দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ১০

দশম অধ্যায় 

২৮ ডিসেম্বর। 

রবিবার সকাল। গির্জার আচার-অনুষ্ঠান শেষে সেক্রেড হার্ট রেক্টরিতে ফিরলেন ফাদার ফ্রাংক ম্যানকুসো। দুটো জায়গার দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ, কিন্তু ফেরার পথে ঠান্ডা আবহাওয়া আর দুর্বল শরীরের কারণে ওইটুকু রাস্তাকেই অনেক মনে হচ্ছিল ফাদারের। 

রেক্টরির অতিথিকক্ষে ওনার জন্য একজন অপেক্ষা করছিল। সাফোক কাউন্টি পুলিশ বিভাগের সার্জেন্ট জিয়নফ্রিদো। তার সাথে করমর্দন করে ফাদার বললেন, “চলুন, দোতালাতেই আমার অ্যাপার্টমেন্ট। আপনি যোগাযোগ করাতে খুবই খুশি হয়েছি আমি… তবে নিজেই যে চলে আসবেন এতটা ভাবিনি!” 

“ব্যাপার না ফাদার,” হাসল সার্জেন্ট, “আজ আমার ছুটির দিন। ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই।” 

ফাদার আড়চোখে তাকালেন সার্জেন্টের দিকে। বিশালদেহী একটা লোক, তবে চেহারায় আন্তরিকতা আছে। 

ফাদারের অ্যাপার্টমেন্টের বসার ঘরে এলো ওরা। জিয়নফ্রিদো দেখল ঘরটার চারদিকে শুধু বই আর বই। এমনকি চেয়ার-টেবিলও খালি নেই! কাউচ থেকে কয়েকটা বই সরিয়ে সেখানেই বসে পড়ল সার্জেন্ট। 

বেজায় ঠান্ডা লাগছিল ফাদারের। ঘরে একটু মদ থাকলে নিজেও খাওয়া যেত, সার্জেন্টকেও দেওয়া যেত। কিন্তু নেই তো। কী আর করা? অবশেষে রান্নাঘরে গিয়ে চা বসিয়ে দিলেন তিনি। পানি গরম হতেই চা পাতা ছেড়ে দিয়ে বসার ঘরে ফিরলেন তিনি। 

“বুঝলেন সার্জেন্ট,” বলে উঠলেন ফাদার, “লুজদের নিয়ে বেশ চিন্তিত আমি। এই কারণেই সেদিন আমার বন্ধু চার্লি জাম্মাতারো গুয়ারিনোকে ফোন করে বলেছিলাম, কাউকে দিয়ে ১১২ নম্বর বাড়িটার একটু খোঁজ নিতে। দাঁড়ান, চা নিয়ে আসি।” 

রান্নাঘরে ফিরে কাপ আর পিরিচ বের করলেন ফাদার। তারপর একটা সেগুলোতে চা ঢেলে বসার ঘরে চলে এলেন। 

সার্জেন্ট চুপচাপ বসেছিল। 

“চার্লিকে যখন ফোন করলাম,” কাপগুলো টেবিলে রাখলেন ফাদার, প্রথমে একটু অবাকই হলো। বলেছিল লুজদের ওই বাড়িতে ওঠা ঠিক হয়নি, কারণ ওখানেই তো এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল! অবশ্য কিছু বন্ধুর কাছে আগেই আমি ব্যাপারটা শুনেছিলাম। তবে কী করে এসব হয়েছিল… তা জানা নেই! মানে রনি ডিফেও কেন এসব করেছিল?” 

“ওই কেসের তদন্তে আমিই ছিলাম ফাদার,” গম্ভীরকণ্ঠে বলল সার্জেন্ট। 

“জানি, চার্লি সেদিন বলল আমাকে। আপনার সাথে কথা বলার পরে ও আবার আমাকে ফোন করেছিল,” চায়ের কাপটা সার্জেন্টের দিকে এগিয়ে দিলেন ফাদার, তারপর একদম তার মুখোমুখি বসলেন, “যা-ই হোক, কাল রাতে আমার ঘুম আসছিল না। অনেক কষ্টে ভোরের দিকে ঘুমটা এলো। স্বপ্নে আমি ডিফেওদের দেখেছি! কেন এমন হচ্ছে সার্জেন্ট?” 

চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চলল সার্জেন্ট। ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন ফাদার। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ, মানুষের মুখ দেখেই অনেক কিছু বুঝতে পারেন। কিন্তু এই সার্জেন্ট পুরো আলাদা। এর মুখ দেখে সহজে কিছু বোঝা যায় না। না-কি প্রথম দিনে অ্যামিটিভিলে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলবেন সার্জেন্টকে? জর্জের সাথে টেলিফোনে কথা বলার সময়ের ওই অদ্ভুত সমস্যার কথাও বলা যায়।

ওদিকে সার্জেন্ট জিয়নফ্রিদো কিন্তু ঠিকই ফাদারের মনের কথা বুঝে গেছে, “আপনার কী মনে হচ্ছে? বাড়িটাতে অদ্ভুত কিছু ঘটছে?” 

“কী যে মনে হচ্ছে! সেটা আমি নিজেই জানি না! তবে, আপনার কী মনে হয়?” 

চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল সার্জেন্ট, “আপনি কী ভাবছেন? বাড়িটা ভূতুড়ে? ওখানে অশুভ কোনো প্রেতশক্তির বাস? আপনি একজন পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে ভৌতিক তথ্য চান?” 

“আরে আরে চটছেন কেন?” মাথা নাড়লেন ফাদার, “আচ্ছা ডিফেও পরিবারের লোকেরা যে রাতে খুন হয়… ওই রাতে আসলে কী ঘটেছিল? আমাকে একটু বলা যায়? রনি নামের ছেলেটা না-কি আদালতে বলেছিল যে আকাশ থেকে ভেসে আসা কোনো শব্দের হুকুমে এমনটা করেছে সে?” 

কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে ফাদারের দিকে রইল জিয়নফ্রিদো। তারপর একটু কেশে পুলিশি গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলতে লাগল, “আপনি বোধ হয় বেশ চিন্তাতে আছেন, তাই না ফাদার? চোখ-মুখ বসে গেছে রীতিমতো। যা-ই হোক, আপাতদৃষ্টিতে তদন্ত মারফত যতটুকু বুঝা যায়, ১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর রাতের বেলা খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল রোনাল্ড ডিফেও। সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর খুব শক্তিশালী একটা রাইফেল দিয়ে ওদেরকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে পিশাচটা। হ্যাঁ, আদালতে ও বলেছিল যে অদৃশ্য এক কণ্ঠস্বর না-কি ওকে এসব করতে বলেছিল।” 

আরও কিছু শোনার জন্য অধীর আগ্রহে চেয়ে রইলেন ফাদার। কিন্তু সার্জেন্টের মুখে কোনো কথা নেই। এর বেশি কিছু বলার ইচ্ছা নেই ওর। 

‘এটুকুই?” অবশেষে বলে উঠলেন ফাদার। 

“হ্যাঁ, মোটামুটি এটুকুই,” মাথা নাড়ল সার্জেন্ট। 

“ছোড়াটা এত গুলি করল, প্রতিবেশীদের ঘুম ভেঙে যায়নি? ওরা ছুটে এলো না কেন?” 

“না, কেউ শব্দ শোনেনি। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুতই। রনি ডিফেও নিজেই একটু পর ঘটনাটা ‘দ্য উইচেস ব্রু’ পানশালার বারটেন্ডারকে বলে আসে। আমরা ওর কাছ থেকেই খবরটা পাই। ওশান অ্যাভিনিউয়ের কাছেই পানশালাটা। আসলে ছেলেটার মাথা ঠিক ছিল না।” 

অবাক হয়ে গেলেন ফাদার ম্যানকুসো, “মানে আপনি বলতে চাইছেন ছ-ছ’টা মানুষকে শক্তিশালী রাইফেল দিয়ে গুলি করা হলো… কিন্তু পাড়ার কেউ শুনতেই পেল না! একটা গুলির শব্দও না?” 

হুট করেই মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল জিয়নফ্রিদোর, একটু বমিও পেল। ও ভাবল ফাদারের অ্যাপার্টমেন্টের বদ্ধ পরিবেশের কারণে এমনটা হচ্ছে। ওভারকোটটা হাতে নিল সে। 

“একদম, ডিফেওদের বাড়ির দু’পাশের প্রতিবেশীরাই জানিয়েছে সেই রাতে ওরা কোনো শব্দই পায়নি,” উঠে দাঁড়াল সার্জেন্ট। 

“এটা কি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়? 

“হ্যাঁ, আমারও অবাক লেগেছে,” ওভারকোটটা পরে নিল জিয়নফ্রিদো, “কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে ওটা ছিল তীব্র শীতের সময়। বেশিরভাগ লোকই দরজা-জানালা লাগিয়ে ঘুমায়। আর রাত সোয়া তিনটার দিকে কে জেগে থাকবে? সবাই তো গভীর ঘুমে অচেতন থাকে ওই সময়ে।” 

আরও কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাইছিলেন ফাদার। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ আর না দিয়ে রেক্টরি থেকে রীতিমতো ছুটে বেরিয়ে এলো সার্জেন্ট। খুব অস্বস্তি লাগছিল ওর সেখানে। বের হওয়ার একটু পরেই একটা ফাঁকা জায়গাতে গিয়ে বমি করে ফেলল সে। 

কিন্তু তবুও অস্বস্তিটা গেল না। কোনোমতে গাড়ি চালিয়ে অ্যামিটিভিলের দিকে চলল সার্জেন্ট জিয়নফ্রিদো। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে অস্বস্তি একটু হলেও কাটল। সাধারণত ও ১১২ নম্বর বাড়িটার পাশ দিয়ে যায়, কিন্তু সেদিন কী মনে করে দ্য উইচেস ব্রু পানশালার পথ ধরল। 

উইচেস ব্রুতে সবসময়ই বলতে গেলে ভিড় থাকে। এলাকার নতুন সিগারেট আর মদ খেতে শেখা ছেলে-ছোকরাদের আড্ডা এটা। এছাড়া গ্রীষ্মকালে বাইরে থেকে অ্যামিটিভিলে আসা লোকেরাও এখানেই ভিড় করে। অন্য অঞ্চলের থেকে গ্রীষ্মে অ্যামিটিভিলের তাপমাত্রা বেশ কম থাকে, তাই অনেকেই এখানে ওই সময়ে কিছুদিনের জন্য বাড়ি ভাড়া নেয়। 

ডিসেম্বরের এই রবিবার বিকালে রাস্তাতে প্রচুর মানুষ থাকে, কিন্তু আজ ফাঁকা। পেশাদার ফুটবল[৮] লিগের খেলা আছে, তাই আজ অনেকেই টিভির সামনে থেকে উঠবে না। 

[৮. আমেরিকান ফুটবল, রাগবির কাছাকাছি পর্যায়ের একটি খেলা। ফুটবল বলতে আমরা যা বুঝি তাকে আমেরিকানরা সকার বলে।]

উইচেস ব্রু’তে একটা লোক ঢুকছে। দেখেও দেখল না জিয়নফ্রিদো। হয়তো লোকটার ফুটবল পছন্দ না, তাই ফাঁকা পানশালায় মদ গিলতে চলে এসেছে। প্রায় পঞ্চাশ গজের মতো এগিয়ে হুট করেই গাড়ির ব্রেক কষল সে। পিছনে তাকাল, লোকটা ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে গেছে! অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেলা করছে ওর মাথায়… লোকটা দেহের গড়ন, দাড়ি, হাঁটার ধরন… সবকিছুই রনি ডিফেওর মতো! 

এক দৃষ্টিতে পানশালার দরজার দিকে চেয়ে রইল সার্জেন্ট। “ব্যাটা যাজকের সাথে কথা বলে আমার মাথাটাও গেল না কি?” আপনমনেই বলে উঠল সে, “ধুর ধুর, ওর কথা কে শোনে?” গাড়িটা চালু করল জিয়নফ্রিদো, প্রচণ্ড জোরে ওর গাড়িটা ছুটে চলল বাড়ির দিকে। বিশ্রাম দরকার সার্জেন্টের। 

*** 

ওদিকে দ্য উইচেস ব্রুর ভেতরে এক গ্লাস বিয়ার অর্ডার করল জর্জ। 

আচ্ছা, বারটেন্ডার ওর দিকে ওভাবে চেয়ে আছে কেন? সে ঢোকার পর থেকেই লোকটা ওভাবে তাকাচ্ছে। মিলার্স কোম্পানির বোতল থেকে গ্লাসে বিয়ার ঢালছে ব্যাটা, হুট করেই আবার জর্জের দিকে চাইল। কিছু একটা বলতে চায় যেন! তারপরে আবার বিয়ার ঢালাতে মন দিলো। 

তারপর গ্লাসটা দিয়ে গেল জর্জের সামনে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আশপাশটা ভালো করে খেয়াল করল জর্জ। মেরিন বাহিনীতে থাকার সময়ে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে জর্জকে, বাহিনী ছাড়ার পর বেছে নিয়েছে ভূমি জরিপের কাজ… এটাও নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরেই করতে হয়। লং আইল্যান্ডের ছোটো শহর আর গ্রামগুলোতে এমন পানশালা অনেক দেখেছে সে। টিমটিমে আলো, কোনায় পয়সা দিয়ে গান শোনার একটা জুকবক্স, সিগারেটের ধোঁয়া আর মদের গন্ধ! ও ছাড়া পুরো পানশালায় আর একজনই লোক আছে। লম্বা মেহগনি কাঠের তৈরি কাউন্টার টেবিলের একদম শেষ কোনায় বসে আছে ব্যাটা। কাউন্টারের সামনেই একটা বেশ লম্বা আয়না, কে জানে হয়তো বারটেন্ডার মুখ দেখে ওখানে? ওই আয়নার ওপরে একটা টিভি। সেখানেই চোখ আটকে আছে লোকটার। ফুটবল ম্যাচের প্রথমার্ধ চলছে। 

গ্লাসে বেশ কয়েকটা চুমুক দিয়ে আয়নায় ভেসে ওঠা নিজের মুখটার দিকে তাকাল জর্জ। বাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে ভাবার পরিবেশ নেই! বাচ্চাদের চেঁচামেচি তো আছেই, তাছাড়া ওখানে কেন যেন কোনো ব্যাপারেই মন বসে না ওর। একা একা বসে একটু ভাবতে হবে। বাড়িতে হচ্ছে কী? এসব ঘটনার কি আসলেই কোনো ব্যাখ্যা আছে? অদ্ভুত এক ধাঁধায় যেন ফেলে দিয়েছে কেউ ওদের। 

আর তাছাড়া নতুন বাড়িটাতে আসার পর বাচ্চাদেরও কিছু একটা হয়েছে! ওরা আর আগের মতো নেই। ভয়ংকর রকমের দুষ্ট আর জেদি হয়ে উঠেছে, কিছু কিছ ক্ষেত্রে তো অভদ্রও! অথচ এই ওরাই ডিয়ার পার্কে থাকার সময় কত ভালো ছিল! 

সবচেয়ে বেশি বদলে গেছে মিসির আচরণ। সেদিন রাতে কি সত্যিই মিসির ঘরের জানালায় ওর সাথে কোনো শুয়োরকে দেখেছিল সে? আর জিমির টাকাটারই বা কী হলো? সবার চোখের সামনে থেকে টাকাগুলো কে নিল? রীতিমতো যেন হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে খামটা। 

গ্লাসের বিয়ার শেষ। আরেক গ্লাস দেওয়ার জন্য বারটেন্ডারকে ইশারা করল সে। তারপর আবার আয়নার দিকে চাইল। আজকাল নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে না। শুধু কি বাচ্চাদের আচরণ বদলে গেছে? ও নিজেও তো অনেক বদলে গেছে। প্রায় পুরো সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়ই সে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে থেকেছে, রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে নৌকা রাখার ছাউনিটা দেখতে গেছে… কিন্তু কেন? এখন আবার নতুন করে হাজির হয়েছে বেসমেন্টের লাল ঘরটা। এসব কী হচ্ছে? বাড়িটার ইতিহাস জানতে হবে, পুরোপুরি। অ্যামিটিভিল রিয়েল এস্টেট খাজনা আদায় দপ্তরে যেতে হবে কাল, ওখানে বাড়ি সংক্রান্ত যাবতীয় নথি থাকার কথা। 

“ও হ্যাঁ,” আপনমনেই বলে উঠল সে, “ব্যাংকে গিয়ে পাঁচশ ডলার জমা করতে হবে। নইলে অ্যাস্টোরিয়া ম্যানরের ম্যানেজার ঝামেলা করবে!” 

বিয়ারের দ্বিতীয় গ্লাসটাও এসে গেছে ততক্ষণে। এক চুমুকেই সেটুকু খেয়ে ফেলল জর্জ। তারপর খেয়াল করল যে বারটেন্ডার ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় ভাবছে আরও বিয়ার অর্ডার দেবে ও। 

“আর লাগবে না,” হাসল জর্জ। 

“কিছু মনে করবেন না স্যার,” আস্তে করে বলল বারটেন্ডার, “আপনি কি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন? মানে বেড়াতে এসেছেন আমাদের অঞ্চলে? 

“আরে না না,” হাসল জর্জ, “আমি অ্যামিটিভিলেই থাকি। অল্প কিছুদিন হলো এসেছি,” বারটেন্ডারের হাতে বিয়ারের দাম দিলো সে। 

মাথা নাড়ল বারটেন্ডার, “আমারই ভুল হয়েছে, আপনাকে আমাদের এলাকার এক লোক ভেবে ভুল করেছিলাম, “ খুচরাগুলো কাউন্টারের ওপর রাখল ও, “আসলে সেই লোক আর নেই এখানে… খুব তাড়াতাড়ি যে ফিরবে সেই আশাও নেই। হয়তো আর কখনোই ওর সাথে দেখা হবে না।” 

“আমাকে মাঝে মাঝেই অন্য লোক ভেবে ভুল করে অনেকে,” টাকাগুলো তুলে পকেটে পুরল জর্জ, “সম্ভবত আমার দাড়ির কারণে। আজকাল অনেকেই তো এমন দাড়ি রাখছে। বুঝলেন? যা-ই হোক আবার দেখা হবে,” দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। 

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আবার অবশ্যই আসবেন।” 

জর্জ বেরিয়ে যাবে, ঠিক তখনই বারটেন্ডার বলে উঠল, “আচ্ছা স্যার, এখানে কোন বাড়িটা নিয়েছেন আপনারা? “ 

“এইতো কাছেই,” ফিরে তাকাল জর্জ, তারপর পশ্চিম দিকটা দেখিয়ে বলল, “গোটা দুই রাস্তা পেরিয়ে ওশান অ্যাভিনিউ আছে না? ওখানে। 

“ওশান অ্যাভিনিউয়ের কোন বাড়িটা?” 

“১১২ নম্বর বাড়ি।” 

সাথে সাথে চমকে উঠল বারটেন্ডার। বিয়ারের খালি গ্লাসটা ওর হাত থেকে মাটিতে পড়ে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ঝনঝনে একটা শব্দ হলো… তারপর সব চুপচাপ। 

*** 

জর্জের জন্য অপেক্ষা করছে ক্যাথি। বসার ঘরে ক্রিসমাস ট্রিটার পাশে চুপচাপ বসে আছে সে। আজকাল একা একা রান্নাঘরে থাকতে ভয় পায় মেয়েটা। আবার যদি সেই অদৃশ্য হাত তাকে ধরে? কিংবা পারফিউমের সেই গন্ধটা… নাহ, ওখানে একা থাকা যাবে না। তিন তলায় ক্রিস আর ড্যানির শোবার ঘরে গেছে মিসি। তিন জনে মিলে একটা পুরোনো সিনেমা দেখছে, আজকে ওদের কেউই তেমন দুষ্টুমি করেনি। ওপর থেকে মিসির হাসির শব্দ ভেসে এলো, খুব জোরে জোরে হাসছে সে… ওরা যে সিনেমাটা দেখছে সেটা নাম সম্ভবত ‘অ্যাবট অ্যান্ড কস্টেলো’। 

হুট করেই জিমির টাকার কথাটা মনে এলো ক্যাথির। সে আর জর্জ মিলে রান্নাঘর, বসার ঘর আর হলঘরের প্রতিটা ইঞ্চি খুঁজে দেখেছে। আলমারিগুলোও খুলে দেখা হয়েছে। পুরো বাড়ির আনাচেকানাচে সব জায়গা দেখা হয়েছে। কিন্তু খামটা আর পাওয়া যায়নি। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ওটা! কোথায় গেল ওটা? বাইরের কেউ এসে যে নেবে সেই সম্ভাবনাও নেই। ওদিন বাইরে থেকে কেউ এসেছিলও না। 

রান্নাঘরে কিছু নড়ে উঠল না? রীতিমতো পিলে চমকে গেল ক্যাথির। না না, সব ওর মনের ভুল। আজকাল রান্নাঘর নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে সে। অন্য ঘরগুলো নিয়েও তো ভাবা যায়। আচ্ছা! কোন ঘর নিয়ে ভাববে? দোতালার সেলাইঘর? না কি বেসমেন্টের লাল ঘরটা? একবার বেসমেন্টে যেয়ে দেখবে না কি? চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সে। “না বাবা, একা ওখানে যাব না,” আপনমনেই বলে উঠল ক্যাথি। আবার বসে পড়ল সে। ঘরটাকে আরও ভালো করে দেখা উচিত ছিল ওদের। লাল দেওয়ালগুলো দেখেই ভয় পেয়ে গেছিল ও আর জর্জ! 

হাতঘড়ি সময় দেখল ক্যাথি। বিকাল চারটা বাজে প্রায়। জর্জ কোথায়? প্রায় এক ঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছে সে। ঠিক ওই সময়েই ক্যাথির মনে হলো ডানদিকে কিছু একটা নড়ছে! 

বিয়ের পর প্রথম বড়োদিনে ক্যাথি জর্জকে একটা বেশ বড়ো আকারের চারফুট লম্বা সিরামিকের সিংহমূর্তি দিয়েছিল। হাঁটু গেড়ে বসে থাকা নকল সিংহটা দেখলে মনে হয় এই যেন অদৃশ্য শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমনভাবে রং করা হয়েছে… দেখে মনে যেন ওটা আসল! জর্জের খুবই পছন্দের জিনিস ওটা, ডিয়ার পার্কের বাড়িটাতেও বসার ঘরে থাকত, এখানেও আছে। ফায়ারপ্লেসের কাছে জর্জের চেয়ারের পাশের বড়ো টেবিলটার ওপর রাখা থাকে সিংহটা। 

মূর্তিটার দিকে ঘুরে তাকাল ক্যাথি। সাথে সাথে চমকে উঠল সে… ওর সামনেই কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে এলো নকল সিংহটা! 

*** 

সার্জেন্ট জিয়নফ্রিদো চলে যাওয়ার পর নিজের ওপরেই রাগ উঠল ফাদার ম্যানকুসোর। কী করবেন এখন তিনি? সার্জেস্ট ওনার কথা বিশ্বাস করেনি… হয়তো উনিই ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারেননি লোকটাকে। আচ্ছা, লুজদের বাড়িটা নিয়ে এত চিন্তা কীসের ওনার? কোনো সমস্যা হলে ওরাই তো ডাকবে, তাই না? নাহ, ওই ঘটনা নিয়ে এত ভাবলে চলবে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। টেবিলের ওপর জমে থাকা গির্জার নানান কাজের ফাইলগুলো দেখতে বসলেন ফাদার। অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে ওগুলো দেখা হয়নি। 

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা যে কীভাবে কেটে গেল তিনি নিজেই বুঝতে পারলেন না। তবে এটুকু বুঝলেন যে শারীরিক দুর্বলতা অনেকটাই কেটে যাচ্ছে, শরীরের শীত-শীত ভাবটাও আর নেই। নাহ, আর ওই বাড়ির কথা ভাবা যাবে না। কিন্তু জিয়নফ্রিদো যেভাবে রোনাল্ড ডিফেওর অপকর্মের বর্ণনা দিলো… ব্যাপারটা কেমন যেন! ছ-ছ’টা মানুষকে ব্যাটা খুন করল, কিন্তু কেউ গুলির শব্দ পেল না? বাড়িটা নিয়ে ওনার আশংকার কথাও রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছে লোকটা। সন্ধ্যা প্রায় ছ’টা বেজে গেছে, জিয়নফ্রিদোর সাথে ওই এক কাপ চা খাওয়ার পর আর কিছুই খাননি ফাদার। আড়মোড়া ভেঙে হাতের ফাইলটা টেবিলের ওপর রেখে রান্নাঘরে গেলেন তিনি। তখনই বসার ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠল। এটা ওনার ব্যক্তিগত নম্বর, শুধুমাত্র পরিচিত কিছু লোকের কাছেই আছে। এমনকি গির্জার কর্মচারীদের কাছেও নেই। 

“হ্যালো,” ফোনটা ধরলেন ফাদার। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো শব্দ নেই। শুধু একটানা ‘ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ। 

ভয়ের একটা তীব্র স্রোত যেন জমিয়ে দিলো ফাদারকে। রিসিভারটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন উনি। শেষবার যখন জর্জ লুজের সাথে কথা বলেছিলেন তখনও তো এমনই হয়েছিল! 

*** 

রিসিভারটা কানে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে জর্জ। ওপাশ থেকে ভেসে আসছে একটানা ‘ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ। বেজায় বিরক্ত লাগছে ওর, আজকাল ক্যাথি একা রান্নাঘরে যেতে ভয় পায়। তাই জর্জ ওখানে বসেছিল। বাচ্চারাও পাশেই খেলছিল, তখনই বেজে ওঠে ফোনটা… আর ফোন ধরে এই অবস্থা! রাগের মাথায় ‘ধম’ করে রিসিভারটা ফোনের ওপর রেখে দিলো ও। 

“জর্জ, খাবার তৈরি, এসে পড়ো,” বলে উঠল ক্যাথি। 

“বুঝলে ক্যাথি, মনে হয় কোনো হারামজাদার হাতে আমাদের নম্বরটা পড়েছে! ফোন করে কোনো কথা বলে না… উদ্ভট আওয়াজ করে!” 

ক্রিসের থালায় তরকারি তুলে দিতে দিতে মুখ তুলে চাইল ক্যাথি। বাচ্চারা সন্ধ্যার নাস্তা খেতে বসে গেছে। একটু আগেই বাড়ি এসেছে জর্জ। ক্যাথি দেরির কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বলেছে, “এই একটু পায়ে হেঁটে আশেপাশের এলাকা দেখে এলাম। আমাদের ওশান অ্যাভিনিউই অ্যামিটিভিলের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা, বুঝলে?” বেশ ফুরফুরে লাগছিল জর্জকে। তাই আর সিরামিকের সিংহের সরে আসার ঘটনাটা ওকে বলেনি ক্যাথি। কী দরকার মানুষটাকে শুধু শুধু এসব বলা? হতেও তো পারে ওর চোখের ভুল। আর তাছাড়া বললে যদি জর্জ মেজাজ খারাপ করে? 

সেই তো মেজাজ খারাপ করলই জর্জ! 

“কী হলো আবার?” ভয়ে ভয়ে বলে উঠল ক্যাথি। 

“আরে ফোন দিয়ে কোনো কথা বলে না… কেমন যেন উদ্ভট একটা শব্দ হয়! ফাজলামো না কি? হুঁ?” বসতে বসতে বলল জর্জ। 

“লাইনের ঝামেলাও তো হতে পারে!” তুমি খাও। 

“আরে দাঁড়াও,” উঠে দাঁড়াল জর্জ, “সেদিন ফাদার ম্যানকুসোর সাথে কথা বলতেও বলতেও এমনটাই হলো! উনিই আবার আমাদের ফোন করছেন না তো?” বলতে বলতেই টেলিফোনের কাছে গিয়ে ফাদারের ব্যক্তিগত নম্বর ডায়াল করে বসল সে। 

দশবার রিং হলো, কিন্তু ওপাশে কোনো সাড়া নেই। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে রান্নাঘরের বেসিনের ওপর লাগানো ইলেকট্রিক ঘড়িটার দিকে তাকাল জর্জ। ঠিক সন্ধ্যা সাতটা বাজে। হুট করেই কেঁপে উঠল ওর শরীরটা, কেমন যেন শীত করছে! পুরো ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ করেই যেন কমে গেল! 

“ক্যাথি… ঘরটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে, তাই না?” ফিসফিসিয়ে বলল জর্জ। 

*** 

ফাদার ম্যানকুসো থার্মোমিটারটা তুলে দেখলেন তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রি! তার মানে আবার জ্বর আসছে ওনার। নাড়ির স্পন্দন দেখতে হবে, হাত ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা বারোটা স্পর্শ করল, একদম সন্ধ্যা সাতটা বাজে। কব্জিতে আঙুল রেখে গুণতে শুরু করলেন ফাদার। পুরো এক মিনিট গোনার পর চমকে উঠলেন তিনি… একশ বিশ! সাধারণত যেখানে গতি থাকে আশি। ওনার বুঝতে বাকি রইল না যে আবার অসুস্থ হতে চলেছেন! 

*** 

“ক্যাথি আমি ফায়ারপ্লেসে কিছু কাঠ দিয়ে আসি,” এই বলে বসার ঘরের দিকে ছুট দিলো জর্জ। 

“আরে আরে, না খেয়ে যাচ্ছ কোথায়?” ক্যাথিও উঠে পড়ল। মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেছে ওর। আবার ওইসব অদ্ভুত ঘটনা শুরু হয়েছে! ঠিক তখনই বসার ঘর থেকে খুব জোরে একটা শব্দ এলো। 

ক্যাথি গিয়ে দেখে জর্জ মেঝেতে পড়ে আছে! 

“এই বালের সিংহটা মেঝেতে কে রাখল?” খেঁকিয়ে উঠল জর্জ, “আরেকটু হলে মাথা ফেটে মরেই যেতাম মনে হয়!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *