দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ৯

নবম অধ্যায় 

২৭ ডিসেম্বর, 

বিয়ে শেষে রাত তিনটার দিকে ওশান অ্যাভিনিউতে ফিরল লুজরা। পুরো আসরেই নানান হইচইতে মেতে থাকলেও ভেতর ভেতর জিমির টাকা হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কুরে কুরে খাচ্ছিল জর্জকে। অনুষ্ঠানে আসলে কখনোই মন ছিল না ওর, এছাড়া আরও কিছু উদ্ভট ঘটনার কারণে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে সে। 

ভোজসভা শুরুর আগে বর-কনে আর নিমন্ত্রিত সকলেই ম্যানরের পাশের একটা ছোট্ট গির্জায় গেল। ওখানে বিয়ে পড়ানোর পরেই ম্যানরের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। ফাদার বিয়ে পড়ানো শুরু করতেই হুট করে জর্জের বমি পেতে লাগল। ফাদার স্যানটিনি বিচক্ষণ লোক, দীর্ঘকাল ধরে ‘আওয়ার লেডি অফ মার্টারস রোমান ক্যাথলিক চার্চ’র প্রধান যাজক তিনি। জর্জের অবস্থা খেয়াল করেই বিয়ে পড়া থামিয়ে ওকে পবিত্র পানপাত্রে করে খানিকটা মদ দিলেন উনি। পাত্রে এক চুমুক দিতেই জর্জের মাথা ঘুরে গেল রীতিমতো! 

“এ ভালো লক্ষণ না, কোনোভাবেই না,” ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন ফাদার। ওদিকে জর্জ বলতে গেলে পড়েই যাচ্ছিল, সাথে সাথে জিমি গিয়ে ওর হাতটা ধরল। ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে গির্জার পিছনদিকে দৌড় দিলো জর্জ, ওদিকেই পুরুষদের বাথরুম 

বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল। সবাই ফিরে এলো ম্যানরে। জর্জের অবস্থাও ভালো। “বুঝলে ক্যাথি, গির্জায় ঢোকার সাথে সাথেই আমার খারাপ লাগছিল! এখানে আসতেই সব ঠিক! অদ্ভুত না?” ক্যাথির কানে কানে বলল জর্জ। অনুষ্ঠানটা বেশ ভালোই হলো। প্রচুর খাবার, পানীয় আর মদের আয়োজন ছিল, আইরিশ বিয়ের রীতি অনুযায়ী খাওয়া শেষে যুগল-নৃত্যেরও ব্যবস্থা ছিল। অতিথিরা সবাই বেশ মজা করল। জর্জ অবশ্য আরেকবার বাথরুমে গেছিল, তবে এবার খুব তাড়াতাড়িই ফিরে এলো সে। 

পরবর্তীতে ও আমাদের জানিয়েছে, “পুরো অনুষ্ঠানেই আমার শুধু বাথরুমে যাওয়ার কথা মনে হচ্ছিল। ডায়রিয়া হলে অনেকেরই এমনটা হয়! খুব অস্বস্তি লাগছিল, মনে হচ্ছিল বাথরুমে গেলেই শান্তি পাবো!” 

জিমি আর ওর নবপরিণীতা স্ত্রী ক্যারি ওখান থেকেই বারমুডাতে মধুচন্দ্রিমাতে যাওয়ার কথা। ম্যানর থেকে সরাসরি ট্যাক্সিতে করে লাগার্দিয়া বিমানবন্দরে চলে যাবে ওরা। আর জিমির গাড়িটা চালিয়ে ক্যাথি আর বাচ্চাদের নিয়ে অ্যামিটিভিলে ফিরবে জর্জ। গাড়ি চালাতে হবে বলে বেশি মদ খায়নি সে। 

কিছুক্ষণ পর ম্যানরের ম্যানেজার এলো জিমির কাছে, ভাড়া বুঝে নিতে। জিমি খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়ল, হাজার হলেও সাথে নতুন বউ আছে। ম্যানেজার যদি উলটা-পালটা কিছু বলে বসে? 

যা-ই হোক, জর্জ আর জিমির শ্বশুর মিলে ম্যানেজারকে জিমির টাকা হারিয়ে যাওয়ার কথাটা খুলে বলল। ওরা দু’জন মিলে ম্যানেজারকে অনেক বুঝিয়ে বলল যে বিয়েতে পাওয়া উপহারের টাকা থেকে বাকি টাকাটা দিয়ে দেওয়া হবে। ম্যানেজার এই শর্তে রাজি হলো যে তাকে নগদ টাকাই দিতে হবে, কোনো চেক সে নেবে না। কিন্তু হায়রে জিমির ভাগ্য… কিছুক্ষণ পরেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন ফাদার, উপহারের কাউন্টারে গিয়ে খামগুলো আলাদা করল জর্জ, কিন্তু দেখা গেল বেশিরভাগ খামেই চেক রয়েছে! নগদ টাকা মাত্র পাঁচশ ডলারের মতো। 

সেই পাঁচশ ডলার ম্যানেজারের হাতে তুলে দেওয়ার সাথে সাথে রীতিমতো রেগে গেল লোকটা। জর্জ তাকে চেকগুলোর মধ্যে দুটো পাঁচশ ডলারের চেক নিতে বলল, কিন্তু লোকটার এক কথা। সে নগদ টাকাই নেবে। কথা কাটাকাটিতে কেটে গেল প্রায় আধা ঘণ্টা। অবশেষে ম্যানেজার বলল সে চেক নেবে, কিন্তু সেগুলো হতে হবে বরের কোনো আত্মীয়ের অ্যাকাউন্টের চেক। কী আর করা? অবশেষে জর্জ দুটো পাঁচশ ডলারের চেক দিলো তাকে। একটা ওর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের চেক আরেকটা সিয়োসেটের কোম্পানির অ্যাকাউন্টের চেক। 

সমস্যা হলো, জর্জের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে পাঁচশ ডলার ছিল না। কিন্তু পরের দুটো দিন যেহেতু ছিল শনি আর রবিবার… ব্যাংক বন্ধ। সোমবারের মধ্যে টাকা ব্যাংকে জমা করে দিতে পারবে সে। 

জিমির শ্বশুর তার আত্মীয়দের সাথে আলোচনা করে মেয়ে আর জামাইয়ের মধুচন্দ্রিমাতে খরচ করার মতো টাকা জোগাড় করে ফেললেন। জিমির কপাল ভালো যে বিমানের টিকিট সে আগেই কেটে ফেলেছিল। অনুষ্ঠান পুরোপুরি শেষ হলো রাত দুটোর দিকে। দশ মিনিট পরেই লুৎজরা রওনা দিলো ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার দিকে। 

*** 

বাড়ি ফিরেই সোজা শোবার ঘরে চলে গেল ক্যাথি। জর্জ আগে গেল নৌকা রাখার ছাউনিটা দেখতে, তারপর হ্যারির ঘরের সামনে। তখনও ঘুমাচ্ছিল হ্যারি। 

“হ্যারি,” ডাক দিলো জর্জ। শুধু একটু নড়ল কুকুরটা, কিন্তু চোখ খুলল না। নিচু হয়ে কুকুরটার পিঠ চাপড়ে দিলো জর্জ, তখনই ওর মনে অদ্ভুত একটা খেয়াল এলো… হ্যারিকে কেউ ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয়নি তো? আরে না না, এই অঞ্চলে এমনটা কে করবে? হয়তো ও অসুস্থ। উঠানে পড়ে থাকা আজেবাজে কোনো জিনিস খেয়ে হয়তো পেট খারাপ হয়েছে। কিন্তু পেট খারাপ হলে কি কোনো কুকুর এভাবে ঘুমাতে পারে? উঠে দাঁড়াল জর্জ, সকালেই হ্যারিকে পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ও। নৌকা রাখার ছাউনির দরজা ঠিকমতো লাগানোই ছিল। সদর দরজা বন্ধ করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল জর্জ, তারপর রান্নাঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ মেঝেতে খামটা খুঁজে দেখল… কিন্তু পেল না। 

রান্নাঘরের দরজা-সহ একতলার সব জানালা বন্ধই ছিল। সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে গেল জর্জ, বেজায় ক্লান্ত লাগছে ওর। তারপরেও আজকে ক্যাথিকে একটু ভালোবাসা দিতে হবে… নতুন বাড়িতে তো একবারও হয়নি… নরম বিছানায় শুয়ে থাকা ক্যাথিকে কল্পনা করতে করতে এগিয়ে চলল ও। সেলাইঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ও দেখল দরজাটা একটু ফাঁক করা… নিশ্চয় বাচ্চাদের কাজ! ওদের মধ্যেই কেউ লুকিয়ে ঘরটায় ঢুকেছিল, তারপর বিয়েতে যাওয়ার সময় বন্ধ করতে ভুলে গেছে! সকালে উঠুক সবগুলো, ওদের ধরবে জর্জ। 

ওদিকে বেজায় ঘুম এলেও ক্যাথি জেগে ছিল। জর্জের জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। সন্ধ্যাবেলাতেই ও বুঝে গেছে যে আজ রাতে জর্জ ওকে ভালোবাসা দেবে… জর্জের স্পর্শের জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে আছে মেয়েটা। এই বাড়িতে আসার পর থেকে একবারও ওকে আদর করেনি জর্জ! আশ্চর্য ব্যাপার… জুলাইয়ে বিয়ে হয়েছে ওদের। তারপর প্রায় প্রতিরাতেই নিবিড়ভাবে একে অপরকে ভালোবেসেছে ওরা। কিন্তু ১৮ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাথির ঠোঁটে একটা চুমুও দেয়নি জর্জ! ওর কাছে আসার চেষ্টাই করেনি। আজকে তো জর্জ ওর কাছে আসবেই, হুহু… বাচ্চারাও ঘুমিয়ে পড়েছে, এত লম্বা একটা অনুষ্ঠানের পর বেজায় ক্লান্ত ওরা। ঘরে ঢুকেই জামা আর প্যান্ট খুলতে লাগল জর্জ। ঠোঁট চাটল ক্যাথি, গত কয়েকদিনের দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি আর অভিমান যেন এক মুহূর্তেই গলে পানি হয়ে গেল! 

চট করে ভারী কম্বলটার নিচে ঢুকে পড়ল জর্জ। “আহা, এখানে দেখছি বেজায় আরাম,” এই বলে ক্যাথির গা ঘেঁষে এলো সে, “অবশেষে তোমাকে একা পেলাম। জ্ঞানীরা কী বলে জানো?” 

“কী?” হাসল ক্যাথি। 

“বউকে একা পেলে ছাড়তে নেই,” এই বলে ওকে আরও কাছে টেনে নিল জর্জ।

*** 

ওই রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল ক্যাথি, লুইস ডিফেও আর একটা লোক ওদের বিছানাতে ঘনিষ্ঠভাবে শুয়ে আছে! দৃশ্যটা এতই স্পষ্ট ছিল যে ঘুম থেকে ওঠার পরেও ক্যাথির মনে ছিল। কেন যেন ক্যাথির মনে হলো, ওই লোকটা লুইসের স্বামী না! সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটা থেকে সপরিবারে পালানোর কয়েক সপ্তাহ পর ক্যাথি, ডিফেও পরিবারের পরিচিত একজন আইনজীবীর কাছ থেকে শুনেছিল, লুইস ডিফেওর আসলেই একজন প্রেমিক ছিল! লোকটা একজন বেকার চিত্রশিল্পী, কয়েকমাস সে ডিফেওদের বাড়িটার একটা ঘরে ভাড়া ছিল। মি. ডিফেও সম্ভবত শেষের দিকে জেনে গেছিলেন স্ত্রীর সাথে লোকটির প্রেমের কথা, তাঁর কাছ থেকেই ওই আইনজীবী জেনেছিল ব্যাপারটা। 

সকালে ভ্যানটা নিয়ে বাজার করতে গেল ক্যাথি। কিছুক্ষণ পর জিমির গাড়িটাতে বাচ্চাদের যত্ন করে বসাল জর্জ, সিয়োসেটের অফিসে যেতে হবে। ওখানে অনেক চিঠিপত্র জমেছে, ওগুলো দেখতে হবে। মিসি বলল, “বাবা, হ্যারিকেও নাও।” ওকেও তুলে নিল জর্জ। 

কর্মচারীরা তো অবাক! এতদিন পর ওদের বস অফিসে এসেছেন! তা-ও আবার বাচ্চা-কাচ্চা আর কুকুরটাকে সাথে নিয়ে! সবকিছু দেখেশুনে জর্জ ওদের বলল, “আমি সোমবার থেকে নিয়মিত অফিসে আসছি!” 

বাড়ি এসে ওরা দেখল যে কাঁচা শাক-সবজিতে ফ্রিজ ভরিয়ে ফেলেছে ক্যাথি। মাছ-মাংস আর তৈরি খাবারের কৌটাগুলো একপাশে আলাদা করে রেখেছে, ওগুলো বেসমেন্টের ডিপ ফ্রিজটায় রাখবে। 

“বুঝলে জর্জ,” বিরক্ত কণ্ঠে বলল ক্যাথি, “অ্যামিটিভিলের দোকানগুলোতে জিনিসপত্রের দাম বেশি!” 

“হুম,” মাথা নাড়ল জর্জ, “এমনটাই হওয়ার কথা… ডিয়ার পার্কের চেয়ে অ্যামিটিভিলে অনেক বেশি লোক থাকে, জায়গাটাও বেশি সুন্দর। এখানে সব লোকই প্রায় ধনী। দোকানদাররা সুযোগ তো নেবেই!” 

“দুপুর একটা বেজে গেল! মাংস আর খাবারের কৌটাগুলো ডিপ ফ্রিজে তুলতে হবে, তোমাদের জন্য দুপুরের খাবারও বানাতে হবে! কী যে করি…’ 

“আচ্ছা যাও আজকে আমিই স্যান্ডউইচ বানিয়ে ফেলছি কিছু, তুমি কাজ করোগে।” 

“বলছ?’ 

“হ্যাঁ, তুমি যাও।” 

বেসমেন্টে চলে গেল ক্যাথি। কিছুক্ষণ পরেই সদর দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল। জর্জ দরজা খুলে দেখে ক্যাথির খালা থেরেসা দাঁড়িয়ে আছেন। বিয়ের আগে একবারই ক্যাথিদের বাড়িতে থেরেসাকে দেখেছিল জর্জ। এককালে মহিলা ছিলেন গির্জার সন্ন্যাসিনী। কিন্তু বর্তমানে সংসারী হয়েছেন, তিনটে বাচ্চাও আছে। কী কারণে মহিলা সন্ন্যাস ব্রত ত্যাগ করলেন তা কখনোই জানা হয়নি জর্জের। 

মহিলার বয়স মেরেকেটে ত্রিশের একটু বেশি হবে। বেশ খাটো আর পাতলা। পরনে কালো রঙের মোটা উলের কোট আর রাবারের জুতা। দেখে মনে হচ্ছে বেজায় ক্লান্ত, মুখটা লাল হয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকাল জর্জ, গতকালের চেয়ে আজকের দিনটা বেশ উজ্জ্বল। কিন্তু তারপরেও অ্যামিটিভিলে আশেপাশের অঞ্চলগুলো থেকে ঠান্ডা ঢের বেশি, রীতিমতো কাঁপছেন থেরেসা। 

“আরে আসুন আসুন,” বলে উঠল জর্জ, “এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?” 

“আর বলো না,” মাথা নাড়লেন মহিলা, “বাসে করে তোমাদের অ্যামিটিভিলে এলাম, সেই যে বাস নামিয়ে দিলো… তারপর ওশান অ্যাভিনিউতে আসার জন্য আর কিছুই পেলাম না! হেঁটে এলাম তোমাদের বাড়ি।” 

মহিলাকে বসিয়ে বেসমেন্টে ছুটল জর্জ। ক্যাথি মাছ-মাংস গুছিয়ে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। 

“ক্যাথি, ওপরে এসো, তোমার থেরেসা খালা এসেছে,” বলল জর্জ।

“খালা? এই সময়ে?” অবাক হলো ক্যাথি, “আচ্ছা তুমি খালাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাও। আমি একটু পরেই আসছি।” 

জর্জ এসে দেখে বাচ্চারা তাদের থেরেসা নানির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা কেমন যেন গম্ভীর করে বসে আছেন মহিলা। বাচ্চাদের সামনে এভাবে বসে না কি? খানিকটা বিরক্ত হলো জর্জ। 

“বাবা, আমি আর ক্রিস বাইরে গিয়ে খেলি?” বলল ড্যানি। 

“ঠিক আছে যাও,” মাথা নাড়ল জর্জ, “কিন্তু শোনো বাবা, উঠানের বেড়ার ওপাশে যেন যেয়ো না? ঠিক আছে? 

“আচ্ছা,” বাইরে ছুটল ওরা দু’জন। মিসিও দৌড়ে বেসমেন্টে ওর মায়ের কাছে চলে গেল। 

“ওরা সবাই দেখছি চলে গেল,” ম্লান হাসি ফুটে উঠল থেরেসার মুখে। যেন খানিকটা কষ্ট পেয়েছেন। 

“বাচ্চা মানুষ, চলুন আপনাকে বাড়িটা ঘুরে দেখাই, ক্যাথি একটু পরেই আসছে।” 

একতলার খাবার ঘর আর বিরাট বসার ঘরটা থেরেসাকে ঘুরে ঘুরে দেখাল জর্জ। হুট করেই ও খেয়াল করল যে থেরেসা আসার পর থেকেই বাড়িতে ঠান্ডা বেড়ে গেছে, শুধু তাই নয় কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে একটা ভাব এসেছে। 

“তোমাদের বাড়িটা একটু বেশিই ঠান্ডা না কি?” বলে উঠলেন থেরেসা। 

“হুম,” মাথা নাড়ল জর্জ। মানে থেরেসাও বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা। থার্মোস্টাটের দিকে তাকাল জর্জ, তাপমাত্রা পঁচাত্তর ডিগ্রি দেখাচ্ছে ওখানে। ফায়ারপ্লেসের আগুনে আরও কয়েকটা কাঠ দিতে হবে। 

দোতালায় উঠল ওরা। জর্জ আর ক্যাথির বিছানার পিছনে রাখা আয়নাটা দেখে খানিকটা বিরক্ত হলেন থেরেসা। এককালে সন্ন্যাসিনী ছিলেন তো। কোনো দম্পতির বিছানার আশেপাশে আয়না রাখা ইনারা পছন্দ করেন না, স্বামী-স্ত্রীর একান্ত মুহূর্তগুলো আয়নায় ফুটে ওঠা না-কি ঠিক নয়। জর্জ বলতে যাচ্ছিল যে আয়নাটা ওরা কেনেনি বরং ডিফেওরাই রেখে গেছে। তারপর কী মনে করে যেন বলল না। কী দরকার এত কৈফিয়ত দেওয়ার? তবে সন্ন্যাস ব্রত ছাড়লেও থেরেসার মানসিকতা এখনও বদলায়নি। 

বাকি ঘরগুলোও ঘুরে দেখাল জর্জ। সেগুলোর প্রশংসাই করলেন মহিলা। অবশেষে এলো সেলাইঘরের পালা। ওটার সামনে এসেই কেমন যেন থমকে গেলেন তিনি। মুখ দেখে মনে হলো বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। 

দরজাটা খুলল জর্জ। প্রায় লাফিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন থেরেসা! মুখটা 

রীতিমতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মহিলার! 

“আমি এই ঘরে ঢুকব না!” রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।

“কী ব্যাপার? এমন করছেন কেন?” এই বলে দরজা দিয়ে উঁকি দিলো জর্জ। ভেতরে কিছু দেখেছেন না কি থেরেসা? নাহ, জানালায় কোনো মাছি-টাছি নেই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এই বয়সের মহিলারা বেজায় খুঁতখুঁতে হন। মাছি দেখলে হয়তো উনি বলে বেড়াতেন, “ক্যাথি নিজের নতুন বাড়িটা ঠিকমতো পরিষ্কারও করেনি!” কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে হিমশীতল হাওয়া বেরিয়ে আসছে। এত ঠান্ডা হলো কী করে ঘরটা? থেরেসার দিকে চাইল জর্জ, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। অদ্ভুত ব্যাপার! হলো কী? 

“চলুন আমরা তিন তলায় যাই,” দরজাটা লাগিয়ে দিলো জর্জ। 

তিন তলাতেও একইরকম আরেকটা ঘটনা ঘটল। সবগুলো ঘর দেখা শেষে বাচ্চাদের খেলাঘরের দরজায় এসে থমকে দাঁড়ালেন থেরেসা, “না না, আমি এখানে ঢুকব না। এটা আরেকটা খারাপ জায়গা!” 

“খারাপ বলতে?” অবাক হলো জর্জ। 

“অশুভ!” থেরেসার চোখে কেমন যেন শূন্য দৃষ্টি। 

জর্জ আর থেরেসা নিচে নামার প্রায় সাথে সাথেই মিসিকে সাথে নিয়ে বেসমেন্ট থেকে ফিরল ক্যাথি। খালাকে জড়িয়ে ধরল সে। 

“চলো খালা তোমাকে আমার রান্নাঘর দেখাই,” হাসল ক্যাথি, “জর্জ, বেসমেন্টে আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি কিন্তু। জানো ওখানে একটা দেওয়াল আলমারি খুঁজে পেয়েছি! কেন যে ওটা আগে খেয়াল করিনি। কতগুলো খাবারের ক্যান ওখানে রেখে দেবো। ভাবছি কদিন পর থেকে ওটাকে ভাঁড়ার হিসেবে ব্যবহার করব।” কোনো উত্তর না দিয়ে বসার ঘরে চলে গেল জর্জ, ফায়ারপ্লেসে কাঠ দিতে হবে। 

ওদিকে বাড়িতে আসার আধ ঘণ্টা হতে না হতেই থেরেসা যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেল ক্যাথির, ভেবেছিল যে ওর 

খালা রাতের খাবার খেয়ে যাবেন। 

“রাতের খাবার খেয়ে যাও খালা,” বলল সে, “জর্জ গাড়িতে করে তোমাকে রেখে আসবে?” 

কিন্তু থেরেসা শুনলেনই না। 

“এখানে খুব খারাপ কিছু একটা আছে ক্যাথি,” ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে চোখ বোলালেন তিনি, “আমাকে এখনই যেতে হবে।” 

“কিন্তু থেরেসা খালা, বাইরে অনেক ঠান্ডা, তুমি একটু পরে যেয়ো?”

“না না, আমি এখনই যাব। জর্জকে ডাকো,” তাড়াতাড়ি নিজের কোটটা পরে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। তখনই একটা নতুন ছেলেকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল ড্যানি আর ক্রিস। 

জর্জের সাথে করমর্দন করে, ক্যাথির গালে আলতোভাবে চুমু খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন থেরেসা। অবাক হয়ে চেয়ে রইল বাচ্চারা। জর্জ আর ক্যাথির মুখেও কথা নেই। হুট করে কী হলো থেরেসার? 

 “বাচ্চাদের সামনে এভাবে না গেলেও পারতেন উনি,” আস্তে করে বলল জর্জ।

“আরে ক্রিস, ড্যানি… তোমাদের নতুন বন্ধুর কী নাম?” জর্জের কথায় কান না দিয়ে বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে গেল ক্যাথি। 

“মা, এর নাম ববি, একটু আগেই দেখা হলো আমাদের,” বলল ক্রিস, “একটু সামনেই ওদের বাড়ি।” 

 “হ্যালো ববি,” হাসল ক্যাথি। ড্যানির বয়সি হবে ছেলেটা, মাথাভরতি কালো চুল।

“হাই,” একটু সংকোচের সাথে হাতটা বাড়িয়ে দিলো ববি। করমর্দন করে জর্জকে দেখিয়ে ক্যাথি বলল, “ইনি মি. লুজ, আমার স্বামী।” 

মৃদু হেসে ছেলেটার সাথে করমর্দন করল জর্জ, তারপর বলল, “তোমরা তিন জন ওপরে গিয়ে খেলো? না কি?” 

চুপ করে কিছুক্ষণ ঘরটার আশেপাশে চোখ বোলাল ববি, তারপর বলল, “নাহ, ঠিক আছে। আমি এখানেই খেলব।” 

“এখানে? হলঘরে?” অবাক হলো ক্যাথি। 

“হ্যাঁ ম্যাম।” 

“আহা, আমাকে ম্যাম বলার দরকার নেই। মিসেস লুৎজ বললেই হবে, আন্টিও বলতে পারো,” এই বলে জর্জের দিকে তাকাল ক্যাথি, ওর চোখে উঁকি মারছে না বলা কিছু প্রশ্ন, “এই বাড়ির সমস্যা কী? কেন সবাই এখানে অস্বস্তি বোধ করে? কেন এখানে এত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে?” 

পরবর্তী আধা ঘণ্টা বাচ্চা তিনটে হলঘরের মেঝেতেই খেলল। ড্যানি আর ক্রিসের বড়োদিনে পাওয়া খেলনাগুলো বেজায় পছন্দ হয়েছিল ববির। জর্জ অবাক হয়ে খেয়াল করল যে ববি ওর পরনের জ্যাকেটটা খুলছে না! যা-ই হোক, ক্যাথি বেসমেন্টে ফিরে গেল, নিজের নতুন ভাঁড়ার সাজাতে… আর জর্জ ফায়ারপ্লেসের সামনে। কিছুক্ষণ পরেই ববি উঠে দাঁড়াল, তারপর ড্যানি আর ক্রিসকে বলল, 

“আমি বাড়ি যাব!” 

সেই যে গেল, আর এলো না। ‘ববি’ নামের ‘একটু সামনের বাড়ির’ ছেলেটার ওটাই ছিল ১১২ নম্বর বাড়িটাতে প্রথম আর শেষ আগমন। এরপর ওকে আর কখনোই লুজরা দেখেনি। 

বাড়িটার বেসমেন্ট ৪৩ ফুট লম্বা আর ২৮ ফুট চওড়া। সিঁড়ি দিয়ে নামলে ডানদিকে যে দরজাটা পড়ে তার ভেতরেই রয়েছে অয়েল বার্নার, গরম পানির হিটার, ডিপ ফ্রিজ, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র আর ড্রায়ারগুলো। সবই ডিফেওদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি। 

সিঁড়ির বাঁ-দিকে আরেক সারি দরজা। তার মধ্যে আটাশ ফুট লম্বা আর এগারো ফুট চওড়া একটা ঘর। খুবই সুন্দর আর সাজানো-গোছানো ওটা, সম্ভবত বাচ্চাদের খেলাঘর হিসেবে জায়গাটা ব্যবহার করত ডিফেওরা। দেওয়ালে আখরোট কাঠের প্যানেল বসানো, সিলিংয়ে বেশ কয়েকটা ফ্লুরোসেন্ট বাল্ব। এই ঘরটাকেই অফিস বানানোর ইচ্ছা জর্জের। 

সিঁড়ির ঠিক নিচে ফাঁকের মধ্যে দেওয়াল আলমারিটা, যেটার কথা ক্যাথি বলছিল। ওটার ডানদিকে আরেকটা খাঁজের মতো জায়গা দেওয়ালের প্রায় সাত ফুট গভীরে ঢুকে গেছে, তারপরেই প্লাইউডের দেওয়ালে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কাঠের তাক লাগানো সেখানে। হয়তো এককালে কেউ এখানে রান্না করত। ক্যাথি টিনগুলো তাকে সাজিয়ে রাখছিল। “ভাঁড়ার ঘর হিসেবে জায়গাটা ভালোই,” মনে মনে ভাবল জর্জ, “ক্যাথির পছন্দের তুলনা নেই। অন্য কিছু করলে জায়গাটা নষ্ট হতো। রান্নাঘর থেকে খুব সহজেই তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসা যাবে।” 

ওপরে চলে এলো জর্জ। 

বেশ মন দিয়ে কাজ করছিল ক্যাথি। মেয়েটার এই একটা গুণ, যে-কোনো কাজ খুব মন দিয়ে করে। ঠিক তখনই ভারী টিনের কৌটার ওজন সহ্য করতে না পেরে ক্যাঁচ করে একটা তাক ভেঙে পড়ল! ক্যাথি খেয়াল করল পিছনের প্লাইউড একটু যেন ফাঁক হয়ে গেছে। কৌটাটা সরিয়ে ভাঙা তাকটাতে ধাক্কা মারল ক্যাথি, আরও খানিকটা ভেতরে ঢুকে গেল ওটা। 

এগিয়ে গেল ক্যাথি। মোটামুটি পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছিল জায়গাটাতে, সেই আলোতে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল যে ফাঁক হয়ে যাওয়া প্লাইউডের ওপাশে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে! এমনটা তো হওয়ার কথা নয়… সিঁড়ির নিচে ফাঁকা জায়গা! নকশাতে তো এমন ছিল না। 

ওপরে উঠে জর্জকে ডেকে নিয়ে এলো ক্যাথি 

জর্জ এসে তাকটায় ঠেলা দিলো। আরও খানিকটা পিছনে সরে গেল সেটা।

“এখানে তো এমন কিছু থাকার কথা না!” অবাক হয়ে ক্যাথিকে বলল সে, “তারপরেও আমি দেখছি। “ 

তাড়াতাড়ি চারটে কাঠের তক্ত নামিয়ে মাটিতে রাখল সে। তারপর জোরে ধাক্কা মারল প্লাইউডের দেওয়ালে। সাথে সাথে সরে গেল খানিকটা অংশ… ওটা একটা গোপন দরজা! 

পিছনে একটা ছোট্ট ঘর। চার ফুট লম্বা, পাঁচ ফুটের মতো চওড়া। চমকে উঠল ক্যাথি… মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরো ঘরটাই টকটকে লাল রং করা! 

“এখানে ঘর, এটা আসলে কী জর্জ?” জর্জের হাত খামচে ধরল ক্যাথি 

“বুঝতে পারছি না,” ঘরের দেওয়ালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল জর্জ, “হয়তো লুকিয়ে থাকার জন্য বানানো হয়েছিল ঘরটা। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বোমার হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই বাড়িতে এমন ঘর বানাত বলে শুনেছি। কিন্তু এডিথ আমাদের বাড়ির যে নকশাটা দিয়েছিলেন তাতে তো এই ঘরটা ছিল না! দেওয়ালটা দেখছি ইটেরই তৈরি, মানে ওপাশে আর কোনো গোপন ঘর নেই।” 

“তোমার কি মনে হয়? ডিফেওরা বানিয়েছিল এটা?” জর্জের হাতটা আরও জোরে চেপে ধরল ক্যাথি। 

“সেটা তো আমি বলতে পারব না ক্যাথি, বানাতেও পারে!” ক্যাথিকে প্রায় টানতে টানতে ঘরটা থেকে বার করে নিয়ে এলো জর্জ, তারপর লাগিয়ে দিলো প্লাইউডের দরজাটা, “কিন্তু ওদের কী কাজে লাগত এই ঘর?” 

“তোমার কী মনে হয় জর্জ? আর কোনো দেওয়াল আলমারির পিছনে এমন ঘর আছে?” ফিসফিসিয়ে বলল ক্যাথি। 

“সেটাও বলতে পারছি না ক্যাথি,” হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল জর্জ, “এখন তো মনে হচ্ছে এই বাড়ির প্রতিটা দেওয়ালই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।” 

“আচ্ছা, ওই ঘরে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছিলে কি তুমি?” 

“হ্যাঁ পেয়েছি,” মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল জর্জ, “বাসি রক্তের গন্ধ অমন হয়।” 

“জর্জ, এই বাড়িটা আমার কেন যেন ঠিক লাগছে না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যাথি, “এখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে! এসব কেন ঘটছে?” 

জর্জ খেয়াল করল যে ক্যাথি নিজের বাম হাতের বুড়ো আঙুল চুষছে। ভয় পেলে এমনটা করে ও. মিসিও মায়ের স্বভাব পেয়েছে। 

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পিছনে আলতো করে একটা চাপড় মারল জর্জ, “ভয় পেয়ো না সোনা। ওই ঘরটা কে বা কারা… কেন তৈরি করেছিল তা আমি খুঁজে বের করবোই। দেখে নিয়ো। কিন্তু ঘরটা ফেলে রেখে কী লাভ? ওটাকেই বরং ভাঁড়ার ঘর বানাও? কী মনে হয়? প্লাইউডের গোপন দরজাটার দিকে তাকিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো জর্জ। সবকিছু অন্ধকার হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে জর্জের মনে হলো দাড়িওয়ালা একটা লোক যেন দরজাটার সামনে দাঁড়িয়েছিল! চোখের ভুলও হতে পারে!”

ওটা যে রনি ডিফেওর ছায়ামূর্তি তা বুঝতে আরও কয়েকদিন লেগেছিল জর্জের! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *