দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ৮

অষ্টম অধ্যায় 

২৬ ডিসেম্বর। 

ঠিক সোয়া তিনটার দিকে আবার ঘুম ভেঙে গেল জর্জের। পায়জামাটা বদলে জ্যাকেট পরে বাইরে বের হলো সে। গভীর অন্ধকার আর হিম ঠান্ডা… এর মধ্যে কেন বার বার বের হয় সে? “প্রতিদিন রাতে কী খুঁজতে আমি এই ছাউনির কাছে আসি? কী আছে এখানে?” আপনমনেই বলে উঠল সে। এসব ভাবতে ভাবতেই হ্যারির ঘরের কাছে কিছু আলগা তারের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল জর্জ… অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। তবে মোটামুটি জোরেই একটা আওয়াজ হলো। জর্জ অবাক হয়ে খেয়াল করল এতকিছুর পরেও হ্যারির ঘুম ভাঙল না! 

ডিয়ার পার্কে থাকার সময়েও বাড়ির বাইরের একটা ঘরেই থাকত হ্যারি। সব আবহাওয়াতেই বাইরে থাকতে অভ্যস্ত কুকুরটা, সাধারণত রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত টানা জেগে থাকত সে, তারপর ঘুমাত। আশেপাশে ‘উঁ’ শব্দটা হলেও খেঁকিয়ে উঠত। কিন্তু ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে আসার পর থেকে কেন যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায় কুকুরটা। সন্ধ্যার পর থেকেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে, ডাকলেও উত্তর দিতে চায় না। জর্জ যখন নৌকা রাখার ছাউনিটা দেখতে আসে, বেশিরভাগ সময়ই হ্যারি উঠে না। একবার তো ডাক দিয়ে ওর ঘুম ভাঙিয়েছিল জর্জ। 

*** 

বড়োদিনের পরের সকালের কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে জর্জের। ওটার ছিল জিমির বিয়ের দিন। মারাত্মক ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিল সেদিন সে। রাতের বেলা নৌকা রাখার ছাউনি থেকে ঘরে আসার পথেই পেট ব্যথা শুরু হয় ওর, প্রথম দিকে ব্যথাটা এতই অসহ্য ছিল যে জর্জের মনে হচ্ছিল ওর পেটে কেউ রীতিমতো ছুরি চালাচ্ছে! প্রচণ্ড বমি আসতে লাগল, রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল সে। পেট ব্যথা ততক্ষণে বদলে গেছে মলত্যাগের চাপে। বাড়িতে ঢুকেই একতলার বাথরুমটার দিকে দৌড় দিলো সে। 

বাথরুম থেকে বেরোতেই আবার মলত্যাগের চাপ! এভাবেই ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত অসংখ্যবার বাথরুমে যেতে হলো তাকে। অবশেষে পেট কিছুটা শান্ত হলো, খানিকটা কুনকুনে ব্যথা যদিও রয়ে গেল। শ্রান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলো জর্জ, সাথে সাথে ঘুম। অল্প একটু পরেই ওকে ডেকে তুলল ক্যাথি, “মনে আছে তো জর্জ? আজ জিমির বিয়ে। সকালে ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেবে আর সন্ধ্যায় আমরা যাব। ও নিজেই আমাদের নিতে আসবে। তার আগে অনেক কাজ বাকি রয়েছে। আমি চুলটা ঠিক করে নিই, জামা-কাপড় বের করারও ব্যাপার আছে… রান্নাও আছে… গেলাম। তুমি থাকো, কেমন?” 

“হুম,” আধো ঘুম চোখে গজগজ করে উঠল জর্জ। 

নাস্তা বানাতে যাওয়ার আগে ক্যাথি একবার তিন তলায় বাচ্চাদের খেলাঘরটা দেখতে গেল। দরজা খোলার সাথে সাথে হিমশীতল বাতাসে রীতিমতো কেঁপে উঠল ক্যাথি… ঘরটা এখনও ঠান্ডা আছে, তবে গতরাতের মতো নয়। জর্জ উঠলে ওকে বলতে হবে এই ঘরের রেডিয়েটরটা একবার পরীক্ষা করে দেখতে। কী যে হয়েছে জর্জের… ফায়ারপ্লেসের সামনে থেকে নড়তেই চায় না। ক্যাথি নিজেই দেখল রেডিয়েটরটা…আরে ওটা তো চলছে! কিন্তু তারপরেও ঘরে কোনো তাপ নেই। 

নাহ, এই স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা ঘরে বাচ্চারা আজ খেলতে পারবে না। কিন্তু আজ ওরা ঘরে থাকলেও সমস্যা। মন দিয়ে কি আর ক্যাথিকে সাজগোজ করতে দেবে? তার চেয়ে ওরা বরং বাইরেই খেলুক, ততক্ষণে তৈরি হয়ে নেবে ক্যাথি, তারপর ওদের ডেকে একে একে জামা-কাপড় পরিয়ে দেবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে, জমে থাকা তুষার গলে থকথকে তরলের মতো হয়ে আছে চারদিকে! নাহ, তাহলে আজ বাচ্চারা বাইরেও যেতে পারবে না। তার চেয়ে ওরা ওদের শোবার ঘরেই খেলুক আজ। 

*** 

খাওয়া শেষে মায়ের কথামতো নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল মিসি। ক্যাথি ওকে মনে করিয়ে দিলো, কোনোভাবেই যেন সেলাইঘরে না যায়, এমনকি দরজাও যেন না খোলে। 

“ঠিক আছে মা,” হাসল মিসি, “জোডি আজকে আমার ঘরেই খেলতে চাইছে।” 

“আহা সোনা মেয়ে আমার,” মুচকি হাসল ক্যাথি, “যাও, গিয়ে বন্ধুর সাথে খেলো।” ওদিকে বাড়ির ভেতর খেলা নিয়ে বেজায় নারাজ ড্যানি আর ক্রিস। বড়োদিনের ছুটি তো মাত্র ক’টা দিন, তারপরেই আবার নতুন স্কুলে ভর্তি হবে ওরা… তখন কি এভাবে খেলার সুযোগ পাবে? মায়ের সাথে রীতিমতো তর্কাতর্কি শুরু করল ওরা। অবাক হয়ে গেল ক্যাথি, ওরা এমন ছিল না! নতুন বাড়িতে আসার পর থেকে দুই ছেলেই কেমন বদলে গেছে। 

কিন্তু ক্যাথি এটা ভুলে যাচ্ছিল যে সে-ও কিন্তু এই বাড়িতে এসে বদলে গেছে। আগের চেয়ে অনেক অস্থির হয়ে গেছে, সেই সাথে মেজাজটাও বেশ খিটখিটে হয়েছে। 

“হয়েছে, অনেক ন্যাকামো হয়েছে,” ধমকে উঠল ক্যাথি, “আরেকবার মার না খেলে হচ্ছে না? তাই না? আর একটাও কথা নয়। যা বলছি তা-ই করো, সোজা তিন তলায় নিজেদের ঘরে চলে যাও। আর আমি ডাকা না পর্যন্ত নামবে না। 

মুখ গোমড়া করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ড্যানি আর ক্রিস। মাঝপথে জর্জের সাথে দেখা হয়ে গেল তাদের। পাশ কাটিয়ে নেমে গেল জর্জ, যেন বাচ্চাদুটোকে দেখতেই পায়নি। ওরা দু’জনেও জর্জকে ‘সুপ্রভাত’ জানাল না! 

খাবার টেবিলে বসে কফির কাপে চুমুক দিতেই জর্জের পেটে আবার কামড় শুরু হলো। রীতিমতো পেট খামচে ধরে ওপরতলায় ছুটল সে। “শোনো জর্জ, আজকে কিন্তু তোমাকে দাড়ি কামিয়ে গোসল করতে হবে, কোনো অজুহাত শুনব না,” চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি। তাড়াহুড়ো করে ওপর তলায় উঠে বাথরুমের দিকে ছুটল জর্জ, ওদিকে মাথায় হাত দিয়ে ক্যাথি ভাবতে লাগল, “জর্জ কি আমার কথা শুনেছে?” 

এক কাপ কফি শেষ করে রান্নাঘরে বসে বাজারের ফর্দ বানাতে লাগল ক্যাথি। বাচ্চাদের জামাকাপড় কিনতে হবে; ফ্রিজটাও একটু আগে খুলে দেখেছে সে, খাওয়ার অনেক জিনিসই কিনতে হবে। রুটি আর আটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ক্যাথি জানে, এসব ওকে নিজেই গিয়ে কিনে আনতে হবে। জর্জের ভরসায় থেকে লাভ নেই। ডিফেওদের যে বড়ো ডিপ ফ্রিজটা ওরা বিনামূল্যে পেয়েছিল ওটা এবার কাজে লাগবে। বেসমেন্টে ওটা রেখেছে জর্জ। ওতে বেশ খানিকটা মাংস আর অনেকগুলো খাবারের কৌটা এঁটে যাবে। বাথরুম পরিষ্কার করার জিনিসপত্রও শেষ। টানা কয়েকদিন ধরে কমোডের বেসিনগুলো ঘষেছে সে, কালো দাগগুলো এখন আর নেই-ই বলতে গেলে। 

ক্যাথি ঠিক করল যে পরেরদিন, মানে শনিবার সকালে ও অ্যামিটিভিল সুপারমার্কেটে যাবে। বাচ্চারা কমলার জুস অনেক পছন্দ করে, ওটার কথা লিখতে ভুলে গেছিল ক্যাথি। তাড়াতাড়ি লিখে ফেলল ও… আর ঠিক তখনই ওর মনে হলো রান্নাঘরে সে ছাড়াও আর কেউ আছে! গট গট করে কে যেন হেঁটে গেল ওর পাশ দিয়ে। ক্যাথির হুট করেই মনে পড়ে গেল সেই ‘অদৃশ্য আলিঙ্গন’র কথা! সংসারের নানান ঝামেলায় ব্যাপারটা রীতিমতো ভুলতে বসেছিল সে! ভয়ে রীতিমতো জমে গেল ও… ভয়ে ভয়ে পিছে তাকাল ও। নাহ, কেউ নেই। কিন্তু আরেকজনের উপস্থিতি টের পাচ্ছে সে! ঠিক ওর পিছে এসে যেন দাঁড়িয়েছে কেউ… মিষ্টি একটা গন্ধ পেল, কোনো অজানা পারফিউমের গন্ধ! গন্ধটা চিনতে বেশি সময় লাগল না ক্যাথির, চার দিন আগে শোবার ঘরে এই গন্ধটাই পেয়েছিল সে! 

সহসা আঁতকে উঠল ক্যাথি! অদৃশ্য দুটো হাত যেন ওর কোমর জড়িয়ে ধরছে। খুব আলতো সে স্পর্শ, কোনো মহিলা যেন আদর করে ধরেছে ওকে… খানিকটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল ক্যাথি। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে, ওই অদৃশ্য মানুষটা কোনো ক্ষতি করবে না। গন্ধটা ধীরে ধীরে বেড়ে চলল, যেন বাতাসে পাক খেয়ে বারবার ফিরে আসছে ওটা। ক্যাথির মাথাটা ঝিমঝিম করছে… নিজেকে সেই অদৃশ্য হাতদুটো থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল সে, কিন্তু সাথে সাথে ও-দুটো যেন আরও শক্ত করে চেপে বসল! ক্যাথির মনে হলো ফিসফিস করে ওকে কেউ কিছু বলতে চাইছে… ঘোর লাগা ভাবটা ততক্ষণে কেটে গেছে। এখান থেকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক। 

“নাআআআ,” চেঁচিয়ে উঠল সে, “ছাড়ো… ছাড়ো আমাকে, ঈশ্বরের দোহাই লাগে!” মরিয়া হয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগল। কিন্তু অদৃশ্য হাতদুটো আরও জোরে চেপে ধরল ওর কোমর। তখনই কাঁধের ওপর আরেকটা হাতের স্পর্শ অনুভব করল ক্যাথি। যেন কোনো মহিলা পরম মমতায় ওকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, “কোনো ভয় নেই মেয়ে, কিচ্ছু হবে না তোমার!” একদম সেদিনের মতো! 

তারপরেই সব ঠিকঠাক! কেউ ক্যাথির কোমর ধরে নেই… ওর কাঁধেও হাত দিয়ে নেই। রয়ে গেল শুধু সেই সস্তা পারফিউমের গন্ধটা। চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো ক্যাথি, নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ওর। চোখ বুজে কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা, এ কীসের মধ্যে এসে পড়ল সে? এসব কী হচ্ছে? ঠিক তখনই একটা হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করল। 

“হে ঈশ্বর! না না… আবার না,” রীতিমতো লাফিয়ে উঠল ক্যাথি। 

মিসি দাঁড়িয়েছিল পাশে, হাতটা ও-ই রেখেছিল। 

“আরে মিসি,” মেয়েটাকে কাছে টেনে নিল ক্যাথি। 

“মা, তুমি কেঁদো না,” ওর কাঁধে চাপড় মেরে বলল মিসি। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকাল, ক্যাথিও তাকাল সেদিকে। জায়গাটা ফাঁকা। 

“জোড়ি তোমাকে কাঁদতে মানা করেছে,” হাসল মিসি, “ও বলেছে খুব তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে!” 

*** 

সেদিন সকাল নয়টায় সেক্রেড হার্ট রেক্টরিতে ফাদার ম্যানকুসোর ঘুম ভাঙল। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপলেন তিনি, তাপমাত্রা এখনও একশ তিন ডিগ্রি! বেলা এগারোটার দিকে হুট করেই শরীরটা ভালো হয়ে গেল ফাদারের। পেটে আর ব্যথা নেই, মাথাটাও আর ঝিমঝিম করছে না। তাড়াতাড়ি জিভের নিচে থার্মোমিটার লাগিয়ে দেখলেন তিনি, তাপমাত্রা- ৯৮.৬ ডিগ্রি। আর জ্বর নেই! 

খুব খিদে পেয়েছে ফাদারের। মনে হচ্ছে একটা আস্ত খাসির বাচ্চাও খেয়ে ফেলতে পারবেন তিনি। না না, এই অবস্থায় মাংস খাওয়া চলবে না, নিরামিষই খেতে হবে। তাছাড়া জ্বর সেরে যাওয়ার পর বেশি খাওয়া ঠিক নয়। রান্নাঘরে চা আর টোস্ট বানাতে বানাতে ফাদার ভাবতে লাগলেন গির্জার বাকি কাজগুলোর কথা, আজ বেজায় চাপ যাবে ওনার ওপর। জর্জ লুজের কথা একবারও মনে এলো না তার। 

*** 

ওদিকে জর্জেরও ফাদার ম্যানকুসোর কথা ভাবার সময় নেই। শুধু কী তাই? ক্যাথি কিংবা ওর নিজের শালার বিয়ে নিয়েও ভাবতে পারছে কই সে? বেলা এগারোটা বাজতে বাজতে তাকে প্রায় দশবার বাথরুমে যেতে হয়েছে। 

বেশ শক্ত রকমের ডায়রিয়া হয়েছে। 

কুইন্সের অ্যাসটোরিয়া ম্যানরে জিমির বিয়ে এবং বিয়ে পরবর্তী প্রীতিভোজ অনুষ্ঠিত হবে। প্রায় পঞ্চাশ জন দম্পতি আসবে অনুষ্ঠানে। নিতবর হিসেবে জর্জের অনেক কাজ রয়েছে, কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? কোনোমতে ফায়ারপ্লেসের সামনে রাখা চেয়ারটায় গিয়ে বসল সে। 

তখনই ক্যাথি এসে বলল, “জর্জ তোমার সিয়োসেটের অফিস থেকে একজন ফোন দিয়েছে। লোকটা জানতে চাচ্ছে কবে থেকে তুমি আবার অফিসে যাবে? তোমাকে ছাড়া কিছু ভূমি জরিপের কাজে সমস্যা হচ্ছে, ওরা না-কি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আর কিছু ভবনের ঠিকাদাররাও না-কি নালিশ করেছে। আরেকটা কথা বলার ছিল তোমাকে…” 

“থামো, এখন আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করছে না, যাও রান্নাঘরে যাও, “ হাত নাড়ল জর্জ। 

রান্নাঘরে সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলতে চাচ্ছিল ক্যাথি। কিন্তু জর্জ তো শুনতেই চায় না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ক্যাথির। জর্জকে এই ক’দিনে পুরো আলাদা মানুষ মনে হচ্ছে! ঠিক তখনই তিন তলার ঘর থেকে ড্যানি আর ক্রিসের চিৎকারের শব্দ এলো… আবার মারামারি লাগিয়েছে ছেলেদুটো। নাহ, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না, দু’জনকেই আচ্ছা করে বকে দিতে হবে… সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল ক্যাথি, তখনই ওকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত উঠে গেল জর্জ। অবাক হয়ে ক্যাথি খেয়াল করল যে জর্জ একবারে দুটো করে ধাপ টপকাচ্ছে… এভাবে তো কখনোই ওপরে উঠে না ও! 

ওর পিছে পিছে যেতে আর সাহস হলো না ক্যাথির। চুপচাপ সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে। কিছুক্ষণ পরেই হুংকার দিয়ে উঠল জর্জ… আবার মন খারাপ হয়ে গেল ক্যাথির। এভাবে বাচ্চাদের আগে কখনও বকেনি জর্জ। কয়েক মিনিট এভাবেই চলল, তারপর সব চুপচাপ। ড্যানিদের শোবার ঘরের দরজা দড়াম করে বন্ধ হবার শব্দ হলো। সিঁড়ি দিয়ে জর্জের নেমে আসার শব্দ হচ্ছে, মাঝামাঝি আসতেই ক্যাথির সাথে চোখাচোখি হলো ওর। অবাক দৃষ্টিতে দু’জন দু’জনকে দেখতে লাগল… কিন্তু কারও মুখে কোনো কথা নেই। ঘুরে দোতালার শোবার ঘরটায় চলে গেল জর্জ, এটার দরজাও বেশ জোরে লাগিয়ে দিলো সে। 

আধা ঘণ্টা পর নিচে নেমে এলো জর্জ। নয় দিনের মধ্যে এই প্রথম সে দাড়ি কামিয়ে গোসল করেছে, পরনেও পরিষ্কার জামা-কাপড়। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে সে। ওখানে তখন ক্যাথি বসেছিল মিসির সাথে। চুপচাপ দুপুরের খাবার খাচ্ছিল মিসি। 

“ক্যাথি, তুমি মিসি আর দুই ছেলেকে বিকাল পাঁচটার মধ্যে জামা-কাপড় পরিয়ে তৈরি রাখবে,” এই বলে ক্যাথি কোনো জবাব দেওয়ার আগেই সেখান থেকে চলে গেল সে। 

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে জিমি সবাইকে নিতে এলো। 

“জিমি, এলে তবে তুমি? আমি ভেবেছিলাম আসবে না,” মজা করল ক্যাথি। “আরে কী বলো। দুলাভাই না নিতবর? ওনাকে ছাড়া চলে?” হেসে উঠল জিমি। সাতটার মধ্যে ওদের অ্যাস্টোরিয়া ম্যানরে পৌঁছতেই হবে। অ্যামিটিভিল থেকে কুইন্সে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো রাস্তা হলো সানরাইজ হাইওয়ে। ওখান দিয়ে অ্যাস্টোরিয়া ম্যানরে যেতে বড়োজোর একঘণ্টা লাগে। কিন্তু বরফে ভরতি রাস্তার কারণে দেরি হতেই পারে… আর তাছাড়া শুক্রবার রাতে হাইওয়েতে প্রচুর ভিড় হয়। তাই জিমি একটু আগেভাগেই চলে এসেছে, বিয়ে বলে কথা! 

মিলিটারি পোশাকে বেজায় চমৎকার দেখাচ্ছে জিমিকে, খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আছে ওর। 

“আহারে আমার ভাইটা, একদম বর বর দেখাচ্ছে,” এই বলে আহ্লাদে ভাইয়ের কপালে একটা চুমু খেলো ক্যাথি, তারপর বলল, “রান্নাঘরে বসো, জর্জ ওপরে কাপড় পরছে… কিছুক্ষণের মধ্যেই নামবে। “ 

রেইনকোটটা খুলে রাখল জিমি, তারপর ওটার পকেট থেকে একটা খাম বের করল, “এতে পনেরশ ডলার আছে, অ্যাস্টোরিয়া ম্যানরের বাকি ভাড়াটা। বেশিরভাগ টাকা তো কয়েকমাস আগেই দিয়ে দিয়েছি, বুঝলে? এটুকুই বাকি ছিল। আজ ব্যাংক থেকে তুলে আনলাম। অ্যাকাউন্টে বলতে গেলে আর টাকাই নেই! যা-ই হোক… বিয়েটা শেষ করি, তারপর ভাবা যাবে এসব নিয়ে।” 

টাকাগুলো বের করে ক্যাথিকে দেখাল সে, তারপর সেগুলোকে আবার খামে ভরে খামটাকে রেইনকোর্টের পকেটে রেখে ওটাকে পাশের চেয়ারের ওপর রেখে দিলো। 

অবশেষে জর্জ নামল। টাক্সেডোতে বেশ মানিয়েছে ওকে। বহুদিন পর গোসল আর দাড়ি কামানোর জন্য আরও অসাধারণ লাগছে দেখতে, যদিও ডায়রিয়ার কারণে মুখটা একটু ফ্যাকাশে হয়ে আছে। জিমিকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকল জর্জ। ফায়ারপ্লেসটা ভালো করে পরীক্ষা করল সে, একটু আগে দেওয়া শেষ গুঁড়িটা পুড়ে গেছে। তারপরেও দেখতে লাগল যে ছাইয়ের আড়ালে কোনো কাঠ পড়ে আছে না-কি! 

ওর এমন আচরণে একটু অবাকই হলো জিমি, কিন্তু কিছু বলল না। 

বাচ্চারাও ততক্ষণে তৈরি হয়ে চলে এসেছে। ক্যাথি ওপরে গেছে নিজের কোটটা আনতে। কিছুক্ষণ পরেই নিচে নেমে এলো সে। জিমি দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেল রেইনকোনটা আনার জন্য। 

ওটা কাঁধে নিয়ে আবার বসারঘরে ফিরে এলো সে। তারপর পরে নিল।

“তো? সবাই প্রস্তুত?” হাসল জর্জ। 

“আরে আমি তো অনেকক্ষণ আগে থেকেই তৈরি, আপনারাই না দেরি করলেন,” এই বলে নিজের অজান্তেই রেইনকোটের পকেটে চাপড় মারল জিমি। পরক্ষণেই যেন জমে গেল সে… তাড়াতাড়ি পকেটে হাত ঢোকাল… পকেট খালি! আরেকটা পকেটেও হাত দিলো সে, কিন্তু ওখানেও কিছু নেই! কোটটা খুলে ঝাঁকাল। তারপর নিজের মিলিটারি পোশাকের প্রতিটি পকেট ভালো করে দেখল ও… কিন্তু সেখানেও খামটা নেই! 

টাকাগুলো নেই! 

রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিলো জিমি, ওর পিছে পিছে ক্যাথি আর জর্জ। তিন জন মিলে তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখল জায়গাটা, এরপর বসার ঘর আর উঠানের প্রায় প্রতিটি ইঞ্চি চষে ফেলল তারা। কিন্তু কোথাও খামটা নেই। যেন জিমির পনেরশ ডলার একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! 

“জর্জ! এখন আমি কী করব!” রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল জিমি। 

“আহা জিমি, অস্থির হয়ো না,” ওর কাঁধে হাত রাখলো জর্জ, “মাথা ঠান্ডা করো। টাকাটা বাড়িতেই কোথাও আছে… পাওয়া যাবেই, “ দরজার দিকে এগিয়ে গেল জর্জ, “চলো আমরা রওনা দিই, টাকা হয়তো বাড়ির কোনো কোনায় পড়ে আছে। বিয়ে খেয়ে আসার পর আমি ভালো করে খুঁজে দেখব। 

এমন আনন্দের দিনে হুট করেই সব তালগোল পাকিয়ে গেল! ব্যাপারটা আর নিতে পারল না ক্যাথি, ডুকরে কেঁদে উঠল সে। ওর দিকে তাকাতেই তীব্র অপরাধবোধ পেয়ে বসল জর্জকে। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই কী যেন একটা হয়েছে ওর… গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ক্যাথিকে একটুও আদর করেনি সে! রাতের বেলা কাছেও টেনে নেয়নি! ওর সঙ্গ না পেয়ে মেয়েটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। জিমি না থাকলে এখনই ও ক্যাথিকে শোবার ঘরে নিয়ে যেত… আচ্ছা রাতে ফিরে এসে দেখা যাবে। ডায়রিয়ার কারণে শরীরটা দুর্বল, তারপরেও ও সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে ক্যাথিকে খুশি করার। ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটা যেন জাদু করেছিল ওর ওপর… এখানে আসার পর বউকে বলতে গেলে ছুঁয়েও দেখেনি সে! 

“সোনা, চলো রওনা হই,” ক্যাথির পিঠে চাপড় মারল সে, “সব ঠিক হয়ে যাবে, আগে বিয়েটা খেয়ে আসি।” 

জিমির গাড়িতে উঠল ওরা সবাই। জর্জ, ক্যাথি আর জিমি বসল সামনে, পিছনে বাচ্চারা। দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার গাড়ি থেকে নেমে পড়ল জর্জ, “এক মিনিট দাঁড়াও আমি একটু হ্যারিকে দেখে আসি।” 

হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পিছনদিকে চলে এলো জর্জ। শীতের সন্ধ্যা, অন্ধকার ধীরে ধীরে বাড়ছে। “হ্যারি, শুনতে পাচ্ছ? আমরা বাইরে যাচ্ছি, তুমি জেগে থেকো, হ্যারি?” 

জবাবে হ্যারির ডাক ভেসে এলো না। উঠানের তারের বেড়ার কাছে এসে পড়ল জর্জ, “হ্যারি? তুমি কোথায়?” 

পাশের বাড়িতে জ্বালানো একটা বাল্বের আলো খানিকটা এসে পড়েছে উঠানে। সেই আলোতে জর্জ দেখতে পেল যে হ্যারি ওর ঘরের মধ্যেই আছে। কাছে এসে ঝুঁকল জর্জ, “কী ব্যাপার হ্যারি? তোমার শরীর খারাপ?” 

কোনো উত্তর নেই। আরেকটু এগুলো জর্জ, সাথে সাথে নাক ডাকার শব্দ এলো তার কানে! সন্ধ্যা ছ’টা বাজে মাত্র… আর এখনই হ্যারি ঘুমিয়ে পড়েছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *