্ত্রীলোকদিগের স্বভাব উত্তমরূপেই আছেন; যে স্থানে সমবয়স্কা দুই চারিজন স্ত্রীলোক একত্র হইয়াছেন, সেইস্থানেই পরস্পর পরস্পরের মনের কপাট বন্ধ করিয়া রাখিতে কোন ক্রমেই সমর্থ হন না। সুতরাং, ইঁহারা যে নিতান্ত একেবারে মুখ বন্ধ করিয়া আপন আপন গা’ হাত পা প্ৰক্ষালনপূর্ব্বক জল লইয়া গমন করিবেন, তাহা কি প্রকারে বলিতে পারি? ইহা স্বভাবের বিপরীত। 

উঁহাদিগের মধ্যে একজন কহিলেন, “দেখলি ভাই! কি ভয়ানক! আপনার স্বামীর চেয়ে এ সংসারে আর কি আছে?” 

২য় স্ত্রীলোক। তা যদি ভাই সকলে বুঝিতে পারত, তা’ হ’লে আর কি ভাবনা ছিল? তা’ হ’লে ত, এই সংসার সোণার সংসার হ’ত, এখানে স্বর্গের চেয়ে সকলে অনেক সুখ পে’ত 

৩য় স্ত্রীলোক। তা’ ভাই! এ স্বর্গ না হউক, সকলে প্রাণ দিয়ে স্বামীর সেবা না করুক, কিন্তু ভাই, এমন কখন দেখিনি, কখন শুনিনি। ঘরের স্বামী এমন ক’রে মারা গেল, তা’র কি না চখেতে একফোঁটা জল কেউ দেখতে পেল না। সে কোন্ মুখ নিয়ে ভাই, সকলের সঙ্গে হেসে খেলে কথা ব’লে বেড়াচ্ছে। এত লোকের মরণ হয়, কিন্তু যম কি এমন ধারা স্ত্রীলোককে চেনেন না? 

৪র্থ স্ত্রীলোক। এ ভাই তোমাদের ভুল। আমি শুনিছি, যে স্ত্রীলোকের চরিত্র খারাপ হয়, যে পরপুরুষের উপর সর্ব্বদা নজর করে, তা’র মনে, ভাই! দয়া ধৰ্ম্ম কিছুই থাকে না। আপনার স্বামী যে দেবতা, তা’ ভুলে, তা’র বদলে স্বামীর সহিত নিতান্ত মন্দ ব্যবহার ক’রে থাকে। প্রমদাকে ত ভাই তোমরা সকলেই জান, সে কি কখন একদিনের জন্যও তা’র স্বামীর সেবা করেছে যে, সে তাঁ’র জন্য কষ্ট ক’রবে, না, তাহার চখ দিয়ে একফোঁটা জল পড়বে? আর ভাই সেই হতভাগা হরেটাকেই বা কি বলি, তা’র বাপ তা’র বিয়ে দেওয়ার জন্যে এত ঝুলোঝুলি কল্পে, কিন্তু সে ত কিছুতেই শুনলে না, কোন রকমেই সে বিয়ে কর্তে রাজি হ’ল না। কি জানি ভাই, এ মাগী তাকে কি মন্তর দিয়েছে, তা’ বোঝা ভার! 

৫ম স্ত্রীলোক। আবার শুনেছিস্ ভাই! যে দিন নবকুমার খুন হ’য়েছে, সেইদিন হ’তেই সেই হতভাগাটা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। মাগী তা’র জন্যে ভেবে মরছে! কি পোড়া কপাল! এমন সোণার চাঁদ স্বামী, তাঁর এরূপ অবস্থা দেখে, তা’র চোক দিয়া একফোঁটা জল বেরোয় না, আর সে অপর একটা হতভাগার জন্যে এরকম অস্থির হয়? এ ব্যাপার ভাই, কখন শুনিনি, দেখা ত পরের কথা? 

১ম স্ত্রীলোক। সে কি? সেই হতভাগা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে? কেন ভাই, তবে কি সে-ই প্রমদার স্বামীকে মেরে ফেলেছে? তাহা যদি হয়, তবে ভাই প্রমদাও বোধ হয়, এর কতক কতক নিশ্চয়ই জানে। 

এইরূপ বলিতে বলিতে স্ত্রীলোক কয়েকটি গা হাত পা ধুইয়া কলসীকক্ষে জল লইয়া, গ্রামাভিমুখে সারি সারি গমন করিতে লাগিলেন। ইঁহারা আপন কথাতেই উন্মত্ত হইয়া গমন করিতেছেন, অন্য কোনদিকে লক্ষ্য নাই—এই মনেই চলিয়াছেন। 

সেই মরা নদীর যে ঘাটে অবতরণ করিয়া জল লইতে হয়, সেই ঘাটের নিকটেই কতকগুলি আগাছার একটি জঙ্গল আছে। কামিনীগণ সেই ঘাট হইতে উঠিবামাত্রই, সেই জঙ্গলের ভিতর হইতে একটি মনুষ্য বাহির হইয়া, তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। কোন কামিনী সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া, আপন প্রাণের কথা অপরের নিকট বর্ণন করিতে করিতে গমন করিতে লাগিলেন। যে লোকটি স্ত্রীলোকদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছিলেন, তাঁহার পোষাক পরিচ্ছদ, এবং ধরণ-ধারণ দেখিয়া বোধ হয়, ইনিও সেই গ্রামের কোন একজন অধিবাসী হইবেন। ইহার পদযুগল পাদুকা-বিহীন, পরিধানে কেবলমাত্র অর্দ্ধ-ময়লা ধুতি, গাত্রে পিরান বা চাদর নাই; কিন্তু, স্কন্ধে একখানি ময়লা গামছা আছে, এবং হস্তে একটি পিতলের গাড়ু। 

ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল, সেই অন্ধকারের মধ্যে সকলেই গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলেন। কিন্তু, কে যে কোনদিকে গমন করিলেন, তাহা আর কেহই দেখিতে পাইলেন না। 

সেই রাত্রিতে একজন চৌকীদার একখানি পত্র আনিয়া সেই খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত শ্যামাচরণ দারোগার হস্তে প্রদান করিল। শ্যামাচরণ পত্রখানি খুলিয়া পড়িলেন; পড়িয়া আপনার পকেটে রাখিয়া দিলেন, এবং তাঁহার সহিসকে ঘোটক সজ্জিত করিতে কহিলেন। সকলেই জানিল, কোন বিশেষ কার্য্যোপলক্ষে শ্যামাচরণকে রাত্রির নিমিত্ত সেইস্থান পরিত্যাগ করিতে হইতেছে। পরদিবস প্রাতঃকালে পুনরায় তিনি আগমন করিবেন, এবং অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবেন। 

সন্তোষপুর গ্রামের প্রায় দুইক্রোশ দূরে রায়নগর নামক একখানি গ্রাম আছে। এই গ্রামে একখানি ফাঁড়ীঘর আছে। কনষ্টেবলগণ পাহারায় আসিলে বা কোন কর্ম্মচারী কোন অনুসন্ধানে আগমন করিলে, সেইস্থানেই প্রায় অবস্থান করিয়া থাকেন। 

শ্যামাচরণ সেই রাত্রিকালে একাকী অশ্বারোহণে সেই ফাড়ীঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া তিনি ঘরের ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক দেখিলেন, সেই ঘরের ভিতর একখানি চারিপায়ার উপর একজন শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছেন। দেখিবামাত্রই শ্যামাচরণ জানিতে পারিলেন, সেই ব্যক্তি কে, ও কহিলেন, “বাঁশীরাম দাদা! আজ বড় ঘুম যে?” 

বাঁশীরাম। কে? শ্যামাচরণ আসিয়াছ? ভালই হইয়াছে, তোমার আগমন প্রতীক্ষা করিতে করিতে আমি নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছি। এ মোকদ্দমার কিছু উপায় করিয়া উঠিতে পারিলে কি? 

শ্যামাচরণ। এই মোকদ্দমার উপায় করিবার ভার ত আমার উপর নয়, সে ভার দাদার উপর;—আমি আসর জমকাইয়া কেবল বসিয়া আছি মাত্র। দেখিতেছি দূর হইতে, দাদা আমার কি করিয়া উঠেন। 

বাঁশীরাম। এতদিবস পরে এই মোকদ্দমার যেন উপায় হইবে বলিয়া বোধ হইতেছে, ইহার কিছু কিছু আভাষ আমি প্রাপ্ত হইয়াছি। আজ সন্ধ্যার সময় আমি গুপ্তবেশে সন্তোষপুরে গমন করিয়াছিলাম, এবং লুক্কায়িতভাবে সেই গ্রামের মৃত নদীর ধারে বসিয়াছিলাম। সেই সময়ে কয়েকটি স্ত্রীলোক জল লইবার নিমিত্ত সেইস্থানে গমন করে। তাহারা পরস্পর যেরূপভাবে গল্প করিতেছিল, তাহাতে আমার বেশ বিশ্বাস হইতেছে—নবকুমারের স্ত্রী ইহার কিছু না কিছু অবগত আছেন। স্বামীর হত্যাসম্বন্ধে কোন কথা স্ত্রী জানিতে পারিলে যে, সে চুপ করিয়া থাকে, তাহা এতদ্দেশীয় হিন্দুরমণীদিগের মধ্যে অসম্ভব হইলেও, কুলটার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নহে। আমি যেরূপ শুনিয়াছি, তাহা যদি প্রকৃত হয়,—বাস্তবিকই সেই গ্রামের হরি নামক কোন ব্যক্তির সহিত যদি নবকুমারের স্ত্রী অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধা হইয়া থাকে, এই হত্যার পরদিবস হইতেই যদি সেই হরি পলায়ন করিয়া থাকে, তাহা হইলে বোধ হয়, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান হইতে আর বিলম্ব হইবে না। হরি কে, কাহার পুত্র, সে এখন কোথায়, এবং প্রমদার সহিত সে অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ কি না? সে বিষয়ে বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া, তাহার প্রকৃত সংবাদ আগামী কলা তুমি আমাকে প্রদান করিবে। রাত্রিতে আমাকে এইস্থানেই পাইবে। এই সকল সংবাদ জানিতে পারিলে পর, যে পন্থা অবলম্বন করা যুক্তিযুক্ত হয়, তখন তাহাই করা যাইবে। 

বাঁশীরামের এই কথা শুনিয়া এবং তাঁহার নিকট হইতে সেই সম্বন্ধে আরও যাহা যাহা জানিতে হইবে, তাহা জানিয়া লইয়া শ্যামাচরণ প্রস্থান করিলেন। 

পরদিবস ঠিক্ নিরূপিত সময়ে শ্যামাচরণ পুনরায় গিয়া বাঁশীরামের সহিত সেইস্থানে সাক্ষাৎ করিলেন। তাঁহার নিকট হইতে আজ বাঁশীরাম জানিতে পারিলেন যে, বাস্তবিকই প্রমদার সহিত হরি বৈধ প্রণয়ে আসক্ত, এবং হত্যার পরদিবস হইতেই সে গ্রাম পরিত্যাগ পূর্ব্বক কোথায় চলিয়া গিয়াছে। সে যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহা তাহার বাড়ির কেহই বা গ্রামের কোন লোকই জানিতে পারে নাই, বা জানিতে পারিলেও, শ্যামাচরণের নিকট তাহা গোপন করিয়া রাখিয়াছে। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

অসৎ স্ত্রীলোকগণের কুটিলবুদ্ধি! মিথ্যা কথা বলিয়া প্রমাদ ঘটান তাহাদিগের পক্ষে অতি সহজ কথা। এই ভাবিয়া বাঁশীরাম প্রমদাকে একাকী কোন কথা বলিতে সাহসী হইলেন না। সেই গ্রামের দুই একজন লোকের সাহায্য তাঁহাকে গ্রহণ করিতে হইল। এক দিবস প্রাতঃকালে বাঁশীরাম সদল বলে পুনরায় সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন; শ্যামাচরণ ও তাঁহার দলবলকেও সেইস্থানে পাইলেন। সেই গ্রামের প্রধান প্রধান দুই একজনকে সঙ্গে লইয়া, সকলে নবকুমারের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই সময়ে প্রমদা বাড়ীতে ছিল না, পাড়ার ভিতর অপর কাহারও বাড়ীতে গমন করিয়াছিল। সংবাদ পাঠাইয়া প্রমদাকে বাড়ীতে গমন করিয়াছিল। সংবাদ পাঠাইয়া প্রমদাকে বাড়ীতে ডাকিয়া আনা হইল। পুলিস পুনরায় তাহার বাড়ীতে আগমন করিয়াছে, এই কথা সে জানিতে পারিয়া, পাড়ার আরও দুই তিনজন প্রবীণা স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া আনিল। ইচ্ছা—পূর্ব্বের মত ইহাদিগের মধ্যবর্তিনী করিয়া পুলিসের কথার উত্তর প্রদান করে। বাঁশীরাম কিন্তু এবার তাহাতে সম্মত হইলেন না, ও কহিলেন, “আমি পূর্ব্বে যখন প্রমদার জবানবন্দী গ্রহণ করিয়াছিলাম, তখন নবকুমারের স্ত্রী হিন্দুকুলবালা বলিয়া, তাঁহার সহিত আমাদিগের নিজের কথা কহিবার প্রয়োজন হইয়াছিল না। সুতরাং, অপর একজন স্ত্রীলোকের প্রমুখাৎ যাহা শুনিয়াছিলাম, তখন তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া চলিয়া গিয়াছিলাম। কিন্তু আজ আমরা নবকুমারের বিধবা পত্নী সরলা হিন্দুরমণী প্রমদার জবানবন্দী লইতে আসি নাই। আজ কুলটা, কুল-ধ্বংশকারিণী প্রমদার জবানবন্দী—নিজ স্বামীঘাতিনী, পাপময়ী পিশাচিনীর জবানবন্দী গ্রহণ করিতে আসিয়াছি; আজ আসিয়াছি—কেবল প্রমদার প্রমাদকাণ্ডের ভীষণরহস্য উদ্ঘাটন করিবার অভিপ্রায়ে; সুতরাং, আজ অপর স্ত্রীলোকের সাহায্য লইবার প্রয়োজন হইবে না। আপনারা ভদ্রবংশীয়া যে সকল স্ত্রীলোক এখানে আসিয়াছেন, তাঁহারা আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিতে পারেন। প্রমদার পক্ষ অবলম্বন করিয়া, প্রমদার কথা আমাদিগকে বুঝাইয়া দিবার কোন প্রয়োজন হইবে না। আমাদিগের কথার উত্তর প্রদান করিতে প্রমদা নিজে এখন অনায়াসেই সমর্থ হইবে।” 

বাঁশীরামের সহিত যে কয়েকজন ভদ্রলোক নবকুমারের বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহারা বাঁশীরামের কথা শুনিয়া মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হইলেন। কারণ, প্রমদার চরিত্রের কথা যাহাতে কোনরূপে পুলিসের কর্ণগোচর না হয়, তাঁহারা সেই বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়া এ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছিলেন। তাঁহাদিগের পরামর্শ-গুণেই গ্রামের কোন লোকের মুখে সেকথা এ পর্যন্ত শুনিতে পাওয়া যায় নাই। যে সকল লোক পুলিসের নিকট জবানবন্দী দিয়াছে, তাহাদিগের কাহারও মুখে সেকথা প্রকাশ পায় নাই, এবং সেই গ্রামের চৌকীদারগণও তাহার আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত থাকিলেও, তাহারা পুলিসের নিকট কোন কথা প্রকাশ করে নাই। 

গ্রামের ভদ্রলোকগণ একটু অসন্তুষ্ট হইয়াছেন, জানিতে পারিয়াও, বাঁশীরাম কিন্তু সেদিকে লক্ষ্যপাত করিলেন না; যে কার্য্যের নিমিত্ত তিনি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলেন, সেই কার্য্যের উদ্ধারে প্রবৃত্ত হইলেন। 

বাঁশীরাম প্রমদাকে প্রথমে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন; কিন্তু, তাহার কোনরূপ উত্তর না পাইয়া পরিশেষে বাঁশীরাম কহিলেন, “দেখ প্রমদা! আমরা এখন খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত। এ সম্বন্ধে আমরা তোমাকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি আইন-অনুযায়ী তাহার সঙ্গত উত্তর প্রদানে বাধ্য। তোমার বিপক্ষে আমরা যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহারই উপর নির্ভর করিয়া যদি আমাদিগকে চলিতে হয়, তাহা হইলে তোমার গ্রামের ভদ্রলোকগণের সম্মুখে ভদ্রোচিত ব্যবহারে তোমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার আমাদিগের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। সেরূপস্থলে আমাদিগের কর্তব্য—তোমাকে গ্রেপ্তার করিয়া এইস্থান হইতে থানায় লইয়া যাওয়া, এবং যাহা কিছু জিজ্ঞাস্য, তাহা সেইস্থানেই জিজ্ঞাসা করা। তোমার চরিত্র যাহাই হউক, কিন্তু তুমি ভদ্রলোকের কুলবধূ বলিয়া, এখনও তোমাকে যথাসাধ্য সম্মান করিয়া চলিতেছি। ইহাতেও তুমি আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান না করিলে, বাধ্য হইয়া তোমাকে আমাদিগের থানায় লইয়া যাইব, এবং জিজ্ঞাস্য কথা সেইস্থানেই জিজ্ঞাসা করিব।” 

বাঁশীরামের কথা শুনিয়া প্রমদা অতি মৃদুস্বরে কহিল, “যাহা আপনার জিজ্ঞাস্য থাকে, তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করুন। যথাসাধ্য উত্তর প্রদান করিতেছি, আমাকে থানায় লইয়া যাইবার কোন প্রয়োজন নাই।” 

প্রমদার কথা শুনিয়া বাঁশীরাম কহিলেন, “এ ভাল কথা। হিন্দুরমণী হইয়া তুমি তোমার স্বামীর প্রতি এরূপ ব্যবহার করিলে কেন?” 

প্রমদা। কিরূপ ব্যবহার? আমি আমার স্বামীর প্রতি কখন অন্যায় ব্যবহার করি নাই। 

বাঁশীরাম। তোমার স্বামীর উপর তোমার কিছুমাত্র ভালবাসা ছিল না, একথা কি সত্য? 

প্রমদা। এ মিথ্যা কথা। 

বাঁশীরাম। তোমার স্বামী তোমার চরিত্রের উপর সর্ব্বদা সন্দেহ করিতেন, একথা গ্রামের সকলেই যে বলে, তাহার কারণ কি? 

প্রমদা। মিথ্যা কথা। 

বাঁশীরাম। শুনিতে পাওয়া যায়, একদিবস রাত্রিকালে তোমার ঘরে কোন পুরুষ মানুষকে দেখিয়া তোমার স্বামী গোলযোগ করিয়াছিলেন, ইহার কারণ কি? 

প্রমদা। আমার ঘরে তিনি কখনও কোন পুরুষ মানুষকে দেখেন নাই, বা কোন কারণে কখনই কোনরূপ গোলযোগ করেন নাই। 

বাঁশীরাম। তবে তোমার চরিত্র সম্বন্ধে নানা লোকে যে নানা কথা কহে, সে মিথ্যা? 

প্রমদা যেরূপ মৃদুস্বরে প্রথমে কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, এখন আর সে মৃদুস্বর নাই। উহা ক্রমেই উচ্চরবে পরিণত হইতেছে। প্রথম কথা কহিবার সময় তাহার মস্তকে যে হস্তপরিমিত অবগুণ্ঠন ছিল, ক্রমে ক্রমে তাহা অপসৃত হওয়াতে তাহার মুখমণ্ডল এখন সৰ্ব্বসমক্ষে প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে। বাঁশীরামের শেষ প্রশ্নের উত্তরে এখন প্রমদা কহিল, “সে মিথ্যা কথা, সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। ইহা শত্রুপক্ষীয়দিগের শত্রুতা। এই যে সকলে আপনার সহিত তামাসা দেখিতে এখানে আসিয়াছেন, ইহাদিগের মধ্যে ভদ্রলোক কে? ইঁহারা আমার শত্রু। আমার বিপক্ষে ইঁহারা না বলিতে পারেন, এমন কথাই নাই, না করিতে পারেন, এমন কার্য্যই নাই।”

বাঁশীরাম। ভাল, ইঁহারাই যেন তোমার শত্রু হইলেন, কিন্তু হরি ত আর তোমার শত্রু নহে। হরি এখন কোথায়?

প্রমদা। হরি? কে হরি? আমি ত কোন হরিকে জানি না যে, বলিব সে কোথায়। 

বাঁশীরাম। যে হরির নিমিত্ত তোমার মন সর্ব্বদা ব্যস্ত, নবকুমারের মৃত্যুতে তোমার যত কষ্ট হয় নাই, যে হরির গ্রাম পরিত্যাগে তোমার মন সর্ব্বদা তদপেক্ষা অস্থির, সেই হরিকে তুমি জান না? 

প্রমদা। না, জানি না। যাহাকে জানি না, তাহাকেও জানি বলিতে হইবে না কি? 

বাঁশীরাম। কয়েক দিবসমাত্র অতীত হইল, অসময়ে নবকুমার বাহির হইতে আসিয়া যে হরিকে তোমার ঘরের ভিতর দেখিতে পান, তাঁহাকে দেখিয়া যে হরি প্রাণভয়ে বেগে পলায়ন করে, যে হরির নিমিত্ত নবকুমার তোমাকে হত্যা করিতে সঙ্কল্প করেন, কিন্তু পরিশেষে তুমিও পলায়ন পূর্ব্বক অন্য বাড়ীতে আশ্রয় লইয়া আপন জীবনরক্ষা কর, সেই হরিকে তুমি এখন চিনিতে পারিতেছ না? 

প্রমদা। না, আমি চিনিতে পারিতেছি না। আমি কোন হরিকে চিনি না। 

বাঁশীরাম। তুমি হরিকে চেন কি, না, তাহা তোমাকে আমি পরে দেখাইব। তখন দেখিবে, বাঁশীরামের বুদ্ধি, সামান্য একজন স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অপেক্ষা প্রখর কি না। আর ইহাও বুঝিবে, বাঁশীরাম দারোগা যে কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত, সেই কাৰ্য্য সাধন করিতে সমর্থ কি না। দেখ প্রমদা! তুমি স্ত্রীলোক, বুঝিতে না পারিয়া স্ত্রীবুদ্ধি-সুলভ এই কার্য্য যদি তোমার দ্বারা বা তোমার পরামর্শ অনুসারে, অথবা তোমার জ্ঞাতসারে সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে এখন তুমি তাহা আমার নিকট গোপন করিও না। এই ভদ্রলোকদিগের সম্মুখে এখনও আমি তোমাকে শেষ বলিয়া দিতেছি যে, বাঁশীরাম মনে করিলে, তোমাকে এখন বাঁচাইতেও পারে, কিম্বা ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলাইতেও পারে। 

প্রমদা। তোমরা পুলিস-কৰ্ম্মচারী। “হয় কে নয়” বা “নয় কে হয়” করার ক্ষমতা তোমাদের বেশ আছে, তাহা আমি জানি। তা’ই বলিয়া আমি মিথ্যা কথা কহিব কেন? যাহা আমি অবগত নহি, তাহা জানি বলিয়া ধৰ্ম্ম নষ্ট করিব কেন? আমি কোন কথা জানি না, জানিলে আমি এখনই বলিতাম, সৰ্ব্বসমক্ষে দাঁড়াইয়া এরূপ অবমাননা কখনই সহ্য করিতাম না। 

প্রমদার কথা শুনিয়া বাঁশীরাম বুঝিলেন—যে শ্রেণীর স্ত্রীলোকদিগকে তিনি কার্য্যসূত্রে বিশেষরূপে অবগত হইতে পারিয়াছেন, প্রমদা সে শ্রেণীর স্ত্রীলোক নহে। ইহাকে সরলপথে আনিতে হইলে বিশেষরূপ আয়োজনের প্রয়োজন। এই ভাবিয়া বাঁশীরাম ও তাঁহার সমভিব্যাহারী সকলে সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন, প্রমদা একাকী বাড়ীর ভিতরেই রহিল। বাড়ীর বাহিরে পুলিস প্রহরীর পাহারা পড়িল। প্রমদার বাড়িতে অপরাপর সকলের যাতায়াত বন্ধ হইল, তাঁহারও, বাড়ীর ভিতর হইতে বহির্গত হওয়া এক প্রকার দায় হইয়া উঠিল। 

সেই দিবস হইতে বাঁশীরাম সেইস্থান হইতে নিরুদ্দেশ হইলেন। কিন্তু কোথায় যে গমন করিলেন, তাহা কেহই বলিতে পারিল না, বা কেহই জানিতে পারল না। তবে শ্যামাচরণ কিছু জানিতেন কি না, তাহা আমরা অবগত নহি। তিনি কিন্তু কাহাকেও কোন কথা বলেন নাই। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

সন্তোষপুর গ্রামে রামলোচন ঘোষের বাড়ী। রামলোচন ঘোষ যখন সঙ্গতিশালী ছিলেন, সেই সময়ে তিনি তাঁহার এই বাড়ী প্রস্তুত করেন। এখন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে বাড়ীরও দুরবস্থা ঘটিয়াছে, সমস্ত গৃহগুলিই এখন ভগ্ন অবস্থায় পরিণত হইয়াছে। 

যে দিবস নবকুমারের মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার প্রায় দ্বাবিংশ দিবস পরে রামলোচন ঘোষের একটি পুরাতন ও ভগ্ন গৃহের মধ্যে চারি পাঁচটি লোক উপবিষ্ট। তাহার মধ্যে এক ব্যক্তি অপর আর এক ব্যক্তিকে কহিলেন, “হরি! তুমি আমাকে যাহা যাহা বলিয়াছ, তাহা কি প্রকৃত? যদি উহার ভিতর কোন অপ্রকৃত কথা থাকে, তাহা হইলে এখনও আমাকে বল।” 

“যাহা যাহা বলিতেছি, তাহার সমস্ত কথাই প্রকৃত, বর্ণমাত্রও মিথ্যা নহে।” অপর ব্যক্তি এই উত্তর করিল। 

“প্রকৃত হউক বা অপ্রকৃত হউক, যাহা তুমি পূর্ব্বে আমার নিকট বলিয়াছ, তাহা আমি শ্রবণ করিয়াছি। কিন্তু আমি তোমাকে সবিশেষরূপে সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, মিথ্যা কথা কহিও না। যাহা প্রকৃত, তাহাই যদি তুমি বলিতে চাহ, ত বলিতে পার। আমি বাহিরে গমন করিতেছি, যাঁহারা এখানে উপস্থিত রহিলেন, তোমার কথা শুনিয়া তাঁহারা বেশ বুঝিতে পারিবেন যে, তুমি সত্য বলিতেছ, বা মিথ্যা বলিয়া সকলকে প্রতারিত করিতে বাসনা করিতেছ।” এই বলিয়া প্রথম ব্যক্তি বাহিরে গমন করিলেন। পাঠকগণ, আপনারা বুঝিতে পারিলেন কি, যিনি বাহিরে গমন করিলেন, তিনি কে? তিনি অপর আর কেহই নহেন—আপনাদিগের সুপরিচিত সেই বৃদ্ধ দারোগা বাঁশীরাম। 

বাঁশীরাম বাহিরে গমন করিল, আর এক ব্যক্তি কাগজ কলম গ্রহণ করিয়া হরিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?” 

উত্তর। আমার নাম শ্রীহরিমোহন ঘোষ, নিবাস এই গ্রামেই। 

প্রশ্ন। নবকুমারের হত্যাসম্বন্ধে তুমি আপন ইচ্ছায় আমার নিকট কিছু বলিতে চাহ? 

উত্তর। চাই। 

প্রশ্ন। কি বলিতে চাহ, বল। 

উত্তর। মহাশয়! আমার বাড়ী এই সন্তোষপুর গ্রামে। আমার পিতা এখনও জীবিত। যে নবকুমার মরিয়া গিয়াছেন, তাঁহাকে আমি উত্তমরূপে জানিতাম। তিনি আমাকে বিশেষ যত্ন করিতেন; সুতরাং, সর্ব্বদাই আমি তাঁহাদিগের বাড়িতে গমন করিতাম। নবকুমারের স্ত্রী প্রমদা আমাকে দেখিয়া লজ্জা করিতেন না, বা আমার সম্মুখে আসিতেও কোনরূপে সঙ্কুচিত হইতেন না। সকালেই বলুন, আর সন্ধ্যাকালেই বলুন, যখন সুবিধা পাইতাম, তখনই নবকুমারের বাড়ীতে গমন করিতাম। কিন্তু যখন গমন করিতাম, তখনই প্রায় নবকুমারকে বাড়ীতে উপস্থিত দেখিতে পাইতাম। প্রথম প্রথম তিনি পীড়িত ছিলেন; সুতরাং, বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক কোনস্থানে গমন করিতেন না। পরিশেষে যখন তাঁহার রোগ ক্রমে আরোগ্য হইয়া গেল, তখনও তিনি বাড়ি পরিত্যাগ পূর্ব্বক একেবারে কোনস্থানে গমন করিতেন না। কেবল সকাল ও সন্ধ্যার সময়ে পাড়ার ভিতরেই অল্প অল্প বেড়াইতেন। 

“মহাশয়! এই গরল বৃক্ষের বীজ যে দিবস বপিত হয়, সেই ভয়ঙ্কর পাপ দিবসের কথা বর্ণন করিতে আমার শরীর শিহরিয়া উঠিতেছে, বাক্য রুদ্ধ হইয়া যাইতেছে। একদিবস ঠিক সন্ধ্যার সময় আমি নবকুমারের বাড়ীতে গমন করিলাম। বাড়ীর প্রাঙ্গণে পদার্পণ করিয়া নবকুমারকে দেখিতে পাইলাম না; ডাকিয়াও কোন উত্তর পাইলাম না। সেই সময় প্রমদা তাহার ঘরের ভিতর কি কার্য্যে ব্যস্ত ছিল। আমার কথা শুনিয়া সে বাহিরে আসিয়া আমাকে বলিল, যে, “আমি এখনই আসিতেছি, একটু অপেক্ষা কর।” প্রমদার কথা শুনিয়া আমি সেই ঘরের দাওয়ার উপর গিয়া উপবেশন করিলাম। কিন্তু প্রমদা আমাকে তাহার ঘরের ভিতর গিয়া বসিতে কহিল। আমি ভাবিলাম, সন্ধ্যার সময় প্রমদা বুঝি দাওয়া প্রভৃতি পরিষ্কার করিবে বলিয়া, আমাকে ঘরের ভিতর গিয়া বসিতে বলিতেছে। এই ভাবিয়া আমি সেইস্থান হইতে উঠিলাম, উঠিয়া তাহার ঘরের ভিতরস্থিত একখানি তক্তাপোষের উপর গিয়া উপবেশন করিলাম। সেই সময় সন্ধ্যা কেবলমাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে, ঘরের ভিতর অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। আমি সেই অন্ধকারময় ঘরের ভিতর উপবেশন করিলে, প্রমদা একটি প্রজ্বলিত প্রদীপ লইয়া সেই ঘরের ভিতর যেমন প্রবেশ করিবার উপক্রম করিল, অমনি তাহার হস্তস্থিত প্রদীপ নির্ব্বাপিত হইয়া গেল। পবনদেবের অনুগ্রহে উহা নিবিয়া গেল, কি, প্রমদা ইচ্ছাপূর্ব্বক উহা নির্ব্বাপিত করিয়া দিল, তাহা কিন্তু আমি বুঝিতে পারিলাম না। সেই নির্ব্বাপিত প্রদীপ হস্তে লইয়া প্রমদা পুনরায় ঘরের বাহিরে গমন করিল, এবং দেখিতে দেখিতে উহা প্রজ্বলিত করিয়া পুনরায় সেই ঘরে প্রত্যাবর্তন করিল। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াই কহিল, “না,—পোড়া দেবতা কি আর আলো জ্বালিতে দিবে না?” এই বলিয়াই যেমন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, অমনি ভিতর হইতে সেই ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিল। সেই ঘরের ভিতর প্রদীপের সম্মুখে কেবল রহিল—প্রমদা এবং আমি। 

“যে প্রমদাকে আমি কখনও মন্দ দৃষ্টিতে দর্শন করি নাই, যাহার চরিত্র সম্বন্ধে আমার হৃদয়ে কোনরূপ সন্দেহ কখন উদিত হয় নাই, আজ সেই প্রমদার প্রমাদজনক কাণ্ডে আমার মস্তক ঘুরিয়া গেল। আমি তখন হিতাহিতজ্ঞান—বিবর্জ্জিত হইয়া, প্রমদার সেই বিসদৃশ ব্যাপারের অনুমোদন করিলাম। সঞ্চিত ধর্ম্মের মস্তকে পদাঘাত করিয়া, প্রমদার সেই প্রমোদসলিলে অবগাহন করিলাম। হায়! এই দিবস হইতেই আমি সমস্ত ভুলিয়া গেলাম, পিতার স্নেহ, মাতার মমতা, হৃদয় হইতে দূরীভূত হইতে লাগিল। নবকুমারের উপর পূর্ব্বে যেরূপভাবে ছিল, দিন দিন ক্রমে তাহার বিপরীতভাব উদিত হইতে লাগিল। সেইদিবস হইতে নবকুমারের অনুপস্থিতিই কেবল অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। প্রমদাকে সৰ্ব্বদা নয়নে নয়নে রাখিতে ইচ্ছা করিতে লাগিলাম। সেও আমার নিমিত্ত সর্ব্বদা পাগলের ন্যায় বেড়াইতে লাগিল। যদি কোন দিবস আমি তাহার বাড়ীতে না যাইতাম, বা কোনদিবস কার্য্যানুক্রমে বিলম্ব হইত, তাহা হইলে প্রমদা কোন না কোন ছল অবলম্বন করিয়া, আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইত, ও যেরূপে হউক, আমার সংবাদ লইয়া পরিশেষে আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিত। ক্রমে আমাদিগের উভয়ের মধ্যে এরূপ অবস্থা ঘটিয়া উঠিল যে, আমাদিগের গুপ্তপ্রণয় আর গুপ্ত রহিল না; এককান, দুইকান করিয়া ক্রমে সকলের কর্ণে গিয়া উপস্থিত হইল। ক্রমে নবকুমারেরও কর্ণে সেকথা গিয়া পৌঁছিল। তখন নবকুমার প্রত্যেক কথাতেই তাঁহার স্ত্রীর উপর সন্দেহ করিতে লাগিলেন, আমাকেও সেই সময় হইতে দুইচক্ষে দেখিতে পারিতেন না। ক্রমে আমাকে তাঁহার বাড়ীতে যাওয়াও বন্ধ করিয়া দিলেন। বাড়ীর গৃহিণী যাহার উপর সদয়, তাহার কি সেই বাড়ীতে গমন কখনও বন্ধ হইতে পারে? যে সময়ে নবকুমার বাড়ীর বাহিরে গমন করেন, প্রমদা ঠিক্ সেই সময়ে আমাকে সংবাদ পাঠাইয়া দেয়। অধিক রাত্রিতে নবকুমার যে সময়ে নিদ্রিত হইয়া পড়েন, আমিও ঠিক সেই সময়ে সংবাদ পাইয়া থাকি। এইরূপে সময় পাইলেই প্রমদা আমাকে তাহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করাইয়া লয়। এইরূপে আরও কিছুদিবস গত হইল। পাপের স্রোত ক্রমে ক্রমে আরও প্রবলরূপ ধারণ করিতে লাগিল। নবকুমার আমাদিগের এই প্রবল অত্যাচার আর কোনরূপেই সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি তখন রোগ মুক্ত হইয়া সবল হইয়া উঠিয়াছেন, সুতরাং আর তিনি সহ্য করিবেন কি প্রকারে? এখন কেবল প্রমদার উপরই তাঁহার বিশেষ দৃষ্টি রহিল। সময়ে অসময়ে অনির্দিষ্ট সময়ে তিনি হঠাৎ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে লাগিলেন, নিদ্রিত অবস্থাতেই মধ্যে মধ্যে জাগিয়া উঠিতে লাগিলেন। কখন বা নিদ্রিতের ভান করিয়া, প্রমদার কার্য্য-কলাপ স্বচক্ষে পৰ্যবেক্ষণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। দুই একদিবস আমাকে বাড়ীর ভিতর অসময়েও দেখিতে পাইলেন। একদিবস প্রমদার সহিত এক ঘরের ভিতর আমাকে প্রাপ্ত হইয়া, আমাকে হত্যা করিবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না। আমি এবং প্রমদা উভয়েই পলায়ন পূৰ্ব্বক আপন আপন জীবন রক্ষা করিলাম। ক্রমে একথাও রাষ্ট্রময় হইয়া পড়িল। গ্রামের অধিকাংশ লোকই নবকুমারের পক্ষ অবলম্বন করিয়া, যাহাতে আমাকে ধরিতে পারে, তাহার বিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিল। সেই সময়ে সুযোগমত একদিবস প্রমদার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল; সে তাহাকে লইয়া, এই গ্রাম পরিত্যাগ করিতে আমাকে পরামর্শ দিল। আমি কিন্তু সে পরামর্শ শুনিলাম না, বরং তাহাকে কহিলাম, ‘যখন গ্রামস্থ সমস্ত লোকই আমার বিপক্ষে, তখন তোমাকে বাহির করিয়া, আমি কয়দিবস কোথায় থাকিতে পারিব? শীঘ্রই আমি ধৃত হইব। প্রথমে যৎপরোনাস্তি অবমানিত ত হইতে হইবে, পরিশেষে শ্রীঘর পর্য্যন্তও দর্শন করিতে হইবে।’ আমার কথায় প্রমদা বুঝিল, এবং কহিল, ‘অন্য কোন উপায় অবলম্বন করা আবশ্যক। কোনরূপে নবকুমারের হস্ত হইতে পরিত্রাণ না পাইলে, আমাদিগের সুখভোগের আশা দেখিতে পাইতেছি না।’ আরও কহিল, যে, ভাবিয়া চিন্তিয়া প্রমদা যে কোন উপায় বাহির করিতে পারিবে, সুযোগমত সে তাহা আমাকে কহিবে, এবং সেইরূপভাবে কার্য সম্পন্ন হইবে। 

“এই পরামর্শের পর, ক্রমান্বয়ে সাত আট দিবস চেষ্টা করিয়াও, প্রমদার সহিত কথা কহিবার সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু দূর হইতে উভয়ে উভয়কেই প্রায় দেখিতে পাইতাম। আকার ইঙ্গিতে যথাসম্ভব দূর হইতেই কথাবাৰ্ত্তা হইত। 

“একদিবস স্থির হইল, ঠিক সন্ধ্যার সময় প্রমদার বাড়ীর নিকটবর্তী একটি জঙ্গলের ভিতর আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইবে। হঠাৎ শৌচাদির প্রয়োজন হইলে, প্রমদা সেই জঙ্গলের ভিতরই প্রায় গমন করিতেন। যাহা হউক, সন্ধ্যার পরই আমি সেই জঙ্গল আশ্রয় করিয়া বসিয়া রহিলাম, সময়মত প্রমদাও আসিয়া উপস্থিত হইল। সেও আমার নিকট সেই অন্ধকারময় জঙ্গলের ভিতর উপবেশন করিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

“সেই নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে উভয়ে কিয়ৎক্ষণ উপবেশন করিলে পর, প্রমদা নবকুমারের হস্ত হইতে উদ্ধার পাইবার যে উপায় বাহির করিয়াছে, তাহা আমাকে কহিল। স্নেহময়ী রমণীর হৃদয় হইতে যে এরূপ কথা বাহির হইতে পারে, তাহা শ্রবণ করা দূরে থাকুক, স্বপ্নেও কখন মনে করি নাই। প্রমদার কথা শুনিয়া আমার শরীর কণ্টকিত হইল, মস্তক ঘুরিয়া গেল; ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার জ্ঞানলোপ হইল। প্রমদা কহিল ‘হরি! আমি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিয়াছি, সেই পাপিষ্ঠকে কোনরূপে বিনষ্ট করিতে না পারিলে, আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবার আর কোন উপায় নাই। স্বামী অবর্তমান হইলে, আমি বিধবা হইব সত্য; কিন্তু আমার পক্ষে বিধবা হওয়াই মঙ্গল। যাহাকে আমি দুই চক্ষে দেখিতে পারি না, যাহাকে দেখিলে ক্রোধে আমার সর্ব্বাঙ্গ প্রজ্বলিত হয়, সেই স্বামীর জীবনের আকাঙ্ক্ষা কে করিয়া থাকে? বিশেষ তাহার অবর্তমানে আমাদিগের সুখের পথ পরিষ্কার হইবে, বিনাপ্রতিবন্ধকে তোমাকে লইয়া আমি পরমসুখে দিন অতিবাহিত করিতে পারিব। আজকাল সেই হতভাগ্যটা প্রায়ই সন্ধ্যার পর বাহিরে গমন করে। রাত্রিকালে যখন সে বাড়িতে প্রত্যাগমন করিবে, সেই সময়ে যদি তাহাকে হত্যা করা হয়, তাহা হইলে আমাদিগের সকল আশা পূর্ণ হইবে। বিশেষ রাত্রিকালে কে তাহাকে হত্যা করিল, তাহা স্থির করা সহজ হইবে না। অথচ কোন পুলিশ-কৰ্ম্মচারী বিশ্বাস করিবে না যে, হিন্দুরমণী তাহার স্বামীকে হত্যা করিয়াছে, বা হত্যার সহায়তা করিয়াছে। তোমার ত কথাই নাই, এ বিষয়ে তোমার উপর সন্দেহ কাহারই পড়িবে না। আমি সমস্ত যোগাড় ঠিক করিয়া দিব, তুমি আমাদিগের খিড়কী দরজার নিকট অপেক্ষা করিবে। যেমন তাহাকে দেখিতে পাইবে, অমনি পশ্চাৎ হইতে তাহাকে এমন এক সাংঘাতিক আঘাত করিবে, যাহাতে সে ইহজীবন পরিত্যাগ করে। আমি নিকটেই থাকিব, তোমার কোনরূপ ভয় করিবার প্রয়োজন নাই।” 

“প্রমদা আমাকে এইরূপ বলিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। গমন করিবার সময় ইহা সাব্যস্ত হইল যে, সেই রাত্রিতেই যখন নবকুমার আপনার আলয়াভিমুখে প্রত্যাগমন করিবেন, সেই সময়েই কার্য্য শেষ করিতে হইবে।”

“যে প্রেমিক, প্রণয়িনীর প্রণয়ে একবার মজিয়াছে, তাহার পক্ষে সেই প্রণয়িনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গমন করা যে কতদূর অসম্ভব, তাহা সকলে বুঝিতে পারিবেন না। যাঁহারা কখনও আমার মত ঠেকিয়াছেন, তাঁহারাই বুঝিতে পারিবেন, আমার কথা কতদূর সত্য। প্রমদার প্রস্তাবে আমার মন অগ্রগামী না হইলেও, আমি কিন্তু তাহার বিপরীত কোন কাৰ্য্যই করিতে পারিলাম না। ইচ্ছার বিপরীতেও কে যেন আমাকে টানিয়া নবকুমারের বাড়ীর খিড়কীতে লইয়া গেল; পুষ্করিণীর পার্শ্বে সেই অন্ধকারের ভিতর আমি বসিয়া রহিলাম। বসিয়া বসিয়া আমি কত কি যে ভাবিতে লাগিলাম, তাহা বলিতে পারি না। আমি আমার হিতাহিতজ্ঞান হারাইয়া, এক প্রকার পাগলের মতই হইয়া উঠিলাম। সেই সময়ে প্রমদা কোথা হইতে একখানি তীক্ষ্ণধার কুঠার আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল, ও নিজেও চুপ করিয়া, আমার নিকট উপবেশন করিল। কিয়ৎক্ষণ পরেই দেখিলাম, নবকুমার আসিতেছেন। তিনি যেমন আমাদিগকে অতিক্রম করিয়া গমন করিলেন, অমনি কুঠারহস্তে অগ্রসর হইয়া আমি তাহার পশ্চাতে গমন করিলাম; সবলে তাহার উপর এক আঘাত করিবার চেষ্টা করিলাম—কিন্তু তাহা পারিলাম না। হাত কাঁপিয়া যাওয়াতে সেই কুঠার সেইস্থানে পড়িয়া গেল, কুঠার-পতনের শব্দে নবকুমার ফিরিলেন। দেখিলেন, পশ্চাতে আমরা দুইজন। তিনি কিন্তু আমাদিগের দুরভিসন্ধি বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ না করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমরা কারা?’ সেই সময়ে আমার হিতাহিতজ্ঞান ছিল না, নবকুমারের কথার উত্তর আমার মুখ দিয়া হঠাৎ বহির্গত হইল। আমি কহিলাম, “আমি হরি।’ আমার নাম শুনিয়া নবকুমার ক্রোধে একেবারে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন, এবং আমাকে ধরিবার নিমিত্ত আমার দিকে অগ্রসর হইলেন। তিনি যেমন আমার নিকটবর্ত্তী হইবেন, সেই সময়ে পাপীয়সী আর থাকিতে পারিল না, সেই ভূপতিত কুঠার উঠাইয়া লইয়া পশ্চাৎ হইতেই, স্বহস্তে নবকুমারের মস্তকে সবলে এক আঘাত করিল। সেই আঘাত পাইবামাত্র রক্তাক্ত কলেবরে নবকুমার সেইস্থানে পতিত হইলে, আমি এ দৃশ্য আর দর্শন করিতে না পারিয়া, ঊর্দ্ধশ্বাসে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

“তখন এই গ্রামে ক্ষণকাল থাকিতেও আমার আর ইচ্ছা হইল না। বাটীতে গমন পূর্ব্বক দুই একখানি কাপড় ও কিছু অর্থ সংগ্রহ পূর্ব্বক প্রাণের ভয়ে সেই রাত্রিতেই গ্রাম পরিত্যাগ পূর্ব্বক গমন করিলাম। পরিশেষে বাঁশীরাম দারোগা কর্তৃক আমি ধৃত হইয়া এইস্থানে আনীত হইয়াছি। এই ঘটনার পর প্রমদার সহিত আর আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। সুতরাং তাহার পর যে আর কি অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি।” 

এই বলিয়া হরি চুপ করিল। 

প্রশ্ন। তুমি আমাকে যাহা কহিলে, তাহা কি প্ৰকৃত? 

উত্তর। আমি যাহা বলিয়াছি, তাহার একটি কথাও মিথ্যা নহে, সমস্তই প্ৰকৃত। 

প্রশ্ন। তুমি আমার নিকট যাহা কহিলে, তাহার মধ্যে যদি কোন অপ্রকৃত কথা থাকে, তাহা আমাকে বলিতে পার। কারণ আমি পুলিস-কৰ্ম্মচারী নহি, আমারই নিকট এই মোকদ্দমার প্রথম বিচার হইবে, আমি এই প্রদেশীয় ম্যাজিষ্ট্রেট।

উত্তর। আপনি ম্যাজিষ্ট্রেট হউন বা যেই হউন, আমি যাহা বলিয়াছি, তাহার সমস্তই প্রকৃত। ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা হইবার হইবে, আমি কোনরূপেই মিথ্যা কথা কহিব না। 

এই সময়ে বাঁশীরাম সেই ঘরের ভিতর পুনরায় প্রবেশ করিলেন। এবার তিনি একাকী নহেন, তাঁহার সহিত সেই পাপীয়সী প্রমদা। তিনি সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া বিচারকের দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন “মহাশয়! হরি যাহা যাহা বলিয়াছে, প্রমদা তাহার সমস্তই অন্তরাল হইতে শ্রবণ করিয়াছে। যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে ইহাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন, এ কি বলে।” 

বিচারক। (প্রমদার প্রতি) হরি তোমার বিপক্ষে যাহা যাহা বলিয়াছে, তাহা সমস্তই তুমি শ্রবণ করিয়াছ। এখন তুমি কি বলিতে চাই? 

প্রমদা। হরি যাহা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই মিথ্যা; আমি ইহাকে চিনি না, আমি ইহার কিছুই অবগত নহি। আপনারা কি বিশ্বাস করেন যে, বাঙ্গালী রমণী তাহার স্বামীকে স্বহস্তে হত্যা করিয়াছে? এ অসম্ভব কথা, এ কখনই হইতে পারে না। আমি আমার স্বামীকে হত্যা করিব কেন? 

এই কথা শ্রবণ করিয়া বিচারক প্রমদাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, তাহাকে আসামী শ্রেণীতে দাঁড় করাইয়া দিলেন। সেইস্থানেই মোকদ্দমার প্রথম বিচার আরম্ভ হইল। 

এই ঘটনার কিছুদিবস পূর্ব্বে বিচারক আপনার বিচারের স্থান পরিত্যাগ করিয়া গ্রামে গ্রামে “সারকুটে’ বেড়াইতেছিলেন। এই মোকদ্দমার বিচার করিতে হইবে জানিতে পারিয়া, তিনি “সরেজমিনে” আগমন করিয়া বিচার আরম্ভ করেন। কিন্তু গ্রামে তাম্বু ফেলিবার উত্তমস্থান প্রাপ্ত না হওয়ায়, রামলোচন ঘোষের বাড়ীতেই তিনি কাছারি আরম্ভ করেন। 

ক্রমাগত সাতদিবস কাল বিচারক সেইস্থানে বসিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এক এক করিয়া অনেক সাক্ষীর জবানবন্দী লইয়া স্থির করিলেন, প্রমদাই তাহার স্বামীকে হত্যা করিয়াছে। সুতরাং স্বামী-হত্যা—অপরাধে প্রমদা আসামী হইল। পরিশেষে চূড়ান্ত বিচারের নিমিত্ত এই মোকদ্দমা উচ্চ আদালতের হস্তে অর্পিত হইল। যে হরি এই নারকীকাণ্ডে প্রমদাকে সাহায্য করিয়াছিল, সে প্রকৃত কথা বলিতেছে, বিবেচনায় তাহাকে এই মোকদ্দমায় সাক্ষী করা হইল। যে স্বচক্ষে সমস্ত অবস্থা দর্শন করিয়াছে, সে সহস্রগুণে পাপী হইলেও, প্রমদা তাহার অপেক্ষা আরও পাপী; সুতরাং বিচারে প্রমদার দণ্ড বাঞ্ছনীয়, অথচ হরির সাক্ষ্য ভিন্ন প্রমদার দণ্ড হওয়া সুকঠিন বিবেচনায়, বিচারক বাঁশীরামের পরামর্শ-মত হরিকে আসামী শ্রেণী হইতে এ যাত্রা পরিত্রাণ দিলেন। 

দায়রায় জুরির বিচারে প্রমদার বিচার আরম্ভ হইল। নিম্ন-আদালতে যে সকল সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হইয়াছিল, এখানেও পুনরায় সেই সকল সাক্ষীর জবানবন্দী গৃহীত হইল। নিম্ন আদালতে যে যেরূপ বলিয়াছিল, সকলেই সেইরূপ কহিল। কিন্তু পাপিষ্ঠ হরির অন্তঃকরণে অতঃপর দয়ার বা প্রেমের উদয় হইল। সে যাহাতে প্রমদাকে বাঁচাইতে পারে, পরিশেষে তাহারই উপায় দেখিতে লাগিল। প্রমদার বিপক্ষে সে যাহা যাহা পূৰ্ব্বে বলিয়াছিল, এখনও তাহাই কহিল। কিন্তু কাহার আঘাতে যে নবকুমার হত হইয়াছেন, তাহা কিন্তু বলিল না। বরং কহিল, “আমাকে অস্ত্র দিয়া প্রমদা সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছিল, আমার হস্ত হইতে অস্ত্র পড়িয়া যাইবার পর, আমি আপন চৈতন্য হারাইয়াছিলাম; সুতরাং বলিতে পারি না, কাহার দ্বারা নবকুমার হত হইয়াছেন। প্রমদা কিন্তু সেই সময়ে সেইস্থানে উপস্থিত ছিল না।” 

প্রণয়ের গভীর সমুদ্রে পড়িয়া, পরিশেষে হরি যদিও প্রমদাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিল, পূর্ব্ব সাক্ষ্যের পরিবর্তন করিয়া, মিথ্যা কথা সাজাইয়া যদিও সে বলিল যে, সে প্রকৃত হত্যাকারীকে স্বচক্ষে দর্শন করিতে পারে নাই; কিন্তু জুরিগণ বা বিচারক কেহই তাহার শেষ কথা বিশ্বাস করিলেন না। নিম্ন আদালতে সে যাহা বলিয়াছিল, তাহাই বিশ্বাস করিয়া জুরিগণ প্রমদাকে দোষী সাব্যস্ত করিলেন। বিচারকও সেই মতের অনুমোদন করিয়া প্রমদাকে চরমদণ্ডে দণ্ডিত করিলেন। 

নিম্ন আদালতের বিচারক ও পুলিস-কৰ্ম্মচারী হরিকে সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত করিয়া, এই হত্যা-অপরাধ হইতে তাহাকে অব্যাহতি দিয়াছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের বিচারে হরি নিষ্কৃতি পাইল না, উচ্চ আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে তাহার নামে মোকদ্দমা রুজু করিতে, সেই উচ্চ আদালতের বিচারক আদেশ প্রদান করিলেন। এই মোকদ্দমারও বিচার হইল উচ্চ আদালতে। হরি কিন্তু এই মোকদ্দমায় নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারিল না। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণ অপরাধেই কঠিন পরিশ্রমের সহিত সাত বৎসরের নিমিত্ত তাহাকে জেলে গমন করিতে হইল। প্রেমিক প্রেমিকার কি আশ্চর্য্য পরিণাম!! ধর্ম্মের কি অদৃশ্য সূক্ষ্ম বিচার!!! 

[জ্যৈষ্ঠ, ১৩০১] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *