দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ১৭

সপ্তদশ অধ্যায় 

৬ ডিসেম্বর। 

“তোমার গল্পটা বেজায় অদ্ভুত ফ্রাংক, সত্যি বলছি… যদি তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনতাম, তবে হয়তো ভাবলাম কথাগুলো পাগলের প্রলাপ,” টেবিল থেকে ঘরের এক কোনে রাখা কফি মেশিনটার দিকে এগিয়ে গেলেন বিশপের অফিসের চ্যান্সেলর, ফাদার রায়ান। 

“আমি কফি খাব না ফাদার,” বলে উঠলেন ফাদার ম্যানকুসো। 

“হুম,” নিজের জন্য এক কাপ আর অফিসের দ্বিতীয় চ্যান্সেলর ফাদার নানসিওর জন্য আরেক কাপ দুধ ছাড়া কফি ঢাললেন ফাদার রায়ান। 

নিজের টেবিলে ফিরে এলেন তিনি, তারপর কফিতে বেশ কয়েকটা চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমার কাছে তো অনেকেই পরামর্শের জন্য আসে। এসব আধিভৌতিক ব্যাপার নিয়ে এর আগে আর কেউ এসেছে? আসার তো কথা… শ’খানেক মানুষ তো হবেই, তাই না?” 

“তেমন না, আমি এসব ব্যাপারে তেমন অভিজ্ঞ নই,” হাসলেন ফাদার ম্যানকুসো। 

ফাদার নানসিও চুপচাপ কফিতে চুমুক দিয়ে যাচ্ছিলেন। 

ফাদার রায়ান বিশালদেহী মানুষ, মনে হচ্ছে যেন পুরোটা টেবিল জুড়েই বসে আছেন তিনি। উচ্চতা ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি, মাথাভরতি কাঁচাপাকা চুল আর আইরিশদের মতো ভারী থলথলে মুখ। বয়স ষাটের ওপরে। মুখের ওপর কথা বলে দেওয়ার জন্য বেজায় বদনাম আছে এই লোকের। নিজের চেয়ে অনেক বেশি বয়সি যাজকদেরও খুব একটা তোয়াক্কা করেন না ইনি আর অল্প বয়স্ক যাজকেরা তো রীতিমতো ভয় পায় তাকে। স্বয়ং বিশপের মুখের ওপরও কয়েকবার হক কথা বলে দিয়েছেন! ফাদার নানসিও আবার ঠিক এর ঠিক বিপরীত। বেঁটে-খাটো মানুষ তিনি, মাথাভরতি কালো চুল, বয়স ৪২। কথা বলেন বেশ আস্তে আস্তে, ফাদার রায়ান যতটা হাসি-খুশি, ইনি ততটাই গম্ভীর। 

এতক্ষণ দু’জনে বেশ মন দিয়ে ফাদার ম্যানকুসোর অদ্ভুত অভিজ্ঞতা শুনছিলেন। লুজদের বাড়িতে প্রথম যাওয়া, সেই সতর্কবার্তা, ওদের দুর্ভোগ, নিজের বাজে অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক ঝামেলা, অদৃশ্য হাতের থাপ্পর… কিছুই বাদ দেননি ম্যানকুসো। মাঝে মাঝে প্যাডে কিছু নোট লিখে নিয়েছেন ফাদার রায়ান। আধিভৌতিক ব্যাপার-স্যাপারে ফাদার ম্যানকুসোর অনভিজ্ঞতার কথা তারা দু’জনেই জানেন। 

প্যাডে লেখা নোটগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে মুখ তুললেন ফাদার রায়ান, “দেখো ফ্রাংক, তোমার সব কথাই তো শুনলাম। বিষয়টা তুমি কীভাবে সমাধান করবে সেই ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার আগে তোমাকে কিছু প্রাথমিক তথ্য জানিয়ে রাখি, যেহেতু এক্ষেত্রে তোমার অভিজ্ঞতা বেশ কম। কিছু মনে করো না? ঠিক আছে? ফাদার নানসিও… তুমিই বলো।” 

“আচ্ছা ফ্রাংক শোনো,” কফির কাপটা নামিয়ে রাখলেন ফাদার নানসিও, “তুমি হয়তো ধরেই নিয়েছো যে লুজদের বাড়িতে যা হচ্ছে পুরোটাই আধিভৌতিক ব্যাপার, কোনো দুষ্ট আত্মা আছে বাড়িটায়, তাই না? কিন্তু আমাদের ক্যাথলিকদের বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো জায়গা বা বস্তুর ওপর কখনও প্রেতশক্তির প্রভাব থাকতে পারে না। কেবল মানুষ আর অন্য প্রাণীদের ওপরই এরা প্রভাব বিস্তার করতে পারে,” এই বলে পকেট থেকে একটা সিগারের প্যাকেট বের করলেন তিনি। একটা সিগার নিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন বাকি দু’জনের দিকে, কিন্তু কেউই নিল না। সিগার ধরিয়ে বেশ কয়েক টান মেরে তিনি আবার বলতে লাগলেন, “আসলে শয়তান নানানভাবে মানুষকে প্ররোচিত করে। তাদের ভুল পথ দেখায়… শয়তান ক্রমাগত আমাদের খারাপ কাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা শয়তানের সাথে লড়াই করাই কিন্তু আসল। কিছু ক্ষেত্রে শয়তান আমাদের মানসিক রোগেও আক্রান্ত করে ফেলে, তাই না?” 

“একদম,” মাথা নাড়লেন ফাদার ম্যানকুসো, “মাঝে মাঝেই লোকেরা আমার কাছে এমন সমস্যা নিয়ে আসে। ওরা খারাপ কাজ ছাড়তে চায়, কিন্তু পারে না। এসব মূলত শয়তানেরই প্ররোচনা। মানসিক সমস্যাগুলোও ওই অভিশপ্ত সত্তার কারণেই হয়।” 

“মাঝে মাঝে শয়তানি প্রভাব একটু অদ্ভুত রূপ ধারণ করে,” বলতে লাগলেন ফাদার রায়ান, “সে মানুষকে জাগতিক মোহে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে মানুষ ভালো আর মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে সে জাগতিক জিনিসপত্রকে মানুষের সামনে এমনভাবে তুলে ধরে, যে ওরা ভেবে নেয় দুনিয়াতেই সব আছে… পরকালের চিন্তা আর থাকে না। এই ব্যাপারটা বোঝা কিন্তু খুব জটিল… তাই না নানসিও?” 

“মোহ,” সিগারে আরও কয়েকটা টান মারলেন ফাদার নানসিও, “জগতের মোহে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। কারও ক্ষতি করতে একটুও বাধে না তার। এই পর্যায়ে এসে মানুষের সাথে শয়তানের আর কোনো পার্থক্য থাকে না। মানুষই শয়তান আবার শয়তানই মানুষ। তবে কোনোভাবেই মানুষকে বিপথে না নিতে পারলে শয়তান নিজের অলৌকিক শক্তি প্রয়োগ করে… ভূত-প্রেত, অশুভ আত্মারা সবাই তো তারই দাস।” 

“সেটাই সেটাই, তারপর?” আগ্রহী হয়ে উঠেছেন ফাদার ম্যানকুসো। বিশপের অফিসে আসার আগে তিনি বেশ চিন্তাতে ছিলেন। এখানকার এত জ্ঞানী যাজকেরা ওনার শুনে যদি হেসে ফেলেন? কিন্তু ইনারা যেভাবে মন দিয়ে ওনার কথা শুনেছেন, তাতে এখন উনি নিশ্চিত যে একটা না একটা সমাধান আসবেই। 

“আসলে এইসব ভৌতিক ব্যাপারগুলোকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা সব মিলিয়ে পাঁচটি ব্যাপার দেখতে পেয়েছি,” আরেক কাপ কফি নিয়ে এলেন ফাদার রায়ান, “এক, মিথ্যা এবং ধোঁকাবাজি; দুই, এমন সব ঘটনা যার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে; তিন, মানসিক সমস্যা; চার, সত্যিকার অর্থেই পিশাচের প্রভাব; পাঁচ, এমন সব অলৌকিক ঘটনা যেগুলো কী কারণে হয় তা কেউ জানে না! তুমি যে ঘটনাটা বললে তা মিথ্যা হতে পারে না। কারণ জর্জ আর ক্যাথি তোমারই পরিচিত, তুমি যেহেতু ভালো মানুষ, ওরাও হয়তো এমন। যা ঘটেছে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়াও কঠিন… তো আমরা ধরে নিচ্ছি ব্যাপারটা হয় মানসিক সমস্যা… নইলে এখানে আসলেই পিশাচের প্রভাব আছে।” 

“পাঁচ নম্বর যে ব্যাপারটার কথা ফাদার রায়ান বললেন,” মৃদু হাসলেন ফাদার নানসিও, “সেটাকে কেন বাদ দেওয়া হয়েছে জানো? আমরা মনে করি ওসব মূলত ঈশ্বরের হস্তক্ষেপে হয়। ঈশ্বর তো আর নিজের নিষ্পাপ সন্তানদের এভাবে কষ্ট দেবেন না, তাই না?” 

“অর্থাৎ,” আবার বলতে লাগলেন ফাদার রায়ান, “ঘুরে ফিরে ওই দুটো ব্যাপার নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে। ক্যাথিকে অদৃশ্য কেউ স্পর্শ করল কিংবা জর্জ অদৃশ্য লোকেদের বাজনা শুনতে পেল এগুলো কিন্তু মানসিক সমস্যাও হতে পারে। পরামনোবিদরা এসব নিয়ে অনেক গবেষণা করছেন আজকাল। মানসিক সমস্যা খুব জটিল একটা বিষয়, তোমার পাশের মানুষের যদি এই সমস্যা থাকে তবে সে তোমাকেও আক্রান্ত করে ফেলতে পারে। নর্থ ক্যারোলাইনার ডারহামের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিখ্যাত মনোবিদ ড. রাইনের মতে মানসিক সমস্যার চারটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে আমাদের মস্তিষ্ক এমন একটা সংকেত পায় যে জায়গাটা অশুভ, তারপর ওই জায়গা সম্পর্কে আগে থেকে শোনা কিছু অদ্ভুত কথা আমাদের মনে আসে এবং তারপর চোখের সামনে অদ্ভুত সব দৃশ্য ভেসে ওঠে কিংবা আমরা অদ্ভুত গন্ধ পাই বা কোনো শব্দ শুনি। জর্জ কিন্তু আগে থেকেই জানত ওখানে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যাপারে, তাই না? এই কারণে হয়তো সে রাত সোয়া তিনটার সময় উঠে যেত? আর সিংহটার স্থান পরিবর্তন? এটার জন্য চতুর্থ ধাপের ব্যাপার বুঝতে হবে তোমাকে। সাইকোকাইনেসিস বা মনোগতিসঞ্চারের নাম শুনেছ? কোনো বস্তুর ওপর গভীর মনযোগ দিয়ে তাকে মনের শক্তির মাধ্যমে অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য করা! এটা কিন্তু আসলেই ঘটে! হতে পারে জর্জ বা ক্যাথি কেউ এই ক্ষমতা পেয়ে গেছে, কিন্তু বোঝেনি।” 

“সেটাই,” নিজের খালি কাপটা নিয়ে কফি মেশিনের দিকে এগিয়ে গেলেন ফাদার নানসিও, “এতকিছু যে আমরা তোমাকে বললাম, এমনি এমনি কিন্তু বলিনি। শুরুতেই ব্যাপারটাকে ভৌতিক কেন ধরে নিচ্ছ? এক কাজ করো, ডক্টর রাইনের মতো কোনো বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করো। তাদের দিয়ে বাড়িটা ভালো করে পরীক্ষা করাও। দেখো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না-কি পরামনোবিজ্ঞান আজকাল অনেক এগিয়েছে।” 

“আচ্ছা, তাহলে আমার সমস্যা কেন হচ্ছে?” উঠে দাঁড়ালেন ফাদার ম্যানকুসো, “আমি কী করব?” 

“হুম,” একটু হাসলেন ফাদার রায়ান, “তুমি আর কখনও ওই বাড়িতে যেয়ো না। ওদের ফোন দিয়ে আমরা যা বলেছি সেগুলো বলে দিয়ো, কিন্তু নিজে আর যেয়ো না। কখনোই না, কোনোভাবেই না! ওই বাড়ি নিয়ে ভাবারও প্রয়োজন নেই তোমার।” 

“এ আবার কেমন কথা! এতক্ষণ আপনাদের কথা শুনে তো মনে হলো আপনারা বিশ্বাস করছেন না যে ওই বাড়িতে ভৌতিক কিছু আছে। তাহলে? আমি গেলে কী সমস্যা?” মেজাজ খারাপ হচ্ছে ফাদার ম্যানকুসোর। 

“হ্যাঁ, আমরা বিশ্বাস করছি না,” হাত নাড়লেন রায়ান, “কিন্তু ওই যে… মানসিক রোগ বড়োই ভয়ানক। ওদের সাথে থেকে, ওদের কথা শুনে… তুমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছ যে ওই বাড়িতে ভূত আছে। তাই দয়া করে… আর ওখানে যেয়ো না। বিশ্রাম নাও। ১১২ নম্বর ওশান অ্যাভিনিউতে যা ঘটছে সেগুলোর ব্যাখ্যা খুব তাড়াতাড়িই পাওয়া যাবে।” 

**** 

বাচ্চাদের নাস্তা খাইয়ে গাড়িতে করে দুই ছেলেকে ওদের নতুন স্কুলে নামিয়ে দিলো ক্যাথি, তারপর মিসিকে নিয়ে মায়ের বাড়ি বেড়াতে চলে গেল। ওদিকে জর্জ বাড়িতে একা, বেসমেন্ট পরিষ্কার করার জন্য নিচে নামল সে। কিন্তু কোনো গন্ধ নেই! আজব ব্যাপার! আগের দিনই গন্ধে বমি করে ফেলেছিল না। ওখানে দুটো ফ্যান লাগিয়ে দিলো সে। 

এরপর ভালো করে পুরো বেসমেন্ট ঘুরেও কোনো গন্ধ পেল না সে। অবশেষে প্লাইউডের দরজা সরিয়ে সেই লালঘরটাতে ঢুকল। টর্চ মেরে ভালো করে দেখল, ওখানেও কোনো গন্ধ নেই। 

“আশ্চর্য,” আপনমনেই বলে উঠল জর্জ, “নিশ্চয় এখানে কোনো ভেন্টিলেটর আছে, নইলে গন্ধ কী করে বেরিয়ে গেল? “ 

গর্তটা খুঁজে বের করার জন্য পুরো ঘরটা তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগল জর্জ। ওদিকে ফাদার ম্যানকুসো ফোন দিচ্ছেন তাকে। বিশপের অফিস থেকে তাড়াতাড়িই রেক্টরিতে ফিরেছেন তিনি। জর্জকে ফোন দিয়ে চ্যান্সেলরদের পরামর্শ যত তাড়াতাড়ি জানানো যায়, ততই ভালো। দশবার রিং হওয়ার পরেও ফোনটা কেউ ধরল না। ফাদার ভাবলেন হয়তো লুৎত্তরা বাইরে কোথাও গেছে। 

“একটু পর ফোন দেবো,” আপনমনেই বলে উঠলেন তিনি। 

ফোনের রিং কিন্তু একেবারেই শুনতে পায়নি জর্জ, অথচ বেসমেন্টের দরজা খোলাই ছিল। বাসার সব জায়গা থেকেই ফোনের রিং শোনা যায়, কিন্তু সেদিন শোনা গেছিল না। 

ওদিকে লাল ঘরটায় কিছু না পেয়ে ওপরে উঠে এলো সে। পুরো বাড়িটাকেই কেন যেন তার সন্দেহ হচ্ছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে সব। এভাবে খুঁজতে খুঁজতেই সদর দরজার সামনের সিঁড়ির মতো ধাপগুলোতে এসে থমকে দাঁড়াল জর্জ। ধাপের একদম পাশে গোলাকার একটা সিমেন্টের ঢাকনা দিয়ে কিছু যেন ঢেকে রাখা হয়েছে, ভালো করে না দেখলে বোঝা যায় না। সম্ভবত বাড়িটার কাজ শুরুর আগে ঠিকাদারের হুকুমে জায়গাটা ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। ময়লা জমে ঢাকনাটা বেশ শক্ত হয়ে আটকে গেছিল, বেশ কৌশলে ওটা খুলে ফেলল জর্জ। প্রথমদিকে টুপটাপ শব্দ পাচ্ছিল সে, কিন্তু ঢাকনাটা খোলার সাথে সাথে একটা পাথর বেশ নিচে গিয়ে পড়ল… পানি আছে নিচে! তাড়াতাড়ি টর্চ মারল জর্জ… 

“এ যে একটা কুয়া,” আর্তনাদ করে উঠল সে, “নকশাতে তো এটা দেখানো হয়নি! সম্ভবত পুরোনো যে বাড়িটা ভেঙে এই বাড়ি বানানো হয়েছে সেটার অংশ ছিল এই কুয়াটা!” 

রান্নাঘরের রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল জর্জ। দেওয়াল ঘড়িটার দিকে নজর পড়ল ওর, দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। ফাদার ম্যানকুসো এখনও যোগাযোগ করলেন না! নিজেই টেলিফোনটার দিকে এগিয়ে গেল জর্জ। 

ফাদারের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন দিলো সে। একবার রিং হতেই ফোন ধরলেন ফাদার। কিছুক্ষণ আগে ফাদার ফোন দিয়েছিলেন শুনে বেশ অবাক হলো জর্জ। 

“আপনি আজ আসবেন না ফাদার?” নিজেকে সামলে নিয়ে বলল সে। 

জবাবে ফাদার ওকে বিশপের অফিসের ঘটনা খুলে বললেন, তারপর বললেন, “বুঝতেই পারছ জর্জ, ওনারা প্রথমেই ব্যাপারটাকে ভৌতিক বলে ধরে নিতে চাচ্ছেন না। নর্থ ক্যারোলাইনার একটি বিশেষ সংস্থার ঠিকানা আমাকে দিয়েছে অফিস থেকে, ওরা পরামনোবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের সাথে যোগাযোগ করো।” 

“তা করব, কিন্তু আপনিও একবার আসুন।’ 

“আমি আসতে পারব না জর্জ… 

“ফাদার আমি চাই আপনি একবার আসুন… এই যে সংস্থার কথা বললেন, ওদের কি আমি চিনি? আমি চিনি আপনাকে! আর আপনিই আমাদের সাহায্য করতে আসতে চাচ্ছেন না? আর ওরা যে আসবে, ওদের কি টাকা দিতে হবে? আমার কাছে তো এখন তেমন টাকা নেই!” 

আবার জর্জকে সবকিছু বোঝাতে লাগলেন ফাদার। অবশেষে সে কথা দিলো যে ওই সংস্থার সাথে যোগাযোগ করবে, তারপর ওরা কী বলল তা ফাদারকে জানাবে। তারপর ফোনটা রেখে দিলো। 

আসলে, ১১২ নম্বর ওশান অ্যাভিনিউ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পর জর্জ জানতে পেরেছিল যে ওর বাড়িতে আসার জন্য ফাদারের ওপর কী পরিমাণ অত্যাচার করেছিল অশুভ শক্তিরা… তখন বেজায় লজ্জা পেয়েছিল বেচারা। 

তবে ওই সময়ে ফাদারের ওপর ভীষণ রাগ হয়েছিল তার। ক্যাথির মায়ের বাড়িতে ফোন দিয়ে ওকে সব খুলে বলল সে, এটাও জানাল যে, কোনো সংস্থার সাথে যোগাযোগ করবে না সে। শুধু শুধু টাকা নষ্ট আর তাছাড়া ওর হাতের অবস্থাও ভালো না। ওদিকে বিশপের অফিসের চ্যান্সেলরদের নাম শুনেই ক্যাথি ভক্তিতে গদগদ… ও জর্জকে রীতিমতো চাপ দিতে লাগল ফাদার ম্যানকুসোর কথামতো কাজ করার জন্য। 

অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে জর্জ বলল, “ঠিক আছে, আমি মোটর সাইকেলে করে অফিসে যাচ্ছি। ওখান থেকে একটা চিঠি টাইপ করে নর্থ ক্যারোলাইনার ওই সংস্থার সাথে যোগাযোগ করব।’ 

জর্জ ঠিক করল যে ও এরিকের সাথেও ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবে। ওর প্রেমিকা তো ভূত-প্রেতের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তবে ক্যাথিকে এ ব্যাপারে কিছু বলল না। 

*** 

বেশ ভালো লাগছে ফাদার ম্যানকুসোর। জর্জের সাথে কথা বলার পর থেকে ওনার কাঁধ থেকে যেন একটা ভারী বোঝা নেমে গেছে। জর্জরা ওই বাড়িতে ওঠার পর থেকেই তীব্র মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন তিনি, যা-ই হোক, বিশপের অফিসে গিয়ে আসলেই ভালো হয়েছে। চ্যান্সেলররা জ্ঞানী মানুষ, ওনারা যেহেতু পরামর্শ দিয়েছেন… ভালো কিছুই হবে। ঈশ্বর, ফাদার রায়ান আর ফাদার নানসিওর ভালো করুন। 

আগামী সপ্তাহে কী কী কাজ করবেন তার একটা তালিকা তৈরি করলেন ফাদার, তারপর ফাইলগুলো নিয়ে ডুবে গেলেন কাজে। সব কিছু শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেল। এখনও কিছু ফাইল জমা হয়ে আছে টেবিলে। রান্না করতে গেলে এগুলো আর দেখা হবে না। রেক্টরির কাছের একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁতে ফোন করে রাতের খাবার অর্ডার করলেন ফাদার। তারপর আবার ডুবে গেলেন কাজে, প্রায় এক ঘণ্টা পর চলে এলো খাবার। বুভুক্ষের মতো খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ম্যানকুসো, বেজায় খিদে পেয়েছিল তার। 

*** 

অফিসে এসেই টাইপিস্টকে দিয়ে সেই সংস্থার কাছে পাঠাবার জন্য একটা চিঠি টাইপ করালো ফ্রাংক, বলে দিলো বিশেষভাবে বিশপের অফিসের ওই দু’জন চ্যান্সেলরের নাম উল্লেখ করতে। একবার পড়ে নিয়েই চিঠিটা পোস্ট করে দিলো সে। শুরুতেই ভেবেছিল ‘এয়ার মেল’ ডাকটিটেট লাগাবে, পরে ভাবল, “ওরা উত্তর দেবে না কি, কে জানে? আর দিলেই যে আমার বাড়ি আসতে চাইবে সেটারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই!” তাই সাধারণ একটা ডাকটিকেট লাগিয়েই সেটা ডাকবাক্সে ফেলে দিলো। তারপর এরিকের কাছ থেকে ওর প্রেমিকা ফ্রান্সিনের নম্বর নিয়ে ফোন করল। 

জর্জের সাথে বেশ আগ্রহ নিয়েই কথা বলল মেয়েটা। সে বলল ভূত-প্রেতের সাথে যোগাযোগ করা ওর জন্য নতুন কিছু না, অনেক আগে থেকেই কাজটা করে আসছে। খুব তাড়াতাড়িই ও জর্জের বাড়ি এসে দেখবে যে ওখানে আসলে কী হচ্ছে… এরিকও আসবে ওর সাথে। তারপর প্রয়োজন হলে, সেই অশুভ শক্তির সাথে যোগাযোগ করবে। 

এরপর হুট করেই মেয়েটা জর্জকে এমন একটা কথা বলল যে ওর চোখ কপালে উঠল রীতিমতো। 

ও বলেছিল, “স্যার, আপনি এক কাজ করুন। উঠানটা একটু ভালো করে দেখুন তো। ঢাকনা দেওয়া কোনো পুরোনো কুয়া খুঁজে পান না-কি। 

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল জর্জ, তারপর ভাবল কুয়া যে ও ইতোমধ্যেই খুঁজে পেয়েছে সেটা চেপে যাবে। 

“আচ্ছা দেখব,” আস্তে করে বলল ও, “কিন্তু কুয়া দিয়ে কী হবে?” 

ফ্রান্সিনের উত্তর শুনে আরও খানিকটা চমকে গেল জর্জ, “আমার মনে হয় স্যার, ওই কুয়ার মধ্যেই প্রেতাত্মারা থাকে… ঢাকনিতে যদি একটুও ফাঁক থাকে…. সেই ফাঁক দিয়েই ওরা বেরিয়ে আসে। মধ্য যুগে প্রেতদের কুয়াতে বন্দি করে রাখার প্রচলন ছিল।” 

“আচ্ছা দেখব, সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। তাড়াতাড়ি একবার এসো আমার বাড়িতে।” 

“আসব স্যার।” 

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল জর্জ। তারপর ফাদারের দেওয়া ঠিকানাটা মনে করল, ফাদার সংস্থাটার ফোন নম্বরও দিয়েছিলেন। সংস্থাটার নাম ‘সাইকিয়াল রিসার্চ ইন্সটিটিউট’, নর্থ ক্যারোলাইনার ডারহামে ওদের অফিস। কী মনে করে ওদের নম্বরে ফোন দিলো জর্জ, কিছুক্ষণ পর একজন ধরল। জর্জ তাকে জানাল যে সে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। লোকটা জানাল যে ওরা চিঠি পেলেই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার একজনকে পাঠাবে। জর্জও বলল যে পুরো তদন্তে যা খরচ হবে তা দিতে কোনো আপত্তি নেই ওর। 

*** 

সেদিন রাতে ফাদার ম্যানকুসোও বেশ অনেকক্ষণ ফোনে কথা বললেন। রাত এগারোটায় ফোন আসায় বেশ অবাকই হয়েছিলেন ফাদার। ফোনটা ধরে আরও অবাক হলেন, ভ্যান উইক মহাসড়কে তাকে যে যাজক বন্ধু সাহায্য করেছি, তিনিই ফোন করেছেন। 

এতদিন পর বন্ধুর কথা মনে পড়ল লোকটার? 

যা-ই হোক, কথায় কথায় অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। একটা সময়ে এলো সেই রাতের প্রসঙ্গ। 

“আচ্ছা শোনো, ওই রাতে তোমার উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারে ঝামেলা হয়েছিল বলেছিলে,” প্রশ্ন করলেন ফাদার ম্যানকুসো, “এরপর আর কিছু হয়েছিল? 

“না,” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ওনার বন্ধু, “তবে আজকে তোমাকে ফোন দেওয়ার কয়েক মিনিট আগেই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। সেটা বলতেই ফোন দেওয়া, কীভাবে যে বলব বুঝতে পারছিলাম না। যাক, তুমিই তুললে কথাটা…” 

বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল ফাদার ম্যানকুসোর। 

“ফ্রাংক বুঝলে,” বলে চলল ওনার বন্ধু, “এই একটু আগে একটা ফোন এসেছিল। লোকটা যে কে… তা আমি জানি না, কোনো পরিচয়ও সে দেয়নি। কণ্ঠটাও অদ্ভুত। শুধু বলেছে, ‘ওই ব্যাটা যাজককে বলে দিয়ো, ও যেন আর ফিরে না আসে।” 

“এ তো দেখি অদ্ভুত ব্যাপার! তা যাজক বলতে আমাকেই বোঝাল এটা কীভাবে বুঝলে তুমি?” 

“জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওকে। ওর কথা শুনেই বললাম, ‘কে আপনি? কোন যাজকের কথা বলছেন?’ সেই অদ্ভুত কণ্ঠের মালিক জবাব দিলো, “যে যাজককে তুমি বাঁচিয়েছিলে!” 

“শুধু এটুকুই? আর কিছু বলেনি?” 

“হুম, ও ফোন রাখার পর আমি অনেক চিন্তা করলাম। তুমি ছাড়া আর কোনো যাজককে আমি সাহায্য করলাম? মনে তো পড়ছে না! কে হতে পারে লোকটা ফ্রাংক? চেনো ওকে? তুমি বলতে চাইছ যে ও তোমার কথা বলেনি?” 

“তা আমার কথা তোমাকে ফোন করে বলবে কেন? ওর পরিচয় পাওয়া গেলে ভালো হতো!” 

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ফোন রাখার আগে ও দুটো লাইন বলেছিল। প্রথম লাইনটা হলো—’ওই যাজক ভালো করেই জানে, যে আমি কে।” 

“আর তারপর? তারপরের লাইনটা?” 

“হুম… কেমন যেন ফ্যাসফ্যাস করে হেসে ব্যাটা বলল, “ওই ব্যাটাকে বলে দিয়ো, ও যদি আবার এখানে আসে তবে স্রেফ মারা পড়বে!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *