দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ৬

ষষ্ঠ অধ্যায়

২৪ ডিসেম্বর।  

ফাদার ম্যানকুসো ১১২ নম্বর, ওশান অ্যাভিনিউ থেকে আসার প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সেদিনের অদ্ভুত ঘটনাগুলো ভুলতেই পারছেন না তিনি! বিশেষ করে রাতের ব্যাপারগুলো তো চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে! যদিও এই নিয়ে কারও সাথেই আলোচনা করেননি। জর্জ বা ক্যাথি তো দূরের কথা, গির্জায় যে জ্যেষ্ঠ যাজক সবার স্বীকারোক্তি শোনেন তাকেও কিছু বলেননি তিনি। 

২৩ ডিসেম্বর রাতে হুট করেই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে বিছানাগত হয়ে পড়লেন ফাদার। বেচারা কখনও জ্বরে কাঁপছেন তো কখনও ঘামছেন! অবশেষে কোনোমতে উঠে থার্মোমিটারটা দিয়ে দেহের তাপমাত্রা মাপলেন তিনি… ১০৩ ডিগ্রি জ্বর! জ্বর কমানোর জন্য কয়েকটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নিলেন তিনি। বড়োদিনের সময় যাজকদের প্রচুর কাজ থাকে, কোনোভাবেই বিছানায় পড়ে থাকলে চলবে না তার! তাই সকালের মধ্যেই জ্বরটা কমাতে হবে। ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু ঘুম হলো কেমন যেন ভাঙা-ভাঙা। ২৪ ডিসেম্বর ভোর চারটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল তার, জ্বর মেপে দেখলেন ১০৪ ডিগ্রি! মানে আরও এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে! প্রধান যাজককে ফোন করলেন তিনি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রলোক এসে গেলেন তার ঘরে। সব শুনে তিনি একজন ডাক্তারকে ফোন করলেন। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফাদার ম্যানকুসোর হুট করেই লুজদের কথা মনে পড়ল! 

এই সময়ে ওদের কথা ভাবাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু এ কি! ফাদার অনেক চেষ্টা করেও চিন্তাটা নিজের মাথা থেকে সরাতে পারলেন না। ওশান অ্যাভিনিউয়ের সেই বাড়িটার দোতালার একটা বিশেষ ঘর ভেসে উঠল ওনার চোখের সামনে, মনে হচ্ছে মাথার ভেতর থেকে কে যেন কথা বলছে! ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ঘরটা। ওই ঘরের মেঝেতে অনেকগুলো না খোলা বাক্স পড়েছিল… জানালা দিয়ে নৌকা রাখার ছাউনিটা স্পষ্ট দেখা যায়। 

পরবর্তীতে ফাদার আমাদের জানিয়েছেন, ওই অবস্থায় জ্বরের ঘোরে না-কি দুটো শব্দ তিনি বারবার বলেছিলেন- ‘শয়তান’ আর ‘অশুভ’। তিনি এখনও জানেন না ওই দুটো শব্দ কেন তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। 

ওনার জবানিতে, “কথাগুলো জ্বরের ঘোরে প্রলাপ হতে পারে, কিংবা কোনো অশুভ শক্তি আসলেই ভর করেছিল আমার ওপর! যা-ই হোক, একটা জিনিস বারবার মাথায় আসছিল—যেভাবেই হোক লুজদের ওই ঘর থেকে দূরে রাখতে হবে। মানা করে দিতে হবে যেন ওরা ওখানে না যায়!” 

*** 

ওদিকে ঠিক একই সময়ে অ্যামিটিভিলেও ক্যাথি লুৎজ বসে বসে দোতালার ওই ঘরটার কথা ভাবছে। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে একা বসে থাকে ক্যাথি, এক্ষেত্রে ওই ঘরটাই ভরসা। কেমন যেন নিঃস্তব্ধ ওটার পরিবেশ। এই ক’দিনে রান্নাঘরে বেশ ক’বার ধ্যানে বসেছে সে, আচ্ছা ওই ঘরেও তো চাইলে বসা যায়! কিছু অতিরিক্ত জামা-কাপড়ও ওখানে এনে রাখা যায়। ওদের আয়নাটাও ওখানে থাকলে কেমন হয়? 

ওই ঘরের মেঝেতে রাখা বাক্সগুলোতে বড়োদিনে বাড়ি সাজসজ্জার নানান সরঞ্জাম আছে। বছরের পর বছর ধরে ওগুলো জমিয়েছে ক্যাথি। বাক্সগুলো খুলে রঙিন বল আর বাতিগুলো বের করে আনতে হবে। যাতে করে ওর মা আর ভাই ক্রিসমাস ট্রিটা আনার সাথে সাথেই সাজিয়ে ফেলা যায়। সন্ধ্যাতেই ওদের চলে আসার কথা। 

দুপুরের খাবার শেষে ড্যানি আর ক্রিসকে বাক্সগুলো নিচতলার বসার ঘরে নিয়ে আসতে বলল ক্যাথি। জর্জের অবশ্য বড়োদিনের সাজসজ্জার চেয়ে ফায়ারপ্লেসে কাঠের গুঁড়ি ভরতেই বেশি আগ্রহ। খানিকক্ষণ ‘গাঁইগুঁই’ করার পর সে-ও ওদের সাথে যোগ দিলো। নানান রঙের বাতিগুলোর জট ছড়িয়ে সেগুলো ঠিক আছে না-কি তা পরীক্ষা করতে লাগল জর্জ। আর বাক্সগুলো খুলে টিস্যু পেপারের আস্তরণ সরিয়ে একে একে রঙিন বল, কাঠের তৈরি পরি, কাচের তৈরি দেবদূত, স্যান্টা, বলনর্তকী, বলগা হরিণ, তুষারমানব ইত্যাদি বের করে আনতে শুরু করল ক্যাথি আর বাচ্চারা। প্রতি বছরই কাচ আর কাঠের তৈরি পুতুলগুলো কেনে ক্যাথি, এই বছরই কেনা হলো না। 

মেঝেতে একটা তোয়ালে বিছিয়ে দিয়েছিল ক্যাথি। তাতে যার যার প্রিয় জিনিসগুলো রাখছিল বাচ্চারা। কিছু জিনিস দেখে তো রীতিমতো স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ল ক্যাথি। কাচের তৈরি স্যান্টাগুলো ড্যানির জন্মের বছরের ক্রিসমাসেই কেনা! তবে এই বছর বাচ্চাদের নজর অন্য একটা জিনিসের দিকে… ক্যাথির সাথে বিয়ের পর জর্জই ওটা নিয়ে এসেছিল, ওদের পারিবারিক জিনিস আরকি। প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা একটা দণ্ড, তাতে ঝুলছে রূপার তৈরি কিছু তারা আর অর্ধচন্দ্র! সেগুলোর গায়ে আবার সোনার কারুকাজ। ওটাকে ক্রিসমাস ট্রির একদম ওপরে লাগানো যাবে। জিনিসটা প্রায় একশ বছর আগে জার্মানিতে বানানো হয়েছিল। জর্জকে ওটা দিয়েছিলেন ওর দাদি, উনি আবার ওটা পেয়েছিলেন ওনার দাদির কাছ থেকে। 

*** 

রেক্টরিতে একজন ডাক্তার এলেন ফাদার ম্যানকুসোকে দেখতে। ফাদারকে পরীক্ষা করে তিনি রায় দিলেন—ভয়ের কিছু নেই, ফাদারের ফ্লু-ই হয়েছে। ফুটা তেমন মারাত্মক নয়। তবে আরও একদিন পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে হবে ওনাকে, কোনোভাবেই বিছানা থেকে ওঠা যাবে না। অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা বিশ্রাম না নিলে জ্বর ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ওদিকে বেজায় অখুশি হলেন ফাদার, বড়োদিনের এই কাজের চাপে একজন ফাদারের শুয়ে থাকা কি মানায়? কত কাজ পড়ে রয়েছে! কিছু কিছু কাজ অবশ্য এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া যায়, তবে বড়োদিনের দিন ওনার কাছে কিছু লোকের আসার কথা। এরা নানান ব্যাপারে ফাদারের পরামর্শ নেয়। অনেক দূর থেকে আসে লোকগুলো, ওদেরকে কী করে ফিরিয়ে দেবেন তিনি? ব্যাপারগুলো তিনি খুলে বললেন ডাক্তারকে। কিন্তু ডাক্তার জানালেন কোনোভাবেই ওনার বিছানা থেকে ওঠা উচিত না। তাছাড়া বিকালের পর জ্বর বেড়ে যেতে পারে। প্রধান যাজক তো সায় দিয়ে বলেই বসলেন, “দেখো ফ্রাংক, এই দুর্বল শরীরে জেদ করো না তো। ভালো-মন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে… তখন? তোমাকে যেন আমি কোনোভাবেই রেক্টরির বাইরে যেতে না দেখি। রেক্টরির বাইরে কী বলছি? তুমি তোমার অ্যাপার্টমেন্টের বাইরেই বেরোবে না। “ 

কী আর করা? তাদের কথা মেনে নিতে বাধ্য হলেন ফাদার ম্যানকুসো। তবে একটা জরুরি কাজ ঘরে বসেও করা যায়, আর সেটা হলো জর্জ লুৎজকে টেলিফোন। অ্যামিটিভিলের ওই বাড়ির দোতালার ঘরটাতে কিছু একটা তো আছেই… খারাপ কিছু! একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। অবশেষে বিকাল পাঁচটায় তিনি ফোন করলেন জর্জকে। 

“হ্যালো,” ফোন ধরল ড্যানি। 

“শোনো, তোমার বাবাকে দাও, আমি ফাদার ম্যানকুসো।” 

বাবাকে ডাকতে বসার ঘরে ছুটল ড্যানি। সেখানে ক্যাথিও ছিল, ফাদার ফোন করেছেন শুনে সে বেশ অবাকই হলো। তবে জর্জকে দেখে মনে হলো না ও একটুও আশ্চর্য হয়েছে, সারাটাদিন ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে বসে সে কেন যেন ফাদার ম্যানকুসোর কথাই ভেবেছে। নিজেই কয়েকবার ফাদারকে ফোন করার কথা ভেবেছিল, কিন্তু ফোন করে বলবেটা কী? বড়োদিনের দাওয়াত দেবে? বড়োদিনে ফাদার গির্জা থেকে বেরোবার সময় পাবেন? এসব ভাবতে ভাবতেই আর ফোন দেওয়া হয়নি। 

ফোনটা ধরল জর্জ। ফাদারের জ্বরের কথা শুনে মনটা বেশ খারাপই হলো তার, এই উৎসবের মধ্যে লোকটা অসুস্থ! কী কপাল! 

“ফাদার, আমরা তবে আপনাকে দেখতে আসি?” বলে উঠল সে। 

“না না, তোমাদের আসার দরকার নেই। এখানে আমরা সবাই যাজক… তোমরা আর এসে কী করবে? তা কেমন কাটছে বড়োদিন?” 

“ভালোই তো মনে হচ্ছে। নতুন বাড়িতে প্রথম বড়োদিন। সবকিছু সাজিয়ে নিচ্ছি!” 

“বাহ বাহ, এভাবেই থাকো চিরকাল… আশীর্বাদ করলাম।’ 

“অনেক ধন্যবাদ ফাদার। ক্যাথির ভাই জিমি আমাদের জন্য একটা ক্রিসমাস ট্রি আনছে। ওটাকে সাজানোর সব সরঞ্জাম বাচ্চারা বের করেছে। এইতো… জিমি আর ক্যাথির মা এলো বলে…” 

“জর্জ শোনো… একটা কথা…”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন ফাদার?”

“তোমাকে একটা জরুরি ব্যাপারে বলতে চাই। একটা জিনিস নিয়ে ভাবছি, বুঝলে? সেটা জানাতেই ফোন দিলাম। আচ্ছা তোমাদের বাড়ির দোতালায় নৌকা রাখার ছাউনির দিকে জানালাওয়ালা একটা ঘর আছে না? যেটার মেঝেতে অনেকগুলো না খোলা বাক্স আর কার্টুন দেখে এসেছিলাম? বুঝতে পারছ কোন ঘরটা?” 

“হ্যাঁ হ্যাঁ ফাদার, ওটা ক্যাথির সেলাইঘর। ওখানেই আমরা কিছুদিন পর থেকে ধ্যানে বসব বলে ঠিক করেছি। এখনও পুরোপুরি গুছিয়ে নিতে পারিনি, তবে খুব তাড়াতাড়ি নেবো। আরে জানেন, কদিন আগে ওই ঘরটার জানালাতে কী দেখেছি? মাছি! শয়ে শয়ে মাছি! ভাবতে পারেন? এই শীতকালে মাছি!” 

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল জর্জ। ওপাশ থেকে ফাদারও কিছু বলছেন না। 

“জর্জ শোনো,” অবশেষে বলে উঠলেন ফাদার ম্যানকুসো, “আমি চাই না তুমি, ক্যাথি বা বাচ্চারা… কেউ আর ওই ঘরে যাও। তোমাদের জন্য ঘরটা এড়িয়ে চলাই মঙ্গল।” 

“কেন ফাদার? ওখানে কী সমস্যা?” অবাক হলো জর্জ। 

ফাদার কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই হঠাৎ করে টেলিফোনে কেমন যেন ‘খসখস’ শব্দ হতে শুরু করল। দু’জনেই অবাক হয়ে কান থেকে রিসিভারটা সরিয়ে নিল। ফাদার ম্যানকুসো কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু জর্জ শুনতে পেল না। সেই খসখসে শব্দটা প্রচুর বেড়ে গেছে। 

“হ্যালো! হ্যালো! ফাদার? আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি না! বরফ পড়ার কারণে লাইনে সমস্যা হলো না কি? ধুর!” 

অপরদিকে ফাদার ম্যানকুসোও কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই খসখসে শব্দটার মাঝে কিছুক্ষণ পর পর জর্জের অস্পষ্ট “হ্যালো… হ্যালো” ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। অবশেষে ফোনটা রেখে আবার লুজদের নম্বরে ডায়াল করলেন তিনি। বেশ কয়েকবার রিং হলো, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ধরল না। 

দশবার রিং হওয়ার পরেও কেউ ওপাশ থেকে ফোন ওঠাল না, হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দিলেন ফাদার। অদ্ভুত এক আতঙ্ক পেয়ে বসেছে তাকে। 

ওদিকে প্রচণ্ড আওয়াজের মধ্যে ফাদার ম্যানকুসোর কণ্ঠ বুঝতে না পেরে জর্জও ফোনের রিসিভারটা রেখে দিলো। ভেবেছিল ফাদার একটু পর আবার ফোন করবেন, কিন্তু কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও ফাদার আর ফোন করলেন না। চুপচাপ রান্নাঘরের টেলিফোনটার দিকে চেয়ে রইল জর্জ। কিছুক্ষণ পর সে নিজেই ফাদারের নম্বরে ডায়াল করল, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোন ওঠাল না। 

ওদিকে বসার ঘরে বড়োদিনের উপহারগুলো প্যাকেট করছে ক্যাথি। ওগুলো সবই অ্যামিটিভিলে আসার আগে কেনা। ভ্যালি স্ট্রিমের ‘সেলস অ্যাট সিয়ার্স’ আর “গ্রিন একরস শপিং সেন্টার’ থেকে ওগুলো কিনেছে সে। তিন বাচ্চা এবং জর্জের জন্য অল্প কিছু জামা-কাপড় আর মা-ভাইয়ের জন্য কিছু উপহার কিনতে পেরেছে। মেজাজ বেজায় খারাপ হচ্ছে ক্যাথির, কেন অ্যামিটিভিল থেকে বাজারে গেল না? এত কম উপহার সে কোনো বড়োদিনে কেনেনি! হ্যাঁ… ড্যানি, ক্রিস আর মিসির জন্য অল্প কিছু খেলনাও কেনা হয়েছে। তবে সেগুলোও আহামরি কিছু না। ছোটো ছোটো বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা হলো ক্যাথির 

একটু আগেই বাচ্চাদের ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। ওরা থাকলে শান্তিতে কাজ করা যায় না। হুট করেই মিসির কথা মনে পড়ল ওর। “দেবদূতেরা কি কথা বলে?” এই প্রশ্ন কেন করেছিল মেয়েটা? তখন কোনো উত্তর দেয়নি ক্যাথি। সেদিন রাতে আবার প্রশ্নটা করেছিল মেয়েটা। তখন ক্যাথি বলেছিল, “তোমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করে দেখব।” কিন্তু জর্জকে আর কিছু বলা হয়নি, আজকাল তো জর্জ সারাদিন ফায়ারপ্লেস নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু এমন প্রশ্ন কেন করল মিসি? আচ্ছা… আগেরদিন ঘরে বসে অদ্ভুত একটা সুরে গান করছিল না সে? ওই গানের সাথে কি এই প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক আছে? ও সেলাইঘরে কেন গেছিল? ওখানে ওইটুকু মেয়ের কী কাজ? 

রান্নাঘর থেকে ফিরে এলো জর্জ, চিন্তায় ছেদ পড়ল ক্যাথির। দেখে মনে হচ্ছে বেজায় বিব্রত হয়ে আছে জর্জ, ক্যাথির চোখের দিকেও তাকাচ্ছে না। খানিকটা অবাক হলো ক্যাথি। ফাদার ম্যানকুসো কী এমন বললেন জর্জকে? আর জর্জ সেসব ওকে খুলে বলছে না কেন? ঠিক তখনই দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল। 

“হায় হায়,” ক্যাথির রীতিমতো মাথায় হাত, “মা আর জিমি মনে হয় এসে পড়েছে, আমি তো রান্নাই শুরু করিনি! জর্জ তুমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দাও,” এই বলে রান্নাঘরের দিকে ছুটল সে। 

ক্যাথির ভাই জিমি কনার্স বিশালদেহী হাসিখুশি যুবক, জর্জকে বেজায় পছন্দ করে সে। হাসিতে মুখটা ভরে আছে ছোকরার, বড়োদিনের ঠিক পরেরদিনই ওর বিয়ে। জর্জকেই নিতবর হতে বলেছে জিমি। জিমির হাতে একটা বেশ বড়োসড়ো দেবদারু গাছের ডাল, ওটাই ক্রিসমাস ট্রি হবে। কিন্তু জর্জের অবস্থা দেখে রীতিমতো চমকে উঠল জিমি আর ওর মা! প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দাড়ি কামায়নি জর্জ, গোসলও করেনি! 

“আপনাকে তো দেখতে রীতিমতো দাঁড়কাকের মতো লাগছে, “ মশকরা করল জিমি। 

কোনো উত্তর দিলো না জর্জ। 

“ক্যাথি আর বাচ্চারা কই?” উদবিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন ক্যাথির মা জোয়ান। “সন্ধ্যা তো হয়েই এলো, ক্যাথি রান্না করছে, বাচ্চারা ওপরে খেলছে… আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন মা?” 

“না… এমনিই, আমার কেন যেন মনে হলো… কিছু একটা ঠিক নেই…” বলে বাড়িতে ঢুকে পড়লেন জোয়ান। 

“আমাদের নতুন বাড়িতে স্বাগতম মা, ওই যে ওদিকে রান্নাঘর, ওখানে ক্যাথি আছে,” বলে রান্নাঘরের রাস্তাটা দেখিয়ে দিলো জর্জ। তারপর সে আর জিমি মিলে গাছের ডালটাকে বসার ঘরের মাঝখানে রাখল। 

“আরে বাহ! রীতিমতো নরকের আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন দেখছি, “ ফায়ারপ্লেসের দিকে নজর পড়তেই বলে উঠল জিমি। 

“আর বলো না,” দীর্ঘশ্বাস ফেললো জর্জ, “এই বাড়িতে আসার পর থেকে শরীর থেকে শীত শীত ভাব যেন যাচ্ছেই না আমার! এই আজকেই ধরো দশটা গাছের গুঁড়ি পুড়িয়ে ফেলেছি, কিন্তু ঠান্ডা যায় না।” 

“হুম,” মাথা নাড়ল জিমি, “বাড়িটা একটু বেশিই ঠান্ডা। বার্নার আর থার্মোস্টাটে কোনো সমস্যা নেই তো? পরীক্ষা করে দেখেছেন?” 

“না, ওগুলো ঠিক আছে। অয়েল বার্নার একদম ঠিকঠাক কাজ করছে। থার্মোস্টাটও আশি ডিগ্রি তাপমাত্রা দেখাচ্ছে। বেসমেন্টে এসো, তোমাকে দেখাই।” 

*** 

ওদিকে রেক্টরিতে চলছে আরেক খেল। ডাক্তার যেমনটা বলেছিলেন ঠিক তেমনটাই হয়েছে। বিকাল পাঁচটার পর হুট করেই বেড়ে গেছে ফাদারের শরীরের তাপমাত্রা। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে তার, পেটটাও খুব ব্যথা করছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও ওনার মাথায় ঘুরছে অন্য জিনিস। জর্জের সাথে কথা বলার সময় অমন কেন হলো? টেলিফোনে কি আসলে কোনো সমস্যা আছে? না-কি … 

এখন রাত আটটা বেজে গেছে প্রায়। অনেকবার তিনি চেষ্টা করেছেন জর্জকে ফোন দেওয়ার, কিন্তু ফোন যাচ্ছে না। বেশ কয়েকবার তিনি টেলিফোন দপ্তরে ফোন করে জানতে চেয়েছেন যে লুজদের ফোনে কোনো সমস্যা আছে না-কি। প্রতিবারই অপারেটর ব্যাপারটা পরীক্ষা করে তাকে ফোন করে জানিয়েছে যে কোনো সমস্যা নেই ওদের লাইনে। তাহলে জর্জ ওনাকে আর ফোন করল না কেন? ফাদার নিশ্চিত যে জর্জ এটুকু শুনেছে যে তিনি ওদের দোতালার ওই ঘরটাতে যেতে মানা করেছেন। তাহলে কি ওদের কোনো বিপদ হয়েছে? ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার কোনো ভরসা নেই! আর অপেক্ষা করা যাবে না। একটা বিশেষ নম্বরে ফোন করলেন ফাদার… খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ওটাতে কখনও ফোন দেন না তিনি। 

*** 

লুজদের বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রিটা বসানো হয়ে গেছে। ডালটাকে ছেঁটে একদম জায়গামতো বসিয়ে দিয়েছে জিমি। ড্যানি, ক্রিস আর মিসি এসে দাঁড়িয়েছে ওদের মামার পাশে। সবার হাতেই কোনো না কোনো খেলনা, প্রত্যেকেই আশায় আছে যে মামা সবার আগে তার খেলনাটাই গাছে লাগিয়ে দেবে! জর্জ ফিরে গেছে নিজের জগতে… মানে ফায়ারপ্লেসের সামনে আরকি। ক্যাথি ওর মায়ের সাথে রান্নাঘরে গল্প করছে। 

“বুঝলে মা,” বলে উঠল সে, “পুরো বাড়িতে এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় ঘর, এখানে থাকলে কেন যেন খুব ভালো লাগে… অন্য কোথাও শান্তি নেই!” 

“কেন?” অবাক হলেন জোয়ান। 

“বাচ্চারা জ্বালায়… আর তাছাড়া তোমার জামাই…” 

“কী হয়েছে ওর?” 

“এই বাড়িতে ওঠার পর থেকে জর্জ কেমন যেন বদলে গেছে। ও আর আগের মানুষটা নেই মা…” 

“হুম, ওকে দেখে কেমন যেন অদ্ভুত লাগল আমার!” 

“আরে কী আর বলব মা… ও দাড়ি কামায় না, গোসল করে না। বাড়ি থেকে বেরই হতে চায় না! আজকাল অফিসেও যায় না, জানো? সারাদিন শুধু ওই বালের ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে থাকবে আর কাঠ গুঁজবে! যেন জায়গাটা ওকে জাদু করেছে… ওর না-কি ঠান্ডাই যাচ্ছে না! কই আমাদের তো অত ঠান্ডা লাগে না। আর প্রতিরাতে ঘুম থেকে হুট করে উঠে বসবে আর নৌকা রাখার ছাউনিটা দেখতে যাবে… কী যে হলো মানুষটার!” 

“নৌকা রাখার ছাউনিতে রাতের বেলা কেন যায়? কী দেখতে যায়?” 

“ঈশ্বরই জানেন! আমি জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘রাত বিরাতে কোনো সমস্যা তো হতেই পারে, আর তাছাড়া আমাদের ছোটো স্পিডবোটটা ঠিক আছে না কি সেটা দেখব না?’ কী যে অশান্তিতে আছি!” 

“জর্জের তো এমন স্বভাব ছিল না! তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করোনি? কিছু নিয়ে চিন্তায় আছে না কি? মানে ব্যাবসা ভালো যাচ্ছে তো ওর? “ 

“করিনি আবার,” বিরক্ত হয়ে হাতদুটো ছুড়ল ক্যাথি, “জবাবে শুধু এভাবে ফায়ারপ্লেসে কাঠ ঢুকিয়ে যায় ও, কিছুই খুলে বলে না! আমাদের সারা মাসের কাঠ এক সপ্তাহে পুড়িয়ে ফেলেছে ও।” 

এক পশলা হিমেল হাওয়া হুট করেই বয়ে গেল রান্নাঘরে। কেঁপে উঠে নিজের পরনের সোয়েটারটা ঠিক করলেন ক্যাথির মা! 

“আসলেই কিন্তু তোমাদের বাড়িটা একটু বেশিই ঠান্ডা,” আস্তে করে বললেন তিনি, “ঢোকার পর থেকেই বুঝতে পারছি।” 

বসার ঘরে একটা চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে জিমি। জর্জের দাদির কাছ থেকে পাওয়া ওই জিনিসটা ক্রিসমাস ট্রির একেবারে ওপরে লাগাতে হবে। ঠান্ডা বাতাসে সে-ও কেঁপে উঠল। 

“আরে জর্জ, শুনুন,” বলে উঠল সে, “আপনাদের কোনো দরজা-টরজা খোলা আছে না কি? বাপরে বাপ! হিম ঠান্ডা বাতাস রীতিমতো জমিয়ে দিলো আমার ঘাড়টাকে!” 

“না তো,” ফায়ারপ্লেসের দিক থেকে মুখ তুলে চাইল জর্জ, “সব দরজা আর জানালা বন্ধ করে দিয়েছি আমি।” হুট করেই ওর মনে হলো, দোতালার সেলাইঘরটার জানালা খোলা নেই তো? 

“দাঁড়াও জিমি, আমি আসছি,” বলে দোতালায় উঠে গেল সে। 

রান্নাঘরের সামনে দিকে হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল জর্জ। ক্যাথি আর ওর মা তাকিয়ে ছিল, কিন্তু কাউকে কিছুই বলল না সে। 

“আবার কী হলো ওর?” বললেন মিসেস কনার্স। 

“দেখলে? বললাম না ও বদলে গেছে?” কাঁধ ঝাঁকাল ক্যাথি। বসার ঘরে চলে এলো ওরা দু’জন। তারপর ক্যাথি রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহারগুলো গাছের নিচে রাখতে শুরু করল। 

“এত কম উপহার মা!” ফুঁপিয়ে উঠল ড্যানি। সেই সাথে ক্রিসও। মিসি তো একেবারে কেঁদেই ফেলল। 

“আরে শোনো বাচ্চারা, আমার বিয়েতে তোমাদের জন্য আরও উপহার আছে, মন খারাপ করো না তো,” ওদের ভোলানোর চেষ্টা করল জিমি। 

“কী ব্যাপার তোমরা কাঁদছো কেন? হু?” সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো জর্জ, “যাও তো এখান থেকে। বাচ্চাগুলো একেবারে জ্বালিয়ে মারল… উচ্ছনে গেছে সব!” 

বেজায় রাগ উঠে গেল ক্যাথির। ওর মা আর ভাইয়ের সামনে বাচ্চাদের সাথে এমন ব্যবহার না করলেই কি হতো না? নাহ জর্জকে আর ছাড় দেওয়া যাবে না। এইবার ধরতে হবে। 

কিন্তু জর্জের চাহনি দেখে থমকে গেল ক্যাথি, রীতিমতো জ্বলছে ওর চোখদুটো। 

“ক্যাথি,” গর্জে উঠল জর্জ, “সেলাইঘরের জানালা তুমি খুলেছ? 

“আমি! আমি তো সারাদিন ওই ঘরেই যাইনি!” অবাক হলো ক্যাথি। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা তিন বাচ্চার দিকে ঘুরল জর্জ, “বাক্সগুলো নামানোর সময় তোমরা খুলেছিলে না কি? হুম? অনেক দুষ্ট হয়েছ….” 

“না বাবা, আমরা খুলিনি,” একসাথে মাথা নাড়ল তিন জন। ক্যাথির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল জর্জ, নিজের অজান্তেই বুকটা কেঁপে উঠল ক্যাথির। 

“কী ব্যাপার জর্জ? হয়েছে কী?” 

“ওই ঘরে জানালাটা খোলা… মাছিগুলো ফিরে এসেছে!”

‘ঠাস’ করে খুব জোরে একটা শব্দ এলো বাইরে থেকে, রীতিমতো চমকে উঠল ওরা সবাই। তারপরে দরজা নক করার মতো আরেকটা শব্দ। হ্যারি খুব জোরে ডেকে উঠল। 

“নৌকা রাখার ছাউনির দরজা খুলে গেছে! আবারও,” জিমির দিকে ঘুরল জর্জ, “জিমি, তুমি এদের সাথেই থেকো, কাউকে বাইরে যেতে দিয়ো না। আমি আসছি,” এই বলে চেয়ার থেকে নিজের জ্যাকেটটা নিয়ে রান্নাঘরের রাস্তা দিয়ে বাইরে ছুটল জর্জ। 

ও চলে যাওয়ার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ক্যাথি। 

“এসব কী হচ্ছে ক্যাথি?” গলা চড়িয়ে বললেন মিসেস কনার্স, “এই বাড়িতে কোনো সমস্যা আছে না কি?” 

“আমি জানি না মা… আমি একদমই জানি না,” কাঁদতে কাঁদতেই বলল ক্যাথি। 

*** 

রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাড়ির পিছনে দৌড় দিলো জর্জ। ওদিকে একটা লোক খেয়াল করছে ওকে। ও জানে যে ওটা রান্নাঘরের দরজা, কারণ আগেও সে ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে এসেছে। 

পার্ক করা গাড়ির ভেতর থেকে ও নজর রাখছে জর্জের ওপর। নৌকা রাখার ছাউনিটার দরজা বন্ধ করে দিলো জর্জ। ঘড়ি দেখল লোকটা, রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। গাড়ির রেডিয়ো মাইক্রোফোনটা তুলে নিল সে, “হ্যালো, জাম্মাতারো? আমি জিয়নফ্রিদো বলছি, তোমার বন্ধুকে ফোন করে বলে দাও ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার লোকেরা ভেতরেই আছে… বাইরে যায়নি।” 

সাফোক কাউন্টি পুলিশ বিভাগের সার্জেন্ট অ্যাল জিয়নফ্রিদো বড়োদিনের আগের রাতে ওশান অ্যাভিনিউতে কর্তব্যরত। ডিফেও পরিবার সেই ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হওয়ার রাতেও এখানেই তার ডিউটি ছিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *