বলিহারি বুদ্ধি! (কোন গুপ্তহত্যার গূঢ় রহস্যভেদ ও চোরের স্ত্রীর অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব)

বলিহারি বুদ্ধি! (কোন গুপ্তহত্যার গূঢ় রহস্যভেদ ও চোরের স্ত্রীর অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

১৯শে আষাঢ় রবিবার প্রাতঃকালে ছয়টার সময় বাড়ী হইতে কেবলমাত্র থানায় আসিয়া পদার্পণ করিয়াছি, এমন সময়ে আফিসের ভিতর হইতে টুং টুং টুং টুং করিয়া জোরে ইলেকট্রিক বেলের শব্দ হইতে লাগিল। আফিসের ভিতর এককোণে, দেওয়ালের গায়ে, টেলিফোন সংযুক্ত আছে, উহার সংলগ্ন ঘন্টা বা বেলই টুং টুং শব্দ করিয়া আগমনোন্মুখ সংবাদের পূর্ব্ব সংবাদ প্রদান করিয়া থাকে। উক্ত বেলের শব্দ কর্ণে প্রবেশ করিলে, আর স্থির থাকিতে পারিলাম না; দ্রুতপদে আফিসের ভিতর গমন করিয়া, টেলিফোনের চোঙ্গা কাণে লাগাইলাম। দূর হইতে কে আমার কাণে কাণে বলিয়া দিল,–“গড়ের মাঠে একটি লাস পাওয়া গিয়াছে, তাহার মস্তকে সাংঘাতিক আঘাতের চিহ্ন আছে। অনুসন্ধানের নিমিত্ত তুমি শীঘ্র সেইস্থানে গমন কর। এ আদেশ তোমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর।” 

আদেশের বশীভূত আমরা, আদেশের নাম শুনিয়া আর কালবিলম্ব করিতে সমর্থ হইলাম না। যেরূপ অবস্থাতেই ছিলাম, সেইরূপ অবস্থাতেই ময়দানের অভিমুখে গমন করিলাম। লালবাজারের চৌরাস্তায় দেখিলাম, একখানি ট্রামগাড়ি ধৰ্ম্মতলাভিমুখে গমন করিতেছে। উহাতে আরোহণ করিয়া ধর্ম্মতলায় গিয়া অবতরণ করিলাম, এবং পদব্রজে উক্ত ময়দানের ভিতর প্রবেশ করিলাম 

চলিতে চলিতে ক্রমে কেল্লার নিকটে গিয়া উপনীত হইলাম। দেখিলাম, কেল্লার দক্ষিণ পূর্ব্ব অংশে, ময়দানের ভিতরস্থিত একটি পুষ্করিণীর ধারে কতকগুলি লোকের জনতা হইয়াছে। তাহার ভিতর হইতে দুই একটি লাল-পাগড়িও দৃষ্টিগোচর হইল। ভাবিলাম, সেইস্থানেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। সেই জনতা লক্ষ্য করিয়া ক্রমে সেইদিকে গমন করিলাম, পরিশেষে তাহার ভিতর গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

দেখিলাম, একজন পুরুষের মৃতদেহ সেইস্থানে পতিত। অনুমানে উহার বয়ঃক্রম চল্লিশ বা বিয়াল্লিশ বৎসর বোধ হইল। উহার পরিধেয় একখানি কালাপেড়ে পুরাতন অথচ পরিষ্কার ধুতি। অঙ্গে, পিরানের ধরণে নির্ম্মিত একটি সাদা কামিজ। উহাতে রূপার বোতাম লাগান আছে, একটিও খুলিয়া পড়িয়া যায় নাই, বা কেহই অপহরণ করে নাই। ‘কপের’ সংলগ্ন বোতামগুলিও রূপার, তাহাও বৰ্ত্তমান। একখানি কোঁচান চাদর গলায়। একগাছি সরু বেতের বাঘমুখো ছড়ি সেইস্থানে পড়িয়া আছে, বার্ণিস করা জুতার একখানি বামপদে সংলগ্ন, অপরখানি ভূতলে পতিত। মৃতব্যক্তির আকৃতি প্রকৃতি ও পোষাক-পরিচ্ছদাদি দেখিলে বোধ হয়, তিন বঙ্গদেশবাসী, কোন মধ্যবিত্ত লোক ছিলেন। ইহার মস্তকে আঘাতের বিষম চিহ্ন বর্ত্তমান। রক্তে বস্ত্রাদি প্রায় রঞ্জিত, এবং যে স্থানে তাঁহার মস্তক রহিয়াছে, সেই স্থানের মৃত্তিকাও রক্তে ভিজিয়া গিয়াচে। উঁহার পরিহিত কামিজ প্রভৃতি অল্পদূর হইতে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম; দেখিলাম, ঐ কামিজের দক্ষিণপার্শ্বে একটি পকেট আছে, ও বুকের উপর বামপার্শ্বে ঘড়ী রাখিবার উপযোগী আর একটি ছোট পকেট আছে। উভয় পকেটই উল্টান অবস্থায় রহিয়াছে, অর্থাৎ পকেটের ভিতরস্থিত কাপড়ের যে অংশটুকু ভিতরেই থাকা উচিত, তাহা যেন ভিতর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া আনা হইয়াছে। পকেট দুইটির ভিতর দেখিলাম, কোন দ্রব্য নাই। 

আঘাতের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, কোনরূপ গুরুষ্টির দ্বারা পশ্চাদ্দিক হইতে উহার মস্তকে আঘাত করা হইয়াছে, ও সেই আঘাতেই তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আর বোধ হয়, সেই আঘাতই তাঁহার মৃত্যুর কারণ। 

কোনস্থানে অপরিচিত মৃতদেহ পাওয়া গেলে যেরূপ আমাদিগের নিয়ম আছে, প্রথমে সেইরূপ অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। যাহারা সেইস্থানে উপস্থিত, ছিল, যাহারা ময়দান বা নিকটবর্তী স্থানে গমন করিতেছিল, তাহাদিগের প্রায় প্রত্যেককেই সেই মৃতদেহ দেখান হইতে লাগিল। কিন্তু উহা যে কাহার দেহ, কেহই বলিতে পারিল না। সুতরাং লাস সনাক্ত না হওয়ার পূর্ব্বেই দিবা প্রায় বারটার সময় উহা ডেডহাউসে প্রেরিত হইল। সেইস্থানে ডাক্তারের দ্বারা পরীক্ষা হইবে, উহার মৃত্যু কিরূপে হইয়াছে? 

ময়দান হইতে লাস স্থানান্তরিত হইলে, একজন দুইজন করিয়া ক্রমে দর্শকমণ্ডলী সেইস্থান পরিত্যাগ করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে অনেকেই চলিয়া গেল; কেবল দুই দশ নিষ্কর্ম্মা লোক, যে পৰ্য্যন্ত আমরা সেইস্থানে থাকিলাম, সেই পৰ্য্যন্ত সেইস্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বিরক্ত হইয়া ক্রমে তাহারা সেইস্থানে বসিল, তথাপি সেই স্থান পরিত্যাগ করিল না। 

ময়দানের যে স্থানে লাস পাওয়া গিয়াছিল সেইস্থান, এবং তাহার চতুষ্পার্শ্ববর্তী স্থান সকল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু আমাদিগের আবশ্যকোপযোগী কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইলাম না। ময়দানের ভিতর কোন অনির্দিষ্ট দ্রব্য আমাদিগকে অনুসন্ধান করিতে দেখিয়া, সেই অবশিষ্ট দর্শকমণ্ডলী ও আমাদিগের দেখাদেখি সেই ময়দানের স্থানে স্থানে অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। যে স্থানে লাস পাওয়া গিয়াছিল, ক্রমে উহারা সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া, ময়দানের ভিতর অনেক দূর পর্যন্ত দেখিতে লাগিল। আমরাও ঘুরিয়া ফিরিয়া চতুর্দিক দেখিতে লাগিলাম। যখন আমরা এইরূপ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, সেই সময় একজন আমার নিকট আগমন করিয়া কহিল, “মহাশয়! ঐ স্থানে রক্তমাখা কি পড়িয়া রহিয়াছে!” 

আমি। রক্তমাখা কি পড়িয়া আছে? 

দর্শক। কি যে পড়িয়া আছে, তাহা আমি দেখি নাই। অন্য আর এক ব্যক্তি উহা দেখিয়া আমাকে আপনার নিকট সংবাদ প্রদান করিতে পাঠাইয়া দিয়াছে। 

উহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, তাহার নির্দ্দেশ-মত যে স্থানে রক্তমাখা কোন দ্রব্য পড়িয়া আছে, সেই স্থানাভিমুখে দ্রুতপদে চলিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

ময়দানের পূর্ব্বদিক হইতে যে পথ কেল্লার ভিতর গমন করিয়াছে, সেই পথ অনুসরণ করিলাম। ময়দান ছাড়িয়া কেল্লার ভিতর গমনকারী সেই ক্রমনিম্ন-বৎ পথের ভিতর প্রবেশ করিলাম। উহার ভিতর আনুমানিক শতহস্ত প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইলাম, একস্থানে দুই তিন জন লোক দাঁড়াইয়া কি দেখিতেছে। আমিও সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম যে, সেইস্থানে একখানি কাগজ পড়িয়া আছে, কাগজের স্থানে স্থানে অল্প অল্প রক্তের দাগও লাগিয়া আছে। রক্তাক্তহস্তে কোন কাগজ নাড়িলে তাহাতে যেরূপ রাগ হয়, ইহাতেও সেইরূপ দাগ লাগিয়ছে। সেই কাগজখানি আমি উঠাইয়া লইলাম। দেখিলাম, উহা ডাকের মোহর-সংযুক্ত একখানি বাঙ্গালা পত্র; দেখিলে অনেক দিবসের পুরাতন বলিয়া বোধ হয়। পত্রখানি পাঠ করিয়া এইমাত্র অবগত হইলাম যে, সেই পত্র “কাশীধাম, বাঙ্গালীটোলা হইতে তারামণি দাসী, ১৩ নং ভাদুড়ীর লেনস্থিত ধরণীধর মিত্রকে লিখিতেছেন! উহাতে লেখিকা ধরণীধরকে অনুরোধ করিতেছেন যে, তাঁহার পিতাকে বলিয়া তাঁহার খরচের টাকা শীঘ্র পাঠাইয়া দিতে যেন চেষ্টা করেন। কারণ, তখন খরচ অভাবে তাঁহার বিলক্ষণ কষ্ট হইতেছিল। 

পত্রের ভাবার্থ অবগত হইয়া, কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। এই পত্রের সহিত আমাদিগের অনুসন্ধানের কোনরূপ সংস্রব আছে, কি না? তাহাও ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। যে স্থানে সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার নিকটবর্তী কোনস্থানে যদি সেই পত্র পাওয়া যাইত, তাহা হইলেও ভাবিতে পারিতাম যে, এই পত্র বোধ হয়, সেই মৃতব্যক্তির নিকটেই ছিল। কিন্তু এই পত্র যতদূরে এবং যে স্থানে পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে সেই প্রকার অনুমান কোনরূপেই করিতে পারিলাম না। ক্রমে ক্রমে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল সত্য; কিন্তু সেই পত্র একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। পত্রোল্লিখিত স্থানে গিয়া একটু অনুসন্ধান করাই স্থির করিলাম। 

মৃতদেহ দেখিয়া অনুসন্ধান করিবার পূর্ব্বেই অবস্থানুরূপ অনেকগুলি চিন্তা আসিয়া প্রথমেই আমার মনে উদয় হয়। এরূপ চিন্তা অপর কোন ব্যক্তির হৃদয়ে আবির্ভূত হয় কি না, জানি না। কিন্তু বোধ হয়, সময়ে সকলকেই সেইরূপ চিন্তার প্রবল পরাক্রম সহ্য করিতে হয়। এই মৃতদেহ সম্বন্ধে আমার মনে যে কয়েকটি চিন্তার উদয় হইয়াছিল, তাহার সংক্ষিপ্ত মৰ্ম্মবোধ হয়, পাঠকগণের জানা আবশ্যক। তাহা হইলে এ বিষয়ে হয়ত নিজে বুদ্ধিচালনা করিতে পারিবেন। 

আমার প্রথম চিন্তা: –এই মৃতদেহ কাহার? এবং তাহা কি প্রকারেই বা অবগত হইতে পারিব? 

দ্বিতীয় চিন্তা-–এ মৃতদেহ যাহারই হউক, কে ইহাকে হত্যা করিল? এবং হত্যা করিবার কারণই বা কি? 

তৃতীয় চিন্তা—যে স্থানে এই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেইস্থান গমনাগমনের পথ নহে। জীবিতাবস্থায় সহসা মৃতব্যক্তির এই স্থানে আগমনের কোন কারণই দেখা যাইতেছে না। সন্ধ্যার সময় বায়ু-সেবন করিতে করিতে যদি তিনি এইস্থানে আসিতেন, ও যে কোন কারণেই হউক, এইস্থানে হত হইতেন, তাহা হইলে সন্ধ্যার পরই এই মৃতদেহ কাহারও না কাহারও দৃষ্টিগোচর হইত। ইহা ব্যতীত রাত্রি প্রায় দশটা পর্য্যন্ত বৃষ্টি হইয়াছে। বৃষ্টির অগ্নে যদি ইনি হত হইতেন, তাহা হইলে ইঁহার পরিধেয় বসন প্রভৃতি এরূপ অবস্থায় পাওয়া যাইত না। নিশ্চয়ই উহা আর্দ্র থাকিত, এবং রক্তের অধিকাংশই ধুইয়া যাইত। 

চতুর্থ চিন্তা—ইনি এইস্থানে হত হইয়াছেন, কি অন্য কোনস্থানে ইঁহাকে হত্যা করিয়া, কেহ এইস্থানে আনিয়া ফেলিয়া দিয়াছে? 

পঞ্চম চিন্তা—অপর কোনস্থানে যদি ইনি হত হইতেন, তাহা হইলে যে স্থানে লাস পাওয়া গিয়াছে, সেই স্থানের মৃত্তিকার উপর এরূপ পরিমাণে রক্ত পড়িবার সম্ভাবনা আছে কি না? 

ষষ্ঠ চিন্তা–হত্যার কারণ কি? যদি কাহারও সহিত মনোবিবাদ-সূত্রে এই হত্যা সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে বিপক্ষ-পক্ষীয় লোকের সহিত উক্ত মৃতব্যক্তির সহর ছাড়িয়া এই বিরল জন-সমাগম স্থানে জন-মাত্রও নিজ পক্ষীয় লোককে সঙ্গে না করিয়া আগমন করা সম্ভব, কি অসম্ভব? 

সপ্তম চিন্তা–চুরির অভিপ্রায়ই যদি এই হত্যার কারণ হয়, তাহা হইলে ইঁহার রূপার বোতামগুলি একটিও স্থানান্তরিত হইল না কেন? 

অষ্টম চিন্তা—কথিত পত্র যদি ইঁহারই হয়, তাহা হইলে ততদূরে সেই পত্র কে লইয়া গেল? হত্যাকারী কর্তৃক ই যদি সেই পত্র স্থানান্তরিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে কেল্লা প্রবেশের পথেই বা উহা কি প্রকারে যাইবে? আর যদি অনুসন্ধানে জানিতে পারা যায় যে, সেই পত্র মৃতব্যক্তিরই তাহা হইলে হত্যাকারী কি কেল্লায় প্রবেশ করিয়াছে? কিন্তু রাত্রি দশটার পর কেল্লার ভিতর অপর কোন ব্যক্তির প্রবেশের অধিকার নাই; তবে কি হত্যাকারী পল্টনের কোন দেশীয় সিপাই বা কোন ইংরাজ সৈন্য? যদি তাহা হয়, তাহা হইলে উহার এ হত্যার উদ্দেশ্য কি? 

নবম চিন্তা—ইঁহার কামিজের পকেট দুইটি উল্টান কেন? তবে কি উহা হইতে কোন দ্রব্য বাহির করিয়া লওয়া হইয়াছে? চুরিই কি তবে এই হত্যার প্রধান উদ্দেশ্য? 

এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে আমি ময়দান হইতে ক্রমে চৌরঙ্গি পথ-অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

চৌরঙ্গি রাস্তায় গমন করিয়া সেইস্থানে একটু দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময়ে দেখিলাম যে, একখানি ঘোড়ার গাড়ি ভবানীপুর-অভিমুখ হইতে আসিতেছে। উহাতে আরোহী নাই, উহা খালি। এই গাড়ি ভাড়া করিয়া চলিলাম—সেই ভাদুড়ীর যেন অভিমুখে; ১৩ নম্বরের বাড়ীও পাইলাম। অনুসন্ধানে অবগত হইলাম, এ বাড়ীতে কিশোরীলাল মিত্র বাস করেন। ধরণীধর তাঁহারই পুত্র, এবং তারামণি তাঁহারই কন্যা। গত দুই তিন বৎসর হইতে তাঁহার উক্ত বিধবা কন্যা কাশীবাসিনী হইয়াছেন। কিশোরীলালকে সেই পত্র দেখাইলাম। তিনি সেই পত্র দেখিয়া কহিলেন, এই পত্র তাঁহারই কন্যা, তাঁহার পুত্রকে লিখিয়াছেন। ধরণীধরের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু তাঁহাকে বাড়ীতে পাইলাম না। বৃদ্ধ কিশোরীলাল কহিলেন, আজ দুইদিবস হইল, ধরণীধর তাঁহার শ্বশুরালয়ে গমন করিয়াছেন। তাঁহার শ্বশুরালয় –দর্জ্জিপাড়ায়। 

বৃদ্ধের কথা শ্রবণ করিয়া, আমার মনে একটু আশা হইল। ভাবিলাম, বোধ হয়, লাস সনাক্ত হইতে আর বিলম্ব হইবে না। এই ভাবিয়া আমার মনের কথা তাঁহাকে বলিতে সাহসী হইলাম। তখন বৃদ্ধকে কহিলাম, “মহাশয় গড়ের মাঠে একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু কেহই বলিতে পারিতেছে না যে, সেই মৃতদেহ কাহার। যে পত্র আপনাকে দেখাইলাম, তাহাও সেই ময়দানে পড়িয়াছিল। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক একবার আমার সহিত গমন করিয়া সেই মৃতদেহ দর্শন করেন, তাহা হইলে বোধ হয়, আপনি চিনিলেও চিনিতে পারিবেন যে, এ মৃতদেহ আপনার পুত্র ধরণীধরের কোন বন্ধুবান্ধবের কি না।” 

বলিতে কি, বৃদ্ধের কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে মনে বেশ বিশ্বাস হইয়াছিল, সেই মৃতদেহ ধরণীধরের দেহ ব্যতীত আর কাহারও দেহ নহে। কিন্তু তাহার বৃদ্ধ পিতার নিকট আমি তাহা বলিতে পারিলাম না। কাজেই আমাকে বলিতে হইল, উহা ধরণীধরের কোন বন্ধুবান্ধবের মৃতদেহ। বস্তুতঃ বৃদ্ধ আমার কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনের ভাব বুঝিলেন; কিন্তু আমার কথার উত্তর প্রদানে হঠাৎ তিনি সমর্থ হইলেন না। দেখিলাম যে, তাঁহার চক্ষু দিয়া হঠাৎ জলধারা বহির্গত হইল; অতি কষ্টে তিনি তাঁহার চক্ষুজল সম্বরণ করিয়া তাঁহার ভৃত্যগণকে ডাকিলেন। ডাকিবামাত্র গগন তাঁহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তিনি গগনকে কহিলেন, “এই বাবুর সহিত এখনই গমন কর। উনি তোমাকে যাহা দেখিতে দেন, তাহা দেখ, এবং শীঘ্র আসিয়া আমাকে সংবাদ প্রদান কর। যদি ইঁহারা কেহ তোমার সহিত না আসেন, তাহা হইলে একখানি গাড়ি করিয়া, শীঘ্র এখানে আগমন করিবে। আমি তোমার প্রত্যাশায় এইস্থানেই বসিয়া রহিলাম।” 

গগন, ভাল মন্দ কিছুই অবগত নহে, প্রভুর আদেশ পাইবামাত্র সে আসিয়া আমার গাড়িতে উঠিল। আমিও আর কোন কথা না বলিয়া, কোচমানকে গাড়ি হাঁকাইতে কহিলাম। সে দ্রুতবেগে গাড়ি লইয়া ডেডহাউসে উপনীত হইল। গগনকে এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত কিছুই বলি নাই। সেই মৃতদেহ দেখাইয়া দিয়া কহিলাম, “দেখ দেখি, এই মৃতদেহ তুমি চিনিতে পার কি না?” 

গগন বেশ করিয়া উহাকে দেখিয়া পরিশেষে কহিল, “না মহাশয়! আমি উঁহাকে যে আর কখন দেখিয়াছি, তাহা আমার বোধ হইতেছে না।” 

আমি। বেশ ভাল করিয়া দেখ দেখি, ইহা তোমার ধরণীবাবুর দেহ কি না? 

গগন। ধরণীবাবুর দেহ? না মহাশয়! ইনি ধরণীবাবু হইবেন কেন? এ ধরণীবাবুর দেহ নহে। 

আমি। তুমি বেশ চিনিতে পারিতেছ যে, ইহা ধরণীবাবুর দেহ নহে? 

গগন। হাঁ মহাশয়! বেশ চিনিতে পারিতেছি। যাঁহাকে বিশ বৎসরকাল ক্ৰমাগত দেখিতেছি, তাহার দেহ দেখিলে, আমি আর চিনিতে পারিব না? 

আমি। আচ্ছা, যদি ইহা ধরণীবাবুর মৃতদেহ না হয়, তাহা হইলে দেখ দেখি, ধরণীবাবুর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কোন ব্যক্তির এ দেহ কি না? 

গগন। না মহাশয়! আমি যতদূর বুঝিতে পারিতেছি, তাহাতে আমার বোধ হয় না যে, পূর্ব্বে আমি ইহাকে আর কখন দেখিয়াছি। 

আমি। তুমি ধরণীবাবুর শ্বশুরবাড়ি চেন কি? 

গগন। চিনি বই কি, কত শতবার আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছি। 

আমি। তুমি একবার আমার সহিত আগমন করিয়া, তোমার বাবুর শ্বশুরবাড়ি আমাকে দেখাইয়া দাও। 

গগন। চলুন, এখনই আমি আপনাকে সেইস্থানে লইয়া যাইতেছি। কিন্তু মহাশয় আমাকে শীঘ্র ছাড়িয়া দিবেন, কারণ, আমার প্রভুর আদেশ ত আপনি স্বকর্ণেই শুনিয়াছেন। 

আমি। আমিও তোমাকে বিলম্ব করিতে পরামর্শ দেই না। তুমি সেই বাড়িটি আমাকে দেখাইয়া দিয়া, শীঘ্র তোমার প্রভুর নিকট গমন কর। 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া গগন তখনই আমার গাড়িতে পুনরায় আরোহণ করিল, এবং দর্জিপাড়ায় লইয়া গিয়া ধরণীধরের শ্বশুরবাড়ি আমাকে দেখাইয়া দিল। আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া বৈঠকখানার ভিতর প্রবেশ করিলাম। গগনও আমার সঙ্গে সঙ্গে চলিল। বৈঠকখানার ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই দেখিলাম, সম্মুখেই একটি বাবু বসিয়া আছেন। তাঁহাকে দেখাইয়া দিয়া গগন কহিল, “মহাশয়! এই ধরণীবাবু বসিয়া আছেন। যাহা জিজ্ঞাসা করিতে হয় করিতে পারেন। আমি এখন প্রস্থান করিলাম।” আমাকে এই কথা বলিয়া এবং যে নিমিত্ত গগন আমার সহিত আগমন করিয়াছিল, তাহা সংক্ষেপে ধরণীধরকে বলিয়া, সে তখনই সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। 

আমি ধরণীধরের নিকট উপবেশন করিলাম, তাহাকেও সমস্ত কথা বলিলাম। তাহার যে পত্র আমার নিকট ছিল তাহাও তাহাকে দেখাইলাম। সেই পত্র যে কিরূপে ময়দানে গিয়াছিল, তাহা ধরণীধর বলিতে সমর্থ হইল না। কিরূপেই বা উহাতে রক্তের দাগের মত লাল দাগ লাগিয়াছে, তাহাও ধরণীধর বলিতে পারিল না। পরিশেষে আমি তাহাকেও সঙ্গে করিয়া ডেড্‌হাউসে লইয়া গেলাম, এবং সেই মৃতদেহ দেখিতে কহিলাম। সেই মৃতদেহ দেখিয়া ধরণীধরও কহিল, আমি ইহাকে পূৰ্ব্বে যে কখন দেখিয়াছি, তাহা আমার বোধ হয় না।” যাহা হউক, পরিশেষে ধরণীধরও আমাকে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিল। আমি অতঃপর কোন পন্থা অবলম্বন করিব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। 

এখানে আর একটি চিত্তা আমার মনে হঠাৎ আসিয়া উদয় হইল। এই চিন্তার বিষয় কতদূর সম্ভব কি অসম্ভব, তাহা জানি না। কিন্তু যখন নূতন কথা মনে উদয় হইল, তখন পাঠকগণকে বোধ হয়, তাহা বলিয়া দেওয়া আমার কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম। সে চিন্তা এই,—“এই দেহ ধরণীধরের দেহ বলিয়াই পূর্ব্বে আমি স্থির করিয়াছিলাম। কিন্তু পরিশেষে জানিলাম, আমার সেই অনুসন্ধান ভ্রমাত্মক। ধরণীধরের সেই পত্র কিরূপে ময়দানে গমন করিল, সে সম্বন্ধে ধরণীধর আমাকে সন্তোষজনকরূপে বুঝাইতে সমর্থ হইলেন না। অথচ বৃষ্টির পূর্ব্বে অর্থাৎ রাত্রি দশটার পূৰ্ব্বে সেই পত্ৰ সেইস্থানে পতিত হইল, নিশ্চয়ই উহা বৃষ্টির জলে আর্দ্র অবস্থায় পাওয়া যাইত। তবে কি ধরণীধর বৃষ্টির পর সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন? কিন্তু একথা ত তিনি স্বীকার করেন না। যদি ধরণীধর রাত্রিকালে সেই ময়দানের ভিতর গমন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে কেনই বা ভাবিব না যে, এই হত্যা ধরণীধর দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে? যাহা হউক, যে পৰ্য্যন্ত লাস সনাক্ত না হয়, সেই পর্য্যন্ত ধরণীধরের বিপক্ষে সে সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা বৃথা।” এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে আপনার বাসা-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। তখন বেলা প্রায় অপরাহ্ চারিটা। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

অপরাহ্ণ চারিটার সময় বাসায় গিয়া আহারাদি করিতে প্রায় একঘন্টা কাল অতিবাহিত হইল। পাঁচটার সময় পুনরায় বহির্গত হইলাম। এবার ময়দানে গমন না করিয়া, যে স্থানে সেই মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, সেই ডেড্‌হাউসে গিয়া উপনীত হইলাম। আমার বাসা হইতে এইস্থান বহুদূরে নহে, প্রায় এক মাইলমাত্র ব্যবধান। তাহাতে আবার ট্রামগাড়িতে গমনাগমন করা যায়। ট্রামে আরোহণ করিয়া আমি মেডিকেল কলেজের নিকট অবতরণ করিলাম; যে গৃহে লাসের পরীক্ষা হয়, কলেজের কম্পাউণ্ডের ভিতর দিয়া তাহার নিকট উপনীত হইলাম। সেই গৃহের সম্মুখে কলুটোলা রাস্তার উপর দেখি, ডাক্তার সাহেবের গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। ডাক্তার সাহেব লাস পরীক্ষার নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন ভাবিয়া, আমিও সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। পূর্ব্বে গগনের সহিত, এবং তৎপরে ধরণীধরের সহিত আমি যখন এইস্থানে আগমন করিয়াছিলাম, তখন কেবলমাত্র আমাদিগের প্রেরিত সেই মৃতদেহ ভিন্ন অপর দেহ সেই গৃহে ছিল না। এবার কিন্তু সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, যে টেবিলের উপর আমাদের প্রেরিত মৃতদেহ স্থাপিত রহিয়াছে, তাহার পার্শ্বের টেবিলের উপর একটি অষ্টমবর্ষীয় বালকের মৃতদেহ। উহার হস্তপদ এবং মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে। দেখিয়া বোধ হইতেছে, কতকগুলি রুধিরমিশ্রিত অস্থিমাংস একত্র করিয়া সেইস্থানে রক্ষিত আছে। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, ঘুড়ি উড়াইতে উড়াইতে ত্রিতল ছাদের উপর হইতে পতিত হইয়া সেই বালক এই দশা প্রাপ্ত হইয়াছে। 

উহার পার্শ্বে অপর আর একটি টেবিলের উপর একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। কিন্তু উহার মুখের দিকে দৃষ্টি করিলে ভয়ের উদ্রেক হয়। উহার চক্ষু যেন সবলে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। জিহ্বাও বহির্গত হওয়াতে মুখ একরূপ বিকৃত ভাব ধারণ করিয়াছে। গ্রীবা বক্র অবস্থাতেই রহিয়াছে, একগাছি সুমার্জিত দড়ির একপ্রান্ত দ্বারা আবদ্ধ। জানিলাম, হতভাগী আপনার স্বামীর সহিত কলহ করিয়া এই তরুণ বয়সেই গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে। 

ইহার নিকটবর্তী টেবিলের উপর আর একটি মৃতদেহ রহিয়াছে। ইতিপূর্ব্বে আমি বিস্তর মৃতদেহ দেখিয়াছি। ভয়ানক দুর্গন্ধবিশিষ্ট বিস্তর মৃতদেহ দেখিলেও কিন্তু এরূপ ভয়াবহ মৃতদেহ ইতিপূৰ্ব্বে কখনও আমার নয়নগোচর হয় নাই। যাহারা পূর্ব্বে কখন মৃতদেহ দেখেন নাই, এরূপ মৃতদেহ দর্শন করিলে তাঁহাদের নিতান্ত ভীত হইবারই সম্ভাবনা। কিন্তু তাঁহাদের কথা দূরে থাকুক, বলিতে কি, এই মৃতদেহ দর্শন করিবার পর, আমি প্রায় এক সপ্তাহকাল পর্যন্ত রাত্রিকালে সুষুপ্তিলাভ করিতে সমর্থ হই নাই। কারণ, সেই মৃতদেহের মুখমণ্ডল সর্ব্বদাই আমার অন্তরে জাগরূক ছিল, এবং শয়নে, ভোজনে, সৰ্ব্বসময়েই আমি যেন সেই ভয়ানক দুর্গন্ধ অনুভব করিতাম। 

উহার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি সকলই বিকৃত। সৰ্ব্বাংশই ফুলিয়া বৃহৎকায় ধারণ করিয়াছে। সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষরূপে বিকৃত হইয়া এরূপ স্ফীত হইয়াছে যে, বোধ হয়, দুইজনে বাহুবেষ্টন করিয়া উহাকে ধরিতে পারে না। উহার ওষ্ঠদ্বয় মসীবর্ণ ধারণ করিয়া, প্রায় চারি অঙ্গুলি পরিমিত স্ফীত হইয়াছে। স্কন্ধের বামপার্শ্বের মাংস সকল বসিয়া পড়িয়াছে, বা কোন জীবের উদরে স্থান পাইয়াছে। কর্ণ একটি বিকৃত, অপরটি নাই। মস্তকের ছোট ছোট চুল কতক মস্তকে সংলগ্ন আছে, এবং কতক চর্ম্ম সহিত খসিয়া পড়িয়াছে। দেহ পুরুষের, উহাকে উলঙ্গ অবস্থায় চিৎ করিয়া রাখা আছে। ঊরুদেশেরও নিকটবর্তী স্থানের মাংস সকল খসিয়া পড়িয়াছে। তলপেট দিয়া কতক পরিমিত নাড়ীভুঁড়ি বাহির হইয়া অযথা রক্ষিত আছে। লাসের অবস্থা দেখিয়া কিছুতেই স্থির করিবার উপায় নাই যে, উহা কাহার মৃতদেহ। এমন কি কোন্ জাতির মৃতদেহ, তাহা স্থির করাও সহজ নহে। সহজে কেহই বলিতে পারেন না যে, এই মৃতদেহ বাঙ্গালীর কি ইহুদির, মুসলমানের কি ইংরাজের; দেশীয় কি বিদেশীয়ের। তবে সবিশেষরূপে অবয়ব দেখিলে বোধ হয় যে, ইহা কোন কারণে কাফরির ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিয়াছে। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে, গঙ্গা দিয়া ভাসিয়া যাইবার কালীন এই লাস ধৃত হইয়া পরীক্ষার নিমিত্ত ডেড্‌হাউসে প্রেরিত হইয়াছে। 

গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া সেই সকল দৃশ্য অবলোকন করিয়া, আমি বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। ডাক্তার সাহেব সেই সময় আমাদিগের প্রেরিত মৃতদেহেরপরীক্ষা করিতে ছিলেন। আমাকে বাহিরে গমন করিতে দেখিয়া, ডাক্তার সাহেব একটু হাসিলেন এবং কহিলেন, “কি বাবু! ভয় পাইয়াছ না কি?” উত্তরে আমি কহিলাম, “না সাহেব! ভয় পাই নাই; বড় দুর্গন্ধ লাগিতেছে বলিয়া, এইস্থানে দাঁড়াইতে পারিতেছি না।” এই বলিয়া ডাক্তার সাহেবের আর কোন কথা বলিবার পূর্ব্বেই আমি বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। যে কৰ্ম্মচারী সেই লাসের সহিত সেইস্থানে গমন করিয়াছিলেন, তাহাকে কহিলাম, “লাসের পরীক্ষা শেষ হইলে, ডাক্তার সাহেবের প্রদত্ত কাগজ (Postmor—tem Report) এবং লাসের সহিত কাপড় প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি আছে, তাহা সমস্ত থানায় লইয়া আসিও। আমিও সেইস্থানে তোমার অপেক্ষায় থাকিব।” এই বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

থানায় প্রত্যাগমন করিবার প্রায় দেড়ঘন্টা পরে ডেহাউস হইতে সেই কর্মচারী প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহার আনীত ডাক্তার সাহেবের রিপোর্ট পাঠে অবগত হইলাম যে, ময়দানে যাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, যষ্টির প্রচণ্ড আঘাতেই তাহার আয়ুঃশেষ হইয়াছে। 

এতদ্দেশীয় হিন্দুগণের মধ্যে কেহ কোন সময়ে, বিশেষতঃ সন্ধ্যার সময়ে কোন মৃতদেহ বা মৃতদেহ সংস্পৃষ্ট কোনরূপ দ্রব্যাদি সহজে স্পর্শ করিতে চাহেন না। আমরা সেই হিন্দু হইয়াও কিন্তু সেই নিয়ম প্রতিপালনে কোনরূপেই সমর্থ হইতে পারি না। মৃতদেহ সংস্পৃষ্ট দ্রব্যাদি স্পর্শ করিলে সেই রাত্রিকালে আমাকে স্নান করিতে হইবে জানিয়াও, কর্তব্য-কর্ম্মের অনুরোধে উহা আমাকে স্পর্শ করিতে হইল। সেই কর্ম্মচারী আনীত দ্রব্যাদি তখন উত্তমরূপে একে একে পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিলাম। চাদর, পিরান, ধুতি প্রভৃতি একে একে সবিশেষ সতর্কতার সহিত দেখিলাম। তাহাতে রক্ত ও ধোপার কাল-মার্কা ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে একপাটি জুতা উঠাইয়া লইলাম, উহা নূতন বলিয়া বোধ হইল। কিন্তু আমাদিগের আবশ্যকোপযোগী কোন বিষয়ই উহাতে প্রাপ্ত হইলাম না। তৎপরে দ্বিতীয় পার্টির পরীক্ষায় দেখিলাম, সেই জুতার ভিতর সাদা রঙ্গের একখানি টিকিট মারা আছে। পড়িয়া বুঝিলাম যে, চীনে লোকের দোকান হইতে সেই জুতা ক্রয় করা হইয়াছে, এ টিকিট তাহার দোকানের। সেই দোকানদারের নাম “থম্‌কি”, ঠিকানা ২৯ নং বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট। এইরূপে সেই লাসের সহিত প্রাপ্ত সমস্ত দ্রব্যাদির পর্যবেক্ষণ শেষ হইলে, এখন কোন উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে, তাহাই ক্ষণকালের নিমিত্ত ভাবিয়া লইলাম। একবার ভাবিলাম, “থম্‌কির” নিকট একবার জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি, এই মৃতদেহ সম্বন্ধে সে যদি কোনরূপ সন্ধান বলিয়া দিতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে ইহল যে, কাহার নিকট এই জুতা বিক্রয় করিয়াছে, তাহা বলা “থমকির” পক্ষে একবারে অসম্ভব। কারণ, চীনের বাড়ী হইতে নিত্য নিত্য কত শত লোক যে কত শত জুতা খরিদ করিতেছে, তাহার হিসাব কোন্ চীনা রাখিতে পারে? এইরূপ ভাবিয়াও কিন্তু মনকে তখন প্রবোধ দিতে পারিলাম না। “থম্‌কির” বাড়িতে গিয়া একবার তাহাকে সেই জুতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করাই স্থির করিলাম। 

“থমকির” বাড়ীতে সহজেই বাহির হইল। তাহাকে সেই জুতা দেখাইলাম। জুতা দেখিয়া “থম্‌কি” যাহা বলিল—তাহাতে মনে অতীব আনন্দের সঞ্চার হইল; আবার নতুন আশার ছায়া আসিয়া হৃদয়ে দেখা দিল। “থম্‌কি” কহিল, অতি অল্পদিন হইল, এই জুতা আমি গি ব্রাদারের বড় বাবুকে তৈয়ার করিয়া দিয়াছি। বড়বাবু কোথায় থাকেন, তাহা আমি জানি না; কিন্তু বাবুর নাম ললিতবাবু। ললিতবাবুকে আমি অনেক দিবস হইতে জুতা প্রস্তুত করিয়া দিতেছি; আমার নিকট তাঁহার দেনা পাওনাও আছে। দেখুন মহাশয়! এই তাঁহার হিসাব, হিসাবে জুতার নম্বর দেখুন, এই লেখা আছে। ইহার দাম এখনও পাই নাই।” 

“থম্‌কি” আমাকে যখন এই সকল কথা বলিল, তখন রাত্রি প্রায় নয়টা। ভাবিলাম, এত রাত্রিতে গি ব্রাদারের বাড়ীতে গিয়া কি করিব? এই রাত্রিতে বড়বাবুর বাড়ী আমাকে কে দেখাইয়া দিবে? এখন আফিসে দ্বারবান্ ব্যতীত আর কেহই নাই। তবে দ্বারবান্ যদি বাবুর বাড়ীর ঠিকানা বলিয়া দিতে পারে, তাহা হইলেই শীঘ্র শীঘ্র কাৰ্য্য-নিৰ্ব্বাহ করিতে পারিব; নতুবা কল্য ব্যতীত আর কিছুই হইবে না। এই ভাবিয়া, কালবিলম্ব না করিয়া সেই আফিস-অভিমুখে চলিলাম। আফিসের সম্মুখে গমন করিয়া দেখিলাম, আফিসের সমস্ত দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। বুঝিলাম, ভিতরে কোন না কোন ব্যক্তি নিশ্চয়ই আছে। অনেক ডাকাডাকির পর পশ্চিম-দেশবাসী একজন দ্বারবান নিতান্ত বিরক্তির সহিত বাহিরে আগমন করিয়া নিতান্ত কর্কশস্বরে কহিল, “এত্তা রাকো দরওয়াজামে তোমলোক কোন গোলমাল কৰ্ত্তা হ্যায়। হিয়াসে আবি চলা যাও। আর নেই যাওগে, তো কাল জরুরি হাম হামারা সাহেবকা বোল্ দেঙ্গে। 

দরওয়ানের কথা শুনিয়া একটু হাসিলাম ও কহিলাম, “আমরা গোলমাল কচ্ছিনে, তোমাকে ডাকছি। তোমাদের আফিসের বড়বাবু অত্যন্ত বিপদ্‌গ্রস্থ হইয়া আমাকে তোমার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন। তোমাকে এখনি আমার সহিত তাঁহার নিকট গমন করিতে হইবে।” 

কোন্ বড়াবাবু? ললিতবাবু? বাবু হামারা কেয়া মস্কিলমে পড়েহেঁ, বাবু সাহেব? হামকো বোলায়েহেঁ? হাম আফিস ছোড়কে এত্তা রাকো কেসা জায়েঙ্গে।” 

“তোমাকে গমন করিতেই হইবে। তোমার গাড়ি ভাড়ার নিমিত্ত বাবু একটি টাকা প্রদান করিয়াছেন, এবং বলিয়া দিয়াছেন, এখনই তুমি গমন না করিলে, তাঁহার সবিশেষ অনিষ্ট হইবে।” এই বলিয়া একটি টাকা সেই দরওয়ানের হস্তে প্রদান করিলাম এবং কহিলাম, “ এ টাকা তুমি রাখিয়া দেও। আমার সহিত গাড়ি আছে, তুমি তাহাতেই গমন করিতে পারিবে, গড়ির ভাড়া তোমার লাগিবে না।” 

আমার কথা শুনিয়া এবং টাকাটি পাইয়া, দ্বারবান্ আর কিছু বলিল না। কোমরে টাকাটি রাখিয়া, আর একজন দ্বারবানকে ডাকিল। সে ভিতর হইতে বাহিরে আসিলে তাহাকে আফিসের দ্বার বন্ধ করিতে বলিয়া আমার গাড়িতে উঠিল। অপর দ্বারবান্ আফিসের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আমাদিগের গাড়ি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

গাড়ি কিয়দ্দূর গমন করিলে আমি দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ললিতবাবু কোথায় থাকেন? এখান হইতে তাঁহার বাড়ী কতদূর?” 

আমার কথা শুনিয়া দ্বারবান্ অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হইয়া কহিল, “আপ্‌ উল্কা ঘর নেই জান্তেহেঁ? হাম্‌তো উকা ঘরমে কভি গিয়া নেই। বাবু কাঁহা রয়তেহেঁ ওবি হামারা মালুম নেই হ্যায়। আপ্ যব্ বাবুকা ঘর নেই জান্তেহেঁ, তব্‌ আপ্ কেছা উন্‌কা পাসে আয়েহেঁ?” 

দ্বারবানের কথা শুনিয়া তাহাকে কহিলাম, “তুমি না জান, তাহাতে ক্ষতি নাই। কারণ, আমি জানি, তোমার বাবু কোথায় থাকেন।” মনে কিন্তু ভাবিলাম, যে আশার উপর নির্ভর করিয়া দ্বারবানকে সঙ্গে করিয়া আনিলাম, এখন দেখিতেছি, সে আশাও পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলাম না। এখন কি করি? দ্বারবানকে কি এখন বিদায় করিয়া দিয়া কল্য দিনমানে যখন সকলে আফিসে আসিবে, সেই সময় হইতে অনুসন্ধান আরম্ভ করিব? কি দ্বারবানকে সকল কথা খুলিয়া বলিয়া, যদি সে কোনরূপে এখনই সাহায্য করিতে পারে, তাহার চেষ্টা করিব? এইরূপ কয়েকটি সামান্য ভাবনা ক্ষণকালের জন্য হৃদয়ে প্রবেশ করিল। মুহূর্ত পরে অনুসন্ধানের একটি সহজ উপায় আমার মনে আসিয়া উদিত হইল। সেই উপায় যখন মনের সম্মুখে উপস্থিত হইল, তখন আমার বুদ্ধির উপর ঘৃণা হইল। আমি আমার স্থূল বুদ্ধির উপর বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়া কহিলাম, ‘তুমি কি মূর্খ!’ 

দ্বারবানকে আর কোন কথা না বলিয়া, গাড়ির ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। কেবল কোন্ রাস্তায় গমন করিতে হইবে, তাহাই মধ্যে মধ্যে কোচমানকে বলিয়া দিতে লাগিলাম। 

পাঠকগণ! আপনারা নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, এখন আমি কি নিমিত্ত কোথায় গমন করিতেছি। কারণ, আমার বিশ্বাস, আপনারা নিশ্চয়ই আমার মত স্থূল বুদ্ধিকে হৃদয়ে স্থান দেন না। সুতরাং আমার বিলক্ষণ বোধ হইতেছে, এখন বলিয়া না দিলেও আপনারা বুঝিতে পারিবেন যে, এখন আমার গমনের ইচ্ছা কোন্ স্থানে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য—বশতঃ যদি আমার অপেক্ষাও স্থূল-বুদ্ধিমান্ কোন পাঠক থাকেন, তাহা হইলে আমার মনের কথা তাঁহাকে পূৰ্ব্বে না বলিয়া দিলে, কৰ্ত্তব্য-কর্ম্মের ত্রুটি করা হয়। সুতরাং কেবলমাত্র তাঁহাদিগকেই আমি বলিতেছি যে, সেই সময়ে আমার মনে উদয় হইয়াছিল—আমি ললিতবাবুর বাড়ীর অনুসন্ধান করিয়া এখন কি করিব? ললিতবাবুই যদি হত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে দ্বারবানকে তাঁহার লাস দেখাইলে, আমার বর্ত্তমান উদ্দেশ্য সফল হইয়া যাইবে। লাস সনাক্ত হইলে, তাহার বাড়ীর অনুসন্ধান হইতেও বাকি থাকিবে না। এই ভাবিয়া দ্বারবানকে সেই লাস দেখাইবার অভিপ্রায়ে আমি এখন সেই ডেড্‌হাউস অভিমুখে গমন করিতেছি। কারণ, সেই মৃতদেহ এখনও সেইস্থানে বৰ্ত্তমান। সমস্ত দিবস যে সকল বেওয়ারিস লাসের পরীক্ষা হয়, রাত্রিকালেও তাহা সেইস্থানে রক্ষিত থাকে, শেষরাত্রি বা প্রত্যূষে ভিন্ন উহার সৎকার হয় না। 

দ্বারবানকে সমভিব্যাহারে লইয়া, সেই রাত্রিকালে সেই রক্ষিত-শবময় গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেইস্থানে উপযুক্তরূপ আলো না থাকায়, গাড়ির প্রজ্বলিত লণ্ঠন দুইটি খুলিয়া লইয়া, সেই গৃহের ভিতর যাইতে হইল। সেই গৃহের চাবি, সেই গৃহের রক্ষক শিবু ডোমের নিকট ছিল; বলিবামাত্র শিবু চাবি খুলিয়া দিল। আমি লন্ঠনহস্তে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া, দ্বারবানকে সেই লাসটি দেখাইয়া দিয়া কহিলাম, “বেশ করিয়া দেখ দেখি, তুমি ইহাকে চিনিতে পার কি না?” এই গৃহ দেখিয়া দ্বারবান একটু বিস্মিত হইল এবং কহিল, “হিয়ি হামারা বাবু রয়তে হেঁ?” এই বলিয়া সে আমাদিগের প্রদর্শিত লাসের নিকট গমন করিয়া যেমন উহা দেখিল, অমনি পশ্চাদ্‌পদ হইয়া কহিল, “এ তো মুদ্দোর হ্যায়! “ 

সেই মৃতদেহ সে চিনিতে পারি কি না, উত্তমরূপে দেখিয়া আমাকে বলিবার নিমিত্ত তখন তাহাকে কহিলাম। প্রথমে সে অনেক প্রকার ওজর আপত্তি করিল; কিন্তু পরিশেষে অনেক কষ্টে আমাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, সেই দেহ উক্ত আলোর সাহায্যে সে উত্তমরূপে দেখিল। 

যেরূপ অবস্থায় এই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, এখন আর তাহার সেরূপ অবস্থা নাই। এখন উহা স্ফীত হইয়াছে, আকৃতি অনেক বিকৃত হইয়া পড়িয়াছে। বিলক্ষণ পরিচিত লোকের পক্ষেও সহসা চিনিতে পারা এখন নিতান্ত সহজ নহে। 

দ্বারবান কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত উত্তমরূপে অবলোকন করিয়া পরিশেষে কহিল, “মালুম হোতা হ্যায়, এ হামারা বাবু হ্যায়। লেকেন হাম্ ঠিকসে নেই বোল্‌নে সেত্তা। ইন্কা মুর আবি ঠিক্ নেই হ্যায়। চেহারা এক দম্ বিগড় গিয়া।” 

দ্বারবানের কথা শুনিয়া, আমার মনে আশা হইল। ভাবিলাম, যে কার্য্য-টুকুর নিমিত্ত আমি এ পর্য্যন্ত ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, তাহা এখন সফল হইল। তখন ললিতবাবুর বাড়ী অনুসন্ধান করিয়া বাহির করাই কর্তব্য স্থির করিলাম, এবং কোন উপায়ে সেই রাত্রিকালে তাঁহার বাড়ী খুঁজিয়া পাইব, তখন তাহারই উপায় মনে মনে স্থির করিতে লাগিলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

দ্বারবানকে এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত কোন কথা স্পষ্ট করিয়া বলি নাই, এখন কিন্তু তাহাকে সমস্ত কথা বলিলাম। আমি কে, সেই পরিচয়ও তাহাকে তখন প্রদান করিলাম। আমার কথা শুনিয়া, সে যেন একটু চিন্তিত হইল; কিন্তু হঠাৎ কোন কথা না বলিয়া, সে তাহার কোমর হইতে আমার প্রদত্ত টাকাটি বাহির করিয়া আমাকে প্রত্যর্পণ করিতেচাহিল; আমি কিন্তু উহা গ্রহণ করিলাম না। সেই রাত্রিতে কি প্রকারে ললিত বাবুর বাড়ীর অনুসন্ধান করিতে পারিব, তাহারই উপায় তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। সে একটু চিন্তার পর আমাকে কহিল যে, তাহাদের আফিসের একজন সরকারের বাড়ী সে চিনে, সে ললিতবাবুর ঠিকানা বলিয়া দিতে পারিলে আমাদের অভিলাষ পূর্ণ হইবে। 

সেই দ্বারবানকে সঙ্গে লইয়া, অগত্যা সেই সরকারের বাড়ীতে গমন করিলাম। সরকার বাড়ীতেই ছিল, তাহাকে পাইতে অধিক কোন কষ্ট হইল না। কিন্তু সেও ললিতবাবুর বাড়ীর ঠিকানা বলিতে পারিল না; তবে সেই আফিসের আর একজন বাবুর বাড়ি সে জানিত। আমাদিগের সঙ্গে গমন করিয়া সে সেই বাড়ী দেখাইয়া দিল। সেই বাবুটি ললিতবাবুর বাড়ী চিনিতেন। তিনি আমাদিগের সহিত গমন করিয়া ললিত বাবুর বাড়ী দেখাইয়া দিতে প্রথমে অনেকরূপ ওজর আপত্তি করিলে কিন্তু তাঁহাকে অনেক প্রকার বুঝাইয়া বলায়, পরিশেষে তিনি সম্মত হইয়া আমাদিগের সহিত গমন করিলেন, এবং ললিতবাবুর বাড়ী দেখাইয়া দিলেন। ললিত বাবুর বাসস্থান এইস্থানে নহে; কিন্তু তিনি সিমলায় একখানি বাড়ীতে তাঁহার পরিবার প্রভৃতির সহিত বাস করিতেন। 

ললিতবাবুর একটি পুত্র ছিল, তাহার নাম শরৎ। শরতের বয়ঃক্রম দশ বার বৎসরের কম নহে। সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া ডাকাডাকি করায়, শরৎ বাহিরে আগমন করিল। তাহাকে ললিতবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “শনিবার বৈকালে আফিস হইতে বাড়িতে আগমন করিয়া, পিতা আমার বাহিরে গমন করিয়াছেন। তাহার পর এ পর্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই। তাঁহার নিমিত্ত বাড়ীর সকলেই ভাবিয়া অস্থির হইয়াছেন। স্থানে স্থানে তাঁহার অনুসন্ধান করাও হইয়াছে, কিন্তু কোন স্থানেই তাঁহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই।” 

বালকের নিকট এই কথা শ্রবণ করিয়া, আমাদিগের আর মনে কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। তথাপি শরৎকে সঙ্গে লইয়া, পুনরায় সেই ডেড্‌হাউসে গমন করিলাম। বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা আমাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া রোদন করিয়া উঠিল। যদিও সেই সময় আমি স্পষ্ট কিছু বলিলাম না; তথাপি তাঁহাদের আর বুঝিতে বাকি থাকিল না যে, তাঁহাদিগের সর্ব্বনাশ ঘটিয়াছে। শরৎ যখন আমাদিগের সঙ্গে গমন করিতে প্রস্তুত হইল, তখন দেখিলাম, শরতের মা’ এবং আরও একজন স্ত্রীলোক শরতের সহিত গমন করিয়া সেই মৃতদেহ দেখিতে প্রস্তুত হইলেন। কাজেই আমাকে তাঁহাদিগের মতে মত দিয়া, অপর আর একখানি গাড়ির বন্দোবস্ত করিতে হইল। 

পরিশেষে সকলেই আমার সহিত গমন করিয়া, সেই ডেডহাউসে উপনীত হইলেন। পূর্ব্বোক্ত মৃতদেহ তখন যতই বিকৃতরূপ ধারণ করুক না কেন, উঁহারা কিন্তু দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিলেন যে, উহা ললিতের মৃতদেহ। 

সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন নিশীথরাত্রিতে, সেই শবরাশি-সমাকীর্ণ নিস্তব্ধ ডেড্‌হাউসের ভিতর সেই সময়ে যে কিরূপ রোদন ধ্বনি উত্থিত হইয়া দিঙমণ্ডল প্রকম্পিত করিতে লাগিল, তাহা বর্ণন করা আমার লেখনীর সাধ্যের অতীত ও আমার হস্তের ক্ষমতার বহির্ভূত। 

সেই সময়ে অনেক বুঝাইয়া, কোন প্রকারেই আমি তাঁহাদিগকে নিরস্ত করিতে পারিলাম না। আমি তাঁহাদিগকে যতই বলিলাম, তাঁহাদিগকে যতই বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, দেখিলাম, প্রজ্বলিত হুতাশনের ভিতর ততই যেন ঘৃতাহুতি পড়িতেছে। সুতরাং আমাকে নিরস্ত হইয়া বাহিরে আসিতে হইল। আমি বাহিরে আগমন করিলে দেখিলাম, শিবু ডোম উঁহাদিগের উপর নিতান্ত কঠিন ব্যবহার করিল,—উহাদিগকে সেই গৃহের বাহির করিয়া দিয়া তাহাতে চাবি বন্ধ করিয়া দিল। উঁহারা সেই শবসজ্জিত গৃহের বাহিরে পড়িয়া, নিতান্ত অধীরতার সহিত উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। 

তাঁহাদিগের সেই সকরুণ রোদনধ্বনির উচ্চরোলে, দূরস্থিত জনৈক মহাপুরুষের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি সক্রোধে সেইস্থানে আগমন পূর্ব্বক উহাদিগকে বিজাতীয় ভাষায় গালি দিয়া, সেইস্থান হইতে বহির্গত করিয়া দিবার নিমিত্ত শিবুকে আজ্ঞা প্রদান করিলেন। যখন দেখিলাম যে, শিবু তাঁহার আজ্ঞা প্রতিপালনে অগ্রবর্ত্তী হইল, তখন আর আমি তাঁহাদের অভিমতের প্রত্যাশা না করিয়া, আমার সমভিব্যাহারী সেই দ্বারবানের সাহায্যে বলপূর্ব্বক উহাদিগকে একে একে আনিয়া সেই গাড়ির ভিতর স্থাপিত করিলাম। গাড়ির দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া, গাড়িবানকে গাড়ি হাঁকাইতে কহিলাম। যে স্থান হইতে উহাদিগকে আনিয়াছিল, গাড়িবান তাহার গাড়ি সেইস্থানে লইয়া চলিল। আমাদিগের গাড়িও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ক্রমে আমরা সকলে সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম। উহাদিগের রোদনধ্বনি শ্রবণে, এক এক করিয়া পাড়ার অনেকে আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। তাঁহাদিগের মধ্যে দুই একজনকে নিকট আত্মীয় বলিয়াও বোধ হইতে লাগিল। তাঁহাদিগকে সকল কথা খুলিয়া বলিলাম। কোথায় ললিতের লাস পাওয়া গিয়াছে, এবং কিরূপ উপায়ে আমরা জানিতে পারিয়াছি যে, উহা কাহার লাস; এই সকল কথা তাহাদিগকে আমি পরিষ্কাররূপে কহিলাম। আরও কহিলাম “সেই লাস এখন পর্য্যন্ত ডেড্‌হাউসে বেওয়ারিস অবস্থায় আছে। আর অল্পক্ষণের মধ্যে উহার সৎকার ডোম-কর্তৃক নিৰ্ব্বাহিত হইয়া যাইবে। আপনারা যদি সেই লাসের সৎকার করিতে চাহেন, তাহা হইলে তাহার উপায় অগ্রে দেখুন। পরিশেষে আমাদিগের অনুসন্ধান কার্য্যে সাহায্য করিতে অনেক সময় পাইবেন।” আমার কথা শ্রবণ করিয়া দুই এক জন শরৎকে সঙ্গে লইয়া সেই লাসের সৎকার অভিপ্রায়ে গমন করিলেন। আমিও আমার বর্ত্তমান কার্য সমাপ্ত করিয়া, অর্থাৎ লাসের সনাক্ত হইয়া গেল দেখিয়া, আমার অশুচি বস্ত্রাদি পরিত্যাগ করিবার অভিপ্রায়ে আপনার বাসাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। বাসায় উপনীত হইয়া দেখিলাম, রাত্রি চারিটা বাজিয়া গিয়াছে। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

পরদিবস প্রাতঃকাল ছয়টার সময় পুনরায় সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যাঁহারা লাসের গতি করিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছিলেন, তখন পৰ্য্যন্ত তাঁহারা প্রত্যাগমন করেন নাই। তাঁহারা যতক্ষণ প্রত্যাগমন না করিলেন, ততক্ষণ পর্য্যন্ত রীতিমত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারিলাম না। তাঁহাদিগের প্রত্যাগমন করিতে প্রায় দশটা বাজিয়া গেল। আমাদিগের অনুসন্ধানও সেই সময় হইতে আরম্ভ হইল। 

আমরা যেরূপভাবে অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম, যেরূপভাবে বাড়ীর প্রত্যেক ব্যক্তিরই এজাহার গ্রহণ করিলাম, তাহার সমস্ত কথা বিস্তারিতরূপে বিবৃত করিতে হইলে, এই প্রবন্ধের আকার নিতান্ত দীর্ঘ হইয়া পড়িবে, এই ভয়ে তাহা পরিত্যক্ত হইল। তবে কেবলমাত্র এই মোকদ্দমার উপযোগী যে কয়েকটি বিষয় আমি বাহির করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, তাহারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ হইল। 

১ম। শনিবারে ললিতবাবু আফিস হইতে প্রত্যাগমন করিবার সময়, রজনীবাবু নামক আর একজন লোকের সহিত আগমন করিয়াছিলেন। 

২য়। আফিসের কাপড় চাদর ছাড়িয়া, তিনি রজনীবাবুর সহিত বাহির হইয়া গিয়াছিলেন। 

৩য়। রজনীবাবু প্রায়ই ললিতবাবুর নিকট আসিতেন। 

৪র্থ। ললিতবাবু যখন বাহির হইয়া যান, সেই সময় কিছু টাকা তিনি সঙ্গে লইয়া যান। কত টাকা, তাহা কেহ বলিতে পারেন না, কিন্তু অধিক টাকা যে তিনি লইয়া যান নাই, ইহা নিশ্চয়। বোধ হয় আট দশ টাকার অধিক তাঁহার নিকট ছিল না। 

৫ম। যখন তিনি বাহির হইয়া যান, সেই সময় তাঁহার সহিত তাঁহার সোণার চেন ও ঘড়ী ছিল। সেই চেন ঘড়ীর দাম দুই তিন শত টাকার কম হইবে না। 

৬ষ্ঠ। রজনী ললিতবাবুর সহিত বাহির হইয়া যাওয়ার পর, আর ললিতবাবুর বাড়িতে আগমন করেন নাই। ৭ম। যখন ললিতবাবু বাহির হইয়া যান, সেই সময় তিনি কেবল এইমাত্র বলিয়া যান যে, তাঁহার প্রত্যাগমন করিতে রাত্রি অধিক হইবে। কারণ, একটি নিমন্ত্রণ উপলক্ষে তিনি গমন করিতেছেন। 

৮ম। নিমন্ত্রণ উপলক্ষে যে কোথায় গমন করিতেছেন, তাহা কিন্তু কাহারও নিকট তিনি বলিয়া যান নাই। ললিতবাবুর বাড়ী হইতে এই কয়েকটি বিষয় অবগত হইবার পর, রজনীবাবুর অনুসন্ধান করা আমাদের অনুসন্ধানের প্রথম কার্য্য হইল। রজনীবাবু কে? কোথায় থাকেন? সে বিষয় বাড়ীর কেহই কেন প্রকার বলিতে পারিলেন না। 

পাড়ার অপর কোন ব্যক্তি ললিতবাবুর নিকট আগমন করিতেন কি না? যদি আসিতেন, তাহা হইলে রজনীবাবু যে সময়ে আগমন করিতেন, সেই সময়ে তিনি থাকিতেন কি না? এই সম্বন্ধে অনুসন্ধান করায় জানিতে পারিলাম, সেই পাড়ার কেশবচন্দ্র সর্ব্বদাই ললিত বাবুর নিকট আগমন করিতেন। তিনি রজনীবাবুকেও অনেকবার দেখিয়াছেন। 

কেশবচন্দ্র ললিতের প্রতিবেশী, সুতরাং তখনই তাঁহাকে পাওয়া গেল। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় অবগত হইলাম যে, তিনি অনেকবার রজনীবাবুকে ললিতে সহিত দেখিয়াছেন এবং শুনিয়াছেন, রজনীবাবু কোন আফিসে কর্ম্ম করেন ও থাকেন—গড়পারে। কিন্তু গড়পারের যে কোথায় থাকেন, এবং কোন আফিসে কর্ম্ম করেন, তাহার সবিশেষ সংবাদ কেশবচন্দ্র প্রদান করিতে সমর্থ হইলেন না। 

কেশবচন্দ্রের নিকট হইতে এই সামান্য বিষয়মাত্র অবগত হইয়া, তখনই গড়পারে গমন করিলাম। সেইস্থানে আমার দুই চারি জন পরিচিত লোকের বাসস্থান আছে। প্রথমেই আমি তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম এবং যে উদ্দেশ্যে আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ তাঁহাদিগকে কহিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহারা সকলেই অতিশয় বিস্মিত হইলেন। উহাদিগের মধ্যে হরি নামক এক ব্যক্তি তখনই রজনীর অনুসন্ধানে বহির্গত হইলেন। আমি আমার পরিচিত এক ব্যক্তির বাটিতে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

ইতিপূর্ব্বে অপর এক ব্যক্তি কর্তৃক হরি একবার বিলক্ষণ রূপে অবমানিত হইয়াছিলেন। কিন্তু অনেকে সেই অবমানকারীর পক্ষ অবলম্বন করায়, প্রথমে হরি তাহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারেন নাই। পরিশেষে তিনি নিতান্ত নিরুপায় হইয়া জনৈক বন্ধুর নিকট হইতে একখানি পত্র আমার নিকট আনয়ন করেন। সেই বন্ধুর অনুরোধে আমি হরিকে সবিশেষ সাহায্য করি। আমি সাহায্য করিয়াছিলাম বলিয়াই সেই অবমানকারী উপযুক্তরূপে দণ্ডিত হয়, এই বিশ্বাস হরির মনে বদ্ধমূল হয়। আজ সময় পাইয়া সেই উপকারের কিয়দংশ যদি হরি পরিশোধ করিতে পারেন, এই ভাবিয়া রজনীর অনুসন্ধানে তিনি দ্রুতপদে বহির্গত হইয়া গেলেন, এবং দশ পনের মিনিটের মধ্যেই রজনীবাবুকে সঙ্গে করিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

নবম পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্বে রজনীকান্ত সম্বন্ধে যে কয়েকটি কথা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, জিজ্ঞাসা করায় রজনীকান্ত তাহার সমস্ত কথা স্বীকার করিলেন ও কহিলেন—“আমার আফিস ও ললিতবাবুর আফিস একস্থানে। শনিবার দিবা প্ৰায় দুইটার সময় আমাদের উভয়ের পরিচিত ভুবনবাবু প্রথমে আফিসে আমার নিকট গমন করেন। তাঁহার বাড়ীতে সেই দিবস কোন ক্রিয়া ছিল, সেই উপলক্ষে আমাদিগকে নিমন্ত্রণ করিবার নিমিত্তই তিনি গমন করিয়াছিলেন। তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া যাহাতে আমার যাওয়া হয়, তাহার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করেন। ললিতবাবু তাঁহার আফিসের ভিতর কোন স্থানে বসেন, তাহা তিনি জানিতেন না বলিয়া, আমাকে সেইস্থান দেখাইয়া দিতে কহেন। বন্ধুর প্রস্তাবে সম্মত হইয়া ভুবনবাবুকে সঙ্গে লইয়া, আমি ললিতবাবুর নিকট গমন করি। তিনি ললিতবাবুকেও নিমন্ত্রণ করেন, এবং যাহাতে তিনি নিমন্ত্রণে নিশ্চয়ই যান, তাহার নিমিত্ত তাঁহাকেও বার বার অনুরোধ করেন। তিনিও তাঁহার অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া, সন্ধ্যার পর সেইস্থানে গমন করিবেন, এইরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইলে, ভুবনবাবু সেইস্থান পরিত্যাগ করেন। ললিতবাবু ও আমি পরামর্শ করিয়া পরিশেষে এই স্থির করি যে, আফিস হইতেই একখানি গাড়ি করিয়া, প্রথমে আমরা উভয়ে ললিতবাবুর বাড়ীতে গমন করিব। সেইস্থানে তিনি আফিসের বস্ত্রাদি পরিত্যাগ পূর্ব্বক আমার সহিত সেই গাড়িতেই আমার বাড়ীতে আগমন করিবেন। পরিশেষে আমরা এইস্থান হইতে উভয়েই ভুবনবাবুর বাড়ীতে গমন করিব। 

“যেরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছিল, কার্য্যেও আমরা সেইরূপ করিয়াছিলাম। আমরা প্রথমে ললিতবাবুর বাড়ীতে যাইয়া আমার বাড়ীতে আগমন করি ও পরিশেষে এইস্থান হইতে উভয়েই খিদিরপুরে ভুবনবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হই। যখন আমরা সেইস্থানে গমন করিলাম, তখন কেবল সন্ধ্যা হইয়াছে মাত্র। সেইস্থানে বিলম্ব হইবে ভাবিয়া, যে গাড়িতে আমরা গমন করিয়াছিলাম, সেই গাড়ি ছাড়িয়া দেই। সেই স্থানে আমোদ-আহ্লাদ ও আহারাদি করিতে রাত্রি প্রায় দশটা বাজিয়া যায়। ভুবনবাবু আমাদিগের নিমিত্ত আদর অভ্যর্থনার কিছুই ত্রুটি করেন নাই। আমার এবং ললিতবাবুর যে একটু পানদোষ আছে, তাহা তিনি বিলক্ষণরূপে অবগত ছিলেন। সুতরাং সে বিষয়ের আয়োজন ও তিনি প্রচুর রূপে করিয়া রাখিয়াছিলেন। যাহা হউক, রাত্রি এগারটার সময় আমরা উভয়ে বাড়ী আগমন করিবার নিমিত্ত সেইস্থান পরিত্যাগ করি। আমাদিগের গাড়ি পূর্ব্বেই বিদায় করিয়া দিয়াছিলাম, সুতরাং একখানি ঠিকা গাড়ি ভাড়া করিয়া লই। এই গাড়ি ভুবনবাবুর চাকর কোথা হইতে আনিয়া দেয়, তাহা জানি না। কিন্তু গাড়িতে আমরা উভয়েই আরোহণ পূর্ব্বক কলিকাতা ভিমুখে আগমন করিতে থাকি। 

“যখন আমরা এই গাড়িতে উঠিলাম, তখন আমাদিগের বুদ্ধির স্থিরতা ছিলনা। আমরা উভয়েই তখন সুরাদেবীর প্রভাবে শূন্যে ভ্রমণ করিতেছিলাম। আমাদিগের গাড়ি যখন ময়দানের ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল, তখন বোধ হয়, কি একটি সামান্য কারণে আমাদিগের উভয়ের মধ্যে বান্বিতণ্ডা আরম্ভ হইল। সেই সময় আমাদিগের উভয়েরই হিতাহিত জ্ঞান ছিল না, কাজেই সেই বিবাদ সহজে মিটিল না। আমার বেশ মনে হয় যে, ললিতবাবু প্রথমে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ আরম্ভ করেন। আমিও তাহাতে তাঁহাকে নিতান্ত কটু কঠিনরূপে বলিতে থাকি, এবং এমন কি, পরিশেষে তাঁহাকে দুই একটি চড় চাপড় দিবারও উপক্রম করি। সেই সময়ে ললিতবাবু গাড়ি হইতে হঠাৎ নামিয়া পড়েন ও সেই গাড়িতে আর উঠিবেন না বলিয়া, রাস্তা ছাড়িয়া পদব্রজেই ময়দানের ভিতর গমন করিতে থাকেন। আমিও উঁহাকে আর না ডাকিয়া, নেসার ঘোরে গাড়িবানকে গাড়ি হাঁকাইতে কহি। গাড়িবান্ আমার কথা শুনিয়া গাড়ি হাঁকাইয়া দেয়। 

“যে সময় ভুবনবাবুর চাকর আমাদিগের নিমিত্ত গাড়ি আনিয়া দিয়াছিল, সেই সময় আমার বেশ মনে হয় যে, গাড়িবান্ ভিন্ন গাড়ির উপর আর কেহই ছিল না। কিন্তু ময়দানের ভিতর ললিত বাবু গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজে যখন গমন করিতে থাকেন, সেই সময়ে আমি দেখিতে পাই, আমার গাড়ির উপর হইতে অপর আর এক ব্যক্তি অবতরণ করিয়া, তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে থাকে। সেই ব্যক্তি কে কোথা হইতে আসিল, এবং কখনই বা গাড়িতে উঠিল, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি। 

“ললিতবাবুকে সেই ময়দানের ভিতর পরিত্যাগ করিয়া, আমি আমার বাটিতে প্রত্যাগমন করি ও শয়ন করিবামাত্র অঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়ি। পরদিবস নিদ্রা ভাঙ্গিলে নিয়মিতরূপে স্নান, আহার প্রভৃতি করিয়া যেরূপে রবিবার অতিবাহিত করিয়া থাকি, সেইরূপেই সেই দিবস যাপন করি। ললিতবাবুর কথা একবারেই বিস্মৃত হইয়া যাই। ইহা ব্যতীত আর কোন কথা আমার মনে পড়িতেছে না।” এই বলিয়া রজনীকান্ত নিরস্ত হইলেন। 

আমি। ললিতবাবু যখন গাড়ি পরিত্যাগ করিয়া ময়দানের ভিতর চলিয়া গেলেন, তখন তাঁহার নিকট মূল্যবান কোন দ্রব্য ছিল কি না, তাহা আপনি বলিতে পারেন? 

রজনী। সোণার চেন ও ঘড়ী তাঁহার নিকট ছিল দেখিয়াছি, এবং একখানি কাগজে মোড়া কয়েকটি টাকা তাঁহার পকেটে ছিল জানি। ইহা ভিন্ন অপর কোন মূল্যবান দ্রব্য কিছু ছিল কি না তাহা আমি বলিতে পারি না। 

রজনীকান্তের নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, যদি রজনীকান্তের কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে চুরি সূত্রেই যে ললিত বাবু হত হইয়াছেন, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তবে এখন দেখিতেছি, কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইল, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ নহে। টাকা কয়েকটি একখানি কাগজে মোড়া ছিল। কিন্তু কৈ, সেই রক্তমাখা কাগজ ভিন্ন আর কোন কাগজ ময়দানের ভিতর পাওয়া যায় নাই। আমার পূর্ব্বকার অনুমান যদি সত্য হয়, যদি ধরণীধরের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই কাগজে ললিতবাবু টাকা মুড়িয়া রাখিতে পারেন কি প্রকারে? 

যাহা হউক, এখন যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে উক্ত অপরিচিত ব্যক্তি কে, তাহা জানিতে না পারিলে, এই খুনি মোকদ্দমার রহস্যোদ্ঘাটন হওয়া একেবারেই অসম্ভব। যে ব্যক্তি সম্বন্ধে রজনীবাবু কোন কথাই বলিতে পারিতেছেন না, তাহাকেই বা কি প্রকারে পাইব? আর তাহাকে না পাইলেই বা যে পন্থা দৃষ্টিগোচর হইতেছে, তাহা শেষ হইবে কি প্রকারে? এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। 

দশম পরিচ্ছেদ 

রজনীবাবুর পাড়া হইতে বহির্গত হইয়াই প্রথমে খিদিরপুরে ভুবনবাবুর বাড়িতে গমন করিলাম। ভুবনবাবু বাড়ীতেই ছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিলাম, রজনীবাবু যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, তাহার প্রত্যেক কথাই ভুবনবাবুর কথার সহিত মিলিয়া গেল। ভুবনবাবু কর্তৃকতাঁহাদিগের নিমন্ত্রণ, ভুবনবাবুর বাড়ীতে উভয়ের গমন, সেইস্থানে আহারাদি ও সুরাপান, এবং সেইস্থান হইতে গাড়ি আনাইয়া তাহাতে প্রত্যাগমন প্রভৃতি, যাহা যাহা ভুবনবাবুর বাড়ীতে ঘটিয়াছিল, তাহার সমস্তই ভুবনবাবুর নিকট জানিতে পারিলাম। ললিতবাবুর নিকট চেন ও ঘড়ী যে ছিল, তাহাও ভুবনবাবু বলিলেন। 

ভুবনবাবুর যে চাকর তাঁহাদিগের নিমিত্ত গাড়ি আনিয়া দিয়াছিল, সে সেইস্থানেই উপস্থিত ছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিবামাত্রই সে কহিল, ‘হাঁ মহাশয়! আমি গাড়ি আনিয়া দিয়াছিলাম। আমি যে গাড়ি আনিয়াছিলাম, তাহা আমার পরিচিত, আমি সেই গাড়িবানকে চিনি।” 

ভৃত্যের এই কথা শ্রবণ করিয়া, তাহার প্রভুর আদেশ লইয়া, তাহাকে পুনরায় সেই গাড়িবানকে আনিতে কহিলাম। সে আদেশ পাইবামাত্র তখনই গমন করিল; কিন্তু প্রায় দশ মিনিট পরে প্রত্যাগমন করিয়া কহিল, “ভাড়া লইয়া সে বাহিরে গমন করিয়াছে। তাহার প্রত্যাগমন করিবার ঠিক নাই, কিন্তু রাত্রি দশটার মধ্যে সে নিশ্চয়ই প্রত্যাগমন করিবে। একথা আস্তাবলের অপর লোকে কহিল।” 

এখন প্রায় সন্ধ্যা আগত প্রায়। বিনা-বিশ্রামে এবং বিনা আহারে সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে, তাহা পাঠকগণ আপনারা সকলেই অবগত আছেন। কিন্তু তাহা বলিয়া যতক্ষণ সেই গাড়িবানের সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ না হই, ততক্ষণ খিদিরপুরই বা পরিত্যাগ করি কি প্রকারে? 

কার্য্যের গতিতে সময়ে সময়ে আমাদিগকে চক্ষু-লজ্জা পরিত্যাগ করিতে হয়। সুতরাং ভুবনবাবুকে যে আমি আমার মনের কথা সহজে বলিতে পারিব না, তাহা সম্ভব নহে। আমি অবলীলাক্রমে ভুবনবাবুকে বলিলাম, “মহাশয়! এ পর্যন্ত স্নান আহার করিবার সময় পাই নাই। আর এইস্থানে যে কতক্ষণ আমাকে থাকিতে হইবে, তাহাও ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। অতএব জিজ্ঞাসা করি, এরূপ অবস্থায় আপনার এখানে এখন স্নান করিবার সুযোগ হইতে পারে কি না?” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া ভুবনবাবু কহিলেন, “আপনার এতক্ষণ স্নান আহার হয় নাই! একথা এতক্ষণ আমাকে বলেন নাই কেন?” এই বলিয়া তিনি তাঁহার চাকরকে আমার স্নানার্থ উদযোগ করিতে কহিলেন। 

চাকর স্নান করিবার উদযোগ করিয়া দিল, পরিধানের নিমিত্ত একখানি বস্ত্রও আনিয়া দিল। আমি স্নান-আহ্নিক সেইস্থানেই সম্পন্ন করিলাম। ভুবনবাবু জলযোগের উত্তম বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। পরিতোষের সহিত জলযোগ করিয়া, সেই গাড়িবানের প্রত্যাশায় সেইস্থানেই বসিয়া রহিলাম! সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেল, ক্রমে রাত্রি দশটা হইল, তথাপি সেই গাড়ি আস্তাবলে ফিরিল না; দ্বিপ্রহর হইল, তথাপিও দেখা নাই। রাত্রি তিনটার সময় সেই গাড়ি আসিয়া আস্তাবলে পৌঁছিল। 

সেই রাত্রি তিনটার সময় গাড়িবানের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। শনিবারের কথা জিজ্ঞাসা করায় সে প্রথমে সমস্ত কথাই অস্বীকার করিয়া কহিল, “আমি শনিবারে গাড়ি চালাই নাই। আমার শরীর একটু অসুস্থ বোধ হওয়ায়, সেই দিবস কোন কার্য্য না করিয়া, আমি আস্তাবলেই পড়িয়াছিলাম।” গাড়িবানের এই কথা শুনিয়া, আমি তাহাকে ভুবনবাবুর নিকট লইয়া গেলাম। ভুবনবাবু, ভুবনবাবুর চাকর এবং আমি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইবার পর, সে সকল কথা স্বীকার করিল। অধিকন্তু কহিল, “ যে ব্যক্তি আমার গাড়ির উপর বসিয়াছিল, সে ব্যক্তি সেই বাবুদেরই লোক, তাঁহাদের সঙ্গেই এইস্থানে আগমন করিয়াছিল।” 

গাড়িবানের এই শেষোক্ত কথা শুনিয়া আমি তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কি প্রকারে জানিতে পারিলে যে, সেই ব্যক্তি সেই বাবুদের লোক, এবং তাঁহাদের সহিতই আগমন করিয়াছিল?” 

গাড়িবান্। বাবুরা যেমন আমার গাড়িতে উঠিলেন, সেও অমনি কোচবাক্সে উঠিয়া বসিয়াছিল 

আমি। সে তোমার কোচবাক্সে উঠিয়া বসিয়াছিল বলিয়াই, তুমি জানিতে পারিলে যে, সে তাঁহাদের লোক এবং তাঁহাদের সহিতই আগমন করিয়াছিল? 

গাড়িবান। না মহাশয়! কেবল তাহাই নহে। এই ঘাঁটীর পাহারাওয়ালা মহম্মদ তাহাকে চিনে। যে সময়ে সেই ব্যক্তি আমার গাড়িতে উঠিয়া বসে সেই সময়ে কোথা হইতে মহম্মদ খাঁ আসিয়া উপস্থিত হয়, ও উহাকে দেখিয়া কহে, “কি ইব্রাহিম! তুমি আজকাল কোথায় আছ?” উত্তরে সে কহে, “আমি এখন এই বাবুদের নিকট চাকরি করিতেছি।” ইহাতেই আমি জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সেই ব্যক্তি বাবুদেরই চাকর। 

গাড়িবানের কথা শুনিয়া মনে আশা হইল, যখন পাহারাওয়ালা তাহাকে চিনে, তখন অনায়াসেই তাহাকে বাহির করিতে পারিব। এই ভাবিয়া গাড়িবানকে বিদায় দিলাম। সে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও যে থানায় মহম্মদ খাঁ থাকে, সেই থানায় গমন করিলাম। 

মহম্মদ খাঁ কনষ্টেবল থানাতেই ছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, সে সমস্ত কথা বর্ণনা করিল এবং কহিল, “এই থানায় আমার বদলী হওয়ার পূর্ব্বে আমি সহরের ভিতর ছিলাম। সেই সময় হইতেই আমি ইব্রাহিমকে চিনি। ইব্রাহিম একজন বিখ্যাত গোণ্ডা ও চোর। মারামারি করিয়া এবং চুরি করিয়া, সে অনেকবার জেলে গমন করিয়াছে। ইব্রাহিমকে হঠাৎ বাবুদিগের গাড়ির উপর দেখিয়া আমার সন্দেহ হইয়াছিল। তাহাতেই আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, এবং উত্তরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সে এখন বাবুদিগের নিকট কৰ্ম্ম করিতেছে। 

আমি। কোন ইব্রাহিম? যে ইব্রাহিম মেছুয়াবাজারে থাকে, সেই কি? 

কনষ্টেবল। হাঁ মহাশয়! সেই মেছুয়াবাজারের ইব্রাহিম। 

আমি। আমিও তাহাকে উত্তরমরূপে চিনি, সে বড় ভয়ানক চোর। যাহা হউক, তুমি আমার সহিত চল। সে যেখানে থাকে, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতেই হইবে। 

কনষ্টেবল আমার সহিত ইব্রাহিমের অনুসন্ধানে গমন করিতে সম্মত হইল। আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক সহরের ভিতর আগমন করিলাম। এখন আর রাত্রি নাই। রাত্রি থাকিতে আমরা বাহির হই নাই, বরং বেলা করিয়াই আসিয়াছি। এখন বেলা প্রায় নয়টা। 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

পুলিস বিভাগে আমি এতদিবস কৰ্ম্ম করিয়া বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে, মোকদ্দমা ধরা পড়িবে, তাহার সূত্র পাইতে প্রায়ই বিলম্ব হয় না; এবং সেই সূত্রাবলম্বনে যাহার অনুসন্ধান করা যায়, কে যেন কোথা হইতে তাহাকে আনিয়া সম্মুখে উপস্থিত করিয়া দেয়। 

এ মোকদ্দমাতেও আমাদিগের ঠিক সেইরূপ অবস্থাই ঘটিল। যাহার অন্বেষণে আমরা গমন করিতেছিলাম, দেখিলাম, চিৎপুর রাস্তা ধরিয়া সেও আমাদিগের দিকে আসিতেছে; সুতরাং সে অনায়াসেই ধৃত হইল। তাহার পরিধেয় বস্ত্রাদি উত্তমরূপে পরীক্ষা করাতে দেখিলাম যে, পরিহিত পিরানের পকেটে একছড়া সোণার চেন রহিয়াছে। বুঝিলাম, ইহাই ললিতবাবুর চেন; কিন্তু তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “এ চেন আমার। আমি যে ইহা কোথায় পাইয়াছি তাহা আমি এখন বলিব না। আবশ্যক হইলে বিচারালয়ে প্রমাণ উপস্থিত করিব।” 

ইব্রাহিমের মুখের বড়ই জোর। যে তাহাকে জানে না, সে তাহাকে কখনই ধরিতে সমর্থ হয় না। আমি কিন্তু ইহাকে বেশ চিনি, ইহার থাকিবার স্থান প্রভৃতি সমস্তই জানি। সুতরাং এ যতই কেন আপনাকে ভদ্রলোক বলিয়া পরিচয় দিউক না, নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরিয়া মিথ্যা কষ্ট দেওয়া অপরাধে আমার উপর নালিস করিবে বলিয়া, যতই কেন আমাকে ভয় প্রদর্শন করুক না, আমি কিন্তু তাঁহার কোন কথাতেই ভীত বা ভাবিত হইলাম না; বরং উহাকে উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া পথ হইতে আরও দুই একজন কনষ্টেবলকে ডাকিয়া লইয়া, উহার গৃহে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত তৎপর হইলাম। তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদে তাহার থাকিবার স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই গৃহ আমি পূৰ্ব্ব হইতেই চিনিতাম, সুতরাং উহা দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত অপর আর কাহারও সাহায্যের আবশ্যক হইল না। 

ইব্রাহিমকে লইয়া যাইবার কালীন তাহাকে ভাল করিয়া নিষেধ করিয়া দিলাম যে, বাড়ীতে গিয়া সে যেন আমাদিগের বিনা অনুমতিতে কোন কথা না কহে; কিন্তু চোরের স্বভাব যাইবে কোথা? যেমন আমরা সকলে তাহার গৃহের নিকট উপস্থিত হইলাম, অমনি সে চীৎকার শব্দে বলিয়া উঠিল, “গৃহের ভিতর আমার স্ত্রী আছে, একবারে কেহ বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিও না।” 

উহার কথা শুনিয়া আমার আপাদ-মস্তক জ্বলিয়া গেল; ক্রোধ আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিলাম, “তোর স্ত্রী ওমদাকে আর আমি জানি না; সে আজ বড় পরদা-নসীন হইয়াছে?” এই বলিয়া আমরা দ্রুতপদে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

ওমদাকেঘড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করায়, সে আধহাত ঘোমটা টানিয়া রন্ধন-শালার ভিতর প্রবেশ করিল। ইব্রাহিম কহিল, “কি ঘড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।” উহার কথার উত্তর দেওয়া নিষ্প্রয়োজন ভাবিয়া, গৃহের খানা-তল্লাসি আরম্ভ করিলাম। ইব্রাহিমের গৃহ হইতে খানা তল্লাসি করিয়া, এ পর্যন্ত কেহই কোন চোরাদ্রব্য বাহির করিতে সমর্থ হন নাই। চোরাদ্রব্য গৃহের ভিতর রাখিবার পাত্র ইব্রাহিম নহে। তবে সাহসের মধ্যে কেবল এইমাত্র আছে যে, ইব্রাহিম হঠাৎ ধৃত হইয়াছে, সুতরাং তাহার বাটীতে কোনরূপে সংবাদ দিতে সে সমর্থ হয় নাই। 

যে গৃহ ইব্রাহিমের অধিকৃত, উহা একখানি খাপ্‌রেলের গৃহ। আমাদিগের যেরূপ সাধ্য, সেইরূপ ভাবে সেই গৃহে অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। গৃহের ভিতর বাসন হাঁড়ী প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা একে একে দেখিলাম। বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি সমস্ত বাহিরে আনিয়া খুলিয়া খুলিয়া দেখিলাম। বিছানা-তোষক উল্টাইয়া দেখিলাম, লেপ-বালিস ছিঁড়িয়া ফেলিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই ঘড়ীর কোনরূপ চিহ্নই দেখিতে পাইলাম না। গৃহের মেজে খনন করিয়া ফেলিলাম, থাপ্‌রেলের অধিকাংশই উল্টাইয়া ফেলিলাম; তথাপি কিছুই বাহির হইল না। এখন অবশিষ্ট থাকিল—রন্ধনের স্থান। সেইস্থানেও পরিশেষে গমন করিলাম। সেইস্থানও পূর্ব্বের গৃহের মত তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলাম, কিন্তু কোনস্থানেই অপহৃত দ্রব্যের চিহ্নমাত্রও পাইলাম না। একজন স্ত্রীলোককে ডাকাইয়া তাহার দ্বারা ওম্দার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রভৃতি সমস্ত স্থানই অনুসন্ধান করা হইল; কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। যে স্থানে ওম্দা দাঁড়াইয়াছিল, তাহারই পার্শ্বে একটি উনানের উপর একটি বড় হাঁড়ীতে ভাত ফুটিতেছিল। এখন অনুসন্ধান করিতে কেবলমাত্র অবশিষ্ট থাকিল—সেই প্রজ্বলিত উনান। একজন মুসলমান কনষ্টেবলকে উহাও দেখিতে বলিলাম। সে উনান হইতে অগ্নিরাশি বাহির করিয়া ফেলিল; দেখিলাম, তাহার ভিতর কিছুমাত্র নাই। উনানের উপর যে হাঁড়িতে ভাত ফুটিতেছিল, দেখিলাম, সেই মুসলমান কনষ্টেবল একগাছি যষ্টি সেই হাঁড়ির ভিতর দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিল কিন্তু তাহাতেও কিছু পাইল না। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমরা সকলে গৃহ পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক প্রাঙ্গনে আসিয়া উপবেশন করিলাম। আমার মনে কি জানি কেন নিশ্চয় বিশ্বাস হইল, সেই ঘড়ী বাড়ীর ভিতরেই আছে। আর ইব্রাহিম বাহির হইতে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলায়, ওম্দা উহা কোনস্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছে। ওম্দা প্রথমে আমাদিগকে দেখিয়া যে আধহাত ঘোমটা টানিয়াছিল, সেই ঘোমটা ক্রমে ক্রমে ঊর্দ্ধে উঠিতে লাগিল, এবং ক্রমে উহা মস্তচ্যুত হইয়া গ্রীবাদেশ আশ্রয় করিল। উহার সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া ও কথার উত্তর প্রত্যুত্তর শুনিয়া, আমার মনে বড়ই সন্দেহ হইতে লাগিল। পুনরায় অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম, সমস্ত স্থান অন্বেষণ করিয়া পুনরায় দেখিলাম; কিন্তু কোনস্থান হইতে কোন দ্রব্য বাহির হইল না। আমরা যখন অন্যস্থান অনুসন্ধান করিতে নিযুক্ত, সেই সময়ে ওম্দা পুনরায় সেই অগ্নিরাশি একত্র করিয়া উনানের ভিতর দিল, ও ইন্ধন প্রজ্বলিত করিয়া সেইস্থানে বসিয়া ভাত রাঁধিতে লাগিল। আমরা তাহাকে যে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, সে সেইস্থানেই বসিয়া বসিয়া নিতান্ত অবজ্ঞার সহিত আমাদিগের সেই কথার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিবার অভিপ্রায়ে উহাকে বাহিরে আসিতে কহিলাম। সে কিন্তু আমার কথা না শুনিয়া সেইস্থানেই বসিয়া বসিয়া কহিল, “আমি বাহিরে যাইব কেন?” 

ওম্দার এই শেষ কথা শুনিয়া সে সময় আমার একটু ক্রোধের উদ্রেক হইল। তাহাকে একটু ভয় দেখাইবার নিমিত্ত একজন কনষ্টেবলকে ডাকিয়া কহিলাম, “উহার ভাতরান্ধা শেষ করিয়া দেও ত। উনানের উপরের ঐ হাঁড়ী উঠাইয়া আনিয়া, এই নদ্দমার ভিতর ফেলিয়া দাও।” 

আদেশ পাইবামাত্রই সেই কনষ্টেবল মহাপ্রভু প্রকৃতই দ্রুতপদে সেইস্থানে গমন করিয়া, ভাতসমেত হাঁড়ি উঠাইয়া আনিয়া নিষেধ করিতে করিতে সেই প্রাঙ্গনে ঢালিয়া ফেলিল। আমি একটু ক্রুদ্ধ হইয়া দ্রুতপদে সেইস্থানে ‘গমন করিলাম, ইচ্ছা—যদি সমস্ত ফেলিয়া না দিয়া থাকে, তাহা হইলে অবশিষ্ট আর ফেলিতে দিব না। কিন্তু নিকটে গিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে ক্রোধের পরিবর্তে বিস্ময় আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, চোরের স্ত্রীর কথা পূর্ব্বে গল্পে শুনিয়াছি, কিন্তু আজ স্বচক্ষে দেখিলাম যে, চোরের স্ত্রীর কিরূপ অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব! 

দেখিলাম, যে ঘড়ীর আমরা অনুসন্ধান করিতেছিলাম, সেই ভাতের সহিত তাহা রহিয়াছে। ভাত যখন হাঁড়ীর ভিতর ফুটিতেছিল, সে ঘড়ীও তখন তাহারই ভিতর ছিল। চতুরা স্ত্রীলোক ভাবিয়াছিল, যে ভাত ফুটিতেছে, সেই ভাত ফেলিয়া দিয়া সেই হাঁড়ীর ভিতর অনুসন্ধান করা সাধারণতঃ মানব-বুদ্ধির অতীত; সুতরাং এরূপ নিরাপদ স্থান আর নাই। প্রকৃত হইত তাহাই। যদি ওম্দার উপর হঠাৎ আমার ক্রোধের উদয় না হইত, আর সেই কনষ্টেবল আমার আদেশ পাইয়াও যদি এই অমানুষিক ব্যবহার না করিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বলিতে পারি, এ ঘড়ী আমরা কখনই প্রাপ্ত হইতে পারিতাম না। 

যাহা হউক, অতঃপর আমাদিগের কার্য্য উদ্ধার হইল। ইব্রাহিম ও ওম্দা উভয়কেই বন্ধনাবস্থায় সেইস্থান হইতে লইয়া গেলাম। উহাদিগের উভয়েরই উপর মোকদ্দমা রুজু হইল। ললিত বাবুর স্ত্রী, পুত্র এবং অন্যান্য সকলেই সেই ঘড়ী চিনিতে পারিলেন। 

ইব্রাহিমের উপর খুনি মোকদ্দমা প্রমাণ করিতে পারা গেল না; কিন্তু চুরি মোকদ্দমাতেই তাহাকে খুনির দণ্ডগ্রহণ করিতে হইল। ইহার পূর্ব্বে অনেকবার ইব্রাহিম জেলে গিয়াছিল, তাহা আদালতে প্রমাণিত হইলে, তাহাকে আজীবন দ্বীপান্তরে থাকিতে হইবে, ইহাই আদেশ হইল। আর ওম্দা, চোরাদ্রব্য লুকাইয়া রাখা অপরাধে কেবলমাত্র দুই বৎসরের নিমিত্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিতা হইল। 

পূর্ব্বকথিত পত্র সম্বন্ধেও পরিশেষে একটু অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, এবং অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, ভুবনবাবুর সহিত ধরণীবাবুর পরিচয় আছে। তিনি একদিবস ভুবনবাবুর বাড়ীতে কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে গমন করিয়াছিলেন; সেইদিবস ভ্রমক্রমে সেই পত্রখানি তিনি ফেলিয়া আসেন। সেইদিবস হইতে উহা ভুবনবাবুর বৈঠকখানায় ব্রাকেটের উপর পড়িয়াছিল। যে দিবস ললিতবাবু নিমন্ত্রণে গমন করেন, সেই দিবস যে কাগজে তাঁহার টাকা কয়েকটি মোড়া ছিল, তাহা ছিঁড়িয়া যাওয়ায় উক্ত কাগজখানি তিনি ব্রাকেটের উপর হইতে গ্রহণ করেন, এবং উহাতে টাকা কয়েকটি জড়াইয়া পকেটের ভিতর রাখিয়া দেন। 

[ ফাল্গুন, ১৩০০] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *