সপ্তম অধ্যায়
২৫ ডিসেম্বর।
এই নিয়ে পরপর সাত রাত জর্জের ঘুম ঠিক রাত সোয়া তিনটার দিকে ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসল সে। শীতের রাতে চাঁদের রূপালী আলোয় রীতিমতো ভেসে যাচ্ছিল ঘরটা। ক্যাথিকে স্পষ্ট দেখতে পেল সে… উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা!
ওর চুলে বিলি কেটে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াল জর্জ, তখনই উঠে বসল ক্যাথি! দু’চোখ ভরা ভয় নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল সে।
“কী হলো ক্যাথি?” আস্তে করে বলল জর্জ।
“ওনাকে মাথায় গুলি করা হয়েছিল!” চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি, “ভদ্রমহিলাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিল! আ… আমি পরিষ্কার শুনেছি সেই গুলির শব্দ… মাথার খুলি ভেদ করে ঢুকে গেছে গুলি!”
অবাক হয়ে গেল জর্জ! কার কথা বলছে ক্যাথি?
কিন্তু ক্যাথি ঠিকই বলেছিল। সেই সময়ে সেখানে ডিটেকটিভ, সার্জেন্ট জিয়নফ্রিদো থাকলে ব্যাপারটা বুঝতে পারত। ডিফেও পরিবারের হত্যাকাণ্ডের দিন প্রাথমিক তদন্তের পর সে নিজ হাতে রিপোর্টে লিখেছিল, “বাড়ির গিন্নি, লুইস ডিফেও মানে নিজের মাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় মাথায় গুলি করে হত্যা করে রোনাল্ড ডিফেও। কিন্তু বাকি সবাইকেই একইভাবে শোয়া অবস্থায় পিঠে গুলি করা হয়েছে। এমনকি মহিলার স্বামী যিনি তার পাশেই শুয়েছিলেন, তার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অমনই।”
খবরটা শুধুমাত্র সাফোক পুলিশ বিভাগ জানে, সংবাদমাধ্যমের কাছে কখনোই এটি বলা হয়নি। বাইরে কেউ এটা নিয়ে কথাও বলেনি, এমনকি রনি ওরফে রোনাল্ড ডিফেওর বিচারের সময়েও ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়।
তাহলে ক্যাথি কী করে জানলো যে সেদিন রাতে লুইস ডিফেওর মাথায় গুলি করা হয়েছিল? সে এটাও জানে যে সেই রাতে মহিলা আর তার স্বামী ওই ঘরটাতেই শুয়েছিলেন যেখানে সে আর জর্জ ঘুমায়!
রীতিমতো কাঁপছিল সে! শক্ত হাতে বউকে জড়িয়ে ধরল জর্জ, “কিচ্ছু হয়নি সোনা, তুমি ঘুমাও!” খানিক পরেই শান্ত হয়ে গেল ক্যাথি, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। তখনই জর্জের আবার মনে হলো নৌকা রাখার ছাউনিটার দেখে আসার কথা! আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে।
হ্যারির ঘরটার খুব কাছাকাছি আসতেই জেগে উঠল কুকুরটা। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে হাঁকডাক শুরু করল সে।
“শশশশশ, হ্যারি, সব ঠিক আছে… তুমি ঘুমাও,” ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো জর্জ। বসে পড়ল হ্যারি, কিন্তু জর্জের দিক থেকে চোখ সরাল না।
ধীরে ধীরে ছাউনির সামনে গিয়ে দাঁড়াল জর্জ। নাহ, আজ সব ঠিকই আছে। দরজা বন্ধ, তালাটাও মারা।
আবার হ্যারির কাছে এসে ওকে আদর করল জর্জ, “সব ঠিক আছে হ্যারি, তুমি ঘুমাও।” তারপর রান্নাঘরের দরজার দিকে হাঁটা দিলো সে।
হাঁটতে হাঁটতে সুইমিংপুলের পাশে এসে গেল সে, চাঁদের আলোয় বেজায় সুন্দর দেখাচ্ছে জায়গাটাকে। গরমকালে ভালোই মজা করা যাবে এখানে বাচ্চাদের নিয়ে। চাঁদটা যেন হয়েছে একটা বিরাট টর্চলাইট, আশপাশের বাড়িগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! মনে মনে হাসল জর্জ। নিজের অজান্তেই ওপরে তাকাল সে আর সাথে সাথে হৃৎস্পন্দন যেন থেমে গেল ওর! নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ওকে খেয়াল করছে মিসি… একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেয়েটা!
“হে ঈশ্বর!” ফিসফিসিয়ে উঠল জর্জ। চাঁদের আলোয় জর্জ স্পষ্ট দেখতে পেল যে মিসির ঠিক পিছনেই একটা শুয়োরের মাথা! লাল টকটকে দুটো চোখে সেই শুয়োরের… সে-ও জর্জকে দেখছে!
“মিসি!” চিৎকার করতে চাইলো জর্জ, কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে ঠিকমতো আওয়াজও বের হলো না ওর গলা দিয়ে। দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল সে, তারপর কোনোভাবে সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছল মিসির শোবার ঘরে।
কিন্তু লাইট জ্বালিয়ে দেখে মিসি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়, গভীর ঘুমে মগ্ন মেয়েটা! কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে জর্জ বলল, “মিসি!” কোনো সাড়া নেই। আসলেই ঘুমিয়ে আছে ও!
পিছন থেকে একটা মৃদু ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হলো। ঘুরে তাকাল জর্জ। ওদিককার জানালাটা দিয়েই একটু আগে বাইরে চেয়েছিল মিসি। ওর চেয়ারটা ধীরে ধীরে দোল খেয়ে চলেছে, কিন্তু ওটায় কেউ বসে নেই!
***
ছয় ঘণ্টা পর, সকাল সাড়ে ন’টা বাজে। রান্নাঘরে বসে কফি খাচ্ছে জর্জ আর ক্যাথি। দু’জনেই মুখের চিন্তার কালো ছায়া। দু’জনেই দু’জনকে নিজেদের কিছু ছোটো-বড়ো অভিজ্ঞতা খুলে বলেছে। নতুন বাড়িতে এসব কী হচ্ছে? এসব কি সত্য? না কি ওদের কল্পনা? অবশেষে সমাধান কিছুই এলো না, বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল দু’জন। বড়োদিনের অনেক কাজ তখনও বাকি।
দিনটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৫। গোটা আমেরিকা মেতেছে বড়োদিনের আনন্দে। ‘হোয়াইট ক্রিসমাস—হোয়াইট ক্রিসমাস’ বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিল। কিন্তু এখনও তুষারপাত শুরু হয়নি। তবে বেশ ঠান্ডা, যে-কোনো মুহূর্তে বরফ পড়লেও পড়তে পারে। ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার বাচ্চাগুলো বসার ঘরের ক্রিসমাস ট্রির নিচে নিচে বসে খেলছে। মনটা আজকেও বেশ খারাপ ওদের, অল্প খেলনায় কোনো বাচ্চার মন ভরে? কিন্তু মা- বাবার ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না।
জর্জ হিসাব করে দেখল মাত্র এক সপ্তাহে প্রায় একশ গ্যালন তেল আর গোটা মাসের জন্য জোগাড় করা সব কাঠই পুড়িয়ে ফেলেছে সে। বাইরে গিয়ে কিছু কাঠ কিনে আনা দরকার। এছাড়া দুধ, রুটি, ময়দা এগুলোও লাগবে। রান্নার মশলাপাতিও নেই তেমন।
জর্জ ক্যাথিকে জানিয়েছে যে সেলাইঘরে যেতে ফাদার ম্যানকুসো ওদের মানা করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এরপর অনেক চেষ্টা করেও আর ফাদারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে পারেনি সে। সব শুনে ক্যাথি ভাবল সে নিজেই একবার ফাদারের সাথে কথা বলবে।
ফাদারের নম্বর ডায়াল করল সে, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউই ফোন ধরল না। ক্যাথি ভাবল যে হয়তো ফাদার ম্যানকুসো অ্যাপার্টমেন্টে নেই। বড়োদিনে যাজকেরা অনেক ব্যস্ত থাকেন, কিংবা কে জানে? হয়তো নিজের আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে গেছেন তিনি।
“কাঠ আর বাকি জিনিসপত্র আমিই কিনে আনছি, তুমি বাচ্চাদের খেয়াল রেখো,” জর্জকে এই বলে বেরিয়ে গেল ক্যাথি।
***
ওদিকে ফাদার ম্যানকুসো কী করছিলেন? লং আইল্যান্ডের সেই রেক্টরি ছেড়ে এক পা-ও বাইরে বের হননি তিনি। আর হবেনই বা কী করে? তিনি যে এখনও অসুস্থ! ডাক্তারের কথামতো চব্বিশ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েও উনার কোনো উন্নতি হয়নি! শরীরের তাপমাত্রা এখনও একশ তিন ডিগ্রিই রয়েছে গেছে!
ফাদারের অবস্থা হয়েছে খাঁচায় বন্দি সিংহের মতো। তিনি ব্যস্ত মানুষ, নানান কাজ নিয়ে মেতে থাকতেই ভালোবাসেন। সেই তাকেই বড়োদিনের দিন এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে হলো! না না এভাবে থাকা চলবে না… কোনোভাবে বিছানায় উঠে বসলেন ফাদার। ব্রিফকেসটার দিকে নজর পড়ল তার, ওটা ভরতি নানান ফাইল! যেসব মানুষেরা সমস্যা নিয়ে ওনার কাছে আসে তাদের তথ্য। আজকেও হয়তো ওরা গির্জাতে এসেছে… তারপর? কী আর করবে, ওনাকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে! কী করবেন এখন উনি? গির্জার হলঘরে চলে যাবেন? কিন্তু প্রধান যাজক যে রেগে যাবেন! লুজদের না জানি কী অবস্থা! ওদের কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে ফাদারের। কিছু একটা আছে ওই বাড়িতে… ক্যাথি আর বাচ্চারা ভালো আছে তো?
***
বাড়িতে গাড়ি ঢোকানোর রাস্তায় ‘ঘর-ঘর’ চাকার শব্দ পেয়েই জর্জ বুঝতে পারল যে ক্যাথি বাজার থেকে ফিরে এসেছে। কোনো কারণ ছাড়াই মেজাজটা গরম হয়ে গেল জর্জের, কেন যেন ক্যাথির ওপর বেজায় রাগ উঠছে ওর।
বাইরে বেরিয়ে এলো সে, তারপর ভ্যান থেকে দুটো কাঠের গুঁড়ি নিয়ে ভেতরে চলে এলো। সে দুটোকে ফায়ারপ্লেসে গুঁজে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। বাকি কাঠগুলো পড়ে রইল ভ্যানেই! ক্যাথির বুঝতে বাকি রইল না যে জর্জ ওই কাঠগুলো ভেতরে আনবে না।
বেশ বিরক্ত হলো ক্যাথি। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই উদ্ভট আচরণ করছে জর্জ। ক্যাথি তেমন কিছু বলছে না দেখে বেশি মাথায় উঠেছে! নাহ … বেশি কথা বলতে গেলে আবার ঝগড়া লাগিয়ে দেবে জর্জ। অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা করল সে, তারপর ভ্যান থেকে খাবারের বাক্সগুলো নামিয়ে বাড়িতে চলে এলো। কাঠগুলো ভ্যানেই থেকে গেল, সে ভালো করেই জানে যে ঠান্ডা লাগলে জর্জ নিজেই ওগুলো ভেতরে নিয়ে আসবে।
চুপচাপ রান্নাঘরে বসে রইল ক্যাথি। সে আর জর্জ বেশ ভালোভাবে ড্যানি, ক্রিস আর মিসিকে মানা করে দিয়েছে দোতালার সেলাইঘরে যেতে। এতে করে বাচ্চাদের কৌতূহল আরও বেড়ে গেছে। কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়া কাউকে কোনো কাজ করতে মানা করলে এমনটাই হয়।
ওদিকে বাচ্চারাও আলোচনা করছে ওই ঘরটা নিয়ে। ওদের দৃঢ় বিশ্বাস মা- বাবা কিছু লুকিয়ে রেখেছে ওখানে!
“হয়তো ওখানে আমাদের জন্য আনা বাকি উপহারগুলো রাখা আছে? হুম? এত কম উপহার মা কিনবে? তোমাদের বিশ্বাস হয়?” বলে উঠল ক্রিস।
“আমারও সেটাই মনে হয়,” সায় দিলো ড্যানি।
“আমি জানি কেন মা-বাবা আমাদের মানা করেছে… ওখানে জোডি আছে যে,” হুট করে বলে বসল মিসি।
“জোডি? সে আবার কে?” বলল ড্যানি।
“আমার বন্ধু… একটা শুয়োর।”
“মিসি, তুমি চিরকাল বাচ্চাই রয়ে গেলে,” রেগে উঠল ক্রিস, “যতসব ফালতু কল্পনা। আর কত মিথ্যা বন্ধু বানাবে? হুম?”
***
সন্ধ্যা ছ’টা বাজে। রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত ক্যাথি। ঠিক তখনই রান্নাঘরের জানালাতে ‘ঠক-ঠক’ করে দু’বার টোকা দেওয়ার শব্দ হলো। বাইরে বেশ অন্ধকার, তুষার পড়ছে। ঘরের ভেতরের বৈদ্যুতিক বাল্বের আলোতে জানালায় জমে থাকা সাদা সাদা বরফ দেখতে বেশ লাগছে। ধীরে ধীরে আরও পুরু হবে জানালায় তুষারের ওই আস্তরণ, সকালবেলা হয়তো জর্জ পরিষ্কার করে দেবে সবকিছু।
“যাক, অবশেষে বরফ,” আপনমনেই বলে উঠল ক্যাথি।
বড়োদিনে তুষারপাত না হলে হয়? মুহূর্তেই মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠল ক্যাথির। স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল ওর। ও ছোটো থাকতে প্রায় প্রতি বছরের বড়োদিনেই তুষারপাত হতো। হোয়াইট ক্রিসমাস মানেই বিশেষ কিছু! একদিকে বরফের শ্বেতশুভ্র চাদর অপরদিকে প্রতিবেশীদের বাড়িতে লাগানো রঙিন সব আলোর শোভা!
আলোছায়া আর ঝিরঝিরে তুষারকণা যেন পৃথিবীটাকে পরিণত করেছে স্বর্গে, রেডিয়োতে বাজছে বড়োদিনের গান। মন দিয়ে রান্না করতে লাগল ক্যাথি! কী সুন্দর পরিবেশ চারপাশে… না না অশুভ কিছুই নেই এই বাড়িতে, সবকিছুই ওদের কল্পনা।
রাতের খাওয়া শেষে জর্জ আর ক্যাথি বসার ঘরে এলো। ক্রিসমাস ট্ৰিটা আলোকিত হয়ে আছে রীতিমতো! জর্জের দাদির ওই বিশেষ জিনিসটা একদম মাথায় লাগানো হয়েছে। পুরো ঘরের পরিবেশটাই পালটে গেছে একদম। জিমি একটা ডাল এনেছে বটে! অসাধারণ! মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল ওরা দু’জন, কিন্তু কেউ কারও সাথে কোনো কথা বলল না। মিনিটখানেক পর বাইরে গেল জর্জ। ক্যাথির বুঝতে বাকি রইল না যে কাঠ আনতে গেছে ব্যাটা!
ছ’টা গাছের গুঁড়ি নিয়ে ফিরল জর্জ। এই দিয়ে পুরো রাত আরামসে কেটে যাবে।
ক্যাথি উঠে দোতালার শোবার ঘরে চলে গেল। বাচ্চাদের কিছু কাপড় নিয়ে কাজ করতে হবে। ছেলেদের কয়েকটা পায়জামা সেলাই করল সে, ছেঁড়া জায়গাগুলো তালি মেরে দিলো। মিসির কয়েকটা পায়জামার ঝুল বাড়িয়ে দিলো, মেয়েটা বেশ লম্বা হচ্ছে; আজকাল জুতা পরলে ওর ছোটো পায়জামাগুলো বেশ দৃষ্টিকটু লাগে। ওদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনে আনা পর্যন্ত এগুলো দিয়েই চালাতে হবে। সাধারণত এসব কাজ সেলাইঘরেই করে ও… কিন্তু ফাদার…
রাত ন’টার দিকে মিসিকে আনার জন্য ঘর থেকে বের হলো ক্যাথি, এই সময়ে তিন তলার খেলাঘরেই থাকে মেয়েটা। কিন্তু সিঁড়িতে উঠতেই সে মিসির শোবার ঘর থেকে ওর গলার আওয়াজ পেল। তাড়াতাড়ি আবার নেমে এলো সে। মিসি কার সাথে যেন কথা বলছে… বেশ জোরে। ওর ঘরে এই সময়ে কে আছে? ড্যানি বা ক্রিস হয়তো। কিন্তু কাছাকাছি যেতেই ক্যাথি শুনল যে মিসি বলছে, “তুষার খুব সুন্দর? তাই না জোডি?” তাড়াতাড়ি ওর ঘরে ঢুকল ক্যাথি। চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে বাইরের তুষারপাত দেখছে ওর মেয়ে। অবাক হয়ে পুরো ঘরটা দেখল ক্যাথি… মিসি ছাড়া আর কেউ নেই ওখানে!
“কার সাথে কথা বলছিলে তুমি মিসি? সেদিনের সেই দেবদূতের সাথে না কি?” বলে উঠল ক্যাথি
ঘুরে তাকাল মিসি, তারপর ওর নজর চলে গেল ঘরের একটা কোনার দিকে, “না মা। জোড়ির সাথে কথা বলছিলাম।”
মিসির দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল ক্যাথি। ওই কোণে শুধু ওর কয়েকটা খেলনা পড়ে আছে!
“জোডি? এটা কি তোমার নতুন কোনো পুতুলের নাম?”
“না না, জোডি একটা শুয়োর। ও আমার বন্ধু… আমি ছাড়া আর কেউ ওকে দেখতে পায় না।”
এই বয়সের বাচ্চারা মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব মানুষ আর জীবজন্তুদের কল্পনা করে তাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতায়, গল্পও করে। মিসিরও এই অভ্যাস আছে, ডিয়ার পার্কে থাকার সময়েও ও নিজের খেলনাগুলোর সাথে কথা বলত। ক্যাথি ধরে নিল এটাও তেমনই কোনো ব্যাপার। সে তো আর জানত না যে জর্জ আগের রাতে মিসির জানালায় ‘কী’ দেখেছে… আলোচনার সময়ে ওই ঘটনাটা কেন যেন এড়িয়ে গেছিল জর্জ।
ড্যানি আর ক্রিসকে ঘুম পাড়ানোর জন্য তিন তলায় উঠল ক্যাথি। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়! ছেলেদুটো ইতোমধ্যেই শোবার ঘরে চলে গেছে, পায়জামা বদলাচ্ছে ওরা! যেখানে অন্যদিন রাত দশটার আগে ওরা ঘুমাতেই চায় না, মাঝে মাঝে তো আরও দেরি করে। ক্যাথি জোর করে ঘুম পাড়ায়। সেখানে আজ সাড়ে নয়টার মধ্যে শোবার ঘরে… ক্যাথি না আসতেই! হলো কী আজ ছেলেদুটোর?
“কী হলো আজ তোমাদের দু’জনের?” অবাক হয়ে বলল ক্যাথি, “আমি না বলতেই শোবার ঘরে চলে এলে?”
পায়জামা পরতে পরতে ড্যানি উত্তর দিলো, “এই ঘরটা বেশি গরম মা। ওখানে অনেক ঠান্ডা। ভালো লাগছে না ঠান্ডার মধ্যে খেলতে।”
“ঠান্ডা? তাহলে নিশ্চয় তোমরা আবার জানালা খুলেছো! তোমাদের নিয়ে পারি না,” এই বলে ঘরটার দিকে ছুটল ক্যাথি।
কিন্তু না! সবকটা জানালা বন্ধ… তারপরেও ঘরটা একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা। আর তাছাড়া কোনো জানালা খোলা থাকলে পুরো তিন তলাটাই ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কথা… যেখানে বারান্দা আর ড্যানিদের শোবার ঘর তো বেশ গরমই আছে। রেডিয়েটরটা পরীক্ষা করল সে, ওটাও বেশ গরম আছে।
তাড়াতাড়ি নিচে নেমে জর্জকে ব্যাপারটা জানাল ক্যাথি। কিন্তু ঠান্ডার মধ্যে ফায়ারপ্লেসের সামনে থেকে জর্জ হটতে চাইলে তো?
“সকালে গিয়ে দেখব ব্যাপারটা, এখন তো ওখানে কেউ ঘুমাচ্ছে না? তাই না? তাহলে আর কী দরকার দেখার,” মাথা নিচু করে বলল সে। অবশেষে রাত বারোটার দিকে জর্জ আর ক্যাথি ঘুমাতে গেল।
***
এগারোটা একটু পরেই অ্যামিটিভিলে তুষারপাত বন্ধ হয়ে গেছিল, পনেরো মাইল দূরের ‘লং আইল্যান্ড সেক্রেড হার্ট রেক্টরি’র আশেপাশের এলাকারও একই অবস্থা। জানালার পাশ থেকে সরে দাঁড়ালেন ফাদার ম্যানকুসো। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে তার, পেটের অবস্থাও খুব একটা ভালো না… একটু পরপরই কামড়ে উঠছে। প্রচণ্ড ঘামতে লাগলেন তিনি, মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে… পরনের আলখাল্লাটা খুলে টেবিলে রেখে দিলেন। সাথে সাথে আবার কাঁপুনি শুরু হলো!
বিছানায় উঠে পড়লেন তিনি, কম্বলটা গায়ে না দিলে আর হচ্ছে না। এ কি! কম্বলের ভেতরেও কনকনে ঠান্ডা! তারপরেও কয়েক মিনিট চুপচাপ রইলেন ফাদার, মুখটা ঢেকে নিলেন কম্বল দিয়ে… অন্ধকার! ভেবেছিলেন হয়তো জ্বরের কারণে ঠান্ডা লাগছে।
কম্বলের ভেতরের অন্ধকার অনেকটা সয়ে এলো চোখে। খেয়াল করলেন… ওনার প্রতিটি নিশ্বাস যেন ধোঁয়া হয়ে জমে যাচ্ছে! তার মানে আসলেই কম্বলের নিচে অনেক ঠান্ডা! জ্বরের কারণে এমনটা হচ্ছে না!
“হচ্ছেটা কী এসব?” আপনমনেই বলে উঠলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের রেডিয়েটরটা ছুঁয়ে দেখলেন তিনি… ওটা চলছে না! একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে!
অসুস্থ ফাদার ম্যানকুসো আবার ঘামতে শুরু করলেন। কিন্তু এবার আর বাইরে এলেন না তিনি, কম্বলের ভেতর আরও বেশি করে ঢুকে গেলেন। রীতিমতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে, চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন।