দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ২০

বিংশ অধ্যায় 

৮-৯ জানুয়ারি। 

সকালবেলা খুবই দুর্বল লাগছিল ফাদার ম্যানকুসোর। তাই গির্জার প্রার্থনায় না গিয়ে নিজের ঘরেই চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলেন তিনি। তখনই ফোনটা বেজে উঠল। বিশপের অফিস থেকে ফোন দিয়েছেন ফাদার নানসিও। 

“ম্যানকুসো, আমি আর চ্যান্সেলর রায়ান এখন অফিসে আছি, তুমি চাইলে আসতে পারো,” বললেন তিনি। 

ফাদার ম্যানকুসো জানালেন যে তিনি বেশ অসুস্থ। তারপর বললেন, “আমি ফোনেই খুলে বলি? লুজদের বাড়িতে আরও কিছু ঝামেলা হয়েছে। আপনার সময় হবে ফাদার? ফোনেই বলি?” 

“হুম, বলো তবে।” 

সবকিছু খুলে বললেন ফাদার ম্যানকুসো। এটাও বললেন যে তিনি কিছুদিন লুজদের অন্য কোথাও থাকতে বলেছেন। 

“যা শুনলাম… তাতে মনে হচ্ছে তুমি ঠিকই বলেছ,” বললেন ফাদার নানসিও, “তা লুৎজদের জানিয়ে দাও যে আমরাও তোমার সাথে একমত। ওরা কিছুদিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকুক। ওই সংস্থার লোকেরা এসে পরীক্ষা করে যাক… তারপর কোনো ঝামেলা না পেলে আবার আসবে।” 

“আমি আর ওখানে যাব না ফাদার। কিন্তু হ্যাঁ, ফোনে বলে দিচ্ছি।” 

.

অ্যামিটিভিলে কিন্তু জর্জ আর ক্যাথির চোখে ঘুম নেই! ওই ভয়ংকর কণ্ঠ এখনও তাদের কানে বাজছে। শোবার ঘরের বিছানার ওপর চুপচাপ বসে আছে ক্যাথি। ওদিকে আলমারিতে ক্রুসিফিক্সটা রেখে চেয়ারে বসেছিল জর্জ। খানিক পর ক্যাথির পাশে এসে বসল সে। নানান কথা হলো ওদের মধ্যে, সত্যিই কি কেউ কথা বলেছিল? না কি সবই ওদের মনের ভুল? দু’জনের একসাথে ভুল হবে? সকাল আটটার দিকে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল ক্যাথি। তারপর বাচ্চাদের ডাকতে চলে গেল, নাস্তা খাওয়াতে হবে ওদের। সকাল সাড়ে আটটার ঘুম থেকে উঠল জিমি আর ক্যারি, জামা-কাপড় বদলে নাস্তার জন্য নিচে নামল ওরা। 

*** 

ফাদার নানসিওর সাথে কথা বলার পর লুজদের বাড়িতে ফোন দিলেন ফাদার ম্যানকুসো। স্বয়ং বিশপের অফিসের চ্যান্সেলরও চান যে জর্জরা যেন কিছুদিন ওই বাড়িতে না থাকে… এটা ওদের জানাতে হবে। প্রায় দশবার রিং হলো, কিন্তু কেউ ধরল না। ফাদার ভাবছিলেন রিসিভারটা রেখে দেবেন, তখনই ফোন ধরল জর্জ। 

“হ্যালো,” বলে উঠল সে। বেশ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ওর কথা। 

“হ্যালো জর্জ, আমি ম্যানকুসো” ভয়ে ভয়ে বললেন ফাদার। না জানি কখন আবার ফোনে ঝামেলা শুরু হয়। 

“ফাদার! ভালো হয়েছে আপনি ফোন করেছেন! একটু আগে জিমি আর ক্যারিকে ইস্ট ব্যাবিলনে রেখে এলাম… কালরাতে যা হয়েছে…” ধীরে ধীরে ফাদারকে সব খুলে বলল জর্জ। বাড়িটাকে শুদ্ধ করতে গিয়ে কী হয়েছে সেটাও বাদ দিলো না! 

সব শুনে তো রীতিমতো চোখ কপালে উঠল ফাদার ম্যানকুসোর। তাড়াতাড়ি তিনি জর্জকে জানালেন যে বিশপের অফিস থেকেও বলা হয়েছে যে ওরা যেন ওই বাড়িতে কিছুদিন না থাকে। 

“কী বলেন ফাদার! এভাবে ভীরুর মতো পালাব? বিশপের অফিস থেকে সত্যিই এই কথা বলেছে?” অবাক হলো জর্জ। 

“শোনো জর্জ, সাহস দেখানোর আরও অনেক জায়গা পাবে, ঠিক আছে? যা হওয়ার তা হয়েছে… এরপর আর কখনও কিছু করতে যেয়ো না। কী ভাবো? পবিত্র শ্লোকে কাজ হবে? ওখানকার খারাপ শক্তিটা অনেক বেশি ক্ষমতাবান .. ওকে আর রাগিয়ো না! আর তাছাড়া আমার যে অবস্থা…” 

“কী অবস্থা? কী হয়েছে আপনার?” 

“আরে না না, তেমন কিছু না,” চমকে গেলেন ফাদার। একটু বেশিই বলে ফেলেছেন তিনি। আগে নর্থ ক্যারোলাইনার সংস্থার লোকেরা এসে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালিয়ে দেখুক… বাড়িতে কোনো ঝামেলা আছে না-কি! ওরা যদি কিছু বের করতে না পারে তখন বিশপের অফিস ধরে নেবে যে বাড়িটাতে আসলেই অশুভ প্রেতশক্তির বাস। সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে ওনারা। 

“আপনি কিছু লুকাচ্ছেন ফাদার,” বিরক্ত হলো জর্জ। 

“আরে ধুর। শোনো, আমার কথা শোনো… ওই সংস্থার তদন্তকারী আসুক। মাঝে মাঝে পুরোনো বাড়িতে কিছু বিষাক্ত গ্যাস জমার কারণেও লোকেরা ভুল- ভাল দেখে। ওরা দেখুক, বুঝুক… ওরা আসার আগ পর্যন্ত অন্য কোথাও গিয়ে থাকো। নইলে…” 

“নইলে কী হবে ফাদার?”

“এমন ভয়ংকর কিছু হবে যা আমরা ভাবতেও পারি না! দেখো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই বাড়িতে ভয়ংকর কিছু আছে। কিন্তু বিশপের অফিসের লোকেরা এত সহজে মানতে চাইছেন না। পৃথিবীর অনেক তথাকথিত অলৌকিক ঘটনাই না-কি আজকাল বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়… তো আসুক না ওই সংস্থার লোকেরা… দেখুক ওরা। এমনটাও হতে পারে যে নতুন পরিবেশে এসে তোমার আর ক্যাথির মানসিকতায় খানিকটা পরিবর্তন এসেছে… তাই এসব অদ্ভুত জিনিস দেখছ তোমরা… সবই হয়তো মনের ভুল! কিন্তু… যা-ই হোক, আমার মনে হয় না এসব মনের ভুল, আসলেই ওই বাড়িতে কিছু আছে! 

“জর্জ, তুমি কি আমার কথা শুনছ?” 

“হ্যাঁ ফাদার, বলে যান।” 

“আচ্ছা বেশ,” হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ফাদার, ভেবেছিলেন আবার লাইনে ঝামেলা শুরু হবে, “কিছুদিনের জন্য অন্য কোথাও গিয়ে থাকো। ইস্ট ব্যাবিলনেই যাও না হলে? হুম? ওখানে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় বাড়িটা নিয়ে ভাবো। তাই না? তোমরা এখানে না থাকলে আমিও দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচি! আর গতরাতে তোমাদের বাড়িতে যা যা ঘটেছে সবই চ্যান্সেলরদের খুলে বলছি। হয়তো ওনারা আজই কাউকে পাঠিয়ে দেবেন…” 

তখনই ওপরতলা থেকে ক্যাথির চিৎকার ভেসে এলো। 

“ফাদার, আমি পরে ফোন করছি,” এই বলে ফোন রেখে দৌড় দিলো জর্জ। ওদিকে ফাদার চিন্তায় পড়ে গেলেন। আবার কী ঘটল ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটায়। 

তাড়াহুড়ো করে তিন তলায় পৌঁছে জর্জ দেখে, বারান্দায় মিসি, ড্যানি আর ক্রিসকে বকছে ক্যাথি। বারান্দার দেওয়াল আর ছাদে সবুজ রঙের আঠাল তরল লেপে দিয়েছে যেন কেউ। ওগুলো থেকে জেলির মতো থকথকে তরল পড়ছে… জমা হচ্ছে মেঝেতে। গা ঘিনঘিন করে উঠল জর্জের। এই কারণেই তাহলে চেঁচামেচি করছে ক্যাথি? 

“সত্যি করে বলো, কে করেছে এই কাজ?” হুংকার দিলো ক্যাথি,”  নইলে সবগুলোকে পিটিয়ে হাড্ডি ভেঙে ফেলব। 

“আমরা কেউ কিছু করিনি মা, “ তিন জন একসাথে বলে উঠল। রাগের চোটের ওদের মাথায় চাটি মারতে গেল ক্যাথি, কিন্তু সরে গেল বাচ্চারা। 

“আরে মা, বিশ্বাস করো,” চেঁচিয়ে উঠল ড্যানি, “আমরা এসব করিনি! নিচ থেকে ওপরে এসে দেখি এই অবস্থা!” 

“আরে আরে, করছ কী তোমরা?” বউ আর বাচ্চাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল জর্জ, “ক্যাথি, এসব কী? এত রাগলে চলে? আমার মনে হয় না বাচ্চারা এগুলো লাগিয়েছে! দাঁড়াও দেখি।” 

দেওয়ালের কাছে গিয়ে থকথকে সেই তরল খানিকটা আঙুলে নিল জর্জ, তারপর একটু করে জিভে ছোঁয়াল, “জেলো কোম্পানির চকলেটগুলোর মতো, তবে কোনো স্বাদ নেই, পানসে।” 

“হুম” এতক্ষণে খানিকটা শান্ত হয়েছে ক্যাথি, “রং না কি ওগুলো?” বলে উঠল সে। 

“আরে না না,” দুই আঙুলে খানিকটা তরল ডলল জর্জ, “বুঝতে পারছি না এটা কী। তবে পরিষ্কার করতে জান বেরিয়ে যাবে… তা নিশ্চিত!” 

ছাদের দিকে চাইল জর্জ, “ওখান থেকে এ জিনিস আসেনি,” তারপর আশেপাশে তাকাল, “আসলে এই বাড়িটাতে কী যে হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না!” কয়েক মিনিট আগে ফাদার ম্যানকুসোর বলা কথাগুলো মনে পড়ল ওর। 

তবে কি সত্যিই এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়া উচিত ওদের? 

“কে করল এসব?” জর্জের কাঁধে হাত রাখল ক্যাথি। 

“শয়…” থমকে দাঁড়াল জর্জ, বাচ্চাদের সামনে এসব বলা ঠিক হবে না, আরেকটু হলেই ‘শয়তান’ শব্দটা ওর মুখ দিয়ে বেরিয়েই যেত। 

“কী বললে? বুঝলাম না?” 

“না তেমন কিছু না,” বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাল ও, বকা খেয়ে বেচারাদের মন খারাপ, “আমি একটা জিনিস ভাবছিলাম। চলো সবাই নিচে নামি। আমার খিদে পেয়েছে। খাওয়াদাওয়া শেষে ড্যানি, ক্রিস আর আমি মিলে এগুলো পরিষ্কার করব। আসবে না ছেলেরা?” 

মাথা নাড়ল ড্যানি আর ক্রিস। ওরা আসবে। 

*** 

ইস্ট ব্যাবিলনে ফিরে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ক্যারি। জিমির মা খুবই খুঁতখুঁতে মহিলা, সেই কারণে আগে এখানে তেমন আসতে চাইত না সে। তবে ওশান অ্যাভিনিউয়ের ওই বাড়িটা থেকে এই জায়গা ঢের ভালো। 

“ওই বাড়িটা ভালো না জিমি, “ বাড়িতে ঢোকার আগে বলে উঠল সে, “রাতের বেলা ওই ছেলেটাকে কিন্তু আমি দেখেছি। তুমি বিশ্বাস করো!” 

আদর করে ক্যারির পিঠে একটা চাপড় মেরে জিমি বলল, “ওসব তোমার চোখের ভুল সোনা। বাদ দাও। আর এই যুগে এসব কে বিশ্বাস করে? বলো তো? তুমি খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে। এসো তোমাকে একটু আদর করি,” এই বলে ক্যারিকে জড়িয়ে ধরল সে। 

“ছি ছি, এই সময়ে,” এই বলে আশেপাশে তাকাল ক্যাথি। প্রতিবেশীরা কেউ দেখে ফেলল ঝামেলা। জিমির কোনো লাজ-শরম নেই। 

“ক্যারি,” ওর হাতটা ধরলো জিমি, “একটা কথা দাও… মাকে ওই বাড়ির ব্যাপারে কিছু বলবে না, ঠিক আছে? উনি কেমন তুমি তো জানোই! দেখবে আজই কোনো যাজক নিয়ে গিয়ে ক্যাথিকে বিরক্ত করে মারবেন!” 

“হুম,” মুখটা শক্ত হয়ে এলো ক্যারির, “আচ্ছা, আমি না হয় স্বপ্ন দেখলাম, কিন্তু তোমার যে টাকা হারাল? সেটাও স্বপ্ন?” 

*** 

ওদিকে জর্জের ফোনের আশায় পুরো বিকালটা কাটিয়ে দিলেন ফাদার ম্যানকুসো। যতদূর মনে পড়ছে, সম্ভবত ক্যাথি চিৎকার করে উঠেছিল… তারপরেই ফোনটা রেখে দিয়েছিল জর্জ! ওরা ঠিক আছে তো? একবার ভাবলেন সাফোক পুলিশের সার্জেন্ট জিয়নফ্রিদোকে ফোন করে ওদের খবর নিতে বলবেন। না না, এই সময়ে বাড়িতে পুলিশ গেলে জর্জরা ব্যাপারটাকে অন্যভাবে নিতে পারে। 

“হে ঈশ্বর! ওদের রক্ষা করো… বাচ্চাগুলোকে রক্ষা করো,” আপনমনেই বলে উঠলেন ফাদার। আরও কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে রইলেন তিনি। তারপর আর থাকতে না পেরে রিসিভার তুলে ফোন দিলেন লুজদের নম্বরে। 

প্রায় দশবার রিং হলো। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। 

ধরবেই বা কী করে? লুৎজরা তখন সবাই বাড়ির পিছনে, নৌকা রাখার ছাউনিটার কাছে। সেখানকার কম্প্রেসরের আওয়াজে সবকিছু চাপা পড়ে গেছে। জর্জ, ড্যানি আর ক্রিস বালতিতে জমা করা সেই সবুজ তরলগুলো পানিতে ফেলে দিচ্ছিল, আর কমপ্রেসরের ঘূর্ণিতে পানির সাথে মিশে ওগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল বরফের আড়ালে। একটু আগেই তিন তলা পরিষ্কার করেছে ওরা, সবুজ থকথকে জিনিসগুলো জমা করেছে কয়েকটা ছোটো ছোটো বালতিতে। 

সরু কাঠের তক্তার ওপর দাঁড়িয়ে ওগুলো পানিতে ফেলছে ওরা। আর ফেলার সময় তক্তার ওপর যেটুকু তরল ছলকে পড়ছে সেগুলো ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলছে ক্যাথি। ওদিকে হ্যারিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মিসি, যাতে ও কাউকে জ্বালাতে না পারে। জর্জ বেশ চুপচাপ। এই সবুজ তরল যে বাড়িতে থাকা অপশক্তিটার কারসাজি তা বুঝতে ওর বাকি নেই। কিন্তু এই কথা ক্যাথি বা বাচ্চাদের সামনে বলে ওদের ভয় পাওয়াতে চাচ্ছে না। ওদিকে ক্যাথির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও এখনও মনে করছে যে এসবের জন্য বাচ্চারাই দায়ী। একদিক দিয়ে ব্যাপারটা ভালো, কিছুক্ষেত্রে বাস্তবতা থেকে দূরে থাকাই উত্তম। 

কাজে এতটাই মগ্ন হয়ে গেছে জর্জ যে ফাদার ম্যানকুসোকে আবার ফোন করার কথা ওর মনেই নেই। 

সন্ধ্যার দিকে কোনো একটা কারণে বিষণ্ন হয়ে পড়ল ক্যাথি। কেন যেন ওর মনে হচ্ছিল খুব খারাপ একটা কিছু হতে চলেছে। ফায়ারপ্লেসের সামনে চুপচাপ বসেছিল জর্জ। 

অবশেষে ক্যাথি জর্জকে বলেই বসল, “চলো আমরা সবাই ইস্ট ব্যাবিলনে গিয়ে আমার মায়ের কাছে থাকি!” 

“নাহ, কখনও না,” রাগে রীতিমতো ফেটে পড়ল জর্জ, “না না, কোনোভাবেই না!” চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল সে, “অনেক টাকা গেছে এই বাড়িটার পিছে… এত সহজে এখান থেকে যাব না।” 

“কিন্তু জর্জ…” 

“কোনো কিন্তু নয়!” রাগে রীতিমতো লাল হয়ে গেছে জর্জের মুখটা, “এই বাড়ি ছেড়ে আমরা কেন যাব? এখানের সবকিছু আমাদের… আমাদের সব সঞ্চয় খরচ হয়ে গেছে এটার পিছে আর এত সহজে চলে যাব?” 

ভয় পেয়ে বাচ্চারা ক্যাথির গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ক্যাথিও ভয় পেয়ে গেছে। জর্জকে কখনও এতটা রাগতে দেখেনি সে। এ কি সেই পরিচিত জর্জ? ক্যাথির মনে হচ্ছিল ওর ওপর কিছু একটা ভর করেছে! 

সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে বেজায় জোরে চেঁচিয়ে উঠল জর্জ, “কুত্তার বাচ্চারা… তোরা আমার বাড়ি থেকে বেরো… ভূত-প্রেত যা-ই হোস না কেন, এই বাড়ি এখন আমার!” তারপর এক ছুটে তিন তলায় উঠে বাচ্চাদের খেলাঘরের সবগুলো জানালা খুলে আবার চিৎকার দিলো, “বের হ… ঈশ্বরের  দোহাই!” 

এরপর ছেলেদের শোবার ঘরে দিয়ে গিয়েও সে একই কাজ করল। তারপর দোতালায় নিজেদের শোবার ঘরে এসেও… সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনবারই জর্জ একই লাইন বলেছিল! হুবহু এক! প্রতিটা শব্দ এক, “বের হ… ঈশ্বরের দোহাই!” 

সব জানালা খুলে দিতে লাগল জর্জ। কিছু জানালা অবশ্য কেন যেন খুলছিল না! সেগুলোর পাল্লা ধরেও টানাটানি শুরু করল সে। মনে হচ্ছিল যেন ও উন্মাদ হয়ে গেছে! খোলা জানালাগুলো দিয়ে হাওয়া ঢুকে রীতিমতো হিম ঠান্ডা হয়ে গেল পুরো বাড়িটা! 

অবশেষে একতলায় নেমে এলো জর্জ, এতক্ষণে মেজাজ কিছুটা শান্ত হয়েছে ওর। এতগুলো জানালা খোলা আর ছুটাছুটির কারণে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে। ভালো করে আশপাশটা দেখে নিল সে, মুঠি পাকাল কয়েকবার। 

এতক্ষণ চুপচাপ ফায়ারপ্লেসের কাছে দাঁড়িয়েছিল ক্যাথি আর বাচ্চাগুলো। ধীরে ধীরে জর্জের কাছে এগিয়ে এলো ওরা, ঘিরে ধরল ওকে। হাত বাড়িয়ে ওদের সবাইকে কাছে টেনে নিল জর্জ, জড়িয়ে ধরল। কেঁদেই ফেললো ক্যাথি, মিসিও ফোঁপাচ্ছিল। 

*** 

অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? এই আবেগঘন দৃশ্যের একজন ষষ্ঠ সাক্ষীও ছিল কিন্তু। ফাদার ম্যানকুসো যে সার্জেন্ট জিয়নফ্রিদোকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, সে নিজের রাত ন’টার ডিউটি শেষ করে ফেরার আগে সবকিছু ঠিকমতো দেখে নিচ্ছিল। ওশান অ্যাভিনিউ দিয়ে যাওয়ার সময় ১১২ নম্বর বাড়িটার জানালা খোলা দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল সে! এই ঠান্ডার মধ্যে কোনো সুস্থ মানুষ জানালা খুলতে পারে না! 

সাউথ আয়ারল্যান্ড প্লেস থেকে ওশান অ্যাভিনিউতে ঢুকতে হয় যে মোড় দিয়ে, সেখানেই গাড়ি থামাল সে। রাস্তার ওপাশেই লুজদের বাড়িটা। তারপর হেডলাইট নিভিয়ে বাড়ির দিকে চেয়ে রইল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল যে বাড়ির মালিক জর্জ রীতিমতো পাগলামো করছে! একবার ভাবল গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দেখবে… কিন্তু কী মনে করে যেন থেমে গেল! তার কিছুক্ষণ পরেই নিচে নেমে সবাইকে জড়িয়ে ধরল লোকটা। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির সব জানালা লাগিয়ে দিলো এক মহিলা। 

“ওটাই হয়তো মিসেস লুজ,” মনে মনে ভাবল জিয়নফ্রিদো। সবকিছুই যখন ঠিকঠাক তখন আর এখানে পুলিশের কী করার আছে? গাড়ি আবার চালু করল সার্জেন্ট, তারপর সাউথ আয়ারল্যান্ড প্লেসের দিকে এগোতে লাগল। হেডলাইট বন্ধ করেই রাখল… ধীরে ধীরে বামের ঢুকে গেল ওর গাড়ি, এখান থেকে ওশান অ্যাভিনিউ আর দেখা যায় না। হেডলাইট চালু করে জোরে গাড়ি ছোটাল জিয়নফ্রিদো। 

একঘণ্টার মধ্যে গরম হয়ে উঠল ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটা, রেডিয়েটরের তাপের কাছে হার মানল ঠান্ডা। ধীরে ধীরে থার্মোস্টাটের তাপমাত্রা গিয়ে পৌঁছল ৭৫ ডিগ্রিতে। 

ফায়ারপ্লেসের সামনে সোফাতে বসে ঝিমাচ্ছে ড্যানি আর ক্রিস। ওদিকে চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে ক্যাথি, ওর কোলে ঘুমন্ত মিসি। দশটার দিকে বাচ্চাদের শোবার ঘরগুলো ভালো করে দেখে এলো সে, ওগুলো যথেষ্ট গরম হয়েছে। তারপর ড্যানি আর ক্রিসকে ঘুমাতে যেতে বলল। 

চেঁচামেচি করার পর থেকে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে জর্জ। ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে কাঠের গুঁড়িগুলোর পুড়ে যাওয়া দেখছে সে। জর্জ আর ক্রিস ওপরে রওনা দিলো, ক্যাথিও একটু পর চুপচাপ মিসিকে নিয়ে ওপরে উঠে গেল। এই অবস্থায় জর্জের সাথে কথা বলতে গেলে আবার ঝামেলা হতে পারে। মিসি ঘুমিয়ে পড়লে আবার নেমে এলো ক্যাথি। 

“কী ব্যাপার জর্জ? ঘুমাতে যাবে না?” ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ক্যাথি 

ফ্যালফ্যাল করে ক্যাথির দিকে চেয়ে রইল জর্জ। চোখদুটো ভিজে আছে ওর। ক্যাথিরও কেমন যেন কান্না পাচ্ছে! এই বাড়ির প্রেতশক্তির সামনে ওরা রীতিমতো অসহায়। জর্জের মাথায় আবার হাত বুলিয়ে দিলো সে। 

“হুম, যাব,” শান্ত কণ্ঠে বলল জর্জ, “তুমি যাও, আমি একটু পর আসছি।” এরপর আবার মন দিলো ফায়ারপ্লেসে। 

শোবার ঘরে চলে এলো ক্যাথি। জর্জের দিকের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রেখে পোশাক পালটে শুয়ে পড়ল সে। বাইরে বাতাসের একটানা ‘শো শো আওয়াজ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুম এসে গেল ক্যাথির। 

হুট করেই ঘুমটা ভেঙে গেল ক্যাথির, জর্জের শোবার জায়গাটার দিকে তাকাল সে। জর্জ এখনও আসেনি! পিছনে তাকাল ক্যাথি, খাটের পিছনের বিরাট আয়নাটায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে রীতিমতো বুকটা কেঁপে উঠল ওর। বিরাট আয়নাটা যেন ছাদ ছুঁয়েছে, এত বড়ো আয়না আর শোবার ঘরে রাখা যাবে না। বিছানা থেকে উঠে পড়ল ক্যাথি, ভয় লাগছে ওর… দেওয়াল আলমারি থেকে ক্রুসিফিক্সটা আনতে হবে। 

আলমারিটার কাছাকাছি পৌঁছে কী মনে করে যেন আবার আয়নার দিকে তাকাল সে। একি! আয়নার প্রতিবিম্বটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে… কেমন যেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ওটা! তাড়াতাড়ি আলমারির দিকে এগিয়ে গেল ক্যাথি, আর সাথে সাথে সে স্পষ্ট শুনতে পেল প্রতিবিম্বটা ওরই গলায় বলছে, “এই কাজ করো না… এই ভুল করো না! তোমার ভুলের কারণে সবাই শেষ হয়ে যাবে!” 

*** 

জর্জ ওপরে উঠে দেখল ক্যাথি ঘুমাচ্ছে। শরীর থেকে কম্বলটা যেন একটু সরে গেছে ওর, ঠিক করে দিলো সে। তারপর পাশের টেবিলটার ড্রয়ার থেকে ক্যাথির বাইবেলটা বের করল। ওটা নিয়ে টেবিলল্যাম্পটা বন্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জর্জ। 

বসার ঘরে এসে আবার ফায়ারপ্লেসের সামনের চেয়ারটায় বসল সে। বাইবেলটা খুলে ‘দ্য বুক অফ জেনেসিস’ অংশটা পড়তে লাগল সে। খ্রিষ্ট ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসগুলোর ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় এই অংশকে। কয়েকটা জায়গা পড়ে বেশ অবাক লাগল ওর, জোরে জোরে পড়তে লাগল, “এবং ঈশ্বর সেই অভিশপ্ত সর্পকে বললেন, “তোমার কর্মের জন্য তুমি আজ থেকে অভিশপ্ত হলে! পৃথিবীর সব পশু-পাখি আর মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে তুমি! মানুষ তোমাকে অভিশাপ দেবে, কেউ করুণা করবে না… এভাবেই শেষ দিনের আগ পর্যন্ত থাকবে তুমি!’ 

কেঁপে উঠল জর্জ। এই ‘অভিশপ্ত সৰ্প’-ই তো আসলে শয়তান! ঠিক তখনই গরম বাতাসের একটা ঝাপটা এসে লাগল ওর মুখে, বই থেকে মুখ তুলে তাকাল জর্জ… ফায়ার প্লেসের আগুন বেরিয়ে এসেছে! জর্জের একদম কাছাকাছি চলে এসেছে! 

লাফিয়ে উঠল জর্জ, ও বসার আগ দিয়ে আগুন প্রায় নিস্তেজ হয়ে এসেছিল। এতক্ষণে তো পুরোপুরি নিভে যাওয়ার কথা! সেই আগুনের এই অবস্থা হলো কী করে? পুরো ফায়ারপ্লেস ভরে গেছে আগুনে… গরমে রীতিমতো ঘামতে লাগল জর্জ। 

ঠিক তখনই কার যেন ঠান্ডা একটা আঙুল স্পর্শ করল ওকে। সাথে সাথে পিছে ঘুরল সে! কিন্তু কেউ নেই! তবে ঠান্ডা একটা বাতাস যেন সরে গেল… আরে! সিঁড়ির কাছে অদ্ভুত একটা আকৃতি… কুয়াশা দিয়ে গড়া যেন! মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিল সেটা! 

বাইবেলটা শক্ত করে ধরে দোতালার শোবার ঘরের দিকে দৌড় দিলো জর্জ। সেই ঠান্ডা বাতাসটাও যেন পিছে পিছেই আসছিল। ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল সে, ঘরটা বেশ গরমই আছে। তখনই পিছে আবার সেই ঠান্ডা আঙুলের স্পর্শ! 

পিছনে কেউ নেই! 

হুট করেই কী মনে করে মিসির ঘরে দৌড় দিলো জর্জ। ঘরের সবগুলো জানালা খোলা… সমানে হাওয়া ঢুকছে! বেচারি ঘুমের মধ্যেও কাঁপছে। 

ওকে কোলে তুলে নিল জর্জ, ঠান্ডা হয়ে আছে ছোট্ট শরীরটা। এক দৌড়ে শোবার ঘরে চলে এলো সে, ক্যাথি ততক্ষণে জেগে গেছে। মিসিকে কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল জর্জ, “তাড়াতাড়ি! ওর শরীরটা গরম করতে হবে… নইলে ঠান্ডাতে মেয়েটা মরেই যাবে!” 

কাঁদতে কাঁদতে মিসিকে জড়িয়ে ধরল ক্যাথি। জর্জ ছুটল তিন তলায়। 

ওদের শোবার ঘরের জানালাও একদম হাট করে খোলা! কম্বলের মধ্যে শুয়ে রীতিমতো কাঁপছে দুই ভাই। দু’জনকেই একসাথে কোলে তুলে নিল জর্জ। তারপর ফিরে এলো দোতালার শোবার ঘরে। ঠান্ডায় দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে ওদের। ওদের কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে জড়িয়ে ধরল জর্জ। 

একই শোবার ঘরে বাড়ির পাঁচ জন! কে জানত এমনটা হবে? 

কিছুক্ষণের মধ্যে গা গরম হয়ে এলো বাচ্চাদের। ওদের হাত আর পা ঘষে ঘষে গরম করতে লাগল জর্জ আর ক্যাথি। প্রায় আধাঘণ্টা পর ওদের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলো। জর্জ খেয়াল করল, বাইবেলটা তখনও ওর হাতে! এটা পড়ার জন্যই এত ভোগান্তি? এর জন্যই বাচ্চাদের এই অবস্থা? তাহলে কি এই বাড়ির অপশক্তি ওকে সতর্ক করল? 

মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো সে গ্রন্থটা! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *