প্রথম অধ্যায়
১৯৭৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর জর্জ আর ক্যাথি লুৎজ সপরিবারে ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে ওঠে। মাত্র আটাশ দিন থাকতে পেরেছিল ওরা, তারপর পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ওদের মতে এই ভয়ংকর বাড়িতে থাকা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না। সেই কাহিনি শুরু করার আগে ওদের বাড়ি কেনার অভিজ্ঞতাটাও তুলে ধরা দরকার।
জর্জ লি লুজের বয়স আটাশ। ওই বাড়িতে আসার আগে লং আইল্যান্ডের ডিয়ার পার্কে থাকত ওরা। ঘরবাড়ি আর জমিজমা কেনা-বেচার ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ জর্জ। উইলিয়াম এইচ. প্যারি ইনকরপোরেটেড নামের একটি ভূমি জরিপ সংস্থার মালিক সে। মাঝে মাঝেই গর্ব করে ও বন্ধুদের বলতো, “তিন পুরুষ ধরে জমি-জমার ব্যাবসা করছি, আমাকে ঠকাবে এমন সাধ্য কারও আছে না কি?” সংস্থাটা খুলেছিলেন ওর দাদা, তারপর দায়িত্ব নেন ওর বাবা, এরপর জর্জ।
জর্জের স্ত্রী ক্যাথলিনের বয়স ত্রিশ। অ্যামিটিভিলের বাড়িটা দেখার আগে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লং আইল্যান্ডের দক্ষিণে প্রায় পঞ্চাশটা বাড়ি দেখেছে ওরা দু’জন, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হয়নি। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলারের মধ্যে সাগরতীরের কাছাকাছি একটাও ভালো বাড়ি পাওয়া যায়নি যেখানে জর্জ তার ব্যাবসা স্থানান্তর করতে পারে।
এভাবে খুঁজতে খুঁজতেই জর্জ, ম্যাসাপেকা পার্কের ‘কংকলিন রিয়্যালটি অফিস’র সাথে যোগাযোগ করে। সেখানকার কর্মচারী এডিথ ইভান্স জর্জকে জানান যে তাদের হাতে মোটামুটি নতুন একটা বাড়ি আছে এবং জর্জ চাইলে সেদিনই দুপুর তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে তিনি বাড়িটা দেখাতে পারেন। মহিলা ছিলেন খুবই আন্তরিক, বেশ সুন্দরীও। জর্জ ভাবল, বাড়িটা দেখাই যাক না? সে মহিলাকে জানাল যে দুপুরের আগ দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে আসছে। মহিলা বললেন, তিনিও প্রস্তুত থাকবেন।
জর্জরা ঠিক সময়েই এসে পড়ল, এডিথও প্রস্তুত ছিলেন। দুপুর তিনটার দিকেই ওরা পৌঁছে গেল বাড়িটাতে।
“বুঝলেন, আপনাদের বয়স কম,” হাসলেন এডিথ, “তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। জানি না বাড়িটা আপনাদের পছন্দ হবে না-কি। তবে এটুকু বলতে পারি, এটা কিনলে ঠকবেন না। পুরো অ্যামিটিভিলে এমন বাড়ি আর নেই।”
বাড়ি দেখে ক্যাথি আর জর্জ তো অবাক! ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাকে রীতিমতো প্রাসাদই বলা যায়। দু’শ সাইত্রিশ ফুট লম্বা আর পঞ্চাশ ফুট চওড়া জমির ওপর কাঠের টালিওয়ালা একটা বিরাট তিন তলা বাড়ি। আগের মালিক নিশ্চিতভাবেই বেশ পুরোনো আমলের লোক ছিলেন, কারণ বাড়িটা বেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বানানো। ছায়ায় ঢাকা এবং বেশ পরিপাটি, ভেতরে কেমন যেন একটা অন্ধকার ভাব। বাড়ির সামনে পঞ্চাশ ফুটের মতো লম্বা একটা উঠান। সেখান থেকে একটু সামনে গিয়ে ডান দিকেই বাড়ির সদর দরজা। পাশেই একটা বেশ বড়ো গলি, ওটার মেঝে পাকা। তারপর গাড়ি রাখার গ্যারেজ। খুব সহজেই গাড়ি চালিয়ে ঢোকা যাবে ওই গলি দিয়ে। পিছন দিকে অ্যামিটিভিল নদীর ধার ঘেঁষে বেশ বড়ো একটা ছাউনিও রয়েছে। ওখানে সম্ভবত আগে নৌকা বেঁধে রাখা হতো। একটু পাশে আরেকটা গাড়ি রাখার গ্যারেজ। সেদিকে গাড়ি ঢোকানোর জন্য পিছনদিকে আরেকটা বিশেষ গলি
গাড়ি চালানোর সামনের গলিটার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্ট। ওতে একটা ফলক ঝোলানো, তাতে লেখা রয়েছে—’হাই হোপস’। আগের মালিক বাড়িটার এই নাম দিয়েছিলেন।
বাড়ির বারান্দাগুলোও বেশ চওড়া। নিচতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের বাড়িগুলো খেয়াল করল জর্জ। এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িই বেশ পুরোনো ধাঁচের। বাড়িটার দু’পাশে জন্মানো অসংখ্য সবুজ গাছপালা এটাকে প্রতিবেশীদের নজর থেকে অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে। উদাস নজরে চেয়ে রইল সে, তারপরেই হুট করে একটা জিনিস খেয়াল করল… আশেপাশের বাড়িগুলোতে এই বাড়িটার দিকে মুখ করা যত জানালা রয়েছে, সবগুলোই হয় বন্ধ করা নয়তো পর্দা দিয়ে ঢাকা। ভালো করে খেয়াল করল সে, ওই বাড়িগুলোর অন্য দিকের জানালাগুলো কিন্তু ঠিকই খোলা রয়েছে।
এই বাড়িটা প্রায় এক বছর ধরে অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে। কোনো পত্ৰ- পত্রিকায় অবশ্য বিজ্ঞানপন দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র এডিথের কোম্পানির খাতায় বাড়িটার কথা ছিল—
অ্যামিটিভিলে বাড়ি বিক্রি
১১২ নম্বর, ওশান অ্যাভিনিউ
ওলন্দাজ আমলের বিশেষ স্থাপত্যশৈলীতে বানানো আরামদায়ক বড়ো বাড়ি, ছয়টি শোবার ঘর, একটি বড়ো বসার ঘর, খাবার ঘর, প্রতি তলাতে একটা করে ফুল[২] আর হাফ[৩] বাথরুম, দুটো গ্যারেজ, গাড়ি ঢোকানোর রাস্তা, সুইমিংপুল (পানি গরম করার ব্যবস্থা রয়েছে) আর নৌকা বাঁধার একটি বড়ো ছাউনি। প্রস্তাবিত মূল্য—আশি হাজার ডলার।
[২. আমেরিকানরা ফুল বাথরুম বলতে বোঝে যেখানে মলত্যাগ, গোসল করা এবং মুখ ধোয়ার জায়গা রয়েছে।
৩. অপর দিকে যেগুলোতে শুধু মলত্যাগ আর মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো হাফ বাথরুম।]
এমন একটা বাড়ির দাম মাত্র আশি হাজার ডলার! প্রথম দেখাতে কে বিশ্বাস করবে? হয়তো ভেবে বসবে যে টাইপিস্ট ভুল করে আশি হাজারের ‘৮’-এর আগে একটা ‘১’ লিখতে ভুলে গেছে। আবার কেউ কেউ ভাবতে পারে বাড়িটা শুধু বাইরেই ফিটফাট, কিন্তু ভেতরে সদরঘাট! জর্জেরও খানিকটা তেমনই মনে হয়েছিল, তাই সে এডিথকে জিজ্ঞাসা করল বাড়ির ভিতরটা দেখা যাবে না-কি। এডিথ সানন্দে ওদের দু’জনকে বাড়িটার ভেতরে নিয়ে গেলেন। যথেষ্ট কৌতূহল নিয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল জর্জ আর ক্যাথি, যদিও একদিনে কি আর সব বোঝা সম্ভব? যা-ই হোক, সবকিছু মিলে বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়ে গেল ওদের। এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন বহুদিন ধরেই ছিল ক্যাথির, কিন্তু টাকার কথা চিন্তা করে জর্জকে বলতে পারছিল না। বাড়ির ভেতরের অবস্থা যথেষ্ট ভালো! শুধু কী তাই? সবগুলো আসবাবপত্রও খুবই ভালো অবস্থায় রয়েছে।
এডিথের বুঝতে বাকি রইল না যে বাড়িটা লুজদের পছন্দ হয়েছে। তাই তিনি আর রাখঢাক না রেখে বলেই বলসেন যে এটাই ছিল ‘ডিফেওদের বাড়ি’। এখানে আসলে লুকানোর কিছু ছিল না, তিনি না বললে জর্জরা অন্য কোথাও থেকে জানত। গোটা আমেরিকাই জানে রোনাল্ড ডিফেওর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা। ১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর নিজের বাবা-মা, দুই ভাই আর দুই বোনকে ঘুমের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে রোনাল্ড ডিফেও।
টিভির খবর আর সংবাদপত্রে লুৎজরাও পড়েছিল এই ভয়াবহ ঘটনার কথা। পুলিশের মতে খুবই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেল দিয়ে গুলি করেছিল রোনাল্ড। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছয়টি মৃতদেহকেই পুলিশ একই অবস্থাতে খুঁজে পায়। সবাই হাতের ওপর মাথা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। পুলিশের জেরার মুখ রোনাল্ড একটা সময়ে মেনে নেয় যে সে-ই সবাইকে খুন করেছে, ও বলেছিল – “হ্যাঁ, আমিই মেরেছি ওদের। কিন্তু জানি না কেন! হুট করেই সব শুরু হলো… আবার হুট করেই শেষ। এত দ্রুত সবকিছু শেষ হয়ে গেল যে আমি কিছু বুঝতেই পারলাম না। নিজেকে সামলানোর সুযোগটুকুও পাইনি।”
আদালতে মামলা চলার সময়ে রোনাল্ডের আইনজীবী উইলিয়াম ওয়েবার বারবার চেষ্টা করেছেন রোনাল্ডকে মানসিক ভারসাম্যহীন প্রমাণ করতে। রোনাল্ডও বিবৃতি দিয়েছিল, “ওই রাতের অনেক মাস আগে থেকেই আমি অদ্ভুত সব শব্দ শুনতাম। অপরিচিত সব কণ্ঠ… আশেপাশে তাকাতাম, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেতাম না। মাঝে মাঝে মনে হতো স্বয়ং ঈশ্বর আমার সাথে কথা বলছেন!”
যা-ই হোক, কোনো যুক্তিই টেকেনি। ছয় জন মানুষকে খুন করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে পরপর ছয় মেয়াদে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে।
“ভাবছিলাম, ব্যাপারটা আপনাদের বাড়িটা দেখানোর আগে বলব না পরে? অনেক চিন্তা করে পরেই বললাম,” আস্তে করে বললেন এডিথ, “কারণ আমি দেখতে চাই যে ভবিষ্যতে এই বাড়ি যারা কিনতে আসবে তারা এসব শুনে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিশেষ করে যাদের আশি থেকে নব্বই হাজার ডলারে বাড়ি কেনার ইচ্ছা আছে।” আসলে লুজরা অনেক কম দামে বাড়ি খুঁজছিল, তাই এডিথ ভাবতেই পারেননি যে ওরা এই বাড়ি কিনে ফেলবে।
“বুঝলেন ম্যাডাম,” চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল ক্যাথি, “এখন পর্যন্ত আমরা যত বাড়ি দেখেছি সেগুলোর মধ্যে এটাই সেরা। আমি যেমনটা চেয়েছিলাম, ঠিক তেমন! এত অসাধারণ একটা বাড়ি যে খুঁজে পাবো তা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু আমার স্বামী…”
“আরে না না, কোনো সমস্যা নেই,” হেসে উঠল জর্জ। সে ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছে যে বাড়িটা নিয়ে নেবে। নিজের বউয়ের শখ পূরণ করতে না পারলে আর টাকা রেখে কী হবে? আর তাছাড়া বাচ্চারাও এমন একটা বাড়িতে থাকতে পারলে খুশিই হবে। কোনকালে কোন উন্মাদ কী করেছিল, সেইসব ভেবে কোনো কাজ আছে?
এভাবেই ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার ভয়ংকর ইতিহাসকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে ওটা কিনে ফেলল জর্জ আর ক্যাথি। ওরা যদি জানত যে কত বড়ো ভুল করতে যাচ্ছে!
নভেম্বরের বাকি সময় আর ডিসেম্বরের প্রথম সন্ধ্যাগুলো লুৎজ দম্পতি নতুন বাড়ি সাজানো-গোছানো আর প্রয়োজন মতো সামান্য পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেই কাটিয়ে দিলো। জর্জ এসব ব্যাপারে আগে থেকেই বেশ অভিজ্ঞ, তাই ওদের খুব একটা অসুবিধা হলো না।
জর্জ আর ক্যাথি ঠিক করল যে তিন তলার একটা শোবার ঘরে থাকবে ওদের দুই ছেলে। ছোটো ছেলে ক্রিস্টোফারের বয়স সাত আর বড়ো ছেলে ড্যানিয়েলের বয়স নয়। আরেকটা হবে তিন বাচ্চার খেলার ঘর। দোতালার বড়ো শোবার ঘরটাতে ঘুমাবে ওরা দু’জন আর পাশের ছোট্ট ঘরটায় থাকবে ওদের ছোটো মেয়ে পাঁচ বছর বয়সি মেলিসা ওরফে ‘মিসি’। ক্যাথির জন্য থাকবে আলাদা একটা সেলাইঘর, এছাড়া সবার জামাকাপড় রাখা আর সাজসজ্জার জন্য বড়ো একটা সাজঘরও থাকবে। ক্রিস, মিসি আর ড্যানি তিন জনেই থাকার ব্যবস্থা নিয়ে বেজায় খুশি।
নিচতলার বড়ো ঘরটা নিয়ে একটু সমস্যাই হয়ে গেল। খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিল বা অন্য কোনো সরঞ্জাম লুজদের ছিল না। অবশেষে ক্যাথির সাথে আলোচনা করে জর্জ ঠিক করল যে কথাবার্তা পাকা হওয়ার পর এডিথকে বলে গুদামে রাখা ডিফেওদের খাবার ঘরের সরঞ্জামগুলোই তারা কিনে নেবে। বাড়িটাতে মেয়েদের শোবার ঘরের সরঞ্জামও দেখেছিল ক্যাথি। সে জর্জকে বলল সেগুলোও কিনে নিতে। অমত করল না জর্জ। পরেরদিন সকালে আবার আলোচনায় বসলো তারা, অবশেষে ঠিক হলো—রোনাল্ড ডিফেওর শোবার ঘরের সমস্ত মালামাল, টিভি দেখার চেয়ার, অতিরিক্ত দুটো খাট… এগুলোও কিনে নেবে তারা।
আসলে এডিথ তাদের জানিয়েছিলেন যে বাড়িটার দাম আসবাবপত্রগুলো ছাড়া আশি হাজার, আসবাবপত্রগুলো কিনতে অতিরিক্ত দাম দিতে হবে।
এডিথের সাথে কথা বলে মাত্র চারশ ডলারে সবকিছু পেয়ে গেল জর্জ। এছাড়া বিনামূল্যে পেল সাতটা সেকেলে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র, দুটো কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, দুটো ড্রায়ার, একটা প্রায় নতুন ফ্রিজ আর একটা ডিপফ্রিজ।
এবার পুরোনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে ওঠার পালা। এর আগেও তো ঝামেলা কম নয়। শুধুমাত্র জিনিসপত্র বেঁধে অন্য বাড়িতে পাঠালেই তো হবে না, আইনি অনেক জটিলতা রয়েছে। নতুন বাড়ির মালিকানা ঠিকমতো বুঝে নিতে হবে। বাড়ি এবং আশেপাশের জমির মালিকানা ছিল রোনাল্ড ডিফেওর মা-বাবার নামে। ডিফেওর বাবা বাড়িটা সন্তানদের নামে উইল করে দিয়েছিলেন। নিজের পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরে ডিফেও পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য হিসেবে এসবের মালিক এখন রোনাল্ড ডিফেও। আদালতে উইলের সত্যতা নতুন করে প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত ওই সম্পত্তি বিক্রি করা সম্ভব না সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পক্ষে। কোম্পানি থেকে লুজদের জানানো হয় যে আদালতে সবকিছুর নিষ্পত্তি হতে হতে খানিকটা সময় লাগবে আবার পুরো সম্পত্তি লুজদের কাছে হস্তান্তরেও বেশ কিছু আইনি জটিলতা আছে।
লুৎজরাও যোগাযোগ করে এক আইনজীবীর সাথে। সেই ভদ্রলোক তাদের জানান এগুলো ব্যাপার আইনের প্রতিটি ধারা মেনে শেষ করতে বেশ খানিকটা সময় লাগে, তবে এমনও কিছু উপায় রয়েছে যা অনুসরণ করলে খুব দ্রুত সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে। তিনি জর্জকে বলেন, বাড়িটার দায়িত্বে থাকা কোম্পানিকে আগাম চল্লিশ হাজার ডলার দিতে, যাতে করে ওই কোম্পানি কাগজে-কলমে এটা দেখাতে পারে যে বাড়িটা তারা লুজদের কাছে বন্ধক রেখেছে। আইনি জটিলতায় বাড়ি বিক্রিতে সমস্যা থাকলেও, বন্ধক রাখতে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। যতদিন বাড়িটার মালিকানা তাদের নামে না আসে ততদিন এভাবেই থাক।
কোম্পানিও এতে রাজি হয়ে যায়। তারা জানতে চায় যে লুৎজরা কবে ওই বাড়িতে উঠতে চাচ্ছে। জর্জ তারিখ বলার পর কোম্পানির তরফ থেকে জানানো হয় যে কাগজে-কলমে বন্ধক বাড়িটা ছাড়িয়ে নেওয়ার শেষ দিন হিসেবে ওই দিনটাই দেখানো হবে। এর আগেই যেন লুজরা বাকি টাকা পরিশোধ করে দেয়। এরপর কোম্পানি আদালতে গিয়ে বলবে যে তারা বন্ধক বাড়িটার কোনো টাকাই পরিশোধ করতে পারেনি, তাই ওটার মালিক লুজরা।
খুশিমনে নিজেদের ডিয়ার পার্কের বাড়িতে ফিরে গেল জর্জ আর ক্যাথি। খুব তাড়াতাড়িই নিজেদের পুরোনো বাড়িটা বিক্রি করে দিলো তারা। এবার সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার পালা। জিনিসপত্রগুলো বেঁধে ফেলার দায়িত্ব পড়ল ক্যাথির ওপর। এই সময়ে বাচ্চারা ভীষণ জ্বালাতন করে। তাই ক্যাথি করল কী, ওদেরকেও কাজে লাগিয়ে দিলো। তিন জন মিলে নিজেদের খেলনাগুলো জড়ো করে বাক্সে পুরলো, এরপর হাত দিলো জামা-কাপড়ে। এরপর ওরা নিজেদের ঘরগুলো পরিষ্কার করে ফেলল, যাতে করে বাড়িতে নতুন যারা আসবে তাদের আর অতিরিক্ত খাটতে না হয়। জর্জ ঠিক করল যে ওর সিয়োসেটের অফিসটা বন্ধ করে নতুন বাড়ির একটা ঘরে অফিস খুলবে। এতে করে অফিসের ভাড়াটাও বেঁচে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা আশি হাজার ডলার খরচ করে বাড়ি কেনার পরিকল্পনা তার ছিল না, কিন্তু ক্যাথি পছন্দ করেছে… তাই কিনে ফেলেছে। এখন খরচ কমাতে হবে। নতুন বাড়িটার বেসমেন্ট বেস ভালো অবস্থায় আছে, ওখানেই নতুন অফিস বানানো যেতে পারে। ওর অফিসের সরঞ্জামগুলো নিয়ে আসা বেশ সময়ের ব্যাপার, তাছাড়া বেসমেন্টটা নতুন করে রংও করাতে হবে। এছাড়া বাড়ির পিছনের ছাউনি আর গ্যারেজটাও ফাঁকা রাখা যাবে না। ছাউনিটা পঁয়তাল্লিশ ফুট লম্বা আর বাইশ ফুট চওড়া, গ্যারেজটাও অনেক বড়ো। জর্জের একটা পঁচিশ ফুট লম্বা কেবিন ক্রুজার বোট আর পনেরো ফুট লম্বা স্পিডবোট ছিল। কাছেরই একটা বন্দরে সেগুলো রাখার জন্য বেশ চড়া ভাড়া গুণতে হতো তাকে। ওগুলো এখানে এনে রাখা যাবে। অনেকগুলো টাকাই বেঁচে যাচ্ছে।
বেশ বড়ো একটা ট্রাক ভাড়া করতে হলো জলযানদুটো আনার জন্য। ক্যাথি শুরুর দিকে খানিকটা বিরক্ত হলেও পরে আর কিছু বলেনি। জর্জের খুবই প্রিয় ওদুটো।
এছাড়াও নতুন বাড়িটাতে আরও অনেক কাজই আছে। অনেকদিন ধরে ফাঁকা আছে ওটা, তাই ময়লা জমেছে। সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। ঘরগুলো রং করতে হবে, সামনের উঠানে নানান ফুলের গাছ লাগানোর পরিকল্পনা জর্জের। শীতকালে তুষারপাতে সেগুলোর যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করতে হবে, ল্যাম্পপোস্টগুলোতে নতুন বাল্ব লাগাতে হবে, মাটিতে চুন দিতে হবে।
জর্জ মাঝে মাঝেই বাড়িটাতে গিয়ে অল্প অল্প করে কাজ এগিয়ে রাখতে লাগল। ধীরে ধীরে বাগানের সব আগাছা পরিষ্কার করে ফেলল সে, ঘরগুলোও মোটামুটি সাফ করে দিলো। বেশ মন দিয়ে ঠিক করল চিমনিটা তারপর হাত দিলো ফায়ারপ্লেসে। সামনে বড়োদিন… ঠান্ডা বেড়েই চলেছে, তাই এগুলো ঠিক করাটা জরুরি। ওদিকে পুরোনো বাড়িতে সবকিছু বাঁধা হয়ে গেছে, শেষ রাতটা মেঝেতেই ঘুমাল লুৎজ পরিবার।
সকালবেলা বড়ো একটা ট্রাকে ধীরে ধীরে মালামাল তুলতে লাগল জর্জ আর ক্যাথি। পুরোনো বাড়িটাও মোটামুটি পরিষ্কার করেই রেখে গেল ওরা।
ওদিকে বাড়ির মালিকানা হস্তান্তরের আইনগত প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছিল। নিজের আইনজীবীকে নিয়ে কোম্পানির অফিসে গেল জর্জ। গম্ভীরমুখে একটা টেবিলে বসেছিল কোম্পানির আইনজীবী, তার পাশে বসে টাইপরাইটিং মেশিনে পাতার পর পাতা টাইপ করে চলেছিল একটা লোক। কোম্পানির আইনজীবী জর্জের আইনজীবীকে এক কোনায় ডেকে নিলেন। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক ফিরে এসে জর্জকে জানালেন, বাকি টাকাটা এখনই না দিতে, কিছুটা জটিলতা নতুন করে দেখা দিয়েছে, ব্যাপারটা আদালতে উঠেছে। প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। জর্জের তো মাথায় হাত! কিন্তু দুপুরের আগেই আদালতের রায় এসে গেল। বাড়ির মালিকানা লুৎজদের কাছে হস্তান্তর করা হলো। আইনজীবী ওকে জানালেন যে খুব তাড়াতাড়িই বাড়ির দলিলপত্র ওকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। খুশিমনে বাকি টাকা মিটিয়ে দিলো জর্জ।
বেলা একটার মধ্যে জর্জদের মালামালবাহী ট্রাকটা পৌঁছে গেল ওশান অ্যাভিনিউতে। জর্জই ওটা চালিয়ে এনেছিল। ওদিকে ডিফেওদের ফ্রিজ, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, ড্রায়ার, ডিপ ফ্রিজ আগে থেকেই সাজানো ছিল। ট্রাকের পিছন পিছন জর্জদের ফ্যামিলি ভ্যানে করে এলো ক্যাথি আর বাচ্চারা, ভ্যানের পিছনে জর্জের মোটর সাইকেলটাও ঢোকানো ছিল। জর্জের পাঁচ জন বন্ধু আগে থেকেই বাড়িটাতে উপস্থিত ছিল। সবাই মোটামুটি জর্জেরই বয়সি। অত মালামাল ভেতরে নেওয়া তো আর সহজ কথা নয়, তাই ওদের ডাকা।
ধীরে ধীরে মালামাল নামানো শুরু হলো। কাঠের বাক্স, খেলনার বাক্স, জামাকাপড়, বাসন-পত্র সবকিছু একে-একে নামানো শুরু হলো। সবকিছু সদর দরজার সামনে জড়ো করে রাখা হলো।
সদর দরজার সামনে গিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা চাবির গোছা বের করল জর্জ। কিন্তু কোনো চাবিতেই দরজাটা খুললো না। এতদিন পিছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল জর্জ, সদর দরজা দিয়ে কখনও ঢোকেনি। কিন্তু পিছনের দরজা দিয়ে তো এত মালামাল ঢোকানো যাবে না। সে ক্যাথিকে জিজ্ঞাসা করল যে ওদেরকে কি আর কোনো চাবি দেওয়া হয়েছিল? ক্যাথি জানাল যে কোম্পানি থেকে এই এক গোছা চাবিই দেওয়া হয়েছে। জর্জের মনে পড়ে গেল যে সামনের দরজার চাবিটা আসলে এডিথের কাছে রয়েছে, প্রথমবার বাড়ি দেখতে আসার দিন উনিই দরজাটা খুলেছিলেন। কাছের একটা ফোনবুথ থেকে সে এডিথকে ফোন করল।
কিছুক্ষণ পর এসে চাবিটা দিয়ে গেলেন এডিথ।
খুলে গেল দরজাটা। সাথে সাথে নিজেদের খেলনার বাক্সগুলো নিয়ে বাড়িতে ঢুকল বাচ্চারা। “দেখো জর্জ,” হেসে উঠল ক্যাথি, “প্যারেড করে ঢুকছে একদল ছোট্ট সেনা।” এরপর মালামাল ঢোকানো শুরু করল জর্জের বন্ধুরা। কোথায় কোন বাক্স থাকবে সেটা ক্যাথি বলে দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর বাচ্চারাও বেরিয়ে এলো, সবার দেখাদেখি ভারী ভারী জিনিসগুলো ধরাধরি করে ভেতরে নিতে লাগল ওরা। ওদের অবস্থা দেখে জর্জ হেসে ফেলল।
সরু সিঁড়ি দিয়ে দুই আর তিন তলাতে জিনিস তুলতে গিয়ে রীতিমতো জান বেরিয়ে গেল জর্জ আর তার বন্ধুদের। বেলা দেড়টার দিকে ‘বাড়ি শুদ্ধীকরণ’ প্রক্রিয়ার জন্য এসে পৌঁছলেন সেক্রেড হার্ট রেক্টরির ফাদার ম্যানকুসো। সেদিনের তারিখ ছিল ১৮ ডিসেম্বর। ভয়ংকর এক সময়ের শুরু…