দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ২৩

ত্রয়োবিংশ অধ্যায়

১২ জানুয়ারি। 

 একটু একটু করে স্বপ্নের কথা মনে পড়ছে জর্জের। ক্যাথি হয়তো ভুল শুনেছে, কারণ জর্জ ঘুমের মধ্যে, “আমি টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি” বলেনি। সে বলেছে, “আমাকে ছিঁড়ে ফেলল, মেরে ফেলল!” হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে আছে ওর, স্বপ্নের মধ্যে বারবার এটা বলেই চিৎকার দিচ্ছিল সে। 

ধীরে ধীরে পুরো স্বপ্নটাই হুবহু মনে পড়ে গেল ওর। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে সবেমাত্র একটু তন্দ্রা এসেছে ঠিক তখনই পিছন থেকে দুটো শক্তিশালী হাত চেয়ারটা ওপরে তুলে ধরে, তারপর পিছে ঘুরিয়ে দেয়! অনেক চেষ্টা করেও নড়তে পারছিল না জর্জ। সে দেখল ফায়ারপ্লেসে দেখা সেই বীভৎস দানবটা দাঁড়িয়ে আছে… অর্ধেক মুখহীন সেই শয়তানটা জ্বলন্ত চোখে তাকিয়েছিল জর্জের দিকে, যেন গিলে খাবে! তারপরেই অদ্ভুত একটা সাদা পর্দা এসে ঢেকে দিলো মুখটাকে…. কয়েক মুহূর্ত পরেই হটে গেল পর্দাটা… বদলে গেছে মুখটা! ওটা এখন জর্জের মুখ… ওর মুখেরও অর্ধেকটা নেই! 

তখনই সে চিৎকার দেয়, “আমাকে ছিঁড়ে ফেলল, মেরে ফেলল!” 

ওটা কি স্বপ্ন ছিল না কি বাস্তব? 

হুট করেই ক্যাথির ওপর মেজাজ খারাপ হলো জর্জের, “কীসব বলছ… টুকরো হয়ে যাওয়ার কথা কখন বললাম আমি, হুম? ভুল শুনেছ তুমি! ওই কথা বলিনি আমি… অন্য কথা বলেছিলাম!” কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল জর্জের, ঘুমের ভাবটা এখনও পুরোপুরি যায়নি। 

“হুম,” মাথা নাড়ল ক্যাথি, “হয়তো আমিই ভুল শুনেছি, খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি?” এই বলে জর্জের মাথাটাকে বুকে জড়িয়ে নিল সে। এই সময়ে ওর সাথে ফালতু তর্ক করে লাভ নেই। 

“বাবা,” জর্জের পাশে এসে দাঁড়াল মিসি, “আমার ঘরে এসো একবার। জোডি তোমাকে কী যেন বলতে চায়!” 

মিসির কণ্ঠে কী যেন একটা ছিল, জর্জের ঘুম ঘুম ভাবটা পুরোই কেটে গেল। রীতিমতো লাফিয়ে উঠল সে, “জোডি? জোডি কে?” 

“ওর বন্ধু,” বলল ক্যাথি, “বলেছিলাম না? মিসি কাল্পনিক বন্ধু বানায় … তেমনই আরকি। যেয়ো না, জোডিকে তো আর তুমি দেখতে পাবে না। “ 

“না না, মা,” বিরক্ত হলো মিসি, “আমি তো জোডিকে দেখতে পাই, তাহলে তোমরা কেন পাও না? ও একটা শুয়োর… অনেক বড়ো শুয়োর… এত বড়ো শুয়োর এর আগে আমি কখনও দেখিনি,” ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল মিসি। ক্যাথির মুখের দিকে চেয়ে রইল জর্জ। 

“শুয়োর!” হুট করেই চমকে উঠল জর্জ, সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল ওর, “দাঁড়াও আমি এখনই আসছি, তোমরা সবাই ঘরেই থাকো,” এই বলে সে ছুটল মিসির ঘরে। 

জর্জ গিয়ে দেখে মিসি বিছানায় উঠে পড়েছে, ঘরে আর কেউ নেই। 

“জোডি কোথায় মিসি?” ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল সে। 

“এইতো আসবে এখনই,” বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে বলল মিসি, “এক মিনিটের জন্য বাইরে গেল ও।” 

হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জর্জ, স্বপ্নে ওই পিশাচটাকে দেখার পর বাস্তবেও যদি কোনো ভয়ংকর শুয়োরকে দেখা লাগত তবে রীতিমতো পাগল হয়ে যেত জর্জ। 

“মিসি, শোনো আমার কথা,” বেশ জোরেই বলে উঠল জর্জ, “জোডি এখানে নেই।” 

“ওই তো, জোডি এসে গেছে,” হাততালি দিলো মিসি। 

অবাক হয়ে তাকাল জর্জ, জানালার দিকে আঙুল তুলে আছে মিসি। শার্শির পিছনে টকটকে লাল দুটো চোখ! কোনো মুখ দেখা যাচ্ছে না… শুধু দুটো চোখ, ওগুলো যে শুয়োরেরই চোখ সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই! 

“আমার বন্ধু জোড়ি,” চেঁচিয়ে উঠল মিসি, “ও ভেতরে আসতে চায় বাবা!” হুট করেই জর্জের বাম পাশ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে কে যেন ঘরে ঢুকল… ক্যাথি! কেমন যেন অদ্ভুত স্বরে আর্তনাদ করে উঠল সে। জানালার দিকে ছুটে যাচ্ছে মেয়েটা… টেবিল থেকে মিসির একটা খেলনা নিয়ে জানালার দিকে ছুড়ে দিলো সে। বেশ ভারী ছিল খেলনাটা, ভেঙে পড়ল কাচ… ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। 

‘ঘোঁত’ করে একটা শব্দ হলো, ঠিক যেভাবে ব্যথা পেলে শুয়োর আর্তনাদ করে… তারপরেই চোখদুটো অদৃশ্য। তাড়াতাড়ি জানালার সামনে ছুটে গেল জর্জ, নিচে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে শুয়োরের হালকা আর্তনাদের শব্দ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। যেন নৌকা রাখার ছাউনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা… ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ক্যাথি। পড়েই যাচ্ছিল সে, তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে ধরল জর্জ। 

কেমন যেন বিকৃত দেখাচ্ছিল ক্যাথির চেহারাটা। চোখে বুনো চাহনি, ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে… যেন রাস্তার কোনো পাগলি! চেঁচিয়ে উঠল সে, “ওই শয়তানটা এখানেই ছিল! মিসি অনেকবার বলেছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি… আমি ওটাকে মেরে ফেলব! মেরেই ফেলব! কিন্তু পারলাম না!” অদ্ভুতভাবে ঝাঁকি খেলো ওর শরীরটা। শক্ত হাতে ওকে ধরে রইল জর্জ, তারপর কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ড্যানি আর ক্রিসও চলে এসেছিল একটু আগে, বাবার পিছে পিছে ওরা বেরিয়ে এলো। বের হওয়ার সময় শুধুমাত্র ক্রিস খেয়াল করল যে মিসি ভাঙা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কাকে যেন হাত নাড়াচ্ছে! 

কিছুক্ষণ পরেই ওকে ডাক দিলো জর্জ, বেরিয়ে এলো মেয়েটা। জর্জদের শোবার ঘরে চলে গেল সবাই। 

*** 

ভোর হয়ে এলো। জর্জ আর ক্যাথি চেয়ারে ঘুমাচ্ছে আর বাচ্চারা বিছানায়। ওদিকে নিজের গাড়ি নিয়ে রকভিলের বিশপ অফিসে রওনা দিয়েছেন ফাদার ম্যানকুসো। 

ঠান্ডায় রীতিমতো কাঁপছিলেন তিনি। শীতকালে এত সকালে কখনোই গাড়ি চালান না ফাদার। অফিসে পৌঁছানোর পর বিশপের ব্যক্তিগত সচিব চা খেতে দিলো ফাদারকে। ছেলেটাকে চেনেন ফাদার, এককালে ওনারই ছাত্র ছিল। এখনও ফাদারকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে সে। নানান বিষয়ে কথা হলো দু’জনের, কিছুক্ষণ পরেই এসে গেলেন বিশপ 

বেশ বয়স্ক মানুষ বিশপ, মাথাভরতি সাদা চুল। ওনার জন্য ফাদার ম্যানকুসোর আলাদা একটা ফাইলই বানিয়ে রেখেছিলেন দুই চ্যান্সেলর। বেশ মন দিয়ে ওগুলো দেখলেন তিনি। 

“শোনো ম্যানকুসো,” রিপোর্টগুলো দেখা শেষ করলেন বিশপ, “তুমি আর এই ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ো না, যদি ওদের বাড়িতে শুদ্ধীকরণ অভিযান চালাতেই হয়… তবে সেই ব্যবস্থা আমিই করব। আরেকজন অভিজ্ঞ যাজককে ইতোমধ্যেই বলেছি ব্যাপারটা।” 

“হুম!” 

“কী চেহারা হয়েছে তোমার! ফাদার রায়ানের কাছ থেকে যা শুনলাম… মনোচিকিৎসক দেখাচ্ছ না কেন তুমি?” 

এবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ফাদার ম্যানকুসোর, “মহামান্য বিশপ, এতে কি কোনো কাজ হবে? আমার অসুখ ভালো হবে?”

বিশপ বুঝতে পারলেন যে ম্যানকুসো রেগে যাচ্ছেন, তাই তিনি বললেন, “দেখো ম্যানকুসো, তুমি ধরেই নিয়েছিল ওই বাড়িতে অশুভ কোনো প্ৰেত আছে! এসব এত নিশ্চিতভাবে বলা যায় না! আমার তো মনে হয় ওই বাড়ির কথা ভেবে ভেবেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ছ…” 

“মহামান্য বিশপ…” 

“শোনো ম্যানকুসো,” উঠে এসে ফাদারের কাঁধে হাত রাখলেন বিশপ, “ওদের আর ফোন দেবে না তুমি। আমি যে যাজককে ঠিক করেছি… সে দেবে। তুমি নিজের খেয়াল রাখো। তোমাকে অনেক পছন্দ করি আমি… চাই না তোমার কিছু হয়ে যাক!” 

*** 

সোমবার সকালে বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল ক্যাথির। ড্যানি আর ক্রিসের স্কুল আর বাদ দেওয়া যাবে না। এভাবে বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি করার কোনো মানে নেই। মনকে শক্ত করল ক্যাথি, তারপর দুই ছেলে তুলে নাস্তা খেতে দিলো। মিসিও উঠে এলো একটু পর, ওকেও নাস্তা খাওয়াল ক্যাথি। তারপর তিন জনকে ভ্যানে তুলে রওনা দিলো স্কুলের দিকে। জর্জ তখনও ঘুমিয়ে। 

মিসিকে নিয়ে ক্যাথি যখন ফিরল ততক্ষণে জর্জ উঠে গেছে। ওকে নিয়ে কফি খেতে বসল ক্যাথি, জর্জের ঘোরলাগা ভাবটা এখনও যায়নি। এই সময়ে ক্যাথির শক্ত থাকার বিকল্প নেই, একেবারে দু’জন ভেঙে পড়লে বাচ্চাদের কী হবে? জর্জের সাথে নানান ব্যাপারে আলাপ শুরু করল সে, তারপর ওকে মনে করিয়ে দিলো যে মিসির ঘরের জানালা ঠিক করতে হবে। 

ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটা ছেড়ে ইস্ট ব্যাবিলনে যাওয়ার কথাও ভাবছে ক্যাথি, কিন্তু এখন সে কথা জর্জকে বলবে না ও। 

পেরেক দিয়ে জানালার পাল্লাতে কয়েকটা প্লাইউডের তক্তা মেরে দিলো জর্জ। যাক, মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হলো। বৃষ্টির পানি বা তুষার আর ঢুকবে না। 

“জর্জ,” তখনই নিচ থেকে ডাক দিলো ক্যাথি, “তোমার সিয়োসেটের অফিস থেকে ফোন দিয়েছে, এসো তো!” 

এসে ফোন ধরল জর্জ। হিসাবরক্ষক ওকে মনে করিয়ে দিলো যে আজ বারোটায় সেই কর কর্মকর্তার আসার কথা। 

“এক কাজ করো, তুমিই সামলে নাও না ব্যাপারটা, হুম?” বলল জর্জ। বাড়ি থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা নেই ওর, শুধু ভয় হচ্ছে ও বের হলেই যদি আবার ভয়ংকর কিছু হয়? 

“স্যার এটা কীভাবে হয়? মালিকপক্ষের কেউ না থাকলে তো কর্মকর্তা আমাদের জরিমানা করে দেবেন!” ভয় পেয়ে গেল হিসাবরক্ষক। 

“যাও যাও, কোনো ঝামেলা হবে না,” জর্জের কাঁধে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলল ক্যাথি। 

“আচ্ছা আমি আসছি,” বলে ফোনটা রেখে দিলো জর্জ। 

“আরে এসব কর কর্মকর্তারা বেশিক্ষণ থাকে না, তুমি তাড়াতাড়িই চলে আসবে। আমার আর মিসির চিন্তা করো না,” ম্লান হাসি ফুটে উঠল ক্যাথির মুখে, “আমরা ভালোই থাকব। কাছেরই একটা কাচের দোকানের নম্বর আছে… ওখানে ফোন করে মিসির ঘরের জানালা-সহ আর সব জানালা ঠিক করার জন্য লোক পাঠাতে বলব।” 

“আচ্ছা, যাচ্ছি তবে।” 

কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল জর্জ। হাসিমুখে ওকে বিদায় জানাল ক্যাথি। কেউই জোডির কথা তুলল না। 

মিসিকে দুপুরের খাবার খাওয়াচ্ছিল ক্যাথি, তখনই ফোন দিলো জর্জ কেকোরিস। সে জানাল যে ওর ফ্লু হয়েছে, তাই জর্জকে যেদিন আসার কথা দিয়েছিল সেদিন আসতে পারছে না। শুধু তাই নয়, আর যে ক’টা তদন্তে যাওয়ার কথা ছিল তার সবগুলোই বাতিল করে দিয়েছে। শরীরের অবস্থা বেজায় খারাপ… তবে দুয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবে। সবকিছু ঠিক থাকলে বুধবারে সে ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে রাত কাটাবে। 

ওদিকে কেকোরিসের কথা তেমন মন দিয়ে শুনছিল না ক্যাথি। ওর নজরে চলে গেছে মিসির দিকে। খেতে খেতে টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাকা কার সাথে যেন কথা বলছে মেয়েটা! কয়েকবার তো টেবিলক্লথের নিচে হাত ঢুকিয়ে পিনাট বাটার আর জেলির স্যান্ডউইচও এগিয়ে দিয়েছে সে! মা যে ওকে দেখছে সেটা এখনও টের পায়নি বাচ্চা মেয়েটা। 

টেলিফোনের সামনে থেকে টেবিলের নিচটা ভালো করে দেখা যায় না। কিন্তু জোডির ব্যাপারে মিসিকে কিছু জিজ্ঞাসাও করল না সে। শেষ হলো কেকোরিসের কথা, ফোনটা রেখে এগিয়ে এলো ক্যাথি। 

একটা চেয়ারে বসে মিসির চোখে চোখ রাখল, “মিসি, জোডি কি সেই দেবদূত? যার কথা তুমি বলেছিলে?” 

অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল মিসি, যেন কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারেনি ও। 

“আরে, মনে নেই?” মাথা নাড়ল ক্যাথি, “তুমি একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে না? দেবদূতেরা কথা বলে না কি?” 

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ মা,” খুশিতে ভরে উঠল মিসির মুখটা, “জোডি আসলে একজন দেবদূত, ও সারাদিন আমার সাথে গল্প করে!” 

“আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো… মানে একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। তুমি গল্পের বইয়ে দেবদূতদের ছবি দেখেছ… ক্রিসমাস ট্রিতেও অনেক দেবদূতের ছোট্ট পুতুল ছিল… দেখেছ না এসব?” 

“হ্যাঁ মা!” 

“তুমি না বলো জোডি একটা শুয়োর? তাহলে ও আবার দেবদূত হয় কী করে?” 

চিন্তায় পড়ে গেল মিসি, ভ্রু কুঁচকে ও বলল, “কিন্তু ও যে আমাকে সেটাই বলেছে! অনেকবার বলেছে!” বেশ কয়েকবার মাথা নাড়াল সে, “জোডি মিথ্যা বলে না।” 

চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে মিসির আরও কাছে গিয়ে বসল ক্যাথি, “তোমার সাথে আর কী কী গল্প করে ও?” 

অবাক হয়ে চেয়ে রইল মিসি, যেন মায়ের কথাগুলো বুঝতে পারছে না ও। “মানে তোমরা কোন কোন ব্যাপার নিয়ে কথা বলো? ও তোমার সাথে খেলে?” 

“না না, খেলে না। শুধু গল্পই করে। ও আমাকে বলেছে যে আমার ঘরে আগে একটা বাচ্চা থাকত… ছোটো একটা ছেলে,” আশেপাশে কেমন যেন অদ্ভুত নজরে তাকাল সে, “ওই ছেলেটা মারা গেছে মা!” ফিসফিসিয়ে বলল সে, “অনেক অসুখ হয়েছিল… ভুগে ভুগে মারা গেছে!” 

“আচ্ছা? আর কী কী বলেছে?” 

“হুম,” একটু ভাবল মিসি, “গতরাতে ও আমাকে বলেছে যে সারাজীবন আমি এই বাড়িতেই থাকব। যাতে করে ওই ছেলেটা আমার সাথে খেলতে পারে!”

তীব্র আতঙ্কে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল ক্যাথি, চিৎকার করতে খুব ইচ্ছা করছে তার! 

*** 

ওদিকে কর কর্মকর্তা একেবারে হয়রান করে ফেলল জর্জকে। বেশ কয়েক জায়গার কর মওকুফ করতে অনুরোধ করল জর্জ, এটাও বলল যে কোম্পানির অবস্থা ভালো নেই। কিন্তু কর্মকর্তা কিছুই বোঝে না! জর্জও ছাড়ার পাত্র না। অবশেষে লোকটা বলল, “আপনি চাইলে আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন! কিন্তু আমি কোনো কর মওকুফ করব না।” 

যাক, এটাই জর্জের জন্য অনেক কিছু। ফেরার আগে বাড়িতে ফোন করল সে, ক্যাথিকে জানাল বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে ফিরবে। 

ওরা তিন জন বাড়ি এসে দেখে ক্যাথি আর মিসি ওভারকোট পরে তৈরি।

“জর্জ, তোমাদের জামা-কাপড় খোলার দরকার নেই,” বলল ক্যাথি, “আমরা এখনই ইস্ট ব্যাবিলনে চলে যাব। “ 

ড্যানি আর ক্রিস তো অবাক! আর জর্জ বিরক্ত। 

“কী ব্যাপার? হলোটা কী তোমাদের?” হাত নাড়ল জর্জ। 

“মিসিকে জোডি বলেছে যে সে একজন দেবদূত, এই আরকি,” ছেলেদের ঠেলে দরজার দিকে নিয়ে চলল ক্যাথি, “আমরা এখনই এখান থেকে চলে যাব!”

“দাঁড়াও,” জর্জ শক্ত করে ধরল ওর হাতটা, “এক মিনিট তো সময় দাও আমাকে? জোড়ি দেবদূত? মানে কী? 

মিসির দিকে তাকাল ক্যাথি, “মিসি, তোমার বাবাকে বলো তো, জোডি কী বলেছে!” 

“বাবা,” হাসল মিসি, “মা ঠিকই বলেছে, জোডি নিজেই বলেছে আমাকে এসব… ও দেবদূত!” 

মেয়েকে একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল জর্জ ঠিক তখনই বাড়ির পিছন থেকে হ্যারির ডাক ভেসে এলো। “হ্যারি!” চমকে উঠল জর্জ, ‘ওর কথা ভুলেই গেছিলাম!” 

হ্যারির ঘরের কাছে এসে ওরা দেখল যে নৌকা রাখার ছাউনির দিকে চেয়ে পাগলের মতো ডেকে চলেছে কুকুরটা। বারবার ওদিকে ছুটতে চাচ্ছে কিন্তু গলায় বাঁধা শিকলটার কারণে কিছুটা এগোতেই থেমে যেতে হচ্ছে ওকে। 

“হলো কী তোমার?” হ্যারির ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলো জর্জ, “ছাউনিতে কেউ ঢুকেছে?” একেবারে লাফিয়ে সরে গেল হ্যারি। 

“জর্জ, তুমি আবার ছাউনির দিকে যেয়ো না,” চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি, “চলো তাড়াতাড়ি আমরা এই বাড়ি ছেড়ে পালাই। “ 

নিচু হয়ে হ্যারির গলার শিকলটা খুলে দিলো জর্জ। সাথে সাথে ছাউনির দিকে ছুটল হ্যারি, ওটার বন্ধ দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে… তারপর পিছিয়ে এসে আবার ডাকতে লাগল। 

এগিয়ে গেল জর্জ, ছাউনির দরজা খুলতে লাগল সে। দেখা যাক হ্যারি ঢুকে কী করে! তখনই ক্রিস আর ড্যানি এসে হ্যারিকে টেনে নিল। 

“দরজা খুলো না বাবা,” প্রায় কেঁদে ফেলল ক্রিস, “ভেতরে ঢুকলে হ্যারি আর বাঁচবে না! ওকে ওরা মেরে ফেলবে!” 

গলায় লাগানো কলারটা ধরে হ্যারিকে বসাল জর্জ। তারপর ক্রিসকে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যারিকে কারা মেরে ফেলবে?” 

ওর প্রশ্ন কানেই নিল না ছেলেটা। বরং হ্যারিকে বোঝাতে লাগল, “কিছু হয়নি হ্যারি, তুমি চুপচাপ এখানে বসো… যেয়ো না ওখানে!” কিন্তু হ্যারি তখনও বেশ উত্তেজিত। 

“চলো, ওকে নিয়ে ভেতরে যাই,” বাড়ির দিকে এগোতে লাগল জর্জ, “ছাউনি না দেখতে পেলে ও আর চেঁচাবে না।” 

দুই ছেলে হ্যারিকে টেনে ঢোকাতে শুরু করল। তখন ওদের বাড়ির সামনে একটা ভ্যান এসে থামল। জানালা ঠিক করার লোক চলে এসেছে! “আরে, ও যে আসবে ভুলেই গেছিলাম!” ফিসফিসিয়ে বলল ক্যাথি। “যাক, তাহলে দেরি হওয়াতে ভালোই হয়েছে,” এই বলে ওদের দিকে এগিয়ে গেল জর্জ। 

গাড়ি থেকে একটা লোক নামল। থলথলে মুখ, বেশ ফর্সা। “কী খবর আপনাদের? জানালাগুলোর কী অবস্থা?” লোকটার কথায় স্লাভিক টান স্পষ্ট, “কী যে বাজে আবহাওয়া চলছে। তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম। আপনাদেরও তো বেশ ভোগান্তি হচ্ছে।” 

“তা তো হচ্ছেই, আরেকবার বৃষ্টি এলে বাড়ি ভিজে যাবে,” হাসল জর্জ।

“সেটাই, জানালা এখনই ঠিক না করলে পরে খরচ আরও বেড়ে যাবে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ ভেতরে আসুন। ভাঙা জানালাগুলো দেখাচ্ছি আপনাকে।

“সেদিনের ঝড়ে ভেঙেছে, তাই না?” 

“হ্যাঁ, কী মারাত্মক ঝড়টাই না হয়েছিল!” 

*** 

লোকটার কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা ছ’টা বেজে গেল। বেশ সময় নিয়ে সবগুলো জানালা ঠিক করল লোকটা, তারপর জর্জকে বলল, “যাক, এমন কাজ করে দিলাম যে অন্তত সামনের পাঁচ বছর কোনো ঝামেলা হবে না। তবে দুঃখিত স্যার, ছোটো মেয়েটার ঘরের জানালা ঠিক করতে পারলাম না। কাঠমিস্ত্রি দিয়ে আগে কাঠামোটা ঠিক করতে হবে… সেটা ঠিক হওয়ার পর আবার আমাকে ডাকবেন।” 

“হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবছিলাম, সমস্যা নেই। এই সপ্তাহেই আপনাকে আবার ডাকব,” এই বলে পকেটে হাত ঢোকাল সে, “তা কত দেবো? 

“আরে না না, এখনই না। হিসাব করে বিল পাঠিয়ে দেবো, আমার বাড়িও এই অঞ্চলেই। সেই হিসেবে আপনারা আমার প্রতিবেশী। আর তাছাড়া আবার তো আসতে হবে আমাকে।” 

“বেশ বেশ,” হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জর্জ। লোকটার পুরো পারিশ্রমিক দেওয়ার মতো টাকা তখন এমনিতেও ওর পকেটে ছিল না। লোকটার আন্তরিক ব্যবহারে ক্যাথিও বেশ খুশি হলো। পুরোটা সময়ই ওভারকোট পরে রান্নাঘরে বসেছিল সে, কিন্তু লোকটা যাওয়ার পর কোট খুলে রান্না করতে লেগে পড়ল, সন্ধ্যাবেলায় জর্জ আর বাচ্চাদের নাস্তা দিতে হবে। 

“আমার অতো খিদে নেই, বুঝলে?” আস্তে করে বলল জর্জ, “ভাজা মাংস আর পনিরের স্যান্ডউইচ করে দিলেই হবে। “ 

ফ্রিজ থেকে মাংস বের করল ক্যাথি। জর্জের জন্য স্যান্ডউইচ আর বাচ্চাদের জন্য হ্যামবার্গার বানাবে। ড্যানি আর ক্রিসও এলো রান্না দেখতে, ওদের রান্নাঘরের টেবিলেই হোমওয়ার্ক করতে বসিয়ে দিলো ক্যাথি। বসার ঘরে টিভি দেখছিল মিসি, আর জর্জ ফায়ারপ্লেসে কাঠ দিচ্ছিল। জানালা ঠিক করার লোকটা বেশ অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চাদের খেলাঘর আর দোতালার সেলাইঘরে কাজ করেছে। কই তার তো কিছু হয়নি! ব্যাপারটায় একটু সাহস পেয়েছে ক্যাথি আর জর্জ। কে জানে, হয়তো অদ্ভুত ঘটনাগুলো সবই ওদের কল্পনা ছিল? ঝড়ে দরজা-জানালা ভাঙার শব্দ তো ওরা না-ও পেতে পারে… হয়তো সবার ঘুমই বেশ গভীর ছিল? 

বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা কিছুক্ষণের জন্য বিদায় নিল ক্যাথির মন থেকে। 

***

ওদিকে ফাদার ম্যানকুসো বেজায় বিরক্ত বিশপের ওপর। কেন যেন ওনার মনে হচ্ছে সবকিছুর পিছনেই ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার সেই অপশক্তির হাত আছে! ওনাকে আর লুজদের কষ্ট দিয়ে মজা পাচ্ছে ওই শক্তিটা। হয়তো বিশপের ওপরে প্রভাব বিস্তার করেছে? নইলে বিশপ কেন ওনাকে মনোচিকিৎসকের কাছে যেতে বললেন? মঙ্গলবার রাতে ঘুমানোর আগে মন দিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন তিনি, যেন লুৎজরা মুক্তি পায় ওই অপশক্তির হাত থেকে…. ওই বাড়িতে খারাপ কিছু আছে, অবশ্যই আছে। 

*** 

রাতের বেলা জর্জ আর ক্যাথি ঠিক করল যে সেদিনও ওরা সবাই একসাথে ঘুমাবে। ড্যানি, ক্রিস আর মিসিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হ্যারিকে বেসমেন্টে রেখে এসেছে জর্জ। জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে পড়ল জর্জ আর দুটো চেয়ার একসাথে করে হেলান দিয়ে বসল ক্যাথি। 

“তুমিও দুটো চেয়ার নাও জর্জ?” হাই তুলল ক্যাথি। 

“নাহ, একটাতেই ঠিক আছি, আর তাছাড়া ওভাবে ঘুম এসে যাবে। আমি সারারাত জেগে থাকব… সকালে ঘুমাব।” 

রাত সোয়া তিনটার দিকে নিচতলায় শুরু হলো সেই অপার্থিব বাজনা। এবার আর নিচে নামল না জর্জ। “সবই আমার মনের ভুল, “ হাসল সে, “নিচে নেমে তো দেখব কিছুই নেই!” ক্যাথি আর বাচ্চারা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাজনার তালে তালে মাথা দোলাতে শুরু করল জর্জ, ড্রাম আর শিঙা এত জোরে বাজছে যে 

আধমাইল দূর থেকেও শোনা যাবে। নাহ, আসলেই সব ওর মনের ভুল… নইলে এত আওয়াজের মধ্যে ক্যাথিরা ঘুমাচ্ছে কী করে? 

ঘুমিয়ে পড়ল জর্জ। 

রীতিমতো ঝাঁকিয়ে ওর ঘুম ভাঙাল ক্যাথি। অদ্ভুত দুটো ভাষাতে না-কি চিৎকার করছিল জর্জ… কোনো ভাষাই ক্যাথি আগে কখনও শোনেনি। হুট করেই না-কি জর্জের চিৎকারে ঘুম ভাঙে ওর, তারপর উঠে গিয়ে স্বামীকে ঝাঁকাতে শুরু করে। 

জর্জের গায়ে হাত দিতেই না-কি গর্জে উঠেছিল সে, তারপর পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে ওঠে, “ওটা ক্রিসের ঘরে… ক্রিসের ঘরেই আছে… ওখানেই থাকবে আজীবন!” 

কণ্ঠটা ছিল অন্য কারও! তারপরেও ভয় না পেয়ে ওকে জাগিয়ে তোলে ক্যাথি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *